দুনিয়ার জীবনের উদ্দেশ্য কি?

আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

 

একটা সময় ছিল যখন মুখে হলেও লজ্জা, বিনয়, ভদ্রতার মতো বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রশংসনীয় বলে স্বীকার করা হতো। দিন বদলে গেছে। লজ্জা এখন ব্যাকডেটেড, ভদ্রতা হল ল্যাক অফ কনফিডেন্স আর বিনয় হল দুর্বলতা। আমরা এমন এক গ্লোবাল কালচারে বসবাস করছি যা সব মানদন্ডকে উলটে দিয়েছে। মিউযিশিয়ান, মুভিস্টার, বিভিন্ন খেলোয়ার, দেশিবিদেশি সেলিব্রিটি এরা একেকজন আত্মমুগ্ধতা, আত্মমগ্নতার এক একজন আইডল, মনুমেন্ট। শিক্ষক। নির্লজ্জের মতো আত্মপ্রশংসা, আত্মপ্রচার এবং নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ, খুব বিশেষ কিছু একটা মনে করা এখন খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এটা স্মার্টনেস, কনফিডেন্স – মানসিক ভাবে হেলদি। একটা গোঁটা সভ্যতা আত্মউপাসনা আর মানসিক আত্মরতিতে লিপ্ত।
.
অহংকার এবং দম্ভ হল আর-রাজীম ইবলিসের বৈশিষ্ট্য। অহংকারের কারনে ইবলিস অবাধ্য হয়েছিল তার সৃষ্টিকর্তা এবং আমাদের সৃষ্টিকর্তার। হয়েছিল বিতাড়িত, অভিশপ্ত। আজ আমরা নিজের বিদ্যা, বুদ্ধি, পরিচিতি, সম্পদ, ক্ষমতার কারনে নিজেকে অন্যের চেয়ে ভালো মনে করি। গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সম্মানিত মনে করি। গর্বিত মুখে, দাম্ভিক পদক্ষেপে আমাদের বুকের ভেতরে টুকরো টুকরো ইবলিশকে বয়ে নিয়ে বেড়াই।

আমরা গর্বের উপলক্ষের অভাব হয় না। স্কুলে ভাল ছাত্র হওয়া, ‘আই অ্যাম জিপিএ ৫’ হওয়া, ট্রেন্ডি পোশাক থাকা, লেইটেস্ট মডেলের সেলফোন কিংবা গ্যাজট থাকা, বুয়েট-আইবিএ-ডিউ ইত্যাদি কোন নির্দিষ্ট কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া – এগুলো সব আমাদের গর্বের কারন। আবার কারো জন্য প্রাইভেট ইউনিতে পড়া গর্বের কারন। কারো জন্মপরচিয় তার গর্বের কারন, কারো পরিবারের আর্থিক অবস্থা তার গর্বের কারন। গাড়ি, বাড়ি, বউ, বাইজি – সবগুলোই দেখিয়ে বেড়ানোর বস্তু, অহংকারের উপলক্ষ। নিজ সন্তানও প্রতিযোগিতার জিনিষ। আমার বাচ্চার কাপড় অমুকের বাচ্চার চাইতে দামি হবে, আমার বাচ্চা অমুকের বাচ্চার চাতে ভালো ছাত্র হবে, আমার বাচ্চা অমুকের বাচ্চার চাইতে বেশি এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে থাকবেন। অন্তহীন এক লিস্ট। অন্তহীন এক ছুটে চলা।
.
অহংকার এমন এক অসুস্থতা যা বিভিন্ন ভাবে অন্তরে প্রবেশ করে। শুধু দুনিয়ার পেছনে ছুটে চলা, এক্সক্লুসিভলি দুনিয়ার চিন্তা করা লোকেরা এই অসুখে ভোগেন না। অধিক ইবাদাতকারী, অধিক যুহুদ পালনকারী, আলিম, দা’ঈ কেউই এই অসুখ থেকে নিরাপদ না। আমাদের মধ্য এমন মানুষ কি নিতান্তই কম যারা মাসজিদে দড়িয়ে অন্যদের চাইতে নিজেকে ‘স্পেশাল’ মনে করে না? আমাদের মধ্যে এমন মানুষ কি কম যারা অন্যান্য মুমিনদের মাঝে নিজেকে বিশেষ কিছু মনে করে না? নিজের আক্বিদা, মানহাজ, ‘ইলম কিংবা আমলের কারনে?
.
অহংকারের পেছনে একটা মূল কারন হল পারিপার্শ্বিকতার সাথে মিলিয়ে নিজেকে বিচার করা। সেই পুরনো সমস্যা। কোন মাপকাঠিকে আমাদের গ্রহন করা উচিৎ? কোন লেন্সের ভেতর দিয়ে আমাদের দুনিয়াকে দেখা উচিৎ? গ্রাম্য একটা অনুষ্ঠান – যেখানে সবার প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার দৌড় হাইস্কুল পর্যন্ত সেখানে যদি একজন পিএইচডি হোল্ডার বসে থাকেন তবে তার কি নিজেকে সবার মাঝে বিশেষ কিছু মনে করা অযৌক্তিক? কিংবা একটি মাসজিদ যেখানে ৯০% লোক সূরা ফাতিহা সঠিক তাজউয়িদসহ পড়তে পারেন না, সেখানে চোস্ত আরবি জানা ‘উস্তায’-এর নিজেকে আলাদা মনে করা? আমাদের পার্থিব বিচারে তো অযৌক্তিক বলা যায় না। এরকম অসংখ্যা উদাহরন দেওয়া সম্ভব। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেকে বিশেষ কিছু মনে করা, নিজেকে অন্যের চাইতে উত্তম মনে করা যৌক্তিক এবং সঠিক। মাপকাঠি যখন পার্থিব, তখন।
.
কিন্তু মাপকাঠিকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে একটু বদলে নিলেই ব্যাপারটা বদলে যায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নিয়ামত আপনি কীভাবে কাজে লাগাচ্ছেন এই প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা শুরু করলেই গ্রাম্য আড্ডাতে কেন, মেথরদের পাশে বসেও নিজেকে বিশেষ কিছু মনে হবার কথা না। জামাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জালের সামনে নিজেকে অন্যান্য মুসল্লিদের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ, আলাদা কেউ হিসেবে উপস্থাপন করার মতো ধৃষ্টতা কোন অন্তরের হবার কথা না। অহংকার তখনই আমাদের বিষাক্ত করে যখন আমরা সৃষ্টির সাপেক্ষে নিজের একটা অবস্থান হিসেব করতে চাই। আর এর চিকিৎসা হল রাব্বুল আলামিনের সামনে নিজের অবস্থান কী – সেটা নিয়ে চিন্তা করা। কারন মানুষের মধ্য কে উত্তম তার মাপকাঠি হল তাক্বওয়া – আর কিছু না।

সম্ভবত শায়খ আল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছিলেন – ‘আদম সন্তানের কীসের এতো গর্ব যখন সে দুইবার যৌনাঙ্গ থেকে নির্গত হয়েছে?’ আমরা কী নিয়ে অহংকার করি? আমরা নিজেদের কী মনে করি? আমাদের বিশেষত্বটা কী? যেই জীব দিনের মধ্যে দুইবার বাধ্য হয় শরীর থেকে বর্জ্য বের করে দিতে, তার কীসের এতো অহংকার, কীসের এতো গর্ব?
.
অহংকারের বশবর্তী হয়ে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না, আর পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা কর না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। চলাফেরায় সংযত ভাব অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নীচু কর। স্বরের মধ্যে নিশ্চয়ই গাধার স্বর সর্বাপেক্ষা শ্রুতিকটু।
.

collected from Know your Deen

 

https://www.youtube.com/watch?v=wUJm7zqoWns