সূরা বাকারাঃ ১০ম রুকু (৮৩–৮৬)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:৮৩ وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِیۡثَاقَ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ لَا تَعۡبُدُوۡنَ اِلَّا اللّٰهَ ۟ وَ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا وَّ ذِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ قُوۡلُوۡا لِلنَّاسِ حُسۡنًا وَّ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ ؕ ثُمَّ تَوَلَّیۡتُمۡ اِلَّا قَلِیۡلًا مِّنۡکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ﴿۸
৮৩. আর স্মরণ কর, যখন আমরা ইসরাঈল-সন্তানদের নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও দরিদ্রের সাথে সদয় ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করবে। আর সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দিবে, তারপর তোমাদের মধ্য হতে কিছুসংখ্যক লোক ছাড়া(৪) তোমরা সকলেই অবজ্ঞা করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে।
পূর্বে বলা হয়েছিলো, তোমরা ওয়াদা রক্ষা করো আমিও করবো।
এখানেও আবার স্মরন করিয়ে দেয়া হয়েছে সেই প্রতিশ্রুতি যা করা হয়েছিলো আল্লাহর সাথে।
এই আয়াতগুলোতে পুনরায় বানী-ইস্রাঈলদের নিকট হতে নেওয়া অঙ্গীকারের কথা আলোচনা হচ্ছে। তবে এ থেকেও তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এই অঙ্গীকারে প্রথমতঃ তাদেরকে আল্লাহর ইবাদতের তাকীদ করা হয়েছে যা প্রত্যেক নবীর মৌলিক ও প্রাথমিক দাওয়াত ছিল। (যেমন, সূরা আম্বিয়ার ২৫নং আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াতেও এ কথা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে।)
﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾
আমি তোমার পূর্বে যে রসূলই পাঠিয়েছি তার প্রতি এ অহী করেছি যে, আমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই কাজেই তোমরা আমারই বন্দেগী করো৷ আম্বিয়াঃ২৫
“তোমাদের إِلَٰه ‘ইলাহ’ একজন” — إِلَٰه ইলাহ শব্দটিকে সাধারণত উপাস্য বা উপাসনার যোগ্য প্রভু অনুবাদ করা হয়। কিন্তু ইলাহ অর্থ আসলে হচ্ছে: কোনো কিছু বা কাউকে এতটাই চাওয়া হয়, এতটাই ভালবাসা হয় যে, ভালবাসা তখন উপাসনার পর্যায়ে চলে যায়। হৃদয়ে তখন দিন, রাত শুধু ইলাহ-এর চিন্তা ঘোরে। ইলাহ হয়ে যায় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ আকাঙ্খা। বাকি সব কিছু ইলাহ’র কাছে তখন তুচ্ছ। মন তখন ইলাহকে পাওয়া, ইলাহকে তুষ্ট করার চিন্তায় বিভোর হয়ে যায়।
ইবলিস কিন্তু জানতো আল্লাহ تعالى একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। সে আল্লাহর تعالى সাথে কথা পর্যন্ত বলতে পারতো। আল্লাহর تعالى ক্ষমতা, সন্মান, অবস্থান নিয়ে তার কোনোই সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তারপরেও সে কাফির হয়ে গিয়েছিল। ইবলিসের কুফরি আল্লাহর تعالى অস্তিত্বকে অস্বীকার করা ছিল না, তার কুফরি ছিল আল্লাহর تعالى অবাধ্যতা। এই ব্যাপারটা খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুন: ইবলিসের কুফরি ছিল না যে, সে নাস্তিক ছিল বা সে আল্লাহকে تعالى বিশ্বাস করতো না, বা আল্লাহর تعالى বিরুদ্ধে ব্লগে, পত্রিকায় লেখালেখি করতো। তার কুফরি ছিল আল্লাহর تعالى অবাধ্যতা।
ইলাহের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে;
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
ইলাহ হলো ঐ সত্ত¡ যিনি স্বীয় গুণবাচক বিশেষণসমূহের কারণে ইবাদাতের উপযুক্ততা রাখেন। আর এ গুণগুলো মানুষকে বাধ্য করে তাকে মন-দিল উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতে ও তাঁর প্রতি বিনয়ী ও মস্তকাবনত হতে। কেননা ইলাহ তো তিনিই হবেন, প্রগাঢ় ভালবাসা ও অগাধ ভক্তি নিয়ে মানুষ যার উপাসনা করে। তাঁর প্রতি বিনয়ী ও নিচু হয়। আপন অক্ষমতা প্রকাশ করে। তাঁর শক্তি ও সামর্থ্যরে স্বীকারোক্তি দেয়। তিনি রাগান্বিত হওয়াকে ভয় করে ও তাঁর রহমতের আশা করে। তাঁর জিকিরে প্রশান্তি লাভ করে ও তাঁর ভালোবাসায় ¯স্বস্তি খুঁজে পায়। আর এহেন/এরূপ গুণ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সত্তা এক আল্লাহ ব্যাতিরেকে ভিন্ন কেউ নেই।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘ইলাহ হলেন ঐ সত্ত¡ মানবাত্মা যার উপাসনা করে তাকে ভালোবেসে। তাঁর প্রতি বিনয়ী ও মস্তকাবনত হয়ে তাঁকে ভয় করে ও তাঁর বড়ত্ব অনুধাবন করে। তাঁর প্রতি আশা ও ভরসা নিয়ে।’
আল-কুরআনে ইলাহ শব্দের ব্যবহার
পবিত্র কুরআনে ইলাহ শব্দ ব্যবহারের মূল কারণ ছিল অন্যসকল ইলাহ বাদ দিয়ে কেবল এক উপাস্যের অস্তিত্বকেই ফুটিয়ে তোলা। যে কয়টি পন্থায় মহান আল্লাহ তা ফুটিয়ে তোলেন তার কয়েকটি নিম্নে উদ্ধৃত হলো
(এক) কি উদ্দেশ্যে মিথ্যা উপাস্যদের উপাসনা করা হতো তা উল্লেখ করে তাদের ভ্রষ্টতা, ভ্রান্ততা ও ব্যর্থতা স্পষ্ট করা হয়েছে।
وَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اٰلِہَۃً لَّعَلَّہُمۡ یُنۡصَرُوۡنَ .لَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ نَصۡرَہُمۡ ۙ وَ ہُمۡ لَہُمۡ جُنۡدٌ مُّحۡضَرُوۡن
অথচ তারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য সব ইলাহ গ্রহণ করেছে, এই প্রত্যাশায় যে, তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। এরা তাদের কোন সাহায্য করতে সামর্থ হবে না, বরং এগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে বাহিনীরূপে হাযির করা হবে।(সূরা ইয়াসীন : ৭৪,৭৫)
(দুই) মহান আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহ থাকলে কি সমস্যা হতো তা স্পষ্ট করা হয়েছে।
لَوۡ کَانَ فِیۡہِمَاۤ اٰلِہَۃٌ اِلَّا اللّٰہُ لَفَسَدَتَا ۚ فَسُبۡحٰنَ اللّٰہِ رَبِّ الۡعَرۡشِ عَمَّا یَصِفُوۡنَ
যদি আসমান ও যমীনে আল্লাহ ছাড়া বহু ইলাহ থাকত তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত, সুতরাং তারা যা বলে, আরশের রব আল্লাহ তা থেকে পবিত্র। (সূরা আম্বিয়া : ২২)
مَا اتَّخَذَ اللّٰہُ مِنۡ وَّلَدٍ وَّ مَا کَانَ مَعَہٗ مِنۡ اِلٰہٍ اِذًا لَّذَہَبَ کُلُّ اِلٰہٍۭ بِمَا خَلَقَ وَ لَعَلَا بَعۡضُہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ ؕ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ عَمَّا یَصِفُوۡنَ
আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেননি, তাঁর সাথে অন্য কোন ইলাহও নেই। (যদি থাকত) তবে প্রত্যেক ইলাহ নিজের সৃষ্টিকে নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত; তারা যা বর্ণনা করে তা থেকে আল্লাহ কত পবিত্র! (সূরা মুমিনুন : ৯১)
(তিন) আল্লাহ ছাড়া ভিন্ন কাউকে ইলাহ মানলে আযাবের কথা উল্লেখ হয়েছে।
ذٰلِکَ مِمَّاۤ اَوۡحٰۤی اِلَیۡکَ رَبُّکَ مِنَ الۡحِکۡمَۃِ ؕ وَ لَا تَجۡعَلۡ مَعَ اللّٰہِ اِلٰـہًا اٰخَرَ فَتُلۡقٰی فِیۡ جَہَنَّمَ مَلُوۡمًا مَّدۡحُوۡرًا
এগুলো সেই হিকমতভুক্ত, যা তোমার রব তোমার নিকট ওহীরূপে পাঠিয়েছেন। আর তুমি আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য নির্ধারণ করো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও বিতাড়িত হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে । (সূরা বানী-ইসরাঈল : ৩৯)
لَا تَجۡعَلۡ مَعَ اللّٰہِ اِلٰـہًا اٰخَرَ فَتَقۡعُدَ مَذۡمُوۡمًا مَّخۡذُوۡلًا
আল্লাহর সাথে অপর কোন ইলাহ নির্ধারণ করো না। তাহলে তুমি নিন্দিত ও লাঞ্ছিত হয়ে যাবে। (সূরা বনী-ইসরাঈল : ২২)
(চার) ইলাহ হিসেবে কেবলমাত্র আল্লাহর অস্তিত্বকেই জোর তাকীদ দিয়ে বুঝানো হয়েছে
اِنَّ اِلٰـہَکُمۡ لَوَاحِدٌ
নিশ্চয় তোমাদের ইলাহ এক। (সূরা সাফফাত : ৪)
اِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ ۚ فَالَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ قُلُوۡبُہُمۡ مُّنۡکِرَۃٌ وَّ ہُمۡ مُّسۡتَکۡبِرُوۡنَ
তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। অতঃপর যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর অস্বীকারকারী এবং তারা অহংকারী। (সূরা নাহল : ২২)
(পাঁচ) অন্যসব ইলাহ(?) কে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে এক আল্লাহকেই কেবলমাত্র ইলাহ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। (পবিত্র কুরআনে ইলাহ শব্দটি এ পদ্ধতিতেই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।)
اَللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَۚ اَلۡحَیُّ الۡقَیُّوۡمُ
আল্লাহ! তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সব কিছুর ধারক। (সূরা বাকারা : ২৫৫)
اِنَّ ہٰذَا لَہُوَ الۡقَصَصُ الۡحَقُّ ۚ وَ مَا مِنۡ اِلٰہٍ اِلَّا اللّٰہُ ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ لَہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ
নিশ্চয় এটি সত্য বিবরণ। আর আল্লাহ ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই এবং নিশ্চয় আল্লাহ, তিনিই হলেন পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাপূর্ণ। (সূরা আলে ইমরান : ৬২)
হাদীস শরীফে ইলাহ শব্দের অর্থ
পবিত্র কুরআনের ন্যায় হাদীস শরীফেও ইলাহ শব্দটি মৌলিকভাবে দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
(এক) ইলাহ إله বা আলিহাতুন آلهة বলে প্রকৃত উপাস্য মহান আল্লাহ ছাড়া মিথ্যা-বানোয়াট ও ভ্রান্ত উপাস্য বুঝানো হয়েছে।
যেমন- হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে,
عن أبي سعيدنالخدري رضي الله عنه قال- … رسول الله صلى الله عليه وسلم … قال ينادي منادٍ ليذهب كلّ قومٍ الى ماكانوا يعبدون فيذهب أصحاب الصليب مع صليبهم وأصحاب الأوثان مع أوثانهم، وأصحاب كلّ آلهة مع آلهتهم حتى يبقى من كان يعبد الله.
(الصحيح البخارى ১১০৭/২ كتاب التوحيد- باب قول الله تعالى وجوه يومئذ ناضرة الى ربها ناظرة)
হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেদিন একজন ঘোষক ঘোষণা করবেন, যারা যে জিনিসের ইবাদাত করতে তারা সে জিনিসের কাছে গমন কর। এরপর যারা ক্রুশপুজারী ছিল তারা যাবে তাদের ক্রুশের কাছে। মূর্তিপুজারীরা যাবে তাদের মূর্তির সঙ্গে। সকলেই তাদের উপাস্যের সঙ্গে যাবে। বাকী থাকবে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদাতকারীরা। (বুখারী খ.২ পৃ.১১০৭ হা.৭১৩৯ তাওহীদ অধ্যায়)
(দুই) ইলাহ إله বলে সত্য ও প্রকৃত উপাস্য হিসেবে মহান সৃষ্টিকর্তা, পরম দয়ালু ও সর্বশক্তিমান আল্লাহকে বুঝানো হয়েছে।
হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে,
عن ابن عباس رضي الله عنه قال كان النبى صلى الله عليه وسلم يدعو من الليل … فاغفرلي ماقدمت وماأخرتُ وأسررتُ وأعلنتُ أنت الهى لااله لي غيرك- (الصحيح البخارى ১০৯৯/২ كتاب التوحيد- باب وهوالذى خلق السموات والأرض)
হযরত ইবনু আব্বাস রাযি. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত্রিকালে এ দুআ করতেন ……….. সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। ক্ষমা করে দিন আমার আগের ও পরের গুনাহসমূহ যা আমি গোপনে ও প্রকাশ্যে করেছি। এবং আপনিই আমার ইলাহ। আপনি ছাড়া আমার কোন ইলাহ নেই। (বুখারী খ.২ পৃ.১০৯৯ হা.৭০৮৮
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, (وَلَا إِلَهَ غَيْرُهُ) তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই।
ব্যাখ্যা: এটি হলো সেই কালিমাতুত তাওহীদ, যার দিকে সমস্ত নাবী-রসূলই আহবান করেছেন। যেমন ইতিপূর্বে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। নাকচ করা ও সাব্যস্ত করার মাধ্যমে এ কালেমার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ সাব্যস্ত করা হয়েছে।
নাকচ করা ও সাব্যস্ত করার মাধ্যমে ইবাদতকে কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করার অর্থ হলো কালেমায়ে তাওহীদের প্রথম অংশ দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বাতিল মাবুদের ইবাদতকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং এর দ্বিতীয় অংশ দ্বারা কেবল আল্লাহর জন্যই ইবাদতকে সীমাবদ্ধ ও নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
এক কথায় ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য নির্দিষ্ট ও সীমিত করে দেয়া হয়েছে। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের হকদার হওয়ার অযোগ্য। নাকচ করা ও সাব্যস্ত করার মাধ্যমে ইবাদতকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য হওয়ার সন্দেহ বিদূরিত না করে শুধু আল্লাহর জন্য ইবাদত সাব্যস্ত করা হলে সম্ভবত এ ধারণা থেকে যেত যে, অন্যান্য মাবুদের জন্যও ইবাদত করা যেতে পারে। তাই আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার ১৬৩ নং আয়াতে বলেছেন,
﴿وَإِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ﴾
তোমাদের ইলাহ হলেন এক, এ কথা বলার পরপরই বলেছেন,
(لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَٰنُ الرَّحِيمُ)
‘সে দয়াবান ও করুণাময় আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই (সূরা আল বাকারা:১৬৩)।
‘তোমাদের ইলাহ হলেন এক’ এ কথা বলাকেই যথেষ্ট মনে করা হলে, কারো অন্তরে এ শয়তানী ধারণা উদয় হওয়ার আশঙ্কা ছিল যে, আমাদের ইলাহ মাত্র এক ঠিকই। কিন্তু আমাদের ইলাহ ব্যতীত অন্যদেরও রয়েছে আরেক ইলাহ। এ সম্ভাব্য শয়তানী ধারণা দূর করার জন্যই আল্লাহর জন্য ইবাদত সাব্যস্ত করে চুপ থাকা হয়নি, বরং সাথে সাথেই বলা হয়েছে,
﴿لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَٰنُ الرَّحِيمُ ﴾
সেই দয়াবান ও করুণাবান আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই’’।
পিতা মাতার সাথে ইহসানের আচরনঃ
অতঃপর পিতা-মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর ইবাদতের পর দ্বিতীয় নম্বরে পিতা-মাতার আনুগত্য এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার তাকীদ করে এ কথা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে যে, যেমন আল্লাহর ইবাদত করা জরুরী, তেমনি পিতা-মাতার আনুগত্য করাও অত্যাবশ্যক এবং এ ব্যাপারে গড়িমসি করার কোন অবকাশ নেই। ক্বুরআনের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদতের পর দ্বিতীয় নম্বরে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার কথা বলে এর গুরুত্ব যে অনেক, সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল কি? তিনি বলেনঃ ওয়াক্তমত নামায পড়া। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বলেনঃ পিতা-মাতার সাথে সদাচার। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বলেনঃ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। রাবী বলেন, তিনি আমাকে এইসব বিষয়ে বললেন। আমি আরো জিজ্ঞেস করলে তিনি অবশ্যই আমাকে আরো বলতেন (বুখারী, মুসলিম, দারেমী, তিরমিযী, নাসাঈ)।
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, (কারো প্রতি তার) পিতা সন্তুষ্ট থাকলে প্রভুও তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন এবং তার পিতা অসন্তুষ্ট থাকলে প্রভুও অসন্তুষ্ট থাকেন।- (তিরমিযী, হাকিম, বাযযার, তাহাবী, আদ-দুররুল মানসুর)
তাহকীক আলবানীঃ মাওকুফ সুত্রে হাসান, মারফু’ সুত্রে সহীহ।
হাকীম ইবনে হিযাম (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সদ্ব্যবহার পেতে কে অগ্রগণ্য? তিনি বলেনঃ তোমার মা। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বলেনঃ তোমার মা। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বলেনঃ তোমার মা। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বলেনঃ তোমার পিতা, তারপর ক্রমান্বয়ে আত্মীয়ের সম্পর্কের নৈকট্যের ভিত্তিতে (দারিমী, তিরমিযী, হাকিম)। হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
আল্লাহ বলেছেন–
আর তোমাদের রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমাকের কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের সঙ্গে ‘উফ’ শব্দ ব্যবহার করবে না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো। আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং (দোয়া করে) বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করুন; যেভাবে তারা শৈশবে আমাদের লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৩-২৪)
