সূরা মায়েদাঃ ২য় রুকু (আয়াত সংখ্যাঃ ৬-১১)
৫:৬ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا قُمۡتُمۡ اِلَی الصَّلٰوۃِ فَاغۡسِلُوۡا وُجُوۡهَکُمۡ وَ اَیۡدِیَکُمۡ اِلَی الۡمَرَافِقِ وَ امۡسَحُوۡا بِرُءُوۡسِکُمۡ وَ اَرۡجُلَکُمۡ اِلَی الۡکَعۡبَیۡنِ ؕ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوۡا ؕ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ مَّرۡضٰۤی اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ اَوۡ جَآءَ اَحَدٌ مِّنۡکُمۡ مِّنَ الۡغَآئِطِ اَوۡ لٰمَسۡتُمُ النِّسَآءَ فَلَمۡ تَجِدُوۡا مَآءً فَتَیَمَّمُوۡا صَعِیۡدًا طَیِّبًا فَامۡسَحُوۡا بِوُجُوۡهِکُمۡ وَ اَیۡدِیۡکُمۡ مِّنۡهُ ؕ مَا یُرِیۡدُ اللّٰهُ لِیَجۡعَلَ عَلَیۡکُمۡ مِّنۡ حَرَجٍ وَّ لٰکِنۡ یُّرِیۡدُ لِیُطَهِّرَکُمۡ وَ لِیُتِمَّ نِعۡمَتَهٗ عَلَیۡکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ
হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথায় মাসেহ কর এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে। আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে, বা তোমরা স্ত্রীর সাথে সংগত হওএবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে। সুতরাং তা দ্বারা মুখমণ্ডলে ও হাতে মাসেহ করবে। আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা করতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তার নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।
মুখমন্ডল ধৌত কর’ অর্থাৎ, একবার, দুইবার অথবা তিনবার করে দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ধৌত করা, কুল্লী করা বা কুলকুচা করা অতঃপর নাকের ভিতরে পানি টেনে নিয়ে নাক ঝাড়ার পর — যেমনটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। মুখমন্ডল ধৌত করার পর দুই হাত (আঙ্গুলের ডগা হতে) কনুইসহ ধৌত করতে হবে।
পুরো মাথা মাসাহ করতে হবে। যেমনটি হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, (দুই হাতকে ভিজিয়ে আঙ্গুলগুলিকে মুখোমুখি করে) মাথার সামনের দিক থেকে (যেখান থেকে চুল গজানো শুরু হয়েছে সেখান) থেকে পিছন দিক (গর্দানের চুল যেখানে শেষ হয়েছে সেখান) পর্যন্ত, তারপর সেখান থেকে শুরু করে সামনের দিকে নিয়ে এসে যেখান থেকে শুরু করেছিল সে পর্যন্ত মাসাহ করতে হবে। ঐ সঙ্গে কানও মাসাহ করতে হবে। যদি মাথার উপর পাগড়ি বা শিরস্ত্রাণ থাকে, তাহলে হাদীসের নির্দেশানুসারে মোজার উপর মাসাহর মত তার উপরেও মাসাহ বৈধ। (মুসলিমঃ পবিত্রতা অধ্যায়) মাসাহ সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসে একবার মাসাহ করাই যথেষ্ট বলা হয়েছে।
أَرْجُلَكُمْ এর সংযোগ وُجُوهَكُمْ এর সঙ্গে, যার ভাবার্থ হচ্ছে; পায়ের গাঁট বা গোড়ালির উপরের হাড় পর্যন্ত ধৌত কর। পক্ষান্তরে পায়ে যদি চামড়া বা কাপড়ের মোজা থাকে (এবং তা যদি ওযু থাকা অবস্থায় পরিধান করা হয়), তাহলে হাদীসের নির্দেশানুসারে পা ধোয়ার পরিবর্তে মোজার উপর নিয়মিত মাসাহ করা বৈধ।
আনুষঙ্গিক বিষয়াবলীঃ
(ক) ওযু থাকলে পুনরায় ওযু করা জরুরী নয়। তবে প্রত্যেক নামাযের জন্য নতুনভাবে ওযু করা উত্তম। (খ) ওযু করার পূর্বে নিয়ত করা ফরয। (গ) ওযু করার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা জরুরী। (ঘ) দাঁড়ি ঘন বা জমাট হলে তা খেলাল করতে হবে। (ঙ) ওযুর অঙ্গগুলিকে পর্যায়ক্রমে ধৌত করতে হবে। (চ) একটি অঙ্গ ধোয়ার পর দ্বিতীয় অঙ্গ ধোওয়ায় যেন দেরী না হয়; বরং একের পর এক যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে ধৌত করা হয়। (ছ) ওযুর অঙ্গগুলির মধ্যে কোন অঙ্গ যেন শুষ্ক না থেকে যায়, কেননা শুষ্ক থাকলে ওযু হবে না। (জ) ওযুর কোন অঙ্গকে তিনবারের বেশী যেন ধোওয়া না হয়, কারণ এটা সুন্নতের পরিপন্থী। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ফাতহুল ক্বাদীর ও আইসারুত তাফাসীর)
নু’আইম আল-মুজমির থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে মসজিদের ছাদে উঠলাম। তিনি ওযু করে বললেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আমার উম্মতদেরকে কেয়ামতের দিন তাদেরকে ‘গুররান-মুহাজ্জালীন’ বলে ডাকা হবে। (অর্থাৎ ওযুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো উজ্জ্বল অবস্থায় উপস্থিত হবে) কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার উজ্জ্বলতাকে বৃদ্ধি করতে সক্ষম, সে যেন তা (বৃদ্ধি) করে। [বুখারী: ১৩৬]
অপবিত্রতা; ঐ অপবিত্রতাকে বুঝানো হয়েছে, যা স্বপ্নদোষ অথবা স্ত্রী সহবাস (বা যৌনতৃপ্তির সাথে বীর্যপাতের) ফলে হয়। আর একই বিধান মহিলাদের মাসিক ও (প্রসবোত্তর) নিফাসজনিত অপবিত্রতারও। যখন মহিলার মাসিক বা নিফাস বন্ধ হয়ে যাবে, তখন পবিত্রতা অর্জনের জন্য গোসল করা জরুরী। গোসলের পানি না পাওয়া গেলে তায়াম্মুম করা বিধেয়; যেমনটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর ও আইসারুতর তাফাসীর)
আয়াতের এই অংশের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এবং তায়াম্মুমের পদ্ধতি সূরা নিসার ৪৩নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। সহীহ বুখারীতে এই আয়াতের শানে নুযূল (অবতীর্ণ হওয়ার কারণ) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, কোন এক সফরে আয়েশা (রাঃ) এর গলার হার বাইদা নামক স্থানে হারিয়ে যায়। তা খোঁজার জন্য তাঁদেরকে সেখানে থামতে হয়। ফজরের নামাযের জন্য তাঁদের নিকট পানি ছিল না এবং অনুসন্ধান করার পরও তাঁরা পানি সংগ্রহ করতে পারলেন না। এমতাবস্থায় (আল্লাহ তাআলা) এই আয়াত অবতীর্ণ করলেন, যাতে তায়াম্মুম করার অনুমতি দেওয়া হল। উসাইদ বিন হুযাইর (রাঃ) এই আয়াত শুনে বললেন, ‘হে আবু বাকরের বংশধর! তোমাদের কারণে আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য বরকত অবতীর্ণ করেছেন। আর এটা তোমাদের প্রথম বরকত নয়। (বরং তোমরা মানুষের জন্য সর্বদাই বরকতময়)।’ (বুখারীঃ সূরা মায়েদার তাফসীর)
এই জন্যই তিনি তায়াম্মুমের অনুমতি প্রদান করেছেন।
হাদীসে ওযু করার পর দু’আ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা
আত্মার পবিত্রতা যেমন একটি নিয়ামত ঠিক তোমনি শরীরের পবিত্রতাও একটি নিয়ামত৷ আর মানুষের ওপর আল্লাহর নিয়ামত তখনই সম্পূর্ণ হতে বা পূর্ণতা লাভ করতে পারবে যখন সে আত্মা ও শরীর উভয়ের তাহারাত ও পাক-পবিত্রতা অর্জনের জন্য পূর্ণ হেদায়াত লাভ করতে সক্ষম হবে৷
ওজুর পদ্ধতি
ওজু করার দুটো পদ্ধতি রয়েছে-
ক. ফরয পদ্ধতি। সেটা হচ্ছে-
১। সমস্ত মুখমণ্ডল একবার ধৌত করা। এর মধ্যে- গড়গড়া কুলি ও নাকে পানি দেয়াও অন্তর্ভুক্ত হবে।
২। কনুই পর্যন্ত হাত একবার ধৌত করা
৩। সমস্ত মাথা একবার মাসেহ করা। এর মধ্যে কানদ্বয় মাসেহ করাও অন্তর্ভুক্ত হবে
৪। দুই পায়ের টাকনু পর্যন্ত একবার ধৌত করা।
পূর্বোক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘একবার’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- সংশ্লিষ্ট অঙ্গের কোন অংশ যেন ধোয়া থেকে বাদ না পড়ে।
৫। এই ক্রমধারা বজায় রাখা। অর্থাৎ প্রথমে মুখমণ্ডল ধৌত করবে, এরপর হাতদ্বয় ধৌত করবে, এরপর মাথা মাসেহ করবে, এরপর পা দুইটি ধৌত করবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ক্রমধারা বজায় রেখে ওযু করেছেন।
৬। পরম্পরা রক্ষা করা। অর্থাৎ উল্লেখিত অঙ্গগুলো ধৌত করার ক্ষেত্রে পরম্পরা রক্ষা করা; যাতে করে একটি অঙ্গ ধোয়ার পর অপরটি ধোয়ার মাঝখানে স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময়ের বিরতি না পড়ে। বরং এক অঙ্গের পরপর অপর অঙ্গ ধারাবাহিকভাবে ধৌত করা।
এগুলো হচ্ছে- ওজুর ফরয কাজ; ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য যে কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে।
এ কাজগুলো ওজুর ফরয হওয়ার পক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী:[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬]
খ. মুস্তাহাব পদ্ধতি:
যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহতে বর্ণিত হয়েছে; ওযুর বিস্তারিত পদ্ধতি নিম্নরূপ:
১। ব্যক্তি নিজে পবিত্রতা অর্জন ও হাদাস (ওজু না থাকার অবস্থা) দূর করার নিয়ত করবে। তবে নিয়ত উচ্চারণ করবে না। কেননা নিয়তের স্থান হচ্ছে- অন্তর। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই নিয়তের স্থান অন্তর
২। বিসমিল্লাহ বলবে।
৩। হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধৌত করবে।
৪। এরপর তিনবার গড়গড়া কুলি করবে (গড়গড়া কুলি: মুখের ভেতরে পানি ঘুরানো)। বাম হাত দিয়ে তিনবার নাকে পানি দিবে ও তিনবার নাক থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে দিবে। ‘ইস্তিনশাক’ শব্দের অর্থ- নাকের অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ করানো। আর ‘ইস্তিনসার’ শব্দের অর্থ- নাক থেকে পানি বের করে ফেলা।
৫। মুখমণ্ডল তিনবার ধৌত করবে। মুখমণ্ডলের সীমানা হচ্ছে- দৈর্ঘ্যে মাথার স্বাভাবিক চুল গজাবার স্থান থেকে দুই চোয়ালের মিলনস্থল ও থুতনি পর্যন্ত। প্রস্থে ডান কান থেকে বাম কান পর্যন্ত। ব্যক্তি তার দাঁড়ি ধৌত করবে। যদি দাঁড়ি পাতলা হয় তাহলে দাঁড়ির ওপর ও অভ্যন্তর উভয়টা ধৌত করবে। আর যদি দাঁড়ি এত ঘন হয় যে চামড়া দেখা যায় না তাহলে দাঁড়ির ওপরের অংশ ধৌত করবে, আর দাঁড়ি খিলাল করবে।
৬। এরপর দুই হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধৌত করবে। হাতের সীমানা হচ্ছে- হাতের নখসহ আঙ্গুলের ডগা থেকে বাহুর প্রথমাংশ পর্যন্ত। ওজু করার আগে হাতের মধ্যে আঠা, মাটি, রঙ বা এ জাতীয় এমন কিছু লেগে থাকলে যেগুলো চামড়াতে পানি পৌঁছাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেগুলো দূর করতে হবে।
৭। অতঃপর নতুন পানি দিয়ে মাথা ও কানদ্বয় একবার মাসেহ করবে; হাত ধোয়ার পর হাতের তালুতে লেগে থাকা অবশিষ্ট পানি দিয়ে নয়। মাসেহ করার পদ্ধতি হচ্ছে- পানিতে ভেজা হাতদ্বয় মাথার সামনে থেকে পেছনের দিকে নিবে; এরপর পুনরায় যেখান থেকে শুরু করেছে সেখানে ফিরিয়ে আনবে। এরপর দুই হাতের তর্জনী আঙ্গুল কানের ছিদ্রতে প্রবেশ করাবে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কানের পিঠদ্বয় মাসেহ করবে। আর মহিলার মাথার চুল ছেড়ে দেয়া থাকুক কিংবা বাঁধা থাকুক; মাথার সামনের অংশ থেকে ঘাড়ের ওপর যেখানে চুল গজায় সেখান পর্যন্ত মাসেহ করবে। মাথার লম্বা চুল যদি পিঠের ওপর পড়ে থাকে সে চুল মাসেহ করতে হবে না।
৮। এরপর দুই পায়ের কা’ব বা টাকনু পর্যন্ত ধৌত করবে। কা’ব বলা হয় পায়ের গোছার নিম্নাংশের উঁচু হয়ে থাকা হাড্ডিদ্বয়কে। দলিল হচ্ছে ইতিপূর্বে উল্লেখিত উসমান (রাঃ) এর ক্রীতদাস হুমরান এর বর্ণনা যে, একবার উসমান বিন আফফান (রাঃ) ওযুর পানি চাইলেন। এরপর তিনি ওযু করতে আরম্ভ করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন), উসমান (রাঃ) হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধুইলেন, এরপর কুলি করলেন এবং নাক ঝাড়লেন। এরপর তিনবার তার মুখমণ্ডল ধুইলেন এবং ডান হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর বাম হাত অনুরূপভাবে ধুইলেন। অতঃপর তিনি মাথা মাসেহ করলেন। এরপর তার ডান পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর অনুরূপভাবে বাম পা ধুইলেন। তারপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার এ ওযুর করার ন্যায় ওযু করতে দেখেছি এবং ওযু শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার এ ওযুর ন্যায় ওযু করবে এবং একান্ত মনোযোগের সাথে দু’ রাকাআত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তির পিছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”[সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত ৩৩১]
ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি উযূ করলেন এবং তাঁর মুখমন্ডল ধুলেন। এক আঁজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে কুলি করলেন ও নাকে পানি দিলেন। অতঃপর আর এক আঁজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে অনুরূপ করলেন অর্থাৎ আরেক হাতের সাথে মিলিয়ে মুখমন্ডল ধুলেন। অতঃপর আর এক আঁজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে ডান হাত ধুলেন। অতঃপর আর এক আঁজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে তাঁর বাম হাত ধুলেন। অতঃপর তিনি মাথা মাস্হ করলেন। অতঃপর আর এক আঁজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে ডান পায়ের উপর ঢেলে দিয়ে তা ধুয়ে ফেললেন। অতঃপর আর এক আঁজলা পানি নিয়ে তা দিয়ে বাম পা ধুলেন। অতঃপর বললেনঃ ‘আমি আল্লাহ্র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে এভাবে উযূ করতে দেখেছি।’(আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩৭, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ১৪২)হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস
ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে-
ইসলাম গ্রহণ করা, আকলবান হওয়া, বুঝদার হওয়া ও নিয়ত করা। এসব শর্তের কারণে কোন কাফের ওযু করলে ওযু হবে না। পাগলের ওযু হবে না। বুঝদার হয়নি এমন শিশুর ওযু হবে না। নিয়ত করেনি এমন ব্যক্তির ওযু হবে না; উদাহরণতঃ কেউ যদি ঠাণ্ডা উপভোগ করার নিয়তে এ অঙ্গগুলো ধৌত করে। ওযু শুদ্ধ হওয়ার জন্য পানি পবিত্রকারী হতে হবে। নাপাক পানি দিয়ে ওযু শুদ্ধ হবে না। অনুরূপভাবে ওযু শুদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব বস্তু চামড়াতে ও নখে পানি পৌঁছতে বাধা দেয় সেসব জিনিস দূর করতে হবে; যেমন- মহিলাদের নখের মধ্যে ব্যবহৃত নেইল পলিশ।
জমহুর আলেমের মতে, ওযুতে বিসমিল্লাহ পড়ার বিধান রয়েছে। তবে আলেমেরা মতানৈক্য করেছেন— বিসমিল্লাহ পড়া ওয়াজিব নাকি মুস্তাহাব? ওযুর শুরুতে কিংবা মাঝখানে যে ব্যক্তির স্মরণে থাকে তার উচিত বিসমিল্লাহ পড়া।
পুরুষ ও মহিলার ওযু করার পদ্ধতিতে কোন পার্থক্য নেই।
ওযু সমাপ্ত করার পর এই দোয়া বলা মুস্তাহাব: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যখন ওযু করে এবং পরিপূর্ণভাবে পানি পৌঁছায় কিংবা (বলেছেন) পরিপূর্ণভাবে ওযু করে এরপর বলে: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’ (অর্থ- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরিক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল) তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজায় খুলে দেয়া হয়। সে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে”[সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত ৩৪৫; সুনানে তিরমিযিতে আরেকটু অতিরিক্ত এসেছে যে, ‘আল্লাহুম্মাজ আলনি মিনাত্তাওয়্যাবীন ওয়াজ আলনি মিনাল মুত্বাতাহ্হিরীন’ (অর্থ- হে আল্লাহ! আমাকে আপনি তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন)[সহিহুত তিরমিযি গ্রন্থে (৪৮) আলবানী হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন]
[দেখুন শাইখ আল-ফাওযান লিখিত ‘আল-মুলাখ্খাস আল-ফিকহী’ ১/৩৬]
আপনি লিখেছেন “আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন, আমাদের নবীর প্রতি দয়া করেন”: শরয়ি বিধান হচ্ছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে ওপর দরুদ পড়া; ঠিক যেভাবে আমাদের রব্ব আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্ নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশ্তাগণ নবীর জন্য দো’আ-ইসতেগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নবীর উপর সালাত (দরুদ) পাঠ কর এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।”[সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৬]
সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
যদি কেউ পবিত্র অবস্থায় থাকে তাহলে পোশাক পরিবর্তন করা ওজু ভঙ্গের কারণ নয়; যতক্ষণ না ওজু ভঙ্গের কোন কারণ না ঘটে। এ ক্ষেত্রে নর-নারীর বিধান সমান। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
ওজু ভঙ্গের কারণসমূহ নিম্নরূপ:
১। দুই রাস্তা দিয়ে কোন কিছু বের হওয়া (যেমন- পেশাব, পায়খানা, বায়ু ইত্যাদি)। কিন্তু নারীর সামনের রাস্তা দিয়ে বায়ু বের হলে ওজু ভাঙ্গবে না।
২। নির্দিষ্ট নিগর্মন পথ ছাড়া অন্য কোনভাবে পায়খানা বা পেশাব বের হওয়া।
৩। বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলা। সেটা সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে হোক; যেটা হচ্ছে পাগলামি। কিংবা বিশেষ কারণের পরিপ্রেক্ষিতে (যেমন- ঘুম, বেহুশ হয়ে যাওয়া, মাতাল হওয়া ইত্যাদি) নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিবেক-বুদ্ধি বিকল হয়ে থাকুক।
৪। পুরুষাঙ্গ ছোঁয়া। দলিল হচ্ছে– বুসরা বিনতে সাফওয়ান (রাঃ) এর হাদিস তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে: “যে ব্যক্তি তার পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করেছে তার উচিত ওজু করা”।[সুনানে আবু দাউদ, তাহারাত অধ্যায়/১৫৪), আলবানী সহিহ সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (১৬৬) বলেছেন: সহিহ]
৫। উটের গোশত খাওয়া। দলিল হচ্ছে জাবের বিন সামুরা (রাঃ) এর হাদিস: “এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, আমরা কি উটের গোশত খাওয়ার কারণে ওজু করব? তিনি বললেন: হ্যাঁ।”[সহিহ মুসলিম, হায়েয অধ্যায়/৫৩৯)]
এখানে উল্লেখ্য, কোন নারীর শরীরের ছোঁয়া লাগলেই ওজু ভেঙ্গে যাবে না; সেটা উত্তেজনাসহ হোক কিংবা উত্তেজনা ছাড়া হোক; যতক্ষণ পর্যন্ত না এ ছোঁয়ার কারণে কোন কিছু বের না হয়।
[দেখুন: শাইখ উছাইমীনের ‘আল-শারহুল মুমতি’ (১/২১৯-২৫০) ও স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র (৫/২৬৪)]
কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ, উসমান ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবূ শাইবাহ, ইসহাক ইবনু ইবরাহীম আল হানযালী (রহঃ) ….. উসমান ইবনু আফফান (রাযিঃ) এর আযাদকৃত দাস হুমরান থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উসমান ইবনু আফফান (রাযিঃ) কে বলতে শুনেছি যে, তিনি মসজিদের বারান্দায় ছিলেন। এমন সময় আসর সালাতের জন্যে মুওয়াযযিন তার নিকট আসলে তিনি ওযুর পানি চাইলেন এবং ওযু করে বললেনঃ আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তোমাদেরকে একটি হাদীস শুনাব, যদি আল্লাহর কিতাবে একটি আয়াত না থাকতো তাহলে আমি তোমাদেরকে হাদীসটি শুনাতাম না। (অতঃপর তিনি বললেন) আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করে সালাত আদায় করবে তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। মুসলিম শরিফ(ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৩১, ইসলামিক সেন্টারঃ ৪৪৭)
মুহাম্মাদ ইবনু হাতিম ইবনু মাইমূন (রহঃ) ….. উকবাহ ইবনু আমির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার ওপর উট চড়ানোর দায়িত্ব ছিল। আমার পালা এলে আমি উট চরিয়ে বিকেলে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পেলাম, তিনি দাঁড়িয়ে লোকেদের সঙ্গে কথা বলছেন। তখন আমি তার এ কথা শুনতে পেলাম, “যে মুসলিম সুন্দরভাবে ওযু করে তারপর দাঁড়িয়ে দেহ ও মনকে পুরোপুরি আল্লাহর প্রতি নিবদ্ধ রেখে দু’ রাকাআত সালাত আদায় করে সে অবশ্যই জান্নাতে যাবে। উকবাহ বলেন, কথাটি শুনে আমি বলে উঠলামঃ বাহ! হাদীসটি কত চমৎকার! তখন আমার সামনের একজন বলতে লাগলেন, আগের কথাটি আরো উত্তম। আমি সে দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি ’উমার। তিনি আমাকে বললেন, তোমাকে দেখেছি, এ মাত্র এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগে বলেছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি উত্তম ও পূর্ণরূপে ওযু করে এ দু’আ পড়বে- “আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয় আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু”। তার জন্যে জান্নাতের আটটি দরজা খুলে যাবে এবং যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।মুসলিম শরিফ (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৪৪, ইসলামিক সেন্টারঃ ৪৬০)
৫:৭ وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَۃَ اللّٰهِ عَلَیۡکُمۡ وَ مِیۡثَاقَهُ الَّذِیۡ وَاثَقَکُمۡ بِهٖۤ ۙ اِذۡ قُلۡتُمۡ سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ۫ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ
আর স্মরণ কর, তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামত এবং যে অঙ্গীকারে তিনি তোমাদেরকে আবদ্ধ করেছিলেন তা; যখন তোমরা বলেছিলে, ‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।
অর্থাৎ আল্লাহর এ নিয়ামত যে, জীবনের সরল সঠিক রাজপথ তিনি তোমাদের জন্য আলোকোজ্জল করে দিয়েছেন এবং সারা দুনিয়ার মানুষের হেদায়াত ও নেতৃত্ব দানের আসনে সমাসীন করেছেন৷
এখানে মহান আল্লাহ আমাদের তাঁর ইবাদাত করার তাওফিক দিয়েছেন সেটা অনন্য একটি নি’আমাত যার জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় ও শুকরিয়া আদায় করা প্রয়োজন। ঈমান দিয়েছেন সেটার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো প্রয়োজন।
মুমিনের স্বভাব হবে দ্বীনের কথা শুনার সাথে সাথেই শুনলাম ও মানলাম নীতি থাকা।
এখানে মহান আল্লাহ অংগিকারে আবদ্ধ করার কথা রবের সাথে করাকে বলেছেন। وَ مِیۡثَاقَهُ الَّذِیۡ وَاثَقَکُمۡ بِهٖۤ
বনী ইসরাইলদের কথা বলা হয়েছিলো যে তাদের অংগীকার যা তারা ভংগ করেছিলো। এখানে মহান আল্লাহ তাঁর সাথে অংগীকারে আবদ্ধ বলা হয়েছে।
আল্লাহর সাথে চুক্তিঃ
‘আর যখন তোমার পালনকর্তা বনু আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদের বের করে আনলেন এবং নিজের উপর তাদের প্রতিজ্ঞা করালেন ‘আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই’? তারা বলল, অবশ্যই। ‘আমরা এ বিষয়ে অঙ্গীকার করছি’ আর এটা এজন্য, যাতে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন একথা বলতে না পারো যে, বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না’ (আ‘রাফ ৭/১১২)।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে ছহীহ সনদে ইমাম আহমাদ, নাসাঈ ও হাকেম (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, ألست بربكم ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই? বনু আদমের কাছ থেকে এই বহুল প্রসিদ্ধ ‘আহদে আলাস্ত্ত’ বা প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতিটি তখনই নেওয়া হয়, যখন আদম (আঃ)-কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়া হয়। আর এ প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছিল না‘মান (وادى نَعْمَانَ)নামক উপত্যকায়, যা পরবর্তীকালে ‘আরাফাত’-এর ময়দান নামে পরিচিত হয়েছে।আহমাদ, মিশকাত হা/১২১ ‘ঈমান’ অধ্যায় ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ।
মুসলিম ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বলেন, কিছু লোক হযরত ওমর ফারূক (রাঃ)-এর নিকটে সূরা আ‘রাফ ১৭২ আয়াতের মর্ম জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হ’লে তাঁকে আমি বলতে শুনেছি যে, ‘আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। অতঃপর নিজের ডান হাত তার পিঠে বুলিয়ে দিলেন। তখন তার ঔরসে যত সৎ মানুষ জন্মাবার ছিল, তারা সব বেরিয়ে এল। আল্লাহ বললেন, এদেরকে আমি জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছি এবং এরা দুনিয়াতে জান্নাতেরই কাজ করবে। অতঃপর তিনি পুনরায় তার পিঠে হাত বুলালেন, তখন সেখান থেকে একদল সন্তান বের করে আনলেন এবং বললেন, এদেরকে আমি জাহান্নামের জন্যে সৃষ্টি করেছি। এরা দুনিয়াতে জাহান্নামের কাজই করবে। একথা শুনে জনৈক ছাহাবী প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে আর আমল করানোর উদ্দেশ্য কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যখন আল্লাহ কাউকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তিনি তাকে দিয়ে জান্নাতের কাজই করিয়ে নেন, এমনকি তার মৃত্যুও অনুরূপ কাজের মধ্যে হয়ে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। পক্ষান্তরে যখন তিনি কাউকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তাকে দিয়ে জাহান্নামের কাজই করিয়ে নেন। এমনকি তার মৃত্যুও অনুরূপ কাজের মধ্যে হয়ে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করান। মালেক, আহমাদ, তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৯৫ ‘ঈমান’ অধ্যায় ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ।
আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ডান মুষ্টির লোকগুলো ছিল সুন্দর চকচকে ক্ষুদ্র পিপীলিকা দলের ন্যায়। আর বাম মুষ্টির ক্ষুদ্র লোকগুলো ছিল কালো কয়লার ন্যায়’।আহমাদ, মিশকাত হা/১১৯ ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ।
পরবর্তীতে নবী রাসূলদের মাধ্যমে সেই চুক্তি স্মরন করিয়ে দেয়া হয়েছে সেটাই কলেমার কথা বা আহবান।
কালিমা পড়ার সাথে সাথে রবের সাথেই চুক্তি হয়ে যায়। যা করতে বলেন তা করা ও যা নিষেধ তা না করা। সুতরাং এই চুক্তি যে করেছে সেটা ব্যক্তির জন্য রবের পক্ষ থেকে উত্তম নি’আমত। যারা করেনি তারা সেই নি’আমত থেকে বঞ্চিত। রবের পথে চলা, দাসত্ব মেনে জীবন পরিচালিত করার তাওফিক যিনি পেয়েছেন তিনি উত্তম নি’আমতেই রয়েছেন। আর মুমিনের চরিত্রের মূল দিকটিই হলো রবের সাথে এই চুক্তি করার পর তিনি শুধু বলেন শুনলাম এবং মানলাম। সমাজ, পরিবেশ,নফস যা-ই বলুকনা কেনো মুমিন সকল সময়েই আল্লাহর আনুগত্যে প্রস্তুত হয়েই চলে। অটল থাকে এই পথে।
সূরা নিসা ও সূরা মায়েদার পার্থক্য হলো- সূরা নিসাতে মু’আমালাত সংক্রান্ত যা মানুষ বা সৃষ্টির সাথে লেন দেনের কথা এসেছে (যেমন ওয়ারিসদের হক) কিন্তু মায়েদাতে মহান আল্লাহর সাথে যে লেন দেন(ইবাদাত) সেটা বলা হয়েছে। কোনটি হালাল, হারাম ইত্যাদি।
নি’আমত ও ওয়াদার কথা স্মরন করিয়ে দিয়ে এরপর বলা হয়েছে আল্লাহর তাকওয়ার কথা, যেনো সেই চুক্তি ঠিক রাখার জন্য রবের সম্পর্কে সচেতন থাকে যেখানে থাকবে আল্লাহভীতি, আল্লাহর ভালোবাসা, আল্লাহকে লজ্জা করা ইত্যাদি অর্থাৎ মহান আল্লাহকে এমনভাবে স্মরন রাখবে যেনো সেই চুক্তি রক্ষা করে চলতে পারে। তাকওয়ার কথা বলার পর এটাও জানিয়ে দিচ্ছেন আল্লাহতা’আলা যে তিনি সকল কিছুই জানেন যা অন্তরে আছে সেটাও। আল্লাহ ভালোভাবেই জানেন অন্তরে কি আছে, সুতরাং সেইভাবেই চলো।
রাসূল সা এর সময় যারা ইমান আনতেন তারা রাসূল সা এর হাতে (সাহাবা রা) বাইয়াত নিতেন আনুগত্যের। পরবর্তীতে মুসলমানদের সংখ্যা যখন বেড়ে যায় এবং ইসলাম একটি সর্ব বৃহৎ শক্তি হিসেবে অবতীর্ণ হয় তখন কলেমা পড়েই ঈমান আনতেন সকলে। সাধারনভাবেই কুর’আন ও সুন্নাহকে আকড়ে ধরার অংগীকার চলে আসে এরই মাধ্যমে। বর্তমানেতো ইসলাম অই একমাত্র জীবন ব্যবস্থা যা পূর্ণাংগ রুপেই আমরা পেয়েছি। কলেমার দাবীই হলো শরীয়া অনুযায়ী চলা।
সত্যনিষ্ঠ মুফাসসিরদের মতে, এখানে কোন মুখ দিয়ে বের হওয়া অঙ্গীকার উদ্দেশ্য নয়। বরং ঈমান আনার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ-নিষেধ পালনের যে অঙ্গীকার স্বতঃই এসে যায়, তা-ই উদ্দেশ্য। [ইবন কাসীর, সা’দী, মুয়াসসার]
৫:৮ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ لِلّٰهِ شُهَدَآءَ بِالۡقِسۡطِ ۫ وَ لَا یَجۡرِمَنَّکُمۡ شَنَاٰنُ قَوۡمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعۡدِلُوۡا ؕ اِعۡدِلُوۡا ۟ هُوَ اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی ۫ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ
হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষাদানে তোমরা অবিচল থাকবে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা তোমাদেরকে যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত
এ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হ’ল মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার না থাকলে মানুষ পশুর মত হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বে মানব রচিত আইন ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা আদেশ করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁর মনোনীত রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন তাঁর বিধানকে বাস্তবায়নের জন্য।
হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ; যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়; সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ্ উভয়েরই ঘনিষ্টতর। কাজেই তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হইয়ো না। যদি তোমরা বক্রতা কথা বল বা পাশ কাটিয়ে যাও তবে তোমরা যা কর আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন। সূরা নিসাঃ১৩৫
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ ‘তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি’ (শূরা ৪২/১৫)।
নবী (সাঃ)-এর নিকট ন্যায্য সাক্ষীর কত বড় গুরুত্ব ছিল, তা এই ঘটনার দ্বারা অনুমান করা যায়। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নু’মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, আমার পিতা আমাকে কিছু হাদিয়া (দান) দিলেন, তা দেখে আমার মাতা বললেন, ‘এই হাদিয়া বা দানের উপর যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে সাক্ষী না রাখবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি সন্তুষ্ট হব না।’ সুতরাং আমার পিতা রসূলে কারীম (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে, (ঘটনা বর্ণনা করলেন।) তখন রসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন; ‘‘তুমি তোমার সমস্ত সন্তানদেরকে অনুরূপভাবে হাদিয়া বা উপঢৌকন দিয়েছ কি?’’ প্রতি উত্তরে (আমার আব্বা) বললেন, ‘না।’ অতঃপর রসূল (সাঃ) বললেন, ‘‘আল্লাহকে ভয় কর এবং সন্তানদের মাঝে সমদৃষ্টিসম্পন্ন সুবিচার কর।
তিনি আরো বললেন, ‘‘আমি যুলুমের (অন্যায়ের) সাক্ষী হতে পারব না।’’ (সহীহ বুখারী ও মুসলিম / কিতাবুল হিবা বা দানপত্র নামক অধ্যায়) বুখারী ২৫৮৬; মুসলিম: ১৬২৩]
বুখারী মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার মাখজুমী গোত্রের এক কুরাইশী মহিলা চুরি করে ধরা পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সা) তার হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দেন। নির্দেশ শুনে লোকজন খুব পেরেশান হয়ে পড়লো। কারণ সেই মহিলা ছিল সম্ভ্রান্ত বংশের। তারা বলাবলি করতে লাগল,উসামা ইবন যায়িদ ছাড়া আর কে আছে,যাকে আল্লাহর রাসূল (সা) অধিক ভালবাসেন। তারা উসামা (রা)কে সুপারিশের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে পাঠালেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে কথা বললেন,তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন,‘হে উসামা! তুমি কি আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা না করার সুপারিশ করতে এসেছো? তখন উসামা ইবন যায়িদ ভয় পেয়ে বললেন,‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার ভুল হয়েছে।’
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিলেন। প্রথমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হামদ ও সানা পেশের পর বললেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকজন এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে যে, যখন তাদের মধ্যে কোন সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী লোক চুরি করতো তখন তারা তাকে ছেড়ে দিতো এবং দুর্বল লোক চুরি করলে তাকে শাস্তি দিতো। ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, আজ যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করতো তবে আমি তার ক্ষেত্রেও হাত কাটার নির্দেশ দিতাম।
আয়াতের বিষয়বস্তু প্রায় এসব শব্দেই অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে। পার্থক্য এতটুকু যে, সেখানে বলা হয়েছিলঃ (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ) [সূরা আন-নিসাঃ ১৩৫]
আর এখানে বলা হচ্ছেঃ (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ)।
সাধারণতঃ দুটি কারণ মানুষকে ন্যায় ও সুবিচারে বাধা-প্রদান এবং অন্যায় ও অবিচারে প্ররোচিত করে।
(এক) নিজের অথবা বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব।
(দুই) কোন ব্যক্তির প্রতি শক্রতা ও মনোমালিন্য।
সূরা আন-নিসার আয়াতে প্রথমোক্ত কারণের উপর ভিত্তি করে সুবিচারের আদেশ দেয়া হয়েছে আর সূরা আল-মায়েদার আলোচ্য আয়াতে শেষোক্ত কারণ হিসেবে বক্তব্য রাখা হয়েছে।
সূরা আন-নিসার আয়াতের সারমর্ম এই যে, ন্যায় ও সুবিচারের ক্ষেত্রে নিজের এবং পিতা-মাতা ও আত্নীয়-স্বজনেরও পরওয়া করো না। যদি ন্যায় বিচার তাদের বিরুদ্ধে যায়, তবে তাতেই কায়েম থাক। সূরা আল-মায়েদার আয়াতের সারমর্ম এই যে, ন্যায় ও সুবিচারের ক্ষেত্রে কোন শক্রর শক্রতার কারণে পশ্চাদপদ হওয়া উচিত নয় যে, শক্রর ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে সুবিচারের পরিবর্তে অবিচার শুরু করবে। [বাহরে-মুহীত] তাছাড়া সত্য সাক্ষ্য দিতে ত্রুটি না করার প্রতি পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত বিভিন্ন ভঙ্গিতে জোর দিয়েছে। এক আয়াতে অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, “সাক্ষ্য গোপন করো না। যে সাক্ষ্য গোপন করে, তার অন্তর পাপী” [সূরা আল-বাকারাহঃ ২৮৩]
আজ আমাদের মুসলিম জাতির মাঝে অনেকেরই এই ইনসাফ কায়েমে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। আইন আদালতে যারা আছেন সেখান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে যারা আছেন সেটাসহ প্রায় জায়গাতেই যারা দায়িত্বশীল,এই ইনসাফ, ন্যয় নীতির বড়ই অভাব। যে রাসূল সা ইনসাফের ঝাণ্ডা উড়িয়েছেন সমগ্র মক্কা মদিনায়, দেখিয়ে গিয়েছেন একজন স্বামী, একজন পিতা, রাষ্ট্রনায়ক, দাঈ ইলাল্লাহ, সমাজের একজন সদস্য, রাষ্ট্রের একজন নাগরিক,একজন ব্যবসায়ী, একজন এতিম, সকল স্থানেই ন্য্য নীতির, ইনসাফের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই,সেটা আমরা কতটুকু অনুসরন, অনকরন করছি? রাসূল সা এর প্রতি ভালোবাসার এটাইতো লক্ষন যে, তিঁনি বাস্তব জীবনে যে মূলনীতি দেখিয়েছেন সেটা যেনো আমরা অনুসরন কর্রি।
ব্যক্তিগত জীবন ,পারিবারিক জীবনেও আমরা যদি এই সঠিক দৃষ্টিভংগি, শরীয়ার শিক্ষাকে আমল করতাম তাহলে আজকের পারিবারিক বিবেধ অনেকাংশই মিটে যেতো ইন শা আল্লাহ।
মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
৫:৯ وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ ۙ لَهُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ
যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।
এইভাবেই ঈমান ও আমলের মাধ্যমে যারাই রবের পথে চলার প্রচেষ্টায় আছেন,তাদের এই কষ্ট কখনোই বিফলে যাবে না, মহান আল্লাহই ইরশাদ করেছেন-
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ
আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তারাই জান্নাতবাসী, তারা সেখানে স্থায়ী হবে বাকারাঃ৮২
اُولٰٓئِکَ جَزَآؤُهُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهِمۡ وَ جَنّٰتٌ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا ؕ وَ نِعۡمَ اَجۡرُ الۡعٰمِلِیۡنَ
তারাই, যাদের পুরস্কার হলো তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর সৎকর্মশীলদের পুরস্কার কতইনা উত্তম! আলে ইমরানঃ১৩৬
اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اِنَّا لَا نُضِیۡعُ اَجۡرَ مَنۡ اَحۡسَنَ عَمَلًا
নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে – আমরা তো তার শ্ৰমফল নষ্ট করি না- যে উত্তমরূপে কাজ সম্পাদন করেছে। কাহাফঃ৩০
৫:১০ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَحِیۡمِ
আর যারা কুফরী করে এবং আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী।
আর যারা রবের এই নির্দেশনাগুলো মেনে নিতে পারে নি অস্বীকার করেছে,তাদের পরিনতিও মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন-
আর যারা কুফরী করেছে এবং আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করেছে তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। বাকারাঃ ৩৯
অবশ্যই, যে ব্যক্তি পাপ করেছে এবং যার পাপরাশি তাকে পরিবেষ্টন করেছে, তারাই হবে জাহান্নামের অধিবাসী; তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। বাকারাঃ ৮১
৫:১১ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ هَمَّ قَوۡمٌ اَنۡ یَّبۡسُطُوۡۤا اِلَیۡکُمۡ اَیۡدِیَهُمۡ فَکَفَّ اَیۡدِیَهُمۡ عَنۡکُمۡ ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ وَ عَلَی اللّٰهِ فَلۡیَتَوَکَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ
হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ কর যখন এক সম্প্রদায় তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের হাত প্রসারিত করতে চেয়েছিল, অতঃপর আল্লাহ তাদের হাত তোমাদের থেকে নিবৃত রাখলেন আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। আল্লাহর উপরই যেন মুমিনগণ তাওয়াক্কুল করে।
এই আয়াতের শানে নুযুল বা অবতীর্ণের কারণ সম্পর্কে কুরআনের ভাষ্যকারগণ বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেছেন যেমন;
(ক) একজন বেদুঈনের ঘটনা, কোন এক সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় রসূল (সাঃ) কোন এক গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং তরবারিটিকে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। (সুযোগ বুঝে) ঐ বেদুঈন (তাঁর দিকে ধাবিত হয়ে) তরবারিটি হস্তগত করে ফেলল। অতঃপর তাঁর দিকে তরবারি উঁচিয়ে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আমার কবল থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে?’ রসূল (সাঃ) নিশ্চিন্তে উত্তর দিলেন; ‘আল্লাহ।’ (অর্থাৎ আল্লাহ রক্ষা করবেন।) শুধু এতটুকু কথা বলতে যত দেরী, (অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে) তার হাত থেকে তরবারিটি পড়ে গেল।
(খ) আবার কেউ বলেন যে, কা’ব বিন আশরাফ ও তার সহযোগীরা রসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবা (রাঃ)গণের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও ছল-চাতুরী করে তাঁদের ক্ষতি করার ষড়যন্ত্র করেছিল; যখন তিনি ও সাহাবাগণ তার বাড়িতে পৌঁঁছেছিলেন। কিন্তু তাদের এ ষড়যন্ত্র আল্লাহ তাআলা যথাসময়ে তাঁর রসূল (সাঃ)-কে অবগত করে ব্যর্থ করে দেন।
(গ) আবার কেউ বলেন যে, একজন মুসলমানের হাতে ভুলক্রমে আ’মেরী গোত্রের দুই ব্যক্তি খুন হয়েছিল। আল্লাহর রসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) সহ রক্তপণ আদায়ের ব্যাপারে সন্ধিচুক্তি মোতাবেক সহযোগিতার কামনায় ইয়াহুদীদের গোত্র বানী নাযবীরের বস্তীতে গমন করেন। তিনি একটি দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসেন। অপর দিকে তারা ষড়যন্ত্র করেছিল যে, উপর থেকে যাঁতার একটি পাথর ফেলে তাঁকে হত্যা করা হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূল (সাঃ)-কে অহীর মাধ্যমে (তাদের সংকল্পের কথা) জানিয়ে দেন এবং তৎক্ষণাৎ তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করেন। সম্ভবতঃ উক্ত সমস্ত ঘটনার পরেই এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। কেননা একটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন কারণ ও পটভূমিকা থাকতে পারে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, আইসারুত তাফাসীর ও ফাতহুল ক্বাদীর)
এখান থেকে যে ভাষণ শুরু হচ্ছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে দু’টো৷
প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুসলমানদের পূর্বসূরী আহলী কিতাবরা যে পথে চলছিল সে পথে চলা থেকে তাদেরকে বিরত রাখা৷ কাজেই তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেভাবে আজ তোমাদের থেকে অংগীকার নেয়া হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈল ও ঈসা আলাইহিস সালামের উম্মতদের থেকেও এ একই অংগীকার নেয়া হয়েছিল৷ তারা যেভাবে নিজেদের অংগীকার ভংগ করে পথভ্রষ্ট হয়েছে তোমরাও যেন তেমনি অংগীকার ভংগ করে পথভ্রষ্ট হয়ে না যাও৷
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইহুদী ও খৃস্টান উভয় সম্প্রদায়কে তাদের ভুলের জন্য সতর্ক করে দেয়া এবং তাদেরকে সত্য দীন তথা ইসলামের দাওয়াত দেয়া৷
এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাকওয়া ও তাওয়াক্কলের কথা বলেছেন, মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার কথা এসেছে।
আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল : গুরুত্ব ও তাৎপর্য ()আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
তাওয়াক্কুল আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো, ভরসা করা, নির্ভর করা। তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ অর্থ হলো: আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করা। ইসলামে আল্লাহ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি একটি ইবাদত। তাই আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো ওপর তাওয়াক্কুল করা যায় না।
কজন ঈমানদার মানুষ ভালো ও কল্যাণকর বিষয় অর্জনের জন্য সকল ব্যাপারে নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করবে, সার্বিক প্রচেষ্টা চালাবে আর ফলাফলের জন্য আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করবে, তাঁর প্রতি আস্থা ও দৃঢ় ইয়াকীন রাখবে। বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন ফলাফল তা-ই হবে। আর তাতেই রয়েছে কল্যাণ চূড়ান্ত বিচার ও শেষ পরিণামে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদি আমরা তা অনুধাবন না-ও করতে পারি। এটাই তাওয়াক্কুলের মূলকথা।
তাওয়াক্কুলের নীতি অবলম্বনকারী ব্যক্তি কখনো হতাশ হয় না। আশা ভঙ্গ হলে মুষড়ে পড়ে না। বিপদ-মুসীবত, যুদ্ধ-সংকটে ঘাবড়ে যায় না। যে কোনো দুর্বিপাক, দুর্যোগ, সঙ্কট, বিপদ-মুসীবতে আল্লাহ তা‘আলার ওপর দৃঢ় আস্থা রাখে। ঘোর অন্ধকারে আশা করে উজ্জ্বল সুবহে সাদিকের। যত যুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়নের ঝড়-তুফান আসুক, কোনো অবস্থাতেই সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করে না। তাই আল্লাহ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল হলো তাওহীদের একটি গুরত্বপূর্ণ অংশ।
﴿وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱلۡحَيِّ ٱلَّذِي لَا يَمُوتُ﴾ [الفرقان: ٥٧]
‘‘আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার ওপর যিনি মরবেন না।’’ [সূরা আল ফুরকান, আয়াত: ৫৮]
﴿وَعَلَى ٱللَّهِ فَلۡيَتَوَكَّلِ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ﴾ [ابراهيم: ١١]
‘‘আর আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।’’ [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১১]
﴿فَإِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَوَكِّلِينَ﴾ [ال عمران: ١٥٩]
‘‘অতঃপর তুমি যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর।’’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯]
﴿وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُ﴾ [الطلاق: ٣]
‘‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্যে যথেষ্ট।’’ [সূরা আত-তালাক, আয়াত: ৩]
﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتۡ قُلُوبُهُمۡ وَإِذَا تُلِيَتۡ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتُهُۥ زَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا وَعَلَىٰ رَبِّهِمۡ يَتَوَكَّلُونَ ٢﴾ [الانفال: ٢]
‘‘মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের ওপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে।’’ [সূরা আল আনফাল, আয়াত: ২]
আব্দুললাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“আমার সম্মুখে সকল উম্মতকে পেশ করা হলো। (এভাবে যে,) আমি একজন নবীকে ছোট একটি দলসহ দেখলাম। কয়েকজন নবীকে একজন বা দু’জন অনুসারীসহ দেখলাম। আরেকজন নবীকে দেখলাম তার সাথে কেউ নেই। ইতোমধ্যে আমাকে একটি বড় দল দেখানো হলো। আমি মনে করলাম এরা হয়ত আমার উম্মত হবে। কিন্তু আমাকে বলা হলো, এরা হলো মূসা আলাইহিস সালাম ও তার উম্মত। আমাকে বলা হলো, আপনি অন্য প্রান্তে তাকান। আমি তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে বিরাট একটি দল। আবার আমাকে বলা হলো, আপনি অন্য প্রান্তে তাকান। তাকিয়ে দেখলাম, সেখানেও বিশাল এক দল। এরপর আমাকে বলা হলো, এসব হলো আপনার উম্মত। তাদের সাথে সত্তর হাজার মানুষ আছে যারা বিনা হিসেবে ও কোনো শাস্তি ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ পর্যন্ত বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘরে চলে গেলেন। এরপর লোকেরা সেসব মানুষ (যারা বিনা হিসাবে ও বিনা শাস্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে) তারা কারা হবে, সে সম্পর্কে আলোচনা শুরু করে দিল। কেউ বলল, এরা হচ্ছে, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহচর্য লাভ করেছে। আবার কেউ বলল, এরা হবে যারা ইসলাম অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করেছে আর আল্লাহর সাথে কখনো শরীক করে নি, তারা। এভাবে সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে এসে বললেন, তোমরা কী বিষয়ে আলোচনা করছ? সাহাবীগণ আলোচনার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে তাকে জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা হচ্ছে এমনসব লোক যারা ঝাড়-ফুঁক করেনা। ঝাড়-ফুঁক চায় না। কোনো কুলক্ষণে-শুভাশুভে বিশ্বাস করে না এবং শুধুমাত্র নিজ রবের ওপর তাওয়াক্কুল করে।’’ এ কথা শুনে উক্কাশা ইবন মিহসান দাঁড়িয়ে বলল, আপনি আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন, তিনি যেন আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর আরেকজন উঠে বলল, আপনি আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন, তিনি যেন আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘উক্কাশা এ ব্যাপারে তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছে।’ ] সহীহ বুখারী ও মুসলিম।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«حسْبُنَا اللَّهُ ونِعْمَ الْوكِيلُ قَالَهَا إبْراهِيمُ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم حينَ أُلْقِى في النَّارِ، وَقالهَا مُحمَّدٌ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم حيِنَ قَالُوا: «إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إيماناً وقَالُوا : حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوكِيلُ » رواه البخارى
وفي رواية له عن ابْنِ عَبَّاسٍ رضي اللَّه عنهما قال : «كَانَ آخِرَ قَوْل إبْراهِيمَ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم حِينَ ألْقِي في النَّارِ «حسْبي اللَّهُ وَنِعمَ الْوَكِيلُ».
“ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হলো, তখন তিনি বললেন, হাসবুনাল্লাহু ওয়া-নিমাল ওয়াকীল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি উত্তম অভিভাবক)। আর লোকেরা যখন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথীদের বলল, (শত্রু বাহিনীর) লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হচ্ছে, তাই তোমরা তাদের ভয় কর, তখন তাদের ঈমান বেড়ে গেল এবং তারা বলল, হাসবুনাল্লাহু ওয়া-নিমাল ওয়াকীল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট তিনি উত্তম অভিভাবক)।” সহীহ বুখারী।
ইবনে আব্বাস থেকে বুখারীর আরেকটি বর্ণনায় আছে, “আগুনে নিক্ষেপকালে ইবারহীম আলাইহিস সালামের শেষ কথা ছিল, হাসবুনাল্লাহু ওয়া-নিমাল ওয়াকীল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট তিনি উত্তম অভিভাবক)।”
উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত (তার মূল নাম হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া হুযায়ফা আল মাখযুমিয়্যাহ), (তিনি বলেন),
«أن النبيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم كانَ إذَا خَرجَ مِنْ بيْتِهِ قالَ : «بسم اللَّهِ، توكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ، اللَّهُمَّ إِنِّي أعوذُ بِكَ أنْ أَضِلَّ أو أُضَلَّ، أَوْ أَزِلَّ أوْ أُزلَّ، أوْ أظلِمَ أوْ أُظلَم، أوْ أَجْهَلَ أو يُجهَلَ عَلَيَّ »
“নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নিজ ঘর থেকে বের হতেন, বলতেন, ‘‘আল্লাহর নামে বের হলাম, তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করলাম। হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি, যেন আমি পথভ্রষ্ট না হই আর আমাকে যেন পথভ্রষ্ট করা না হয়। আমার যেন পদস্খলন না হয় বা পদস্খলন করা না হয়। আমি যেন কারো ওপর অত্যাচার না করি বা করো দ্বারা অত্যাচারিত না হই। আমি যেন মুর্খতা অবলম্বন না করি বা আমার সাথে মুর্খতা সুলভ আচরণ না করা হয়।’আ বু দাউদ, তিরমিযীসহ আরো অনেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযীর মতে হাদীসটি হাসান সহীহ। বর্ণনার এ ভাষা আবু দাউদ থেকে নেওয়া)।
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ قَالَ يعنِي إذا خَرَج مِنْ بيْتِهِ : بِسْم اللَّهِ توكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ، ولا حوْلَ ولا قُوةَ إلاَّ بِاللَّهِ، يقالُ لهُ هُديتَ وَكُفِيت ووُقِيتَ، وتنحَّى عنه الشَّيْطَانُ»
‘‘যখন কোনো ব্যক্তি নিজ ঘর হতে বের হওয়ার সময় বলে, ‘আল্লাহর নামে (বের হচ্ছি), আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করলাম। খারাপ বিষয় থেকে ফিরে থাকা আর ভালো বিষয়ে সামর্থ্য রাখা আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত সম্ভব নয়।’
তাহলে তাকে বলা হয়, তোমাকে সঠিক পথ দেখানো হলো, তোমার জন্য যথেষ্ট হলো, তোমাকে রক্ষা করা হলো। আর শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়।’ আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাই প্রমুখ। আবু দাউদের বর্ণনায় আরো আছে যে, এক শয়তান অন্য শয়তানকে বলে, যে ব্যক্তিকে হিদায়াত দেওয়া হয়েছে, যার জন্য আল্লাহর রহমত যথেষ্ট করা হয়েছে, যাকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে তার ব্যাপারে তোমার করার কী আছে?’
সূরা জুমুআর প্রসিদ্ধ আয়াত আমাদের সবার জানা।
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ
(তরজমা) সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে। … (সূরা জুমুআ ৬২ : ১০)
তাহলে আল্লাহ তাআলাই আদেশ করেছেন তাওয়াক্কুল করার, আল্লাহর উপর ভরসা রাখার, আবার তিনিই আদেশ করেছেন, নামায শেষে ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ার, আল্লাহর ফযল অন্বেষণ করার। এর তাৎপর্য হল মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী কাজ করবে, কিন্তু ঈমান থাকবে আল্লাহর ফয়সালার উপর। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কর্ম ও উপকরণের মাঝে, কিন্তু অন্তর আল্লাহর সাথে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে কর্ম করছি আর অন্তরে ভরসা আল্লাহর উপর পোষণ করছি।
হাদীস শরীফে আছে-
الكيس من دان نفسه وعمل لما بعد الموت، والعاجز من اتبع نفسه هواها وتمنى على الله.
বিচক্ষণ ঐ ব্যক্তি যে নিজের কর্মের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জন্য আমল করে। পক্ষান্তরে অক্ষম ঐ ব্যক্তি যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুসারী করে আর আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে অলীক আশা পোষণ করে। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪৫৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৪২৬০)
যেমন কেউ ধারণা করল, ‘আল্লাহ তো গাফূরুর রাহীম, তিনি আমাকে মাফ করে দিবেন। সুতরাং আমল না করলেও কোনো অসুবিধা নেই।’ এই ব্যক্তি মুতাওয়াক্কিল নয়। সে হচ্ছে অক্ষম নির্বোধ।
সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারীতে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ.-এর একটি উক্তি বর্ণিত হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেউ যদি ঘরে বা মসজিদে এই বলে বসে থাকে যে, আমি কোনো কাজ করব না। আমার নির্ধারিত রিযক আমার কাছে এসে পড়বে। তার হুকুম কী? ইমাম আহমদ রাহ. জবাব দিলেন,هذا رجل جهل العلم ‘এ লোক প্রকৃত ইলম থেকে বঞ্চিত।’ এরপর বলেন, ‘স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ, ‘আল্লাহ আমার রিযক রেখেছেন আমার বর্শার ছায়ায়’। তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহর উপর যথোপযুক্ত তাওয়াক্কুল করতে তাহলে তিনি তোমাদের সেভাবেই রিযিক দিতেন যেভাবে পাখিদের দিয়ে থাকেন। তারা সকালে ক্ষুধার্ত বের হয় আর সন্ধ্যায় তৃপ্ত ফেরে।’ এ হাদীসে রিযকের খোঁজে নীড় থেকে বের হওয়ার কথা আছে। একইভাবে সাহাবীগণ ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন, ক্ষেত-খামারে কাজ করতেন।
মহান আল্লাহ আমাদের বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন।
তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান।তাফহিমুল কুর’আন।