সুরা বাকারাঃ ৩১তম রুকু (২৩৬-২৪২)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:২৩৬ لَا جُنَاحَ عَلَیۡکُمۡ اِنۡ طَلَّقۡتُمُ النِّسَآءَ مَا لَمۡ تَمَسُّوۡهُنَّ اَوۡ تَفۡرِضُوۡا لَهُنَّ فَرِیۡضَۃً ۚۖ وَّ مَتِّعُوۡهُنَّ ۚ عَلَی الۡمُوۡسِعِ قَدَرُهٗ وَ عَلَی الۡمُقۡتِرِ قَدَرُهٗ ۚ مَتَاعًۢا بِالۡمَعۡرُوۡفِ ۚ حَقًّا عَلَی الۡمُحۡسِنِیۡنَ
২৩৬. যদি তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ না করে অথবা মোহর নির্ধারণ না করেই তালাক দাও তবে তোমাদের কোন অপরাধ নেই। আর তোমরা তাদের কিছু সংস্থান করে দেবে, সচ্ছল তার সাধ্যমত এবং অসচ্ছল তার সামর্থ্যানুযায়ী, বিধিমত সংস্থান করবে, এটা মুহসিন লোকদের উপর কর্তব্য।
এ নির্দেশ এমন মহিলার জন্য, বিবাহের সময় যার দেনমোহর নির্ধারিত হয়নি এবং স্বামী সহবাসের পূর্বেই যাকে তালাক দিয়ে দিয়েছে, (বলা হচ্ছে,) তাকে কিছু না কিছু খরচপত্র (ক্ষতিপূরণস্বরূপ) দিয়ে বিদায় কর। এ খরচপত্র বা ক্ষতিপূরণ প্রত্যেক ব্যক্তির সামর্থ্য অনুযায়ী হওয়া উচিত। সচ্ছল ব্যক্তিরা তাদের সচ্ছলতা অনুযায়ী এবং অসচ্ছলরা তাদের সাধ্য মুতাবেক প্রদান করবে। সৎকর্মশীলদের পক্ষে এটা জরুরী কর্তব্য। আর খরচপত্র বা ক্ষতিপূরণের এই জিনিসকে নির্দিষ্টও করা হয়েছে। কেউ বলেছেন, একটি খাদেম। কেউ বলেছেন, ৫০০ দিরহাম। কেউ বলেছেন, এক বা একাধিক জোড়া কাপড় ইত্যাদি। তবে এ নির্দিষ্টীকরণ শরীয়ত কর্তৃক নয়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার সাধ্য অনুযায়ী দেওয়ার এখতিয়ার এবং নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারেও মতভেদ রয়েছে যে, খরচপত্র বা ক্ষতিপূরণ প্রত্যেক প্রকার তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে দেওয়া জরুরী; কেবল সেই তালাকপ্রাপ্তা মহিলার জন্য নির্দিষ্ট নয়, যার কথা এই আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। কুরআন কারীমের আরো অন্যান্য আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এটা প্রত্যেক প্রকার তালাকপ্রাপ্তা মহিলার জন্য। আর আল্লাহই ভালো জানেন। খরচপত্র বা ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কিছু জিনিস দেওয়ার মধ্যে যে হিকমত, যৌক্তিকতা ও সুফল আছে তা বর্ণনার মুখাপেক্ষী নয়। তালাকের কারণ স্বরূপ তিক্ততা, মন কষাকষি এবং মতবিরোধের সময়ে মহিলার প্রতি অনুগ্রহ করা এবং তার হার্দিক প্রশান্তি ও আন্তরিক তুষ্টির প্রতি যত্ন নেওয়া ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিবাদের পথ রোধ করার জন্য বড়ই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু আমাদের সমাজে এই অনুগ্রহ ও উত্তম আচরণের পরিবর্তে তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে এমন নাজেহাল করে বিদায় করা হয় যে, উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক চিরকালের জন্য বিদ্বেষপূর্ণ রয়ে যায়।
২:২৩৭ وَ اِنۡ طَلَّقۡتُمُوۡهُنَّ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ تَمَسُّوۡهُنَّ وَ قَدۡ فَرَضۡتُمۡ لَهُنَّ فَرِیۡضَۃً فَنِصۡفُ مَا فَرَضۡتُمۡ اِلَّاۤ اَنۡ یَّعۡفُوۡنَ اَوۡ یَعۡفُوَا الَّذِیۡ بِیَدِهٖ عُقۡدَۃُ النِّکَاحِ ؕ وَ اَنۡ تَعۡفُوۡۤا اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی ؕ وَ لَا تَنۡسَوُا الۡفَضۡلَ بَیۡنَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿
২৩৭. আর তোমরা যদি তাদেরকে স্পর্শ করার আগে তালাক দাও, অথচ তাদের জন্য মাহর ধার্য করে থাক, তাহলে যা তোমরা ধার্য করেছ তার অর্ধেক, তবে যা স্ত্রীগণ অথবা যার হাতে বিয়ের বন্ধন রয়েছে সে মাফ করে দেয় এবং মাফ করে দেয়াই তাকওয়ার নিকটতর। আর তোমরা নিজেদের মধ্যে অনুগ্রহের কথা ভুলে যেও না। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ তা সবিশেষ প্রত্যক্ষকারী।
মাহর ও স্ত্রীর সাথে নির্জনবাস ও সহবাসের প্রেক্ষিতে তালাকের চারটি অবস্থা নির্ধারিত হয়েছে। তন্মধ্যে ২৩৬ ও ২৩৭ নং আয়াতে দু’টি অবস্থার হুকুম বর্ণিত হয়েছে।
তার একটি হচ্ছে, যদি মাহর ধার্য করা না হয়।
দ্বিতীয়টি, মাহর ধার্য করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্ত্রীর সাথে নির্জনবাস বা সহবাস হয়নি।
তৃতীয়তঃ মাহর ধার্য হয়েছে এবং সহবাসও হয়েছে। এক্ষেত্রে ধার্যকৃত মোহর সম্পূর্ণই পরিশোধ করতে হবে। কুরআনুল কারীমের অন্য জায়গায় এ বিষয়টি বর্ণিত রয়েছে।
চতুর্থতঃ মাহর ধার্য করা হয়নি, অথচ সহবাসের পর তালাক দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর পরিবারে প্রচলিত মাহর পরিশোধ করতে হবে। এর বর্ণনাও অন্য এক আয়াতে এসেছে। ২৩৬ ও ২৩৭ নং আয়াতদ্বয়ে প্রথম দুই অবস্থার আলোচনা রয়েছে। তন্মধ্যে ২৩৬ নং আয়াতে প্রথম অবস্থার নির্দেশ হচ্ছে, মাহর কিছুই ওয়াজিব নয়।
তবে নিজের পক্ষ থেকে স্ত্রীকে কিছু দিয়ে দেয়া স্বামীর কর্তব্য। অন্ততপক্ষে তাকে এক জোড়া কাপড় দিয়ে দেবে। কুরআনুল কারীম প্রকৃতপক্ষে এর কোন পরিমাণ নির্ধারণ করেনি। অবশ্য এ কথা বলেছে যে, ধনী ব্যক্তিদের পক্ষে তাদের মর্যাদা অনুযায়ী দেয়া উচিত, যাতে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হয় যে, সামর্থ্যবান লোক এহেন ব্যাপারে কার্পণ্য করে না। হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু এমনি এক ব্যাপারে দশ হাজারের উপঢৌকন দিয়েছিলেন। আর কাজী শোরাইহ পাঁচশ দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) দিয়েছেন। দ্বিতীয় অবস্থায় হুকুম হচ্ছে এই যে, যদি স্ত্রীর মাহর বিয়ের সময় ধার্য করা হয়ে থাকে এবং তাকে সহবাসের পূর্বে তালাক দেয়া হয়, তবে ধার্যকৃত মাহরের অর্ধেক দিতে হবে। আর যদি স্ত্রী তা ক্ষমা করে দেয় কিংবা স্বামী পুরো মাহরই দিয়ে দেয়, তবে তা হচ্ছে তাদের ঐচ্ছিক ব্যাপার।
তালাকপ্রাপ্তা মহিলারা চার ধরনের। (ক) যার মোহর নির্ধারিত, স্বামী তার সাথে সহবাসও করেছে, তাকে তার মোহরের সম্পূর্ণ অধিকার দেওয়া হবে। যেমন, ২২৯নং আয়াতে এর বর্ণনা রয়েছে। (খ) মোহরও নির্ধারিত নেই এবং তার সাথে সহবাসও করা হয়নি, তাকে কেবল কিছু খরচপত্র দেওয়া হবে। (গ) মোহর নির্ধারিত, কিন্তু সহবাস হয়নি, তাকে অর্ধেক মোহর দেওয়া জরুরী। (উভয়ের ব্যাখ্যা ২৩৬-২৩৭ নং আয়াতে বিদ্যমান।) (ঘ) মোহর নির্ধারিত নেই, কিন্তু সহবাস করা হয়েছে, তার জন্য রয়েছে মোহরে মিসল। অর্থাৎ, এই মহিলার সমাজে যে পরিমাণ মোহরের প্রচলন আছে অথবা তার মত মহিলাদের সাধারণতঃ যে পরিমাণ মোহর দেওয়া হয়, তাকেও সে পরিমাণ মোহর দিতে হবে। (নাইনুল আওত্বার ও আ’উনুল মা’বুদ)
(২) “যার হাতে বিয়ের বন্ধন রয়েছে”-এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় আলেমগণ দুটি মতে বিভক্ত- (১) একদল আলেম বলেনঃ এখানে “যার হাতে বিয়ের বন্ধন রয়েছে” বলতে স্ত্রীর অভিভাবককে বোঝানো হয়েছে। তাদের মতের সমর্থনে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এ তাফসীর বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এ মত একদিকে শক্তিশালী, অপরদিকে দূর্বল, শক্তিশালী হলো এদিক থেকে যে, ক্ষমা করাটা মূলতঃ স্ত্রীর অভিভাবকের পক্ষেই মানানসই। অপরদিকে দূর্বল হলো এ দিক থেকে যে, সত্যিকারভাবে বিয়ের বন্ধন স্বামীর হাতেই। স্ত্রীর অভিভাবকের এখানে কোন হাত নেই। (২) আরেক দল আলেম বলেনঃ এখানে “যার হাতে বিয়ের বন্ধন” বলতে স্বামীকে বোঝানো হয়েছে। তাদের মতের সমর্থনেও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা রয়েছে। তাছাড়া ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমসহ অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীনদের থেকে বর্ণনা এসেছে। [দারাকুতনী: ৩/২৭৯]
এ মতও একদিক থেকে শক্তিশালী, অপরদিক থেকে দূর্বল। শক্তিশালী হলো এদিক থেকে যে, মূলতঃ যার হাতে বিয়ের বন্ধন, সে হলো স্বামী। আর দূর্বল হলো এদিক থেকে যে, যদি স্বামী উদ্দেশ্য হয় তবে ক্ষমা কিভাবে করা হবে? মাহর দেয়া তো তার উপর ওয়াজিব। সে কিভাবে ক্ষমা করতে পারে? তবে ইবন জারীর রাহিমাহুল্লাহ এ মতের সমর্থন করেছেন এবং যুক্তি দিয়েছেন যে- ক) স্বামীর হাতেই মূলতঃ বিয়ের বন্ধন। স্ত্রীর অভিভাবকের হাতে নেই। খ) স্বামীর পক্ষ থেকে ক্ষমার অর্থ হলো এই যে, তারা পূর্বকালে পূর্ণ মাহর আদায় করেই বিয়ে করত, তারপর বিয়ে ভঙ্গ হলে স্বামী বাকী অর্ধেক মাহর ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমার দৃষ্টান্ত দেখাতো।
২:২৩৮ حٰفِظُوۡا عَلَی الصَّلَوٰتِ وَ الصَّلٰوۃِ الۡوُسۡطٰی ٭ وَ قُوۡمُوۡا لِلّٰهِ قٰنِتِیۡنَ ﴿۲۳۸﴾
২৩৮. তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হবে, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা দাঁড়াবে বিনীতভাবে;
সামাজিক ও তামাদ্দুনিক বিষয় বর্ণনা করার পর সালাতের তাকীদ দিয়ে আল্লাহ এ ভাষণটির সমাপ্তি টানছেন। কারণ, সালাত এমন একটি জিনিষ যা মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয়, সততা, সৎকর্মশীলতা ও পবিত্রতার আবেগ এবং আল্লাহর বিধানের আনুগত্যের ভাবধারা সৃষ্টি করে আর এ সঙ্গে তাকে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখে। মানুষের মধ্যে এ বস্তুগুলো না থাকলে সে কখনো আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে অবিচল নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারত না।
“ইসলামকে পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তা হলো: বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা (দাস) ও রাসুল বা প্রেরিত বার্তাবাহক (অন্য বর্ণনায়: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু (উপাস্য) আছে সবকিছুকে অবিশ্বাস করতে হবে), সালাত (নামায) কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমযান মাসের সিয়াম (রোজা) পালন করা, বাইতুল্লাহর হজ্জ আদায় করা।” (বুখারী ও মুসলিম)
সালাত এমন একটি ফরয ইবাদত যার কোনো বিকল্প নেই। ইসলামে সকল বিধান সহজ করে দেওয়া হয়েছে। একজন অসুস্থ মানুষ রোযা কাযা করতে পারেন এবং পরে রাখতে পারেন। একেবারে অক্ষম মানুষ ফিদইয়া- কাফ্ফারা দিতে পারেন। কিন্তু সালাতের ক্ষেত্রে সেই বিধান নেই। সালাতকে অন্যভাবে সহজ করা হয়েছে। তা হলো মুমিন যেভাবে পারেন তা আদায় করবেন। সম্ভব হলে পূর্ণ নিয়মানুসারে। না হলে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে, যানবাহনে আরোহণ রত অবস্থায়, পোশাক পরিধান করে, উলঙ্গ হয়ে… যে ভাবে সম্ভব মুমিন তাঁর প্রভুর দরবারে হাযিরা দেবেন
সালাত দায়িত্ব নয় সুযোগ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সুযোগ দিয়েছেন, দিনের মধ্যে পাঁচবার তাঁর সাথে কথা বলে, মনের সকল আবেগ তাঁকে জানিয়ে, তাঁর রহমত, বরকত লাভ করে আমরা ধন্য হব। কুরআনের আলোকে জানা যায় যে সালাতই হল সকল সফলতার চাবিকাঠি। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেছেন:
قد أفلح المؤمنون. الذين هم في صلاتهم خاشعون [ المؤمنون ১-২ ]
“মুমিনগণ সফলকাম হয়েছেন, যারা অত্যন্ত বিনয় ও মনোযোগিতার সাথে সালাত আদায় করেন।”
২৩:৯ وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ عَلٰی صَلَوٰتِهِمۡ یُحَافِظُوۡنَ
আর যারা নিজেদের সালাতে থাকে যত্নবান। মুমিনুনঃ ৯
قد أفلح من تزكى وذكر اسم ربه فصلى (الأعلى ১৪-১৫)
অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছে: “সেই ব্যক্তিই সাফল্য অর্জন করতে পারে, যে নিজেকে পবিত্র করে এবং নিজ প্রভুর নাম স্মরণ করে সালাত আদায় করে।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ বান্দার ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন, যে তা হিফাযত করল তার জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হলো যে, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন…।” (আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ)
যে ব্যক্তি সালাতের হিফাযত করল তার জন্য সালাত জ্যোতি ও প্রমাণ হবে:
অর্থাৎ সালাত তার ঈমানের দলীল হবে এবং কিয়ামতের দিন জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের কারণ হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি সালাতের হিফাযত করল, সালাত তার জন্য কিয়ামতের দিন জ্যোতি, দলীল-প্রমাণ ও নাযাতের উসীলা হবে। আর যে ব্যক্তি সালাতের হিফাযত করল না, তার জন্য সালাত কিয়ামতের দিন জ্যোতি, প্রমাণ ও নাযাতের উসীলা হবে না, বরং কারূন, ফিরআউন, হামান এবং উবাই ইবন খালাফের সাথে তার হাশর (পুনরুত্থান) হবে”। (মুসনাদে আহমদ)
সালাত হলো, মানুষের পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার একমাত্র পথ। সালাতই মানুষকে পরিশীলিত করে এবং মানবতার পূর্ণতার শিখরে তুলে দেয়। সালাতের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে মানসিক দৃঢ়তা ও ভারসাম্য অর্জন করেন এবং মানবীয় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:
إن الإنسان خلق هلوعا إذا مسه الشر جزوعا وإذا مسه الخير منوعا إلا المصلين الذين هم على صلاتهم دائمون
“নিশ্চয় মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই অস্থিরচিত্ত ও ধৈর্যহারা। বিপদে পড়লে সে অধৈর্য ও হতাশ হয়ে পড়ে। আর কল্যাণ বা সম্পদ লাভ করলে সে কৃপণ হয়ে পড়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম সালাত আদায়কারীগণ (তারা এই মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন।) যারা সর্বদা (নিয়মিতভাবে) সালাত আদায় করেন।” ((মাআরিজ ১৯-২২))
সালাত গোনাহ মার্জনার অন্যতম উপায়। আবূ উমামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
من توضأ فأسبغ الوضوء … ثم قام إلى الصلاة المفروضة غفر الله له في ذلك اليوم ما مشت إليه رجله وقبضت عليه يداه وسمعت إليه أذناه ونظرت إليه عيناه وحدث به نفسه من سوء. (أحمد والطبراني بسند قوي)
যে ব্যক্তি ওযু করবে এবং পূর্ণরূপে তা সম্পন্ন করবে… অতঃপর সে ফরয সালাতে দাঁড়াবে, আল্লাহর তার সেই দিনে তার দুই পা যা চলেছে, তার দুই হাত যা ধরেছে, তার দুই কান যা শুনেছে, তার দুই চোখ যা দেখেছে এবং তার মনে যা কিছু খারাপ কল্পনা করেছে ক্ষমা করে দেবেন। (আহমদ, তাবারানী)
চার ইমামের মধ্যে ইমাম আহমদ ও আরো অনেক ফকীহ এই মত পোষণ করেন। এদের মতে মুসলিম কোন পাপকে পাপ জেনে পাপে লিপ্ত হলে কাফির বলে গণ্য হবে না। একমাত্র ব্যতিক্রম নামায ত্যাগ করা। যদি কেউ নামায ত্যাগ করাকে কঠিনতম পাপ জেনেও এক ওয়াক্ত ফরয নামায ইচ্ছা পূর্বক ত্যাগ করেন তাহলে তিনি কাফির ও মুরতাদ বলে গণ্য হবেন। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফিয়ী প্রমুখ ইমাম বলেন যে, এই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে সরাসরি কাফির বলা যাবে না, তবে তাকে নামায ত্যাগ্যের শাস্তি স্বরূপ জেল ও মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে।
এক ওয়াক্ত ফরয সালাত ইচ্ছাকৃতভাবে কাযা করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) যিম্মাদারী থেকে তার নাম কাটা যাবে বলে সহীহ হাদীসে উলেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
لا تترك صلاة مكتوبة متعمدا فمن تركها متعمدا فقد برئت منه الذمة (ذمة الله وذمة رسوله)
“ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাতও পরিত্যাগ করবে না। কারণ যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাত পরিত্যাগ করবে, সে আল্লাহর যিম্মা ও তাঁর রাসূলের (সা.) যিম্মা থেকে বহিস্কৃত হবে।” ((ইবনু মাজাহ, বাইহাকী, তাবারানী, আহমদ, সহীহুত তারগীব))
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সালাতের সময় আল্লাহ তা’আলা বান্দার প্রতি সর্বক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন যতক্ষণ না সে অন্য কোন দিকে দৃষ্টি না দেয়। তারপর যখন সে অন্য কোন দিকে মনোনিবেশ করে, তখন আল্লাহ্ তা’আলা তার দিকে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। [ইবনে মাজাহঃ ১০২৩]
সালাত হিফাযত বা সংরক্ষণকারীর জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হলো যে, তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ বান্দার ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন, যে তা হিফাযত করল তার জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হলো যে, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন…।” (আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ)
আল্লাহ যখন জাহান্নামীদের কাউকে দয়া করতে চাইবেন, তখন ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিবেন ঐ লোকদের বের করার জন্য, যারা আল্লাহর ইবাদত করত। অনন্তর তাঁরা তাদেরকে বের করবেন। তাঁরা তাদেরকে সিজদার চিহ্নসমূহ দেখে চিনে নিবেন। আল্লাহ আগুনের উপর সিজদার চিহ্ন ভক্ষণ হারাম করে দিয়েছেন। এভাবে তাঁরা তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করবেন। -সহিহ বুখারী হা/৮০৬; মুসলিম হা/১৮২; মিশকাত হা/৫৫৮১
কতিপয় হাদীসের প্রমাণ অনুসারে অধিকাংশ আলেমের মতে মধ্যবর্তী সালাতের অর্থ হচ্ছে আসরের সালাত। কেননা, এর একদিকে দিনের দুটি সালাত – ফজর ও যোহর এবং অপরদিকে রাতের দুটি সালাত – মাগরিব ও এশা রয়েছে। এ সালাতের জন্য তাকীদ এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, অনেক লোকেরই এ সময় কাজকর্মের ব্যস্ততা থাকে। আসরের সালাতের গুরুত্ব বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার আসরের সালাত ছুটে গেল তার যেন পরিবার-পরিজন এবং ধন-সম্পদ সবই ধ্বংস হয়ে গেল। [বুখারীঃ ৫৫২] আর হাদীসে قانتين ‘কানেতীন’ বা বিনীতভাবে বাক্যটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে নীরবতার সাথে। [বুখারীঃ ১২০০]
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কাছে রাত ও দিনে ফেরেশতারা পালাক্রমে আসে। আর তাঁরা একত্রিত হন আসর ও ফজরের সালাতে। তারপর যাঁরা তোমাদের মাঝে রাত কাটিয়েছেন তাঁরা উঠে যান। তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন- অথচ তিনি তোমাদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত- কেমন অবস্থায় আমার বান্দাদেরকে তোমরা ছেড়ে এসেছ? তারা তখন উত্তর দেবে, আমরা ওদেরকে সালাত আদায়রত অবস্থায় রেখে এসেছি, প্রথম গিয়েও আমরা ওদেকে সালাতে পেয়েছিলাম। [৫৫৫] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৯১২ প্রথমাংশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৯২৪ প্রথমাংশ) সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)৭৪২৯
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ নামাযটিকে ‘সালাতুল উস্তা’ ঘোষণা করেছেন৷ কিন্তু যে ঘটনাটি থেকে এই সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে তাতে কেবলমাত্র এতটুকু কথা বলা হয়েছেঃ আহযাব যুদ্ধের সময় মুশরিকদের আক্রমণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এতদূর ব্যস্ত রেখেছিল যার ফলে বেলা গড়িয়ে একেবারে সূর্য ডুবু ডুবু হয়েছিল৷ অথচ তখনো তিনি আসরের নাময পড়তে পারেননি৷ তখন তিনি বললেনঃ ”আল্লাহ তাদের কবর ও তাদের ঘর আগুনে ভরে দিন৷ তারা আমাদের ‘সালাতুল উস্তা’ পড়তে দেয়নি৷” এ বক্তব্য থেকেই একথা মনে করা হযেছে যে, রসূল (সা) আসরের নামাযকে সালাতুল উস্ত বলেছেন৷ অথচ এই বক্তব্যের সবচেয়ে বেশী নির্ভুল অর্থ আমাদের কাছে এটাই মনে হচ্ছে যে, এই ব্যস্ততার কারণে উন্নত পর্যায়ে নামায থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি৷ এখন অসময়ে এটি পড়তে হবে৷ তাড়াতাড়ি পড়তে হবে৷ খুশু-খুযু তথা নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সাথে ধীর-স্থিরে এ নামাযটি পড়া যাবে না৷
‘উস্ত’ অর্থ মধ্যবর্তী জিনিসও হয়৷ আবার এ শব্দটি এমন জিনিস সম্পর্কও ব্যবহৃত হয় যা উন্নত ও উৎকৃষ্ট৷ ‘সালাতুল উস্তা’ এর মধ্যবর্তী নামাযও হতে পারে আবার এমন নামাযও হতে পারে, যা সঠিক সময়ে পূর্ণ একাগ্রতার সাথে আল্লাহর প্রতি গভীরভাবে মন সংযোগ সহকারে পড়া হয এবং যার মধ্যে নামাযের যাবতীয় গুণেরও সমাবেশ ঘটে৷ আল্লাহর সামনে অনুগত বান্দার মতো দাঁড়াও- এই পরবর্তী বাক্যটি নিজেই ‘সালাতুল উস্তা’ শব্দটির ব্যাখ্যা করে দিচ্ছে৷
২:২৩৯ فَاِنۡ خِفۡتُمۡ فَرِجَالًا اَوۡ رُکۡبَانًا ۚ فَاِذَاۤ اَمِنۡتُمۡ فَاذۡکُرُوا اللّٰهَ کَمَا عَلَّمَکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿
২৩৯. অতঃপর যদি তোমরা বিপদাশংকা কর, তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায় সালাত আদায় করবে। অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ বোধ কর তখন আল্লাহ্কে স্মরণ করবে, যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।
সালেহ বিন খাওয়াত ঐ ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে যাতুর রিকা’র যুদ্ধে সালাতুল খাওফ বা ভীতির সালাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ (সাহাবাগণের) একদল সালাত আদায়ের জন্য তার (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর) সাথে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়ালেন এবং আরেক দল শক্রর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকলেন। তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রথমোক্ত দলের সাথে এক রাকাআত সালাত আদায় করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। মোক্তাদীগণ একা একা দ্বিতীয় রাকাআত পড়ে ফিরে গেলেন এবং শক্রর মুখোমুখী হয়ে দাঁড়ালেন। এবার অপর দলটি এসে দাঁড়ালে তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে সাথে নিয়ে অবশিষ্ট (এক) রাকাআত আদায় করে বসে থাকলেন। (দ্বিতীয় দলের) মুক্তাদীগণ নিজে নিজে দ্বিতীয় রাকাআত শেষ করে বসলে তিনি তাদেরকে সংগে নিয়ে সালাম ফিরালেন। [বুখারীঃ ৪১২৯]
গাযওয়া যাতুর রিক্বা‘(غزوة ذات الرقاع) : ৭ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। এই যুদ্ধে মদীনার আমীর নিযুক্ত হন আবু যার গিফারী (রাঃ)। মতান্তরে ওছমান বিন ‘আফফান (রাঃ)। ইবনু হিশাম, ইবনুল ক্বাইয়িমসহ প্রায় সকল জীবনীকার এই যুদ্ধকে ৪র্থ হিজরীর ঘটনা বলেছেন। কিন্তু আবু মূসা আশ‘আরী ও আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর অংশগ্রহণের কারণে সর্বাধিক ধারণা মতে এটি ৭ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। কেননা তারা ৭ম হিজরীর মুহাররম-ছফর মাসে সংঘটিত খায়বর যুদ্ধের সময় মুসলমান হয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে খায়বরে সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ করেন। এই যুদ্ধকে গাযওয়া নাজদ, গাযওয়া বনু মুহারিব ও বনু ছা‘লাবাহ বিন গাত্বফানও বলা হয়ে থাকে (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৬২)।
খন্দকের যুদ্ধে শত্রুদের তিনটি প্রধান পক্ষের দু’টি অর্থাৎ কুরায়েশ ও ইহূদী পক্ষকে দমন করার পর তৃতীয় শক্তি নাজদের বনু গাত্বফানের দিকে এই অভিযান প্রেরিত হয়। যারা প্রায়ই মদীনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুটতরাজ করত। এদের কোন স্থায়ী জনপদ বা দুর্গ ছিল না। এরা ছিল সুযোগসন্ধানী ডাকাত দল। তাই মক্কা ও খায়বরবাসীদের ন্যায় এদের দমন করা সহজ ছিল না। ফলে এদের বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডসমূহ প্রতিহত করার জন্য অনুরূপ আকস্মিক হামলাসমূহ পরিচালনা করার প্রয়োজন ছিল। সেমতে খায়বর বিজয় সম্পন্ন করার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ৪০০ অথবা ৭০০ সাথী নিয়ে এদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আনমার অথবা বনু গাত্বফানের ছা‘লাবাহ ও মুহারিব গোত্রের লোকেরা একত্রিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিচ্ছে মর্মে সংবাদ পেয়ে তিনি অগ্রসর হন এবং নাখল (نَخْل) নামক স্থানে তাদের মুখোমুখি হন। কিন্তু তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। আবু মূসা আশ‘আরী বলেন, আমাদের ৬ জনের জন্য মাত্র একটি উট ছিল, যা আমরা পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলাম। এ কারণে আমাদের পা সমূহ আহত হয় ও আমার নখ ঝরে পড়ে। ফলে আমরা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পায়ে পট্টি বাঁধি। এ কারণ এ যুদ্ধের নাম হয় যাতুর রিক্বা‘ বা ছেঁড়া পট্টির যুদ্ধ। বুখারী হা/৪১২৮; মুসলিম হা/১৮১৬।
২:২৪০ وَ الَّذِیۡنَ یُتَوَفَّوۡنَ مِنۡکُمۡ وَ یَذَرُوۡنَ اَزۡوَاجًا ۚۖ وَّصِیَّۃً لِّاَزۡوَاجِهِمۡ مَّتَاعًا اِلَی الۡحَوۡلِ غَیۡرَ اِخۡرَاجٍ ۚ فَاِنۡ خَرَجۡنَ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡکُمۡ فِیۡ مَا فَعَلۡنَ فِیۡۤ اَنۡفُسِهِنَّ مِنۡ مَّعۡرُوۡفٍ ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ
২৪০. আর তোমাদের মধ্যে যারা মারা যাবে এবং স্ত্রী রেখে যাবে, তারা যেন তাদের স্ত্রীদেরকে ঘর থেকে বের না করে তাদের এক বছরের ভরণ-পোষণের অসিয়াত করে কিন্তু যদি তারা বের হয়ে যায়, তবে বিধিমত নিজেদের জন্য তারা যা করবে তাতে তোমাদের কোন পাপ নেই। আর আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।
স্বামীর মৃত্যুর দরুন স্ত্রীর ইদ্দতকাল ছিল এক বছর। কিন্তু পরবর্তীতে এ সূরার ২৩৪ নং আয়াতের মাধ্যমে বছরের স্থলে চার মাস দশ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে একটি বিষয় জানা আবশ্যক যে, এ আয়াতটি এ সূরার ২৩৪ নং আয়াতের পূর্বে নাযিল হয়েছিল।
২:২৪১ وَ لِلۡمُطَلَّقٰتِ مَتَاعٌۢ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ؕ حَقًّا عَلَی الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿
২৪১. আর তালাকপ্রাপ্তা নারীদের প্রথামত ভরণ-পোষণ করা মুত্তাকীদের কর্তব্য।
তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীলোকের জন্য (مَتَاعٌ) “মাতা” বা সংস্থান করে দেয়ার কথা এর পূর্ববর্তী আয়াতেও এসেছে। তবে তা ছিল শুধু দু’রকম তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর জন্য। সহবাস কিংবা নির্জনবাসের পূর্বে যাদেরকে তালাক দেয়া হয়েছে। বাকী রইল সে সমস্ত তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যাদের সাথে স্বামী নির্জনবাস কিংবা সহবাস করেছে। তাদের মধ্যে যাদের মাহর ধার্য করা হয়েছে, তাদের “মাতা” বা সংস্থান করে দেয়ার এক অর্থ, তার ধার্যকৃত পূর্ণ মাহর দিয়ে দেয়া। আর যার মাহর ধার্য করা হয়নি, তার কিছু কাপড় বা আর্থিক দান বোঝানো হয়, তবে একজনকে তা দেয়া ওয়াজিব, যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ প্রথমোক্ত মহিলা যার সাথে স্বামীর সহবাসও হয়নি আর তার মাহরও নির্ধারিত হয়নি। আর অন্যান্যদের বেলায় তা মুস্তাহাব। আর যদি ‘মাতা’ শব্দের দ্বারা খোর-পোষ বোঝানো হয়ে থাকে, তবে যে তালাকের পর ইদ্দত অতিক্রান্ত করতে হয়, তাতে ইদ্দত পর্যন্ত তা দেয়া ওয়াজিব। তালাকে রাজয়ীই হোক আর তালাকে বায়েনই হোক, ব্যাপক অর্থে সব ধরনের তালাকই এর অন্তর্ভুক্ত।
এটা এক সাধারণ নির্দেশ, যাতে সকল তালাকপ্রাপ্তা মহিলারাই শামিল। এতে বিচ্ছেদের সময় (মহিলার সাথে) সদ্ব্যবহার এবং তার মানসিক খুশির প্রতি যত্ন নেওয়ার উপর তাকীদ করা হয়েছে। আর এর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য সামাজিক উপকারিতা। কতই না ভাল হত, যদি মুসলিমরা অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই নির্দেশের উপর আমল করত; যা তারা একেবারে ভুলে বসেছে। ইদানিং কোন কোন তথাকথিত ‘মুজতাহিদ’ (?) (مَتَاعٌ) এবং (مَتِّعُوهُنَّ) (খরচপত্র দাও) থেকে সাব্যস্ত করতে চেষ্টা করেছেন যে, তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে নিজের সম্পদ থেকে অংশ দিতে হবে অথবা চিরজীবন তার ভরণ-পোষণ করতে হবে। অথচ এই উভয় কথাই ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। যে মহিলাকে স্বামী অপছন্দ করে নিজের জীবন থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছে, চিরজীবন তার ব্যয়ভার বহন করার জন্য সে কিভাবে প্রস্তুত থাকতে পারে?
২:২৪২ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمۡ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّکُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿
২৪২. এভাবে আল্লাহ তার আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা বুঝতে পার।
آية এর বহুবচন হল آيات। শব্দটি কয়েকটি অর্থেই ব্যবহৃত হয়। যথা- মু’জিযাকে ‘আয়াত’ বলা হয়। অনুরূপভাবে, কুরআনের বাক্যকেও ‘আয়াত’ বলা হয়। তৃতীয় অর্থে দলীল-প্রমাণ ও নিদর্শনাবলীকে বুঝানো হয়ে থাকে।
যেমন অন্যত্র এসেছে—
৩:১৯০ اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّهَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الۡاَلۡبَابِ ﴿۱۹
১৯০. আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তন নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য। সূরা আলে ইমরানঃ ১৯০
৪১:৫৩ سَنُرِیۡهِمۡ اٰیٰتِنَا فِی الۡاٰفَاقِ وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَهُمۡ اَنَّهُ الۡحَقُّ ؕ اَوَ لَمۡ یَکۡفِ بِرَبِّکَ اَنَّهٗ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ شَهِیۡدٌ ﴿
অচিরেই আমরা তাদেরকে আমাদের নিদর্শনাবলী দেখাব, বিশ্ব জগতের প্রান্তসমূহে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, অবশ্যই এটা (কুরআন) সত্য। এটা কি আপনার রবের সম্পর্কে যথেষ্ট নয় যে, তিনি সব কিছুর উপর সাক্ষী? হামীম আস সাজদাঃ ৫৩
২৯:৩৫ وَ لَقَدۡ تَّرَکۡنَا مِنۡهَاۤ اٰیَۃًۢ بَیِّنَۃً لِّقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ ﴿
আর অবশ্যই আমরা এতে বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য একটি স্পষ্ট নিদর্শন রেখেছি। সূরা আনকাবুতঃ ৩৫
সহায়ক ও সংগ্রহঃ
তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন