পর্দা- মহান রবের আনুগত্যের একটি রুপায়ন: ১ম পর্ব (পোষাক ও সতর)
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ.
بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ
আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ
Power Point Presentation:
পর্দা- মহান রবের আনুগত্যের একটি রুপায়ন-১ম পর্ব
কেনো এই বিধান জানতে হবে? মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন–
অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত পৌঁছে, তবে যে ব্যক্তি আমার সে হিদায়াত অনুসারে চলবে, তার উপর না কোন ভয় আসবে, না (কোন কারণে) তারা চিন্তাগ্রস্ত ও সন্তপ্ত হবে। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করবে এবং আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাবে, তারাই হবে জাহান্নামবাসী; অনন্তকাল সেখানে থাকবে। সূরা আল-বাকারা: ৩৮-৩৯ মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। এটি হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকী’দের জন্য… সূরা আল-বাকারা: ২
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
ঐ দিনকে ভয় কর, যে দিন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোন রূপ অবিচার করা হবে না। সূরা আল-বাকারা: ২৮১
যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। সূরা আল-আহযাব: ২১
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়। সূরা আল-আহযাব: ৩৬
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
মুমিনদের বক্তব্য কেবল এ কথাই – যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে তাদেরকে আহবান করা হয়, তখন তারা বলে: আমরা শুনলাম ও আদেশ মান্য করলাম। তারাই সফলকাম। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকে তারাই কৃতকার্য। সূরা আন-নূর: ৫১-৫২
আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো – যা তিনি রাসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফিকদেরকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। সূরা আন-নিসা: ৬১
না, হে মুহাম্মাদ! তোমার রবের কসম, এরা কখনো মু’মিন হতে পারে না যতক্ষণ এদের পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে এরা তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নেবে, তারপর তুমি যা ফায়সালা করবে তার ব্যাপারে নিজেদের মনের মধ্য কোনো প্রকার কুণ্ঠা ও দ্বিধার স্থান দেবে না, বরং সর্বান্তকরণে মেনে নেবে। সূরা আন-নিসা: ৬৫
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং শোনার পর তা থেকে বিমুখ হয়ো না। আর তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা বলে যে, আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনেনা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’লার নিকট সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই মূক ও বধির, যারা উপলদ্ধি করে না। সূরা আনফাল: ২০-২২
নবী সা: বলেছেন, আমার উম্মতের সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যারা অস্বীকার করেছে (তারা ব্যতিত)। (উপস্থিত সাহাবাগণ) জিজ্ঞেস করলেন, কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আমার (দ্বীনের) আনুগত্য করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে ব্যক্তি আমাকে অমান্য করবে সে-ই অস্বীকার করে। সহীহ বুখারী: ৬৭৭১
পর্দা শ্রেষ্ঠ ইবাদত ও গুরুত্বপূর্ণ ফরযসমূহের অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে সৌন্দর্য প্রদর্শনকে নিষেধ করে পর্দার আদেশ দেন, তেমনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাদীসে বেপর্দার নিষেধাজ্ঞা জারি করে পর্দার আদেশ জারি করেন। পর্দা ফরযের ব্যাপারে পূর্বের ও বর্তমানের আলিমগণ একমত।
নারী-পুরুষের পর্দার বিধান নিয়ে আমরা আলোচনাটি কয়েকটি পর্বে ভাগ করে নেই:
১। নারী ও পুরুষের পোশাক
২। নারী ও পুরুষের সতর
৩। নারী ও পুরুষের পর্দা
মানুষ যেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্যসব প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে তার অন্যতম পোশাক। মানুষের মতো অন্য প্রাণীরাও খায়, ঘুমায় এবং জৈবিক চাহিদা মেটায়। তারাও তাদের আব্রু ঢাকে। তবে তা প্রকৃতির নিয়মে। প্রাণীরা মানুষের মতো আপন লজ্জাস্থান ঢাকে না ঠিক। তবে আল্লাহ তাআলা জন্মগতভাবেই তাদের লজ্জাস্থান স্থাপন করেছেন কিছুটা আড়ালে। প্রাণীদের মধ্যেও আছে লজ্জার ভূষণ। ইরশাদ হয়েছে—
অতঃপর সে তাদেরকে প্রবঞ্চনার দ্বার অধঃপতিত করল। এরপর যখন তার সে গাছের ফল খেল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। তখন তাদের রব তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ গাছ থেকে নিষেধ করিনি এবং আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় শয়তান তোমাদের উভয়ের প্রকাশ্য শত্রু। আরাফঃ ২২
পোশাক মানুষের আভিজাত্যের প্রতীক হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বাস-প্রত্যয় ও মূল্যবোধেরও পরিচয় বহন করে। তাই এক্ষেত্রেও ইসলামের রয়েছে এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামী শরীয়ত মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট কোন মাপের বা ডিজাইনের পোশাক আবশ্যিক করে দেয়নি, তবে এমন কিছু শর্ত ও মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের পক্ষেই মেনে চলা সম্ভব এবং এর মধ্যেই রয়েছে শালীনতা ও কল্যাণ। কাজেই ইসলাম নির্দেশিত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করে স্থান, কাল, পরিবেশ ও আবহাওয়াভেদে যে কোন পোশাকই ইসলামে জায়েয। পোশাক মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লারই দান।
পোশাক মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লারই দান। তিনিই এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন:
হে বনী-আদম! আমি তোমাদের জন্যে পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজ-সজ্জার বস্ত্র এবং পরহেযগারীর পোশাক, এটি সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।সূরা আরাফ: ২৬
তোমাদের জন্যে পোশাক তৈরী করে দিয়েছেন, যা তোমাদেরকে গ্রীষ্ম এবং বিপদের সময় রক্ষা করে। এমনিভাবে তিনি তোমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহের পূর্ণতা দান করেন, যাতে তোমরা আত্নসমর্পণ কর। সূরা আন-নহল: ৮১
এই আয়াত থেকে পোশাকের চারটি মৌলিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায়:
১। লজ্জাস্থানকে আবৃত করে বা অন্তরালে রাখে।
২। সৌন্দর্য বিধান করে।
৩। তাকওয়া বা আল্লাহভীতির পরিচয় বহন করে।
৪। দেহকে সুরক্ষিত রাখে।
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেছেন, দুই শ্রেণীর জাহান্নামী রয়েছে যাদের আমি দেখিনি। একশ্রেণীর হলো, যাদের কাছে গরুর লেজের মতো চাবুক রয়েছে, যা দিয়ে তারা মানুষকে মারে। আর দ্বিতীয় শ্রেনী হলো, যে স্ত্রীলোকেরা কাপড় পরেও উলংগ। তারা নিজেরাও বিপথগামী হয়েছে এবং অন্যদেরকেও বিপথগামী করেছে। তাদের মাথা বুখতি উটের কুঁজের মত একদিকে ঝুঁকানো। তারা না জান্নাতে যেতে পারবে, আর না জান্নাতের সুঘ্রাণ পাবে। যদিও তার সুঘ্রাণ বহুদূর থেকে পাওয়া যায়। সহীহ মুসলিম: ৫৪১৯
এখানে এমন পাতলা ও আঁটসাঁট পোশাকের কথা বলা হয়েছে যা পরলেও শরীরের গঠন ও বাঁকসমূহ বাইরে থেকে যে কেউ তাকালেই দেখতে এবং বুঝতে পারবে।
ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল (সা:) ঐসব পুরুষকে লা’নত করেছেন, যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে। সহীহ বুখারী: ৫৪৬৫, তিরমিযী: ২৭২২
এখানে লক্ষ্য করুন, শুধুমাত্র পোশাকই নয় বরং বিপরীত লিঙ্গের পোশাকের অনুকরণ ও সাদৃশ্যকেও অভিসম্পাত করেছেন। তাই এক ব্যক্তি আয়েশা রা:কে পুরুষের জুতা পরিধানকারিণী এক মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সা: পুরুষের বেশ ধারনকারিণী মহিলাদের উপর লা’নত করেছেন। আবু দাউদ: ৪০৫৫
এই দু’টি হাদীস থেকে জানা যায়:
১। পোশাক পাতলা ও আঁটসাঁট হওয়া যাবে না।
২। পোশাক বিপরীত লিঙ্গের সদৃশ হবে না।
ইবনে উমার রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি গর্ব ভরে নিজের পরিধানের কাপড় মাটিতে হেঁচড়ে টেনে চলে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাঁর দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাবেন না।সহীহ মুসলিম: ৫২৯৬
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন: যে ব্যক্তি দুনিয়াতে যশ লাভের উদ্দেশ্যে পোশাক পরে, কিয়ামতের দিন তাকে অপমানের পোশাক পরাবেন, অতঃপর তাতে অগ্নিসংযোগ করবেন।সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৬০৭
পোশাক কোনভাবেই গর্ব প্রকাশক ও খ্যাতি লাভের মানসে হবে না।
তবে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: সুন্দর, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন পোশাক যা গর্ব প্রকাশক ও খ্যাতি লাভের মানসে না হয় তা অনুমোদন করেছেন।
আনাস রা: বলেন, রাসূল সা: পুরুষদেরকে জাফরানী রংয়ের কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন। সহীহ বুখারী: ৫৪২১
আলী ইবনে তালিব রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: কাসসী (একপ্রকার রেশমী কাপড়), হলুদ বর্ণের কাপড়, সোনার আংটি এবং রুকুতে কুরআন পাঠকে নিষেধ করেছেন।সহীহ মুসলিম: ৫২৭৬
জাবির রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বাম হাতে পানাহার করতে, একপায়ে জুতা পরে পথ চলতে, এক কাপড়ে পুরো শরীর ঢাকতে এবং এক কাপড় পরিধান করে হাঁটু পর্যন্ত পেঁচিয়ে বসতে নিষেধ করেছেন। এতে লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। সহীহ মুসলিম: ৫৩৩৮
রেশমী কাপড় (সিল্ক), জাফরান রং-এর পোশাক এবং এক কাপড়ের পোশাক যা লজ্জাস্থান দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা পুরুষদের জন্য নিষেধ।
আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি ছবিযুক্ত একটি গদি বা আসন কিনলেন। নবী সা: এটি দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন, ভেতরে প্রবেশ করলেন না। আমি বললাম, আমি আল্লাহর দরবারে আমার গুনাহ থেকে তওবা করছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এই গদিটি কেন? আমি বললাম, আপনার বসার এবং বালিশ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে। তিনি বলেন, এসব ছবি যারা তৈরি করেছে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে, যে জিনিষ তোমরা বানিয়েছ, তাতে জীবন দান করো। ফেরেশতারা কখনো এমন ঘরে প্রবেশ করেন না, যেখানে প্রাণীর ছবি থাকে। সহীহ বুখারী: ৫৫২৪
প্রাণীর ছবি সম্বলিত পোশাক পড়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
মহান আল্লাহ তা’লা বলেন: হে বনী-আদম! তোমরা প্রত্যেক সালাতের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও, খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না। সূরা আল আরাফ: ৩১
পোশাক যেন অপচয়কারীর খাতায় নাম না লিখায়, সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন: যদি কেউ কোনো সম্প্রদায়ের অনুকরণ করে, তবে সে ঐ সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য হবে। আবু দাউদ: ৪/৪৪
অন্য ধর্মের ‘নির্দিষ্ট’ চিহ্ন বহন করে যেমন ধূতি, ক্রুশচিহ্ন ইত্যাদি পরিধান করা যাবে না।
পোষাকের নীতিসমূহঃ
১। লজ্জাস্থানকে আবৃত করে বা অন্তরালে রাখে। পোশাক তার চারপাশ আচ্ছাদনকারী হওয়া চাই।
২। পোশাক পাতলা ও আঁটসাঁট হওয়া যাবে না।
৩। পোশাক বিপরীত লিঙ্গের সদৃশ হবে না।
৪। পোশাক কোনভাবেই গর্ব প্রকাশক ও খ্যাতি লাভের মানসে হবে না।
৫। অন্য ধর্মের ‘নির্দিষ্ট’ চিহ্ন বহন করে যেমন ধূতি, ক্রুশচিহ্ন ইত্যাদি পরিধান করা যাবে না।
৬। পোশাক যেন অপচয়কারীর খাতায় নাম না লিখায়, সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
৭। প্রাণীর ছবি সম্বলিত পোশাক পড়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
৮। রেশমী কাপড় (সিল্ক), জাফরান রং-এর পোশাক এবং এক কাপড়ের পোশাক যা লজ্জাস্থান দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা পুরুষদের জন্য নিষেধ।
৯। নারীর জন্য বাইরে যাওয়ার সময় সুগন্ধিমক্ত পোষাক যা পুরুষের সংস্পর্শে ফিতনার সৃষ্টি থেকে হেফাজত করবে।
physiology এর ভাষায় BMR বলে একটা টার্ম আছে। এর পুরো অর্থ Basal Metabolism Rate। এটা মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের অনেক বেশি। তাই ছেলেদের শরীরে বেশি সংখ্যক মেটাবলিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। আর এই বিক্রিয়ার ফলে শক্তির পাশাপাশি উৎপন্ন হয় প্রচুর পরিমান তাপ। অন্যদিকে মেয়েদের BMR কম। তাই তাদের শরীরে কম তাপ উৎপাদন হয়। এ অবস্থায় স্বাভাবিক ফিজিওলজিক্যাল কন্ডিশন ধরে রাখতে হলে ছেলেদের শরীর থেকে অধিক পরিমাণ তাপ বিকিরণ হওয়া প্রয়োজন। নতুবা উৎপন্ন অত্যধিক তাপে তাদের thermostat set point অনেক বেড়ে যাবে যা তাদের জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু মেয়েদের শরীরে তুলনামূলকভাবে অনেক কম তাপ উৎপাদন হয়। তাই তাদের ক্ষেত্রে অত বেশি তাপ বিকিরণের দরকার নেই।
আমাদের শরীরের physiological system গুলো আপনি বা আমি নির্ধারণ করিনি, অন্যকেউও নির্ধারণ করেনি। বরং তা নির্ধারণ করেছেন আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহ। তিনি জানেন ছেলেদের জন্য কাপড়-চোপড় দিয়ে নিজেদের আবৃত করে রাখা অপেক্ষাকৃত বেশি কঠিন। তাই তিনি ছেলেদের পর্দার পরিসীমা নির্ধারণ করলেন হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত। অন্যদিকে মেয়েদের সতর হলো মুখ ও হাত ব্যতীত সমস্ত শরীর। এই পর্দার সীমা নির্ধারণ করে আল্লাহ তায়ালা মেয়েদের উপর কোনরূপ অবিচার করেননি। বরং এই কাজ করাকে মেয়েদের জন্য তিনি সহজ করে দিয়েছেন। তিনিই তো মেয়েদের BMRকে কম করে সৃষ্টি করেছেন যেন তাদের শরীরকে কম তাপ উৎপাদন হয় এবং গরমের সময়ও তাদের জন্য পর্দা করতে কম কষ্ট হয়। সুবহান আল্লাহ । সত্যি আল্লাহ তায়ালা প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর নির্ধারিত প্রতিটি বিধান এবং তার সৃষ্টিকার্যের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে আল্লাহ তায়ালার প্রজ্ঞার নিদর্শন। (সংগৃহিত অংশ)
২। নারী ও পুরুষের সতর
নারীর সতর
ইসলামিক শরীয়াহ অনুসারে, আওরাহ বা সতর আরবি: عورة ‘আওরাহ, আরবি: ستر, সতর ) হল মানব শরীরের সে সকল অংশ যেগুলো অপরের সামনে ঢেকে রাখা বাধ্যতামুলক
রাসূল সা বলেছেন- ঈমানের শাখা হচ্ছে সত্তরের কিছু বেশী এবং লজ্জা হলো ঈমানের একটি (বিশেষ) শাখা।সহীহ মুসলিম: ৬০
২৪:৩১ وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِهِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَهُنَّ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَ لۡیَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰی جُیُوۡبِهِنَّ ۪ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَهُنَّ اِلَّا لِبُعُوۡلَتِهِنَّ اَوۡ اٰبَآئِهِنَّ اَوۡ اٰبَآءِ بُعُوۡلَتِهِنَّ اَوۡ اَبۡنَآئِهِنَّ اَوۡ اَبۡنَآءِ بُعُوۡلَتِهِنَّ اَوۡ اِخۡوَانِهِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ اِخۡوَانِهِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ اَخَوٰتِهِنَّ اَوۡ نِسَآئِهِنَّ اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُهُنَّ اَوِ التّٰبِعِیۡنَ غَیۡرِ اُولِی الۡاِرۡبَۃِ مِنَ الرِّجَالِ اَوِ الطِّفۡلِ الَّذِیۡنَ لَمۡ یَظۡهَرُوۡا عَلٰی عَوۡرٰتِ النِّسَآءِ ۪ وَ لَا یَضۡرِبۡنَ بِاَرۡجُلِهِنَّ لِیُعۡلَمَ مَا یُخۡفِیۡنَ مِنۡ زِیۡنَتِهِنَّ ؕ وَ تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰهِ جَمِیۡعًا اَیُّهَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۳۱﴾
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
এখানে ‘যিনাত’, ‘যুউবিহিন্না’, ‘খুমুরুন’ আরবী শব্দ তিনটি লক্ষ্য করুন।
“তাঁদের সাজ-সজ্জা না দেখায় যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া”। এখানে বলা হয়েছে, নিজে থেকে ইচ্ছায় প্রকাশ করে না বরং প্রকাশিত হয়ে যায় যা সবার কাছে লুকানো যায় না-এটা বাইরের পরিধান বুঝায় কারন ‘যিনাত’ শব্দ ব্যবহার হয় বাইরের সৌন্দর্য (কাপড়) বুঝাতে। যেমন সূরা আরাফে (৩১ নং আয়াত) মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বনী আদম! প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা নিজ নিজ সুন্দর সাজে সজ্জিত হও.
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ মহিলা উলঙ্গ অবস্থায় কা’বার তাওয়াফ করত আর বলত, কে আমাকে তাওয়াফের কাপড় ধার দেবে? যা তার লজ্জাস্থানে রাখবে। আরও বলতঃ আজ হয় কিছু অংশ প্রকাশ হয়ে পড়বে নয়ত পুরোটাই। আর যা আজ প্রকাশিত হবে তা আর হালাল করব না। তখন এ আয়াত নাযিল হয়- “তোমরা তোমাদের মাসজিদ তথা ইবাদাতের স্থানে সুন্দর পোষাক পরবে।” [মুসলিমঃ ৩০২৮]
جيوب শব্দটি جيب এর বহুবচন- এর অর্থ জামার কলার। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]
“তারা যেন তাদের সাজসজ্জা (আভরণ) প্রকাশ না করে”, এখানে ‘যুউবিহিন্না’ বলতে ভিতরের সৌন্দর্যের কথা বলা হয়েছে যা মুখমণ্ডল সহ গলা, কান ইত্যাদি”। (আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা:)
উক্ত আয়াতে ‘খুমুরুন’( خُمُر শব্দটি خمار এর বহুবচন) যা খিমার শব্দের বহুবচন। খিমার বলতে সেই কাপড় বুঝায় যা দিয়ে নারী তার মাথা, বক্ষ ও গলা ঢেকে রাখতে পারে।[কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]
মু’মিন মহিলারা কুরআনের এ হুকুমটি শোনার সাথে সাথে যেভাবে একে কার্যকর করে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার প্রশংসা করে বলেনঃ সূরা নূর নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে (وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ) বাক্যাংশ শোনার পর তারা নিজের কোমরে বাঁধা কাপড় খুলে নিয়ে আবার অনেকে চাদর তুলে নিয়ে সংগে সংগেই ওড়না বানিয়ে ফেলল এবং তা দিয়ে শরীর ঢেকে ফেললো৷ [বুখারীঃ ৪৭৫৯]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, যখন (وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ) এ আয়াত নাযিল হলো, তখন তাদের মাথা এমনভাবে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলল মনে হয় যেন তাদের মাথার উপর কাক রয়েছে। [আবু দাউদঃ ৪১০১]
হে মুমিনগণ! তোমাদের দাসদাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি তারা যেন তিন সময়ে তোমাদের কাছে অনুমতি গ্রহণ করে, ফজরের নামাযের পূর্বে, দুপুরে যখন তোমরা বস্ত্র খুলে রাখ এবং এশার নামাযের পর। এই তিন সময় হলো তোমাদের খোলামেলা থাকার সময়। এ সময়ের পর তোমাদের ও তাদের জন্যে কোন দোষ নেই। তোমাদের একে অপরের কাছে তো যাতায়াত করতেই হয়, এমনি ভাবে আল্লাহ তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ বিবৃত করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তোমাদের সন্তান-সন্ততিরা যখন বায়োপ্রাপ্ত হয়, তারাও যেন তাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় অনুমতি চায়। এমনিভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।সূরা আন-নূর: ৫৮-৫৯
রাসূল সা: বলেছেন: যে নারী আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান রাখে, তার জন্য এ পরিমানের বেশী খোলা রাখা জায়েয নয় একথা বলে তিনি তাঁর কব্জীর উপর এমনভাবে হাত রাখলেন যে, কব্জীর মধ্যস্থল এবং তাঁর হাত রাখার স্থানের মধ্যে মাত্র একমুষ্ঠী পরিমান জায়গা অবশিষ্ট রইল।আবু দাউদ
রাসূল সা: আরো বলেছেন, নিজের স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া বাকী সবার কাছ থেকে সতরের হেফাজত করো। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেন, আর যখন আমরা একাকী থাকি? রাসূল সা: জবাব দেন, এ অবস্থায় আল্লাহকে লজ্জা করা উচিত, তিনিই এর বেশী হকদার।তিরমিযী: ২৭০৬, আবু দাউদ
তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে(১) তোমাদের মা(২), মেয়ে(৩), বোন(৪), ফুফু(৫) খালা(৬), ভাইয়ের মেয়ে(৭), বোনের মেয়ে(৮), দুধমা(৯), দুধবোন(১০), শাশুড়ী ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সংগত হয়েছ তার আগের স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত মেয়ে, যারা তোমাদের অভিভাবকত্ব আছে(১১), তবে যদি তাদের সাথে সঙ্গত না হয়ে থাক, তাতে তোমাদের কোন অপরাধ নেই। আর তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত ছেলের স্ত্রী(১২) ও দুই বোনকে একত্র করা, আগে যা হয়েছে, হয়েছে(১৩)। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সূরা নিসাঃ ২৩
প্রশ্ন
একজন বোন ও ভাইয়ের মাঝে সতরের সীমানা কী? একজন মেয়ে ও তার মা কিংবা বোনের মাঝে সতরের সীমানা কী?
উত্তর আলহামদু লিল্লাহ।.
এক: মাহরাম পুরুষদের সামনে একজন নারীর সতর হচ্ছে তার গোটা দেহ; কেবল চেহারা, চুল, ঘাড়, হাতের বাহুদ্বয় ও পদযুগল যা সচরাচর প্রকাশিত হয়ে পড়ে সেগুলো ব্যতিত। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “তারা যেন তাদের স্বামীগণ, পিতাগণ, স্বামীর পিতাগণ, ছেলেগণ, স্বামীর ছেলেগণ, ভাইগণ, ভাইয়ের ছেলেগণ, বোনের ছেলেগণ, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাস, যৌনকামনা রহিত অধীনস্থ পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ শিশুরা ছাড়া কারো নিকট নিজেদের সাজসজ্জা (সাজসজ্জার অঙ্গগুলো) প্রকাশ না করে।”[সূরা নূর, আয়াত: ৩১]
অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা নারীর জন্য তার স্বামীর সামনে ও তার মাহরামদের সামনে নিজের সাজসজ্জা প্রদর্শন জায়েয করেছেন। এখানে সাজসজ্জা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে— সাজসজ্জার স্থানগুলো। যেমন আংটি পরার স্থানের মধ্যে পড়বে হাতের কব্জি। চুড়ি পরার স্থানের মধ্যে পড়বে হাতের বাহু। কানফুল পরার স্থানের মধ্যে পড়বে কান। গলার হার পরার স্থানের মধ্যে পড়বে গলা, বুক। নূপুর পরার স্থানের মধ্যে পড়বে পায়ের গোছা।
আবু বকর আল-জাস্সাস তার তাফসিরে বলেন: “এ বাণীর বাহ্যিক মর্মের দাবী হচ্ছে সাজসজ্জা স্বামীর জন্য এবং পিতাসহ অন্য যাদেরকে স্বামীর সাথে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের সামনে প্রকাশ করা বৈধ। জ্ঞাতব্য, সাজসজ্জা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে— সাজসজ্জার স্থান। আর সে স্থানগুলো হচ্ছে চেহারা, হাত ও হাতের বাহু…। তাই এই বাণীর দাবী হচ্ছে আয়াতে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের জন্য উল্লেখিত স্থানগুলো দেখা বৈধ। এগুলো হচ্ছে আভ্যন্তরীণ সাজের স্থান। কেননা আয়াতের প্রথমাংশে বাহ্যিক সাজসজ্জা গাইরে-মাহরাম ব্যক্তিদের জন্য দেখা জায়েয করা হয়েছে। আর স্বামী ও মাহরাম ব্যক্তিবর্গের জন্য আভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা দেখাকে জায়েয করা হয়েছে। ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও যুবাইর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে: কানের দুল, গলার হার, চুড়ি ও নূপুর…।
যেহেতু আয়াতে স্বামী ও উল্লেখিত ব্যক্তিদের জন্য বিধানকে সমান করা হয়েছে তাই আয়াতের সামগ্রিকতার দাবী হচ্ছে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের জন্য এ সকল সাজসজ্জার স্থানের দিকে তাকানো বৈধ; যেমনিভাবে স্বামীর জন্য বৈধ।”[সমাপ্ত]
বাগাভী (রহঃ) বলেন: “নিজেদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে” অর্থাৎ গাইরে মাহরামের সামনে প্রকাশ না করে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আভ্যন্তরীণ সাজ। সাজ দুই প্রকার: আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। আভ্যন্তরীণ সাজ হল: নূপুর, পায়ের মেহেদি, হাতের কব্জিতে চুড়ি, কানের দুল ও গলার হার। তাই নারীর জন্য এগুলো প্রকাশ করা নাজায়েয এবং গাইরে মাহরামের জন্য এগুলো দেখা নাজায়েয। আর এখানে সাজ দ্বারা উদ্দেশ্য সাজের স্থান।”[সমাপ্ত]
কাশ্শাফুল ক্বিনা গ্রন্থে (৫/১১) বলেন: “পুরুষের জন্য তার মাহরাম নারীদের চেহারা, ঘাড়, হাত, পা, মাথা, পায়ের গোছা দেখা জায়েয। এই বর্ণনায় ক্বাযী বলেন: সচরাচর যা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, যেমন- মাথা, কনুই পর্যন্ত হাত দেখা বৈধ।”[সমাপ্ত]
এই মাহরামগণ নৈকট্যের দিক ও ফিতনা থেকে নিরাপদ হওয়ার দিকের বিবেচনা থেকে একই স্তরে নয়। তাই একজন নারী তার বাবার সামনে যা কিছু প্রকাশ করবেন তার স্বামীর ছেলের সামনে সেসব কিছু প্রকাশ করবেন না। কুরতুবী বলেন: “আল্লাহ্ তাআলা যখন স্বামীদের কথা উল্লেখ করলেন তখন তিনি তাদেরকে দিয়ে আলোচনা শুরু করেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে মাহরাম পুরুষদের কথা উল্লেখ করেন। সাজসজ্জা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে উভয় শ্রেণীর জন্য সমান বিধান দিয়েছেন। কিন্তু মানুষের মনে যা কিছুর উদ্রেক হয় সে বিবেচনা থেকে মাহরামদের মর্যাদার ভেদ রয়েছে। কোন সন্দেহ নাই যে, পিতার সামনে, ভাইয়ের সামনে নারীর কোন কিছু প্রকাশ করা স্বামীর ছেলের সামনে প্রকাশ করার চেয়ে অধিক নিরাপদ। অনুরূপভাবে মাহরামদের সামনে কোন অঙ্গটি প্রকাশ করা হচ্ছে সেটার বিবেচনা থেকেও স্তরভেদ রয়েছে। তাই পিতার সামনে এমন কোন অঙ্গ প্রকাশ করা বৈধ; যা স্বামীর ছেলের সামনে প্রকাশ করা বৈধ নয়।”[সমাপ্ত]
দুই:
ফিকাহবিদ আলেমদের নিকট স্বতঃসিদ্ধ এক নারীর কাছে অপর নারীর গোপন অঙ্গ হচ্ছে নাভী থেকে হাঁটুর মধ্যস্থিত স্থান; চাই সেই নারী মা হোক, বোন হোক, কিংবা অনাত্মীয় কোন নারী হোক। তাই কোন নারীর জন্য তার বোনের নাভী থেকে হাঁটুর মধ্যস্থিত স্থানটুকু দেখা বৈধ নয়; একান্ত জরুরী অবস্থা কিংবা চিকিৎসার মত তীব্র প্রয়োজন ছাড়া।
তার মানে এ নয় যে, একজন নারী নারীদের মাঝে তার নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত বাদ দিয়ে সমস্ত শরীর উন্মুক্ত করে বসে থাকবেন। এমন কাজ বেহায়া ও নির্লজ্জ কিংবা অশালীন ফাসেক মহিলারা ছাড়া আর কেউ করে না। ফিকাহবিদ আলেমদের উক্তি “গোপন অঙ্গ হচ্ছে: নাভী ও হাঁটুর মধ্যবর্তী স্থান” কে ভুলভাবে বুঝা উচিত হবে না। তাদের এ কথার মধ্যে এমন কোন কিছু নাই যে, নারীর পোশাক এতটুকুন; যে পোশাক নারী সবসময় গায়ে পরবেন এবং যে পোশাক পরে আর বোন ও বান্ধবীদের সামনে আসবেন। কোন বিবেকবান মানুষ এমন অভিমতে সায় দিবেন না এবং স্বাভাবিক মানব প্রবৃত্তিও এর প্রতি আহ্বান করে না।
বরং নিজের বোনদের ও অন্য নারীদের সামনে তার পোশাক পরিপূর্ণ শরীর ঢাকে এমন হওয়া বাঞ্চনীয়; যা নারীর লজ্জাশীলতা ও গাম্ভীর্যের পরিচায়ক হবে। কাজের সময় ও কোন সেবা দেয়ার সময় যতটুকু প্রকাশ হয়ে পড়ে ততটুকুর বেশি প্রকাশ করবে না; যেমন- মাথা, গলা, দুই হাতের বাহু, দুই পায়ের পাতা; ঠিক ইতিপূর্বে মাহরামদের প্রসঙ্গে আমরা যেভাবে উল্লেখ করেছি।
একজন নারী তার মাহরাম পুরুষদের সামনে ও অন্য নারীদের সামনে কি কি প্রকাশ করা জায়েয এ ব্যাপারে ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া আমরা ইতিপূর্বে 34745 নং প্রশ্নোত্তরে উল্লেখ করেছি। আমরা আল্লাহ্র কাছে আমাদের জন্য ও আপনার জন্য তাওফিক প্রার্থনা করছি। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সন্তানদের সামনে একই ধরনের শর্ট পোশাক পরে থাকেন – এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কি?
উত্তর
আলহামদু লিল্লাহ।. ফতোয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন:
সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।
ইসলামের প্রথম যুগের নারীগণ আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণের বরকতে পুতঃপবিত্রতা, লজ্জাশীলতা ও শালীনতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিলেন। সে সময়ে নারীগণ পরিপূর্ণ শরীর আচ্ছাদনকারী পোশাক পরতেন। নারীদের সামনে অথবা মোহরেম পুরুষের মধ্যে অবস্থানকালে তারা খোলামেলা চলতেন বা অনাবৃত থাকতেন বলে জানা যায় না। শতাব্দীর পর শতাব্দী, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, এমনকি নিকট অতীত পর্যন্ত মুসলিম নারীসমাজ এভাবেই চলে এসেছেন। এরপর নানা কারণে অনেক নারীর মধ্যে পোশাক ও চরিত্রের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। সে বিষয়ে বিশদ আলোচনার স্থান এটি নয়।
নারীর প্রতি নারীর দৃষ্টি ও মেয়েদের উপর আবশ্যকীয় পোশাকের ব্যাপারে প্রচুর ফতোয়া আসার পরিপ্রেক্ষিতে ফতোয়া কমিটি মুসলিম নারীকুলকে এই মর্মে অবহিত করছে যে, লজ্জার ভূষণে নিজেকে অলংকৃত করা নারীর উপর ফরজ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লজ্জাকে ঈমানের শাখা আখ্যায়িত করেছেন। শরিয়তের বিধান ও সামাজিক প্রথাগত লজ্জা হচ্ছে- নারী নিজেকে ঢেকে রাখবে, শালীনতা বজায় রেখে চলবে এবং এমন চরিত্র লালন করবে যা তাকে ফেতনা ও সন্দেহ-সংশয়ের উৎস থেকে দূরে রাখবে। কুরআনের সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণ করে- কোন নারী অপর নারীর সামনে তার দেহের ততটুকু অংশ খোলা রাখতে পারবে যতটুকু মোহরেমদের সামনে খোলা রাখা জায়েয। অর্থাৎ সাধারণতঃ বাড়িঘরে থাকাকালে ও গৃহস্থালির কাজ করতে গিয়ে যতটুকু উন্মুক্ত হয়ে পড়ে ততটুকু। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত বাঁদি, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।”[সূরা নূর, আয়াত: ৩১]
এই হলো কুরআনের সুস্পষ্ট দলিল। সুন্নাহও এটাই প্রমাণ করে। এর উপরেই রাসূলের স্ত্রীগণ, সাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীগণ ও তাঁদেরকে সঠিকভাবে অনুসরণকারী মুমিন নারীগণ আজ পর্যন্ত চলে আসছেন। আয়াতে যাদের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রকাশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে সেটা হচ্ছে- সাধারণতঃ ঘরে থাকাকালে, গৃহস্থালির কাজ করতে গিয়ে যা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং যা ঢেকে রাখা কঠিন। যেমন- মাথা, হস্তদ্বয়, ঘাড় ইত্যাদি। এর চেয়ে বেশি কিছু উন্মুক্ত রাখার পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর কোন দলিল নেই। বরং এর চেয়ে বেশি উন্মুক্ত করলে নারীর প্রতি নারী আসক্ত হওয়ার দুয়ার খুলে যাবে; বাস্তবে এ ধরনের আসক্তির অস্তিত্ব রয়েছে এবং এ ধরনের আচরণ অন্য নারীদের জন্য খারাপ উদাহরণ তৈরী করবে। উপরন্তু এটি অমুসলিম নারী, বেহায়া ও বেশ্যাদের পোশাক অনুকরণের নামান্তর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়কে অনুসরণ করে সে তাদের দলভুক্ত।”[ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ] সহিহ মুসলিমে (২০৭৭) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার গায়ে কুসুমের রঙে (লাল রং) রঞ্জিত দুটি কাপড় দেখে বললেন: এগুলো কাফেরদের পোশাক। তুমি এগুলো পরবে না।”
সহিহ মুসলিমে (২১২৮) আরো এসেছে- দুই শ্রেণীর জাহান্নামীকে আমি দেখি নাই। এক শ্রেণীর মানুষ তাদের কাছে গুরুর লেজের মত চাবুক থাকবে যা দিয়ে তারা মানুষকে প্রহার করবে। আর এমন নারী যারা পোশাক পরা সত্ত্বেও উলঙ্গ, নিজে নষ্টা, অন্যকেও নষ্টকারিনী। তাদের মাথা উটের বাঁকা কুঁজের মত। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। যদিও জান্নাতের ঘ্রাণ এত এত দূর থেকে পাওয়া যাবে।” হাদিসে ‘এমন নারী যারা পোশাক পরা সত্ত্বেও উলঙ্গ’ এ কথার অর্থ হচ্ছে- কোন নারী এমন কোন পোশাক পরা যে পোশাক দেহকে আচ্ছাদিত করে না। তাই সে যদিও পোশাক পরেছে কিন্তু বাস্তবে সে উলঙ্গই থেকে গেছে। যেমন- এমন স্বচ্ছ পোশাক পরা যাতে তার চামড়া পর্যন্ত দেখা যায়। অথবা এমন পোশাক পরা যা তার শরীরের ভাঁজগুলো পর্যন্ত ফুটিয়ে তোলে। অথবা এত শর্ট-পোশাক পরা যা তার শরীরের সবটুকু অংশ আবৃত করে না।
তাই মুসলিম নারীর কর্তব্য হলো- মুমিনদের মাতৃবর্গ, সাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীগণ ও তাঁদেরকে সঠিকভাবে অনুসরণকারী নারীগণের আদর্শকে আঁকড়ে ধরা। পর্দা ও শালীনতা রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা। এটি তাদেরকে ফেতনা থেকে দূরে রাখবে, মনের মধ্যে খারাপ কামনার উদ্রেক থেকে হেফাযত করবে।
অনুরূপভাবে মুমিন নারীদের উপর ফরজ হচ্ছে- আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যেসব পোশাক হারাম করেছেন, যেগুলো অমুসলিম নারীদের পোশাক বা চরিত্রহীন নারীদের পোশাকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ সেগুলো পরিহার করা। আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর নিকট থেকে সওয়াব পাওয়ার আশা এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে এসব পোশাক বর্জন করতে হবে।
এছাড়া প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ তার অধীনস্থ নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা। অধীনস্থ নারীদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নিষিদ্ধ, অশ্লীল, সংকীর্ণ ও উত্তেজক পোশাক পরার সুযোগ না দেয়া। তার জেনে রাখা উচিত, কেয়ামতের দিন প্রত্যেক কর্তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।
আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করছি তিনি যেন মুসলমানদের অবস্থা সংশোধন করে দেন। তাদের সকলকে যেন সঠিক পথে পরিচালিত করেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, নিকটবর্তী ও দুআকবুলকারী। আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের উপর আল্লাহ রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। সমাপ্ত। ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সংকলন (১৭/২৯০)
ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সংকলনে (১৭/২৯৭) এসেছে-
সন্তানদের সামনে ততটুকু খোলা যাবে প্রথাগতভাবে যা খোলা রাখা হয়। যেমন- চেহারা, দুই হাতের কব্জি, দুই বাহু, দুই পা ইত্যাদি। সমাপ্ত। আল্লাহই ভাল জানেন।
২য় পর্ব পড়ার জন্য—
পর্দা- মহান রবের আনুগত্যের একটি রুপায়ন: ২য় পর্ব (পর্দা ও নিকাব)