সূরা আন নিসাঃ ৯ম রুকু(৬০-৭০)আয়াত

সূরা আন নিসাঃ ৯ম রুকু(৬০-৭০)আয়াত

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

৪:৬০ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ یَزۡعُمُوۡنَ اَنَّهُمۡ اٰمَنُوۡا بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یَّتَحَاکَمُوۡۤا اِلَی الطَّاغُوۡتِ وَ قَدۡ اُمِرُوۡۤا اَنۡ یَّکۡفُرُوۡا بِهٖ ؕ وَ یُرِیۡدُ الشَّیۡطٰنُ اَنۡ یُّضِلَّهُمۡ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا 

৬০. আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা দাবি করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা ঈমান এনেছে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও সেটাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।

এখানে ‌’তাগুত’ বলতে সুস্পষ্টভাবে এমন শাসকক বুঝানো হয়েছ আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন অনুযায়ী ফালসালা করে এবং এমন বিচার ব্যবস্থাকে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার আনুগত্য করে না এবং আল্লাহর কিতাবকে চূড়ান্ত সনদ (Final Authority) হিসেবে স্বীকৃতিও দেয় না৷ কাজেই যে আদালত তাগুতের ভূমিকা পালন করছে, নিজেরে বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালার জন্য তার কাছে উপস্থিত হওয়া যে একটি ঈমান বিরোধী কাজ এ ব্যাপার আয়াতটির বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ৷ আর আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের ওপর ঈমান আনার অপহিহার্য দাবি অনুযায়ী এ ধরনের আদালতকে বৈধ আদালত হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকৃত জানানোই প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য৷ কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও তাগুতকে অস্বীকার করা, এ দু’টি বিষয় পরস্পরের সাথে অংগাংগীভাবে সংযুক্ত এবং এদের একটি অন্যটির অনিবার্য পরিণতি৷ আল্লাহ ও তাগুত উভয়ের সামনে একই সাথে মাথা নত করাই হচ্ছে সুস্পষ্ট মুনাফেকী৷

৪:৬১ وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡا اِلٰی مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ وَ اِلَی الرَّسُوۡلِ رَاَیۡتَ الۡمُنٰفِقِیۡنَ یَصُدُّوۡنَ عَنۡکَ صُدُوۡدًا ﴿ۚ۶۱﴾

৬১. তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে আপনি আপনার কাছ থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখবেন।

অর্থাৎ তারা রাসূলের কাছে আসার ব্যাপারে পরিপূর্ণভাবে অনীহা ব্যক্ত করেছে। এটা তাদের অহংকারেরই ফলশ্রুতি। তাদের এ অভ্যাস সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতেও বলেছেন, “আর তাদেরকে যখন বলা হয়, আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তোমরা তা অনুসরণ কর। তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যাতে পেয়েছি তারই অনুসরণ করব।” [সূরা লুকমান: ২১]

মোটকথা: এখানে বলা হয়েছে যে, পারস্পরিক বিবাদ-বিসংবাদের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কৃত মীমাংসাকে অমান্য করা কোন মুসলিমের কাজ হতে পারে না। যে কেউ এমন কাজ করবে, সে মুনাফেক ছাড়া আর কিছু নয়। এরা এমন লোক, যখন তাদেরকে বলা হয় যে, তোমরা সে নির্দেশের প্রতি চলে এসো, যা আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেছেন এবং চলে এসো তার রাসূলের দিকে, তখন এসব মুনাফেক আপনার দিকে আসতে অনীহা প্রকাশ করে। মুমিনরা কখনো এধরনের কাজ করতে পারে না। তাদের কথা ও কাজ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “মুমিনদের উক্তি তো এই—যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ এবং তার রাসূলের দিকে ডাকা হয় তখন তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম। [সূরা আন-নূর: ৫১]

এই আয়াতগুলি এমন লোকদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়, যারা নিজেদের ফায়সালা ইসলামী আদালত থেকে গ্রহণ করার পরিবর্তে ইয়াহুদীদের অথবা কুরাইশদের সর্দারদের কাছ থেকে গ্রহণ করতে চাইত। তবে আয়াতের নির্দেশ ব্যাপক; এতে এমন সব লোক শামিল, যারা কিতাব ও সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের ফায়সালার জন্য এ দু’টিকে বাদ দিয়ে অন্য কারো শরণাপন্ন হয়।

 

৪:৬২ فَکَیۡفَ اِذَاۤ اَصَابَتۡهُمۡ مُّصِیۡبَۃٌۢ بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡهِمۡ ثُمَّ جَآءُوۡکَ یَحۡلِفُوۡنَ ٭ۖ بِاللّٰهِ اِنۡ اَرَدۡنَاۤ اِلَّاۤ اِحۡسَانًا وَّ تَوۡفِیۡقًا 

৬২. অতঃপর কি অবস্থা হবে, যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের কোন মুসীবত হবে? তারপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করে আপনার কাছে এসে বলবে, আমরা কল্যাণ এবং সম্প্রীতি ছাড়া অন্য কিছু চাইনি।

অর্থাৎ, যখন তারা নিজেদের ঐ কৃতকর্মের কারণে আল্লাহর আযাবের শিকার হয়ে বিপদাপদে ফেঁসে যায়, তখন বলতে শুরু করে যে, অন্যত্র যাওয়ার উদ্দেশ্য আমাদের এই নয় যে, আমরা সেখান থেকে ফায়সালা গ্রহণ করব অথবা আমরা সেখানে তোমার চেয়ে বেশী সুবিচার পাব বরং আমাদের উদ্দেশ্য কল্যাণ, সম্প্রীতি ও সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা।

সম্ভবত এর অর্থ হচ্ছে এই যে, যখন মুসলমানরা তাদের মুনাফেকী কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারে এবং তারা জাববদিহি করার ও শাস্তিলাভের আশংকা করতে থাকে তখন কসম খেয়ে খেয়ে নিজেদের ঈমানের নিশ্চয়তা দিতে থাকে৷

৪:৬৩ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُ اللّٰهُ مَا فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ ٭ فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ عِظۡهُمۡ وَ قُلۡ لَّهُمۡ فِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ قَوۡلًۢا بَلِیۡغًا ﴿۶۳

৬৩. এরাই তারা, যাদের অন্তরে কি আছে আল্লাহ্ তা জানেন। কাজেই আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন, তাদেরকে সদুপদেশ দিন এবং তাদেরকে তাদের মৰ্ম স্পর্শ করে- এমন কথা বলুন।

মহান আল্লাহ বললেন, যদিও আমি তাদের অন্তরের সমূহ গুপ্ত রহস্য সম্পর্কে অবহিত (যার শাস্তি তাদেরকে আমি দেব), তবুও হে নবী! তুমি তাদের বাহ্যিক অবস্থাকে সামনে রেখে তাদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওয়ায-নসীহত ও কল্যাণকর কথার মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরীণ সংশোধনের প্রচেষ্টা জারী রাখুন। এ থেকে জানা যায় যে, উপেক্ষা, ক্ষমা, ওয়ায-নসীহত এবং হৃদয়স্পর্শী উত্তম কথা দ্বারা শত্রুদের ষড়যন্ত্রসমূহকে ব্যর্থ করার প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত।

‘‘হে নবী! আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদ দাতা, ভীতি প্রদর্শক ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।’’ [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪৫-৪৬]

রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত করে বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা অহির মাধ্যমে আমার কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছেন যে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করো। কেউ যেন অন্যের ওপর গর্ব ও অহংকারের পথ অবলম্বন না করে এবং কেউ যেন কারও ওপর জুলুম বা নির্যাতন না করে।’ (মুসলিম)

আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলে; যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদের ক্ষমা করো এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)

সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারভুক্ত, সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে উত্তম ওই ব্যক্তি যে আল্লাহর পরিবারভুক্তদের প্রতি সদাচার করে তথা দয়াপরবশ হয়।’ (মিশকাত)

তুমি অন্যায় ও মন্দকে দূর কর সে ভালো দ্বারা যা অতি উত্তম। তাহলে দেখতে পাবে যে, তোমার সাথে যাদের শত্রুতা ছিলো সে প্রাণের বন্ধু হয়ে যাবে।

কাজেই মানুষের, প্রতিপক্ষের মন জয় করতে হলে মন্দের মোকাবেলায় উত্তম ও ভালোর নীতি গ্রহণ করতে হবে।সূরাঃ হামীম সাজদা আয়াত ৩৪

 

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ [٧:١٩٩]

আর ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ে তোল, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খ জাহেলদের থেকে দূরে সরে থাক।   সূরাঃ আ’রাফ আয়াত১৯৯

“আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে।” [সূরা নাহল, আয়াতঃ১২৫]

কাজেই দাওয়াত দানকরীর মধ্যে হিকমত তথা প্রজ্ঞার গুনাবলী থাকতে হবে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে লোকদের মনঃস্তত্ত্ব ও পরিবেশকে সামনে রেখে দাওয়াত দিতে হবে। সম্বোধিত ব্যক্তির প্রতি কল্যান কামনা ও অকৃত্রিম দরদ ফুটে উঠতে হবে। তাহলেই দাওয়াত ফলপ্রসূ হতে পারে।

৪:৬৪ وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا لِیُطَاعَ بِاِذۡنِ اللّٰهِ ؕ وَ لَوۡ اَنَّهُمۡ اِذۡ ظَّلَمُوۡۤا اَنۡفُسَهُمۡ جَآءُوۡکَ فَاسۡتَغۡفَرُوا اللّٰهَ وَ اسۡتَغۡفَرَ لَهُمُ الرَّسُوۡلُ لَوَجَدُوا اللّٰهَ تَوَّابًا رَّحِیۡمًا ﴿

৬৪. আল্লাহর অনুমতিক্রমে কেবলমাত্র আনুগত্য করার জন্যই আমরা রাসূলদের প্রেরণ করেছি। যখন তারা নিজেদের প্রতি যুলুম করে তখন তারা আপনার কাছে আসলে ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইলে তারা অবশ্যই আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালুরূপে পাবে।

আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূল এ জন্য আসেন না যে, কেবল তাঁর রিসালাতের প্রতি ঈমান আনতে হবে তারপর ইচ্ছেমতো যে কারো আনুগত্য করার যাবে৷ বরং রসূলের আগমনের উদ্দেশ্যই এই হয় যে, জীবন যাপনের জন্য যে আইন কানুন তিনি আনেন দুনিয়ার সমস্ত আইন কানুন বাদ দিয়ে কেবল মাত্র তারই অনুসরণ করতে হবে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি যে বিধান দেন সমস্ত বিধান ত্যাগ করে একমাত্র তাকেই কার্যকর করতে হেব৷ যদি কেউ এ কাজে ব্রতী না হয়, তাহলে তার নিছক রসূলকে রসূল মেনে নেয়া অর্থহীন হয়ে পড়ে৷

আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূল প্রেরণের পটভূমি ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

‘সকল মানুষ একটি জাতি সত্ত্বার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নবীগণকে পাঠালেন সুসংবাদ দাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী হিসেবে। আর তাদের সাথে অবতীর্ণ করলেন সত্য কিতাব, যাতে মানুষের মাঝে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে মীমাংসা করতে পারেন। বস্তুতঃ কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতভেদ করে নি। কিন্তু পরিষ্কার নির্দেশ এসে যাবার পর নিজেদের পারস্পরিক জেদ বশতঃ তারাই করেছে, যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ ঈমানদারদেরকে হিদায়াত করেছেন সেই সত্য বিষয়ে, যে ব্যাপার তারা মতভেদে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।’’ [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২১৩]

[المائ‍دة: ١٩] ‘‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমাদের কাছে আমার রাসূল আগমন করেছেন, যিনি রাসূলগণের বিরতির পর তোমাদের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা একথা বলতে না পার যে, আমাদের কাছে কোন সুসংবদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শক আগমন করে নি। অতএব, তোমাদের কাছে সুসংবাদ দাতা ভীতিপ্রদর্শক এসে গেছে আর তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।  [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ১৯]

‘‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে উপদেশ দিন, আপনি কেবল উপদেশদাতা, আপনাকে দারোগা বানিয়ে পাঠানো হয় নি যে আপনি তাদের বাধ্য করবেন।’’ [সূরা আল-গাশিয়াহ, আয়াত: ২১-২২]

৬১ নং আয়াত থেকে এ আয়াত পর্যন্ত মুনাফিকদের উদ্দেশ্যে হেদায়াত দেয়া হয়েছে। তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, রাসূল যদি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তবে আল্লাহকে তারা ক্ষমাশীল পাবে। এ আয়াতটি মুনাফিকদের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং রাসূলের জীবদ্দশায়ই তার পক্ষে তাদের কথা শোনা ও তাদের জন্য দো’আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা সম্ভব। রাসূলের মৃত্যুর পর তার কবরের কাছে এসে এ আয়াত তেলাওয়াত করে রাসূলের কাছে দোআ করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও শির্ক। অনুরূপভাবে রাসূলের মৃত্যুর পর তার কবরের কাছে এসে আল্লাহর কাছে তার জন্য দো’আ করা বা ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য আহবান করা বেদ’আত ও শির্কের মাধ্যম। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, হেদায়াতের ইমামগণ যেমন ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ্ সহ কেউই এ ধরনের কাজ করেন নি। তারা এটাকে জায়েয মনে করতেন না। কোন কোন কবরপূজারী কিছু কাহিনী রটনা করে এর সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চেষ্টা করে মানুষের ঈমান নষ্ট করার পায়তারা করতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকা উচিত।

৪:৬৫ فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا ﴿۶۵﴾

৬৫. কিন্তু না, আপনার রবের শপথ তারা মুমিন হবে না যতক্ষন পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের(১) বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে(২) এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়

আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের বলেন, আনসারী এক ব্যক্তির সাথে খেজুর গাছে পানি দেয়া নিয়ে তার ঝগড়া হয়। আনসারী বলল, পানির পথ পরিস্কার করে দাও যাতে তা আমার জমির উপর যায়। যুবায়ের তা দিতে অস্বীকার করলে তারা উভয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শালিসের জন্য আসলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব শুনে বললেনঃ যুবায়ের তুমি তোমার জমিতে পানি দেয়ার পর তোমার পড়শীর জমিতে পানি দিয়ে দিও। লোকটি তা শুনে বলল, আপনার ফুফাত ভাই তো তাই। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করল এবং তিনি বললেন, যুবায়ের তুমি তোমার জমিতে পানি দেয়ার পর তা দেয়াল পর্যন্ত আটকে রাখ। যুবায়ের বলেন, আল্লাহর শপথ, আমার মনে হয় এ আয়াতটি এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নাযিল হয়েছে। [বুখারীঃ ২৩৫৯, ২৩৬০, মুসলিমঃ ২৩৫৭]

এ দ্বারা এ বিষয়ও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর রাসূলের আদেশ-নিষেধ নিদ্বিধায় মেনে নেয়া শুধু আচার অনুষ্ঠান কিংবা অধিকারের সাথেই সম্পৃক্ত নয়; আকীদা এবং অপরাপর বৈষয়িক বিষয়েও ব্যাপক। অতএব, কোন সময় কোন বিষয়ে পারস্পারিক মতবিরোধ দেখা দিলে বিবাদ পরিহার করে উভয় পক্ষকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এবং তার অবর্তমানে তার প্রবর্তিত শরীআতের আশ্রয়ে গিয়ে মীমাংসা অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরয।

(২) এতে এ কথাও জানা গেল যে, যে কাজ বা বিষয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক কথা বা কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত, তা সম্পাদন করতে গিয়ে মনে কোন রকম সংকীর্ণতা অনুভব করাও ঈমানের দূর্বলতার লক্ষণ। উদাহারণতঃ যে ক্ষেত্রে শরীআত তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করার অনুমতি দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে যদি কেউ সম্মত না হয় তবে একে পরহেযগারী বলে মনে করা যাবে না, বরং এটা একান্তই মানসিক ব্যাধি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা কেউ বেশী পরহেযগার হতে পারে না। যে অবস্থায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসে সালাত আদায়ের অনুমতি দিয়েছেন এবং নিজেও বসে সালাত আদায় করেছেন, কারো মন যদি এতে সম্মত না হয় এবং অসহনীয় পরিশ্রম ও কষ্ট সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে, তবে তার জেনে রাখা উচিত যে, তার মন ব্যাধিগ্রস্ত।

(৩) এ আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহত্ত্ব ও সুউচ্চ মর্যাদার বিষয় প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে কুরআনের অসংখ্য আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের অপরিহার্যতার বিষয়টি সবিস্তারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা শপথ করে বলেছেন যে, কোন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন কিংবা মুসলিম হতে পারে না যতক্ষণ না সে ধীরস্থির মস্তিস্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এভাবে স্বীকার করে নেবে যাতে রাসূলের কোন সিদ্ধান্তেই মনে কোন রকম সংকীর্ণতা না থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাসূল হিসেবে গোটা উম্মতের শাসক এবং যে কোন বিবাদের মীমাংসার যিম্মাদার। তার শাসন ও সিদ্ধান্ত অপর কাউকে বিচারক সাব্যস্ত করার উপর নির্ভরশীল নয়। তিনি শুধুমাত্র একজন শাসকই নন, বরং তিনি একজন নিষ্পাপ রাসূল, রাহমাতুল্লিল আলামীন এবং উম্মতের জন্য একান্ত দয়ালু ব্যক্তিত্ব। কাজেই শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, যখনই কোন বিষয়ে, কোন সমস্যার ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয়, তখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিচারক সাব্যস্ত করে তার মীমাংসা করিয়ে নেয়া উচিত এবং অতঃপর তার মীমাংসাকে স্বীকার করে নিয়ে সেমতে কাজ করা উভয় পক্ষের উপর ফরয।

মনে রাখতে হবে যে, কুরআনের বাণী ও রাসূলের হাদীসসমূহের উপর আমল করা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের সাথেই সীমিত নয়। তার তিরোধানের পর তার পবিত্র শরীআতের মীমাংসাই হল তার মীমাংসা। কাজেই এ নির্দেশটি কিয়ামত পর্যন্ত তেমনিভাবেই বলবৎ থাকবে, যেমন ছিল তার যুগে। তেমনি তার পরে তার প্রবর্তিত শরীআতের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। এটা প্রকৃতপক্ষে তারই অনুসরণ।

আনাস ও আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে মারফূ‘ হিসেবে বর্ণিত, “তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হই।”

[সহীহ] – [এটি বুখারী বর্ণনা করেছেন। – মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)।]

এ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন যে, কোনো মুসলিমের ঈমান পরিপূর্ণ হবে না এবং এমন ঈমান অর্জন করতে পারবে না যার দ্বারা সে আযাব ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবে, যতক্ষণ না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুহাব্বত তার পিতা-মাতা এবং সব মানুষের অপেক্ষা অগ্রগামী হবে। তার কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত মানেই হচ্ছে আল্লাহর মুহাব্বত। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে মুবাল্লিগ এবং তাঁর দীনের দিকে আহ্বানকারী। প্রকৃত প্রস্তাবে শরী‘আতের আদেশ পালন ও তার নিষেধসমূহ বর্জন করাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মুহাব্বতের সত্যিকার প্রমাণ। সেটা কখনো কবিতা আবৃত্তি করা, অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং বিভিন্ন স্বরে গান গাওয়ার মাধ্যমে সাব্যস্ত হয় না

আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম রা. বলেন, একদিন আমরা নবীজী (সা.)-এর সাথে ছিলাম। নবীজী ওমর রা.-এর হাত ধরা ছিলেন। ওমর রা. বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমার কাছে সবকিছু থেকে প্রিয়, তবে আমার জান ছাড়া। তখন নবীজী (সা.) বললেন, না ওমর, এতে হবে না। যে সত্তার হাতে আমার জান তাঁর কসম! (ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না,) যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার জানের চেয়েও প্রিয় না হই। পরক্ষণেই ওমর রা. বললেন, হ্যাঁ এখন তা হয়েছে; আল্লাহর কসম! (এখন থেকে) আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও প্রিয়। তখন নবীজী (সা.) বললেন, হ্যাঁ ওমর! এখন হয়েছে। (সহীহ বুখারী : ৬৬৩২)।

নবীজী (সা.) বলে গেছেন, ব্যক্তি যাকে ভালোবাসে তার সাথেই তার হাশর হবে। (সহীহ মুসলিম : ২৬৪০)।

হযরত আনাস রা. বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমাদের কাছে সবচে’ খুশির বিষয় ছিল নবী কারীম (সা.)-এর এই কথা, ‘নিশ্চয়ই যাকেতুমি ভালোবাস, (কিয়ামতের দিন) তার সাথেই থাকবে।’ আনাস রা. আরও বলেন, আর আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি। আবু বকর ও উমরকেও। তাই আশা রাখি, আখেরাতে আমি তাঁদের সাথেই থাকব, যদিও তাঁদের মতো আমল আমি করতে পারিনি। (সহীহ মুসলিম : ২৬৩৯)।

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যার মধ্যে তিনটি বস্তু পাওয়া যাবে, সে ঐ তিন বস্তুর মাধ্যমে ঈমানের মিষ্টতা অনুভব করবে। (১) আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নিকট সর্বাধিক প্রিয়তম হবে, (২) কোন ব্যক্তিকে সে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে এবং (৩) সে (মুসলমান হওয়ার পর) পুনরায় কুফরীতে ফিরে যেতে এমন অপছন্দ করবে, যেমন সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে।” (বুখারী ১৬, মুসলিম ১৭৪নং)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে আমার প্রতি ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি প্রগাঢ় হবে এমন কিছু লোক, যারা আমার পরবর্তীকালে আগমন করবে; তাদের প্রত্যেকে এই আশা পোষণ করবে যে, যদি সে তার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের বিনিময়ে আমার দর্শন লাভ করতে পারত!” (আহমাদ ৯৩৯৯, মুসলিম ৭৩২৩, ইবনে হিব্বান ৭২৩১, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৪১৮, ১৬৭৬নং)

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছে এসে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি অবশ্য অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসি।’ তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তুমি কী বলছ, তা ভেবে দেখ।” সে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি অবশ্য অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসি।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবারও বললেন, “তুমি কী বলছ, তা ভেবে দেখ।” সে পুনরায় বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি অবশ্য অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসি।’ একই কথার তিনবার পুনরাবৃত্তি করলে তিনি বললেন, “যদি তুমি আমাকে ভালোবেসেই থাকো, তাহলে দারিদ্রের জন্য বর্ম প্রস্তুত রাখো। কেননা, যে আমাকে ভালবাসবে, স্রোত তার শেষ প্রান্তের দিকে যাওয়ার চাইতেও বেশি দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য তার নিকট আগমন করবে।” (তিরমিযী ২৩৫০, সিঃ সহীহাহ ২৮২৭নং)

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

৪:৬৬ وَ لَوۡ اَنَّا کَتَبۡنَا عَلَیۡهِمۡ اَنِ اقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ اَوِ اخۡرُجُوۡا مِنۡ دِیَارِکُمۡ مَّا فَعَلُوۡهُ اِلَّا قَلِیۡلٌ مِّنۡهُمۡ ؕ وَ لَوۡ اَنَّهُمۡ فَعَلُوۡا مَا یُوۡعَظُوۡنَ بِهٖ لَکَانَ خَیۡرًا لَّهُمۡ وَ اَشَدَّ تَثۡبِیۡتًا 

৬৬. আর যদি আমরা তাদেরকে আদেশ দিতাম যে, তোমরা নিজেদেরকে হত্যা কর বা আপন গৃহ ত্যাগ কর তবে তাদের অল্প সংখ্যকই তা করত(১)। যা করতে তাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা তা করলে তাদের ভাল হত এবং চিত্তস্থিরতায় তারা দৃঢ়তর হত।

আয়াতে অবাধ্য প্রকৃতির লোকদের প্রত্যাখ্যান করার কু-অভ্যাসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে যে, এদেরকে যদি নির্দেশ দেওয়া হত যে, তোমরা পরস্পরকে হত্যা কর অথবা নিজেদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও, তাহলে তারা এই নির্দেশের উপর কিভাবে আমল করতে পারত, অথচ তারা এর থেকেও আসান জিনিসের উপর আমল করতে পারেনি? তাদের ব্যাপারে এটা মহান আল্লাহ নিজ জ্ঞান অনুযায়ী বলেছেন, যা অবশ্যই বাস্তবসম্মত। অর্থাৎ, কঠিন নির্দেশের উপর আমল করা তো অবশ্যই কঠিন। কিন্তু মহান আল্লাহ চরম দয়ালু এবং পরম করুণাময়, তাঁর বিধানাদিও সহজ। কাজেই তারা যদি এই নির্দেশগুলো পালন করে, যা করতে তাদেরকে নসীহত করা হচ্ছে, তাহলে তা তাদের জন্য উত্তম এবং (দ্বীনে) সুদৃঢ় থাকার মাধ্যম সাব্যস্ত হবে। কেননা, ঈমান পুণ্যকর্ম দ্বারা বর্ধিত হয় এবং পাপকর্ম দ্বারা হ্রাস পায়। পুণ্য দ্বারা পুণ্যের পথ আরো খুলে যায় এবং পাপ দ্বারা আরো অনেক পাপের জন্ম হয়। অর্থাৎ, পাপের পথ আরো প্রশস্ত এবং সহজ হয়ে যায়।

৪:৬৭ وَّ اِذًا لَّاٰتَیۡنٰهُمۡ مِّنۡ لَّدُنَّـاۤ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿ۙ

৬৭. আর অবশ্যই তখন আমরা তাদেরকে আমাদের কাছ থেকে মহাপুরস্কার প্রদান করতাম।

৪:৬৮ وَّ لَهَدَیۡنٰهُمۡ صِرَاطًا مُّسۡتَقِیۡمًا ﴿۶۸

৬৮. এবং অবশ্যই আমরা তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করতাম।

স্নেহ ও করুণা এবং কল্যাণ কামনাসহ কাউকে মঙ্গলময় পথ দেখিয়ে দেয়া ও মনজিলে পৌছিয়ে দেয়াকে আরবী পরিভাষায় ‘হেদায়াত’ বলে। হেদায়াত’ শব্দটির দুইটি অর্থ। একটি পথ প্রদর্শন করা, আর দ্বিতীয়টি লক্ষ্য স্থলে পৌছিয়ে দেয়া।

যেখানে এই শব্দের পর দুইটি object থাকবে إلى থাকবে না, সেখানে এর অর্থ হবে লক্ষ্যস্থলে পৌছিয়ে দেয়া।

আর যেখানে এ শব্দের পর إلى শব্দ আসবে, সেখানে অর্থ হবে পথ-প্রদর্শন।

যেমন আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করে বলেছেন,

إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ

“নিশ্চয়ই আপনি লক্ষ্যস্থলে—মনজিলে পৌঁছিয়ে দিতে পারবেন না যাকে আপনি পৌছাতে চাইবেন। বরং আল্লাহই লক্ষ্যস্থলে পৌছিয়ে দেন যাকে তিনি ইচ্ছা করেন [সূরা আল-কাসাস ৫৬]

কিন্তু লক্ষ্যস্থলে পৌছিয়ে দেয়ার কাজ কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। তাই তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন,

وَلَهَدَيْنَاهُمْ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا “আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে সরল সোজা সুদৃঢ় পথে পৌছিয়ে দিতাম।[সূরা আন-নিসা: ৬৮]

 

সূরা আল-ফাতিহা’র আলোচ্য আয়াতে হেদায়েত শব্দের পর إلى শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। ফলে এর অর্থ হবে সোজা সুদৃঢ় পথে মনজিলের দিকে চালনা করা। অর্থাৎ যেখানে বান্দাহ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে শুধু এতটুকু বলে না যে, হে আল্লাহ্! আপনি আমাদেরকে সোজা সুদৃঢ় পথের সন্ধান দিন। বরং বলে, হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে সরল সুদৃঢ় পথে চলবার তাওফীক দিয়ে মনজিলে পৌছিয়ে দিন। কেননা শুধু পথের সন্ধান পাইলেই যে সে পথ পাওয়া ও তাতে চলে মনজিলে পোঁছা সম্ভবপর হবে তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু সিরাতে মুস্তাকীম কি?

সিরাত শব্দের অর্থ হচ্ছে, রাস্তা বা পথ। আর মুস্তাকীম হচ্ছে, সরল সোজা। সে হিসেবে সিরাতে মুসতাকীম হচ্ছে, এমন পথ, যা একেবারে সোজা ও ঋজু, প্রশস্ত ও সুগম; যা পথিককে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছিয়ে দেয়; যে পথ দিয়ে লক্ষ্যস্থল অতি নিকটবর্তী এবং মনযিলে মাকছুদে পৌছার জন্য যা একমাত্র পথ, যে পথ ছাড়া লক্ষ্যে পৌছার অন্য কোন পথই হতে পারে না।

 

আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ আমারও রব তোমাদেরও রব, অতএব একমাত্র তারই দাস হয়ে থাক। এটাই হচ্ছে সিরাতুম মুস্তাকীম-সঠিক ও সুদৃঢ় ঋজু পথ [সূরা মারইয়াম: ৩৬]

অর্থাৎ আল্লাহকে রব স্বীকার করে ও কেবল তারই বান্দাহ হয়ে জীবন যাপন করলেই সিরাতুম মুস্তাকীম অনুসরণ করা হবে। অন্যত্র ইসলামের জরুরী বিধি-বিধান বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর এটাই আমার সঠিক দৃঢ় পথ, অতএব তোমরা এই পথ অনুসরণ করে চল। এছাড়া আরও যত পথ আছে, তাহার একটিতেও পা দিও না; কেননা তা করলে সে পথগুলো তোমাদেরকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দিবে-ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন এ উদ্দেশ্যে, যেন তোমরা ধ্বংসের পথ হতে আত্মরক্ষা করতে পার [সূরা আল-আনআমঃ ১৫৩]

একমাত্র আল্লাহর নিকট থেকে যে পথ ও বিধি-বিধান পাওয়া যাবে, তাই মানুষের জন্য সঠিক পথ। আল্লাহ বলেন, “প্রকৃত সত্য-সঠিক-ঋজু-সরল পথ প্রদর্শন করার দায়িত্ব আল্লাহর উপর, যদিও আরও অনেক বাঁকা পথও রয়েছে। আর আল্লাহ চাইলে তিনি সব মানুষকেই হেদায়াতের পথে পরিচালিত করতেন [সূরা আন-নাহ্‌ল: ৯]

 

সিরাতে মুসতাকীমের তাফসীর কোন কোন মুফাসসির করেছেন, ইসলাম। আবার কারও কারও মতে, কুরআন। [আত-তাফসীরুস সহীহ] বস্তুত: আল্লাহর প্রদত্ত বিশ্বজনীন দ্বীনের অন্তর্নিহিত প্রকৃত রূপ ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ শব্দ হতে ফুটে উঠেছে। আল্লাহ্ তা’আলার দাসত্ব কবুল করে তারই বিধান অনুসারে জীবন যাপন করার পথই হচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকীম এবং একমাত্র এই পথে চলার ফলেই মানুষ আল্লাহর নিয়ামত ও সন্তোষ লাভ করতে পারে। সে একমাত্র পথই মানব জীবনের প্রকৃত ও চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য একান্ত অপরিহার্য। তাই সে একমাত্র পথে চলার তওফীক প্রার্থনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে এই আয়াতটিতে। কিন্তু আল্লাহর নিকট হতে এই পথ কিরূপে পাওয়া যেতে পারে? সে পথ ও পন্থা নির্দেশ করতে গিয়ে আল্লাহ এর তিনটি সুস্পষ্ট পরিচয় উল্লেখ করেছেনঃ

১. এই জীবন কিভাবে যাপন করতে হবে তা তাদের নিকট হতে গ্রহণ করতে হবে, যারা উক্ত বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করে আল্লাহর নিকট হতে নিয়ামত ও অসীম অনুগ্রহ লাভ করেছে।

২. এই পথের পথিকদের উপর আল্লাহর গজব নাযিল হয় নি, অভিশপ্তও তারা নয়।

৩, তারা পথভ্রান্ত লক্ষ্যভ্রষ্টও নয়।

যখন তারা সংশয় পরিহার করে ঈমান ও নিশ্চিত বিশ্বাস সহকারে রসূলের আনুগত্য করার ফায়সালা করে তখন আল্লাহর অনুগ্রহে তাদের সামনে প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের সরল-সোজা পথ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ তখন নিজেদের শক্তি ও মেহনত যে পথে ব্যবহার করলে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ আসল মনযিলে মাকসূদের দিকে এগিয়ে যাবে সে পথটি তারা পরিস্কার দেখতে পায়৷

আল্লাহ কাদের সরল পথে পরিচালিত করেন—

যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত”।(সূরা তাগাবুনঃ১১)

তিনি তাদেরকে তাঁর পথ দেখান যারা তাঁর অভিমুখী”।(সূরা রা’দঃ২৭)

যারা সৎপথ অবলম্বন করে আল্লাহ তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে মুত্তাকী হবার শক্তিদান করেন “(সূরা মুহাম্মাদঃ১৭)

“সুতরাং কেউ দান করলে,মুত্তাকী হলে এবং যা উত্তম তা সত্য বলে গ্রহণ করলে,আমি তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ।এবং কেহ কার্পণ্য করলে ও নিজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলে,আর যা উত্তম তা অস্বীকার করলে, তার জন্য আমি সুগম করে দেব কঠোর পথ”।(সূরা লায়লঃ৫-১০)

শপথ মানুষের এবং তাঁর, যিনি তাকে সুঠাম করেছেন,অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন।সে-ই সফলকাম হবে,যে নিজেকে পবিত্র করবে।এবং সে-ই ব্যর্থ হবে,যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।(সূরা শামসঃ৭-১০)

সঠিক পথে চলবার ব্যাপারটা আল্লাহর সাথে দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কের মত।যতই আপনি আল্লাহর উপর ঈমান আনবেন,ততই আল্লাহ আপনাকে সঠিক রাস্তায় তুলে নিয়ে আসবেন।এর জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে,প্রার্থনা করতে হবে।আর এর বিপরীতে আমরা যদি অসচেতন ও ভ্রূক্ষেপবিহীন হই তবে আল্লাহ গোমরাহির দিকে ঠেলে দিবেন।তাই প্রিয় নবীজী (সাঃ) প্রায়ই প্রার্থনা করতেনঃ

হে অন্তরের নিয়ন্ত্রক,আমাদের অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত করে দিন এবং আমাদের অন্তরকে আপনার আনুগত্যের দিকে নিয়ে আসুন।(তিরমিযিঃ৩৫২২,মুসলিমঃ২৬৫৪)

হেদায়েতের ৩টি স্তরঃ (ইমাম রাগেব ইসফাহানী ‘মুফরাদাতুল কোরআনে’ হেদায়েত শব্দের সুন্দও ব্যাখ্যা দিয়েছেন)

১মঃ সাধারণ ও ব্যাপক।

এতে সমগ্র সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত। জড়পদার্থ, উদ্ভিদ এবং প্রাণিজগত পর্যন্ত এর আওতাধীন।

এমন কোনো বস্তু নেই যা আল্লাহর প্রশংসার তাসবিহ পাঠ করে না, কিন্তু তোমরা তাদের তাসবিহ বোসুরা নূরে ইরশাদ হয়েছে-

‘তোমরা কি জাননা যে, আসমান-জমিনে যা কিছু রয়েছে, সকলেই আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা ও গুণগান করে? বিশেষত পাখীকুল যারা দুই পাখা বিস্তার করে শূন্যে উড়ে বেড়ায়, তাদের সকলেই স্ব স্ব দোয়া তাসবিহ সম্পর্কে জ্ঞাত এবং আল্লাহ তায়ালাও তাদের তাসবিহ সম্পর্কে খবর রাখেন।ঝতে পার না। সূরা বনী ইসরাঈল।

২য়ঃ হেদায়েতের দ্বিতীয় স্তর হলো সে সমস্ত বস্তুর সাথে জড়িত, পরিভাষায় যাদেরকে বিবেকবান বুদ্ধিসম্পন্ন বলা হয়। অর্থাৎ মানুষ এবং জ্বিন জাতি। এ হেদায়েত নবি-রসুল ও আসমানি কিতাবের মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের নিকট পৌঁছেছে। কেউ এই হেদায়েতকে গ্রহণ করে মুমিন হয়েছে, আবার কেউ একে প্রত্যাখ্যান করে কাফির বে দ্বীনে পরিণত হয়েছে।

৩য়ঃ হেদায়েতের তৃতীয় স্তর আরো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তা শুধু মুমিন মুত্তাকি বা ধর্মভীরুদের জন্য। এই হেদায়েত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোনো প্রকাশ মাধ্যম ছাড়াই মানুষকে প্রদান করা হয়। এরই নাম তওফিক। অর্থাৎ এমন অবস্থা, পরিবেশ ও মনোভাব সৃষ্টি করে দেওয়া যে, তার ফলে কোরআনের হেদায়েতকে গ্রহণ করা এবং এর ওপর আমল করা সহজসাধ্য হয় এবং এর বিরুদ্ধাচরণ কঠিন হয়ে পড়ে। এই তৃতীয় স্তরের পরিসীমা অতি ব্যাপক। এই স্তরই মানুষের উন্নতির ক্ষেত্র। নেক কাজের সাথে এই হেদায়েতের বৃদ্ধি হতে থাকে। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই বৃদ্ধির উল্লেখ রয়েছে।

ইরশাদ হয়েছে

‘যারা আমার পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা কওে, আমি তাদেরকে আমার পথে আরো অধিকতর অগ্রসর হওয়ার পথ অবশ্যই দেখিয়ে থাকি’

হেদায়েতের তিনটি স্তরের মধ্যে প্রথম ও তৃতীয় স্তর সরাসরি আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ পর্যায়ের হেদায়েত একান্তভাবে একমাত্র তারই কাজ। এতে নবি-রসুলগণেরও কোনো অধিকার নেই। নবি-রসুলগণের কাজ শুধু হেদায়েতের দ্বিতীয় স্তরে সীমাবদ্ধ। কোরআনের যেখানে যেখানে নবি-রসুলগণকে হেদায়েতকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা হেদায়েতের দ্বিতীয় স্তরের ভিত্তিতেই বলা হয়েছে

প্রশ্নঃ: কিভাবে আমরা আল্লাহ্‌ তাআলার বাণী:

وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَن تُؤْمِنَ إِلاَّ بِإِذْنِ اللّه

আল্লাহ্‌র অনুমতি ছাড়া ঈমান আনা কারো সাধ্য নয়) ও তাঁর বাণী:

وَاللَّهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ

আল্লাহ্‌যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন) এর মাঝে সমন্বয় করতে পারি? আল্লাহ্‌আমাদেরকে যে ফিতরাতের উপর সৃষ্টি করেছেন আমি সে ফিতরাতের উপর থাকার চেষ্টা করি এবং তিনি যা কিছুর উপর ঈমান আনতে আমাদেরকে আদেশ করেছেন সেগুলোর উপর ঈমান আনার মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করার চেষ্টা করি। কিন্তু ইদানিং আমার কাছে এই বিষয়ে শয়তানের কুমন্ত্রণা আসা শুরু হয়েছে। তাই আমি এ বিষয়ে জবাব পেতে চাই।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

তাওফিক ও হেদায়েত আল্লাহ্‌র হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিতে চান তাকে হেদায়েত দেন; আর যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান তাকে পথভ্রষ্ট করেন। আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “এটা আল্লাহ্‌র পথনির্দেশ, তিনি তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন। আল্লাহ্‌যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন হেদায়াতকারী নেই।”[সূরা যুমার, ৩৯:২৩] তিনি আরও বলেন: “আল্লাহ্‌যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে রাখেন।”[সূরা আনআম, ৬:৩৯] তিনি আরও বলেন: “আল্লাহ্‌যাকে পথ দেখান সে-ই পথ পায় এবং যাদেরকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।”[সূরা আল-আরাফ, ৭:১৭৮]

একজন মুসলিম তার নামাযে দোয়া করে: “আমাকে সরল পথে অটল রাখুন।”[সূরা ফাতিহা, ১:৬] যেহেতু বান্দা জানে যে, হেদায়েত আল্লাহ্‌র হাতে। তা সত্ত্বেও বান্দা হেদায়েতের উপায়-উপকরণ গ্রহণ করতে আদিষ্ট। ধৈর্য রাখা, অবিচল থাকা এবং সরল পথে পথচলা শুরু করতে আদিষ্ট। কারণ আল্লাহ্‌তাকে প্রোজ্জ্বল বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন; যা দিয়ে সে ভাল কিংবা মন্দ, হেদায়েত কিংবা পথভ্রষ্টতা নির্বাচন করতে পারে। যদি বান্দা প্রকৃত উপকরণগুলো ব্যবহার করে এবং আল্লাহ্‌তাকে হেদায়েত দিন এর জন্য সচেষ্ট থাকে তখন আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সে তাওফিকপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “এভাবেই আমি একদলকে আরেকদল দ্বারা পরীক্ষা করেছি; কেননা তারা বলতে পারত, ‘আল্লাহ্‌কি আমাদের মধ্য থেকে এদেরকেই অনুগ্রহ করলেন?’ কৃতজ্ঞদের সম্পর্কে আল্লাহ্‌ই কি সবচেয়ে বেশী অবগত নন?”[সূরা আনআম, ৬:৫৩]

এই যে মাসয়ালাটি কিছু কিছু মানুষের কাছে জটিলতা তৈরী করে সেটা নিয়ে শাইখ উছাইমীন (রহঃ) দীর্ঘ আলোচনা করেছেন; তিনি বলেন: “যদি সব কিছুর উৎস হয় আল্লাহ্‌তাআলার ইচ্ছা এবং সব কিছু তাঁর হাতেই থাকে তাহলে মানুষের পথ কী? যদি আল্লাহ্‌তাআলা মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়া ও হেদায়েত না-পাওয়া তাকদীরে রাখেন তাহলে মানুষের উপায় কী? আমরা বলব: এর জবাব হচ্ছে আল্লাহ্‌তাআলা কেবল তাকেই হেদায়েত দান করেন যে হেদায়েত পাওয়ার উপযুক্ত এবং তাকেই পথভ্রষ্ট করেন যে পথভ্রষ্ট হওয়ার উপযুক্ত। আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “কিন্তু তারা যখন বাঁকা পথ ধরল, তখন আল্লাহ্‌ও তাদের অন্তরকে বাঁকা করে দিলেন।”[সূরা আছ-ছফ, ৬১:৫]

তিনি আরও বলেন:”অতএব তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে আমি তাদেরকে অভিসম্পাত দিয়েছি এবং তাদের অন্তরসমূহ কঠিন করেছি। তারা শব্দসমূহের সঠিক অর্থ বিকৃত করে। তাদেরকে যা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তারা ভুলে গিয়েছে।”[সূরা আল-মা’ইদাহ, ৫:১৩]

আল্লাহ্‌ পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যে বান্দাকে পথভ্রষ্ট করেছেন তাকে পথভ্রষ্ট করার কারণ সে বান্দার পক্ষ থেকেই। বান্দা তো জানে না আল্লাহ্‌তার তাকদীরে কী রেখেছেন। যেহেতু তাকদীরকৃত বিষয়টি সংঘটিত হওয়ার পর সে তাকদীরের কথা জানতে পারে। সে জানে না যে, আল্লাহ্‌কি তাকে পথভ্রষ্ট হিসেবে তাকদীরে রেখেছেন; নাকি হেদায়েতপ্রাপ্ত হিসেবে? সুতরাং সে নিজে ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করে কেন আপত্তি আরোপ করবে যে আল্লাহ্‌ই তার জন্য সেটা চেয়েছেন! তার জন্য কী এটাই উপযুক্ত ছিল না যে, সে নিজে হেদায়েতের পথে চলবে এবং এরপর বলবে: নিশ্চয় আল্লাহ্‌ আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।

 

এটা কী তার জন্য সমীচীন যে পথভ্রষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সে জাবারিয়া (নিয়তিবাদী) হবে, আর আনুগত্যের সময় সে কাদারিয়া (তাকদীর অস্বীকারকারী) হবে! কক্ষনো নয়, পথভ্রষ্টতা ও গুনাহর ক্ষেত্রে কোন মানুষের জাবারিয়া হওয়া সমীচীন নয় যে, পথভ্রষ্ট হয়ে কিংবা গুনাহ করে সে বলবে: এটি আমার জন্য লেখা ছিল ও তাকদীরে ছিল, আল্লাহ্‌আমার জন্য যা ফয়সালা করে রেখেছেন সেটা থেকে বের হওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।

প্রকৃতপক্ষে মানুষের ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। রিযিকের বিষয়টির চেয়ে হেদায়েতের বিষয় অধিক প্রচ্ছন্ন নয়। সকলের কাছেই সুবিদিত যে, মানুষের রিযিক পূর্বনির্ধারিত (তাকদীরকৃত)। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ রিযিক লাভের উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার চেষ্টা করে; নিজের দেশে থেকে, বিদেশে গিয়ে, ডানে, বামে। কেউ নিজ বাড়ীতে বসে থেকে বলে না যে: আমার জন্য যে রিযিক নির্ধারণ করা আছে সেটা আমার কাছে আসবেই। বরং রিযিক লাভের উপায়-উপকরণগুলো গ্রহণ করার চেষ্টা করে। অথচ রিযিকের সাথে আমলের কথাও আছে; যেমনটি হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে।

নেক আমল বা বদ আমল করা যেমন লিপিবদ্ধ ঠিক তেমনি রিযিকও লিপিবদ্ধ। তাহলে দুনিয়ার রিযিক তালাশ করার জন্য আপনি ডানে যান, বামে যান, পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ান; অথচ আখিরাতের রিযিক তালাশ করা ও চূড়ান্ত সুখ লাভে সফল হওয়ার জন্য আপনি নেক আমল করবেন না!!

অথচ দুটো একই ধরণের। দুটোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আপনি যেমন রিযিকের জন্য চেষ্টা করেন, নিজের জীবন ও বয়সকে প্রলম্বিত করার প্রচেষ্টা করেন: আপনি অসুস্থ হলে পৃথিবীর আনাচেকানাচে ভাল ডাক্তারের অনুসন্ধান করেন যিনি আপনার রোগের চিকিৎসা দিতে পারবে। অথচ আপনার আয়ু যতটুকু নির্ধারণ করা আছে তার চেয়ে একটুও বাড়বে না, কিংবা কমবে না। আপনি তো এর উপর নির্ভর করে বসে থাকেন না এবং বলেন না যে, আমি অসুস্থ হয়ে আমার ঘরে পড়ে থাকব; আল্লাহ্‌যদি আমার আরও দীর্ঘ হায়াত নির্ধারণ করে রাখেন (তাকদীরে রাখেন) তাহলে হায়াত দীর্ঘায়িত হবেই। বরং আমরা দেখতে পাই যে, আপনি আপনার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেন, সন্ধান করেন যাতে করে এমন কোন ডাক্তার খুঁজে পান যার হাতে রোগ থেকে সুস্থ হওয়া আল্লাহ্‌নির্ধারণ করে রেখেছেন।

তবে আপনার আখিরাতের ও সৎকর্মের পন্থা কেন দুনিয়ার কর্মপন্থার মত হয় না? ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ক্বাযা বা আল্লাহ্‌র ফয়সালা হচ্ছে এমন এক গোপন গূঢ় রহস্য যা জানা সম্ভবপর নয়।

এখন আপনার সামনে দুটো পথ খোলা আছে:

এক পথ আপনাকে নিরাপত্তা, সফলতা, সুখ ও সম্মানে পৌঁছাবে।

অপর পথ আপনাকে ধ্বংস, অনুতপ্ততা ও অসম্মানে পৌঁছাবে।

আপনি এখন এ দুটো রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং আপনি স্বাধীন। এমন কেউ নাই যে আপনাকে ডানের রাস্তায় চলতে বাধা দিবে কিংবা বামের রাস্তায় চলতে বাধা দিবে। আপনি চাইলে এই পথেও যেতে পারেন এবং ঐ পথেও যেতে পারেন।

এ আলোচনার মাধ্যমে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মানুষ তার স্বনির্বাচিত কর্মে স্বাধীনভাবে অগ্রসর হতে পারে। অর্থাৎ সে তার দুনিয়াবী কর্মে যেভাবে স্বাধীনভাবে অগ্রসর হতে পারে; অনুরূপভাবে সে তার আখিরাতের পথেও এভাবে স্বাধীনভাবে চলতে পারে। বরং আখিরাতের পথগুলো দুনিয়ার পথগুলোর চেয়ে আরো বেশি সুস্পষ্ট। কারণ আখিরাতের পথগুলোর বর্ণনাকারী আল্লাহ্‌তাআলা নিজে; তাঁর নাযিলকৃত গ্রন্থে ও তাঁর রাসূলের মুখে। তাই আখিরাতের পথগুলো দুনিয়ার পথগুলোর চেয়ে অধিক স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। তা সত্ত্বেও মানুষ দুনিয়ার পথগুলো ধরে অগ্রসর হয়; যার ফলাফলের গ্যারান্টি নাই। কিন্তু আখিরাতের পথগুলো বর্জন করে; অথচ সেগুলোর ফলাফল গ্যারান্টিযুক্ত ও সুবিদিত; কেননা এর ফলাফল আল্লাহ্র প্রতিশ্রুত। আল্লাহ্‌তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।

এই আলোচনার পর আমরা বলব: আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত এই আকিদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা তাদের আকিদা-বিশ্বাস এভাবে ঠিক করেছেন যে, মানুষ নিজ ইচ্ছায় তার কর্ম করে এবং তার ইচ্ছানুযায়ী সে কথা বলে। কিন্তু তার ইচ্ছা ও এখতিয়ার আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের অনুবর্তী।

আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআত ঈমান রাখে যে, আল্লাহ্‌র অভিপ্রায় তাঁর হেকমত (প্রজ্ঞা)-র অনুবর্তী। আল্লাহ্‌র তাআলার হেকমত বর্জিত কোন অভিপ্রায় নাই; বরং তাঁর অভিপ্রায় তাঁর হেকমতের অনুবর্তী। কেননা আল্লাহ্‌র নামসমূহের মধ্যে রয়েছে الحكيم “আল-হাকীম” (বিচারক, নিপুণ ও প্রজ্ঞাবান)। “আল-হাকীম” হচ্ছেন— যিনি সবকিছুর অস্তিত্বগত ও আইনগত সিদ্ধান্ত দেন এবং কর্ম ও সৃষ্টির দিক থেকে সবকিছুকে নিপুণভাবে সম্পাদন করেন। আল্লাহ্‌তাআলা তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে যার জন্য ইচ্ছা হেদায়েত নির্ধারণ করে রাখেন, যার ব্যাপারে জানেন যে সে সত্যকে গ্রহণ করতে চায় ও তার অন্তর সঠিক পথে আছে এবং যে এমন নয় তার জন্য পথভ্রষ্টতা নির্ধারণ করে রাখেন, যার কাছে ইসলামকে পেশ করা হলে তার অন্তর সংকুচিত হয়ে পড়ে যেন সে আকাশে আরোহণ করছে। আল্লাহ্‌ তাআলার প্রজ্ঞা এমন ব্যক্তির হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়াকে অস্বীকার করে; তবে যদি না আল্লাহ্‌তাআলা তাঁর সংকল্পকে নবায়ন করেন এবং তাঁর পূর্ব ইচ্ছাকে অন্য কোন ইচ্ছা দিয়ে পরিবর্তন করে নেন। আল্লাহ্‌তাআলা সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। কিন্তু আল্লাহ্‌তাআলার হেকমত (প্রজ্ঞা)-র দাবী হচ্ছে— হেতুর ফলাফল সাথে সম্পৃক্ত থাকা।”[রিসালা ফিল কাযা ওয়াল ক্বাদর (পৃষ্ঠা-১৪-২১) থেকে সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]

 

একজন মুসলিম ক্বাযা ও ক্বাদর (ভাগ্য ও নিয়তি)-এর বিষয়টি যে কর্মের দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে তার সাথে এভাবেই বুঝে থাকে। যে কর্মের উপর তার সুখ ও দুঃখ নির্ভর করে। হেদায়েতপ্রাপ্তি ও জান্নাতে প্রবেশের কারণ হচ্ছে— নেক আমল। আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “এই হল জান্নাত; তোমাদের কর্মের প্রতিদানে তোমাদেরকে এর উত্তরাধিকারী করা হয়েছে।”[সূরা আরাফ, ৭:৪৩] তিনি আরও বলেন: “তোমরা যেসব (ভাল) কাজ করতে তার প্রতিদানস্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ কর।”[সূরা নাহল, ১৬:৩২] আর পথভ্রষ্টতা ও জাহান্নামের প্রবেশের কারণ হচ্ছে— আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা ও তাঁর আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। জাহান্নামবাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “তারপর অন্যায়কারীদেরকে বলা হবে, ‘চিরন্তন শাস্তি আস্বাদন কর। তোমরা যা উপার্জন করতে তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হচ্ছে।”[সূরা ইউনুস, ১০:৫২]  তিনি আরও বলেন: “তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য চিরস্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে থাক।”[সূরা আস-সাজদাহ, ৩২:১৪]

এভাবে বুঝলে একজন মুসলিম সঠিক পথে তার প্রথম পদক্ষেপ ফেলতে পারবে। সে তার জীবনের একটি মুহূর্তও আল্লাহ্‌র পথে আমল করা ছাড়া নষ্ট করবে না। একই সময়ে সে তার রবের প্রতি বিনয়ী থাকবে এবং উপলব্ধি করবে যে, তাঁর হাতেই রয়েছে আসমান ও জমিনের নিয়ন্ত্রণ। তখন সে সার্বক্ষণিক তাঁর কাছে ভিখারি হয়ে থাকা ও তাঁর তাওফিকপ্রাপ্তির প্রয়োজন অনুভব করবে।

আমরা আল্লাহ্‌তাআলার কাছে আমাদের জন্য ও আপনাদের জন্য হেদায়েতপ্রাপ্তি এবং সকল ভাল কর্মের তাওফিক প্রার্থনা করছি।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

হেদায়েতের জন্য দু’আঃ

হাদিসে কুদসি: আবু যর আল গিফারি রা. থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর নিকট থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,

يَا عِبَادِي! كُلُّكُمْ ضَالٌّ إلَّا مَنْ هَدَيْته، فَاسْتَهْدُونِي أَهْدِكُمْ.

“হে আমার বান্দাগণ, আমি যাকে হেদায়েত (সঠিক পথের সন্ধান) দিয়েছি সে ছাড়া তোমরা সকলে পথভ্রষ্ট। সুতরাং তোমরা আমার কাছে হেদায়েত চাও আমি তোমাদেরকে হেদায়েত দান করব।” (সহিহ মুসলিম)

◈ দুআ: ১

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

“হে আল্লাহ, আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।” (সূরা ফাতিহা: ৬)

 

◈ দুআ: ২

اللَّهُمَّ إِنِي أَسْأَلُكَ الهُدَى، وَالتُّقَى، وَالعفَافَ، والغنَى‎

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস আলুকাল হুদা ওয়াত-তুকা ওয়াল আ’ফাফা ওয়াল গিনা।

অর্থ: “হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে সুপথ, আল্লাহ ভীতি,  চরিত্রের নির্মলতা ও অভাব মুক্তির প্রার্থনা করছি।” (সুনানে তিরমিযী, হাদিসটি সহিহ)

 

◈ দুআ: ৩

اللَّهُمَّ أَلْهِمْنِي رُشْدِي، وَأَعِذْنِي مِنْ شَرِّ نَفْسِي

উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা আলহিমনী রুশদী, ওয়া আয়িজনী মিন শাররি নাফসী।

অর্থ: “হে আল্লাহ, আমাকে হেদায়েত দান করো এবং আমার নফসের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করো।”

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-কে দুটি বাক্য দ্বারা দুআ করতে শিখিয়েছিলেন।

(সুনানে তিরমিজি। অবশ্য এ হাদিসটিকে শাইখ আলবানি রহ. জঈফ বলেছেন [জঈফুল জামে/৪০৯৮] তবে কোনও দুআ ভালো অর্থবোধক হলে তা জইফ সনদে বর্ণিত হলেও কোনও সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ- যেখানে নিজের ইচ্ছেমত দুআ করার সুযোগ আছে)

 

◈ দুআ: ৪

 

رَبِّ أَعِنِّي وَلاَ تُعِنْ عَلَىَّ وَانْصُرْنِي وَلاَ تَنْصُرْ عَلَىَّ وَامْكُرْ لِي وَلاَ تَمْكُرْ عَلَىَّ وَاهْدِنِي وَيَسِّرِ الْهُدَى لِي

 

উচ্চারণ:  রাব্বি আ’য়িননী ওয়ালা তু’য়িন আ’লাইয়া। ওয়ানসুরনি ওয়ালা তানসুর আ’লাইয়া। ওয়ামকুর লী ওয়ালা তামকুর আ’লাইয়া, ওয়াহদিনী ওয়া ইসসিরিল হুদা লী।

অর্থ: ‘‘হে আমার রব, আমাকে সাহায্য করো এবং আমার বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করো না। আমাকে সহযোগিতা করো এবং আমার বিরুদ্ধে কাউকে সহযোগিতা করো না। আমার জন্য কৌশল এঁটো, আমার বিরুদ্ধে কৌশল এঁটো না। আমাকে হেদায়েত দান করো, আমার জন্য হেদায়েতের পথ সহজতর করো এবং যে ব্যক্তি আমার উপর অত্যাচার ও সীমা লঙ্ঘন করে তার বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করো। [সুনানে ইবনে মাজাহ- অধ্যায়: ২৮/ দোয়া, পরিচ্ছেদ: ২৮/২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুআ-সহিহ]

 

◈ দুআ: ৫

 

‏ اللَّهُمَّ رَبَّ جِبْرَائِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ تَهْدِي مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‏‏ ‏

 

“হে আল্লাহ, জিবরিল, মিকাইল ও ইসরাফিলের প্রভু, আসমান-জমিনের মালিক, দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সবকিছুর ব্যাপারে সম্যক অবগত, আপনার বান্দারা যে সব বিষয়ে মতবিরোধ করছে আপনি তাতে ফয়সালা করেন। হকের যি বিষয়ে মতবিরোধ দেখা যায় সে বিষয়ে  আপনার অনুমতিক্রমে আমাকে সঠিক পথ দেখান। নিশ্চয় আপনি যাকে ইচ্ছা তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন।” (সহিহ মুসলিম)

 

◈ দুআ: ৬

اَللّٰهُمَّ اهْدِنِيْ وَسَدِّدْنِيْ – اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ الْهُدٰى وَالسَّدَادَ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাহদিনী ওয়া সাদ্দিদনী, আল্লাহুম্মা ইন্নী আস-আলুকাল হুদা ওয়াস সাদাদ।

অর্থ: “হে আল্লাহ, আমাকে হেদায়েত দান কর, আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত কর। হে আল্লাহ! তোমার নিকট হেদায়েত ও সঠিক পথ কামনা করছি।”

[সহিহ মুসলিম]

 

◈ দুআ: ৭

اللَّهُمَّ ثَبِّتْنى وَاجْعَلْهنى هَادِيًا مَهْدِيًّا

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাব্বিতনি ওয়াজ’আলনী হাদিয়াম মাহদিয়া।

অর্থ: “হে আল্লাহ, আমাকে স্থির রাখুন ও হিদায়েত কারী ও হিদায়েত প্রাপ্ত বানান ” [সহিহ মুসলিম]

 

◈ দুআ: ৮

 

اللهمَّ اهْدِني فيمن هديتَ, وعافِني فيمن عافيتَ, وتولَّني فيمن توليتَ, وبارِكْ لي فيما أعطيتَ, وقِنِي شرَّ ما قضيتَ, فإنك تقضي ولا يُقْضَى عليك, وإنَّهُ لا يَذِلُّ من واليتَ, ولا يَعِزُّ من عاديتَ, تباركتَ ربنا وتعاليتَ, لا مَنْجَا منك إلا إليكَ

 

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাহদিনী ফী মান হাদাইত।

ওয়া-ফিনী ফীমান আ’-ফাইত।

ওয়া তাওয়াল্লানী ফী-মান তাওয়াল্লাইত।

ওয়া বা-রিকলী ফী মা আত্বাইত।

ওয়া ক্বিনী শাররা মা-ক্বায্বাইত।

ফাইন্নাকা তাক্বয্বী অলা য্যুকয্বা আলাইক। ইন্নাহু লা য়্যাযিল্লু মাঁউ ওয়া-লাইত। ওয়া লা য়্যাইয্‌যু মান আ’-দাইত। তাবা-রাকতা রাব্বানা ওয়া তাআ’লাইত। লা মানজা মিনকা ইল্লা ইলাইক।

অর্থ: “হে আল্লাহ! তুমি যাদেরকে হেদায়েত করেছ, আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত কর। তুমি যাদেরকে নিরাপদ রেখেছ আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত কর।

তুমি যাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছ, আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করো।

তুমি আমাদেরকে যা দিয়েছ তাতে বরকত দাও।

তুমি যে অমঙ্গল নির্দিষ্ট করেছ তা হতে আমাদেরকে রক্ষা করো। নিশ্চয় তুমিই ফয়সালা করো; তোমার ওপরে ফয়সালা করার কেউ নেই। তুমি যার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছ, সে কোনও দিন অপমানিত হবে না এবং তুমি যার সাথে শত্রুতা করেছ, সে কখনো সম্মানিত হতে পাবে না। হে আমাদের রব, তুমি বরকতময় ও সুমহান। তোমার পাকড়াও থেকে বাঁচার উপায় নাই তোমার আশ্রয় ছাড়া।”

হাসান বিন আলি রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বিতর সলাতে বলার জন্য এ দুআটি শিখিয়েছেন।”

[তিরমিযী, ইরওয়াউল গালীল গ্রন্থে (হা/ ৪২৯), শাইখ আলবানি এটিকে সহীহ বলেছেন]

 

◈ দুআ: ৯ (হেদায়েত লাভের পর অন্তরের বক্রতা হতে মুক্তি চাওয়ার দুআ)

‎رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ

উচ্চারণ: রব্বানা-লা-তুযিগ্ কুলূবানা- বা’দা ইয্ হাদাইতানা-অহাবলানা-মিল্ লাদুনকা রহমাহ , ইন্নাকা আন্তাল্ ওয়াহহা-ব।

অর্থ: “হে আমাদের রব, আপনি হিদায়েত দেয়ার পর আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন।”

 

◈ দুআ: ১০ (হেদয়েত পাওয়ার পর তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার দুআ)

اللَّهُمَّ مُصَرِّفَ القُلُوبِ صَرِّفْ قُلُوبَنَا عَلَى طَاعَتِكَ

উচ্চারণ: “ইয়া মুসাররিফাল কুলুব সাররিফ কুলুবানা আলা ত্ব-আতিক।”

অর্থ: “হে হৃদয়সমূহের পরিবর্তনকারী, আমাদের হৃদয়গুলোকে আপনার আনুগত্যের দিকে ঘুরিয়ে দিন।” (সহিহ মুসলিম)

‎يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِى عَلَى دِينِكَ

উচ্চারণ: ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুব, সাব্বিত কলবি আ’লা দীনিক।

অর্থ: “হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর সুদৃঢ় করে দাও।” (তিরমিযি, সহিহুল জামে/৭৯৮৭)

▬▬▬▬◈◍◈▬▬▬▬

সংকলনে:

আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

– ৪:৬৯ وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰهَ وَ الرَّسُوۡلَ فَاُولٰٓئِکَ مَعَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِمۡ مِّنَ النَّبِیّٖنَ وَ الصِّدِّیۡقِیۡنَ وَ الشُّهَدَآءِ وَ الصّٰلِحِیۡنَ ۚ وَ حَسُنَ اُولٰٓئِکَ رَفِیۡقًا ﴿ؕ۶۹﴾

৬৯. আর কেউ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, সিদ্দীক (সত্যনিষ্ঠ), শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ যাদের প্রতি আল্লাহ্‌ অনুগ্রহ করেছেন- তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী!

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

একদা এক ব্যক্তি (সওবান (রাঃ)) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমার নিকট আমার জান-মাল, সন্তান-সন্ততি অপেক্ষা অধিক প্রিয়। বাড়িতে অবস্থানকালে আপনার স্মরণ হলে আপনাকে দর্শন না করা পর্যন্ত ধৈর্য হয় না, তখন আপনার নিকট এসে সাক্ষাৎ করি। কিন্তু যখন আপনার ও আমার মৃত্যুর কথা স্মরণ করি, তখন ভাবি যে, আপনি যখন জান্নাতে প্রবেশ করবেন, তখন আপনি নবীদের সঙ্গে বাস করবেন। আর আমি যখন জান্নাতে প্রবেশ করব, তখন আপনার সঙ্গে হয়তো সাক্ষাৎ হবে না। এই ভেবে ভীষণ শঙ্কিত হই।’ এ কথা শুনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে কোন উত্তর দিলেন না। অতঃপর এই আয়াত অবতীর্ণ হল, যার অর্থ, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে, তারা (পরকালে) ঐ সমস্ত মহান ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকবে, যাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ অবতীর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ নবীগণ, সত্যবাদীগণ, শহীদগণ এবং সৎব্যক্তিগণের সঙ্গে।” (সুরা নিসা ৬৯ আয়াত, ত্বাবারানীর আওসাত্ব ৪৭৭, স্বাগীর ৫২, সিঃ সহীহাহ ২৯৩৩নং) [আল-মু’জামুস সাগীর লিত তাবরানী ১/২৬; মাজমাউদ যাওয়ায়িদ ৭/৭]

হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

“আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি শুনেছিলাম যে, নবীদেরকে মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়া ও আখেরাত যে কোন একটি বেছে নেয়ার অধিকার দেয়া হয়। অত:পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অসুস্থতার পর মারা গেলেন, সে অবস্থায় তার মুখ থেকে এ আয়াত শুনতে পেলাম। তখন আমি বুঝলাম যে, তাকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। আর তিনি আখেরাত বেছে নিয়েছেন।” [বুখারী ৪৪৩৫; মুসলিম: ২৪৪৪]

আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করার প্রতিদানের কথা বলা হচ্ছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, (المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ) “মানুষ তার সাথে থাকবে, যাকে সে ভালোবাসে।” (বুখারী ৬১৬৮, মুসলিম ২৬৪১নং)

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট দিয়ে গমন করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তখন লোকজন ছিল। তাঁর কাছে উপস্থিত লোকেদের মধ্য থেকে একজন বলল, আমি এ ব্যক্তিকে আল্লাহরই উদ্দেশে ভালোবাসি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি কি তাকে এ কথা জানিয়েছ? লোকটি বলল : না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ উঠো এবং তাকে জানিয়ে দাও। তখন লোকটি উঠে তার নিকট গেল এবং তাকে জানিয়ে দিলো। তখন লোকটি জবাবে বলল, তোমাকে সে সত্তা ভালোবাসবেন, যাঁর সন্তুষ্টির জন্য তুমি আমাকে ভালোবেসেছ।

 

রাবী [আনাস (রাঃ)] বলেনঃ অতঃপর লোকটি ফিরে এলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন। তখন লোকটি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাই জানাল, যা গমনকারী বলেছে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির সাথে থাকবে, যাকে তুমি ভালোবাসো। আর তুমি তোমার নিয়্যাতের বিনিময় পাবে। [ইমাম বায়হাক্বী (রহিমাহুল্লাহ) এ হাদীসটি ‘‘শু‘আবুল ঈমানে’’ বর্ণনা করেছেন।] হাসান : শু‘আবুল ঈমান ৯০১১, আবূ দাঊদ ৫১৫২, তিরমিযী ২৩৮৬।

আনাস (রাঃ) বলেন, রসূল (সাঃ)-এর এই কথা শুনে সাহাবাগণ যত আনন্দিত হয়েছিলেন এত আনন্দিত আর কখনও হন নি। কারণ, তাঁরা জান্নাতেও রসূল (সাঃ)-এর সঙ্গ লাভ চাইতেন। আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কোন কোন সাহাবী নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট আরজ করলেন যে, মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাতে সর্বোচ্চ স্থান দান করবেন। আর আমরা তার থেকে নিম্নস্তরের স্থানই লাভ করব এবং এইভাবে আমরা আপনার সঙ্গ-সংসর্গ এবং আপনার দর্শন লাভ থেকে বঞ্চিত থাকব, যা দুনিয়াতে আমরা পাই। তাই আল্লাহ তাআলা আয়াত অবতীর্ণ করে তাঁদেরকে সান্ত্বনা দিলেন। (ইবনে কাসীর) কোন কোন সাহাবী তো বিশেষভাবে রসূল (সাঃ)-এর সাথে জান্নাতে থাকার দরখাস্ত করেছিলেন। (أَسْأَلُكَ

مُرَافَقَتَكَ فِي الجَنَّةِ) আর এর জন্য রসূল (সাঃ) তাদেরকে বেশী বেশী নফল নামায পড়ার তাকীদ করেছিলেন। (فَأَعِنِّي عَلى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُوْدِ) ‘‘তুমি বেশী বেশী সিজদা করে আমার সাহায্য কর।’’ (মুসলিম ৪৮৯নং)

এ ছাড়া আরো একটি হাদীসে এসেছে যে,

(التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الْأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ ) ‘‘সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী আম্বিয়া, সিদ্দীক এবং শহীদদের সাথে থাকবে।’’ (তিরমিযী ১২০৯নং)

সিদ্দীকত্ব (সত্য-নিষ্ঠা) হল পূর্ণ ঈমান ও পূর্ণ আনুগত্যের নাম। নবুঅতের পর এর মান। মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উম্মতের মধ্যে আবূ বাকার সিদ্দীক (রাঃ) এই স্থান লাভ করার ব্যাপারে ছিলেন সবার ঊর্ধে। আর এই জন্যই সকলের ঐকমত্যে নবীগণ ছাড়া অন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে নবী করীম (সাঃ)-এর পর তিনিই হলেন সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সৎকর্মশীল বা নেক লোক তাঁকে বলা হয়, যিনি আল্লাহ এবং তাঁর বান্দাদের অধিকারসমূহ পূর্ণরূপে আদায় করেন এবং তাতে কোন প্রকার ত্রুটি করেন না।

সিদ্দীক বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায় যে পরম সত্যনিষ্ঠ ও সত্যবাদী।

তার মধ্যে সততা ও সত্যপ্রিয়তা পূর্ণমাত্রায় বিরাজিত থাকে। নিজের আচার আচরণ ও লেনদেনে সে হামেশা সুস্পষ্ট ও সরল-সোজা পথ অবলম্বন করে। সে সবসময় সাচ্চাদিলে হক ও ইনসাফের সহযোগী হয়। সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী যে কোন বিষয়ের বিরুদ্ধে সে পর্বত সমান অটল অস্তিত্ব নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে সামান্যতম দুর্বলতাও দেখায় না। সে এমনই পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হয় যে, তার আত্মীয়অনাত্বীয়, বন্ধু-শক্র, আপন-পর কেউই তার কাছ থেকে নির্লজ্জ ও নিখাদ সত্যপ্রীতি, সত্য-সমর্থন ও সত্য-সহযোগিতা ছাড়া আর কিছুরই আশংকা করে না। কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ ও বিরোধিতা তাদের মনে কখনও স্থান পায় না। যেমন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমূখ।

আল্লাহ্ তা’আলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল ইসলামী চরিত্রের আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে সত্যবাদিতার চরিত্র। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ

[سورة التوبة-119]

((হে ঈমানদারগণ আল্লাহ্কে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হও।)) [সূরা আত্-তাওবাহঃ ১১৯]

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ ((তোমরা সত্যবাদিতা গ্রহণ কর, কেননা সত্যবাদিতা পূণ্যের পথ দেখায় আর পূণ্য জান্নাতের পথ দেখায়, একজন লোক সর্বদা সত্য বলতে থাকে এবং সত্যবাদিতার প্রতি অনুরাগী হয়,ফলে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।)) [মুসলিম]

﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ﴾

প্রকৃত ঈমানদার তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান এনেছে এবং এ ব্যাপারে পরে আর কোন সন্দেহ পোষণ করেনি৷ তারপর প্রাণ ও অর্থ-সম্পদ দিয়ে জিহাদ করেছে৷ তারাই সত্যবাদী৷হুজুরাতঃ ১৫

আর এ কারণেই ‘সিদক’ ও সত্যবাদিতার অর্থে অন্তর ও কর্মের সত্যবাদিতা অন্তর্ভুক্ত। সূরা আহযাবের এক আয়াতে সত্যবাদীদের বিপরীতে মোনাফেকীন (খল) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।

ইরশাদ হয়েছে, ‘যাতে আল্লাহ তাআলা সত্যনিষ্টদের তাদের সত্যবাদিতার বদলা ও বিনিময় দান করেন এবং ইচ্ছা করলে মোনাফেকদের শাস্তি দান করেন।’ (সূরা আহযাব : ২৪)।

(২) সালেহীন বা সৎকর্মশীল বলতে এমন ব্যক্তিকে বুঝায়, যে তার নিজের চিন্তাধারা, আকীদা-বিশ্বাস, ইচ্ছা, সংকল্প, কথা ও কর্মের মাধ্যমে সত্য-সরল পথে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এর সাথে নিজের জীবনে সৎ ও সুনীতি অবলম্বন করে। আর যারা প্রকাশ্য ও গোপন সব ক্ষেত্রেই সৎকর্মসমূহের অনুবর্তী।

শহীদ কারা————

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন , যে মুসলমান

(১) তার দ্বীনের জন্য নিহত হ’ল, সে শহীদ

(২) যে তার জীবন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ

(৩) যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ

(৪) যে ব্যক্তি তার পরিবার রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ। তিরমিযী হা/১৪২১, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৫২৯ ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়।

(৫) যে ব্যক্তি মহামারীতে মারা যায়, সে ব্যক্তি শহীদ,

 

(৬) যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় (কলেরা, ডায়রিয়া) মারা যায়, সে শহীদ,

(৭) যে ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়, সে শহীদ’। মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১১, ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪৪৯।

(৮) যে ব্যক্তি মযলূম অবস্থায় নিহত হয়, সে ব্যক্তি শহীদ’। আহমাদ, ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪৪৭।

(৯) যে ব্যক্তি তার ন্যায্য অধিকার রক্ষায় নিহত হয়, সে ব্যক্তি শহীদ’।আবু ইয়া‘লা হা/৬৭৭৫; সনদ হাসান।

 

রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন, আল্লাহ্র রাস্তায় নিহত ব্যক্তি ছাড়াও আরও সাত জন ‘শহীদ’ রয়েছে। তারা হ’ল :

(১) মহামারীতে মৃত (মুমিন) ব্যক্তি

(২) পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি

(৩) ‘যাতুল জাম্ব’ নামক কঠিন রোগে মৃত ব্যক্তি

(৪) কলেরা বা অনুরূপ পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি

(৫) আগুনে পুড়ে মৃত ব্যক্তি

(৬) ভূমিধ্বসে মৃত ব্যক্তি ও

(৭) সন্তান প্রসবকালে মৃত মহিলা’। আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৫৬১; সনদ ছহীহ।

 

উল্লেখ্য যে, ঐ সকল মুমিন ব্যক্তি আখেরাতে শহীদের নেকী পাবেন। যদিও দুনিয়াতে তাদের গোসল ও জানাযা করা হবে।

শহীদগণ তিন শ্রেণীর:

(১) যারা দুনিয়া ও আখেরাতে শহীদ। এঁরা হ’লেন, কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত মুমিন ব্যক্তি,

(২) আখেরাতে শহীদ। তারা হ’লেন উপরে বর্ণিত অন্যান্য শহীদগণ,

(৩) দুনিয়াতে শহীদ, আখেরাতে নয়। তারা হ’ল : যুদ্ধের ময়দানে গণীমতের মাল আত্মসাৎকারী অথবা জিহাদ থেকে পলাতক অবস্থায় নিহত ব্যক্তি’। ফিক্বহুস সুন্নাহ ৩/৯১।

 

 

(৩) জান্নাতের পদমর্যাদাসমূহ আমলের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। জান্নাতীদের পদমর্যাদা তাদেরই আমল তথা কৃতকর্ম অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।

প্রথম শ্রেণীর লোকদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা নবী-রাসূলগণের সাথে জান্নাতের উচ্চতর স্থানে জায়গা দেবেন এবং

দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকদেরকে নবীগণের পরবর্তী মর্যাদার লোকদের সাথে স্থান দেবেন। তাদেরকেই বলা হয় সিদ্দীকীন।

অতঃপর তৃতীয় শ্রেণীর লোকেরা থাকবেন শহীদগণের সাথে।

আর চতুর্থ শ্রেণীর লোকেরা থাকবেন সালেহীনদের সাথে। সারকথা, আল্লাহ তা’আলার আনুগত্যশীল বান্দাগণ সে সমস্ত মহান ব্যক্তিদের সাথে থাকবেন, যারা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত ও মকবুল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ “জান্নাতবাসীরা নিজেদের জানালা দিয়ে উপরের শ্রেণীর লোকদেরকে তেমনিভাবে দেখতে পাবে, যেমন পৃথিবীতে তোমরা সূদুর দিগন্তে নক্ষত্রকে দেখ। বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কি শুধু নবী-রাসূলগণ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ অবশ্যই না, এমন কিছু লোক যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং নবী-রাসূলদের সত্যায়ন করেছে।” [বুখারীঃ ৩২৫৬, মুসলিমঃ ২৮৩১] তাই যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভে ধন্য হতে চাইবে, তাদেরকে তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার মাধ্যমেই লাভ করতে হবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হল যে, সে লোকটির মর্যাদা কেমন হবে, যে লোক কোন গোষ্ঠীর ভালবাসা পোষণ করে, কিন্তু আমলের বেলায় এ দলের নির্ধারিত মান পর্যন্ত পৌছতে পারেনি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ প্রতিটি লোকই যার সাথে তার ভালবাসা, তার সাথে থাকবে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, পৃথিবীতে কোন কিছুতেই আমি এতটা আনন্দিত হইনি যতটা এ হাদীসের কারণে আনন্দিত হয়েছি। কারণ, এ হাদীসে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যাদের গভীর ভালবাসা রয়েছে তারা হাশরের মাঠেও তার সাথেই থাকবেন। [বুখারীঃ ৬১৬৭, মুসলিমঃ ২৬৩৯]

০ ذٰلِکَ الۡفَضۡلُ مِنَ اللّٰهِ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ عَلِیۡمًا ﴿۷۰﴾

. এগুলো আল্লাহর অনুগ্রহ। সর্বজ্ঞ হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট