সূরা কাহফ তাফসীর (ভূমিকা ও দাজ্জালের বর্ণনা)

 

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

১৫তম পারা, ১৮তম সূরা, আয়াত সংখ্যাঃ ১১০ ,  মোট রুকুঃ ১২

নামকরণঃ

এ সূরার নাম সূরা আল-কাহাফ। কারণ সূরার মধ্যে কাহাফ বা গুহাবাসীদের আলোচনা স্থান পেয়েছে। ১৮:৯ اَمۡ حَسِبۡتَ اَنَّ اَصۡحٰبَ الۡکَهۡفِ وَ الرَّقِیۡمِ ۙ کَانُوۡا مِنۡ اٰیٰتِنَا عَجَبًا

كهف এর অর্থ বিস্তীর্ণ পার্বত্য গুহা। বিস্তীর্ণ না হলে তাকে غار বলা হয়। [কুরতুবী]

নাযিল হওয়ার স্থানঃ

সূরা আল-কাহাফ মক্কায় নাযিল হয়েছে। [কুরতুবী]

এখান থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের তৃতীয় অধ্যায়ে অবতীর্ণ সূরাগুলো শুরু হচ্ছে ।

মক্কী জীবনকে  চারটি বড় বড় অধ্যায়ে ভাগ করেছেন কোন কোন আলেম।

এ বিভাগ অনুযায়ী তৃতীয় অধ্যায়টি প্রায় ৫ নববী সন থেকে শুরু হয়ে ১০ নববী সন পর্যন্ত বিস্তৃত । পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর মোকবিলায় এ অধ্যায়টির বৈশিষ্ট হচ্ছে এই যে, পূর্ববর্তী অধ্যায় দু’টিতে কুরাইশরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম এবং তাঁর আন্দোলন ও জামায়াতকে বিপর্যস্ত করার জন্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উপহাস, ব্যাংগ – বিদ্রূপ, আপত্তি, অপবাদ, দোষারোপ, ভীতি প্রদর্শন, লোভ দেখানো ও বিরুদ্ধে প্রচারণার ওপর নির্ভর করছিল । কিন্তু এ তৃতীয় অধ্যায় এসে তারা জুলুম, নিপীড়ন, মারধর ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির অস্ত্র খুব কড়াকড়িভাবে ব্যবহার করে । এমনকি বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে দেশ ত্যাগ করে হাবশার দিকে যেতে হয় । আর বাদবাকি মুসলমানদের এবং তাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবার ও বংশের লোকদের আবু তালেব গিরি গুহার পূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কটের মধ্যে অবরুদ্ধ জীবন যাপন করতে হয় । তবুও এ যুগে আবু তালেব ও উমমূল মু’মিনীন হযরত খাদীজার (রা) ন্যায় দু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রভাবে ফলে কুরাইশদের দু’টি বড় বড় শাখা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃষ্ঠপোষকতা করছিল । ১০ নববী সনে এ দু’জনের মৃত্যুর সাথে সাথেই এ অধ্যায়টির সমাপ্তি ঘটে । এরপর শুরু হয় চতুর্থ অথ্যায় । এ শেষ অধ্যায়ে মুসলমানদের মক্কায় জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে । এমনকি শেষ পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমস্ত মুসলমানদের নিয়ে মক্কা ত্যাগ করতে হয় ।

সূরা কাহফের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায়, মক্কী যুগের এ তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতেই এ সূরাটি নাযিল হয়ে থাকবে । এ সময় জুলুম, নিপীড়ন, বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল  ঠিকই কিন্তু তখনো মুসলমানরা হাবশায় হিজরত করেনি । তখন যেসব মুসলমান নির্যাতিত হচ্ছিল তাদেরকে আসহাবে কাহফের কাহিনী শুনানো হয়, যাতে তাদের হিম্মত বেড়ে যায় এবং তারা জানতে পারে যে, ঈমানদাররা নিজেদের ঈমান বাঁচাবার জন্য ইতিপূর্বে কি করেছে ।

অবতীর্ণের কারণ

আল্লামা ইবনে কাছীরসহ অন্যান্য মুফাসসিরে কেমরাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে,

মক্কার কুরাইশরা নযর বিন হারিছ এবং উকবা বিন আবু মঈতকে মদীনার ইহুদী আলেমদের কাছে পাঠাল। তারা তাদের উভয়কে বললঃ তোমরা মদীনায় যাও এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর। তোমার তাদেরকে মুহাম্মাদের গুণাগুণ সম্পর্কেও বল এবং সে যা বলছে, সে সম্পর্কেও তাদেরকে খবর দাও। কেননা তারা আহলে কিতাব। তাদের কাছে নবী-রাসূলদের সম্পর্কে এমন জ্ঞান আছে, যা আমাদের কাছে নেই।

সুতরাং নযর বিন হারিছ এবং উকবাহ মদীনায় গিয়ে ইহুদী আলেমদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তারা ইহুদী আলেমদের কাছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বৈশিষ্ট এবং তাঁর কিছু খবরাদিও বর্ণনা করল। পরিশেষে তারা বললঃ তোমরা তাওরাতের অধিকারী। তাই আমরা তোমাদের কাছে আমাদের সাথী (মুহাম্মাদ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছি। সুতরাং আমাদেরকে তার সম্পর্কে কিছু সংবাদ দাও এবং এমন কিছু বিষয় শিখিয়ে দাও, যার দ্বারা আমরা তাঁকে পরীক্ষা করতে পারি।

এবার ইহুদী আলেমরা তাদেরকে বললঃ তোমরা তাঁকে তিনটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। সে যদি প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারে, তাহলে সে সত্য নবী। আর যদি উত্তর দিতে না পারে, তাহলে বুঝবে যে, সে একজন মিথ্যুক। তোমরা তার ব্যাপারে যা ইচ্ছা তাই করতে পার।

১) তোমরা তাকে ঐ সমস্ত যুবকদের সম্পর্কে (আসহাবে কাহাফ) জিজ্ঞেস কর, যারা অতীত কালে দ্বীন নিয়ে পলায়ন করেছিল। তাদের অবস্থা কি হয়েছিল? কেননা তাদের ঘটনাটি ছিল সত্যিই বিস্ময়কর।

২) তোমরা তাকে আল্লাহর সেই মুমিন বান্দা (যুল কারনাইন) সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যিনি পূর্ব ও পশ্চিমের সব দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তার খবর কি ছিল?

৩) তোমরা তাঁকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। এটি কি? (যদিও কোন কোন আলেম বলেছেন মূসা আ ও খিযির এর সংক্রান্ত প্রশ্ন ছিলো, রুহ নয়)

সে যদি তোমাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারে, তাহলে সে একজন সত্য নবী। তার অনুসরণ কর। আর উত্তর দিতে না পারলে মনে করবে সে একজন মিথ্যুক। অতঃপর তোমরা তার ব্যাপারে যে কোন সিদ্বান্ত নিতে পার।

প্রশ্নগুলো নিয়ে নযর এবং উকবাহ মক্কার কুরাইশদের নিকট ফেরত আসল। তারা কুরাইশদেরকে বললঃ আমরা মুহাম্মাদ ও তোমাদের মাঝে ফয়সালাকারী একটি বিষয় নিয়ে এসেছি। এই বলে তারা প্রশ্নগুলো সম্পর্কে কুরাইশদেরকে জানাল এবং বললঃ মদীনার ইহুদী আলেমগণ আমাদেরকে বলেছে, আমরা যেন প্রশ্নগুলো মুহাম্মাদের সামনে পেশ করি। সুতরাং তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আগমণ করল এবং উপরোক্ত তিনটি প্রশ্ন করল। তিনি বললেনঃ আগামীকাল আমি তোমাদেরকে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিব। কিন্তু তিনি ইনশা-আল্লাহ্ বলতে ভুলে গেলেন। কাফেররা আগামীকালের ওয়াদা নিয়ে চলে গেল। ইনশা-আল্লাহ্ না বলার কারণে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও এ ব্যাপারে কোন অহী আসল না এবং জিবরীলও আগমণ করলনা।

ঐ দিকে মক্কার কুরাইশরা বলাবলি করতে লাগলঃ মুহাম্মাদ আগামীকালের ওয়াদা করেছে। আর আজ পনের দিন হল। এখন পর্যন্ত আমাদের প্রশ্নগুলোর কোন উত্তরই দিতে পারে নি। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তিত হলেন এবং বিষয়টি তাঁর কাছে কঠিন আকার ধারণ করল। অতঃপর পনের দিন পর জিবরীল সূরা কাহাফসহ অবতীর্ণ হলেন। তাতে আসহাবে কাহাফের ঘটনা, যুল কারনাইন বাদশার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হলো।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—(কাহফ ২৩-২৪)

১৮:২৩ وَ لَا تَقُوۡلَنَّ لِشَایۡءٍ اِنِّیۡ فَاعِلٌ ذٰلِکَ غَدًا

২৩. আর কখনই আপনি কোন বিষয়ে বলবেন না, আমি তা আগামীকাল করব,

১৮:২৪ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰهُ ۫ وَ اذۡکُرۡ رَّبَّکَ اِذَا نَسِیۡتَ وَ قُلۡ عَسٰۤی اَنۡ یَّهۡدِیَنِ رَبِّیۡ لِاَقۡرَبَ مِنۡ هٰذَا رَشَدًا ﴿

২৪. ‘আল্লাহ ইচ্ছে করলে’ এ কথা না বলে আর যদি ভুলে যান তবে আপনার রবকে স্মরণ করবেন এবং বলবেন, সম্ভবত আমার রব আমাকে এটার চেয়ে সত্যের কাছাকাছি পথ নির্দেশ করবেন।

প্রশ্নটি ছিল রূহ সম্পর্কে  বনী ইসরাঈলের ১০ রুকূতে ৮৫ আয়াতে এর জবাব দেয়া হয়েছে

৮৫. আর আপনাকে তারা রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলুন, ‘রূহ আমার রবের আদেশঘটিত এবং তোমাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে অতি সামান্যই।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মদীনার জনবসতিহীন এলাকায় পথ অতিক্রম করেছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে খেজুর ডালের একটি ছড়ি ছিল। তিনি কয়েকজন ইহুদীর কাছ দিয়ে গমন করছিলেন। তারা পরস্পরে বলাবলি করছিলঃ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করছেন। তাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর। অপর কয়েকজন নিষেধ করল। কিন্তু কয়েকজন ইহুদী প্রশ্ন করেই বসল। প্রশ্ন শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছড়িতে ভর দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি অনুমান করলাম যে, তাঁর প্রতি ওহী নাযিল হবে কিছুক্ষণ পর ওহী নাযিল হলে তিনি এ আয়াত পাঠ করে শোনালেনঃ (وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا) তখন তারা পরস্পর বলল, তোমাদেরকে নিষেধ করিনি যে, তাকে প্রশ্ন করো না? [বুখারীঃ ১২৫, মুসলিমঃ ২৭৯৪]

অন্য বর্ণনায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বৰ্ণনা করেনঃ কোরায়শরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম–কে সঙ্গত অসঙ্গত প্রশ্ন করত। একবার তারা মনে করল যে, ইহুদীরা বিদ্বান লোক। তারা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহেরও জ্ঞান রাখে। কাজেই তাদের কাছ থেকে কিছু প্রশ্ন জেনে নেয়া দরকার; যেগুলো দ্বারা মুহাম্মদের পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। তদনুসারে কুরাইশরা কয়েকজন লোক ইহুদীদের কাছে প্রশ্ন প্রেরণ করল। তারা শিখিয়ে দিল যে, তোমরা তাঁকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন কর। [মুসনাদে আহমাদ ১/২৫৫, তিরমিযীঃ ৩১৪০, ইবনে হিব্বানঃ ৯৯, মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৫৩১] এ আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাসের যে দু’টি হাদীস উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, তন্মধ্যে ইবনে মাসউদের হাদীস অনুযায়ী প্রশ্নটি মদীনায় করা হয়েছিল। এ কারণেই কোন কোন তফসীরবিদ আয়াতটিকে ‘মাদানী’ সাব্যস্ত করেছেন যদিও সূরা বনী-ইসরাঈলের অধিকাংশই মক্কা। পক্ষান্তরে ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েত অনুসারে প্রশ্নটি মক্কায় করা হয়েছিল। এদিক দিয়ে গোটা সূরার ন্যায় এ আয়াতটিও মক্কী।

সূরার কিছু বৈশিষ্ট্যঃ

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, বনী ইসরাইল, আল-কাহফ, মারইয়াম, ত্বা-হা এবং আম্বিয়া এগুলো আমার সবচেয়ে প্রাচীন সম্পদ বা সর্বপ্রথম পুঁজি ৷ [বুখারীঃ ৪৭৩৯] এর অর্থ, প্রাচীন সূরা সমূহের মধ্যে এগুলো অন্যতম। এগুলোর বিশেষ বিশেষত্ব রয়েছে। কারণ এগুলো অনেক কাহিনী এবং নবী-রাসূলদের কিসসা সমৃদ্ধ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যক্তি সূরা আল-কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফেৎনা থেকে নিরাপদ থাকবে।” [আবু দাউদঃ ৪৩২৩, আহমাদঃ ৬/৪৪৯]

অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যক্তি সূরা কাহফের শেষ দশটি আয়াত মুখস্থ করবে সে দাজ্জালের ফেৎনা থেকে মুক্ত থাকবে। [মুসলিমঃ ৮০৯]

অন্য এক হাদীসে বারা ইবনে আযিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এক লোক সূরা আল-কাহাফ পড়ছিল তার ঘরে ছিল একটি বাহন। বাহনটি বারবার পালাচ্ছিল। সে তাকিয়ে দেখল যে, মেঘের মত কিছু যেন তাকে ঢেকে আছে। সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সেটা বর্ণনা করার পর রাসূল বললেনঃ হে অমুক! তুমি পড়। এটাতো কেবল ‘সাকীনাহ’ বা প্রশান্তি যা কুরআন পাঠের সময় নাযিল হয়৷ [বুখারীঃ ৩৬১৪, মুসলিমঃ ৭৯৫]।

অন্য হাদীসে এসেছে, যে কেউ শুক্রবারে সূরা আল-কাহাফ পড়বে পরবর্তী জুম’আ পর্যন্ত সে নূর দ্বারা আলোকিত থাকবে। [মুস্তাদরাকে হাকিমঃ ২/৩৬৮, সুনান দারমী ২/৪৫৪]

অপর হাদীসে এসেছে, ‘যেভাবে সূরা আল-কাহাফ নাযিল হয়েছে সেভাবে কেউ তা পড়লে সেটা তার জন্য কিয়ামতের দিন নূর বা আলোকবর্তিকা হবে। [মুস্তাদরাকে হাকিমঃ ১/৫৬৪]

জুমার দিন সূরা কাহাফ পড়ার সময়:

সূরা কাহাফ জুমার রাত বা জুমার দিনে পড়া হবে। জুমার রাত শুরু হয় বৃহষ্পতিবার সূর্য ডোবা থেকে এবং শেষ হয় জুমাবারের সূর্য ডোবার মাধ্যমে। অতএব, সূরা কাহাফ পড়ার সময় হচ্ছে: বৃহষ্পতিবার সূর্য ডোবা থেকে শুরু করে জুমাবারের সূর্য ডোবা পর্যন্ত।

মুনাওয়ি বলেন: হাফেয ইবনে হাজার তাঁর ‘আমালীতে’ বলেছেন: এভাবে কিছু রেওয়ায়েতে ‘জুমার দিন’ উদ্ধৃত হয়েছে। আর কিছু রেওয়ায়েতে ‘জুমার রাত’ উদ্ধৃত হয়েছে। উভয়টির মাঝে সমন্বয় এভাবে যে, উদ্দেশ্য হচ্ছে: রাতসহ দিন এবং দিনসহ রাত।[ফাইযুল কাদির (৬/১৯৯)]

মুনাওয়ি আরও বলেন:

অতএব, জুমার দিনে সেই সূরা পড়া মুস্তাহাব; অনুরূপভাবে জুমার রাতেও— যেমনটি ইমাম শাফেয়ি দ্ব্যর্থহীন ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন।[ফাইযুল কাদির (৬/১৯৮)]

সূরা কাহাফের ফযীলত সম্পর্কে এসব সহীহ হাদীস ছাড়াও কিছু যইফ ও জাল হাদীস রয়েছে । সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এগুলো :

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি সুরা’র সন্ধান দিবো না, যার মাহাত্ম আকাশ ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থান জুড়ে রয়েছে এবং তার পাঠকের জন্যও রয়েছে অনুরূপ পুরষ্কার ? যে তা পাঠ করবে তার এক জুমু’আহ হতে আরেক জুমু’আহর মধ্যবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া গুনাহ মাফ করা হবে, উপরন্তু অতিরিক্ত আরো তিনদিনের গুনাহ ক্ষমা করা হবে। তারা বললো, হ্যাঁ আপনি বলুন। তিনি বললেন, তা হলো সুরা কাহাফ। – দায়লামী।

–          হাদীসটি খুবই দুর্বল। ( সিলসিলাহ যইফাহ হা/১৩৩৬)।

যে ব্যক্তি জুমু’আহর দিন সূরাহ পাঠ করবে, সে আট দিন পর্যন্ত প্রত্যেক এমন ফিতনাহ হতে নিরাপদ থাকবে যা সামনে ঘটবে। এতে যদি দাজ্জাল আবির্ভূত হয় সে তার থেকেও নিরাপদ থাকবে।

–          হাদীসটি খুবই দুর্বল। এর সানাদে রয়েছে ইবরাহীম মুখায়রামী। ইমাম দারা কুতনী বলেন, সে নির্ভরযোগ্য নয়। সে বিশ্বস্তদের সূত্রে বাতিল হাদীস বর্ণনা করে। বিস্তারিত দেখুন, সিলসিলা হ যইফাহ হা/১৩৩৬।

অপর একটি হাদীস হলো ,

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, যে ব্যক্তি সূরাহ কাহাফের প্রথম তিনটি আয়াত পাঠ করবে সে দাজ্জালের ফিতনা হতে নিরাপদ থাকবে। (তিরমিযী)।

–          হাদীসটি শায। আলবানী বলেন, উপরোক্তে শব্দে হাদীসটি শায। কিন্তু ভিন্ন শব্দে হাদীসটি সহীহ। এতে তিন আয়াত কথাটি ভুল। সঠিক হলো দশ আয়াত। দেখুন সিলসিলাহ যইফাহ হা/১৩৩৬।

ইবনু মীরদুওয়াই (রহ) বর্ণনা করেছেন যে, জুমুআ’হর দিন যে ব্যক্তি সূরায়ে কাহাফ পাঠ করবে সে তার পায়ের নীচ থেকে নিয়ে আকাশের উচ্চতা পর্যন্ত নূর লাভ করবে। ওটা কিয়ামতের দিন খুবই উজ্জ্বল হবে এবং পরবর্তী জুমুআহ পর্যন্ত তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।

হাদীসটির সনদ গারীব বা দুর্বল। ( তাফসীর ইবন কাসীর, ১৪খন্ড,১ম পৃষ্ঠা )

কেনো সূরা কাহফ পাঠ করার কথা এসেছে?

একটি উদ্দেশ্য দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা বলা হয়েছে।

দাজ্জালের ফিতনা সম্পর্কে একটু জানা প্রয়োজন——তাহলে এই সূরার সাথে অর্থাৎ যে ৪টি ঘটনা বর্নিত হয়েছে তার সম্পর্ক বুঝা সহজ হবে ইন শা আল্লাহ।

আল-মাসীহ’ ঈসা আলাইহিস সালামের উপাধি। তাকে এই উপাধি দেয়ার কয়েকটি কারণ আলেমগণ উল্লেখ করেছেন; যেমন:

১। আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে মোছন করেছেন (مَسَحَه) তথা গুনাহ থেকে পবিত্র করেছেন।

২। তিনি ছিলেন বরকত দিয়ে মোছনকৃত (مُسِحَ)।

৩। কারো কারো মতে, কারণ তিনি যখনই কোন রোগগ্রস্তকে হাত দিয়ে মুছতেন তখন তারা সুস্থ হয়ে যেত।[দেখুন: তাফসিরে তাবারী (৫/৪০৯), মাক্কী রচিত ‘আল-হিদায়া (৩/১০১৩)]

ইবনে আতিয়্যা (১/৪৩৬) বলেন: المَسِيح শব্দটির উৎসমূলের ব্যাপারে মানুষ মতভেদ করেছে।

একদল বলেছেন: এটি ساح يسيح في الأرض থেকে উদ্ভুত। অর্থাৎ পৃথিবীতে বিচরণ করা। সেক্ষেত্রে শব্দটির ওজন হচ্ছে: مَفْعَل।

আর অধিকাংশ আলেমের মত হলো: শব্দটি مَسَحَ থেকে উদ্ভুত। তখন এর ওজন হবে: فعيل।

এরপর তারা مَسَحَ থেকে এর রূপান্তর প্রক্রিয়া নিয়েও মতভেদ করেছেন।

একদল বলেছেন: তাঁকে এই নামে অভিহিত করা হয়েছে مساحة الأرض থেকে। যেহেতু তিনি ভূমিতে বিচরণ করেছেন এতে করে যেন তিনি গোটা পৃথিবীকে مسح করেছেন বা চষে বেড়িয়েছেন।

অন্যরা বলেছেন: তাঁকে এই নামে অভিহিত করা হয়েছে যেহেতু তিনি তাঁর হাত দিয়ে কোন রোগগ্রস্তকে মুছে দিলে সে সুস্থ হয়ে যেত। এই দুই অভিমতের ভিত্তিতে এখানে فعيل শব্দ فاعل অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

মাসীহ দাজ্জাল কে?

১। মাসীহ শব্দটি এসেছে ‘মাসাহ’ থেকে। যার অর্থ স্পর্শ করা বা মোছা।

 দাজ্জালকেও মাসীহ বলা হয়েছে। কারণ তার এক চোখ লেপন করা থাকবে। সেও আল্লাহর হকুমে মৃতকে জীবিত করতে পারবে (মুসলিম হা/২৯৩৩; মিশকাত হা/৫৪৭৩)।

২। মাসীহ (مَسِيْحٌ) শব্দটি مَسَحَ ধাতু থেকে গঠিত। যার অর্থ হল, বেশি বেশি সফর করা। আরবীতে ভূপৃষ্ঠের উপর খুব বেশি ভ্রমণকারীকে مَسَحَ الأَرْضَ বলা হয়। এই বিশ্লেষণ অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা ঈসা (আলাইহিস সালাম) নবীদের মধ্যে সর্বাধিক ভ্রমণকারী। (লিসানুল আরব, ২য় খ-, পৃ. ৫৯৪-৫৯৮) মাসীহ: এর অর্থ সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, يُقَالُ إِنَّهُ سُمِّيَ بِذَلِكَ لِكَوْنِهِ يَمْسَحُ الْأَرْضَ وَقِيلَ سُمِّيَ بِذَلِكَ لِأَنَّهُ مَمْسُوحُ الْعَيْنِ ‘বলা হয় যে, তাকে এই নামে নামকরণ করা হয়েছে, কারণ সে পৃথিবী ধ্বংস করবে। কারো মতে, যেহেতু তার এক চোখ কানা থাকবে তাই এ নামে তাকে নামকরণ করা হয়েছে।’ (ফাতহুল বারী ৬/৪৭২)

শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘দাজ্জালও যেহেতু সারা দুনিয়া ভ্রমণ করবে এবং মক্কা ও মদীনা ব্যতীত সব স্থানেই প্রবেশ করবে, সে জন্য তাকে মাসীহ অর্থাৎ অধিক ভ্রমণকারী বলা হয়।’ (ইবনে বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট: ফাতওয়া নং ১৩১১৩ লিসানুল আরাব, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৯৪-৫৯৮)

মাসীহ দাজ্জাল (المسيح الدجل) দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। প্রথম শব্দ মাসীহ, আরবি মাসাহা (مَسَحَ) থেকে নির্গত। যার ভাবার্থ আশীর্বাদ প্রাপ্ত। আর দাজ্জাল শব্দের অর্থ ধোঁকাবাজ, প্রতারক। একত্রে মাসীহ দাজ্জাল অর্থ দাড়ায় – আশীর্বাদ প্রাপ্ত ধোঁকাবাজ।

মূলত দাজ্জাল হবে শয়তানের (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৪৪২৬) আশীর্বাদ প্রাপ্ত। আল্লাহ শয়তানকে এ সময়ে এমন ক্ষমতা দিবেন যা পুরো সৃষ্টির ইতিহাসে শুধুমাত্র ফেরেশতাদের হাতে ছিল। যেমনঃ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ, ফসল উৎপাদন ইত্যাদি

‘দাজ্জাল’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ভণ্ড, মিথ্যুক, প্রতারক, দুষ্ট।

মূল দজালা মানে মিশ্রিত করা। দাজালা শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর বিষয় এবং অস্পষ্ট এবং অস্পষ্ট হওয়া বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, দাজ্জাল হল সেই ব্যক্তি যে অস্পষ্টভাবে কথা বলে, যে অনেক মিথ্যা বলে এবং অনেক লোককে প্রতারিত করে।

“দাজ্জাল” শব্দটি মিথ্যাবাদী, একচোখা, মিথ্যা মসীহকে দেওয়া একটি উপাধিতে পরিণত হয়েছে। দাজ্জালকে এই জন্য বলা হয় যে, সে তার কুফর লোকদের কাছে মিথ্যা বলে, তাদের সাথে প্রতারণা করে এবং তাদের বিভ্রান্ত করে তাদের কাছ থেকে গোপন করবে।

ইয়াহুদীরা দাজ্জালকে ‘মাসীহ’ এই জন্যই বলে যে, তাদেরকে যে বিপ্লব সৃষ্টিকারী মাসীহের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে এবং যার জন্য তারা এখনো পর্যন্ত ভ্রান্তিময় অপেক্ষায় রয়েছে, দাজ্জাল এই মাসীহর নাম নিয়েই আসবে। অর্থাৎ সে নিজেকে তাদের সেই অপেক্ষিত মাসীহ বলেই প্রকাশ করবে। কিন্তু সে তার এই দাবী সহ অন্যান্য দাবীতে এত বড় প্রতারক ও ধোঁকাবাজ হবে যে, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মধ্যে তার কোন নজির মিলবে না। আর এই জন্য তাকে ‘দাজ্জাল’ অর্থাৎ ভীষণ মিথ্যুক ও ধোঁকাবাজ, বিভ্রান্তিকারী ও প্রতারক বলা হয়। মূলত দাজ্জাল বলতে বুঝায় ছদ্মবেশী মিথ্যাবাদীকে, যে নিরন্তর মিথ্যা বলে মানুষকে ধোঁকা দেয়। (তাফরীরে কুরতুবী ও ফাৎহুল ক্বাদীর, ০৩:৪৯)

কিয়ামতের আলামত  কিয়ামতের বড় আলামত (আব্দুল্লাহ্ শাহেদ আল-মাদানী)

২. দাজ্জালের আগমণ

আখেরী যামানায় কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে মিথ্যুক দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। দাজ্জালের আগমণ কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সবচেয়ে বড় আলামত। মানব জাতির জন্যে দাজ্জালের চেয়ে অধিক বড় বিপদ আর নেই। বিশেষ করে সে সময় যে সমস্ত মুমিন জীবিত থাকবে তাদের জন্য ঈমান নিয়ে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। সমস্ত নবীই আপন উম্মাতকে দাজ্জালের ভয় দেখিয়েছেন। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও দাজ্জালের ফিতনা থেকে সতর্ক করেছেন এবং তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার উপায়ও বলে দিয়েছেন। ইবনে উমার (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেনঃ

قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي النَّاسِ فَأَثْنَى عَلَى اللَّهِ بِمَا هُوَ أَهْلُهُ ثُمَّ ذَكَرَ الدَّجَّالَ فَقَالَ إِنِّي لَأُنْذِرُكُمُوهُ وَمَا مِنْ نَبِيٍّ إِلَّا وَقَدْ أَنْذَرَهُ قَوْمَهُ وَلَكِنِّي سَأَقُولُ لَكُمْ فِيهِ قَوْلًا لَمْ يَقُلْهُ نَبِيٌّ لِقَوْمِهِ إِنَّهُ أَعْوَرُ وَإِنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِأَعْوَرَ

‘‘একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাড়িয়ে আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করলেন। অতঃপর দাজ্জালের আলোচনা করতে গিয়ে বললেনঃ আমি তোমাদেরকে তার ফিতনা থেকে সাবধান করছি। সকল নবীই তাদের উম্মাতকে দাজ্জালের ভয় দেখিয়েছেন। কিন্তু আমি তোমাদের কাছে দাজ্জালের একটি পরিচয়ের কথা বলব যা কোন নবীই তাঁর উম্মাতকে বলেন নাই। তা হলো দাজ্জাল অন্ধ হবে। আর আমাদের মহান আল্লাহ অন্ধ নন। নাওয়াস বিন সামআন (রাঃ) বলেনঃ

ذَكَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الدَّجَّالَ ذَاتَ غَدَاةٍ فَخَفَّضَ فِيهِ وَرَفَّعَ حَتَّى ظَنَنَّاهُ فِي طَائِفَةِ النَّخْلِ قَالَ فَانْصَرَفْنَا مِنْ عِنْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ رَجَعْنَا إِلَيْهِ فَعَرَفَ ذَلِكَ فِينَا فَقَالَ مَا شَأْنُكُمْ قَالَ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ ذَكَرْتَ الدَّجَّالَ الْغَدَاةَ فَخَفَّضْتَ فِيهِ وَرَفَّعْتَ حَتَّى ظَنَنَّاهُ فِي طَائِفَةِ النَّخْلِ قَالَ غَيْرُ الدَّجَّالِ أَخْوَفُ لِي عَلَيْكُمْ إِنْ يَخْرُجْ وَأَنَا فِيكُمْ فَأَنَا حَجِيجُهُ دُونَكُمْ وَإِنْ يَخْرُجْ وَلَسْتُ فِيكُمْ فَامْرُؤٌ حَجِيجُ نَفْسِهِ وَاللَّهُ خَلِيفَتِي عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ

‘‘একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকাল বেলা আমাদের কাছে দাজ্জালের বর্ণনা করলেন। তিনি তার ফিতনাকে খুব বড় করে তুলে ধরলেন। বর্ণনা শুনে আমরা মনে করলাম নিকটস্থ খেজুরের বাগানের পাশেই সে হয়ত অবস্থান করছে। আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নিকট থেকে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা আবার তাঁর কাছে গেলাম। এবার তিনি আমাদের অবস্থা বুঝে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের কি হলো? আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যেভাবে দাজ্জালের আলোচনা করেছেন তা শুনে আমরা ভাবলাম হতে পারে সে খেজুরের বাগানের ভিতরেই রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ দাজ্জাল ছাড়া তোমাদের উপর আমার আরো ভয় রয়েছে। আমি তোমাদের মাঝে জীবিত থাকতেই যদি দাজ্জাল আগমণ করে তাহলে তোমাদেরকে ছাড়া আমি একাই তার বিরুদ্ধে ঝগড়া করবো। আর আমি চলে যাওয়ার পর যদি সে আগমণ করে তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজেকে হেফাযত করবে। আর আমি চলে গেলে আল্লাহই প্রতিটি মুসলিমকে হেফাযতকারী হিসেবে যথেষ্ট’’। তিরমিজী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

দাজ্জালের আগমণের সময় মুসলমানদের অবস্থাঃ

দাজ্জালের আগমণের পূর্ব মুহূর্তে মুসলমানদের অবস্থা খুব ভাল থাকবে। তারা পৃথিবীতে শক্তিশালী এবং বিজয়ী থাকবে। সম্ভবতঃ এই শক্তির পতন ঘটানোর জন্যই দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে।

দাজ্জালের পরিচয়ঃ

দাজ্জাল মানব জাতিরই একজন হবে। মুসলমানদের কাছে তার পরিচয় তুলে ধরার জন্যে এবং তার ফিতনা থেকে তাদেরকে সতর্ক করার জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পরিচয় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। মুমিন বান্দাগণ তাকে দেখে সহজেই চিনতে পারবে এবং তার ফিতনা থেকে নিরাপদে থাকবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার যে সমস্ত পরিচয় উল্লেখ করেছেন মু’মিনগণ তা পূর্ণ অবগত থাকবে। দাজ্জাল অন্যান্য মানুষের তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী হবে। জাহেল-মূর্খ ও হতভাগ্য ব্যতীত কেউ দাজ্জালের ধোঁকায় পড়বেনা।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালকে স্বপ্নে দেখে তার শারীরিক গঠনের বর্ণনাও প্রদান করেছেন। তিনি বলেনঃ দাজ্জাল হবে বৃহদাকার একজন যুবক পুরুষ, শরীরের রং হবে লাল, বেঁটে, মাথার চুল হবে কোঁকড়া, কপাল হবে উঁচু, বক্ষ হবে প্রশস্ত, চক্ষু হবে টেরা এবং আঙ্গুর ফলের মত উঁচু। বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

 দাজ্জাল নির্বংশ হবে। তার কোন সন্তান থাকবেনা’’। মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

দাজ্জালের কোন্ চোখ কানা থাকবে?

বিভিন্ন হাদীছে দাজ্জালের চোখ অন্ধ হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন হাদীছে বলা হয়েছে দাজ্জাল অন্ধ হবে। কোন হাদীছে আছে তার ডান চোখ অন্ধ হবে। আবার কোন হাদীছে আছে তার বাম চোখ হবে অন্ধ। মোটকথা তার একটি চোখ দোষিত হবে। তবে ডান চোখ অন্ধ হওয়ার হাদীছগুলো বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে।বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

মোটকথা দাজ্জালের অন্যান্য লক্ষণগুলো কারো কাছে অস্পষ্ট থেকে গেলেও অন্ধ হওয়ার বিষয়টি কারো কাছে অস্পষ্ট হবেনা।

(অন্য বর্ননায় জানা যায়ঃ উপরের হাদিসগুলো থেকে লক্ষ্য করা যায় বেশিরভাগ তার ডান চোখ অন্ধ বা ত্রুটিযুক্ত হবে বলেছে আবার কোন কোন বর্ণনাতে তার বাম চোখকে অন্ধ বা ত্রুটিযুক্ত বলা হয়েছে। উভয় বর্ণনাই সহিহ। কিছু আলেম এই বর্ণনাগুলো একত্রিত করেছেন। কাদি আইয়াদ বলেছেনঃ “দাজ্জালের উভয় চোখই ত্রুটিপূর্ণ হবে। তার ডান চোখ হবে ক্ষতবিক্ষত (ممسوحة) এবং নিস্তেজ, দেখতে অক্ষম, যেমনটি ইবনে উমরের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আর বাম চোখ এমন হবে যেটি চামড়ার মোটা ভাঁজে ঢাকা থাকবে এবং এটিও ত্রুটিযুক্ত হবে।” সুতারং তার বাম এবং ডান উভয় চোখেই ত্রুটি থাকবে। কারণ হাদিসে ব্যবহৃত আরবি শব্দ (أعْوَرٌ) ত্রুটিযুক্ত যেকোন কিছুকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয় এবং বিশেষকরে চোখ দুর্বল হলে তা বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। মোটকথা তার একচোখ অকার্যকর এবং অন্যটি ত্রুটিযুক্ত হবে।

দাজ্জালের দু’চোখের মাঝখানে কাফের লেখা থাকবেঃ

তাছাড়া দাজ্জালকে চেনার সবচেয়ে বড় আলামত হলো তার কপালে কাফের كافر)) লেখা থাকবে।বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

অপর বর্ণনায় আছে তার কপালে(ك ف ر) এই তিনটি বর্ণ লেখা থাকবে। প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তিই তা পড়তে পারবে।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

 অপর বর্ণনায় আছে শিক্ষিত-অশিক্ষত সকল মুসলিম ব্যক্তিই তা পড়তে পারবে।সহীহ মুসলিম, শরহুন্ নববীর সাথে (১৮/৬১)।

 মোটকথা আল্লাহ মু’মিনের জন্যে অন্তদৃষ্টি খোলে দিবেন। ফলে সে দাজ্জালকে দেখে সহজেই চিনতে পারবে। যদিও ইতিপূর্বে সে ছিল অশিক্ষিত। কাফের ও মুনাফেক লোক তা দেখেও পড়তে পারবেনা। যদিও সে ছিল শিক্ষিত ও পড়ালেখা জানা লোক। কারণ কাফের ও মুনাফেক আল্লাহর অসংখ্য সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ দেখেও ঈমান আনয়ন করেনি।ফাতহুল বারী, (১৩/১০০)।

দাজ্জালের ফিতনাসমূহ ও তার অসারতাঃ

আদম সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির জন্য দাজ্জালের চেয়ে বড় ফিতনা আর নেই। সে এমন অলৌকিক বিষয় দেখাবে যা দেখে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়বে। দাজ্জাল নিজেকে প্রভু ও আল্লাহ হিসেবে দাবী করবে। তার দাবীর পক্ষে এমন কিছু প্রমাণও উপস্থাপন করবে যে সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগেই সতর্ক করেছেন। মু’মিন বান্দাগণ এগুলো দেখে মিথ্যুক দাজ্জালকে সহজেই চিনতে পারবে এবং আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু দুর্বল ঈমানদার লোকেরা বিভ্রান্তিতে পড়ে ঈমান হারা হবে।

দাজ্জাল নিজেকে রব বা প্রভু হিসেবেও দাবী করবে। ঈমানদারের কাছে এ দাবীটি সুস্পষ্ট দিবালোকের মত মিথ্যা বলে প্রকাশিত হবে। দাজ্জাল তার দাবীর পক্ষে যত বড় অলৌকিক ঘটনাই পেশ করুক না কেন মুমিন ব্যক্তির কাছে এটি সুস্পষ্ট হবে যে সে একজন অক্ষম মানুষ, পানাহার করে, নিদ্রা যায় এবং পেশাব-পায়খান করে। সর্বোপরি সে হবে অন্ধ। যার ভিতরে মানবীয় সব দোষ-গুণ বিদ্যমান সে কিভাবে রবব ও আল্লাহ হতে পারে!! একজন সত্যিকার মুমিনের বিশ্বাস হলোঃ মহান আল্লাহ সর্বপ্রকার মানবীয় দোষ-ত্রুটি হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। কোন সৃষ্টজীবই তার মত নয়। আল্লাহকে দুনিয়ার জগতে কোন মানুষের পক্ষে দেখাও সম্ভব নয়।

সহীহ হাদীসের আলোকে দাজ্জাল আবির্ভাবের পূর্বশর্ত সমূহ: জুয়েল মাহমুদ সালাফি

ক্বিয়ামতের দশটি বড় আলামতের অন্যতম আলামত হল দাজ্জালের আবির্ভাব। হুযায়ফাহ ইবনু আসীদ আল-গিফারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদিন আমরা (বিবিধ বিষয়ে) আলোচনা করছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের নিকট আবির্ভূত হলেন এবং প্রশ্ন করলেন, তোমরা কী বিষয়ে আলোচনা করছ? উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ কথা শুনে তিনি বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না তোমরা দশটি বিশেষ আলামত দেখবে। অতঃপর তিনি বর্ণনা করলেন যে, (১) ধুম্র (২) দাজ্জাল (৩) দাব্বাতুল আরয বা ভূমির প্রাণী (৪) পশ্চিমাকাশ হতে সূর্যোদয় হওয়া (৫) মারইয়াম পুত্র ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর অবতরণ (৬) ইয়াজূজ-মাজূজ এবং তিনবার ভূখণ্ড ধ্বসে যাওয়া। যথা: (৭) পূর্ব দিকের ভূখণ্ড ধ্বস (৮) পশ্চিম দিকের ভূখণ্ড ধ্বস (৯) আরব উপদ্বীপে ভূখণ্ড ধ্বস। (১০) এ আলামতসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর এডেনের ভূগর্ভ থেকে এক অগ্নুৎপাতের প্রকাশ ঘটবে, যা তাদেরকে ইয়ামান থেকে হাশরের মাঠ পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।’ (সহীহ মুসলিম, হা/২৯০১, ‘কিতাবুল ফিতান’; আবু দাঊদ, হা/৪৩১১; তিরমিযী, হা/২১৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৮৭ মিশকাত,৫৪৬৪)। অপর বর্ননায় আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ছয়টি লক্ষণ প্রকাশ হওয়ার পূর্বে ভাল ‘আমল অর্জনে তৎপর হও। ১. ধোঁয়া, ২. দাজ্জাল, ৩. দাব্বাতুল আরয (মৃত্তিকাগর্ভ হতে বহির্ভূত জন্তু), ৪. পশ্চিমাকাশ হতে সূর্য উদিত হওয়া, ৫. সর্বগ্রাসী ফিতনাহ্ ও ৬. তোমাদের ব্যক্তিবিশেষের ওপর আরোপিত ফিতনাহ্(সহীহ মুসলিম ১২৮-(২৯৪৭), ইবনু মাজাহ ৪০৫৬, সিলসিলাতুস সহীহাহ ৭৫৯, সহীহুল জামি ৫১২৩, মিশকাত ৫৪৬৫)

(১) যখন আরববাসীরা সংখ্যায় নগণ্য হয়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম হা/২৯৪৫; তিরমিযী হা/৩৯৩০; মুসনাদে আহমাদ হা/২৭৬২০)

(২) মহাযুদ্ধে কুস্তুন্তুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপলের উপর মুসলিম বাহিনীর বিজয় লাভ। (বিস্তারিত দেখুন আবু দাঊদ হা/৪২৯৪; সনদ হাসান, সহীহুল জামে হা/৪০৯৬; মিশকাত হা/৫৪২৪; মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৭২০৯; মুসনাদে আহমাদ হা/২২০২৩; ত্বাবারাণী আল-মুজামুল কাবীর হা/১৬৬৩৮; মুসতাদরাক হাকিম হা/৮২৯৭; সহীহ মুসলিম হা/২৯০০; মুসনাদে আহমাদ হা/১৫৪১; সহীহুল জামে হা/২৯৬৯; মিশকাত হা/৫৪১৯; সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৬৬৭২; ত্বাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১৮০১; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৩৬৯১; সহীহ মুসলিম হা/২৯২০; সহীহুল জামে হা/৩৬৩৮; মুসতাদরাক হাকিম হা/৮৪৬৯; মিশকাত হা/৫৪২৩)

(৩) উদ্ভিদ উৎপাদনের হার ও বৃষ্টি বর্ষণের হার হ্রাস পাবে। (সহীহুল জামে হা/৭৮৭৫, সনদ সহীহ)

(৪) তামীম-আদ-দারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হাদীসে দাজ্জাল আগমনের তিনটি আলামত পাওয়া যায়। (বিস্তারিত দেখুন, সহীহ মুসলিম হা/২৯৪২; আবু দাঊদ হা/৪৩২৫, ৪৩২৬; তিরমিযী হা/২২৫৩; ইবনু মাজাহ হা/৪০৭৪)

দাজ্জাল বর্তমানে কোথায় আছে?

ফাতেমা বিনতে কায়স (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি মসজিদে গমণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সাথে নামায আদায় করলাম। আমি ছিলাম মহিলাদের কাতারে। তিনি নামায শেষে হাসতে হাসতে মিম্বারে উঠে বসলেন। প্রথমেই তিনি বললেনঃ প্রত্যেকেই যেন আপন আপন জায়গায় বসে থাকে। অতঃপর তিনি বললেনঃ তোমরা কি জান আমি কেন তোমাদেরকে একত্রিত করেছি? তাঁরা বললেনঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। অতঃপর তিনি বললেনঃ আমি তোমাদেরকে এ সংবাদ দেয়ার জন্যে একত্রিত করেছি যে তামীম দারী ছিল একজন খৃষ্টান লোক। সে আমার কাছে আগমণ করে ইসলাম গ্রহণ করেছে। অতঃপর সে মিথ্যুক দাজ্জাল সম্পর্কে এমন ঘটনা বলেছে যা আমি তোমাদের কাছে বর্ণনা করতাম। লাখ্ম ও জুযাাম গোত্রের ত্রিশ জন লোকের সাথে সে সাগর পথে ভ্রমণে গিয়েছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার শিকার হয়ে এক মাস পর্যন্ত তারা সাগরেই ছিল। অবশেষে তারা সাগরের মাঝখানে একটি দ্বীপে অবতরণ করলো। দ্বীপের ভিতরে প্রবেশ করে তারা মোটা মোটা এবং প্রচুর চুল বিশিষ্ট একটি অদ্ভুত প্রাণীর সন্ধান পেল। চুল দ্বারা সমস্ত শরীর আবৃত থাকার কারণে প্রাণীটির অগ্রপশ্চাৎ নির্ধারণ করতে সক্ষম হলোনা। তারা বললঃ অকল্যাণ হোক তোমার! কে তুমি? সে বললোঃ আমি সংবাদ সংগ্রহকারী গোয়েন্দা। তারা বললোঃ কিসের সংবাদ সংগ্রহকারী? অতঃপর প্রাণীটি দ্বীপের মধ্যে একটি ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বললোঃ হে লোক সকল! তোমরা এই ঘরের ভিতরে অবস্থানরত লোকটির কাছে যাও। সে তোমাদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তামীম দারী বলেনঃ প্রাণীটি যখন একজন লোকের কথা বললোঃ তখন আমাদের ভয় হলো যে হতে পারে সে একটি শয়তান। তথাপিও আমরা ভীত হয়ে দ্রুত অগ্রসর হয়ে ঘরটির ভিতরে প্রবেশ করলাম। সেখানে প্রবেশ করে আমরা বৃহদাকার একটি মানুষ দেখতে পেলাম। এত বড় আকৃতির মানুষ আমরা ইতিপূর্বে আর কখনও দেখিনি। তার হাত দু’টিকে ঘাড়ের সাথে একত্রিত করে হাঁটু এবং গোড়ালীর মধ্যবর্তী স্থানে লোহার শিকল দ্বারা বেঁধে রাখা হয়েছে। আমরা বললামঃ মরণ হোক তোমার! কে তুমি? সে বললোঃ তোমরা আমার কাছে আসতে সক্ষম হয়েছ। তাই আগে তোমাদের পরিচয় দাও। আমরা বললামঃ আমরা একদল আরব মানুষ নৌকায় আরোহন করলাম। সাগরের প্রচন্ড ঢেউ আমাদেরকে নিয়ে একমাস পর্যন্ত খেলা করলো। অবশেষে তোমার দ্বীপে উঠতে বাধ্য হলাম। দ্বীপে প্রবেশ করেই প্রচুর পশম বিশিষ্ট এমন একটি জন্তুর সাক্ষাৎ পেলাম, প্রচুর পশমের কারণে যার অগ্রপশ্চাৎ চেনা যাচ্ছিলনা। আমরা বললামঃ অকল্যাণ হোক তোমার! কে তুমি? সে বললোঃ আমি সংবাদ সংগ্রহকারী গোয়েন্দা। আমরা বললামঃ কিসের সংবাদ সংগ্রহকারী? অতঃপর প্রাণীটি দ্বীপের মধ্যে এই ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বললোঃ হে লোক সকল! তোমরা এই ঘরের ভিতরে অবস্থানরত লোকটির কাছে যাও। সে তোমাদের নিকট থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তাই আমরা তার ভয়ে তোমার কাছে দ্রুত আগমণ করলাম। হতে পারো তুমি একজন শয়তান- এ ভয় থেকেও আমরা নিরাপদ নই। সে বললোঃ আমাকে তোমরা ‘বাইসান’ সম্পর্কে সংবাদ দাও। আমরা তাকে বললামঃ বাইসানের কি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছো? সে বললোঃ আমি তথাকার খেজুরের বাগান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি। সেখানের গাছগুলো এখনও ফল দেয়? আমরা বললামঃ হ্যঁা। সে বললোঃ সে দিন বেশী দূরে নয় যে দিন গাছগুলোতে কোন ফল ধরবেনা। অতঃপর সে বললোঃ আমাকে বুহাইরাতুত্ তাবারীয়া সম্পর্কে সংবাদ দাও। আমরা তাকে বললামঃ বুহাইরাতুত্ তাবারীয়ার কি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছো? সে বললোঃ আমি জানতে চাই সেখানে কি এখনও পানি আছে? আমরা বললামঃ তথায় প্রচুর পানি আছে। সে বললোঃ অচিরেই তথাকার পানি শেষ হয়ে যাবে। সে পুনরায় বললোঃ আমাকে যুগার নামক ঝর্ণা সম্পর্কে সংবাদ দাও। আমরা তাকে বললামঃ সেখানকার কি সম্পর্কে তুমি জানতে চাও? সে বললোঃ আমি জানতে চাই সেখানে কি এখনও পানি আছে? লোকেরা কি এখনও সে পানি দিয়ে চাষাবাদ করছে? আমরা বললামঃ তথায় প্রচুর পানি রয়েছে। লোকেরা সে পানি দিয়ে চাষাবাদ করছে। সে আবার বললোঃ আমাকে উম্মীদের নবী সম্পর্কে জানাও। আমরা বললামঃ সে মক্কায় আগমণ করে বর্তমানে মদ্বীনায় হিজরত করেছে। সে বললোঃ আরবরা কি তার সাথে যুদ্ধ করেছে? বললামঃ হ্যাঁ। সে বললোঃ ফলাফল কি হয়েছে? আমরা তাকে সংবাদ দিলাম যে, পার্শ্ববর্তী আরবদের উপর তিনি জয়লাভ করেছেন। ফলে তারা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। সে বললঃ তাই না কি? আমরা বললাম তাই। সে বললোঃ তার আনুগত্য করাই তাদের জন্য ভাল। এখন আমার কথা শুন। আমি হলাম দাজ্জাল। অচিরেই আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। আমি বের হয়ে চল্লিশ দিনের ভিতরে পৃথিবীর সমস্ত দেশ ভ্রমণ করবো। তবে মক্কা-মদ্বীনায় প্রবেশ করা আমার জন্য নিষিদ্ধ থাকবে। যখনই আমি মক্কা বা মদ্বীনায় প্রবেশ করতে চাইবো তখনই ফেরেশতাগণ কোষমুক্ত তলোয়ার হাতে নিয়ে আমাকে তাড়া করবে। মক্কা-মদ্বীনার প্রতিটি প্রবেশ পথে ফেরেশতাগণ পাহারা দিবে।

হাদীছের বর্ণনাকারী ফাতেমা বিনতে কায়েস বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতের লাঠি দিয়ে মিম্বারে আঘাত করতে করতে বললেনঃ এটাই মদ্বীনা, এটাই মদ্বীনা, এটাই মদ্বীনা। অর্থাৎ এখানে দাজ্জাল আসতে পারবেনা। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তামীম দারীর হাদীছটি আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছে। তার বর্ণনা আমার বর্ণনার অনুরূপ হয়েছে। বিশেষ করে মক্কা ও মদ্বীনা সম্পর্কে। শুনে রাখো! সে আছে সাম দেশের সাগরে (ভূমধ্য সাগরে) অথবা আরব সাগরে। তা নয় সে আছে পূর্ব দিকে। সে আছে পূর্ব দিকে। সে আছে পূর্ব দিকে। এই বলে তিনি পূর্ব দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন। ফাতেমা বিনতে কায়েস বলেনঃ ‘‘আমি এই হাদীছটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নিকট থেকে মুখস্থ করে রেখেছি’’।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

আবু বকর সিদ্দীক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, প্রাচ্যের ‘খোরাসান’ অঞ্চল হতে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। এমনসব জাতি তার অনুসরণ করবে, যাদের মুখাবয়ব হবে স্তরবিশিষ্ট ঢালের মত চ্যাপ্টা ও মাংসল।’ (তিরমিযী হা/২২৩৭ ‘কলহ-বিপর্যয়’ অধ্যায়, ‘দাজ্জাল কোথায় থেকে আবির্ভূত হবে’? অনুচ্ছেদ; ইবনু মাজাহ, হা/৪০৭২; মুসনাদে আহমাদ হা/১২, ৩৩; সনদ হাসান সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ হা/১৫৯১)

নাউওয়াস ইবনু ছামআন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, إِنَّهُ خَارِجٌ خَلَّةً بَيْنَ الشَّأْمِ وَالْعِرَاقِ فَعَاثَ يَمِيْنًا وَعَاثَ شِمَالًا يَا عِبَادَ اللهِ فَاثْبُتُوْا

‘সে ইরাক্ব ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী রাস্তা হতে আবির্ভূত হবে। সে ডানে-বামে দুর্যোগ সৃষ্টি করবে। সুতরাং হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা অটল থাকবে।’ (সহীহ মুসলিম হা/২৯৩৭; তিরমিযী হা/২২৪০; ইবনু মাজাহ হা/৪০৭৫; মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৬২৯)

উপরোক্ত হাদীসে মূলত খুরাসানের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, يَخْرُجُ الدَّجَّالُ مِنْ يَهُوْدِيَّةِ أَصْبَهَانَ مَعَهُ سَبْعُوْنَ أَلْفًا مِنَ الْيَهُوْدِ ‘দাজ্জাল আসবাহান বা ইসফাহানের ‘ইয়াহুদিয়্যাহ’ নামক অঞ্চল থেকে বাহির হবে। আর তার সাথে থাকবে সত্তর হাজার ইয়াহুদী। একই অর্থের হাদীস আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতেও বর্ণিত হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ হা/১৩৩৪৪, ২৪৪৬৭, সনদ হাসান; সহীহ মুসলিম হা/২৯৪৪; ফাৎহুল বারী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৪০)

খুরাসান শহরের-ই একটি অঞ্চলের নাম ইসফাহান। হাফিয ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সর্বপ্রথম দা-জ্জাল ইসফাহানের ‘ইয়াহুদিয়্যাহ’ নামক মহল্লা থেকে আবির্ভূত হবে।’ (আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ, পৃ. ৫৯)। হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এই অঞ্চলটি ইয়াহুদী প্রধান হওয়ার কারণেই এটির ‘ইয়াহুদিয়্যাহ’ নামকরণ করা হয়েছে।’ (ফাৎহুল বারী, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৯২, ৩৪০)

শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, শায়খ মাশহূর হাসান সালমান বলেছেন, ‘অসংখ্য সহীহ হাদীস ও আছার থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দাজ্জাল ‘খুরাসান’ এবং ‘ইসফাহান’ থেকে আবির্ভূত হবে এবং তার অবতরণ হবে ‘খুজ’ এবং ‘কিরমান’’ থেকে। আর এ সমস্ত অঞ্চলের সবগুলোই বর্তমানে ইরানে অবস্থিত। নির্দিষ্ট করে সে ‘কুছা’ গ্রামে অবতরণ করবে। বর্তমান সময়ে যেটি ‘ইবরাহীমের টিলা’ বা ‘ইবরাহীমের টিলা পাহাড়’ নামে পরিচিত। কারণ সেখানে একটি সমাধি রয়েছে, যা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর বলে মনে করা হয়।’ (বুলদানুল খিলাফাতিশ শারক্বিয়্যাহ, পৃ. ৯৪-৯৫; মু‘জামুল বুলদান, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৩; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১২৯১৬৪)

▪️দাজ্জাল কোথায় অবস্থান করবে (জুয়েল মাহমুদ সালাফি)।

আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদিন নবী (ﷺ) আমাদের নিকট দাজ্জাল সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করলেন। তিনি তার সম্পর্কে আমাদেরকে যা কিছু বলেছিলেন, তাতে এও বলেছিলেন যে, দাজ্জাল আসবে কিন্তু মদীনার প্রবেশ পথে তার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ থাকবে। সুতরাং সে মদীনার নিকটবর্তী বালুকাময় একটি স্থানে অবতরণ করবে।’ (সহীহ বুখারী হা/১৮৮২, ৭১৩২, সহীহ মুসলিম হা/২৯৩৮)

উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটি এমন একটি বালুকাময় অনুর্বর ভূমি যেখানে লবণাক্ততার কারণে কোন ফসল উৎপন্ন হয় না। আর মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর এটিই বৈশিষ্ট্য। এ জায়গাটি মূলত মদীনা থেকে শামের দিকে অবস্থিত। (ফাৎহুল বারী, ১৩তম খ, পৃ. ১০২)

আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লহ (ﷺ) বলেছেন, অতঃপর হাম্মাদ ইবনু সালামাহ অবিকল বর্ণনা করেছেন। তবে এতে রয়েছে যে, দাজ্জাল এসে ‘জুরুফ’-এর এক অনুর্বর ভূমিতে নামবে এবং এখানেই সে তার তাঁবু বা শিবির স্থাপন করবে। যার ফলে প্রত্যেক মুনাফিক্ব পুরুষ ও মহিলা তার কাছে চলে যাবে।’ (সহীহ মুসলিম হা/২৯৪৩)

উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত ‘জুরুফ’ নামক জায়গা সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জুরুফ’ হলো মদীনা থেকে মোটামুটি তিন মাইল দূরে শামের দিকে যেতে রাস্তার ধারে অবস্থিত একটি জায়গার নাম। (ফাৎহুল বারী, ১৩তম খ-, পৃ. ৯৩)। অর্থাৎ দাজ্জাল যেখানে অবস্থান করবে বা শিবির স্থাপন করবে সে জায়গাটি মদীনা থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে অবস্থিত। অথচ মদীনা থেকে জেরুজালেমের দূরত্ব প্রায় ১.২০০ কিলোমিটার। তাহলে বক্তা কোন গবেষণার ভিত্তিতে বলেছেন যে, দাজ্জাল জেরুজালেম থেকে বিশ্ব পরিচালনা করবে? তবে এ কথা সত্য যে, দাজ্জাল সমগ্র বিশ্ব ভ্রমণ করবে, অবশেষে সে যখন জেরুজালেমে পৌঁছবে, তখন তাকে ঈসা (আলাইহিস সালাম) সেখানেই হত্যা করবেন।

দাজ্জালের যে সমস্ত ক্ষমতা দেখে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়বেঃ

ক) একস্থান হতে অন্য স্থানে দ্রুত পরিভ্রমণঃ

 নাওয়াস বিন সামআন থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দাজ্জালের চলার গতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ ‘‘দ্রুতগামী বাতাস বৃষ্টিকে যেভাবে চালিয়ে নেয় দাজ্জালের চলার গতিও সে রকম হবে’’।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

তিনি আরো সংবাদ দিয়েছেন যে মক্কা ও মদ্বীনা ব্যতীত পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চল সে পরিভ্রমণ করবে। মক্কা ও মদ্বীনার সমস্ত প্রবেশ পথে ফেরেশতাগণ তলোওয়ার হাতে নিয়ে পাহারা দিবে।

খ) দাজ্জালের সাথে থাকবে জান্নাত-জাহান্নামঃ

দাজ্জালের সাথে জান্নাত এবং জাহান্নাম থাকবে। প্রকৃত অবস্থা হবে সম্পূর্ণ বিপরীত। দাজ্জালের জাহান্নামের আগুন প্রকৃতপক্ষে সুমিষ্ট পানি এবং জান্নাত হবে জাহান্নামের আগুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

لَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا مَعَ الدَّجَّالِ مِنْهُ مَعَهُ نَهْرَانِ يَجْرِيَانِ أَحَدُهُمَا رَأْيَ الْعَيْنِ مَاءٌ أَبْيَضُ وَالْآخَرُ رَأْيَ الْعَيْنِ نَارٌ تَأَجَّجُ فَإِمَّا أَدْرَكَنَّ أَحَدٌ فَلْيَأْتِ النَّهْرَ الَّذِي يَرَاهُ نَارًا وَلْيُغَمِّضْ ثُمَّ لْيُطَأْطِئْ رَأْسَهُ فَيَشْرَبَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مَاءٌ بَارِدٌ وَإِنَّ الدَّجَّالَ مَمْسُوحُ الْعَيْنِ عَلَيْهَا ظَفَرَةٌ غَلِيظَةٌ مَكْتُوبٌ بَيْنَ عَيْنَيْهِ كَافِرٌ يَقْرَؤُهُ كُلُّ مُؤْمِنٍ كَاتِبٍ وَغَيْرِ كَاتِبٍ

‘‘দাজ্জালের সাথে যা থাকবে তা আমি অবগত আছি। তার সাথে দু’টি নদী প্রবাহিত থাকবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটিতে সুন্দর পরিস্কার পানি দেখা যাবে। অন্যটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যাবে। যার সাথে দাজ্জালের সাক্ষাৎ হবে সে যেন দাজ্জালের আগুনে ঝাপ দিয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে পান করে। কারণ উহা সুমিষ্ট পানি। তার চোখের উপরে মোটা আবরণ থাকবে। কপালে কাফের লেখা থাকবে। মূর্খ ও শিক্ষিত সকল ঈমানদার লোকই তা পড়তে সক্ষম হবে’’।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

গ) দাজ্জাল মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করবেঃ

 দাজ্জাল তার কর্মকান্ডে শয়তানের সহযোগীতা নিবে। শয়তান কেবল মিথ্যা ও গোমরাহী এবং কুফরী কাজেই সাহায্য করে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ দাজ্জাল মানুষের কাছে গিয়ে বলবেঃ আমি যদি তোমার মৃত পিতা-মাতাকে জীবিত করে দেখাই তাহলে কি তুমি আমাকে প্রভু হিসেবে মানবে? সে বলবে অবশ্যই মানব। এ সুযোগে শয়তান তার পিতা-মাতার আকৃতি ধরে সন্তানকে বলবেঃ হে সন্তান! তুমি তার অনুসরণ কর। সে তোমার প্রতিপালক’’।সহীহুল জামে আস্-সাগীর, হাদীছ নং-৭৭৫২।

 হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই।

ঘ) জড় পদার্থ ও পশুরাও দাজ্জালের ডাকে সাড়া দেবেঃ

দাজ্জালের ফিতনার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করবেন। দাজ্জাল আকাশকে আদেশ দিবে বৃষ্টি বর্ষণ করার জন্যে। আকাশ তার আদেশে বৃষ্টি বর্ষণ করবে। যমীনকে ফসল উৎপন্ন করতে বলবে। যমিন ফসল উৎপন্ন করবে। চতুষ্পদ জন্তুকে ডাক দিলে তারা দাজ্জালের ডাকে সাড়া দিবে। ধ্বংস প্রাপ্ত ঘরবাড়িকে তার নিচে লুকায়িত গুপ্তধন বের করতে বলবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘দাজ্জাল এক জনসমাজে গিয়ে মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনয়নের আহবান জানাবে। এতে তারা ঈমান আনবে। দাজ্জাল তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করার জন্য আকাশকে আদেশ দিবে। আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে, যমিন ফসল উৎপন্ন করবে এবং তাদের পশুপাল ও চতুষ্পদ জন্তুগুলো অধিক মোটা-তাজা হবে এবং পূর্বের তুলনায় বেশী দুধ প্রদান করবে। অতঃপর অন্য একটি জনসমাজে গিয়ে মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনয়নের আহবান জানাবে। লোকেরা তার কথা প্রত্যাখ্যান করবে। দাজ্জাল তাদের নিকট থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসবে। এতে তারা চরম অভাবে পড়বে। তাদের ক্ষেত-খামারে চরম ফসলহানি দেখা দিবে। দাজ্জাল পরিত্যক্ত ভূমিকে তার নিচে লুকায়িত গুপ্তধন বের করতে বলবে। গুপ্তধনগুলো বের হয়ে মৌমাছির দলের ন্যায় তার পিছে পিছে চলতে থাকবে’’।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

ঙ) দাজ্জাল একজন মু’মিন যুবককে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করবেঃ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ দাজ্জাাল বের হয়ে মদ্বীনার দিকে অগ্রসর হবে। যেহেতু মদ্বীনায় দাজ্জালের প্রবেশ নিষেধ তাই সে মদ্বীনার নিকটবর্তর্ী একটি স্থানে অবস্থান করবে। তার কাছে একজন মুমিন লোক গমণ করবেন। তিনি হবেন ঐ যামানার সর্বোত্তম মু’মিন। দাজ্জালকে দেখে তিনি বলবেনঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি সেই দাজ্জাল যার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সাবধান করেছেন। তখন দাজ্জাল উপস্থিত মানুষকে লক্ষ্য করে বলবেঃ আমি যদি একে হত্যা করে জীবিত করতে পারি তাহলে কি তোমরা আমার ব্যাপারে কোন সন্দেহ পোষণ করবে? লোকেরা বলবেঃ না। অতঃপর সে উক্ত মুমিনকে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করবে। এ পর্যায়ে যুবকটি বলবেঃ আল্লাহর শপথ! তুমি যে মিথ্যুক দাজ্জাল- এ সম্পর্কে আমার বিশ্বাস আগের তুলনায় আরো মজবুত হলো। দাজ্জাল তাকে দ্বিতীয়বার হত্যা করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাঁকে হত্যা করতে সক্ষম হবেনা। বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

 মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে উক্ত যুবক দাজ্জালকে দেখে বলবেঃ হে লোক সকল! এটি সেই দাজ্জাল যা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সাবধান করেছেন। অতঃপর দাজ্জাল তার অনুসারীদেরকে বলবেঃ একে ধর এবং প্রহার কর। তাকে মেরে-পিটে যখম করা হবে। অতঃপর দাজ্জাল তাকে জিজ্ঞেস করবে এখনও কি আমার প্রতি ঈমান আনবেনা? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ উক্ত যুবক বলবেনঃ তুমি মিথ্যাবাদী দাজ্জাল। তারপর দাজ্জালের আদেশে তার মাথায় করাত লাগিয়ে দ্বিখন্ডিত করে ফেলবে। দাজ্জাল দু’খন্ডের মাঝ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করবে। অতঃপর বলবেঃ উঠে দাড়াও। তিনি উঠে দাড়াবেন। দাজ্জাল বলবে এখনও ঈমান আনবেনা? তিনি বলবেনঃ তুমি মিথ্যুক দাজ্জাল হওয়ার ব্যাপারে এখন আমার বিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। অতঃপর তিনি বলবেনঃ হে লোক সকল! আমার পরে আর কারো সাথে এরূপ করতে পারবেনা। অতঃপর দাজ্জাল তাকে পাকড়াও করে আবার যবেহ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তার গলায় যবেহ করার স্থানটি তামায় পরিণত হয়ে যাবে। কাজেই সে যবেহ করতে ব্যর্থ হবে। অতঃপর তাঁর হাতে-পায়ে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। লোকেরা মনে করবে তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। অথচ সে জান্নাতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। নবী (ﷺ) বলেনঃ ‘‘এই ব্যক্তি হবে পৃথিবীতে সেদিন সবচেয়ে মহা সত্যের সাক্ষ্য দানকারী’’।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

দাজ্জাল কোথা থেকে বের হবে?

দাজ্জাল বের হওয়ার স্থান সম্পর্কেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা দিয়েছেন। সে পূর্ব দিকের পারস্য দেশ থেকে বের হবে। সে স্থানটির নাম হবে খোরাসান। সেখান থেকে বের হয়ে সমগ্র দুনিয়া ভ্রমণ করবে। তবে মক্কা এবং মদ্বীনায় প্রবেশ করতে পারবেনা। ফেরেশতাগণ সেদিন মক্কা-মদ্বীনার প্রবেশ পথসমূহে তরবারি নিয়ে পাহারা দিবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘পূর্বের কোন একটি দেশ থেকে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে যার বর্তমান নাম খোরাসান’’।তিরমিজী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান, সহীহুল জামে আস্-সাগীর, হাদীছ নং-৩৩৯৮। নিশাপুর, হিরাত, মরো, বালখ এবং পার্শ্ববর্তী কতিপয় অঞ্চলের নাম খোরাসান।

দাজ্জাল মক্কা ও মদ্বীনায় প্রবেশ করতে পারবেনাঃ

সহীহ হাদীছের বিবরণ অনুযায়ী দাজ্জালের জন্যে মক্কা ও মদ্বীনাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। মক্কা ও মদ্বীনা ব্যতীত পৃথিবীর সকল স্থানেই সে প্রবেশ করবে। ফাতেমা বিনতে কায়েস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত দাজ্জালের হাদীছে এসেছে অতঃপর দাজ্জাল বললোঃ আমি হলাম দাজ্জাল। অচিরেই আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। আমি বের হয়ে চল্লিশ দিনের ভিতরে পৃথিবীর সমস্ত দেশ ভ্রমণ করবো। তবে মক্কা-মদ্বীনায় প্রবেশ করা আমার জন্য নিষিদ্ধ থাকবে। যখনই আমি মক্কা বা মদ্বীনায় প্রবেশ করতে চাইবো তখনই কোষমুক্ত তলোয়ার হাতে নিয়ে ফেরেশতাগণ আমাকে তাড়া করবে। মক্কা-মদ্বীনার প্রতিটি প্রবেশ পথে ফেরেশতাগণ পাহারা দিবে’’।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাঃ) বলেছেন: মাসীহে দাজ্জাল পূর্বদিক থেকে আগমন করে মদীনাহ্ মুনাওয়ারায় প্রবেশ করতে চাইবে। এমনকি সে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত পৌছে যাবে। অতঃপর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) তার চেহারা (গতি) সিরিয়ার দিকে ঘুরিয়ে দেবেন এবং সেখানেই সে (ঈসা আলায়হিস সালাম এর হাতে) ধ্বংস হবে। (বুখারীতে নেই, মুসলিম ৪৮৬-(১৩৮০), মুসনাদে আহমাদ ৯১৫৫, আবূ ইয়া’লা ৬৪৫৯, সহীহুল জামি’ ৭৯৯৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৭৭৪, তিরমিযী ২২৪৩, মিশকাত,৫৪৮২)

 সে সময় মদ্বীনা শরীফ তিনবার কেঁপে উঠবে এবং প্রত্যেক মুনাফেক এবং কাফেরকে বের করে দিবে। যারা দাজ্জালের নিকট যাবে এবং তার ফিতনায় পড়বে তাদের অধিকাংশই হবে মহিলা। দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচানোর জন্য পুরুষেরা তাদের স্ত্রী, মা, বোন, কন্যা, ফুফু এবং অন্যান্য স্বজন মহিলাদেরকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখবে।

দাজ্জাল পৃথিবীতে কত দিন থাকবে?

সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছেন দাজ্জাল পৃথিবীতে কত দিন অবস্থান করবে? উত্তরে তিনি বলেছেনঃ সে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। প্রথম দিনটি হবে এক বছরের মত লম্বা। দ্বিতীয় দিনটি হবে এক মাসের মত। তৃতীয় দিনটি হবে এক সপ্তাহের মত। আর বাকী দিনগুলো দুনিয়ার স্বাভাবিক দিনের মতই হবে। আমরা বললামঃ যে দিনটি এক বছরের মত দীর্ঘ হবে সে দিন কি এক দিনের নামাযই যথেষ্ট হবে? উত্তরে তিনি বললেনঃ না; বরং তোমরা অনুমান করে সময় নির্ধারণ করে নামায পড়বে। মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

কারা দাজ্জালের অনুসরণ করবে?

দাজ্জালের অধিকাংশ অনুসারী হবে ইহুদী, তুর্কী এবং অনারব লোক। তাদের অধিকাংশই হবে গ্রাম্য মূর্খ এবং মহিলা। ইহুদীরা মিথ্যুক কানা দাজ্জালের অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী দাজ্জাল হবে তাদের বাদশা। তার নেতৃত্বে তারা বিশ্ব পরিচালনা করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ দাজ্জালের অধিকাংশ অনুসারী হবে ইহুদী এবং মহিলা। মুসনাদে ইমাম আহমাদ। আহমাদ শাকের সহীহ বলেছেন।

তিনি আরো বলেনঃ ‘‘ইস্পাহানের সত্তর হাজার ইহুদী দাজ্জালের অনুসরণ করবে। তাদের সবার পরনে থাকবে সেলাই বিহীন চাদর’’।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

গ্রাম্য অশিক্ষিত লোকেরা মূর্খতার কারণে এবং দাজ্জালের পরিচয় সম্পর্কে তাদের জ্ঞান না থাকার কারণে দাজ্জালের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে তারা ফিতনায় পড়বে। মহিলাদের ব্যাপারটিও অনুরূপ। তারা সহজেই যে কোন জিনিষ দেখে প্রভাবিত হয়ে থাকে।

উম্মু শারীক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: লোকেরা দাজ্জালের (ফিতনাহ থেকে পলায়ন করবে, এমনকি পাহাড়-পর্বতসমূহে গিয়ে আশ্রয় নেবে। উম্মু শারীক (রাঃ) বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! তখন ‘আরব (মুজাহিদীনগণ) কোথায় থাকবেন? তিনি (সা.) বললেন, সংখ্যায় তারা খুবই কম হবে। (সহীহ মুসলিম ১২৫-(২৯৪৫), তিরমিযী ৩৯৩০, সহীহুল জামি ৫৪৬১, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬৭৯৭, মিশকাত ৫৪৭৭)

দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচার উপায়ঃ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের ফিতনা হতে রেহাই পাওয়ার উপায়ও বলে দিয়েছেন। তিনি উম্মাতকে একটি সুস্পষ্ট দ্বীনের উপর রেখে গেছেন। সকল প্রকার কল্যাণের পথ প্রদর্শন করেছেন এবং সকল অকল্যাণের পথ হতে সতর্ক করেছেন। উম্মাতের উপরে যেহেতু দাজ্জালের ফিতনা সবচেয়ে বড় তাই তিনি দাজ্জালের ফিতনা থেকে কঠোরভাবে সাবধান করেছেন এবং দাজ্জালের লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। যাতে মুমিন বান্দাদের জন্য এই প্রতারক, ধোকাবাজ ও মিথ্যুক দাজ্জালকে চিনতে কোনরূপ অসুবিধা না হয়।

ইমাম সাফারায়েনী (রঃ) বলেনঃ প্রতিটি বিজ্ঞ মুসলিমের উচিৎ তার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী-পরিবার এবং সকল নারী-পুরুষদের জন্য দাজ্জালের হাদীছগুলো বর্ণনা করা। বিশেষ করে ফিতনায় পরিপূর্ণ আমাদের বর্তমান যামানায়। দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচার উপায়গুলো নিম্নরূপঃ-

১) ইসলামকে সঠিকভাবে আঁকড়িয়ে ধরাঃ

 ইসলামকে সঠিকভাবে আঁকড়িয়ে ধরা এবং ঈমানের উপর অটল থাকাই দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। যে মুমিন আল্লাহর নাম ও তাঁর অতুলনীয় সুমহান গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে সে অতি সহজেই দাজ্জালকে চিনতে পারবে। সে দেখতে পাবে দাজ্জাল খায় পান করে। মু’মিনের আকীদা এই যে, আল্লাহ তাআলা পানাহার ও অন্যান্য মানবীয় দোষ-গুণ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। যে পানাহারের প্রতি মুখাপেক্ষী সে কখনও আল্লাহ বা রবব হতে পারেনা। দাজ্জাল হবে অন্ধ। আল্লাহ এরূপ দোষ-ত্রুটির অনেক উর্ধে। আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অধিকারী মুমিনগণের মনে প্রশ্ন জাগবে যে নিজের দোষ থেকে মুক্ত হতে পারেনা সে কিভাবে প্রভু হতে পারে? মুমিনের আকীদা এই যে, আল্লাহকে দুনীয়ার জীবনে দেখা সম্ভব নয়। অথচ মিথ্যুক দাজ্জালকে মুমিন-কাফের সবাই দুনিয়াতে দেখতে পাবে।

২) দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করাঃ

আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ ‘‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযের ভিতরে দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাইতে শুনেছি’’।বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

 তিনি নামাযের শেষ তাশাহুদে বলতেনঃ

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ عَذَابِ النَّارِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ

‘‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব, জাহান্নামের আযাব, জীবন-মরণের ফিতনা এবং মিথ্যুক দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই’’।বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল জানায়েয।

৩) দাজ্জাল থেকে দূরে থাকাঃ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের নিকট যেতে নিষেধ করেছেন। কারণ সে এমন একজন লোকের কাছে আসবে, যে নিজেকে ঈমানদার মনে করবে। দাজ্জালের কাজ-কর্ম দেখে সে বিভ্রান্তিতে পড়ে ঈমান হারা হয়ে যাবে। মু’মিনের জন্য উত্তম হলো সম্ভব হলে সে সময়ে মদ্বীনা অথবা মক্কায় বসবাস করার চেষ্টা করা। কারণ দাজ্জাল তথায় প্রবেশ করতে পারবেনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি দাজ্জাল বের হওয়ার কথা শুনবে সে যেন তার কাছে না যায়। আল্লাহর শপথ! এমন একজন লোক দাজ্জালের নিকটে যাবে যে নিজেকে ঈমানদার মনে করবে। অতঃপর সে দাজ্জালের সাথে প্রেরিত সন্দেহময় জিনিষগুলো ও তার কাজ-কর্ম দেখে বিভ্রান্তিতে পড়ে ঈমান হারা হয়ে তার অনুসারী হয়ে যাবে। হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই।

৪) সূরা কাহাফ পাঠ করাঃ

 নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের ফিতনার সম্মুখিন হলে মুমিনদেরকে সূরা কাহাফ মুখস্থ করতে এবং তা পাঠ করতে আদেশ করেছেন। তিনি বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ করবে সে দাজ্জালের ফিতনা হতে হেফাযতে থাকবে’’।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

সূরা কাহাফ পাঠের নির্দেশ সম্ভবতঃ এজন্য হতে পারে যে, এই সূরায় আল্লাহ তাআলা বিস্ময়কর বড় বড় কয়েকটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মুমিন ব্যক্তি এগুলো গভীরভাবে পাঠ করলে দাজ্জালের বিস্ময়কর ঘটনা দেখে কিছুতেই বিচলিত হবেনা। এতে সে হতাশ হয়ে বিভ্রান্তিতেও পড়বেনা।

দাজ্জালের শেষ পরিণতিঃ

সহীহ হাদীছের বিবরণ অনুযায়ী ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ)এর হাতে দাজ্জাল নিহত হবে। বিস্তারিত বিবরণ এই যে, মক্কা-মদ্বীনা ব্যতীত পৃথিবীর সকল দেশেই সে প্রবেশ করবে। তার অনুসারীর সংখ্যা হবে প্রচুর। সমগ্র দুনিয়ায় তার ফিতনা ছড়িয়ে পড়বে। সামান্য সংখ্যক মু’মিনই তার ফিতনা থেকে রেহাই পাবে। ঠিক সে সময় দামেস্ক শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এক মসজিদের সাদা মিনারের উপর ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। মুসলমানগণ তার পার্শ্বে একত্রিত হবে। তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি দাজ্জালের দিকে রওনা দিবেন। দাজ্জাল সে সময় বায়তুল মাকদিসের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। অতঃপর ঈসা (আঃ) ফিলিস্তীনের লুদ্দ শহরের গেইটে দাজ্জালকে পাকড়াও করবেন। ঈসা (আঃ)কে দেখে সে পানিতে লবন গলার ন্যায় গলতে শুরু করবে। ঈসা (আঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলবেনঃ ‘‘তোমাকে আমি একটি আঘাত করবো যা থেকে তুমি কখনও রেহাই পাবেনা।’’ ঈসা (আঃ) তাকে বর্শা দিয়ে আঘাত করবেন। অতঃপর মুসলমানেরা তাঁর নেতৃত্বে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। মুসলমানদের হাতে দাজ্জালের বাহিনী ইহুদীর দল পরাজিত হবে। তারা কোথাও পালাবার স্থান পাবেনা। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবেঃ হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবেঃ হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদীদেরকে গোপন করার চেষ্টা করবে। কেননা সেটি ইহুদীদের বৃক্ষ বলে পরিচিত।নেহায়া, আল-ফিতান ওয়াল মালাহিম, (১/১২৮-১২৯)

সহীহ মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

(لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُقَاتِلَ الْمُسْلِمُونَ الْيَهُودَ فَيَقْتُلُهُمُ الْمُسْلِمُونَ حَتَّى يَخْتَبِئَ الْيَهُودِيُّ مِنْ وَرَاءِ الْحَجَرِ وَالشَّجَرِ فَيَقُولُ الْحَجَرُ أَوِ الشَّجَرُ يَا مُسْلِمُ يَا عَبْدَ اللَّهِ هَذَا يَهُودِيٌّ خَلْفِي فَتَعَالَ فَاقْتُلْهُ إِلَّا الْغَرْقَدَ فَإِنَّهُ مِنْ شَجَرِ الْيَهُودِ)

‘‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবেনা যতক্ষণ না মুসলমানেরা ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ করবে। অতঃপর মুসলমানগণ ইহুদীরকে হত্যা করবে। ইহুদীরা গাছ ও পাথরের আড়ালে পালাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু কেউ তাদেরকে আশ্রয় দিবেনা। গাছ বা পাথর বলবেঃ হে মুসলমান! হে আল্লাহর বান্দা! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা করো। তবে ‘গারকাদ’ নামক গাছের পিছনে লুকালে গারকাদ গাছ কোন কথা বলবেনা। এটি ইহুদীদের গাছ বলে পরিচিত’’।সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।

সূরা কাহফের সাথে দাজ্জালের ফিতনার সম্পর্ক  কি তা বুঝা প্রয়োজন।

এইক্ষেত্রে যে ৪ ধরনের ফিতনা বুঝা যাচ্ছে তা হলো

১। ইমান বা দ্বীনকে ছিনিয়ে নেয়া অর্থাৎ ঈমানের উপর পরীক্ষা। দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করেই মানুষকে আদেশ করবে, তারা যেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে তার ইবাদত করে। তাকে প্রভু বলে মেনে নেয়। ঈমানের উপর এটি অনেক বড় পরীক্ষা।

২। সম্পদের উপর পরীক্ষা। দাজ্জাল ধন-সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থিত হবে। মানুষকে ধন-সম্পদের ফেতনায় ফেলবে। ফলে মানুষ সম্পদের লোভে পরে ঈমানহীন হয়ে যাবে।

৩। জ্ঞানের উপর পরীক্ষা। আল্লাহ এর মাধ্যমে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন দাজ্জালের সময়ে মানুষ শুধু বাহ্যিক জ্ঞানকেই অর্থাৎ চর্মচক্ষুর পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক বস্তুবাদী জ্ঞানকেই শুধু মূল্যায়ন করবে, আর অন্তর্চক্ষুর অন্ধত্বের ফলে অন্তর্জ্ঞানহীন হয়ে গিয়ে অন্ধ আর দাজ্জালের মতোই এক চোখা (ম্যাটেরিয়ালিস্টিক) হয়ে যাবে। সত্য মিথ্যা আলাদা করতে পারবে না।

৪। ক্ষমতার উপর পরীক্ষা। দাজ্জাল পৃথিবীতে এসে তার ক্ষমতা দেখাবে

 

৪টা মাত্র ঘটনা। মাত্র এই ৪টা ঘটনা দিয়েই আল্লাহ বুঝিয়ে দিয়েছেন দাজ্জালের সময়ে (অর্থাৎ সম্ভবত বর্তমান সময়েই) আমাদের কী নিয়ে ভাবা উচিৎ এবং কী করা উচিৎ!

এক প্রথম ঘটনায় (আয়াত নং ৯-২৬) বুঝিয়ে দিয়েছেন ঈমান রক্ষার জন্যে দু’আ করতে হবে। দরকার হলে ঈমান রক্ষায় সব বস্তু ফেলে ছুঁড়ে চলে যেতে হবে দূরে কোথাও। সবার আগে ঈমান। এই ঈমান রক্ষায় সঙ্গী-সাথীর গুরুত্বও অপরিসীম। এমন বন্ধু-সাথী যারা বিশ্বাসে-কাজে নিজেরা সচেতন, সাথীর বিশ্বাস-কার্যে সাহায্য-স্মরণিকাতেও জাগ্রত। একা একা থাকার মাধ্যমে পরাজিত না হয়ে এইরকম আধ্যাত্মিকতায় সচেতন সাথীদের সঙ্গের মাধ্যমে অশুভ ঋণাত্মক শক্তির বিরুদ্ধে নিজ নিজ বিশ্বাস-কর্মের সংরক্ষণে সদা-তৎপর থাকা একসাথে আল্লাহর আশ্রয় আর রাহমাত প্রার্থনা করে স্থান-সময়ের তথাকথিত বাস্তবতার বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন এই হচ্ছে প্রথম ঘটনার শিক্ষা।

এছাড়াও সময় আপেক্ষিক (ফলে, স্থানও)! সময়ের স্রষ্টা যিনি, তিনি সময়ের আপক্ষিকতার কথা পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন এই ঘটনার মাধ্যমে আজ হতে আরো দেড় হাজার বছর আগে। আইনস্টাইনেরও প্রায় ১৩০০ বছর আগে।

এই ঘটনায় পরিস্কারভাবেই আল্লাহ বুঝিয়ে দিয়েছেন যে একই বস্তু (যেমন দাজ্জাল) অস্তিত্বে আসার পরেও সময়ের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় অবস্থান করা সম্ভব। এমনকি অনেক বিশাল সময় পার করার পরে আমাদের মাত্রায় আত্মপ্রকাশ করে আবার দেখা দেওয়াও সম্ভব। অর্থাৎ দাজ্জাল যদি এই মূহুর্তে অস্তিত্বে থেকে থাকে, আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তবু তাকে আমরা দেখবো না। কারণ সে রয়েছে সময়ের অন্য মাত্রায়, যেখানে তার একটা সময়কাল আমাদের এক হাজার সময়কালের সমান হতে পারে। যখন আমাদের এক দিন, তার একদিনের সমান হবে তখনই তাকে আমরা দেখবো। এর আগে নয়। [দাজ্জালের সময় সংক্রান্ত হাদীসসমূহের বিশ্লেষণ দ্রষ্টব্য]

দুই দ্বিতীয় ঘটনায় (আয়াত নং ৩২-৪৪) আল্লাহ আমাদের সামনে এক ধনী আর এক গরীবের কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের অন্তরের অবস্থাকে তুলে ধরেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন সত্যিকারের সফলতা কোনটা আর আমাদের অন্তরটা কার মতো হওয়া উচিৎ।

উল্লেখ্য যে ধনী ব্যক্তিটি (বর্তমান সমাজের মানুষগুলোর মতোই) নিজের ধন সম্পদ তথা বস্তু-সামগ্রীকেই সফলতা মনে করেছিলো নিজেকে সফল মনে করেছিলো। পরবর্তীতে সে সব কিছু হারায়, সব ধ্বংস হয়ে যায়। আমাদেরও তাই এখুনি সাবধান হওয়া উচিৎ। দাজ্জালের দেখানো সফলতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে সত্যিকারের সফলতাকে চিনে নেয়া উচিৎ। সেইভাবেই জীবন যাপন করা উচিৎ। নচেৎ পরিণতি হবে ধনী মানুষটার মতোই ভয়ংকর।

খেয়াল করলে দেখবো ধনী ব্যক্তিটি মুখে আল্লাহকে প্রতিপালক বললেও তার অন্তরে প্রতিপালক হিসেবে স্থান ছিলো নিজের ধন-সম্পদ আর বস্তুসামগ্রীর জন্য (যেমন বাগান)। সে কিন্তু মূর্তি পূজা করতো না সরাসরি, অথচ খুঁটিয়ে ভাবলেই ধরতে পারবো যে তার চরম ভালবাসা, আনুগত্য, আগ্রহ আর পরম মনোযোগের জায়গাটা ছিলো বস্তুর (তথা বাগানের) জন্য, যা কিনা কেবলই ইলাহের জন্য হওয়ার কথা! মুখে ইলাহ আর প্রতিপালক হিসেবে আল্লাহর কথা বললেও তার অন্তরে কিন্তু ইলাহের জায়গায় স্রষ্টার স্থান ছিলো না, ছিলো সৃষ্টির। আল্লাহ শাস্তি হিসেবে তার বাগান ধ্বংস করে দেয়ার পর তাই ৪২ নং আয়াতের শেষাংশে তার মন্তব্য পড়লে অবাক হতেই হবে। ভাবনায় হাবুডুবু খেতে খেতে নিজেকেও এই প্রশ্নটা করলে ধরা খেয়ে যেতে হবে:

আমি তাহলে আমার রাব্বের সাথে কী কী শরীক করি?

ঘটনাটা বুঝলে, প্রশ্নটার উত্তর নিয়ে ভাবতে জানলে, করুণ আর ক্রমাগত পরীক্ষার এই সময়ে নিজের ঈমান-তাওহীদের ভঙ্গুর অগভীর আলোহীন বুঝ নিয়ে কান্নায়-আফসোসে ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। তবে এই ব্যাপারটা আসলে খুব বেশি মানুষ বুঝে হজম করতে পারবে না, এটাও একটা শঙ্কা!

“শেষ সময়ে মানুষ সকালে সন্ধ্যায় ঈমান হারা হবে, কিন্তু বুঝতেও পারবে না”- এই কথাটার মানে কি এখন কিছুটা হলেও ধরতে পারছি আমরা? অন্তত নিজের অজ্ঞতাকে চেনার মাধ্যমে হলেও? আমি কি সত্যিই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো যে ঈমান কী জিনিস, তাওহীদ কী জিনিস তা আমি ঠিকঠাক বুঝে নিয়েছি গভীরভাবে, যেভাবে প্রথম প্রজন্মের মানুষগুলো বুঝে নিয়েছিলেন?

তিন  তৃতীয়  ঘটনাটা (আয়াত নং ৬০-৮২) নবী মুসা (আ) এর সাথে একজন প্রজ্ঞাবান জ্ঞানী ব্যক্তির কথোপকথন নিয়ে। মুসা (আ) নিজের বাহ্যিক জ্ঞান আর দৃষ্টি দিয়েই সবকিছু বিচার করতেন। এবং ভাবতেন তিনি অনেক জ্ঞানী। তাই উনার ভুল ভাঙ্গাতে উনাকে এক জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে আল্লাহ দেখা করতে বলেন। সেই প্রজ্ঞাবান জ্ঞানী ব্যক্তি যাই করেন, মুসা (আ) এর কাছে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাই ভুল মনে হয়। শেষে জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের কাজগুলোর ব্যাখ্যা মুসাকে (আ) বুঝিয়ে বলেন। হতভম্ব মুসা (আ) বুঝতে পারেন বাহ্যিক জ্ঞানের পাশাপাশি অন্তর্জ্ঞান না থাকলে ভ্রান্তি আর সত্যের ফারাক বুঝা যায় না কখনোই।

এই ঘটনার সাথে দাজ্জালের সম্পর্কটা কী? আল্লাহ এর মাধ্যমে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন দাজ্জালের সময়ে মানুষ শুধু বাহ্যিক জ্ঞানকেই অর্থাৎ চর্মচক্ষুর পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক বস্তুবাদী জ্ঞানকেই শুধু মূল্যায়ন করবে, আর অন্তর্চক্ষুর অন্ধত্বের ফলে অন্তর্জ্ঞানহীন হয়ে গিয়ে অন্ধ আর দাজ্জালের মতোই এক চোখা (ম্যাটেরিয়ালিস্টিক) হয়ে যাবে। সত্য মিথ্যা আলাদা করতে পারবে না। তাই অন্তর্জ্ঞান থাকাটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সবচাইতে সরাসরি বিশুদ্ধ জ্ঞানের উৎসে (তথা আল-কুরআনে) ফিরে যাওয়া, নিজের ঈমান রক্ষার জন্যে, খাঁটিটা চেনার জন্যে।

চার সর্বশেষ অর্থাৎ চতুর্থ ঘটনায় (আয়াত নং ৮৩-৯৯) যুলকারনাইনের ঘটনা বর্ণিত আছে। আল্লাহর আদেশে যুলকারনাইন ইয়াজুজ মাজুজ নামক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী আর ভয়ংকর এক জাতিকে বিশাল এক দেয়াল তৈরী করে, সেই দেয়াল দিয়ে ঘিরে বন্দী করে ফেলেছিলেন এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলেন,

এ আমার রবের অনুগ্রহ। কিন্তু যখন আমার রবের প্রতিশ্রুতির নির্দিষ্ট সময় আসবে তখন তিনি একে ধুলিস্মাৎ করে দেবেন আর আমার রবের প্রতিশ্রুতি সত্য। (আয়াত নং ৯৮)

শেষ সময়ে একটা ভয়ংকর জাতির আবির্ভাব ঘটার বিশদ বর্ণণা আমরা হাদীসে পাই যারা পুরো পৃথিবীতে যুদ্ধ, রক্ত আর অশান্তির বন্যা বইয়ে দেবে। মারা যাবে অসংখ্য নিরাপরাধ প্রাণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে গণণা শুরু করলে বর্তমান পর্যন্ত চালু থাকা সেই ধ্বংসযজ্ঞ পর্যবেক্ষণ করলে ভবিষ্যত ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে হালকা-পাতলা কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

বাঁচতে হলে আমাদেরকে ফিরে আসতে হবে গুহাবাসীদের মতোই, দলেবলে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হবে আল্লাহর কাছেই। সেটাই সুরা কাহাফে আল্লাহ শিখিয়ে দিয়েছেন।

বলে দিয়েছেন, বাঁচতে হলে, সফল হতে হলে কর্ম করতে হবে, জীবনটাকে যাপন করতে হবে, দেখতে শিখতে হবে, ভাবতে-বুঝতে হবে আল-কুরআনের বর্ণিত পথেই। ফিরতে হবে আল-কুরআনের দিকেই। এরই ইঙ্গিত আছে এই সুরার একদম শুরুতে এবং সবার শেষে (আয়াত নং ১-৮ এবং ১০৩-১১০)।

সাধারণভাবে এই সুরাকে সবাই ৪টি গল্পের সমষ্টি হিসাবেই বলে থাকে। হ্যাঁ, বেশ উল্লেখ্যযোগ্য ৪টি কাহিনী এখানে আছে কিন্তু আসলে তার সাথে সাথে আরো ৪টি অংশ রয়েছে যাতে রয়েছে আমাদের জন্য আল্লাহর কিছু উপদেশ বা দিক নির্দেশনা। তাই সুরাটাকে আসলে মোটামুটি ৮ টি ভাগে ভাগ করা যায়।

আল্লাহর উপদেশ/ দিক নির্দেশনা

আয়াত ১-৯

এই পার্থিব দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ীত্ব বিষয়ে, আমরা যেন এই দুনিয়ার সৌন্দর্যে আসল সত্যটা ভুলে না যাই যে আল্লাহ্‌ তায়ালা একসময় এই দুনিয়াকে ধু ধু প্রান্তরে পরিণত করবেন, তিনি দুনিয়া বানিয়েছেন যাতে আমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন, কে আমাদের মাঝে কর্মে শ্রেষ্ঠ।

কাহিনী

আয়াত ১০-২৬

গুহাবাসী যুবকদের গল্প, যাদের আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন সহায় ছিল না, শুধু ছিল আল্লাহর প্রতি ঈমান, আর সেটার উপর ভরসা করে তারা অত্যাচারী শাসকের জায়গা থেকে পালিয়ে গেল, আর আল্লাহ্‌ তাদেরকে নিদর্শন হিসাবে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন তিনশ নয় বছরের জন্য।চ

আল্লাহর উপদেশ/ দিক নির্দেশনা

আয়াত ২৭-৩১

এই জায়গায় প্রথমেই আবার সেই দুনিয়াবি মোহে যেন বিশ্বাসীরা আসক্ত না হয়ে পড়ে সেই কথা এসেছে। তারপর বলা হচ্ছে এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার পরীক্ষায় যারা সফল হবে তাদের জন্য কি থাকবে আর যারা ব্যর্থ হবে তাদের জন্য কি শাস্তি রয়েছে।

কাহিনী

আয়াত ৩২-৪৩

এরপর আসছে দুইটি সমৃদ্ধ বাগানের মালিকের কথা যে কিনা তার প্রতিবেশী, তুলনামূলক ভাবে দুর্বল্‌ এর সাথে বড়াই করছিল তার সম্পদ নিয়ে। কিন্তু আল্লাহ তার সেই বড়াই এক লহমায় ধুলিস্যাৎ করে দেন তার বাগান ধ্বংস করে দেন। আর সেও তখন তার ভুল বুঝতে পারে এবং আল্লাহর কাছেই সাহায্য চায়।

এই চারটি অংশের মাঝে যোগ সুত্র

দুইটা কাহিনীর মাঝে যেমন সুন্দর একটি যোগসূত্র রয়েছে তেমনি রয়েছে দুইটি উপদেশের মাঝেও। যেমন উপদেশ দুইটির মাঝে আল্লাহ্‌ আমাদেরকে বস্তুবাদ বা ভোগবাদে আসক্ত না হয়ে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নেবার দিকেই মনোযোগ দিতে বলছেন।

এখানে বলে রাখা দরকার যে বস্তুবাদটা কি? বস্তুবাদ যে শুধু দুনিয়ার জীবনে আসক্তি তাই নয় বস্তুবাদ মানে এটা মনে করা যে সম্পদ, প্রাচুর্য এগুলো দিয়েই সব সম্ভব।

এখন আসা যাক দুইটি কাহিনীর দিকে। ভাল করে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে এই কাহিনী গুলোতেও মূলত আল্লাহ্‌ সেই বস্তবাদেরই দুইটি দিক তুলে ধরেছেন। যেমন গুহাবাসীর কথা, তাদের দুনিয়াবী কোন সহায় ছিল না, তাই যদি বস্তবাদের দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয় তাহলে তারা একদমই ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু তারপর আল্লাহ্‌ তাদেরকে বাঁচিয়েছেন। অন্যদিকে বাগানের মালিক, আপাত দৃষ্টিতে দেখলে তার দুনিয়াবি সবই ছিল, সম্পদ, লোকবল, কিন্তু তারপরও দিনশেষে সেই হয়ে গেল ক্ষতিগ্রস্ত।

এই থেকে যা আমরা শিখতে পারি যে তা হল যদি আমার কিছু নাও থাকে তাহলে এমন ভাবার কিছু নেই যে হায় আমার কিছু নাই, বরং আমার আল্লাহ্‌ আমার সাথে আছেন। অন্যদিকে যদি আমার সব কিছু থাকে তাহলেও ভাবার কিছু নেই যে আহা আমি কত বড়, বরং আল্লাহ্‌ তা যেকোন সময় আমার থেকে কেড়ে নিতে পারেন।

এবার যাওয়া যাক সুরার দ্বিতীয় অংশে

আল্লাহর উপদেশ/ দিক নির্দেশনা

আয়াত ৪৪-৫৯

এতে রয়েছে কিয়ামতের দিনের বর্ননা।

কাহিনী

আয়াত ৬০-৮২

মুসা (আঃ) এর কাহিনী যখন উনি আল খিদর এর সাথে বের হয়েছিলেন জ্ঞান অর্জনের জন্য, আর খিদর উনাকে বলেছিলেন যে তাঁর সাথে থাকতে হলে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। তার পর উনি তিনটি ঘটনার সম্মুখীন হন আর মুসা(আঃ) এর কাছে ঘটনা তিনটিই অত্যন্ত খারাপ বা অন্যায় মনে হয়েছিল। পরে খিদর মুসা (আ) কে ব্যাখ্যা করেন যে ঘটনাগুলোর পেছনের কারণ কি।

কাহিনী

আয়াত ৮৩-৯৯

যুলকারনাইন এর ঘটনা। তিনি তিনটি জায়গায় পৌছেছিলেন এবং সেসব জায়গায় ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চান।

আল্লাহর উপদেশ/ দিক নির্দেশনা

আয়াত ১০০-১১০

এতে রয়েছে কিয়ামতের দিনের বর্ননা।

এই চারটি অংশের মাঝে যোগ সুত্রঃ

লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে প্রথম এবং শেষ অংশটুকু রয়েছে দুইখানেই কিয়ামতের দিনের বর্ণনা রয়েছে। আর দুইটি কাহিনীর মাঝে মিলটা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, দুই ক্ষেত্রেই, মুসা (আঃ) এবং যুলকারনাইন, দুইজনেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার পক্ষে, কিন্তু একজনের কাছে ক্ষমতা ছিল না (মুসা (আঃ)) আর আরেকজনের কাছে তা ছিল। যেই শিক্ষাটা আল্লাহ আমাদেরকে দিতে চাচ্ছেন তা হল হতে পারে যে কখনও কখনও আমাদের কাছে হয়তো ক্ষমতা নাও থাকতে পারে সঠিক কাজটা করার জন্য। আবার আপাত দৃষ্টিতে যেটা সঠিক বলে মনে হচ্ছে না সেটা হয়তো আল্লাহর বড় কোন পরিকল্পনার একটি অংশ যা অনুধাবন করার সামর্থ্য আমাদের নেই।

সব মিলিয়ে যেটা বলা যায় এই সুরাতে আল্লাহ আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন যে দুনিয়াবী জীবন, ঘটনাবলী এগুলোর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে। ক্ষমতা থাকাই সবসময় ভাল সেটা যেমন নয় তেমনি ক্ষমতা না থাকাটাও কোন অভিশাপ নয়। যদি কারো সেটা থেকে থাকে তাহলে তাকে সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। আর যদি না থেকে থাকে তাহলেও বুঝতে হবে যে এই না থাকার পেছনে কোন কারণ আছে। দিনশেষে একজন মুসলিমের একমাত্র ভরসার জায়গা হচ্ছে আল্লাহ্‌তায়ালা। আর দাজ্জালের যেই ধারণা হাদিস থেকে পাওয়া যায় তাতে দাজ্জাল এমন একজন ব্যক্তি যে কিনা মানুষকে দুনিয়াবী জিনিসপত্র দিয়ে প্রলুব্ধ করবে যে মানুষের কাছে মনে হবে সেই সকল ক্ষমতার অধিকারী। এই সুরা একজন মুসলিমকে সেই মোহ থেকে রক্ষা করবে কারণ সে যখন সুরার শিক্ষাগুলো বুঝতে পারবে সে আর দুনিয়াবী মোহে তখন আকৃষ্ট থাকবে না।

সংগ্রহঃ

তাফসিরে যাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন,

https://islamqa.info/en          https://islamqa.info/bn

https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=21&chapter=3111

https://www.muslimmedia.info/2022/04/01/the-emerge-of-dajjal-and-the-city-of-lod-in-isreal)

সূরা কাহফ এর গঠন