সূরা আন’আমঃ ভূমিকা

                                         সূরা আন’আমঃ          মোট রুকুঃ ২০                 মোট আয়াতঃ ১৬৫

সূরার ফযিলতঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ সূরা আল-আন’আমের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, কয়েকখানি আয়াত বাদে গোটা সূরাটিই একযোগে মক্কায় নাযিল হয়েছে। জাবের, ইবন আব্বাস, আনাস ও ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সূরা আল-আন’আম নাযিল হচ্ছিল, তখন এত ফিরিশতা তার সাথে অবতরণ করেছিলেন যে, তাতে আকাশের প্রান্তদেশ ছেয়ে যায়। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৭০; ২৪৩১] উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সূরা আল-আন’আম কুরআনের উৎকৃষ্ট অংশের অন্তর্গত। [সুনান দারমী ২/৫৪৫; ৩৪০১]

এ সূরারা ১৬ ও ১৭ রুকূতে কোন কোন আন’আমের (গৃহপালিত পশু) হারাম হওয়া এবং কোন কোনটির হালাল হওয়া সম্পর্কিত আরববাসিদের কাল্পনিক ও কুসংস্কারমূলক ধারণা বিশ্বাসকে খণ্ডন করা হয়েছে।  এ সূরারই ১৩৬, ১৩৯ ও ১৪২ নং আয়াতসমূহে উল্লেখিত “আল-আন’আম” শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আল-আনআম শব্দের অর্থঃ গবাদি পশু।

নাযিল হওয়ার সময়-কালঃ

ইবনে আব্বাসের বর্ণনা মতে এ সম্পূর্ণ সূরাটি একই সাথে মক্কায় নাযিল হয়েছিল। হযরত মূআয ইবনে জাবালের চাচাত বোন হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটনীর পিঠে সওয়ার থাকা অবস্থায় এ সূরাটি নাযিল হতে থাকে। তখন আমি তাঁর উটনীর লাগাম ধরে ছিলাম। বোঝার ভারে উটনীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যেন মনে হচ্ছিল এই বুঝি তার হাড়গোড় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। হাদীসে একথাও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে, যে রাতে এ সূরাটি নাযিল হয় সে রাতেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটিকে লিপিবদ্ধ করান।

এর বিষয় বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে সুস্পষ্টভাবে মনে হয়, এ সূরাটি মক্কী যুগের শেষের দিকে নাযিল হয়ে থাকবে। হযরত আসমা বিনতে ইয়াযিদের রেওয়াতটিও একথার সত্যতা প্রমাণ করে। কারণ তিনি ছিলেন আনসারদের অন্তরভুক্ত। হিজরতের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। যদি ইসলাম গ্রহণ করার আগে তিনি নিছক ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণে মক্কায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবে হয়ে থাকবেন তাঁর মক্কায় অবস্থানের শেষ বছরে। এর আগে ইয়াসরেববাসীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক এত বেশী ঘনিষ্ঠ হয়নি যার ফলে তাদের একটি মহিলা তার খেদমতে হাযির হয়ে যেতে পারে।

নাযিল হওয়ার উপলক্ষঃ

আল্লাহর রসূল যখন মানুষকে ইসলামের দিকে দেওয়াত দেবার কাজ শুরু করেছিলেন। তারপর থেকে বারোটি বছর অতীত হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশদের প্রতিবন্ধকতা, জুলুম ও নির্যাতন চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। ইসলাম গ্রহণকারীদের একটি অংশ তাদের অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ত্যাগ করেছিল। তারা হাবশায় (ইথিওপিয়া ) অবস্থান করছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্য-সমর্থন করার জন্য আবু তালিব বা হযরত খাদীজা (রা) কেউই বেঁচে ছিলেন না। ফলে সব রকমের পার্থিব সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে তিনি কঠোর প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রচার ও রিসালতের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। তাঁর ইসলাম প্রচারের প্রভাবে মক্কায় ও চারপাশের গোত্রীয় উপজাতিদের মধ্য থেকে সৎ লোকেরা একের পর এক ইসলাম গ্রহণ করে চলছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমগ্র জাতি ইসলামের অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যানের ঝোঁক প্রকাশ করলেও তার পেছনে ধাওয়া করা হতো। তাকে তিরস্কার, গালিগালাজ করা হতো। শারীরিক দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক,সামাজিক নিপীড়নে তাকে জর্জরিত করা হতো। এ অন্ধকার বিভীষিকাময় পরিবেশে একমাত্র ইয়াসরবের(মদিনা) দিক থেকে একটি হালকা আশার আলো দেখা দিয়েছিল। সেখানকার আওস ও খাযরাজ গোত্রের প্রভাবশালী লোকেরা এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাই’আত করে গিয়েছিলেন। সেখানে কোন প্রকার আভ্যন্তরীণ বাধা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয়েই ইসলাম প্রসার লাভ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু এ ছোট্ট একটি প্রারম্ভিক বিন্দুর মধ্যে ভবিষ্যতের যে বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল তা কোন স্থুলদর্শীর দৃষ্টিগ্রাহ্য হওয়া সম্ভবপর ছিল না। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হতো, ইসলাম একটি দুর্বল আন্দোলন। এর পেছনে কোন বৈষয়িক ও বস্তুগত শক্তি নেই। এর আহবায়কের পেছনে তার পরিবারের ও বংশের দুর্বল ও ক্ষীণ সাহায্য-সমর্থন ছাড়া আর কিছুই নেই। মুষ্টিমেয় অসহায় ও বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিই ইসলাম গ্রহণ করেছে। যেন মনে হয় নিজেদের জাতির বিশ্বাস, মত ও পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে তারা সমাজ থেকে এমনভাবে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে যেমন গাছের মরা পাতা মাটির ওপর ঝরে পড়ে।

আলোচ্য বিষয়ঃ

এই পরিস্থিতিতেই সূরাটি নাযিল হয়। এ হিসেবে এখানে আলোচ্য বিষয়গুলোকে প্রধান সাতটি শিরোনামে ভাগ করা যেতে পারেঃ

একঃ শিরকের খণ্ডন করা ও তাওহীদ বিশ্বাসের দিকে আহবান জানানো

দুইঃ আখেরাতে বিশ্বাসের প্রচার ও দুনিয়ার জীবনটাই সবকিছু এ ভুল চিন্তার অপনোদন।

তিনঃ জাহেলীয়াতের যে সমস্ত ভ্রান্ত কাল্পনিক বিশ্বাস ও কুসংস্কারে লোকেরা ডুবে ছিল তার প্রতিবাদ করা।

চারঃ যেসব বড় বড় নৈতিক বিধানের ভিত্তিতে ইসলাম তার সমাজ কাঠামো গড়ে তুলতে চায় সেগুলো শিক্ষা দেয়া।

পাঁচঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর দাওয়াতের বিরুদ্ধে উত্থাপিত লোকদের বিভিন্ন আপত্তি ও প্রশ্নের জবাব ।

ছয়ঃ সুদীর্ঘ প্রচেষ্টা ও সাধনা সত্ত্বেও দাওয়াত ফলপ্রসূ না হবার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম ও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে যে অস্থিরতা ও হতাশাজনক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছিল সে জন্য তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়া।

সাতঃ অস্বীকারকারী ও বিরোধী পক্ষকে তাদের গাফলতি, বিহ্বলতা ও অজ্ঞানতা প্রসূত আত্মহত্যার কারণে উপদেশ দেয়া, ভয় দখানো ও সতর্ক করা।

এ শিরোনামগুলো পুরো সূরায় বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উঠে উঠেছে এবং প্রতিবারেই নতুন নতুন ভংগীতে এর ওপর আলোচনা করা হয়েছে।

মাদানী সূরাগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোর নাযিলের সময়কাল জানা যায় অথবা সামান্য চেষ্টা-পরিশ্রম করলে তার সময়-কাল চিহ্নিত করে নেয়া যেতে পারে। এমনকি সেসব সূরার বহু সংখ্যক আয়াতের পর্যন্ত নাযিলের উপলক্ষ ও কারণ নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াতে পাওয়া যায়। কিন্তু মক্কী সূরাগুলো সম্কর্কে এতটা বিস্তারিত তথ্য–উপকরণ জানা যায় নেই। খুব কম সংখ্যক সূরা এমন রয়েছে যার নাযিলের সময়কাল ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কিত নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত পাওয়া যায়। কারণ মাদানী যুগের তুলনায় মক্কী যুগের ইতিহাসে খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা কম। তাই মক্কী সূরাগুলোর ব্যাপারে আমাদের ঐতিহাসিক সাক্ষ-প্রমাণের পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূরার বিষয়বস্তু, আলোচ্য বিষয় ও বর্ণনা পদ্ধতি এবং প্রত্যেক সূরার নাযিলের পটভূমি সংক্রান্ত সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট ইশারা-ইংগিতের আকারে যে আভ্যন্তরীণ সাক্ষ-প্রমাণ রয়েছে তার ওপরই নির্ভর করতে হয়।

গবেষণা ও অনুসন্ধানের এক পদ্ধতি অনুসরণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা ই্সলামী দাওয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে একে চারটি প্রধান প্রধান ও উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়ঃ

প্রথম পর্যায়ঃ

নবুওয়াত প্রাপ্তির সূচনা থেকে শুরু করে নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণা পর্যন্ত প্রায় তিন বছর। এ সময় গোপন দাওয়াত দেবার কাজ চলে। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদেরকে দাওয়াত দেয়া হয়। মক্কার সাধারণ লোকেরা এ সম্পর্কে তখনো কিছুই জানতো না।

প্রথমেই তাঁর দাওয়াত কবুল করে ধন্য হ’লেন তাঁর পুণ্যশীলা স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)। অতঃপর মুক্ত দাস যায়েদ বিন হারেছাহ, আলী ইবনু আবী তালেব, আবুবকর ইবনু আবী কুহাফা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)। অতঃপর ইসলাম কবুল করেন বেলাল, আমর ইবনু আম্বাসাহ, খালেদ ইবনু সা‘দ ইবনু আছ (রাঃ)। অতঃপর আবুবকর (রাঃ)-এর দাওয়াতে ইসলাম কবুল করেন ওছমান গণী, যুবায়ের, আবদুর রহমান বিন ‘আওফ, ত্বালহা, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)। অরঃপর আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ, আবদুল আসাদ বিন বিলাল, ওছমান বিন মায‘ঊন, আমের বিন ফুহাইরা, আবু হোযায়ফা বিন ওৎবা, সায়েব বিন ওছমান বিন মায‘ঊন, আরক্বাম (রাঃ) প্রমুখ। মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদীজার পরে রাসূলের চাচা আববাস-এর স্ত্রী উম্মুল ফযল, আবুবকরের মেয়ে আসমা, ওমরের বোন ফাতেমা ও তার স্বামী সাঈদ ইবনু যায়েদ, অতঃপর আবুবকরের স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়েস (রাঃ) প্রমুখ। এতদ্ব্যতীত খাববাব ইবনুল আরত, আবু সালামাহ ও আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ সহ প্রথম তিন বছরে চল্লিশ জনের অধিক ভাগ্যবান ব্যক্তি ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। ইবনু ইসহাকের বর্ণনা মতে এরপর পুরুষ এবং মহিলাগণ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকেন। ফলে ইসলাম মক্কায় প্রকাশ্য হয়ে পড়ে ও তা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা হ’তে থাকে।

উপরে যাদের নামের তালিকা দেওয়া হ’ল, তারা কুরায়েশ গোত্রের প্রায় সকল শাখা-প্রশাখার সাথে সরাসরি কিংবা আত্মীয়তা সূত্রে যুক্ত ছিলেন। কুরায়েশ নেতাদের কাছে এঁদের খবর পেঁŠছে গিয়েছিল। কিন্তু তারা এটাকে স্রেফ ব্যক্তিগত ধর্মাচার মনে করে তেমন কোন গুরুত্ব দেননি।

দ্বিতীয় পর্যায়ঃ

আত্মীয়-স্বজনের কাছে তিন বছর যাবৎ গোপন দাওয়াত দেওয়ার পর এবার আল্লাহর হুকুম হ’ল প্রকাশ্য দাওয়াত দেওয়ার। নাযিল হ’ল, وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ ‘নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে ভয় প্রদর্শন করুন’ (শো‘আরা ২৬/২১৪)। কিন্তু প্রকাশ্য দাওয়াত দেওয়ার প্রতিক্রিয়া যে অতীব কষ্টদায়ক হবে, সে বিষয়ে আগেভাগেই স্বীয় নবীর মন-মানসিকতাকে প্রস্ত্তত করে নেন সূরা শো‘আরা নাযিল করে। ২২৭ আয়াত বিশিষ্ট এই সূরার শুরুতেই আল্লাহ তার নবীকে বলেন,

لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ أَلَّا يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ، إِنْ نَشَأْ نُنَزِّلْ عَلَيْهِم مِّنَ السَّمَاء آيَةً فَظَلَّتْ أَعْنَاقُهُمْ لَهَا خَاضِعِينَ-

‘লোকেরা ঈমান আনছে না বলে হয়ত আপনি মর্মবেদনায় আত্মঘাতি হবার উপক্রম করেছেন’। ‘জেনে রাখুন, আমরা যদি ইচ্ছা করি, তাহ’লে আকাশ থেকে তাদের উপরে এমন নিদর্শন (গযব) অবতীর্ণ করতে পারি, যা দেখে এদের সবার (উদ্ধত) গর্দান অবনত হয়ে যাবে’ (শো‘আরা ২৬/৩-৪)। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, গর্বিত সমাজনেতাদের আচরণে বেদনাহত হয়ে তাওহীদের দাওয়াত থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না। বরং আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে বুকে বল নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণার পর থেকে জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন ও উৎপীড়নের সূচনাকাল পর্যন্ত প্রায় দু-বছর। এ সময় প্রথমে বিরোধিতা শুরু হয়। তারপর তা প্রতিরোধের রূপ নেয়। এরপর ঠাট্টা, বিদ্রুপ, উপহাস, দোষারোপ, গালিগালাজ, মিথ্যা প্রচারণা এবং জোটবদ্ধভাবে বিরোধিতা করার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন শুরু হয়ে যায়। যারা তুলনামূলকভাবে বেশী গরীব, দুর্বল ও আত্মীয় বান্ধবহীন ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে তারাই হয় সর্বাধিক নির্যাতনের শিকার।

তৃতীয় পর্যায়ঃ

ছাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কুরায়েশ বংশের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর পর এবার আল্লাহর রাসূলকে সর্বস্তরের মানুষের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন,

فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ-

‘আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, তা প্রকাশ্যে বর্ণনা করুন এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না।’ ‘বিদ্রূপকারীদের জন্য আমরাই আপনার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)।

উল্লেখ্য যে, ঐ সময় বিদ্রূপকারীদের নেতা ছিল পাঁচ জন: ‘আছ বিন ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনে মুত্ত্বালিব, আসওয়াদ ইবনে আব্দে ইয়াগূছ, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরাহ এবং হারিছ ইবনে তালাতিলা। এই পাঁচ জনই আল্লাহর হুকুমে একই সময়ে মৃত্যুবরণ করে। এভাবেই আল্লাহর ওয়াদা সত্যে পরিণত হয়।

চরম উৎপীড়নের সূচনা অর্থাৎ নবুওয়াতের ৫ম বছর থেকে নিয়ে আবু তালিব ও হযরত খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ইন্তিকাল তথা ১০ম বছর পর্যন্ত পাচঁ বছর সময়-কাল পর্যন্ত এ পর্যায়টি বিস্তৃত। এ সময়ে বিরোধীতা চরম আকার ধারণ করতে থাকে। মক্কার কাফেরদেরকে জুলুম-নির্যাতনে আতিষ্ঠ হয়ে অনেক মুসলমান আবিসিনিয়া হিজরত করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও অবশিষ্ট মুসলমানদেরকে আর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কট করা হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সমর্থক ও সংগী-সাথীদের নিয়ে আবু তালিব গিরিবর্তে অবরুদ্ধ হন।

চতুর্থ পর্যায়ঃ নবুওয়াতের দশম বছর থেকে ত্রয়োদশ বছর পর্যন্ত প্রায় তিন বছর ।

এটি ছিল নবী সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাথীদের জন্য সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক সময়। তাঁর জন্য মক্কায় জীবন যাপন করা কঠিন করে দেয়া হয়েছিল। তায়েফে গেলেন। সেখানেও আশ্রয় পেলেন না। হজ্জের সময়ে আরবের প্রতিটি গোত্রকে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ ও তাঁকে সাহায্য করার আবেদন জানালেন। কিন্তু কোথাও সাড়া পেলেন না। এদিকে মক্কাবাসীরা তাঁকে হত্যা করার , বন্দী করার বা নগর থেকে বিতারিত করার জন্য সলা-পরামর্শ করেই চলছিল। অবশেষে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আনসারদের হৃদয় দুয়ার ইসলামের জন্য খুলে গেলো। তাদের আহবানে তিনি মদীনায় হিজরত করলেন। এ সকল পর্যায়ে বিভিন্ন সময় কুরআন মজীদের যে সমস্ত আয়াত নাযিল হয়। সেগুলোর প্রত্যেকটি তাদের বিষয়বস্তু ও বর্ণনা রীতির দিক দিয়ে পরস্পর থেকে বিভিন্ন। এক পর্যায়ের আয়াতের বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভংগী অন্য পর্যায়েরে আয়াতের থেকে ভিন্নধর্মী। এদের বহু স্থানে এমন সব ইশারা-ইংগিত পাওয়া যায়, যা থেকে তাদের পটভূমির অবস্থা ও ঘটনাবলীর ওপর সুস্পষ্ট আলোকপাত হয়। প্রত্যেক পর্যায়ের বৈশিষ্টের প্রভাব সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে নাযিলকৃত বাণীর মধ্যে বিপুলভাবে লক্ষণীয় ।

প্রকাশ্য দাওয়াতের সাধারণ প্রতিক্রিয়া :

সমাজ নেতাদের প্রতিক্রিয়া

রাসূলের আহবানের সত্যতা ও যথার্থতার বিষয়ে সমাজ নেতাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিমত ছিল না। কিন্তু ধুরন্ধর নেতারা তাওহীদের এ অমর আহবানের মধ্যে তাদের দুনিয়াবী স্বার্থের নিশ্চিত অপমৃত্যু দেখতে পেয়েছিল। এক আল্লাহকে মেনে নিলে শিরক বিলুপ্ত হবে। দেব-দেবীর পূজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সারা আরবের উপর তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব ও পৌরহিত্যের মর্যাদা শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া লোকেরা যে পূজার অর্ঘ্য সেখানে নিবেদন করে, তা ভোগ করা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। আল্লাহর বিধানকে মানতে গেলে তাদের রচিত শোষণমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধান সমূহ বাতিল হয়ে যাবে।  ঘরে বসে দাদন ব্যবসার মাধ্যমে চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ নিয়ে তারা যেভাবে জোঁকের মত গরীবের রক্ত শোষণ করছিল, তা বন্ধ হয়ে যাবে। যে নারীকে তারা ভোগের সামগ্রী হিসাবে মনে করে, তাকে পূর্ণ সম্মানে অধিষ্ঠিত করতে হবে। এমনকি তাকে নিজ কষ্টার্জিত সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসগুলোকে ভাই হিসাবে সমান ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা যুগ যুগ ধরে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব আমরা দিয়ে আসছি, তা নিমেষে হারিয়ে যাবে এবং মুহাম্মাদকে নবী মেনে নিলে কেবল তারই আনুগত্য করতে হবে। অতএব মুহাম্মাদ দিন-রাত কা‘বা গৃহে বসে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকুক, আমরাও তার সাথী হ’তে রাযী আছি। কিন্তু তাওহীদের এ সাম্য ও মৈত্রীর আহবান আমরা কোনমতেই মানতে রাযী নই। এইভাবে প্রধানতঃ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরোধী বিবেচনা করে তারা রাসূলের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ‘জ্ঞানের চূড়া’ বলে পরিচিত কুরায়েশ নেতা ‘আবুল হেকাম’ এরপর থেকে মুসলমানদের নিকটে ‘মূর্খতার চূড়া’ বা ‘আবু জাহ্ল’ নামে পরিচিত হয়। আল্লাহ বলেন, قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُونَ فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِينَ بِآيَاتِ اللّهِ يَجْحَدُونَ- ‘তারা যেসব কথা বলে তা যে তোমাকে খুবই কষ্ট দেয়, তা আমরা জানি। তবে ওরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে না। বরং যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)।

বিরোধিতার কৌশল সমূহ নির্ধারণ

তারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন পথ-পন্থা উদ্ভাবন করল।

(১) আবু ত্বালেবকে দলে টানা: প্রথম পন্থা হিসাবে বেছে নিল মুহাম্মাদের আশ্রয়দাতা আবু ত্বালেবকে দলে টানা

(২) হজ্জের সময় দাওয়াতে বাধা দেওয়া : হজ্জের মৌসুম সমাগত। হারামের এ মাসে কোন ঝগড়া-ফাসাদ নেই। অতএব এই সুযোগে মুহাম্মাদ বহিরাগতদের নিকটে তার দ্বীনের দাওয়াত পেশ করবেন এটাই স্বাভাবিক। অতএব তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, এমন একটা কথা মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তৈরী করতে হবে এবং তা সকলের মধ্যে প্রচার করে দিতে হবে, যাতে কোন লোক তার কথায় কর্ণপাত না করে। অলীদ বিন মুগীরাহর গৃহে বৈঠক বসল। এক একজন এক এক প্রস্তাব করল। কেউ বলল, তাকে ‘কাহেন’ (ভবিষ্যদ্বক্তা) বলা হউক। কেউ বলল, ‘পাগল’ বলা হউক। কেউ বলল, ‘কবি’ বলা হউক। সব শুনে দলনেতা অলীদ বলল, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ-এর কথাবার্তা বড়ই সুন্দর ও মিষ্ট-মধুর। তার কাছে কিছুক্ষণ বসলেই লোকেদের নিকট তোমাদের দেওয়া ঐসব অপবাদ মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে। তারা বলল, তাহ’লে আপনিই বলুন, কী বলা যায়। অলীদ অনেকক্ষণ ভেবে-চিন্তে বলল, তার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয়, তবে বেশীর বেশী তাকে ‘জাদুকর’ বলা যায়। কেননা তার কথা যেই-ই মন দিয়ে শোনে তার মধ্যে জাদুর মত আছর করে (মুদ্দাচ্ছির ৭৪/২৪) একসময় লোকেরা তার দলে ভিড়ে যায়।

অলীদ বিন মুগীরা ছিল মক্কার সেরা ধনী। আল্লাহ তাকে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য দান করেছিলেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তার ফসলের ক্ষেত ও বাগ-বাগিচা মক্কা হ’তে ত্বায়েফ পর্যন্ত (৬০ মাইল) বিস্তৃত ছিল। ছওরী বলেন, তার বার্ষিক আয় ছিল এক কোটি দীনার। শীত-গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে তার ক্ষেতের ফসল ও বাগানের আমদানী অব্যাহত থাকত। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেছেন, وَجَعَلْتُ لَهُ مَالاً مَّمْدُوداً ‘তাকে আমি দিয়েছিলাম প্রচুর মাল-সম্পদ’ (মুদ্দাছছির৭৪/১২)। তাকে আরবদের সরদার গণ্য করা হ’ত। সে ‘রায়হানাতু কুরায়েশ’ (কুরায়েশ-এর শান্তি) নামে খ্যাত ছিল। অহংকারে স্ফীত হয়ে সে নিজেকে ‘অহীদ ইবনুল অহীদ’ ‘অদ্বিতীয়ের বেটা অদ্বিতীয়’ বলত। অর্থাৎ  সে ভাবত যে, গোটা কুরায়েশ বংশের মধ্যে সে ও তার বাপ ছিল অতুলনীয় ও অদ্বিতীয়। একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা গাফের/মুমিন পাঠ করছিলেন- حم، تَنزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللهِ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ، غَافِرِ الذَّنبِ وَقَابِلِ التَّوْبِ شَدِيدِ الْعِقَابِ ذِي الطَّوْلِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ إِلَيْهِ الْمَصِيرُ- ‘হা-মীম’। কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহর পক্ষ হ’তে, যিনি পরাক্রমশালী। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তাঁর কাছেই সবার প্রত্যাবর্তন স্থল’ (গাফের৪০/১-৩)।

শুরুতে উক্ত তিনটি আয়াত শুনে সে বলে উঠল… ‘আল্লাহর কসম আমি তার মুখে এমন কালাম শুনেছি, যা কোন মানুষের কালাম হ’তে পারে না এবং তা কোন জিনেরও কালাম হ’তে পারে না। এতে রয়েছে এক অপূর্ব মাধুর্য এবং এর শব্দ বিন্যাসে রয়েছে এক বিশেষ বর্ণাঢ্যতা। এর বাহ্যিক আবরণ হৃদয়গ্রাহী এবং অভ্যন্তরভাগে প্রবাহিত রয়েছে এক স্নিগ্ধ ফল্পুধারা। এটা নিশ্চিতই সবার ঊর্ধ্বে থাকবে এবং এর উপরে কেউ প্রবল হ’তে পারবে না। এটা কখনোই মানুষের কালাম নয়’।

বিরোধিতার নয়া কৌশল সমূহ

১. অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি :

হজ্জের মৌসুম শেষে নেতারা পুনরায় হিসাব-নিকাশে বসে গেল। তারা দেখল অপবাদ রটনায় কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশী। এর দ্বারা যেমন প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করা যায়। অন্যদিকে তেমনি সাধারণ মানুষ দ্রুত সেটা লুফে নেয়। কেউ যাচাই-বাছাই করতে চাইলে তো আমাদের কাছেই আসবে। কেননা আমরাই সমাজের নেতা এবং আমরাই তার নিকটতম আত্মীয় এবং প্রতিবেশী। অতএব আমরাই যখন তার বিরুদ্ধে বলছি, তখন কেউ আর এ পথ মাড়াবে না। অতএব অপবাদের ধারা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল। একটি হিসাব মতে রাসূলের বিরুদ্ধে তারা অনেকগুলি অপবাদ তৈরী করল। যেমন-

তিনি (১) পাগল (২) কবি وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ (ছাফফাত৩৭/৩৬), (৩) জাদুকর ও  (৪) মহা মিথ্যাবাদী وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ (ছোয়াদ৩৮/৪), (৫) পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيرُ الأوَّلِينَ (আনফাল৮/৩১)। (৬) অন্যের  সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ (নাহল১৬/১০৩), (৭) মিথ্যা রটনাকারী وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَذَا إِلاَّ إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ (ফুরক্বান২৫/৪), (৮) ভবিষ্যদ্বক্তা فَذَكِّرْ فَمَا أَنتَ بِنِعْمَتِ رَبِّكَ بِكَاهِنٍ وَلاَ مَجْنُونٍ (তূর৫২/২৯)। (৯) ফেরেশতা নয়, এতো সাধারণ মানুষ وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً (ফুরক্বান২৫/৭)। (১০) পথভ্রষ্ট وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوا إِنَّ هَؤُلاَء لَضَالُّونَ (তাত্বফীফ৮৩/৩২)। (১১) বেদ্বীন قَالَ ابو لهب: لاَتُطِيْعُوْهُ فَإِنَّهُ صَابِىءٌ كَذَّابٌ (আর-রাহীক্বপৃঃ৮২)। (১২) পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী (১৩) জামা‘আত বিভক্তকারী (আর-রাহীক্বপৃঃ৯৭) (১৪) জাদুগ্রস্ত يَقُوْلُ الظَّالِمُوْنَ إِنْ تَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ رَجُلاً مَّسْحُوْراً (বনুইস্রাঈল১৭/৪৭)। (১৫) ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) (আর-রাহীক্বপৃঃ৮৭)। (১৬) এতদ্ব্যতীত মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার দুরাচার ইহুদীরা রাসূলকে ‘রা‘এনা’ (رَاعِنَا) বলে ডাকত।

২. নাচ-গানের আসর করা :

গল্পের আসর জমানো এবং গান-বাজনা ও নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান করা, যাতে মানুষ মুহাম্মাদের কথা না শোনে। এজন্য অন্যতম কুরায়েশ নেতা ও বিত্তশালী ব্যবসায়ী নযর বিন হারেছ তৎকালীন সমৃদ্ধ নগরী ইরাকের ‘হীরা’ চলে গেল এবং সেখান থেকে পারস্যের প্রাচীন রাজা-বাদশাদের কাহিনী, মহাবীর রুস্তম ও খৃষ্টপূর্বকালের দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের কাহিনী শিখে এসে মক্কায় বিভিন্ন স্থানে গল্পের আসর বসাতে শুরু করল। যেখানেই রাসূল (ছাঃ) মানুষকে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের সুখ-শান্তির কথা শুনিয়ে মানুষকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দিতেন, নযর বিন হারেছ  সেখানে গিয়ে উক্ত সব কাহিনী শুনিয়ে বলত, এগুলো কি মুহাম্মাদের কাহিনীর চেয়ে উত্তম নয়?

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَّيَتَّخِذَهَا هُزُواً أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ-

‘লোকেদের মধ্যে একটি শ্রেণী আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ হ’তে গোমরাহ করার জন্য অলীক কল্পকাহিনী খরিদ করে অজ্ঞতাবশে এবং এগুলো খেল-তামাশা রূপে গ্রহণ করে। এদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (লোকমান৩১/৬)।

৩. ইহুদী-নাছারা পন্ডিতদের সাহায্য নিয়ে তাঁকে ভন্ডনবী প্রমাণের চেষ্টা।

এতদুদ্দেশ্যে কুরায়েশ নেতারা পরামর্শ করে নযর ইবনে হারেছ এবং ওক্ববা ইবনে আবী মু‘আইত্বকে মদীনায় পাঠায়। সেখানকার ইহুদী-নাছারা পন্ডিতেরা তাদেরকে তিনটি প্রস্তাব শিখিয়ে দিয়ে বলল যে, যদি মুহাম্মাদ এগুলির সঠিক জবাব দিতে পারে, তাহলে সে যথার্থ নবী। নইলে সে ভন্ড নবী। তারা এসে নবীকে তিনটি প্রশ্ন করল। পনের দিনের মধ্যে তিনি তাদের সবকটি প্রশ্নের জবাব দিলেন। প্রশ্ন তিনটি ছিল নিম্নরূপ :

(১) আছহাবে কাহফের সেই যুবকদের ঘটনা, যারা প্রাচীনকালে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

(২) যুল-ক্বারনায়েন-এর ঘটনা, যিনি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমে বিশ্বব্যাপী সফর করেছিলেন।

(৩) রূহ কি? এগুলির মধ্যে রূহ কি- এ প্রশ্নের জবাবে সূরা বনু ইস্রাঈলের ৮৫ আয়াতে নাযিল হয়। অতঃপর বাকী দু’টি ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা কাহফ নাযিল হয় (ইবনুজারীরইবনুআববাস (রাঃ) হ’তেএবংকুরতুবী, ইবনুকাছীর)।

৪. ইহুদী পন্ডিতদের আনিয়ে সরাসরি নবীকে পরীক্ষা করা।

যেমন মদীনা থেকে একদল ইহুদী পন্ডিত এসে কুরায়েশ নেতাদের সাথে নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে হযরত ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কে প্রশ্ন করল। কেননা এ কাহিনী তখন মক্কার লোকদের নিকটে অজ্ঞাত ছিল। তাদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে গোটা সূরা ইউসুফ নাযিল হয়ে যায়।

৫. চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণের প্রস্তাব :

সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে সবশেষে ইহুদী পন্ডিতেরা কুরায়েশ নেতাদেরকে একটা বিস্ময়কর কৌশল শিখিয়ে দিল। তারা বলল, মুহাম্মাদ জাদুকর কি-না, যাচাইয়ের একটা প্রকৃষ্ট পন্থা এই যে, জাদুর প্রভাব কেবল যমীনেই সীমাবদ্ধ। আসমানে এর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। অতএব তোমরা মুহাম্মাদকে বল, সে চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করুক। সম্ভবতঃ হযরত মূসা (আঃ) কর্তৃক লাঠির সাহায্যে নদী বিভক্ত হওয়ার মু‘জেযা থেকেই চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার চিন্তাটি ইহুদীদের মাথায় আসে।

ঐ সময় সেখানে হযরত আলী, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, জুবায়ের ইবনু মুত্বইম নওফেলী প্রমুখ ছাহাবী উপস্থিত ছিলেন। এতদ্ব্যতীত বহু ছাহাবী উক্ত বিষয়ে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যে কারণ হাফেয ইবনে কাছীর এতদসংক্রান্ত হাদীছকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ভুক্ত বলেছেন।

কুরায়েশ নেতাদের দাবী মোতাবেক আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উক্ত মু‘জেযা প্রদর্শন করলেন। মুহূর্তের মধ্যে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিমে ছিটকে পড়ল। উভয় টুকরার মাঝখানে পাহাড় আড়াল হয়ে গেল। অতঃপর পুনরায় দুই টুকরা এসে সংযুক্ত হ’ল। এ সময় আল্লাহর নবী (ছাঃ) মিনা-তে ছিলেন। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) কর্তৃক ছহীহায়নের বর্ণনায় এসেছে যে, এরপর রাসূল (ছাঃ) উপস্থিত নেতাদের বললেন, إشْهَدُوْا   ‘তোমরা সাক্ষ্য থাক’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৫৪-৫৫।

ইবনু মাস‘ঊদ ও ইবনু ওমর কর্তৃক ছহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ঐসময় আল্লাহকে সাক্ষী রেখে রাসূল (ছাঃ) বলেন, اَللَّهُمَّ اشْهَدْ হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষ্য থাক।মুসলিম হা/৭০৭৩-৭৪ ‘মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যাবলী’ অধ্যায়, ‘চন্দ্রদ্বিখন্ডিতকরণ’ অনুচ্ছেদ।

উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে শূরা ক্বামার নাযিল হয়। যার শুরু হ’ল اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ ‘ক্বিয়ামত আসন্ন। চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে’ (ক্বামার৫৪/১)।

৬. আপোষমুখী দাওয়াতী পদ্ধতি গ্রহণের প্রস্তাব পেশ :

বুদ্ধিবৃত্তিক ও অলৌকিক সকল পন্থায় পরাজিত হওয়ায় কুরায়েশ নেতারা এবার আপোষমুখী পদ্ধতি গ্রহণ করল। কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জনের নীতিতে তারা রাসূলের সাথে আপোষ করতে চাইল। কুরআনের ভাষায় وَدُّوا لَوْ تُدْهِنُ فَيُدْهِنُوْنَ ‘তারা চায় যদি আপনি কিছুটা শিথিল হয়ে যান, তাহ’লে তারাও নমনীয় হয়ে যাবে’ (ক্বলম৬৮/৯)। এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাবগুলি ছিল নিম্নরূপ :

(ক) মুহাম্মাদ এক বছর আমাদের মা‘বূদের (অর্থাৎ দেব-দেবীর) পূজা করবে, আমরাও একবছর মুহাম্মাদের রব-এর পূজা করব (ইবনুজারীরওত্বাবারাণী)। (খ) যদি মুহাম্মাদ আমাদের উপাস্যগুলির স্বীকৃতি দেয়, তাহ’লে আমরা সকলে তার উপাস্যের ইবাদত করব (গ) আমরা উভয়ে উভয়ের মা‘বূদের পূজা করব। তারপর দেখব, যার মা‘বূদ যে অংশে উত্তম, আমরা সেই অংশটুকু পরস্পরে গ্রহণ করে নেব (ঘ) মুহাম্মাদ আমাদের দেব-দেবীর গায়ে কেবল একটু হাত বুলিয়ে দিক, তাতেই আমরা তাকে সত্য বলে মেনে নিব। তখন সূরা কাফেরূণ নাযিল হয় এবং তাদের সাথে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘোষণা করা হয়।

৭. লোভনীয় প্রস্তাব পেশ :

অতঃপর তারা সাধারণ মুসলমানদের ফিরিয়ে আনার জন্য লোভনীয় প্রস্তাব সমূহ প্রেরণ করল। সেরা ধনী অলীদ বিন মুগীরাহর নেতৃত্বে তারা নির্যাতিত-নিপীড়িত নওমুসলিমদের বলতে লাগলো যে, তোমরা পিতৃধর্মে ফিরে এলে তোমাদের জীবনে সচ্ছলতা ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি পরকালে তোমাদের পাপের বোঝা আমরা বহন করব। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন,

قُلْ أَغَيْرَ اللهِ أَبْغِي رَبّاً وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ وَلاَ تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ إِلاَّ عَلَيْهَا وَلاَ تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى ثُمَّ إِلَى رَبِّكُم مَّرْجِعُكُمْ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ-

‘আপনি বলুন, আমি কি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে পালনকর্তা হিসাবে কামনা করব? অথচ তিনিই সকল বস্ত্তর প্রতিপালক। যে ব্যক্তি কোন পাপ করে, সেটা তারই। কেউ কারু বোঝা বহন করবে না। তোমাদের প্রভুর নিকটেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে। অতঃপর তিনিই তোমাদের জানিয়ে দিবেন যেসব বিষয়ে তোমরা বিরোধ করতে’ (আন‘আম ৬/১৬৪)।

৮. উদ্ভট দাবী সমূহ পেশ :

যেমন (ক) কুরায়েশ নেতারা বলল, মুহাম্মাদ তুমি তোমার প্রভুকে বল যেন মক্কার পাহাড়গুলি সরিয়ে এস্থানটিকে সমতল ভূমিতে পরিণত করে দেন (খ) এখানে নহর সমূহ প্রবাহিত করে দেন, যেমন সিরিয়া ও ইরাকে রয়েছে’ (গ) ছাফা পাহাড়কে যেন স্বর্ণের পাহাড় বানিয়ে দেন। কুরতুবী, ইবনুকাছীর, বাক্বারাহ১০৮।

৯. দুনিয়াবী স্বার্থ লাভের দাবী পেশ :

এক সময় তারা তিনটি দাবী নিয়ে উপস্থিত হয়। এক- যদি তুমি সত্যই নবী হয়ে থাক, তবে মো‘জেযার মাধ্যমে সারা পৃথিবীর ধন-ভান্ডার আমাদের কাছে এনে দাও। দুই- আমাদের ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দের বিষয়গুলি বলে দাও। যাতে আমরা আগেভাগে সাবধান হ’তে পারি। তিন- তুমি একজন ফেরেশতাকে নবী হিসাবে এনে দাও, আমরা তাকে নেতা রূপে মেনে নেব। কেননা তুমি তো আমাদেরই মত একজন মানুষ মাত্র।

জবাবে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,

قُل لآ أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَآئِنُ اللهِ وَلا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلاَّ مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلاَ تَتَفَكَّرُونَ-

‘আপনি বলে দিন যে, আমি তোমাদেরকে একথা বলিনা যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার সমূহ রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগত নই। আমি একথাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো কেবল অহি-র অনুসরণ করি। যা আমার নিকটে প্রেরণ করা হয়। আপনি বলে দিন যে, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কখনো কি সমান হয়? তোমরা কি চিন্তা করবে না? (আন‘আম৬/৫০)।

১০. বিভিন্ন অপযুক্তি প্রদর্শন : যেমন-

(ক) তারা যুক্তি দেখিয়ে বলে, আল্লাহ প্রেরিত রাসূল হ’লে সে কখনো মানুষের মত খাওয়া-দাওয়া ও বাজার-ঘাট করে বেড়াত না। আল্লাহ বলেন,وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً- ‘তারা বলে যে, এ কেমন রাসূল খাদ্য আহার করে ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করে? কেন তার নিকটে ফেরেশতা নাযিল হ’ল না যে তার সাথে ভয় প্রদর্শনকারী হ’ত’ (ফুরক্বান২৫/৭)।

জবাবে আল্লাহ বলেন, وَلَوْ جَعَلْنَاهُ مَلَكاً لَّجَعَلْنَاهُ رَجُلاً وَلَلَبَسْنَا عَلَيْهِم مَّا يَلْبِسُونَ- ‘যদি আমরা কোন ফেরেশতাকে রাসূল করে পাঠাতাম, তবে সে মানুষের আকারেই হ’ত এবং তাকে ঐ ধরনের পোষাক পরাতাম, যা তারা পরিধান করে’ (আন‘আম৬/৯)।

তিনি বলেন,انظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوا لَكَ الْأَمْثَالَ فَضَلُّوا فَلاَ يَسْتَطِيعُونَ سَبِيلاً- ‘আপনি দেখুন ওরা কিভাবে আপনার নামে (বাজে) উপমাসমূহ প্রদান করছে। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা আর পথ পেতে পারে না’ (ফুরক্বান২৫/৯)

(খ) তারা বলল, যদি নিতান্তই কোন মানুষকে নবী করার ইচ্ছা ছিল, তাহ’লে মক্কা ও ত্বায়েফের বিত্তবান প্রভাবশালী কোন ব্যক্তিকে কেন নবী করা হ’ল না?

আল্লাহ বলেন, وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ- ‘তারা বলে, কুরআন কেন দুই জনপদের কোন প্রধান ব্যক্তির উপরে অবতীর্ণ হ’ল না? (যুখরুফ৪৩/৩১)।

জবাবে আল্লাহ বলেন, أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ ‘তারা কি আপনার প্রতিপালকের রহমত বণ্টন করবে? (যুখরুফ৪৩/৩২)। অর্থাৎ আল্লাহ কাকে নবুঅত দান করবেন এটা কেবল তাঁরই এখতিয়ার। রহমত বণ্টনের দায়িত্ব সম্পর্ণরূপে তাঁর হাতে।

(গ) কোন যুক্তিতে কাজ না হওয়ায় অবশেষে তারা অজুহাত দিল, যদি আল্লাহ চাইতেন, তাহ’লে আমরা শিরক করতাম না। যেমন আল্লাহ বলেন,

سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُواْ لَوْ شَاء اللهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلاَ آبَاؤُنَا وَلاَ حَرَّمْنَا مِن شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم حَتَّى ذَاقُواْ بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِندَكُم مِّنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِن تَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ أَنتُمْ إَلاَّ تَخْرُصُونَ-

‘এখন মুশরিকরা বলবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ-দাদারা … আপনি বলুন, তোমাদের কাছে কি কোন প্রমাণ আছে যে, আমাদের দেখাতে পার? তোমরা কেবল ধারণার অনুসরণ কর এবং কেবল অনুমান করে কথা বলে থাক’ (আন‘আম৬/১৪৮)।

অথচ বান্দা শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হউক, এটা কখনোই আল্লাহ চান না। যেমন তিনি বলেন, وَلاَيَرْضَى لِعَبِادِهِ الْكُفْرَ ‘তিনি তার বান্দাদের কুফরীতে সন্তুষ্ট নন (যুমার৩৯/৭)।

সমস্ত যুক্তি, কৌশল ও আপোষ প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর আবু লাহাবের নেতৃত্বে কুরায়েশ নেতাদের মধ্য থেকে ২৫ জনের একটি কমিটি গঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে এখন থেকে কঠোরতম নির্যাতন চালাতে হবে। এ ব্যাপারে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ করা চলবে না

১. রাসূলের উপর প্রতিবেশীদের অত্যাচার

আবু লাহাব ছিল রাসূলের চাচা ও নিকটতম প্রতিবেশী। সে ও তার স্ত্রী ছাড়াও অন্যতম প্রতিবেশী ছিল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব, আদী বিন হামরা ছাক্বাফী, ইবনুল আছদা আল-হুযালী। এদের মধ্যে কেবল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া ইসলাম কবুল করেছিলেন। ইনিই ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের অন্যতম খলীফা মারওয়ানের পিতা। বস্ত্ততঃ মু‘আবিয়া ও ইয়াযীদ বাদে তাঁর বংশধরগণই উমাইয়া খেলাফতের ধারানুক্রমিক খলীফা ছিলেন। ইনি ব্যতীত বাকীরা রাসূলের উপর নানাবিধ অত্যাচার চালায়।

২. কা‘বা গৃহে ছালাতরত অবস্থায় কষ্টদান

আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (ছাঃ) বায়তুল্লাহ্র পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। আবু জাহ্ল ও তার সাথীরা অদূরে বসেছিল। কিছুক্ষণ পর তার নির্দেশে ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুড়ির চাপে ও দূর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। ইবনু মাসঊদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অন্যদিকে শত্রুরা দানবীয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। এই সময় কিভাবে এই দুঃসংবাদ ফাতেমার কানে পৌঁছলে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,

اللهم عليك بقريش (ثلاث مرات)، اللهم عليك بعمرو بن هشام اى بأبى جهل وعليك بعتبة بن ربيعة وشيبة بن ربيعة والوليد بن عتبة وامية بن خلف وعقبة بن ابى مُعَيط وعُمارة بن الوليد، متفق عليه-

‘হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধরো (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম আবু জাহলকে ধরো। হে আল্লাহ তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, অলীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধরো’। ইবনু মাস‘ঊদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’।(মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪৭; ‘রাসূলের আবির্ভাব ও অহি-রসূচনা’ অনুচ্ছেদ। )

৩. সম্মুখে ও পশ্চাতে নিন্দা করা ও অভিশাপ দেওয়া :

এ ব্যাপারে উমাইয়া বিন খালাফ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সে পশ্চাতে সর্বদা নিন্দা করত। তাছাড়া রাসূলকে দেখলেই তাঁর সামনে গিয়ে যাচ্ছে তাই বলে নিন্দা ও ভৎর্সনা করত এবং তাঁকে অভিশাপ দিত। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়, وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ ‘প্রত্যেক সম্মুখ নিন্দাকারী ও পশ্চাতে নিন্দাকারীর জন্য রয়েছে ধ্বংস’ (হুমাযাহ১০৪/১)।

৪. রাসূলের মুখে থুথু নিক্ষেপ করা :

(ক) উমাইয়া বিন খালাফের ভাই উবাই বিন খালাফ ছিল আরেক দুরাচার। সে যখন শুনতে পেল যে, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব রাসূলের কাছে বসে কিছু আল্লাহর বাণী শুনেছে, তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ওক্ববাকে বাধ্য করল যাতে সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাসূলের মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আসে। ওক্ববা তাই-ই করল।

(খ) অনুরূপ এক ঘটনায় একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতায়বা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, আমি সূরা নাজমের ১ ও ৮ আয়াত (وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى- ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى) দু’টিকে অস্বীকার করি বলেই একটা হেঁচকা টানে রাসূলের গায়ের জামা ছিঁড়ে দিল এবং তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। অথচ এই হতভাগা ছিল রাসূলের জামাতা। যে তার পিতার কথা মত রাসূলের মেয়ে উম্মু কুলছূমকে তালাক দেয়। পরে উক্ত মেয়ের বিয়ে হযরত ওছমানের সাথে হয়। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তখন তাকে বদ দো‘আ করে বললেন, اللهم سلط عليه كلبا من كلابك ‘আল্লাহ তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’। কিছুদিন পরে ওতায়বা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে যারক্বা (الزرقاء) নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠল, هو والله يأكلنى كما دعا محمد علىّ فقتلنى وهو بمكة وانا بالشام ‘আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে দো‘আ করেছিল। সে আমাকে হত্যা করল। অথচ সে মক্কায় আর আমি শামে’। পরদিন সকালে বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল।

৫. রাসূলের মুখে পচা হাড্ডি চূর্ণ ছুঁড়ে মারা :

উবাই বিন খালাফ নিজে একবার মরা-পচা হাড্ডি চূর্ণ করে রাসূলের কাছে গিয়ে তাঁর মুখের দিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। যাতে তাঁর মুখ ভর্তি হয়ে যায় এবং দুর্গন্ধে বমি হবার উপক্রম হয়।

৬. তার সামনে এসে মিথ্যা শপথ করা এবং পরে চোগলখুরী করা :

রাসূলকে নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম সেরা বদমাশ ছিল আখনাস বিন শুরাইক্ব ছাক্বাফী। তবে মুফতী শফী  এ ব্যক্তির নাম ওলীদ বিন মুগীরা বলেছেন। তিনি বলেন, ঐ ব্যক্তি আসলেই জারজ ছিল। সে ভাল মানুষ সেজে রাসূলের সামনে মিথ্যা শপথ করে কথা বলত এবং পরে লোকদের কাছে গিয়ে চোগলখুরী করত। আল্লাহ পাক তার নয়টি বদ স্বভাবের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلاَّفٍ مَّهِينٍ- هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ- مَنَّاعٍ لِّلْخَيْرِ مُعْتَدٍ أَثِيْمٍ- عُتُلٍّ بَعْدَ ذَلِكَ زَنِيْمٍ-

‘আপনি কথা শুনবেন না ঐ ব্যক্তির, যে অধিক শপথকারী ও হীন স্বভাব বিশিষ্ট’। ‘যে সম্মুখে নিন্দা করে এবং একের কথা অন্যকে লাগিয়ে চোগলখুরী করে’। ‘সে ভালকাজে অধিকহারে বাধাদানকারী, সীমা লংঘনকারী ও পাপিষ্ঠ’। ‘রুক্ষ স্বভাবী এবং সে জারজ সন্তান’ (ক্বলম৬৮/১০-১৩)।

তার এই বাড়াবাড়ির কারণ ছিল তার অতুল বিত্ত-বৈভবের অহংকার। যেমন আল্লাহ বলেন,

أَنْ كَانَ ذَا مَالٍ وَّ بَنِيْنَ- إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا قَالَ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- سَنَسِمُهُ عَلَى الْخُرْطُوْمِ، (القلم ১৪-১৬)-

‘আর এটা এ কারণে যে, সে ছিল মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মালিক’। ‘যখন তার সম্মুখে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে বলে, এসব পুরাকালের উপকথা’। ‘সত্বর আমরা তার নাসিকা দাগিয়ে দেব’ (ক্বলম৬৮/১৪-১৬)। হাতী বা শূকরের শুঁড়কে আরবীতে ‘খুরতূম’ বলা হয়। অথচ এখানে ঐ ব্যক্তির নাম সম্পর্কে এই বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে তার হীনতা ও নিকৃষ্টতা প্রকাশ করার জন্য।

৭. রাসূলের সামনে বসে কুরআন শোনার পর তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে চলে যাওয়া :

এ কাজটা প্রায়ই আবু জাহ্ল করত, আর ভাবত আমি মুহাম্মাদকে ও তাঁর কুরআনকে গালি দিয়ে একটা দারুণ কাজ করলাম। অথচ তার এই কুরআন শোনাটা ছিল কপটতা এবং লোককে একথা বুঝানো যে, আমার মত আরবের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তির নিকটেই যখন কুরআনের কোন মূল্য নেই, তখন তোমরা কেন এর পিছনে ছুটবে?

আবু জাহলের এই কপট ও গর্বিত আচরণের কথা বর্ণনা করেন আল্লাহ এভাবে- فَلَا صَدَّقَ وَلَا صَلَّى- وَلَكِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- ثُمَّ ذَهَبَ إِلَى أَهْلِهِ يَتَمَطَّى- ‘সে বিশ্বাস করেনি এবং ছালাত আদায় করেনি’। ‘পরন্তু সে মিথ্যারোপ করেছে ও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে’। ‘অতঃপর সে দম্ভভরে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছে’ (ক্বিয়ামাহ৭৫/৩১-৩৩)।

 

এক বর্ণনায় এসেছে যে, তার অশ্লীল গালিগালাজ শুনে এক পর্যায়ে রাসূল (ছাঃ) আবু জাহলের জামার কলার ধরে জোরে হেচকা টান মেরে নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন, أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى- ثُمَّ أَوْلَى لَكَ فَأَوْلَى- ‘তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’। ‘অতঃপর তোমার দুর্ভোগের উপরে দুর্ভোগ’ (ক্বিয়ামাহ৭৫/৩৪-৩৫)।

৮. কা‘বা গৃহে ছালাত আদায়ে নানারূপ বাধা সৃষ্টি :

(ক) প্রথম দিকে সকালে ও সন্ধ্যায় দু’রাক‘আত করে ছালাত আদায়ের নিয়ম ছিল। প্রথম তিন বছর সকলে সেটা গোপনে আদায় করতেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা প্রকাশ্যে কা‘বা গৃহে আদায় করতে থাকেন। একদিন তিনি ছালাত আদায় করছেন। এমন সময় আবু জাহ্ল গিয়ে তাঁকে ধমকের সুরে বলল, ألم أنهك عن هذا يا محمد! ‘হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এসব করতে নিষেধ করিনি’?

তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে পাল্টা ধমক দেন। এতে সে বলে, بأى شيء تهددنى يا محمد أما والله إنى لأكثر هذا الوادى ناديًا. ‘কিসের জোরে তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ। আল্লাহর কসম! মক্কার এই উপত্যকায় আমার বৈঠক সবচেয়ে বড়’। অর্থাৎ আমার দল সবচেয়ে বড়। তখন আল্লাহ সূরা আলাক্ব-এর ৬-১৯ আয়াত গুলি নাযিল করেন।(তিরমিযীহা/৩৩৪৯, সিলসিলাছাহীহাহহা/২৭৫। )

  • শিস দেওয়া ও তালি বাজানো : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কা‘বায় গিয়ে ছালাত আদায় করতেন, তখন কাফের নেতারা তাদের লোকজন নিয়ে কা‘বা গৃহে আসত। অতঃপর ইবাদতের নাম করে তারা সেখানে জোরে জোরে তালি বাজাত ও শিস্ দিত। যাতে রাসূলের ছালাত ও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো যায়। এ বিষয়টি উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاءً وَّتَصْدِيَةً فَذُوْقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُوْنَ ‘আর কা‘বার নিকটে তাদের ইবাদত বলতে শিস দেওয়া ও তালি বাজানো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অতএব (ক্বিয়ামতের দিন তাদের বলা হবে) তোমরা নিজেদের কুফরীর আযাবের স্বাদ আস্বাদন কর’ (আনফাল ৮/৩৫)।
  • ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এতদ্ব্যতীত আবু জাহ্ল অন্যান্যদেরকে প্ররোচিত করেছিল যে, মুহাম্মাদ যখন কুরআন তেলাওয়াত করে তখন তোমরা হৈ-হুল্লোড় ও হট্টগোল করবে, যাতে কেউ তার তেলাওয়াত শুনতে না পায়। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়-

وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لاَ تَسْمَعُوْا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ- فَلَنُذِيْقَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا عَذَاباً شَدِيْداً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِيْ كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ-

‘আর কাফেররা বলে যে, তোমরা এ কুরআন শুনোনা এবং এর তেলাওয়াত কালে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা জয়ী হও’। ‘আমরা অবশ্যই কাফিরদের কঠিন আযাব আস্বাদন করাব এবং আমরা অবশ্যই তাদের কাজের হীনতম বদলা নেব’ (হামীম সাজদাহ ৪১/২৬-২৭)।

১০. সত্যনবী হ’লে তাকে অমান্য করায় গযব নাযিল হয় না কেন বলে যুক্তি প্রদর্শন করা :

নযর বিন হারিছ প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা নও মুসলিমদের সম্মুখে এবং নিজেদের লোকদের সম্মুখে জোরে-শোরে একথা প্রচার করত যে, যদি মুহাম্মাদ সত্য নবী হ’তেন ও তার আনীত কুরআন সত্য কিতাব হয়ে থাকে, তাহ’লে তা অমান্য করার অপরাধে আমাদের উপরে গযব নাযিল হয় না কেন? বস্ত্ততঃ তাদের এসব কথা দ্বারা দুর্বলদের মন আরও দুর্বল হয়ে যেত এবং ইসলাম গ্রহণ করা হ’তে মানুষ পিছিয়ে যেত। তাদের এই দাবী ও তার জওয়াবে আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوْا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَـذَا إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- وَإِذْ قَالُوْا اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَـذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ- وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ-

‘যখন তাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা (তাচ্ছিল্যের সাথে) বলে, আমরা শুনেছি, ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি। এসব তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ভিন্ন কিছুই নয়’। ‘এতদ্ব্যতীত যখন তারা বলতে আরম্ভ করে যে, হে আল্লাহ! যদি এটাই তোমার নিকট থেকে আগত সত্য দ্বীন হয়ে থাকে, তাহ’লে তুমি আমাদের উপরে আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণ কর কিংবা আমাদের উপরে বেদনাদায়ক আযাব নাযিল কর’। ‘অথচ আল্লাহ কখনোই তাদের উপরে আযাব নাযিল করবেন না, যতক্ষণ আপনি তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন। তাছাড়া তারা (দুর্বল মুসলমানেরা) যতক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, আল্লাহ কখনো তাদের উপরে আযাব দিবেন না’ (আনফাল ৮/৩১-৩৩)।

আল্লাহ কাফেরদের কথার জওয়াবে বলেন, যতক্ষণ হে মুহাম্মাদ! আপনি তাদের মধ্যে অবস্থান করবেন অথবা আপনার হিজরতের পরেও যতদিন মক্কার দুর্বল ঈমানদারগণ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, ততদিন আল্লাহ কখনোই তাদের উপর গযব নাযিল করবেন না। কারণ একজন নবী ও ঈমানদারের মূল্য সমস্ত আরববাসী এমনকি সারা পৃথিবীর সমান নয়। এ কারণেই হাদীছে এসেছে, لاتقوم الساعة حتى لايقال فى الأرض: الله الله ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন পৃথিবীতে একজন আল্লাহ বলার মত (প্রকৃত তাওহীদপন্থী ঈমানদার) লোক বেঁচে থাকবে’।মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫১৬।

বস্ত্ততঃ ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তাদের উপরে সে আযাবই নাযিল হয়েছিল। কেননা যে দুনিয়ার লোভে তারা ইসলামকে সত্য জেনেও তার বিরোধিতায় জীবনপাত করেছিল, সেই দুনিয়াবী নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব সবই তাদের ধূলিসাৎ হয়ে যায় মক্কা বিজয়ের দিন এবং যেদিন তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইসলাম কবুল করতে বাধ্য হয়। নিজেদের জীবদ্দশায় এরূপ মর্মান্তিক ছন্দপতন প্রত্যক্ষ করা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী গযব নয় কি? বরং আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণে নিহত হওয়ার চাইতে এটিই ছিল কুরায়েশ নেতাদের জন্য আরও বড় গযব। যুগে যুগে সত্য এভাবেই বিজয়ী হয়েছে।

১১. রাস্তায় ছেলে-ছোকরাদের লেলিয়ে দেওয়া :

উপরে বর্ণিত অত্যাচার সমূহের সাথে যোগ হ’ল একটি নিষ্ঠুরতম অত্যাচার। সেটি হ’ল নেতাদের কারসাজিতে ছেলে-ছোকরাদের অত্যাচার। যেহেতু ছোট ছেলেদের সাত খুন মাফ। তাই নেতারা তাদের কাজে লাগালো। আধুনিক পরিভাষায় নেতারা হ’ল গডফাদার এবং ছোকরারা হ’ল টিন এজার সন্ত্রাসী।

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যখন রাস্তায় বেরোতেন, তখনই আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা ছোকরার দল ছুটে আসত। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ওদের সালাম দিতেন। ওরা পাল্টা গালি দিত। তিনি ওদের উপদেশ দিতেন। ওরা তখন হি হি করে অট্টহাস্য করত। এভাবে কোন এক পর্যায়ে যখন ওরা রাসূলের দিকে ঢিল ছুঁড়ে মারা শুরু করত, তখন রাসূল (ছাঃ) আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নিতেন। তখন ছোকরারা চলে যেত। আবু সুফিয়ান বাহ্যিক সৌজন্য বজায় রাখতেন। সম্ভবতঃ এরই প্রতিদান স্বরূপ  মক্কা বিজয়ের রাতে সুফিয়ান গোপন অভিযানে এসে ধরা পড়লে রাসূল (ছাঃ) তাকে মাফ করে দেন এবং ঘোষণা দেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে আশ্রয় নিবে, সে ব্যক্তি নিরাপদ থাকবে’আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪০১।

সহায়ক ও সংগ্রহে-

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন, https://i-onlinemedia.net/