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৩ বার তাগিদের সঙ্গে বলেছেন, ‘তার নাক ধুলামলিন হোক’। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো- হে আল্লাহর রাসুল! লোকটি কে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘যে ব্যক্তি তাঁর বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পেল অথবা তাদের যে কোনো একজনকে জীবিত পেল অথচ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না।’ (মুসলিম)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রহঃ) বলেন, পিতা-মাতাকে গলি শুনানো আল্লাহর নিকট একটি কবীরা গুনাহ (বুখারী, মুসলিম, দারিমী, তিরমিযী)।
আবু বাকরা (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পিতা-মাতার অবাধ্যতা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার অপরাধের শাস্তি অন্যান্য পাপের চেয়ে দ্রুত অপরাধীর উপর কার্যকর হয়। পরকালের শাস্তি তো আছেই (দারেমী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, হাকিম, ইবনে হিব্বান)।
তায়সালা (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি ইবনে উমার (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ পিতা-মাতাকে কাঁদানো এবং তাদের অবাধ্যাচরণ কবীরা গুনাহসমূহের অন্তর্ভুক্ত (৮ নং হাদীসের বরাত)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, মানুষের মৃত্যুর পর তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে বলে, হে প্ৰভু! এটা কি জিনিস? তাকে বলা হয়, তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে (ইবনে মাজাহ, মুওয়াত্তা মালিক)।
ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কোন ব্যক্তির সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার হলো, তার পিতার বন্ধু পরিবারের প্রতি তার সদ্ব্যবহার (মুসলিম, দারিমী, তিরমিযী)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) দুই ব্যক্তিকে দেখে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করেন, ইনি তোমার কি হন? সে বললো, তিনি আমার পিতা। তিনি বলেন, তাকে নাম ধরে ডেকো না, তার আগে আগে চলো না এবং তার আগে বসো না (বাযযার, ইবনুস সুন্নী)।
পিতা – মাতার হক ১৪ টি, ৭ টি জীবিত অবস্থায়, ৭ টি মৃত্যুর পর।
জীবিত অবস্থায় ৭ টিঃ
১. আজমত অর্থাৎ পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
২. মনে প্রাণে মুহাব্বত করা।
৩. সর্বদা তাঁদেরকে মেনে চলা।
৪. তাঁদের খেদমত করা।
৫. তাঁদের জরুরত (প্রয়োজন) পুরা করা।
৬. তাঁদেরকে সর্বদা আরাম পৌঁছানোর ফিকির (চিন্তা ভাবনা) করা।
৭. নিয়মিত তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ ও দেখাশুনা করা।
মৃত্যুর পর আরো ৭ টিঃ
১. তাঁদের মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করা।
২. নেক আমল করা
৩. তাঁদের সাথী-সঙ্গী ও আত্মীয়-স্বজনদের সম্মান করা।
৪. সাথী-সঙ্গী ও আত্মীয়-স্বজনের সাহায্য করা।
৫. ঋন পরিশোধ ও আমানত আদায় করা।
৬. শরী‘আতসম্মত ওসিয়ত পুরা করা।
৭. মাঝে মাঝে তাদের কবর যিয়ারত করা।
এরপর তিন ধরনের সম্পর্কের সাথে সুন্দর আচরন সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েহেন। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও দরিদ্রদের সাথে সদ্ব্যবহার করার ও সুন্দর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামেও এই বিষয়গুলোর অনেক গুরুত্ব রয়েছে। অনুরূপ রসূল (সাঃ)-এর বহু সংখ্যক হাদীসে এগুলোর গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে।ইরশাদ হয়েছে–
আর তোমরা সবাই আল্লাহর বন্দেগী করো৷ তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না৷ বাপ-মার সাথে ভালো ব্যবহার করো৷ নিকট আত্মীয় ও এতিম-মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো৷ আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্বসাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন বাদী ও গোলামদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো৷ নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ এমন কোন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না যে আত্মঅহংকারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে এবং নিজের বড়াই করে৷ নিসাঃ ৩৬
﴿فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ﴾
কাজেই এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না৷সূরা দুহাঃ৯
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মিসকীন সে নয়, যে এক খাবার বা দুই খাবারের জন্য ঘুরে বেড়ায় বরং মিসকীন হচ্ছে, যার সামর্থ নেই অথচ সে লজ্জায় কারও কাছে চায় না। অথবা মানুষকে আগলে ধরে কোন কিছু চায় না।” [বুখারী: ১৪৭৬, মুসলিম: ১০৩৯]
এই অঙ্গীকারে নামায পড়া ও যাকাত দেওয়ারও নির্দেশ রয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এই দুই ইবাদত পূর্বের শরীয়তেও বিদ্যমান ছিল এবং এই ইবাদতদ্বয়ের গুরুত্বও এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। ইসলামেও এই ইবাদত দু’টির অনেক গুরুত্ব রয়েছে। এমন কি এই ইবাদতদ্বয়ের কোন একটির অস্বীকার করলে বা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, তা কুফরী বিবেচিত হবে। যেমন আবূ বাকার সিদ্দীক্ব (রাঃ)-এর খেলাফত কালে যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার মাধ্যমে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায়।
আয়াতে এমন কথাকে বুঝানো হয়েছে, যা সৌন্দর্যমণ্ডিত। এর অর্থ এই যে, যখন মানুষের সাথে কথা বলবে, নম্রভাবে হাসিমুখে ও খোলামনে বলবে। তবে দ্বীনের ব্যাপারে শৈথিল্য অথবা কারো মনোরঞ্জনের জন্য সত্য গোপন করবে না। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা যখন মূসা ও হারূন আলাইহিমাস সালাম-কে নবুয়ত দান করে ফিরআউনের প্রতি পাঠিয়েছিলেন, তখন এ নির্দেশ দিয়েছিলেন, “তোমরা উভয়েই ফিরআউনকে নরম কথা বলবে।” [সূরা ত্বা-হাঃ ৪৪] আজ যারা অন্যের সাথে কথা বলে, তারা মূসা আলাইহিস সালাম-এর চাইতে উত্তম নয় এবং যার সাথে কথা বলে, সেও ফিরআউন অপেক্ষা বেশী মন্দ বা পাপিষ্ঠ নয়। সুতরাং সবার সাথে সুন্দরভাবে কথা বলা উচিত। হাদীসে এসেছে, “তোমরা সৎকাজের সামান্যতম কিছুকে খাটো করে দেখ না। যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাত করা।” [মুসলিম: ২৬২৬] তাছাড়া মানুষের সাথে সদালাপের অর্থ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে যে, তা হচ্ছে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
অল্প কয়েকজন অর্থ, তারাই যারা তাওরাতের পুরোপুরি অনুসরণ করত, তাওরাত রহিত হওয়ার পূর্বে তারা মূসা আলাইহিস সালাম প্রবর্তিত শরীআতের অনুসারী ছিল এবং তাওরাত রহিত হওয়ার পর ইসলামী শরীআতের অনুসারী হয়ে যায়। আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, একত্ববাদে ঈমান, এবং পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম বালক-বালিকা ও দীন-দরিদ্রের সেবাযত্ন করা, মানুষের সাথে নম্রভাবে কথাবার্তা বলা, সালাত আদায় করা ও যাকাত দেয়া ইসলামী শরীআতসহ পূর্ববর্তী শরীআতসমূহেও ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মানুষ সেগুলো ত্যাগ করে।
আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে না, আল্লাহ তার প্রতি অনুগ্রহ করেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০১৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) অপর হাদিসে বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা দয়ালুদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা জমিনে যারা বসবাস করছে তাদের প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৯৪১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘চোখ অশ্রু ঝরায়, হৃদয় শোকার্ত হয়, তবে আমরা শুধু তা-ই বলব যাতে আমাদের প্রতিপালক সন্তুষ্ট হয়। হে ইবরাহিম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা শোকাহত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩০৩)
হে ঈমানদারগণ ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ তোমাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার অথবা তোমাদের বাপ-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও৷ উভয় পক্ষ ধনী বা অভাবী যাই হোক না কেন আল্লাহ তাদের চাইতে অনেক বেশী কল্যাণকামী ৷ কাজেই নিজেদের কামনার বশবর্তী হয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেকো না৷ আর যদি তোমরা পেঁচালো কথা বলো অথবা সত্যতাকে পাশ কাটিয়ে চলো, তাহলে জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ তার খবর রাখেন৷ নিসাঃ১৩৫
২:৮৪ وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِیۡثَاقَکُمۡ لَا تَسۡفِکُوۡنَ دِمَآءَکُمۡ وَ لَا تُخۡرِجُوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ مِّنۡ دِیَارِکُمۡ ثُمَّ اَقۡرَرۡتُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَشۡهَدُوۡنَ
৮৪. আর স্মরণ কর, যখন তোমাদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম তোমরা একে অপরের রক্তপাত করবে না এবং একে অন্যকে স্বদেশ থেকে বহিস্কার করবে না, তারপর তোমরা তা স্বীকার করেছিলে। আর তোমরা তার সাক্ষ্য দিচ্ছ।
এখানে দিমা আকুম বলে নিজেদের রক্ত ঝড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলমান নিজেরা একে অন্যের অংশ, তাই এখানে এইভাবে বলা হয়েছে।
ঘটনা বিবরনঃ
নবী করীম (সাঃ)-এর যুগে মদীনায় আনসার (যারা ইসলামের পূর্বে মুশরিক ছিল তাদের আউস ও খাযরাজ নামে দু’টি গোত্র ছিল। ওদের আপোসে সর্বদা যুদ্ধ লেগেই থাকত।
মদীনাতে ইয়াহুদীদেরও বানু-ক্বায়নুক্বা, বানু-নাযীর এবং বানু-ক্বুরায়যা নামে তিনটি গোত্র ছিল। এরাও আপোসে সব সময় লড়ত।
বানু-ক্বুরায়যা আউসের মিত্র ছিল এবং বানু-ক্বায়নুক্বা ও বানু-নাযীর খাযরাজের মিত্র ছিল। যুদ্ধে এরা আপন আপন মিত্রদের সাহায্য করত এবং নিজেদেরই জাতভাই ইয়াহুদীদেরকে হত্যা করত, তাদের ঘর-বাড়ী লুণ্ঠন করত এবং তাদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করত। অথচ তাওরাত অনুযায়ী এ রকম করা তাদের জন্য হারাম ছিল। আবার ওই ইয়াহুদীরাই যখন পরাজিত হয়ে বন্দী হত, তখন তাদেরকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করত এবং বলত যে, তাওরাতে আমাদেরকে এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আয়াতগুলোতে ইয়াহুদীদের সেই আচরণের কথাই বর্ণনা করা হয়েছে। তারা তাদের শরীয়তের বিধানকে খেলার পুতুল বানিয়ে নিয়েছিল। কোন কোন জিনিসের উপর ঈমান আনত এবং কোন কোন জিনিসকে উপেক্ষা করত। কোন নির্দেশকে পালন করত, আবার কোন সময় শরীয়তের কোন গুরুত্বই দিত না। হত্যা, বহিষ্কার এবং একে অপরের বিরুদ্ধে সাহায্য করা তাদের শরীয়তেও হারাম ছিল। তা সত্ত্বেও এ কাজগুলো নির্দ্বিধায় তারা করত এবং মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি করার যে বিধান ছিল, তার উপরে আমল করত। অথচ প্রথম তিনটি নির্দেশ (হত্যা, বহিষ্কার এবং একে অপরের বিরুদ্ধে সাহায্য না করা) যদি তারা পালন করত, তাহলে মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করার প্রয়োজনই হত না।
মায়িদা ৩২—আল্লাহ জানিয়েছেন
এ কারণেই বনী ইসরাঈলের জন্য আমি এ ফরমান লিখে দিয়েছিলাম, নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোন কারণে যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করলো সে যেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করলো৷ আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করলো সে যেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষের জীবন রক্ষা করলো ৷ কিন্তু তাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, রসূলগণ একের পর এক সুস্পষ্ট হেদায়াত নিয়ে তাদের কাছে এলো, তারপরও তাদের বিপুল সংখ্যক লোক পৃথিবীতে সীমালংঘনকারীই থেকে গেলো৷
২:৮৫ ثُمَّ اَنۡتُمۡ هٰۤـؤُلَآءِ تَقۡتُلُوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ وَ تُخۡرِجُوۡنَ فَرِیۡقًا مِّنۡکُمۡ مِّنۡ دِیَارِهِمۡ ۫ تَظٰهَرُوۡنَ عَلَیۡهِمۡ بِالۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ ؕ وَ اِنۡ یَّاۡتُوۡکُمۡ اُسٰرٰی تُفٰدُوۡهُمۡ وَ هُوَ مُحَرَّمٌ عَلَیۡکُمۡ اِخۡرَاجُهُمۡ ؕ اَفَتُؤۡمِنُوۡنَ بِبَعۡضِ الۡکِتٰبِ وَ تَکۡفُرُوۡنَ بِبَعۡضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ مَنۡ یَّفۡعَلُ ذٰلِکَ مِنۡکُمۡ اِلَّا خِزۡیٌ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ یُرَدُّوۡنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الۡعَذَابِ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ
৮৫. তারপর তোমরাই তারা, যারা নিজদেরকে হত্যা করছ এবং তোমাদের একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিস্কার করছ। তোমরা একে অন্যের সহযোগিতা করছ তাদের উপর অন্যায় ও সীমালঙ্ঘন দ্বারা। আর তারা যখন বন্দীরূপে তোমাদের কাছে উপস্থিত হয় তখন তোমরা মুক্তিপণ দাও; অথচ তাদেরকে বহিষ্কার করাই তোমাদের উপর হারাম ছিল। তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আন এবং কিছু অংশে কুফরী কর? তাহলে তোমাদের যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ও অপমান এবং কেয়ামতের দিন তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে কঠিনতম শাস্তির দিকে। আর তারা যা করে আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।
বনী ইসরাইল জাতির লোকেরা কিছু অংশ মানা ও কিছু অংশ না মানার স্বভাব ছিলো।
আমরা মুসলমানরাই যেনো এই চরিত্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সুবিধা অংশ পালন আর পছন্দ না লাগা অংশ না মানার দিকেই অবস্থান। অথচ প্রয়োজন ছিলো পূর
ইসলামের কিছু অংশ গ্রহণ করে বাকি অংশ ত্যাগ করলে কখনোই মুসলিম হওয়া যাবেনা। কেননা আল্লাহু(সুবঃ) বলেনঃ
“হে মুমিনগণ !! তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণরুপে প্রবেশ করো এবং তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।”(সূরা বাকারা-২০৮)
এ আয়াত দ্বারা আল্লাহু(সুবঃ) পরিষ্কার করে দিলেন যে, ইসলাম গ্রহণ করতে হলে পরিপূর্ণভাবেই গ্রহণ করতে হবে কোন কিছু বাদ দেয়া যাবে না।
কিন্তু যারা সুবিধাবাদী প্রয়োজন মতো ইসলামের কিছু বিষয় মানে আর বাকি গুলো ত্যাগ করে তাদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে চরম হুশিয়ারী বার্তা উচ্চারিত হয়েছে।
এছাড়াও সূরা নিসার ১৪৩নং আয়াতে আল্লাহু(সুবঃ) আরো ইরশাদ করেনঃ
“তারা এই দ্বীনের ব্যাপারে দোদুল্যমান, না মুমিনদের দিকে আর না কাফেরদের দিকে। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট হতে দেন তুমি কখনো তার জন্য কোন পথ পাবে না।”
অপর আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেনঃ
যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের সাথে কুফরী করে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে আমরা কাউকে মানবো ও কাউকে মানবো না আর কুফর ও ঈমানের মাঝখানে একটি পথ বের করতে চায়, তারা সবাই আসলে কট্টর কাফের ৷ আর এহেন কাফেরদের জন্য আমি এমন শাস্তি তৈরী করে রেখেছি, যা তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবে৷”(সূরা নিসা-১৫১)
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের ইখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।
অতঃপর যদি তারা তোমার আহবানে সাড়া না দেয়, তাহ’লে জানবে যে, তারা তো শুধু নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহর পথনির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে, সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে পথ-নির্দেশ করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৫০)।
হুকুম বা বিধান একমাত্র আল্লাহরই”। [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৪০]
আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করে না, তারা কাফির। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৪
আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করে না, তারা যালিম।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৫]
আরও বলেন,
“আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করে না, তারা ফাসেক।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৪৭]
সুতারাং ইসলামে প্রবেশ করতে হলে পুরোপুরিভাবেই প্রবেশ করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে ইসলামকে মানবে আর জীবনের বিশাল অংশে মানব রচিত আইন মেনে চলবে তা হতে পারেন।
“ তাদেরকে যখন বলা হলো যে, তোমরা আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসরণ কর ; তখন তারা বলল যে, আমরা তো শুধু সেই পথই অনুসরণ করে চলবো, যে পথে আমাদের বাপ-দাদাকে চলতে দেখেছি। কিন্তু শয়তান যদি তাদেরকে জাহান্নামের দিকে ডাকে, তবুও কি ? যে ব্যক্তি নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিয়েছে এবং নেককার হয়েছে সে তো মযবুত রশি ধারণ করেছে। কারণ সকল কাজের শেষ আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অস্বীকার করবে-হে নবী, তার অস্বীকারের জন্য তোমার দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। তারা সকলেই আমার কাছে ফিরে আসবে । তখন আমি তাদের সকল কাজের পরিণাম ফল দেখিয়ে দেব।” (সূরা লোকমানঃ ২১-২৩)
“মানুষকে আল্লাহ তাঁর নিজের বান্দাহ করে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কারো বন্দেগী করার আদেশ মানুষকে দেয়া হয়নি। তাদের একমাত্র অবশ্য কর্তব্য ফরয এই যে, সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধু আল্লাহর জান্যই নিজেই দ্বীন-অথাৎ আনুগত্য ও গোলামীকে নিযুক্ত করবে, একমুখী হয়ে তাঁরই বন্দেগী করবে এবং শুধু তাঁরই হিসেব করার ক্ষমতাকে ভয় করবে।” – সূরা আল বাইয়্যেনাঃ ৫
আল্লাহ তাআলা বলেন: “আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি। তারা তাগূতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে।”[সূরা নিসা ০৪:৬০]
আল্লাহ তাআলা বলেন: “অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।”। [সূরা নিসা, ০৪:৬৫]
মানুষের গোমরাহ হবার তিনটি বড় বড় কারণ বর্তমানঃ
প্রথম – নফসের দাসত্ব।
দ্বিতীয় – বাপ-দাদা, পরিবার ও বংশের রসম-রেওয়াজের দাসত্ব।
তৃতীয় – সাধারণভাবে দুনিয়ার মানুষের দাসত্ব, ধনী, রাজা, শাসনকর্তা, ভন্ড নেতা এবং দুনিয়ার পথভ্রষ্ট জাতিগুলোর দাসত্ব এর মধ্যে গণ্য।
প্রায়ই শোনা যায় যে ‘সব জায়গায় ইসলাম টেনে আনেন কেন?’
কয়েক ধরনের মানুষ এ ধরনের প্রশ্ন তোলে।
এক. অমুসলিম (ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মে বিশ্বাসী)।
দুই. নাস্তিক।
তিন. বংশগতভাবে মুসলিম (ধর্ম-কর্মের ধার ধারে না)। চার. ছদ্মবেশী মুসলিম (সুবিধা বুঝে ইসলাম পালন, নয়তো গোপনে বিরোধিতা)। পাঁচ. ইসলামবিদ্বেষী।
কোনো তর্কে জড়ানোর আগে নিজের পরিচয় এবং অনুসরণীয় মূলনীতি নির্ণয় করা জরুরি। আপনি কে এবং আপনি কী চান—এটি শুরুতে নির্ধারণ করা গেলে যুক্তির আলোকে কথা বলা সহজ।
সব জায়গায় ইসলাম টেনে আনেন কেন—এ প্রশ্নের সহজ-সরল জবাব হলো, প্রথমে ‘সব জায়গা’ কথাটির পরিধি নির্ধারণ করতে হবে। আপনি কি ‘সব জায়গা’র ভেতরে আছেন? যদি না থাকেন, তাহলে এ প্রশ্ন করার অধিকার আপনার নেই।
আর হ্যাঁ, একজন মুসলমান, যিনি আমৃত্যু আল্লাহর আনুগত্য পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ, তার ‘সব জায়গা’য় ইসলাম থাকবে—এটিই স্বাভাবিক। ইসলামের বিধান কোনো অমুসলিমের জন্য নয়। ইসলামের বিধান কোনো নাস্তিকের জন্য নয়। ইসলামের বিধান কোনো নামধারী মুসলিমের জন্য নয়। ইসলামের বিধান কোনো ছদ্মবেশী কিংবা ইসলামবিদ্বেষীর জন্য নয়। যে ইসলাম মানে না, তার জন্য ইসলাম নয়
ইসলামের বিধান শুধু ওই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নিয়েছে। মুহাম্মদ (সা.)-কে নবী ও রাসুল হিসেবে মেনে নিয়েছে। আমৃত্যু আল্লাহর ইবাদত করার অঙ্গীকার করেছে। শয়নে-স্বপনে, গোপনে-প্রকাশ্যে, আলোকে-আঁধারে, ছোট থেকে বৃহত্—সব কাজে যে আল্লাহকে স্মরণ করে, ইসলাম তার জন্য। যে নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়েছে, ইসলাম তার জন্য। যে দুনিয়ার জীবন থেকে পরকালের জীবনকে প্রাধান্য দেয়, ইসলাম তার জন্য।
ইসলাম ওই ব্যক্তির জন্য, যে দ্ব্যর্থহীনভাবে এই ঘোষণা দেয়, ‘বলে দাও, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ বিশ্বজাহানের রব আল্লাহর জন্য। ’ (সুরা: আনআম, আয়াত: ১৬২)
তাই প্রত্যেক মুসলমানের করণীয় হলো, যে কাজই সে করুক না কেন, তা কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা। সুতরাং ‘সব জায়গায় ইসলাম টেনে আনেন কেন—এ প্রশ্ন সঠিক নয়।
আসলে ইসলামকে ‘টেনে আনার’ কিছু নেই, বরং ইসলাম সব ক্ষেত্রে স্বমহিমায় উপস্থিত। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। সব কিছুতে ইসলাম—এ কথার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ইসলামে ‘সব কিছু’ আছে। কোরআন বলছে, ‘…আমি মুসলমানদের জন্য সব বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী, পথনির্দেশক, অনুগ্রহ ও সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৮৯)
ইসলাম আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ অনুগত হওয়া, আনুগত্য করা, আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর কাছে সর্বতোভাবে আত্মসমর্পণকারীকে মুসলিম বা মুসলমান বলা হয়। ইসলামের বাণী সবার জন্য অবারিত হলেও ইসলামের বিধান মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য। একজন মুসলমানকে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জীবনের সব ক্ষেত্রে ইসলাম মোতাবেক জীবন যাপন করতে হয়।
কেননা মুসলমান মাত্রই এ কথা বিশ্বাস করে, ‘নিঃসন্দেহে (মানুষের) আল্লাহর কাছে একমাত্র (গ্রহণযোগ্য) দ্বিন (জীবনব্যবস্থা) ইসলাম। ’ (সুরা: আলে ইমরান, আয়াত: ১৯)
ইসলাম একমাত্র ও সর্বোত্তম জীবনব্যবস্থা। একজন মুসলমান ঘুম থেকে উঠা নিয়ে আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক—সব কিছুর ওপর ইসলামের বিধান আরোপিত। ইসলামের আংশিক ধারণ করে, বিশেষ ক্ষেত্রে ইসলাম বর্জন করার সুযোগ ইসলামে নেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। ’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২০৮)
মুসলমান হতে হলে এ কথায় বিশ্বাসী হতে হয় আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা, মালিক, প্রতিপালক ও একচ্ছত্র কর্তৃত্বের অধিকারী। সুতরাং তাঁর বান্দাদের জীবনযাত্রার নিয়ম-কানুন নির্ধারণের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাও তাঁর। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তুমি কি জানো না, আসমান ও জমিনের সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহরই?’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১০৭)
কোনো মুসলমানের জন্য ইসলামকে কাটছাঁট করা কিংবা সহজায়ন করা সম্ভব নয়। কোরআন বলছে, ‘…তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখো আর কিছু অংশ অস্বীকার করো? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিফল হতে পারে? আর কিয়ামতের দিন তাদের কঠিন আজাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা করো, সে সম্পর্কে আল্লাহ উদাসীন নন। ’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ৮৫)
“আমি হক ও বাতিলের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী আয়তসমূহ নাযিল করে দিয়েছি। আল্লাহ যাকে চান এ আয়াতের সাহায্যে তাকে সোজা পথ দেখিয়ে দেন। লোকেরা বলে আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং আমরা (তাঁদের) আনুগত্য স্বীকার করছি ; কিন্তু পরে তাদের মধ্য হতে কিছু সংখ্যক লোক আনুগত্য করা ছেড়ে দেয়। এ শ্রেণীর লোকেরা ঈমানদার নয়। তাদের কাজ-কারবারের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার আইন অনুসারে ফায়সালা করার জন্য যখন তাদেরকে ডাকা হয় তখন কিছু লোক অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। কিন্তু আল্লাহর আইনের ফায়সালা যদি তাদের মনের মত হয় তবে অবশ্য তা স্বীকার করে নেয়। তাদের মনের মধ্যে কি রোগ আছে ? না তারা শুধু অকারণ সন্দেহের মধ্যে ডুবে রয়েছে ? অথবা তাদের এ ভয় আছে যে, আল্লাহ এবং তার রাসূল তাদেও ‘হক’ নষ্ট করবেন ? কারণ যাই হোক, তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর যুলুম করেছে। প্রত্যেক ঈমাদার লোকের নিয়ম এই যে, আল্লাহর আইন অনুসারে বিচার করার জন্য যখন তাদেরকে ডাকা হয় তখন তারা ‘আমরা শুনেছি এবং তা অনুসরণ করি’ বলে মাথা নত করে দেয়। বাস্তবিক পক্ষে এ শ্রেণীর লোকেরাই মুক্তি ও উন্নতি লাভ করতে পারে। আর যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের হুকুম পালন করবে, আল্লাহকে ভয় করবে এবং তাঁর নাফরমানী হতে ফিরে থাকবে কেবল তারাই সফলকাম হবে এবং মুক্তি পাবে ।”– সুরা আন নূরঃ ৪৬-৫২
২:৮৬ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ اشۡتَرَوُا الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا بِالۡاٰخِرَۃِ ۫ فَلَا یُخَفَّفُ عَنۡهُمُ الۡعَذَابُ وَ لَا هُمۡ یُنۡصَرُوۡنَ ﴿
৮৬. তারাই সে লোক, যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন ক্রয় করে; কাজেই তাদের শাস্তি কিছুমাত্র কমানো হবে না এবং তাদেরকে সাহায্যও করা হবে না।
এই আয়াতে আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ করা, হত্যা করা এবং অন্যদেরকে ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বনী ইসরাইলীরা শুধু দুনিয়ার জীবনের পিছনেই ছুটছে এবং শুধু নিজেদের স্বার্থ রক্ষাকারী বিধানগুলোই পালন করছে। কিন্তু আখেরাতের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ের প্রতি তারা উদাসীন। এত দুনিয়া পূজা ও পাপ করা সত্ত্বেও ইহুদীরা পরকালে শাস্তি পাবে না বলে দাবি করতো। কিন্তু এই আয়াতে বলা হয়েছে যে,তাদের এই দূরাশার বিপরীতে অন্যান্য পাপীদের মত তারাও তাদের পাপের জন্য শাস্তি ভোগ করবে এবং কেউই তাদের সাহায্য করবে না।
খানে শরীয়তের কোন বিধানকে মেনে নেওয়া এবং কোন বিধানকে পরিত্যাগ করার শাস্তির কথা বর্ণিত হচ্ছে। আর শাস্তি হল, দুনিয়াতে (পূর্ণ শরীয়তের উপর আমল করলে প্রতিদানে যা পাওয়া যায় সেই) সম্মান ও মর্যাদা লাভের পরিবর্তে লাভ হবে লাঞ্ছনা ও অপমান এবং আখেরাতে চিরন্তন নিয়ামত ও সুখের পরিবর্তে লাভ হবে কঠিন শাস্তি। এ থেকে এ কথাও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহর নিকট পূর্ণ আনুগত্যই কেবল গৃহীত হয়। আংশিকভাবে কোন কোন বিধানকে মেনে নেওয়া বা তার উপর আমল করার কোনই মূল্য আল্লাহর নিকট নেই। এই আয়াত মুসলিমদেরকেও চিন্তা-ভাবনা করার প্রতি আহবান জানাচ্ছে যে, মুসলিমরা যে লাঞ্ছনা ও অধঃপতনের শিকার, তার কারণও মুসলিমদের এমন কার্যকলাপ নয় তো, যা ইয়াহুদীদের ব্যাপারে বহু আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে?
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, চারটি জিনিস (মানুষের) দুর্ভাগ্যের অন্তর্গত-
১. আল্লাহর ভয়ে চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত না হওয়া
২. অন্তর শক্ত হয়ে যাওয়া
৩. (অতিরিক্ত) আশা বৃদ্ধি পাওয়া
৪. (দুনিয়ার সম্পদের) লোভী হয়ে যাওয়া। (মুসনাদে বাযযার)
জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি কানকাটা মৃত বকরীর বাচ্চার নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে একে এক দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করতে পছন্দ করবে’? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা তো একে কোন কিছুর বিনিময়েই ক্রয় করতে পছন্দ করব না। তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! এটা তোমাদের কাছে যতটুকু নিকৃষ্ট, আল্লাহর কাছে দুনিয়া এর চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট’। -মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৫৭
‘আপনি নিজেকে তাদের সৎসঙ্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, সে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না’। (কাহফ ১৮/২৮)
তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন