সূরা কাহফ(মুসা আ ও খিযর আ এর ঘটনা-১ম পর্ব) ৯ম রুকুঃ ( ৬০-৭০ আয়াত)

 

 সূরা কাহফ

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

৯ম রুকুঃ ( ৬০-৭০ আয়াত)-১ম পর্ব

 ঘটনাটি আমাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। এর মধ্যে কয়েকটি হল:

মানুষের জ্ঞান কখনই অনুধাবন করতে পারে না আল্লাহএর উপায় বা বিভিন্ন ঘটনার কারণ যা আল্লাহ ঘটতে দেন

মানুষ সর্বদা অধৈর্য থাকে এবং উপলব্ধিকে অস্বীকার করে এমন সমস্ত ঘটনার অবিলম্বে উত্তর খোঁজে

আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আমাদেরকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তাঁর বিধান মেনে নেওয়া উচিত।

১৮:৬০ وَ اِذۡ قَالَ مُوۡسٰی لِفَتٰىهُ لَاۤ اَبۡرَحُ حَتّٰۤی اَبۡلُغَ مَجۡمَعَ الۡبَحۡرَیۡنِ اَوۡ اَمۡضِیَ حُقُبًا ﴿

৬০. আর স্মরণ করুন, যখন মূসা তার সঙ্গী যুবককে বলেছিলেন, দুঃসাগরের মিলনস্থলে না পৌছে আমি থামব না অথবা আমি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকব।

খিদর বা খাদর একটি লকব যার অর্থ সবুজ।

সূরা কাহফে বর্নিত ৩য় ঘটনাটা (আয়াত নং ৬০-৮২) নবী মুসা (আ) এর সাথে একজন প্রজ্ঞাবান জ্ঞানী ব্যক্তির কথোপকথন নিয়ে। মুসা (আ) নিজের বাহ্যিক জ্ঞান আর দৃষ্টি দিয়েই সবকিছু বিচার করতেন। এবং ভাবতেন তিনি অনেক জ্ঞানী। তাই উনার ভুল ভাঙ্গাতে উনাকে এক জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে আল্লাহ দেখা করতে বলেন। সেই প্রজ্ঞাবান জ্ঞানী ব্যক্তি যাই করেন, মুসা (আ) এর কাছে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাই ভুল মনে হয়। শেষে জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের কাজগুলোর ব্যাখ্যা মুসাকে (আ) বুঝিয়ে বলেন। হতভম্ব মুসা (আ) বুঝতে পারেন বাহ্যিক জ্ঞানের পাশাপাশি অন্তর্জ্ঞান না থাকলে ভ্রান্তি আর সত্যের ফারাক বুঝা যায় না কখনোই।

মুসা আ দুনিয়ার মাঝে জ্ঞানী হওয়ার পরও যখন জানতে পারলেন মহান রবের কাছ থেকে নতুন এক জ্ঞানীর কথা তিি সাথে সাথে নিজেকে সেই জ্ঞানার্জন লাভের জন্য সুপারিশ করেন । সুতরাং মক্কায় ইহুদীরা যখন প্রশ্ন করেছিলো রাসূল সা কে এই ঘটনা দিয়ে তাদের শিক্ষা দেয়া যে তোমাদের নবী মুসা আ যেভাবে সত্যকে গ্রহন করার জন্য নিজকে সপে দিয়েছিলেন তোমরাও শেষ নবীর দাওয়াত গ্রহনে সপে দাও।

এই ঘটনা জ্ঞানের মাধ্যমে অহংকারী হওয়া এবং বিনয়ী হওয়ার পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছে। জ্ঞান যদি ব্যক্তিকে সত্যের দিকে না নিয়ে আসে, রবের কাছে নত না করে তাহলে সেই জ্ঞান কোনই কাজে লাগলো না যেমন ইরশাদ হয়েছে—

যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি, তারা গাধার মত! যে বহু পুস্তক বহন করে। সূরা জুময়াঃ ৫

এই ঘটনার সাথে দাজ্জালের সম্পর্কটা কী? আল্লাহ এর মাধ্যমে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন দাজ্জালের সময়ে মানুষ শুধু বাহ্যিক জ্ঞানকেই অর্থাৎ চর্মচক্ষুর পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক বস্তুবাদী জ্ঞানকেই শুধু মূল্যায়ন করবে, আর অন্তর্চক্ষুর অন্ধত্বের ফলে অন্তর্জ্ঞানহীন হয়ে গিয়ে অন্ধ আর দাজ্জালের মতোই এক চোখা (ম্যাটেরিয়ালিস্টিক) হয়ে যাবে। সত্য মিথ্যা আলাদা করতে পারবে না। তাই অন্তর্জ্ঞান থাকাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সবচাইতে সরাসরি বিশুদ্ধ জ্ঞানের উৎসে (তথা আল-কুরআনে) ফিরে যাওয়া, নিজের ঈমান রক্ষার জন্যে, খাঁটিটা চেনার জন্যে।

এখানে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়—

أَمْضِىَআমি চলতে থাকবোI continue

حُقُبًا যুগ যুগ (দীর্ঘকাল)”(for) a long period”

মুসা আ হলেন প্রথম যিনি জ্ঞানার্জনের জন্য ভ্রমন করেছিলেন যা বুখারী রহ উল্লেখ করেছেন।

জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে যুগ যুগ ধরে পথ চলবেন যা মুসা আ জানিয়েছেন। এই জ্ঞানার্জন আসলেই একটি চলন্ত প্রক্রিয়া যা মৃত্যু অবধি চলতে থাকা দরকার।

আর এই জ্ঞান হলো অহীর জ্ঞান যা দুনিয়ার জীবনের চলার পথকে নির্ধারন করতে পথ দেখায় যা আখেরাতের সফলতার জন্য প্রয়োজন।

আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিবকেও সা. জ্ঞানার্জনের জন্য দোয়া করার আহবান জানিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, “এবং বলুন, হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।” (সূরা ত্বহা : ১১৪)।

একইভাবে আল্লাহ পাক হযরত ইবরাহীম (আ)কেও জ্ঞানার্জনের জন্য দোয়া করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং হযরত ইবরাহিম (আ) এই মর্মে দোয়া করেছিলেন,

رَبِّ هَبۡ لِیۡ حُکۡمًا وَّ اَلۡحِقۡنِیۡ بِالصّٰلِحِیۡنَ

“হে আমার রব, আমাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করুন এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন। (সূরা শুআরা : ৮৩)

রাসূল সা. নিজেই তার প্রিয় সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা রা. এর জন্য দোয়া করেছিলেন যাতে তার স্মৃতিশক্তি বেড়ে যায়। একইসঙ্গে তার আরেক প্রিয় সাহাবি হযরত ইবনে আব্বাসের রা.-এর জন্যও একইভাবে দোয়া করেন যে, ‘হে আল্লাহ! আপনি তাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং কুরআনে কারিমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জ্ঞান দিন।’ আল্লাহ তায়ালা নবীজি সা. এর দুটো দোয়াই কবুল করেছিলেন। নবীজির সা. দোয়ার বরকতেই আবু হুরায়রা রা. অনেক বেশি হাদিস স্মরণে রাখতে পেরেছিলেন। আবু হুরায়রা রা.কে আমরা এখন সর্বোচ্চ সংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি হিসেবেই জানি। অন্যদিকে হযরত ইবনে আব্বাসও রা. উম্মাহর আলেম এবং কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাসসির হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছেন। সুবহানআল্লাহ।

হাদিসের ভাষায় রাসূল (সা:) প্রতি ফজর সালাতের পর প্রার্থনা করতেন এই বলে যে,

اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَرِزْقًا طَيِّبًا وَعَمَلاً مُتَقَبَّلاً

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট উপকারী জ্ঞান, কবুলযোগ্য আমল ও পবিত্র রুজি প্রার্থনা করছি।’ (আহমাদ ইবনে মাজাহ, তাবারানি, মিশকাত হা/২৪৯৮) সুতরাং আমাদের সকলেরই উচিত একমাত্র আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করা।

ইলম অর্জনের মর্যাদা অত্যধিক। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহ যাদেরকে জ্ঞান দান করেছেন তাদেরকে উচ্চমর্যাদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত।’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)। ইলম

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ قَال أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ{رواه الترمذي

আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম (জ্ঞান) অর্জন করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন। (তিরমিযী হা/২৬৪৬; ইখনু মাজাহ হা/২২৩; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৮, সনদ সহিহ।)

আবু উমামা আল-বাহিলি (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সামনে দু’জন লোকের কথা উল্লেখ করা হলো। যাদের একজন আলিম অপরজন আবিদ। তখন তিনি বলেন, আলিমের মর্যাদা আবিদের ওপর। যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণের ওপর। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, নিশ্চয়ই তার প্রতি আল্লাহ রহমত করেন এবং তার ফেরেশতামন্ডলী, আসমান-জমিনের অধিবাসী, পিপীলিকা তার গর্তে থেকে এবং এমনকি মাছও কল্যাণের শিক্ষা দানকারীর জন্য দোয়া করেন। ( তিরমিজি হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, সনদ হাসান।)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللَّهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِى السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِى الأَرْضِ وَالْحِيتَانُ فِى جَوْفِ الْمَاءِ .

‘যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘আলা তা দ্বারা তাকে জান্নাতের কোন একটি পথে পৌঁছে দেন এবং ফেরেশতাগণ ইলম অন্বেষণকরীর ওপর খুশি হয়ে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। এ ছাড়া আলেমদের জন্য আসমান ও জমিনের সকল অধিবাসী আল্লাহর নিকট দোয়া ও প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মধ্যে বসবাসকারী মাছও (তাদের জন্য দোয়া করে)। ( আবুদাউদ হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/২১২; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৭, সনদ সহিহ।)

রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ওপর সর্বপ্রথম প্রত্যাদেশকৃত শব্দ হল, اِقْرَأْ ‘আপনি পড়ুন!। রাসূলুল্লাহ (সা:) তখন বলেছিলেন, أَنَا بِقَارِئٍ

‘আমি পড়তে জানি না’। তখন জিবরিল (আ:) তাকে জাপটে ধরেছিলেন। এই একই দৃশ্য তিনবার হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নিকট সূরা ‘আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে অহির জ্ঞান শিক্ষা দেন। সুতরাং আমাদের সমাজ ও দেশ থেকে অন্যায়, অপকর্ম দূর করতে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। ইলম অর্জনের নির্দেশনাস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,

طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ

‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপরে জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরজ। (ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮, সনদ হাসান।)

দ্বীনি ইলম অর্জনের প্রতি আল্লাহর উৎসাহ প্রদান :

আল্লাহ জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহিত মানুষকে উৎসাহিত করেছেন, কেননা মানুষ ইলম অর্জন করবে, সে অনুযায়ী আমল করবে এবং নিজেদের মাঝে ইলম প্রচার করবে এটাই আল্লাহর দাবি। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

‘সুতরাং এমন কেন হয় না যে, তাদের প্রত্যেকটি বড় দল হতে এক একটি ছোট দল বের হবে, যাতে তারা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আর যাতে তারা নিজ কওমকে ভয় প্রদর্শন করতে পারে যখন তারা ওদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, যেন তারা সতর্ক হয়।’ (সূরা তওবা ৯/১২২)

দ্বীনী জ্ঞান অর্জন দু’ভাগে বিভক্ত। ফরযে আইন ও ফরযে কিফায়া।

ফরযে আইনঃ শরীআত মানুষের উপর যেসব কাজ ফরয বা ওয়াজিব করে দিয়েছে, সেগুলোর হুকুম আহকাম ও মাসআল মাসায়েল সম্পর্কে জ্ঞান হাসিল করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয। যেমন, ইসলামের বিশুদ্ধ আকীদাহসমূহের জ্ঞান, পবিত্রতা ও অপবিত্রতার হুকুম-আহকাম, সালাত, সাওম, যাকাত ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান। ফরযে কেফায়াঃ যেমন, অধিকার আদায় করা, হুদুদ প্রতিষ্ঠা করা, মানুষের মধ্যে বিবাদ নিরসন ইত্যাদি। কেননা, সবার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকে এটা করতে গেলে নিজেদের অবস্থাও খারাপ হবে, অন্যদেরও নিজেদের জীবন-জীবিকা অসম্পূর্ণ হবে বা বাতিল হবে। তাই কাউকে না কাউকে সুনির্দিষ্ট করে এর জন্য থাকতে হবে। আল্লাহ যাকে এর জন্য সহজ করে দেন সে এটা করতে পারে। তিনি প্রতিটি মানুষকে পূর্বেই এমন কিছু যোগ্যতা দিয়েছেন যা অন্যদের দেননি। সে হিসেবে প্রত্যেকে তার জন্য যা সহজ হয় তা-ই বহন করবে। [কুরতুবী; বাগভী]

“মানুষ যেন গুপ্তধন, স্বর্ণ ও রৌপ্যের গুপ্তধনের মত। তাদের মধ্যে যারা জাহেলিয়াতে উত্তম তারা ইসলামেও উত্তম, যদি তারা দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে।” [বুখারী: ৩৪৯৩; মুসলিম: ২৫২৬]

মানুষ অজ্ঞ-মূর্খ হয়ে পৃথিবীতে আসে। আল্লাহ বলেন,

عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

‘আমি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছি, যা সে জানত না।’ (সূরা আলাক ৯৬/৫

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,

إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ

‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমল ব্যতীত। এই তিনটি আমল হলো, প্রবহমান ছাদাকা, এমন ইলম যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন সুসন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম হা/১৬৩১)

এ ঘটনায় মূসা’ নামে প্রসিদ্ধ নবী মূসা ইবনে ইমরান আলাইহিস সালাম-কে বোঝানো হয়েছে। فتى এর শাব্দিক অর্থ যুবক। শব্দটিকে কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে সম্বন্ধ করা হলে অর্থ হয় খাদেম। [ফাতহুল কাদীর] বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, এই খাদেম ছিল ইউশা ইবনে নূন। [ইবন কাসীর] (مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ) এর শাব্দিক অর্থ দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থল। বলাবাহুল্য, এ ধরনের স্থান দুনিয়াতে অসংখ্য আছে। এখানে কোন জায়গা বোঝানো হয়েছে, কুরআন ও হাদীসে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তাই ইঙ্গিত ও লক্ষণাদী দৃষ্টি তাফসীরবিদদের উক্তি বিভিন্নরূপ। [ফাতহুল কাদীর]

কোন নিশ্চিত ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ স্থানকে নির্দিষ্ট করা যায়নি। তবে অনুমান ও লক্ষণাদির দাবী অনুযায়ী এটা হল সিনাই মরুভূমির দক্ষিণ মাথায়, যেখানে উকবাহ উপসাগর ও সুইজ উপসাগর এক সাথে একত্রিত হয়ে লোহিত সাগরে মিশে গেছে।

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ একদিন মূসা ‘আলাইহিস সালাম বনী-ইসরাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলঃ সব মানুষের মধ্যে অধিক জ্ঞানী কে? মূসা আলাইহিস সালাম-এর জানামতে তার চাইতে অধিক জ্ঞানী আর কেউ ছিল না। তাই বললেনঃ আমিই সবার চাইতে অধিক জ্ঞানী। আল্লাহ তা’আলা তাঁর নৈকট্যশীল বান্দাদেরকে বিশেষভাবে গড়ে তোলেন। তাই এ জবাব তিনি পছন্দ করলেন না। এখানে বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াই ছিল আদব। অর্থাৎ একথা বলে দেয়া উচিত ছিল যে, আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন, কে অধিক জ্ঞানী। এ জবাবের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে মূসা আলাইহিস সালাম-কে তিরস্কার করে ওহী নাযিল হল যে, দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আপনার চাইতে অধিক জ্ঞানী। একথা শুনে মূসা ‘আলাইহিস সালাম প্রার্থনা জানালেন যে, তিনি অধিক জ্ঞানী হলে তার কাছ থেকে জ্ঞান লাভের জন্য আমার সফর করা উচিত।

তাই বললেনঃ হে আল্লাহ! আমাকে তার ঠিকানা বলে দিন। আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নিন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের দিকে সফর করুন। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, সেখানেই আমার এই বান্দার সাক্ষাত পাবেন। মূসা ‘আলাইহিস সালাম নির্দেশমত থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তার সাথে তার খাদেম ইউশা ইবনে নূনও ছিল। পথিমধ্যে একটি প্রস্তর খণ্ডের উপর মাথা রেখে তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। এখানে হঠাৎ মাছটি নড়াচড়া করতে লাগল এবং থলে থেকে বের হয়ে সমুদ্রে চলে গেল। (মাছটি জীবিত হয়ে সমুদ্রে যাওয়ার সাথে সাথে আরো একটি মু’জিযা প্রকাশ পেল যে,) মাছটি সমুদ্রের যে পথ দিয়ে চলে গেল, আল্লাহ তা’আলা সে পথে পানির স্রোত বন্ধ করে দিলেন। ফলে সেখানে পানির মধ্যে একটি সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল। ইউশা’ ইবনে নূন এই আশ্চর্যজনক ঘটনা নিরীক্ষণ করছিল।

মূসা আলাইহিস সালাম নিদ্রিত ছিলেন। যখন জাগ্রত হলেন, তখন ইউশা ইবনে নুন মাছের এই আশ্চর্যজনক ঘটনা তার কাছে বলতে ভুলে গেলেন এবং সেখান থেকে সামনে রওয়ানা হয়ে গেলেন। পূর্ণ একদিন একরাত সফর করার পর সকাল বেলায় মূসা ‘আলাইহিস সালাম খাদেমকে বললেনঃ আমাদের নাশ্‌তা আন। এই সফরে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। নাশতা চাওয়ার পর ইউশা ইবনে নুনের মাছের ঘটনা মনে পড়ে গেল। সে ভুলে যাওয়ার ওযর পেশ করে বললঃ শয়তান আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর বললঃ মৃত মাছটি জীবিত হয়ে আশ্চর্যজনকভাবে সমুদ্রে চলে গেছে। তখন মূসা আলাইহিস সালাম বললেনঃ সে স্থানটিই তো আমাদের লক্ষ্য ছিল। ( মাছের জীবিত হয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার স্থানটিই ছিল গন্তব্যস্থল।) সে মতে তৎক্ষণাৎ তারা ফিরে চললেন এবং স্থানটি পাওয়ার জন্য পূর্বের পথ ধরেই চললেন।

প্রস্তরখণ্ডের নিকট পৌছে দেখলেন, এক ব্যক্তি আপাদমস্তক চাদরে আবৃত হয়ে শুয়ে আছে। মূসা আলাইহিস সালাম তদাবস্থায় সালাম করলে খাদির ‘আলাইহিস সালাম বললেনঃ এই (জনমানবহীন) প্রান্তরে সালাম কোথা থেকে এল? মূসা ‘আলাইহিস সালাম বললেনঃ আমি মূসা। খাদির ‘আলাইহিস সালাম প্রশ্ন করলেনঃ বনী-ইসরাঈলের মূসা? তিনি জবাব দিলেনঃ হ্যাঁ, আমিই বনী-ইসরাঈলের মূসা। আমি আপনার কাছ থেকে ঐ বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ তা’আলা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। খাদির বললেনঃ যদি আপনি আমার সাথে থাকতে চান, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে তার স্বরূপ বলে দেই।

একথা বলার পর উভয়ে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে একটি নৌকা এসে গেলে তারা নৌকায় আরোহণের ব্যাপারে কথাবার্তা বললেন। মাঝিরা খাদিরকে চিনে ফেলল এবং কোন রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদেরকে নৌকায় তুলে নিল। নৌকায় চড়েই খাদির কুড়ালের সাহায্যে নৌকার একটি তক্তা তুলে ফেললেন। এতে মূসা আলাইহিস সালাম (স্থির থাকতে না পেরে) বললেনঃ তারা কোন প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিয়েছে। আপনি কি এরই প্রতিদানে তাদের নৌকা ভেঙ্গে দিলেন যাতে সবাই ডুবে যায়? এতে আপনি অতি মন্দ কাজ করলেন। খাদির বললেনঃ আমি পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। তখন মূসা আলাইহিস সালাম ওযর পেশ করে বললেনঃ আমি ওয়াদার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার প্রতি রুষ্ট হবেন না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ঘটনা বর্ণনা করে বললেনঃ মূসা ‘আলাইহিস সালাম-এর প্রথম আপত্তি ভুলক্রমে, দ্বিতীয় আপত্তি শর্ত হিসেবে এবং তৃতীয় আপত্তি ইচ্ছাক্রমে হয়েছিল। (ইতিমধ্যে) একটি পাখি উড়ে এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চ পানি তুলে নিল। খাদির ‘আলাইহিস সালাম মূসা ‘আলাইহিস সালাম-কে বললেনঃ আমার জ্ঞান এবং আপনার জ্ঞান উভয়ের মিলে আল্লাহ তা’আলার জ্ঞানের মোকাবিলায় এমন তুলনাও হয় না, যেমনটি এ পাখির চঞ্চর পানির সাথে রয়েছে সমুদ্রের পানি।

অতঃপর তারা নৌকা থেকে নেমে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। হঠাৎ খাদির একটি বালককে অন্যান্য বালকের সাথে খেলা করতে দেখলেন। খাদির স্বহস্তে বালকটির মস্তক তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। বালকটি মারা গেল। মূসা আলাইহিস সালাম বললেনঃ আপনি একটি নিষ্পাপ প্রাণকে বিনা অপরাধে হত্যা করেছেন। এ যে বিরাট গোনাহর কাজ করলেন। খাদির বললেনঃ আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। মূসা ‘আলাইহিস সালাম দেখলেন, এ ব্যাপারটি পূর্বের চাইতেও গুরুতর। তাই বললেনঃ এরপর যদি কোন প্রশ্ন করি তবে আপনি আমাকে পৃথক করে দেবেন। আমার ওযর-আপত্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে।

অতঃপর আবার চলতে লাগলেন। এক গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলেন। ওরা সোজা অস্বীকার করে দিল। খাদির এই গ্রামে একটি প্রাচীরকে পতনোন্মুখ দেখতে পেলেন। তিনি নিজ হাতে প্রাচীরটি সোজা করে দিলেন। মূসা আলাইহিস সালাম বিস্মিত হয়ে বললেনঃ আমরা তাদের কাছে খাবার চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করলো। অথচ আপনি তাদের এত বড় কাজ করে দিলেন; ইচ্ছা করলে এর পারিশ্রমিক তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। খাদির বললেনঃ (هَٰذَا فِرَاقُ بَيْنِي وَبَيْنِكَ) অর্থাৎ এখন শর্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। এটাই আমার ও আপনার মধ্যে বিচ্ছেদের সময়।

এরপর খাদির উপরোক্ত ঘটনাত্ৰয়ের স্বরূপ মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে বর্ণনা করে বললেনঃ (ذَٰلِكَ تَأْوِيلُ مَا لَمْ تَسْطِعْ عَلَيْهِ صَبْرًا) অর্থাৎ এ হচ্ছে সেসব ঘটনার স্বরূপ; যেগুলো আপনি দেখে ধৈর্য ধরতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে বললেনঃ মূসা আলাইহিস সালাম যদি আরো কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেন, তবে আরো কিছু জানা যেত ৷ [বুখারীঃ ১২২, মুসলিমঃ ২৩৮০]

এই দীর্ঘ হাদীসে পরিস্কার উল্লেখ রয়েছে যে, মূসা বলতে বনী-ইসরাঈলের নবী মূসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার যুবক সঙ্গীর নাম ইউশা ইবন নুন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে যে বান্দার কাছে মূসা আলাইহিস সালাম-কে প্রেরণ করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন খাদির ‘আলাইহিস সালাম। [ফাতহুল কাদীর]

খিদর কে ছিলেন?

খিদর বা খাদর একটি লকব যার অর্থ সবুজ।

সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রা. সূত্রে বর্ণিত হয়েছে :

খিযিরকে এই নামে অভিহিত করার কারণ হল, একদা তিনি ঘাস-পাতা বিহীন শুষ্ক সাদা জায়গায় বসেছিলেন। সেখান থেকে তাঁর উঠে যাওয়ার পরই হঠাৎ ঐ স্থানটি সবুজ (খিজির) হয়ে গেল। আরবিতে আল খাদির অর্থ সবুজ; বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে তাঁর নাম খিজির হয়েছে (এ ঘটনা থেকেই তাঁর নাম খিযির হয়ে যায়)। ইমাম বুখারী: সহীহ বুখারী; হাদিস নং- ৩১৬৩।

খিদর কি ফেরেশতা, রসূল, নবী নাকি আ ওয়ালী (“সাধু”)। শেখ মুহাম্মদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (islamqa.info) এটিকে নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন: “এর সাধারণ অর্থ থেকে কুরআনিক আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে তিনি একজন নবী ছিলেন।”

শায়খ আল-শানকিতি (রহঃ) আয়াতটির (অর্থের ব্যাখ্যায়) তার তাফসীরে বলেছেন:“অতঃপর তারা আমাদের একজন বান্দাকে পেল, যার উপর আমরা ছিলাম করুণা দান করেছেন আমাদের পক্ষ থেকে এবং যাকে আমরা আমাদের কাছ থেকে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলাম” (সূরা আল কাহফ 18:65)

“কিন্তু কিছু আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, এখানে যে রহমতের কথা বলা হয়েছে তা ছিল নবুওয়াতের রহমত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা এই জ্ঞান ছিল ওহীর জ্ঞান (ওহে) এক ইঙ্গিত যে রহমত ও জ্ঞান যার সাথে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে বরকত দিয়েছেন আল-খিদর নবী হুডের মাধ্যমে এসেছিল এবং আয়াতটি হল:

আল্লাহ খিদরকে হযরত মূসা (আঃ)-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন

“এবং আমি সেগুলি নিজের ইচ্ছায় করিনি” (সূরা আল কাহফ 18:82)

অর্থাৎ, বরং আমি আল্লাহর নির্দেশে এগুলো করেছি এবং আল্লাহর হুকুম কেবল মাধ্যমেই পৌঁছে দেওয়া হয় ওহে (প্রত্যাদেশ), কারণ আল্লাহর নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞাগুলি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে জানার কোনো উপায় নেই, বিশেষ করে যখন তিনি পূর্বে বর্ণিত আমলের কথা আসে। আল্লাহ বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা):

১৮:৬১ فَلَمَّا بَلَغَا مَجۡمَعَ بَیۡنِهِمَا نَسِیَا حُوۡتَهُمَا فَاتَّخَذَ سَبِیۡلَهٗ فِی الۡبَحۡرِ سَرَبًا

৬১. অতঃপর তারা উভয়ে যখন দু’সাগরের মিলনস্থলে পৌঁছল তারা নিজেদের মাছের কথা ভুলে গেল; ফলে সেটা সুড়ঙ্গের মত নিজের পথ করে সাগরে নেমে গেল।

মাছের সমুদ্রে চলে যাওয়ার কথাটি প্রথমবার سَرَبًا শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এর অর্থ সুড়ঙ্গ। পাহাড়ে রাস্তা তৈরী করার জন্য অথবা শহরে ভূগর্ভস্থ পথ তৈরী করার উদ্দেশ্যে সুড়ঙ্গ খনন করা হয়। এ থেকে জানা গেল যে, মাছটি সমুদ্রের যেদিকে যেত, সেদিকে একটি সুড়ঙ্গের মত পথ তৈরী হয়ে যেত। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] উপরোক্ত হাদীস থেকে তা-ই জানা যায়। দ্বিতীয় বার যখন ইউশা ইবন নূন দীর্ঘ সফরের পর এ ঘটনাটি উল্লেখ করেন, তখন (وَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ عَجَبًا) শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে عَجَبًا শব্দের অর্থ: আশ্চর্যজনকভাবে। উভয় বর্ণনার মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। কেননা, পানিতে সুড়ঙ্গ তৈরী হওয়া স্বয়ং একটি অভ্যাসবিরুদ্ধ আশ্চর্য ঘটনা। [ফাতহুল কাদীর]

১৮:৬২ فَلَمَّا جَاوَزَا قَالَ لِفَتٰىهُ اٰتِنَا غَدَآءَنَا ۫ لَقَدۡ لَقِیۡنَا مِنۡ سَفَرِنَا هٰذَا نَصَبًا

৬২. অতঃপর যখন তারা আরো অগ্রসর হল মূসা তার সঙ্গীকে বললেন, আমাদের দুপুরের খাবার আন, আমরা তো এ সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

১৮:৬৩ قَالَ اَرَءَیۡتَ اِذۡ اَوَیۡنَاۤ اِلَی الصَّخۡرَۃِ فَاِنِّیۡ نَسِیۡتُ الۡحُوۡتَ ۫ وَ مَاۤ اَنۡسٰنِیۡهُ اِلَّا الشَّیۡطٰنُ اَنۡ اَذۡکُرَهٗ ۚ وَ اتَّخَذَ سَبِیۡلَهٗ فِی الۡبَحۡرِ ٭ۖ عَجَبًا

৬৩. সে বলল, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যে, আমরা যখন শিলাখণ্ডে বিশ্রাম করছিলাম তখন মাছের যা ঘটেছিল আমি তা আপনাকে জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম শয়তানই সেটার কথা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল; আর মাছটি আশ্চর্যজনকভাবে নিজের পথ করে সাগরে নেমে গেল।

অর্থাৎ, মাছটি জীবিত হয়ে সমুদ্রের মধ্যে চলে যায় এবং তার জন্য মহান আল্লাহ সমুদ্রে সুড়ঙ্গের মত পথ বানিয়ে দেন। ইউশা’ (আঃ) মাছটিকে সমুদ্রে যেতে এবং পথ সৃষ্টি হতে দেখেছিলেন, কিন্তু মূসা (আঃ)-কে এ কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। এমন কি সেখানে বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরু করে দিয়েছিলেন। এই দিন এবং দিনের পরে রাত সফর করে যখন দ্বিতীয় দিনে মূসা (আঃ) ক্লান্তি ও ক্ষুধা অনুভব করলেন, তখন তিনি তাঁর যুবক সাথীকে বললেন, চল খাবার খেয়ে নিই। তিনি বললেন, যেখানে পাথরে হেলান দিয়ে আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম, মাছটি সেখানে জীবিত হয়ে সমুদ্রে চলে গেছে এবং সেখানে বিস্ময়করভাবে সে তাঁর পথ বানিয়ে নিয়েছে। আর এ কথা আপনাকে বলতে আমি ভুলে গেছি। আসলে শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে।

১৮:৬৪ قَالَ ذٰلِکَ مَا کُنَّا نَبۡغِ ٭ۖ فَارۡتَدَّا عَلٰۤی اٰثَارِهِمَا قَصَصًا

৬৪. মূসা বললেন, আমরা তো সে স্থানটিরই অনুসন্ধান করছিলাম তারপর তারা নিজেদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চলল। এরপর তারা সাক্ষাত পেল আমাদের।

আমাদের গন্তব্যের এ নিশানীটিই তো আমাকে বলা হয়েছিল। এ থেকে স্বতঃস্ফৰ্তভাবে এ ইংগিতই পাওয়া যায় যে, আল্লাহর ইংগিতেই মূসা আলাইহিস সালাম এ সফর করছিলেন। তার গন্তব্য স্থলের চিহ্ন হিসেবে তাকে বলে দেয়া হয়েছিল যে, যেখানে তাদের খাওয়ার জন্য নিয়ে আসা মাছটি অদৃশ্য হয়ে যাবে সেখানে তারা আল্লাহর সেই বান্দার দেখা পাবেন, যার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য তাকে পাঠানো হয়েছিল। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]

নিজেদের পায়ের চিহ্নকে অনুসরণ করে সেদিকেই প্রত্যাবর্তন করলেন, যেদিক থেকে এসেছিলেন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে ফিরে গেলেন। قَصَصًا এর অর্থ, পিছনে পড়া, পিছে পিছে চলা। অর্থাৎ, পায়ের চিহ্নকে অনুসরণ করে তার পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় তা হলো একজন মালিক তার খাদেমের সাথে কি রকম আচরন করেছেন,খাদেম ভুলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেও মুসা আ এর কথা বলার ধরন কত সুন্দর ছিলো। খাদেমকে দোষারোপ না করে ফিরে চললেন গন্তব্যে।

১৮:৬৫ فَوَجَدَا عَبۡدًا مِّنۡ عِبَادِنَاۤ اٰتَیۡنٰهُ رَحۡمَۃً مِّنۡ عِنۡدِنَا وَ عَلَّمۡنٰهُ مِنۡ لَّدُنَّا عِلۡمًا

৬৫. এরপর তারা সাক্ষাৎ পেল আমাদের বান্দাদের মধ্যে একজনের, যাকে আমরা আমাদের কাছ থেকে অনুগ্রহ দান করেছিলাম ও আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান।

এই দাস বা বান্দা হলেন খাযির। বহু সহীহ হাদীসে সুস্পষ্টভাবে এটা বর্ণিত হয়েছে। ‘খাযির’-এর অর্থ সবুজ-শ্যামল। তিনি একদা সাদা যমীনের উপর বসলে, যমীনের সেই অংশটুকু তাঁর নীচে দিয়ে সবুজ হয়ে উঠে। এই কারণেই তাঁর নাম হয়ে যায় ‘খাযির’। (বুখারীঃ সূরা কাহ্ফের তাফসীর)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নামকরণের কারণ প্রসঙ্গে বলেন যে, তিনি যেখানে বসতেন, সেখানেই ঘাস উৎপন্ন হয়ে যেত, মাটি যেরূপই হোক না কেন। [বুখারীঃ ৩৪০২] খাদির কি নবী ছিলেন, না ওলী ছিলেন, এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে গ্রহণযোগ্য আলেমদের মতে, খাদির ‘আলাইহিস সালামও একজন নবী। [ইবন কাসীর]

رَحْمَةٌ এর অর্থ কোন কোন মুফাসসির নিয়েছেন বিশেষ অনুগ্রহ যা আল্লাহ তাঁর এই বিশিষ্ট বান্দাকে প্রদান করেছিলেন। তবে অধিকাংশ মুফাস্সির এর অর্থ নিয়েছেন নবুঅত।

এটা মূসা (আঃ)-এর কাছে যে জ্ঞান ছিল সেই নবুঅত ছাড়াও এমন সৃষ্টিগত বিষয়ের এমন জ্ঞান, যে জ্ঞান দানে মহান আল্লাহ কেবল খাযিরকেই ধন্য করেছিলেন এবং মূসা (আঃ)-এর কাছেও এ জ্ঞান ছিল না। এটাকেই দলীল হিসাবে গ্রহণ করে কোন কোন সুফিপন্থীরা দাবী করে যে, আল্লাহ তাআলা নবী নন এমন কোন কোন লোককে, ‘ইলমে লাদুন্নী’ (বিশেষ আধ্যাত্মিক জ্ঞান) দানে ধন্য করেন। আর এ জ্ঞান কোন শিক্ষক ছাড়াই কেবল আল্লাহর অপার দয়া ও করুণায় লব্ধ হয় এবং এই ‘বাতেনী ইলম’ (গুপ্ত জ্ঞান) শরীয়তের বাহ্যিক জ্ঞান — যা কুরআন ও হাদীস আকারে বিদ্যমান তা — থেকে ভিন্ন হয়, বরং কখনো কখনো তার বিপরীত ও বিরোধীও হয়। কিন্তু এ দলীল এই জন্য সঠিক নয় যে, তাঁকে যে কিছু বিশেষ জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল, সে কথা মহান আল্লাহ নিজেই পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। অথচ অন্য কারো জন্য এ ধরনের কথা বলা হয়নি। যদি এটাকে ব্যাপক করে দেওয়া হয়, তবে প্রত্যেক যাদুকর-ভেল্কিবাজ এই ধরনের দাবী করতে পারে। তাই তো সুফিবাদীদের মাঝে এই দাবী ব্যাপকহারে বিদ্যমান। তবে এই ধরনের দাবীর কোনই মূল্য নেই।

এখানে  মহান আল্লাহ মূসা আ কে যার কাছে জ্ঞান আহরনের জন্য বলেছিলেন সেই জ্ঞানী ব্যক্তির পরিচয় দিতে যেয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন আমাদের বান্দাদের মাঝে একজন বান্দা বা দাস, তাহলে একজন শিক্ষকের চারিত্রিক গুনের মাঝে অন্যতম একটি হলো আল্লাহর বান্দা হওয়া অর্থাৎ ঈমানের অধিকারী হওয়া। আরো পরিচয় দেয়া হয়েছে সেটা হলো মহান আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ করেছে এবং রবের কাছ থেকে জ্ঞান দিয়েছেন যা ছিলো বিশেষ জ্ঞান-এখান থেকে  আলেমদের বক্তব্য আসে যে এই অবস্থা সাধারনত কোন নবী রাসূলদের বেলায় হয়ে থাকে, হাদীসের আলোকে আমরা এই জ্ঞানী ব্যক্তির নাম যা ছিল লকব, জানা যায় খিদির বা খিজির বা খাদির।

এখান থেকে একজন শিক্ষকের কাছে জ্ঞান থাকতে হবে আল্লাহর দেয়া জ্ঞান।

১৮:৬৬ قَالَ لَهٗ مُوۡسٰی هَلۡ اَتَّبِعُکَ عَلٰۤی اَنۡ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمۡتَ رُشۡدًا

৬৬. মূসা তাকে বললেন, যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে তা থেকে আমাকে শিক্ষা দেবেন, যা দ্বারা আমি সঠিক পথ পাব, এ শর্তে আমি আপনার অনুসরণ করব কি

এখানে মূসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহর নবী ও শীর্ষস্থানীয় রাসূল হওয়া সত্বেও খাদির ‘আলাইহিস সালাম-এর কাছে সবিনয় প্রার্থনা করেছিলেন যে, আমি আপনার জ্ঞান শিক্ষা করার জন্য আপনার সাহচর্য কামনা করি। এ থেকে বোঝা গেল যে, ছাত্রকে অবশ্যই উস্তাদের সাথে আদব রক্ষা করতে হবে। [ইবন কাসীর]

এখান থেকে শিক্ষার ক্রাইটেরিয়া জানা যায়। অর্থাৎ যা মহান আল্লাহ দান করেছেন সেখান থেকে জ্ঞান শিক্ষা করতে হবে এবং সেটা সঠিক পথের রুপরেখা দিবে। এই শর্তেই তিনি(মুসা আ) জ্ঞানার্জনের অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।

১৮:৬৭ قَالَ اِنَّکَ لَنۡ تَسۡتَطِیۡعَ مَعِیَ صَبۡرًا

৬৭. সে বলল, আপনি কিছুতেই আমার সংগে ধৈর্য ধারণ করে থাকতে পারবেন না,

১৮:৬৮ وَ کَیۡفَ تَصۡبِرُ عَلٰی مَا لَمۡ تُحِطۡ بِهٖ خُبۡرًا

৬৮. যে বিষয় আপনার জ্ঞানায়ত্ত নয় সে বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করবেন কেমন করে?

খাদির ‘আলাইহিস সালাম মূসা (আলাইহিস সালাম-কে বললেনঃ আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। আসল তথ্য যখন আপনার জানা নেই, তখন ধৈর্য ধরবেনই বা কেমন করে? উদ্দেশ্য এই যে, আমি যে জ্ঞান লাভ করেছি, তা আপনার জ্ঞান থেকে ভিন্ন ধরণের। তাই আমার কাজকর্ম আপনার কাছে আপত্তিকর ঠেকবে। আসল তথ্য আপনাকে না বলা পর্যন্ত আপনি নিজের কর্তব্যের খাতিরে আপত্তি করবেন। [ইবন কাসীর]

১৮:৬৯ قَالَ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰهُ صَابِرًا وَّ لَاۤ اَعۡصِیۡ لَکَ اَمۡرًا

৬৯. মূসা বললেন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আপনার কোন আদেশ আমি অমান্য করব না।

১৮:৭০ قَالَ فَاِنِ اتَّبَعۡتَنِیۡ فَلَا تَسۡـَٔلۡنِیۡ عَنۡ شَیۡءٍ حَتّٰۤی اُحۡدِثَ لَکَ مِنۡهُ ذِکۡرًا

৭০. সে বলল, আচ্ছা, আপনি যদি আমার অনুসরণ করবেনই তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যতক্ষণ না। আমি সে বিষয়ে আপনাকে কিছু বলি।

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যাঁর অসীম অনুগ্রহে আমরা সূরা কাহফে আলোচিত চারটি ঘটনার মধ্যে প্রথম দুটির শিক্ষা আলোচনা করতে পেরেছি। এই পর্বে আমরা তৃতীয় ঘটনাটি এবং সম্ভবত সর্বাপেক্ষা জনশ্রুত ঘটনা অর্থাৎ মূসা (আ) এবং খিদর (আ) এর যাত্রাপথের ঘটনাটির মাঝে নিহিত শিক্ষা আলোচনা করবো। এই ঘটনাটি সূরা কাহফের ৬০-৮২ আয়াতে আলোচিত হয়েছে। এই ঘটনার মূলকথা হলো- “জ্ঞানের পরীক্ষা”। এই ঘটনা উল্লেখ করার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে আরও শেখাতে চান-

(১) জ্ঞানার্জন ও ‘আলিমদের সান্নিধ্যের জন্য দূর-দূরান্তে সফরের গুরুত্বঃ

সহীহ বুখারীতে উল্লেখ আছে- মূসা (আ) একদিন বনী ইসরাঈলের মাঝে ওয়াজ-নসীহত করলেন। এতে উপস্থিত লোকদের চক্ষু আর্দ্র হলো এবং অন্তর আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়ে গেলো। তখন একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “দুনিয়ায় আপনার চেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি আর কেউ আছেন কি?” জবাবে মূসা (আ) বললেন, “না।” এমন উত্তরে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর কাছে ওয়াহী পাঠালেন এই মর্মে যে- “দুই সমুদ্রের মিলনস্থলে আমার এক বান্দা আছে যার নাম খাদির (অবশ্য তিনি খিদর নামেই অধিক পরিচিত), সে তোমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী।” মূসা (আ) আল্লাহকে বললেন, “আপনি আমাকে এমন একটা নিদর্শন দিন যেন আমি সেই স্থান চিনতে পারি।” তখন আল্লাহ বললেন, “বড় বাক্সে একটি মৃত মাছ নাও। যে স্থানে মাছটি জীবিত হয়ে হারিয়ে যাবে সেটাই হচ্ছে তোমার কাঙ্খিত স্থান।” এরপর মূসা (আ) তাঁর যুবক ভৃত্যকে নিয়ে [যাঁর নাম ইউশা ইবনে নূন] আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী যাত্রা শুরু করেনর

মূসা (আ) আল্লাহর নবী ও রাসূল ছিলেন, তাঁর কাছে ওয়াহী আসতো। কিন্তু তবুও আল্লাহ তাঁকে জ্ঞানার্জনের জন্য সফরের নির্দেশ দিলেন। এই ঘটনা থেকে জ্ঞানার্জনের জন্য, বিশেষত দ্বীনি জ্ঞানার্জনের জন্য সফরের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। এছাড়াও মহান ধার্মিক ব্যক্তিত্ব ও ‘আলিমগণের সাহচর্যে থাকার গুরুত্বও এখানে অনুমেয়, যদিও তার জন্য দীর্ঘ সফরের প্রয়োজন হয়।

(২) অধীনস্থ লোকদের সাথে উত্তম আচরণ করাঃ

মহান আল্লাহ বলেন-

“(স্মরণ করো) যখন মূসা তার যুবককে বলেছিল…” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৬০]

এখানে মূসা (আ) এর ভৃত্যকে আল্লাহ ভৃত্য বলে সম্বোন্ধন না করে “তার যুবক” বলে সম্বোন্ধন করে আমাদেরকে শিখিয়েছেন অধীনস্থ লোকদের সম্মান করতে, ভালোবাসতে, তাদের তাচ্ছিল্যমূলক নামে না ডেকে তাদেরকে আমাদেরই ভাই গণ্য করতে।

এছাড়াও ইউশা ইবনে নূন যখন মূসা (আ) কে জানালেন যে, মাছটি যখন জীবিত হয়ে সমুদ্রে চলে গেছিল তখন তিনি সেটা তাঁকে জানাতে ভুলে গেছিলেন তখন মূসা (আ) এজন্য তাঁকে কোনরূপ দোষারোপ কিংবা রাগারাগি করেননি। অধীনস্থ লোকদের সাথে এহেন সদাচরণের গুরুত্ব ও নির্দেশ অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

(৩)সফরে খাদ্যদ্রব্য এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্র সাথে নেওয়া উত্তমঃ

মহান আল্লাহ বলেন-

“যখন তারা সেই স্থান অতিক্রম করে গেলো তখন মূসা তার সাথের যুবককে বললো, ‘আমাদের খাদ্য নিয়ে আসো। আমরা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৬২]

এই আয়াত থেকে আল-কুরতুবি (রহিমাহুল্লাহ) একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা উদঘাটন করেছেন আর তা হলো- ‘সফরে খাদ্যদ্রব্য এবং ব্যবহার্য জিনিষপত্র সাথে নেওয়া’। কিছু সুফি সাধকদের দেখা যায় কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই দীর্ঘ সফরে বের হয় এবং দাবী করে এটাই আল্লাহর উপর ভরসার নমুনা। তাদের এই দাবী মিথ্যা। কারণ, আল্লাহর নবী এবং রাসূল হওয়ার পরেও মূসা (আ) খাদ্যদ্রব্য এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্র সাথে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন আর নবী-রাসূলদের চেয়ে অধিক আল্লাহর উপর ভরসাকারী আর কে হতে পারে?

(৪) সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ (যিকর) করাঃ

আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হওয়াই পাপের অন্যতম একটি কারণ। এজন্য সদাসর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। আল্লাহর স্মরণ না থাকলে শয়তান বান্দাকে অনেক ভালো কাজ থেকে গাফেল করে দেয়। আমাদের উচিত সমস্ত ভালো কাজের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং মন্দ কাজের দায়ভার শয়তানের উপর আরোপ করা। এই শিক্ষা আমরা পাই ইউশা ইবনে নূন এর এই কথাটি থেকে-

“…একমাত্র শয়তানই আমাকে তা (আপনাকে) জানানোর কথাটি ভুলিয়ে দিয়েছে…” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৬৩]

(৫) দ্বীনের জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী ছাত্রদেরকে তাদের শিক্ষকদের সাথে বিনয়ী, শ্রদ্ধাশীল ও দয়ালু হতে হবেঃ

মূসা (আ) ছিলেন একজন বিশেষ নবী ও রাসূল। মর্যাদায় তিনি খিদর এর চাইতে উপরে ছিলেন। কিন্তু তবুও অজানা জ্ঞান অর্জনের জন্য খিদর (আ) কে তিনি বিনয় ও শ্রদ্ধার সাথে অনুরোধ করেন তাঁকে সফরসঙ্গী করার জন্য। মূসা (আ) বলেন-

“মূসা তাঁকে বললেনঃ আমি কি এ শর্তে আপনার অনুসরণ করতে পারি যে, সত্যপথের যে জ্ঞান আপনাকে শেখানো হয়েছে, তা থেকে আমাকে কিছু শিক্ষা দেবেন?” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৬৬]

(৬) দ্বীনের জ্ঞানার্জন ‘সবর’ অর্জনের পূর্বশর্তঃ

মূসা (আ) এর অনুরোধের প্রেক্ষিতে খিদর বলেন-

“তিনি বললেনঃ ‘আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। যে বিষয় বোঝা আপনার আয়ত্তাধীন নয়, সে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করবেন কেমন করে?’ ” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৬৭-৬৮]

খিদরের এই কথায় বোঝা যায়, কোনো বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করতে হলে সে বিষয় সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ও ধারণা অর্জন করা দরকার। দ্বীনের পথে চলার ক্ষেত্রেও এই কথাটি সত্য। দ্বীনের পথে চলতে বহু বাধা-বিঘ্ন আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দ্বীনের জ্ঞান যে ব্যক্তির মধ্যে থাকবে এসব বাধা-বিঘ্ন কিছুই তাকে এ জ্ঞানার্জন ও দ্বীন পালন থেকে সরিয়ে দিতে পারবে না।

(৭) জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি বর্জনীয়ঃ দুনিয়াবি এবং দ্বীনি কোনো প্রকার জ্ঞানই ধীরস্থিরতা এবং সবর ছাড়া অর্জন করা যায় না। তড়িঘড়ি শুধুমাত্র একজন ছাত্রের জ্ঞানার্জনের জন্য বাধাই নয়, এর কারণে অনেক ছাত্র জ্ঞানার্জনের পথ থেকে ঝরেও পড়ে। দ্বীনের জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই কথাটি আরও সত্য। দ্বীনের জ্ঞানার্জন কোন শর্টকোর্স নয়, এর জন্য প্রয়োজন সুদীর্ঘ অধ্যবসায় আর লেগে থাকার মানসিকতা। এছাড়াও একজন ছাত্রের উচিত নয় যেকোনো বিষয়ে পাঠদান সম্পন্ন হওয়ার আগেই শিক্ষককে তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করা। সম্পূর্ণ বিষয়টি শিক্ষকের কাছ থেকে বুঝে নেওয়ার পর শিক্ষকের অনুমতিক্রমে প্রশ্ন করাই আদর্শ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য। খিদর এর দ্বারা কৃত আপাত দৃষ্টিতে ‘হারাম’ (বাস্তবে সেগুলোর পেছনে ছিল হিকমাহ, যা আল্লাহ ওয়াহীর মাধ্যমে খিদরকে জানিয়েছিলেন) কাজগুলোকে মূসা (আ) প্রশ্নবিদ্ধ করলে খিদর এই শিক্ষাটি মূসা (আ)কে দিয়েছিলেন এই বলে-

“তিনি বললেনঃ যদি আপনি আমার অনুসরণ করেনই তবে কোনো বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজেই সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি।” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৭০]

(৮) ভুলভ্রান্তির জন্য শিক্ষকের কাছে নিঃসংকোচে ক্ষমা চাইতে হবেঃ

জ্ঞানার্জনের পথে একজন ছাত্রের ভুলভ্রান্তি হতেই পারে, কিন্তু শিক্ষক সংশোধন করে দেওয়ার সাথে সাথে সেই ভুল নিঃসংকোচে স্বীকার করে নিয়ে নিজেকে সংশোধন করাই আদর্শ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য। ঠিক এই গুণটাই দেখা যায় মূসা (আ) এর ভেতর যখন তিনি খিদরকে বলেছিলেন-

“মূসা বললেনঃ আমাকে আমার ভুলের জন্যে অপরাধী করবেন না এবং আমার কাজে আমার উপর কঠোরতা আরোপ করবেন না।” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৭৩]

এছাড়াও মূসা (আ) বলেছিলেন-

“…আমি এরপর আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে আমাকে আপনার সাথে রাখবেন না। আপনি ইতিমধ্যেই আমার কাছে যথেষ্ট অজুহাত শুনেছেন।” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৭৬]

(৯) বিপদের সময় ধৈর্যধারণ মু’মিনের বৈশিষ্ট্যঃ

আমাদের উপর আপতিত প্রতিটি দুর্যোগের পেছনে রয়েছে আল্লাহর নির্ধারিত কল্যাণ। কখনও কখনও হয়ত আমরা এই কল্যাণ নাও বুঝতে পারি কিন্তু আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে যে, দুনিয়া অথবা আখিরাতে এই আপাত অকল্যাণের পেছনের কল্যাণ আমাদেরকে আল্লাহ দান করবেন। এজন্য দুর্যোগের সময় হা-হুতাশ না করে বরং আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহর প্রশংসাজ্ঞাপন করতে হবে।

আলোচ্য ঘটনায় দেখা যায়, খিদর লোকভর্তি একটি নৌকা ফুটো করে দিয়েছিলো। এই ঘটনার পেছনের কল্যাণ তারা দুনিয়াতেই টের পেয়েছিলো আর তা হলো অত্যাচারী রাজা তাদের নৌকাটি দখল করতে পারেনি। আবার একটি ছোট্ট বাচ্চাকে খিদর হত্যা করেছিলো কারণ ওয়াহীর মাধ্যমে সে জানতে পেরেছিলো যে এই বাচ্চাটি বড় হলে তার বাবা-মাকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে নিবে। বালকটিকে হত্যার কারণ তার বাবা-মা ইহকালে জানতে পারেনি তবে পরকালে আল্লাহ তাদেরকে জানিয়ে দিবেন এবং তখন তারা এর হিকমাহ বুঝতে পারবেন। এই দুটি ঘটনা আমাদেরকে শেখায় আপাত অকল্যাণের পেছনের কারণ ও কল্যাণ আমরা হয় দুনিয়ায় অথবা আখিরাতে অবশ্যই জানতে পারবো ইনশাআল্লাহ। এই বিশ্বাসই একজন মুমিনকে দুনিয়ায় সকল পরিস্থিতিতে শক্ত থাকার প্রেরণা যোগায়।

(১০) কিছু ফিক্বহী বিধান উদ্ভাবনঃ

এই ঘটনাটি থেকে ‘আলিমগণ কয়েকটি ফিক্বহী বিষয় উদ্ভাবন করেছেন। সেগুলো হলো-

“দুটি মন্দের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অল্প মন্দকে বেছে নেওয়া”-এটি ফিক্বহশাস্ত্রের একটি মূলনীতি। (রাজা কর্তৃক নৌকা দখল হওয়ার চাইতে নৌকা ফুটো হয়ে যাওয়া ছিল অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর)।

“সামান্য অংশকে ক্ষতিগ্রস্থ করার মাধ্যমে বাকি অংশকে রক্ষা করা”-এটিও ফিক্বহশাস্ত্রের একটি মূলনীতি। শরীরের একটি অংশ থেকে চামড়া তুলে নিয়ে অপর স্থানে প্রতিস্থাপন করার চিকিৎসায় ডাক্তারগণ এই মূলনীতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেন। ফকীহগণ এখান থেকে অভিমত দিয়েছেন যে, ইসলামিক ট্রাস্টের কোন অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে এর কিছু অংশ বিক্রি করে সেটির ক্ষতিপূরণ করা যেতে পারে।

(১১) নিয়্যাত প্রকাশের বৈধতাঃ

মূসা (আ) বলেছিলেন-

“যখন মূসা তার যুবক সঙ্গীকে বলেছিলেন- ‘দুই সমুদ্রের মিলনস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত আমি থামবো না অথবা আমি আরও দীর্ঘ সময় চলতে থাকবো।’” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৬০]

এখান থেকে বোঝা যায়, ভালো কাজের নিয়্যাত প্রকাশ করলে যদি তা অন্যকে সেই ভালো কাজের প্রতি উৎসাহী করে তবে নিয়্যাত প্রকাশ করা বৈধ এবং তা অহংকার নয়। কিছু ক্ষেত্রে নিয়্যাত প্রকাশ করা বরং উত্তম।

(১২) আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ছাড়া খিদর গায়েবের অন্য কিছুই জানতেন নাঃ

সহীহ বুখারী এবং মুসলিমের হাদীসে রয়েছে- মূসা (আ) এবং তাঁর ভৃত্য তাঁদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চললেন সেই স্থানের সন্ধানে যেখানে মাছটি হারিয়ে গেছিলো। সেখানে পৌঁছে মূসা (আ) দেখেন সমুদ্রের মাঝখানে একটি সবুজ গালিচায় খিদর অবস্থান করছেন। মূসা (আ) এবং খিদর এর মধ্যে সালাম বিনিময়ের পর কথাবার্তার এক পর্যায়ে খিদর মূসা (আ)কে প্রশ্ন করেন-‘আপনি কি বনী ইসরাইলের মূসা?’ তখন মূসা (আ) উত্তর দেন-‘হ্যাঁ।’ এ থেকে বোঝা যায়, নৌকা ফুটো করা, বালকটিকে হত্যা করা এবং প্রাচীর মেরামত করে দেওয়ার পেছনের হিকমাহ আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি জানতে পারলেও তাঁর কাছে গায়েবের সকল জ্ঞান ছিল না, নচেৎ তিনি মূসা (আ) কে চিনতে পারতেন।

(১৩) ভৃত্য/খাদেম রাখার বৈধতাঃ

মূসা (আ) এর ভৃত্য ছিলেন ইউশা ইবনে নূন যাকে তিনি নিজের সফরসঙ্গী বানিয়েছিলেন। এ থেকে বাসায় অবস্থানকালে কাজের প্রয়োজনে এবং সফরে সহজতার জন্য ভৃত্য রাখা এবং সাথে নেওয়ার বৈধতা প্রমাণিত হয়।

(১৪) নিজের খাদ্য থেকে ভৃত্যকে খাওয়ানো উত্তমঃ

মূসা (আ) তাঁর ভৃত্য ইউশা ইবনে নূন-কে বলেছিলেন-

“…মূসা সঙ্গীকে বললেনঃ আমাদের নাশতা আনো। আমরা এই সফরে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি।” [সূরাহ কাহফ(১৮): ৬২]

এখান থেকে বোঝা যায়, মূসা (আ) তাঁর নিজের ও তাঁর ভৃত্যের জন্য একই খাবার নিয়েছিলেন। ভৃত্যকে নিজের খাবার থেকে খাওয়ানো, নিজের পোশাক থেকে পরানো ইত্যাদি বিষয়গুলি আমাদের শরীয়তেও নির্দেশিত।

(১৫) কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশের প্রতি শর্তহীন আনুগত্যঃ কোরআন এবং সুন্নাহ-তে আমাদেরকে যেসব পালনের এবং বর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর সবগুলোর পেছনের হিকমাহ এবং কারণ আমরা নাও জানতে পারি। কিন্তু এজন্য সেগুলো আমল করা থেকে পিছু হটা যাবে না। কোনো বিষয় কোরআন এবং সহীহ সুন্নাহতে আছে কিনা তা যাচাই করতে সমস্যা নেই বরং সেটাই করণীয় কিন্তু যখনই সেটি কোরআন এবং সহীহ সুন্নাহ দিয়ে প্রমাণিত হয়ে যাবে তখনই আমাদেরকে তা কোনোরকম প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিতে হবে। আলোচ্য ঘটনায় খিদর কর্তৃক নৌকা ফুটো করা, বালককে হত্যা করা এবং প্রাচীর মেরামত করে দেওয়ার ঘটনা এই নীতিরই প্রমাণ। আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

https://www.muslimmedia.info/2016/08/31/surah-kahf-a-scholar-and-a-student

জ্ঞানার্জনের ১০টি নীতিমালা(আলী আহমাদ মাবরুর)

১. আল্লাহর সাহায্য কামনা করা

মানুষ মাত্রই দুর্বল ও অসহায়। আল্লাহর সাহায্য ও অনুমোদন ছাড়া মানুষের কিছুই করার ক্ষমতা ও সামর্থ্য নেই। যদি মানুষ নিজেকে শক্তিশালী মনে করে এবং কেবলমাত্র নিজের ওপরই ভরসা রাখে তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু যদি সে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে পারে, নিজের অসহায়ত্ব অনুধাবন করে রাব্বুল আলামিনের কাছে সাহায্য চাইতে পারে তাহলে সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। এই চিরন্তন সত্যটি জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। মানুষ যদি জ্ঞানার্জন করতে গিয়ে তার রবের কাছে খোলামনে চাইতে পারে তাহলে আল্লাহও তাকে সাহায্য করবেন। আল্লাহ কালামে পাকে মানুষকে সাহায্য করার ধরনও শিখিয়ে দিয়েছেন এভাবে, “আমরা শুধু আপনারই ইবাদত করি, আপনার কাছেই সাহায্য চাই।” (সূরা ফাতিহা : ৫)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন।” (সূরা ত্বালাক : ৩)

অন্যত্র ইরশাদ করেন, “আল্লাহর উপর ভরসা কর যদি তোমরা মুমিন হও।” (সূরা মায়িদাহ : ২৩)

রাসূল সা. নিজেও বারবার আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে বলতে শুনেছি, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি যথার্থ ভরসা করো তাহলে তিনি তোমাদেরকে ঠিক সেভাবেই রিজিক দান করবেন, যেভাবে তিনি পাখিকে রিজিক দিয়ে থাকেন। তারা ভোরে খালি পেটে বের হয় এবং দিনের শেষে ভরা পেটে বাসায় ফিরে আসে।  (তিরমিজি-২৩৪৪, ইবনু মাজাহ-৪১৬৪)

আর রিজিকের সর্বোত্তম একটি উপকরণ হলো জ্ঞান। আমরা রিজিক বলতে শুধুমাত্র খাবার ও আয় রোজগার বুঝে থাকি- যা আমাদের জানার সীমাবদ্ধতা। আর রিজিকের যে কোনো উপকরণ পাওয়ার জন্যই আল্লাহর ওপর শতভাগ ভরসা ও নির্ভরতা রাখা জরুরি। হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূল সা. যখনই ঘর থেকে বের হতেন তখনই তিনি এই দোয়া করতেন, ‘বিসমিল্লাহি, তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহি, ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহি।’

অর্থ : আল্লাহর নামে বের হচ্ছি; আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো উপায় নেই; আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো শক্তিও নেই।’ (তিরমিজি-৩৪২৬, আবু দাউদ-৫০৯৫)। এই দোয়াটি যেকোনো সময়ই বিশেষ করে অধ্যয়নের আগেও পাঠ করা যায়। কারণ এর মধ্য দিয়ে আল্লাহর ওপর আমাদের একনিষ্ঠ ভরসাও প্রকাশিত হয়।

২. নেক নিয়ত লালন করা

জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়ায় একজন মানুষকে অবশ্যই ভালোভাবে নিয়ত করতে হবে। জ্ঞানার্জনটি যেন হয় শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই। খ্যাতিমান হওয়ার বাসনা কিংবা অন্য কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে জ্ঞানার্জন করা কাম্য নয়। তাই এ ধরনের নিয়ত বা সুপ্ত ইচ্ছাও লালন করা যাবে না। আল্লাহর জন্য কেউ যখন কোনো কাজ করে- আল্লাহ তাতে বরকত দান করেন, সফলতা প্রদান করেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে জ্ঞানার্জন বড় ধরনের একটি ইবাদত।

ইবাদত হোক বা আমল- তাতে কখনোই সফলতা আসবে না যদি কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তেই করা না যায়। আর আমল করার ক্ষেত্রে বিশ^নবী সা.-এর সুন্নত অনুসরণ করাও জরুরি। আল্লাহ পাক বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা তাকওয়াবান এবং যারা সৎকর্ম করে।” (সূরা নাহল : ১২৮)

আর তাকওয়াবান হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নমুনা হলো যে কোনো কাজকে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করার মতো মানসিকতা লালন করা। তাই যিনি প্রদর্শনেচ্ছা থেকে জ্ঞানার্জন করবেন, তিনি যেমন এই দুনিয়াতে লাঞ্ছিত হবেন তেমনি পরকালেও তার জন্য শাস্তিই নির্ধারিত হয়ে যাবে। এ ধরনের জ্ঞানী বা আলেমদের ভয়ঙ্কর পরিণতির বিষয়টি হাদিসেও পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. বলেছেন, “কিয়ামতের সবার আগে যাদের বিচারের জন্য আনা হবে, তাদের মধ্যে অন্যতম দানবীর, আলেম (জ্ঞানী) ও আল্লাহর পথে জিহাদকারী শহীদ।” এর মধ্যে আলেম সংক্রান্ত অংশটি হলো, “আলেমকে আল্লাহর সামনে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তায়ালা আলেমকে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘তোমাকে আমি যে জ্ঞান দিয়েছিলাম- সেটি তুমি কোন পথে ব্যয় করেছো?’ তখন সে বলবে, ‘আমি আপনাকে খুশি করার জন্য সে জ্ঞান অন্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি।’ আল্লাহ বলবেন, ‘তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি এসব জ্ঞান অন্যদের কাছে পৌঁছে দিয়েছো- যাতে লোকেরা তোমার প্রশংসা করে এবং তোমাকে গুরুত্ব দেয়। সেটি তুমি দুনিয়ায় পেয়ে গেছো। তাই এখানে তোমার জন্য আর কোনো প্রাপ্যই রাখা হয়নি।’ এরপর তাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (তিরমিজি-২৩৮২)

৩. আল্লাহর সামনে বিনয়ী হওয়া এবং সফলতার জন্য  আল্লাহর কাছে দোয়া করা

জ্ঞানার্জনে আগ্রহী প্রত্যেকের উচিত আল্লাহর কাছে জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া করা। কারণ মানুষ মাত্রই অসহায় এবং তার প্রতিটি মুহূর্তেই আল্লাহর সাহায্যের প্রয়োজন। এ কারণে আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদেরকে উৎসাহিত করেছেন যাতে তারা মালিকের সামনে নমনীয় হয় এবং তাঁর কাছেই সাহায্য কামনা করে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি নিশ্চয়ই সাড়া দেবো।” (সূরা মুমিন : ৬০)

রাসূল সা. আমাদের জানিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা বান্দার ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য প্রতিদিন সাত আসমান থেকে নেমে আসেন। আবু হুরায়রাহ্ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, প্রতি রাতে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বরকতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।’ (বুখারি-১১৪৫, মুসলিম-৭৫৮)

আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিবকেও সা. জ্ঞানার্জনের জন্য দোয়া করার আহবান জানিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, “এবং বলুন, হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।” (সূরা ত্বহা : ১১৪)। একইভাবে আল্লাহ পাক হযরত ইবরাহীম (আ)কেও জ্ঞানার্জনের জন্য দোয়া করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং হযরত ইবরাহিম (আ) এই মর্মে দোয়া করেছিলেন, “হে আমার রব, আমাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করুন এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন। (সূরা শুআরা : ৮৩)

রাসূল সা. নিজেই তার প্রিয় সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা রা. এর জন্য দোয়া করেছিলেন যাতে তার স্মৃতিশক্তি বেড়ে যায়। একইসঙ্গে তার আরেক প্রিয় সাহাবি হযরত ইবনে আব্বাসের রা.-এর জন্যও একইভাবে দোয়া করেন যে, ‘হে আল্লাহ! আপনি তাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং কুরআনে কারিমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জ্ঞান দিন।’ আল্লাহ তায়ালা নবীজি সা. এর দুটো দোয়াই কবুল করেছিলেন। নবীজির সা. দোয়ার বরকতেই আবু হুরায়রা রা. অনেক বেশি হাদিস স্মরণে রাখতে পেরেছিলেন। আবু হুরায়রা রা.কে আমরা এখন সর্বোচ্চ সংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি হিসেবেই জানি। অন্যদিকে হযরত ইবনে আব্বাসও রা. উম্মাহর আলেম এবং কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাসসির হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছেন। সুবহানআল্লাহ।

আমাদের পূর্বসূরি সালাফদের মাঝে যারা প্রকৃতার্থেই জ্ঞানের অনুশীলন করতেন তারা আলেমদের এই কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যগুলো লালন করে গিয়েছেন। তারা জ্ঞান নিয়ে বড়াই করতেন না। বরং আল্লাহর কাছে বারবার নিজেদের অপ্রতুল জ্ঞানের জন্য মাফ চাইতেন, ইলম বৃদ্ধির জন্য দোয়া করতেন। এক্ষেত্রে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ)-এর প্রয়াস সম্পর্কে আমরা আলোকপাত করতে পারি। তিনি জ্ঞানার্জনের আগে মসজিদে চলে যেতেন। আল্লাহর দরবারে সিজদা দিতে, আর কান্নাভরা কণ্ঠে দোয়া করতেন, “হে আমার রব, হে ইবরাহিমের রব, হে সুলাইমানের রব, আপনি আমাকে জ্ঞান দান করুন। আমাকে বোঝার তাওফিক দিন।”

আল্লাহ তায়ালা শাইখুল ইসলামের এ দোয়া কবুল করে নিয়েছিলেন বলে তার সমসাময়িক অনেকেই মনে করেন। এ কারণে ইবনে দাকিক আল ঈদ তার সম্বন্ধে বলেন, “আল্লাহ তায়ালা এমনভাবে ইবনে তাইমিয়াকে জ্ঞান দিয়েছিলেন যেন জ্ঞানের সাগরটি তার দুচোখের মাঝেই দেখা যেতো। ইচ্ছেমতো সেই সাগর থেকে তিনি জ্ঞান আহরণ করতে পারতেন, আবার অপ্রয়োজন মনে করলে তিনি নিজেকে সংযতও করতে পারতেন।” (আদ দুররাত আল ইয়াতিমিয়া ফি আস সিরাত আত তাইমিয়া)

৪. একটি ন্যায়নিষ্ঠ অন্তর লালন করুন

আমাদের অন্তর হলো সেই স্থান যেখানে যাবতীয় জ্ঞান সুরক্ষিত থাকে। যদি অন্তরটাই দূষিত হয়, তাহলে এতে সংরক্ষিত সবটাই পচনের মুখে পড়বে। আর অন্তর পরিশুদ্ধ থাকলে এর ভেতর থাকা সবকিছুই ভালোভাবে সংরক্ষিত হবে। রাসূল সা. বলেছেন, “জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সেটি হলো কলব বা অন্তর।” (সুনানে দারেমি-২৫৬৯)

একটি অন্তর তখনই ন্যায়নিষ্ঠ হয় যখন তা তাকওয়ার ওজনে সমৃদ্ধ হয়। আল্লাহর সিফাত ও কার্যক্রম সম্বন্ধেও সচেতন হয়। সেই অন্তরই শুদ্ধ থাকতে পারে যা প্রতিনিয়ত ইবাদত ও জিকিরে ব্যস্ত থাকে- বিশেষ করে গভীর রাতেও আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে। প্রতিটি সচেতন মানুষের উচিত এমন কার্যক্রম থেকে দূরে থাকা যেগুলো তার অন্তরকে দূষিত করে ফেলে। আর অন্তর পচে গেলে তা আর জ্ঞান ধরে রাখতে পারে না। নতুন জ্ঞান যেমন আহরণ করতে পারে না তেমনি পূর্বে অর্জিত জ্ঞানগুলোও তার ওপর আর কোনো রেখাপাত করতে পারে না। আল্লাহ পাক এ ধরনের রোগাক্রান্ত ও দূষিত অন্তর সম্পর্কে বলেন, “আর আমি সৃষ্টি করেছি দোজখের জন্য বহু জিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তবে তা দিয়ে তারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তা দিয়ে দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তা দিয়ে শোনেও না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হলো গাফেল,  শৈথিল্যপরায়ণ।” (সূরা আরাফ : ১৭৯)

আমরা এ পর্যায়ে রোগাক্রান্ত অন্তর নিয়ে কথা বলছি। মনে রাখতে হবে, অন্তরের সাধারণত দুই ধরনের রোগ হয়।  একটি হলো সন্দেহ রোগ আর অপরটি হলো কামনা-বাসনা সংক্রান্ত রোগ। সন্দেহ সংশয়ে যখন একটি অন্তর আক্রান্ত হয় তখন তারা ধর্মের নতুন নতুন ব্যাখ্যা ও কার্যক্রম (বিদআত) সংযোজন করে; ক্ষেত্রবিশেষে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে নতুন করে কোনো আন্দোলন বা প্রয়াসও শুরু করে। আর কামনা-বাসনা সংক্রান্ত রোগটি তখন হয় যখন অন্তরে পার্থিব জীবনের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায়। মানুষ তখন দুনিয়াবি আনন্দ উপভোগে মশগুল হয়ে যায়। অবৈধ ও হারাম জিনিসের প্রতি আসক্তি বেড়ে যায়। হারাম উপকরণগুলো দেখতে ও শুনতে শুরু করে।

আরো কিছু বিষয় আছে যা প্রকৃত জ্ঞানার্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন: হিংসে, লোভ ও অহংকার প্রভৃতি। অন্তরকে আরো যে বিষয়গুলো কলুষিত করে তার মাঝে আছে মাত্রাতিরিক্ত ঘুম, অতিকথন এবং অতি আহার। এ কারণে প্রতিটি সচেতন মানুষের উচিত এ জাতীয় রোগ ও বাজে অভ্যাস থেকে দূরে থেকে অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও ন্যায়নিষ্ঠ রাখার চেষ্টা করা।

৫. মেধা

মেধা একেবারেই সহজাত বা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত হতে পারে আবার অর্জিতও হতে পারে। যদি কোনো মানুষ সহজাতভাবেই মেধাবী হয় তাহলে তার উচিত একে কাজে লাগানো এবং সরলপন্থায় নিজের বুদ্ধিমত্তাকে আরো বিকশিত করা। যদি কেউ সহজাতভাবে ততটা মেধাবী না হয় তাহলে তার এমন চেষ্টা চালানো উচিত যাতে সে এই নেয়ামতটুকু অর্জন করে নিতে পারে। মানুষের মেধাই হলো প্রধান শক্তি যা একজন ব্যক্তিকে জ্ঞানার্জনে, অনুধাবনে এবং মুখস্থকরণে সহায়তা করে। মেধা ও বুদ্ধিমত্তার বদৌলতেই একজন মানুষ একাধিক ফিকহি বিষয়াবলি, প্রমাণাদি বিশ্লেষণে এবং অন্যান্য বিষয় নিরূপণে সফল হয়ে থাকে।

৬. জ্ঞানার্জনের তীব্র ইচ্ছা

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা তাকওয়াবান এবং যারা সৎকর্ম করে।” (সূরা নাহল : ১২৮)

যখন একজন ব্যক্তি কোনো একটি বিষয়ের গুরুত্ব ভালোভাবে বুঝতে পারে তখনই সে তা অর্জনে তৎপর ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর অর্জন করার ক্ষেত্রে মানুষের জন্য জ্ঞানের চেয়ে বরকতময় আর কোনো উপকরণ হতে পারে না। এ কারণে যারা জ্ঞানার্জনের পথে অগ্রসর হবেন তাদের দায়িত্ব হলো, জ্ঞান অর্জন, মুখস্থকরণ এবং অনুধাবন করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিমাণ আকাক্সক্ষা লালন করা। জ্ঞানী ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে থাকা এবং তাদের থেকে সবসময় কিছু শেখার বা জানার চেষ্টা করা। পাশাপাশি, সবসময় পড়াশুনা করার এবং নিজের অবসর সময়কে কাজে লাগানোর একটি তাগিদও ভেতরে থাকা চাই।

৭. একাগ্রতা, উৎসাহ ও পরিশ্রম করার  মানসিকতা থাকতে হবে

জ্ঞানার্জনে আগ্রহী মানুষকে অলসতা ও নিষ্ক্রিয়তা থেকে শতভাগ দূরে থাকতে হবে। তাকে নিরন্তর নিজের প্রবৃত্তি ও অনিষ্টকর ইচ্ছের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কারণ প্রবৃত্তি ও অনিষ্টতা জ্ঞানার্জনের পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। যে কয়েকটি বিষয় একজন মানুষকে জ্ঞানার্জনে আগ্রহী ও উৎসাহী করে তুলতে পারে তার মধ্যে একটি হলো বেশি বেশি করে দুনিয়াখ্যাত স্কলার ও আলেমদের জীবনী অধ্যয়ন। বিশেষ করে পূর্বসূরি এই স্কলাররা বিপদাপদ ও মুসিবতের সময় কিভাবে ধৈর্য ধারণ করেছিলেন তা জানতে হবে। সামান্য একটি হাদিস সংগ্রহের জন্য তারা কতটা পরিশ্রম করেছেন, কত শত মাইল সফর করেছেন- এই ঘটনাগুলোও জ্ঞানার্জনে আগ্রহী মানুষের জন্য প্রেরণা হয়ে কাজ করতে পারে।

৮. দক্ষতা

জ্ঞানার্জনের পথে আগ্রহী একজন মানুষ যখন সর্বোচ্চ প্রয়াসটুকু চালাতে পারে তখনই সে কাক্সিক্ষত দক্ষতাও অর্জন করে নিতে পারে। এই দক্ষতা অর্জিত হলে মানুষ জ্ঞানার্জনে যেমন তৃপ্তি পায় আবার একইসঙ্গে নিজের ভেতর এক ধরনের শক্তি ও দৃঢ়তাও অনুভব করে। পাশাপাশি, প্রয়োজনীয় তথ্য মুখস্থকরণে এবং অনুধাবনেও তার পারদর্শিতা ও গতি অনেকটাই বেড়ে যায়।

৯. একজন ভালো মানের শিক্ষকের সান্নিধ্যে থাকা

জ্ঞান শুধু পড়ারই বিষয় নয়, বরং যারা জানেন তাদের কাছ থেকে শুনলেও অনেকটা জ্ঞান অর্জিত হয়। এই কারণে জ্ঞানার্জনে আগ্রহী মানুষের উচিত একজন দক্ষ ও দৃঢ় জ্ঞানস্তম্ভ খুঁজে বের করা। জ্ঞানী ও আলেমদের মজলিসে বসা এবং তাদের কথা শ্রবণ করা। এতে তার জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াটি শক্তিশালী হবে। কুরআন তিলাওয়াত সঠিক ও সহিহ হবে। উচ্চারণে বড় কোনো ত্রুটি থাকলে তাও সংশোধিত হবে। তাছাড়া একটি বিষয়ের প্রকৃত ব্যাখ্যা বোঝাও তার জন্য অনেকটা সহজতর হবে।

তাছাড়া একজন ভালো আলেমের পাশে থাকলে ছাত্রছাত্রীরা আদব, শিষ্টাচার ও তাকওয়ার অনুশীলনও শিখতে পারে। একা একা বই পড়ে সব জানার চেষ্টা করলে নানা ধরনের সংশয় ও অসম্পূর্ণ ধারণাও কারো মাঝে প্রবেশ করতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন ভালো ওস্তাদ তার জন্য আশীর্বাদও হয়ে উঠতে পারে। আগে যেভাবে গুরুমুখী বিদ্যার অনুশীলন ছিল, এখন তা অনেকটাই অনুপস্থিত। তারপরও বাস্তবতা হলো, ভালো মানের আলেমের সংস্পর্শ ছাড়া এ যুগেও প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া বেশ কঠিন। প্রযুক্তি বা তথ্য সংগ্রহের সুযোগ অনেকটা সহজলভ্য হয়ে গেলেও ভালো মানের আলেম ও স্কলারের আবেদন এখনো প্রকটভাবেই রয়ে গেছে।

১০. সময় দিতে হবে

একজন প্রকৃত জ্ঞানার্জনকারী ছাত্রের সময় নিয়ে পেরেশান হলে চলবে না। এক বছর বা দুই বছরের মধ্যে জ্ঞানার্জন শেষ হয়ে যাবে- এমনটিও মনে করার কারণ নেই। বরং একজন জ্ঞানমুখী ছাত্রের উচিত অনেক বছর সাধনা করার মতো মানসিকতা লালন করা। আল কাদী ইলিয়াদকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, একজন ছাত্রের কতদিন পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ করতে হবে? তিনি বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ না তার মৃত্যু হয়।” এটিই প্রকৃত বাস্তবতা যে, মেধাবী ছাত্ররা কোনো নির্দিষ্ট সময় ধরে আলেমদের সাথে থাকেন না। নির্দিষ্ট সময় মেপে পড়াশুনাও করেন না। বরং তারা জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি এই প্রয়াসগুলো চালিয়ে যান।

এগুলোই হচ্ছে জ্ঞানার্জন করার ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু নীতিমালা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এই নীতিমালাগুলো অনুসরণ করার এবং কল্যাণকর জ্ঞানার্জনের তাওফিক দিন। আমিন।

(আবদুল্লাহ বিন সালফিক আয যুফাইরির ‘টেন গাইডলাইন্স ফর অবটেইনিং নোলেজ’ শীর্ষক কলাম অবলম্বনে)

লেখক : সাংবাদিক, অনুবাদক ও কলামিস্ট

 

তালিবুল ইলম কেমন হওয়া প্রয়োজন?

ড. মো: মুস্তাফিজুর রহমান

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ قَال أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ{رواه الترمذي

আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম (জ্ঞান) অর্জন করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন। (তিরমিযী হা/২৬৪৬; ইখনু মাজাহ হা/২২৩; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৮, সনদ সহিহ।)

রাবির পরিচয় : আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাহাবা। যাঁর প্রকৃত নাম আবদুর রহমান ইবনে সা’খর অথবা উমায়র ইবনে আমির। (তিনি তিন বছর নবী মুহাম্মদ (সা:)-এর সান্নিধ্যে ছিলেন এবং বহুসংখ্যক হাদিস আত্মস্থ করেন এবং বর্ণনা করেন। হিসাব অনুযায়ী ৫,৩৭৫টি হাদিস তাঁর কাছ থেকে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে আটশত তাবেঈ হাদিস শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

আলোচ্য বিষয় : আলোচ্য হাদিসে ‘ইলম তথা জ্ঞান অর্জনের ফজিলত ও মর্যাদার কথা আলোচনা করা হয়েছে।

হাদিসের ব্যাখ্যা : ইলম অর্জনের মর্যাদা অত্যধিক। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহ যাদেরকে জ্ঞান দান করেছেন তাদেরকে উচ্চমর্যাদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত।’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)। ইলম অর্জনের মর্যাদা সম্পর্কে অত্র হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে পথ চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেবেন।

অন্য হাদিসে এসেছে,

عَنْ أَبِى أُمَامَةَ الْبَاهِلِىِّ قَالَ ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَجُلاَنِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالآخَرُ عَالِمٌ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِى عَلَى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِى جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ.

আবু উমামা আল-বাহিলি (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সামনে দু’জন লোকের কথা উল্লেখ করা হলো। যাদের একজন আলিম অপরজন আবিদ। তখন তিনি বলেন, আলিমের মর্যাদা আবিদের ওপর। যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণের ওপর। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, নিশ্চয়ই তার প্রতি আল্লাহ রহমত করেন এবং তার ফেরেশতামন্ডলী, আসমান-জমিনের অধিবাসী, পিপীলিকা তার গর্তে থেকে এবং এমনকি মাছও কল্যাণের শিক্ষা দানকারীর জন্য দোয়া করেন। ( তিরমিজি হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩, সনদ হাসান।)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللَّهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِى السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِى الأَرْضِ وَالْحِيتَانُ فِى جَوْفِ الْمَاءِ .

‘যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘আলা তা দ্বারা তাকে জান্নাতের কোন একটি পথে পৌঁছে দেন এবং ফেরেশতাগণ ইলম অন্বেষণকরীর ওপর খুশি হয়ে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। এ ছাড়া আলেমদের জন্য আসমান ও জমিনের সকল অধিবাসী আল্লাহর নিকট দোয়া ও প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মধ্যে বসবাসকারী মাছও (তাদের জন্য দোয়া করে)। ( আবুদাউদ হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/২১২; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৭, সনদ সহিহ।)

ইলম অর্জনের গুরুত্ব : রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ওপর সর্বপ্রথম প্রত্যাদেশকৃত শব্দ হল, اِقْرَأْ ‘আপনি পড়ুন!। রাসূলুল্লাহ (সা:) তখন বলেছিলেন, أَنَا بِقَارِئٍ

‘আমি পড়তে জানি না’। তখন জিবরিল (আ:) তাকে জাপটে ধরেছিলেন। এই একই দৃশ্য তিনবার হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নিকট সূরা ‘আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে অহির জ্ঞান শিক্ষা দেন। সুতরাং আমাদের সমাজ ও দেশ থেকে অন্যায়, অপকর্ম দূর করতে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। ইলম অর্জনের নির্দেশনাস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,

طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ

‘প্রত্যেক মুসলিমের ওপরে জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরজ। (ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮, সনদ হাসান।)

দ্বীনি ইলম অর্জনের প্রতি আল্লাহর উৎসাহ প্রদান :

আল্লাহ জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহিত মানুষকে উৎসাহিত করেছেন, কেননা মানুষ ইলম অর্জন করবে, সে অনুযায়ী আমল করবে এবং নিজেদের মাঝে ইলম প্রচার করবে এটাই আল্লাহর দাবি। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

‘সুতরাং এমন কেন হয় না যে, তাদের প্রত্যেকটি বড় দল হতে এক একটি ছোট দল বের হবে, যাতে তারা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আর যাতে তারা নিজ কওমকে ভয় প্রদর্শন করতে পারে যখন তারা ওদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, যেন তারা সতর্ক হয়।’ (সূরা তওবা ৯/১২২)

মানুষ অজ্ঞ-মূর্খ হয়ে পৃথিবীতে আসে। আল্লাহ বলেন,

عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

‘আমি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছি, যা সে জানত না।’ (সূরা আলাক ৯৬/৫) ইলম বা জ্ঞান দ্বারা ভাল-মন্দ নির্ণয় করা যায়। এর দ্বারা অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সুতরাং আল্লাহ যার মঙ্গল চান এবং যার দ্বারা হকের বাস্তবায়ন সম্ভব তাকেই মহামূল্যবান জ্ঞান দান করে থাকেন। যেহেতু জ্ঞানের মালিক আল্লাহ, তাই এই জ্ঞান আল্লাহ যাকে চান তাকে দান করেন। তিনি বলেন,

يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ

‘তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয় এবং কেবল বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শিক্ষা গ্রহণ করে।’ (সূরা বাকারাহ ২/২৬৯) এ সম্পর্কে রাসূল (সা:) বলেন,

خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّين مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ

আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’। (ইবনু মাজাহ হা/২২৩; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৭, সনদ সহিহ)

‘আলিমগণই নবীদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী : রক্ত সম্পর্ক কিংবা বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে কোন ব্যক্তির ওয়ারিশ হওয়া যায়। কিন্তু ইলম এমন একটি মূল্যবান সম্পদ, যে ব্যক্তি তা অর্জন করবে আল্লাহ তাকে নবীদের ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী বানাবেন। সুতরাং আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক ধারণাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মূলত নবীদের উত্তরাধিকারী। আর উত্তরাধিকার জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন,

إِنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ.

‘আলেমরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দিনার বা দিরহামের উত্তরাধিকারী করেন না। বরং তারা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। ফলে যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল। (সহিহুল বুখারী হা/৭১)

আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।’ (ইবনু মাজাহ হা/২২৩; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৭, সনদ সহিহ।) অতএব দ্বীনি ইলম অর্জন করলে নবীদের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়।

আল্লাহর নিকট উপকারী ইলমের প্রার্থনা করা : আল্লাহর নিকট ইলমসহ যাবতীয় কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহর নিকট চাওয়ার মাধ্যমে ইলম অর্জিত হলে তা দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই অর্জন করা সম্ভব। আর যদি না চাওয়াতেই ইলম আসে, তা দিয়ে দুনিয়া সম্ভব আখিরাত কখনই অর্জন করা সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন,

مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا

وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ

‘অনেকে বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে দান কর। অথচ তার জন্য পরকালের কোন অংশ নেই।’ (সূরা বাকারাহ ২/২০০)

আর এজ্যই নবী-রাসূলগণ একমাত্র আল্লাহর নিকটেই চাইতেন। যেমন ইবরাহিম (আ:) প্রার্থনা করে বলেন,

رَبِّ هَبْ لِي حُكْمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ

‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর।’ (শু‘আরা ২৬/৮৩) অনুরূপ মুসা (আ:) আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,

رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي- وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي- وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي- يَفْقَهُوا قَوْلِي

‘হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষকে প্রশস্ত করে দাও, আমার কাজকে সহজ করে দাও এবং আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দাও, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (ত্বহা ২০/২৫-২৮) আর এরই ধারাবাহিকতায় রাসূল (সা:) আল্লাহর নিকট উপকারী ইলমের প্রার্থনা করতেন। হাদিসের ভাষায় রাসূল (সা:) প্রতি ফজর সালাতের পর প্রার্থনা করতেন এই বলে যে,

اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَرِزْقًا طَيِّبًا وَعَمَلاً مُتَقَبَّلاً

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট উপকারী জ্ঞান, কবুলযোগ্য আমল ও পবিত্র রুজি প্রার্থনা করছি।’ (আহমাদ ইবনে মাজাহ, তাবারানি, মিশকাত হা/২৪৯৮) সুতরাং আমাদের সকলেরই উচিত একমাত্র আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করা।

‘আলিম তথা জ্ঞানীদের করণীয় : জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই করণীয় হলো জানা বিষয়গুলো মানুষের নিকট প্রচার করা। যেমন আল্লাহ তাঁর নবীদের নিকট অহি প্রেরণের পর তা মানুষের নিকট প্রচারের নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ

‘হে রাসূল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন তবে আপনি তাঁর পয়গাম পৌঁছালেন না।’ (সূরা মায়েদা ৫/৬৭)

এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,

بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَةً

‘আমার পক্ষ হতে মানুষের নিকটে পৌঁছে দাও, যদি একটি আয়াতও হয়’। (বুখারী হা/৩৪৬১; তিরমিজি হা/২৬৬৯)

পক্ষান্তরে আলিমগণ দ্বীন প্রচারে অবহেলা করলে কিংবা বিরত থাকলে তাদের অবস্থা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। হাদিসে এসেছে,

عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمِ يُجَاءُ بِالرَّجُلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُلْقَى فِى النَّارِ فَتَنْدَلِقُ بِهِ أَقْتَابُهُ فَيَدُورُ بِهَا فِى النَّارِ كَمَا يَدُورُ الْحِمَارُ بِرَحَاهُ فَيُطِيفُ بِهِ أَهْلُ النَّارِ فَيَقُولُونَ يَا فُلاَنُ مَا لَكَ مَا أَصَابَكَ أَلَمْ تَكُنْ تَأْمُرُنَا بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَانَا عَنِ الْمُنْكَرِ فَقَالَ كُنْتُ آمُرُكُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَلاَ آتِيهِ وَأَنْهَاكُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَآتِيهِ.

ওসামা ইবনু যায়েদ (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, এক ব্যক্তিকে ক্বিয়ামতের দিন নিয়ে আসা হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে করে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। আর সে তা নিয়ে ঘুরতে থাকবে যেমনভাবে গাধা আটা পিষা জাঁতার সাথে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামিরা তার নিকট একত্রিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কি আমাদের ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করতেন না? সে বলবে, হ্যাঁ। আমি তোমাদের ভালো কাজের আদেশ করতাম, কিন্তু নিজে করতাম না। আর খারাপ কাজের নিষেধ করতাম কিন্তু নিজেই তা করতাম। (সহিহুল বুখারী হা/৩২৬৭; মিশকাত হা/৫১৩৯)

অতএব আমলবিহীন ইলম কিয়ামতের দিন বড় শাস্তির কারণ হবে। আরবি প্রবাদে রয়েছে,

رجل بلا عمل كشجرة بلا ثمر

‘আমলবিহীন ব্যক্তি ফলবিহীন বৃক্ষের ন্যায়’। জনৈক আরব কবি বলেন,

لو كان للعلم شرف من دون التقي* لكان أشرف خلق الله إبليس

‘যদি তাক্বওয়াবিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত, তবে ইবলিস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হতো। (নবীদের কাহিনী, ১/১৩ পৃ:)

প্রকৃত ‘ইলম তথা জ্ঞানের সফলতা : গোটা বিশ্ব আজ অশান্তিতে ভরপুর। এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হলো প্রকৃত ইলম অর্জন তথা সুশিক্ষা। কেননা সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে দুনিয়াতে যেমন মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে ও সমাজে শান্তি আসবে, তেমনি আখেরাতের পাথেয় অর্জনের পথ সুগম হবে। মৃত্যুর পর মানুষের আমল বন্ধ হয়ে যায় অথচ দ্বীনি ইলম অর্জন করে শিক্ষা দিলে তা কবরে পৌঁছানোর অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন,

إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ

‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমল ব্যতীত। এই তিনটি আমল হলো, প্রবহমান ছাদাকা, এমন ইলম যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন সুসন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম হা/১৬৩১)

সহায়কঃ

তাফসিরে যাকারিয়া ও বিভিন্ন স্কলারের বক্তব্য এবং অনলাইন থেকে নেয়া যা উল্লেখিত আছে।