সুরা বাকারাঃ ৩৩তম রুকু (২৪৯-২৫৩)আয়াত

 সুরা বাকারাঃ ৩৩তম রুকু (২৪৯-২৫৩)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:২৪৯ فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوۡتُ بِالۡجُنُوۡدِ ۙ قَالَ اِنَّ اللّٰهَ مُبۡتَلِیۡکُمۡ بِنَهَرٍ ۚ فَمَنۡ شَرِبَ مِنۡهُ فَلَیۡسَ مِنِّیۡ ۚ وَ مَنۡ لَّمۡ یَطۡعَمۡهُ فَاِنَّهٗ مِنِّیۡۤ اِلَّا مَنِ اغۡتَرَفَ غُرۡفَۃًۢ بِیَدِهٖ ۚ فَشَرِبُوۡا مِنۡهُ اِلَّا قَلِیۡلًا مِّنۡهُمۡ ؕ فَلَمَّا جَاوَزَهٗ هُوَ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَهٗ ۙ قَالُوۡا لَا طَاقَۃَ لَنَا الۡیَوۡمَ بِجَالُوۡتَ وَ جُنُوۡدِهٖ ؕ قَالَ الَّذِیۡنَ یَظُنُّوۡنَ اَنَّهُمۡ مُّلٰقُوا اللّٰهِ ۙ کَمۡ مِّنۡ فِئَۃٍ قَلِیۡلَۃٍ غَلَبَتۡ فِئَۃً کَثِیۡرَۃًۢ بِاِذۡنِ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ

২৪৯ তারপর তালুত যখন সেনাবাহিনীসহ বের হলো তখন সে বলল, আল্লাহ এক নদী দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করবেন। যে তা থেকে পানি পান করবে সে আমাদের দলভুক্ত নয়; আর যে তার স্বাদ গ্রহণ করবে না সে আমার দলভুক্ত; এছাড়া যে তার হাতে এক কোষ পানি গ্রহণ করবে সেও’। অতঃপর অল্প সংখ্যক ছাড়া তারা তা থেকে পানি পান করল। সে এবং তার সংগী ঈমানদারগণ যখন তা অতিক্রম করল তখন তারা বলল, জালূত ও তার সেবাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত শক্তি আজ আমাদের নেই। কিন্তু যাদের প্রত্যয় ছিল আল্লাহ্‌র সাথে তাদের সাক্ষাৎ হবে তারা বলল, আল্লাহ্‌র হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে! আর আল্লাহ্‌ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।

এই নদীটি জর্ডান ও প্যালেষ্টাইনের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত।

আমীরের আনুগত্য করা সর্বাবস্থায় জরুরী। আর শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার সময় তো তার (আমীরের আনুগত্য করার) গুরুত্ব দ্বিগুণ নয়, বরং শতগুণ হয়ে যায়।

দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধে সফলতা অর্জনের জন্য জরুরী হল, সৈন্যের যুদ্ধকালীন সময়ের ক্ষুৎপিপাসা এবং অন্যান্য কষ্ট অতীব ধৈর্যের সাথে সহ্য করা। তাই এই দু’টি বিষয়ে তরবিয়াত এবং পরীক্ষার জন্য ত্বালুত বললেন, নদীতে তোমাদের প্রথম পরীক্ষা হবে। যে এই নদীর পানি পান করবে, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু এই সতর্কতা সত্ত্বেও অধিকাংশ লোকেরাই পানি পান করে নেয়। তাদের সংখ্যার ব্যাপারে মুফাসসিরগণের বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপ যারা পান করেনি, তাদের সংখ্যা ৩১৩ বলা হয়েছে, যা ছিল বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের সংখ্যা। আর আল্লাহই অধিক জানেন।

এই ঈমানদাররাও যখন শুরুতে দেখল শত্রুর সংখ্যা অনেক, তখন তাদের সংখ্যা (শত্রুর তুলনায়) কম থাকায় তারা এই মত প্রকাশ করল। তখন তাদের আলেমগণ এবং যারা আল্লাহর সাহায্যে পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরা বললেন, সফলতা সংখ্যার আধিক্যের এবং অস্ত্র-শস্ত্রের প্রাচুর্যের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং তা আল্লাহর ইচ্ছা এবং তাঁর নির্দেশের উপর নির্ভর করে। আর আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য জরুরী হল ধৈর্যের প্রতি যত্ন নেওয়া।

নেতার আনুগত্য করাও ঈমানের অন্যতম দাবী। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা বলেন,

أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ

তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা নির্দেশ দেবার অধিকারী তাদের আনুগত্য কর। সূরা আন নিসা, আয়াত : ৫৯।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,

من أطاعني فقد أطاع الله. ومن يعصني فقد عصى الله. ومن يطع الأمير فقد أطاعني. ومن يعص الأمير فقد عصاني

যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করলো সে প্রকারান্তরে আল্লাহর আনুগত্য করলো, তেমনিভাবে যে আমার অবাধ্য হলো সে যেন আল্লাহর অবাধ্য হলো। আর যে আমীরের আনুগত্য করলো সে যেন আমারই আনুগত্য করলো, যে ব্যক্তি আমীরের অবাধ্য হলো সে প্রকারান্তরে আমারই অবাধ্য হলো। সহীহ আল বুখারী; সহীহ মুসলিম।

আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে লক্ষ্য করে বলেছেন,

يا أبا ذر اسمع وأطع ولو عبداً حبشيا مجدع الأطراف

হে আবু যার! শুনবে এবং মানবে। যদি কালো কুৎসিত এবং এবড়ো থেবড়ো মাথাবিশিষ্ট হাবশী (তোমাদের নেতা) হয় তবু। ইমাম বাইহাকী নিজস্ব সনদে।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,

مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ ثُمَّ مَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً

“যে ব্যক্তি জামা’আত থেকে বিচ্ছিন্ন হলো এবং আনুগত্য পরিহার করলো অতপর মারা গেল, তার মৃত্যু হলো জাহেলিয়াতের মৃত্যু। সহীহ মুসলিম।

পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সংগঠন সর্বত্র আনুগত্য এক অপরিহার্য বিষয়। এগুলির কোন স্তরে আনুগত্য না থাকলে সেটা ভালভাবে চলবে না, সেখানে নিয়ম-শৃংঙ্খলা থাকবে না। ফলে সেখানে কোন কাজ সুচারুরূপে পরিচালিতও হবে না। তাই সর্বস্তরে আনুগত্যের কোন বিকল্প নেই। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল।-

আনুগত্য অর্থ : কোন প্রতিবাদ, বিতর্ক ও পরিবর্তন ব্যতিরেকে আদেশ-নিষেধ শ্রবণ করা বা মান্য করাই হচ্ছে আনুগত্য।

আনুগত্যের প্রকার : আনুগত্যকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ক. নিষিদ্ধ আনুগত্য খ. ফরয ও ওয়াজিব আনুগত্য।

ক. নিষিদ্ধ আনুগত্য : নিষিদ্ধ আনুগত্য বলতে বুঝায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) যাদের আনুগত্য ও অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। যেমন-

১. কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য : মুসলমানদের জন্য কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য নিষিদ্ধ।

আর তুমি কাফের ও মুনাফিকদের অনুসরণ কর না। তাদের দেওয়া কষ্টসমূহ উপেক্ষা কর এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর। বস্ত্ততঃ তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (আহযাব ৩৩/৪৮)।

২. আহলে কিতাবদের আনুগত্য : আহলে কিতাব তথা ইহুদী-নাছারাদের আনুগত্য করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আহলে কিতাবদের কোন একটি দলের কথা মেনে নাও, তাহ’লে ওরা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর পুনরায় কাফের বানিয়ে ফেলবে’ (আলে ইমরান ৩/১০০)।

৩. অধিকাংশ মানুষের অনুসরণ করা :

‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)।

৪. মিথ্যাবাদী, পাপিষ্ঠদের আনুগত্য :

‘অতএব তুমি মিথ্যারোপ- কারীদের আনুগত্য করবে না’ (কলম ৬৮/৮)

আর তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য কর না যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে’ (কাহ্ফ ১৮/২৮)।

খ. ফরয বা ওয়াজিব আনুগত্য :

১. আল্লাহর আনুগত্য : আল্লাহর আনুগত্য করা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম ব্যক্তির উপরে ফরয (নিসা ৪/৫৯)

২. রাসূলের আনুগত্য : রাসূলের আনুগত্য করাও ফরয।

আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল’ (নিসা ৪/৮০)।

৩. আমীরের আনুগত্য :

আমীরের আনুগত্য করা ওয়াজিব (নিসা ৪/৫৯)।

রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَطَاعَنِى فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمَنْ يُطِعِ الأَمِيْرَ فَقَدْ أَطَاعَنِى، وَمَنْ يَعْصِ الأَمِيْرَ فَقَدْ عَصَانِى-

‘যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল সে আমারই আনুগত্য করল, আর যে ব্যক্তি আমীরের অবাধ্যতা করল সে আমারই অবাধ্যতা করল. বুখারী হা/২৯৫৭, ৭১৩৭; মুসলিম হা/১৮৩৫; মিশকাত হা/৩৬৬১।

উহুদ যুদ্ধের কথা–

আল্লাহ তোমাদের কাছে ( সাহায্য ও সমর্থনদানের ) যে ওয়াদা করেছিলেন, তা পূর্ণ করেছেন৷ শুরুতে তাঁর হুকুমে তোমরাই তাদেরকে হত্যা করেছিলে৷ কিন্তু যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে এবং নিজেদের কাজে পারস্পারিক মতবিরোধে লিপ্ত হলে আর যখনই আল্লাহ তোমাদের সেই জিনিস দেখালেন যার ভালোবাসায় তোমরা বাঁধা ছিলে ( অর্থাৎ গনীমাতের মাল), তোমরা নিজেদের নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে, কারণ তোমাদের কিছু লোক ছিল দুনিয়ার প্রত্যাশী আর কিছু লোকের কাম্য ছিল আখেরাত, তখনই আল্লাহ কাফরদের মোকাবিলায় তোমাদেরকে পিছিয়ে দিলেন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য৷ তবে যথার্থই আল্লাহ এরপরও তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন . কারণ মুমিনদের প্রতি আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহের দৃষ্টি রাখেন৷ আলে ইমরান ১৫২

﴿إِن يَنصُرْكُمُ اللَّهُ فَلَا غَالِبَ لَكُمْ ۖ وَإِن يَخْذُلْكُمْ فَمَن ذَا الَّذِي يَنصُرُكُم مِّن بَعْدِهِ ۗ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ﴾

১৬০) আল্লাহ যদি তোমাদের সাহায্য করেন তাহলে কোন শক্তি তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারবে না৷ আর যদি তিনি তোমাদের পরিত্যাগ করেন, তাহলে এরপর কে আছেন তোমাদের সাহায্য করার মতো ? কাজেই সাচ্চা মুমিনদের আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত ৷আলে ইমরান

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ﴾

১৪২) তোমরা কি মনে করে রেখেছ তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে ? অথচ এখনো আল্লাহ দেখেনইনি, তোমাদের মধ্যে কে তাঁর পথে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং কে তাঁর জন্য সবরকারী৷আলে ইমরান

২:২৫০ وَ لَمَّا بَرَزُوۡا لِجَالُوۡتَ وَ جُنُوۡدِهٖ قَالُوۡا رَبَّنَاۤ اَفۡرِغۡ عَلَیۡنَا صَبۡرًا وَّ ثَبِّتۡ اَقۡدَامَنَا وَ انۡصُرۡنَا عَلَی الۡقَوۡمِ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿

(২৫০) তারা যখন (যুদ্ধার্থে) জালূত ও তার সৈন্যবাহিনীর সম্মুখীন হল, তখন বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্য দান কর, আমাদেরকে অবিচলিত রাখ এবং অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য দান কর।’

জালূত সেই শত্রুদলের সেনাপতি ও দলনেতা ছিল, যাদের সাথে ত্বালূত ও তাঁর সঙ্গীদের সংঘর্ষ ছিল। এরা ছিল আমালেক্বা জাতি। সেই সময়ে এই জাতি বড় দুর্ধর্ষ যুদ্ধ-বিশারদ এবং বীর নামে প্রসিদ্ধ ছিল। তাদের এই প্রসিদ্ধির কারণে ঠিক যুদ্ধের সময় ঈমানদারগণ আল্লাহর নিকট ধৈর্য ও সুদৃঢ় থাকার তওফীক চেয়ে এবং কুফরীর মোকাবেলায় ঈমানের সফলতার জন্য দু’আ করেন। অর্থাৎ, (যুদ্ধের) পার্থিব উপকরণাদি গ্রহণ করার সাথে সাথে ঈমানদারদের জন্য অত্যাবশ্যক হল, এ রকম পরিস্থিতিতে আল্লাহর নিকট বিশেষভাবে প্রার্থনা করা। যেমন, বদরের যুদ্ধে নবী করীম (সাঃ) অত্যধিক কাকুতি-মিনতির সাথে বিজয় ও সাহায্য চেয়ে দু’আ করেছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর সে দু’আ কবুল করেছিলেন। ফলে অতীব অল্প সংখ্যক মুসলিম দল অধিক সংখ্যক কাফের দলের উপর জয় লাভ করেছিল।

২:২৫১ فَهَزَمُوۡهُمۡ بِاِذۡنِ اللّٰهِ ۟ۙ وَ قَتَلَ دَاوٗدُ جَالُوۡتَ وَ اٰتٰىهُ اللّٰهُ الۡمُلۡکَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ عَلَّمَهٗ مِمَّا یَشَآءُ ؕ وَ لَوۡ لَا دَفۡعُ اللّٰهِ النَّاسَ بَعۡضَهُمۡ بِبَعۡضٍ ۙ لَّفَسَدَتِ الۡاَرۡضُ وَ لٰکِنَّ اللّٰهَ ذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿

২৫১. অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে (কাফেরদেরকে) পরাভূত করল এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করলেন। আর আল্লাহ্‌ তাকে রাজত্ব ও হেকমত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছে করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন। আর আল্লাহ্‌ যদি মানুষের এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ সৃষ্টিকুলের প্রতি অনুগ্রহশীল।

দাঊদ (আঃ) তখন না নবী ছিলেন, না রাজা। বরং ত্বালূতের সৈন্যদলের একজন সাধারণ সৈনিক ছিলেন। তাঁরই হাতে মহান আল্লাহ জালূতকে ধ্বংস করলেন এবং অল্প সংখ্যক ঈমানদার দ্বারা বিশাল এক জাতিকে জঘন্যভাবে পরাজিত করলেন।

এখানে ফা দিয়ে অতঃপর বলে যা বুঝানো হচ্ছে তা হলো দু’আ ও সবরের ফলাফল মহান আল্লাহ তাদের জয়ী করে দিয়েছিলেন।

আবার ফা দিয়ে ইমেডিয়েট বুঝায়।

[2] এর পর মহান আল্লাহ দাঊদ (আঃ)-কে রাজত্বও দিলেন এবং নবুঅতও। ‘হিকমত’ বলতে কেউ বলেছেন, নবুঅত। কেউ বলেছেন, লোহার কারিগরী এবং কেউ বলেছেন, যুদ্ধ সম্বন্ধীয় বিষয়ের এমন পারদর্শিতা, যা আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত স্থানে বড় নিষ্পত্তিকর সাব্যস্ত হয়েছিল।

পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা অক্ষুন্ন রাখার জন্য মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ যে পদ্ধতি নির্ধারণকরেছেন তা হচ্ছে এই যে, তিনি বিভিন্ন মানব গোষ্ঠী ও দলকে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত দুনিয়ায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভের সুযোগ দিয়ে থাকেন৷ কিন্তু যখনই কোন দল সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে তখনই তিনি অন্য একটি দলের সাহায্যে তার শক্তির দর্প চূর্ণ করে দেন৷ কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা চিরন্তনভাবে একটি জাতি ও একটি দলের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে রাখা হতো এবং তার ক্ষমতার দাপট ও জুলুম-নির্যাতন হতো সীমাহীন ও অশেষ, তাহলে নিসন্দেহে আল্লাহর এই রাজ্যে মহা বিপর্যয় নেমে আসতো৷

এখানে আল্লাহর এক নিয়মের কথা বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি একদল মানুষের মাধ্যমেই অপর একদল মানুষের যুলুম-অত্যাচার ও ক্ষমতা নিশ্চিহ্ন করে থাকেন। তিনি যদি এ রকম না করে কোন একই পক্ষকে সব সময়ের জন্য ক্ষমতা ও এখতিয়ার দিয়ে রাখতেন, তাহলে এ পৃথিবী যুলুম-অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। কাজেই আল্লাহর এই নিয়ম বিশ্ববাসীর জন্য তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের একটি দৃষ্টান্ত। মহান আল্লাহ সূরা হজ্জের ৩৮ ও ৪০ নং আয়াতেও এ কথা উল্লেখ করেছেন।

যদি আল্লাহ লোকদেরকে একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন, তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী করে উচ্চারণ করা হয় সেসব আশ্রম, গীর্জা, ইবাদাতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হতো৷আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তাঁকে সাহায্য করবে৷ আল্লাহ বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রান্ত৷

অর্থাৎ আল্লাহ কোন একটি গোত্র বা জাতিকে স্থায়ী কর্তৃত্ব দান কেরননি, এটি তাঁর বিরাট অনুগ্রহ৷ বরং বিভিন্ন সময় দুনিয়ায় একটি দলকে দিয়ে তিনি অন্য একটি দলকে প্রতিহত করতে থেকেছেন৷ নয়তো কোন এটি নির্দিষ্ট দল যদি কোথাও স্থায়ী কর্তৃত্ব লাভ করতো তাহলে শুধু দূর্গ, প্রাসাদ এবং রাজনীতি, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস করে দেয়া হতো না বরং ইবাদাতগাহগুলোও বিধ্বস্ত হওয়ার হাত থেকে রেহাই পেতো না৷ সূরা বাকারায় এ বিষয়বস্তুকে এভাবে বলা হয়েছেঃ

“যদি আল্লাহ লোকদেরকে একজনের সাহায্যে অন্যজনকে প্রতিহত না করতে থাকতেন তাহলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে যেতো৷ কিন্তু আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি বড়ই করুণাময়৷” (২৫১ আয়াত)

জালূত ও তালূতের কাহিনী এবং দাঊদের বীরত্ব

সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়ে মূসা ও হারূণ (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে শামে এলেন এবং শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন, তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের পিতৃভূমি ফিলিস্তীনে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন এবং ফিলিস্তীন দখলকারী শক্তিশালী আমালেক্বাদের সঙ্গে জিহাদের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে এ ওয়াদাও দিলেন যে, জিহাদে নামলেই তোমাদের বিজয় দান করা হবে (মায়েদাহ ৫/২৩)।

কিন্তু এই ভীতু ও জিহাদ বিমুখ বিলাসী জাতি তাদের নবী মূসাকে পরিষ্কার বলে দিল, اذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ-(المائدة ২৫)- ‘তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)।

এতবড় বেআদবীর পরে মূসা (আঃ) তাদের ব্যাপারে নিরাশ হলেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই দুভাই পরপর তিন বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বরণ করলেন।

জিহাদের আদেশ অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর যাবত উন্মুক্ত কারাগারে অতিবাহিত করার পর মূসার শিষ্য ও ভাগিনা এবং পরবর্তীতে নবী ইউশা‘ বিন নূনের নেতৃত্বে জিহাদ সংঘটিত হয় এবং আমালেক্বাদের হটিয়ে তারা ফিলিস্তীন দখল করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তারা পুনরায় বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয় এবং নানাবিধ অনাচারে লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তাদের উপরে পুনরায় আমালেক্বাদের চাপিয়ে দেন। বনু ইস্রাঈলরা আবার নিগৃহীত হ’তে থাকে। এভাবে বহু দিন কেটে যায়। এক সময় শ্যামুয়েল (شمويل) নবীর যুগ আসে। লোকেরা বলে আপনি আমাদের জন্য একজন সেনাপতি দানের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, যাতে আমরা আমাদের পূর্বের ঐতিহ্য ফিরে পাই এবং বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তি পাই। এই ঘটনা আল্লাহ তার শেষনবীকে শুনিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়-

أَلَمْ تَرَ إِلَى الْمَلإِ مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ مِن بَعْدِ مُوسَى إِذْ قَالُوْا لِنَبِيٍّ لَّهُمُ ابْعَثْ لَنَا مَلِكاً نُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللهِ قَالَ هَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ أَلاَّ تُقَاتِلُوْا قَالُوْا وَمَا لَنَا أَلاَّ نُقَاتِلَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَقَدْ أُخْرِجْنَا مِنْ دِيَارِنَا وَأَبْنَآئِنَا فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ تَوَلَّوْا إِلاَّ قَلِيلاً مِّنْهُمْ وَاللهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِيْنَ- (البقرة ২৪৬)-

‘তুমি কি মূসার পরে বনু ইস্রাঈলদের একদল নেতাকে দেখনি, যখন তারা তাদের নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন শাসক প্রেরণ করুন, যাতে আমরা (তার নেতৃত্বে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি। নবী বললেন, তোমাদের প্রতি কি এমন ধারণা করা যায় যে, লড়াইয়ের নির্দেশ দিলে তোমরা লড়াই করবে? তারা বলল, আমাদের কি হয়েছে যে, আমরা আল্লাহর পথে লড়াই করব না? অথচ আমরা বিতাড়িত হয়েছি নিজেদের ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততি হ’তে! অতঃপর যখন লড়াইয়ের নির্দেশ হ’ল তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া বাকীরা সবাই ফিরে গেল। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যালেমদের ভাল করেই জানেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৬)। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-

وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ اللهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوتَ مَلِكاً قَالُوْا أَنَّى يَكُونُ لَهُ الْمُلْكُ عَلَيْنَا وَنَحْنُ أَحَقُّ بِالْمُلْكِ مِنْهُ وَلَمْ يُؤْتَ سَعَةً مِّنَ الْمَالِ قَالَ إِنَّ اللهَ اصْطَفَاهُ عَلَيْكُمْ وَزَادَهُ بَسْطَةً فِي الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ وَاللهُ يُؤْتِي مُلْكَهُ مَن يَّشَآءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ- وَقَالَ لَهُمْ نِبِيُّهُمْ إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ أَن يَّأْتِيَكُمُ التَّابُوْتُ فِيْهِ سَكِيْنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَبَقِيَّةٌ مِّمَّا تَرَكَ آلُ مُوْسَى وَآلُ هَارُونَ تَحْمِلُهُ الْمَلآئِكَةُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لَّكُمْ إِنْ كُنْتُم مُّؤْمِنِيْنَ-(البقرة ২৪৭-২৪৮)-

‘তাদের নবী তাদের বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য শাসক নিযুক্ত করেছেন। তারা বলল, সেটা কেমন করে হয় যে, তার শাসন চলবে আমাদের উপরে। অথচ আমরাই শাসন ক্ষমতা পাওয়ার অধিক হকদার। তাছাড়া সে ধন-সম্পদের দিক দিয়েও সচ্ছল নয়। জওয়াবে নবী বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপরে তাকে মনোনীত করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের দিক দিয়ে তাকে প্রাচুর্য দান করেছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন। তিনি হ’লেন প্রাচুর্য দানকারী ও সর্বজ্ঞ’। ‘নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের নেতৃত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের কাছে (তোমাদের কাংখিত) সিন্দুকটি আসবে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে তোমাদের হৃদয়ের প্রশান্তি রূপে। আর তাতে থাকবে মূসা, হারূণ ও তাদের পরিবার বর্গের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বহন করে আনবে ফেরেশতাগণ। এতেই তোমাদের (শাসকের) জন্য নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (বাক্বারাহ ২/২৪৭-২৪৮)।

বিষয়টি এই যে, বনু ইস্রাঈলগণের নিকটে একটা সিন্দুক ছিল। যার মধ্যে তাদের নবী মূসা, হারূণ ও তাঁদের পরিবারের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী ছিল। তারা এটাকে খুবই বরকতময় মনে করত এবং যুদ্ধকালে একে সম্মুখে রাখত। একবার আমালেক্বাদের সাথে যুদ্ধের সময় বনু ইস্রাঈলগণ পরাজিত হলে আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূত উক্ত সিন্দুকটি নিয়ে যায়। এক্ষণে যখন বনু ইস্রাঈলগণ পুনরায় জিহাদের সংকল্প করল, তখন আল্লাহ তাদেরকে উক্ত সিন্দুক ফিরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। অতঃপর এই সিন্দুকটির মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়ার নিরসন করেন।

সিন্দুকটি তালূতের বাড়ীতে আগমনের ঘটনা এই যে, জালূতের নির্দেশে কাফেররা যেখানেই সিন্দুকটি রাখে, সেখানেই দেখা দেয় মহামারী ও অন্যান্য বিপদাপদ। এমনিভাবে তাদের পাঁচটি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ট হয়ে তারা একে তার প্রকৃত মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং গরুর গাড়ীতে উঠিয়ে হাঁকিয়ে দিল। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশমতে গরুর গাড়ীটিকে তাড়িয়ে এনে তালূতের ঘরের সম্মুখে রেখে দিল। বনু ইস্রাঈলগণ এই দৃশ্য দেখে সবাই একবাক্যে তালূতের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্ত্ততি শুরু করলেন।

সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হ’লে তিনি কথিত মতে ৮০,০০০ হাজার সেনাদল নিয়ে রওয়ানা হন। ইবনু কাছীর এই সংখ্যায় সন্দেহ পোষণ করে বলেন, ক্ষুদ্রায়তন ফিলিস্তীন ভূমিতে এই বিশাল সেনাদলের সংকুলান হওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার। আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ২/৮;

অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাঊদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর। এ বিষয়টি কুরআন বর্ণনা করেছে নিম্নরূপ:

فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوْتُ بِالْجُنُوْدِ قَالَ إِنَّ اللهَ مُبْتَلِيْكُمْ بِنَهَرٍ فَمَنْ شَرِبَ مِنْهُ فَلَيْسَ مِنِّي وَمَنْ لَّمْ يَطْعَمْهُ فَإِنَّهُ مِنِّيْ إِلاَّ مَنِ اغْتَرَفَ غُرْفَةً بِيَدِهِ فَشَرِبُوْا مِنْهُ إِلاَّ قَلِيلاً مِّنْهُمْ فَلَمَّا جَاوَزَهُ هُوَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ قَالُوْا لاَ طَاقَةَ لَنَا الْيَوْمَ بِجَالُوْتَ وَجُنُوْدِهِ قَالَ الَّذِيْنَ يَظُنُّوْنَ أَنَّهُم مُّلاَقُو اللهِ: كَم مِّنْ فِئَةٍ قَلِيْلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيْرَةً بِإِذْنِ اللهِ وَاللهُ مَعَ الصَّابِرِيْنَ-(البقرة ২৪৯)-

‘অতঃপর তালূত যখন সৈন্যদল নিয়ে বের হ’ল, তখন সে বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। যে ব্যক্তি সেই নদী হ’তে পান করবে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত হবে। তবে হাতের এক আঁজলা মাত্র। অতঃপর সবাই সে পানি থেকে পান করল, সামান্য কয়েকজন ব্যতীত। পরে তালূত যখন নদী পার হ’ল এবং তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি (তখন অধিক পানি পানকারী সংখ্যাগরিষ্ট) লোকেরা বলতে লাগল, আজকের দিনে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। (পক্ষান্তরে) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সম্মুখে তাদের একদিন উপস্থিত হ’তেই হবে, তারা বলল, কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড় বড় দলের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৯)।

বস্ত্ততঃ নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর যুদ্ধকালে যুদ্ধরত ছাহাবীগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাযারো সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে। বস্ত্তবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই ছিলেন দাঊদ। আল্লাহ বলেন,

وَلَمَّا بَرَزُوْا لِجَالُوْتَ وَجُنُوْدِهِ قَالُوْا رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْراً وَّثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِيْنَ-(البقرة ২৫০)-

‘আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হ’ল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’ (বাক্বারাহ ২/২৫০)।

জালূত বিরাট সাজ-সজ্জা করে হাতীতে সওয়ার হয়ে সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগল এবং সে যুগের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষের সেরা যোদ্ধাকে আহবান করতে থাকল। অল্পবয়ষ্ক বালক দাঊদ নিজেকে সেনাপতি তালূতের সামনে পেশ করলেন।

তালূত তাকে পাঠাতে রাযী হ’লেন না। কিন্তু দাঊদ নাছোড় বান্দা। অবশেষে তালূত তাকে নিজের তরবারি দিয়ে উৎসাহিত করলেন এবং আল্লাহর নামে জালূতের মোকাবিলায় প্রেরণ করলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি এ ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি জালূতকে বধ করে ফিলিস্তীন পুনরুদ্ধার করতে পারবে, তাকে রাজ্য পরিচালনায় শরীক করা হবে। অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত জালূতকে মারা খুবই কঠিন ছিল। কেননা তার সারা দেহ ছিল লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত। তাই তরবারি বা বল্লম দিয়ে তাকে মারা অসম্ভব ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় দাঊদ ছিলেন পাথর ছোঁড়ায় উস্তাদ। সমবয়সীদের সাথে তিনি মাঠে গিয়ে নিশানা বরাবর পাথর মারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দাঊদ পকেট থেকে পাথর খন্ড বের করে হাতীর পিঠে বসা জালূতের চক্ষু বরাবর নিশানা করে এমন জোরে মারলেন যে, তাতেই জালূতের চোখশুদ্ধ মাথা ফেটে মগয বেরিয়ে চলে গেল। এভাবে জালূত মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার সৈন্যরা পালিয়ে গেল। যুদ্ধে তালূত বিজয় লাভ করলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَهَزَمُوْهُمْ بِإِذْنِ اللهِ وَقَتَلَ دَاوُودُ جَالُوْتَ وَآتَاهُ اللهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَهُ مِمَّا يَشَآءُ وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الأَرْضُ وَلَـكِنَّ اللهَ ذُوْ فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِيْنَ-(البقرة ২৫১)-

‘অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে দান করলেন রাজ্য ও দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দান করলেন, যা তিনি চাইলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যদি এভাবে একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্তই দয়াশীল’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)।

[4]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ২/৮; আমরা মনে করি স্থান সংকুলান বড় কথা নয়। যুদ্ধটাই বড় কথা। কেননা আমরা দেখেছি যে, পরবর্তীতৈ এর পাশেই আজনাদাইন ও ইয়ারমূক যুদ্ধে ২,৪০,০০০ রোমক সৈন্যের মুকাবিলায় মুসলমানরা ৪০,০০০ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করেছে ও বিজয়ী হয়েছে (ঐ, ৭/৭)

শিক্ষণীয় বিষয় (১) নেতৃত্বের জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন হ’ল জ্ঞান ও দৈহিক স্বাস্থ্য, যা তালূতের মধ্যে ছিল।

(২) নেতৃত্বের জন্য বংশ ও অর্থ-সম্পদের চাইতে বড় প্রয়োজন দৃঢ় ঈমান ও আল্লাহর উপরে নির্ভরশীলতা।

(৩) নেতার জন্য অবশ্য কর্তব্য হ’ল কর্মীদের পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করা। যেমন তালূত করেছিলেন।

(৪) চিরকাল সংখ্যালঘু ঈমানদারগণ সংখ্যাগুরু অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে থাকে। যা তালূত ও জালূতের ঘটনায় প্রমাণিত হয়।

(৫) আল্লাহর উপরে নির্ভরশীল, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও কুশলী সেনাপতি এবং স্বল্পসংখ্যক নিবেদিত প্রাণ লোকই যথেষ্ট হয় বিজয় লাভের জন্য। তালূত ও দাঊদ যার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।

(৬) অস্ত্রবল ও জনবলের চাইতে ঈমানী বল যেকোন বিজয়ের মূল শক্তি।

(৭) উপরোক্ত ঘটনায় আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, তালূত কর্তৃক পরীক্ষা গ্রহণের ফলে তাঁর আমলেই বনু ইস্রাঈলগণের মধ্যে দু’টি দলের সৃষ্টি হয়। একদল তালূতের অনুগত মুমিন। যারা নিজেদেরকে ‘বনূ ইস্রাঈল’ বলেই পরিচিত করে। অর্থ ‘আল্লাহর দাস’-এর বংশ। অপর দল ছিল মুনাফিক- যাদেরকে ‘ইয়াহুদী’ বলা হ’ত। প্রকৃত বনু ইস্রাঈলগণ ‘ইয়াহুদী’ নামকে ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজও পৃথিবীতে তারা ঘৃণিত হয়েই আছে। অতদিন কিয়ামত হবেনা যতদিন না মুসলমানরা একে একে এদেরকে হত্যা করবেন। গাছ ও পাথর পর্যন্ত এদের পালিয়ে থাকা অবস্থান মুসলমানদের জানিয়ে দেবে। মুসলিম, মিশকাত হা/৫৪১৪ ‘ফিতান’ অধ্যায়, ১ অনুচ্ছেদ।

২:২৫২ تِلۡکَ اٰیٰتُ اللّٰهِ نَتۡلُوۡهَا عَلَیۡکَ بِالۡحَقِّ ؕ وَ اِنَّکَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ

(২৫২) এই সমস্ত আল্লাহর নিদর্শন; যা আমি যথাযথভাবেম তোমাকে পড়ে শুনাচ্ছি। আর নিশ্চয় তুমি রসূলগণের অন্যতম।

অতীতের যে ঘটনাগুলো রসূল (সাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ কিতাবের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে, হে মুহাম্মাদ! অবশ্যই সে সমস্ত ঘটনাগুলো তোমার রিসালাত ও সত্যতার দলীল। কারণ, এগুলো না তুমি কোন কিতাবে পড়েছ, আর না কারো কাছ থেকে শুনেছ। আর এ থেকে এ কথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এগুলো সব অদৃশ্য জগতের (গায়বী) খবরাদি, যা মহান আল্লাহ কর্তৃক অহীর মাধ্যমে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। কুরআন কারীমের বহু স্থানে অতীত উম্মতের ঘটনাবলী রসূল (সাঃ)-এর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ পেশ করা হয়েছে।

 تِلۡکَ الرُّسُلُ فَضَّلۡنَا بَعۡضَهُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ ۘ مِنۡهُمۡ مَّنۡ کَلَّمَ اللّٰهُ وَ رَفَعَ بَعۡضَهُمۡ دَرَجٰتٍ ؕ وَ اٰتَیۡنَا عِیۡسَی ابۡنَ مَرۡیَمَ الۡبَیِّنٰتِ وَ اَیَّدۡنٰهُ بِرُوۡحِ الۡقُدُسِ ؕ وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰهُ مَا اقۡتَتَلَ الَّذِیۡنَ مِنۡۢ بَعۡدِهِمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡهُمُ الۡبَیِّنٰتُ وَ لٰکِنِ اخۡتَلَفُوۡا فَمِنۡهُمۡ مَّنۡ اٰمَنَ وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ کَفَرَ ؕ وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰهُ مَا اقۡتَتَلُوۡا ۟ وَ لٰکِنَّ اللّٰهَ یَفۡعَلُ مَا یُرِیۡدُ ﴿

২৫৩. সে রাসূলগণ, আমরা তাদের কাউকে অপর কারো উপর শ্ৰেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাদের মধ্যে এমন কেউ রয়েছেন যার সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন, আবার কাউকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। আর মারইয়াম-পুত্র ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণাদি প্রদান করেছি ও রুহুল কুদুস দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে তাদের পরবর্তীরা তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণাদি সমাগত হওয়ার পরও পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হত না; কিন্তু তারা মতভেদ করলো। ফলে তাদের কেউ কেউ ঈমান আনলো এবং কেউ কেউ কুফরী করল। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে তারা পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হত না; কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করেন।

কথা বলা আল্লাহ তা’আলার একটি গুণ। তিনি যখন যেভাবে ইচ্ছা শ্রুত বাক্য দ্বারা কথা বলেন। কথা বলার এ গুণটির উপর কুরআন ও সুন্নাহর বহুদলীল রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

“এবং মূসার সাথে আল্লাহ কথা বলেছিলেন”। [সূরা আন-নিসাঃ ১৬৪]

আল্লাহ আরও বলেনঃ “আর মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলেন এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন, তখন মূসা বললেনঃ হে আমার রব! আমাকে দর্শন দান করুন, আমি আপনাকে দেখব”। [সূরা আল-আরাফঃ ১৪৩]

আর সুন্নাহ হতে দলীল হলো, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আদম ও মূসা বাদানুবাদে লিপ্ত হলেন। মূসা আদমকে বললেন, হে আদম! আপনি আমাদের পিতা। আমাদেরকে নিরাশ করে আপনি আমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন। আদম তাকে বললেন, হে মূসা আল্লাহ আপনাকে কথপোকথন দ্বারা নির্বাচিত করেছেন এবং নিজ হস্তে আপনাকে তাওরাত লিখে দিয়েছেন……। [বুখারীঃ ৬৬১৪, মুসলিমঃ ২৬৫২]

তবে মূসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদের মাধ্যম ব্যতীত কথা বললেও তা অন্তরালমুক্ত ছিল না। কেননা, সূরা শুরার (وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُكَلِّمَهُ اللَّهُ) (কোন মানুষের পক্ষে আল্লাহর সাথে কথা বলা বাস্তবসম্মত নয়) আয়াতে অন্তরালমুক্তভাবে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কথা বলার বিষয়টিকে নাকচ করা হয়েছে। অবশ্য মৃত্যুর পর কোন রকম অন্তরাল বা যবনিকা ছাড়াই কথাবার্তা হবে বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাই সূরা আশ-শুরার সে আয়াতটি দুনিয়ার জীবনের সাথে সম্পৃক্ত।

কুরআন অন্য আর এক স্থানেও এ কথা বর্ণনা করেছে।

{وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِيِّينَ عَلَى بَعْضٍ} ‘‘আমি তো কতক পয়গম্বরকে কতক পয়গম্বরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’’ (বানী-ইস্রাঈল ৫৫)

কাজেই এ প্রকৃতত্বের ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নেই। তবে নবী করীম (সাঃ) যে বলেছেন, ‘‘তোমরা আমাকে নবীদের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব দিও না।’’ (বুখারী ৪৬৩৮, মুসলিম ২৩৭৩নং)

এ থেকে একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের অস্বীকৃতি সাব্যস্ত হয় না, বরং এ থেকে উম্মতকে নবীদের ব্যাপারে আদব ও সম্মান দানের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, তোমরা যেহেতু সে সমূহ বৈশিষ্ট্য ও বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত নও, যার ভিত্তিতে তাঁদের কেউ অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছেন, তাই তোমরা আমার শ্রেষ্ঠত্বও এমনভাবে বর্ণনা করো না, যাতে অন্য নবীদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। নবীদের পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং সমস্ত নবীদের উপর সর্বশেষ নবী (সাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা তো সুসাব্যস্ত বিষয় এবং আহলে সুন্নাহর ঐকমত্যপূর্ণ বিশ্বাস; যা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (আরো বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্যঃ ফাতহুল ক্বাদীর।

নবী ও রাসূলগণের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে যারা উত্তম:

রাসূলগণের সংখ্যা তিন শত দশের কিছু বেশি প্রমাণিত হয়েছে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন রাসূলগণের সংখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তিনি বলেন,

«ثلاثمائة وخمس عشرة جماً وغفيراً»

“তিনশত পনের জনের বিরাট এক দল।” (হাকিম)

আর নবীদের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। আল্লাহ তাদের কারোও কথা তাঁর কিতাবে আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেন, আর কারোও কথা বর্ণনা করেন নি।

আল্লাহ তাঁর কিতাবে পঁচিশ জন নবী ও রাসূলের নাম উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَرُسُلٗا قَدۡ قَصَصۡنَٰهُمۡ عَلَيۡكَ مِن قَبۡلُ وَرُسُلٗا لَّمۡ نَقۡصُصۡهُمۡ عَلَيۡكَۚ وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَكۡلِيمٗا ١٦٤﴾ [النساء: ١٦٤]

“আর এমন কতক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের ইতিবৃত্ত আমরা আপনাকে বর্ণনা করেছি ইতোপূর্বে এবং এমন কতক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের বৃত্তান্ত আপনার কাছে বর্ণনা করি নি।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৪]

তিনি আরো বলেন,

“এটি ছিল আমার যুক্তি, যা আমরা ইবরাহীমকে তাঁর সম্প্রদায়ের বিপক্ষে প্রদান করেছিলাম। আমরা যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় সমুন্নত করি। আপনার পালনকর্তা প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী। আমরা তাঁকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকূব। প্রত্যেককেই আমরা পথ-প্রদর্শন করেছি এবং পূর্বে আমি নূহকে পথ-প্রদর্শন করেছি- তাঁর সন্তানদের মধ্যে দাউদ, সোলায়মান, আইউব, ইউসুফ, মূসা ও হারুনকে। এমনিভাবে আমরা সৎকর্মীদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। আরও যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকে। তারা সবাই পূণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর ইসমাঈল, ঈসা, ইউনুস, লূতকে প্রত্যেককেই আমরা সারা বিশ্বের ওপর গৌরবান্বিত করেছি। আরো তাদের কিছু সংখ্যক পিতৃপুরুষ, সন্তান-সন্ততি ও ভ্রাতাদেরকে, আমরা তাদেরকে মনোনীত করেছি এবং সরল পথ প্রদর্শন করেছি।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৮৩-৮৭]

আল্লাহ নবীদের কাউকে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدۡ فَضَّلۡنَا بَعۡضَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ عَلَىٰ بَعۡضٖۖ﴾ [الاسراء: ٥٥]

“অবশ্যই আমরা নবীদেরকে কতককে কতকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৫]

এবং আল্লাহ রাসূলদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿تِلۡكَ ٱلرُّسُلُ فَضَّلۡنَا بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖۘ﴾ [البقرة: ٢٥٣]

“এ রাসূলগণ আমরা তাদের কাউকে কারো ওপর মর্যাদা দান করেছি।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৩]

রাসূলগণের মধ্যে যারা উলুল-আযম তথা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন তারা সর্ব উত্তম। তারা হলেন নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَٱصۡبِرۡ كَمَا صَبَرَ أُوْلُواْ ٱلۡعَزۡمِ مِنَ ٱلرُّسُلِ﴾ [الاحقاف: ٣٥]

“অতএব আপনি ধৈর্য ধরুন, যেমন উলুল আযম (উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন) রাসূলগণ ধৈর্য ধরেছেন।” [সূরা আল-আহক্বাফ, আয়াত: ৩৫]

﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مِيثَٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوحٖ وَإِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَۖ وَأَخَذۡنَا مِنۡهُم مِّيثَٰقًا غَلِيظٗا ٧﴾ [الاحزاب: ٧]

“যখন আমরা নবীগণের কাছ থেকে, আপনার কাছ থেকে এবং নূহ, ইবরাহীম মূসা ও মারিইয়ামের পুত্র ঈসার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম, আরো অঙ্গীকার নিলাম তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৭]

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী, মুত্তাকীদের ইমাম, আদম সন্তানের সরদার।

নবীরা যখন একত্রিত হবেন তখন তিনি তাদের ইমাম। যখন তারা কোনো জায়গা থেকে প্রতিনিধি দল হিসাবে আগমন করেন তখন তিনি তাদের প্রবক্তা।

তিনি মাকামে মাহমুদের (প্রশংসিত স্থানের) মালিক, যে স্থানকে নিয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলেই ঈর্ষা করবে।

অবতরণ স্থান, হাউয ও হামদ বা প্রশংসার ঝাণ্ডার মালিক।

শেষ দিবসে সমস্ত সৃষ্টি জীবের সুপারিশকারী, জান্নাতের ওয়াসীলা নামক স্থা্ন ও মর্যাদার মালিক।

আল্লাহ তাকে তাঁর দীনের সর্বোত্তম শরী‘আত বিধি-বিধান দিয়ে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর উম্মাতকে সর্বোত্তম উম্মতরূপে এই পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণের জন্য পাঠানো হয়েছে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মাতের জন্য বহু মর্যাদা ও উত্তম বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন। যা তাদের পূর্ববর্তীদের থেকে স্বতন্ত্র। সৃষ্টির দিক দিয়ে তারা সর্বশেষ উম্মত আর পুনরুত্থানে তারা সর্বপ্রথম উম্মত।

আল্লাহ তা‘আলা নবীদের মর্যাদায় তারতম্য করেছেন। কেউ কারো থেকে শ্রেষ্ঠ। শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল।

শ্রেষ্ঠত্বের বিবেচনায় দ্বিতীয় ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

«فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى، قَدِ اتَّخَذَنِي خَلِيلًا، كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا».

“নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে খলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন, যেমন তিনি খলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন ইবরাহীমকে”। মুসলিম: (৮৩২)

অতঃপর মর্যাদার বিবেচনায় তৃতীয় স্থানে আছেন মূসা ‘আলাইহিস সালাম। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿ وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَكۡلِيمٗا ١٦٤ ﴾ [النساء : ١٦٤]

“আর আল্লাহ মূসার সাথে সুস্পষ্টভাবে কথা বলেছেন”। সূরা নিসা: (১৬৪) দ্বিতীয় দলিল তার উম্মতের সংখ্যা অধিক হবে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

«وَرَأَيْتُ سَوَادًا كَثِيرًا سَدَّ الْأُفُقَ، فَرَجَوْتُ أَنْ تَكُونَ أُمَّتِي، فَقِيلَ هَذَا مُوسَى وَقَوْمُهُ»

“আমি বিরাট একদল দেখলাম, যা দিগন্ত আড়াল করে রেখেছে। আমি আশা করেছি দলটি আমার উম্মত হোক, আমাকে বলা হল: এ হচ্ছে মূসা ও তার কওম”। বুখারি: (৩১৮১) অপর হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لَا تُخَيِّرُونِي عَلَى مُوسَى، فَإِنَّ النَّاسَ يَصْعَقُونَ، فَأَكُونُ أَوَّلَ مَنْ يُفِيقُ، فَإِذَا مُوسَى بَاطِشٌ بِجَانِبِ الْعَرْشِ، فَلَا أَدْرِي، أَكَانَ فِيمَنْ صَعِقَ، فَأَفَاقَ قَبْلِي، أَمْ كَانَ مِمَّنْ اسْتَثْنَى اللَّهُ ؟».

“তোমরা আমাকে মূসার উপর প্রাধান্য দিয়ো না, কারণ মানুষেরা সংজ্ঞাহীন হবে, আমি সর্বপ্রথম সংজ্ঞা ফিরে পাব, তখন দেখব মূসা আরশের পার্শ্ব ধরে আছেন। আমি জানি না, তিনি সংজ্ঞাহীনদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আমার পূর্বে জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন, না আল্লাহ যাদেরকে সংজ্ঞামুক্ত রেখেছেন তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন”?মুসলিম: (৪৩৮৪)

ইসরা ও মেরাজের হাদিসে তার মর্তবা ষষ্ঠ আসমানে বিধৃত হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় মর্যাদার বিবেচনায় মূসা ‘আলাইহিস সালাম তৃতীয় স্থানে

চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছেন ঈসা ও নূহ ‘আলাইহিমুস সালাম। তাদের দু’জনের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণে আলেমগণ দ্বিমত করেছেন। কেউ বলেন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম শ্রেষ্ঠ, কেউ বলেন নূহ ‘আলাইহিস সালাম শ্রেষ্ঠ। কেউ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণে নীরবতা অবলম্বন করেন। উল্লেখিত পাঁচজন সবাই শ্রেষ্ঠ রাসূল। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿فَٱصۡبِرۡ كَمَا صَبَرَ أُوْلُواْ ٱلۡعَزۡمِ مِنَ ٱلرُّسُلِ ٣٥﴾ [الاحقاف: ٣٥]

“অতএব তুমি ধৈর্যধারণ কর, যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল সুদৃঢ় সংকল্পের রাসূলগণ”। সূরা আহযাব: (৩৫)

অন্যত্র ইরশাদ করেন:

﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مِيثَٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوحٖ وَإِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَۖ وَأَخَذۡنَا مِنۡهُم مِّيثَٰقًا غَلِيظٗا ٧﴾ [الاحزاب : ٧]

“আর স্মরণ কর, যখন আমি অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম নবীদের থেকে এবং তোমার থেকে, নূহ, ইবরাহিম, মূসা ও মারইয়াম পুত্র ঈসা থেকে। আর আমি তাদের কাছ থেকে সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম”। সূরা আহযাব: (৭)

এখানে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বাগ্রে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ لَخَاتَمُ النَّبِيِّينَ، وَإِنَّ آدَمَ عَلَيْهِ السَّلَام لَمُنْجَدِلٌ فِي طِينَتِهِ».

“আমি আল্লাহর বান্দা, নিশ্চয় সর্বশেষ নবী, তখন আদম ‘আলাইহিস সালাম ছিল মাটিতে মিশ্রিত”। আহমদ: (১৬৮১৭

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«فضلت على الأنبياء بست».

“আমি ছয়টি বৈশিষ্ট্যে সকল নবীদের ওপর প্রাধান্য পেয়েছি।” (সহীহ মুসলিম)

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ৬টি বিষয় দ্বারা আমাকে সকল নবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে।

১. আমাকে অল্প ভাষায় অধিক ভাব প্রকাশের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

২. আমাকে সাহায্য করা হয়েছে শত্রুদের অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করার মাধ্যমে

৩. আমার জন্য গণীমত হালাল করা হয়েছে। [উল্লেখ্য, গণীমত পূর্ববর্তী উম্মতের জন্য হালাল ছিলনা]।

৪. পুরো পৃথিবীকে আমার জন্য পবিত্র ও মসজিদ করে দেয়া হয়েছে। [যা অন্য উম্মতের জন্য ছিলনা]

৫. আমাকে পুরো সৃষ্টির কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। [আগের সকল নবীকে নির্দিষ্ট গোত্রের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তাদের রিসালাত ছিল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য]

৬. আমার দ্বারা নবুঅতের ধারাবাহিকতাকে সমাপ্ত করা হয়েছে। মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৪৮ ‘নবীগণের সরদারের ফযীলত’ অধ্যায়।

হজরত আলী রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- মহানবী সা: বলেছেন- আমাকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য প্রদান করা হয়েছে, যা অন্য কোনো নবী-রাসূলকে প্রদান করা হয়নি। আমরা আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! এ বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন-

১. মহানবী সা:-এর চেহারা মোবারকে আল্লাহ তায়ালা এমন এক আকর্ষণীয় রূপ দান করেছিলেন, যা দেখে শত্রুরা ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ত। তাঁকে কিছু করার সাহস পেত না।

২. আমাকে সমগ্র দুনিয়ার চাবি দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ দুনিয়া আমার করতলগত এবং আমার অধীন হবে। এ ক্ষমতা অন্য কোনো নবী-রাসূলকে দেয়া হয়নি।

৩. আমার নাম রাখা হয়েছে আহমদ তথা অতি প্রশংসাকারী। এমন নাম কোনো নবী-রাসূলের রাখা হয়নি।

৪. আমার জন্য মাটিকে পবিত্র বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে পানির বিকল্প হিসেবে আমার উম্মতের জন্য মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ।

৫. আমার উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। (কুরতুবি)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন- আমার উম্মতকে এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে যা অন্য কোনো উম্মতকে দান করা হয়নি। ১. সালাম, তা জান্নাতিদের অভিবাদন ২. সারিবদ্ধ হয়ে ইবাদত করা তা ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য ৩. আমীন বলা, যা হজরত মূসা ও হজরত হারুন আ: ছাড়া কোনো নবীর সময় ছিল না। (ইবন খুজাইমা)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

«أنا سيد ولد آدم يوم القيامة وبيدي لواء الحمد ولا فخر. وما من نبي يومئذ آدم فمن سواه إلا تحت لوائي يوم القيامة».

“আমি কিয়ামত দিবসে আদম সন্তানের সর্দার, আমারই হাতে হামদের পতাকা থাকবে। এটা কোনো গর্বের বিষয় নয়। কিয়ামত দিবসে আদম ছাড়া সকলেই আমার পতাকার অধীনে থাকবে।” (তিরমিযী ও আহমদ)

মর্যাদার দিক দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে যিনি তিনি হলেন ইবরাহীম খালীলুর রহমান। সুতরাং (আল্লাহর) দু’বন্ধু -মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উলুল আযমদের সর্বশ্রেষ্ঠ। অতঃপর তিনজন (নূহ, মূসা ও ঈসা) সর্বশ্রেষ্ঠ (অন্য সব নবীদের চেয়ে)।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদিসে অন্যান্য নবীর উপর তাকে প্রাধান্য দিতে নিষেধ করেছেন। কোথাও তিনি বলেছেন:

«لَا تُخَيِّرُوا بَيْنَ الْأَنْبِيَاءِ».

“নবীদের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ কর না”। বুখারি: (৬৪৩৩), ও মুসলিম: (৪৩৮৫)

অথচ উপরের আলোচনা থেকে জানলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ এবং নবীদের মাঝে মর্যাদার তারতম্য রয়েছে। ইব্‌ন কাসির রাহিমাহুল্লাহ্ সূরা বাকারার (২৫৩)নং আয়াতের ব্যাখ্যায় এ প্রশ্নের কয়েকটি উত্তর দিয়েছেন:

১. মর্যাদার তারতম্য জানার পূর্বে তিনি নিষেধ করেছেন।

২. বিনয়ী ও নম্রতার খাতিরে তিনি নিষেধ করেছেন।

৩. তর্কের সময় অহংকার করে প্রাধান্য দিতে নিষেধ করেছেন।

৪. সাম্প্রদায়িকতার জন্য প্রাধান্য দিতে নিষেধ করেছেন।

৫. তার নিষেধ করার অর্থ মর্যাদার বিষয়টি তোমাদের উপর ন্যস্ত নয়, আল্লাহর উপর ন্যস্ত। তোমাদের দায়িত্ব শুধু আনুগত্য করা।

কারও কারও মতে, নতুন শরীয়ত নিয়ে আগমনকারীকে রাসূল বলা হয়, আর পূর্বের রাসূলের শরীয়ত প্রচারকারীকে বলা হয় নবী। প্রত্যেক রাসূল নবী, কিন্তু প্রত্যেক নবী রাসূল নয়।

এই বিষয়টাকে মহান আল্লাহ কুরআনের কয়েক স্থানে বর্ণনা করেছেন। এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর নাযিল করা দ্বীনে মতভেদ পছন্দনীয়। এটা তো আল্লাহর নিকট খুবই অপছন্দনীয়। তাঁর পছন্দনীয় ও সন্তোষজনক জিনিস হল, সমস্ত মানুষ তাঁর নাযিল করা শরীয়তকে অবলম্বন করে জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে যাক। এই জন্যই তিনি গ্রন্থসমূহ অবতীর্ণ করেন, ক্রমাগতভাবে নবীদেরকে প্রেরণ করেন এবং নবী করীম (সাঃ)-কে প্রেরণ করে রিসালাতের ইতি টানেন।

এর পরও খলীফাগণ, উলামা এবং দ্বীনের আহবায়কদের মাধ্যমে সত্যের প্রতি আহবান, ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা প্রদানের ধারাবাহিকতা জারী রাখা হয় এবং তার গুরুত্বকে তুলে ধরে তার প্রতি তাকীদও করা হয়। এত ব্যবস্থা কেন? এই জন্যই যে, মানুষ যাতে আল্লাহর পছন্দনীয় পথকে অবলম্বন করে। কিন্তু যেহেতু তিনি হিদায়াত ও গুমরাহীর উভয় পথ প্রদর্শন করে দিয়ে মানুষকে কোন একটি পথ অবলম্বন করার জন্য বাধ্য করেননি, বরং পরীক্ষার জন্য তাকে (কোন একটি পথ) নির্বাচন করার ইচ্ছা ও স্বাধীনতা দিয়েছেন, সুতরাং কেউ এই এখতিয়ারের সদ্ব্যবহার করে মু’মিন হয়ে যায়, আবার কেউ এই এখতিয়ারের অসদ্ব্যবহার করে কাফের হয়ে যায়। অর্থাৎ, এটা তাঁর কৌশল ও ইচ্ছা সম্পর্কীয় বিষয়; যা তাঁর সন্তুষ্টি ও পছন্দ থেকে ভিন্ন জিনিস।

 

সংগ্রহে– তাফসিরে জাকারিয়া,আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন