সূরা মায়েদাঃ ১৩তম রুকু (আয়াত সংখ্যাঃ ৯৪-১০০)

সূরা মায়েদাঃ ১৩তম রুকু (আয়াত সংখ্যা ৯৪-১০০)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

৫:৯৪ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَیَبۡلُوَنَّکُمُ اللّٰهُ بِشَیۡءٍ مِّنَ الصَّیۡدِ تَنَالُهٗۤ اَیۡدِیۡکُمۡ وَ رِمَاحُکُمۡ لِیَعۡلَمَ اللّٰهُ مَنۡ یَّخَافُهٗ بِالۡغَیۡبِ ۚ فَمَنِ اعۡتَدٰی بَعۡدَ ذٰلِکَ فَلَهٗ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ

৯৪. হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন শিকারের এমন বস্তু দ্বারা যা তোমাদের হাত ও বর্শা নাগাল পায়, যাতে আল্লাহ প্রকাশ করে দেন, কে তাঁকে গায়েবের সাথে ভয় করে। কাজেই এরপর কেউ সীমালংঘন করলে তার জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে।

অর্থাৎ সহজলভ্য শিকার। কারণ, এগুলো মুহরিম ব্যক্তির আশেপাশেই থাকে। এর মাধ্যমে মুহরিম ব্যক্তির পরীক্ষা করা হয়। মুজাহিদ বলেন, এখানে ছোট ও বাচ্চা শিকারকে বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর]

এর অর্থ বড় শিকার। [ইবন কাসীর] কারণ, বড় শিকার করতেই সাধারণতঃ বর্শা ব্যবহার করতে হয়।

নিকটবর্তী শিকার অথবা ছোট জন্তু শিকার সাধারণতঃ হাত দিয়েই ধরা হত এবং দূরবর্তী ও বড় জন্তুর জন্য তীর-বল্লম ব্যবহার করা হত। সেই জন্যে এই দুয়েরই কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিকার যেমনই হোক আর যেভাবেই করা হোক, ইহরাম অবস্থায় কোন রকম শিকার করা যাবে না; যা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

মুকাতিল বলেন, মুসলিমরা যখন উমরা পালনের উদ্দেশ্যে হুদায়বিয়ায় অবস্থান করছিলেন, তখন এ আয়াত নাযিল হয়। সেখানে বন্য চতুষ্পদ জন্তু, পাখী এবং অন্যান্য শিকার তাদের অবস্থানস্থলে জমা হয়েছিল। এরূপ দৃশ্য তারা ইতোপূর্বে দেখেনি। সুতরাং ইহরামের অবস্থায় তাদেরকে শিকার করতে নিষেধ করা হয়, যাতে আল্লাহ্ তা’আলা স্পষ্ট করে দেন যে, কে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করছে, আর কে করছে না। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, আপনি শুধু তাকেই সতর্ক করতে পারেন যে ‘যিকর’ এর অনুসরণ করে এবং গায়েবের সাথে রহমানকে ভয় করে। অতএব তাকে আপনি ক্ষমা ও সম্মানজনক পুরস্কারের সুসংবাদ দিন। [সূরা ইয়াসীনঃ ১১] [ইবন কাসীর]

আল  কুর’আনে ইরশাদ হয়েছে—

﴿أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ﴾

লোকেরা কি মনে করে রেখেছে, “আমরা ঈমান এনেছি” কেবলমাত্র একথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে না?

﴿وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ﴾

অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি  আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন   কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক৷   সূরা আনকাবুতঃ ২-৩

﴿وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّىٰ نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ﴾

আমি তোমাদের কে অবশ্যই পরীক্ষা করবো যাতে আমি তোমাদের অবস্থা যাঁচাই করে দেখে নিতে পারি তোমাদের মধ্যে কে জিহাদকারী এবং কে ধৈর্যশীল৷ সূরা মুহাম্মদঃ৩১

কেন আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করেন? এই প্রশ্নের উত্তর কুর’আন থেকেই জানার চেষ্টা করিঃ

১. গুনাহ মাফ ও পুরস্কার প্রদান

ইবরাহীম (আ.) কে আল্লাহ প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কুরবানী করার আদেশ দিয়ে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। এ ঘটনা বর্ণনা করে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

“অতপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহীম তাকে বলল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখো। সে বললো, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম,  তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। (সূরা সাফফাত, আয়াত: ১০২-১০৫)

হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) কে প্রশ্ন করা হলো,

“মানুষের মধ্যে দুনিয়াতে কাকে বেশি পরীক্ষা করা হয়?” রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন, “নবী-রাসূলদের, তারপর ন্যায়পরায়ন বান্দাদের, তারপর তাদের অনুরূপ ব্যক্তিদের, তারপর তাদের অনুরূপ ব্যক্তিদের। একজন ব্যক্তিকে তার ন্যায়পরায়নতা ও বিশ্বাসের মাত্রা অনুপাতে পরীক্ষা করা হয়। তার বিশ্বাসের চর্চা যদি উত্তম হয়, তবে তার পরীক্ষার মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং তার বিশ্বাসের চর্চা যদি দুর্বল হয়, তবে তার পরীক্ষার মাত্রা হ্রাস করা হয়। একজন বান্দাকে ততক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়, যতক্ষণ না সে পাপমুক্ত অবস্থায় পৃথিবীতে বিচরণ করে।” (আহমদ, তিরিমিযি)

সুতরাং, পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ যেমন আমাদের গুনাহকে মাফ করিয়ে নেন, ঠিক তেমনি জীবনের পরবর্তী ধাপে আমাদের উত্তম প্রতিদান ও পুরষ্কার দান করেন।

২. পরিশুদ্ধ করা

পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ উত্তমকে মন্দ থেকে পৃথক করে নেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,

“তোমরা যে অবস্থায় আছো সে অবস্থায় আল্লাহ্ কোনোক্রমেই বিশ্বাসীদের ফেলে রাখবেন না, যে পর্যন্ত না তিনি ভালোদের থেকে মন্দদের পৃথক করেন। আর আল্লাহ্ অদৃশ্য সন্বন্ধে তোমাদের কাছে গোচরীভূত করবেন না, তবে আল্লাহ্ তাঁর রসূলদের মধ্যে থেকে যাঁকে ইচ্ছা করেন, নির্বাচিত করেন। অতএব আল্লাহ্‌তে ও তাঁর রসূলগণে ঈমান আনো। আর যদি তোমরা বিশ্বাস করো ও ভয় শ্রদ্ধা করো তবে তোমাদের জন্য রয়েছে বিরাট পুরস্কার।” (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৭৯)

৩. রবের সাথে কৃত ওয়াদার প্রমান প্রকাশ

“মানুষের উপর এমন কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্রবিন্দু থেকে, এভাবে যে, তাকে পরীক্ষা করবো অতঃপর তাকে করে দিয়েছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সে হয়তো কৃতজ্ঞ হয়, না হয় অকৃতজ্ঞ হয়।” (সূরা দাহর: ২-৩)

মূলত মানুষের প্রকৃত রূপ তার কাছে স্পষ্ট করার জন্য আল্লাহ তার বিভিন্ন পরীক্ষা গ্রহন করেন।

৪. ধৈর্যশীলদের বাছাই করা

বিপদরূপী পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ মূলত তার ধৈর্য্যশীল বান্দাদের বেছে নেন। পরীক্ষার মাধ্যমেই তিনি তাদের পৃথিবীতে উচ্চ দায়িত্ব ও মর্যাদার জন্য তৈরি করে নেন। কুরআনে বলা হয়েছে,

“এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)

এছাড়াও আরও বিভিন্ন প্রেক্ষিতে আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় পরীক্ষা নেন। আল্লাহ আমাদেরকে তার নেওয়া সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মত যোগ্য হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

৫:৯৫ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقۡتُلُوا الصَّیۡدَ وَ اَنۡتُمۡ حُرُمٌ ؕ وَ مَنۡ قَتَلَهٗ مِنۡکُمۡ مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآءٌ مِّثۡلُ مَا قَتَلَ مِنَ النَّعَمِ یَحۡکُمُ بِهٖ ذَوَا عَدۡلٍ مِّنۡکُمۡ هَدۡیًۢا بٰلِغَ الۡکَعۡبَۃِ اَوۡ کَفَّارَۃٌ طَعَامُ مَسٰکِیۡنَ اَوۡ عَدۡلُ ذٰلِکَ صِیَامًا لِّیَذُوۡقَ وَبَالَ اَمۡرِهٖ ؕ عَفَا اللّٰهُ عَمَّا سَلَفَ ؕ وَ مَنۡ عَادَ فَیَنۡتَقِمُ اللّٰهُ مِنۡهُ ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ ذُو انۡتِقَامٍ

৯৫. হে ঈমানদারগণ! ইহরামে থাকাকালে তোমরা শিকার-জন্তু হত্যা করোনা তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছে করে সেটাকে হত্য করলে যা সে হত্যা করল তার বিনিময় হচ্ছে অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু, যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দুজন ন্যায়বান লোক- কা’বাতে পাঠানো হাদঈরূপে। বা সেটার কাফফারা হবে দরিদ্রকে খাদ্য দান করা কিংবা সমান সংখ্যক সিয়াম পালন করা, যাতে সে আপন কৃতকর্মের ফল ভোগ করে। যা গত হয়েছে আল্লাহ তা ক্ষমা করেছেন। কেউ তা আবারো করলে আল্লাহ্‌ তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পাঁচ প্রকার প্রাণী আছে যা ইহরাম অবস্থায় হত্যা করলে কোন পাপ হয় না। কাক, চিল, বিচ্ছু, ইদুর এবং হিংস্র কুকুর। [বুখারীঃ ১৮২৯, মুসলিমঃ ১১৯৯]

ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এর মতে ইহরাম অবস্থায় ঐ সমস্ত জন্তু শিকার করা নিষিদ্ধ, যাদের গোশত খাওয়া হয়। পক্ষান্তরে ঐ সমস্ত স্থলচর জন্তু হত্যা করা জায়েয বা বৈধ, যাদের গোশত খাওয়া হয় না (বা হালাল নয়)।

কিন্তু অধিকাংশ উলামাগণের মতে ইহরাম অবস্থায় কোন প্রকার জন্তু শিকার করা বৈধ নয়; তার গোশত খাওয়া বৈধ হোক অথবা অবৈধ; উভয় জন্তুই এই নিষেধের অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য সেই অনিষ্টকর জন্তু (ইহরাম) অবস্থাতেও হত্যা করা বৈধ, যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আর এর সংখ্যা পাঁচটি; কাক, চিল, বিছা, ইঁদুর ও পাগলা কুকুর। (মুসলিম, মুঅত্তা ইমাম মালেক) না’ফে (রঃ)-কে সাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, সাপকে হত্যা করার ব্যাপারে তো (উলামাদের মধ্যে) কোন মতভেদই নেই। (ইবনে কাসীর) ইমাম আহমাদ, ইমাম মালেক (রঃ) ও অন্যান্য উলামদের নিকট হিংস্রজন্তু; নেকড়ে বাঘ চিতাবাঘ ও সিংহকে কামড়িয়ে দেয় এমন পাগলা কুকুরের সাথে তুলনা করে ইহরাম অবস্থায় হত্যা করার অনুমতি দিয়েছেন। (ইবনে কাসীর)

‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ শব্দ থেকে প্রতিপাদন করে কোন কোন উলামা বলেন, কেউ যদি ভুলবশতঃ অনিচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে ফেলে, তাহলে তার উপর কোন ফিদ্ইয়া (দন্ড) নেই। কিন্তু অধিকাংশ উলামাগণের মতে ভুলবশতঃ অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবেও যদি হত্যা করে ফেলে, তাহলে তার জন্য ফিদ্ইয়া আদায় করা ওয়াজেব। ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ শর্ত অধিকাংশ অবস্থার প্রেক্ষাপটে লাগানো হয়েছে, শর্ত হিসাবে নয়। ‘অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু’র ভাবার্থ হচ্ছে, আকার-আকৃতি ও দৈহিক গঠনে অনুরূপ ও সদৃশ, মূল্যে অনুরূপ নয়; যেমনটি হানাফীদের অভিমত। উদাহরণ স্বরূপ; কেউ যদি হরিণ শিকার করে ফেলে, তাহলে তার ‘অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু’ হল ছাগল আর নীল গাভীর ‘অনুরূপ গৃহপালিত জন্তু’ হল গাভী ইত্যাদি। কিন্তু যে জন্তুর সদৃশ পাওয়া দুষ্কর, তার মূল্য নির্ধারণ করে ফিদ্ইয়া স্বরূপ মক্কায় পৌঁঁছে দিতে হবে।

তারা বলবে যে, শিকারকৃত জন্তু অমুক জন্তুর সদৃশ। আর যদি তা সদৃশহীন হয় অথবা তার সদৃশ জন্তু পাওয়া দূরূহ ব্যাপার হয়, তাহলে তার পরিবর্তে মূল্য দিতে হবে। আর এই মূল্য থেকে খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে মক্কার প্রত্যেক মিসকীনের মাঝে এক মুদ (৬২৫ গ্রাম) হিসাবে বণ্টন করে দিতে হবে। হানাফীদের নিকট প্রত্যেক মিসকীনকে দুই মুদ (সওয়া এক কিলো) হিসাবে প্রদান করতে হবে।

এই ফিদ্ইয়া যদি পশু হয় অথবা তার মূল্য হয়, কা’বা শরীফ পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। আর কা’বা থেকে উদ্দেশ্য, হারামের এলাকা। (ফাতহুল ক্বাদীর) অর্থাৎ, হারামের এলাকায় বসবাসরত মিসকীনদের মাঝে তা বণ্টন করতে হবে।

أو শব্দটি এখতিয়ারের জন্য ব্যবহূত হয়েছে। অর্থাৎ, (মুহরিম ব্যক্তির) কাফফারা স্বরূপ মিসকীনকে খানা খাওয়ানো অথবা রোযা রাখার ব্যাপারে এখতিয়ার বা স্বাধীনতা রয়েছে; দুটির মধ্যে যে কোন একটা করা বৈধ। শিকারকৃত পশু হিসাবে খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে কম-বেশী হবে, অনুরূপ রোযা রাখার ব্যাপারেও কম-বেশী হবে। উদাহরণ স্বরূপ; মুহরিম যদি হরিণ শিকার করে বসে, তাহলে তার সমকক্ষ এবং সদৃশ হচ্ছে, ছাগল। আর এই ফিদ্ইয়ার পশু মক্কার হারামের মধ্যে যবেহ করতে হবে। যদি তা না পাওয়া যায়, তাহলে ইবনে আববাস (রাঃ)-এর মতে ছয়জন মিসকীনকে খানা খাওয়াতে হবে অথবা তিন দিন রোযা রাখতে হবে। যদি শিং-ওয়ালা বড় হরিণ, নীলগাভী অথবা এই ধরনের কোন জন্তু শিকার করে, তাহলে তার অনুরূপ বা সদৃশ হচ্ছে, গৃহপালিত গাভী। আর যদি তা পাওয়া না যায় অথবা এ ধরনের ফিদ্ইয়া আদায় করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে ২০ জন মিসকীনকে খানা খাওয়াতে হবে অথবা ২০ দিন রোযা রাখতে হবে। যদি এমন জন্তু যেমন (উটপাখী কিংবা জংলী গাধা ইত্যাদি) শিকার করে, যার সদৃশ হচ্ছে উট, তাহলে তা না পেলে ৩০ জন মিসকীনকে খানা খাওয়াতে হবে অথবা ৩০ দিন রোযা রাখতে হবে। (ইবনে কাসীর) তাফসীরে আহসানু বায়ান

এরপর বলা হয়েছে,এই বিধান জানার পরও যারা অবাধ্য হবে তাহলে জানা দরকার মহান আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতাও।

কেউ তা আবারো করলে আল্লাহ্‌ তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।

‘’আলাহকে ভয় কর। আর জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। বাকারাহ ১৯৬

‘’নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। বাকারাহ ২১১

‘’আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর। আলে ইমরান ১১

‘’যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধিতা করবে (তাদের জেনে রাখা দরকার) আল্লাহ শাস্তি দানে বড়ই কঠোর। সূরা আনফালঃ ১৩

‘’সতর্ক থাকো সেই ফিতনা হতে, যা বিশেষভাবে তোমাদের যালিম লোকেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না; আর জেনে রাখ! আল্লাহ শাস্তিদানে খুবই কঠোর।আনফাল ২৫

‘’আল্লাহ যাকে পথ দেখান, তাকে গুমরাহ করার কেউ নেই; আল্লাহ কি মহাশক্তিধর প্রতিশোধ গ্রহনকারী নন?’’  সূরা যুমার ৩৭

তোমার প্রতিপালকের পাকড়াও অবশ্যই বড় কঠিন।সূরা বুরুজঃ ১২

’যালিমরা যা করছে সে ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে কক্ষনো উদাসীন মনে কর না। তিনি তাদেরকে সেই দিন পর্যন্ত ঢিল দিচ্ছেন, যেদিন ভয়ে আতঙ্কে চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। আতঙ্কিত হয়ে মাথা তুলে পালাতে থাকবে, দৃষ্টি তাদের নিজেদের পানে ফিরে আসবে না, আর তাদের অন্তর উড়ে যাবে। সূরা ইবরাহিমঃ ৪২-৪৩

৫:৯৬ اُحِلَّ لَکُمۡ صَیۡدُ الۡبَحۡرِ وَ طَعَامُهٗ مَتَاعًا لَّکُمۡ وَ لِلسَّیَّارَۃِ ۚ وَ حُرِّمَ عَلَیۡکُمۡ صَیۡدُ الۡبَرِّ مَا دُمۡتُمۡ حُرُمًا ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیۡۤ اِلَیۡهِ تُحۡشَرُوۡنَ

৯৬. তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও তা খাওয়া হালাল করা হয়েছে, তোমাদের ও পর্যটকদের ভোগের জন্য। তোমরা যতক্ষণ ইহরামে থাকবে ততক্ষণ স্থলের শিকার তোমাদের জন্য হারাম। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যার কাছে তোমাদেরকে একত্র করা হবে।

صيد (শিকার) থেকে উদ্দেশ্য হচ্ছে; জীবিত প্রাণী। আর طعامه (খাদ্য) থেকে উদ্দেশ্য হচ্ছে; মৃত (মাছ ইত্যাদি) যাকে সমুদ্র, নদী বা পুকুর কিনারায় নিক্ষেপ করে অথবা যা পানির উপর ভাসে। যেমন হাদীসে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে, সমুদ্রের মৃত (প্রাণী খাওয়া) হালাল বা বৈধ।

(বিস্তারিত জানার জন্য তাফসীরে ইবনে কাসীর ও নাইনুল আওতার ইত্যাদি দেখুন।

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত , রাসূল সাঃ আমাদের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় সেনাবাহিনী আমাদের প্রেরণ করেন আমরা ছিলাম তিনশ’ । পথেই আমাদের পাথেয় নিঃশেষ হয়ে আসে ।পরে আমরা সমুদ্র তীরে উপনীত হই এবং দেখলাম উঁচু টিলার মত কি একটা দেখা গেল । আমরা সেখানে গিয়ে দেখি একটি সামুদ্রিক জন্তু (তিমি মাছ) মৃত অবস্থায় পড়ে আছে । পরে তার গোশত খাই এবং তথায় এক মাস অবস্থান করি  ।এত বড় বড় টুকরা আমরা কেটেছিলাম যে ,ঐগুলোকে গরু বলে মনে হচ্ছিল । পরে অ তার অবশিষ্ট গোশত শুকিয়ে পাথেয় বানিয়েছিলাম এবং মদীনায় পৌঁছে রাসূল সাঃ কে বললে তিনি বললেন ‘ঐ আহার্য আল্লাহ্ তোমাদের জন্যেই বের করে ছিলেন ।তোমাদের কাছে কি ওর কিছু গোশত আছে কি যা আমাকে খাওয়াতে পার ।’

কোন কোন ফিকাহ্ শাস্ত্রবিদ এ আয়াত হতে দলীল গ্রহকরেছেন যে, সমস্ত সামুদ্রিক জীব খাওয়া যেতে পারে । কোন জীবই এর বহির্ভূত নয়

প্রশ্ন: কুমির, তিমি, ব্যাঙ, কাঁকড়া, কচ্ছপ, অক্টোপাস, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি সামুদ্রিক প্রাণী কি খাওয়া কি হালাল?

উত্তর:

ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত এবং হারাম ঘোষিত প্রাণী ব্যতীত সমস্ত সকল প্রকার সামুদ্রিক প্রাণী খাওয়া হালাল। সুতরাং এ দৃষ্টিতে তিমি মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ, অক্টোপাস, শামকু, ঝিকুন ইত্যাদি সবই হালাল প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত।

আর ব্যাঙ খাওয়া সর্বসম্মতভাবে হারাম। কারণ ব্যাঙ হত্যার ব্যাপারে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে।

কুমিরের ব্যাপারটি দ্বিমত পূর্ণ। জুমহুর বা অধিকাংশ আলেমদের মতে তা হারাম।

নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরা হল:

সর্বপ্রকার সামুদ্রিক প্রাণী খাওয়া হালাল হওয়ার ব্যাপারে কুরআন-হাদিসের বক্তব্য:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

..أُحِلَّ لَكُمْ صَيْدُ الْبَحْرِ وَطَعَامُهُ

“তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও সমুদ্রের খাদ্য হালাল করা হয়েছে তোমাদের উপকারার্থে”। (সূরা মায়িদাহ: ৯৬)

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন:

قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ

“আপনি বলে দিন: যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্যে, যা সে ভক্ষণ করে; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস এটা অপবিত্র অথবা অবৈধ।” (সূরা আনআম: ৫)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:« هو الطهور ماؤه الحل ميتته »

“নদী বা সাগরের পানি পবিত্র, এবং পানিতে বসবাসকারী মৃত প্রাণীও খাওয়া বৈধ।” (তিরমিযী ৬৯, আবু দাউদ ৮৩, হাদিসটি আলবানী রহ. ইরওয়াউল গালীল গ্রন্থে সহীহ বলেছেন: ১/২১)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবী শুরাইহ বলেন; পানিতে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণী খাওয়া বৈধ।” (বুখারী ৫/২০৯১)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন:

مَا أَحَلَّ اللهُ فِىْ كِتَابِهِ فَهُوَ حَلاَلٌ وَمَا حَرَّمَ فَهُوَ حَرَامٌ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَافِيَةٌ فَاقْبَلُوْا مِنَ اللهِ الْعَافِيَةَ، فَإِنَّ اللهَ لَمْ يَكُنْ نَسِيًّا. ثُمَّ تَلاَ هَذِهِ الآيَةَ (وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا)-

‘আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে যা হালাল করেছেন তা হালাল, যা হারাম করেছেন তা হারাম, আর যে বিষয়ে তিনি নীরব থেকেছেন তা ক্ষমা। সুতরাং তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমাকে গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বিস্মৃত হন না। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন, ‘তোমার প্রতিপালক বিস্মৃত হন না’ (মারিয়াম ১৯/৬৪)।[ হাকেম, দারাকুৎনী; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২২৫৬।]

🔹 তাছাড়া ইসলামের একটি অন্যতম মূলনীতি হল, দুনিয়াবি সকল বস্তুই বৈধ যতক্ষণ না ইসলামে সে ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায়। আর কাঁকড়া, কচ্ছপ, অক্টোপাস, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি খাওয়ার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নায় নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায় না।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হল যে, উপরোক্ত সামুদ্রিক প্রাণী বৈধতার ব্যাপারে কোন বাধা নেই।এগুলোকে মাকরূহ বলাও প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। তবে কারও যদি তা খেতে রুচি না হয় তবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এগুলোকে হারাম বা মাকরূহ বলার কোন যৗক্তিকতা নাই।

ব্যাঙ খাওয়া হারামঃ

যে সকল ব্যাঙ পানি ছাড়া বাঁচে না সেগুলোও খাওয়া হারাম কেননা হাদিসে ব্যাঙ হত্যার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এ ব্যাপারে হাদিস হল: আব্দুর রহমান ইবনে উসমান রা. থেকে বর্ণিত:

أَنَّ طَبِيباً سَأَلَ رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – عَنِ الضِّفْدَعِ يَجْعَلُهَا فِي دَوَاءٍ، فَنَهَى عَنْ قَتْلِهَا. أَخْرَجَهُ أَحْمَدُ، وَصَحَّحَهُ الْحَاكِمُ في صحيح الجامع 6970 .হাদিস

“কোন চিকিৎসক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি’ ওয়া সাল্লাম কে ব্যাঙ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন এটা ঔষধে প্রয়োগ করবেন কি না? তিনি ওটা হত্যা করতে নিষেধ করলেন।” (আহমাদ ১৫৩৩০, নাসাঈ ৪৩৫৫, আবূ দাউদ ৩৮৭১, দারেমী ১৯৯৮, হাকিম ৪র্খ খণ্ড ৪১১ পৃষ্ঠা। সহীহুল জামে, হা/৬৯৭০)

আর শরীয়তের একটি মূলনীতি হল, যে প্রাণী হত্যা করা হারাম তা খাওয়াও হারাম। সেটা খাওয়া হালাল হলে তা হত্যা করা বৈধ হত।

কুমির:

কুমিরের ব্যাপারে আলেমদের মাঝে দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়। তবে ইমাম মালেক ছাড়া অন্যান্য ইমামগণ যেমন ইমাম আবু হানিফা, শাফেঈ, আহমদ বিন হাম্বল তথা অধিকাংশ ইমামদের মতে কুমির খাওয়া হারাম। কারণ এটি উভচর প্রাণী। অর্থাৎ কুমির যেমন পানিতে বসবাস করে স্থল ও বন-জঙ্গলেও বসবাস করে। সেই সাথে এটি বড় বড় দাঁত বিশিষ্ট হিংস্র প্রাণী।আর হাদিসে বড় নড় নখ বিশিষ্ট হিংস্র প্রাণী খাওয়াকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।

আবু হুরারা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

«كُلُّ ذِي نَابٍ مِنَ السِّبَاعِ، فَأَكْلُهُ حَرَامٌ» رَوَاهُ مُسْلِمٌ

“লম্বা দন্ত বিশিষ্ট সকল হিংস্র পশুর গোশত খাওয়া হারাম।” (সহীহ মুসলিম ১৯৩৩) আল্লাহু আলাম

❇ যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা দ্বারা কোন প্রাণীর গোস্ত খাওয়া ক্ষতিকর প্রমাণিত হয় তাহলে তা খাওয়া হারাম। চাই তা সামুদ্রিক হোক অথবা স্থলচর হোক।

▪ কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَلَا تَقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّـهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا

“আর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি দয়ালু।” (সূরা নিসা: ২৯)

▪ তিনি আরও বলেন:

وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ۛ

“তোমরা নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না।” (সূরা বাকারা: ১৯৫)

উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

৫:৯৭ جَعَلَ اللّٰهُ الۡکَعۡبَۃَ الۡبَیۡتَ الۡحَرَامَ قِیٰمًا لِّلنَّاسِ وَ الشَّهۡرَ الۡحَرَامَ وَ الۡهَدۡیَ وَ الۡقَلَآئِدَ ؕ ذٰلِکَ لِتَعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ یَعۡلَمُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ وَ اَنَّ اللّٰهَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ

৯৭. পবিত্র কা’বা ঘর, পবিত্র মাস, হাদঈ ও গলায় মালা পরানো পশুকে আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারিত করেছেন। এটা এ জন্য যে, তোমরা যেন জানতে পার, নিশ্চয় যা কিছু আসমানসমূহে ও যমীনে আছে আল্লাহ তা জানেন এবং নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।

কাবাগৃহকে শরীফ, সম্মানিত বা পবিত্র গৃহ এই জন্যই বলা হয় যে, তার সীমানায় শিকার করা, গাছ কাটা ইত্যাদি নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে যদি সেখানে বাপের হত্যাকারীও সামনে পড়ে যায়, তবুও তার কিছু করা যাবে না। আর কা’বাকে মানুষের স্থিতিশীলতার কারণ নির্ধারিত করা হয়েছে; যার উদ্দেশ্য হল; এর দ্বারা মক্কাবাসীর নিয়ম-শৃংখলা ও সমাজ-ব্যবস্থা ভালো থাকে এবং তাদের অর্থনৈতিক ও জৈবিক চাহিদা পূরণের উপায়ও লাভ হয়। অনুরূপ পবিত্র (রজব, যুলক্বাদাহ, যুলহিজ্জাহ ও মুহাররম) মাস এবং হারামে নিয়ে যাওয়া হাদী (গলায় কিছু বেঁধে চিহ্নিত কুরবানীর) পশুও মানুষের স্থিতিশীলতার কারণ। কেননা, উল্লিখিত সমস্ত জিনিস দ্বারাও মক্কাবাসীরা উক্ত উপকারিতা উপভোগ করে থাকে।

এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা চারটি বস্তুকে মানুষের প্রতিষ্ঠা, স্থায়িত্ব ও শান্তির কারণ বলে উল্লেখ করছেন।

প্রথমতঃ কা’বা। আরবী ভাষায় কা’বা চতুষ্কোণবিশিষ্ট গৃহকে বলা হয়। জাহেলিয়াত যুগেও আল্লাহ্ তা’আলা আরবদের মনে হারাম শরীফের সম্মান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ফলে শান্তি ও নিরাপত্তা অব্যাহত ছিল।

দ্বিতীয় বস্তুটি হচ্ছে, সম্মানিত মাস। সম্মানিত মাস বলে এখানে কারও কারও মতে, জিলহজ্জ মাস বোঝানো হয়েছে। অপর কারও কারও মতে, এর দ্বারা হারাম মাসসমূহ বোঝানো হয়েছে। আর তা হচ্ছে, রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররাম।

আরবে কাবা ঘরের মর্যাদা কেবলমাত্র একটি ইবাদতগৃহ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত ছিল না বরং নিজের কেন্দ্রীয় অবস্থান ও পবিত্রতম ভাবমূর্তির কারণে এরই ওপর সারা দেশের অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক জীবনধারায় নির্ভরশীল ছিল ৷ হজ্জ ও উমরাহর জন্য সারাদেশ কাবা ঘরের দিকে ধাবিত হতো ৷ হজ্জ উপলক্ষে এ সম্মিলনের কারণে বিশৃংখল ও বিক্ষিপ্ত আরবদের মধ্যে একটি ঐক্য সূত্র সৃষ্টি হতো ৷ বিভিন্ন অঞ্চল ও গোত্রের লোকেরা নিজেদের মধ্যে তামাদ্দুনিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করতো ৷ কাব্য সম্মেলন ও কবিতা প্রতিযোগিতার ফলে তাদের ভাষা ও সাহির্তের উন্নতি সাধিত হতো ৷ বাণিজ্যিক লেনদেনের ফলে সারাদেশের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূর্ণ হতো ৷

কারণে আরবরা বছরের এক-তৃতীয়াংশ সময় লাভ করতো শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ৷ এ সময় তাদের কাফেলা দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত অবাধে চলাফেরা করতো ৷ কুরবানীর পশু ও বিচিত্র বর্ণের ঝলমলে মালা জড়ানো পশু দলের উপস্থিতিও তাদের এ চলাফেরায় বিরাট সাহায্য যোগাতো ৷ কারণ মানত ও নযরানার আলামত হিসেবে যেসব পশুর গলায় ঝলমলে মালা শোভা পেতো তাদের দেখে ভক্তিতে আরবদের মাথা নত হয়ে আসতো ৷ এ সময় কোন লুটেরা আরব গোত্র তাদের ওপর আক্রমণ চালাবার দুঃসাহস করতো না ৷

তৃতীয় বস্তু হচ্ছে, ‘হাদঈ’। হারাম শরীফে যে জন্তুকে তামাত্তু ও কেরান হজের কারণে যবাই করতে হয়, তাকে হাদঈ বলা হয়। যে ব্যক্তির সাথে এরূপ জন্তু থাকত, সে নির্বিবাদে পথ চলতে পারত; তাকে কেউ কিছু বলত না। এভাবে কুরবানীর জন্তুও ছিল শান্তি ও নিরাপত্তার অন্যতম উপায়।

চতুর্থ বস্তুটি হচ্ছে,   ক্বলায়িদ قلائد এ শব্দটি قلادة শব্দের বহুবচন। এর অর্থ, গলার হার। আরবে প্রথা প্রচলিত ছিল যে, কেউ হজের উদ্দেশ্যে বের হলে চিহ্নস্বরূপ তার হাদঈর গলায় একটি হার পরিয়ে দিত। ফলে কেউ তাকে কোন কষ্ট দিত না। এ কারণে قلادة শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় হয়ে যায়। [ফাতহুল কাদীর]

قيام ও قوام এর অর্থ ঐসব বস্তু, যার উপর কোন বস্তুর স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। তাই (قِيَامًا لِلنَّاسِ) এর অর্থ হবে এই যে, কাবা ও তৎসম্পর্কিত বস্তুসমূহ মানুষের প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্বের কারণ এবং উপায়। এর উপরই তাদের জীবিকা ও দ্বীন নির্ভরশীল। এর মাধ্যমেই তাদের দ্বীন ও দুনিয়ার কর্মকাণ্ড সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের মধ্যে যারা ভীত তারা সেখানে নিরাপত্তা পায়। যারা ব্যবসায়ী তারা ব্যবসায় লাভবান হয়। যারা ইবাদাত করতে চায়, তারা নির্বিঘ্ন ইবাদাত করতে পারে [ফাতহুল কাদীর]

৫:৯৮ اِعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ وَ اَنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

৯৮. জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর, আর আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

৫:৯৯ مَا عَلَی الرَّسُوۡلِ اِلَّا الۡبَلٰغُ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ مَا تُبۡدُوۡنَ وَ مَا تَکۡتُمُوۡنَ

৯৯. প্রচার করাই শুধু রাসূলের কর্তব্য। আর তোমরা যা প্রকাশ কর ও গোপন রাখ আল্লাহ তা জানেন।

আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, আমার রাসূলের দায়িত্ব এতটুকই যে, তিনি আমার নির্দেশাবলী মানুষের কাছে পৌঁছে দিবেন। এরপর তা মানা না মানার লাভ ক্ষতি তারাই ভোগ করবে; তারা না মানলে আমার রাসূলের কোন ক্ষতি নেই। এ কথাও জেনো যে, আল্লাহ তা’আলাকে ধোঁকা দেয়া যাবে না। তিনি তোমাদের প্রকাশ্যে ও গোপন কাজ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। তিনি তোমাদের আমলের প্রকৃত অবস্থা জেনে সেটা অনুসারে তোমাদেরকে এর প্রতিফল দিবেন। [সা’দী]

৫:১০০ قُلۡ لَّا یَسۡتَوِی الۡخَبِیۡثُ وَ الطَّیِّبُ وَ لَوۡ اَعۡجَبَکَ کَثۡرَۃُ الۡخَبِیۡثِ ۚ فَاتَّقُوا اللّٰهَ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ

১০০. বলুন, মন্দ ও ভাল এক নয় যদিও মন্দের আধিক্য তোমাকে চমৎকৃত করে। কাজেই হে বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরা! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।

(الْخَبِيثُ وَالطَّيِّبُ) আরবী ভাষায় দুটি বিপরীত শব্দ। প্রত্যেক উৎকৃষ্ট বস্তুকে الطَّيِّب এবং প্রত্যেক নিকৃষ্ট বস্তুকে الْخَبِيث বলা হয়। অর্থাৎ কোন প্রকার خَبِيْث এর সাথেই কোন প্রকার طَيِّب এর তুলনা চলে না। আয়াতে خَبِيْث শব্দ দ্বারা হারাম ও অপবিত্র এবং طَيِّب শব্দ দ্বারা হালাল ও পবিত্র বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। অতএব, আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার দৃষ্টিতে, এমনকি প্রত্যেক সুস্থ্য বুদ্ধিমান লোকের দৃষ্টিতে, পবিত্র ও অপবিত্র এবং হালাল ও হারাম সমান হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে (الْخَبِيثُ وَالطَّيِّبُ) শব্দ দুটি স্বীয় ব্যাপকতার দিক দিয়ে হালাল ও হারাম অর্থ-সম্পদ, উত্তম ও অধম মানুষ এবং ভাল ও মন্দ কাজ-কর্ম ও চরিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাই কোন বিচারেই সৎ ও অসৎ এবং ভাল ও মন্দ সমান নয়। এ স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী আল্লাহ তা’আলার কাছ থেকে হালাল ও হারাম কিংবা পবিত্র ও অপবিত্র বস্তু সমান নয়। ঈমান ও কুফর সমান নয়। জান্নাত ও জাহান্নাম সমান নয়। আনুগত্য ও অবাধ্যতা সমান নয়। সুন্নাতের অনুসারী ও বিদাআতের অনুসারী সমান নয়। [ইবন কাসীর, সা’দী, মুয়াসাসার]

অর্থাৎ হে মানুষ যদিও খারাপ বস্তু তোমাকে চমৎকৃত করে তবুও খারাপ বস্তু ও ভালো বস্তু কখনও সমান হতে পারে না। এখানে সাধারণভাবে সকল মানুষকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [ইবন কাসীর]

অর্থাৎ যদিও মাঝে মাঝে মন্দ ও অনুৎকৃষ্ট বস্তুর প্রাচুর্য দর্শকদের বিস্মিত করে দেয় এবং আশ-পাশে মন্দ ও অপবিত্র বস্তুর ব্যাপক প্রসারের কারণে সেগুলোকেই ভাল মনে করতে থাকে, কিন্তু আসলে এটি মানুষের অবচেতন মনের একটি রোগ এবং অনুভূতির ক্রটি বিশেষ। মন্দ বস্তু কখনও ভাল হতে পারে না। সুতরাং উপকারী হালাল বস্তু স্বল্প হলেও তা অপকারী হারাম বস্তু বেশী হওয়ার চেয়ে উত্তম। [ফাতহুল কাদীর] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অল্প ও প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট জিনিস সেই অধিক জিনিস হতে উত্তম যা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ হতে গাফেল ও উদাসীন রাখে। [মুসনাদে আহমাদ ৫/১৯৭]

আয়াতটি মূল্যবোধ ও মূল্যমানের এমন একটি মানদণ্ড পেশ করে, যা স্থুলদর্শী মানুষের মানদণ্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ৷ স্থুলদর্শীর দৃষ্টিতে পাঁচ টাকার তুলনায় একশ টাকার দাম অবশ্যি অনেক বেশী ৷ কারণ একদিকে পাঁচ টাকা আর একদিকে একশ টাকা ৷ কিন্তু এ আয়াতটি বলছে, যদি আল্লাহর নাফরমানী করে একশ টাকা লাভ করা হয় তাহলে তা নাপাক ও অপবিত্র ৷ অন্যদিকে আল্লাহর হুকুম পালনের আওতায় যদি পাঁচ টাকা লাভ করা হয় তাহলে তা পাক ও পবিত্র ৷ আর অপবিত্রের পরিমাণ যত বেশীই হোক না কেন তা কোন দিন পবিত্রের সমান হতে পারবে না ৷ আবর্জনার একটি স্তূপের তুলনায় এক ফোঁটা আতরের মূল্য ও মর্যাদা অনেক বেশী ৷ এক পুকুর ভর্তি পেশাবের চাইতে সামান্য পরিমাণের পাক পবিত্র পানির মূল্য বেশী ৷ কাজেই একজন যথার্থ বুদ্ধিমান ব্যক্তির অবশ্যি হালাল জিনিস নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত, আপাত দৃষ্টিতে তার পরিমাণ যতই সামান্য হোক না কেন এবং হারামের দিকে কোন অবস্থাতেই হাত বাড়ানো উচিত নয়, বাহ্যত তা যতই বিপুল পরিমাণ ও যতই আড়ম্বরপূর্ণ হোক না কেন ৷

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে মন্দ চিহ্নিত করার এবং তা থেকে বেঁচে থাকার যে সকল উপায় দান করেছেন তার একটি হচ্ছে, বিবেকের বিচার। ব্যক্তির বিবেক ও সমাজের বিবেক। এ দুটো জিনিস মানুষকে মন্দ থেকে বিরত থাকতে সহায়তা করে। একটি হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সুন্দরভাবে বলেছেন-

الْإِثْمُ مَا حَاكَ فِي صَدْرِكَ، وَكَرِهْتَ أَنْ يَطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ

‘পাপ ঐ জিনিস যা তোমার অন্তরে বেধে আর মানুষ তা জানুক তা তুমি অপছন্দ কর।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৫৩

তাহলে বিবেকের দংশন ও সমাজের শাসন হচ্ছে এমন এক প্রয়োজনীয় বিষয় যা পাপের পথে এক বড় প্রতিবন্ধক। সুতরাং পাপের বিস্তার যদি ঘটাতে হয় তাহলে এক জরুরি কাজ, বিবেকের দংশন বিদায় করা ও সমাজের শাসন প্রতিহত করা। পক্ষান্তরে পাপের বিস্তার রোধের জন্য প্রয়োজন বিবেককে জাগ্রত করা, এবং তাকওয়া ও খোদাভীতি শক্তিশালী করা আর সমাজে আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকারের বিস্তার ঘটানো।

হালাল সুস্পষ্ট, হারামও সুস্পষ্ট। এ দুটির মাঝখানে কতিপয় জিনিস সন্দেহপূর্ণ। সেসব সম্পর্কে অনেক লোকেরই জানা নেই যে, আসলে তা হালাল না হারাম। এরূপ অবস্থায় যে ব্যক্তি স্বীয় দ্বীন ও স্বীয় মান-মর্যাদা রক্ষার জন্যে সেসব থেকে দূরে থাকে, সে নিশ্চয়ই নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তন্মধ্য থেকে কোন কিছুর সাথে জড়িয়ে পড়বে, তার পক্ষে হারামের মধ্যে পড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। যে ব্যক্তি নিজের জন্তুগুলোকে নিষিদ্ধ চারণভূমির আশে-পাশে চড়ায়, তার পক্ষে সে নিষিদ্ধ অঞ্চলের মধ্যে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তোমরা শোন, প্রত্যেক রাজা-বাদশাহরই একটি ‘সুরক্ষিত চারণভূমি’ থাকে। আরও শোন আল্লাহ্‌র হারাম করা জিনিসগুলোই তাঁর সংরক্ষিত চারণভূমি। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)

—সংগৃহিত

এই আয়াতে আল্লাহ তার রাসূল ﷺ কে বলতে নির্দেশ দিচ্ছেন যে – মন্দ এবং ভালো এক সমান নয়। প্রথমেই যেটা আমাদের বুঝতে হবে তা হলো আল্লাহ শুধু এইটুকুই বলেন নি যে, নোংরামি এবং ভালো এক জিনিস নয়, বরং তিনি তার রাসূল ﷺ কে এই ঘোষণা দিতে আদেশ করেন। কারণ রাসূল ﷺ হলেন আল্লাহর নির্বাচিত প্রতিনিধি – যিনি কোনটা ভালো কোনটা খারাপ, কোনটা গ্রহণযোগ্য, কোনটা অগ্রহণযোগ্য এই বিষয়গুলো নির্ধারণ করে দিবেন। এ ক্ষেত্রে রাসূল ﷺ ই হলেন মানদন্ড স্বরূপ।

এই ধরনের আলোচনায় আমরা প্রায় বলি যে, সিদ্ধান্ত নিবে সমাজ। সমাজই সিদ্ধান্ত নিবে কোনটা স্বাভাবিক, কোনটা অস্বাভাবিক, কিংবা কোনটা অশ্লীল আর কোনটা শ্লীল অথবা কোনটা গ্রহণযোগ্য কোনটা বর্জনীয়। কিন্তু এই সকল সীমা প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই নয় কি? তাই দেখা যায় কয়েক বছর আগেও যা ছিল অগ্রহণযোগ্য তাই সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে। যেমন, বিনোদন জগতে আগে যে মুভিটাকে ‘R’ রেটিং করা হতো পরে তা ‘PG13’ হয়েছে, তারপর ‘PG’ হয়েছে আর এখন এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। যা কিনা পঞ্চাশ বছর আগেও ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ মানদন্ড পরিবর্তনশীল। সুতরাং কতদূর পর্যন্ত আপনি পরিবর্তন করবেন? কোথায় আপনি সীমা নির্ধারণ করবেন? রাসূল ﷺ -ই হলেন সীমা নির্ধারণ করার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তার আগমনের এটি অন্যতম উদ্দেশ্য।

“তাদেরকে বলুন – ভালো ও মন্দ কখনো সমান নয়, যদিও মন্দের প্রাচুর্য তোমাকে বিস্মিত করে।” এই কথাটির প্রতি লক্ষ্য করুন, “যদিও মন্দের বিপুলতা আপনাকে অভিভূত করে ফেলে।” এমনকি যদি এটা আপনার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এর অর্থ হলো – খারাপ জিনিস হবে অগনিত এবং সর্বত্র ছড়িয়ে থাকবে, আর আপনি হয়তো আমাকে বলবেন “সবাইতো এটা করছে, সবাইতো এভাবেই কথা বলে। আপনি আবার কী বলতে চাচ্ছেন? স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখুন, এরকম অদ্ভুত কেন আপনি?”

অদ্ভুত হলো তাই যা দুষ্প্রাপ্য, যা বিস্ময়কর, অগ্রহণযোগ্য এবং বিরল। আর যা সাধারণ্যে স্বীকৃত তাকে আমরা বলে স্বাভাবিক। তাই আল্লাহ বলেন নোংরামি বা মন্দ কাজটিই একসময় সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হবে। কিন্তু এটা যত গ্রহণযোগ্যই হোক বা সমাজে যত স্বাভাবিক হোক, আপনাকে ভুললে চলবে না যে মন্দ আর ভালো কখনই এক নয়।

যা ভুল আপনার সব বন্ধুরা করতে থাকলেও তা ভুলই হবে। এমনকি যদি আপনার চারপাশে এই ভুল কাজটিই ঘটতে দেখেন, এটি কখনো সঠিক হয়ে যাবে না।(অলাও আ’জাবাকা কাস্রাতুল খাবিস – যদিও খবিসের প্রাচুর্য তোমাকে বিস্মিত করে।)

এখন কারা নোংরামি এবং বিশুদ্ধতার মাঝে পার্থক্য করতে পারবে? (ফাত্তাকুল্লাহ – আল্লাহকে ভয় কর) আল্লাহর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন কর। (ইয়া উলিল আল বাব) যারা নেক হৃদয় ও স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী। এমন মানুষ যাদের চিন্তা শক্তি সংস্কৃতির দ্বারা দূষিত হয়নি, যাদের হৃদয় অন্ধ মানসিকতার হৃদয়গ্রাহী কিন্তু অন্তঃসারশুন্য মতবাদের আক্রমনে পরাভূত হয়নি। সবাই যেহেতু এটা করছে তাহলে নিশ্চয়ই এটা ঠিক – আপনার চিন্তার ধরন এমন হতে পারে না।

এমন মানুষ আছে যারা নির্দিষ্ট কিছু অনুষ্ঠান পালন করে অথচ জানে না কেন তা পালন করে। তাদের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো ক্লু নেই। এমন কিছু ছুটির দিন আছে যা উদযাপন করতে মানুষ অধীর থাকে অথচ কেন তা উদযাপন করতে হবে, তা তাদের জানা নেই। অধিকাংশ সময় অন্যান্য মানুষকে করতে দেখেন বলে তারাও এটা করেন। বোকার মত আচরণ করবেন না। আপনাদের স্বচ্ছ, মুক্ত ও গভীর চিন্তার অধিকারী হতে হবে। (ইয়া উলিল আলবাব লা’আল্লাকুম তুফলিহুন ) ‘’হে বুদ্ধিমানগণ, যাতে তোমরা সাফল্যের ভাগীদার হও।” আপনি সবাইকে একটা কাজ করতে দেখেন আর ভাবেন নিশ্চয়ই এটা সাফল্য লাভের উপায়। কিন্তু আল্লাহ বলেন – না যত লোকই সে কাজ করুক না কেন কিংবা এ কাজের দ্বারা সাফল্য লাভ করছে বলে যতই আপনার মনে হোক না কেন, আপনার জন্য মঙ্গলজনক হলো – আপনি আল্লাহর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করবেন, চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগান এবং ভালো কাজের সংগে যুক্ত থাকুন। যদি সত্যিকারের সাফল্য লাভ করতে চান।

এই আয়াতের শেষ যে শব্দটির প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হলো – ইফ্লাহ, আল্লাহ বলেন নি “লাআল্লাকুম তাফুজুন” যাতে আপনি সফল হন, আরবিতে সাফল্য বোঝাতে অন্য একটি ক্রিয়াপদ রয়েছে। হ্যাঁ, তিনি বলেছেন ‘তুফ্লিহুন।’ আর এর মূল শব্দ ইফ্লাহ, আর ইফ্লাহ শব্দটি সেই সাফল্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয় – যেমন আপনি একটি খামার তৈরী করছেন, তাতে বীজ বুনলেন, মাটি নরম করলেন এবং পোকার সংক্রমণ ও আগাছা রোধে ব্যবস্থা নিলেন, সারা বছর জমিতে কঠোর পরিশ্রম করলেন, পরিশেষে সাফল্য পেলেন। ‘তুফলিহুন’ মানে হলো যখন আপনি কোনো কাজের পেছনে প্রচুর শ্রম দেন। অর্থাৎ আল্লাহ ইঙ্গিত করছেন যে – নোংরামির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং এমন এক দুনিয়ায় পবিত্রতার সন্ধান করা যা অপবিত্রতা দ্বারা বেষ্টিত, পবিত্রতার দৃষ্টান্ত যেখানে দুষ্প্রাপ্য, সেখানে পবিত্রতার উপর টিকে থাকতে হলে আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এই সাফল্যের জন্য মূল্য দিতে হবে। এটা এমনিতেই ঘটবে না।

এর জন্য প্রচুর শ্রম দিতে হবে, ভালো বন্ধু খুঁজে বের করতে হবে, ভালো বিনোদন, ভালো বই পড়তে হবে, সঠিক উপার্জনের উৎস খুঁজে পেতে হবে, এমনকি ভালো ও খাটি খাদ্যেরও ব্যবস্থা করতে হবে যা আসলে অনেক শ্রম সাধ্য ব্যাপার। আপনার পক্ষে এসব করা অনেক অনেক পরিশ্রমের ব্যাপার কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনি বুঝবেন যে এ কাজ পরিশ্রমেরই যোগ্য ছিল।

.এতসব কিছু করেছেন কারণ আপনি আল্লাহকে ভয় করেন, সাফল্য অর্জন করতে চেয়েছেন। আপনি কখনই আপনার চিন্তাশক্তিকে বিশৃঙ্খল হতে দেন নি, আপনি “উলিল আলবাব-বুদ্ধিমানদের” অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, স্পষ্ট ও সঠিক চিন্তার অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বারাকাল্লাহু লি ওলাকুম।▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂ লেখাঃ নোমান আলি খান (আল্লাহ্‌ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)

উলিল আলবাব কারাঃ

﴿إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ﴾

১৯০) পৃথিবী  ও আকাশের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পালাক্রমে যাওয়া আসার মধ্যে

﴿الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ﴾

যে সমস্ত বুদ্ধিমান লোক উঠতে, বসতে ও শয়নে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর গঠনাকৃতি নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করে, তাদের জন্য রয়েছে বহুতর নিদর্শন ৷১৩৫  (তারা আপনা আপনি ওঠেঃ) হে আমাদের প্রভু! এসব তুমি অনর্থক ও উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সৃষ্টি করোনি৷ বাজে ও নিরর্থক কাজ করা থেকে তুমি পাক-পবিত্র ও মুক্ত৷ আলে ইমরানঃ১৯০

আল কুর’আনে ইরশাদ হয়েছে–

فَبَشِّرْ عِبَادِ

অতএব, আমার বান্দাদেরকে সুসংবাদ দিন।

الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُوْلَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ وَأُوْلَئِكَ هُمْ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ

(আমার সেই সমস্ত বান্দাদের জন্যে সুসংবাদ), যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে, অতঃপর তারা মাঝে যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। আল্লাহ তাদেরকেই সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই হচ্ছে সত্যিকারের বুদ্ধিমান। সুরা আয-যুমারঃ ১৭-১৮।

﴿أَفَمَن يَعْلَمُ أَنَّمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ أَعْمَىٰ ۚ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ﴾

আচ্ছা তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার ওপর যে কিতাব নাযিল হয়েছে, তাকে যে ব্যক্তি সত্য মনে করে আর যে ব্যক্তি এ সত্যটির ব্যাপারে অন্ধ, তারা দু’জন সমান হবে, এটা কেমন করে সম্ভব ?  উপদেশ তো শুধু বিবেকবান লোকেরাই গ্রহণ করে৷ সূরা রাদঃ১৯

উলুল আলবাবের চরিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে—(সূরা আর রাদঃ২০-২৪)

২০) আর তাদের কর্মপদ্ধতি এমন হয় যে, তারা আল্লাহকে প্রদত্ত নিজেদের অংগীকার পালন করে এবং তাকে মজতুব করে বাঁধার পর ভেঙ্গে ফেলে না৷

২১) তাদের নীতি হয়, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন অক্ষণ্ন রাখার হুকুম দিয়েছেন৷  সেগুলো তারা অক্ষুণ্ন রাখে, নিজেদের রবকে ভয় করে এবং তাদের থেকে কড়া হিসেব না নেয়া হয় এই ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে৷

২২) তাদের অবস্থা হয় এই যে, নিজেদের রবের সন্তুষ্টির জন্য তারা সবর করে,  নামায কায়েম করে, আমার দেয়া রিযিক থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে খচর করে এবং ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করে৷ আখেরাতের গৃহ হচ্ছে তাদের জন্যই৷ অর্থাৎ এমন সব বাগান যা হবে তাদের চিরস্থায়ী আবাস৷

২৩) তারা নিজেরা তার মধ্যে প্রবেশ করবে এবং তাদের বাপ-দাদারা ও স্ত্রী-সন্তানদের মধ্য থেকে যারা সৎকর্মশীল হবে তারাও তাদের সাথে সেখানে যাবে৷ ফেরেশতারা সব দিক থেকে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আসবে

২৪) এবং তাদেরকে বলবে : “তোমাদের প্রতি শান্তি৷  তোমরা দুনিয়ায় যেভাবে সবর করে এসেছো তার বিনিময়ে আজ তোমরা এর অধিকারী হয়েছো৷”- কাজেই কতই চমৎকার এ আখেরাতের গৃহ! সূরা রাদঃ ২০-২৪

৪১:৩৪ وَ لَا تَسۡتَوِی الۡحَسَنَۃُ وَ لَا السَّیِّئَۃُ ؕ اِدۡفَعۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ فَاِذَا الَّذِیۡ بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَهٗ عَدَاوَۃٌ کَاَنَّهٗ وَلِیٌّ حَمِیۡمٌ ﴿

আর ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন তা দ্বারা যা উৎকৃষ্ট; ফলে আপনার ও যার মধ্যে শক্ৰতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। হামীম আস সাজদাঃ৩৪

সংগ্রহেঃ

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন