بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
সূরা লাহাব
সূরা নংঃ ১১১, আয়াত সংখ্যাঃ ৫, মক্কী সূরা
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর আয়াত নাযিল হ’ল,
وَأَنْذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ ‘আর তুমি তোমার নিকটতম আত্মীয়-পরিজনকে সতর্ক কর’ (শো‘আরা ২৬/২১৪), তখন আল্লাহর রাসূল (সা) সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী একদিন সকালে সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সকলের উদ্দেশ্যে বিপদসংকেতমূলক ভাষায় ডাক দিয়ে বলেন, يا صَباحاه (প্রত্যুষে সকলে সমবেত হও!)। এভাবে রাসূল (সা) বিভিন্ন গোত্রের নাম ধরে ধরে ডাকতে থাকলেন। অতঃপর সবাই হাযির হলে তিনি বলেন, أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ الْعَدُوَّ يُصَبِّحُكُمْ أَوْ يُمَسِّيكُمْ أَمَا كُنْتُمْ تُصَدِّقُونِى؟ قَالُوا بَلَى- আমি যদি বলি এই পাহাড়ের অপর পার্শ্বে একদল শত্রুসেনা তোমাদের উপরে সকালে বা সন্ধ্যায় হামলার জন্য অপেক্ষা করছে, তাহলে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না?
সকলে সমস্বরে বলে উঠলো, অবশ্যই করব। কেননা, مَا جَرَّبْنَا عَلَيْكَ إِلاَّ صِدْقًا ‘আমরা এযাবত তোমার কাছ থেকে সত্য ব্যতীত কিছুই পাইনি’। তখন রাসূল (সা) বললেন, فَإِنِّىْ نَذِيْرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَىْ عَذَابٍ شَدِيْدٍ ‘আমি ক্বিয়ামতের কঠিন আযাবের প্রাক্কালে তোমাদের নিকটে সতর্ককারী রূপে আগমন করেছি’। অতঃপর তিনি আবেগময় কণ্ঠে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا بَنِىْ كَعْبِ بْنِ لُؤَىٍّ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا بَنِىْ عَبْدِ مَنَافٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا بَنِىْ هَاشِمٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا بَنِىْ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا عَبَّاسُ بْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ لاَ أُغْنِى عَنْكَ مِنَ اللهِ شَيْئًا، يَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ أَنْقِذِىْ نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ، فَإِنِّىْ لاَ أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئاً غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِماً سَأَبُلُّهَا بِبَلاَلِهَا –
‘হে কুরায়েশগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও!
হে বনু কা‘ব বিন লুআই! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও!
হে বনু আবদে মানাফ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুনথেকে বাঁচাও!
হে বনু হাশেম! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও!
হে বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও!
হে আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব! আমি আল্লাহর আযাব থেকে তোমার কোনই কাজে আসব না।
হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! কেননা আমি তোমাদের কাউকে আল্লাহর পাকড়াও হ’তে রক্ষা করতে পারব না’। তবে তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তার যে সম্পর্ক রয়েছে, তা আমি (দুনিয়াতে) সদ্ব্যবহার দ্বারা সিক্ত করব’।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, يَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَلِيْنِىْ مَا شِئْتِ مِنْ مَالِىْ وَلاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا ‘হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি আমার মাল-সম্পদ থেকে যা খুশী নাও। কিন্তু আল্লাহর পাকড়াও হ’তে আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারব না। বুখারী হা/২৭৫৩;
অন্য বর্ণনায় এসেছে, إلا ان تقولوا لآ اله الا الله ‘তবে যদি তোমরা বল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই)।বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ১/৬৪।
রাসূল (সা)-এর এই মর্মস্পর্শী আবেদন গর্বোদ্ধত চাচা আবু লাহাবের অন্তরে দাগ কাটেনি। তিনি চিৎকার দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর মুখের উপর বলে দিলেন تَبًّا لَكَ سَائِرَ الْيَوْمِ ، أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا؟ ‘সকল দিনে তোমার উপর ধ্বংস আপতিত হৌক! এজন্য তুমি আমাদের জমা করেছ’? বলেই তিনি উঠে যান। অতঃপর অত্র সূরাটি নাযিল হয়। বুখারী হা/৪৭৭০, ৪৯৭১; মুসলিম হা/২০৮; তিরমিযী হা/৩৩৬৩; কুরতুবী হা/৬৫১২; মিশকাত আলবানী হা/৫৩৭২।
কথিত আছে যে, এই সময় আবু লাহাব রাসূল (ছাঃ)-কে পাথর মারতে উদ্যত হন। কিন্তু আল্লাহ তাকে প্রতিরোধ করেন’ (কুরতুবী; আর-রাহীক্ব ৮৬ পৃ:)।
আবু লাহাব কথাটি তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন। কেননা আখেরাতে জবাবদিহিতার কথা তাদের আগেই জানা ছিল। কিন্তু এটি তাদের কাছে অতীব তুচ্ছ বিষয় ছিল। দুনিয়া তাদেরকে গ্রাস করেছিল ও আখেরাত থেকে বেপরওয়া করেছিল।
উল্লেখ্য যে, রাসূল (সা)-এর আপন চাচাদের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ ছিলেন।
১. যারা তাঁর উপরে ঈমান এনেছিলেন ও তাঁর সাথে জিহাদ করেছিলেন। যেমন হামযাহ ও আববাস (রাঃ)।
২. যারা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করেন। যেমন আবু তালিব।
৩. যারা শুরু থেকে মৃত্যু অবধি শত্রুতা করেন। যেমন আবু লাহাব।
ইবনে যায়েদ বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে : আবু লাহাব একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো , যদি আমি তোমার দীন গ্রহণ করি তাহলে এর বদলে আমি কি পাবো ? তিনি জবাব দিলেন , অন্যান্য ঈমানদাররা যা পাবে আপনিও তাই পাবেন। আবু লাহাব বললো : আমার জন্য কিছু বাড়তি মর্যাদা নেই ? জবাব দিলেন : আপনি আর কি চান ? একথায় সে বললো “সর্বনাশ হোক এ দীনের যেখানে আমি ও অন্যান্য লোকেরা একই পর্যায়ভুক্ত হবে । ” ( ইবনে জারীর )
আবু লাহাবের আসল নাম ছিল ‘আব্দুল উয্যা’ তার রূপ-সৌন্দর্য ও মুখমন্ডলের লাল আভার ঔজ্জ্বল্যের কারণে তাকে আবু লাহাব (শিখাময়) বলা হত। এ ছাড়া পরিণামের দিক দিয়ে সে আগুনের ইন্ধন তো বটেই। এ ব্যক্তি নবী (সাঃ)-এর আপন চাচা ছিল। কিন্তু শত্রুতায় সে ছিল তাঁর প্রতি অতি কঠোর। আর তার স্ত্রী উম্মে জামীল বিনতে হার্বও তাঁর প্রতি দুশমনীতে নিজ স্বামীর চেয়ে কম ছিল না।
মক্কায় আবু লাহাব ছিল রসূলুল্লাহর (সা) নিকটতম প্রতিবেশী । উভয়ের ঘরের মাঝখানে ছিল একটি প্রাচীর । এ ছাড়াও হাকাম ইবনে আস ( মারওয়ানের বাপ ) , উকবা উবনে আবু মুঈত , আদী ইবনে হামরা ও ইবনুল আসদায়েল হুযালীও তাঁর প্রতিবেশী ছিল। এরা বাড়িতেও রসূলুল্লাহকে নিশ্চিন্তে থাকতে দিত না। তিনি যখন নামায পড়তেন , এরা তখন ওপর থেকে ছাগলের নাড়িভূড়ি তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করতো। কখনো তাঁর বাড়ির আঙিনায় রান্নাবান্না হতো এরা হাড়ির মধ্যে ময়লা ছুঁড়ে দিতো। রসূলুল্লাহ (সা) বাইরে এসে তাদেরকে বলতেন , “ হে বনী আবদে মান্নাফ ! এ কেমন প্রতিবেশীসূলভ আচরণ ? ” আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল ( আবু সুফিয়ানের বোন ) প্রতি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের দরজার সামনে কাঁটাগাছের ডাল পালা ছড়িয়ে রেখে দিতো। এটা ছিল তার প্রতিদিনের স্থায়ী আচরণ । যাতে রসূলুল্লাহ (সা) বা তাঁর শিশু সন্তানরা বাইরে বের হলে তাদের পায়ে কাঁটা বিঁধে যায়। ( বায়হাকী ,. ইবন আবী হাতেম, ইবনে জারীর , ইবনে আসাকির ও ইবনে হিশাম)।
সে যে কেমন জঘন্য মানসিকতার অধিকারী ছিল তার পরিচয় একটি ঘটনা থেকেই পাওয়া যায়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছেলে হযরত আবুল কাসেমের ইন্তিকালের পর তাঁর দ্বিতীয় ছেলে হযরত আবদুল্লাহরও ইন্তিকাল হয়। এ অবস্থায় আবু লাহাব তার ভাতিজার শোকে শরীক না হয়ে বরং আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌঁড়ে কুরাইশ সরদারদের কাছে পৌঁছে যায়। সে তাদেরকে জানায় : শোনো , আজ মুহাম্মাদের ( রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) নাম নিশানা মুছে গেছে। তার এ ধরনের আচরণের কথা আমরা ইতপূর্বে সূরা কাউসারের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করে এসেছি।
তারেক ইবনে আবদুল্লাহ আল মাহারেবীর (রা) রেওয়ায়াতও প্রায় এ একই ধরনের। তিনি বর্ণনা করেছেন : যুল মাজাযের বাজারে দেখলাম , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের বলে যাচ্ছেন , “ হে লোকেরা ! তোমরা লা – ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো , তাহলে সফলকাম হয়ে যাবে । ” ওদিকে তাঁর পিছে পিছে একজন লোক তাঁকে পাথর মেরে চলছে। এভাবে তাঁর পায়ের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই সাথে সাথে ঐ ব্যক্তি বলে চলেছে , “ এ মিথ্যুক , এর কথা শুনো না। ” আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম , এ লোকটি কে ? লোকেরা বললো : ওঁরই চাচা আবু লাহাব। ( তিরমিযী )
নবুওয়াতের সপ্তম বছরে কুরাইশদের সমস্ত পরিবার মিলে যখন বনি হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট করলো এবং এ পরিবার দু’টি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমর্থনে অবিচল থেকে আবু তালেব গিরিপথে অন্তরীণ হয়ে গেলো তখন একমাত্র আবু লাহাবই নিজের পরিবার ও বংশের সহগামী না হয়ে কুরাইশ কাফেরদের সহযোগী হলো। এ বয়কট তিন বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময় বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে অনেক সময় অনাহারে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আবু লাহাবের ভূমিকা ছিল মারমুখী। বাইর থেকে মক্কায় কোন বাণিজ্য কাফেলা এলে আবু তালেব গিরিপথে অন্তরীণদের মধ্য থেকে কেউ তাদের কাছ থেকে খাদ্যদ্রব্য কিনতে যেতো। আবু লাহাব তখন চিৎকার করে বনিকদেরকে বলতো : ওদের কাছে এতো বেশী দাম চাও যাতে ওরা কিনতে না পারে । এ জন্য তোমাদের যত টাকা ক্ষতি হয় তা আমি দেবো। কাজেই তারা বিরাট দাম হাঁকতো । ক্রেতা মহাসংকটে পড়তো। শেষে নিজের অনাহারের কষ্ট বুকে পুষে রেখে খালি হাতে পাহাড়ে ফিরে যেতে হতো ক্ষুধা কাতর সন্তানদের কাছে । তারপর আবু লাহাব সেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সেই পণ্যগুলোই বাজার দরে কিনে নেতো। ( ইবনে সা’দ ও ইবনে হিশাম )
কেনো আবু লাহাবের কথাই একটি সূরা নাযিল হয়েছে যদিও আরো অনেক শত্রু ছিলো?
জাহেলী যুগেও আরবের লোকেরা বংশীয় আত্মীয় সম্পর্কের রক্ষনাবেক্ষনের নৈতিক আদর্শকে অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখতো।
কোন ব্যক্তির জন্য তার নিজের বংশ ও রক্তসম্পর্কের আত্মীয় – পরিজনের সহায়তা ছাড়া নিজের ধন প্রাণ ও ইজ্জত – আবরুর হেফাজত করা কোনক্রমেই সম্ভবপর ছিল না। এ জন্য আরবীয় সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে আত্মীয় – স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বের অধিকারী। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাকে মহাপাপ মনে করা হতো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে এলেন তখন আরবের ঐ প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রভাবে কুরাইশ গোত্রের অন্যান্য পরিবার ও তাদের সরদাররা তাঁর কঠোর বিরোধিতা করলেও বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিব ( হাশেমের ভাই মুত্তালিবের সন্তানরা ) কেবল তাঁর বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেনি বরং প্রকাশ্যে তাঁকে সমর্থন দিয়ে এসেছে । অথচ তাদের অধিকাংশই তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেনি।
অথচ শুধু মাত্র একজন লোক ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতায় অন্ধ হয়ে এ আদর্শ ও মূলনীতি লংঘন করে। সে ছিল আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব । রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা। রসূলের ( সা) পিতা এবং এ আবু লাহাব ছিল এই পিতার সন্তান ।
এ সূরাটি নাযিল হবার পর যখন আবু লাহাব রাগে অন্ধ হয়ে আবোলতাবোল বকতে লাগলো তখন লোকেরা বুঝতে পারলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতার ব্যাপারে তার কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে নিজের ভাতিজার শত্রুতায় অন্ধ হয়ে গেছে।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ
১) ভেঙে গেছে আবু লাহাবের হাত এবং ব্যর্থ হয়েছে সে ৷
আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল উযযা ৷ তাকে আবু লাহাব বলে ডাকার কারণ , তার গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল সাদা লালে মেশানো৷ লাহাব বলা হয় আগুনের শিখাকে৷ কাজেই আবু লাহাবের মানে হচ্ছে আগুন বরণ মুখ৷ এখানে তার আসল নামের পরিবর্তে ডাক নামে উল্লেখ করার কয়েকটি কারণ রয়েছে৷
এর একটি কারণ হচ্ছে এই যে , মূল নামের পরিবর্তে ডাকনামেই সে বেশী পরিচিত ছিল৷
দ্বিতীয় কারণ , তার আবদুল উযযা ( অর্থাৎ উযযার দাস ) নামটি ছিল একটি মুশরিকী নাম৷ কুরআনে তাকে এ নামে উল্লেখ করা পছন্দ করা হয়নি৷
তৃতীয় কারণ , এ সূরায় তার যে পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে তার এ ডাকনামই বেশী সম্পর্কিত ৷
يَدَا শব্দটি يَدٌ এর দ্বিবচন। অর্থ হল দুই হাত। এ থেকে উদ্দেশ্য হল তার সত্তা বা দেহ। এই আংশিক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করে সমষ্টিগত অর্থ নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সে নিজে ধ্বংস হয়ে যাক। এই বদ্দুআটি সেই বদ্দুআর জওয়াবে বলা হয়েছে, যা আবু লাহাব মহানবী (সাঃ)-এর প্রতি রাগ ও শত্রুতাবশে করেছিল।
تَبَّ শব্দের অর্থ হল ধ্বংস ও বরবাদ হয়েছে। অর্থাৎ, সে ধ্বংস হয়েছে। (অতীত কালকে দুআর অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।) অথবা এটা হল খবর।
আল্লাহ বলেন, وَمَا كَيْدُ فِرْعَوْنَ إِلاَّ فِي تَبَابٍ ‘আর ফেরাঊনের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল পুরোপুরি’ (গাফের/মুমিন ৪০/৩৭)।
এটা একটা ভবিষ্যদ্বাণী৷ এখানে ভবিষ্যতে যে ঘটনাটি ঘটবে তাকে অতীতে কালের অর্থ প্রকাশক শব্দের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে৷ এর মানে , তার হওয়াটা যেন এত বেশী নিশ্চিত যেমন তা হয়ে গেছে ৷ আর আসলে শেষ পর্যন্ত তাই হলো যা এ সূরায় কয়েক বছর আগে বর্ণনা করা হয়েছিল৷ হাত ভেঙে যাওয়ার মানে শরীরের একটি অংগ যে হাত সেটি ভেঙে যাওয়া নয়৷ বরং কোন ব্যক্তি যে উদ্দেশ্য সম্পন্ন করার জন্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তাতে পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে যাওয়াই এখানে বুঝানো হয়েছে ৷
সূরাটি নাযিল হবার মাত্র সাত আট বছর পরেই বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়৷ এ যুদ্ধে কুরাইশদের অধিকাংশ বড় বড় সরদার নিহত হয়৷ তারা সবাই ইসলাম বিরোধিতা ও ইসলামের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে আবু লাহাবের সহযোগী ছিল৷ এ পরাজয়ের খবর মক্কায় পৌঁছার পর সে এত বেশী মর্মাহত হয় যে , এরপর সে সাত দিনের বেশী জীবিত থাকতে পারেনি৷
তার মৃত্যুর ছিল বড়ই ভয়াবহ ও শিক্ষাপ্রদ৷ তার শরীরে সাংঘাতিক ধরনের ফুসকুড়ি (Malignant pustule) দেখা দেয়৷ রোগ সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়৷ মরার পরও তিন দিন পর্যন্ত তার ধারে কাছে কেউ ঘেঁসেনি৷ ফলে তার লাশে পচন ধরে৷ চারদিকে র্দুগন্ধ ছড়াতে থাকে ৷ শেষে লোকেরা তার ছেলেদেরকে ধিক্কার দিতে থাকে৷ একটি বর্ণনা অনুসারে তখন তারা মজুরীর বিনিময়ে তার লাশ দাফন করার জন্য কয়েকজন হাবশীকে নিয়োগ করে এবং তারা তার লাশ দাফন করে৷ অন্য এক বর্ণনা অনুসারে , তারা গর্ত খুঁড়ে লম্বা লাঠি দিয়ে তার লাশ তার মধ্যে ফেলে দেয় এবং ওপর থেকে তার ওপর মাটি চাপা দেয়৷ যে দীনের অগ্রগতির পথ রোধ করার জন্য সে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল তার সন্তানদের সেই দীন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তার আরো বেশী ও পূর্ণ পরাজয় সম্পন্ন হয়৷ সর্বপ্রথম তার মেয়ে দাররা হিজরাত করে মক্কা থেকে মদীনায় চলে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন৷ আর মক্কা বিজয়ের পর তার দুই ছেলে উতবা ও মু’আত্তাব হযরত আব্বাসের (রা) মধ্যস্থাতায় রসূলুল্লাহর (সা) সামনে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁর হাতে বাইআত করেন৷
মুররাহ আল-হামদানী বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল প্রতিদিন কাঁটাযুক্ত ঝোপের বোঝা এনে মুসলমানদের চলার পথে ছড়িয়ে দিত। ইবনু যায়েদ ও যাহহাক বলেন, সে রাতের বেলা একাজ করত। একদিন সে বোঝা বহনে অপারগ হয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়ে। তখন ফেরেশতা তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে এবং সেখানেই তাকে শেষ করে দেয়’ (কুরতুবী)।
مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ
২) তার ধন-সম্পদ এবং যা কিছু সে উপার্জন করেছে তা তার কোন কাজে লাগেনি
كَسَبَ এর অর্থ ধন-সম্পদ দ্বারা অর্জিত মুনাফা ইত্যাদি। এর অর্থ সন্তান-সন্ততিও হতে পারে। কেননা, সন্তান-সন্ততিকেও মানুষের উপার্জন বলা হয়।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম বলেন, “মানুষ যা খায়, তন্মধ্যে তার উপার্জিত বস্তুই সর্বাধিক হালাল ও পবিত্র, আর তার সন্তান সন্ততিও তার উপার্জিত বস্তুর মধ্যে দাখিল।” [নাসায়ী: ৪৪৪৯; আবু দাউদ: ৩৫২৮]
অর্থাৎ সন্তানের উপার্জন খাওয়াও নিজের উপার্জন খাওয়ারই নামান্তর। এ কারণে কয়েকজন তাফসীরবিদ এস্থলে كَسَبَ এর অর্থ করেছেন সন্তান-সন্ততি। [কুরতুবী, ইবন কাসীর] আল্লাহ তা’আলা আবু লাহাবকে যেমন দিয়েছিলেন অগাধ ধন-সম্পদ, তেমনি দিয়েছিলেন অনেক সন্তান-সন্ততি। অকৃতজ্ঞতার কারণে এ দুটি বস্তুই তার গর্ব, অহমিকা ও শাস্তির কারণ হয়ে যায়।
সূরা বাকারার ১৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: ‘হে মানব জাতি ! পৃথিবীতে যা কিছু আছে সেসব থেকে হালাল ও পাক জিনিসগুলো খাও এবং শয়তানের প্ররোচনার অনুসরণ করো না যে কিনা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’।
আমি রসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি : প্রত্যেক উম্মতের জন্যই একটি পরীক্ষার বস্তু থাকে, আমার উম্মতের পরীক্ষার বস্তু হচ্ছে অর্থ-সম্পদ (তিরমিযি)।
হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরিকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৪]
হজরত মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রাজি.) থেকে বর্ণিত যে, নবী করীম (সা.) বলেছেন— আদম সন্তান দুটি জিনিসকে অপছন্দ করে, অথচ তার জন্য এগুলো ভালো। (১) মৃত্যুকে সে অপছন্দ করে অথচ মুমিনের জন্য ফিতনার চেয়ে মৃত্যুই ভালো (২) অর্থ-সম্পদ কম হওয়া সে অপছন্দ করে, অথচ সম্পদ কম হলে আখেরাতে হিসাবও কম দিতে হবে এবং তার জন্য সহজ হবে (মুসনাদে আহমাদ)।
তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষাস্বরূপ।” (সূরা আনফাল: ২৮ ও
তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর নিকটই মহান প্রতিদান”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৫]
“হে মুমিনগণ, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ তোমাদের দুশমন।অতএব, তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর যদি তোমরা মার্জনা কর, এড়িয়ে যাও এবং মাফ করে দাও তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ৪]
অর্থাৎ তারা কখনো কখনো আল্লাহর পথে চলা, তাঁর আনুগত্য করা অথবা আল্লাহর যিকির ও আখিরাতের স্মরণ থেকে তোমাদের বিরত রাখতে পারে। এ আয়াতে শত্রুতা ও দুশমনি বলতে এর প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য। ’ -সূরা কাহাফ : ৪৬
উক্ত আয়াতে ফিতনা শব্দের অর্থ হল, পরীক্ষা। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সন্তান-সন্ততি এবং অর্থ-সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করতে চান যে, এ সব পেয়ে কি আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি না কি এগুলো পেয়ে আত্ম অহমিকা ও অহংকারে ডুবে যাই এবং শেষ পর্যন্ত এ সব পার্থিব নিয়ামতের পেছনে পড়ে এ সব নিয়ামত দানকারী স্বয়ং মহান আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের কথাই ভুলে যাই!!
বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ এ পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার পরিচয় দিচ্ছে। দুনিয়া অর্থ-সম্পদ, স্ত্রী-সন্তান সহ সুখে জীবন-যাবন করার অভিপ্রায়ে হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম বানিয়ে ছেড়েছে! সুদ, ঘুস, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা, অবৈধ পণ্যের ব্যবসা সব বিভিন্ন হারাম উপার্জনের পেছনে ছুড়ে বেড়াচ্ছে উদভ্রান্ত পাগলের মত! তাদের নামায, যাকাত, রোযা, হজ্জ, জিকির, তাসবীহ, কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন অধ্যয়ন করার সময় নাই!! সন্তানদের ক্যারিয়ার গঠনের চিন্তায় তাদেরকে দ্বীন শেখানোর কথা ভুলে গেছে!! এভাবে মানুষ এই পরীক্ষায় স্পষ্ট অকৃতকার্য হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে গেছে। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
سَيَصْلَى نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ
৩. অচিরে সে দগ্ধ হবে লেলিহান আগুনে,
(১) অর্থাৎ কেয়ামতে অথবা মৃত্যুর পর কবরেই সে এক লেলিহান অগ্নিতে প্রবেশ করবে। তার নামের সাথে মিল রেখে অগ্নির বিশেষণ (ذَاتَ لَهَبٍ) বলার মধ্যে বিশেষ অলংকার রয়েছে। [আত তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]
পুনরুত্থান দিবসে মানুষের ভাবনা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوا إِلاَّ عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا ‘সেদিন যখন তারা এটা দেখবে, তখন তাদের মনে হবে, তারা (দুনিয়াতে) একটি রাত্রি বা একটি দিনের অধিক অবস্থান করেনি’ (নাযে‘আত ৭৯/৪৬)।
আল্লাহ বলেন, إِنَّهُمْ يَرَوْنَهُ بَعِيْدًا- وَنَرَاهُ قَرِيْبًا- ‘তারা ঐ দিনকে (ক্বিয়ামতকে) অনেক দূরে মনে করে’। ‘কিন্তু আমরা তা দেখছি নিকটে’ (মা‘আরিজ ৭০/৬-৭)।
وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ
৪. আর তার স্ত্রীও যে ইন্ধন বহন করে,
আবু লাহাবের স্ত্রীর নাম ছিল “আরওয়া”। সে ছিল আবু সুফিয়ানের বোন ও হরব ইবনে উমাইয়্যার কন্যা। তাকে “উম্মে জামীল” বলা হত। আবু লাহাবের ন্যায় তার স্ত্রীও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বিদ্বেষী ছিল। সে এ ব্যাপারে তার স্বামীকে সাহায্য করত। আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, এই হতভাগিনীও তার স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এক বর্ণনায় এসেছে, এ মহিলা যখন শুনতে পেল যে, আল্লাহ তা’আলা তার ও তার স্বামীর ব্যাপারে আয়াত নাযিল করে অপমানিত করেছেন সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বসা ছিলেন।
তার সাথে ছিলেন আবু বকর। তখন আবু বকর বললেন, আপনি যদি একটু সরে যেতেন তা হলে ভাল হতো যাতে করে এ মহিলা আপনাকে কোন কষ্ট না দিতে পারে। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার ও তার মাঝে বাধার সৃষ্টি করা হবে। ইত্যবসরে মহিলা এসে আবু বকরকে জিজ্ঞেস করল, আবু বকর! তোমার সাথী আমাদের বদনামী করে কবিতা বলেছে? তিনি জবাবে বললেন, এ ঘরের (কাবার) রবের শপথ, তিনি কোন কবিতা বলেননি এবং তার মুখ দিয়ে তা বেরও হয়নি। তখন মহিলা বলল, তুমি সত্য বলেছ। তারপর মহিলা চলে গেলে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, সে কি আপনাকে দেখেনি? রাসূল বললেন, মহিলা ফিরে যাওয়া পর্যন্ত একজন ফেরেশতা আমাকে তার থেকে আড়াল করে রাখছিল। [মুসনাদে আবি ইয়া’লা: ২৫, ২৩৫৮, মুসনাদে বাযযার: ২৯৪] [ইবন কাসীর]
(২) এখানে আবু জাহলের স্ত্রী উম্মে জামীলের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে (حَمَّالَةَ الْحَطَبِ) বলা হয়েছে। এর শাব্দিক অর্থ শুষ্ককাঠ বহনকারিণী। আরবের বাকপদ্ধতিতে পশ্চাতে নিন্দাকারীকে ‘খড়ি-বাহক’ বলা হত। শুষ্ককাঠ একত্রিত করে যেমন কেউ অগ্নি সংযোগের ব্যবস্থা করে, পরোক্ষে নিন্দাকার্যটিও তেমনি। এর মাধ্যমে সে ব্যক্তিবর্গ ও পরিবারের মধ্যে আগুন জ্বলিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামকে কষ্ট দেয়ার জন্যে আবু লাহাব পত্নী পরোক্ষ নিন্দাকার্যের সাথেও জড়িত ছিল। অধিকাংশ তাফসীরবিদ এখানে এ তাফসীরই করেছেন। অপরপক্ষে কোন কোন তাফসীরবিদগণ একে আক্ষরিক অর্থেই রেখেছেন এবং কারণ এই বর্ণনা করেছেন যে, এই নারী বন থেকে কন্টকযুক্ত লাকড়ি চয়ন করে আনত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়ার জন্যে তার পথে বিছিয়ে রাখত।
তার এই নীচ ও হীন কাণ্ডকে কুরআন (حَمَّالَةَ الْحَطَبِ) বলে ব্যক্ত করেছে। ইমাম তাবারী এ উক্তিটি গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ বলেন যে, তার এই অবস্থাটি হবে জাহান্নামে। সে জাহান্নামে লাকড়ি এনে জাহান্নামে তার স্বামীর উপর নিক্ষেপ করবে, যাতে অগ্নি আরও প্ৰজ্বলিত হয়ে উঠে, যেমন দুনিয়াতেও সে স্বামীকে সাহায্য করে তার কুফার ও জুলুম বাড়িয়ে দিত। কোন কোন মুফাসসির বলেন, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দরিদ্র বলে উপহাস করত। পরিণামে আল্লাহ এ মহিলাকে লাকড়ি আহরণকারী বলে অপমানজনক উপাধী দিয়ে উপহাস করেছেন। আবার সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেন, আয়াতের অর্থ “গোনাহের বোঝা বহনকারিনী”। [কুরতুবী, ইবন কাসীর]
فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِنْ مَسَدٍ
৫. তার গলায়(১) পাকানো রশি।(২)
(১) তার গলার জন্য “জীদ” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় গলাকে জীদ বলা হয়। পরবর্তীতে যে গলায় অলংকার পরানো হয়েছে তার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। [আত-তাহরীর ওয়াত-তানওয়ীর] সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব বলেন, সে একটি অতি মূল্যবান হার গলায় পরতো এবং বলতো, লাত ও উযযার কসম, এ হার বিক্রি করে আমি এর মূল্য বাবদ পাওয়া সমস্ত অর্থ মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কাজ করার জন্য ব্যয় করবো। [ইবন কাসীর] এ কারনে জীদ শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যাঙ্গার্থে। অর্থাৎ এ অলংকার পরিহিত সুসজ্জিত গলায়, যেখানে পরিহিত হার নিয়ে সে গর্ব করে বেড়ায়, কিয়ামতের দিন সেখানে রশি বাধা হবে। [আত-তাহরীর ওয়াত-তানওয়ীর]
(২) বলা হয়েছে, তার গলায় বাঁধা রশিটি ‘মাসাদ’ ধরনের। ‘মাসাদ’ এর অর্থ নির্ণয়ে কয়েকটি মত রয়েছে। তার একটি হচ্ছে, খুব মজবুত করে পাকানো রশিকে ‘মাসাদ’ বলা হয়। [বাগাবী] দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে, খেজুর গাছের (ডালের) ছাল/আঁশ থেকে তৈরি শক্ত পাকানো খসখসে রশি ‘মাসাদ’ নামে পরিচিত। [মুয়াস্সার] এর আরেকটি অর্থ, খেজুরের ডালের গোড়ার দিকের মোটা অংশ থেতলে যে সরু আশ পাওয়া যায় তা দিয়ে পাকানো রশি অথবা উটের চামড়া বা পশম দিয়ে তৈরি রশি। [কুরতুবী] মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এর অর্থ লোহার তারের পাকানো রশি বা লোহার বেড়ি। কোন কোন মুফাসসির বলেন, তার গলায় আগুনের রশি পরানো হবে। তা তাকে তুলে আগুনের প্রান্তে উঠবে। আবার তাকে এর গর্তদেশে নিক্ষেপ করবে। এভাবে তার শাস্তি চলতে থাকবে। [ইবন কাসীর]
[1] جِيدٌ অর্থ হল গর্দান, ঘাড়। আর مَسَد অর্থ হল মজবুত রশি; চাহে তা কোন ঘাস অথবা খেজুরের আঁশ বা ছিলকার অথবা লোহার তার পাকানো হোক; যেমন এক এক মুফাসসির এর এক এক রকম অর্থ বর্ণনা করেছেন। কিছু উলামার মতে, সে দুনিয়াতে ঐ রশি নিজ ঘাড়ে বা গলদেশে ঝুলিয়ে রাখত। কিন্তু সবচেয়ে বেশী সঠিক বলে মনে হয় যে, জাহান্নামে তার গলায় যে বেড়ি হবে, তা হবে লোহার তারের পাকানো রশি। مَسَد শব্দ দ্বারা উপমা দিয়ে রশির মজবুতী ও শক্ত অবস্থার কথা স্পষ্ট।
দ্বীনের দাওয়ার কাজ শুরু করতে হবে পরিবার ও আত্মীয়দের মধ্য দিয়ে। অনেকেই আমরা দাওয়ার কাজ করতে গিয়ে পরিবার ও আত্মীয়দের কথা গুরুত্ব দেই না যা দাওয়ার কাজের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরনীয় নয়। তাই সর্বাগ্রে নিজ সংশোধন ও পরিবার পরিজন, আত্মীয়দের মাঝে দাওয়ার কাজের গুরুত্ব বেশী দিয়ে অন্যান্যদের মাঝেও দাওয়াতের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে শুধুমাত্র মহান রবের সন্তুষ্টির জন্য ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসৃত দেখানো পথে।
এখনও আমাদের সমাজে আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর মতো ইসলামের চির শত্রু রয়েছে যারা মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামের বিধানের বিরোধীতা করেই গিয়েছে, করে যাচ্ছে। পাশাপাশি মুমিন মুজাহিদরা যারা নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে দ্বীন প্রচার প্রসারে ভূমিকা রেখেই যাচ্ছে তারাই ইন শা আল্লাহ সফল ও বিজয়ী হবে।
মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
(তাফসিরে যাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন, আহসানুল বয়ান )