সূরা আনআমঃ ১৪তম রুকু (১১১-১২১)আয়াত সমূহ

 সূরা আনআমঃ ১৪তম রুকু (১১১-১২১)আয়াত সমূহ

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

 

৬:১১১ وَ لَوۡ اَنَّنَا نَزَّلۡنَاۤ اِلَیۡهِمُ الۡمَلٰٓئِکَۃَ وَ کَلَّمَهُمُ الۡمَوۡتٰی وَ حَشَرۡنَا عَلَیۡهِمۡ کُلَّ شَیۡءٍ قُبُلًا مَّا کَانُوۡا لِیُؤۡمِنُوۡۤا اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰهُ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَهُمۡ یَجۡهَلُوۡنَ ﴿

১১১. আর আমরা তাদের কাছে ফিরিশতা পাঠালেও এবং মৃতেরা তাদের সাথে কথা বললেও এবং সকল বস্তুকে তাদের সামনে সমবেত করলেও আল্লাহর ইচ্ছে না হলে তারা কখনো ঈমান আনবে না; কিন্তু তাদের অধিকাংশই মূর্খ।

আলোচ্য আয়াতে এ বিষয়বস্তুই বর্ণিত হয়েছে যে, যদি আমি তাদের প্রার্থিত মুজিযাসমূহ দেখিয়ে দেই; বরং এর চাইতেও বেশী ফিরিশতাদের সাথে তাদের সাক্ষাৎ এবং মৃতদের সাথে বাক্যালাপ করিয়ে দেই, তবুও তারা মানবে না। [মুয়াস্‌সার]

যে নিদর্শনসমূহের এরা দাবী করে, সেগুলো সবই যদি তাদের সামনে উপস্থিত করে দেওয়া হত। আর একটি অর্থ হল, প্রতিটি জিনিস একত্রিত হয়ে দলে দলে যদি এই সাক্ষ্য দিত যে, নবী প্রেরণের ধারা সত্য, তবুও এই সমস্ত নিদর্শন এবং যাবতীয় দাবী পূরণ করে দেওয়া সত্ত্বেও এরা ঈমান আনত না। তবে যাকে আল্লাহ চান (তার কথা ভিন্ন)। নিম্নের আয়াতটিও এই অর্থেরই

{إِنَّ الَّذِينَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ كَلِمَتُ رَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ، وَلَوْ جَاءَتْهُمْ كُلُّ آيَةٍ حَتَّى يَرَوُا الْعَذَابَ الْأَلِيمَ}

অর্থাৎ, নিঃসন্দেহে যাদের সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালকের বাক্য সত্য হয়েছে, তারা বিশ্বাস করবে না; যদিও তাদের নিকট সমস্ত নিদর্শন আগত হয়, যে পর্যন্ত না তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রত্যক্ষ করেছে। (সূরা ইউনুস ৯৬-৯৭)

আর অজ্ঞতাপূর্ণ কথাগুলোই তাদের এবং সত্যকে গ্রহণ করার মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। যদি অজ্ঞতার এই বেড়া ভেঙ্গে যায়, তবে হয়তো সত্য তাদের বুঝে আসবে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তা অবলম্বনও করে নেবে।

অর্থাৎ তারা নিজেদের স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা ব্যবহার করে মিথ্যার মোকাবিলায় সত্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষন করে না৷ এমতাবস্থায় তাদের সত্যপন্থী হবার কেবলমাত্র একটি পথ বাকি থাকে৷ সেটি হচ্ছে, সৃষ্টিগত ও প্রকৃতগতভাবে যেমন প্রতিটি স্বাধীন ক্ষমতাহীন সৃষ্টিকে সত্যপন্থী হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে ঠিক তেমনি তাদের থেকেও স্বাধীন ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে প্রকৃতিগত ও জন্মগতভাবে তাদেরকে সত্যপন্থী বানিয়ে দেয়া৷ কিন্তু আল্লাহ যে কর্মকৌশলের ভিত্তিতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এটি তার পরিপন্থী৷ কাজেই আল্লাহ সরাসরি তাঁর প্রকৃতিগত ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদেরকে মুমিন বানিয়ে দেবেন, তোমাদের এ ধরনের আশা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়৷

৬:১১২ وَ کَذٰلِکَ جَعَلۡنَا لِکُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیٰطِیۡنَ الۡاِنۡسِ وَ الۡجِنِّ یُوۡحِیۡ بَعۡضُهُمۡ اِلٰی بَعۡضٍ زُخۡرُفَ الۡقَوۡلِ غُرُوۡرًا ؕ وَ لَوۡ شَآءَ رَبُّکَ مَا فَعَلُوۡهُ فَذَرۡهُمۡ وَ مَا یَفۡتَرُوۡنَ

১১২. আর এভাবেই আমরা মানব ও জিনের মধ্য থেকে শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শক্র করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তারা একে অপরকে চমকপ্রদ বাক্যের কুমন্ত্রণা দেয়। যদি আপনার রব ইচ্ছে করতেন তবে তারা এসব করত না; কাজেই আপনি তাদেরকে ও তাদের মিথ্যা রটনাকে পরিত্যাগ করুন।

অর্থাৎ আজ যদি মানুষ ও জীন সম্প্রদায়ের শয়তানরা একজোট হয়ে তোমার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে তাহলে আশংকার কোন কারণ নেই৷ কারন এটা কোন নতুন কথা নয়৷ শুধুমাত্র তোমার একার ব্যাপার এমনটি ঘটছে না৷ প্রত্যেক যুগে এমনটি হয়ে এসেছে৷ যখনই কোন নবী দুনিয়াবাসীকে সত্য পথে দেখাতে এগিয়ে এসেছেন তখনই সমস্ত শয়তানী শক্তি তাঁর মিশনকে ব্যর্থ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছে৷

“চমকপ্রদ কথা” বলতে সত্যের আহবায়ক ও তাঁর দাওযাতের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত ও বিরূপ মনোভাবাপন্ন করে তোলার জন্য তারা যেসব কৌশল ও ব্যবস্থা অবলম্বন এবং যে সমস্ত সন্দেহ সংশয় ও আপত্তি উত্থাপন করতো সেগুলো কথা বলা হয়েছে৷ তারপর এ সমস্ত কথাকে সামষ্টিকভাবে ধোঁকা ও প্রতারণা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে৷ কারণ সত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সত্য বিরোধীরা যেসব অস্ত্রই ব্যবহার করে বাহ্যত সেগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী ও সফর অস্ত্র মনে হলেও তা কেবল অন্যদের জন্যই নয়, তাদের নিজেদের জন্যও প্রকৃত পক্ষে একটি ধোঁকা ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই হয় না৷

কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহর ইচ্ছা ও চাওয়া এবং তাঁর সন্তুষ্টির মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে৷ এটিকে উপেক্ষা করতে গেলে সাধারণভাবে অনেক বিভ্রান্তি দেখা দেয়৷ কোন জিনিস আল্লাহর ইচ্ছা ও তাঁর অনুমোদনক্রমে আত্মপ্রকাশ করার অর্থ অবশ্যই এ নয় যে, আল্লাহ তাতে সন্তুষ্ট আছে এবং তাকে পছন্দও করেন৷ আল্লাহ কোন ঘটনা সংঘটিত হবার অনুমতি না দিলে, তার মহাপরিকল্পনায় তার সংঘটিত হবার অবকাশ না রাখলে এবং কার্যকারণসমূহকে সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি সংঘটিত করার অনুকূলে ছাড়া কোন চোরের চুরি, হত্যাকারীর হত্যা, জালেম ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীর বিপর্যয় এবং কাফের ও মুশরিকের কুফরী ও শিরক সম্ভব নয়৷ অনুরূপভাবে কোন মুমিন ও মুত্তাকী ব্যক্তির ঈমান ও তাকওয়াও আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়৷ দু’ ধরনের ঘটনাই একইভাবে আল্লাহর ইচ্ছায়ই সংঘটিত হয়৷ কিন্তু প্রথম ধরনের ঘটনায় আল্লাহ সন্তুষ্ট নন৷ আর দ্বিতীয় ধরনের ঘটনা তিনি পছন্দ করে, ভালবাসেন এবং এর প্রতি তিনি সন্তুষ্ট৷ যদিও কোন বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই বিশ্ব-জাহানের মালিকের ইচ্ছা কাজ করছে তবুও আলো ও আঁধার, ভাল ও মন্দ এবং সংস্কার ও বিপর্যয়ের বিপরীতমুখী শক্তিগুলোর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষশীল হবার ফলেই এ কল্যাণের পথ উন্মুক্ত হয়৷ তাই এ বৃহত্তর কল্যানের ভিত্তিতেই তিনি আনুগত্য ও অবাধ্যতা, ইবরাহিমী প্রকৃতি ও নমরূদী প্রকৃতি, মূসার স্বভাব ও ফেরাউনী স্বভাব এবং মানবিক স্বভাব ও শয়তানী স্বভাব উভয়কেই কাজ করার সুযোগ দেন৷ তিনি নিজের স্বাধীন চেতনা ও ক্ষমতা সম্পন্ন সৃষ্টিকে (জীন ও মানুষ) ভাল ও মন্দের মধ্য থেকে কোন একটি বাছাই করে নেবার স্বাধীনতা দান করেছেন৷ পৃথিবীর এ কর্মশালায় প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামতো ভাল কাজ করতে পারে এবং খারাপ কাজও করতে পারে৷ আল্লাহর মর্জী ও ইচ্ছা যত দূর সুযোগ দেয়, যতদূর তিনি অনুমোদন দান করেন ততদূর পর্যন্ত উভয় ধরনের কর্মীরা পার্থিব উপায় উকপরণসমূহের সমর্থন লাভ করে থাকে৷ কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে একমাত্র তারাই যারা ভাল ও কল্যাণের জন্য কাজ করে আর আল্লাহর বান্দা তাঁর প্রদত্ত নির্বাচনের স্বাধীনতা ব্যবহার করে মন্দকে নয়, ভাল ও কল্যাণকে অবলম্বন করুক, এটাই আল্লাহ ভালবাসেন৷

