সূরা মায়েদাঃ ১৪তম রুকু (আয়াত সংখ্যাঃ ১০১-১০৮)

সূরা মায়েদাঃ ১৪তম রুকু (আয়াত সংখ্যা ১০১-১০৮)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

৫:১০১ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَسۡـَٔلُوۡا عَنۡ اَشۡیَآءَ اِنۡ تُبۡدَ لَکُمۡ تَسُؤۡکُمۡ ۚ وَ اِنۡ تَسۡـَٔلُوۡا عَنۡهَا حِیۡنَ یُنَزَّلُ الۡقُرۡاٰنُ تُبۡدَ لَکُمۡ ؕ عَفَا اللّٰهُ عَنۡهَا ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ حَلِیۡمٌ ﴿

১০১. হে মুমিনগণ! তোমরা সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করো না যা তোমাদের কাছে প্রকাশ হলে তা তোমাদেরকে কষ্ট দেবে। আর কুরআন নাযিলের সময় তোমরা যদি সেসব বিষয়ে প্রশ্ন কর তবে তা তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হবে। আল্লাহ সেসব ক্ষমা করেছেন এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।

আলোচ্য আয়াতসমূহে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, কিছু সংখ্যক লোক আল্লাহর বিধিবিধানে অনাবশ্যক চুলচেরা ঘাটাঘাটি করতে আগ্রহী হয়ে থাকে এবং যেসব বিধান দেয়া হয়নি সেগুলো নিয়ে বিনা প্রয়োজনে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন তুলতে থাকে। আয়াতে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন এরূপ প্রশ্ন না করে, যার ফলশ্রুতিতে তারা কষ্টে পতিত হবে কিংবা গোপন রহস্য ফাঁস হওয়ার কারণে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধী ঐ ব্যক্তি যে এমন বস্তু সম্পর্কে প্রশ্ন করেছে, যা হারাম করা হয়নি। অতঃপর তার প্রশ্ন করার কারণে তা হারাম করে দেয়া হয়েছে। [বুখারীঃ ৭২৮৯, মুসলিমঃ ২৩৫৮]

আলোচ্য আয়াতসমূহের শানে-নুযুল এই যে, যখন হজ ফরয হওয়া সম্পর্কিত আদেশ নাযিল হয়, তখন আকরা ইবন হাবেস রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রশ্ন করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের জন্য কি প্রতি বছরই হজ করা ফরয? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। প্রশ্নকারী পুনর্বার প্রশ্ন করলেন। তিনি তবুও চুপ। প্রশ্নকারী তৃতীয় বার প্রশ্ন করলে তিনি শাসনের সুরে বললেন, যদি আমি তোমার উত্তরে বলে দিতাম যে, হ্যাঁ প্রতি বছরই হজ্জ ফরয, তবে তাই হয়ে যেত। কিন্তু তুমি এ আদেশ পালন করতে পারতে না। অতঃপর তিনি বললেন, যেসব বিষয় সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে কোন নির্দেশ দেইনা, সেগুলোকে সেভাবেই থাকতে দাও- ঘাটাঘাটি করে প্রশ্ন করো না। তোমাদের পূর্বে কোন কোন উম্মত বেশী প্রশ্ন করে সেগুলোকে ফরয করিয়ে নিয়েছিল এবং পরে সেগুলোর বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হয়েছিল। আমি যে কাজের আদেশ দেই, সাধ্যানুযায়ী তা পালন করা এবং যে কাজ নিষেধ করি, তা পরিত্যাগ করাই তোমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। [মুসলিম: ১৩৩৭]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে এক অভূতপূর্ব ভাষণে বললেন, যদি তোমরা জানতে, যা আমি জানি তবে তোমরা অল্প হাসতে এবং বেশী করে কাঁদতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ মুখ ঢেকে কান্না আরম্ভ করলেন। তখন এক লোক ডেকে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার বাবা কে? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ অমুক। তখন এ আয়াত নাযিল হল। [বুখারীঃ ৪৬২১, মুসলিমঃ ২৩৫৯]

অপর আরেক বর্ণনায় এসেছে, কিছু লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে ঠাট্টা করে প্রশ্ন করত। কেউ কেউ বলতঃ আমার বাবা কে? কেউ বলতঃ আমার উট হারিয়ে গেছে, তা কোথায় আছে? এসব ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয়। [বুখারীঃ ৪৬২২]

বলা হয়েছে, কুরআন অবতরণকালে যদি তোমরা এরূপ প্রশ্ন কর, যাতে কোন বিধান বুঝতে তোমাদের সমস্যা হচ্ছে, তবে ওহীর মাধ্যমে উত্তর এসে যাবে, যা একান্তই সহজ বিষয়। কিন্তু যদি অন্য সময় হয়, তবে তোমাদের উচিত এ ব্যাপারে চুপ থাকা। [সা’দী, ইবন কাসীর] কোন কোন মুফাসসির বলেন, আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যখন কুরআন নাযিল হচ্ছে, তখন তোমাদের প্রশ্নের উত্তর আসবেই। কিন্তু তোমরা নিজেরা নতুন করে প্রশ্ন করতে যেও না; কারণ, এতে করে তোমাদের উপর কোন কঠিন বিধান এসে যেতে পারে। [ইবন কাসীর]

এতে ‘কুরআন অবতরণকাল’ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কুরআন অবতরণ সমাপ্ত হলে নবুওয়াত ও ওহীর আগমনও বন্ধ করে দেয়া হবে। নবুওয়াতের আগমন খতম হয়ে যাওয়া ও ওহীর আগমন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এ ধরনের প্রশ্নের ফলে যদিও নতুন কোন বিধান আসবে না এবং যা ফরয নয়, তা ফরয হবে না কিংবা ওহীর মাধ্যমে কারো গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে না, তথাপি অনাবশ্যক প্রশ্ন তৈরী করে সেগুলোর তথ্যানুসন্ধানে ব্যাপৃত হওয়া কিংবা অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা নবুওয়াত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধই থাকবে। কেননা, এতে করে নিজের ও অপরের সময় নষ্ট করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ মুসলিম হওয়ার একটি সৌন্দর্য এই যে, মুসলিম ব্যক্তি অনর্থক বিষয়াদি পরিত্যাগ করে। [তিরমিযীঃ ২৩১৭, ইবন মাজাহঃ ৩৯৭৬

আল কুর’আনে ইরশাদ হয়েছে-

﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ﴾

১) নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা

﴿الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ﴾

২) যারাঃ নিজেদের   নামাযে বিনয়াবনত   হয়,

﴿وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ﴾

৩) বাজে কাজ থেকে দূরে থাকে,   সূরা মুমিনুনঃ ১-৩

সুতরাং মুমিনের জীবন হবে অর্থবহ সময়ের কাজের সমন্বয়।

ইসলামের অন্যতম শিক্ষা এই যে, কোন দ্বীনী কিংবা জাগতিক উপকার লক্ষ্য না হলে যে কোন জ্ঞানানুশীলন, কর্ম অথবা কথায় ব্যাপৃত হওয়া উচিত নয়। তবে যদি কোন বিধানের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে কোন সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এসে থাকে, তবে সেটার বিস্তারিত জ্ঞান জেনে নেয়ার জন্য প্রশ্ন করা হলে সে ব্যাপারে বিশদ বর্ণনা দেয়া হবে। আর যদি কোন বিষয়ে কোন বর্ণনাই না এসে থাকে, তবে সেটার ব্যাপারে নিরবতা পালন করাই হচ্ছে সঠিক নীতি। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি যতক্ষণ কোন বিষয় পরিত্যাগ করি ততক্ষণ তোমরা আমাকে ছাড় দাও; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণ তাদের নবীদেরকে বেশী প্রশ্ন এবং বেশী বাদানুবাদের কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে।” [মুসলিম: ১৩৩৭] [ইবন কাসীর]

আবু হুরায়রা আবদুর রহমান বিন সাখরুদ দাউসি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘আমি তোমাদের যে বিষয়ে নিষেধ করেছি, তা থেকে বিরত থাকো এবং যে বিষয়ে আদেশ করেছি, তা তোমাদের সাধ্যমতো পালন করো। নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তীগণ ধ্বংস হয়েছে তাদের বেশি বেশি প্রশ্ন করা ও তাদের নবীগণের সঙ্গে মতবিরোধ করার কারণে। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৩৮৮)

আয়াতের দুটি অর্থ হতে পারে, এক. আল্লাহ তোমাদের অতীতের প্রশ্নগুলোর কারণে পাকড়াও করা ক্ষমা করেছেন। [জালালাইন] দুই. যে সমস্ত বিষয়ে তোমরা প্রশ্ন করছ আল্লাহ তা’আলা সেগুলোর বর্ণনা করা ছেড়ে দিয়েছেন, যাতে বান্দাদেরকে এর পরিণতি থেকে নিরাপত্তা প্রদান করতে পারেন। [মুয়াসসার]

এই নিষেধাজ্ঞা কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়ে ছিল। খোদ নবী করীম (সাঃ)ও সাহাবাগণকে বেশী বেশী প্রশ্ন করতে নিষেধ করতেন। এক হাদীসে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, ‘‘মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যার প্রশ্ন করার ফলে কোন জিনিস হারাম করে দেওয়া হল, অথচ ইতিপূর্বে তা হালাল ছিল।’’ (বুখারী ৭২৮৯নং, মুসলিম) [(আর এক হাদীসে তিনি বলেন, ‘‘—আল্লাহ তোমাদের জন্য পরের কথা চর্চা, অধিকাধিক প্রশ্ন এবং অর্থ নষ্ট করাকে অপছন্দ করেছেন।’’ (বুখারী ও মুসলিম)]

৫:১০২ قَدۡ سَاَلَهَا قَوۡمٌ مِّنۡ قَبۡلِکُمۡ ثُمَّ اَصۡبَحُوۡا بِهَا کٰفِرِیۡنَ

১০২. তোমাদের আগেও এক সম্প্রদায় এ রকম প্রশ্ন করেছিল; তারপর তারা তাতে কাফির হয়ে গিয়েছিল।

অর্থাৎ তারা বিভিন্ন বিধি-বিধান চেয়ে নিয়েছিল। তারপর সেগুলোর উপর আমল করা ত্যাগ করে কুফর করেছিল। [জালালাইন] ফলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। [বাগভী] অথবা তারা বিভিন্ন বিধি-বিধান চেয়ে নিয়েছিল, তারপর সেগুলোকে মানতে অস্বীকার করেছিল, যার কারণে তারা কুফরীতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। তাই অতিরিক্ত প্রশ্নই তাদের কুফরির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। [কাশ্‌শাফ]

( সূরা বাক্বারায় গাভী যবেহ করার ঘটনায় বানী ইস্রাঈল অনর্থক প্রশ্ন করেছিল।)

ইসলামের বিধান হলো, অহেতুক ও অনাকাক্সিক্ষত বিষয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। কোনো অবস্থাতেই জানার নামে সীমালঙ্ঘন না করা। অবান্তর প্রশ্ন করে আলোচনায় আসার চেষ্টা না করা। বিতর্ক সৃষ্টির উদ্দেশে কোনো কিছু জানতে না চাওয়া। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে, বর্তমান সময়ে মানুষ দরকারি বিষয়ে খুব একটা প্রশ্ন করে না, অথচ এমন সব অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশ্ন করে, যাতে দুনিয়া ও আখেরাতে কোনো ফায়দা নেই।

জ্ঞানার্জন কিংবা অজানাকে জানার নামে প্রশ্নের অন্তরালে বাড়াবাড়িমূলক প্রশ্ন সীমালঙ্ঘন, এটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কাজের কথা ছেড়ে অকাজে লিপ্ত হওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন ও বুদ্ধিমান মানুষ তার জীবনের সীমিত এ সময় কেবল প্রয়োজনীয় কাজে খরচ করবে। সে হিসেবে যা জানা দরকার, সে সম্পর্কে অবশ্যই বিষয় সম্পর্কিত বিজ্ঞজনকে জিজ্ঞেস করবে। আর যা জানা অপ্রয়োজনীয়, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকবে। প্রশ্নোত্তরের ক্ষেত্রে এটাই মধ্যমপন্থা। এটাই কল্যাণকর অভিমত।

আরেকটি কথা, দ্বীনি বিষয়ে যার-তার কাছে কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করা। এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,

‘তোমার জানা না থাকলে জ্ঞানীজনকে জিজ্ঞেস করো।’ -সুরা নাহল : ৪৩

নবী করিম (সা.) যেসব নারী-পুরুষের প্রশংসা করেছেন, যারা দ্বিনের যথাযথভাবে চলার জন্য শরিয়তের বিধানগুলো মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে বুঝতে চাইত। তিনি বলেন, ‘আনসারি মহিলারা কতই না প্রশংসনীয়! দ্বিনের গভীর জ্ঞান অর্জনে লজ্জা-শরম তাদের জন্য কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭৭৬)

৫:১০৩ مَا جَعَلَ اللّٰهُ مِنۡۢ بَحِیۡرَۃٍ وَّ لَا سَآئِبَۃٍ وَّ لَا وَصِیۡلَۃٍ وَّ لَا حَامٍ ۙ وَّ لٰکِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یَفۡتَرُوۡنَ عَلَی اللّٰهِ الۡکَذِبَ ؕ وَ اَکۡثَرُهُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ

১০৩. বাহীরাহ, সায়েবাহ, ওহীলাহ ও হামী আল্লাহ প্রবর্তণ করেননি; কিন্তু কাফেররা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে এবং তাদের অধিকাংশই বুঝে না।

ভারবহন বা অন্য কোন কাজে লাগানো হয় না এবং তাদেরকে যবেহ করা বা তাদের সাহায্যে কোন প্রকার ফায়দা হাসিল করা হারাম মনে করা হয়, ঠিক তেমনি জাহেলী যুগে আরববাসীরাও পুণ্য কাজের নিদর্শন হিসেবে বিভিন্ন পশু ছেড়ে দিতো ৷ এ ধরনের ছেড়ে দেয়া পশুদের আলাদা আলাদা নামে আখ্যায়িত করা হতো ৷

এগুলি ঐ সকল পশুর বিভিন্ন নাম, যা আরবের বাসিন্দাগণ তাদের প্রতিমার নামে উৎসর্গ করত। এগুলির বিভিন্ন ব্যাখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে। সহীহ বুখারীতে সাঈদ বিন মুসাইয়েব কর্তৃক এইরূপ ব্যাখ্যা উল্লেখ হয়েছে,

‘বাহীরা’ ঐ জন্তুকে বলা হত, যার দুধ দোহন করা হত না এবং বলত যে, এ দুধ প্রতিমার জন্য। সুতরাং কোন লোকই তার ওলানে (দুধের বাঁটে) হাত লাগাত না।

‘সায়েবা’ ঐ জন্তুকে বলা হয়, যাকে মূর্তির নামে স্বাধীন ছেড়ে দেওয়া হত; না তার উপর আরোহণ করা হত আর না তার উপর কোন বোঝা বহন করা হত।

‘অস্বীলা’ ঐ উটনীকে বলা হত, যা প্রথমবার একটা মাদী বাচ্চা প্রসব করার পর দ্বিতীয় বারেও মাদী বাচ্চা প্রসব করত। (অর্থাৎ প্রথম মাদী বাচ্চার সাথে দ্বিতীয় মাদী বাচ্চা মিলিত হত এবং উভয়ের মাঝে নর বাচ্চা পার্থক্য সৃষ্টি করত না) তাহলে ঐ ধরনের উটনীকে মূর্তির নামে স্বাধীন ছেড়ে দেওয়া হত।

‘হাম’ ঐ ষাঁড় উটকে বলা হত, যার বীর্যে বহু বাচ্চা জন্মলাভ করত (এবং তার বংশ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেত), তখন তার দ্বারা বোঝা বহনের কাজ নেওয়া হত না এবং তার উপর আরোহণ করাও হত না। তাকে মূর্তির নামে স্বাধীন ছেড়ে দেওয়া হত। আর তাকে ‘হামী’ বলা হত। এই বর্ণনায় এ হাদীসও উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমর বিন আমের খুযাঈ সর্বপ্রথম মূর্তির নামে জন্তু উৎসর্গ করার প্রথা চালু করেছিল। নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘‘আমি তাকে জাহান্নামে নিজ নাড়ীভুঁড়ি নিয়ে টানাটানি করতে দেখেছি।’’ (বুখারীঃ সূরা মায়েদার তফসীর) [বুখারী ৪৬২৩; অনুরূপ মুসলিম: ২৮৫৬]

আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ এই জন্তুগুলোকে ঐভাবে শরীয়তরূপে নির্ধারণ করেননি। কেননা তিনি নযর-নিয়ায শুধু নিজের জন্যই নির্দিষ্ট করেছেন। মূর্তির নামে নযর-নিয়াযের পদ্ধতি মুশরিকদের চালু করা জঘন্য প্রথা। বলা বাহুল্য, মূর্তি ও বাতেল উপাস্যদের নামে জন্তু উৎসর্গ করা এবং নযর-নিয়ায পেশ করার ধারা আজও মুশরিকদের মাঝে বিদ্যমান। এমনকি কিছু নামধারী মুসলিমদের মাঝেও এই শিরকী কাজ প্রচলিত। আমরা এই সমস্ত কর্ম থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি।

৫:১০৪ وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡا اِلٰی مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ وَ اِلَی الرَّسُوۡلِ قَالُوۡا حَسۡبُنَا مَا وَجَدۡنَا عَلَیۡهِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَ لَوۡ کَانَ اٰبَآؤُهُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ شَیۡئًا وَّ لَا یَهۡتَدُوۡنَ

১০৪. আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে ও রাসূলের দিকে আস, তখন তারা বলে, “আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যেটাতে পেয়েছি সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। যদিও তাদের পূর্বপুরুষরা কিছুই জানত না এবং সৎপথপ্রাপ্তও ছিল না, তবুও কি?     

“আর যখন তাদের বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার তোমরা অনুসরণ কর।’ তারা বলে, ‘(না-না) বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের যাতে (মতামত ও ধর্মাদর্শে ) পেয়েছি, তার অনুসরণ করব।’ যদিও তাদের পিতৃপুরুষগণ কিছুই বুঝত না এবং তারা সৎ পথেও ছিল না। (বাকারাহঃ ১৭০)

যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কর’, তখন তারা বলে, ‘আমাদের বাপ দাদাকে যাতে পেয়েছি, আমরা তো তাই মেনে চলব।’ যদিও শয়তান তাদেরকে দোজখ যন্ত্রণার দিকে আহবান করে (তবুও কি তারা বাপ দাদারই অনুসরণ করবে) ? সূরা লুকমানঃ ২১

“বরং ওরা বলে, আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদের এক মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমতা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে পথপ্রাপ্ত। এভাবে, তোমার পূর্বে কোন জনপদে যখনই কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী ছিল তারা বলত, ‘আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষকে এক মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।’ (প্রত্যেক সতর্ককারী) বলত, ‘তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষকে যার অনুসারী পেয়েছ, আমি যদি তোমাদের জন্য তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পথনির্দেশ আনায়ন করি, তবুও কি তোমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ ক্রব্যে? (প্রত্যুত্তরে) তারা বলত, ‘তোমরা যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি।’ সুতরাং আমি ওদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করলাম। অতএব দেখ, মিথ্যাচারীদের পরিণাম কি হয়েছে?  সূরা যুখরুফঃ ২২-২৫)

মহান আল্লাহ আরও বলেছেনঃ

“তারা আরও বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল।”  সূরা আহযাবঃ :৬৭।

মহান আল্লাহ আরও বলেছেনঃ

“তারা যখন কোন মন্দ কাজ করে, তখন বলে আমরা বাপ-দাদাকে এমনি করতে দেখেছি এবং আল্লাহও আমাদেরকে এ নির্দেশই দিয়েছেন। আল্লাহ মন্দকাজের আদেশ দেন না। এমন কথা আল্লাহর প্রতি কেন আরোপ কর, যা তোমরা জান না।” সুরা আরাফঃ ২৮।

মহান আল্লাহ আরও বলেছেনঃ

“তারা বলল, তুমি কি আমাদেরকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে দিতে এসেছ যাতে আমরা পেয়েছি আমাদের বাপ-দাদাদেরকে? আর যাতে তোমরা দুইজন এদেশের সর্দারী পেয়ে যেতে পার? আমরা তোমাদেরকে কিছুতেই মানব না।”সূরা ইউনূসঃ ৭৮।

মহান আল্লাহ বিদআতিদের আমল সম্পর্কে বলেছেনঃ

“বলুনঃ আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে। ” ***সূরা কাহফঃ ১০৩-১০৪।

৫:১০৫ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا عَلَیۡکُمۡ اَنۡفُسَکُمۡ ۚ لَا یَضُرُّکُمۡ مَّنۡ ضَلَّ اِذَا اهۡتَدَیۡتُمۡ ؕ اِلَی اللّٰهِ مَرۡجِعُکُمۡ جَمِیۡعًا فَیُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ

১০৫. হে মুমিনগণ! তোমাদের দায়িত্ব তোমাদেরই উপর। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তবে যে পথ ভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর দিকেই তোমাদের সবার প্রত্যাবর্তন; তারপর তোমরা যা করতে তিনি সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে অবহিত করবেন।

কিছু লোকের মনে বাহ্যিক এই শব্দাবলীর কারণে সংশয়ের সৃষ্টি হয় যে, নিজেকে সংশোধন করে নেওয়াই যথেষ্ট। আর সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ ধরনের ধারণা সঠিক নয়, তার কারণ হচ্ছে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফরয বিষয়।

অমুক কি করছে, অমুকের আকীদার মধ্যে কি গলদ আছে এবং অমুকের কাজে কোন কোন ধরনের দোষ-ত্রুটি আছে, সবসময় এসব দেখার পরিবর্তে মানুষের দেখা উচিত, সে নিজে কি করছে ৷ তার নিজের চিন্তাধারার এবং নিজের চরিত্র ও কার্যাবলীর কথা চিন্তা করা উচিত সেগুলো যেন খারাপ ও বরবাদ না হয়ে যায় ৷ কোন ব্যক্তি নিজে যদি আল্লাহর আনুগত্য করতে থাকে, তার ওপর আল্লাহ ও বান্দার যেসব অধিকার আরোপিত হয় সেগুলো আদায় করতে থাকে এবং সততা ও সঠিক পথ অবলম্বন করার দাবী পূর্ণ করে যেতে থাকে এবং এই সংগে সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখা তার কর্মসূচীর অপরিহার্য অংশরূপে বিবেচিত হতে থাকে, তাহলে নিশ্চিতভাবে অন্য কোন ব্যক্তির গোমরাহী ও বক্র পথে চলা তার জন্য কোন ক্ষতির কারণ হতে পারে না ৷

তাই বলে মানুষ কেবলমাত্র নিজের নাজাত ও মুক্তির কথা ভাবতে, অন্যের সংশোধন করার কথা ভাববে না, এটা নিশ্চয়ই এ আয়াতের উদ্দেশ্য নয় ৷

যদি একজন মুসলিম এই ফরয ত্যাগ করে, তাহলে পথভোলাকে কে পথ দেখাবে? (এই কাজ ত্যাগ করলে কেউ কি সৎপথে থাকতে পারে?) অথচ কুরআন শর্তারোপ করেছে যে, যদি তোমরা সৎপথে পরিচালিত হও তবে। এই আয়াতের মর্মার্থ সম্পর্কে যখন আবু বাকর (রাঃ) অবগত হলেন, তখন তিনি বললেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা আয়াতকে ভুল জায়গায় ব্যবহার করছ। আমি তো রসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘‘লোকেরা যখন কাউকে কোন পাপ কাজে লিপ্ত দেখে এবং পরিবর্তন করার পরিকল্পনা বা চেষ্টা না করে, সম্ভবতঃ আল্লাহ তাদেরকে অচিরেই আযাব দ্বারা গ্রেফতার করবেন। (আহমাদ, তিরমিযী ২১৭৮, আবু দাউদ ৪৩৩৮নং) সুতরাং আয়াতের সঠিক ভাবার্থ এই যে, তোমাদের বুঝানো সত্ত্বেও যদি তারা পাপ থেকে বিরত না থাকে এবং সৎপথ অবলম্বন না করে, তাহলে এই অবস্থায় তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না; বরং তোমরা সৎপথে আছ এবং পাপ করা হতে বিরত আছ। অবশ্য একটি অবস্থায় সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেওয়া থেকে বিরত থাকা বৈধ, যদি কেউ সে কাজে নিজের মধ্যে দুর্বলতা পায় এবং জীবননাশের আশঙ্কা থাকে, তাহলে এই অবস্থায় ‘‘তাতে যদি সক্ষম না হয়, তাহলে হৃদয় দ্বারা; আর এ হল সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক হাদীসের ভিত্তিতে অনুমতি আছে। উক্ত আয়াতও এই অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত বহন করতে পারে।

৫:১০৬ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا شَهَادَۃُ بَیۡنِکُمۡ اِذَا حَضَرَ اَحَدَکُمُ الۡمَوۡتُ حِیۡنَ الۡوَصِیَّۃِ اثۡنٰنِ ذَوَا عَدۡلٍ مِّنۡکُمۡ اَوۡ اٰخَرٰنِ مِنۡ غَیۡرِکُمۡ اِنۡ اَنۡتُمۡ ضَرَبۡتُمۡ فِی الۡاَرۡضِ فَاَصَابَتۡکُمۡ مُّصِیۡبَۃُ الۡمَوۡتِ ؕ تَحۡبِسُوۡنَهُمَا مِنۡۢ بَعۡدِ الصَّلٰوۃِ فَیُقۡسِمٰنِ بِاللّٰهِ اِنِ ارۡتَبۡتُمۡ لَا نَشۡتَرِیۡ بِهٖ ثَمَنًا وَّ لَوۡ کَانَ ذَا قُرۡبٰی ۙ وَ لَا نَکۡتُمُ شَهَادَۃَ ۙ اللّٰهِ اِنَّاۤ اِذًا لَّمِنَ الۡاٰثِمِیۡنَ

১০৬. হে মুমিনগণ! তোমাদের কারো যখন মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন ওসিয়াত করার সময় তোমাদের মধ্য থেকে দুজন ন্যায়পরায়ণ লোককে সাক্ষী রাখবে; অথবা অন্যদের (অমুসলিমদের) থেকে দু’জন সাক্ষী মনোনীত করবে, যদি তোমরা সফরে থাক এবং তোমাদেরকে মৃত্যুর বিপদ পেয়ে বসে। যদি তোমাদের সন্দেহ হয়, তবে উভয়কে সালাতের পর অপেক্ষমান রাখবে। তারপর তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে, আমরা তার বিনিময়ে কোন মূল্য গ্রহণ করব না যদি সে আত্মীয়ও হয় এবং আমরা আল্লাহর সাক্ষ্য গোপন করব না, করলে অবশ্যই আমরা পাপীদের অন্তর্ভুক্ত হব।

অসিয়ত এর আভিধানিক অর্থ আদেশ দান, ভার অর্পণ। এটি অসিয়তকারীর জীবদ্দশায় বা তার মৃত্যুর পরে পালনের জন্যও হতে পারে। শরীয়তের পরিভাষায় অসিয়ত বলতে কোন ব্যক্তি তার মৃত্যু ও পরবর্তীকালের জন্য কাউকে কোনকিছুর মালিকানা প্রদানার্থে নির্দেশ দান করাকে বুঝায়। অসিয়ত কোন সম্পত্তি বা সম্পত্তির উপযোগ হতে পারে।

‘তোমাদের মধ্য হতে’ এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন, ‘মুসলমানদের মধ্য হতে’, আবার কেউ বলেন, অসিয়তকারীর গোত্রের মধ্য হতে। অনুরূপ ‘তোমাদের ছাড়া অন্য লোকদের মধ্য হতে’ এরও দুটি ভাবার্থ হতে পারে, অর্থাৎ অমুসলিম (আহলে কিতাব) হতে পারে অথবা অসিয়তকারীর গোত্র ব্যতীত অন্য গোত্রের লোক উদ্দেশ্য হতে পারে।

কেউ যদি সফরকালে কঠিন রোগ বা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়, যাতে তার বাঁচার আশা না থাকে, তাহলে এমতাবস্থায় সফরে দু’জন ব্যক্তিকে ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী রেখে যা অসিয়ত করতে চায় করবে।

অর্থাৎ, (মৃত ব্যক্তি) অসিয়তকারীর ওয়ারেসগণের মধ্যে যদি সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, যাদেরকে অসিয়ত করা হয়েছে তারা খেয়ানত অথবা পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে এমতাবস্থায় নামাযের পর সমস্ত মানুষের সামনে তাদেরকে (আল্লাহর নামে) শপথ করানো হবে; তারা বলবে, ‘আমরা শপথের বিনিময়ে এই নশ্বর জগতের সামান্য স্বার্থ উদ্ধার করছি না; অর্থাৎ মিথ্যা শপথ করছি না।’

৫:১০৭ فَاِنۡ عُثِرَ عَلٰۤی اَنَّهُمَا اسۡتَحَقَّاۤ اِثۡمًا فَاٰخَرٰنِ یَقُوۡمٰنِ مَقَامَهُمَا مِنَ الَّذِیۡنَ اسۡتَحَقَّ عَلَیۡهِمُ الۡاَوۡلَیٰنِ فَیُقۡسِمٰنِ بِاللّٰهِ لَشَهَادَتُنَاۤ اَحَقُّ مِنۡ شَهَادَتِهِمَا وَ مَا اعۡتَدَیۡنَاۤ ۫ۖ اِنَّاۤ اِذًا لَّمِنَ الظّٰلِمِیۡنَ

১০৭. অতঃপর যদি এটা প্রকাশ হয় যে, তারা দুজন অপরাধে লিপ্ত হয়েছে তবে যাদের স্বার্থহানি ঘটেছে তাদের মধ্য থেকে নিকটতম দুজন তাদের স্থলবর্তী হবে এবং আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে বলবে, আমাদের সাক্ষ্য অবশ্যই তাদের সাক্ষ্য থেকে অধিকতর সত্য এবং আমরা সীমালঙ্ঘন করিনি, করলে অবশ্যই আমরা যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হব।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ বনী সাহমের এক লোক তামীম আদ-দারী এবং আদী ইবনে বাদ্দারের সাথে সফরে বের হলেন। পথিমধ্যে সাহমী লোকটি মারা গেল; এমন জায়গায় মারা গেল যেখানে কোন মুসলিম ছিল না। তারা দু’জন তার মীরাস নিয়ে যখন ফিরে আসল, তখন আত্মীয় স্বজনরা সোনা দিয়ে মোড়ানো একটি রুপার পাত্র খুঁজে পেল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে তাদের দু’জনকে শপথ করালে তারা এ সম্পর্কে কিছু জানে না বলে জবাব দিল। অপরদিকে এ পাত্রটি মক্কায় পাওয়া গেল এবং তারা বলল যে, আমরা তামীম এবং আদীর নিকট থেকে এ পাত্র খরিদ করেছি। অতঃপর সাহমীর পক্ষ থেকে দু’জন নিকটআত্মীয় দাঁড়িয়ে শপথ করে বলল যে, আমাদের শপথ ঐ দু’জনের শপথের চেয়ে উত্তম। এ পাত্রটি আমাদের লোকের। তখন এ আয়াতটি নাযিল হয়। [বুখারীঃ ২৭৮০, আবু দাউদঃ ৩৬০৬, তিরমিযীঃ ৩০৬০]

أوليان এটা أولى এর দ্বিবচন। যার অর্থ; অসিয়তকারীর দুই নিকটাত্মীয়। (مِنَ الَّذِيْنَ اسْتَحَقَّ عَلَيْهِم) এর অর্থঃ যাদের স্বার্থহানি ঘটেছে তাদের মধ্য হতে। ‘أوليان ’এটা ‘هما’ ঊহ্য সর্বনাম (উদ্দেশ্য)র খবর (বিধেয়) অথবা يقومان/آخران এর সর্বনামের বদল (পরিবর্ত)। যার ভাবার্থ, এই দুই নিকটাত্মীয় তাদের মিথ্যা কসমের বিরুদ্ধে শপথ করবে।

৫:১০৮ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَنۡ یَّاۡتُوۡا بِالشَّهَادَۃِ عَلٰی وَجۡهِهَاۤ اَوۡ یَخَافُوۡۤا اَنۡ تُرَدَّ اَیۡمَانٌۢ بَعۡدَ اَیۡمَانِهِمۡ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ وَ اسۡمَعُوۡا ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿

১০৮. এ পদ্ধতিই(১) বেশী নিকটতর যে, তারা সাক্ষ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করবে অথবা তারা (মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারীরা) ভয় করবে যে, তাদের (নিকটাত্মীয়দের) শপথের পর (পূর্বোক্ত) শপথ প্রত্যাখ্যান করা হবে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং শুন; আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।

এখানে সেই উপকারিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা উক্ত নির্দেশে নিহিত আছে। আর তা এই যে, উক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলে যাদেরকে অসিয়ত করা হয়েছে তারা সঠিক সঠিক সাক্ষী দেবে। কেননা, তাদের এই আশঙ্কা হবে যে, যদি আমরা খেয়ানত করি অথবা মিথ্যা বলি, অথবা পরিবর্তন করি, তাহলে এর প্রতিক্রিয়া তাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ সম্বন্ধে বুদাইল বিন আবী মারয়্যামের ঘটনা উল্লেখ করা হয়। তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে শাম সফরে ছিলেন এবং সেখানে অসুস্থ তথা মরণোন্মুখ হয়ে পড়েন। তাঁর সাথে মাল-পত্র ও চাঁদির একটি পিয়ালা ছিল; যা তিনি দুজন খ্রিষ্টানকে সমর্পণ করে নিজ আত্মীয়দের নিকট পৌঁছে দেওয়ার অসিয়ত করেন। অতঃপর তিনি মারা যান। উক্ত অসী দুইজন চাঁদির পিয়ালা বিক্রি করে অর্থ ভাগ করে নেয় এবং ফিরে এসে বাকী মাল-পত্র তাঁর ওয়ারেসদেরকে প্রত্যর্পণ করে। ঐ মাল-পত্রে একটি চিঠিও ছিল; যাতে মাল-পত্রের একটি তালিকাও ছিল। যার ভিত্তিতে চাঁদির পিয়ালা বিদ্যমান ছিল না। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা মিথ্যা কসম খেয়ে তা আত্মসাৎ না করার কথা বলল। কিন্তু পরে জানা গেল যে, তারা ঐ পিয়ালা অমুক মুদ্রা-ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছে। সুতরাং তাঁর ওয়ারেসরা ঐ অমুসলিমদের বিরুদ্ধে কসম খেয়ে ঐ পিয়ালার মূল্য আদায় করে নিল। এ বর্ণনা সনদের দিক থেকে যয়ীফ। (তিরমিযী ৩০৫৯নং) কিন্তু অন্য সনদ দ্বারা ইবনে আববাস (রাঃ) কর্তৃকও সংক্ষিপ্তাকারে উক্ত ঘটনা বর্ণিত আছে। যাকে আল্লামা আলবানী সহীহ বলেছেন। (সহীহ তিরমিযী ২৪৪৯নং)