أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
১০ : ৮৩ فَمَاۤ اٰمَنَ لِمُوۡسٰۤی اِلَّا ذُرِّیَّۃٌ مِّنۡ قَوۡمِهٖ عَلٰی خَوۡفٍ مِّنۡ فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَا۠ئِهِمۡ اَنۡ یَّفۡتِنَهُمۡ ؕ وَ اِنَّ فِرۡعَوۡنَ لَعَالٍ فِی الۡاَرۡضِ ۚ وَ اِنَّهٗ لَمِنَ الۡمُسۡرِفِیۡنَ ﴿۸۳﴾
. কিন্তু ফিরআউন এবং তার পরিষদবর্গ নির্যাতন করবে এ আশংকায় মূসার সম্প্রদায়ের এক ছোট্ট নওজোয়ান দল ছাড়া আর কেউ তার প্রতি ঈমান আনেনি। আর নিশ্চয় ফিরআউন ছিল যমীনে পরাক্রমশালী এবং সে নিশ্চয় ছিল সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।
কুরআনের মূল বাক্যে ذُرِّيَّةٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে সন্তান-সন্ততি।ইবনে কাসীর ও অন্যান্যরা ‘তার’ বলতে ফিরআউনকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ ফিরআউনের সম্প্রদায় থেকে কিছু মানুষ ঈমান এনেছিল। এর প্রমাণ হল, বনী ইস্রাঈলরা তো একজন রসূল ও পরিত্রাতার অপেক্ষায় ছিল এবং মূসা (আঃ) রূপে তারা তা পেয়ে গিয়েছিল। আর সেই হিসেবে (কারূন) ছাড়া সকল বনী ইস্রাঈল তাঁর প্রতি ঈমান রাখত। ফলে এটাই সঠিক যে ذُرِّيَّةٌ مِنْ قَوْمِهِ (তার গোত্রের কিছু লোক) থেকে উদ্দেশ্য হল ফিরআউনী সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ, যারা মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিল; তার মধ্যে তার স্ত্রী আসিয়াও ছিলেন।
আয়াত থেকে একটি বিষয় বুঝা যাচ্ছে যে, যারাই তখন ঈমান এনেছিল তারা ছিল অল্প বয়স্ক যুবক। [ইবন কাসীর; সা’দী]
কুরআনের একথা বিশেষভাবে সুস্পষ্ট করে পেশ করার কারণ হচ্ছে এই যে, মক্কার জনবসতিতেও মুহাম্মাদ ﷺ এর সাথে সহযোগিতা করার জন্য যারা এগিয়ে এসেছিলেন তারাও জাতির বয়স্ক ও বয়োবৃদ্ধ লোক ছিলেন না। বরং তারাও সবাই ছিলেন বয়সে নবীন। আলী ইবনে আবী তালেব (রা.), জাফর ইবনে তাইয়ার(রা.), যুবাইর (রা.), তালহা (রা.), সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.), মুসআব ইবনে উমাইর (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) মতো লোকদের বয়স ইসলাম গ্রহণের সময় ২০ বছরের কম ছিল। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), বিলাল (রা.) ও সোহাইবের (রা.) বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিল। আবু উবাদাহ ইবনুল জাররাহ (রা.), যায়েদ ইবনে হারেসাহ (রা.), উসমান ইবনে আফ্ফান (রা.) ও উমর ফারুকের (রা.) বয়স ছিল ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এদের সবার থেকে বেশী বয়সের ছিলেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা.)। তার বয়স ঈমান আনার সময় ৩৮ বছরের বেশী ছিল না। প্রথমিক মুসলমানদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন সাহাবীর নাম আমরা পাই যার বসয় ছিল নবী (সা.) এর চেয়ে বেশী। তিনি ছিলেন হযরত উবাদাহ ইবনে হারেস মুত্তালাবী (রা.)। আর সম্ভবত সাহাবীগণের সমগ্র দলের মধ্যে একমাত্র হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) ছিলেন নবী (সা.) এর সমবয়সী।
আয়াতে مُسْرِفِينَ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, সীমা অতিক্রমকারী। সে সত্যিকার অর্থেই সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। কারণ সে কুফরির সীমা অতিক্রম করেছিল। সে ছিল দাস, অথচ দাবী করল প্রভুত্বের। [কুরতুবী]
১০ : ৮৪ وَ قَالَ مُوۡسٰی یٰقَوۡمِ اِنۡ كُنۡتُمۡ اٰمَنۡتُمۡ بِاللّٰهِ فَعَلَیۡهِ تَوَكَّلُوۡۤا اِنۡ كُنۡتُمۡ مُّسۡلِمِیۡنَ ﴿۸۴
৮৪. আর মূসা বলেছিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনে থাক, তবে তোমরা তারই উপর নির্ভর কর, যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাক।
বনী ইস্রাঈলগণ ফিরআউনের পক্ষ থেকে যে অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার ছিল, মূসা (আঃ) আসার পরেও তা কম হয়নি, ফলে তিনি বড় চিন্তান্বিত ছিলেন। বরং মূসা (আঃ)-এর সম্প্রদায় তাঁকে এমন কথাও বলে ফেলেছিল যে, হে মূসা! যেমন আমরা আপনার আগমনের পূর্বে ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের নিপীড়নে নিপীড়িত ছিলাম, অনুরূপ আপনার আগমনের পরেও আমাদের একই অবস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতে মূসা (আঃ) তাদেরকে বলেছিলেন, আশা করি যে আমার প্রভু অবিলম্বে তোমাদের শত্রুকে ধ্বংস করে দেবেন। তবে এর জন্য জরুরী যে, তোমরা একমাত্র এক আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর এবং অধৈর্য হয়ো না।
“মূসা তার সম্প্রদায়কে বললেন, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং ধৈর্য ধর; নিশ্চয় যমীন আল্লাহরই। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে তার ওয়ারিশ বানান। আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্যই। তারা বলল, আপনি আমাদের কাছে আসার আগেও আমরা নির্যাতিত হয়েছি এবং আপনি আসার পরও। তিনি বললেন, শীঘ্রই তোমাদের রব তোমাদের শক্রকে ধ্বংস করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে যমীনে স্থলাভিষিক্ত করবেন, তারপর তোমরা কি কর তা তিনি লক্ষ্য করবেন”. (সূরা আ‘রাফ ১২৮-১২৯) এখানেও মূসা (আঃ) তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, যদি তোমরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আনুগত্যশীল হও, তাহলে একমাত্র তাঁরই উপর ভরসা কর।
যারাই আল্লাহর উপর ভরসা করবে আল্লাহ তাদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। [সূরা আয-যুমারঃ ৩৬, সূরা আত-তালাকঃ ৩] আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ঈমান ও ইবাদতের সাথে তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর উপর ভরসা করার জন্য জোর নির্দেশ দিয়েছেন।
وَّ یَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَكَّلۡ عَلَی اللّٰهِ فَهُوَ حَسۡبُهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بَالِغُ اَمۡرِهٖ ؕ قَدۡ جَعَلَ اللّٰهُ لِكُلِّ شَیۡءٍ قَدۡرًا
এবং তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে দান করবেন রিযিাক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ তার ইচ্ছে পূরণ করবেনই; অবশ্যই আল্লাহ সবকিছুর জন্য স্থির করেছেন সুনির্দিষ্ট মা। সূরা আত-তালাকঃ ৩
رَبُّ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَاتَّخِذۡهُ وَكِیۡلًا ﴿۹﴾
তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের রব, তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই; অতএব তাকেই আপনি গ্ৰহণ করুন কর্মবিধায়করূপে। সূরা মুযযাম্মিলঃ ৯
وَ لِلّٰهِ غَیۡبُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اِلَیۡهِ یُرۡجَعُ الۡاَمۡرُ كُلُّهٗ فَاعۡبُدۡهُ وَ تَوَكَّلۡ عَلَیۡهِ ؕ وَ مَا رَبُّكَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۲۳﴾
আসমানসমূহ ও যমীনের গায়েব আল্লাহরই মালিকানায় এবং তারই কাছে সবকিছু প্রত্যাবর্তন করানো হবে। কাজেই আপনি তার ইবাদাত করুন এবং তার উপর নির্ভর করুন। আর তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আপনার রব গাফিল নন। সূরা হুদঃ১২৩
তিরমিযী ও ইবনে মাজায় বর্ণিত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যদি তোমরা আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা করতে, তবে আল্লাহ্ তোমাদেরকে পাখির ন্যায় রিযিক দান করতেন। পাখি সকাল বেলায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় উদরপূর্তি করে ফিরে আসে।” [মুসনাদে আহমাদ: ১/৩০, তিরমিযী: ২৩৪৪, ইবনে মাজাহঃ ৪১৬৪]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ আমার উম্মত থেকে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্ৰবেশ করবে। তাদের অন্যতম গুণ এই যে, তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করবে। [বুখারী: ৫৭০৫, মুসলিম: ২১৮, মুসনাদে আহমাদ: ১/৪০১]
১০ : ৮৫ فَقَالُوۡا عَلَی اللّٰهِ تَوَكَّلۡنَا ۚ رَبَّنَا لَا تَجۡعَلۡنَا فِتۡنَۃً لِّلۡقَوۡمِ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿ۙ۸۵﴾
অতঃপর তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপর নির্ভর করলাম। হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে যালিম সম্প্রদায়ের উৎপীড়নের পাত্র করবেন না।
“আমাদেরকে জালেম লোকদের ফিতনার শিকারে পরিণত করবেন না”। অর্থাৎ তাদেরকে আমাদের উপর বিজয় দিবেন না। কারণ এটা আমাদের দ্বীন সম্পর্কে আমাদেরকে বিভ্রান্তিতে নিপতিত করবে। [কুরতুবী] অথবা তাদের হাতে আমাদের শাস্তি দিয়ে আমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলবেন না। মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ আমাদের শত্রুদের হাতে আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না। আর আমাদেরকে এমন কোন শাস্তিও দিবেন না যা দেখে আমাদের শক্ররা বলে যে, যদি এরা সৎপন্থী হতো তবে আমরা তাদের উপর করায়ত্ব করতে পারতাম না। এতে তারাও বিভ্রান্ত হবে, আমরাও। আবু মিজলায বলেন, এর অর্থ, তাদেরকে আমাদের উপর বিজয় দিবেন না, ফলে তারা মনে করবে যে, তারা আমাদের চেয়ে উত্তম, তারপর তারা আমাদের উপর সীমালঙ্ঘনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে [কুরতুবী; ইবন কাসীর]
১০ : ৮৬ وَ نَجِّنَا بِرَحۡمَتِكَ مِنَ الۡقَوۡمِ الۡكٰفِرِیۡنَ ﴿۸۶﴾
৮৬. আর আমাদেরকে আপনার অনুগ্রহে কাফির সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করুন।
তারা আল্লাহর উপর ভরসা করার সাথে সাথে আল্লাহর দরবারে দু’আও করেছিল। দু’আ অবশ্যই মু’মিনদের জন্য একটি বড় হাতিয়ার এবং বড় সহায়-সম্বল।
১০ : ৮৭ وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰی مُوۡسٰی وَ اَخِیۡهِ اَنۡ تَبَوَّاٰ لِقَوۡمِكُمَا بِمِصۡرَ بُیُوۡتًا وَّ اجۡعَلُوۡا بُیُوۡتَكُمۡ قِبۡلَۃً وَّ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۸۷﴾
৮৭. আর আমরা মূসা ও তার ভাইকে ওহী পাঠালাম যে, মিসরে আপনাদের সম্প্রদায়ের জন্য ঘর তৈরী করুন এবং তোমাদের ঘরগুলোকে কিবলা তথা ইবাদাতের ঘর বানান, আর সালাত কায়েম করুন এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন।
এখানে (وَاجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ قِبْلَةً) এর দ্বারা কি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে তা নির্ধারনে কয়েকটি মত রয়েছে-
(এক) কোন কোন মুফাসসিরের মতে এর অর্থ তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কেবলামুখী করে তৈরী করে নাও। যাতে করে সেগুলোতে সালাত আদায় করলে ফিরআউনের লোকেরা বুঝতে না পারে। [ইবন কাসীর]
(দুই) কোন কোন মুফাসসির-এর মতে এর অর্থ তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে মসজিদে রূপান্তরিত করে নাও। যাতে সেগুলোতে সালাত আদায় করার ব্যাপারে কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকে। কারণ পূর্ববর্তী উম্মতদের উপর সালাত আদায় করার জন্য মসজিদ হওয়া শর্ত ছিল। যেখানে সেখানে সালাত আদায়ের অনুমতি ছিল না। [ইবন কাসীর]
(তিন) কাতাদাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ এর অর্থ তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যে মসজিদ বানিয়ে নেবে যাতে তার দিক হয় কেবলার দিকে এবং সেদিকে ফিরে সালাত আদায় করবে। [কুরতুবী] এ আয়াত দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে, সালাত আদায়ের জন্য কেবলামুখী হওয়ার শর্তটি পূর্ববতী নবীগণের সময়ও বিদ্যমান ছিল। [কুরতুবী]
কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। তখন অর্থ হবে, বর্তমানে ঈমানদারদের ওপর যে হতাশা, ভীতি-বিহবলতা ও নিস্তেজ-নিস্পৃহভাব ছেয়ে আছে তা দূর করে তাদেরকে আশান্বিত করুন। তাদেরকে উৎসাহিত ও উদ্যমশীল করুন। অপর মুফাসসিরগণের মতে এখানে মূসা আলাইহিস সালামকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। আর এটা বেশী সুস্পষ্ট। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলকে সুসংবাদ দিন যে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে তাদের শত্রুদের উপর বিজয় দান করবেন। [কুরতুবী]
: ৮৮ وَ قَالَ مُوۡسٰی رَبَّنَاۤ اِنَّكَ اٰتَیۡتَ فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَاَهٗ زِیۡنَۃً وَّ اَمۡوَالًا فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۙ رَبَّنَا لِیُضِلُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِكَ ۚ رَبَّنَا اطۡمِسۡ عَلٰۤی اَمۡوَالِهِمۡ وَ اشۡدُدۡ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ فَلَا یُؤۡمِنُوۡا حَتّٰی یَرَوُا الۡعَذَابَ الۡاَلِیۡمَ ﴿۸۸﴾
৮৮. মূসা বললেন, হে আমাদের রব! আপনি তো ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গকে দুনিয়ার জীবনে শোভা ও সম্পদ দান করেছেন, হে আমাদের রব! যা দ্বারা তারা মানুষকে আপনার পথ থেকে ভ্রষ্ট করে। হে আমাদের রব! তাদের সম্পদ বিনষ্ট করুন, আর তাদের হৃদয় কঠিন করে দিন, ফলে তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত ঈমান আনবে না।
আড়ম্বর, শান-শওকত ও সাংস্কৃতিক জীবনের এমন চিত্তাকর্ষক চাকচিক্য, যার কারণে দুনিয়ার মানুষ তাদের ও তাদের রীতি-নীতির মোহে মত্ত হয় এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাদের পর্যায়ে পৌছার আকাঙ্খা করতে থাকে।
উপায়-উপকরণ, যেগুলোর প্রাচুর্যের কারণে নিজেদের কলা-কৌশলসমূহ কার্যকর করা তাদের জন্য সহজসাধ্য ছিল। হে আমাদের রব, আপনিই তাদেরকে এগুলো দিয়েছেন, অথচ আপনি জানতেন যে, আপনি যা নিয়ে তাদের কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন তারা তার উপর ঈমান আনবে না। এটা তো আপনি করেছেন তাদেরকে পরীক্ষামূলক ছাড় দেয়ার জন্য। [ইবন কাসীর]
এ দোআটি মূসা আলাইহিস সালাম এমন সময় করেছিলেন যখন একের পর এক সকল নিদর্শন দেখে নেবার এবং দ্বীনের সাক্ষ্য প্রমাণ পূর্ণ হয়ে যাবার পরও ফিরআউন ও তার রাজসভাসদরা সত্যের বিরোধিতার চরম হঠকারিতার সাথে অবিচল ছিল। এহেন পরিস্থিতিতে পয়গম্বর যে বদদোয়া করেন তা কুফরীর ওপর অবিচল থাকার অনুরূপ হয়ে থাকে। অর্থাৎ তাদেরকে আর ঈমান আনার সুযোগ দেয়া হয় না। মূসা আলাইহিস সালামের এ দোআটি নূহ আলাইহিস সালামের দোআর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেখানে বলা হয়েছেঃ “হে আমার প্রভু! যমীনের বুকে কাফেরদের কোন আস্তানা অবশিষ্ট রাখবেন না; কারণ তাদেরকে যদি আপনি পাকড়াও না করে এমনি ছেড়ে দেন তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং প্রচণ্ড অপরাধী এবং অতিশয় কাফের ছাড়া আর কিছুর জন্মও তারা দেবে না।” [সূরা নূহঃ ২৭]।
১০ : ৮৯ قَالَ قَدۡ اُجِیۡبَتۡ دَّعۡوَتُكُمَا فَاسۡتَقِیۡمَا وَ لَا تَتَّبِعٰٓنِّ سَبِیۡلَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۸۹﴾
৮৯. তিনি বললেন, আপনাদের দুজনের দোআ কবুল হল, কাজেই আপনারা দৃঢ় থাকুন এবং আপনারা কখনো যারা জানে না তাদের পথ অনুসরণ করবেন না।
এর একটি অর্থ এই যে, তোমরা নিজ বদ্দুআর উপর অবিচল থাকো; যদিও তার বাস্তব রূপ প্রকাশ পেতে দেরী হয়। কারণ তোমাদের দু’আ অবশ্যই কবুল করা হয়েছে। কিন্তু তা কখন বাস্তবায়ন করব, তা একমাত্র আমার ইচ্ছা ও হিকমতের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং কোন কোন তফসীরবিদ বর্ণনা করেছেন যে, সেই বদ্দুআর চল্লিশ বছর পর ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে। সেই বদ্দুআ অনুযায়ী ফিরআউন যখন পানিতে ডুবতে আরম্ভ করল, তখন সে বলল, ‘আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনছি।’ কিন্তু এই ঈমানে তার কোন লাভ হয়নি। এর দ্বিতীয় অর্থ এই যে, তুমি আপন দাওয়াত-তবলীগ, বনী ইস্রাঈলদেরকে পথ প্রদর্শন এবং তাদেরকে ফিরআউনের দাসত্ব থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য চেষ্টা-চরিত্র অব্যাহত রাখ।
অর্থাৎ যারা আল্লাহর নিয়ম-নীতি, তাঁর আইন-কানুন এবং তাঁর কর্মগত কৌশল ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, অবশ্যই তোমরা তাদের মত হয়ে যেয়ো না; বরং এখন অপেক্ষা ও ধৈর্য ধারণ কর, আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজ হিকমত ও কৌশল অনুযায়ী অবিলম্বে অথবা বিলম্বে তাঁর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই পূর্ণ করবেন। কারণ তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না ।
মুমিনের দোয়া কখনও বৃথা যায় না। তিন পদ্ধতিতে আল্লাহ তাআলা দোয়া কবুল করেন। যখন কোনো মুমিন ব্যক্তির দোয়ায় কোনো পাপ থাকে না, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় থাকে না, তাহলে আল্লাহ তিন পদ্ধতির কোনো এক পদ্ধতিতে দোয়া কবুল করেন। পদ্ধতি তিনটি হলো—
১. সে যে দোয়া করেছে, হুবহু তা কবুল করে দুনিয়াতে দেওয়া হয়।
২. তার দোয়ার প্রতিদান পরকালের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
৩. দোয়ার মাধ্যমে তার অনুরূপ কোনো অমঙ্গলকে তার থেকে দূরে রাখা হয়।’এই কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, তাহলে আমরা বেশি বেশি দোয়া করবো। নবীজি বললেন, আল্লাহ তাহলে আরো বেশি করে দিবেন। (মুসনাদে আহমদ: ১১১৩৩)
আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, কাফির যদি পৃথিবীতে কোন নেক আমল করে তবে এর বিনিময়ে পৃথিবীতেই তাকে কিছু প্রদান করা হয়ে থাকে। আর মুমিনদের জন্য আল্লাহ তাআলা আখিরাতের সঞ্চয় হিসাবে নেকী রেখে দেন। (সহীহ মুসলিম ২৮০৮)
১০ : ৯০ وَ جٰوَزۡنَا بِبَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ الۡبَحۡرَ فَاَتۡبَعَهُمۡ فِرۡعَوۡنُ وَ جُنُوۡدُهٗ بَغۡیًا وَّ عَدۡوًا ؕ حَتّٰۤی اِذَاۤ اَدۡرَكَهُ الۡغَرَقُ ۙ قَالَ اٰمَنۡتُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا الَّذِیۡۤ اٰمَنَتۡ بِهٖ بَنُوۡۤا اِسۡرَآءِیۡلَ وَ اَنَا مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ﴿۹۰﴾
৯০. আর আমরা বনী ইসরাঈলকে সাগর পার করলাম। আর ফিরআউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত সহকারে এবং সীমালংঘন করে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। পরিশেষে যখন সে ডুবে যেতে লাগল তখন বলল, আমি ঈমান আনলাম যে, নিশ্চয় তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই, যার প্রতি বনী ইসরাঈল ঈমান এনেছে। আর আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহর আদেশে অলৌকিকভাবে তৈরী শুষ্ক পথে, যে পথ দিয়ে মূসা (আঃ) ও তাঁর সম্প্রদায় সমুদ্র পার হয়েছিলেন, ফিরআউন ও তার সৈন্য-সামন্তও সমুদ্র পার হওয়ার ইচ্ছায় ঐ পথে চলতে আরম্ভ করে। উদ্দেশ্য ছিল যে, মূসা বনী ইস্রাঈলদেরকে আমার দাসত্ব থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য রাতারাতি তাদেরকে নিয়ে পালিয়েছে, পুনরায় তাদেরকে দাসত্বেরবেড়ীতে আবদ্ধ করতে হবে। যখন ফিরআউন ও তার সৈন্য-সামন্ত সেই সামুদ্রিক পথে প্রবেশ করে গেল, তখন আল্লাহ তাআলা সাগরকে পূর্ব নিয়ম অনুযায়ী চলাচলের আদেশ দিলেন। ফলে ফিরআউন সহ তার সৈন্যদল সকলে সাগরে ডুবে মরল।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করলেন, তখন তিনি দেখলেন ইয়াহুদীরা আশুরার সাওম পালন করছে। তিনি এ ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বললঃ এ দিন আল্লাহ তা’আলা মূসাকে ফিরআউনের উপর বিজয় দিয়েছিলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমরা মূসার সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের থেকেও বেশী হকদার। সুতরাং তোমরা এদিনে সওম পালন কর। [বুখারীঃ ৪৬৮০]
১০ : ৯১ آٰلۡـٰٔنَ وَ قَدۡ عَصَیۡتَ قَبۡلُ وَ كُنۡتَ مِنَ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ﴿۹۱﴾
এখন (ঈমান আনছ)? অথচ ইতিপূর্বে তুমি অবাধ্য ছিলে এবং অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।
স্বয়ং আল্লাহ জাল্লা শানুহুর পক্ষ থেকে তার উত্তর দেয়া হয়েছে (آلْآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ) অর্থাৎ কি এতক্ষণে ঈমান এনেছ? অথচ ঈমান আনার এবং ইসলাম গ্রহণের সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, ঠিক মৃত্যুকালে ঈমান আনা শরীআত অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টির আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণ সে হাদীসের দ্বারাও হয়, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা বান্দার তাওবা ততক্ষণ পর্যন্তই কবুল করে থাকেন, যতক্ষণ না মৃত্যুর উর্ধ্বশ্বাস আরম্ভ হয়ে যায়। [তিরমিযীঃ ৩৫৩৭]
মৃত্যুকালীন উর্ধ্বশ্বাস বলতে সে সময়কে বুঝানো হয়েছে, যখন জান কবজ করার সময় ফিরিশতা সামনে এসে উপস্থিত হন। তখন কর্মজগত পৃথিবীর জীবন সমাপ্ত হয়ে আখেরাতের হুকুম-আহকাম আরম্ভ হয়ে যায়। কাজেই সে সময়কার কোন আমল গ্রহণযোগ্য নয়। এমন সময়ে যে লোক ঈমান গ্রহণ করে, তাকেও মুমিন বলা যাবে না এবং কাফন-দাফনের ক্ষেত্রে মুসলিমদের অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। যেমন, ফিরআউনের এ ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের নির্দেশেও এটাই সুস্পষ্ট। এ ব্যাপারে অন্য কিছু বলা বা বিশ্বাস করা কুরআন হাদীসের পরিপন্থী।
১০ : ৯২ فَالۡیَوۡمَ نُنَجِّیۡكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُوۡنَ لِمَنۡ خَلۡفَكَ اٰیَۃً ؕ وَ اِنَّ كَثِیۡرًا مِّنَ النَّاسِ عَنۡ اٰیٰتِنَا لَغٰفِلُوۡنَ ﴿۹۲﴾
৯২. সুতরাং আজ আমরা তোমার দেহটি রক্ষা করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। আর নিশ্চয় মানুষের মধ্যে অনেকেই আমাদের নিদর্শন সম্বন্ধে গাফিল।
এখানে ফিরআউনকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে, জলমগ্নতার পর আমি তোমার লাশ পানি থেকে বের করে দেব যাতে তোমার এই মৃতদেহটি তোমার পরবর্তী জনগোষ্ঠীর জন্য আল্লাহ তা’আলার মহাশক্তির নিদর্শন ও শিক্ষণীয় হয়ে থাকে। কাতাদা বলেন, সাগর পাড়ি দেবার পর মূসা আলাইহিস সালাম যখন বনী ইসরাঈলদেরকে ফিরআউনের নিহত হবার সংবাদ দেন, তখন তারা ফিরআউনের ব্যাপারে এতই ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল যে, তা অস্বীকার করতে লাগল এবং বলতে লাগল যে, ফিরআউন ধ্বংস হয়নি। আল্লাহ তা’আলা তাদের সঠিক ব্যাপার প্রদর্শন এবং অন্যান্যদের শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে একটি ঢেউয়ের মাধ্যমে ফিরআউনের মৃতদেহটি তীরে এনে ফেলে রাখলেন, যা সবাই প্রত্যক্ষ করল। [তাবারী] তাতে তার ধ্বংসের ব্যাপারে তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস এল এবং তার লাশ সবার জন্য নিদর্শন হয়ে গেল। লাশের কি পরিণতি হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না।
অর্থাৎ আমি তো শিক্ষণীয় ও উপদেশমূলক নিদর্শনসমূহ দেখিয়েই যেতে থাকবো, যদিও বেশীর ভাগ লোকদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, বড় বড় শিক্ষণীয় নির্দশন দেখেও তাদের চোখ খোলে না। আর জানা কথা যে, ফিরআউন ও তার দলবলের ধ্বংস ও বনী ইসরাঈলের নাজাত ছিল আশুরার দিনে। [ইবন কাসীর]
উলামাগণের সুস্পষ্ট বক্তব্য-
[1]- ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেনঃ বনী ইসরাইলের লোকেরা ফেরাউনের মৃত লাশ দেখার পর যখন তাদের সন্দেহ দূর হয়ে গেলো তখন সাগর আবার ফেরাউনকে গিলে নিলো। (তাফসীরে কুরতুবী-সূরা ইউনুস:92 আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
[2]-ইমাম মুহাম্মাদ বিন ছলেহ আল উসাইমীন রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ মিশরে এখনো ফেরাউনের লাশ আছে এটা মিথ্যা কথা, যার কোন ভিত্তি নেই।
📗(لقاح الباب المفتوح:25/183)
[3]- শাইখ ছলেহ আল-ফাওযান হাফিজাহুল্লাহ উপরের সমস্ত মুফাসসিরগণের একই কথা উল্লেখ করার পর বলেনঃ যারা ধারণা করে ফেরাউনের লাশ এখনো মিশরে আছে তারা জাহেল। ফেরাউনের মৃত দেহ ক্ষনিকের জন্য যমীনের উপর তুলার উদ্দেশ্যে ছিলো ফেরাউনের মৃত্যু সম্পর্কে বনী ইসরাইলের লোকেদের বিশ্বাস করানো। লাশ দেখার পর তারা বিশ্বাস করে নিয়েছে আর উদ্দেশ্যেও পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
📙(المنتقى لصالح الفوزان:1/213)
[4]- শাইখ মুহাম্মাদ বিন ছলেহ আল-মুনাজ্জিদ হাফিজাহুল্লাহ বলেনঃ ফেরাউনের দেহ অক্ষত রাখাটা যদি সকলের জন্য নিদর্শন হতো তবে তো সকলেই দেখতে পেতো। (কিন্ত কই সাড়ে তিন হাজার বছর পেরিয়ে গেল অথচ কেউ দেখলো না-) এতেই বুঝা যায় ফেরাউনের লাশ সবার জন্য প্রত্যক্ষ নিদর্শন নয়।
(الإسلام سؤال وجواب:72516)
জ্ঞাতব্য- ১৯০৭/১৯০৮ সালে আবিষ্কৃত হয়েছে কথিত ফেরাউনের লাশ!
আল্লাহর প্রশংসা।
সূরা ইউনুসের এই আয়াতে আল্লাহর নবী মূসা (আঃ) এবং তাঁর সাথে ঈমান আনা বনী ইসরাঈলের প্রতি অত্যাচারী ফেরাউনের মনোভাব বর্ণনা করার প্রেক্ষাপটে এসেছে। ঠিক সেই সময় মূসা (আঃ) মুমিনদের সাথে পবিত্র ভূমিতে হিজরতের জন্য বেরিয়েছিলেন, এবং ফেরাউন এবং তার সৈন্যরা তাদের ফিরিয়ে আনার এবং তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য তাদের পিছু ধাওয়া করেছিল। তাদের দীর্ঘ ভ্রমণের সময়, তারা সমুদ্রের কাছে এসেছিল এবং আর এগোতে পারেনি, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নবী মূসা (আঃ) এবং তাঁর সাথে থাকা মুমিনদের সম্মানিত করেছিলেন, তাদের জন্য সমুদ্র শুকিয়ে দিয়েছিলেন যাতে তারা হেঁটে পার হতে পারে। তাই তারা তাদের শত্রুদের সামনে, যখন তারা তাকিয়ে ছিল, পার হয়ে গেল। আল্লাহর শত্রু ফেরাউন, তার অহংকার এবং বোকামিতে, মূসা (আঃ) এবং তাঁর সাথে থাকা লোকদের পিছনে একটি জাহাজে করে বেরিয়েছিল, কিন্তু সে এবং তার সাথে থাকা লোকেরা সেই সমুদ্রে ডুবে গেল যে সমুদ্র মূসা (আঃ) এবং তাঁর সাথে থাকা লোকরা পার হয়েছিলেন।
যখন মৃত্যু জালেম শাসককে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল, সমুদ্রের ঢেউ তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে ডুবে যাওয়া তার অনিবার্য পরিণতি, তখন তিনি বলেছিলেন: “আমি বিশ্বাস করি যে বনী ইসরাঈলরা যার উপর বিশ্বাস করে তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, এবং আমি মুসলিমদের একজন (যারা আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে)” [ইউনুস ১০:৯০]। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, তওবার সময় চলে গিয়েছিল এবং মৃত্যুর আগমনের সাথে সাথে বিশ্বাসের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল, এবং অপরাধী সমস্ত শক্তি এবং কৌশল হারিয়ে ফেলেছিল।
নিঃসন্দেহে এই চরম জালেমের মৃত্যু হ’ল একগুঁয়েমি, অন্যায় এবং অহংকারের পরিণতি প্রদর্শনকারী সবচেয়ে বড় নিদর্শনগুলির মধ্যে একটি। তাই আল্লাহ এই নিদর্শনটি প্রতিষ্ঠা এবং নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, যাতে কোনও সন্দেহ বা বিভ্রান্তি দূর হয়। তাই তিনি আদেশ দিলেন যে ফেরাউনের মৃতদেহ তীরে স্থির এবং মৃত অবস্থায় প্রদর্শিত হবে, যাতে তার সম্প্রদায় এবং যারা তার উপাসনা করত তারা তাকে দেখতে পারে, এবং এটি তাদের জন্য সবচেয়ে স্পষ্ট শিক্ষা হবে। আল্লাহ বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা):
“অতএব আজ আমি তোমার (মৃত) দেহ (সমুদ্র থেকে) উদ্ধার করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারো! আর নিশ্চয়ই, মানুষের মধ্যে অনেকেই আমার আয়াত সম্পর্কে গাফেল”[ইউনুস ১০:৯২]
ইবনে কাছীর (রাঃ) বলেন: ইবনে আব্বাস এবং অন্যান্য সালাফ বলেছেন যে, বনী ইসরাঈলের কিছু লোক ফেরাউনের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিল, তাই আল্লাহ সমুদ্রকে আদেশ দিলেন যেন তার সুপরিচিত বর্ম পরিহিত সম্পূর্ণ কিন্তু প্রাণহীন দেহটি ভূমির একটি উঁচু অংশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, যাতে তারা দেখতে পায় যে সে সত্যিই মৃত। তাই আল্লাহ বলেন, “তাই আজ আমরা তোমার (মৃত) দেহ উদ্ধার করব” অর্থাৎ, আমরা তোমাকে ভূমির একটি বিশিষ্ট অংশে উঠাব। “তোমার (মৃত) দেহ” – মুজাহিদ বলেন, তোমার দেহ। আল-হাসান বলেন, এমন একটি দেহ যার মধ্যে কোন আত্মা নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ বলেন, সম্পূর্ণ এবং সম্পূর্ণ, অর্থাৎ পচে না যাওয়া, যাতে তারা তাকে চিনতে পারে এবং নিশ্চিত হতে পারে যে এটিই তিনি। আবু সাখর বলেন: তোমার বর্ম সহ। এই মতামতগুলির মধ্যে কোনও বিরোধ নেই, যেমনটি আমরা নীচে ইন শা আল্লাহ দেখতে পাব।
“যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য একটি নিদর্শন হও” এই কথাটির অর্থ হল, যাতে এটি বনী ইসরাঈলের জন্য তোমার মৃত্যুর প্রমাণ হয় এবং দেখায় যে আল্লাহই সর্বশক্তিমান, এবং প্রতিটি জীবের কপালের চুল তাঁর হাতে, এবং তাঁর ক্রোধের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে পারে না। তাফসীরে ইবনে কাছীর (২/৫৬৫)
এই নিদর্শনে এমন কিছু নেই যা ইঙ্গিত দেয় যে তার দেহ কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে, যেমনটি কিছু লোক কল্পনা করে। এটি কুরআনের এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যা অকল্পনীয়। যদি উদ্দেশ্য হত ফেরাউনের দেহ তার পরবর্তী সকল লোকের জন্য সংরক্ষণ করা, যাতে তারা তার মৃতদেহ নিজেরাই দেখতে পারে, তাহলে তার দেহ তার পরবর্তী সকলের কাছে এবং যারা তার গল্প শুনেছিল তাদের কাছে সুপরিচিত থাকত, যাতে শিক্ষা নেওয়া যায়, নিদর্শনটি প্রকাশিত হয় এবং প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়। তার গল্পের কী হয়েছিল যে লোকেরা এটি ভুলে গিয়েছিল এবং এত শতাব্দী ধরে কেউ এটি মনে রাখেনি, যতক্ষণ না প্রত্নতাত্ত্বিকরা দাবি করেছিলেন যে তারা ডুবে যাওয়া ফেরাউনের মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছেন?
এবং এটাই ঘটেছিল। বনী ইসরাঈলরা ফেরাউনকে তাদের নিজের চোখে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছিল, তাই সে তাদের জন্য একটি নিদর্শন ছিল যারা তখন তাকে দেখেছিল এবং সে তাদের সকলের জন্য একটি নিদর্শন যারা তার পরে আসবে এবং তার মৃত্যুর গল্প শুনবে।
শাইখ সালেহ আল-ফাওযান (রহঃ) বলেন: “যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হও” আল্লাহর বাণীর অর্থ হল: যাতে বনী ইসরাঈলের জন্য প্রমাণ থাকে যে তুমি সত্যিই মৃত, এবং আল্লাহ সর্বশক্তিমান, এবং প্রতিটি জীবের কপালের চুল তাঁর হাতে, এবং কেউই তাঁর শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে না, এমনকি যদি সে মানুষের মধ্যে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার পদেও থাকে। এর অর্থ এই নয় যে ফেরাউনের মৃতদেহ আমাদের যুগ পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে, যেমনটি অজ্ঞরা মনে করে, কারণ তার মৃতদেহ সমুদ্র থেকে নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্য ছিল এটি জানা যে তিনি মারা গেছেন এবং বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা সন্দেহ করেছিল তাদের জন্য এটি নিশ্চিত করা।” এই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছিল, এবং ফেরাউনের দেহ অন্যান্য দেহের মতোই, এটি অবশ্যই ভেঙে যাবে এবং এর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, কেবল অন্য কোনও দেহের অবশিষ্টাংশ ছাড়া, যা হল লেজের হাড়ের শেষ অংশ, যেখান থেকে প্রতিটি ব্যক্তির দেহ কেয়ামতের দিন নতুন করে তৈরি করা হবে, যেমনটি হাদিসে বলা হয়েছে। সুতরাং ফেরাউনের দেহ অন্য কারও দেহ থেকে আলাদা নয়। এবং আল্লাহই ভালো জানেন।
আল-মুনতাকা মিন ফাতাওয়া আল-ফাওযান (১/প্রশ্ন নং ১৩২)।
কিন্তু এখানে বলা যেতে পারে যে, যদি ফেরাউনের দেহ আবার আবির্ভূত হয় এবং ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেন যে এটি ফেরাউনের দেহ, যাকে আল্লাহ তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন, তাহলে এটি ফেরাউনের দেহ (সমুদ্র থেকে) উদ্ধার করার বিষয়ে কুরআনের বক্তব্যের সত্যতার ইঙ্গিত হবে।
পণ্ডিত তাহির ইবনে আশুর (রা.) বলেন: কুরআনের সূক্ষ্ম বিষয়গুলির মধ্যে একটি হল আল্লাহর বাণী (অর্থের ব্যাখ্যা): “আজ আমরা তোমার (মৃত) দেহ (সমুদ্র থেকে) উদ্ধার করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারো”। এটি এমন কিছু যা ফেরাউন সম্পর্কে কেউ লেখেনি; এটি কুরআনের বৈজ্ঞানিক অলৌকিক ঘটনাগুলির মধ্যে একটি, কারণ আয়াতটি ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে।”আল-তাহরীর ওয়াল-তানভীর (1/2065)
উপসংহার: ফেরাউনের মৃতদেহ সেদিন সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল এবং পচনশীলতা থেকে রক্ষা করা হয়েছিল, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এটি কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হবে। যদি প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকদের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ফেরাউনের মৃতদেহ আজও সংরক্ষিত আছে, এবং এটি কিছু জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়, তাহলে এই সংরক্ষণকে সকল মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি অলৌকিক ঘটনা বলে দাবি করা বৈধ নয়, বরং এটি কেবল ঐতিহাসিক প্রমাণ যা কুরআনে যা আছে তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং এটিই অলৌকিক ঘটনা। এবং আল্লাহই ভালো জানেন। https://islamqa.info/en/answers/72516/meaning-of-the-verse-so-this-day-we-shall-deliver-your-dead-body-out-from-the-sea
অপর বর্ননায় সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম সাগর তীরে সেখানে ফেরাউনের লাশ সাগরে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল আজো সে জায়গায়টি অপরিবর্তিত রয়েছে। বর্তমান সময়ে এ জায়গাটির নাম জাবালে ফেরাউন বা ফেরাউন পর্বত। এরই কাছাকাছি আছে একটি গরম পানির ঝর্ণা। স্থানীয় লোকেরা এর নাম দিয়েছে হাম্মামে ফেরাউন। এর অবস্থান স্থল হচ্ছে আবু যানীমর কয়েক মাইল ওপরে উত্তরের দিকে। স্থানীয় লোকেরা এ জায়গাটি চিহ্নিত করে বলে, ফেরাউনের লাশ এখানে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
এ ডুবন্ত ব্যক্তি যদি মিনফাতাহ ফেরাউন হয়ে থাকে, যাকে আধুনিক গবেষণার মূসার আমলের ফেরাউন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাহলে এর লাশ এখনো কায়রোর যাদু ঘরে রয়েছে। ১৯০৭ সালে স্যার গ্রাফটিন এলিট স্মিথ তার মমির ওপর থেকে যখন পট্রি খুলেছিলেন তখন লাশের ওপর লবনের একটি স্তর জমাটবাঁধা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এটি লবণাক্ত পানিতে তার ডুবে যাওয়ার একটি সুস্পষ্ট আলামত ছিল। (তাফহিমুল কুর’আন)