এ সংগে একথাটিও বুঝে নিতে হবে যে, সত্যের দুশমনদের বিরোধিতামূলক কার্যকলাপের উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ বারবার নিজের ইচ্ছার বরাত দেন৷ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে মুমিনদেরকে একথা বুঝিয়ে দেয়া যে, তোমাদের কাজের ধরনের ফেরেশতাদের মতো নয়৷ ফেরেশতারা কোন প্রকার বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই আল্লাহর হুকুম তামিল করছে৷ অন্যদিকে দৃষ্কৃতিকারী ও বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় আল্লাহর পছন্দনীয় পদ্ধতিকে বিজয়ী করার প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালানোই হচ্ছে তোমাদের আসল কাজ৷ আল্লাহ নিজের ইচ্ছায় আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করে যাচ্ছে৷ আবার তোমরা যারা আনুগত্য ও বন্দেগীর পথ অবলম্বণ করেছো তাদেরকেও একইভাবে কাজ করার পূর্ণ সুযোগ দিচ্ছেন৷ অবশ্য তাঁর সুন্তুষ্টি, হেদায়াত, সমর্থন ও সাহায্য-সহায়তার হাত প্রসারিত হয়েছে৷ তোমাদের দিকেই , কারণ তিনি যে কাজ পছন্দ করেন তোমরা তাই করে যাচ্ছো৷ কিন্তু তোমরা এ আশা করো না যে, আল্লাহ তাঁর প্রতি প্রাকৃতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে যারা ঈমান আনতে চায় না তাদেরকে ঈমান গ্রহণে বাধ্য করবেন অথবা মানুষ ও জ্বিন সম্প্রদায়ের এমন সব শয়তানকে জোরপূর্বক সমস্ত পথ থেকে সরিয়ে দেবেন, যারা নিজেদের সমস্ত উপায়-উপকরণ সত্যের পথে রোধ করার জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ সেটা কখনো হবার নয়৷ যদি সত্যিই তোমরা সত্য, সততা, সৎবৃত্তি ও কল্যাণের জন্য কাজ করার সংকল্প করে থাকো, তাহলে অবশ্যি তোমাদের মিথ্যা ও কল্যাণের জন্য কাজ করার সংকল্প করে থাকো, তাহলে অবশ্যি তোমাদের মিথ্যা ও বাতিলপন্থীদের মোকাবিলায় কঠোর প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে নিজেদের সত্যপ্রিয়তার প্রমাণ পেশ করতে হবে৷ অন্যথায় মুজিযা, কারামতি ও অলৌকিক ক্ষমতার জোরে যদি বাতিলকে নির্মূল ও হককে বিজয়ী করাই উদ্দেশ্য হতো তাহলে তো তোমাদের কোন প্রয়োজন ছিল না৷ আল্লাহ নিজেই দুনিয়ার সমস্ত শয়তানকে নির্মূর করে কুফরী ও শিরকের সম্ভাবনার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেবার ব্যবস্থা করতে পারতেন৷আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—-

. আর আমরা আপনার পূর্বে যে রাসূল কিংবা নবী প্রেরণ করেছি, তাদের কেউ যখনই (ওহীর কিছু) তিলাওয়াত করেছে, তখনই শয়তান তাদের তিলাওয়াতে (কিছু) নিক্ষেপ করেছে, কিন্তু শয়তান যা নিক্ষেপ করে আল্লাহ তা বিদূরিত করেন। তারপর আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। সূরা হজ্জঃ৫২

৬:১১৩ وَ لِتَصۡغٰۤی اِلَیۡهِ اَفۡـِٕدَۃُ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ وَ لِیَرۡضَوۡهُ وَ لِیَقۡتَرِفُوۡا مَا هُمۡ مُّقۡتَرِفُوۡنَ

১১৩. আর তারা এ উদ্দেশ্যে কুমন্ত্রণা দেয় যে, যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের মন যেন সে চমকপ্রদ কথার প্রতি অনুরাগী হয় এবং তাতে যেন তারা পরিতুষ্ট হয়। আর তারা যে অপকর্ম করে তাই যেন তারা করতে থাকে।

অর্থাৎ, শয়তানী কুমন্ত্রণার শিকার তারাই হয় এবং তারাই তা পছন্দ করে ও সেই অনুযায়ী আমলও করে, যারা আখেরাতে বিশ্বাস রাখে না। আর এ কথা বাস্তব যে, মানুষের অন্তরে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস যত দুর্বল হবে, তত তারা শয়তানের কুমন্ত্রণার জালে ফাঁসতে থাকবে।

মহান আল্লাহ বলেন :

هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ – تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ – يُلْقُونَ السَّمْعَ وَأَكْثَرُهُمْ كَاذِبُونَ

১।

অর্থ: (হে মানুষ!) আমি কি তোমাদের সংবাদ দেবো, শয়তানরা কাদের উপর নাযিল হয় (কাদের ঘাড়ে চেপে বসে)? -তারা চেপে বসে ঘোরতর মিথ্যাবাদী পাপাসক্তদের ঘাড়ে; যারা কান পেতে থাকে এবং মিথ্যা কথা ছড়ায়। (সূরা আশ্ শোয়ারা : ২২১-২২৩)

أَلَمْ تَرَ أَنَّا أَرْسَلْنَا الشَّيَاطِينَ عَلَى الْكَافِرِينَ تَؤُزُّهُمْ أَزًّا

২। অর্থ: তুমি কি দেখোনা, আমি শয়তানদের ছেড়ে রেখেছি; তারা কাফিরদের উপর সওয়ার হয় এবং তাদেরকে মন্দ কর্মে প্রলুব্ধ করে? (সূরা মরিয়ম : ৮৩)

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِي آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ – وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَـٰكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ –

৩।অর্থ: তুমি তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও : যার কাছে আমি আমার আয়াত পাঠিয়েছিলাম; কিন্তু সে তা বর্জন করে। অতএব শয়তান তার পেছনে লাগে এবং সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আমি চাইলে তা (আমার আয়াত) দ্বারা তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতে পারতাম; কিন্তু সে (তা বর্জন করে) দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। (সূরা ৭ : ১৭৫-১৭৬)

إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُم بِهِ مُشْرِكُونَ

৪।অর্থ : শয়তান তো কেবল তাদের উপরই কর্তৃত্ব ও আধিপত্য করে, যারা তাকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে, আর যারা আল্লাহর সাথে শরিক করে। (সূরা  আন নহল :  ১০০)

তিনি এমনটি করেন শয়তানের উদ্ভাবিত সন্দেহকে ঐসব লোকদের জন্যে ফিতনা (পরীক্ষা) বানানোর জন্যে, যাদের অন্তরে রয়েছে ব্যধি এবং যারা পাষন্ড। (সূরা  আল হজ্জ :  ৫৩)

৬:১১৪ اَفَغَیۡرَ اللّٰهِ اَبۡتَغِیۡ حَکَمًا وَّ هُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ اِلَیۡکُمُ الۡکِتٰبَ مُفَصَّلًا ؕ وَ الَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰهُمُ الۡکِتٰبَ یَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهٗ مُنَزَّلٌ مِّنۡ رَّبِّکَ بِالۡحَقِّ فَلَا تَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡمُمۡتَرِیۡنَ ﴿

১১৪. (বলুন) তবে কি আমি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ফয়সালাকারী হিসেবে তালাশ করব? অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি বিস্তারিত কিতাব নাযিল করেছেন! আর আমরা যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা জানে যে, নিশ্চয় এটা আপনার রব-এর কাছ থেকে যথাযথভাবে নাযিলকৃত। কাজেই আপনি সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।

অর্থাৎ তোমরা কি চাও যে, আল্লাহ তা’আলার এ ফয়সালার পর আমি অন্য কোন ফয়সালাকারী অনুসন্ধান করি? না, তা হতে পারে না। এরপর কুরআনুল কারীমের এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো স্বয়ং কুরআনের সত্যতা এবং আল্লাহর কালাম হওয়ারই প্রমাণ। বলা হয়েছে যে,

(এক) কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অলৌকিক গ্রন্থ- এর মোকাবেলা করতে সারা বিশ্ব অক্ষম।

(দুই) যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়বস্তু এতে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। বিস্তারিত কিতাব নাযিল করার দুটি অর্থ হতে পারে।

ক. এখানে হারাম ও হালালের বিধান সম্পূর্ণভাবে বিবৃত করা হয়েছে। কোন প্রকার সন্দেহে ফেলে রাখা হয়নি।

খ. এ কুরআন একসাথে নাযিল করা হয়নি, বরং পর্যায়ক্রমে কুরআনের আয়াতসমূহ নাযিল করা হয়েছে। যাতে করে আপনার অন্তর সুদৃঢ় হয়। আর যাতে করে তা থেকে প্রয়োজনীয় বিধান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। [কুরতুবী, বাগভী]

(তিন) পূর্ববতী আহলে কিতাব ইয়াহুদী ও নাসারারাও নিশ্চিতভাবে জানে যে, কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সত্য কালাম। এরপর তাদের মধ্যে যারা সত্যভাষী ছিল, তারা এ কথা প্রকাশও করেছে। পক্ষান্তরে যারা হঠকারী, তারা বিশ্বাস সত্ত্বেও তা প্রকাশ করেনি। [ফাতহুল কাদীর]

কুরআনুল কারীমের এ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করা হয়েছে যে, এসব সুস্পষ্ট প্রমাণের পর “আপনি সংশয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না”। এটা জানা কথা যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন সময়ই সংশয়কারী ছিলেন না, থাকতে পারেন না। তাই এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে উম্মতের অন্যান্য লোকদেরকে শোনানই এর উদ্দেশ্য। এছাড়া বিষয়টিকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে সরাসরি তাকে সম্বোধন করা হয়েছে।

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কেই যখন এরূপ বলা হয়েছে, তখন অন্য আর কে এরূপ সন্দেহ করতে পারে? [ফাতহুল কাদীর] অথবা এখানে ধরে নেয়ার পর্যায়ে বলা হয়েছে যে, আপনি সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। আর ধরে নেয়ার পর্যায়ে থাকলে সেটা হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। [ইবন কাসীর] আয়াতের আরেক অনুবাদ হচ্ছে যে, আপনি এ ব্যাপারে সন্দেহে থাকবেন না যে, যাদের ওপর কিতাব নাযিল হয়েছে তারা এর সত্যতা সম্পর্কে জানে। [বাগভী, কুরতুবী]

৬:১১৫ وَ تَمَّتۡ کَلِمَتُ رَبِّکَ صِدۡقًا وَّ عَدۡلًا ؕ لَا مُبَدِّلَ لِکَلِمٰتِهٖ ۚ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ

১১৫. আর সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ। তাঁর বাক্যসমূহ পরিবর্তনকারী কেউ নেই।আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

এ আয়াতে কুরআনুল কারীমের আরো দুটি বৈশিষ্ট্যমূলক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এগুলোও কুরআনুল কারীম যে আল্লাহর কালাম, এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বলা হয়েছে,

আপনার রব-এর কালাম সত্যতা, ইনসাফ ও সমতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ। তার কালামের কোন পরিবর্তনকারী নেই। এখানে (وَتَمَّتْ) শব্দে পরিপূর্ণ হওয়া বর্ণিত হয়েছে এবং (كَلِمَتُ رَبِّكَ) বলে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। [তাবারী]

কুরআনের গোটা বিষয়বস্তু দু’প্রকার- (এক) যাতে বিশ্ব ইতিহাসের শিক্ষণীয় ঘটনাবলী, অবস্থা, সৎকাজের জন্য পুরস্কারের ওয়াদা এবং অসৎ কাজের জন্য শাস্তির ভীতি-প্রদর্শন বর্ণিত হয়েছে এবং (দুই) যাতে মানব জাতির কল্যাণ ও সাফল্যের বিধান বর্ণিত হয়েছে। কুরআনুল কারীমের এ দু’প্রকার সাফল্য সম্পর্কে (صِدْقًا وَعَدْلًا) দুই অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। صدق এর সম্পর্ক প্রথম প্রকারের সাথে; অর্থাৎ কুরআনে যেসব ঘটনা, অবস্থা, ওয়াদা ও ভীতি বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো সবই সত্য ও নির্ভুল।

এগুলোতে কোনরূপ ভ্রান্তির সম্ভাবনা নেই। عدل এর সম্পর্ক দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ বিধানের সাথে। উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ তা’আলার সব বিধান عدل তথা ন্যায়বিচার ভিত্তিক। [ইবন কাসীর] অতএব, আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহর বিধান সুবিচার ও সমতার উপর ভিত্তিশীল। এতে কারো প্রতি অবিচার নেই এবং এমন কোন কঠোরতাও নেই যা মানুষ সহ্য করতে পারে না। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ (لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا) অর্থাৎ “আল্লাহ ক্ষমতা ও সামর্থ্যের বাইরে কারো প্রতি কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেননি”। [সূরা আল-বাকারাহঃ ২৮৬]

কুরআনুল কারীমের এ অবস্থাটি অর্থাৎ কুরআনে বর্ণিত অতীত ও ভবিষ্যতের ঘটনাবলী, পুরস্কারের ওয়াদা ও শাস্তির ভীতি-প্রদর্শন সবই সত্য; এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কুরআন বর্ণিত যাবতীয় বিধান সমগ্র বিশ্ব ও কেয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী বংশধরদের জন্য সুবিচার ও সমতাভিত্তিক, এগুলোতে কারো প্রতি কোনরূপ অবিচার নেই এবং সমতা ও মধ্যবর্তিতার চুল পরিমাণও লঙ্ঘন নেই। কুরআনের এ বৈশিষ্ট্য আরো প্রকৃষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কুরআন আল্লাহর কালাম।

(২) কুরআনের আরো একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, (لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ) অর্থাৎ আল্লাহর কালামের কোন পরিবর্তনকারী নেই।’ তিনি যেটা যে সময়ে হবে বলেছেন সেটা সে সময়ে অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে। সেটাকে রদ বা পরিবর্তন করার কোন ক্ষমতা কারো নেই। [তাবারী] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর অর্থ বলেন, আল্লাহর ফয়সালাকে কেউ রদ করতে পারবে না। তার বিধানকে পরিবর্তন করার অধিকার কারও নেই। অনুরূপভাবে তাঁর ওয়াদার বিপরীতও হবার নয়। [বাগভী] পরিবর্তনের এক প্রকার হচ্ছে যে, এতে কোন ভুল প্রমাণিত করার কারণে পরিবর্তন করা। পূর্ব আয়াতে আল্লাহর কালামকে পূর্ণ বলার কারণে কারো মনে আসতে পারে যে, কোন কিছু পূর্ণ হওয়ার পর তাতে কি আবার অপূর্ণাঙ্গতা আসবে? এ রকম প্রশ্নের উত্তর এখানে দেয়া হয়েছে। আর পরিবর্তনের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে জবরদস্তিমূলকভাবে পরিবর্তন করা। যেমন এর পূর্বে তাওরাত ও ইঞ্জলকে পরিবর্তন করা হয়েছে। আল্লাহর কালাম এ সকল প্রকার পরিবর্তনেরই ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং ওয়াদা করেছেনঃ (إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ) অর্থাৎ “আমরাই এ কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষক।” সূরা আল-হিজর: ৯]

এমতাবস্থায় কার সাধ্য আছে যে, এ রক্ষাবৃহ্য ভেদ করে এতে পরিবর্তন করে? [রুহুল মা’আনী] কুরআনের উপর দিয়ে চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। প্রতি শতাব্দি ও প্রতি যুগে এর শক্রদের সংখ্যাও এর অনুসারীদের তুলনায় বেশী ছিল; কিন্তু এর একটি যের-যবর পরিবর্তন করার সাধ্যও কারো হয়নি। অবশ্য একটি তৃতীয় প্রকার পরিবর্তন সম্ভবপর ছিল। তা এই যে, স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনকে রহিত করে পরিবর্তন করতে পারতেন। কিন্তু এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, কুরআনের পরে আর কোন নবী ও কিতাব আসবে না। এমনকি ঈসা আলাইহিস সালাম যখন আবার আসবেন তিনি এ কুরআন অনুসারেই জীবন অতিবাহিত করবেন। [রুহুল মা’আনী] এ আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ রাসূল এবং কুরআন সর্বশেষ কিতাব। একে রহিতকরণের আর কোন সম্ভাবনা নেই। কুরআনের অন্যান্য আয়াতে এ বিষয়বস্তুটি আরো সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।

আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে (وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ) অর্থাৎ তারা যেসব কথাবার্তা বলছে, আল্লাহ সব শোনেন এবং সবার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত অবস্থা জানেন। তিনি প্রত্যেকের কার্যের প্রতিফল দেবেন। [তাবারী; আল- মানার; আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

৬:১১৬ وَ اِنۡ تُطِعۡ اَکۡثَرَ مَنۡ فِی الۡاَرۡضِ یُضِلُّوۡکَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ اِنۡ یَّتَّبِعُوۡنَ اِلَّا الظَّنَّ وَ اِنۡ هُمۡ اِلَّا یَخۡرُصُوۡنَ

১১৬. আর যদি আপনি যমীনের অধিকাংশ লোকের কথামত চলেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে।। তারা তো শুধু ধারণার অনুসরণ করে; আর তারা শুধু অনুমানভিত্তিক কথা বলে

অর্থাৎ দুনিয়ার অধিকাংশ লোক নির্ভুল জ্ঞানের পরিবর্তে কেবলমাত্র আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৷ তাদের আকীদা-বিশ্বাস,দর্শন, চিন্তাধারা, জীবন যাপনের মূলনীতি ও কর্মবিধান সবকিছুই ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে৷ অন্যদিকে আল্লাহর পথ অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী দুনিয়ায় জীবন যাপন করার পথ মাত্র একটিই৷ সেটি হচ্ছে, আল্লাহ নিজে যে পথটি জানিয়ে দিয়েছেন-লোকেরা নিজেদের আন্দাজ-অনুমান ও ধারণা-কল্পনার ভিত্তিতে নিজেরাই যে পথটি তৈরী করেছে, সেটি নয়৷ কাজেই দুনিয়ার বেশীর ভাগ লোক কোন্ পথে যাচ্ছে,কোন সত্য সন্ধানীর এটা দেখা উচিত নয়৷ বরং আল্লাহ যে পথটি তৈরী করে দিয়েছেন তার ওপরই তার দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলা উচিত৷ এ পথে চলতে গিয়ে দুনিয়ায় যদি সে নিসংগ হয়ে পড়ে তাহলেও তাকে একাকীই চলতে হবে৷

এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে অবহিত করেছেন যে, পৃথিবীর অধিবাসীদের অধিকাংশই পথভ্রষ্ট। [ইবন কাসীর] আপনি এতে ভীত হবেন না এবং তাদের কথায় কর্ণপাত করবেন না। কুরআন একাধিক জায়গায় এ বিষয়টি বর্ণনা করেছে। এক জায়গায় বলা হয়েছে, “আর তাদের আগেও পূর্ববতীদের বেশীর ভাগ বিপথগামী হয়েছিল” [সূরা আস-সাফফাত: ৭১] অন্যত্র বলা হয়েছে, “আপনি যতই চান না কেন, বেশীর ভাগ লোকই ঈমান গ্রহণকারী নয়।” [সূরা ইউসুফ ১০৩] সুতরাং অনুসরণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আলেমদেরই অনুসরণ করতে হবে। যারা জানে না তারা যত বেশীই হোক না কেন তাদের অনুসরণ পথভ্রষ্টতাই ডেকে আনবে। [আইসারুত তাফসীর]

এ আয়াত দ্বারা আরো বুঝা গেল যে, সংখ্যাধিক্যতা কোন অবস্থাতেই সঠিক হওয়ার দলীল নয়। কারণ হক বা সঠিক পথ ও মত দলীল-প্রমাণাদির ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে, সংখ্যাধিক্য বা সংখ্যালঘুতার ভিত্তিতে নয়। সাধারণত, হকপন্থীরা সংখ্যায় কম থাকে, কিন্তু তারা আল্লাহর নিকট সওয়াবের দিক থেকে অধিক অগ্রগামী। [সা’দী]

হকপন্থীরা সংখ্যালঘু এবং বাতিলপন্থীরা সংখ্যাগুরু হবে। আর এর সমর্থন সেই হাদীস থেকেও হয়, যাতে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে এবং এর মধ্য থেকে কেবল একটি দল জান্নাতী হবে, অবশিষ্টরা হবে জাহান্নামী। আর এই জান্নাতী দলের নিদর্শন সম্পর্কে তিনি (সাঃ) বলেছেন, (مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي) যারা আমার ও আমার সাহাবার তরীকার উপর কায়েম থাকবে।’’ (আবূ দাউদঃ সুন্নাহ অধ্যায়, তিরমিযীঃ ঈমান অধ্যায়)

১২৭) হে মুহাম্মাদ! সবর অবলম্বন করো-আর তোমার এ সবর আল্লাহরই সুযোগ দানের ফলমাত্র-এদের কার্যকলাপে দুঃখ করো না এবং এদের চক্রান্তের কারণে মনঃক্ষুণ্ন হয়ো না৷সূরা নহলঃ ১২৭

৬:১১৭ اِنَّ رَبَّکَ هُوَ اَعۡلَمُ مَنۡ یَّضِلُّ عَنۡ سَبِیۡلِهٖ ۚ وَ هُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُهۡتَدِیۡنَ ﴿

১১৭. নিশ্চয় আপনার রব, কে তার পথ ছেড়ে বিপথগামী হয় সে সম্বন্ধে অধিক অবগত। আর সৎপথে যারা আছে, তাদের সম্বন্ধেও তিনি অধিক অবগত

হে নবী! প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা এবং সদুপদেশ সহকারে তোমার রবের পথের দিকে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে তোমার রবই বেশী ভালো জানেন কে তাঁর পথচ্যুত হয়ে আছে এবং সে আছে সঠিক পথে৷সূরা নহলঃ ১২৫

৬:১১৮ فَکُلُوۡا مِمَّا ذُکِرَ اسۡمُ اللّٰهِ عَلَیۡهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ بِاٰیٰتِهٖ مُؤۡمِنِیۡنَ

১১৮. সুতরাং তোমরা তার আয়াতসমূহে ঈমানদার হলে, যাতে আল্লাহ্‌র নাম নেয়া হয়েছে তা থেকে খাও;

অর্থাৎ, যে পশুকে শিকার অথবা যবেহ বা নহর করার সময় আল্লাহর নাম নেওয়া হয়, তা খাও; যদি তা এমন পশু হয় যা খাওয়া বৈধ। এর অর্থ হল, যে পশুকে শিকার অথবা যবেহ বা নহর করার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় না, তা হালাল ও বৈধ নয়। তবে যবেহ করার সময় যবেহকারী আল্লাহর নাম নিয়েছে, না নেয়নি –এই সন্দেহজনক ব্যাপারটা এ থেকে স্বতন্ত্র। এ ব্যাপারে বিধান হল, আল্লাহর নাম নিয়ে তা খাও। হাদীসে আছে কিছু লোক রসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, একদল লোক আমাদের কাছে গোশত নিয়ে আসে (এ থেকে বুঝানো হয়েছে এমন মরুবাসীদেরকে, যারা নতুন নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং সম্পূর্ণরূপে ইসলামী জ্ঞান লাভ করতে পারে নি।) আমরা জানি না যে, তারা (যবেহকালে) আল্লাহর নাম নিয়েছে, না নেয়নি? তখন তিনি বললেন, سَمُّوْا عَلَيْهِ أَنْتُمْ وَكُلُوْا )) অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর নাম নিয়ে তা খাও। (বুখারী) অর্থাৎ, সন্দেহজনক অবস্থায় এর অনুমতি আছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সর্বপ্রকার পশুর গোশত ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে নিলেই হালাল হয়ে যাবে। এ থেকে ঊর্ধ্বপক্ষে কেবল এতটাই প্রমাণিত হয় যে, মুসলিমদের বাজার ও দোকানে যে গোশত পাওয়া যায়, তা হালাল। হ্যাঁ, যদি কেউ উক্ত সন্দেহ ও দ্বিধায় পতিত হয়, তবে সে খাওয়ার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে নেবে।

৬:১১৯ وَ مَا لَکُمۡ اَلَّا تَاۡکُلُوۡا مِمَّا ذُکِرَ اسۡمُ اللّٰهِ عَلَیۡهِ وَ قَدۡ فَصَّلَ لَکُمۡ مَّا حَرَّمَ عَلَیۡکُمۡ اِلَّا مَا اضۡطُرِرۡتُمۡ اِلَیۡهِ ؕ وَ اِنَّ کَثِیۡرًا لَّیُضِلُّوۡنَ بِاَهۡوَآئِهِمۡ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ؕ اِنَّ رَبَّکَ هُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُعۡتَدِیۡنَ ﴿

১১৯. আর তোমাদের কি হয়েছে যে, যাতে আল্লাহর নাম নেয়া হয়েছে তোমরা তা থেকে খাবে না? যা তোমাদের জন্য তিনি হারাম করেছেন তা তিনি বিশদভাবেই তোমাদের কাছে বিবৃত করেছেন, তবে তোমরা নিরুপায় হলে তা স্বতন্ত্র। আর নিশ্চয় অনেকে অজ্ঞতাবশত নিজেদের খেয়াল-খুশী দ্বারা অন্যকে বিপথগামী করে; নিশ্চয় আপনার রব সীমালংঘনকারীদের সম্বন্ধে অধিক জানেন।

অর্থাৎ কোনটি হারাম আর কোনটি হালাল তার বিশদ বিবরণ আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদের জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোস্ত , আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবেহ্ করা পশু, গলা চিপে মারা যাওয়া জন্তু, প্রহারে মারা যাওয়া জন্তু, উপর থেকে পড়ে মারা যাওয়া জন্তু, অন্য প্রাণীর শিং এর আঘাতে মারা যাওয়া জন্তু এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া জন্তু; তবে যা তোমরা যবেহ্ করতে পেরেছ তা ছাড়া, আর যা মূর্তি পূজার বেদীর উপর বলী দেয়া হয় তা এবং জুয়ার তীর দিয়ে ভাগ নির্ণয় করা, এসব পাপ কাজ। … অতঃপর কেউ পাপের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হলে তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-মায়িদাহঃ ৩]

তবে সূরা আল মায়িদার এ আয়াতটি মদীনায় আবতীর্ণ হয়েছে। পক্ষান্তরে সূরা আল-আন’আমের এ আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। সে জন্য কুরতুবী বলেন, এখানে ‘বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন’ বলে ‘বিস্তারিত বর্ণনা করবেন’ বুঝানো হয়েছে। [কুরতুবী] তাছাড়া এ সূরাতেই ১৪৫ নং আয়াতে হারাম বস্তুসমূহের কিছু বর্ণনা এসেছে। [আততাফসীরুস সহীহ]

অর্থাৎ উপরোক্ত হারামকৃত বস্তুসমূহও তোমাদের অপারগ অবস্থায় খাওয়ার অনুমতি রয়েছে। যেমন কেউ ক্ষুধায় কাতর হয়ে হালাল বস্তু না পেলে নিরুপায় অবস্থায় তার জন্য মৃত বস্তুও খাওয়ার বিধান দেয়া হয়েছে। [সাদী, আত-তাফসীরুস সহীহ]

৬:১২০ وَ ذَرُوۡا ظَاهِرَ الۡاِثۡمِ وَ بَاطِنَهٗ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡسِبُوۡنَ الۡاِثۡمَ سَیُجۡزَوۡنَ بِمَا کَانُوۡا یَقۡتَرِفُوۡنَ

১২০. আর তোমরা প্রকাশ্য এবং প্রচ্ছন্ন পাপ বর্জন কর; নিশ্চয় যারা পাপ অর্জন করে অচিরেই তাদেরকে তারা যা অর্জন করে তার প্রতিফল দেয়া হবে।

৬:১২১ وَ لَا تَاۡکُلُوۡا مِمَّا لَمۡ یُذۡکَرِ اسۡمُ اللّٰهِ عَلَیۡهِ وَ اِنَّهٗ لَفِسۡقٌ ؕ وَ اِنَّ الشَّیٰطِیۡنَ لَیُوۡحُوۡنَ اِلٰۤی اَوۡلِیٰٓئِهِمۡ لِیُجَادِلُوۡکُمۡ ۚ وَ اِنۡ اَطَعۡتُمُوۡهُمۡ اِنَّکُمۡ لَمُشۡرِکُوۡنَ ﴿

১২১. আর আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি তার কিছুই তোমরা খেও না; এবং নিশ্চয় তা গর্হিত। নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররোচনা দেয়; আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক।

অর্থাৎ যার উপর আল্লাহর নাম নেয়া হয় নি এমন বস্তু খাওয়া ফিস্‌ক। এখানে ফিস্‌ক অর্থ আল্লাহ যা হালাল করেছেন তার বহির্ভূত। [জালালাইন] সুতরাং যে সমস্ত প্রাণীর যবেহ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে না হয়ে অপর কোন কিছুর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হবে, যেমন মূর্তি বা দেব-দেবীর নামে যবেহ করা হবে, তাও এ আয়াতের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হয়ে হারাম হবে। অনুরূপভাবে ইচ্ছাকৃত আল্লাহর নাম উচ্চারণ না করলে সে প্রাণীও অধিকাংশ আলেমের নিকট এ আয়াতের আওতাভুক্ত হওয়ার কারণে হারাম হবে। [সা’দী]

(২) কাফেররা যখন শুনল যে, মুসলিমরা নিজে আল্লাহর নাম নিয়ে যা যবাই করে তা খায়, আর যা যবাই করা হয় নি, এমনিতেই মারা যায় তারা তা খায় না, তখন তারা বলতে লাগল, আল্লাহ স্বয়ং যেটা যবাই করলেন সেটা তোমরা খাও না, অথচ যেটা তোমরা যবাই কর সেটা খাও, (অর্থাৎ এটা কেমন কথা?) [আবু দাউদ: ২৮১৮ ইবন মাজাহ: ৩১৭৩] আল্লাহ তা’আলা তাদের এ কথার জবাব দিতেই আলোচ্য আয়াত নাযিল করেন। [সা’দী) এর দ্বারা বোঝা যায় যে, আনুগত্যের মধ্যেও শির্ক রয়েছে। [কিতাবুত তাওহীদ] অর্থাৎ কেউ কোন কিছু শরীআত হিসেবে প্রবর্তন করলো আর অন্যরা তার আনুগত্য করলো, এতে যারা শরীআত হিসেবে প্রবর্তন করলো তারা হলো, তাগুত। আর যারা তার আনুগত্য করে সেটা মেনে নিলো তারা আল্লাহর সাথে শির্ক করলো। [আশ-শির্ক ফিল কাদীম ওয়াল হাদীস, ৭৮-৭৯, ৪৯০-৪৯৩, ৯৯৫-১০৩১, ১১০৫-১১১৫]

সংগ্রহে

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন