সূরা কাহফ: ৬ষ্ঠ রুকুঃ ( ৪৫-৪৯ আয়াত)

সূরা কাহফ:

৬ষ্ঠ রুকুঃ ( ৪৫-৪৯ আয়াত)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

১৮:৪৫ وَ اضۡرِبۡ لَهُمۡ مَّثَلَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا کَمَآءٍ اَنۡزَلۡنٰهُ مِنَ السَّمَآءِ فَاخۡتَلَطَ بِهٖ نَبَاتُ الۡاَرۡضِ فَاَصۡبَحَ هَشِیۡمًا تَذۡرُوۡهُ الرِّیٰحُ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ مُّقۡتَدِرًا

৪৫. আর আপনি তাদের কাছে পেশ করুন উপমা দুনিয়ার জীবনের: এটা পানির ন্যায় যা আমরা বর্ষণ করি আকাশ থেকে, যা দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদগত হয়, তারপর তা বিশুষ্ক হয়ে এমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় যে, বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান

কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ দুনিয়ার জীবনকে আকাশ থেকে নাযিল হওয়া পানির সাথে তুলনা করেছেন। দুনিয়ার জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বের উদাহরণ হলো আকাশ থেকে বর্ষিত পানির মত। যা প্রথমে যমীনে পতিত হওয়ার সাথে সাথে যমীনে অবস্থিত উদ্ভিদরাজিতে প্রাণের উন্মেষ ঘটে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে পানি পুরিয়ে গেলে, পানির কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে গেলে আবার সে প্রাণের নিঃশেষ ঘটে। দুনিয়ার জীবনও ঠিক তদ্রুপ; এখানে আসার পর জীবনের বিভিন্ন অংশের প্রাচুর্যে মানুষ মোহান্ধ হয়ে আখেরাতকে ভুলে বসে থাকে। কিন্তু অচিরেই তার জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে সে আবার হতাশ হয়ে পড়ে।

এ কথাটি মহান আল্লাহ কুরআনের অন্যত্র এভাবে বলেছেনঃ

“বস্তুত পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত এরূপ, যেমন আমি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি যা দ্বারা ভূমিজ উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদগত হয়, যা থেকে মানুষ ও জীব-জন্তু খেয়ে থাকে। তারপর যখন ভূমি তার শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয় এবং তার অধিকারীগণ মনে করে ওটা তাদের আয়ত্তাধীন, তখন দিনে বা রাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে ও আমি ওটা এমনভাবে নির্মূল করে দেই, যেন গতকালও ওটার অস্তিত্ব ছিল না। এভাবে আমি নিদর্শনাবলী বিশদভাবে বর্ণনা করি চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।” [সূরা ইউনুস: ২৪]

আরো বলেছেনঃ “আপনি কি দেখেন না, আল্লাহ্ আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন, তারপর তা ভূমিতে নির্ঝররূপে প্রবাহিত করেন এবং তা দ্বারা বিবিধ বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন, তারপর তা শুকিয়ে যায়। ফলে তোমরা তা পীত বর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তিনি ওটাকে খড়-কুটায় পরিণত করেন? এতে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য।”[সূরা আয-যুমার: ২১]

আরও বলেছেনঃ “তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন তো খেল-তামাশা, জাঁকজমক, পারস্পরিক শ্লাঘা, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়। এর উপমা বৃষ্টি, যা দ্বারা উৎপন্ন শস্য-সম্ভার কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, তারপর সেগুলো শুকিয়ে যায়, ফলে আপনি ওগুলো পীতবর্ণ দেখতে পান, অবশেষে সেগুলো খড়-কুটায় পরিণত হয়। পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সস্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার সামগ্রী ছাড়া কিছু নয়।” [সূরা আল-হাদীদ: ২০]

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বলেছেনঃ “দুনিয়া হলো সুমিষ্ট সবুজ-শ্যামল মনোমুগ্ধকর। সুতরাং তোমরা দুনিয়া থেকে বেঁচে থাক আর মহিলাদের থেকে নিরাপদ থাক।” [মুসলিম: ২৭৪২]

উদাহরন থেকে যা বুঝা যায়–জীবন ও শস্য ক্ষেত্র

ক্ষনস্থায়ী

যতক্ষন আছে ততক্ষন সুন্দর

যখন শেষ তখন মূল্যহীন

পানি জীবনের জন্য প্রয়োজন তবে অতিরিক্ত পানি যেমন জীবনের জন্য ক্ষতিকর তেমনি দুনিয়ার জীবনে বেশী ডুবে থাকাও ক্ষতিকর।

১৮:৪৬ اَلۡمَالُ وَ الۡبَنُوۡنَ زِیۡنَۃُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ الۡبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ خَیۡرٌ عِنۡدَ رَبِّکَ ثَوَابًا وَّ خَیۡرٌ اَمَلًا

৪৬. ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা; আর স্থায়ী সৎকাজ আপনার রব-এর কাছে পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং কাংখিত হিসেবেও উৎকৃষ্ট।

অর্থবৈভব ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা-আভা। সঠিক ও যথাযথ এগুলোর ব্যবহার হলে পরকালে কল্যাণ ও পুরস্কার লাভ হবে। না হয় এগুলোই ডেকে নিয়ে আসবে চূড়ান্ত বিপদ।

অর্থ বা টাকা সকল বয়সেই প্রয়োজন কিন্তু সন্তান একটি বয়সে এসে প্রয়োজন। তাই সম্পদের কথা আগে এসেছে।

যারা পার্থিব সম্পদ ও সৌন্দর্য হারাম মনে করে, তাদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তাদের জিজ্ঞাসা করো, ‘আল্লাহ বান্দাদের জন্য যে সৌন্দর্য ও পবিত্র রিজিক সৃষ্টি করেছেন, তা হারাম করল কে?’ বলে দাও, ‘এগুলো ঈমানদারদের পার্থিব জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এবং বিশেষভাবে পরকালের জন্য নির্দিষ্ট। ’ এভাবে আমি জ্ঞানবানদের জন্য আমার আয়াতগুলো সবিস্তারে উপস্থাপন করি। ” (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩২)

ইসলামে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ও উপার্জন বাদ দিয়ে শুধু পরকাল নিয়ে পড়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বরং কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন, তা দিয়ে আখিরাতের আবাস সন্ধান করো। কিন্তু দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না…। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭৭)

ইহকাল ও পরকাল দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতে দুনিয়া ত্যাগ করতে বলা হয়নি, বরং পরকালকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে। দুনিয়ায় সম্পদ উপার্জন ও সন্তান জন্ম দেওয়া নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু এসবের জন্য যেন পরকালের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

আর আল্লাহ তোমাদের ঘরসমূহকে করেছেন তোমাদের জন্য আবাসস্থল এবং তিনি তোমাদের জন্য পশুর চামড়ার ঘর তাঁবুর ব্যবস্থা করেছেন, তোমরা সেটাকে সহজ মনে করে থাক তোমাদের ভ্রমণকালে এবং অবস্থানকালে। আর (ব্যবস্থা করেছেন) তাদের পশম, লোম ও চুল থেকে কিছু কালের গৃহ-সামগ্রী ও ব্যবহার-উপকরণ।

আর আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা থেক তিনি তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং তোমাদের জন্য পাহাড়ে আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন এবং তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন পরিধেয় বস্ত্রের; তা তোমাদেরকে তাপ থেকে রক্ষা কর এবং তিনি ব্যবস্থা করেছেন তোমাদের জন্য বর্মের, তা তোমাদেরকে যুদ্ধে রক্ষা করে। এভাবেই তিনি তোমাদের প্রতি তার অনুগ্রহ পূর্ণ করেছেন যাতে তোমরা আত্মসমর্পণ কর। নহলঃ ৮০-৮১

কুরআনের আয়াত থেকে আমরা জানি যে, পার্থিব জীবনের ধন-মাল এবং সন্তান-সন্ততি আমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘তাদের ধন –সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাকে যেন বিমুগ্ধ না করে। আল্লাহ তো সেগুলো দ্বারাই তাদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান। (সুরা তাওবা : আয়াত ৫৫)

মুনাফিকদের জন্যে তাদের ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততিকে যে আযাব বলে অভিহিত করা হয়েছে, তার কারণ হল, দুনিয়ার মোহে উন্মত্ত থাকা মানুষের জন্যে পার্থিব জীবনেও এক বড় আযাব।

প্রথমে অর্থ উপার্জনের সুতীব্র কামনা, অতঃপর তা হাসিলের জন্যে নানা চেষ্টা তদবীর নিরন্তর দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রম, না দিনের আরাম না রাতের ঘুম, না স্বাস্থ্যের হেফাযত আর না পরিবার পরিজনের সাথে আমোদ আহলাদের অবকাশ। অতঃপর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম দ্বারা যা কিছু অর্জিত হয়, তার রক্ষণাবেক্ষণ ও তাকে দ্বিগুণ চতুর্গুণ বৃদ্ধি করার অবিশ্রান্ত চিন্তা ভাবনা প্রভৃতি হল একেকটি স্বতন্ত্র আযাব। এরপরে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে বা রোগ ব্যাধির কবলে পতিত হয়, তখন যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।

সৌভাগ্যক্রমে সবই যদি ঠিক থাকে এবং মনের চাহিদামত অর্থকড়ি আসতে থাকে, তখন তার নিরাপত্তার প্রয়োজন ও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং তখন সে চিন্তা ফিকির তাকে মুহুর্তের জন্যও আরামে বসতে দেয়না। পরিশেষে এ সকল অর্থ সম্পদ যখন মৃত্যুকালে বা তার আগে হাত ছাড়া হতে দেখে, তখন দুঃখ ও অনুশোচনার অন্ত থাকেনা। বস্ততঃ এসবই হল আযাব। অজ্ঞ মানুষ একে শান্তি ও আরামের সম্বল মনে করে। কিন্তু মনের প্রকৃত শান্তি ও তৃপ্তি কিসে, তার সন্ধান নেয় না। তাই শান্তির এই উপকরণকেই প্রকৃত শান্তি মনে করে তা নিয়েই দিবা নিশি ব্যস্ত থাকে। অথচ প্রকৃতপক্ষে তা দুনিয়ার জীবনে তার আরামের শক্র এবং আখেরাতের আযাবের পটভূমি। [ইবনুল কাইয়্যেম: ইগাসাতুল লাহফানঃ ১/৩৫-৩৬]

আল্লাহ তাআলা বান্দাকে সতর্ক করে বলেন-

‘আল্লাহর শাস্তির মোকাবেলায় তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না। তারাই জাহান্নামের স্থায়ী অধিবাসী। (সুরা মাজাদালাহ : আয়াত ১৭)

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ

“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষাস্বরূপ।” [সূরা আনফাল: ২৮ ও সূরা তাগাবুন: ১৫ নং আয়াত]

◈ ফিতনা শব্দের অর্থ কী?

ফিতনা (فتنة) শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। যেমন: পরীক্ষা, দাঙ্গা, গোলযোগ, বিপদ, কষ্ট, পরীক্ষা, সম্মোহন ও আকর্ষণ ইত্যাদি। [ডা. ফজলুর রাহমান রচিত আরবী-বাংলা অভিধান]

আয়াতে আল্লাহ তাআলা অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিকে ‘ফিতনা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইবনে কাসির রাহ. উক্ত আয়াতে ফিতনা শব্দের অর্থ করতে গিয়ে বলেন, أي : اختبار وامتحان منه لكم অর্থাৎ “পরীক্ষা করা, যাচায় বা পরখ করা।”

মহান আল্লাহ তোমাদেরকে এগুলো দিয়েছেন যেন তিনি জানতে পারেন যে, তোমরা এসব পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর ও তার আনুগত্য কর না কি এগুলোতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার থেকে দূরে সরে পড়।” [তাফসিরে ইবনে কাসির] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

وَنَبْلُوكُم بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً

“আর আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দিয়ে পরীক্ষা করি।” [সূরা আন্বিয়া: ৩৫]

এ সব ক্ষেত্রে ফিতনা অর্থ: পরীক্ষা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা এসব জিনিস দ্বারা বান্দাকে পরীক্ষা করতে চান। তারপর দেখতে চান, কারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় আর কারা ব্যর্থ হয়।

(যদিও কুরআনে অন্য অর্থেও এর ব্যাবহার রয়েছে) অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সন্তান-সন্ততি এবং অর্থ-সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করতে চান যে, এ সব পেয়ে কি আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি না কি এগুলো পেয়ে আত্ম অহমিকা ও অহংকারে ডুবে যাই এবং শেষ পর্যন্ত এ সব পার্থিব নিয়ামতের পেছনে পড়ে এ সব নিয়ামত দানকারী স্বয়ং মহান আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের কথাই ভুলে যাই!!

♻ বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ এ পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার পরিচয় দিচ্ছে। দুনিয়া অর্থ-সম্পদ, স্ত্রী-সন্তান সহ সুখে জীবন-যাবন করার অভিপ্রায়ে হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম বানিয়ে ছেড়েছে! সুদ, ঘুস, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা, অবৈধ পণ্যের ব্যবসা সব বিভিন্ন হারাম উপার্জনের পেছনে ছুড়ে বেড়াচ্ছে উদভ্রান্ত পাগলের মত! তাদের নামায, যাকাত, রোযা, হজ্জ, জিকির, তাসবীহ, কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন অধ্যয়ন করার সময় নাই!! সন্তানদের ক্যারিয়ার গঠনের চিন্তায় তাদেরকে দ্বীন শেখানোর কথা ভুলে গেছে!! এভাবে মানুষ এই পরীক্ষায় স্পষ্ট অকৃতকার্য হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে গেছে। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।

অথচ আল্লাহর বিধান মেনে অর্থ-সম্পদ কামানো, আয়-উন্নতি করার ব্যাপারে ইসলাম বাধা দেয়া না। তবে সম্পদের হক আদায় করতে হবে। যাকাত, সদকা, দ্বীনের কাজে সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা, গরীব-অসহায় মানুষের কল্যাণে অবদান রাখার মাধ্যমে সে এ সম্পদ দ্বারা দ্বীন ও দুনিয়া উভয় দিকে দিয়ে কল্যাণ অর্জন করতে সক্ষম হত।

♻ অনুরূপভাবে সন্তানদের উন্নত জীবন ও ক্যারিয়ার গঠনে ইসলাম বাধা দেয় না। কিন্তু তা করতে হবে আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে। দ্বীন থেকে দুরে সরে গিয়ে সন্তানদেরকে গড়ে তুললে এরাই তাদের পিতামাতাকে পদপিষ্ট করে জাহান্নামের আগুনে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। এ সন্তানরাই কিয়ামতের দিন তাদের গোমরাহির জন্য তাদের অভিভাবকদেরকে দায়ী করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا رَبَّنَا أَرِنَا اللَّذَيْنِ أَضَلَّانَا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ أَقْدَامِنَا لِيَكُونَا مِنَ الْأَسْفَلِينَ

“কাফেররা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! যেসব জিন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদেরকে দেখিয়ে দাও, আমরা তাদেরকে পদদলিত করব, যাতে তারা যথেষ্ট অপমানিত হয়।” [সূরা ফুসসিলাত: ২৯]

পক্ষান্তরে এ সন্তানদেরকে দ্বীনের উপর গড়ে তুললে তাদের প্রাণখোলা দুআ ও চোখের পানি পিতামাতার গুনাহ মোচন ও জান্নাতে যাওয়ার কারণ হতে পারে যেমনটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

♻ মোটকথা, এই সন্তান-সন্ততি এবং অর্থ-সম্পদ আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদেরকে দেয়া হয়েছে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে। সুতরাং আমরা যদি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে চাই, তাহলে সর্তক হতে হবে যেন, এগুলো আমাদেরকে দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে না দেয় বরং এগুলোই যেন আমাদের জান্নাতে যাওয়ার কারণ হয়। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন

আল্লাহু আলাম। আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, KSA

স্থায়ী সৎকাজ বলতে কুরআনে বর্ণিত বা হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক অনুমোদিত যাবতীয় নেককাজই বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরামের বিভিন্ন উক্তির মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়েছে। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর দাস হারেস বলেন, উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একদিন বসলে আমরা তার সাথে বসে পড়লাম। ইতিমধ্যে মুয়াজ্জিন আসল। তিনি পাত্রে করে পানি নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। সে পানির পরিমাণ সম্ভবত এক মুদ (৮১৫.৩৯ গ্রাম মতান্তরে ৫৪৩ গ্রাম) পরিমান হবে। (দেখুন, মুজামু লুগাতিল ফুকাহা) তারপর উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু সে পানি দ্বারা অজু করলেন এবং বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার এ অজুর মত অজু করতে দেখেছি। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যদি কেউ আমার অজুর মত অজু করে জোহরের সালাত আদায় করে তবে এ সালাত ও ভোরের মাঝের সময়ের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। তারপর যদি আসরের সালাত আদায় করে তবে সে সালাত ও জোহরের সালাতের মধ্যকার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।

এরপর যদি মাগরিবের সালাত আদায় করে তবে সে সালাত ও আসরের সালাতের মধ্যে কৃত গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। তারপর এশার সালাত আদায় করলে সে সালাত এবং মাগরিবের সালাতের মধ্যে হওয়া সমূদয় গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। এরপর সে হয়ত: রাতটি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবে। তারপর যখন ঘুম থেকে জেগে অজু করে এবং সকালের সালাত আদায় করে তখন সে সালাত এবং এশার সালাতের মধ্যকার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর এগুলোই হলো এমন সৎকাজ যেগুলো অপরাধ মিটিয়ে দেয়। লোকেরা এ হাদীস শোনার পর বলল, হে উসমান এগুলো হলো “হাসানাহ” বা নেক-কাজ। কিন্তু “আল-বাকিয়াতুস সালেহাত” কোনগুলো? তখন তিনি বললেন, তা হল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’ এবং লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। [মুসনাদে আহমাদ: ১/৭১]

ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেনঃ “আল বাকিয়াতুস-সালেহাত” দ্বারা আল্লাহর যাবতীয় যিকর বা স্মরণকে বুঝানো হয়েছে। সে মতে তিনি ‘তাবারাকাল্লাহ’, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’, ‘রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সালাত পাঠ, সাওম, সালাত, হজ্জ, সাদাকাহ, দাসমুক্তি, জিহাদ, আত্মীয়তার সম্পর্ক সংরক্ষণ সহ যাবতীয় সৎকাজকেই এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং বলেছেনঃ এর দ্বারা ঐ সমূদয় কাজই উদ্দেশ্য হবে যা জান্নাতবাসীদের জন্য যতদিন সেখানে আসমান ও যমীনের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন বাকী থাকবে অর্থাৎ চিরস্থায়ী হবে; কারণ জান্নাতের আসমান ও যমীন স্থায়ী ও অপরিবর্তনশীল। [ইবন কাসীর]

“আল-বাকিয়াতুস-সালেহাত” এর তাফসীরে এ পাঁচটি বাক্য অন্যান্য অনেক সাহাবা, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীনদের থেকেও বর্ণিত হয়েছে।

“‘আল-বাকিয়াতুস সালিহাত’ তথা চিরস্থায়ী নেক আমল হচ্ছে,

«سُبْحَانَ اللَّهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ».

(সুবহা-নাল্লা-হি, ওয়ালহামদুলিল্লা-হি, ওয়া লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লা-হু আকবার, ওয়ালা হাউলা ওয়ালা কূওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হি)

“আল্লাহ পবিত্র-মহান। সকল হামদ-প্রশংসা আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই। আল্লাহ সবচেয়ে বড়। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া (পাপ কাজ থেকে দূরে থাকার) কোনো উপায় এবং (সৎকাজ করার) কোনো শক্তি কারো নেই।” মুসনাদে আহমাদ নং ৫১৩; আহমাদ শাকের এর তারতীব অনুসারে, আর তার সনদ বিশুদ্ধ। দেখুন, মাজমাউয যাওয়ায়িদ, ১/২৯৭; ইবন হাজার বুলুগুল মারাম গ্রন্থে এটাকে আবু সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর বর্ণনায় ইমাম নাসাঈ (আস-সুনানুল কুবরা, নং ১০৬১৭) নিয়ে এসেছেন বলে ইঙ্গিত করেছেন এবং বলেছেন যে, হাদীসটিকে ইবন হিব্বান (নং ৮৪০) ও হাকেম (১/৫৪১) সহীহ বলেছেন।

আলী (রাঃ) বলেন, দুনিয়া পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যাচ্ছে, আর আখেরাতের জীবন সামনে এগিয়ে আসছে। উভয়ের রয়েছে নিজ নিজ সন্তানাদি। তোমরা আখেরাতের সন্তান হও, দুনিয়ার নয়। কেননা আজ আমলের সময়, এখানে কোন হিসাব নেই। আর আগামী কাল হিসাব-নিকাশ হবে, সেখানে কোন আমল নেই (বুখারী, মিশকাত হা/৫২১৫)।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘কোন বান্দা জাহান্নামীদের মত কাজ করতে থাকে, অথচ সে জান্নাতের অধিবাসী, এভাবে কোন বান্দা জান্নাতীদের মত কাজ করতে থাকে অথচ সে জাহান্নামের অধিবাসী। বস্ত্ততঃ মানুষের আমল তার ‘খাতেমা’ বা সর্বশেষ অবস্থানের উপর নির্ভর করে’ (মুত্তাফাক আলাইহ, মিশকাত হা/৮৩) ।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা সত্য পথে অটল থাক এবং আল্লাহর নৈকট্যলাভের চেষ্টা কর। কেননা জান্নাতী ব্যক্তির অন্তিম কাজ জান্নাতীদের কাজই হবে, (পূর্বে) সে যে আমলই করে থাকুক না কেন। এভাবে জাহান্নামী ব্যক্তির অন্তিম আমল জাহান্নামীদের মতই হবে, (পূর্বে) সে যে আমলই করে থাকুক না কেন’ (তিরমিযী, মিশকাত হা/৯৬, সনদ ছহীহ)।

১৮:৪৭ وَ یَوۡمَ نُسَیِّرُ الۡجِبَالَ وَ تَرَی الۡاَرۡضَ بَارِزَۃً ۙ وَّ حَشَرۡنٰهُمۡ فَلَمۡ نُغَادِرۡ مِنۡهُمۡ اَحَدًا

৪৭. আর স্মরণ করুন, যেদিন আমরা পর্বতমালাকে করব সঞ্চালিত এবং আপনি যমীনকে দেখবেন উন্মুক্ত প্রান্তর, আর আমরা তাদের সকলকে একত্র করব; তারপর তাদের কাউকে ছাড়ব না।

অর্থাৎ যখন যমীনের বাঁধন আলগা হয়ে যাবে এবং পাহাড় ঠিক এমনভাবে চলতে শুরু করবে। যেমন আকাশে মেঘেরা ছুটে চলে। কুরআনের অন্য এক জায়গায় এ অবস্থাটিকে এভাবে বলা হয়েছেঃ

“আর আপনি পাহাড়গুলো দেখছেন এবং মনে করছেন এগুলো অত্যন্ত জমাটবদ্ধ হয়ে আছে কিন্তু এগুলো চলবে ঠিক যেমন মেঘেরা চলে।” [সূরা আন-নামলঃ ৮৮]

আরো বলা হয়েছেঃ “যেদিন আকাশ আন্দোলিত হবে প্রবলভাবে এবং পর্বত চলবে দ্রুত; [সূরা আত-তূর: ৯–১০]

আরো এসেছেঃ “আর পর্বতসমূহ হবে ধুনিত রঙ্গীন পশমের মত।” [সূরা আল-কারি’আ: ৫]

অর্থাৎ এর উপর কোন শ্যামলতা, বৃক্ষ তরুলতা এবং ঘরবাড়ি থাকবে না। সারাটা পৃথিবী হয়ে যাবে একটা ধুধু প্রান্তর। এ সূরার সূচনায় এ কথাটিই বলা হয়েছিল এভাবে যে, “এ পৃথিবী পৃষ্ঠে যা কিছু আছে সেসবই আমি লোকদের পরীক্ষার জন্য একটি সাময়িক সাজসজ্জা হিসেবে তৈরী করেছি। এক সময় আসবে যখন এটি সম্পূর্ণ একটি পানি ও বৃক্ষ লতাহীন মরুপ্রান্তরে পরিণত হবে।”

কিয়ামতের ভয়াবহতা এবং তার বড় বড় ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। পর্বতকে সঞ্চালিত করার অর্থ, পাহাড় তার স্থান থেকে সরে যাবে এবং তা ধূনিত পশমের মত উড়তে থাকবে।

وَتَكُونُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوشِ ‘‘এবং পাহাড়গুলো ধূনিত রঙিন পশমের মত হয়ে যাবে।’’ (সূরা ক্বারেআহ ৫ আয়াত)

আর তারা আপনাকে পর্বতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, আমার রব এগুলোকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দেবেন।  তারপর তিনি তাকে পরিণত করবেন মসৃণ সমতল ময়দানে,  যাতে আপনি বাঁকা ও উঁচু দেখবেন না  সেদিন তারা আহ্বানকারীর অনুসরণ করবে, এ ব্যাপারে এদিক ওদিক করতে পারবে না। আর দয়াময়ের সামনে সমস্ত শব্দ স্তব্ধ হয়ে যাবে; কাজেই মৃদু ধ্বনি ছাড়া আপনি কিছুই শুনবেন না. সূরা ত্বহা র ১০৫-১০৭নং

যমীন থেকে এই শক্তিশালী পাহাড়গুলো যখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখন ঘর-বাড়ী, গাছপালা এবং এই ধরনের অন্যান্য জিনিসগুলো কিভাবে  সব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে? এই জন্যই পরে বলা হয়েছে, ‘‘তুমি যমীনকে দেখবে একটি শূন্য প্রান্তর।’

অর্থাৎ, পূর্বের ও পরের, ছোট ও বড় এবং কাফের ও মু’মিন সকলকেই একত্রিত করব। কেউ যমীনের তলায় পড়ে থাকবে না এবং কবর থেকে বেরিয়ে কোথাও লুকাতে পারবে না। ইরশাদ হয়েছে-

৭৮ : ১৮ یَّوۡمَ یُنۡفَخُ فِی الصُّوۡرِ فَتَاۡتُوۡنَ اَفۡوَاجًا

সেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে তখন তোমরা দলে দলে আসবে। সূরা নাবাঃ১৮

অতএব, আপনি তাদের উপেক্ষা করুন। (স্মরণ করুন) যেদিন আহ্বানকারী আহবান করবে এক ভয়াবহ পরিণামের দিকে,অপমানে অবনমিত নেত্রে সেদিন তারা কবর হতে বের হবে, মনে হবে যেন তারা বিক্ষিপ্ত পঙ্গপাল, তারা আহবানকারীর দিকে ছুটে আসবে ভীত-বিহ্বল হয়ে।কাফিররা বলবে, বড়ই কঠিন এ দিন। সূরা কামারঃ ৬-৮

১৮:৪৮ وَ عُرِضُوۡا عَلٰی رَبِّکَ صَفًّا ؕ لَقَدۡ جِئۡتُمُوۡنَا کَمَا خَلَقۡنٰکُمۡ اَوَّلَ مَرَّۃٍۭ ۫ بَلۡ زَعَمۡتُمۡ اَلَّنۡ نَّجۡعَلَ لَکُمۡ مَّوۡعِدًا ﴿

৪৮. আর তাদেরকে আপনার রব-এর কাছে উপস্থিত করা হবে সারিবদ্ধভাবে এবং আল্লাহ্‌ বলবেন, তোমাদেরকে আমরা প্রথমবার যেভাবে সৃষ্টি করেছিলাম উপস্থিত হয়েছ, অথচ তোমরা মনে করতে যে, তোমাদের জন্য আমরা কোন প্রতিশ্রুত সময় নির্ধারণ করব না।

১) সারিবদ্ধভাবে বলা দ্বারা এ অর্থ উদ্দেশ্য হতে পারে যে, সবাই এক কাতার হয়ে দাঁড়াবে। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “সেদিন রূহ ও ফিরিশতাগণ এক কাতার হয়ে দাঁড়াবে; দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন। সে ছাড়া অন্যেরা কথা বলবে না এবং সে যথাৰ্থ বলবে।” [সূরা আন-নাবাঃ ৩৮]

অথবা এর দ্বারা এটাও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, তারা কাতারে কাতারে দাঁড়াবে। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “এবং যখন আপনার প্রতিপালক উপস্থিত হবেন ও সারিবদ্ধভাবে ফিরিশতাগণও” [সূরা আল-ফাজার: ২২]

কেয়ামতের দিন সবাইকে বলা হবে; আজ তোমরা এমনিভাবে খালি হাতে, নগ্ন পায়ে, কোন খাদেম ব্যতীত, যাবতীয় জৌলুস বাদ দিয়ে, খালি গায়ে, কোন আসবাবপত্র না নিয়ে আমার সামনে এসেছ, যেমন আমি প্রথমে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। কুরআনের অন্যত্রও এ ধরনের আয়াত এসেছে, যেমন

আর অবশ্যই তোমরা আমাদের কাছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় এসেছ, যেমন আমরা প্রথম বার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম; আর আমরা তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম তা তোমরা তোমাদের পিছনে ফেলে এসেছ। আর তোমরা যাদেরকে তোমাদের ব্যাপারে (আল্লাহর সাথে) শরীক মনে করতে, তোমাদের সে সুপারিশকারিদেরকেও আমরা তোমাদের সাথে দেখছি না। তোমাদের মধ্যকার সম্পর্ক অবশ্যই ছিন্ন হয়েছে এবং তোমরা যা ধারণা করেছিলে তাও তোমাদের থেকে হারিয়ে গিয়েছে।সূরা আল-আন’আম: ৯৪,

আর সে যা বলে তা থাকবে আমাদের অধিকারে এবং সে আমাদের কাছে আসবে একা।সূরা মারইয়াম: ৮০

আজ তোমার চোখের পর্দা সরিয়ে দিয়েছি। যা তুমি বিশ্বাস করতে চাওনি, অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাওনি, তা আজ দেখো এ সত্য দেখার জন্যে আজ তোমার দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে দিয়েছি। (সূরা কাফ-২২)

এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “লোকসকল! তোমরা কেয়ামতে তোমাদের পালনকর্তার সামনে খালি পায়ে, খালি গায়ে, পায়ে হেঁটে উপস্থিত হবে। সেদিন সর্বপ্রথম যাকে পোষাক পরানো হবে, তিনি হবেন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম। একথা শুনে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা প্রশ্ন করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! সব নারী-পুরুষই কি উলঙ্গ হবে এবং একে অপরকে দেখবো? তিনি বললেনঃ সেদিন প্রত্যেককেই এমন ব্যস্ততা ও চিন্তা ঘিরে রাখবে যে, কেউ কারো প্রতি দেখার সুযোগই পাবে না। [বুখারীঃ ৩১৭১, মুসলিমঃ ২৮৫৯]

হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর সর্বশেষ ফুৎকারের সঙ্গে সঙ্গে পিপীলিকার মতো ও বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের মতো সবাই উঠে দাঁড়াবে। আল্লাহর বাণী—‘আর শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমানসমূহে যারা আছে ও যমীনে যারা আছে তারা সবাই বেহুশ হয়ে পড়বে, যাদেরকে আল্লাহ ইচ্ছে করেন তারা ছাড়। তারপর আবার শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে তৎক্ষণাৎ তারা দাঁড়িয়ে তাকাতে থাকবে।(সুরা যুমার : ৬৮)

হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর দ্বিতীয় ফুৎকারের সময় সব মৃত জীবিত হয়ে যাবে। তারা ‘হে আল্লাহ! আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং প্রশংসা করছি’ বলে হাশরের ময়দানে একত্র হবে। হাশরের ময়দানে উত্থিত হওয়ার সময় কাফিররাও আল্লাহর প্রশংসা করবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যেদিন তিনি তোমাদের (হাশরের মাঠে একত্র হওয়ার জন্য) আহ্বান করবেন, অতঃপর তোমরা তাঁর প্রশংসা করতে করতে চলে আসবে এবং তোমরা অনুমান করবে যে সামান্য সময়ই (দুনিয়ায়) অবস্থান করেছিলে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : ৫২)

সবাই হামদ করতে করতে উত্থিত হবে এবং সব ব্যাপারে সমাপ্তিও হামদের মাধ্যমে হবে। যেমন- বলা হয়েছে, “আর তাদের (হাশরবাসীদের) ফয়সালা হক অনুযায়ী করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্যে।” [সূরা আয-যুমারঃ ৭৫]

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বিচার দিবসে তোমাদের ও তোমাদের পিতার নাম ধরে ডাকা হবে। সুতরাং সুন্দর নাম রাখো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৪৮)

হাশরের ময়দানে মানুষ তিনটি অবস্থায় উত্থিত হবে। একদল ১. বাহনে করে, ২. একদল পদব্রজে, ৩. একদল মাথায় হেঁটে। যেমন মহানবী (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই মানুষ তিনটি দলে বিভক্ত হবে। একদল আরোহী স্বাদগ্রহণকারী ও সম্মানী। আরেকদল রয়েছে, যাদের ফেরেশতারা চেহারায় হাঁটিয়ে দোজখে নিয়ে যাবেন, আরেকদল পদব্রজে হাশরে উত্থিত হবে।’ (নাসায়ি, মিশকাত, পৃষ্ঠা ৪৮৪)

প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষ চেহারায় কিভাবে হাঁটবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহ পায়ে হাঁটাতে পারেন, তিনি কি চেহারায় হাঁটাতে পারবেন না?’ (বুখারি ও মুসলিম, হাদিস : ২৮০৬)

অর্থাৎ সে সময় আখেরাত অস্বীকারকারীদেরকে বলা হবেঃ দেখো, নবীগণ যে খবর দিয়েছিলেন তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে তো। তারা তোমাদের বলতেন, আল্লাহ যেভাবে তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন ঠিক তেমনি দ্বিতীয়বারও সৃষ্টি করবেন। তোমরা তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলে। কিন্তু এখন বলো, তোমাদের দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা হয়েছে কি না?

১৮:৪৯ وَ وُضِعَ الۡکِتٰبُ فَتَرَی الۡمُجۡرِمِیۡنَ مُشۡفِقِیۡنَ مِمَّا فِیۡهِ وَ یَقُوۡلُوۡنَ یٰوَیۡلَتَنَا مَالِ هٰذَا الۡکِتٰبِ لَا یُغَادِرُ صَغِیۡرَۃً وَّ لَا کَبِیۡرَۃً اِلَّاۤ اَحۡصٰهَا ۚ وَ وَجَدُوۡا مَا عَمِلُوۡا حَاضِرًا ؕ وَ لَا یَظۡلِمُ رَبُّکَ اَحَدًا

৪৯. আর উপস্থাপিত করা হবে আমলনামা, তখন তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে দেখবেন আতংকগ্ৰস্ত এবং তারা বলবে, হায়, দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! এটা তো ছোট বড় কিছু বাদ না দিয়ে সব কিছুই হিসেব করে রেখেছে। আর তারা যা আমল করেছে তা সামনে উপস্থিত পাবে; আর আপনার রব তো কারো প্রতি যুলুম করেন না

দুনিয়ার বুকে তারা যা যা করেছিল তা সবই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। সে সব লিখিত গ্রন্থগুলো সেখানে তারা দেখতে পাবে। তাদের কারও আমলনামা ডান হাতে আবার কারও বাম হাতে দেয়া হবে। তারা সেখানে এটাও দেখবে যে, সেখানে ছোট-বড়, গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বহীন সবকিছুই লিখে রাখা হয়েছে। অন্যত্র মহান আল্লাহ তাদের আমলনামা সম্পর্কে বলেন,

আমি প্রত্যেকের আমলনামা তার ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। কেয়ামতের দিন আমি তার জন্য আমলনামা বের করব। সে তা উন্মুক্ত অবস্থায় পাবে। আমি তাকে বলব, পাঠ করো তোমার আমলনামা। তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য তুমিই যথেষ্ট।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১৫-১৬)

প্রত্যেক মানুষের হেফাযত ও আমলনামা সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন দু’জন ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমলনামা লিপিবদ্ধ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্ত্তত প্রহরী রয়েছে (ক্বা-ফ ৫০/১৭-১৮; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ক্বা-ফ উক্ত আয়াত)।

তবে, একজনের নাম “কিরামান “আরেকজনের নাম “কাতিবীন” এই ধারনা ঠিক নয়।

বরং “কিরামান কাতিবীন” এটি একটা কুরআনের আয়াত[সূরা ইনফিতার ১১]।যার বাংলা অর্থ “সম্মানীত লেখকবৃন্দ” অর্থাৎ “কিরামান” এর অর্থ সম্মানীত

আর কাতিবীন অর্থ লেখকবৃন্দ।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের জন্য তার সামনে ও পিছনে পরপর আগত পাহারাদার ফেরেশতারা রয়েছে, যারা তাকে হেফাযত করে আল্লাহর হুকুমে’ (রাদ ১৩/১১)। যে ফেরেশতা ডানে অবস্থান করেন তিনি মানুষের ছওয়াব লিখেন। আর যে বামে অবস্থান করেন তিনি পাপ লিখেন। এর অর্থ ফেরেশতা মানুষের সাথে সর্বদা অবস্থান করে (ছহীহাহ হা/১২০৯)। সুতরাং এটা প্রমাণিত যে, একজন ব্যক্তিকে দিনে ও রাতে কমপক্ষে চারজন করে ফেরেশতা পাহারা দেয়। যাদের দু’জন ডানে ও বামে মানুষের আমলনামা লিখে, অপর দু’জন মানুষের পিছনে ও সামনে থেকে পাহারা দিয়ে থাকে (বুখারী, হা/৫৫৫; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা রা‘দ ঐ আয়াত)। উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ মনে করে রাকীব ও আতীদ দুইজন ফেরেশতার নাম যা সঠিক নয় (ড. ওমর সুলায়মান, আলামুল মালায়েকাতিল আবরার, ১২ পৃ.)।

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাবো অন্ধকার। এর মাঝেই দেখা যাবে আমলনামা যার যার রেকর্ড। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

وَإِذَا الصُّحُفُ نُشِرَتْ

যখন আমলনামাসহ খুলে ধরা হবে৷সূরা তাকভীরঃ১০

আকাশ থেকে এই আমলনামা পড়া শুরু করবে অথবা ফেরেশতারা নাম ধরে ধরে যার যার আমলনামা হাতে দিতে চাইবেন। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন–

প্রত্যেক দলকেই সেদিন বলা হবে- এসো, তোমাদের আমলনামা বা রেকর্ড নিয়ে যাও। আজ তোমাদেরকে সে সব আমলের বিনিময়ে দেয়া হবে, যা তোমরা করেছো। এটা আমাদের তৈরী করা আমলনামা। তোমাদের ব্যাপারে সঠিক ও যথাযথ সাক্ষ্য দেবে। তোমরা (পৃথিবীতে) যা কিছু করছিলে তা সঠিকভাবে লিখে রাখা হতো। (আল-জাসিয়া-  ২৮-২৯)

অর্থাৎ হাশরবাসীরা তাদের কৃতকর্মকে উপস্থিত পাবে। অন্যান্য আয়াতে আরো স্পষ্ট ভাষায় তা বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে: “যে দিন প্রত্যেকে সে যা ভাল কাজ করেছে এবং সে যা মন্দ কাজ করেছে তা বিদ্যমান পাবে, সেদিন সে তার ও ওটার মধ্যে ব্যবধান কামনা করবে। আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করতেছেন। আল্লাহ বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়াদ্র।” [সূরা আলে-ইমরান: ৩০]

আরও বলা হয়েছেঃ “সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে সে কী আগে পাঠিয়েছে ও কী পিছনে রেখে গেছে।” [সূরা আল-কিয়ামাহঃ ১৩]

৫৪:৫২ وَ کُلُّ شَیۡءٍ فَعَلُوۡهُ فِی الزُّبُرِ

৫৪:৫৩ وَ کُلُّ صَغِیۡرٍ وَّ کَبِیۡرٍ مُّسۡتَطَرٌ

আর তারা যা করেছে সবকিছুই আছে আমলনামায়।সূরা কামারঃ ৫২

৫৩. আর ছোট বড় সব কিছুই লিখিত আছে।সূরা কামারঃ ৫৩

কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে সে তাও দেখবে।’ (সুরা ঝিলঝাল, আয়াত : ৭-৮)

অপরাধীরা ছোট গুনাহই দেখবে প্রথমে তখনই এইভাবে বলে উঠবে। তারা ছোট গুনাহকে গুরুত্ব দিতো না, হালকা করে দেখতো।

আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: হে ‘আয়িশাহ! তুমি ঐ সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাক যেগুলোকে ছোট বলে ধারণা করা হবে। কেননা এ সমস্ত ছোট ছোট গুনাহগুলোর খোঁজ রাখার জন্য আল্লাহ পক্ষ থেকে (ফেরেশতা) নিয়োজিত রয়েছে। (ইবনু মাজাহ, দারিমী, বায়হাক্বীর শুআবূল ঈমান) (সহীহ হাদিস) সহীহ ইবনু মাজাহ ৪২৪৩, সিলসিলাতুস সহীহাহ ৫১৩, ২৭৩১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব ২৪৭২, সিলসিলাতুস সহীহাহ্ ৫১৩

৮৪:৭ فَاَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ کِتٰبَهٗ بِیَمِیۡنِهٖ ۙ

অতঃপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে।

৮৪:৮ فَسَوۡفَ یُحَاسَبُ حِسَابًا یَّسِیۡرًا ۙ

৮. তার হিসেব-নিকেশ সহজেই নেয়া হবে।(

৮৪:৯ وَّ یَنۡقَلِبُ اِلٰۤی اَهۡلِهٖ مَسۡرُوۡرًا

৯. এবং সে তার স্বজনদের কাছে( প্ৰফুল্লচিত্তে ফিরে যাবে। ইনশিকাকঃ৭-৯

আর যাকে তার আমলনামা তার পিঠের পিছনদিক থেকে দেয়া হবে,  সে অবশ্যই তার ধ্বংস ডাকবে;  এবং জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হবে; নিশ্চয় সে তার স্বজনদের মধ্যে আনন্দে ছিল, সে তো ভাবত যে, সে কখনই ফিরে যাবে না অবশ্যই (সে প্রত্যাবর্তিত হবে)।নিশ্চয়ই তার প্রতিপালক তার উপর সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন। ইনশিককঃ ১০-১২

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, কেয়ামতের দিন যার হিসাব নেয়া হবে, সে আযাব থেকে রক্ষা পাবে না। এ কথা শুনে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রশ্ন করলেন, কুরআনে কি (فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا) বলা হয়নি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই আয়াতে যাকে সহজ হিসাব বলা হয়েছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে পরিপূর্ণ হিসাব নয়; বরং কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলমীনের সামনে পেশ করা। যে ব্যক্তির কাছ থেকে তার কাজকর্মের পুরোপুরি হিসাব নেয়া হবে, সে আযাব থেকে কিছুতেই রক্ষা পাবে না। [বুখারী: ৪৯৩৯, মুসলিম: ২৮৭৬l

আরও বলা হয়েছেঃ “যে দিন গোপন ভেদসমূহ প্রকাশ করা হবে” [সূরা আত-ত্বরেক: ৯]

মুফাসসিরগণ বিভিন্ন হাদীসের ভিত্তিতে এর অর্থ সাধারণভাবে এরূপ বর্ণনা করেন যে, এসব কৃতকর্মই প্রতিদান ও শাস্তির রূপ পরিগ্রহ করবে। তাদের আকার-আকৃতি সেখানে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। যেমন, কোন কোন হাদীসে আছে,

যারা যাকাত দেয় না, তাদের মাল কবরে একটি বড় সাপের আকার ধারণ করে তাদেরকে দংশন করবে এবং বলবেঃ আমি তোমার সম্পদ ৷ [বুখারীঃ ১৩৩৮, তিরমিযীঃ ১১৯৫]

সৎকর্ম সুশ্ৰী মানুষের আকারে কবরের নিঃসঙ্গ অবস্থায় আতঙ্ক দূর করার জন্য আগমন করবে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/২৮৭]

‘যাকে আমলনামা দেওয়া হবে তার ডান হাতে, সে বলবে, হে লোকজন! এই যে আমার আমলনামা তোমরা পড়ে দেখো; আমি আগেই বিশ্বাস করেছিলাম যে, আমাকে অবশ্যই হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে!’ (সুরা হাক্কাহ: ১৯-২০)

‘আর যার আমলনামা দেওয়া হবে তার বাম হাতে, সে বলবে, হায়! আমাকে যদি আমলনামা দেওয়াই না হতো! আমি যদি জানতেই না পারতাম আমার হিসাব কী? হায়! মৃত্যুতেই যদি আমার সব শেষ হয়ে যেত। আমার অর্থ-সম্পদ আমার কোনো কাজে আসল না। আমার থেকে আমার সব ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গেছে!’ (সুরা হাক্কাহ: ২৫-২৯)

ইমাম তিরমিযি হযরত হাসান সূত্রে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন – আল্লাহর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ

করেছেন- “হাশরের দিনে তিন ধরণের মানুষকে আল্লাহর কাছে পেশ করা হবে।

(১) প্রথম পেশ করা হবে যারা আল্লাহর সাথে ঝগড়া-বিবাদ করবে।

(২) নবীগণের পক্ষে  আপত্তি পেশ করার উদ্দেশ্যে নবীগণকে হাযির করা হবে।

(৩) আর ঐ সময়ই তৃতীয় প্রকারের উপস্থিতি হবে তাদের আমলনামা ডানহাতে বা বামহাতে উড়ে আসবে”।

এক প্রকার লোক হবে নিরেট কাফের।তারা আল্লাহর সাথে ঝগড়া ও প্রতারণা করে পার হয়েযেতে চাইবে।

দ্বিতীয় প্রকার লোক হবে- যারা নবীগণের আগমনকে অস্বীকার করবে- কিন্তু আল্লাহপাক নবীগণের পক্ষে সাক্ষী প্রমাণ পেশ করে কাফেরদের পরাস্ত করবেন।

আর তৃতীয় প্রকার লোক হবে গুনাহগার ও নেককার। এদেরই হিসাব নিকাশ হবে। প্রথম দু দল বিনা হিসাবে জাহান্নামে যাবে। নেক্কার ও বদকারের আমলনামা দেখে হিসাব নিকাশ করা হবে।

আমলনামায় কি দেখতে পাবে?

আমলনামায় যা দেখতে পাবে, তার মাঝে ভয়াবহ হলো শিরক ।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে দূরে থাক। তার মধ্যে অন্যতম আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা। আবূ হুরাইরা (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত তিনি বলেন, সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় থেকে তোমরা বিরত থাকবে। সহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী? তিনি বললেন, (১) আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা। (২) যাদু। (৩) আল্লাহ তাআলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, শরীয়ত সম্মত কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করা। (৪) সুদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের মাল গ্রাস করা। (৬) রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং (৭) সরল স্বভাবা সতী-সাধ্বী মু’মিনাদের অপবাদ দেয়া। (সহীহ বুখারীঃ ২৭৬৬ মুসলিমঃ ৮৯, আ প্র ২৫৬৩, ই ফা ২৫৭৫

আমলনামায় ভালো কাজ যা দেখতে পাবে-

মানুষের প্রতি ভালো আচরন বা ইহসান, তার মাঝে উত্তম হলো স্ত্রীর সাথে আচরন, সন্তানদের সাথে, পিতা মাতার সাথে( জান্নাতের দরজা দুটো)।

ফরয কাজ সমূহ, নফল ইবাদাত সমূহ। অন্যের কষ্ট বা সমস্যা দূর করা, ইত্যাদি

অর্থাৎ এক ব্যক্তি একটি অপরাধ করেনি। কিন্তু সেটি খামাখা তার নামে লিখে দেয়া হয়েছে, এমনটি কখনো হবে না। আবার কোন ব্যক্তিকে তার অপরাধের কারণে প্রাপ্য সাজার বেশী দেয়া হবে না এবং নিরপরাধ ব্যক্তিকে অযথা পাকড়াও করেও শাস্তি দেয়া হবে না। জাবের ইবন আব্দুল্লাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তা’আলা মানুষদেরকে অথবা বলেছেন বান্দাদেরকে নগ্ন, অখতনাকৃত এবং কপর্দকশূণ্য অবস্থায় একত্রিত করবেন। তারপর কাছের লোকেরা যেমন শুনবে দূরের লোকরাও তেমনি শুনতে পাবে এমনভাবে ডেকে বলবেনঃ আমিই বাদশাহ, আমিই বিচার-প্রতিদান প্রদানকারী, জান্নাতে প্রবেশকারী কারও উপর জাহান্নামের অধিবাসীদের কোন দাবী অনাদায়ী থাকতে পারবে না।

অনুরূপভাবে, জাহান্নামে প্রবেশকারী কারও উপর জান্নাতের অধিবাসীদের কারও দাবীও অনাদায়ী থাকতে পারবে না। এমনকি যদি তা একটি চপেটাঘাতও হয়। বর্ণনাকারী বললেনঃ কিভাবে তা সম্ভব হবে, অথচ আমরা তখন নগ্ন শরীর, অখতনাকৃত ও রিক্তহস্তে সেখানে আসব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ নেককাজ ও বদকাজের মাধ্যমে সেটার প্রতিদান দেয়া হবে। [মুসনাদে আহমাদ: ৩/৪৯৫] অন্য হাদীসে এসেছে, ‘শিংবিহীন প্রাণী সেদিন শিংওয়ালা প্রাণী থেকে তার উপর কৃত অন্যায়ের কেসাস নিবে।’ [মুসনাদে আহমাদ: ১/৪৯৪]

মানুষের গোনাহ বোঝার আকারে প্রত্যেকের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হবে। অনুরূপভাবে, কুরআন ইয়াতীমের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষনকারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- (إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا) [সূরা আন-নিসাঃ ১০]

অথবা, আয়াতের এ অর্থও করা যায় যে, তারা তাদের কৃতকর্মের বিবরণ সম্বলিত দপ্তর দেখতে পাবে, কোন কিছুই সে আমলনামা লিখায় বাদ পড়েনি। কাতাদা রাহেমাহুল্লাহ এ আয়াত শুনিয়ে বলতেন: তোমরা যদি লক্ষ্য কর তবে দেখতে পাবে যে, লোকেরা ছোট-বড় সবকিছু গণনা হয়েছে বলবে কিন্তু কেউ এটা বলবে না যে, আমার উপর যুলুম করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা ছোট ছোট গুনাহর ব্যাপারে সাবধান হও; কেননা এগুলো একত্রিত হয়ে বিরাট আকার ধারণ করে ধ্বংস করে ছাড়বে। [তাবারী]

সেদিন কারো মা-বাবা জাহান্নামে যাবে, সন্তানরা যাবে জান্নাতে। স্ত্রী জান্নাতে যাবে, স্বামী জাহান্নামে। স্বামী জান্নাতে, স্ত্রী জাহান্নামে। কর্মচারী জান্নাতে, মালিক জাহান্নামে। এভাবে যারা জাহান্নাম থেকে অন্যদেরকে জান্নাতে দেখবে, তখন তাদের পরিতাপের অন্ত থাকবে না। এমনকি জাহান্নামিরা জান্নাতিদের ডেকে সামান্য পানি চাইবে। সেই দৃশ্যের বর্ণনা কোরআনে এসেছে এভাবে—

‘জাহান্নামিরা জান্নাতিদের ডেকে বলবে, আমাদের ওপর সামান্য পানি নিক্ষেপ করো অথবা আল্লাহ তাআলা তোমাদের যে রিজিক দিয়েছেন, তা থেকে কিছু দাও। তারা উত্তরে বলবে, আল্লাহ এই উভয় বস্তু কাফেরদের জন্য হারাম করেছেন।’(সুরা আরাফ: ৫০)

সুতরাং ওই দিন আসার আগে অর্থাৎ বেঁচে থাকতেই মুমিন মুসলমানের সাবধান হওয়া উচিত। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বিষয়ে লক্ষ্য রেখে আমল করা উচিত। দুনিয়াতে যারা মুমিনদের নিয়ে উপহাস করেছিল, পরকালে তারা যখন জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন তাদেরকে ডেকে মুমিনগণ বিদ্রুপ করবেন। জান্নাতিরা জাহান্নামিদের ডেকে বলবে—

‘আমাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিপালক যে ওয়াদা করেছিলেন, তা আমরা সত্য পেয়েছি। অতএব তোমরা কি তোমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা সত্য পেয়েছ? তারা (হতাশ গলায়) বলবে, হ্যাঁ হ্যাঁ; পেয়েছি! অতঃপর একজন ঘোষক উভয়ের মাঝখানে ঘোষণা করবেন, আল্লাহর অভিশাপ জালেমদের ওপর।’ (সুরা আরাফ: ৪৪)।

সহায়কঃ তাফসিরে যাকারিয়া ও আহসানুল বায়ান