সূরা ইউনুসঃ ১ম রুকু (আয়াত ১-১০নং)

 সূরা ইউনুসঃ ১ম রুকু (আয়াত ১-১০নং)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

১০:১ الٓرٰ ۟ تِلۡکَ اٰیٰتُ الۡکِتٰبِ الۡحَکِیۡمِ ﴿

আলিফ-লাম-রা। এগুলো প্রজ্ঞাপূর্ণ কিতাবের আয়াত।

এগুলোকে হরফে মোকাত্তা’আত’ বলা হয়। এগুলোর আলোচনা পূর্বে সূরা আল-বাকারায় করা হয়েছে।

 সূরা আল বাকারাঃ ১ম রুকু (আয়াত সংখ্যাঃ১-৭)

الحَكِيْمِ (বিজ্ঞানময়) কিতাব অর্থাৎ, কুরআন কারীমের বিশেষণ। এর একটি অর্থ তাই যা অনুবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। তার আরো কয়েকটি অর্থ করা হয়েছে। যেমন الْمُحْكَمِ – অর্থাৎ, হালাল ও হারাম এবং দন্ডবিধি ও যাবতীয় বিধান দানে মযবুত। حَكِيْمٌ -حَاكِمٌ এর অর্থে। অর্থাৎ, মতভেদ ইত্যাদিতে মানুষের মাঝে ফায়সালা বা সমাধান দাতা গ্রন্থ। (সূরা বাক্বারাহঃ ২৩) حكيم – محكوم فيه এর অর্থে। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা এই কুরআনে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে ফায়সালা দিয়েছেন।

সমস্ত জ্ঞানের ভান্ডার পূর্ণভাবে সঞ্চিত হওয়ার কারণে কালামুল্লাহকে ‘কুরআন’ বলা হয়েছে। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) একথা বলেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/২৪১)।

আল্লাহ বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّعَدْلاً ‘তোমার প্রভুর কালাম সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ’ (আন‘আম ৬/১১৫)। অর্থাৎ কুরআনের প্রতিটি কথাই সত্য এবং প্রতিটি বিধানই ন্যায় ও ইনছাফপূর্ণ।

ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ এই কিতাবে কোনরূপ ত্রুটি বা সন্দেহ নেই (বাক্বারাহ ২/২)। কুরআন ব্যতীত পৃথিবীতে এমন কোন ধর্মগ্রন্থ নেই, যা তার শুরুতেই নিজেকে সন্দেহমুক্ত বলে ঘোষণা করেছে।

১০:২ اَکَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا اَنۡ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰی رَجُلٍ مِّنۡهُمۡ اَنۡ اَنۡذِرِ النَّاسَ وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنَّ لَهُمۡ قَدَمَ صِدۡقٍ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ ؕؔ قَالَ الۡکٰفِرُوۡنَ اِنَّ هٰذَا لَسٰحِرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿

মানুষের জন্য এটা কি আশ্চর্যের বিষয় যে, আমরা তাদেরই একজনের কাছে ওহী পাঠিয়েছি এ মর্মে যে, আপনি মানুষকে সতর্ক করুন এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্য তাদের রবের কাছে আছে উচ্চ মর্যাদা। কাফিররা বলে, এ তো এক সুস্পষ্ট জাদুকর।

এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কাফের মুশরিকদের একটি সন্দেহ ও তার উত্তর তুলে ধরেছেন। সন্দেহটি ছিল এই যে, কাফেররা তাদের মূর্খতার দরুন সাব্যস্ত করে রেখেছিল যে, আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে যে নবী বা রাসূল আসবেন তিনি মানুষ হবেন না। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাদের এ সন্দেহকে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটা যে শুধু কুরাইশ কাফেরদের সন্দেহ তা নয়।

পূর্ববর্তী উম্মতরাও তা বলেছিল। তারা বলেছিল “মানুষই কি আমাদেরকে পথের সন্ধান দেবে?” [সূরা আত-তাগাবুনঃ ৬]

নূহ ও হুদ এর কাওমও এ রকম বিস্মিত হয়েছিল। তখন নবীগণ তার জবাবে বলেছেন, “তোমরা কি বিস্মিত হচ্ছ যে, তোমাদেরই একজনের মাধ্যমে তোমাদের রবের কাছ থেকে তোমাদের কাছে উপদেশ এসেছে?” [সূরা আল-আরাফঃ ৬৩; ৬৯]

অনুরূপভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাওমও বলেছে, “সে কি বহু ইলাহকে এক ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? এটা তো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! [সূরা সোয়াদঃ ৫] ইবন আব্বাস বলেন, যখন আল্লাহ্ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূল হিসেবে পাঠালেন তখন আরবরা সেটা মানতে অস্বীকার করেছিল। অথবা তাদের মধ্যে অনেকেই এ জন্য অস্বীকার করেছিল যে, আল্লাহ মহান যে তিনি তাঁর রাসূল বানাবেন মুহাম্মাদের মত একজন মানুষকে। তিনি এটা করতেই পারেন না। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। [ইবন কাসীর]

আল্লাহ তা’আলা তাদের এই ভ্রান্ত ধারণার উত্তর কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রকারে দিয়েছেন। এক আয়াতে বলেছেনঃ “যমীনের উপর যদি ফিরিশতারা বাস করত, তাহলে আমি তাদের জন্য কোন ফিরিশতাকেই রাসূল বানিয়ে পাঠাতাম।” [আল-ইসরাঃ ৯৫] যার মূল কথা হল এই যে, রিসালাতের উদ্দেশ্য ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাসূল এবং যাদের মধ্যে রাসূল পাঠানো হচ্ছে এ দুয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকে। বস্তুতঃ ফিরিশতার সম্পর্ক থাকে ফিরিশতাদের সাথে আর মানুষের সম্পর্ক থাকে মানুষের সাথে। যখন মানুষের জন্য রাসূল পাঠানোই উদ্দেশ্য, তখন কোন মানুষকেই রাসূল বানানো উচিত।

এ বাক্যের দ্বারা সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। ইবনে আব্বাস বলেন, এর অর্থ ‘যিকরুল আউয়াল’ তথা লাওহে মাহফুযে তাদের তাকদীরে সৌভাগ্যবান লিখা হয়েছে। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, তারা যে উত্তম আমল পেশ করেছে সে জন্য উত্তম প্রতিদান রয়েছে। [ইবন কাসীর; সাদী] অতএব, বাক্যের অর্থ দাঁড়ালো এই যে, ঈমানদারদেরকে এ সুসংবাদ দিয়ে দিন যে, তাদের জন্য তাদের পালনকর্তার কাছে অনেক বড় সম্মানিত মর্যাদা রয়েছে যা তারা নিশ্চিতই পাবে এবং পাওয়ার পর কখনো তা শেষ হয়ে যাবে না। চিরকালই তারা সে সম্মানিত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকবেন। এ আয়াতের তাফসীর যদি আমরা কুরআনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, এর সমার্থে সূরা আল-কাহফের ১-৩ নং আয়াতে এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, তারা সেখানে সর্বদা অবস্থান করবে।

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنزَلَ عَلَىٰ عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَل لَّهُ عِوَجًا ۜ﴾

১) প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন এবং এর মধ্যে কোনো বক্রতা রাখেননি৷

﴿قَيِّمًا لِّيُنذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِّن لَّدُنْهُ وَيُبَشِّرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا﴾

২) একদম সোজা কথা বলার কিতাব, যাতে লোকদেরকে আল্লাহর কঠিন শাস্তি থেকে সে সাবধান করে দেয় এবং ঈমান এনে যারা সৎকাজ করে তাদেরকে সুখবর দিয়ে দেয় এ মর্মে যে, তাদের জন্য রয়েছে ভালো প্রতিদান৷

﴿مَّاكِثِينَ فِيهِ أَبَدًا﴾

৩) সেখানে তারা থাকবে চিরকাল৷

মুজাহিদ বলেন, এর দ্বারা পূর্বে তারা যে আমল করেছে যেমন, তাদের সালাত, সাওম, সাদকা, তাসবীহ ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর]

কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, এক্ষেত্রে صدق শব্দ প্রয়োগের মাঝে এমন ইশারা করাও উদ্দেশ্য যে, জান্নাতের এসব উচ্চমর্যাদা একমাত্র সত্যনিষ্ঠা ও ইখলাসের কারণেই পাওয়া যাবে। কোন কোন মুফাসসির বলেন এখানে যাবতীয় কল্যাণ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। মুজাহিদ রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ এখানে (قَدَمَ صِدْقٍ) বলে তাদের সৎকর্মকাণ্ডসমূহকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন, তাদের সালাত, সাওম, সাদকা, তাসবীহ ইত্যাদি। [ফাতহুল কাদীর]

নবীর পরে এই দায়িত্ব উম্মতে মুহাম্মদীর

﴿كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّ

এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল৷ তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য ৷৮  তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো৷সূরা আলে ইমরানঃ ১১০

তারা তাঁকে(রাসূল সা) যাদুকর বলে দোষারোপ করলো কিন্তু এ দোষ তার ওপর আরোপিত হয় কিনা একথা চিন্তা করলো না৷ কোন ব্যক্তি উন্নত বক্তৃতা ও ভাষণ দানের মাধ্যমে মানুষের মন -মস্তিষ্ক জয় করে ফেললেই সে যাদুকরের কাজ করছে এ কথা বলা চলে না৷ দেখতে হবে এ বক্তৃতা -বিবৃতির মাধ্যমে সে কি বলছে? কি উদ্দেশ্যে তার বাগ্নীতার শক্তি ব্যবহার করছে? এ বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে ঈমানদারদের জীবনে কোন ধরনের প্রভাব পড়ছে? যে বক্তা কোন অবৈধ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তার বাগ্মীতার অসাধারণ শক্তি ব্যবহার করে সে তো একজন নির্লজ্জ ,নিয়ন্ত্রণহীন ও দায়িত্বহীন বক্তা৷ সত্য, ইনসাফ ও ন্যায়নীতিমুক্ত হয়ে সে এমন সব কথা বলে দেয়, যার প্রত্যেকটি কথা শ্রোতাদের প্রভাবিত করে তা যতই মিথ্যা অতিরঞ্জিত ও অন্যায় হোক না কেন৷ তার কথায় বিজ্ঞতার পরিবর্তে থাকে জনতাকে প্রতারণা করার ফন্দী৷ কোন সুশৃংখল ও সমন্বিত চিন্তাধারার পরিবর্তে সেখানে থাকে স্ববিরোধিতা ও অসামঞ্জস্য৷ ভারসাম্যের পরিবর্তে থাকে অসমতা৷ সে নিছক নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বড় বড় বুলি আওড়ায় অথবা বাগ্মীতার মদে মত্ত করে পরষ্পরকে লড়াবার এবং এক দলকে অন্য দলের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার জন্য উষ্কানী দেয়৷ লোকদের ওপর এর যে প্রভাব পড়ে তার ফলে তাদের কোন নৈতিক উন্নতি সাধিত হয় না৷এবং তাদের জীবনে কোন শুভ পরিবর্তনও দেখা দেয় না৷ অথবা কোন সৎচিন্তা কিংবা সৎকর্মময় পরিবেশ জন্ম লাভ করে না৷ বরং লোকেরা আগের চাইতেও খারাপ চরিত্রের প্রদর্শনী করতে থাকে৷ অথচ এখানে তোমরা দেখতে পাচ্ছো, নবী যে কালাম পেশ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে সুগভীর তত্বজ্ঞান, একটি উপযোগী ও সমন্বিত চিন্তা ব্যবস্থা, সর্বোচ্চ পর্যায়ের সমতা ও ভারসাম্য, সত্য ও ন্যায়নীতির কঠোর ব্যবস্থাপনা ৷ প্রতিটি শব্দ মাপাজোকাএবং প্রতিটি বাক্য পাল্লায়, ওজন করা৷ তার বক্তৃতায় মানুষের সংশোধন ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য চিহ্নিত করা যেতে পারে না৷ তিনি যা কিছু বলে থাকেন তার মধ্যে তার নিজের পরিবারের জাতির বা কোন প্রকার দুনিয়াবী স্বার্থের কোন গন্ধই পাওয়া যায় না৷ লোকেরা যে গাফলতির মধ্যে ডুবে আছে তিনি শুধু তাদেরকে তার খারাপ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেন এবং যে পথে তাদের নিজেদের কল্যাণ সে দিকে তাদেরকে আহবান জানান৷ তারপর তার বক্তৃতার যে প্রভাব পড়ে তাও যাদুকুরদের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের৷ এখানে যে ব্যক্তিই তার প্রভাব গ্রহণ করেছে তার জীবনেই সুন্দর ও সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে৷ সে আগের তুলনায় উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়েছে৷ তার সকল কাজে কল্যাণ ও সৎবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠেছে৷ এখন তোমরা নিজেরই চিন্তা করো, সত্যিই কি যাদুকর এমন কথা বলে এবং তার যাদুর ফলাফল কি এমনটিই হয়?

১০:৩ اِنَّ رَبَّکُمُ اللّٰهُ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ یُدَبِّرُ الۡاَمۡرَ ؕ مَا مِنۡ شَفِیۡعٍ اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ اِذۡنِهٖ ؕ ذٰلِکُمُ اللّٰهُ رَبُّکُمۡ فَاعۡبُدُوۡهُ ؕ اَفَلَا تَذَکَّرُوۡنَ ﴿

৩. তোমাদের রব তো আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশের উপর উঠলেন। তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন। তার অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব; কাজেই তোমরা তারই ইবাদাত কর। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?

এ আয়াতে তাওহীদকে এমন অনস্বীকার্য বাস্তবতার দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, আসমান ও যমীনকে সৃষ্টি করার মধ্যে অতঃপর সমস্ত কাজকর্ম পরিচালনার মধ্যে যখন আল্লাহ তা’আলার কোন শরীক-অংশীদার নেই, তখন ইবাদাত-বন্দেগী এবং হুকুম পালনের ক্ষেত্রে অন্য কেউ কি করে শরীক হতে পারে? বরং এতে (ইবাদাতে) অন্য কাউকে শরীক করা একান্তই অবিচার এবং সীমালঙ্ঘনের শামিল।

মহান রবের অন্যতম সৃষ্টিঃ

এখানে বলা হয়েছে আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন।

কুর’আনের অন্যত্র যা বলা হয়েছে—–

১। নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেন,অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনিই দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন; ওদের একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজিকে, যা তাঁরই আজ্ঞাধীন। জেনে রাখ, সৃষ্টি করা এবং নির্দেশদান তাঁরই কাজ। তিনি মহিমময় বিশ্ব প্রতিপালক। আল আরাফঃ ৫৪

২। আল্লাহ; যিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তাঁর বিরুদ্ধে তোমাদের কোন অভিভাবক অথবা সুপারিশকারী নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? সূরা সাজদাহঃ ৪

৩। তিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের অন্তর্বর্তী সবকিছু ছয়দিনে সৃস্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন। তিনি পরম দয়াময়। তাঁর সম্পর্কে যিনি অবগত, তাকে জিজ্ঞেস কর। ফুরকানঃ ৫৯

৪। আমি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যস্থিত সব কিছু সৃষ্টি করেছি ছয় দিনে; আমাকে কোন ক্লান্তি স্পর্শ করেনি। ক্বাফঃ ৩৮

৫। বলুন, তোমরা কি তাঁর সাথেই কুফরী করবে। যিনি যমীন সৃষ্টি করেছেন দু’দিনে এবং তোমরা কি তাঁর সমকক্ষ তৈরী করছ? তিনি সৃষ্টিকুলের রব্ব্‌!

আর তিনি স্থাপন করেছেন অটল পর্বতমালা ভূপৃষ্ঠে এবং তাতে দিয়েছেন বরকত এবং চার দিনের মধ্যে এতে খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন সমভাবে যাচ্ঞাকারীদের জন্য।

তারপর তিনি আসমানের প্রতি ইচ্ছে করলেন, যা (পূর্বে) ছিল ধোঁয়া। অতঃপর তিনি ওটাকে (আসমান) ও যমীনকে বললেন, তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা আসলাম অনুগত হয়ে।

অত:পর তিনি সেগুলোকে সাত আসমানে পরিণত করলেন দু’দিনে এবং প্রত্যেক আসমানে তার নির্দেশ ওহী করে পাঠালেন এবং আমরা নিকটবর্তী আসমানকে সুশোভিত করলাম প্রদীপমালা দ্বারা এবং করলাম সুরক্ষিত। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের ব্যবস্থাপনা। হামীম আস সাজদাহঃ ৯-১২

এই ছয় দিন হল, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার এবং বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। জুমআর দিনেই আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে।

শনিবারের দিন সম্পর্কে বলা হয় যে,

এ দিনে কোন কিছু সৃষ্টি করা হয় নি। এই জন্যই এ দিনকে يوم السبت (শনিবারের দিন) বলা হয়। কারণ, سبت এর অর্থ ছিন্ন করা। অর্থাৎ, এ দিনে সৃষ্টি করার কাজ ছিন্ন বা শেষ ছিল। অতঃপর এই দিনগুলোর মধ্যে কোন্ দিন বুঝানো হয়েছে? আমাদের দুনিয়ার এই দিন, যা সূর্যোদয় থেকে আরম্ভ হয়ে সূর্যাস্ত গেলে শেষ হয়ে যায়? নাকি এ দিন হাজার বছরের সমান দিন? যেভাবে আল্লাহর নিকট দিনের গণনা হয় সেই দিন, না যেভাবে কিয়ামতের দিনের ব্যাপারে আসে সেই দিন? বাহ্যতঃ দ্বিতীয় এই উক্তিই সর্বাধিক সঠিক মনে হচ্ছে।

কারণ,

প্রথমতঃ সে সময় চাঁদ ও সূর্যের এই নিয়মই ছিল না। আসমান ও যমীন সৃষ্টির পরই এ নিয়ম চালু হয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ এটা ঊর্ধ্ব জগতের ব্যাপার যার দুনিয়ার রাত-দিনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কাজেই এই দিনের প্রকৃতার্থ মহান আল্লাহই বেশী ভাল জানেন। আমরা নিশ্চয়তার সাথে কিছু বলতে পারি না।

তাছাড়া মহান আল্লাহ তো كُنْ শব্দ দ্বারা সব কিছুই সৃষ্টি করতে পারতেন, তা সত্ত্বেও তিনি প্রতিটি জিনিসকে পৃথক পৃথকভাবে পর্যায়ক্রমে বানিয়েছেন কেন? এরও যুক্তি ও কৌশলগত ব্যাপারে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞাত।

এখানে প্রশ্ন হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলা সমগ্র বিশ্বকে মুহুর্তের মধ্যে সৃষ্টি করতে সক্ষম। স্বযং কুরআনুল কারীমেও বিভিন্ন ভঙ্গিতে একথা বার বার বলা হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছেঃ “এক নিমেষের মধ্যে আমার আদেশ কার্যকরী হয়ে যায়।” [সূরা আল-কামারঃ ৫০]

আবার কোথাও বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ তা’আলা যখন কোন বস্তু সৃষ্টি করতে চান, তখন বলে দেনঃ হয়ে যাও।” আর সঙ্গে সঙ্গে তা সৃষ্টি হয়ে যায়।” [যেমন, সূরা আল-বাকারাহঃ ১১৭] এমতাবস্থায় বিশ্ব সৃষ্টিতে ছয় দিন লাগার কারণ কি? তাফসীরবিদ সায়ীদ ইবন জুবাইর রাহিমাহুল্লাহ এ প্রশ্নের উত্তরে বলেনঃ আল্লাহ তা’আলার মহাশক্তি নিঃসন্দেহে এক নিমেষে সব কিছু সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু মানুষকে বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালনার ধারাবাহিকতা ও কর্মতৎপরতা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এতে ছয় দিন ব্যয় করা হয়েছে। আর আল্লাহই অধিক জানেন।

প্রথমে পৃথিবীর উপকরণ সৃজিত হয়েছে। এমতাবস্থায়ই ধুম্রকুঞ্জের আকারে আকাশের উপকরণ নির্মিত হয়েছে। এরপর পৃথিবীকে বর্তমান আকারে বিস্তৃত করা হয়েছে এবং এতে পর্বতমালা, বৃক্ষ ইত্যাদি সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর আকাশের তরল ধূম্রকুঞ্জের উপকরণকে সপ্ত আকাশে পরিণত করা হয়েছে। সবগুলো আয়াতই এই বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। বাকী প্রকৃত অবস্থা আল্লাহ্ তা’আলাই জানেন। সহীহ বুখারীতে এ আয়াতের অধীনে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে কতিপয় প্রশ্ন ও উত্তর বর্ণিত হয়েছে। তাতে ইবন আব্বাস এ আয়াতের উপযুক্তরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। [বুখারী কিতাবুত তাফসীর, বাব হা-মীম-আস-সাজদাহ]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার হাত ধরে বললেন, “আল্লাহ্ মাটি সৃষ্টি করেছেন শনিবার, আর তাতে পাহাড় সৃষ্টি করেছেন রবিবার, গাছ-গাছালি সোমবার, অপছন্দনীয় সবকিছু মঙ্গলবার, আলো সৃষ্টি করেছেন বুধবার, আর যমীনে জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন বৃহস্পতিবার। আর আদমকে শুক্রবার আছরের পরে সর্বশেষ সৃষ্টি হিসেবে দিনের সর্বশেষ প্রহরে আসর থেকে রাত পর্যন্ত সময়ে সৃষ্টি করেছেন।” [মুসলিম: ২৭৮৯] এই হিসাব মতে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি সাত দিনে হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু কুরআনের আয়াত থেকে পরিস্কারভাবে জানা যায় যে, এই সৃষ্টিকাজ ছয় দিনে হয়েছে।

এক আয়াতে আছেঃ “আমি আকাশ পৃথিবী ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছি এবং আমাকে কোন ক্লান্তি স্পর্শ করেনি।” [সূরা কাফ: ৩৮]

সারকথা এই যে, পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহকে একত্রিত করার ফলে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিতরূপে জনা যায়,

প্রথমত: আকাশ, পৃথিবী ও এতদূভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু মাত্র ছয় দিনে সৃজিত হয়েছে।

সূরা হা-মীম সেজদার আয়াত থেকে দ্বিতীয়ত: জানা যায় যে, পৃথিবী, পর্বতমালা, বৃক্ষরাজি ইত্যাদি সৃষ্টিতে পূর্ণ চার দিন লেগেছে।

তৃতীয়ত: জানা যায় যে, আকাশমন্ডলীর সৃজনে দুদিন লেগেছিল।

চতুর্থত: আসমান, যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সৃষ্টির পর যমীনকে বসবাসের উপযোগী করতে সাতদিন লেগেছিল। এ সাতদিনের সর্বশেষ দিন শুক্রবারের কিছু অংশ বেঁচে গিয়েছিল, যাতে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছিল।

তারপর বলেছেন (ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ) অর্থাৎ আরশের উপর উঠেছেন। কুরআন এবং হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, আল্লাহ্ তা’আলার আরশ এক প্রকাণ্ড সৃষ্টি আর তা সমস্ত সৃষ্টিজগতের ছাদস্বরূপ। আল্লাহ্ তা’আলা তার আরশের উপর উঠা বাস্তব বিষয়। এটা আল্লাহর একটি মহান কার্যগত গুণ। তিনি যে রকম তার আরশের উপর উঠাও সেরকম। আমরা তার আরশের উপর উঠা কথাটা বুঝি তবে সে উঠার ধরণ আমরা জানিনা। আল্লাহর আরশের উপর উঠা সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা সূরা আল-বাকারায় করা হয়েছে।

اسْتِوَآءٌ এর অর্থ হল, উপরে ওঠা, সমাসীন হওয়া। সালাফগণ কোন ধরণ নির্ণয় ও সাদৃশ্য স্থাপন ছাড়াই এই অর্থই করেছেন। অর্থাৎ, মহান আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন ও অধিষ্ঠিত। তবে কিভাবে এবং কোন্ ধরনের তা আমরা না বর্ণনা করতে পারব, আর না কারো সাথে তার সাদৃশ্য স্থাপন করতে পারব। নাঈম ইবনে হাম্মাদের উক্তি হল,

“যে ব্যক্তি আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করল, সে কুফরী করল এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নিজের ব্যাপারে বর্ণিত কোন কথাকে অস্বীকার করল, সেও কুফরী করল।”

অতএব আল্লাহ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহর অথবা তাঁর রসূলের বর্ণিত কথাকে বর্ণনা করা সাদৃশ্য স্থাপন করা নয়। কাজেই আল্লাহ সম্পর্কে যে কথাগুলো কুরআন ও হাদীসের আলোকে প্রমাণিত, কোন অপব্যাখ্যা, ধরণ-গঠন নির্ণয় এবং সাদৃশ্য স্থাপন করা ছাড়াই তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরী।(ইবনে কাসীর)

আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে সমুন্নত। এই কথা কুরআনের সাত জায়গায় বলা হয়েছে।

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি আসমান-যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। সূরা আরাফ ৫৪

২। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি আসমান-যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন’ সূরা ইউনূসঃ ৩ নং ।

৩।  আল্লহ তাআলা বলেন,

﴿اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

‘আল্লাহই ঊর্ধবদেশে আকাশমন্ডলী স্থাপন করেছেন বিনা স্তম্ভে। তোমরা এটা দেখছো। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’। সূরা রা’দঃ ২

৪।  আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴾ الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ﴿ ‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’। সূরা তোহা ৫

৫। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ الرَّحْمَٰنُ فَاسْأَلْ بِهِ خَبِيرًا﴾

‘তিনিই ছয়দিনে আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী এবং তাদের মাঝখানে যা কিছু আছে সব তৈরি করে রেখে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন তিনি পরম দয়াময়’। সূরা ফুরকানঃ ৫৯

﴿اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

৬।‘আল্লাহই আসমান-যমীন এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সকল বস্ত্ত ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। সূরা সাজদাঃ ৫৪

৭।‘আললাহই আসমান-যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। সূরা হাদীদঃ ৪

আল্লাহর কিতাবের সাতটি স্থানে আল্লাহ তাআলা সাব্যস্ত করেছেন যে তিনি আরশের উপরে সমুন্নত। প্রত্যেক স্থানেই মাত্র একটি শব্দ তথা استواء (সমুন্নত হওয়া) দ্বারা আরশের উপর সমুন্নত হওয়া সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে استوى على العرش ‘‘তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন’’। ইস্তিওয়া শব্দটি এখানে আসল অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। অন্য অর্থ দ্বারা ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই। ইস্তিওয়া (সমুন্নত হওয়া) আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলার একটি কর্মগত সিফাত। এটি তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য সুসাব্যস্ত। অন্যান্য সিফাতের মতই আল্লাহর বড়ত্ব ও সম্মানের জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতেই এই সুউচ্চ সিফাতটি তাঁর জন্য সাব্যস্ত করতে হবে। আরবদের ভাষায় চারটি শব্দের মাধ্যমে ইস্তিওয়ার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যথাঃعلا وارتفع وصعد واستقر এই চারটি শব্দের প্রথম তিনটির অর্থ উপরে উঠলেন এবং সমুন্নত হলেন। চতুর্থ শব্দটির অর্থ হচ্ছে স্থির হলেন। উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত استواء শব্দের অর্থে সালাফদের থেকে যা বর্ণিত হয়েছে, তার ভিত্তি এই চারটি অর্থের উপরেই। আসলে ঘুরেফিরে অর্থ একটিই। তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে।

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট একটি কাফ্রী দাসীকে নিয়ে আগমন করে বলে যে, তাকে একটি দাস মুক্ত করতে হবে। এ দাসীকে মুক্ত করলে কি তার দায়িত্ব পালন হবে? তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উক্ত দাসীকে বলেন, তুমি কি ঈমানদার? সে বলে: হ্যাঁ। তিনি বলেন: আল্লাহ কোথায়? সে আসমানের দিকে ইশারা করে। তখন তিনি বলেন: একে মুক্ত করে দাও, এ নারী ঈমানদার।’ মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭০ (কিতাবুল মাসাজিদ, বাবু তাহরীমিল কালাম ফিস সালাত)

সৃষ্টিজগতের যাবতীয় কর্মকাণ্ড তিনিই পরিচালনা করেন।

“আসমানও যমীনের অণু পরিমান বস্তুও তাঁর জ্ঞানের বাইরে নেই।” [সাবাঃ ৩]

কোন ব্যাপারে মনযোগ দিতে গিয়ে অন্য ব্যাপার তাঁর বাধা হয় না। [বুখারী] অগণিত আবেদনকারীর আবেদন তাঁর জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না। চাওয়ার প্রচণ্ডতায় তিনি বিরক্ত হোন না। বৃহৎ কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে ছোট ছোট বস্তুগুলো তার খেয়ালচ্যুত হয়না। চাই তা সমুদ্রে বা পাহাড়ে বা জনবসতিপূর্ণ এলাকা যেখানেই হোক না কেন। [এ ব্যাপারে আরো দেখুনঃ সূরা হুদঃ ৬, সূরা আল-আনআমঃ ৫৯]

দুনিয়ার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় অন্য কারোর হস্তক্ষেপ করা তো দূরের কথা, কারো আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাঁর কোন ফায়সালা পরিবর্তন করার অথবা করো ভাগ্য ভাঙা-গড়ার ইখতিয়ারও নেই। বড়জোর সে আল্লাহর কাছে দোআ করতে পারে। কিন্তু তার দোআ কবুল হওয়া না হওয়া পুরোপুরি আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর এ একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার রাজ্যে নিজের কথা নিশ্চিতভাবে কার্যকর করিয়ে নেবার মতো শক্তিধর কেউ নেই। এমন শক্তি কারোর নেই যে, তার সুপারিশকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। এ সুপারিশের বিষয়টি আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন। [দেখুনঃ সূরা আল-বাকারাহঃ ২৫৫, সূরা আন-নাজমঃ ২৬, সূরা সাবাঃ ২৩]

مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَشۡفَعُ عِنۡدَهٗۤ اِلَّا بِاِذۡنِهٖ ؕ یَعۡلَمُ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ مَا خَلۡفَهُمۡ

কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? সম্মুখের অথবা পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। বাকারা ২৫৫

আকাশমন্ডলীতে কত ফিরিশতা রয়েছে তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না, যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন। সূরা আন নাজমঃ২৬

২৩. আর আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন, সে ছাড়া তার কাছে কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। সূরা সাবাঃ ২৩

উপরের তিনটি বাক্যে প্রকৃত সত্য বর্ণনা করা হয়েছিল, অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদের রব। এখন বলা হচ্ছে, এ প্রকৃত সত্যের উপস্থিতিতে তোমাদের কোন ধরনের কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। মূলত রবুবীয়াত তথা বিশ্ব-জাহানের সার্বভৌম ক্ষমতা, নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব যখন পরোপুরি আল্লাহর আয়ত্বাধীন তখন এর অনিবার্য দাবী স্বরুপ মানুষকে তাঁরই বন্দেগী করতে হবে। [ইবন কাসীর]

অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা সেটা বলেছেন, তিনি বলেন, “আর যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে, তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ। অতঃপর তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে? [সূরা আয-যুখরুফঃ ৮৭)

আরও বলেন, “বলুন, সাত আসমান ও মহা-আরশের রব কে? অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ। বলুন, ‘তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না? [সূরা আল-মুমিনুন: ৮৬-৮৭] তাছাড়া সূরা ইউনুসের এ আয়াতের আগের ও পরের আয়াতেও একই বক্তব্য এসেছে।

যখন এ সত্য তোমাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে এবং তোমাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ সত্যের উপস্থিতিতে তোমাদের কি কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে তখন এরপরও কি তোমাদের চোখ খুলবে না এবং তোমরা এমন বিভ্রান্তির মধ্যে ডুবে থাকবে? তোমরা কি তোমাদের অস্বীকার ও গোড়ামীতেই রত থাকবে যে তোমরা মোটেই উপদেশ গ্রহণ করবে না? [আইসারুত তাফাসীর]

১০:৪ اِلَیۡهِ مَرۡجِعُکُمۡ جَمِیۡعًا ؕ وَعۡدَ اللّٰهِ حَقًّا ؕ اِنَّهٗ یَبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُهٗ لِیَجۡزِیَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ بِالۡقِسۡطِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَهُمۡ شَرَابٌ مِّنۡ حَمِیۡمٍ وَّ عَذَابٌ اَلِیۡمٌۢ بِمَا کَانُوۡا یَکۡفُرُوۡنَ ﴿

তারই কাছে তোমাদের সকলের ফিরে যাওয়া; আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। সৃষ্টিকে তিনিই প্রথম অস্তিত্বে আনেন, তারপর সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদেরকে ইনসাফপূর্ণ প্রতিফল প্রদানের জন্য। আর যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য রয়েছে অত্যন্ত গরম পানীয় ও অতীব কষ্টদায়ক শাস্তি; কারণ তারা কুফরী করত।

অর্থাৎ তোমাদের এ দুনিয়া থেকে ফিরে গিয়ে নিজেদের রবের কাছে হিসেব দিতে হবে। সে সুনির্দিষ্ট সময়ে তিনি তোমাদের সবাইকে একত্রিত কববেন। [ইবন কাসীর; সা’দী]

জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদগ্রহণ করবে, আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দিয়ে বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি, আমার কাছেই তোমাদের ফিরতে হবে।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩৪)

সব জাতির একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, যখন তাদের নির্দিষ্ট সময় ঘনিয়ে আসবে তখন তারা মুহূর্তকাল বিলম্ব করত পারবে না এবং ত্বরাও করতে পারবে না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩৪)

‘আপনি বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পালিয়ে যাচ্ছ তার সঙ্গে তোমাদের অবশ্যই সাক্ষাৎ হবে, অতঃপর তোমাদের ফেরানো হবে অদৃশ্য ও দৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত আল্লাহর কাছে, তোমাদের জানানো হবে তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে।’ (সুরা জুমআ, আয়াত : ৮)

(২) এ আয়াতে সমগ্র সৃষ্টিজগতের বহু নিদর্শন উল্লেখিত হয়েছে, যা আল্লাহ তা’আলার পূর্ণ কুদরত ও পরিপূর্ণ হেকমতের স্বাক্ষর বহন করে এবং এ দাবী প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা সৃষ্টিকে ধ্বংস করে গুড়িয়ে দিতে সক্ষম এবং পরে পুনরায় সেই কণাসমূহকে একত্রিত করে একেবারে নতুন অবস্থায় জীবিত করে হিসাব-নিকাশের পর পুরস্কার কিংবা শাস্তির আইন জারি করবেন। কুরাইশ কাফেরদের অধিকাংশই আল্লাহকে তাদের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মানত। তাই আল্লাহ তা’আলা এর দ্বারাই তাদের উপর দলীল নিচ্ছেন যে, যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে পারেন তিনি অবশ্যই ধ্বংসের পর দ্বিতীয়বার সেটাকে অস্তিত্বে আনতে সক্ষম। [কুরতুবী] আর এটা তার ওয়াদা। এ ওয়াদা তিনি অবশ্যই পূরণ করবেন। কারণ, এর মাধ্যমে তিনি যারা হৃদয় দিয়ে ঈমান এনেছে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে ওয়াজিব ও মুস্তাহাব পালন করে নেক আমল করেছে, তাদেরকে প্রতিফল দিবেন। [সা’দী]। আর যারা কুফরী করবে তাদেরকেও তাদের কুফরীর কারণে তিনি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিবেন।

এ বাক্যটির মধ্যে দাবী ও প্রমাণ উভয়েরই সমাবেশ ঘটেছে। দাবী হচ্ছে, আল্লাহ পুনর্বার মানুষকে সৃষ্টি করবেন। এর প্রমাণ হিসেবে বলা হয়েছে, তিনিই প্রথমবার মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আর যে ব্যক্তি একথা স্বীকার করে যে, আল্লাহই সৃষ্টির সূচনা করেছেন। সে কখনো আল্লাহর পক্ষে এ সৃষ্টির পুনরাবৃত্তিকে অসম্ভব বা দুর্বোধ্য মনে করতে পারে না। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “যেভাবে আমরা প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব; এটা আমার কৃত প্রতিশ্রুতি, আর আমরা তা পালন করবই।” [সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৪]

এ অত্যন্ত গরম পানীয় কাফেরদের জন্য শাস্তি স্বরূপ থাকবে। এ প্রচণ্ড গরম পানীয়ের বিভিন্ন গুণাগুণ অন্যান্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সূরা আর-রাহমানের ৪৪ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ “তারা জাহান্নামের আগুন ও ফুটন্ত পানির মধ্যে ছুটোছুটি করবে” আবার কোথাও বলা হয়েছেঃ “এবং যাদেরকে পান করতে দেয়া হবে ফুটন্ত পানি যা তাদের নাড়ীভুঁড়ি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেবে?”। [সূরা মুহাম্মাদঃ ১৫] আরো বলা হয়েছে “তাদের মাথার উপর ঢেলে দেয়া হবে ফুটন্ত পানি, যা দ্বারা তাদের উদরে যা আছে তা এবং তাদের চামড়া বিগলিত করা হবে।” [সূরা আল-হাজ্জঃ ১৯–২০]

অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ “তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে দেয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানীয়, যা তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে।” [সূরা আল-কাহফঃ ২৯] আরো বলা হয়েছেঃ “তারপর তোমরা পান করবে তার উপর অতি উষ্ণ পানি, ফলে তারা পান করবে তৃষ্ণার্ত উটের ন্যায়।” [সূরা আল-ওয়াকি’আহঃ ৫৪–৫৫]

কুরআনের কোন কোন আয়াতে এ গরম পানিকে পুঁজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, বলা হয়েছেঃ “এবং পান করানো হবে গলিত পুঁজ; যা সে অতি কষ্টে একেক ঢোক করে গিলবে এবং তা গিলা প্রায় সহজ হবে না।” [সূরা ইবরাহীমঃ ১৬–১৭]

আবার কোন কোন স্থানে বলা হয়েছে যে, তাদের জন্য সমভাবে গরম পানীয় ও পুঁজ উভয়টিই থাকবে, “কাজেই তারা আস্বাদন করুক ফুটন্ত পানি ও পুঁজ”। [সূরা সোয়াদঃ ৫৭]

আরো এসেছেঃ “সেখানে তারা আস্বাদন করবে না শীত, না কোন পানীয়, ফুটন্ত পানি ও পুজ ছাড়া।” [সূরা আন-নাবা ২৪–২৫]।

১০:৫ هُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ الشَّمۡسَ ضِیَآءً وَّ الۡقَمَرَ نُوۡرًا وَّ قَدَّرَهٗ مَنَازِلَ لِتَعۡلَمُوۡا عَدَدَ السِّنِیۡنَ وَ الۡحِسَابَ ؕ مَا خَلَقَ اللّٰهُ ذٰلِکَ اِلَّا بِالۡحَقِّ ۚ یُفَصِّلُ الۡاٰیٰتِ لِقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ ﴿

তিনিই সূর্যকে দীপ্তিময় ও চাঁদকে আলোকময় করেছেন এবং তার জন্য মনযিল নির্দিষ্ট করেছেন যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এগুলোকে যথাযথ ভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করেন এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা জানে।

‘সূর্যের’ ক্ষেত্রে ‘দিয়া’ শব্দটি এবং ‘চাঁদের’ ক্ষেত্রে ‘নূর’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বাহ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে সূর্য ও চাঁদ উভকেই তো আলো কিংবা উজ্জ্বল আসমানী বস্তু হিসেবে সহজেই ধরে নেয়া যায়। সুতরাং সূর্য ও চাঁদ- দুটির ক্ষেত্রেই তো ‘দিয়া’ এবং ‘নূর’ এই দুটি শব্দের মধ্য থেকে যে কনো একটি শব্দ বেছে নিয়ে তা ব্যবহার করলেই হত। কিন্তু তা না করে স্রষ্টা মহান আল্লাহ দুটির ক্ষেত্রে দু’ধরনের আলো হিসেবে উপস্থাপন করলেন কেন? কারণ এগুলো যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি তো এ দুটো আলোর পার্থক্য ভাল করেই অবগত আছেন। তাই প্রথমত সহজভাবে দুটোকে দুই ধরনের আলো (‘দিয়া’ ও ‘নূর’) হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে যারা সত্যান্বেষী তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পাশাপাশি এনিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

تَبَارَكَ الَّذِي جَعَلَ فِي السَّمَاء بُرُوجًا وَجَعَلَ فِيهَا سِرَاجًا وَقَمَرًا مُّنِيرًا (২৫ : ৬১)

কত মহান তিনি যিনি আকাশে স্থাপন বা পরিগঠন করেছেন (বুরুজ) তারকার ঘরসমূহ বা গ্যালাক্সিগুচ্ছ এবং তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ (সূর্য) এবং উজ্জ্বল/আলোকিত চন্দ্র। সূরা ফুরকানঃ ৬১

‘সিরা-জুন’ (অর্থ) ‘বাতি, সূর্য’- ‘আল-কাওসার’- ‘আধুনিক আরবি বাংলা অভিধান’- ‘মদীনা পাবলেকেশন্স’।

এছাড়া ‘মুনির উদ্দীন আহমদ’ এর- ‘কোরআনের অভিধানে’- ‘ছিরাজুন’ (অর্থ) ‘চেরাগ অর্থাৎ প্রদীপ’- হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘মুনীরুন’ (অর্থ) ‘আলোকিত, উজ্জ্বল’- ‘কোরআনের অভিধান’- ‘মুনির উদ্দীন আহমদ’

وَجَعَلَ الْقَمَرَ فِيهِنَّ نُورًا وَجَعَلَ الشَّمْسَ سِرَاجًا (৭১ : ১৬)

যেথায় চন্দ্রকে স্থাপন করেছি আলো/আলোর-কিরণরূপে এবং সূর্যকে স্থাপন করেছি প্রদীপরূপে। সূরা নুহঃ ১৬

কোরআনের অভিধানে’- ‘ছিরাজুন’ (অর্থ) ‘চেরাগ অর্থাৎ প্রদীপ’- হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

(১০:০৫) নং আয়াতে চাঁদকে প্রথমত ‘নূর’ অর্থাৎ আলো বলা হলেও পরবর্তীতে (ফুরকান:৬১) নং আয়াতে ‘মুনীর’ অর্থাৎ আলোকিত বা উজ্জ্বল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (নুহ : ১৬) নং আয়াতে সূর্যের আলোকে যেমন প্রজ্বলিত প্রদীপের আলোর সাথে তুলনা করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। চাঁদের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটি করা হয়নি।

আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তার পরিচালনার কথা বর্ণনার পর উদাহরণ স্বরূপ আরো কিছু বস্তুর বর্ণনা করা হচ্ছে, যা বিশ্ব-পরিচালনার অন্তর্ভুক্ত। তার মধ্যে সূর্য ও চন্দ্র অধিক গুরুতত্ত্বপূর্ণ। সূর্যের তাপ ও তার আলোর প্রয়োজনীয়তা প্রত্যেকেই জানে। অনুরূপ চন্দ্রের মৃদু জ্যোৎস্নালোকের যে মধুরতা ও উপকারিতা আছে, তাও বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। বৈজ্ঞানিকদের মতে সূর্যের নিজস্ব আলো আছে আর চন্দ্রের নিজস্ব আলো নেই বরং সূর্যের আলো থেকে আলো গ্রহণ করে থাকে। (ফাতহুল কাদীর) والله أعلم بالصواب

অর্থাৎ আমি চন্দ্র পরিভ্রমণের কক্ষপথ নির্ধারণ করে দিয়েছি। কক্ষপথ বলতে তার ঐ পরিভ্রমণপথকে বুঝায়, যা চাঁদ এক দিন ও এক রাত্রে তার বিশেষ পরিক্রমণ দ্বারা অতিক্রম করে। উক্ত কক্ষ হল আটাশটি। প্রত্যেক রাত্রে একটি কক্ষ সমাপ্ত করে, তাতে কখনো কোন ব্যতিক্রম হয় না। প্রথম কক্ষগুলিতে চাঁদকে ছোট ও সরু দেখা যায়। তারপর ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এমন কি চৌদ্দ রাত্রি বা চৌদ্দতম কক্ষে গিয়ে তা পূর্ণ (পূর্ণিমার) চন্দ্র রূপে প্রকাশ হয়। তার পর পুনরায় ছোট ও সরু হতে আরম্ভ করে, এমনকি শেষে এক বা দুই রাত্রি লুক্কায়িত থাকে এবং পরে প্রথম দিনের ক্ষীণচন্দ্র রূপে উদিত হয়। চন্দ্রের উপকারিতা এই বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘‘যাতে তোমরা বছরের গণনা ও সময়ের হিসাব করতে পার।’’ অর্থাৎ চন্দ্রের সেই কক্ষপথ ও গতি দ্বারাই মাস ও বছর গণনা হয়, যার দ্বারা তোমাদের সকল বস্তুর হিসাব রাখা সহজ হয়। অর্থাৎ বছর বার মাসের, মাস উনত্রিশ বা ত্রিশ দিনের, দিবারাত্রি চবিবশ ঘণ্টার, সমান সমান দিন হলে বার ঘণ্টা করে এবং শীত ও গ্রীষ্মকালে কমবেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া পার্থিব উপকার ও কাজ-কারবার শুধু সেই চন্দ্রের কক্ষপথের সাথে সম্পৃক্ত নয়; বরং তাতে দ্বীনী লাভও অর্জন হয়। নতুন চাঁদ দ্বারা হজ্জ, রমযানের রোযা, নিষিদ্ধ মাস এবং অন্যান্য ইবাদতের সময়কাল নির্দিষ্ট করা হয়, প্রত্যেক মু’মিন তার গুরুতত্ত্ব দিয়ে থাকে।

কুরআনের দুটি আয়াতে ‘কক্ষপথ’ শব্দটি পাওয়া যায়। সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৩ (২১ঃ৩৩) এবং সূরা ইয়াসীন, আয়াত ৪০ (৩৬ঃ৪০)।

আরবিতে ‘কক্ষপথ’ হিসেবে ‘فَلَكٍ’ (ফালাকিন)  শব্দ ব্যবহার করা হয়।

এই ফালাকিন শব্দটির মূলত তিনটি অর্থ পাওয়া যায় ডিকশনারিতে — ১। কক্ষপথ (Orbit) ২। গোলাকার (Sphere) ৩। আবর্তন (Circuit)

অর্থাৎ ‘فَلَكٍ’ (ফালাকিন) শব্দের মাধ্যমে গোলাকার কক্ষপথের দিকে ইংগিত করা হয়েছে।

وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। সবাই আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে। [সুরা আম্বিয়া – ২১:৩৩]

সূর্য নাগাল পেতে পারে না চন্দ্রের এবং রাত্রি অগ্রে চলে না দিনের প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে। [সুরা ইয়া-সীন – ৩৬:৪০]

একটা বড় সময় পর্যন্ত মানুষের ধারনা ছিল যে সূর্য স্থির, আর গ্রহগুলো সূর্যের চারিদিকে আবর্তণ করছে। কিন্তু পরবর্তিতে আবিষ্কার হল সূর্য স্থির নয়, বরং সূর্যও আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারিদিকে, প্রায় গোলাকার কক্ষপথে আবর্তন করছে। আর ১৪০০ বছর আগেই চাঁদ আর সূর্য কক্ষপথে আবর্তণ করছে এ কথা কোরআনে বলে দেয়া আছে।

তিনি এগুলো অনাহুত সৃষ্টি করেননি বরং তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাময়, তাঁর প্রত্যেকটি কাজই প্রজ্ঞায় পূর্ণ। আসমান ও যমীন সৃষ্টির মাঝে কোন হেকমত নেই এমন কথা শুধুমাত্র কাফেররাই বলতে পারে।

তোমরা কি মনে করেছিলে যে আমরা তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে না? সুতরাং আল্লাহ মহিমান্বিত, প্রকৃত মালিক, তিনি ছাড়া কোন হক্ক ইলাহ নেই; তিনি সম্মানিত আরশের রব।মুমিনুনঃ ১১৫-১১৬

আর আমরা আসমান, যমীন ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোন কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করিনি। অনৰ্থক সৃষ্টি করার ধারণা তাদের যারা কুফরী করেছে, কাজেই যারা কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে আগুনের দুর্ভোগ।সূরা সোয়াদঃ ২৭

“আমরা আকাশসমূহ ও পৃথিবীকে এবং তাদের মাঝখানে যে বিশ্ব-জাহান রয়েছে তাদেরকে খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমরা তাদেরকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। চূড়ান্ত বিচারের দিনে তাদের সবার জন্য উপস্থিতির সময় নির্ধারিত রয়েছে।” [আদ দুখান: ৩৮–৪০]

১০:৬ اِنَّ فِی اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّهَارِ وَ مَا خَلَقَ اللّٰهُ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَّقُوۡنَ ﴿

৬. নিশ্চয় দিন ও রাতের পরিবর্তনে এবং আল্লাহ আসমানসমূহ ও যমীনে যা সৃষ্টি করেছেন তাতে নিদর্শন রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে।

আসমান ও যমীনে আল্লাহ্ তা’আলা যা সৃষ্টি করেছেন তাতে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, সেগুলো আল্লাহরই মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছে। কুরআনের অন্যান্য আয়াতেও আল্লাহ্ তা’আলা এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন,

وَكَأَيِّن مِّنْ آيَةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَمُرُّونَ عَلَيْهَا وَهُمْ عَنْهَا مُعْرِضُونَ﴾

আকাশসমুহে  ও পৃথিবীতে কত নিদর্শন রয়েছে, যেগুলো তারা অতিক্রম করে যায় কিন্তু সেদিকে একটুও দৃষ্টিপাত করে না৷ সূরা ইউসুফঃ ১০৫

তাদেরকে বলো, “পৃথিবী ও আকাশে যা কিছু আছে চোখ মেলে দেখো”৷ আর যারা ঈমান আনতেই চায় না তাদের জন্য নির্দশন ও উপদেশ তিরষ্কার কীইবা উপকারে আসতে পারে. সূরা ইউনুসঃ ১০১

তারা কি কখনো আকাশ ও পৃথিবী দেখেনি যা তাদেরকে সামনে এ পেছনে থেকে ঘিরে রেখেছে ? আমি চাইলে তাদেরকে যমীনে ধসিয়ে দিতে অথবা আকাশের কিছু অংশ তাদের ওপর নিক্ষেপ করতে পারি ৷১২ আসলে তার মধ্যে রয়েছে একটি নির্দশন এমন প্রত্যেক বান্দার জন্য যে আল্লাহ অভিমুখী হয় সূরা সাবাঃ ৯,

৩:১৯০ اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّهَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الۡاَلۡبَابِ ﴿

১৯০. আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য।সূরা আলে ইমরানঃ ১৯০।

৩:১৯১ الَّذِیۡنَ یَذۡکُرُوۡنَ اللّٰهَ قِیٰمًا وَّ قُعُوۡدًا وَّ عَلٰی جُنُوۡبِهِمۡ وَ یَتَفَکَّرُوۡنَ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ رَبَّنَا مَا خَلَقۡتَ هٰذَا بَاطِلًا ۚ سُبۡحٰنَکَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ ﴿

১৯১. যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে, আর বলে ‘হে আমাদের রব! আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি, আপনি অত্যন্ত পবিত্র, অতএব আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন

হাদীসে বর্ণিত যে, ১৯০নং আয়াত থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলো নবী করীম (সাঃ) যখন রাতে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার জন্য উঠতেন, তখন পড়তেন এবং তারপর ওযূ করতেন। (বুখারী ৪৫৬৯-মুসলিম ২৫৬নং)

এগুলোর পরিবর্তনের অর্থ, একটির পর অপরটি এমনভাবে আসা তাদের সুনির্দিষ্ট নিয়মের কোন ব্যঘাত ঘটে না। [ইবন কাসীর] এ ব্যাপারে সূরা আল-আরাফ এর ৫৪, সূরা ইয়াসীন এর ৪০ নং এবং সূরা আল-আন’আমের ৯৬ নং আয়াতেও চাঁদ ও সূর্যের নিয়মানুবর্তিতার কথা বর্ণিত হয়েছে। [ইবন কাসীর]

কুরাইশ কাফেররা যেসব কারণে মৃত্যুপরের জীবনকে অস্বীকার করতো তার মধ্যে তিনটি জিনিস ছিল সবচেয়ে বেশী সুস্পষ্ট৷

এক, তারা আল্লাহর হিসেব নিকেশ এবং তার কাছে জবাবদিহির ব্যাপারটি মেনে নিতে চাইতো না৷ কারণ এটা মেনে নিলে দুনিয়ায় তাদের ইচ্ছা মতো কাজ করার স্বাধীনতা থাকতো না৷

দুই, তারা কিয়ামত হওয়া, বিশ্ব ব্যবস্থায় ওলট পালট হয়ে যাওয়া এবং পুনরায় একটি নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটাকে অকল্পনীয় মনে করতো৷

তিন, যারা শত শত হাজার হাজার বছর আগে মরে গেছে এবং যাদের হাঁড়গুলোও গুঁড়ো হয়ে মাটিতে, বাতাসে ও পানিতে মিশে গেছে তাদের পুনর্বার প্রাণ নিয়ে সশরীরে বেঁচে ওঠা তাদের কাছে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার মনে হতো৷

ওপরের জবাবটি এ তিনটি দিককেই পরিবেষ্টন করেছে এবং এ ছাড়াও এর মধ্যে এটি কঠোর সতর্কবাণীও নিহিত রয়েছে৷ এ ছোট ছোট বাক্যগুলো মধ্যে যে বিষয়বস্তু লুকিয়ে রয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ-

এক- যদি তোমরা কখনো চোখ মেলে এ পৃথিবী ও আকাশের দিকে তাকাতে তাহলে দেখতে পেতে এসব খেলনা নয় এবং এ ব্যবস্থা ঘটনাক্রমে সৃষ্টি হয়ে যায়নি৷ এ বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি জিনিস একথা প্রকাশ করছে যে, একটি সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন সত্তা পূর্ণ প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা সহকারে তাকে তৈরি করেছেন৷ এ ধরনের একটি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার অধীনে এখানে কাউকে বুদ্ধি, বিবেক, বিচারশক্তি ও স্বাধীন ক্ষমতা দান করার পর তাকে অদায়িত্বশীল ও কারো কাছে কোন প্রকার জবাবদিহি না করে এমনি ছেড়ে দেয়া যেতে পারে বলে ধারণা করা একেবারেই অযৌত্তিক ও অর্থহীন কথা ছাড়া আর কিছুই নয়৷

দুই- গভীর দৃষ্টিতে এ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে কিয়ামতের আগমন যে মোটেই কোন কঠিন ব্যাপার নয়, সে কথা যে কোন ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারবে৷ পৃথিবী ও আকাশ যেসব নিয়মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সামান্য একটু হেরফের হলে কিয়ামত ঘটে যেতে পারে৷ আর এ ব্যবস্থাই আবার একথারও সাক্ষ দেয় যে, যিনি আজ এ দুনিয়া জাহান তৈরি করে করেছেন তিনি আবার অন্য একটি দুনিয়াও তৈরি করতে পারেন৷ এ কাজ যদি তার জন্য কঠিন হতো তাহলে এ দুনিয়াটিই বা কেমন করে অস্তিত্ব লাভ করতো৷

তিন- তোমরা পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টাকে কী মনে করেছো? তাকে তোমরা মৃত মানব গোষ্ঠীকে পুর্নবার সৃষ্টি করতে অক্ষম বলে মনে করছো? যারা মরে যায় তাদের দেহ পচে খাসে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যতই দূরে ছড়িয়ে পড়ুক না কেন সেগুলো থাকে তো আকাশ ও পৃথিবীর সীমানার মধ্যেই৷ এর বাইরে তো চলে যায় না৷ তাহলে এ পৃথিবী ও আকাশ যে আল্লাহ কর্তৃত্বাধীন রয়েছে তার পক্ষে মাটি, পানি ও হাওয়ার মধ্যে সেখানে যে জিনিস প্রবেশ করে আছে সেখান থেকে তাকে টেনে বের করে আনা এমন আর কি কঠিন ব্যাপার৷ তোমাদের শরীরের মধ্যে এখন যা কিছু আছে, তাও তো তারই একত্রিত করা এবং ঐ একই মাটি, পানি ও হাওয়া থেকে বের করে আনা হয়েছে৷ এ বিচ্ছিন্ন অংশগুলো সংগ্রহ করা যদি আজ সম্ভবপর হয়ে থাকে, তাহলে আগামীকাল কেন অবম্ভব হবে?

এ তিনটি যুক্তিসহ ও বক্তব্যের মধ্যে আরো যে সতর্কবাণী নিহিত রয়েছে, তা এই যে, তোমরা সব দিক থেকে আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বের আবেষ্টনীতে ঘেরাও হয়ে আছো৷ যেখানেই যাবে এ বিশ্ব-জাহান তোমাদের ঘিরে রাখবে৷ আল্লাহর মোকাবিলায় কোন আশ্রয়স্থল তোমরা পাবে না৷ অন্যদিকে আল্লাহর ক্ষমতা এতই অসীম যে, যখনই তিনি চান তোমাদের পায়ের তলদেশ বা মাথার ওপর থেকে যে কোন বিপদ আপদ তোমাদের প্রতি বর্ষণ করেত পারেন৷ যে ভুমিকে মায়ের কোলের মতো প্রশান্তির আধার হিসেবে পেয়ে তোমরা সেখানে গৃহ নির্মাণ করে থাকো, তা উপরিভাগের নীচে কেমন সব শক্তি কাজ করছে এবং কখন তিনি কোন ভূমিকম্পের মাধ্যেম এ ভুমিকে তোমাদের জন্য কবরে পরিণত করবেন তা তোমরা জানো না৷ যে আকাশের নিচে তোমরা এমন নিশ্চিন্তে চলাফেরা করছো যেন এটা তোমাদের নিজেদের ঘরের ছাদ, তোমরা জানো না এ আকাশ থেকে কখন কোন বিজলী মেনে আসবে অথবা কোন প্রলয়ংকার বর্ষার ঢল নামবে কিংবা কোন আকষ্মিক বিপদ তোমাদের ওপর আপতিত হবে৷ এ অবস্থায় তোমাদের এ আল্লাহকে ভয় না করা, পরকালের ভাবনা থেকে এভাবে গাফেল হয়ে যাওয়া এবং একজন শুভাকাংখীর উপদেশের মোকাবিলায় এ মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়ার এ ছাড়া আর কি অর্থ হতে পারে যে, নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনছো৷

১০:৭ اِنَّ الَّذِیۡنَ لَا یَرۡجُوۡنَ لِقَآءَنَا وَ رَضُوۡا بِالۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ اطۡمَاَنُّوۡا بِهَا وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ عَنۡ اٰیٰتِنَا غٰفِلُوۡنَ ۙ﴿

৭. নিশ্চয় যারা আমাদের সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না, দুনিয়ার জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট হয়েছে এবং এতেই পরিতৃপ্ত থাকে, আর যারা আমাদের নিদর্শনাবলী সম্পর্কে গাফিল,

১০:৮ اُولٰٓئِکَ مَاۡوٰىهُمُ النَّارُ بِمَا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿

৮. তাদেরই আবাস আগুন; তাদের কৃতকর্মের জন্য।

কাতাদা বলেন, দুনিয়াদারদের তুমি দেখবে যে, তারা দুনিয়ার জন্যই খুশী হয়, দুনিয়ার জন্যই চিন্তিত হয়, দুনিয়ার জন্যই চিন্তিত হয়, দুনিয়ার জন্যই অসন্তুষ্ট হয় আর দুনিয়ার জন্যই সন্তুষ্ট হয়। [তাবারী] এ আয়াতে জাহান্নামের অধিবাসীদের বিশেষ লক্ষণসমূহ বর্ণনা করা হচ্ছে।

প্রথমতঃ তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা করে না, বিশ্বাসও করে না।

দ্বিতীয়তঃ তারা আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবন ও তার অনন্ত-অসীম সুখ-দুঃখের কথা ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র পার্থিব জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে গেছে।

তৃতীয়তঃ পৃথিবীতে তারা এমন নিশ্চিত হয়ে বসেছে যেন এখান থেকে আর কোথাও তাদের যেতেই হবে না; চিরকালই যেন এখানে থাকবে। কখনো তাদের একথা মনে হয় না যে, এ পৃথিবী থেকে প্রত্যেকটি লোকের বিদায় নেয়া এমন বাস্তব বিষয় যে, এতে কখনো কোন সন্দেহ হতে পারে না।

তাছাড়া এখান থেকে নিশ্চিতই যখন যেতে হবে, তখন যেখানে যেতে হবে, সেখানকার জন্যও তো খানিকটা প্রস্তুতি নেয়া কর্তব্য ছিল।

চতুর্থতঃ এসব লোক আমার নিদর্শনাবলী ও আয়াতসমূহের প্রতি ক্রমাগত গাফিলতী করে চলেছে। সুতরাং এরা না আল্লাহর কুরআনের আয়াত দ্বারা উপকৃত হয়, না আসমান-যমীন কিংবা এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোন সাধারণ সৃষ্টি অথবা নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটুও চিন্তা-ভাবনা করে। তাই তাদের ঠিকানা, অবস্থান ও বাসস্থান হবে জাহান্নাম যেখান থেকে তারা আর কোথাও যেতে বা পালাতে পারবে না। কারণ তারা কুফরী, শির্ক ও বিভিন্ন প্রকার পাপের মাধ্যমে তাই অর্জন করেছে। [সা’দী]

১০:৯ اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ یَهۡدِیۡهِمۡ رَبُّهُمۡ بِاِیۡمَانِهِمۡ ۚ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهِمُ الۡاَنۡهٰرُ فِیۡ جَنّٰتِ النَّعِیۡمِ ﴿

৯. নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের রব তাদের ঈমান আনার কারণে তাদেরকে পথ নির্দেশ করবেন; নিয়ামতে ভরপুর জান্নাতে তাদের পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে।

আয়াতে (بِإِيمَانِهِمْ) শব্দের সাথে যে ب হরফটি ব্যবহৃত হয়েছে, তার দুটি অর্থ হতে পারে-

(এক) কারণে। তখন আয়াতের অর্থ হবে- যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদেরকে তাদের প্রভু ঈমানের কারণে মহাপুরষ্কারের ব্যবস্থা করবেন। তিনি তাদেরকে হিদায়াত দিবেন। তিনি তাদেরকে তাদের জন্য যা উপকারী তা শিক্ষা দিবেন। হিদায়াতের কারণে তারা ভালো আমল করার তৌফিক লাভ করবেন, তারা আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনসমূহে দৃষ্টি দিতে পারবেন। এ দুনিয়াতে সৎপথে পরিচালিত করবেন। হিদায়াতুল মুস্তাকীম নসীব করবেন আর আখেরাতে পুল-সিরাতের পথে তাদের পরিচালিত করবেন যাতে তারা জান্নাতে পৌছতে পারে। [সা’দী]

(দুই) সাহায্যে বা দ্বারা। [কাশশাফ; ইবন কাসীর] মুজাহিদ রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ তাদের জন্য আলোর ব্যবস্থা করবেন ফলে তারা সে আলোকে আলোকিত হয়ে পথ চলতে পারবে। [তাবারী] অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনও তাদের আলোকিত হবে। তারা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে জানা থাকার কারণে অন্ধকারে হাতিয়ে বেড়াবে না। তাদের জীবন হবে আলোকিত জীবন।

৫৭:২৮ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ اٰمِنُوۡا بِرَسُوۡلِهٖ یُؤۡتِکُمۡ کِفۡلَیۡنِ مِنۡ رَّحۡمَتِهٖ وَ یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ نُوۡرًا تَمۡشُوۡنَ بِهٖ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿ۚۙ

হে মুমিনগণ! আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তার রাসূলের উপর ঈমান আন। তিনি তার অনুগ্রহে তোমাদেরকে দেবেন দ্বিগুণ পুরস্কার এবং তিনি তোমাদেরকে দেবেন নূর, যার সাহায্যে তোমরা চলবে। এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সূরা আল হাদীদঃ ২৮

এই আয়াতে ঈসা আলাইহিস সালাম-এর প্রতি ঈমানদার কিতাবী মুমিনগণকে সম্বোধন করা হয়েছে। যদিও (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا) বলে কেবল মুসলিমগণকে সম্বোধন করাই পবিত্র কুরআনের সাধারণ রীতি। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে এই সাধারন রীতির বিপরীতে নাসারাদের জন্য (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সম্ভবতঃ এর রহস্য এই যে, পরবর্তী বাক্যে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনার আদেশ দেয়া হয়েছে। কারণ, এটাই ঈসা আলাইহিস সালাম-এর প্রতি বিশুদ্ধ ঈমানের দাবী। তারা যদি তা করে, তবে তারা উপরোক্ত সম্বোধনের যোগ্য হয়ে যাবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার ও সওয়াব দানের ওয়াদা করা হয়েছে। [দেখুন: ফাতহুল কাদীর; কুরতুবী]

আর এভাবে আমরা আপনার প্রতি আমাদের নির্দেশ থেকে রূহকে ওহী করেছি; আপনি তো জানতেন না কিতাব কি এবং ঈমান কি! কিন্তু আমরা এটাকে করেছি নূর, যা দ্বারা আমরা আমাদের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে হেদায়াত দান করি; আর আপনি তো অবশ্যই সরল পথের দিকে দিকনির্দেশ করেন—সূরা আশ-শুরাঃ ৫২

কুরআনকে নূর (জ্যোতি) বানিয়েছি। এর দ্বারা আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে চাই হিদায়াত দানে ধন্য করি। অর্থাৎ, কুরআন দ্বারা হিদায়াত কেবল তারাই পায়, যাদের মধ্যে ঈমানের খোঁজ ও তার প্রতি তীব্র আগ্রহ থাকে। তারা এটাকে হিদায়াত লাভের নিয়তে পড়ে, শোনে এবং চিন্তা-গবেষণা করে। তাই আল্লাহ এদের সাহায্য করেন এবং এদের জন্য হিদায়াতের পথ সুগম করে দেন। এই পথের উপরেই এরা চলতে থাকে। কিন্তু যারা নিজের চোখ বন্ধ করে নেয় ও কানে ছিপি লাগিয়ে নেয় এবং জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগায় না, তারা হিদায়াত কিভাবে পেতে পারে? যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

{ قُلْ هُوَ لِلَّذِيْنَ آمَنُوا هُدىً وَّشِفَاءٌ وَالَّذِيْنَ لاَيُؤْمِنُوْنَ فِي آذَانِهِمْ وَقْرٌ وَّهُوَ عَلَيْهِمْ عَمىً اُولَئِكَ يُنَادُوْنَ مِن مَّكَانٍ بَعِيْدٍ}

অর্থাৎ, বল, বিশ্বাসীদের জন্য এ পথনির্দেশক ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে এদের জন্য অন্ধকারস্বরূপ। এরা এমন যে, যেন এদের বহু দূর হতে আহবান করা হয়। (সূরা হামীম সাজদাহ ৪৪ আয়াত)

যে ব্যক্তি মৃত ছিল, যাকে আমরা পরে জীবিত করেছি এবং যাকে মানুষের মধ্যে চলার জন্য আলোক দিয়েছি, সে ব্যক্তি কি ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে অন্ধকারে রয়েছে এবং সেখান থেকে আর বের হবার নয়? এভাবেই কাফেরদের জন্য তাদের কাজগুলোকে শোভন করে দেয়া হয়েছে। সূরা আল-আনআমঃ ১২২, ,

আর আখেরাতের জীবনেও তারা তাদের প্রভুর যাবতীয় কল্যাণ লাভে সামর্থ হবেন। পুলসিরাতেও তাদের আলোর ব্যবস্থা থাকবে। যাবতীয় সংকটময় মুহুর্তে তাদের প্রভু তাদের পথ দেখানোর ব্যবস্থা করবেন।

সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে বলবে, ‘তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের নূরের কিছু গ্ৰহণ করতে পারি। বলা হবে, তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও ও নূরের সন্ধান কর। তারপর উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, যার ভিতরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে শাস্তি।[ সূরা আল-হাদীদঃ ১৩]

অত:পর যেভাবে অন্ধ ব্যক্তি চক্ষুষ্মান ব্যক্তির চোখ দ্বারা দেখতে পায় না তেমনি কাফের ও মুনাফিক ঈমানদারের নুর দ্বারা আলোকিত হতে পারবে না। মুনাফিকরা ঈমানদারদের বলবে, “তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের নূরের কিছু গ্ৰহণ করতে পারি।” এভাবে আল্লাহ্ মুনাফিকদেরকে ধোঁকাগ্ৰস্থ করবেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন, “তারা আল্লাহকে ধোঁকা দেয় আর আল্লাহ্ তাদেরকে ধোঁকা দিবেন।” [সূরা আন নিসা: ১৪২] তারপর তারা যেখানে নূর বন্টন হয়েছিল সেখানে ফিরে যাবে, কিন্তু উভয়ের মাঝামাঝি স্থাপিত হবে একটি প্রাচীর যাতে একটি দরজা থাকবে, ওটার ভিতরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে শাস্তি। এভাবেই মুনাফিক ধোঁকাগ্ৰস্ত হতে থাকবে। আর মুমিনদের মাঝে নূর বন্টিত হয়ে যাবে। [ইবনে কাসীর]

 

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, প্রত্যেক মুমিনকে তার আমল পরিমাণে নূর দেয়া হবে। ফলে কারও নূর পর্বতসম, কারও খর্জুর বৃক্ষসম এবং কারও মানবদেহসম হবে। সর্বাপেক্ষা কম নূর সেই ব্যক্তির হবে, যার কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলিতে নূর থাকবে; তাও আবার কখনও জ্বলে উঠবে এবং কখনও নিভে যাবে। [ইবনে কাসীর]

কাতাদা ও ইবন জুরাইজ বলেন, তার আমল তার জন্য সুন্দর সূরত ও সুগন্ধিযুক্ত বাতাসের রূপ ধারণ করে যখন সে কবর থেকে উঠবে তখন তার সম্মুখীন হয়ে তাকে যাবতীয় কল্যাণের সুসংবাদ জানাবে। সে তখন তাকে বলবে, তুমি কে? সে বলবে, আমি তোমার আমল। তখন তার সামনে আলোর ব্যবস্থা করবে যতক্ষণ না সে জান্নাতে প্রবেশ করায়। আর এটাই এ আয়াতের অর্থ। পক্ষান্তরে কাফেরের জন্য তার আমল কুৎসিত সূরত ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে আসবে এবং তার সার্বক্ষণিক সাথী হবে যতক্ষণ না সে তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাচ্ছে। [তাবারী; ইবন কাসীর]

(২) যদি কেউ প্রশ্ন করে, কিভাবে বলা হল যে, তাদের নিচ দিয়ে নালাসমূহ প্রবাহিত হবে, আর আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের সবখানেই জান্নাতের এ নালাসমূহকে বাগানের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কথা জানিয়েছে, এটা তো সম্ভব শুধু এক অবস্থায়, সেটা হচ্ছে, তারা যমীনের উপরে থাকবে, আর নালাসমূহ থাকবে যমীনের নীচ দিয়ে? এটা তো জান্নাতের নালাসমূহের বৈশিষ্ট্য নয়। কারণ, সেগুলো প্রবাহিত হবে যমীনের মধ্যে কোন প্রকার গর্ত না করে? উত্তর হচ্ছে, এ অর্থ নেয়াটা শুদ্ধ নয়। বরং নিচে দিয়ে নালা প্রবাহিত হওয়ার অর্থ তাদের নিকট দিয়ে প্রবাহিত হওয়া। তাদের সামনে দিয়ে নে’আমতপূর্ণ বাগানসমূহে।

এর অনুরূপ কথা আল্লাহ্ তা’আলা মারইয়ামকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “অবশ্যই তোমার রব তোমার নিচ দিয়ে প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছেন।” [সূরা মারইয়াম: ২৪] আর এটা জানা কথা যে, সে প্রস্রবণটি মারইয়ামের বসার নিচে ছিল না। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে যে, তার নিকটে। তার সামনে। অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা’আলা ফিরআউনের ভাষণ সম্পর্কে বলেছেন, সে বলেছিল: “মিসরের রাজত্ব কি আমার নয়? আর এ নালাসমূহ কি আমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত নয়?” [সূরা আয-যুখরুফ ৫১] এখানে নিচ দিয়ে অর্থ, কাছে বা সামনে। [তাবারী]

এ বাক্যটিকে হালকাভাবে নেবেন না৷ এর বিষয়বস্তুর ক্রম বিন্যাস গভীর মনোনিবেশের দাবীদার৷ পরকালীন জীবনে তারা জান্নাত লাভ করবে কেন? কারণ ,তারা পার্থিব জীবনে সত্য পথে চলেছে৷ প্রত্যেক, কাজে , জীবনের প্রতিটি বিভাগে, প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক বিষয়ে তারা সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠা পথ অবলম্বন করেছে এবং বাতিলের পথ পরিহার করেছে৷

তারা প্রতিটি পদক্ষেপে, জীবনের প্রতি মোড়ে মোড়ে ও প্রতিটি পথের চৌমাথায় তারা ন্যায় ও অন্যায় হতে ও বাতিল এবং সথ্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারলো কেমন করে? তারপর এ পার্থক্য অনুযায়ী সঠিক পথের ওপর দৃঢ়তা এবং অন্যায় পথ থেকে দূরে থাকার শক্তি তারা কোথা থেকে পেলো?-এসব তারা লাভ করেছে তাদের রবের পক্ষ থেকে ৷ তিনিই তাত্বিক পথনির্দেশনা দান এবং বাস্তব কাজের ক্ষমতা দান ও সুযোগ সৃষ্টির উৎস৷

তাদের রব তাদেরকে পথনির্দেশন ও সুযোগ দান করেন কেন? -তাদের ঈমানের কারণে এ সুযোগ দেন৷

ওপরে এই যে ফলাফলগুলো বর্ণিত হয়েছে এগুলো কোন ঈমান ও বিশ্বাসের ফল? এমন ঈমানের ফল নয় যার অর্থ হয় নিছক বিশ্বাস করা৷ বরং এমন ঈমানের ফল যা চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের পরিচালক শক্তি ও প্রাণসত্তায় পরিণত হয় এবং যার উদ্ধুদ্ধকারী শক্তিতে শক্তিমান হয়ে কর্ম ও চরিত্রে নেকী ও সৎবৃত্তির প্রকাশ ঘটে৷ মানুষের পার্থিব ও জৈবিক জীবনেই দেখা যায় তার জীবন ধারণ,শারীরিক সুস্থতা, কর্মক্ষমতা ও জীবনের স্বাদ আহরণ করার জন্য তাকে বিশুদ্ধও পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হয়৷ কিন্তু শুধু খাদ্য খেয়ে নিলেই এসব গুণ ও ফল লাভ করা যায় না৷ বরং এমনভাবে খেতে হয় যার ফলে তা হজম হয়ে গিয়ে রক্ত সৃষ্টি করে এবং প্রতিটি শিরা উপ-শিরায় পৌছে শরীরের প্রতিটি অংশে এমন শক্তি সঞ্চার করে যার ফলে সে তার অংশের কাজ ঠিকমত করতে পারে৷ ঠিক একইভাবে নৈতিক জীবনে মানুষের সঠিক পথনির্দেশনা লাভ করা, সত্যকে দেখা, সত্য পথে চলা এবং সবশেষে কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করা সঠিক আকীদা- বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে ৷ কিন্তু এমন ধরনের কোন আকীদা বিশ্বাস এ ফল সৃষ্টি করতে পারে না , যা নিছক মুখে উচ্চারিত হয় অথবা মন ও মস্তিষ্কের কোন অংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে থাকে৷ বরং যে আকীদা বিশ্বাস হৃদয়ের মর্মমূলে প্রবেশ করে তার সাথে একাকার হয়ে যায় এবং তারপর চিন্তা পদ্ধতি রুচি-প্রকৃতি ও মেজায -প্রবণতার অংগীভূত হয়ে চরিত্র, কর্মকাণ্ড ও জীবনভংগীতে সুষ্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে৷ তাই এ ফল সৃষ্টিতে সক্ষম৷ যে ব্যক্তি খাদ্য খেয়ে তা যথাযথভাবে হজম করতে সক্ষম হয় তার জন্য যে পুরষ্কার রাখা হয়েছে, যে ব্যক্তি আহার করেও অনাহারীর মতো থাকে আল্লাহর জৈব বিধান অনুযায়ী সে কখনো সেই পুরষ্কারের অধিকারী হয় না৷ তাহলে যে ব্যক্তি ঈমান এনেও বেঈমানের মতো জীবন যাপন করে সে আল্লাহর নৈতিক বিধানে আনয়নের পর সৎকর্মশীলের মতো জীবন যাপনকারী যে পুরষ্কার পায় সেই পুরস্কার পাওয়ার আশা করতে পারে?

আল্লাহ বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীদেরকে এমন উদ্যানসমূহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন, যেগুলোর নিম্নদেশে বইতে থাকবে নদীমালা, সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আরও (প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন) চিরস্থায়ী উদ্যানসমূহে (জান্নাতে আদনে) পবিত্র বাসস্থানসমূহের। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় (নিয়ামত)। এটাই হচ্ছে অতি বড় সফলতা। (তাওবাঃ ৭২)

১০:১০ دَعۡوٰىهُمۡ فِیۡهَا سُبۡحٰنَکَ اللّٰهُمَّ وَ تَحِیَّتُهُمۡ فِیۡهَا سَلٰمٌ ۚ وَ اٰخِرُ دَعۡوٰىهُمۡ اَنِ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿

১০. সেখানে তাদের ধ্বনি হবেঃ হে আল্লাহ! আপনি মহান, পবিত্র! এবং সেখানে তাদের অভিবাদন হবে, ‘সালাম আর তাদের শেষ ধ্বনি হবেঃ ‘সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর প্রাপ্য!

এ আয়াতে জান্নাতবাসীদের প্রথম ও প্রধান অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। [সা’দী] বলা হয়েছে যে, জান্নাতবাসীদের دعوى হবে (سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ)। এখানে دعوى শব্দটির অর্থ কি, এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। কারণ, دعوى শব্দটির কয়েকটি অর্থ রয়েছে-

(এক) দাবী করা। তখন আয়াতের অর্থ হবে, দুনিয়ায় ও আখেরাতে সবসময়ই জান্নাতবাসীগণের দাবী ছিল আল্লাহ্ তা’আলাকে যাবতীয় দোষ-ত্রুটিমুক্ত ঘোষণা করা, তার জন্য উলুহিয়াত তথা যাবতীয় ইবাদাত সাব্যস্ত করা। তাই তারা জান্নাতেও এটার দাবী করবে। [তাবারী] কোন কোন মুফাসসির আবার এ অর্থ করেছেন যে, এখানে দাবী করার অর্থ সার্বক্ষণিক এ কাজে লেগে থাকা। ছুটতে থাকে। [ফাতহুল কাদীর]

(দুই) দো’আ করা। [তাবারী] আর দোআ করার অর্থ নির্ধারণে আলেমগণ বেশকিছু মতামত ব্যক্ত করেছেন- (ক) তাদের আহবান ও সম্বোধন হবে তাসবীহ ও তাহমীদের মাধ্যমে। (খ) তাদের ইবাদত হবে সুবাহানাকাল্লাহুম্মা এ কালেমার মাধ্যমে। [বাগভী] (গ) তাদের কথা ও কাজও হবে উক্ত কালেমার মাধ্যমে। [বাগভী] এসবগুলোই অর্থ হতে পারে। কারণ, আমরা জানি যে, দুআ দু’প্রকার। (এক) চাওয়ার মাধ্যমে দু’আ। যেমন আল্লাহ আমাকে অমুক বস্তু দান করুন। এ ধরণের দোআ অনেক পরিচিত। (দুই) ইবাদাত ও প্রশংসার মাধ্যমে দোআ যাতে আল্লাহর প্রশংসা এবং শুকরিয়া থাকে। এ হিসাবে কুরআন ও সুন্নায় বহু দোআ এসেছে। যেমন,

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ সবচেয়ে উত্তম দোআ হলো আলহামদুলিল্লাহ। [তিরমিযীঃ ৩৩০৫, ইবনে মাজাহঃ ৩৭৯০]

অনুরূপভাবে অন্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ মুসীবতের দো’আ হচ্ছে-

لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ الْعَظِيمُ الْحَلِيمُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ السَّمَوَاتِ، وَرَبُّ الْأَرْضِ، وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ

অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য কোন মা’বুদ নেই, তিনি মহান, সহিষ্ণু। আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, তিনি আরশের মহান রব। আল্লাহ ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য কোন মা’বুদ নেই, তিনি আসমানযমীনের রব এবং আরশের মহান রব। [বুখারীঃ ৬৩৪৫, মুসলিমঃ ২৭৩০]

অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেনঃ যিননূন (ইউনুস) ‘আলাইহিস সালাম যখন মাছের পেটে ছিলেন তখন তার দোআ (লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনায যোয়ালিমীন) এ দোআ দ্বারা যখনই কোন মুসলিম কিছুর জন্য দোআ করবে, আল্লাহ তার দোআ কবুল করবেন। [তিরমিযীঃ ৩৫০০]

এ সমস্ত হাদীস এবং এ জাতীয় অন্যান্য অনেক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, আল্লাহর প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে দোআ করার নির্দেশ শরীআতে এসেছে। তাই অনেক আলেম এ ধরণের প্রশংসাসূচক দোআকে চাওয়াসূচক দোআ হতে শ্রেষ্ঠ বলে মত প্রকাশ করেছেন। এসব কিছু থেকে একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে, জান্নাতের অধিবাসীগণের আল্লাহর প্রশংসা, পবিত্রতা ঘোষণা করা মূলতঃ আল্লাহর কাছে দো’আ করা।

কোন কোন মুফাসসির বলেন, যেহেতু তাদের উপর থেকে ইবাদতের যাবতীয় বোঝা নামিয়ে দেয়া হয়েছে, তখন তাদের কাছে শুধু বাকী থাকবে সবচেয়ে বড় স্বাদের বিষয়। আর তা হচ্ছে আল্লাহর যিকর করা। যা অন্যান্য যাবতীয় নে’আমতের চেয়ে তাদের কাছে বেশী মজাদায়ক হবে। যাতে থাকবে না কোন কষ্ট। [সা’দী]

(তিন) আশা-আকাঙ্খা করা, [ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ জান্নাতে তাদের সবধরণের নেয়ামত লাভের পর তাদের আর কোন চাহিদা বাকী থাকবে না। তাই তারা শুধু ‘সুবাহানাকাল্লাহুম্মা’ বা হে আল্লাহ! আপনি কতই না পবিত্র এ প্রশংসামূলক বাক্যই তাদের দ্বারা সর্বক্ষণ ঘোষিত হোক এমনটি আশা করবে এবং বলতে চাইবে। [ইবন কাসীর]

মোটকথা, জান্নাতবাসীদের যাবতীয় দোআ, কাজ, কথা, দাবী, আশা-আকাঙ্খা সবকিছুই হবে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ ও তার তাহমীদ বা প্রশংসায় নিয়োজিত থাকা। এ ব্যাপারে

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ জান্নাতবাসীগণ জান্নাতে খাবে এবং পান করবে, কিন্তু কোন থুথু, পায়খানা-পেশাব, সর্দি-কাশির সম্মুখীন হবে না। শুধুমাত্র ঢেকুর আসবে যাতে মিস্কের সুঘ্ৰাণ থাকবে। তাদের মনে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই আল্লাহর তাসবীহ তাহমীদ (সুবাহানাল্লাহ-আলহামদুলিল্লাহ) পাঠ করতে ইলহাম (মনে উদিত করে দেয়া) হবে। [মুসলিমঃ ২৮৩৫]

(২) জন্নাতবাসীদের দ্বিতীয় অবস্থা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে (وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ) প্রচলিত অর্থে تَحِيَّةٌ বলা হয় এমন শব্দ বা বাক্যকে যার মাধ্যমে কোন আগন্তুক কিংবা অভ্যাগতকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। যেমন, সালাম, স্বাগতম, খোশ আমদেদ, কিংবা আহলান ওয়া সাহলান প্রভৃতি। সুতরাং আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা অথবা ফিরিশতাদের পক্ষ থেকে জান্নাতবাসীদেরকে سلام এর মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হবে। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ এ সুসংবাদ দেয়া হবে যে, তোমরা যে কোন রকম কষ্ট ও অপছন্দনীয় বিষয় থেকে হেফাযতে থাকবে। এ সালাম স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকেও হতে পারে। যেমন, সূরা ইয়াসীনে রয়েছে

(سَلَامٌ قَوْلًا مِنْ رَبٍّ رَحِيمٍ) আবার ফিরিশতাদের পক্ষ থেকেও হতে পারে। আবার ফিরিশতা কর্তৃক তাদের রবের পক্ষ থেকেও হতে পারে। [বাগভী] যেমন, অন্যত্র এরশাদ হয়েছে (وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ كُلِّ بَابٍ ٭ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ)

অর্থাৎ ফিরিশতাগণ প্রতিটি দরজা দিয়ে সালামুন আলাইকুম বলতে বলতে জান্নাতবাসীদের কাছে আসতে থাকবেন। [সূরা আর-রাদঃ ২৩–২৪]

আর এ দুটি বিষয়ে বিরোধ-বৈপরীত্ব নেই যে, কখনো সরাসরি স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এবং কখনো ফিরিশতাদের পক্ষ থেকে সালাম আসবে। আবার জান্নাতীগণ পরস্পরকে এ সালামের মাধ্যমে সাদর সম্ভাষণ জানাবেন। [ফাতহুল কাদীর; সাদী]

আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ (تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ) অর্থাৎ “যেদিন তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সেদিন তাদের পরস্পর সম্ভাষণ হবে সালামের মাধ্যমে।” [সূরা আহযাবঃ ৪৪

৫৬:২৫ لَا یَسۡمَعُوۡنَ فِیۡهَا لَغۡوًا وَّ لَا تَاۡثِیۡمًا

৫৬:২৬ اِلَّا قِیۡلًا سَلٰمًا سَلٰمًا

সেখানে তারা শুনবে না কোন আসার বা পাপবাক্য

‘সালাম’ আর ‘সালাম’ বাণী ছাড়া। ওয়াকি’আঃ ২৫–২৬]

অর্থাৎ সালাম শব্দটি তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে, ফিরিশতাদের পক্ষ থেকে এবং মুমিনগণ পরস্পর নিজেদের মধ্যে বিনিময় করবে। সালাম শব্দের আরেক অর্থ দোআ বা যাবতীয় আপদ থেকে নিরাপত্তা। তখন অর্থ হবে, জাহান্নামবাসীরা যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছে তা থেকে তোমাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করা হচ্ছে। [তাবারী]

(৩) জান্নাতবাসীদের তৃতীয় অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, জান্নাতবাসীদের সর্বশেষ দোআ হবে (الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ) অর্থাৎ জান্নাতবাসীরা জান্নাতে পৌছার পর আল্লাহ তা’আলাকে জানার ক্ষেত্রে বিপুল উন্নতি লাভ করবে। তখন তারা শুধু তার প্রশংসাই করতে থাকবে। জান্নাতবাসীদের প্রাথমিক দোআ হবে (سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ) আর সর্বশেষ দোআ হবে (الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ) এতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর বিশেষ কিছু গুণ-বৈশিষ্টের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। [বাগভী] যেমন, পরাক্রম ও মহত্ত্ব গুণ যাতে যাবতীয় দোষ-ত্রুটি হতে আল্লাহ তা’আলার পবিত্রতার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। আরো রয়েছে ‘সিফাতে করম’ যাতে তার মহানুভবতা, পরিপূর্ণতা ও পরাকাষ্ঠার উল্লেখ রয়েছে। কুরআনুল কারীমের

(تَبَارَكَ اسْمُ رَبِّكَ ذِي الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ) [সূরা আর-রাহমান: ৭৮]

আয়াতে এতদুভয় গুণ-বৈশিষ্টের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ আয়াত এবং এ জাতীয় অন্যান্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, আল্লাহ তা’আলা সদা প্রশংসিত। সহীহ হাদীসে এসেছে, “জান্নাতবাসীগণকে তাসবীহ ও তাহমীদ যথা সুবহানাল্লাহ ও আলহামদুলিল্লাহর ইলহাম এমনভাবে করা হবে যেমনিভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ইলহাম করা হবে।” [মুসলিমঃ ২৮৩৫] এটা একথাই প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহ সদা প্রসংশিত। আমরা যদি কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের প্রতি তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, আল্লাহ নিজেকে বিভিন্নভাবে প্রশংসনীয় বলে ব্যক্ত করেছেন। সূরা আল-ফাতিহার তাফসীরে তার বর্ণনা চলে গেছে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “মহান প্রভু জান্নাতীদেরকে সম্বােধন করে বলবেন, হে জান্নাতের অধিবাসিগণ!’ তারা উত্তরে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা হাযির আছি, যাবতীয় সুখ ও কল্যাণ তোমার হাতে আছে। তখন আল্লাহ পাক বললেন, তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছ? তারা বলবে, আমাদের কী হয়েছে যে, সন্তুষ্ট হব না? হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো আমাদেরকে সেই জিনিস দান করেছ, যা তোমার কোন সৃষ্টিকে দান করনি। তখন তিনি বলবেন, এর চেয়েও উত্তম কিছু তোমাদেরকে দান করব না কি? তারা বলবে, এর চেয়েও উত্তম বস্তু আর কি হতে পারে?’ মহান প্রভু জবাবে বলবেন, তোমাদের উপর আমার সন্তুষ্টি অনিবার্য করব। অতঃপর আমি তোমাদের প্রতি কখনো অসন্তুষ্ট হব না।” (বুখারী-মুসলিম)

সংগ্রহে

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন