সূরা মায়েদাঃ ৪র্থ রুকু (আয়াত সংখ্যা ২০-২৬)

সূরা মায়েদাঃ ৪র্থ রুকু (আয়াত সংখ্যা ২০-২৬)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

৫:২০ وَ اِذۡ قَالَ مُوۡسٰی لِقَوۡمِهٖ یٰقَوۡمِ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَۃَ اللّٰهِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ جَعَلَ فِیۡکُمۡ اَنۡۢبِیَآءَ وَ جَعَلَکُمۡ مُّلُوۡکًا ٭ۖ وَّ اٰتٰىکُمۡ مَّا لَمۡ یُؤۡتِ اَحَدًا مِّنَ الۡعٰلَمِیۡنَ

আর স্মরণ করুন যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর যখন তিনি তোমাদের মধ্যে নবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে রাজা-বাদশাহ করেছিলেন এবং সৃষ্টিকুলের কাউকেও তিনি যা দেননি তা তোমাদেরকে দিয়েছিলেন।

আলোচ্য আয়াতসমূহে বনী-ইসরাঈলের একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। ঘটনাটি এই যে, ফিরআউন ও তার সৈন্যবাহিনী যখন সমুদ্রে নিমজ্জিত হয় এবং মূসা আলাইহিস সালাম ও তার সম্প্রদায় বনী-ইসরাঈল ফিরআউনের দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ করে তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে কিছু নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং তাদের পৈতৃক দেশ শামদেশকেও তাদের অধিকারে প্রত্যার্পণ করতে চাইলেন। সেমতে মূসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে তাদেরকে জিহাদের উদ্দেশ্যে পবিত্র ভূমি শাম (বর্তমান সিরিয়া, ফিলিস্তীন তথা বাইতুল মুকাদ্দাস) এলাকায় প্রবেশ করতে নির্দেশ দেয়া হল। সাথে সাথে তাদেরকে আগাম সুসংবাদও দেয়া হল যে, এ জিহাদে তারাই বিজয়ী হবে। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা এ পবিত্র ভূমির আধিপত্য তাদের ভাগ্যে লিখে দিয়েছেন যা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।

কিন্তু বনী-ইসরাঈল প্রকৃতিগত হীনতার কারণে আল্লাহর বহু নেয়ামত তথা ফিরআউনের সাগরডুবি ও তাদের মিসর অধিকার ইত্যাদি স্বচক্ষে দেখেও এক্ষেত্রে অঙ্গীকার পালনের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে সক্ষম হল না। তারা জিহাদ সম্পর্কিত আল্লাহ্ তা’আলার এ নির্দেশের বিরুদ্ধে অন্যায় জেদ ধরে বসে রইল। পরিণতিতে তারা চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত একটি সীমাবদ্ধ এলাকায় অবরুদ্ধ ও বন্দী হয়ে রইল। বাহ্যতঃ তাদের চারপাশে কোন বাধার প্রাচীর ছিল না এবং তাদের হাত-পা শেকলে বাধা ছিল না; বরং তারা ছিল উন্মুক্ত প্রান্তরে

তারা স্বদেশে অর্থাৎ মিসর ফিরে যাবার জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পথও চলত; কিন্তু তারা নিজেদেরকে সেখানেই দেখতে পেত, যেখান থেকে সকালে রওয়ানা হয়েছিল। ইত্যবসরে মূসা ও হারূন আলাইহিমাস্ সালামের ওফাত হয়ে যায় এবং বনী-ইসরাঈল তীহ প্রান্তরেই উদভ্ৰান্তের মত ঘোরাফেরা করতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তাদের হেদায়াতের জন্য অন্য একজন নবী প্রেরণ করলেন। এমনিভাবে চল্লিশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বনী-ইসরাঈলের অবশিষ্ট বংশধর তৎকালীন নবীর নেতৃত্বে শাম দেশের সে এলাকা তথা সিরিয়া ও বায়তুলমুকাদ্দাসের জন্যে জিহাদের সংকল্প গ্রহণ করে এবং আল্লাহ্ তা’আলার ওয়াদাও পূর্ণতা লাভ করে। [ইবন কাসীর]

এখানে বনী ইসরাঈলের অতীত গৌরবের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে৷ হযরত মূসা আলাইহিস সালামের বহু পূর্বে কোন এক সময়ে তারা এ গৌরবের অধিকারী ছিল৷ একদিকে তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসহাক, হযরত ইয়াকুব ও হযরত ইউসুফের মতো নবী ও রসূলগণ এবং অন্যদিকে তারা হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের আমলে ও তার পরবর্তী কালে মিসরে ব্যাপক শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েছিল৷ দীর্ঘকাল পর্যন্ত তারাই ছিল তৎকালীন সভ্য জগতের সবচেয়ে প্রতাপশালী শাসক শক্তি এবং মিসর ও তার আশপাশের দেশে তাদেরই মুদ্রা প্রচলিত ছিল৷ সাধারণত ঐতিহাসিকগণ বনী ইসরাঈলের উত্থানের ইতিহাস শুরু করেন হযরত মূসার (আ) আমল থেকে৷ কিন্তু কুরআন এখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করছে যে, বনী ইসরাঈলের উত্থানের আসল যুগটি ছিল হযরত মূসার পূর্বে এবং হযরত মূসা নিজেই তার জাতির সামনে তাদের এ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন৷

আল্লাহ বলেনঃ “তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতকে স্বরণ কর। তিনি তোমাদের মধ্যে অনেক নবী পাঠিয়েছেন, তোমাদেরকে রাজ্যের অধিপতি করেছেন এবং তোমাদেরকে এমন নেয়ামত দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের কেউ পায়নি”।

এতে তিনটি নেয়ামতের কথা বর্ণিত হয়েছে।

একটি ঈমানী নেয়ামত; অর্থাৎ তার সম্প্রদায়ে অব্যাহতভাবে বহু নবী প্রেরণ। এর চাইতে বড় সম্মান আর কিছু হতে পারে না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইসরাইল বংশীয়দেরকে নবীরা শাসন করতেন। যখনই কোন নবী মারা যেত, তখনই অন্য নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। [বুখারী ৩৪৫৫; মুসলিম: ১৮৪২]

আয়াতে বর্ণিত দ্বিতীয় নেয়ামতটি হচ্ছে পার্থিব ও বাহ্যিক। অর্থাৎ তাদেরকে রাজ্য দান। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বনী-ইসরাঈল সুদীর্ঘ কাল ফিরআউন ও ফিরআউন বংশীয়দের ক্রীতদাসরূপে দিনরাত অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল। আজ আল্লাহ্ তাআলা ফিরআউন ও তার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে বনী-ইসরাঈলকে তার রাজ্যের অধিপতি করে দিয়েছেন।

অথবা, এখানে রাজ্যদান বলতে রাজার হাল বোঝানো হয়েছে। কারণ, ইসরাইল বংশীয়দের মধ্যে ইউসুফ আলাইহিস সালাম ব্যতীত তখনও আর কেউ রাজা হন নি। তাই এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, তারা খুবই অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ছিল। তারা রাজার হালে থাকত। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তারা বাড়ী, নারী ও দাস-দাসী নিয়ে জীবন যাপন করত বলেই তাদেরকে রাজা বলা হয়েছে। [ইবন কাসীর]

তৃতীয় নেয়ামত বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার নেয়ামতের সমষ্টি। বলা হয়েছেঃ তোমাদেরকে এমনসব নেয়ামত দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের আর কাউকে দেননি। আভ্যন্তরীণ সম্মান, নবুওয়াত এবং রেসালাতও এর অন্তর্ভুক্ত।

আয়াতের শেষ অংশটিতে ঐ সকল অনুগ্রহ ও অলৌকিক ঘটনাবলীর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা বানী ইস্রাঈলকে দান করা হয়েছিল। যেমন, ‘মান্ন্ ও সালওয়া’র অবতরণ, মেঘমালার ছায়াদান এবং ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তির জন্য সাগরের মাঝে রাস্তা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এই দিক দিয়ে এই জাতি নিজ যুগে মাহাত্ম্য ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানে ছিল। কিন্তু শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনের পর ঐ মাহাত্ম্য ও মর্যাদার অধিকারী শুধুমাত্র উম্মতে মুহাম্মাদী হয়ে গেল। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, {كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاس} অর্থাৎ, তোমরাই মানবমন্ডলীর জন্যে শ্রেষ্ঠতম সম্প্রদায়রূপে সমুদ্ভূত হয়েছ। তবে হ্যাঁ, এই মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তখনই হওয়া যাবে, যখন পরে বর্ণিত অংশের উপর আমল করা হবে। আল্লাহ বলেন, {تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِالله} অর্থাৎ, তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দেবে, মন্দ কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। (সূরা আলে ইমরান ১১০) মহান আল্লাহর নিকট আকুল প্রার্থনা যে, তিনি যেন মুসলিম উম্মাহকে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার তাওফীক দান করেন; যাতে তাঁরা শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যকে অক্ষয় ও অম্লান রাখতে পারে।

৫:২১ یٰقَوۡمِ ادۡخُلُوا الۡاَرۡضَ الۡمُقَدَّسَۃَ الَّتِیۡ کَتَبَ اللّٰهُ لَکُمۡ وَ لَا تَرۡتَدُّوۡا عَلٰۤی اَدۡبَارِکُمۡ فَتَنۡقَلِبُوۡا خٰسِرِیۡنَ

হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি লিখে দিয়েছেন তাতে তোমরা প্রবেশ কর এবং পশ্চাদপসরণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।

৫:২২ قَالُوۡا یٰمُوۡسٰۤی اِنَّ فِیۡهَا قَوۡمًا جَبَّارِیۡنَ ٭ۖ وَ اِنَّا لَنۡ نَّدۡخُلَهَا حَتّٰی یَخۡرُجُوۡا مِنۡهَا ۚ فَاِنۡ یَّخۡرُجُوۡا مِنۡهَا فَاِنَّا دٰخِلُوۡنَ

তারা বলল, হে মূসা! নিশ্চয় সেখানে এক দুর্দান্ত সম্প্রদায় রয়েছে এবং তারা সে স্থান থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত আমরা কখনোই সেখানে কিছুতেই প্রবেশ করব না। অতঃপর তারা সেখান থেকে বের হয়ে গেলে তবে নিশ্চয় আমরা সেখানে প্রবেশ করব।

৫:২৩ قَالَ رَجُلٰنِ مِنَ الَّذِیۡنَ یَخَافُوۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِمَا ادۡخُلُوۡا عَلَیۡهِمُ الۡبَابَ ۚ فَاِذَا دَخَلۡتُمُوۡهُ فَاِنَّکُمۡ غٰلِبُوۡنَ ۬ۚ وَ عَلَی اللّٰهِ فَتَوَکَّلُوۡۤا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ

যারা ভয় করত তাদের মধ্যে দুজন, যাদের প্রতি আল্লাহ্‌ অনুগ্রহ করেছিলেন, তারা বলল, তোমরা তাদের মুকাবেলা করে দরজায় প্রবেশ কর, প্রবেশ করলেই তোমরা জয়ী হবে এবং আল্লাহ্‌র উপরই তোমরা নির্ভর কর যদি তোমরা মুমিন হও।

৫:২৪ قَالُوۡا یٰمُوۡسٰۤی اِنَّا لَنۡ نَّدۡخُلَهَاۤ اَبَدًا مَّا دَامُوۡا فِیۡهَا فَاذۡهَبۡ اَنۡتَ وَ رَبُّکَ فَقَاتِلَاۤ اِنَّا هٰهُنَا قٰعِدُوۡنَ

তারা বলল, “হে মূসা তারা যতক্ষণ সেখানে থাকবে ততক্ষণ আমরা সেখানে কখনো প্রবেশ করব না; কাজেই তুমি আর তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর। নিশ্চয় আমরা এখানেই বসে থাকব।

এখানে পবিত্র ভূমি বলতে কোন ভূমি বোঝানো হয়েছে, এ প্রশ্নে তাফসীরবিদগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। কারো মতে বায়তুল-মুকাদ্দাস, কারো মতে কুদস শহর ও ইলিয়া এবং কেউ কেউ বলেন, আরিহা শহর- যা জর্দান নদী ও বায়তুল মুকাদ্দাসের মধ্যস্থলে বিশ্বের একটি প্রাচীনতম শহর যা পূর্বেও ছিল এবং এখনও আছে। কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে যে, পবিত্র ভূমি বলে দামেস্ক ও ফিলিস্তিনকে এবং কারো মতে জর্দানকে বোঝানো হয়েছে। কাতাদাহ বলেনঃ সমগ্র শামই পবিত্র ভূমি। [ইবন কাসীর, আত-তাফসীরুস সহীহ]

হযরত মূসা তাঁর জাতিকে নিয়ে মিসর থেকে বের হবার প্রায় দু’বছর পর যখন তাদের সাথে ফারানের মরু অঞ্চলে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করছিলেন তখনই এ ভাষণটি দেন৷ এ মরু অঞ্চলটি উত্তরে ও ফিলিস্তিনের দক্ষিণ সীমান্ত সংশ্লিষ্ট সাইনা উপদ্বীপে অবস্থিত।

আল্লাহ্ তা’আলা মূসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে বনী-ইসরাঈলকে আমালেকা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শামদেশ দখল করতে বলেছিলেন। সাথে সাথে এ সুসংবাদও দিয়েছিলেন যে, এ পবিত্র ভূখণ্ড তাদের জন্যে লেখা হয়ে গেছে। কাজেই তোমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। তা সত্বেও বনী-ইসরাঈল চিরাচরিত ঔদ্ধত্য ও বক্র স্বভাবের কারণে এ নির্দেশ পালনে স্বীকৃত হল না; বরং মূসা আলাইহিস সালামকে বললঃ হে মূসা, এ দেশে প্রবল পরাক্রান্ত জাতি বাস করে। যতদিন এ দেশ তাদের দখলে থাকবে, ততদিন আমরা সেখানে প্রবেশ করব না।

যদি তারা অন্য কোথাও চলে যায়, তবে আমরা সেখানে যেতে পারি। বিভিন্ন তাফসীরে এসেছে, তখন সিরিয়া ও বায়তুল-মুকাদ্দাস আমালেকা সম্প্রদায়ের দখলে ছিল। তারা ছিল আদ সম্প্রদায়ের একটি শাখা। দৈহিক দিক দিয়ে তারা অত্যন্ত সুঠাম, বলিষ্ঠ ও ভয়াবহ আকৃতিবিশিষ্ট ছিল। তাদের সাথেই জিহাদ করে বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার করার নির্দেশ মূসা আলাইহিস সালাম ও তার সম্প্রদায়কে দেয়া হয়েছিল। মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ্‌র নির্দেশ পালনের জন্য বনী ইসরাঈলকে সঙ্গে নিয়ে শাম দেশ অভিমুখে রওয়ানা হলেন।

কিন্তু বনী-ইসরাঈল যেখানে নবীর কথার প্রতিই কর্ণপাত করল না, সেখানে তাদের উপদেশের আর মূল্য কি? তারা পূর্বের জবাবেরই আরও বিশ্রী ভঙ্গিতে পুনরাবৃত্তি করে বললঃ “আপনি ও আপনার আল্লাহ উভয়ে গিয়েই যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব”। কথাটি অত্যন্ত বিশ্রী ও পীড়াদায়ক। এ কারণেই তাদের এ বাক্যটি প্রবাদ বাক্যের রূপ পরিগ্রহ করেছে। বদরযুদ্ধে নিরস্ত্র ও ক্ষুধার্ত মুসলিমদের মোকাবেলায় কাফেরদের এক হাজার সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তুত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দৃশ্য দেখে আল্লাহর দরবারে দোআ করতে লাগলেন। এতে সাহাবী মিকদাদ ইবন আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ আল্লাহর কসম, আমরা কস্মিন কালেও ঐকথা বলব না, যা মূসা আলাইহিস সালামকে তার স্বজাতি বলেছিল; বরং আমরা আপনার ডানে, বামে, সামনে ও পেছনে থেকে শক্রর আক্রমণ প্রতিহত করব। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। [বুখারীঃ ৩৭৩৬]

‘ভীরু লোকদের মধ্য থেকে দু’জন বললো’-এ বাক্যাংশটির দু’টি অর্থ হতে পারে৷

এক, যারা শক্তিশালীদেকে ভয় করছিল তাদের মধ্য থেকে দু’জন বলে উঠলো৷

দুই, যারা আল্লাহকে ভয় করতো তাদের মধ্য থেকে দু’জন বলে উঠলো৷

৫:২৫ قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ لَاۤ اَمۡلِکُ اِلَّا نَفۡسِیۡ وَ اَخِیۡ فَافۡرُقۡ بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَ الۡقَوۡمِ الۡفٰسِقِیۡنَ

তিনি বললেন, হে আমার রব! আমি ও আমার ভাই ছাড়া আর কারো উপর আমার অধিকার নেই, সুতরাং আপনি আমাদের ও ফাসিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ করে দিন।

৫:২৬ قَالَ فَاِنَّهَا مُحَرَّمَۃٌ عَلَیۡهِمۡ اَرۡبَعِیۡنَ سَنَۃً ۚ یَتِیۡهُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ فَلَا تَاۡسَ عَلَی الۡقَوۡمِ الۡفٰسِقِیۡنَ

আল্লাহ বললেন, তবে তা’ চল্লিশ বছর তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হল, তারা যমীনে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে, কাজেই আপনি ফাসিক সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করবেন না

এই ভূ-পৃষ্ঠকে ময়দানে ‘তীহ’ বলা হয়। (‘তীহ’ গোলক-ধাঁধার ময়দানকে বলে।) এই ময়দানে চল্লিশ বছর পর্যন্ত এই জাতি নিজেদের বিদ্রোহের ও জিহাদ থেকে বিমুখতা অবলম্বন করার কারণে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এর পরেও (আল্লাহর পক্ষ থেকে) এই ময়দানে ‘মান্ন্’ ও ‘সালওয়া’ অবতরণ হয়। যা (খেতে খেতে) বিরক্ত হয়ে তারা তাদের নবী (মূসা (আঃ))-কে বলে, ‘প্রতিদিন একই খাবার খাওয়ার কারণে আমাদের অরুচি হয়ে গেছে। অতএব আপনি আপনার প্রভুর নিকট দু’আ করুন যে, তিনি যেন আমাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সবজী ও ডাল উৎপন্ন করেন।’ এই ময়দানেই তাদের উপর মেঘ দ্বারা ছায়া দান করা হয়। এখানেই মূসা (আঃ) লাঠি দ্বারা পাথরকে আঘাত করলে বারো গোত্রের জন্য বারোটি ঝর্ণা নিঃসৃত হয় এবং অনুরূপ তারা আরো বহুভাবে নিয়ামতপ্রাপ্ত হতে থাকে। পরিশেষে চল্লিশ বছর পর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, তখন তারা বায়তুল মাকদিস প্রবেশ করে।

নবী (মূসা (আঃ) দাওয়াত ও তাবলীগ করার পর যখন দেখেন যে, তাঁর গোত্র সোজা ও সরল পথ অবলম্বনে প্রস্তুত নয়; যার মধ্যে তাদের ইহকাল ও পরকালে কল্যাণ ও মঙ্গল রয়েছে, তখন প্রকৃতিগতভাবে তিনি বড় আক্ষেপ ও আন্তরিকভাবে দুঃখ-দুশ্চিন্তার শিকার হয়ে পড়েন। ঠিক একই অবস্থা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর হত, যা কুরআন কারীমে বিভিন্ন জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে মূসা (আঃ)-কে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে যে, যখন তুমি তাবলীগের গুরুভার আদায় করেছ এবং আল্লাহর পয়গাম লোকদের নিকট পৌঁছে দিয়েছ, তুমি তোমার জাতিকে এক মহান সফলতার দ্বার প্রান্তে উপস্থিত করেছ, কিন্তু তারা তাদের হীনমন্যতা ও দুর্মতির কারণে তোমার কথা মান্য করে না, তখন তুমি তোমার কর্তব্য পালনের দায়িত্ব হতে নিষ্কৃতি পেয়ে গেছ। সুতরাং তোমাকে এ ব্যাপারে দুঃখিত ও চিন্তিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এমন পরিস্থিতিতে দুঃখিত ও চিন্তিত হওয়াটা একটা প্রকৃতগত ব্যাপার ছিল। কিন্তু সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্য এই ছিল যে, দাওয়াত ও তাবলীগের পর আল্লাহর নিকটে তুমি দায়িত্বমুক্ত।

সংগ্রহে-

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন