দু’আ
দু’আ শব্দের অর্থ আহ্বান, প্রার্থনা। শরীয়তের পরিভাষায় দু’আ বলে কল্যাণ ও উপকার লাভের উদ্দেশ্যে এবং ক্ষতি ও অপকার রোধকল্পে মহান আল্লাহকে ডাকা এবং তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করে (তখন তুমি বল,) আমি তো কাছেই আছি। যখন কোন প্রার্থনাকারী আমার কাছে প্রার্থনা জানায়, তখন আমি তার প্রার্থনা মঞ্জর করি।”সূরা বাক্বারাহঃ ১৮৬
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দু’আই হলো ইবাদত। অতঃপর তিলাওয়াত করেন (অনুবাদঃ) ‘‘এবং তোমার প্রভু বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো। সূরা মুমিনঃ৬০
“নিশ্চয় তোমাদের প্রভু লজ্জাশীল অনুগ্রহপরায়ণ, বান্দা যখন তার দিকে দুই হাত তোলে, তখন তা শূন্য ও নিরাশভাবে ফিরিয়ে দিতে বান্দা থেকে লজ্জা করেন।” (আবু দাউদ ২/৭৮; তিরমিযী ৫/৫৫৭)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিকট দু’আ করে না, আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। তিরমিযী ৩৩৭৩, সহীহাহ ২৬৫৪। তাহকীক আলবানীঃ হাসান।
প্রিয় নবী সা বলেন, “কোন মুসলিম যখন আল্লাহর নিকট এমন দুআ করে, যাতে পাপ ও আত্মীয়তারবন্ধন ছিন্নতা নেই, তখন আল্লাহ তাকে তিনটের একটা দান করে থাকেন; সত্বর তার দুআ মঞ্জুর করা হয় অথবা পরকালের জন্য তা জমা রাখা হয় অথবা অনুরূপ কোন অকল্যাণকে তার জীবন হতে দূর করা হয়।” লোকেরা বলল, তাহলে আমরা অধিক অধিক দুআ করব।’ তিনি বললেন, “আল্লাহও অধিক দানশীল।” (আহমদ ৩/১৮, হাকেম ১৪৯৩ যদুল মাসীর ১/১৯০)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ ‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট চারটি জিনিস থেকে আশ্রয় চাইঃ এমন জ্ঞান থেকে যা উপকারে আসে না, এমন অন্তর থেকে যা ভীত-বিহবল হয় না, এমন আত্মা থেকে যা তৃপ্ত হয় না এবং এমন দু’আ থেকে যা কবুল করা হয় না’।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الأَرْبَعِ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ وَمِنْ دُعَاءٍ لاَ يُسْمَعُ ” .
নাসায়ী ৫৫৩৬, ৫৫৩৭, আবু দাউদ ১৫৪৮। তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।
পরিবার
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘর ও পরিবারকে তাঁর অন্যতম দান হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
“তোমাদের জন্য তোমাদের ঘরগুলোকে বানিয়েছেন শান্তির আবাস।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৮০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যখন কোনো পরিবারের কল্যাণ চান, তখন তাতে মমতা ও ভালোবাসা দান করেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৫৯৩)
পরিবার সম্পর্কে মহান আল্লাহ আল কুর’আনে কি নির্দেশিকা জানিয়েছেন ও তাঁর রাসূল সা কে দিয়ে কি শিক্ষা দিয়েছেন তা জেনে নেয়া প্রয়োজন।
মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قُوْا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيْكُمْ نَاراً وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلاَئِكَةٌ غِلاَظٌ شِدَادٌ لاَ يَعْصُوْنَ اللهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও স্বীয় পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) হ’তে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। সেখানে অত্যন্ত কর্কশ, রূঢ় ও নির্মম স্বভাবের ফেরেশতা নিয়োজিত থাকবে, যারা কখনই আল্লাহর কথা অমান্য করে না এবং নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে’ (তাহরীম ৬)।
তাহলে নিজেকে যেমন আগুন থেকে রক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে তেমনি পরিবারকেও বাঁচাতে সাহায্য করতে হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম দ্বীনের দাওয়াতের কাজ শুরু করেছেন নিজ পরিবার ও আত্মীয়দের থেকে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।’ (সুরা : আশ-শুয়ারা, আয়াত : ২১৪)
তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গের নিকট যাও। তাদের মধ্যে বসবাস কর, তাদের (দ্বীনি) জ্ঞান শিক্ষা দাও এবং সেই অনুযায়ী আমল করার জন্যে তাদের আদেশ কর। (সহীহ্ বুখারী )
– মানুষ যখন মরে যায় তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি আমলের উপকার সে কেয়ামত পর্যন্ত পেতে থাকে। (১) সদকায়ে জারিয়া (২) এমন জ্ঞান যা সে বিতরণ করেছে এবং (৩) নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করবে। ( মুসলিম, মিশকাত )
তাই পরিবার গঠন ও সন্তান গঠন খুবই জরুরী। সামগ্রিক প্রচেষ্টার সাথে সাথে বেশী বেশী মহান আল্লাহর দরবারে দু’আ করতে হবে পরিবারের হেদায়েতের জন্য।
মহান আল্লাহ বলেছেন-
– আর সে সব লোক যারা আল্লাহ্র উপর ঈমান এনেছে অতঃপর তাদের সন্তানগণও ঈমানের সাথে তাদের পথ অনুসরণ করেছে, তাদের সাথে তাদের সন্তানদেরকে আমি মিলিত করে দেবো। আর আমি তাদের কোন আমল বিনষ্ট করব না। প্রতিটি লোক যা কিছু আমল করে তা আমার নিকট মায়াবদ্ধ থাকে। (সুরা আত্তুরঃ ২১ )
পরিবারকে নিয়ে জান্নাতে একসাথে থাকার তীব্র আকাংক্ষা রাখা জরুরী। আবার সচেতন থাকতে হবে পরিবারের সদস্যদের ব্যপারে, কারন হক্ব আদায় লংঘন হলে, হাসরের মাঠে কেউ কারো উপকার করতে পারবে না, বরং নিজেকে বাঁচানোর জন্য পরিবারকে দূষারোপ ও বিনিময় নিতে কুন্ঠাবোধ করবে না। তাই সময় থাকতে সচেতন হয়ে কাজ করা প্রয়োজন।
– অথচ তারা একজন আরেকজনকে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবে, (সেদিন) অপরাধী ব্যক্তি আযাব থেকে (নিজেকে) বাঁচাতে মুক্তিপণ হিসাবে তার পুত্র সন্তানদের দিতে পারলেও তা দিতে চাবে। (দিতে চাবে ) নিজের স্ত্রী এবং নিজের ভাইকেও। এবং নিজের পরিবারভুক্ত এমন আপনজনদেরও, যারা তাকে (জীবনভর ) আশ্রয় দিয়েছিলে। ( সুরা আল মায়ারিজঃ ১১-১৩ )
– নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার প্রতিপালকের, তোমার শরীরের, তোমার সন্তানের হক রয়েছে, অতএব হকদারকে তার হক প্রদান কর। ( সাহীহ্ বুখারী )
– আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) নবী করিম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা নিজেদের সন্তানদের সাথে কোমল ব্যবহার করো এবং তাদের উত্তম শিক্ষা ও ট্রেনিং প্রদান করো। ( ইবনে মাজাহ্ )
– হে মুসলিম জনতা ! স্ত্রীদের অধিকার সম্পর্কে তোমরা আল্লাহ্কে অবশ্যই ভয় করতে থাকবে। মনে রেখো, তোমরা তাদেরকে আল্লাহ্র আমানত হিসাবে পেয়েছে এবং আল্লাহ্র কালামের সাহায্য তাদের ভোগ করাকে নিজের জন্য হালাল করে নিয়েছে। ( আবু দাঊদ, সাহীহ্ মুসলিম )
– আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ্ যখন তার কোন বান্দাকে লোকদের উপর কর্তৃত্ব দান করেন, কিয়ামতের দিন তিনি তার সেই বান্দার কাছে থেকে তার অধীনস্থ লোকদের সম্পর্ক অবশ্যই হিসাব গ্রহণ করবেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন সে তার অধীনস্থ লোকদের উপর আল্লাহ্ দ্বীন বাস্তবায়ন করেছে, নাকি তা বরবাদ করেছে? এমনকি প্রত্যেককে তার নিজস্ব পরিবার পরিজন সম্পর্ক বিশেষভাবে প্রশ্ন করা হবে। ( মুসনাদে আহমেদ )
‘সাবধান তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। সুতরাং শাসক জনগণের দায়িত্বশীল। ক্বিয়ামতের দিন তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, তাকে পরিবারের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর সংসার এবং সন্তানের উপর দায়িত্বশীল। ক্বিয়ামতের দিন তাকে এ দায়িতব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এমনকি দাস-দাসীও তার মালিকের সম্পদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। সেইদিন তাকেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। অতএব মনে রেখো, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর তোমাদের প্রত্যেককেই ক্বিয়ামতের দিন এই দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে’।বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫।
প্রয়োজনীয় কুর’আনীক দু’আ(পরিবারের জন্য)
পরিবার ও সন্তানের জন্য দু’আ যা মহান আল্লাহ শিখিয়ে দিয়েছেন তা উল্লেখ করা হলো।
رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন৷ সূরা বনী ইসরাইল আয়াতঃ ২৪
رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً ۖ إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তুমি তোমার নিকট হতে সৎ বংশধর দান কর। নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা শ্রবনকারী। সূরা আলে ইমরানঃ৩৮
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
“ হে আমাদের রব ! আমাদের নিজেদের স্ত্রীদের/ স্বামী ও নিজেদের সন্তানদেরকে নয়ন শীতলকারী বানাও এবং আমাদের করে দাও মুত্তাকীদের ইমাম ৷সূরা ফুরকানঃ৭৪
رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَىٰ وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي ۖ إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“হে আমার রব, তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে যেসব নিয়ামত দান করেছো আমাকে তার শুকরিয়া আদায় করার তাওফীক দাও ৷ আর এমন সৎ কাজ করার তাওফীক দাও যা তুমি পছন্দ করো ৷ আমার সন্তানদেরকে সৎ বানিয়ে আমাকে সুখ দাও ৷ আমি তোমার কাছে তাওবা করছি ৷ আমি নির্দেশের অনুগত (মুসলিম) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ৷” সূরা আহকাফঃ১৫
رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِن ذُرِّيَّتِي ۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ
“হে আমার রব! আমাকে সালাত কায়েমকারী কর এবং আমার বংশধরদের মধ্য হতেও। হে আমার প্রতিপালক! আমার প্রার্থনা কবুল কর। সূরা ইবরাহীমঃ৪০
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ
হে পরওয়াদিগার! যেদিন হিসেব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সমস্ত মুমিনদেরকে মাফ করে দিয়ো। সূরা ইবরাহীমঃ৪১
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا ۖ إِنَّكَ أَنتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
হে আমাদের রব!আমাদের দু’জনকে তোমার মুসলিম (নির্দেশের অনুগত)বানিয়ে দাও ৷ আমাদের বংশ থেকে এমন একটি জাতির সৃষ্টি করো যে হবে তোমার মুসলিম ৷ তোমার ইবাদাতের পদ্ধতি আমাদের বলে দাও এবং আমাদের ভুলত্রুটি মাফ করে দাও ৷ তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী ৷সূরা আল বাকারাঃ১২৮