মন্দের শেষ পরিণতি ইতিহাস যা বলে

 

শুরুটা হয়েছিল উম্মু আনমারের ভাইকে দিয়ে। কারখানায় এসে হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়ে ওরা মারছিল। হাতুড়ি, লোহার পাত, টুকরো লোহা। জ্ঞান ফেরার পর যুবকটি দেখেছিল তার সারা শরীর রক্তাক্ত।
.
উম্মু আনমারের নিষ্ঠুরতা ছিল গোছানো, কিন্তু আরো তীব্র। কারখানায় এসে হাপরে লোহার পাত গরম করে যুবকটির মাথায় চেপে ধরতো। পৃথিবী অন্ধকার হয়ে একটি বিন্দুতে মিলিয়ে গিয়ে সংজ্ঞা হারানোর মুহুর্তগুলো কাঙ্ক্ষিত ছিল। অতি প্রতীক্ষিত ছিল। কারন চেতনাহীনতায় শুধু নিস্তার মিলতো এই যন্ত্রনা থেকে।
.
আস্তে আস্তে নির্যাতনের মাত্রা বাড়লো। আরো মেথোডিকাল হলো। মধ্যাহ্নের মরুভূমির সূর্‍্যের নিচে উদোম গায়ে বর্ম পড়িয়ে যুবককে ফেলে রাখা হতো। শরীর অবশ হয়ে আসতো। ওরা বুকে, মুখে, মাথায় উঠে লাথি দিতো। প্রশ্ন করতো। তারপর আবার মারতো। তারপর আবার প্রশ্ন, তারপর আবার মারতো। আগুনে পাথর গরম করে, পাথরের উপর শুইয়ে দিত। বুকের উপর পা দিয়ে শক্ত করে ঠেসে ধরতো। যুবকটি নিজের চামড়া আর মাংস পোড়ার শব্দ শুনতো পেত। চর্বি গলে পড়তো। কখনো সরাসরি গরম কয়লার উপর শুইয়ে দিত। তারপর আবার শুরু হতো প্রশ্নের পালা।
.
তার ব্যাপারে তুমি কি বলো?
– আল্লাহ্‌র বান্দা ও রাসূল, তিনি এসেছেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আমাদের নিয়ে যেতে।
.
লাত আর উযযার ব্যাপারে তুমি কি বলো?
– দুই মূর্তি। বোবা ও বধির। না পারে লাভ বা ক্ষতি আনতে
.
ওদের রাগ বাড়তো। বাড়তো পাথরের আকার। বাড়তো যন্ত্রনা। বাড়তো সংজ্ঞাহীনতার মূহুর্তের জন্য প্রতীক্ষা।
.
ওরা কি চায় যুবক জানে। কিন্তু ওরা যা চায় তা মেনে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। সত্যকে চেনার পর সত্যকে অস্বীকারের কোন এখতিয়ার আসমান যমীনের মালিক আমাদের দেন নি। কিন্তু এই যন্ত্রনা অসহনীয়। শরীর নিতে পারে না। মন দুমড়েমুচড়ে ভেঙ্গে যেতে চায়…
.
অনেক সংকোচের পর আজ যুবকটি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুবকটি এগিয়ে যাচ্ছে। ‘কাবার দিকে। দূর থেকে তাঁকে দেখা যাচ্ছে। কাবার ছায়ায় শুয়ে আছেন। কিন্তু এতো দূর থেকেও চিনতে ভুল হচ্ছে না। তিনি ছাড়া আর কে আছেন যার চতুর্দিক থেকে সত্য প্রবাহিত, যার মুখে নূরের আভা দীপ্তিমান।
.
যুবকটি তাঁর কাছে গেল। সাথে একই পথের পথিক আরো কয়েকজন। প্রশ্ন করলেন –
.
ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য ও ক্ষমা চাইবেন না?
.
রাসূলুল্লাহর ﷺ চেহারা লাল হয়ে গেল। তিনি ﷺ বললেন –
.
“তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক লোককে ধরে গর্তে খুঁড়ে তার অর্ধাংশ পোতা হয়েছে, তারপর করাত দিয়ে মাথার মাঝখান থেকে ফেঁড়ে ফেলা হয়েছে। লোহার চিরুনী দিয়ে তাদের হাড় থেকে গোশত ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তবুও তাদের দ্বীন থেকে তারা বিন্দুমাত্র টলেনি। আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই এই দ্বীনকে পূর্ণতা দান করবেন। এমন একদিন আসবে যখন একজন পথিক ‘সান’আ’ থেকে ‘হাদরামাউত’ পর্যন্ত ভ্রমণ করবে। এই দীর্ঘ ভ্রমণে সে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় করবে না। তখন নেকড়ে মেষপাল পাহারা দিবে। কিন্তু তোমরা বেশী অস্থির হয়ে পড়ছো’ [আল-বুখারী]
.
.
আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল ফায়সালা করেছিলেন। উম্মু আনমার মারা গিয়েছিল এক অদ্ভুত রোগে ভুগে। প্রচন্ড মাথার যন্ত্রনা তাকে উন্মাদ করে দিত। কোনভাবে এই যন্ত্রনা কমতো না। তীব্র যন্ত্রনায় উম্মু আনমার জ্বলাতঙ্ক রোগীর মতো আচরণ করতো। বাধ্য হয়ে উম্মু আনমারের সন্তানেরা উত্তপ্ত লোহার পাত দিয়ে উম্মু আনমারের মাথায় চেপে ধরতো। উম্মু আনমারের ভাই মারা গিয়েছিল বদরের ময়দানে হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাতে। মরভূমিতে সেই যুবকের উপর অন্যা অত্যাচারকারীরাও মারা গিয়েছিল বদরের দিনে। আর আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল মুসলিমদের বিজয় দান করেছিলেন, এবং তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করেছিলেন –যদিও তা ছিল মুশরিকদের অপছন্দনীয়।
.
এই যুবককে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পরবর্তীতে সম্মানিত করেছেন, সম্পদশালী করেছেন। যখন তিনি মৃত্যুবরন করেছিলেন তখন তার জানায পড়িয়েছিলেন আমীরুল মুমীনীন আলি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, এবং তিনি বলেছিলেন –
.
“আল্লাহ খাব্বাবের ওপর রহম করুন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন মনেপ্রাণে, হিজরাত করেন অনুগত হয়ে এবং জীবন অতিবাহিত করেন মুজাহিদ রূপে। যারা সৎকাজ করে আল্লাহ তাদের ব্যর্থ করেন না।”
.
তিনি ছিলেন খাব্বাব ইবনুল আরাত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।
.
.
আমরা আমাদের চারপাশে তাকাই আর আমরা দেখি উম্মাহ আজ নির্যাতিত, পদাবনত, অপমানিত। আমরা দেখি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিমরা যেন সর্বনিকৃষ্ট। পশুপাখির রক্ত নিয়েও মানুষ মর্মাহত হয়, কিন্তু মুসলিমদের রক্তের নদী প্রবাহিত হলেও সমগ্র পৃথীবি থাকে নির্বিকার। আর ে শুধু কাফিরদের জন্যই সত্য নাম, মুসলিমদের জন্যও সত্য। মুসলিমদের কাছে ইসলামের মূল্য নেই, উম্মাহর রক্তের মূল্য নেই, মুসলিম পরিচয়ের মূল্য নেই।
.
আমরা চারপাশে তাকাই আর দেখি শত্রু সংখ্য্যা অগনিত। শক্তিতে পরাক্রমশালী। সামর্থ্যে সহস্র যোজন এগোনো। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু মুসলিমরা শতধা বিভক্ত। তারা তাদের কুফরের উপর সন্তুষ্ট, গর্বিত। আর মুসলিমরা তাদের ইসলাম নিয়ে লজ্জিত। তারা ক্ষমতায় আসীন আর মুসলিমরা দুর্বল। আর আমরা চিন্তা করি, কিভাবে এই রাতের শেষ হবে? আদৌ কি শেষ হবে? পরিবর্তন কি কখনো আসবে? কিভাব এতো প্রতিকূলতার মোকাবেলা করা যাবে?
.
আর তারপর আমরা চিন্তা করি চেষ্টা করার অর্থ কি? লাভটাই বা কি? এসবের অর্থ কি?
.
আমরা স্বীকার করি বা না করি আমাদের অধিকাংশের মনেই এ প্রশ্ন এসেছে।
.
স্মরণ করুন। নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। যিনি অনস্তিত্ব থেকে মহাবিশ্বকে অস্তিত্বে এনেছেন, যিনি মৃত হতে জীবিতকে নির্গত করেন এবং জীবিত হতে মৃতকে বহির্গত করেন, সমস্ত কিছু যার উপর নির্ভরশীল, যিনি শুধু বলেন “হও” আর তা হয়ে যায়, যিনি একচ্ছত্র অধিপতি, যার কোন সদৃশ, যার কোন সমকক্ষ নেই, যার কোন প্রতিদন্ধ্বী নেই, যিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, যিনি অপ্রতিরোধ্য মহাপরাক্রমশালী রাজাধিরাজ, তিনি কি যথেষ্ট নন?
.
KnowYourDeen