রাসূল স. বলেছেন-
‘আল্লাহর নিকট শক্তিমান মুমিন দুর্বল মুমিন অপেক্ষা অধিক উত্তম এবং সকল ভাল কাজে যা তোমার উপকারে আসবে এমন বস্তুর প্রতি লালায়িত হও। এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করও অক্ষম হয়োনা। তবে যদি কোন মুসিবত এসে যায় তাহলে বলো না, আমি যদি এমন টি করতাম তাহলে এমন হতো, বরং বলো, আল্লাহ তাআলা তাকদীরে যা রেখেছেন ও চেয়েছেন তাই করেছেন, কেননা যদি শয়তানের কাজ উন্মুক্ত করে দেয়। মুসলিম : ২৬৬৪।
যাদের কাছে হেদায়াতের পথ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পরও তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, শয়তান এদের মন্দ কাজগুলো (ভালো লেবাস দিয়ে) শোভনীয় করে পেশ করে এবং তাদের জন্যে নানা মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে রাখে। সূরা মুহাম্মদ : ২৫
মানুষের অক্ষম ও দূর্বল অবস্থাতেই মানুষ শয়তান ও জীন শয়তান বেশী কর্মতৎপর হয়ে উঠে। দীনের সঠিক জ্ঞান না থাকলে ও শক্ত ঈমানদার না হলে যেকোন সময় ভালো ভালো মানুষ বিপদগামী হয়ে যান।
(শয়তান) ‘‘বললো আপনার ক্ষমতার শপথঃ আমি তাদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করব। তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদের নয়’’। (সূরা সাদ : ৮২-৮৩)
‘‘শয়তানের কোন আধিপত্য নেই তাদের উপর, যারা ঈমান আনে ও তাদের প্রতিপালকের ওপর নির্ভর করে।’’ (সূরা আন-নাহল : ৯৯)
মহান আল্লাহ জানিয়েছেন-
নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সাথে শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। তাছাড়া তিনি অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করে সে এক মহাপাপে লিপ্ত। (সূরা নিসা : ৪৮)
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেন,
‘হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাণী শিক্ষা দেব: (সেগুলি হচ্ছে) আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধের হেফাযত করবে, তাহলে তিনি তোমাকে হেফাযত করবেন। আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধের হেফাযত করবে, তাহলে তুমি তাঁকে তোমার সামনে পাবে। আর যখন কিছু চাইবে, তখন আল্লাহ্র কাছেই চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন আল্লাহ্র কাছেই সাহায্য প্রার্থনা কর। জেনে রেখো, দুনিয়ার সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তাহলে আল্লাহ তোমার জন্য যতটুকু লিখে রেখেছেন, তার বাইরে কিঞ্চিৎ পরিমাণ উপকারও তারা করতে পারবে না। পক্ষান্তরে তারা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যদি তোমার ক্ষতি করতে চায়, তাহলে আল্লাহ যতটুকু তোমার তাকদীরে লিখে রেখেছেন, তার বাইরে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ক্ষতিও তারা করতে পারবে না। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং কালি শুকিয়ে গেছে (অর্থাৎ তাক্বদীর লেখা শেষ হয়ে গেছে)’ (মুসনাদে আহমাদ, ১/২৯৩)।
আমাদের প্রত্যেকের জন্য জরুরী অন্তত তাওহীদ ও সুন্নাত জানা ও বুঝার পাশাপাশি কিছু শির্ক ও বিদয়াতী নমুনা জেনে রাখা। তাহলে শুভাকাংখী সেজে শয়তান ভুলপথে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে না ইন শা আলাহ।
আল্লাহ আমাদের সকলের অন্তর অহীর জ্ঞানে আলোকীত করে দিন।
১। এই সময় অনেকে বিভিন্ন প্রকার তাবীজ ব্যবহার পরামর্শ দিয়ে থাকে। চলুন জেনে নেই এই ব্যাপারে শরীয়া কি বলে।
তাবীযের ব্যবহার জাহেলী যুগ থেকেই প্রচলিত হয়ে আসছে এবং তাবীজ সম্পর্কে তাদের মধ্যে নানা রকমের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণা প্রসিদ্ধ ছিল। তাবীজ ব্যবহারে ‘আকীদাহ- বিশ্বাসে ত্রুটি এবং চিন্তাধারায় ঈমানের দুর্বলতা প্রকাশ করে। বিভিন্ন ধরনের তাবিজ যা শরীয়া অনুমোদন করে না। রাসূলুল্লাহ সা. কুরআনের দ্বারা চিকিৎসা করার স্বরূপ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, আর তা হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। এ ছাড়া কুরআনের আয়াত তাবিজ আকারে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে কোন প্রমাণ নেই, এমনকি সাহাবাদের থেকেও।
ক। জিন, শয়তান, মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে লিখিত তাবীয:
এ প্রকার তাবীয বড় শির্কের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রকার তাবীয ব্যবহারকারী ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে এবং পরকালে সে জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা হবে। কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে এমন বিষয়ের সাহায্য প্রার্থনা করা শির্ক, যে বিষয়ে সাহায্য করার ক্ষমতা তার নেই। মহান আল্লাহ বলেন,
‘বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ আমার অনিষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তবে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ডাক, তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি রহমত করার ইচ্ছা করলে তারা কি সে রহমত রোধ করতে পারবে?’ (আয-যুমার, ৩৮)।
অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘যে ব্যক্তি তাবীয ঝুলালো, সে শির্ক করল’ (আহমাদ, হাকেম)।
খ. বিভিন্ন প্রকার নকশা, চিত্র, জাদুমন্ত্র, নাম, শব্দ সম্বলিত তাবীয, যেগুলির অর্থ বোধগম্য নয়:
এ প্রকারের তাবীয হারাম। কেননা এগুলি মানুষকে শির্কের দিকে নিয়ে যায়।
গ. বালা-মুছীবত দূর করার জন্য পূঁতি, রিং, সূতা, আংটি ইত্যাদি ঝুলানো:
এগুলি ঝুলিয়ে যদি কেউ বিশ্বাস করে যে, খোদ এগুলি বালা-মুছীবত দূর করতে সক্ষম, তাহলে সে বড় শির্ক করল। কেননা সে আল্লাহ্র সাথে অন্য কিছুকে শরীক স্থাপন করল। পক্ষান্তরে যদি সে বিশ্বাস করে যে, উপকার-ক্ষতি শুধুমাত্র এক আল্লাহ্র হাতে; কিন্তু পূঁতি, রিং, সূতা, আংটি ইত্যাদি কারণ মাত্র, তাহলে সে এমন কিছু বস্তুকে কারণ বানালো, যেগুলিকে আল্লাহ কারণ বানান নি। ফলে এই বিশ্বাস রেখে ঐসব জিনিস ঝুলালে তা হারাম বলে গণ্য হবে এবং ছোট শির্কে পরিণত হবে।
উক্ববা ইবনে আমের আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কাছে একটি দল আসলে তিনি তাঁদের ৯ জনের বায়‘আত গ্রহণ করলেন, কিন্তু একজনের বায়‘আত গ্রহণ করলেন না। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি ৯ জনের বায়‘আত গ্রহণ করলেন, কিন্তু এই ব্যক্তির বায়‘আত গ্রহণ করলেন না? তিনি বললেন, তার দেহে তাবীয আছে। অতঃপর তিনি তাঁর হাত ঢুকিয়ে তাবীযটি ছিড়ে ফেললেন। এরপর তার বায়‘আত গ্রহণ করলেন এবং বললেন, ‘যে ব্যক্তি তাবীয ঝুলালো, সে শির্ক করল’ (মুসনাদে আহমাদ, ১৫৬/৪; সিলসিলাহ ছহীহাহ, হা/৪৯২)।
তিনি অন্যত্র বলেন,
‘নিশ্চয়ই (নিষিদ্ধ) ঝাড়ফুঁক, তাবীয এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টিকারী বিশেষ তাবীয (তিওয়ালা) শির্কের অন্তর্ভুক্ত’
মুস্তাদরাক হাকেম, তিনি হাদীছটিকে ‘ছহীহুল ইসনাদ’ বলেছেন এবং যাহাবী তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। আলবানী ‘সিলসিলা ছহীহাহ’ তে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন, (হা/৩৩১)
( আব্দুল্লাহ ইবনে উকাইম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘যে ব্যক্তি কোনো কিছু ঝুলাবে, তাকে তার দিকে ঠেলে দেওয়া হবে’. আলবানী, ছহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, (হা/৩৪৫৬)।
এসব হাদীছে সাধারণভাবে সব ধরনের তাবীয নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোন্টি কুরআন থেকে এবং কোন্টি কুরআন থেকে নয়, তার কোনো পার্থক্য করা হয়নি।
শায়খ উছায়মীন কুরআনের আয়াত দিয়ে তৈরীকৃত তাবীয সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের মতভেদ উল্লেখ করার পর বলেন, তাবীয কুরআন দিয়ে তৈরী হলেও তা ঝুলানো বৈধ নয়। অনুরূপভাবে তা কোনো রোগীর বালিশের নীচে রাখা অথবা দেওয়াল বা অন্য কিছুতে ঝুলানোও বৈধ নয়] (আল-মাজমূ আছ-ছামীন, ১/৫৮)।
কেউ যদি তাবীয ঝুলিয়ে আল্লাহ ব্যতীত তার ইবাদত করে, তাহলে তা ‘বড় শির্ক’ হিসাবে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে তাবীয ব্যবহারকারী যদি বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ্র ইচ্ছা ছাড়াই এই তাবীযই তাকে হেফাযত করছে, তার রোগ-বালাই দূর করছে বা তার থেকে অকল্যাণ দূর করছে, তাহলে তাও ‘বড় শির্ক’ বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যদি কেউ বিশ্বাস করে যে, এই তাবীয চোখ লাগা ও বালা-মুছীবত থেকে তার মুক্তির কারণ, তাহলে তা ‘ছোট শির্ক’ হিসাবে গণ্য হবে।
বড় শির্ক এবং ছোট শির্কের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, বড় শির্ককারীর উপর মুসলিম শাসক ‘রিদ্দার হদ্’ কায়েম করবে। আর তার সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,
‘নিশ্চয়ই আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি অহি হয়েছে যে, যদি আপনি আল্লাহ্র সাথে শরীক স্থির করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনার কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং অবশ্যই অবশ্যই আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন’ (আয-যুমার, ৬৫)।
ছোট শির্ক বলে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, ছোট শির্ক অপরাপর কাবীরা গোনাহ বা বড় পাপের চেয়েও বড় পাপ (ফাতহুল মাজীদ শারহু কিতাবিত-তাওহীদ/১২১)।
আউফ ইবনে মালেক আল-আশজা‘ঈ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
জাহেলী যুগে আমরা ঝাড়-ফুঁক করতাম। ইসলাম পরবর্তী যুগে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! ঝাড়-ফুঁকের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি? তিনি বললেন, ‘তোমাদের ঝাড়-ফুঁকে পঠিত বিষয়গুলিকে আমার কাছে পেশ কর। ঝাড়-ফুঁকে যদি শির্কের সংমিশ্রণ না থাকে, তবে তাতে কোনো দোষ নেই’ (সহীহ মুসলিম, হা/২২০০)।
শরী‘আত সম্মত ঝাড়-ফুঁকের শর্ত:
ঝাড়-ফুঁক শরী‘আত সম্মত হতে হলে তাতে বেশ কিছু শর্ত থাকা জরূরী। যেমন:
() ঝাড়-ফুঁক আরবী ভাষায় অথবা যে কোনো বোধগম্য ভাষায় হতে হবে।
() ঝাড়-ফুঁকে যা পড়া হবে, তা শরী‘আতে অনুমোদিত হতে হবে।
() ঝাড়-ফুঁকের যে নিজস্ব কোনো প্রভাব এবং ক্ষমতা নেই, তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে।
() শরিয়তের নিয়ম মেনে চলে ঝাড়-ফুঁক করতে হবে।
২। মানত করা
বলতে শুনা যায়: আপনি ওখানে মানত করেন, তাহলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে, বিপদ দূর হয়ে যাবে। অনেক খানকাহ ও দরবার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের দরবারে বা খানকায় মানত করার জন্য মুসলিম জনগণকে উৎসাহিত করে থাকে। দরাজ গলায় বলে, আমাদের এই মাদরাসায় বা এই খানকায় মানত করে কেহ বিফল হয়নি।
এমনটি যারা করেন তারা নিজেরাও এ বিষয়ে বিভ্রান্ত। সাথে সাথে অন্যদেরও বিভ্রান্ত করে থাকেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে হিফাজত করুন! দীনে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করুন!
