(২য় পর্ব) পর্দা- মহান রবের আনুগত্যের একটি রুপায়ন: ২য় পর্ব (পর্দা ও নিকাব)

পর্দা- মহান রবের আনুগত্যের একটি রুপায়ন: ২য় পর্ব (পর্দা ও নিকাব)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ.

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

১ম পর্ব পড়ার জন্য–

পর্দা- মহান রবের আনুগত্যের একটি রুপায়ন: ১ম পর্ব (পোষাক ও সতর)

 

Power Point Presentation

পর্দা- মহান রবের আনুগত্যের একটি রুপায়ন-2nd part

হিজাব কুরআনের একটি বিশেষ পরিভাষা। পর্দা শব্দটি ফার্সি এবং এটি বাংলায় বহুল প্রচলিত। পর্দা বা হিজাব আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক নৈতিকতা সম্পর্কিত বিধি বিধানগুলোর অন্যতম। হিজাবের আভিধানিক অর্থ প্রতিহত করা, ফিরিয়ে রাখা, আড়াল করা। পারিভাষিক অর্থ- সেই বিধি-ব্যবস্থা ও চেতনা যার মাধ্যমে ঘর থেকে শুরু করে পথ-প্রতিষ্ঠান-সমাবেশ সহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের নিজস্বতা সংরক্ষণ ও সম্মান বজায় রেখে উভয়ের মধ্যে অপ্রয়োজনীয়, নিয়ন্ত্রণহীন কথাবার্তা, দর্শন, দৃষ্টিবিনিময়, সৌন্দর্য প্রদর্শন ও সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ করা হয়।

ইসলামে পর্দার বিধান নাজিল হয়েছিল দুইটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। হযরত যায়েদ (রা) হযরত যয়নবকে (রা) তালাক দিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর নবীর সা পালিত পুত্রের (যায়েদ রা) স্ত্রী যয়নবকে রা বিয়ে করার ঘটনা, আরেকটি হচ্ছে উমরের রা আবেদন। আল্লামা ইবনে কাসীর এবং “নায়লুল আওতার” গ্রন্থকার” বলেন, পঞ্চম হিজরীতে ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে পর্দা ফরয হয়েছে। তাফসীরে রুহুল মায়ানীতে উল্লেখ আছে, তৃতীয় হিজরীতে ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে পর্দা ফরয হয়েছে।।

৪৪২৭। মুসাদ্দাদ (রহঃ) … উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার কাছে ভাল ও মন্দ লোক আসে। আপনি যদি উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের ব্যাপারে পর্দার আদেশ দিতেন (তবে ভাল হত) তারপর আল্লাহ্ তা’আলা পর্দার আয়াত নাযিল করেন।হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) সহীহ বুখারী (ইফাঃ)অধ্যায়ঃ ৫২/ তাফসীরপাবলিশারঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন

৩৯৩। আমার ইবনু ‘আওন (রহঃ) …. আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘উমর (রাঃ) বলেছেনঃ তিনটি বিষয়ে আমার অভিমত আল্লাহর অহির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। আমি বলেছিলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা যদি মাকামে ইবরাহীম কে সালাতের স্থান বানাতে পারতাম! তখন এ আয়াত নাযিল হয়ঃ (وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى‏) “তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানাও” (২ : ১২৫) সহীহ বুখারী (ইফাঃ)অধ্যায়ঃ ৮/ সালাত‏পরিচ্ছদঃ ২৭৩। কিবলা সম্পর্কে বর্ণনা।

(দ্বিতীয়) পর্দার আয়াত, আমি বললামঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি যদি আপনার সহধর্মিনীগনকে পর্দার আদেশ করতেন! কেননা, সৎ ও অসৎ সবাই তাদের সাথে কথা বলে। তখন পর্দার আয়াত নাযিল হয়।

আর একবার নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মিণীগণ অভিমান সহকারে তাঁর নিকট উপস্থিত হন। তখন আমি তাদেরকে বললামঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তোমাদের তালাক দেয়, তাহলে তাঁর রব তাঁকে তোমাদের পরিবর্তে তোমাদের চাইতে উত্তম স্ত্রী দান করবেন। (৬৬ : ৫) তখন এ আয়াত নাযিল হয়।(অপর সনদে ইবন আবু মারয়াম (রহঃ) …. আনাস (রাঃ) থেকে অনুরূপ বর্ণিত আছে।) হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সতর ও হিজাবের সম্পর্ক

১। সতরের বিষয়টি শুধু শরীর আবৃত করার সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু হিজাব বা পর্দা সম্পর্কিত থাকে নৈতিক, সামাজিক, শারীরিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের সাথে।

২। সতরের উদ্দেশ্য শরীর আবৃত করা কিন্তু হিজাবের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য, আকর্ষণ ও সংস্পর্শকে আড়াল ও পৃথক করা।

৩। সতর রক্ষা করে চলতে হবে সবার সামনে। কিন্তু হিজাব পালনের ক্ষেত্রে মুহরিম ও গায়রে মুহরিমের মধ্যে পার্থক্য টেনে দেয়া হয়েছে।

৪। সতরের উপর আলাদা কাপড় (জিলবাব) নিয়েই হিজাব পালন করতে হবে- নারীর জন্য।

মহান আল্লাহকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্মরণের উদ্দেশ্যে নামাজ, রোজা, যাকাত ইত্যাদি ফরয ইবাদাত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। কিন্তু ঈমান রক্ষা ও হিজাব পালন নারী ও পুরুষের জন্য সার্বক্ষণিক ফরয ইবাদাত যার জন্য প্রতিটি মুহূর্তেই সতর্ক থাকতে হয়। একটি সমাজে নানা রকমের মানুষ বসবাস করে। ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ও নৈতিক জীবন যাপনের জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামকে সার্বজনীন জীবন বিধান হিসাবে অনুসরণযোগ্য করে পাঠিয়েছেন যা প্রতি যুগের জন্য উপযোগী। একমাত্র মহান আল্লাহই ভবিষ্যতকেও জানেন, মানুষকে যে জ্ঞান মেধা দিয়েছেন সেটাকে কাজে লাগিয়ে সে কতদূর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করবে তাও জানেন। মহান আল্লাহই কিয়ামত পর্যন্ত হিজাবের বিধান দিয়ে দিয়েছেন।

আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন:

اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا.

‘আজকের দিন আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিয়েছি। তোমাদেরকে প্রদত্ত আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীনরূপে মনোনীত করেছি। সূরা মায়িদাহ : ০৪

নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্টিত হয়েছেন। তিনি পড়িয়ে দেন রাতের উপর দিনকে এমতাবস্থায় যে, দিন দৌঁড়ে রাতের পিছনে আসে। তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র দৌঁড় স্বীয় আদেশের অনুগামী। শুনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা। আল্লাহ, বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। সুরা আল-আ’রাফ: ৫৪

اِنِ الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰهِ ؕ اَمَرَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴۰

বিধান দেয়ার অধিকার শুধু মাত্র আল্লাহরই তিনি নির্দেশ দিয়েছেন শুধু তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত না করতে, এটাই শাশ্বত দ্বীন কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটা জানে না। সূরা ইউসুফঃ৪০

নিশ্চয় যারা নিজেদের কাছে সৎপথ স্পষ্ট হওয়ার পর তা থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেয়। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা যারা অপছন্দ করে তাদেরকে ওরা বলে, অচিরেই আমরা কোন কোন বিষয়ে তোমাদের অনুগত্য করব। আর আল্লাহ্‌ জানেন তাদের গোপন অভিসন্ধিসমূহ। সূরা মুহাম্মদঃ ২৫-২৬

আল কুরআনের কঠোর সতর্কবাণী

اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ مَنْ یَّفْعَلُ ذٰلِكَ مِنْكُمْ اِلَّا خِزْیٌ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا ۚ وَ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ یُرَدُّوْنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الْعَذَابِ.

তোমরা কি কিতাবের কতেক অংশে বিশ্বাস কর আর কতক অংশকে প্রত্যাখান কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যকার যারা এরূপ করে তাদের প্রতিফল পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা-বিড়ম্বনা ছাড়া আর কী হতে পারে। এবং পরকালে তারা কঠিনতম শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে? সূরা বাকারা : ৮৫

হে বনী আদম! মনে রেখো, যদি তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে কোন রাসূল এসে তোমাদেরকে আমার আয়াত শুনাতে থাকে, তাহলে যারা আমার নাফরমানী করা থেকে বিরত থাকবে এবং নিজেদের কর্মনীতির সংশোধন করে নেবে, তাদের কোন ভয়ভীতি থাকবে না এবং তারা দুঃখিত ও চিন্তিত হবে না। সূরা আল-আরাফ: ৩৪-৩৫

পর্দার বিধানটি ইসলামের একটি অকাট্য বিধান। মুসলিম হওয়ার মাণদন্ড জ্ঞান নয়, সমর্পণ। জ্ঞান তো কাফিরদেরও ছিল এবং আছে। নিছক জ্ঞান মুসলিম হওয়ার পক্ষে যাথেষ্ট নয়; মুসলিম সে-ই, যে আল্লাহর বিধানের সামনে সমর্পিত হয়। আমরা যদি ইসলামের সামগ্রিক পর্দা-ব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করি তাহলে তিন ধরনের বিধান পাই :

১. কিছু বিধান নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন সতরের বিধান, নজরের বিধান, নারী-পুরুষের মেলামেশার বিধান ইত্যাদি।

২. কিছু বিধান শুধু নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন গৃহে অবস্থানের বিধান, প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার সময় নিজেকে আবৃত করার বিধান, সজ্জা ও অলংকার প্রদর্শন না করার বিধান ইত্যাদি।

৩. কিছু বিধান মৌলিকভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন পরিবারের কর্তা হিসেবে অধীনস্তদের পর্দা সম্পর্কে অবগত করার বিধান এবং তাদের পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের বিধান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালক হিসেবে সর্বশ্রেণীর মুসলিম নর-নারীর জন্য পর্দার বিধান জানা ও মানার ব্যবস্থা, পর্দা-বিরোধী সকল অপতৎরতা বন্ধ এবং সমাজে পর্দাহীনতা ও অশ্লীলতা বন্ধে সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করার বিধান ইত্যাদি।

এই পর্দার বিধান উমার (রাঃ)-এর বাসনার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার নিকট সৎ-অসৎ হরেক রকমের লোক আসা যাওয়া করে, আপনি আপনার পত্নীগণকে পর্দা করার আদেশ দিলে খুবই ভাল হত। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা এই পর্দার হুকুম নাযিল করেন।

(বুখারীঃ কিতাবুস স্বালাহ ও তাফসীর সুরা বাক্বারাহ, মুসলিমঃ বাবু ফাযায়েলে ওমর বিন খাত্তাব)

ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, “নারীরা হলো গোপনীয় বস্তু।” (তিরমিযী এবং এটিকে আলাবনী সহীহ বলেছেন)

কুরআন মজীদের অনেকগুলো আয়াতে এই বিধান দেওয়া হয়েছে। সুতরাং কোনো ঈমানদারের পক্ষে এই বিধানকে হালকা মনে করার সুযোগ নেই। এখানে কয়েকটি আয়াত সংক্ষিপ্ত আলোচনাসহ তুলে ধরা হল।

হে নবী-পত্নিগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর সুতরাং পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, কারণ এতে যার অন্তরে ব্যাধি আছে, সে প্ৰলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। সূরা আহযাবঃ ৩২

৩৩:৩৩ وَ قَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ وَ لَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاهِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی

আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন জাহেলী যুগের প্রদর্শনীর মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। সূরা আহযাবঃ ৩৩

মূলে বলা হয়েছে قَرْنَ কোন কোন অভিধানবিদ একে قرار শব্দ থেকে গৃহীত বলে মত প্রকাশ করেন আবার কেউ কেউ বলেন وقار থেকে গৃহীত। যদি এটি قرار থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে এর অর্থ হবে “স্থিতিবান হও” “টিকে থাকো।” আর যদি وقار থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে অর্থ হবে “শান্তিতে থাকো।”, “নিশ্চিন্তে ও স্থির হয়ে বসে উভয় অবস্থায় আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, নারীর আসল কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তার গৃহ। এ বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করে তাকে নিশ্চিন্তে নিজের দায়িত্ব সম্পাদন করে যেতে হবে। কেবলমাত্র প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সে গৃহের বাইরে বের হতে পারে

এ আয়াতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আয়াতের অর্থ অনুধাবন করার জন্য এ দু’টি বুঝে নেয়া জরুরী। এর একটি হচ্ছে “তাবাররুজ” এবং দ্বিতীয়টি “জাহেলিয়াত।”

আরবী ভাষায় ‘তাবাররুজ” মানে হচ্ছে উন্মুক্ত হওয়া, প্রকাশ হওয়া এবং সুস্পষ্ট হয়ে সামনে এসে যাওয়া। দূর থেকে দেখা যায় এমন প্রত্যেক উঁচু ভবনকে আরবরা “বুরুজ” বলে থাকে। দুর্গ বা প্রাসাদের বাইরের অংশের উচ্চ কক্ষকে এ জন্যই বুরুজ বলা হয়ে থাকে। পালতোলা নৌকার পাল দূর থেকে দেখা যায় বলে তাকে “বারজা” বলা হয়, নারীর জন্য তাবাররুজ শব্দ ব্যবহার করা হলে তার তিনটি অর্থ হবে।

এক, সে তার চেহারা ও দেহের সৌন্দর্য লোকদের দেখায়।

দুই, সে তার পোশাক ও অলংকারের বহর লোকদের সামনে উন্মুক্ত করে।

তিন, সে তার চাল-চলন ও চমক-ঠমকের মাধ্যমে নিজেকে অন্যদের সামনে তুলে ধরে। অভিধান ও তাফসীর বিশারদগণ এ শব্দটির এ ব্যাখ্যাই করেছেন। মুজাহিদ, কাতাদাহ ও ইবনে আবি নুজাইহ বলেন, التبرج المشى بتبخر وتكسر وتغنج- “তাবাররুজের অর্থ হচ্ছে, গর্ব ও মনোরম অংগভংগী সহকারে হেলেদুলে ও সাড়ম্বরে চলা।” মুকাতিল বলেন, ابداء قلائدها وقرطها وعنقها “নিজের হার, ঘাড় ও গলা সুস্পষ্ট করা।” আল মুবাররাদের উক্তি হচ্ছেঃ ان تبدى من مناسنها مايجب عليها ستره “নারীর এমন গুণাবলী প্রকাশ করা যেগুলো তার গোপন রাখা উচিত।” আবু উবাইদাহর ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ

ان تخرج من محاسنها ماتستدهى به شهوة الرجال

“নারীর শরীর ও পোশাকের সৌন্দর্য এমনভাবে উন্মুক্ত করা যার ফলে পুরুষেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।”

وَ اِذَا سَاَلۡتُمُوۡهُنَّ مَتَاعًا فَسۡـَٔلُوۡهُنَّ مِنۡ وَّرَآءِ حِجَابٍ ؕ ذٰلِکُمۡ اَطۡهَرُ لِقُلُوۡبِکُمۡ وَ قُلُوۡبِهِنَّ

তোমরা তার পত্নীদের কাছ থেকে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য বেশী পবিত্র। সূরা আহযাবঃ ৫৩ (কিছু অংশ)

এই আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমানদারদের সম্বোধন করে বলেছেন যে, নবী সা এর স্ত্রীদের কাছে কিছু চাইতে হলে হিজাবের আড়ালে অর্থাৎ একটি পর্দার আড়ালের বাইরে থেকে চাইতে। এর মাধ্যমে নবীর স্ত্রীদের দেখা যাবেনার নির্দেশিকা জানা যায়। ঠিক এ কিছু পরের আয়াতে যা বলা হয়েছে–

یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَ بَنٰتِكَ وَ نِسَآءِ الْمُؤْمِنِیْنَ یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ ؕ ذٰلِكَ اَدْنٰۤی اَنْ یُّعْرَفْنَ فَلَا یُؤْذَیْنَ ؕ وَ كَانَ اللّٰهُ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا

হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব : ৫৯)

উল্লেখিত আয়াতের جلابيب শব্দটি جلباب এর বহুবচন। ‘জিলবাব’ অর্থ বিশেষ ধরনের লম্বা চাদর। [দেখুন: কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর] এই চাদরের আকার-আকৃতি সম্পর্কে  ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ এই চাদর ওড়নার উপরে পরিধান করা হয়। [ইবনে কাসীর]

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ  রহ. বলেন: “জিলবাব অর্থ হচ্ছে অবগুণ্ঠন ও বোরকা।

আর ‘ইদন’ শব্দের আসল মানে হচ্ছে নিকটবর্তী করা ও ঢেকে নেয়া। কিন্তু যখন তার সাথে ‘আলা’ অব্যয় (Preposition) বসে তখন তার মধ্যে ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়ার অর্থ সৃষ্টি হয়। একথা সুস্পষ্ট যে, এখানে ‘মিন’ শব্দটি ‘কিছু’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ চাদরের এক অংশ। আর এটাও সুস্পষ্ট যে, জড়িয়ে নিতে হলে পুরো চাদর জড়াতে হবে, নিছক তার একটা অংশ নয়। তাই আয়াতের পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, নারীরা যেন নিজেদের চাদর ভালোভাবে জড়িয়ে ঢেকে নিয়ে তার একটি অংশ বা একটি পাল্লা নিজেদের ওপর লটকিয়ে দেয়।

‘জিলবাব’ হলো সাধারন পরিধেয় পোশাকের উপর একটি অতিরিক্ত বড় চাদর যা নারীর যাবতীয় সৌন্দর্য ও পরিধেয় পোশাককে ঢেকে দিবে। শুধু চোখ খোলা থাকবে। চলাফেরা ও কাজের সুবিধার জন্য বোরখা জিলবাবের ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সেটাকে অবশ্যই পর্দার উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে হবে।

ইমাম মুহাম্মদ ইবন সিরীন বলেনঃ আমি আবীদা আস-সালমানীকে এই আয়াতের উদ্দেশ্য এবং জিলবাবের আকার-আকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি মস্তকের উপর দিক থেকে চাদর মুখমণ্ডলের উপর লটকিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে ফেললেন এবং কেবল বামচক্ষু খোলা রেখে إدناء ও جلباب এর তাফসীর কার্যত: দেখিয়ে দিলেন। আর নিজের উপর চাদরকে নিকটবর্তী করার অর্থ চাদরকে মস্তকের উপরদিক থেকে লটকানো। সুতরাং চেহারা, মাথা ও বুক ঢেকে রাখা যায় এমন চাদর পরিধান করা উচিত।আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে ওড়না/চাদর টেনে স্বীয় মুখমন্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে।-ফাতহুল বারী ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪

ইবনে সীরিন বলেন, আমি (বিখ্যাত তাবেয়ী) আবীদা (সালমানী রাহ.)কে উক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, কাপড় দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত করবে এবং এক চোখ খোলা রাখবে।

এই আবীদা আস-সালমানী নবী সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মুসলিম হন কিন্তু তাঁর খিদমতে হাযির হতে পারেননি। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমলে তিনি মদীনা আসেন এবং সেখানেই থেকে যান। তাকে ফিকহ ও বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে কাযী শুরাইহ-এর সমকক্ষ মনে করা হতো) ইবন আব্বাসও প্রায় এই একই ব্যাখ্যা করেন। তার যেসব উক্তি ইবনে জরীর, ইবনে আবি হাতেম ও ইবনে মারদুওইয়া উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে তার যে বক্তব্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে, “আল্লাহ মহিলাদেরকে হুকুম দিয়েছেন যে, যখন তারা কোন কাজে ঘরের বাইরে বের হবে। তখন নিজেদের চাদরের পাল্লা ওপর দিয়ে লটকে দিয়ে যেন নিজেদের মুখ ঢেকে নেয় এবং শুধুমাত্র চোখ খোলা রাখে।” কাতাদাহ ও সুদ্দীও এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই করেছেন।

সাহাবা ও তাবেঈদের যুগের পর ইসলামের ইতিহাসে যত বড় বড় মুফাসসির অতিক্রান্ত হয়েছেন তারা সবাই একযোগে এ আয়াতের এ অর্থই বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে জারীর তাবারী বলেন, ভদ্র ঘরের মেয়েরা যেন নিজেদের পোশাক আশাকে বাদীদের মতো সেজে ঘর থেকে বের না হয়। তাদের চেহারা ও কেশদাম যেন খোলা না থাকে। বরং তাদের নিজেদের ওপর চাদরের একটি অংশ লটকে দেয়া উচিত। ফলে কোন ফাসেক তাদেরকে উত্যক্ত করার দুঃসাহস করবে না।” [জামে উল বায়ান ২২/৩৩]

ইমাম যাহাবী রাহ. বলেন, যে সব কর্ম নারীর উপর লানত করে তা হল অলংকার ও আকর্ষণীয় পোশাকের সৌন্দর্য প্রকাশ করা। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার …। আলকাবায়ের পৃ. ১০২

অন্যত্র তিনি বলেন: ﴿وَإِذَا سَأَلۡتُمُوهُنَّ مَتَٰعٗا فَسۡ‍َٔلُوهُنَّ مِن وَرَآءِ حِجَابٖۚ﴾ [الاحزاب: ٥٣]

“আর যখন তোমরা তাদের নিকট কিছু প্রার্থনা কর, তবে পর্দার আড়াল থেকে তাদের কাছে চাও”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৩]

এখানে পর্দার উদ্দেশ্য নারীকে আড়ালকারী দেয়াল অথবা দরজা অথবা পোশাক। আয়াতটি যদিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের উদ্দেশ্য করে নাযিল হয়েছে; কিন্তু তাতে সকল মুমিন নারীই প্রবেশ করবে; যেহেতু এখানে আল্লাহ তার কারণ বলেছেন:

﴿ذَٰلِكُمۡ أَطۡهَرُ لِقُلُوبِكُمۡ وَقُلُوبِهِنَّۚ﴾ [الاحزاب: ٥٣]

“এটিই তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিক পবিত্রতা”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৩] আর অন্তরের পবিত্রতা সবার প্রয়োজন, তাই এ হুকুম সবার জন্য ব্যাপক।

মাহরাম ব্যতীত পরপুরুষ থেকে নারীদের চেহারা ঢাকার হাদীস। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন:

»كان الركبان يمرون بنا ونحن مع رسول الله صلى الله عليه وسلم محرمات، فإذا حاذوا بنا سدلت إحدانا جلبابها من رأسها على وجهها، فإذا جاوزنا كشفناه«

“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুহরিম ছিলাম, আরোহীগণ আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত। যখন তারা আমাদের বরাবর হত, আমরা প্রত্যেকে জিলবাব মাথার উপর থেকে চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিতাম, যখন তারা আমাদের ছাড়িয়ে যেত আমরা তা খুলে ফেলতাম”। আবু দাউদ, হাদীস নং ১৮৩৩; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৯৩৫; আহমদ (৬/৩০)

আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

২৪:৬০ وَ الۡقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَآءِ الّٰتِیۡ لَا یَرۡجُوۡنَ نِکَاحًا فَلَیۡسَ عَلَیۡهِنَّ جُنَاحٌ اَنۡ یَّضَعۡنَ ثِیَابَهُنَّ غَیۡرَ مُتَبَرِّجٰتٍۭ بِزِیۡنَۃٍ ؕ وَ اَنۡ یَّسۡتَعۡفِفۡنَ خَیۡرٌ لَّهُنَّ ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ

আর যেসব যৌবন অতিক্রান্ত মহিলা বিয়ের আশা রাখে না, তারা যদি নিজেদের চাদর নামিয়ে রেখে দেয়, তাহলে তাদের কোন গোনাহ নেই, তবে শর্ত হচ্ছে তারা সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী হবে না। তবু তারাও যদি লজ্জাশীলতা অবলম্বন করে তাহলে তা তাদের জন্য ভালো এবং আল্লাহ‌ সবকিছু শোনেন ও জানেন।সূরা আন-নুর: ৬০

‘বহির্বাস’ বলতে দেহের বাইরে বা উপরের লেবাস যা শালওয়ার-কামিজের উপর বড় চাদর বা বোরকারূপে ব্যবহার করা হয়, তা বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এই বয়সে তারা চাদর বা বোরকা খুলে রাখতে পারে। তবে শর্ত হল, যেন সৌন্দর্য, সাজসজ্জা ও প্রসাধন ইত্যাদির প্রকাশ উদ্দেশ্য না হয়। যার অর্থ হল, কোন নারী নিজের যৌন অনুভূতি শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যদি সাজগোজ (ও ঠসক) দ্বারা যৌনকামভাব প্রকাশ করার রোগে আক্রান্ত থাকে, তাহলে তার জন্য পর্দার ব্যাপারে কোন প্রকার শিথিলতা নেই; বরং তাকে পূর্ণরূপ পর্দা করতে হবে।

পরিশেষে আরো বলা হয়েছে (وَأَنْ يَسْتَعْفِفْنَ خَيْرٌ لَهُنَّ) অর্থাৎ সে যদি মাহরাম নয় এরূপ ব্যক্তিদের সামনে আসতে পুরোপুরি বিরত থাকে, তবে তা তার জন্য উত্তম।

ওকবা ইবনে আমের জুহানী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-তোমরা নারীদের নিকট যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক আনসারী সাহাবী আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! স্বামী পক্ষীয় আত্মীয় সম্পর্কে আপনি কী বলেন? তিনি বললে, সে তো মৃত্যু। -সহীহ বুখারী ৯/২৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২১৭২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৭১; মুসনাদে আহমাদ ৪/১৪৯, ১৫৩

হযরত আয়েশা রা. ইফ্কের দীর্ঘ হাদীসে বলেছেন-আমি আমার স্থানে বসে ছিলাম একসময় আমার চোখ দুটি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আসসুলামী ছিল বাহিনীর পিছনে আগমনকারী। সে যখন আমার অবস্থানস্থলের নিকট পৌছল তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেল। এরপর সে আমার নিকট এলে আমাকে চিনে ফেলল। কারণ পর্দা বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে তখন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলে ওঠে, যার দরুণ আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে নিজেকে আবৃত করে ফেলি।

অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আমি ওড়না দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি।-সহীহ বুখারী ৫/৩২০; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৭৭০; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩১৭৯

উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ছিলাম। উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা রা.ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম উপস্থিত হলেন। এটি ছিল পর্দা বিধানের পরের ঘটনা। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তার সামনে থেকে সরে যাও। আমরা বললাম, তিনি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখছেন না?! তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখছ না?-সুনানে আবু দাউদ ৪/৩৬১, হাদীস : ৪১১২; জামে তিরমিযী ৫/১০২, হাদীস : ২৭৭৯; মুসনাদে আহমাদ ৬/২৯৬; শরহুল মুসলিম, নববী ১০/৯৭; ফাতহুল বারী ৯/২৪৮

আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, আমরা পুরুষদের সামনে মুখমন্ডল আবৃত করে রাখতাম। …-মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪

ফাতিমা বিনতে মুনযির রাহ. বলেন, আমরা আসমা বিনতে আবু বকর রা.-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের মুখমন্ডল ঢেকে রাখতাম।-মুয়াত্তা, ইমাম মালেক ১/৩২৮; মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪

হযরত উমাইমা বিনতে রুকাইকা রা. থেকে বাইয়াত সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে যে, নারীগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের প্রতি আমাদের নিজেদের চেয়েও মেহেরবান। সুতরাং আপনার হাত মোবারক দিন, আমরা বাইয়াত হই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি নারীদের সাথে হাত মিলাই না। (যা মুখে বলেছি তা মেনে চলাই তোমাদের জন্য অপরিহার্য)।-মুয়াত্তা মালিক

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, আল্লাহর কসম! বাইয়াতের সময় তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) হাত কখনো কোনো নারীর হাত স্পর্শ করেনি। তিনি শুধু মুখে বলতেন, তোমাকে বাইয়াত করলাম।-সহীহ বুখারী ২/১০৭১

মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন: হে নবী! মু’মিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য বেশী পবিত্র পদ্ধতি। যা কিছু তারা করে আল্লাহ‌ তা জানেন।সূরা আন-নূর: ৩০

আর হে নবী! মু’মিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে আর তাঁদের সাজ-সজ্জা না দেখায় যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া। আর তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে।সূরা আন-নূর: ৩১

উপরোক্ত আয়াত দু’টিতে আল্লাহ তা’আলা মুসলিম নর-নারীদেরকে চক্ষু অবনমিত ও লজ্জাস্থানের হেফাজতের নির্দেশ দেন। মানুষের মন নির্লিপ্ত পাথর খণ্ড নয়। যা কিছুই আমাদের চোখে পড়ে, মন সে সম্পর্কে কিছু না কিছু ভেবে থাকে। যাবতীয় আপত্তিকর ও অকল্যাণকর বিষয় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখতে হবে। সেই ভাবে ফিরিয়ে রাখতে হবে, যে ভাবে আল্লাহর রাসূল সা:  বলেছেন।

রাসূল সা: হযরত আলী রা:কে বললেন, হে আলী! দৃষ্টির উপর দৃষ্টি ফেলো না। হঠাৎ যে দৃষ্টি পড়ে ওটা তোমার জন্য ক্ষমার্হ, কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমার যোগ্য নয়। আবু দাউদ

আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, পথের উপর বসা থেকে তোমরা বেঁচে থাকো। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসূল সা:! কাজ কর্মের জন্য এটাতো জরুরী। উত্তরে তিনি বললেন: আচ্ছা তাহলে পথের হক আদায় করো। সাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, পথের হক কী? তিনি বললেন, দৃষ্টি নিম্নমুখী করা, কাউকে কষ্ট না দেয়া, সালামের উত্তর দেয়া, ভাল কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা।মুসলিম: ৫৪০০

রাসূল সা:এর আদর্শ যদি স্কুল-কলেজে শেখানো হতো তাহলে আজ ইভটিজিংএর কবল থেকে অনেক মেয়েরাই রেহাই পেতো।

আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সা: বলেছেন, আদম সন্তানের জন্য তার ব্যভিচারের অংশ নির্ধারিত করা হয়েছে। সে তা অবশ্যই করবে। দু’চোখ-তাদের ব্যভিচার দেখা, দু’কান-তাদের ব্যভিচার শোনা। জিহবা-তার ব্যভিচার কথা বলা। হাত-তার ব্যভিচার ধরা। পা-তার ব্যভিচার চলা। মন-তা চায় ও আকাঙ্ক্ষা করে। আর গুপ্ত অংগ তাকে সত্য বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। মুসলিম: ৬৫৬৪ মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

তোমরা যেনার নিকটবর্তীও হইওনা। উহা অত্যন্ত খারাপ কাজ, আর উহা অতি নিকৃষ্ট পথ।সূরা বনী ইসরাঈল: ৩২

হযরত আয়েশা(রা) বলেন, “আমি দেখেছি, রাসূল সা: আমার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁর চাদর দিয়ে আমাকে পর্দা করছিলেন এবং আমি ইথিওপীয়-হাবশীদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তারা মসজিদের মধ্যে তাঁদের সড়কি-বল্লম নিয়ে খেলা করছিল। অতঃপর যতক্ষণ না আমি নিজে ক্লান্ত হতাম ততক্ষন তিঁনি আমার জন্য এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতেন। কাজেই তোমরা অল্পবয়স্কা খেলাধূলা-প্রিয় মেয়ের মর্যাদা-গুরুত্ব অনুধাবন করবে।বুখারী: ৫/২০০৬

মহান আল্লাহর বাণী:

﴿وَجَحَدُواْ بِهَا وَٱسۡتَيۡقَنَتۡهَآ أَنفُسُهُمۡ ظُلۡمٗا وَعُلُوّٗاۚ﴾ [النمل: ١٤]

“তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করলো যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ১৪]

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী(সঃ) আল্লাহর উক্তি বর্ণনা করেছেন- “দৃষ্টি হচ্ছে ইবলিসের বিষাক্ত তীরগুলোর মধ্য থেকে একটি তীর, যে ব্যক্তি আমাকে ভয় করে সে তা ত্যাগ করবে আমি তার বদলে তাকে এমন ঈমান দান করবো যার মিষ্টতা সে নিজের হৃদয়ে অনুভব করবে”। তাবারানী

নিষিদ্ধ দৃশ্যাবলী থেকে চোখকে অবনমিত রাখলে- যেমন নারী ও শ্মশ্রুবিহীন সুদর্শন পুরুষের দিকে নজর দেয়া থেকে চোখকে অবনমিত রাখলে তিন প্রকারের অতি মর্যাদাপূর্ণ ফায়দা পাওয়া যায়:

১। ঈমানের সুখ-স্বাদ আস্বাদন করা।

২। আত্মিক নূর ও অন্তর্দৃষ্টির আলোর অধিকারী হওয়া।

৩। আত্মিক শক্তি, দৃঢ়তা ও সাহসিকতা অর্জন।

কণ্ঠস্বরের শালীনতা(কণ্ঠস্বর হলো হৃদয়ের ভাষ্যকার।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন-

হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। সূরা আহযাব: ৩২

নারীর প্রতি শরীয়তের বিধান ও চাহিদা হল, তার কন্ঠস্বর যেন প্রয়োজন ছাড়া পরপুরুষ শুনতে না পায়। এ বিধান কেবল সাধারণ ক্ষেত্রেই নয়; বরং ইবাদত বন্দেগী ও আমলের ক্ষেত্রেও তা পূর্ণমাত্রায় লক্ষ রাখা হয়েছে। যেমন,

১. মুআযযিনের এত অধিক মর্যাদা থাকা সত্বেও নারী কন্ঠস্বর যেন বিনা প্রয়োজনে পরপুরুষ শুনতে না পায় এজন্য তাদের উপর আযানের বিধান দেয়া হয়নি।

২. উচ্চ আওয়াজ বিশিষ্ট ফরয নামাযের কেরাত তাদের জন্য নিম্ন আওয়াজে পড়ার বিধান রয়েছে।

৩. নামাযে ইমামের কোনো ভুল  হলে তা অবগত করানোর জন্য পুরুষ মুক্তাদীদেরকে সুবহানাল্লাহ বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নারীদেরকে তাসফীক অর্থাৎ এক হাতের পিঠ অন্য হাতের তালুতে মেরে শব্দ করতে বলা হয়েছে। যেন পুরুষরা আওয়াজকারী সম্পর্কে বিন্দুমাত্র বুঝতে না পারে।

৪. হজ্বের তালবিয়া পুরুষগণ উচ্চ আওয়াজে পড়বে। কিন্তু মহিলারা পড়বে নিম্ন আওয়াজে। হাঁ, প্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে পর্দার আড়ালে থেকে টুকটাক দরকারী কথা বলা নিষেধ নয়। তবে এক্ষেত্রেও কোমলতা, নম্রতা পরিহার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সহীহ বুখারী ও সহীহ ইবনে হিব্বানে বর্ণিত হয়েছে, একবার কিছু সংখ্যক নারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার মজলিসে পুরুষদের সাথে বসতে পারি না। আমাদের জন্য একটি দিন ধার্য করুন যাতে সেদিনটিতে আমরা আপনার নিকট আসতে পারি। তিনি বললেন موعدكن بيت فلانة অর্থাৎ নির্ধারিত দিন অমুক মহিলার ঘরে জমায়েত হও। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে তাদেরকে ওয়ায-নসীহত করলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৯৪১

আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ রা: থেকে বর্ণিত।তিনি বলেন, যে নারী উলকি আঁকে এবং যে আঁকায়, যে নারী চোখের পাতা চেঁছে ফেলে এবং যে চাঁছায়, যে নারী সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য দাত চেঁছে সরু করে এর মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন সাধন করে-এদের উপর আল্লাহ তা’লা অভিশাপ করেছেন। মুসলিম: ৫৪১০

আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সব নারীর উপর লানত করেছেন, যারা অঙ্গে উলকি আঁকে এবং যে আঁকায় এবং সৌন্দর্যের জন্য ভ্রুর চুল উপড়িয়ে আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে। তিরমিযী: ২৭১৯

উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা: বর্ণনা করেন, এক আনসারী মহিলা তাঁর মেয়ে বিয়ে দিল। অতঃপর সে রোগাক্রান্ত হলে তার চুল পড়ে যায়। মহিলাটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে আরজ করল, তার স্বামী চুল খুবই পছন্দ করে। আমি কি তাঁর মাথায় কৃত্রিম চুল লাগিয়ে দিব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে কৃত্রিম চুল লাগায় তাকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে। মুসলিম: ৫৪০৬

কিছু প্রশ্ন উত্তরঃ

উত্তর : ইসলামী শরী‘আতে পাকা চুলে কাল খেযাব বা কলপ ব্যবহার করা বৈধ নয় (ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৬৬)।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘শেষ যামানায় একদল লোক কবুতরের বুকের রঙের ন্যায় কাল কলপ ব্যবহার করবে। এ কারণেই তারা জান্নাতের কোন সুগন্ধিও পাবে না (আবূ দাঊদ, হা/৪২১২)।

আর চুলে খেযাব বা কালো রং ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন সাধন করা হয়। যাদেরকে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন সর্বাধিক পরিমাণ শাস্তি দিবেন (ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৫৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২১০৭; নাসাঈ, হা/৫৩৫৬; মিশকাত, হা/৪৪৯৫)।

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, মক্কাহ বিজয়ের দিন আবূ কুহাফাকে আনা হল। এ সময় তার মাথার চুল ও দাড়ি ছাগামাহ (গাছের) মত একেবারে সাদা ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, খেযাব লাগিয়ে এগুলো পরিবর্তন কর কিন্তু কালো রং বর্জন কর (ছহীহ মুসলিম, হা/২১০২; আবূ দাঊদ, হা/৪২০৪; নাসাঈ, হা/৫২৪২; ইবনু মাজাহ, হা/৩৬২৪)।

তবে মেহেদীর রং হল সর্বোত্তম খেযাব (আবূ দাঊদ, হা/৪২০৫; তিরমিযী, হা/১৭৫৩; মিশকাত, হা/৪৪৫১, সনদ ছহীহ)। উল্লেখ্য যে, নারীদের ক্ষেত্রেও একই বিধান (ছহীহ মুসলিম, হা/২১০২)।

এছাড়া পাকা চুলের অনেক বরকতপূর্ণ মর্যাদা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা পাকা চুল তুলে ফেলো না। কেননা পাকা চুল হল মুসলিমদের জ্যোতি। কোন মুসলিমের একটি চুল পেকে গেলে আল্লাহ তার জন্য একটি নেকী লিখেন, একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তার একটি পাপ মোচন করেন (মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৯৬২; মিশকাত, হা/৪৪৫৮, সনদ হাসান)।

অন্য বর্ণনায় আছে, ‘পাকা চুল মুসলিমদের জন্য ক্বিয়ামতের দিন নূর হবে’ (তিরমিযী, হা/১৬৩৪-১৬৩৫; নাসাঈ, হা/৩১৪৪; মিশকাত, হা/৪৪৫৯, সনদ ছহীহ)।

চুল-দাড়ি সাদা হয়ে গেলে, তা সাদাই ছেড়ে রাখা ঠিক নয়। বরং তা রঙিয়ে ফেলতে হয়। খোদ আল্লাহর রসূল (ﷺ) কলপ ব্যবহার করেছেন এবং উম্মতকে তা ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধও করেছেন। অতএব তা করা সুন্নাত। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, ‘‘ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা পাকা চুল-দাড়ি রঙায় না, তোমরা (তা রঙিয়ে) তাদের বিরোধিতা কর। বুখারী, মুসলিম, সুনানে আরবাআহ, সহীহুল জা’মে হা/১৯৯৮

কিন্তু কলপের রঙ কালো হওয়া চলবে না। কালো ছাড়া যে কোন রঙ দিয়ে কলপ করা যায়। অবশ্য কালচে লাল বা বাদামী রঙ সবচেয়ে উত্তম।

আল্লাহর রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘তোমরা যে সব জিনিস দিয়ে পাকা চুল-দাড়ি রঙিয়ে থাকো, তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো হল, মেহেদি ও কাতাম। আহমাদ, সুনানে আরবাআহ, ইবনে হিববান, সহীহুল জা’মে হা/১৫৪৬ ‘কাতাম’ এক শ্রেণীর গাছড়ার নাম, যার পাতা থেকে লালচে কালো রঙ প্রস্ত্তত করা হয়।

আর কালো রঙ ব্যবহার করা চলবে না, যেহেতু জাবের (রাঃ) বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন আবু কুহাফাকে আনা হল। তখন তাঁর চুল-দাড়ি ছিল ‘ষাগামা’ ফুলের মত সফেদ (সাদা)। রসূল (ﷺ) বললেন, ‘‘কোন রঙ দিয়ে এই সফেদিকে বদলে ফেল। আর কালো রঙ থেকে ওঁকে দূরে রাখ। মুসলিম, মিশকাত হা/ ৪৪২৪

আর সকলের উদ্দেশ্যে সাধারণ নির্দেশ দিয়ে আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, ‘‘শেষ যামানায় এমন এক শ্রেণীর লোক হবে; যারা পায়রার ছাতির মত কালো কলপ ব্যবহার করবে, তারা জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। আবূ দাউদ ৪২১২, নাসাঈ, সহীহুল জা’মে হা/৮১৫৩

প্রকাশ থাকে যে, কালো চুলকে অন্য রঙ দিয়ে রঙানো আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তাঁর সৃষ্টির পরিবর্তন ঘটানোর আওতাভুক্ত হতে পারে। সুতরাং তা বর্জনীয়। আবদুল হামীদ ফাইযী(ইসলামী জীবনধারা)

মহিলারা কি ঠোটে লিপিস্টিক লাগাতে পারবে, বিশেষ করে ছালাত আদায়কারী মহিলা?

আর যে অলংকারে লালিত-পালিত হয় এবং বিতর্ককালে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদানে অক্ষম’ (সূরা আয-যুখরূফ : ১৮)।

বিশেষভাবে বিবাহিতা মহিলাদের ক্ষেত্রে লিপিস্টিক, ব্লাশার (blush) বা অন্যান্য সৌন্দর্যোপকরণ ব্যবহার করা দোষণীয় নয় (উছায়মীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮২৮)।

হে নবী!) আপনি বলুন, আল্লাহ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব সুশোভন বস্তু বা সৌন্দর্যোপকরণ ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে’? (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩২)।

শায়খ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ বলেন, এই সমস্ত সাজসজ্জার উপকরণগুলো জায়েয হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত আছে।

১. পরপুরুষের সামনে সৌন্দর্য প্রদর্শন উদ্দেশ্যে না করা (আন-নূর : ৩১

২. উক্ত সুশোভন বস্তু কোন হারাম জিনিস দ্বারা নির্মিত না হওয়া। যেমন শুকুরের চর্বি (সূরা আন-আন‘আম : ১৪৫)।

৩. সেগুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকারক না হওয়া

(ইসলাম সুওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৩৪৬৬)।

লম্বা নখে সৌন্দর্য নেই। অবশ্য বিকৃত পছন্দের অনেকের নিকট তা থাকতে পারে। কিন্তু শরীয়তে নখ লম্বা

করার অনুমতি নেই। বরং মানুষের প্রকৃতি তা লম্বা রাখার বিরোধী। তাই চল্লিশ দিনের মাথায় তা কেটে ফেলতেই হবে। মহানবী ﷺ বলেছেন, “প্রকৃতিগত আচরণ পাঁচটি অথবা পাঁচটি কাজ প্রকৃতিগত আচরণ,

(১) খাতনা (লিঙ্গত্বক ছেদন) করা।

(২) লজ্জাস্থনের লোম কেটে পরিষ্কার করা।

(৩) নখ কাটা।

(৪) বগলের লোম ছিঁড়া।

(৫) গোঁফ ছেঁটে ফেলা।” (বুখারী ও মুসলিম)

আনাস (রাঃ) বলেন, ‘মোছ ছাঁটা’, নখ কাটা, নাভির নিচের লোম চাঁছা এবং বগলের লোম তুলে ফেলার ব্যপারে আমাদেরকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যাতে আমরা সে সব চল্লিশ দিনের বেশী ছেড়ে না রাখি। মুসলিম ২৫৮

নখ কেটে ফেলা মানুষের এক প্রকৃতিগত রীতি। প্রতি সপ্তাহে একবার না পারলেও ৪০ দিনের ভিতর কেটে ফেলতে হয়।

সূত্রঃ দ্বীনী প্রশ্নোত্তর লেখকঃ আব্দুল হামিদ ফাইযী আল মাদানী

প্রশ্নঃ মডার্ন কালার দিয়ে চুল রঙ করা কি জায়েয আছে? যেমন লরিয়েল (Loreal) ও বিগেন (Bigen)… এর মত কোম্পানীগুলোর প্রডাক্ট দিয়ে?

উত্তরঃ আলহামদু লিল্লাহ।

চুল কালার করা এটি অভ্যাস শ্রেণীর কর্ম। অভ্যাস শ্রেণীর কর্মের মূল বিধান হচ্ছে— বৈধতা। অতএব, মডার্ন কালার ও অন্যান্য কালার দিয়ে চুল রঙ করা জায়েয; যদি না সে কালার দিয়ে বার্ধক্যের শুভ্রতাকে পরিবর্তন করা না হয়, কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করা না হয় কিংবা এর স্বাস্থ্যগত কোন ক্ষতি সাব্যস্ত না হয়।

শাইখ উছাইমীনের “ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব” এসেছে:

“ইবাদত ব্যতিরেকে অন্য বিষয়গুলোর মূল বিধান হচ্ছে বৈধতা। এর আলোকে নারীর জন্য তার মাথার চুল কালার করা বৈধ; যে রঙ দিয়ে ইচ্ছা হয় সেই রঙ দিয়ে; তবে কালো রঙ দিয়ে নয়। যা দিয়ে বার্ধক্যের শুভ্রতাকে আড়াল করা হয়। কেননা কালো রঙ দেয়া জায়েয নয়। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বার্ধক্যের শুভ্রতাকে আড়াল করার নির্দেশ দিয়েছেন; তবে বলেছেন: “কালো রঙ পরিহার করবে।” কিংবা এ রঙগুলো যদি কাফের নারীদের জন্য খাস হয়; অর্থাৎ এ রঙ ব্যবহারকারী নারীকে দেখে যে কেউ বলবে: কাফের মহিলা। যেহেতু এ রঙ কেবল কাফের নারীরাই ব্যবহার করে। তখন এ রঙ ব্যবহার করা নারীদের জন্য হারাম হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদের দলভুক্ত”। যদি এ রঙ এ দুটো বিষয় মুক্ত হয়: অর্থাৎ বার্ধক্যের শুভ্রতাকে আড়ালকারী কালো রঙ হওয়া এবং রঙটি কাফের নারীদের জন্য খাস হওয়া— তাহলে মূল বিধান হল বৈধতা। সুতরাং নারী যে রঙ ইচ্ছা সেই রঙ দিয়ে চুল কালার করুক।”[ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব (২/২২)]

শাইখ উছাইমীনকে আরও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: বাজারে যে সব ক্যামিকেল কালার পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে চুলের রঙ পরিবর্তন করা কি হারাম? জবাবে তিনি বলেন: চুলের রঙ সাদা থেকে কালো করা নাজায়েয। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কালো রঙ পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে উদ্ধৃত এক হাদিসে চুলের শুভ্রতাকে কালো রঙ করার ব্যাপারে শাস্তির ধমকি এসেছে। পক্ষান্তরে, চুলে অন্যান্য কালার করা: এতে কোন আপত্তি নাই। কেননা এর মূল বিধান হল: বৈধতা; যতক্ষণ না নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে কোন দলিল পাওয়া যায়। তবে এ রঙ করার মধ্যে যদি কাফের নারীদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ থাকে তাহলে হারাম হবে। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদের দলভুক্ত”। এ নারীর তার প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন যে, এই রঙ ক্যামিকেল দিয়ে তৈরী। এমনটি হলে এ ক্ষেত্রে ডাক্তারদের শরণাপন্ন হতে হবে। জানতে হবে, এ ধরণের রঙ কি মাথার চুল ও চামড়ার কোন ক্ষতি করবে? যদি ক্ষতি সাব্যস্ত হয় তাহলে এগুলো ব্যবহার করা জায়েয হবে না।”[শাইখ উছাইমীনের ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব (২/২২) থেকে সমাপ্ত] আরও জানতে দেখুন: 45191 নং প্রশ্নোত্তর।

প্রশ্ন: কয়েক মাসের জন্য চোখের পাপড়ি কার্ল করা ও মাশকারা করার বিধান কী?

উত্তরঃ আলহামদুলিল্লাহ। ইসলামে রূপচর্চার মূল বিধান হচ্ছে বৈধতা।

আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “বলুন, আল্লাহ্‌ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব সজ্জা ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে? বলুন, পার্থিব জীবনে, বিশেষ করে কেয়ামতের দিনে এ সব তাদের জন্য যারা ঈমান আনে। এভাবে আমরা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করি।”[সূরা আরাফ, আয়াত: ৩২]

বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে সাজ-সজ্জা একটি উপকারী অভ্যাস। কেননা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মজবুতিতে এটি ভূমিকা রাখে। যে কোন উপকারী অভ্যাসের মূল বিধান হচ্ছে- বৈধতা।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন: “বান্দার যাবতীয় কথা ও কাজ দুই শ্রেণীর:

– ইবাদতশ্রেণীর; এগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তির দ্বীনদারি ঠিক থাকে।

– অভ্যাসশ্রেণীর; দুনিয়ার জিন্দেগীতে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

ইসলামি শরিয়তের যাবতীয় মূলনীতি আয়ত্ব করার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, যে ইবাদতগুলো আল্লাহ্ বান্দার উপর ফরজ করেছেন কিংবা যে ইবাদতগুলো পালন করা পছন্দ করেন সেগুলো শরিয়তের দলিল ছাড়া সাব্যস্ত হয় না।

আর অভ্যাসগুলো: সেগুলো হচ্ছে দুনিয়ার জীবনে মানুষ যেগুলো করে অভ্যস্থ, যেগুলো করা তাদের প্রয়োজন, সে সবের বিধান হচ্ছে বৈধতা। সেগুলোর মধ্যে আল্লাহ্‌ যেসবকে নিষেধ করেছেন সেগুলো ছাড়া অন্যকিছুকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যাবে না।

অভ্যাস জাতীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে সেটার বৈধতা। সুতরাং আল্লাহ্‌ যা হারাম করেছেন সেটা ছাড়া অন্য কিছু হারাম ঘোষণা দেয়া যাবে না। অন্যথায় আমরা আল্লাহ্‌র সে বাণীর অধীনে পড়ে যাব: “বলুন, তোমরা আমাকে জানাও, আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছেন তারপর তোমরা তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ, বলুন, আল্লাহ্‌ কি তোমাদেরকে এটার অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহ্‌র উপর মিথ্যা রটনা করছ?”[সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৯]

এ কারণে আল্লাহ্‌ মুশরিকদের নিন্দা করেছেন যারা আল্লাহ্‌ যা অনুমোদন করেননি দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু বিধান জারী করেছে এবং আল্লাহ্‌ যা হারাম করেননি এমন কিছুকে যারা হারাম করেছে…। এটি একটি সুমহান ও উপকারী সূত্র।[মাজমুউল ফাতাওয়া (২৯/১৬-১৮)]

চোখের পাপড়ি কার্ল করা ও মাশকারা করা: আমরা এমন কোন শরয়ি দলিল জানি না যাতে এগুলো করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং পূর্বের আলোচনার আলোকে এগুলো করা বৈধ; এটাই মূল বিধান।

তবে, কোন নারীর জন্য বেগানা পুরুষকে সৌন্দর্য্য প্রদর্শন করা থেকে সাবধান থাকা আবশ্যকীয়; কেননা এটি নাজায়েয।

আরও জানতে দেখুন: 148664 নং ও 113725 নং প্রশ্নোত্তর।

আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন। সূত্রঃ islamqa.info

মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন

তোমাদের কাছে যে জ্ঞান এসেছে তা লাভ করার পর যদি তোমরা তাদের ইচ্ছা ও বাসনার অনুসারী হও, তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরা জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।সূরা বাকারা: ১৪৫

হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং শোনার পর তা থেকে বিমুখ হয়ো না। আর তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা বলে যে, আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনেনা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’লার নিকট সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই মূক ও বধির, যারা উপলদ্ধি করে না। সূরা আনফাল: ২০-২২

মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধরে নাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো। সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই, আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে।সূরা আনফাল: ১-২