সূরা মায়েদাঃ ৮ম রুকু (আয়াত সংখ্যা ৫১-৫৬)
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
৫:৫১ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوا الۡیَهُوۡدَ وَ النَّصٰرٰۤی اَوۡلِیَآءَ ۘؔ بَعۡضُهُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّهُمۡ مِّنۡکُمۡ فَاِنَّهٗ مِنۡهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ
হে মুমিনগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহন করলে সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।
এখানে ইয়াহুদ ও খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা তারা ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির কথাও ঘোষণা করা হয়েছে যে, তারা তাদেরই দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।
আলোচ্য আয়াতের অর্থ হল, ঈমানদারদের পারস্পরিক ভালবাসা এবং বিশেষ সম্পর্ক থাকে। তারা আপোসে একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু।
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾
মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী , এরা সবাই পরষ্পরের বন্ধু ও সহযোগী৷ এরা ভাল কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবংআল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্র করে৷ এরা এমন লোক যাদের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবেই৷ অবশ্যি আল্লাহ সবার ওপর পরাক্রমশালি এবং জ্ঞানী ও বিজ্ঞ৷ তাওবাঃ৭১
এখানে মহান আল্লাহ মু’মিনদেরকে কাফেরদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কারণ, কাফেররা আল্লাহর শত্রু এবং মু’মিনদেরও। সুতরাং তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা কিভাবে বৈধ হতে পারে? আর এই কারণেই আল্লাহ তাআলা এই বিষয়টাকে কুরআনের আরো কয়েক স্থানে অতীব গুরুত্বের সাথে পেশ করেছেন। যাতে মুমিনরা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব এবং বিশেষ সম্পর্ক কায়েম করা থেকে বিরত থাকে। অবশ্য (পার্থিব) প্রয়োজন ও সুবিধার দাবীতে তাদের সাথে সন্ধি ও চুক্তি হতে পারে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেনও। অনুরূপ যে কাফের মুসলিমদের সাথে শত্রুতা রাখে না, তার সাথে উত্তম ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার করা বৈধ। (এর বিস্তারিত আলোচনা সূরা মুমতাহিনায় আছে।) কারণ, এ সব কার্যকলাপ (বন্ধুত্ব ও ভালবাসা থেকে) ভিন্ন জিনিস।
মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্র কোন সম্পর্কে থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন। সূরা আলে-ইমরানের ২৮
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوۡا بِطَانَۃً مِّنۡ دُوۡنِکُمۡ لَا یَاۡلُوۡنَکُمۡ خَبَالًا ؕ وَدُّوۡا مَا عَنِتُّمۡ ۚ قَدۡ بَدَتِ الۡبَغۡضَآءُ مِنۡ اَفۡوَاهِهِمۡ ۚۖ وَ مَا تُخۡفِیۡ صُدُوۡرُهُمۡ اَکۡبَرُ ؕ قَدۡ بَیَّنَّا لَکُمُ الۡاٰیٰتِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ
হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের অনিষ্ট করতে ক্রটি করবে না; তারা যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে তা-ই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং তাদের হৃদয় যা গোপন রাখে তা আরো গুরুতর। তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর।আলে ইমরানঃ১১৮
প্রত্যেক মানুষ কুরআনে বর্ণিত এই প্রকৃতত্বকে লক্ষ্য করতে পারে যে, ইয়াহুদ ও খ্রিষ্টানরা তাদের পরষ্পরের মধ্যে আকীদাগত কঠিন মতভেদ এবং পরষ্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ও শত্রুতা বিদ্যমান আছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে তারা একে অপরের পৃষ্ঠপোষক ও সহায়ক।
এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয় যে, উবাদা বিন স্বামেত আনসারী (রাঃ) এবং মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই দু’জনেই জাহেলিয়াতের যুগ থেকে ইয়াহুদীদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। বদরের যুদ্ধে যখন মুসলিমগণ বিজয়ী হলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নিজেকে মুসলিম বলে প্রকাশ করল। এদিকে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বানু কাইনুকার ইয়াহুদীরা ফিতনার আগুন জ্বালিয়ে দিল এবং তা নির্বাপিত করা হল। এর ফলে উবাদা (রাঃ) ইয়াহুদীদের সাথে মৈত্রী-সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করে দিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিপরীত পথ অবলম্বন করে ইয়াহুদীদেরকে বাঁচানোর জন্য সমস্ত রকম প্রচেষ্টা শুরু করে দিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।
৫:৫২ فَتَرَی الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ مَّرَضٌ یُّسَارِعُوۡنَ فِیۡهِمۡ یَقُوۡلُوۡنَ نَخۡشٰۤی اَنۡ تُصِیۡبَنَا دَآئِرَۃٌ ؕ فَعَسَی اللّٰهُ اَنۡ یَّاۡتِیَ بِالۡفَتۡحِ اَوۡ اَمۡرٍ مِّنۡ عِنۡدِهٖ فَیُصۡبِحُوۡا عَلٰی مَاۤ اَسَرُّوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ نٰدِمِیۡنَ
সুতরাং যাদের অন্তরে অসুখ রয়েছে আপনি তাদেরকে খুব তাড়াতাড়ি ওদের সাথে মিলিত হতে দেখবেন এ বলে, আমরা আশংকা করছি যে, কোন বিপদ আমাদের আক্রান্ত করবে। অতঃপর হয়ত আল্লাহ বিজয় বা তার কাছ থেকে এমন কিছু দেবেন যাতে তারা তাদের অন্তরে যা গোপন রেখেছিল সে জন্য লজ্জিত হবে।
মুজাহিদ বলেন, এখানে যাদের অন্তরে অসুখ রয়েছে বলে মুনাফিকদের বুঝানো হয়েছে। তারা ইয়াহুদীদের সাথে গোপন শলা-পরামর্শ ও তাদের খাতির করে কথা বলতে সাচ্ছন্দ বোধ করে। অনুরূপভাবে তারা তাদের সন্তানদের দুধ পান করাতেও অভ্যস্ত। এমতাবস্থায় তাদের আন্তরিক সম্পর্ক ইয়াহুদীদের সাথেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তারা সবসময় ভাবে যে, ইয়াহুদীদেরই বিজয় হবে। আর তখন তাদের কাছ থেকে তারা বাড়তি সুবিধা পাবে। [তাবারী]
ইয়াহুদ ও নাসারাদের উপর জিযিয়া-কর নির্ধারণ করবেন। এ আয়াত বানু কুরাইযাকে হত্যা ও তাদের সন্তানদেরকে বন্দী এবং বানু নাযীরকে নির্বাসিত করার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে; যা তা অদূর ভবিষ্যতেই সংঘটিত হয়েছিল।
মুসলিমরা সে বিজয় দেখেছিল। সুদ্দী বলেন, সে বিজয় হচ্ছে, মক্কা বিজয়। [তাবারী] কাতাদা বলেন, এখানে বিজয় বলে আল্লাহর ফয়সালা বুঝানো হয়েছে। [তাবারী] কাতাদা আরও বলেন, মুনাফিকরা তখন ইয়াহুদীদের সাথে তাদের যে গোপন আতাত, ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও তাদের বিরুদ্ধাচারণ ও এতদসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপের জন্য লজ্জিত হবে। [তাবারী]
তখনো পর্যন্ত আরবে কুফর ও ইসলামের দ্বন্দ্বের কোন মীমাংসা হয়নি ৷ যদিও নিজের অনসারীদের কর্মতৎপরতা সাধনা ও আত্মত্যাগের কারণে ইসলাম একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছিল তবুও বিরুদ্ধ শক্তিগুলোও ছিল প্রবল পরাক্রান্ত ৷ ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনা যেমন ছিল তেমনি কুফরের বিজয়ের সম্ভাবনাও ছিল ৷ তাই মুসলমানদের মধ্যে যেসব মোনাফেক বিদ্যমান ছিল তারা ইসলামী দলের মধ্যে থেকেও ইহুদী ও খৃষ্টানদের সাথেও সম্পর্ক রাখতে চাইতো ৷ তারা ভাবতো, ইসলাম ও কুফরের এ দ্বন্দ্বে যদি ইসলামের পরাজয় ঘটে যায় তাহলে তাদের জন্য যেন কোন একটা আশ্রয় স্থল অবশিষ্ট থাকে ৷ এ ছাড়াও সে সময় আরবে খৃষ্টান ও ইহুদীদের অর্থবল ছিল সবচেয়ে বেশী ৷ মহাজনী ব্যবসায়ের বেশীর ভাগ ছিল তাদের হাতে ৷ আরবের সবচেয়ে উর্বর ও শস্যশ্যামল ভূখণ্ড ছিল তাদের অধিকারে ৷ তাদের সুদখোরীর জাল চারদিকে ছড়িয়ে ছিল ৷ কাজেই অর্থনৈতিক কারণেও এ মোনাফেকরা তাদের সাথে নিজেদের আগের সম্পর্ক অটুট রাখতে চাইতো ৷ তদের ধারণা ছিল, ইসলাম ও কুফরের এ সংঘর্ষে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে আমরা যদি ইসলামের সাথে বর্তমানে বিরোধে ও যুদ্ধে লিপ্ত সম্প্রদায়গুলোর সাথে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করি, তাহলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক দিয়েই এটা হবে আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক ৷
৫:৫৩ وَ یَقُوۡلُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَهٰۤؤُلَآءِ الَّذِیۡنَ اَقۡسَمُوۡا بِاللّٰهِ جَهۡدَ اَیۡمَانِهِمۡ ۙ اِنَّهُمۡ لَمَعَکُمۡ ؕ حَبِطَتۡ اَعۡمَالُهُمۡ فَاَصۡبَحُوۡا خٰسِرِیۡنَ
আর মুমিনগণ বলবে, এরাই কি তারা, যারা আল্লাহর নামে দৃঢ়ভাবে শপথ করেছিল যে, নিশ্চয় তারা তোমাদের সঙ্গেই আছে? তাদের আমলসমূহ নিস্ফল হয়েছে; ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ আয়াতে বিষয়টি আরো পরিস্কার করে বলা হয়েছে যে, যখন মুনাফেকদের মুখোশ উন্মোচিত হবে এবং তাদের বন্ধুত্বের দাবী ও শপথের স্বরূপ ফুটে উঠবে, তখন মুসলিমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলবে, এরাই কি আমাদের সাথে আল্লাহর নামে কঠোর শপথ করে বন্ধুত্বের দাবী করত? আজ এদের সব লোকদেখানো ধর্মীয় কার্যকলাপই বিনষ্ট হয়ে গেছে। আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তা’আলা যে অবস্থার কথা বর্ণনা করেছে, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই প্রত্যেক মুমিন-মুসলিম সবাই তার বাস্তব চিত্র প্রত্যক্ষ করেছিল। [সা’দী] আল্লামা শানকীতী বলেন, মুনাফিকদের মিথ্যা শপথের মূল কারণ হচ্ছে, তারা প্রচন্ড ভীতুপ্রকৃতির মানুষ ছিল। যদি কোথাও পালাবার পথ তাদের জানা থাকত তবে তারা সেটাই করত। [আদওয়াউল বায়ান]
অর্থাৎ ইসলামের বিধান মেনে চলতে গিয়ে তারা যা কিছু করলোঃ নামায পড়লো, রোযা রাখলো, যাকাত দিল, জিহাদে শরীক হলো, ইসলামী আইরে আনুগত্য করলো–এসব কিছুই এ জন্য নষ্ট হয়ে গেলো যে, ইসলামের ব্যাপারে তাদের মনে আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতা ছিল না এবং তারা সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে একমাত্র তারই অনুগত বান্দায় পরিণত হয়ে যায়নি ৷ বরং নিজেদের পার্থিব স্বার্থের কারণে তারা আল্লাহ ও তাঁর বিদ্রোহীদের মধ্যে নিজেদেরকে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে রেখেছিল ৷
৫:৫৪ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَنۡ یَّرۡتَدَّ مِنۡکُمۡ عَنۡ دِیۡنِهٖ فَسَوۡفَ یَاۡتِی اللّٰهُ بِقَوۡمٍ یُّحِبُّهُمۡ وَ یُحِبُّوۡنَهٗۤ ۙ اَذِلَّۃٍ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَعِزَّۃٍ عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ ۫ یُجَاهِدُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ لَا یَخَافُوۡنَ لَوۡمَۃَ لَآئِمٍ ؕ ذٰلِکَ فَضۡلُ اللّٰهِ یُؤۡتِیۡهِ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন থেকে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং যারা তাকে ভালবাসবে; তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে; তারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না; এটা আল্লাহ্র অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছে তাকে তিনি তা দান করেন এবং আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এ আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠোর হুশিয়ারী দেয়া হচ্ছে যে, যারাই আল্লাহর পথ ও তাঁর দ্বীন থেকে পিছু ফিরে যাবে, তারা আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ্ তাআলা তার দ্বীনের জন্য নতুন কোন জাতিকে এগিয়ে আনবেন। [তাবারী] আইয়াদ আল আশ’আরী বলেন, যখন এ আয়াত নাযিল হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে আবু মূসা, এরা হল তোমার সম্প্রদায়। আর রাসূল হাত দিয়ে ইশারা করছিলেন আবু মূসা আল-আশ’আরীর দিকে। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩১৩
(২) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে বললেনঃ “তোমাদের মধ্যে কারো হক জানা থাকলে সে যেন তা বলতে কাউকে ভয় না করে। বর্ণনাকারী আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এ হাদীস বর্ণনা করে কেঁদে ফেললেন। তারপর বললেন, আল্লাহর শপথ আমরা অনেক বিষয় দেখেছি, কিন্তু ভয় করেছি। [ইবন মাজাহঃ ৪০০৭; তিরমিযী: ২১৯১]
(৩) এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মুসলিমদের স্বার্থেই তাদেরকে অমুসলিমদের সাথে গভীর বন্ধুত্ব ও মেলামেশা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, সত্যদ্বীন ইসলামের হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করেছেন। কোন ব্যক্তি কিংবা দলের বক্রতা ও অবাধ্যতা দূরের কথা, স্বয়ং মুসলিমদের কোন ব্যক্তি কিংবা দল যদি সত্যি সত্যিই ইসলাম ত্যাগ করে বসে এবং সম্পূর্ণ দ্বীনত্যাগী হয়ে অমুসলিমদের সাথে হাত মিলায়, তবে এতেও ইসলামের কোন ক্ষতি হবে না- হতে পারে না। মুসলিমরাও যদি দ্বীনত্যাগী হয়ে যায়, আল্লাহ তা’আলা তাদের জায়গায় অন্য কোন জাতির অভ্যুত্থান ঘটাবেন। সে জাতির মধ্যে বেশ কিছু গুণ থাকবে।
তাদের প্রথম গুণ হচ্ছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে ভালবাসবেন এবং তারা নিজেরাও আল্লাহ তা’আলাকে ভালবাসবে।
এ গুণটি দুটি অংশে বিভক্ত- এক. আল্লাহর সাথে তাদের ভালবাসা। একে কোন না কোন স্তরে মানুষের ইচ্ছাধীন মনে করা যায়। দুই. আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে ভালবাসা। এতে বাহ্যতঃ মানুষের ইচ্ছা ও কর্মের কোন ভূমিকা নেই। যে বিষয়টি মানুষের ইচ্ছা ও সামর্থ্যের বাইরে, তা মানুষকে শুনানোরও কোন বাহ্যিক সার্থকতা নেই। কিন্তু কুরআনুল কারীমের অন্যান্য আয়াতের পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, এ ভালবাসার উপায়-উপকরণগুলোও মানুষের ইচ্ছাধীন। মানুষ যদি এসব উপায়কে কাজে লাগায়, তবে তাদের সাথে আল্লাহ তা’আলার ভালবাসা অবশ্যম্ভাবী।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “হে রাসূল, আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভালবাস, তবে আমার অনুসরন কর। এর ফলশ্রুতিতে আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে ভালবাসতে থাকবেন, আর আল্লাহ তোমাদের অপরাধসমূহ মার্জনা করে দিবেন; এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।” [সূরা আলে-ইমরানঃ ৩১] এ আয়াত থেকে জানা যাচ্ছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার ভালবাসা লাভ করতে চায়, তার উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত অনুসরণে অবিচল থাকা। এমনটা করলে আল্লাহ তা’আলা তাকে ভালবাসবেন বলে ওয়াদা দিয়েছেন।
তাদের দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে যে, তারা মুসলিমদের সামনে নম্র হবে এবং কোন ব্যাপারে মতবিরোধ হলে সত্যপন্থী হওয়া সত্বেও সহজে বশ হয়ে তারা ঝগড়া ত্যাগ করবে। এ অর্থেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘আমি ঐ ব্যক্তিকে জান্নাতের মধ্যস্থলে বাসস্থান দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করছি, যে সত্যপন্থী হওয়া সত্বেও ঝগড়া ত্যাগ করে’। [আবু দাউদঃ ৪৮০০]
মোটকথা, তারা মুসলিমদের সাথে স্বীয় অধিকার কাজ-কারবারের ব্যাপারে কোনরূপ ঝগড়াবিবাদ রাখবে না। তাদের তৃতীয় গুণ হচ্ছে যে, তারা কাফেরদের উপর প্রবল, শক্তিশালী ও কঠোর। উদ্দেশ্য এই যে, তারা আল্লাহ ও তার দ্বীনের শক্রদের মোকাবেলায় কঠোর ও পরাক্রান্ত। শক্ররা তাদেরকে সহজে কাবু করতে পারে না। উভয় বাক্য একত্রিত করলে সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, তারা হবে এমন এক জাতি, যাদের ভালবাসা ও শক্রতা নিজ সত্ত্বা ও সত্ত্বাগত অধিকারের পরিবর্তে শুধু আল্লাহ, তার রাসূল ও তার দ্বীনের খাতিরে নিবেদিত হবে।
এ একই বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, (أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ) -অর্থাৎ “কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।” [সূরা আল-ফাতহঃ ২৯) তাদের চতুর্থ গুণ হচ্ছে, “তারা সত্য দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে জিহাদে প্রবৃত্ত হবে।” এর সারমর্ম এই যে, কুফর ও দ্বীনত্যাগের মোকাবেলা করার জন্য শুধু কতিপয় প্রচলিত ইবাদাত এবং নম্র ও কঠোর হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দীপনাও থাকতে হবে।
এই উদ্দীপনাকে পূর্ণতা দানের জন্য পঞ্চম গুণ বলা হয়েছে, “দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত ও সমুন্নত করার চেষ্টায় তারা কোন ভৎসনাকারীর ভৎসনারই পরোয়া করবে না।” [ইবন কাসীর থেকে সংক্ষেপিত]
‘মুমিনদের ব্যাপারে কোমল’ হবার মানে হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি ঈমানদারদের মোকাবিলায় কখনো শক্তি প্রয়োগ করবে না ৷ তার বুদ্ধি, মেধা, যোগ্যতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ-সম্পদ, শারীরিক ক্ষমতা কোনটিই মুসলমানদরেকে দাবিয়ে রাখার , কষ্ট দেবার বা ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করবে না ৷ মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে তাকে সবসময় একজন দয়ার্দ্র হৃদয়, কোমল স্বভাবের, দরদী ও ধৈর্যশীল মানুষ হিসেবেই দেখতে পায় ৷
‘কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর’ হবার মানে হচ্ছে, নিজের মজবুদ ঈমান, নিস্বার্থ ও একনিষ্ঠ দীনদারী, অনমনীয় নীতিবাদিতা, চারিত্রিক শক্তি ও ঈমানী দূরদৃষ্টির কারণে একজন মুমিন ইসলাম বিরোধীদের মোকাবিলায় পাহাড়ের মতো অটল হবে ৷ নিজের স্থান থেকে তাকে এক চূলও নড়ানো যাবে না ৷ ইসলাম বিরোধীরা কখনো তাকে নমনীয়, দোদ্যুল্যমান এবং অক্লেশে গলধঃকরণ কারার মতো খাদ্য মনে করতে পারবে না ৷ যখনই তারা তর মুখোমুখি হয় তখনই টের পেয়ে যায় যে, এ আল্লাহর বান্দা মরে যেতে পারে কিন্তু কখনো কোন মূল্যে বিক্রি হতে পারে না এবং কোন চাপের সামনে নতি স্বীকারও করতে পারে না ৷
ধর্ম-ত্যাগীদের পরিবর্তে আল্লাহ এমন এক কওমকে নির্বাচিত করবেন, যাদের চারটি স্পষ্ট গুণ বর্ণনা করা হয়েছে; (ক) আল্লাহর প্রতি ভালবাসা রাখা ও তাঁর ভালবাসার পাত্রতে পরিণত হওয়া।
(খ) ঈমানদারদের প্রতি কোমল ও বিনম্র এবং কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর হওয়া।
(গ) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। এবং
(ঘ) আল্লাহর ব্যাপারে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে পরোয়া না করা।
সাহাবায়ে কেরামগণ (রাঃ) এই সমস্ত গুণের অধিকারী ছিলেন। যার কারণে আল্লাহ তাঁদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে মহা সৌভাগ্যবান বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর দুনিয়াতেই তিনি তাঁদের প্রতি সন্তুষ্টির সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন।
قُلِ اللّٰهُمَّ مٰلِکَ الۡمُلۡکِ تُؤۡتِی الۡمُلۡکَ مَنۡ تَشَآءُ وَ تَنۡزِعُ الۡمُلۡکَ مِمَّنۡ تَشَآءُ ۫ وَ تُعِزُّ مَنۡ تَشَآءُ وَ تُذِلُّ مَنۡ تَشَآءُ ؕ بِیَدِکَ الۡخَیۡرُ ؕ اِنَّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿
বলুন, ‘হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! আপনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন; যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন আর যাকে ইচ্ছা আপনি হীন করেন। কল্যাণ আপনারই হাতে।(১) নিশ্চয়ই আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আলে ইমরানঃ২৬
৫:৫৫ اِنَّمَا وَلِیُّکُمُ اللّٰهُ وَ رَسُوۡلُهٗ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ هُمۡ رٰکِعُوۡنَ
তোমাদের বন্ধু তো কেবল আল্লাহ, তার রাসূল ও মুমিনগণ- যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং তারা বিনীত।
আউলিয়া ওয়ালীর(ওলী) বহুবচন। আর ওলী এমন বন্ধুকে বলা হয়, যার সাথে থাকে আন্তরিক ভালবাসা এবং বিশেষ সম্পর্ক। যেমন, মহান আল্লাহ নিজেকে ঈমানদারদের ওলী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। [اَللهُ ولِيُّ الَّذِيْنَ آمَنُوا] ‘‘আল্লাহ হলেন ঈমানদারদের ওলী।’’
اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ‘আল্লাহই হচ্ছেন ঈমানদারদের অলী (বন্ধু)। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর যারা কাফের তাদের বন্ধু হচ্ছে তাগুত (শয়তান) তারা তাদেরকে আলো হতে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। (সূরা বাকারাঃ ২৫৭)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(إن آل أبي فلان ليسوا لي بأولياء إنما أوليائي المتقون)
‘অমুকের পিতার সন্তানেরা আমার বন্ধু নয়। মুত্তাকীরাই কেবল আমার বন্ধু। বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আদাব।
হাসান (রাঃ) বলেনঃ একদল লোক আল্লাহর ভালবাসা প্রকাশ করলে আল্লাহ্ তাদেরকে এই আয়াত দ্বারা পরীক্ষা করলেন।
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ
‘হে নবী! আপনি বলে দিনঃ তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তাহলে আমার অনুসরণ কর। তবেই আল্লাহ্ তোমাদেরকে ভালবাসবেন’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৩১)
ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেনঃ যখন তুমি দেখবে কোন লোক পানির উপর দিয়ে হাঁটছে অথবা শূণ্যে উড়ছে তখন তুমি তাকে অলী হিসেবে বিশ্বাস কর না কিংবা তার দ্বারা প্রতারিত হয়ো না। যতক্ষণ না তোমরা জেনে নিবে সে রাসূলের অনুসরণ করে কি না। ইমাম শাফেয়ীর কথাটি ভন্ড অলী ও সঠিক অলী চেনার গুরুত্বপূর্ণ একটি মাপকাঠি।
أَلا إِنَّ أَوْلِيَاء اللّهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ
সাবধান! জেনে রেখ, যারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, আর না তারা চিন্তান্বিত হবে।’ (সুরা ইউনুস : আয়াত ৬২)
لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَياةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ لاَ تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
তাদের জন্য দুনিয়ার জীবন ও পরকালীন জীবনে রয়েছে সুসংবাদ। আল্লাহর কথার কখনো রদবদল হয় না। এটাই হল মহা সফলতা।’ (সুরা ইউনুস : আয়াত ৬৪)
এ আয়াতে মুসলিমদের গভীর বন্ধুত্ব ও বিশেষ বন্ধুত্ব যাদের সাথে হতে পারে, তাদের গুণাগুণ বর্ণনা করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, প্রথমতঃ তারা পূর্ণ আদব ও শর্তাদিসহ নিয়মিত সালাত আদায় করে। দ্বিতীয়তঃ স্বীয় অর্থ-সম্পদ থেকে যাকাত প্রদান করে। তৃতীয়তঃ তারা বিনম্র ও বিনয়ী স্বীয় সৎকর্মের জন্য গর্বিত নয়, তারা মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করে। [সা’দী]
ফাইরোয আদ-দাইলামী বলেন, তার সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাদের প্রতিনিধি পাঠালেন। তারা এসে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তো ঈমান এনেছি, এখন আমার বন্ধু-অভিভাবক কে? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তার রাসূল। তারা বললঃ আমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট এবং আমরা সন্তুষ্ট। [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/২৩২]
আয়াতে উল্লেখিত (وَهُمْ رَاكِعُونَ) এ ركوع শব্দের কয়েকটি অর্থ হতে পারে। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেনঃ এখানে রুকূ’ অর্থ পারিভাষিক রুকূ’, যা সালাতের একটি রুকন। অর্থাৎ আর তারা রুকুকারী। [ফাতহুল কাদীর] এটা যেমন ফরয সালাতের সাধারণ রুকু উদ্দেশ্য হতে পারে, তেমনিভাবে নফল সালাত আদায়কারী অর্থেও হতে পারে। [বাগভী, জালালাইন] পক্ষান্তরে অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, এখানে রুকু বলে বিনম্র ও খুশু-খুযু সম্পন্ন হওয়া বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর, সা’দী] প্রথম অর্থের ক্ষেত্রে واو টি عطف এর জন্য। আর দ্বিতীয় অর্থের ক্ষেত্রে واو টি حال বা অবস্থা নির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইবন কাসীর এ অর্থটি গৌন বিবেচনা করেছেন।
৫:৫৬ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَاِنَّ حِزۡبَ اللّٰهِ هُمُ الۡغٰلِبُوۡنَ
. আর যে আল্লাহ, তার রাসূল ও মুমিনগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তবে নিশ্চয় আল্লাহর দলই বিজয়ী।
আয়াতে বলা হয়েছে, যারা কুরআনের নির্দেশ পালন করে বিজাতির সাথে গভীর বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকে এবং শুধু আল্লাহ ও তার রাসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা হবে বিজয়ী ও বিশ্বজয়ী। বলা হয়েছে, যেসব মুসলিম আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ পালন করে, তারা আল্লাহর দল। এরপর সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, পরিণামে আল্লাহর দলই সবার উপর জয়ী হবে। পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে সবাই প্রত্যক্ষ করে নিয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম সবার উপর জয়ী হয়েছেন। এটি মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বড় সুসংবাদ।
যারা আল্লাহর নির্দেশ মানবে, তারা তার দল ও বাহিনীভুক্ত হবে। তাদের জন্যই জয় অপেক্ষা করছে। যদিও মাঝে মাঝে তাদের উপর কোন কোন বিপদ আসে, তা শুধুমাত্র আল্লাহ তাঁর কোন ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার জন্য তা করিয়ে থাকেন। তবে শেষ পর্যন্ত শুভ পরিণাম ও বিজয় তাদেরই পক্ষে যায়। অন্য আয়াতেও আল্লাহ্ তা’আলা অনুরূপ বলেছেন, তিনি বলেছেন, “আর আমাদের বাহিনী অবশ্যই বিজয়ী হবে।” [সূরা আস-সাফফাত: ১৭৩] [সা’দী]
﴿يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ﴾
এরা তাদের মুখের ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়৷ অথচ আল্লাহর ফায়সালা হলো তিনি তার নূরকে পূর্নরূপে বিকশিত করবেন৷ কাফেররা তা যতই অপছন্দ করুক না কেন৷সূরা সফঃ ৮
﴿هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ﴾
তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত এবং ‘দীনে হক’ দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দীনকে অন্য সকল দীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন৷
সূরা সফঃ ৯
এখানে আল্লাহর দলের নিদর্শন ও তাদের বিজয়ী হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আল্লাহর দল তাঁরাই যাঁরা আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মুমিনদের সাথে সম্পর্ক রাখে, আর ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান, কাফের ও মুশরিকদের সাথে ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখে না; যদিও তারা তাঁদের নিকটাত্মীয় হয়। যেমনটি সূরা মুজাদালার শেষে বলা হয়েছে যে, ‘‘যারা আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস রাখে, তাদেরকে তুমি এরূপ পাবে না যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে; যদিও তারা তাদের পিতা, ভাই ও আত্মীয়-স্বজনও হয়।’’ তারপর সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, এরা তো ওরাই, যাদের অন্তরে ঈমান বিদ্যমান এবং যাদেরকে আল্লাহ সাহায্য করেছেন এবং এদেরকেই আল্লাহ জান্নাতে প্রবিষ্ট করবেন — আর এরাই হচ্ছে আল্লাহর দল। আর তারাই হবে সফলকাম। (দ্রষ্টব্যঃ সূরা মুজাদালার শেষ আয়াত)
এটি হচ্ছে ৭৩ দলের মধ্যে হতে নাজাতপ্রাপ্ত একটি দল। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐসমস্ত দল হতে এই দলটিকে পৃথক করে বলেছেনঃ
(كُلُّهَا فِي النَّارِ إلاَّ وَاحِدَةً وهي الجماعة)‘একটি দল ব্যতীত সমস্ত দলই জাহান্নামে যাবে। আর সেটি হচ্ছে আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। অন্য বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(هم من كان على مثل مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي)
‘তাঁরা হলেন ঐসমস্ত লোক, যারা আমার ও আমার সাহাবীদের তরীকার উপর চলবে। তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান।
আমরা আল্লাহর কাছে দু’আ করি তিনি যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করেন, আমাদের অন্তরকে হেদায়াতের উপর অটল রাখেন এবং আমাদেরকে তাঁর রহমত দ্বারা আচ্ছাদিত করে নেন। তিনিই মহান দাতা।
ইরশাদ হয়েছে—-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ تِجَارَةٍ تُنجِيكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ
হে ঈমান আনয়নকারীগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসায়ে সন্ধান দেবো যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি দেবে?
تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান আন এবং আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ও জান-প্রাণ দিয়ে জিহাদ করো এটাই তোমাদের জন্য অতিব কল্যাণকর যদি তোমরা তা জান৷
يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমনসব বাগানে প্রবেশ করাবেন যার নীচে দিয়ে ঝর্ণাধারা বয়ে চলবে৷ আর চিরস্থায়ী বসবাসের জায়গা জান্নাতের মধ্যে তোমাদেরকে সর্বোত্তম ঘর দান করবেন৷ এটাই বড় সফলতা।
وَأُخْرَىٰ تُحِبُّونَهَا ۖ نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
আর আরেক জিনিস যা তোমরা আকাংখা করো আল্লাহ তাও তোমাদের দেবেন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং অতি নিকটবর্তী সময়ে বিজয়৷ হে নবী! ঈমানদারদেরকে এর সুসংবাদ দান করো৷
সূরা আস সফঃ ১০-১৩
সংগ্রহেঃ তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন
দুইজন মুরতাদের কথাঃ (সংগৃহিত অংশ)
বনু হানীফাহ প্রতিনিধি দল(وفد بني حنيفة) :
ইয়ামামাহর হানীফাহ গোত্রের ১৭ সদস্যের অত্র প্রতিনিধি দলটি ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন (ফাৎহুল বারী হা/৪৩৭১-এর পরের অনুচ্ছেদ)। তাদের নেতা ছুমামাহ বিন আছাল হানাফী(ثُمَامَةُ بْنُ آثَالٍ الْحَنَفِيُّ) ‘যিনি রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার কুমতলবে ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাররম মাসে মদীনায় যাওয়ার পথে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর হাতে পাকড়াও হয়ে মদীনায় নীত হন। তিনদিন বন্দী থাকার পর রাসূল (ছাঃ) তাকে মুক্তি দিলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম কবুল করেন। প্রধানতঃ তাঁরই দাওয়াতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অত্র প্রতিনিধি দলটি ৯ম হিজরী সনে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন। উক্ত প্রতিনিধি দলে ইয়ামামার নেতা মুসায়লামা ছিলেন। তিনি শর্ত দিলেনإنْ جَعَلَ لِيْ مُحَمَّدٌ الْأَمْرَ مِنْ بَعْدِهِ تَبِعْتُهُ ‘যদি মুহাম্মাদ তাঁর পরে আমাকে তাঁর শাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন, তাহ’লে আমি তাঁর অনুসারী হব’ (অর্থাৎ বায়‘আত করব)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর হাতে রাখা খেজুরের শুকনো ডালটির দিকে ইশারা করে বললেন,لَوْ سَأَلْتَنِيْ هَذِهِ الْقِطْعَةَ مَا أَعْطَيْتُكهَا ‘যদি তুমি এই শুকনা ডালের টুকরাটিও চাও, তাহ’লেও আমি তোমাকে এটা দিব না’। অর্থাৎ নেতৃত্বের শর্তে বায়‘আত নেব না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি বায়‘আত না নিয়ে ফিরে যাও, তবে আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করে দিবেন। কারণ তোমার পরিণতি আমাকে দেখানো হয়েছে’ (বুখারী হা/৩৬২০)। রাবী ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমি উক্ত বিষয়ে পরে আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমাকে পৃথিবীর ধনভান্ডার দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আমার দুই হস্ততালুতে দু’টি সোনার বালা এসেছে। এতে আমি খুব ভারি বোধ করি। তখন স্বপ্নেই আমাকে বলা হয় যে, ওটা ফুঁক দিয়ে উড়িয়ে দাও। ফলে আমি ফুঁক দিতেই বালা দু’টি উড়ে গেল। আমি এর ব্যাখ্যা করছি এভাবে যে, এরা হ’ল ঐ দু’জন ভন্ডনবী, যারা আমার পরে বের হবে। তাদের একজন হ’ল ছান‘আর আসওয়াদ ‘আনাসী। অপরজন হ’ল ইয়ামামার মুসায়লামা কাযযাব’। যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৫-৩৬; বুখারী হা/৪৩৭৫, ৩৬২১; মুসলিম হা/২২৭৩-৭৪; মিশকাত হা/৪৬১৯।
উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ) ত্রিশ জন ভন্ডনবী সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান’ (আবুদাঊদ হা/৪২৫২; হাকেম হা/৮৩৯০)।
অতঃপর মুসায়লামা ফিরে গিয়ে মুরতাদ হন ও নিজেই নবুঅত দাবী করেন। তিনি তার অনুসারীদের জন্য ছালাত নিষিদ্ধ করেন এবং মদ্যপান ও ব্যভিচার হালাল করে দেন। তবে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কেও নবী হিসাবে স্বীকৃতি দেন। যাতে তার এলাকার মুসলমানরা তার বিরুদ্ধে না চলে যায়। অতঃপর ১০ম হিজরীতে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিম্নোক্ত পত্র লেখেন।-
مِنْ مُسَيْلِمَةَ رَسُولِ اللهِ، إلَى مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ، سَلاَمٌ عَلَيْكَ، أَمَّا بَعْدُ : فَإِنِّي قَدْ أُشْرِكْتُ فِي الْأَمْرِ مَعَكَ، وَإِنَّ لَنَا نِصْفَ الْأَرْضِ، وَلِقُرَيْشٍ نِصْفَ الْأَرْضِ، وَلَكِنَّ قُرَيْشًا قَوْمٌ يَعْتَدُونَ-
‘আল্লাহর রাসূল মুসায়লামার পক্ষ হ’তে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হৌক! অতঃপর আমাকে আপনার সাথে রাজত্বে শরীক করা হয়েছে। জনপদের অর্ধেক আমাদের জন্য এবং বাকী অর্ধেক কুরায়েশদের জন্য। কিন্তু কুরায়েশরা এমন কওম, যারা সীমালংঘন করে’ (ইবনু হিশাম ২/৬০০)। বালাযুরীর বর্ণনায় এসেছে,ولكن قريشًا لا يُنْصِفُونَ والسَّلامُ عليكَ ‘কিন্তু কুরায়েশরা ন্যায় বিচার করে না। আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক’ (ফুতূহুল বুলদান ৯৭ পৃঃ)। উক্ত পত্রের জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লেখেন,
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ، مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ إلَى مُسَيْلَمَةَ الْكَذَّابِ، السَّلاَمُ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى- أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ الْأَرْضَ ِللهِ يُوْرِثُهَا مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتّقِينَ-
‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে (শুরু করছি)। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে মিথ্যুক মুসায়লামার প্রতি। যে ব্যক্তি হেদায়াতের অনুসারী হয়, তার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! অতঃপর জেনে রাখা আবশ্যক যে, পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর হাতে। তিনি স্বীয় বান্দাগণের মধ্য হ’তে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী করে থাকেন। আর শুভ পরিণাম হ’ল আল্লাহভীরুদের জন্য’। ইবনু হিশাম ২/৬০১; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৩৪। লেখক ছিলেন উবাই ইবনু কা‘ব (ফুতূহুল বুলদান ৯৮ পৃঃ)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত পত্র হাবীব বিন যায়েদ বিন ‘আছেম ও আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব আসলামী (রাঃ) বহন করে নিয়ে যান। কিন্তু প্রচলিত রীতি-নীতি উপেক্ষা করে মুসায়লামা কাযযাব হাবীব বিন যায়েদ-এর দু’হাত ও দু’পা কেটে দেয়। হাবীব-এর মা ছিলেন বায়‘আতে কুবরায় অংশগ্রহণকারিণী দুইজন ভাগ্যবতী মহিলার অন্যতম বীরমাতা উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব (রাঃ)। যিনি ওহোদ যুদ্ধে যোগ দেন এবং হোদায়বিয়াতে বায়‘আতে রিযওয়ানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে যোগ দিয়ে তীর ও তরবারির ১২টি আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং একটি হাত হারান।আবুল হাসান আল-বালাযুরী (মৃ. ২৭৯ হি.), ফুতূহুল বুলদান (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ ১৪০৩/১৯৮৩) ১০২ পৃঃ ‘ইয়ামামাহ’ অধ্যায়; আল-ইছাবাহ উম্মে ‘উমারাহ ক্রমিক ১২১৭৮।
অথচ ইতিপূর্বে মুসায়লামার পত্র নিয়ে যে দু’জন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এসেছিল, তারা তাঁর সামনে চূড়ান্ত বেআদবী করা সত্ত্বেও তিনি তাদের কোনরূপ শাস্তি দেননি। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুসায়লামার দূতদ্বয় রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এলে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি আমাকে আল্লাহর রাসূল বলে সাক্ষ্য দিবে? তারা বলল,نَشْهَدُ أَنَّ مُسَيْلِمَةَ رَسُولُ اللهِ ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুসায়লামা আল্লাহর রাসূল। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন,آمَنْتُ بِاللهِ وَرُسُلِهِ ‘আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের উপর ঈমান রাখি’। অতঃপর বললেন,لَوْ كُنْتُ قَاتِلاً رَسُولاً لَقَتَلْتُكُمَا ‘যদি আমি কোন দূতকে হত্যা করতাম, তাহ’লে তোমাদের দু’জনকে হত্যা করতাম’। আহমাদ হা/৩৭৬১; দারেমী হা/২৫০৩; মিশকাত হা/৩৯৮৪, হাদীছ ছহীহ সনদ যঈফ-আরনাঊত্ব; ইবনু হিশাম ২/৬০০। দারেমীর বর্ণনায় এসেছে, وَفْدًا আবুদাঊদের বর্ণনায় এসেছে, أَمَا وَاللهِ لَوْلاَ أَنَّ الرُّسُلَ لاَ تُقْتَلُ لَضَرَبْتُ أَعْنَاقَكُمَا ‘আল্লাহর কসম! যদি দূতদের হত্যা করা বিধি বহির্ভূত না হ’ত, তাহ’লে অবশ্যই আমি তোমাদের দু’জনের গর্দান উড়িয়ে দিতাম’ (আবুদাঊদ হা/২৭৬১)।
দুই ভন্ডনবীর অবস্থা (عاقبت المتنبيَيْن الكاذبين) :
আল্লাহপাক ভন্ডনবী মুসায়লামাকে দুনিয়াতেই এর শাস্তি দেন এভাবে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১২ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে হযরত খালেদ বিন অলীদকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয় এবং হযরত হামযা (রাঃ)-এর হত্যাকারী ওয়াহশী বিন হারব, যিনি তখন উত্তম মুসলমান ছিলেন, তার হাতেই এই ভন্ডনবী নিহত হয়। ওয়াহ্শী তাই প্রায়ই বলতেন, কাফের অবস্থায় আমি একজন শ্রেষ্ঠ মুসলমানকে হত্যা করেছিলাম। মুসলমান হওয়ার পরে আমি একজন নিকৃষ্টতম কাফেরকে হত্যা করেছি (ইবনু হিশাম ২/৭২-৭৩)।
অতঃপর দ্বিতীয় ভন্ডনবী ইয়ামনের আসওয়াদ ‘আনাসী, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ওফাতের মাত্র একদিন ও একরাত পূর্বে ফীরোয (রাঃ) তাকে হত্যা করেন। সে খবর সাথে সাথে অহী মারফত রাসূল (ছাঃ)-কে জানানো হয় এবং তিনি বিষয়টি ছাহাবীদের জানিয়ে দেন’। বুখারী হা/৪৩৭৯; ফাৎহুল বারী হা/৪৩৭৮-এর আলোচনা; আর-রাহীক্ব ৪৫৩ পৃঃ।
[শিক্ষণীয় : (১) দূতকে অসম্মান করা যায় না বা হত্যা করা যায় না। (২) নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়া নিষিদ্ধ। (৩) উপরে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীতে আবুবকর (রাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। কেননা তাঁর আমলেই রিদ্দার যুদ্ধে মুসায়লামা কাযযাব নিহত হয়। (৪) ইসলামী দাওয়াতের লক্ষ্য হ’ল আখেরাত লাভ, দুনিয়া উপার্জন নয়। কিন্তু ভন্ডরা চিরকাল দুনিয়াকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।]