আমরা বাংলাতে বলি মানত। আরবিতে বলা হয় نذر (নযর) বহুবচনে নুযুর।
মানত বা নযরের আভিধানিক অর্থ হল, নিজের দায়িত্বে নেয়া। যা নিজের দায়িত্ব নয় তা অপরিহার্য করে নেয়া।
শরয়ি পরিভাষায় মানত বলা হয় : নিজের উপর এমন কিছু ওয়াজিব (আবশ্যিক) করে নেয়া যা আসলে ওয়াজিব ছিল না। সেটা শর্তযুক্তও হতে পারে আবার শর্ত মুক্তও হতে পারে।
আসলে মানত করা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সা. মানত করতে নিষেধ করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে সব সময় উম্মতদের নিরুৎসাহিত করেছেন। বিষয়টি আমরা অনেকেই জানি না। বরং মনে করি মানত করা খুব সওয়াবের কাজ। আসলে এটি কোনো সওয়াবের কাজ নয়। বরং মাকরূহ। অধিকাংশ ইমাম ও ফেকাহবিদের অভিমত এটাই। কারণ, রাসূলুল্লাহ সা. মানত করতে নিষেধ করেছেন।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমরা মানত করবে না। কেননা মানত তাকদীরের কোনো কিছু-কে ফেরাতে পারে না। এটা শুধু কৃপণ থেকে সম্পদ খসায়।(সহিহ বুখারি ও মুসলিম: ৪৩২৯, সহিহ সুনান তিরমিজি, সহিহ সুনান নাসায়ি)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়। (সহিহ মুসলিম: ৪৩২৫)
তবে যদি কেউ মানত করে ফেলে তাহলে তাকে তা পালন করতেই হবে। তবে এক্ষেত্রে কিছু শর্তাবলী ও নিয়ম-নীতি আছে।
তারা যেন তাদের মানতসমূহ পূরণ করে। (সূরা আল হজ: ২৯)
আল্লাহ আরো বলেন:
وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ نَفَقَةٍ أَوْ نَذَرْتُمْ مِنْ نَذْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُهُ
তোমরা যা কিছু ব্যয় কর অথবা যে কোনো মানত কর তা অবশ্যই আল্লাহ জানেন। (সূরা বাকারা: ২৭০)
আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীল ঈমানদারদের প্রশংসায় বলেন :
তারা মানত পূরণ করে। (সূরা আল-ইনসান:৭)
এ সকল আয়াত থেকে স্পষ্টত প্রতিভাত হয়,
এক. মানত করলে তা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা মানত পূরণ করতে হুকুম করেছেন।
দুই. এ সকল আয়াতের কোথাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানত করতে আদেশ করেননি বা উৎসাহ দেননি। অন্য কোনো আয়াতেও দিয়েছেন এমনটি পাওয়া যায় না।
তিন. মানত পূরণ করা সৎকর্মশীল ঈমানদারদের একটি গুণ হিসাবে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন। তাই মানত পূরণ করলে সওয়াব অর্জিত হবে, প্রতিদান পাওয়া যাবে।
চার. মানুষ মানত করলে, কিংবা কোনো খরচ করলে আল্লাহ তা ভালভাবেই জানেন। তাই মানত পূরণ না করে কোনো উপায় নেই।
পাঁচ. মানত পূরণ করা যখন একটি ইবাদত, তখন তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে করতে হবে।
মানত পূরণ করা সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করার মানত করে সে যেন (তা পূরণ করে) তাঁর আনুগত্য করে । আর যে অবাধ্যতার কোনো বিষয়ে মানত করে সে যেন তাঁর অবাধ্যতা না করে। (সহিহ বুখারি, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, নাসায়ি)
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি এমন মানত করল যা পূর্ণ করার সামর্থ্য তার নেই, সে কসমের কাফফারা আদায় করবে। হাদীসটি আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন। আর হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বুলুগুল মারাম কিতাবে এর সূত্রকে বিশুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. তার ৩৩/৪৯ নং ফতোয়ায় বলেছেন: যখন কোনো ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে থেকে মানত করে তখন তা পূর্ণ করতেই হয়। কিন্তু যদি পূর্ণ করতে অক্ষম হয়ে যায় তাহলে কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করবে। পূর্ববর্তী অধিকাংশ আলেম-উলামার অভিমত এটাই।
কসম ভঙ্গের কাফফরা,
দশজন অভাবী মানুষকে খাদ্য বা পোশাক দান করা কিংবা একটি দাস মুক্ত করে দেয়া।
নিজেদের নিয়মিত খাবারের মধ্যম ধরনের খাবার দশ জনের প্রত্যেককে দিতে হবে।
প্রতি জনের খাদ্যের পরিমাণ হবে কমপক্ষে অর্ধ সা অর্থাৎ কাছাকাছি দেড় কেজি।
যদি সে এ তিন পদ্ধতির কোনো একটি দিয়ে কাফফারা আদায় করতে না পারে তাহলে তিন দিন রোজা পালন করবে।
যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অর্থহীন কসমের ব্যাপারে, কিন্তু যে কসম তোমরা দৃঢ়ভাবে কর সে কসমের জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করেন। সুতরাং এর কাফফারা হল দশ জন মিসকীনকে খাবার দান করা, মধ্যম ধরনের খাবার, যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে খাইয়ে থাক, অথবা তাদের বস্ত্র দান, কিংবা একজন দাস মুক্ত করা। অতঃপর যে সামর্থ্য রাখে না তবে তিন দিন সিয়াম পালন করা। এটা তোমাদের কসমের কাফ্ফারা, যদি তোমরা কসম কর, আর তোমরা তোমাদের কসম হেফাযত কর। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন যাতে তোমরা শোকর আদায় কর। (সূরা মায়েদা, আয়াত ৮৯)
তবে মনে রাখতে হবে, যে মানত পূরণ জায়েয নয় তা পালন না করার কারণে কাফফারা দিতে হয় না।
মাজারে মানত করা শিরক
যারা মাজারে দান, সদকা, মানত ইত্যাদি করে থাকে তারা তিনটি নিয়তের বাহিরে চতুর্থ কোনো নিয়ত করে না। যেমন-
প্রথম প্রকার নিয়ত :
তারা মনে করে মাজারে মানত বা দান করলে মাজারে শায়িত ওলী খুশী হন। তিনি খুশী হলে আমার মনের আশা পূরণ হবে। বিপদ দূর হবে।
মানত কারীর ধারণায় মাজারে মানত করলে মাজারের ওলীর দোয়ায় বা তাঁর নেক নজরে আমার বিপদ কেটে যাবে বা উদ্দেশ্য অর্জন হবে।
দ্বিতীয় প্রকার নিয়ত :
মাজারে মানত বা দান করছি আল্লাহর জন্যই। তবে মাজারে শায়িত ওলীর সুপারিশে আমার মনের আশা পূরণ হবে। ওলীর অসীলায় বা শাফাআতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আমি মাজারে মানত বা দান করলাম।
তৃতীয় প্রকার নিয়ত:
আমি জানি যে ওলী ভাল-মন্দ করার ক্ষমতা রাখেন না। তাঁর দোয়া বা নেক নজর পাওয়ার নিয়তও আমি করি না। তাঁর শাফাআত বা অসীলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে তিনি আল্লাহর ওলী, তাকে সম্মান করা সওয়াবের কাজ এ জন্য আমি মাজারে মানত করি। দান-সদকা পাঠাই।
তিনটির যে কোনো একটি নিয়তে আপনি মাজারে মানত বা দান করবেন তো, তা শিরক হবে।
আপনি যখন জীবিত মানুষ বাদ দিয়ে মৃত মানুষের কবর-মাজারে দান করেন, তখন অবশ্যই একটি নিয়ত পোষণ করেন, যদিও তা প্রকাশ করেন না। বা অন্যের কাছ থেকে লুকাতে চান । কিন্তু আল্লাহ তাআলা অন্তর্যামী। তাঁর কাছ থেকে লুকানো কি সম্ভব?
মানত আদায় করা একটি ইবাদত। এটি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য নিবেদন করা শিরক। তেমনি এটা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তের সাথে সাথে অন্যের সুপারিশ, শাফায়াত, অসীলা বা তার মর্যাদার প্রতি সম্মান দেখানোও শিরক। এটাই তো ইবাদতে আল্লাহর সাথে অন্যকে অংশীদার করা। এমন করলে ইবাদতটি শতভাগ আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয় না। আর যে ইবাদত শতভাগ আল্লাহর জন্য নিবেদিত নয় তা শিরক, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এক ব্যক্তি বাওয়ানা (য়ালামলাম পাহাড়ের পাদ দেশে অবস্থিত) নামক স্থানে একটি উট জবেহ করার মানত করেছিল। সে তার মানত আদায় করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যে স্থানের উদ্দেশ্যে মানত করেছ সেখানে কি জাহেলী যুগে কোনো প্রতিমা ছিল? লোকেরা বলল, না, ছিল না। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, সেখানে কি মুশরিকদের কোনো উৎসব বা মেলা হয়? লোকেরা উত্তর দিল, না, তা হয় না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাহলে তোমার মানত পূর্ণ করতে পার। আর আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতায় কোনো মানত পূর্ণ করা হবে না। আর যে মানত পূরণ করতে মানুষ সমর্থ নয় তাও পূরণ করা হবে না। (আবু দাউদ : কিতাব আল আইমান ওয়ান-নুযূর)
আমাদের দেশে মাজার, দরগা, পীরদের দরবারে যে উরস, ঈসালে সওয়াব মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয় সেগুলো মুশরিকদের উৎসব। তাই এ সকল স্থানের জন্য গরু, ছাগল ইত্যাদি জাতীয় কোনো কিছু মানত করা যাবে না। কেননা বর্ণিত হাদীসে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চেয়েছেন, সেখানে মুশরিকদের কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠান হয় কি-না। যদি হত তাহলে তিনি সেখানে মানত পূর্ণ করতে অনুমতি দিতেন না।
৩। কিছু দু’আ খতম হিসেবে আমল করা
‘খতম’ শব্দটি মূলত আরবী ‘ ختم ’ শব্দের বাংলা ব্যবহার। যার মূল অর্থ হচ্ছে : কোনো বস্তুতে মোহর লাগানো বা তাকে সিলযুক্ত করা। কর্ম যুগে শব্দটির অর্থ হয়, কাজটি শেষ করা।
খতম শব্দটি শেষ পর্যন্ত পৌঁছা বা পুরোটা পড়ার অর্থে ব্যবহার হলেও ‘খতম করানো’ বা ‘খতম পড়ানো’, এমন কোনো ব্যবহার বা প্রয়োগ না সাহাবিদের যুগে ছিল, না খাইরুল ক্বুরুনে ছিল। কেননা কুরআন, হাদীস, দো‘আ, দুরূদ, যিকর ইত্যাদির আমলের এই সিস্টেম বা পদ্ধতিটি একেবারেই নতুন।
তাই হাদীসে যা আসেনি তা বানিয়ে আমল করা বিদয়াত। যেমন-
খতমে ইউনুস- দু’আ ইউনুস পড়া যাবে কিন্তু প্রচলিত খতমের নিয়মে করা সুন্নাতের খেলাপ।
ইউনুস আলাইহিস সালাম আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী। আল্লাহর নির্দেশের পূর্বে তিনি তাঁর গোত্র থেকে হিজরত করে চলে যান। আল্লাহর কাছে তাঁর এ কাজ অপছন্দনীয় হলে ইউনুস আলাইহিস সালামকে মাছের পেটে যেতে হয়। যার বিবরণ কুরআন পাকে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। কমবেশ আমাদের সবারই ঘটনাটি জানা আছে। বিপদে পড়ে যে কেউ নিজের গোনাহের স্বীকারোক্তি বা তওবা করে আন্তরিকভাবে আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ তাঁর ডাক শুনেন। ইউনুস আলাইহিস সালামের মাছের পেটে পড়ার বিপদ থেকে উদ্ধারের এই কাহিনিটি থেকে আল্লাহ আমাদেরকে এই খবরটি দেন। উদ্ধারের কাহিনিটি আল্লাহ যেভাবে উল্লেখ করেন তাতে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি সাল্লামকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলা কয়েকজন নবীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন,
‘‘আর আপনি মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন, তিনি রাগ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাকে আটকাবো না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করে বললেন, তুমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তুমি দোষমুক্ত, নিশ্চয় আমি গোনাহগার। অতঃপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম। এবং তাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনিভাবে মুমিনদের মুক্তি দিয়ে থাকি’’। সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭-৮৮।
এই ঘটনা থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই? একটু চিন্তা করলেই যে কেউ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে। অর্থাৎ যে কোনো বিপদে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনই একজন মুমিনের করণীয়। সকাতরে আল্লাহকে ডাকলে তিনি তাঁর ডাকে অবশ্যই সাড়া দিবেন।
এবার আমরা দেখি হাদীসে এ দো‘আর ব্যাপারে আমাদের জন্য কী দিকনির্দেশনা রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
‘‘মাছওয়ালা যখন মাছের পেটে থাকাবস্থায় দো‘আ করেছিলেন তখন তার দো‘আ ছিল,
لا إِلَهَ إِلا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
(তুমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তুমি দোষমুক্ত, নিশ্চয় আমি গোনাহগার) অতএব যখনই কোনো মুসলিম ব্যক্তি কোনো বিষয়ে এর মাধ্যমে দো‘আ করেছে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন।’’
তিরমিযী, সুনান, হাদীস সহীহ, হাদীস নং: ৩৫০৫, আলবানী,
কুরআন হাদীসের শিক্ষা থেকে আমরা বুঝলাম, যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো বিপদে পড়লে এই দো‘আটি করতে পারে। এই দো‘আ করলে আল্লাহ তাকে বিপদ মুক্ত করবেন বলে আমরা পূর্ণ আশাবাদী হতে পারি। কিন্তু কে বা কারা প্রথমে কুরআন হাদীসের এই শিক্ষার পরিবর্তন ঘটিয়ে খতমে ইউনুস নামে খতম আবিষ্কার করেছে তার ইতিহাস আমাদের কাছে না থাকলেও অভিজ্ঞতার নামে আমরা কুরআন হাদীসের শিক্ষার বিপরীত চলছি। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতাকে পূঁজি করে আমাদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার প্রচার না করা কতটুকু আমানতদারী তা প্রশ্নযোগ্য। বিবেকের কাছে কি আমরা কখনো প্রশ্নের সম্মুখীন হই না? না কি পেটের তাগিদে আমাদের বিবেকই নষ্ট হয়ে গেছে?
আর তাই আমাদের ঈমানী দায়িত্ব এই ধরনের বিদয়াতি কাজ থেকে নিজেরা দূরে থেকে অন্যকেও সঠিক জ্ঞান দান করা।
এই রকম আরো কিছু খতমের কথা সমাজে প্রচলিত আছে যা হাদীসের শিক্ষায় আসেনি। যেমন খতমে শিফা, বুখারী খতম, সূরা ইয়াসীন খতম, খতমে তাসমিয়া, খতমে দরুদ ইত্যাদি বিভিন্ন রুপে রংগে সাজিয়ে মানুষকে সঠিক আমল থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ও বিদয়াতী কাজ করে নিজের আমল বরবাদ করার পায়তারা করে যাচ্ছে এক ধরনের মানুষরুপী ব্যবসায়ী শয়তান।
আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য সঠিকভাবে দু’আগুলো জেনে সহিহ হাদীসের আলোকে আমল করা।