সূরা মায়েদাঃ ১২তম রুকু (আয়াত সংখ্যা ৮৭-৯৩)
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
৫:৮৭ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُحَرِّمُوۡا طَیِّبٰتِ مَاۤ اَحَلَّ اللّٰهُ لَکُمۡ وَ لَا تَعۡتَدُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الۡمُعۡتَدِیۡنَ
৮৭. হে মুমিনগণ! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য উৎকৃষ্ট যেসব বস্তু হালাল করেছেন সেগুলোকে তোমরা হারাম করো না, এবং সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে পছন্দ করেন না।
এ আয়াতে দু’টি কথা বলা হয়েছে ৷ এক, তোমরা নিজেরাই কোন জিনিস হালাল ও হারাম গণ্য করার অধিকারী হয়ে বসো না ৷ আল্লাহ যেটি হালাল করেছেন সেটি হালাল এবং আল্লাহ যেটি হারাম করেছেন সেটি হারাম ৷ নিজেদের ক্ষমতা বলে তোমরা নিজেরা যদি কোন হালালকে হারাম করে ফেলো তাহলে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে তোমরা নফসের ও প্রবৃত্তির আইনের অনুগত গণ্য হবে ৷
দুই, খৃষ্টীয় সন্যাসী, হিন্দু যোগী, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ইশরাকী তাসাউফ পন্থীদের মতো বৈরাগ্য, সংসার বিমুখতা ও দনিয়ার বৈধ স্বাধ আস্বাদন পরিহার করার পদ্ধতি অবলম্বন করো না ৷ ধর্মীয় মানসিকতার অধিকারী সৎস্বভাব সম্পন্ন লোকদের মধ্যে সাধারণভাবে এ প্রবণতা দেখা গেছে যে, শরীর ও প্রবৃত্তির অধিকার আদায় ও চাহিদা পূরণ করাকে তারা আধ্যাত্মিক উন্নতির অন্তরায় মনে করে থাকেন ৷ তাদের ধারণা, নিজেকে কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করা, নিজের প্রবৃত্তিকে পার্থিব ভোগ ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা এবং দুনিয়ার জীবন যাপনের বিভিন্ন উপায়-উপকরণের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা মূলত একটি মহৎ কাজ এবং এ ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যেতে পারে না ৷ সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যেও কেউ কেউ এ মানসিকতার অধিকারী ছিলেন ৷
পবিত্র রিজিক ও পোশাকের সৌন্দর্যতা পরিত্যাগ করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চাওয়া। খ্রিষ্টান ও তাদের সাদৃশ্য অবলম্বী ইসলামের দিকে সম্বন্ধকারী সূফীরাই এটা করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের উদ্দেশ্যে তারা পবিত্র জিনিসকে বর্জন করে। তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না এবং পবিত্র রিজিকও গ্রহণ করে না। আর পানাহার ও পোশাক-পরিচ্ছেদের ক্ষেত্রে তারা সন্ন্যাসী জীবন যাপন করে। তারা ধারণা করে, এভাবেই আল্লাহর ইবাদত করতে হয়। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ) [الأعراف: 32]
বল, কে হারাম করেছে আল্লাহর সৌন্দর্যোপকরণ, যা তিনি তার বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র রিযিক? (সূরা আরাফ ৭:৩২)।
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ তিনজন লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের ঘরে এসে তার ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তাদেরকে তা জানানো হলে তারা সেসবকে অল্প মনে করল এবং বলল, আমরা কোথায় আর রাসূল কোথায়? তার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে একজন বলল, আমি সারা রাত সালাত আদায় করব। অন্যজন বলল, আমি সারা বছর সিয়াম পালন করব। অপরজন বলল, আমি মহিলাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকব এবং বিয়েই করব না। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে বললেন, তোমরা এসব কথা বলেছ? জেনে রাখ, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের সবার চাইতে আল্লাহকে বেশী ভয় করি এবং বেশী তাকওয়ারও অধিকারী।
কিন্তু আমি সিয়াম পালন করি, সিয়াম থেকে বিরতও থাকি। সালাত আদায় করি আবার নিদ্রাও যাই এবং মেয়েদের বিয়েও করি। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত থেকে বিমুখ হবে সে আমার দলভুক্ত নয়। [বুখারীঃ ৫০৬৩]
অপর বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা যুদ্ধে যেতাম, আমাদের সাথে আমাদের স্ত্রীরা থাকত না। তখন আমরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলাম যে, আমরা খাসি’ হয়ে যাই না কেন? তখন আমাদেরকে এ থেকে নিষেধ করা হয়েছিল। তারপর আবদুল্লাহ এ আয়াত পাঠ করলেন। [বুখারী ৪৬১৫]
ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তার কাছে একবার খাবার নিয়ে আসা হলো। একলোক খাবার দেখে একদিকে আলাদা হয়ে গেল এবং বলল, আমি এটা খাওয়া হারাম করছি। তখন আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বললেন, কাছে আস এবং খাও। আর তোমার শপথের কাফফারা দাও। তারপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৩১৩, ৩১৪; ফাতহুল বারী ১১/৫৭৫]
পোশাক-পরিচ্ছেদ ও পানাহারের মৌলিকত্ব হচ্ছে (শরী‘আত অনুসারে) তা হালাল। কেননা, এসব জিনিস আল্লাহ তা‘আলা বান্দার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। যেমন ছ্বহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সুনদর, তিনি সৌন্দর্যতা পছন্দ করেন। তাই সতর্কতা স্বরূপ পোশাক বর্জন করা দীন ইসলাম নয়।
(ইসলাম চায়) পোশাকের সৌন্দর্যতা গ্রহণ ও পবিত্র রিজিক উপভোগ করতঃ মানুষ যেন আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে। হাদীছে বর্ণিত আছে, إن الله يحب إذا أنعم عبد نعمة أن يرى أثر نعمته عليه
বান্দাকে কোন নি‘আমত দান করা হলে আল্লাহ তা‘আলা ঐ নে‘আমতের নিদর্শন প্রকাশ পাওয়া পছন্দ করেন। হাসান: তিরমিযী, হা/২৮২৪, ছ্বহীহ জামে, হা/১৮৮৭।
তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো অপব্যয় ও নিজের খেয়াল-খুশি ছাড়াই তা হতে হবে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিনিধি দলের মোকাবেলায় বেশি করে সৌন্দর্যতা গ্রহণ করতেন।
৫:৮৮ وَ کُلُوۡا مِمَّا رَزَقَکُمُ اللّٰهُ حَلٰلًا طَیِّبًا ۪ وَّ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیۡۤ اَنۡتُمۡ بِهٖ مُؤۡمِنُوۡنَ
৮৮. আর আল্লাহ তোমাদেরকে যে হালাল ও উৎকৃষ্ট জীবিকা দিয়েছেন তা থেকে খাও এবং আল্লাহ্র তাকওয়া অবলম্বন কর, যাঁর প্রতি তোমরা মুমিন।
ইরশাদ করেছেন-
﴿فَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا وَاشْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ﴾
কাজেই হে লোকেরা! আল্লাহ তোমাদের যা কিছু পাক-পবিত্র ও হালাল রিযিক দিয়েছেন তা খাও এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, যদি তোমরা সত্যিই তাঁর বন্দেগী করতে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকো নহলঃ ১১৪
৫:৮৯ لَا یُؤَاخِذُکُمُ اللّٰهُ بِاللَّغۡوِ فِیۡۤ اَیۡمَانِکُمۡ وَ لٰکِنۡ یُّؤَاخِذُکُمۡ بِمَا عَقَّدۡتُّمُ الۡاَیۡمَانَ ۚ فَکَفَّارَتُهٗۤ اِطۡعَامُ عَشَرَۃِ مَسٰکِیۡنَ مِنۡ اَوۡسَطِ مَا تُطۡعِمُوۡنَ اَهۡلِیۡکُمۡ اَوۡ کِسۡوَتُهُمۡ اَوۡ تَحۡرِیۡرُ رَقَبَۃٍ ؕ فَمَنۡ لَّمۡ یَجِدۡ فَصِیَامُ ثَلٰثَۃِ اَیَّامٍ ؕ ذٰلِکَ کَفَّارَۃُ اَیۡمَانِکُمۡ اِذَا حَلَفۡتُمۡ ؕ وَ احۡفَظُوۡۤا اَیۡمَانَکُمۡ ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمۡ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ
৮৯. তোমাদের বৃথা শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু যেসব শপথ তোমরা ইচ্ছে করে কর সেগুলোর জন্য তিনি তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। তারপর এর কাফফারা দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাদ্য দান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও, বা তাদেরকে বস্ত্রদান, কিংবা একজন দাস মুক্তি। অতঃপর যার সামর্থ নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করলে এটাই তোমাদের শপথের কাফফারা। আর তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করো। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।
যেহেতু কোন কোন লোক হালাল জিনিসগুলো নিজেদের ওপর হারাম করে নেবার কসম খেয়েছিল তাই এ প্রসংগে আল্লাহ এ কসমের বিধানও বর্ণনা করে দিয়েছেন ৷ সে বিধান হচ্ছে নিম্নরূপঃ যদি কোন ব্যক্তির মুখ থেকে অনিচ্ছকৃতভাবে কসম শব্দ বের হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা পূর্ণ করার তেমন কোন প্রয়োজন নেই ৷ কারণ এ ধরনের কসমের জন্য পাকড়াও করা হবে না ৷ আর যদি কেউ জেনে বুঝে কসম খেয়ে থাকে…… সে যেন তা ভেঙে ফেলে এবং এ জন্য কাফফারা আদায় করে ৷ কারণ যে ব্যক্তি কোন গুনাহের কাজ করার কসম খেয়ে বসে তার নিজের কসম পূর্ণ করা উচিত নয় ৷
قسم (কসম) এর আরবী প্রতিশব্দ حلف বা يمين আর বহুবচন أحلاف বা أيمان যা শপথ অর্থে ব্যবহার হয়। এই কসম বা শপথ তিন ভাগে বিভক্ত;
(ক) لغو
(খ) غموس
(গ) مُعقَّدة
(ক) لغو (নিরর্থক বা নিরুদ্দেশ) এমন কসম, যা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং কথায় কথায় ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন ছাড়াই ব্যবহার করে। (এমন কসম খাওয়া তার মুদ্রাদোষে পরিণত হয়।) এই ধরনের কসমের কোন কাফফারা বা ধর-পাকড় নেই।
(খ) غموس (মিথ্যা কসম) যা মানুষ ধোঁকা দেওয়া ও প্রতারণা করার জন্য করে থাকে। এটা মহাপাপ; বরং অতি মহাপাপ। কিন্তু এ ধরনের কসমের কোন কাফফারা নেই। (গ) معقَّدة ঐ কসমকে বলা হয়, যা মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এবং নিয়ত সহকারে নিজের কথার সত্যতার তাকীদ ও তা পাকা করার জন্য ব্যবহার করে। যদি কেউ এ ধরনের কসম ভঙ্গ করে, তাহলে তাকে কাফফারা আদায় করতে হবে। এই কাফফারার কথা এই আয়াতের পরের অংশে উল্লেখ করা হয়েছে।
আব্দুর রহমান বিন সামুরা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি আপনি কোন একটি বিষয়ে শপথ করেন, এরপর দেখতে পান যে, অন্য বিষয়টি শপথকৃত বিষয়ের চেয়ে উত্তম তাহলে আপনি উত্তমটি পালন করুন এবং আপনার শপথ ভঙ্গের কাফফারা পরিশোধ করে দিন।”[সহিহ বুখারী (৬৩৪৩) ও সহিহ মুসলিম (১৬৫২)] আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোন এক বিষয়ে শপথ করে ফেলার পর অন্য বিষয়টিকে উত্তম দেখতে পায় তাহলে সে যেন তার শপথের কাফফারা আদায় করে দেয় এবং যেটা উত্তম সেটাই করে।”[সহিহ মুসলিম (১৬৫০)]
আল-মাওসুআ’ আল-ফিকহিয়্যা গ্রন্থে(৮/৬৩) এসেছে- বির্রুল ইয়ামিন (শপথ) এর মানে হচ্ছে- শপথের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত হওয়া এবং যা শপথ করা হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করা। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “তোমরা আল্লাহ্কে তোমাদের জামিনদার করে শপথ দৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করো না। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ্ তা জানেন।”[সূরা নাহল, আয়াত: ৯১]
﴿وَلَا تَجْعَلُوا اللَّهَ عُرْضَةً لِّأَيْمَانِكُمْ أَن تَبَرُّوا وَتَتَّقُوا وَتُصْلِحُوا بَيْنَ النَّاسِ ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
যে শপথের উদ্দেশ্য হয় সৎকাজ, তাকওয়া ও মানব কল্যাণমূলক কাজ থেকে বিরত থাকা, তেমন ধরণের শপথবাক্য উচ্চারণ করার জন্য আল্লাহর নাম ব্যবহার করো না ৷ আল্লাহ তোমাদের সমস্ত কথা শুনছেন এবং তিনি সবকিছু জানেন ৷সুরা বাকারাঃ ২২৪
﴿لَّا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَٰكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا كَسَبَتْ قُلُوبُكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ﴾
তোমরা অনিচ্ছায় যেসব অর্থহীন শপথ করে ফেলো সেগুলোর জন্য আল্লাহ তোমাদের পাকড়াও করবেন না, কিন্তু আন্তরিকতার সাথে তোমরা যেসব শপথ গ্রহণ করো সেগুলোর জন্য অবশ্যি পাকড়াও করবেন৷ আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও সহিষ্ণু ৷সূরা বাকারাঃ ২২৫
কোন ফরয আমল করা কিংবা হারাম কাজ পরিহার করার ক্ষেত্রে শপথ করা হলে তখন শপথ বাস্তবায়ন করা ফরয। তাই কোন নেককাজ করার শপথ করা হলে সে নেক কাজটি পালন করা হচ্ছে শপথ পূর্ণ করা। এক্ষেত্রে শপথ ভঙ্গ করা হারাম। আর কোন ফরয আমল পরিত্যাগ করা কিংবা কোন গুনাহর কাজ করার শপথ করা হলে এটি বদ শপথ; এ ধরণের শপথ ভঙ্গ করা ফরয। আর যদি কোন নফল আমল করার শপথ করে যেমন নফল নামায পড়া কিংবা নফল সদকা করা; সেক্ষেত্রে শপথ পূর্ণ করা মুস্তাহাব এবং শপথ ভঙ্গ করা মাকরুহ।
আর যদি কোন নফল আমল পরিত্যাগ করার শপথ করে তাহলে এটি মাকরুহ শপথ এবং এ শপথ পূর্ণ করাও মাকরুহ। বরং এ ক্ষেত্রে সুন্নত হচ্ছে- শপথ ভঙ্গ করা। আর যদি কোন মুবাহ কাজের ক্ষেত্রে শপথ হয় তাহলে সে শপথ ভঙ্গ করাও মুবাহ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি আপনি কোন একটি বিষয়ে শপথ করেন, এরপর দেখতে পান যে, অন্য বিষয়টি শপথকৃত বিষয়ের চেয়ে উত্তম তাহলে আপনি উত্তমটি পালন করুন এবং আপনার শপথ ভঙ্গের কাফফারা পরিশোধ করে দিন।”[সমাপ্ত]
শপথ ভঙ্গের কাফ্ফারা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।
উত্তর
আলহামদু লিল্লাহ।.
আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নিম্নোক্ত বাণীতে শপথ ভঙ্গের কাফ্ফারা বর্ণনা করেছেন: “তোমাদের অনর্থক শপথের জন্য আল্লাহ্ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু, যেসব শপথ তোমরা ইচ্ছে করে কর সেগুলোর জন্য তিনি তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। তারপর এর কাফ্ফারা দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাদ্য দান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও, বা তাদেরকে বস্ত্রদান, কিংবা একজন দাস মুক্তি। অতঃপর যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করলে এটাই তোমাদের শপথের কাফ্ফারা। আর তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করো। এভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর”।[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৮৯]
সুতরাং একজন মানুষ তিনটি বিষয়ের মধ্যে যে কোন একটি বাছাই করে নিতে পারেন:
১। দশজন মিসকীনকে খাবার খাওয়ানো। নিজের ফ্যামিলিকে যে ধরনের খাবার খাওয়ানো হয় সে ধরণের মধ্যম মানের খাবার। প্রত্যেক মিসকীনকে দেশীয় খাদ্যদ্রব্যের অর্ধ সা’ দিতে হবে। যেমন– চাল বা এ জাতীয় অন্য কিছু। অর্ধ সা’এর পরিমাণ হচ্ছে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। যদি কোন দেশে ভাতের সাথে তরকারি খাওয়ার প্রচলন থাকে, অনেক দেশে এটাকে তাবিখ (রান্নাকৃত) বলা হয় সেক্ষেত্রে চালের সাথে তাদেরকে তরকারী বা গোশত দেয়া উচিত। আর যদি দশজন মিসকীনকে একত্রিত করে দুপুর বা রাতের খাবার খাওয়ানো হয় তাহলে সেটাও যথেষ্ট।
২। দশজন মিসকীনকে বস্ত্র দান করা। যে কাপড় দিয়ে নামায আদায় করা যায় প্রত্যেক মিসকীনকে এমন ড্রেস দিতে হবে। পুরুষদের জন্য জামা (জুব্বা) কিংবা লুঙ্গি ও চাদর। আর নারীদের জন্য গোটা দেহ আচ্ছাদনকারী পোশাক এবং ওড়না।
৩। একজন ঈমানদার ক্রীতদাস আদায করা।
যে ব্যক্তির এর কোনটি করার সামর্থ্য নেই সে ব্যক্তি লাগাতার তিনদিন রোযা রাখবে
জমহুর আলেমের অভিমত হচ্ছে– নগদ অর্থ দিয়ে কাফ্ফারা দিলে আদায় হবে না।
ইবনে কুদামা বলেন: কাফ্ফারা আদায় করার ক্ষেত্রে খাদ্য কিংবা বস্ত্রের মূল্য দিয়ে দিলে কাফ্ফারা আদায় হবে না। কেননা আল্লাহ্ খাদ্যের কথা উল্লেখ করেছেন সুতরাং অন্য কিছু দিয়ে কাফ্ফারা আদায় হবে না। কারণ আল্লাহ্ তাআলা তিনটি পদ্ধতি থেকে একটি চয়ন করার সুযোগ দিয়েছেন। যদি মূল্য দেয়া জায়েয হত তাহলে তিনটির মধ্যে সীমাবদ্ধ করার কোন অর্থ থাকে না।[ইবনে কুদামা এর আল-মুগনি (১১/২৫৬) থেকে সমাপ্ত]
শাইখ বিন বায (রহঃ) বলেন: কাফ্ফারা অবশ্যই খাদ্য হতে হবে; অর্থ নয়। কেননা কুরআন-সুন্নাহ্তে খাদ্যের কথাই এসেছে। আবশ্যকীয় পরিমাণ হচ্ছে– অর্ধ সা’ দেশীয় খাদ্যদ্রব্য; যেমন- খেজুর, গম ইত্যাদি। আধুনিক পরিমানের হিসাবে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম। আর যদি আপনি তাদেরকে দুপুরের খাবার খাইয়ে দেন বা রাতের খাবার খাইয়ে দেন কিংবা পোশাক পরিয়ে দেয়, যে পোশাক দিয়ে নামায পড়া জায়েয হবে সেটাও যথেষ্ট। এমন পোশাক হচ্ছে– একটা জামা (জুব্বা) কিংবা একটা লুঙ্গি ও চাদর। [ফাতাওয়া ইসলামিয়া (৩/৪৮১)থেকে সমাপ্ত]
শাইখ উছাইমীন বলেন: যদি কেউ ক্রীতদাস না পায়, পোশাক বা খাবার দিতে না পারে তাহলে সে তিনদিন রোযা রাখবে। এ রোযাগুলো লাগাতরভাবে রাখতে হবে। মাঝে কোনদিন রোযা ভাঙ্গা যাবে না।[ফাতাওয়া মানারুল ইসলাম (৩/৬৬৭) আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ। সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব
কসম সংরক্ষণ করার কয়েকটি অর্থ হয় ৷
এক, কসমকে সঠিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে ৷ আজেবাজে অর্থহীণ কথায় ও গুনাহের কাজে কসম খাওয়া যাবে না ৷
দুই, কোন বিষয় কসম খেলে সেটা মনে রাখতে হবে, নিজের ঘাফলতির করণে তা ভুলে গিয়ে তার বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না ৷
তিন, কোন সঠিক বিষয়ে জেনে বুঝে ইচ্ছাকৃতভাবে কসম খেলে তা অবশ্যি পূর্ণ করতে হবে ৷ এ ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধাচরণ করা হলে অবশ্যি কাফফারা আদায় করতে হবে ৷
৫:৯০ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡخَمۡرُ وَ الۡمَیۡسِرُ وَ الۡاَنۡصَابُ وَ الۡاَزۡلَامُ رِجۡسٌ مِّنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ فَاجۡتَنِبُوۡهُ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۹۰﴾
৯০. হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয় করার শর তো কেবল ঘৃণার বস্তু, শয়তানের কাজ। কাজেই তোমরা সেগুলো বর্জন কর-যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।
এটি মদের ব্যাপারে তৃতীয় নির্দেশ। প্রথম ও দ্বিতীয় নির্দেশে পরিষ্কারভাবে নিষেধ করা হয়নি। কিন্তু এখানে মদ ও তার সাথে জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্যনির্ণায়ক তীরকে অপবিত্র বা ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানী বিষয় বলে স্পষ্ট ভাষায় তা থেকে দূরে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এ আয়াতে মদ ও জুয়ার অতিরিক্ত অপকারিতা বর্ণনা করে প্রশ্ন করা হয়েছে, তবুও কি তোমরা বিরত হবে না? এ থেকে উদ্দেশ্য ঈমানদারকে পরীক্ষা করা। সুতরাং যাঁরা মু’মিন ছিলেন, তাঁরা আল্লাহর উদ্দেশ্য বুঝে গেলেন এবং তা যে নিশ্চিত হারাম, তা মেনে নিয়ে বললেন, ‘আমরা বিরত হলাম, হে আমাদের প্রতিপালক!’ (আহমাদ ২/৩৫১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মতের মধ্যে এমন অনেক সম্প্রদায় হবে যারা যিনা-ব্যভিচার, রেশমী কাপড় ব্যবহার, মদ্যপান ও গান বাদ্যকে হালাল করবে। [বুখারীঃ ৫৫৯০]
অন্য এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ পান করবে ও তাওবাহ করবে না, সে আখেরাতে তা থেকে বঞ্চিত হবে। [বুখারীঃ ৫৫৭৫]
(২) أزلام শব্দটি زلم এর বহুবচন। আযলাম এমন শরকে বলা হয়, যা দ্বারা আরবে ভাগ্যনির্ধারণী জুয়া খেলার প্রথা প্রচলিত ছিল। দশ ব্যক্তি শরীক হয়ে একটি উট যবাই করত। অতঃপর এর মাংস সমান দশ ভাগে ভাগ করার পরিবর্তে তা দ্বার জুয়া খেলা হত। দশটি শরের সাতটিতে বিভিন্ন অংশের চিহ্ন অবিকৃত থাকত। কোনটিতে এক এবং কোনটিতে দুই বা তিন অংশ অংকিত থাকত। অবশিষ্ট তিনটি শর অংশবিহীন সাদা থাকত।
এ শরগুলোকে তূনীর মধ্যে রেখে খুব নাড়াচাড়া করে নিয়ে প্রত্যেক অংশীদারের জন্যে একটি করে শর বের করা হত। যত অংশবিশিষ্ট শর যার নামে হত, সে তত অংশের অধিকারী হত এবং যার নামে অংশবিহীন শর হত, সে বঞ্ছিত হত। [কুরতুবী] আজকাল এ ধরনের অনেক লটারী বাজারে প্রচলিত আছে। এগুলো জুয়া এবং হারাম। পূর্বে এ সূরার ৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে।
(৩) মদ্যপানকে পর্যায়ক্রমিকভাবে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে কুরআনের সংক্ষিপ্ত কার্যক্রম হচ্ছে এই যে, মদ্যপান সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়েছে।
তন্মধ্যে প্রথম আয়াত ছিল,
(يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا) [সূরা আল-বাকারাহ: ২১৯]
২১৯) তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছেঃ মদও জুয়ার ব্যাপারে নির্দেশ কি? বলে দাওঃ ঐ দু’টির মধ্যে বিরাট ক্ষতিকর বিষয় রয়েছে যদিও লোকদের জন্য তাতে কিছুটা উপকারিতাও আছে, কিন্তু তাদের উপকারিতার চেয়ে গোনাহ অনেক বেশী ৷
যাতে সাহাবায়ে কিরাম মদ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। তাতে মদ্যপানের দরুন যেসব পাপ ও ফাসাদ সৃষ্টি হয়, তার বর্ণনা দিয়েই ক্ষান্ত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় আয়াত ছিল, (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَىٰ حَتَّىٰ تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ) [সূরা আন-নিসাঃ ৪৩]
৪৩) হে ঈমানদারগণ ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছে যেয়ো না৷ নামায সেই সময় পড়া উচিত যখন তোমরা যা বলছো তা জানতে পারো৷
এতে বিশেষভাবে সালাতের সময় মদ্যপানকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য সময়ের জন্য অনুমতি রয়ে যায়। কিন্তু সূরা আল-মায়িদাহ এর আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে পরিস্কার ও কঠোরভাবে মদ্যপান নিষিদ্ধ ও হারাম করে দেয়া হয়েছে। [ইবন কাসীর] এ বিষয়ে শরীআতের এমন পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ ছিল এই যে, আজীবনের অভ্যাস ত্যাগ করা বিশেষতঃ নেশাজনিত অভ্যাস হঠাৎ ত্যাগ করা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর হত। [ফাতহুল কাদীর]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদ সম্পর্কে কঠোর শাস্তির ভয় প্রদর্শন করেছেন। এরশাদ হয়েছেঃ
‘সর্বপ্রকার অপকর্ম এবং অশ্লীলতার জন্মদাতা হচ্ছে মদ [ইবন মাজাহ ৩৩৭১] কারণ, এটি পান করে মানুষ নিকৃষ্টতর পাপে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, মদ এবং ঈমান একত্রিত হতে পারে না। [নাসায়ীঃ ৮/৩১৭]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণীর ব্যক্তির উপর লা’নত করেছেন। (১) যে লোক নির্যাস বের করে, (২) প্রস্তুতকারক, (৩) পানকারী, (৪) যে পান করায়, (৫) আমদানীকারক, (৬) যার জন্য আমদানী করা হয়, (৭) বিক্রেতা, (৮) ক্রেতা, (৯) সরবরাহকারী এবং (১০) এর লভ্যাংশ ভোগকারী। [ইবন মাজাহঃ ৩৩৮০]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন এক মজলিশে মদ্যপানে সাকীর কাজ সম্পাদন করছিলেন। আবু তালহা, আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ, উবাই ইবন কা’ব, সোহাইল রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমূখ নেতৃস্থানীয় সাহাবীগণ সে মজলিশে উপস্থিত ছিলেন। প্রচারকের ঘোষণা কানে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন – এবার সমস্ত মদ ফেলে দাও। এর পেয়ালা, মটকা, হাড়ি ভেঙ্গে ফেল। [মুসনাদে আহমাদ ৩/১৮১; বুখারী ৪৬২০; মুসলিম: ১৯৮০]
আয়াতে যে জিনিসটি হারাম করা হয়েছে দুনিয়ায় তার তিনটি সংস্কারণ প্রচলিত আছে৷ আয়াতে ঐ তিনটিকেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে৷
একঃ মুশরিকদের মতো করে ’ফাল’ গ্রহণ করা৷ এতে কোন বিষয়ে দেব-দেবীর কাছে ভাগ্যের ফায়সালা জানার জন্য জিজ্ঞেস করা হয় অথবা গায়েবের-অজানার ও অদৃশ্যের খবর জিজ্ঞেস করা হয় বা পারস্পারিক বিবাদ মীমাংসা করে নেয়া হয়৷ মক্কার মুশরিকরা কাবা ঘরে রক্ষিত ‘হুবল’ দেবতার মূর্তিকে এ কাজের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিল৷ তার দেবীমূলে সাতটি তীর রাখা হয়েছিল৷ সেগুলোর গায়ে বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য খোদাই করা ছিল৷ কোন কাজ করার বা না করার প্রশ্নে দোদুল্যমানতা দেখা দিলে, হারানো জিনিসের সন্ধান লাভ করতে চাইলে বা হত্যা মামলার ফায়সালা জানতে চাইলে, মোট কথা যেকোন কাজের জন্যই হুবল-এর তীর রক্ষকের কাছে যেতে হতো, সেখানে নজরানা পেশ করতে হতো এবং হুবল-এর কাছে এ মর্মে প্রার্থনা করা হতো, ”আমাদের এ ব্যাপারটির ফায়সালা করে দিন৷” এরপর তীর রক্ষক তার কাছে রক্ষিত তীলগুলোর সাহায্যে ‘ফাল’ বের করতো৷ এতে যে তীরটিই বের হয়ে আসতো, তার গায়ে লিখিত শব্দকেই হুবল-এর ফায়সালা মনে করা হতো৷
দুইঃ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ফাল গ্রহণ৷ এ ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা ও জ্ঞান-বুদ্ধির সাহায্যে জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের মীমাংসার পরিবর্তে কোন প্রকার কুসংস্কার ও অমূলক ধারণা-কল্পনা বা কোন আকস্মিক ঘটনার মাধ্যমে কোন বিষয়ের মীমাংসা করা হয়৷ অথবা এমন সব উপায়ে ভাগ্যের অবস্থা জানবার চেষ্টা করা হয়, যেগুলো গায়েব জানার উপায় হিসেবে কোন তাত্বিক পদ্ধতিতে প্রমাণিত নয়৷ হস্তরেখা গণনা, নক্ষত্র গণনা, রমল করা, বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার এবং নানা ধরনের ফাল বের করা এর অন্তরভুক্ত৷
তিনঃ জুয়া ধরনের যাবতীয় খেলা ও কাজ৷ যেখানে অধিকার, কর্মমূলক অবদান ও বুদ্ধিবৃত্তিক ফায়সালার মাধ্যমে বস্তু বন্টনের পদ্ধতি গ্রহণ না করে নিছক কোন ঘটনা-ক্রমিক কার্যক্রমের ভিত্তিতে বস্তু বন্টন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়৷ যেমন, লটারীতে ঘটনাক্রমে অমুক ব্যক্তির নাম উঠেছে, কাজেই হাজার হাজার ব্যক্তির পকেট থেকে বের হয়ে আসা টাকা তার একার পকেটে চলে যাবে৷ অথবা তাত্বিক দিক দিয়ে কোন একটি ধাঁধার একাধিক উত্তর হতে পারে কিন্তু পুরস্কারটি পাবে একমাত্র সেই ব্যক্তি যার উত্তর কোন যুক্তিসংগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নয় বরং নিছক ঘটনাক্রমে ধাঁধাঁ প্রতিযোযিতা পরিচালকের সিন্ধুকে রক্ষিত উত্তরটির সাথে নিলে যাবে৷
এ তিন ধরনের ফাল গ্রহণ ও অনুমানভিত্তিক লটারী করাকে হারাম ঘোষণা করার পর ইসলাম ‘কুরআ’ নিক্ষেপ বা লটারী করার একমাত্র সহজ সরল পদ্ধতিটিকেই বৈধ গণ্য করেছে৷ এ পদ্ধতিতে দু’টি সমান বৈধ কাজের বা দু’টি সমপর্যায়ের অধিকারের মধ্যে ফায়সালা করার প্রশ্ন দেখা দেয়৷ যেমন, একটি জিনিসের ওপর দু’ ব্যক্তির অধিকার সবদিক দিয়ে একদম সমান এবং ফায়সালাকারীর জন্য দু’জনের কাউকে অগ্রাধিকার দেবার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই আর তাদের দু’জনের মধ্য থেকে কোন একজন নিজের অধিকার প্রত্যাহার করতেও প্রস্তুত নয়৷ এ অবস্থায় তাদের সম্মতিক্রমে লটারীর মাধ্যমে ফায়সালা করা যেতে পারে অথবা দু’টি একই ধরনের সঠিক ও জায়েয কাজ৷ যুক্তির মাধ্যমে তাদের কোন একটিকে অগ্রাধিকার দেবার ব্যাপারে এক ব্যক্তি দোটানায় পেড়ে গেছে৷ এ অবস্থায় প্রয়োজন হলে লটারী করা যেতে পারে৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে যখন দু’জন সমান হকদারের মধ্যে একজনকে প্রাধান্য দেবার প্রশ্ন দেখা দিতো এবং তাঁর আশংকা হতো যে, তিনি একজনকে প্রাধান্য দিলে তা অন্যজনের মনোকষ্টের কারণ হবে তখন তিনি সাধারণত এ পদ্ধতিটি অবলম্বন করতেন৷
যদিও ভাগ্য নির্ণায়ক শর(আযলাম) স্বভাবতই এক ধরনের জুয়া তবুও তাদের উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে ৷ পার্থক্যটি হচ্ছে আরবী ভাষায় ‘আযলাম’ বলা হয় এমন ধরনের ফাল গ্রহণ ও শর নিক্ষেপ করাকে যার সাথে মুশরিকী আকীদা-বিশ্বাস ও কুসংস্কার জড়িত থাকে আর ‘মাইসির'(জুয়া) শব্দটি এমন সব খেলা ও কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যেখানে আকস্মিক ঘটনাকে অর্থোপার্জন, ভাগ্য পরীক্ষা এবং অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী বন্টনের মাধ্যমে পরিণত করা হয় ৷
দাবা, লুডু ও ক্যারাম (অথবা ক্যারোম) আমাদের সমাজে প্রচলিত তিনটি খেলার নাম। তিনটিই গুটি দিয়ে খেলা হয়। পাশা খেলা এগুলোর সমগোত্রীয় খেলা। এসকল খেলাগুলোর উৎপত্তি ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায়। এ সকল খেলাগুলো সম্পূর্ণ হারাম। চাই তা জুয়ার দ্বারা হোক কিংবা জুয়া ছাড়া এমনিই হোক না কেন। সর্বাবস্থায় হারাম। হাদীসে কঠোরভাবে এ খেলাগুলো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে। যেমন,
حَدَّثَنِي عَنْ مَالِكٍ، عَنْ مُوسَى بْنِ مَيْسَرَةَ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ أبِي هِنْدٍ, عَنْ أبِي مُوسَى الأَشْعَرِيِّ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : مَنْ لَعِبَ بِالنَّرْدِ فَقَدْ عَصَى اللَّهَ وَرَسُولَهُ
🔰 অর্থাৎ আবূ মূসা আশআরী (রা.) হতে বর্ণিত, “যে ব্যক্তি পাশা বা দাবা খেললো, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হলো।”
[মুয়াত্তা মালিক, হা. ৭৬৯; সুনান আবূ দাউদ, হা. ৪৯৩৮]
وَحَدَّثَنِي عَنْ مَالِكٍ، عَنْ نَافِعٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ : أَنَّهُ كَانَ إِذَا وَجَدَ أَحَداً مِنْ أَهْلِهِ يَلْعَبُ بِالنَّرْدِ ضَرَبَهُ وَكَسَرَهَا
🔰 অর্থাৎ “আব্দল্লাহ ইবনে উমর (রা.) যদি তাঁর পরিবারের কাউকে দাবা বা পাশা খেলা দেখতেন, তাহলে তাকে মারতেন এবং দাবা ভেঙে ফেলতেন।”[মুয়াত্তা মালিক; আওজাযুল মাসালেক, শায়খুল হাদীস যাকারিয়া কন্ধলভী, ১৭/৫৩]
🔰 সহীহ মুসলিমের হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“যে ব্যক্তি পাশা বা দাবা খেললো সে যেন তার হাত শুকরের মাংস ও রক্তে ডুবালো।”
عن أبيه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال من لعب بالنردشير فكأنما صبغ يده في لحم خنزير ودمه
🔰 [সহীহ মুসলিম, হা. ২২৬০; সুনানে আবূ দাউদ, হা. ৪৯৩৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হা. ৩৭৬৩; সুনানুল কুবরা, নাসায়ী; তালখীসুল হাবীর, খ. ৪, পৃ. ৬৩]
💠 শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন,
“ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.) বলেন, “দাবা বা পাশা খেলোয়ারকে সালাম দিবে না, কেননা সে প্রকাশ্যে জঘন্য পাপে লিপ্ত।”[মজমউল ফাতাওয়া, ৩২/২৪৫]
*দাবা-লুডু-ক্যারাম একই খেলা* ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)’র ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (রহ.) বলেন,
قَالَ مُحَمَّدٌ: لا خَيْرَ بِاللَّعِبِ كُلِّهَا مِنَ النَّرْدِ، وَالشِّطْرَنْجِ، وَغَيْرِ ذَلِكَ
অর্থাৎ “পাশা, শতরঞ্জ (দাবা) ও এরকম অন্যান্য খেলা খেলে কোনো কল্যাণ নেই ।”[মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, হা. ৯০৫ এর আলোচনায়, প্র. মাকতাবাতুল ইলমিয়া]
সুতরাং এটি পরিষ্কার যে, দাবা-লুডু-ক্যারাম সব একই খেলা। এগুলো সব হারাম। আলী (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, “দাবা অনারবদের জুয়া খেলা।” এর দ্বারা দাবাসহ গুটি দিয়ে খেলা অন্যান্য অনারবীয় খেলাগুলো অর্থাৎ লুডু, ক্যারামও হারাম প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা এগুলো অনারবীয় এবং এগুলো গুটি দিয়ে খেলা হয়।
ফুকাহায়ে কেরামগণ বলেছেন, পাশা বা দাবার ন্যায় গুটি দিয়ে খেলা অন্যান্য খেলাগুলোও হারাম।
[আল মুগনী, ১৩/১৫৪, ১৫৫; আল ফুরূ’ ৬/৫৭৩; আল ইনসাফ, ১২/৫২, ৫৩]
সুতরাং পাশা, দাবা, লুডু ও ক্যারাম এসকল হারাম খেলা থেকে আমরা নিজেরা ত বিরত থাকবোই, অন্যদেরও বিরত রাখবো। আল্লাহু আলাম (সংগৃহীত)
প্রশ্ন: ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা ভলিবল ইত্যাদি খেলাধুলা করা এবং দেখার ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬
উত্তর: খেলা-ধুলা মানুষের জন্মগত স্বভাব। এর উদ্দেশ্য সাময়িক শরীর চর্চা। যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বয়স ভেদে মানুষের শরীর চর্চার ধরনের পরিবর্তন হয়। কিন্তু সাময়িক শরীর চর্চার বদলে যদি তা কেবল সময়ের অপচয় হয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, যদি ঐ ব্যক্তি দ্বীন থেকে গাফেল হয়, দায়িত্ব বিস্মৃত হয় বা তাতে জুয়া মিশ্রিত হয়, তখন ঐ খেলা হারামে পরিণত হয়।খেলাধুলা দেখার ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান হলো যে সকল খেলাধুলায় সরাসরি জুয়া নেই হারাম, কোন কর্মকান্ড নেই এবং শারীরিক ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে করা হয় সে সকল খেলাধুলা করা যেমন জায়েজ রয়েছে তেমনি শরীয়তের বিধি বিধান মেনে চাইলে সেগুলো দেখা যেতে পারে মোটকথা যে সকল খেলাধুলার সাথে কোন প্রকার হারাম কাজ যেমন
জুয়া বা বাজি ধরা
আওড়াহ প্রকাশ করা,
নারী-পুরুষ ফ্রী মিক্সিং,গান-বাজনা ইত্যাদি জড়িত না থাকে, তাহলে এমন খেলায় অংশগ্রহণ করতে বা এই খেলাগুলো দেখতে কোন সমস্যা নেই ইন শাহ্ আল্লাহ।
নিশ্চয়ই একমাত্র আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। [সৌদি আরবের সর্বচ্ছো ফাতওয়া বোর্ড-ফাতওয়া আল-লাজনাহ আদ-দাই’য়িমাহঃ ১৫/২৩৮। স্থায়ী ফাতওয়া কমিটির ফাতওয়া নং– ১৮৯৫১]।
মোটকথা ইসলাম শরীর চর্চার উদ্দেশ্যে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা ভলিবল ইত্যাদি খেলাধুলা করা এবং দেখা জায়েয। ইমাম ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এমন প্রত্যেক খেলা-ধুলা, যা শারীরিকভাবে কোন ক্ষতিসাধন করে না এবং ধর্মীয় কাজেও কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না,তা বৈধ।’ (আল-মুগনী, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ১৫৭)। তবে এই অনুমতি শুধু সাময়িক বৈধ বিনোদনের উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কেউ খেলা-ধুলাকেই বা বিনোদনকেই জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বানিয়ে নেয় এবং এটাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে,তখন তা হালাল বা বৈধ থেকে হারাম বা মাকরূহের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, وَكُلُّ شَيْءٍ يَلْهُوْ بِهِ الرَّجُلُ بَاطِلٌ إِلَّا رَمْيَهُ بِقَوْسِهِ وَتَأْدِيْبَهُ فَرَسَهُ وَمُلَاعَبَتَهُ امْرَأَتَهُ. ‘এমন প্রত্যেক জিনিস যা মানুষকে উদাসীন ও দ্বীন বিমুখ করে তোলে, তা পরিত্যাজ্য। শুধু তীরন্দাজী করা, ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং নিজ স্ত্রীর সাথে প্রেম বিনিময় করা ব্যতীত।’ (দারিমী, হা/২৪৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৩০০,১৭৩৩৭) শুআইব আল-আরনাঊত্ব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সমস্ত তথ্য ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এই হাদীসটি হাসান পর্যায়ের)। ইমাম শাত্বিবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এমন খেলা-ধুলা, যা নিষিদ্ধের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং নিষিদ্ধকরণের কোন কারণও সংগঠিত হয়নি, তা মুবাহ বা অনুমোদনযোগ্য। কিন্তু এটি নিন্দিত কাজ। আলেমগণ এর উপর সন্তুষ্ট নন। বরং তাঁরা এটা অপছন্দ করেন যে কোন একজন ব্যক্তি সামাজিক ও মানবিক সংস্কারমূলক কাজে নিয়োজিত না হয়ে, তার মূল্যবান সময় এমন একটি কাজে ব্যয় করে, যার মধ্যে ইহকাল ও পরকালের জন্য কোন কল্যাণ নেই।’ (আল-মুওয়াফাক্বাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ২০৪-২০৫)।
ইসলাম শর্তসাপেক্ষে কিছু খেলাকে জায়েয করেছে। শর্তগুলো হল:
(১) ইসলামের ফরয ইবাদত পালন থেকে উদাসীন না হওয়া। যেমন: কোন ফরয সালাত ও সালাতের জামা‘আতের সময় খেলাধুলা করা।(সূরা লুক্বমান: ৬; ফাতাওয়াউল ইসলাম সুওয়াল ওয়া জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৮৪২৯১)।
(২) শরী‘আতের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের প্রতি খেয়াল রাখা (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)। সুতরাং খেলাটি হতে হবে ইসলামের জন্য জিহাদের প্রস্তুতি,শারীরিক সক্ষমতা অর্জন ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি বা বৈধ বিনোদনের উদ্দেশ্যে।
(৩) সর্বদা সতর আবৃত রাখা (আবু দাঊদ, হা/৪০১৭; তিরমিযী, হা/২৭৯৪; সনদ ছহীহ, সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৭০৬; ফাতাওয়াউল ইসলাম সুওয়াল ওয়া জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৮৪২৯১)।
(৪) জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়া (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৯৫)।
(৫) জুয়া বা হারাম মিশ্রিত না হওয়া (সূরা আল-মায়িদাহ: ৯০)।
(৬) প্রতিযোগিতার জয়-পরাজয়ে শত্রুতা-মিত্রতা সৃষ্টি না হওয়া। (সূরা আল-মায়িদাহ: ৯১; ফাতাওয়াউল ইসলাম সুওয়াল ওয়া জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৮৪২৯১)। যদি উক্ত বিষয়গুলোর কোন একটি পাওয়া যায়, তখন সে খেলা হারাম হবে।
‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ একদা আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আমার ঘরের দরজায় দেখলাম। তখন হাবশার লোকেরা মসজিদে (বর্শা দ্বারা) খেলা করছিল। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চাদর দিয়ে আমাকে আড়াল করে রাখছিলেন। আমি ওদের খেলা অবলোকন করছিলাম।(আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৩৫, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪৪১, সহিহ বুখারী: হাদিস নং ৪৫৪)।
আর ইসলাম অনুমতি দিয়েছে পুরষ্কার নেওয়ার এমন খেলা হচ্ছে:
ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা
উটের দৌড় প্রতিযোগিতা
তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা।যেমন: আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তীর নিক্ষেপ এবং উট ও ঘোড়দৌড় ব্যতীত অন্য কিছুতে প্রতিযোগিতা নেই। [সহীহ্, ইবনু মা-জাহ ২৮৭৮ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ১৭০০]।
উল্লেখ্য যে, বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট সহ প্রচলিত অধিকাংশ খেলাধুলায় ইসলামী শরী‘আতের উপরিউক্ত শর্তাবলী উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। বরং জীবনের ঝুঁকি, সালাতের প্রতি অবহেলা, সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া-বাজিধরা, রঙখেলা, গ্যালারিতে উদ্দাম নৃত্য-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, উল্কী আঁকা ইত্যাদিতে ভরপুর থাকে, যা শরী‘আতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম।
সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘এমন ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ যেগুলো অর্থ অথবা পুরস্কারের জন্য খেলা হয়ে থাকে, সেগুলো হারাম। এগুলো হারাম জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। কারণ শরী‘আত অনুমোদিত খেলা ছাড়া অন্য যেকোন খেলার জন্য বিনিময় বা পুরস্কার গ্রহণ করা নাজায়েয। আর ইসলাম অনুমোদিত খেলাগুলো হচ্ছে ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা, উটের দৌড় প্রতিযোগিতা এবং তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা। সুতরাং জেনেশুনে এ ধরনের পুরস্কার গ্রহণের খেলার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা এবং দেখা উভয়ই হারাম। কেননা এ ধরনের খেলায় উপস্থিত হওয়াটা তাকে সমর্থন করার শামিল।’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ২৩৮, ফৎওয়া নং-১৮৯৫১)।
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, এগুলো সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। সংকীর্ণ পোশাক পরিধান করে অথবা উরু উন্মুক্ত করে খেলাধুলা করা জায়েয নয়। অতএব তা দেখাও নাজায়েয। অতঃপর তিনি দলীল হিসাবে নিম্নের হাদীসটি উপস্থাপন করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,‘ক্বিয়ামত দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহ তা‘আলার নিকট হতে সরতে পারবে না।
(১) তার আয়ুস্কাল সম্পর্কে,সে তার জীবনকাল কোথায় অতিবাহিত করেছে?
(২) তার যৌবনকাল সম্পর্কে,কী কাজে তা বিনাশ করেছে?
(৩) ও (৪) তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোথায় হতে তা উপার্জন করেছে এবং কোন কোন খাতে তা খরচ করেছে? এবং
(৫) সে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিল সে মুতাবেক কী কী আমল করেছে’? (তিরমিযী, হা/২৪১৬; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৯৪৬; ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৩১)।
পরিশেষে, আমরা যারা আল্লাহকে ভয় করি, আখিরাতের ফিকির করি, আল্লাহর সামনে হাজির হওয়ার উপর ঈমান রাখি আমাদেরকে অবশ্যই শরীয়ত সমর্থন করেনা এমন সকল নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড এবং খেলাধুলা করা এবং দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তাওফীক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
উপস্থাপনায়, জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
৫:৯১ اِنَّمَا یُرِیۡدُ الشَّیۡطٰنُ اَنۡ یُّوۡقِعَ بَیۡنَکُمُ الۡعَدَاوَۃَ وَ الۡبَغۡضَآءَ فِی الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِ وَ یَصُدَّکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰهِ وَ عَنِ الصَّلٰوۃِ ۚ فَهَلۡ اَنۡتُمۡ مُّنۡتَهُوۡنَ
৯১. শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শক্রতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে। তবে কি তোমরা বিরত হবে না?
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যা-ই বিবেকশূণ্য করে তা-ই মদ। আর সমস্ত মাদকতাই হারাম। যে ব্যক্তি কোন মাদক সেবন করল, চল্লিশ প্রভাত পর্যন্ত তার সালাত অসম্পূর্ণ থাকবে। তারপর যদি সে তাওবা করে, তবে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন, এভাবে চতুর্থবার পর্যন্ত। যদি চতুর্থবার পূণরায় তা করে, তখন আল্লাহর উপর হক হয়ে দাঁড়ায় তাকে ত্বিনাতুল খাবাল থেকে পান করানো। বলা হল, হে আল্লাহর রাসূল! ত্বিনাতুল খাবাল কী? তিনি বললেন, জাহান্নামাবাসীদের পূজ। যে কেউ কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ককে মদ খাওয়াবে, যে হারাম হালাল সম্পর্কে জানে না, আল্লাহর উপর হক হয়ে যাবে যে তাকে ত্বীনাতুল খাবাল পান করানো। [মুসলিম: ২০০২: আবু দাউদ ৩৬৮০]
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মদ খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেল এবং তাওবা না করে মারা গেল, সে আখেরাতে তা পান করতে পারবে না। [মুসলিম: ২০০৩] আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অনুগ্রহের খোটাদানকারী, পিতামাতার অবাধ্য এবং মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। [নাসায়ী: ৫৬৭২]
৫:৯২ وَ اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ احۡذَرُوۡا ۚ فَاِنۡ تَوَلَّیۡتُمۡ فَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّمَا عَلٰی رَسُوۡلِنَا الۡبَلٰغُ الۡمُبِیۡنُ
৯২. আর তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। আর সাবধানতা অবলম্বন কর; তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রাখ যে, আমাদের রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টভাবে প্রচার করা।
মানব জাতির জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলেরই আনুগত্য করা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন
, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের অন্তর্গত ‘ঊলুল আমর’ তথা আদেশ দাতাগণের। অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়, তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে থাক। এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর সমাধান’ (নিসা ৪/৫৯)।
মানব জীবনের সকল প্রকার আমল কুরআন-হাদীছ মোতাবেক হ’তে হবে। এর মাঝেই মানবতার সার্বিক সফলতা নিহিত আছে। আর আমল কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণে না হ’লে তা নিঃসন্দেহে বাতিল বলে গণ্য হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَلاَ تُبْطِلُوْا أَعْمَالَكُمْ-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য কর, আর (তা না করে) তোমাদের আমল সমূহ বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)।
রাসূল (ছাঃ) যা করতে আদেশ দিয়েছেন তা গ্রহণ করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা আবশ্যক।
মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা হ’তে তোমাদের নিষেধ করেন তা হ’তে বিরত থাকো’ (হাশরঃ ৭)।
মহান আল্লাহ বলেন, فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ حَتَّى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا ‘অতএব তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনও মুমিন হ’তে পারবে না, যে পর্যন্ত তোমাকে তাদের আভ্যন্তরীণ বিরোধের বিচারক হিসাবে মেনে না নিবে, তৎপর তুমি যে বিচার করবে তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না করবে এবং ওটা শান্তভাবে পরিগ্রহণ না করবে’ (নিসা ৪/৬৫)।
১। মানব জাতির সাফল্য লাভের অন্যতম উপায় হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে কেবল কুরআন-হাদীছকে মেনে নেওয়া।
মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيعُوْهُ تَهْتَدُوْا وَمَا عَلَى
الرَّسُوْلِ إِلَّا الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ–
‘বল! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য সে দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। আর তোমরা তাঁর আনুগত্য করলে সৎপথ পাবে, রাসূলের কর্তব্য হচ্ছে শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া’ (নূরঃ ৫৪)।
মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذَا دُعُوْا إِلَى اللهِ وَرَسُوْلِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُوْلُوْا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ، وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَيَخْشَ اللهَ وَيَتَّقْهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَائِزُوْنَ-
‘মুমিনদের উক্তি তো এই, যখন তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেবার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তারা বলবে, আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম, আর তারাই সফলকাম। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হ’তে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম’ (নূরঃ ৫১-৫২)।
২। রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করা এবং তাঁর অনুসরণে ছালাত প্রতিষ্ঠা করা ও যাকাত দেওয়ার মধ্যেই মানব জীবনে শান্তি ফিরে আসবে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ- ‘তোমরা ছালাত ক্বায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হ’তে পার’ (নূরঃ ৫৬)।
৩। রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করলে, আল্লাহরই আনুগত্য করা হয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, مَنْ يُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে কেউ রাসূলের আনুগত্য করে থাকে, নিশ্চয়ই সে আল্লাহরই আনুগত্য করে থাকে’ (নিসাঃ ৮০)
৪। মানুষকে সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ফায়ছালা গ্রহণ করতে হবে, তাহ’লে তারা সফলকাম হবে। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করলে পথভ্রষ্ট হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاَ مُبِيْنًا
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের ইখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’ (আহযাবঃ ৩৬)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ- ‘আর এটাই আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এ পথেরই অনুসরণ। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করো না। অন্যথা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে সরিয়ে দিবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এই নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আমঃ ১৫৩)।
আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে, বিরুদ্ধাচরণ করলে জাহান্নামে যেতে হবে। যেমন হাদীছে এসেছে,
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ أُمَّتِىْ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَى. قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى، قَالَ مَنْ أَطَاعَنِىْ دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِىْ فَقَدْ أَبَى- ‘আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করবে (সে নয়)। তারা বললেন, কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সেই অস্বীকার করে’ (বুখারী হা/৭২৮০)।
৫। আল্লাহ এবং রাসূল (ছাঃ)-কে অনুসরণের মাধ্যমেই মানব জাতি সর্বোত্তম মর্যাদা পাবে।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَأُوْلَئِكَ مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَحَسُنَ أُوْلَئِكَ
رَفِيْقًا
‘আর যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হয়, তবে তারা ঐ ব্যক্তিদের সঙ্গী হবে যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন; অর্থাৎ নবীগণ, সত্য সাধকগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলগণ। আর এরাই সর্বোত্তম সঙ্গী’ (নিসাঃ ৬৯)।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধাচরণ করবে সে জাহান্নামে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا ‘
আর সুপথ প্রকাশিত হওয়ার পর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং বিশ্বাসীগণের বিপরীত পথের অনুগামী হয়, তবে সে যাতে অভিনিবিষ্ট আমি তাকে তাতেই প্রত্যাবর্তিত করব ও তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব এবং এটা নিকৃষ্টতর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (নিসাঃ ১১৫)।
মহান আল্লাহর বাণী, يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُوْلُوْنَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُوْلاً، وَقَالُوْا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّوْنَا السَّبِيْلاً، رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًا-
‘যে দিন তাদের মুখমন্ডল অগ্নিতে উলটপালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম! তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন এবং তাদেরকে দিন মহা অভিশাপ’ (আহযাবঃ ৬৬-৬৮)।
আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর কঠিন শাস্তি’ (নূরঃ ৬৩)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا رَبَّنَا أَرِنَا اللَّذَيْنِ أَضَلاَّنَا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ أَقْدَامِنَا لِيَكُوْنَا مِنَ الْأَسْفَلِيْنَ- ‘কাফেররা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! যেসব জ্বিন ও মানব আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল তাদের উভয়কে দেখিয়ে দিন, আমরা উভয়কে পদদলিত করবো, যাতে তারা নিম্ন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়’ (হা-মী-ম সাজদাহঃ ২৯)।
রাসূল (ছাঃ) মানুষের মুক্তির জন্য দু’টি জিনিস রেখে গেছেন। তিনি বলেন, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি; যতদিন তোমরা ঐ দু’টি বস্ত্তকে মযবূতভাবে ধরে থাকবে, ততদিন (তোমরা) পথভ্রষ্ট হবে না। সে দু’টি বস্ত্ত হ’ল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত’। মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৮৬, সনদ হাসান।
৫:৯৩ لَیۡسَ عَلَی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ جُنَاحٌ فِیۡمَا طَعِمُوۡۤا اِذَا مَا اتَّقَوۡا وَّ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ ثُمَّ اتَّقَوۡا وَّ اٰمَنُوۡا ثُمَّ اتَّقَوۡا وَّ اَحۡسَنُوۡا ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ
৯৩. যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তারা আগে যা কিছু পানাহার করেছে তার জন্য তাদের কোন গুনাহ নেই, যদি তারা তাকওয়া অবলম্বন করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে। তারপর তারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং ঈমান আনে। তারপর তারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং ইহসান করে। আর আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালবাসেন।
বারা ইবন আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন মদ হারাম হওয়া সম্পর্কিত আয়াত নাযিল হয় তখন জনগণ বলতে আরম্ভ করল, এটা হারাম হওয়ার পূর্বে যারা এটা পান করেছে এবং সে অবস্থায় মারা গেছেন তাদের কি হবে? তখন এ আয়াত নাযিল হয়। [তিরমিযী: ৩০৫১]
তাওবার শর্ত ও ইহার পরিপূরক বিষয়(শাইখ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ)
তাওবা শব্দটি এক মহান শব্দ। এর অর্থ খুবই গভীর। এমন নয় যা অনেকেই মনে করে থাকেন, মুখে শব্দটি বললাম অতঃপর গুনাহে লিপ্ত থাকলাম। আপনি আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী অনুধাবন করে দেখুন। আল্লাহ্ কি বলছেন:‘‘তোমরা তোমাদের প্রভূর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন (তাওবা) কর।’’ (সূরা হুদ: ৩)
আয়াতের মধ্যে সকলকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে, অতঃপর তাওবা করতে বলা হয়েছে। সুতরাং তাওবা হচ্ছে ক্ষমা প্রার্থনার পর অতিরিক্ত আলাদা বিষয়।
কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য অবশ্যই কিছু শর্ত থাকে। আলেম-ওলামাগণ কুরআন ও হাদীস মন্থন করে তাওবার জন্য কতিপয় শর্ত উল্লেখ করেছেন, তা হলো
এক: দ্রুত পাপ থেকে বিরত হওয়া
দুই: পূর্বে যা ঘটে গেছে সে জন্য অনুতপ্ত হওয়া
তিন: পুনরায় পাপ কাজে ফিরে না আসার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা
চার: প্রাপকদের হক ফিরিয়ে দেয়া যা অন্যায়ভাবে নেয়া হয়েছিল অথবা তাদের নিকট থেকে মাফ চেয়ে নেওয়া।
আর খালেসভাবে তাওবার জন্য কতিপয় আলেম যেসব শর্ত উল্লেখ করেছেন, নিম্নে সেগুলো উদাহরণসহ আলোচনা করা হচ্ছে।
[এক]: শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য পাপ ত্যাগ করা, অন্য কোন কারণে নয়, যেমন
~ অক্ষমতার কারণে পাপ থেকে দূরে থাকা, এসব কর্ম করতে ভাল না লাগা অথবা লোকজন মন্দ বলবে এই ভয়ে পাপ ত্যাগ করা।
~ এজন্য তাকে তাওবাকারী বলা হবে না, যে ব্যক্তি পাপ ত্যাগ করেছে তার মানহানী ঘটায় বা এর জন্য হয়তো সে চাকুরীচ্যুত বা পদবী হারাতে পারে।
~ তাকে তাওবাকারী বলা যাবে না, যে ব্যক্তি পাপ ত্যাগ করল তার শক্তি ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য। যেমন; কেউ জেনা করা ত্যাগ করলো যেন দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে বাঁচতে পারে অথবা তার শরীর ও স্মৃতি শক্তিকে দুর্বল না করে।
~ তেমনিভাবে তাকে তাওবাকারী বলা যাবে না, যে ব্যক্তি চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে; কোন বাড়ীতে ঢুকার পথ না পেয়ে বা সিন্দুক খুলতে অসমর্থ কিংবা পাহারাদার ও পুলিশের ভয়ে।
~ তাকে তাওবাকারী বলা যাবে না, যে দূর্নীতি দমন বিভাগের লোকজনদের জোর তৎপরতায় ধরা পড়ার ভয়ে ঘুষ খাওয়া বন্দ রেখেছে।
~ আর তাকেও তাওবাকারী বলা যাবে না, যে ব্যক্তি মদ পান, মাদকদ্রব্য বা হেরোইন সেবন ইত্যাদি ছেড়ে দিয়েছে দারিদ্রের কারণে।
~ তেমনিভাবে তাকেও তাওবাকারী বলা যাবে না, যে সামর্থহীন হওয়ার কারণে গুনাহ করা ছেড়ে দিলো। যেমন মিথ্যা বলা ছেড়ে দিয়েছে তার কথায় জড়তা সৃষ্টি হওয়ার কারণে কিংবা জেনা করছে না যেহেতু সে সহবাস ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, কিংবা চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ার কারণে
বরং এসবে অবশ্যই অনুতপ্ত হতে হবে, সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত হতে হবে এবং অতীত কর্মকান্ডের জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এ জন্যেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘অনুতপ্ত হওয়াই হলো তাওবা।’’ (আহমাদ, ইবনে মাজা, সহীহ আল-জামে ৬৮০২)
মহান আল্লাহ আকাংখা পোষণকারী অপারগকে কর্ম সম্পাদনকারীর মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। আপনি জানেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেছেন:
(إِنَّمَا الدُّنْيَا لأَرَْبَعَةِ نَفَرٍ عَبْدٌ رَزَقَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مَالاً وَعِلْمًا فَهُوَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ وَيَصِلَ فِيهِ رَحِمَهُ وَيَعْلَمَ للهِ عَزَّ وَجَلَّ فِيهِ حَقًّا، قَالَ: فَهَذَا بِأفْضَلِ الْمَنَازِلِ، وَعَبْدٌ رَزَقَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عِلْمًا وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالاً، قَالَ: فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّة، يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلاَنٍ، فَهُوَ بِنِيَّتِهِ، فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ، وَعَبْدٌ رَزَقَهُ اللهُ مَالاً وَلَمْ يَرْزُقْهُ عِلْماً يَخْبِطُ فِي مَالِهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلاَ يَتَّقِي فِيهِ رَبَّهُ، وَلاَ يَصِلُ فِيهِ رَحِمَهُ، وَلاَ يَعْلَمُ لِلّهِ فِيهِ حَقّاً، فَهَذَا بِأَخْبَثِ الْمَنَازِلِ، وَعَبْدٌ لَمْ يَرْزُقْهُ اللهُ مَالاً وَلاَ عِلْماً فَهُوَ يَقُوْلُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ فِيهِ بِعَمَلِ فُلاَنٍ، فَهُوَ بِنِيَّتِهِ، فَوِزْرُهُمَا سَوَاءٌ) رواه أحمد والترمزي وصححه. (صحيح الترغيب والترغيب ১/৯).
‘‘দুনিয়া চার প্রকার লোকের জন্য; (১) সেই বান্দার জন্য যাকে আল্লাহ মাল ও জ্ঞান দান করেছেন সুতরাং সে এতে তার প্রভূকে ভয় করছে, তার আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখছে এবং তার ব্যাপারে আল্লাহর হক জানছে, এ হলো সর্বোত্তম অবস্থানে। (২) সেই বান্দা যাকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন কিন্তু মাল দেননি, সে হলো সঠিক নিয়তের লোক, সে বলে, যদি আমার টাকা পয়সা থাকতো তাহলে উমুক ব্যাক্তির মত কাজ করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী সওয়াব পাবে। এদের দুজনের নেকী সমান হবে। (৩) আর সেই বান্দা যাকে আল্লাহ টাকা পয়সা দিয়েছেন কিন্তু জ্ঞান দান করেননি। সে না জেনেই তার টাকা পয়সা খরচ করছে। এতে সে আল্লাহকে ভয় করে না, আত্মীয়তা রক্ষা করে না এবং এতে আল্লাহর হকও সে জানে না। সে হলো সর্ব নিকৃষ্ট অবস্থানে। (৪) আর সেই বান্দা যাকে আল্লাহ মালও দেননি জ্ঞানও দেননি, সে বলে আমার টাকা পয়সা থাকলে উমুকের মতই (খারাপ কাজ) করতাম। সে তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিদান পাবে। এরা দুজনই গুনাহর দিক থেকে সমান। (আহমদ, তিরমিযী, সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব: ১/৯
[দুই]: পাপের কদর্যতা ও ভয়াবহতা অনুভব করা; অর্থাৎ সঠিক তাওবার সাথে কখনো আনন্দ ও মজা পাওয়া যাবেনা অতীত পাপের কথা স্মরণ হলে অথবা কখনো ভবিষ্যতে সেসব কাজে ফিরে যাবে, এ কামনা মনে স্থান পাবে না
ইবনুল কাইয়্যেম রহমতুল্লাহ আলাইহে তার লিখা [الداء والدواء] ‘রোগ ও চিকিৎসা’ এবং [الفوائد] ‘আল্ফাওয়াইদ’ নামক গ্রন্থে গুনাহের অনেক ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে: জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হওয়া, অন্তরে একাকিত্ব অনুভব করা, কাজকর্ম কঠিন হয়ে যাওয়া, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া, আল্লাহর আনুগত্য থেকে বঞ্চিত হওয়া, বরকত কমে যাওয়া, কাজে সমন্বয় না হওয়া, গুনাহর কাজে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া, আল্লাহর ব্যাপারে পাপীর অনাসক্তি সৃষ্টি হয় এবং লোকজন তাকে অশ্রদ্ধা করে, জীবজন্তু তাকে অভিশাপ দেয়, সে সর্বদা অপমানিত হতে থাকে, অন্তরে মোহর পড়ে যায়, লানতের মাঝে পড়ে এবং দু’আ কবুল হয় না, জলে ও স্থলে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, আত্মমর্যাদাবোধ কমে যায়, লজ্জা চলে যায়, নিয়ামত দূর হয়ে যায়, আজাব নেমে আসে, পাপীর অন্তরে সর্বদা ভয় নেমে আসে এবং সে শয়তানের দোসরে পরিণত হয়, তার জীবন সমাপ্ত হয় মন্দের উপর এবং পরকালীন আজাবে নিপতিত হয়।
পাপের এই ক্ষতি ও বিপর্যয় যদি বান্দা জানতে পারে তাহলে সে পাপ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকবে। কিছু কিছু লোক এক পাপ ছেড়ে আরেক পাপ করতে শুরু করে তার কিছু কারণ হলো:
১. মনে করে যে, এর পাপ কিছুটা হালকা।
২. মন পাপের দিকে বেশী আকৃষ্ট হয় এবং এর দিকে ঝোক খুবই প্রবল থাকে।
৩. এ পাপ করার জন্য পারিপার্শিক অবস্থা সহজ ও সহায়ক হয় অন্যটির তুলনায়, অন্য পাপের মোকাবেলায় যার জন্য অনেক কিছু জোগাড় করা লাগে।
৪. তার সঙ্গী সাথীরা এ পাপের সাথে জড়িত, তাদেরকে ত্যাগ করা কঠিন বলে মনে হয়।
৫. কোন কোন ব্যক্তির নিকট বিশেষ পাপ তার মান সম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তার সঙ্গী সাথীদের মাঝে। এজন্য সে চিন্তা করে যেন তার অবস্থান সে ধরে রাখে এবং এ পাপ অব্যাহত রাখে, যেমনটি ঘটে বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রধানদের বেলায়। যেমনটি ঘটেছিল অশ্লীল কবি আবু নাওয়াসের বেলায়, যখন তাকে কবি আবুল আতাহিয়া উপদেশ দেয় ও ভৎর্সনা করে তার পাপের জন্য। সে তখন জবাবে লিখে -হে আতাহিয়া! তুমি কি চাও আমি
ছেড়ে দেই আনন্দ ফূর্তি করা
তুমি কি চাও আমি ধর্মকর্ম করে হারিয়ে ফেলি
আমার লোকদের কাছে আমার মর্যাদা।
[তিন]: যার জন্য তাওবার প্রয়োজন সে যেন তাড়াতাড়ি তাওবা করে। কারণ তাওবা করতে দেরী করাটাই পাপ।
[চার]: আল্লাহর হক যা ছুটে গেছে তা যথাসম্ভব আদায় করা। যেমন জাকাত দেয়া যা সে পূর্বে দেয়নি। কেননা এতে আবার দরিদ্র লোকজনের অধিকারও রয়েছে।
[পাঁচ]: পাপের স্থানকে ত্যাগ করা যদি সেখানে অবস্থান করলে আবার সে পাপে জড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকে।
[ছয়]: যারা পাপ কাজে সহযোগিতা করে তাদেরকে পরিত্যাগ করা (এটিও পূর্ববর্তী ১০০টি লোক হত্যাকারীর হাদীস থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।)
মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘আন্তরিক বন্ধুরাই সেদিন একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে, মুত্তাকীরা ছাড়া।’’ (সূরা আল-যুখরুফ: ৬৭)
খারাপ সাথীরা একে অপরকে কিয়ামতের দিন অভিশাপ দিবে। এজন্য হে তাওবাকারী, আপনাকে এদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে ও এদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে, যদি আপনি তাদেরকে দাওয়াত দিতে অপারগ হন। শয়তান যেন আপনার ঘাড়ে আবার সওয়ার হবার সুযোগ না পায় এবং আপনাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার কুপথে নিয়ে না যায়। আর আপনি তো জানেন যে, আপনি দুর্বল তাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবেন না। এ ধরণের অনেক ঘটনা রয়েছে যে, অনেক লোকই তার পুরাতন বন্ধু বান্ধবের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার পর আবার পাপে জড়িয়ে পড়েছে।
[সাত]: নিজের কাছে রক্ষিত হারাম জিনিসকে নষ্ট করে ফেলা। যেমন মাদক দ্রব্য, বাদ্যযন্ত্র, যেমন একতারা, হারমনিয়াম, অথবা ছবি, ব্লু ফ্লিম, অশ্লীল নভেল নাটক। এগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তাওবাকারীকে সঠিক পথে দৃঢ়ভাবে থাকার জন্য অবশ্যই সব জাহেলিয়াতের জিনিস থেকে মুক্ত হতে হবে। এ ধরণের অনেক ঘটনা রয়েছে, যাতে দেখা যায়, এসব হারাম জিনিসই তাওবাকারীর পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাবার পিছনে প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর দ্বারাই সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। আমরা আল্লাহর নিকট সঠিক পথে টিকে থাকার জন্য তাওফীক কামনা করছি।
[আট]: ভাল সঙ্গী-সাথী গ্রহণ করতে হবে যারা তাকে দ্বীনের ব্যাপারে সহায়তা করবে এবং এরা হবে খারাপ সঙ্গী সাথীর বিকল্প। আর চেষ্টা করতে হবে বিভিন্ন ধর্মীয় ও ইলমী আলোচনায় বসার জন্য। নিজেকে সব সময় এমন কাজে মশগুল রাখতে হবে যাতে কল্যাণ রয়েছে, যেন শয়তান তাকে পূর্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেবার সুযোগ না পায়।
[নয়]: নিজ শরীরের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে যাকে সে হারাম দিয়ে প্রতিপালন করেছে। একে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লাগাতে হবে এবং হালাল রুজি খেতে হবে যেন শরীরে আবার পবিত্র রক্ত-গোশত সৃষ্টি হয়।
[দশ]: তাওবা দম আটকে যাওয়া বা ফুরিয়ে যাবার (মৃত্যুর পূর্বক্ষণে শ্বাসকষ্ট শুরু হবার) পূর্বে এবং পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হবার পূর্বে হতে হবে। ঘড়ঘড়ার অর্থ হলো কণ্ঠনালী হতে এমন শব্দ বের হওয়া যা মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য হলো কিয়ামতের পূর্বেই তাওবা করতে হবে তা ছোট কিয়ামত হোক (মৃত্যু) বা বড় কিয়ামতই হোক (পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া)। কেননা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট তাওবা করবে ঘড়ঘড়া উঠার পূর্বে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন।’’ (আহমাদ, তিরমিযী, সহীহ আল জামে’ : ৬১৩২) অপর হাদীসে তিনি বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উঠার পূর্বে তাওবা করবে, আল্লাহ তা’আলা তার তাওবা কবুল করবেন।’’ (মুসলিম)
গামেদিয়া (গামেদিয়া গোত্রের জনৈকা মহিলা) এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ব্যভিচার করেছি, আপনি আমাকে পবিত্র করুন! তখন রাসূল তাকে ফিরিয়ে দিলেন। পরের দিন সে আবার এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! কেন আপনি আমাকে ফেরত পাঠালেন? হয়তো আপনি আমাকে মায়েযের মত ফেরত পাঠাচ্ছেন! আল্লাহর শপথ! আমি গর্ভবতী। তখন তিনি তাকে বললেন, যখন সন্তান প্রসব করবে, তারপর আসবে। সন্তান জন্ম নেবার পর বাচ্চাটিকে একটি কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে তিনি রাসূলের নিকট হাজির হলেন। তিনি তাকে বললেন, যাও যখন সে খাবার খেতে পারবে তখন আসবে। এরপর যখন বাচ্চা খাবার খেতে শুরু করে তখন মহিলা তার সন্তানকে নিয়ে এসে হাজির হয়, তখন বাচ্চার হাতে এক টুকরা রুটি ধরা ছিল। সে বলে, হে আল্লাহর রাসূল! বাচ্চা এখন খাবার খাচ্ছে। অতঃপর তার বাচ্চাটাকে একজন মুসলমানের জিম্মায় দেয়া হলো। এরপর তার বুক পর্যন্ত গর্ত খুড়তে নির্দেশ দেয়া হলো। এরপর লোকদের নির্দেশ দেয়া হলো তাকে যেন পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। হযরত খালিদ ইবনে অলিদ একটা পাথর ছুঁড়ে তার মাথায় মারেন, যার ফলে রক্ত ছুটে খালিদের মুখে এসে পড়ে, এজন্য খালিদ তাকে গালি দেন। নবী করীম সাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম তার গালি শুনতে পেয়ে বলেন, ধীরে, হে খালিদ! আমার জীবন যে সত্বার হাতে রয়েছে তার কসম। এই মহিলা এমন তাওবা করেছে যদি এ তাওবা কোন অবৈধ ট্যাক্স আদায়কারী করতো তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হতো। এরপর নির্দেশ দেয়া হয় এবং তার জানাযা পড়ে তাকে দাফন করা হয়। (মুসলিম)
এক বর্ণনায় এসেছে, হযরত উমার রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তাকে রজম (পাথর ছুড়ে হত্যা) করলেন এরপর তার আবার জানাযা পড়বেন? তখন তিনি বললেন, সে এমন তাওবা করেছে তা যদি মদ্বীনার সত্তর জন লোকের মাঝে বন্টন করে দেয়া হতো তাহলে তা যথেষ্ট হতো। তুমি কি এর চেয়ে আর কাউকে উত্তম দেখেছো যে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিজের জীবন নিয়ে উপস্থিত হয়েছে? (মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক ৭/৩২৫)
প্রথমত: ইমাম মুসলিম রহমাতুল্লাহ আলাইহি আমর ইবনে আ’স রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহুর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করেন। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি বলেন: মহান আল্লাহ যখন আমার অন্তরে ইসলামকে পছন্দনীয় করে দিলেন, তখন আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গিয়ে বললাম, আপনি আপনার হাত বাড়ান আমি বাইয়াত করবো। তখন তিনি হাত বাড়ালে আমি হাত গুটিয়ে নি। তিনি বলেন, হে আমর তোমার কি হলো? আমি বললাম, আমি শর্ত করতে চাই। তিনি বলেন, কিসের শর্ত? বললাম, আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়। তিনি বললেন, হে আমর! তুমি কি জাননা যে, ইসলাম পূর্বের সবকিছু ধ্বংস করে দেয় এবং হিজরত পূর্বের সমস্ত গুনাহ ধ্বংস করে দেয়।
দ্বিতীয়ত: মুসলিম শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে। কিছু মুশরিক লোক মানুষ হত্যা করে এবং তারা অনেক হত্যাকান্ড ঘটায়, জিনা করে এবং অনেক ব্যভিচার করে এরপর হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলে, আপনি যা বলেন এবং যার দিকে আহবান করেন তা অতি উত্তম। এখন আপনি যদি আমাদেরকে জানাতেন যে, আমরা যা করেছি এর কি কাফ্ফারা রয়েছে? তখন আল্লাহর এ বাণী নাযিল হয়:‘‘আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন মা’বুদের উপাসনা করে না এবং আল্লাহ যাকে (হত্যা করা) হারাম করে দিয়েছেন, তাকে হত্যা করে না, শরীয়ত সম্মত কারণ ব্যতীত এবং তারা ব্যভিচার করে না, আর যে ব্যক্তি এরূপ কাজ করবে, তাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কিয়ামাতের দিন তার শাস্তি বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং সে তাতে অনন্তকাল লাঞ্ছিত অবস্থায় থাকবে। কিন্তু যারা তাওবা করবে এবং ঈমান আনবে আর নেক কাজ করতে থাকবে আল্লাহ তাদের পাপসমূহকে পুণ্যে পরিবর্তন করে দিবেন। আর আল্লাহ বড়ই করুণাময়। (সূরা আল ফুরকান: ৬৮-৭০)
এবং এ আয়াতটিও নাযিল হয়: ‘‘আপনি বলে দিন, (আল্লাহ বলেন) হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছো, তোমরা আল্লাহ তায়ালার রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ (অতীতের) সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করবেন। নিশ্চয় তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, দয়ালু।’’ (সূরা আয যুমার: ৫৩)
যিহার: পরিচয়, কাফফারা এবং এ সংক্রান্ত জরুরি বিধি-বিধান
▬▬▬❂◉❂▬▬▬
ইসলামি ফিকহে যিহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। কারণ এর সাথে দাম্পত্য জীবনের হালাল-হারামের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধান জড়িয়ে আছে। তাছাড়া জাহেলি যুগ থেকে চলে আসা এর অব্যবহারে ব্যাপারে ইসলামের সঠিক নির্দেশনা জানাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
তাই নিম্নে যিহারের সংজ্ঞা, এর কাফফারা এবং এ সংক্রান্ত জরুরি কিছু বিধান সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে সহজ ভাষায় আলোচনা করা হল: وبالله التوفيق
❑ যিহার কী?
সম্মানিত ফিকাহবিদগণ যিহার এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,
تشبيه الزوج زوجته في الحرمة بمحرمه
“স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনও মাহরাম নারীর সাথে সাদৃশ্য দেওয়াকে যিহার বলা হয়।”
অথবা تشبيه المنكوحة بمن تحرم عليه “বিবাহিত স্ত্রীকে এমন মহিলার সাথে সাদৃশ্য দেওয়া যে তার জন্য হারাম।” [শারহু যাদিল মুস্তাকনি-শাইখ মুহাম্মদ মুখতার শানকিতি। শাইখ উক্ত গ্রন্থে বিভিন্ন মাজহাবের আলোকে যিহারের আরও একাধিক সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন]
উদাহরণ: কোনও পুরুষ যদি তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে যে, তুমি আমার জন্য হারাম যেমন আমার মা আমার জন্য হারাম বা যেমন আমার বোন আমার জন্য হারাম…বা এ জাতীয় বাক্য তাহলে এটাকে যিহার বলা হয়। এর বিভিন্ন রূপ আছে এবং সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও কিছু ভিন্নতা আছে-যেগুলো ফিকহের কিতাব সমূহে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে।
যিহার প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنكُم مِّن نِّسَائِهِم مَّا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ ۖ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ ۚ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَزُورًا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ
“তোমাদের মধ্যের যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে ‘যিহার’ (মায়ের মত হারাম বলে ঘোষণা করে) করে- তাদের স্ত্রীগণ তাদের মাতা নয়। তাদের মা তো কেবল তারাই, যারা তাদেরকে জন্মদান করেছে। তারা তো অসমীচীন ও ভিত্তিহীন কথাই বলে। নিশ্চয় আল্লাহ মার্জনা কারী, ক্ষমাশীল।” [সূরা মুজাদিলা: ২]
সাধারণত: স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বামীর পক্ষ থেকে রাগ বশত: যিহার সংঘটিত হয়। যেমন: তাফসিরে উল্লেখ করা হয় যে, খাওলা বিনত সালাবা এবং তার অতিবৃদ্ধ স্বামী আউস ইবনুস সামিত রা. এর মাঝে মনোমালিন্য হওয়ার প্রেক্ষাপটে আউস রা. ক্রোধান্বিত হয়ে তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, «أنتِ عليَّ كظهرِ أمِّي» “তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পিঠের মত।” অর্থাৎ আমার মা যেমন, আমার উপর হারাম তেমনি তুমিও আমার জন্য হারাম। জাহেলি যুগে কেউ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে এভাবে বলতো।
যাহোক ঘটনাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছলে তিনি তাদের মাঝে সমঝোতা করার চেষ্টা করছিলেন ইত্যবসরে তার উপর সূরা মুজাদালার জিহার সংক্রান্ত আয়াত সমূহ নাজিল হয়। তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে যিহারের কাফফারা প্রদানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। [তাফসিরে ইবনে কাসির-সংক্ষেপায়িত]
❑ যিহারের বিধান কী
ইসলামে যিহার একটি অন্যায় আচরণ এবং হারাম কাজ। কেউ এমনটি করলে তার জন্য কাফফারা আদায় করা আবশ্যক। কাফফারা আদায়ের পূর্বে স্বামী-স্ত্রী মিলন হারাম। জাহেলি যুগে যিহার করাকে তালাক হিসেবে গণ্য করা হতো। ফলে চিরস্থায়ী ভাবে স্ত্রী মিলন নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা হত। যেমন: তাফসিরে কুরতুবিতে এসেছে,
وذلك كان طلاق الرجل امرأته في الجاهلية
“জাহিলি যুগে এটাই স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাক ছিলো।” কিন্তু ইসলাম তা স্থায়ী হারামের পরিবর্তে অস্থায়ী হারামে রূপান্তরিত করেছে। অর্থাৎ কোনও স্বামী তার স্ত্রীর সাথে যিহার করলে কাফফারা প্রদান করলে তা হালাল হয়ে যাবে।
❑ যিহারের কাফফারা কী?
যিহারের কাফফারা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِن نِّسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِّن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۚ ذَٰلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ - فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۖ فَمَن لَّمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ۚ ذَٰلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ۚ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ
“যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে ফেলে, অতঃপর তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার করে, তাদের কাফফারা হল, একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি দাসকে মুক্তি দিবে। এটা তোমাদের জন্যে উপদেশ হবে। আল্লাহ খবর রাখেন তোমরা যা কর। যার এ সামর্থ্য নেই, সে একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে ধারাবাহিকভাবে দু মাস রোজা রাখবে। যে এতেও অক্ষম হয় সে ষাট জন মিসকিনকে আহার করাবে। এটা এজন্যে, যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি। আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি।” [সূরা মুজাদিলা: ৩ ও ৪]
অর্থাৎ যিহারের কাফফারা রমজান মাসে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসের কাফফারার অনুরূপ। তা হল:
- ১. একটি মুমিন দাস মুক্ত করা। কিন্তু বর্তমান যুগে দাস-দাসী প্রথা প্রচলিত না থাকার কারণে তা প্রযোজ্য নয়।
- ২. এটি সম্ভব না হলে ধারাবাহিকভাবে দু মাস রোজা থাকা। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের হায়েজ বা নেফাস শুরু হলে সে দিনগুলোতে রোজা থেকে বিরত থাকবে। অনুরূপভাবে ঈদ উপলক্ষে রোজা রাখা নিষিদ্ধ দিনগুলোতে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকবে। অত:পর হায়েজ-নেফাস থেকে পবিত্র হলে এবং ঈদে রোজা রাখা নিষিদ্ধ দিনগুলো অতিবাহিত হলে যথারীতি রোজা রাখা শুরু করবে।
- ৩. তাও সম্ভব না হলে ৬০ জন মিসকিন (দরিদ্র-অসহায় মানুষ) কে এক বেলা খাবার খাওয়ানো অথবা খাদ্য দ্রব্য দান করা। খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ, প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্য (যেমন: আমাদের দেশে চাল) থেকে প্রায় সোয়া কেজি। এর সমপরিমাণ টাকা দেওয়া শরিয়ত সম্মত নয়। কারণ কুরআনে খাদ্যদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং এর ব্যতিক্রম করা বৈধ নয়।
❑ স্ত্রীর পক্ষ থেকে কি স্বামীর সাথে যিহার হয়?
পূর্বোক্ত আয়াতের আলোকে অধিকাংশ আলেম বলেন, যিহার কেবল স্বামীর পক্ষ থেকে হয়; স্ত্রীর পক্ষ থেকে নয়। কারণ আল্লাহ উক্ত আয়াতে কেবল স্বামীদের কথাই উল্লেখ করেছেন।
অত:এব কোনও স্ত্রী যদি তার স্বামীকে এভাবে বলে যে, “তুমি আমার জন্য হারাম যেমন আমার জন্য আমার পিতা হারাম অথবা যেমন আমার ভাই আমার জন্য হারাম” তাহলে অধিক বিশুদ্ধ মতে তা ‘যিহার’ বলে গণ্য হবে না। বরং তা হালালকে হারাম করার অন্তর্ভুক্ত। এটিও হারাম ও গুনাহের কাজ।
এটি কসম হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে তার করণীয় হল, কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করা।
শাইখ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়, কোন হতভাগা স্বামী স্ত্রীকে ‘তুই আমার মা বা মায়ের মত’ বললে ‘যিহার’ হয়। কিন্তু যদি কোন হতভাগী স্ত্রী ‘তুমি আমার পিতা বা পিতার মত’ বলে। তাহলে তার বিধান কি?
তিনি উত্তরে বলেন, “এ ক্ষেত্রে মহিলার পক্ষ থেকে যিহার হবে না। কেবল মহিলাকে কসমের কাফফারা আদায় করতে হবে।” [দ্বীনী প্রশ্নোত্তর, বিবাহ ও দাম্পত্য- শাইখ আবদুল হামীদ ফাইযী]
শাইখ আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. ও অনুরূপ কথা বলেছেন।
❂ কসম ভঙ্গের কাফফারা:
- দশজন মিসকিনকে মধ্যম ধরণের খাবার খাওয়ানো। (টাকা দেওয়া শরিয়ত সম্মত নয়)
- অথবা ১০ জন মিসকিন (দরিদ্র-অসহায় মানুষকে) পোশাক দেয়া।
- অথবা একটি দাস মুক্ত করা।
- এ তিনটির কোনটি সম্ভব না হলে (লাগাতার) তিনটি রোজা রাখা।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّـهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَـٰكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ الْأَيْمَانَ ۖ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ ۖ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ ۚ ذَٰلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ ۚ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
“আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অনর্থক শপথের জন্যে; কিন্তু পাকড়াও করেন ঐ শপথের জন্যে যা তোমরা মজবুত করে বাঁধ। অতএব, এর কাফফরা এই যে, দশজন দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করবে; মধ্যম শ্রেণির খাদ্য যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে দিয়ে থাক। অথবা, তাদেরকে বস্তু প্রদান করবে অথবা, একজন ক্রীতদাস কিংবা দাসী মুক্ত করে দিবে। যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে না, সে তিন দিন রোজা রাখবে। এটা কাফফরা তোমাদের শপথের, যখন শপথ করবে। তোমরা স্বীয় শপথসমূহ রক্ষা কর এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।” [সূরা মায়িদা: ৮৯]
সুতরাং কেউ যদি আর্থিক সংকটের কারণে উপরোক্ত তিনটি জিনিসের কোনটি দ্বারা কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে লাগাতার তিনটি রোজা রাখবে।
❑ কোনও স্বামী যদি সাধারণভাবে তার স্ত্রীকে নিজের জন্য হারাম ঘোষণা করে তাহলে তার বিধান কী?
কোনও স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তার কোনও মাহরাম নারীর সাথে সাদৃশ্য না দিয়ে সাধারণভাবে হারাম ঘোষণা করে। যেমন: সে বলল, “তুমি আমার জন্য হারাম।” অথবা স্ত্রীকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে বলল, তুমি যদি এ কাজ করো তাহলে তুমি আমার জন্য হারাম বা এ জাতীয় বাক্য তাহলে তা যিহার বলে গণ্য হবে না।
এটিও ইসলামে হারাম। কারণ তা আল্লাহর হালাল কৃত বিধানকে হারাম করার শামিল। এটিও কসম হিসেবে গণ্য হবে এবং এ ক্ষেত্রেও কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করা আবশ্যক।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ ۖ تَبْتَغِي مَرْضَاتَ أَزْوَاجِكَ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ – قَدْ فَرَضَ اللَّهُ لَكُمْ تَحِلَّةَ أَيْمَانِكُمْ
“হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্যে তা নিজের জন্যে হারাম করেছেন কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। আল্লাহ তোমাদের জন্যে কসম থেকে অব্যাহতি লাভের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তোমাদের মালিক।” [সূরা তাহরিম: ১ ও ২]
উপরোক্ত আয়াতের আলোকে ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
إِذَا حَرَّمَ الرَّجُلُ عَلَيْهِ امْرَأَتَهُ فَهِيَ يَمِينٌ يُكَفِّرُهَا
“যদি কোনও স্বামী তার স্ত্রীকে তার জন্য হারাম করে দেয় তাহলে তা হল, একটি কসম। যার জন্য কাফফারা আদায় করবে।” [বুখারি হা/৪৯১১ ও মুসলিম, হা/১৪৭৩]
উল্লেখ্য যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হালাল কৃত কোনও খাবার, পানীয়, পোশাক বা অন্য যে কোনও কিছুকে নিজের জন্য হারাম বলে ঘোষণা দেয় তাহলে তার উপর একই বিধান বর্তাবে। অর্থাৎ তার জন্য কসম ভঙ্গের কাফফারারা আদায় করা আবশ্যক।
তবে কেউ যদি উক্ত বাক্য বলার মাধ্যমে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার নিয়ত করে তাহলে তালাক বলে গণ্য হবে। কারণ “নিয়তের উপর সকল কর্ম নির্ভরশীল।” [সহিহ বুখারি]
❑ কোনও ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে বা কোনও স্ত্রী তার স্বামীকে তার কোনও মাহরামের সাথে বা তার বিশেষ কোনও অঙ্গের সাথে তুলনা করে তাহলে তার বিধান কী?
কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীর শারীরিক গঠন, সৌন্দর্য বা গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে বলে যে, তোমার চোখ দেখতে আমার মায়ের মতো, তোমার চেহারা আমার বোনের মত ইত্যাদি অথবা কোন মহিলা তার স্বামীকে বলে, তোমার দেহের গঠন আমার ভাই বা পিতার মত তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। অনুরূপভাবে সম্মান-মর্যাদার ক্ষেত্রে বা বৈশিষ্টগত ভাবে তুমি আমার মা/বাবার অনুরূপ তাহলেও তা যিহারের অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ হারাম করার নিয়ত না থাকলে যিহার বলে গণ্য হবে না। [আল মুগনি-ইবনে কুদামা]
قال ابن قدامة: وإن نوى به الكرامة والتوقير، أو أنها مثلها في الكبر، أو الصفة، فليس بظهار, والقول قوله في نيته.
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন করে সে আলোকে জীবন যাপনের তওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬❂◉❂▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।
প্রশ্ন: ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলারা কি খেলাধুলা করতে পারবে? খেলাধুলার ক্ষেত্রে ইসলামি মূলনীতি কী?
উত্তর:
শারীরিক সুস্থতা, মানসিক বিকাশ, হালাল বিনোদন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে শরীরচর্চা করা এবং কিছু খেলাধুলা উপকারী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাধুলার ফলে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সচল থাকে এবং শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। ফলে আল্লাহর রহমতে সবল দেহ, সচল মন এবং বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হয়। এতে মানসিক দিক থেকেও উপকৃত হওয়া যায়।
বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে শহুরে জীবনে নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীরা অধিকাংশই খেলাধুলা বলতে বোঝে অনলাইন ভিডিও গেম বা মোবাইল গেইম অথচ এগুলো স্বাস্থ্যের পক্ষে যেমন ক্ষতিকর তেমনই মানসিক বিকাশের পথেও বড় বাধা।
সুতরাং শরিয়তের গণ্ডির মধ্যে থেকে শিশু-কিশোর ও নারী-পুরুষ সকলের জন্য কিছু শরীর চর্চা করা ও হালাল খেলাধুলা করা নাজায়েজ নয়।
তবে এ ক্ষেত্রে কতিপয় ইসলামি মূলনীতি মেনে চলা আবশ্যক। যেমন:
১. খেলাধুলা অবশ্যই হালাল হতে হবে। যেমন: হাঁটা বা দৌড়, সাঁতার কাটা, ঘোড় দৌড়, বিভিন্ন ধরণের শারীরিক কসরত ইত্যাদি।
২. খেলাধুলার পিছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করা। কারণ একজন ইমানদার ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. খেলাধুলার কারণে নামাজ, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবহেলা প্রদর্শন না করা।
৪. খেলাধুলায় সীমাতিরিক্ত মত্ত না থাকা-যার কারণে স্বামী-সন্তান, পরিবার ও পেশাগত দায়-দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবহেলা পরিলক্ষিত হয়।
৫. খেলাধুলায় এত সময় ব্যয় না করা যার ফলে চাকুরী বা জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
৬. এমন পোশাক পরিধান করা জায়েজ নাই যার কারণে পর্দা লঙ্ঘিত হয় বা শরীরের গোপন অঙ্গ ও লজ্জা স্থানগুলো অন্যের সামনে দৃশ্যমান হয়।
৭. শরীর চর্চা বা খেলাধুলার ক্ষেত্রে মিউজিক ব্যবহার করা জায়েজ নাই।
৮. খেলাধুলায় বাজি বা জুয়া না থাকা।
৯. খেলাধুলাকে অর্থ উপার্জন এবং জীবিকার পেশা হিসেবে গ্রহণ না করা।
১০. মার্শাল আর্ট তথা জুডো, কারাতে, কুংফু ইত্যাদিতে প্রশিক্ষককে সম্মান প্রদর্শনার্থে মাথা বা শরীর ঝুঁকিয়ে বাউ (Bow) না করা।
উপরোক্ত শর্তাবলীর পাশাপাশি মহিলাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শর্ত হল,
১১. অবশ্যই তা সম্পূর্ণ ফিতনা-ফ্যাসাদ মুক্ত নিরাপদ পরিবেশে হতে হবে।
১২. পরপুরুষের সহবস্থান মুক্ত পর্দাবৃত স্থানে হতে হবে।
১৩. নির্জনে নন মাহরাম ব্যক্তির নিকটে অবস্থান করা যাবে না ইত্যাদি।
❂ মহিলাদের খেলাধুলার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বিশ্বনন্দিত ফকিহ, দাঈ ও আলেম শাইখ বিন বায রাহ. বলেন,
“পবিত্র শরীয়ত লঙ্ঘন করে না এমন ক্ষেত্রে মহিলাদের খেলাধুলায় কোনও ক্ষতি নেই। যেমন: তারা এমন সংরক্ষিত স্থানে অধিক পরিমাণে হাঁটবে যেখানে পরপুরুষরা মহিলাদের সাথে মেশে না এবং পরপুরুষরা তা দেখতে পায় না। অথবা বাড়িতে মহিলাদের মাঝে বা মহিলাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে সাঁতার কাটবে-যেখানে তাদেরকে পরপুরুষরা দেখে না এবং সেখানে পরপুরুষদের কোনও সংযোগ নাই।
তিনি আরও বলেন, যে সব খেলাধুলা নারীদের জন্য নির্ধারিত এবং যাতে ইসলাম নিষিদ্ধ কোনও কিছু নেই, নারী-পুরুষ সহবস্থান নেই বরং নারী-পুরুষ সংশ্রব মুক্ত ও পর্দাবৃত স্থানে খেলাধুলায় কোন দোষ নেই- চাই তা হাঁটা, সাঁতার কাটা বা এ জাতীয় খেলাধুলা যাই হোক না কেন। অনুরূপভাবে (এ সকল শর্ত সাপেক্ষে) তাদের মধ্যে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা করাও দূষণীয় নয়।” [শাইখের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট]
আল্লাহু আলাম।▬▬▬▬◈◯◈▬▬▬▬উত্তর প্রদানে:আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল। দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।
সংগ্রহে—
তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন