সূরা বাকারাঃ ১৫তম রুকু (১২২–১২৯)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:১২২ یٰبَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتِیَ الَّتِیۡۤ اَنۡعَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ وَ اَنِّیۡ فَضَّلۡتُکُمۡ عَلَی الۡعٰلَمِیۡنَ
১২২. হে ইসরাঈল-বংশধররা! আমার সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি। আর নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি (তৎকালীন) সৃষ্টিকুলের সবার উপর।
এখান থেকে আর একটি ধারাবাহিক ভাষণ শুরু হচ্ছে ৷ এখানে পরিবেশিত বক্তব্য সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন ৷
ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহীম পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল।
হযরত ছালেহ (আঃ)-এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহীমের আগমন ঘটে। ঈসা থেকে ব্যবধান ছিল ১৭০০ বছর অথবা প্রায় ২০০০ বছরের।
তিনি ছিলেন ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা এবং তাঁর স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন ‘উম্মুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের মাতা।
তাঁর স্ত্রী সারার পুত্র হযরত ইসহাক্ব-এর পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশধর ‘বনু ইসরাঈল’ নামে পরিচিত এবং অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে জন্ম নেন বিশ্বনবী ও শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ(ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। যাঁর অনুসারীগণ ‘উম্মতে মুহাম্মাদী’ বা ‘মুসলিম উম্মাহ’ বলে পরিচিত।
আবুল আম্বিয়া কেনো বলা হয়ঃ
ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন ইহুদী-খৃষ্টান-মুসলমান সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পিতা। কেননা আদম (আঃ) হ’তে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাযার পয়গম্বরের প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
إنَّ اللّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ- (آل عمران ৩৩)-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইবরাহীম ও আলে ইমরানকে বিশ্ববাসীর উপরে নির্বাচিত করেছেন’ (আলে ইমরানঃ৩৩)।
এই নির্বাচন ছিল বিশ্ব সমাজে আল্লাহর তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। ইবরাহীম ছিলেন নবীগণের পিতা এবং পুত্র মুহাম্মাদ ছিলেন নবীগণের নেতা, এ বিষয়টি সর্বদা মুমিনের মানসপটে জাগরুক রাখার জন্য দৈনিক ছালাতের শেষ বৈঠকে পঠিত দরূদের মধ্যে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদের উপরে এবং উভয়ের পরিবার বর্গের উপরে আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণের জন্য দো‘আ করার বিধান রাখা হয়েছে। ইবরাহীমের বংশে বরকত হ’ল নবুঅত ও ঐশী কিতাবের বরকত এবং মুহাম্মাদের ও তাঁর বংশে বরকত হ’ল বিজ্ঞানময় কুরআন ও হাদীছ এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার বরকত।
ইবরাহীম ও তাঁর বংশধর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ وَجَعَلْنَا فِيْ ذُرِّيَّتِهِ النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ وَآتَيْنَاهُ أَجْرَهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِيْنَ- (العنكبوت ২৭)-
‘আমরা তাকে দান করলাম ইসহাক্ব ও ইয়াকূবকে এবং তার বংশধরগণের মধ্যে প্রদান করলাম নবুঅত ও কিতাব। তাকে আমরা দুনিয়াতে পুরষ্কৃত করলাম। নিশ্চয়ই পরকালে সে সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আনকাবূত ২৯/২৭)।
অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيراً- (الأحزاب ২১)-
‘যারা আল্লাহ ও শেষদিবসের (অর্থাৎ আখেরাতে মুক্তির) আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক হারে স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের (মুহাম্মাদের) মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে’ (আহযাব ৩৩/২১)। অতঃপর তাঁর পরিবার সম্পর্কে বলা হয়েছে,
إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْراً-(الأحزاب ৩৩)-
‘হে নবী পরিবারের সদস্যগণ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে’ (আহযাব ৩৩/৩৩)।
শেষ যামানায় ইমাম মাহদী আসবেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর বংশধরগণের মধ্য হ’তে এ বিষয়ে বহু ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৪৫৩-৫৪; হাকেম ৪/৫৫৭-৫৮ পৃঃ প্রভৃতি।
এইভাবে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদের নাম পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত দিকে দিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হ’তে থাকবে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
এক: হজরত নূহের পরে হযরত ইবরাহীম প্রথম বিশ্বজনীন নবী ৷ মহান আল্লাহ তাঁকে ইসলামের বিশ্বজনীন দাওয়াত ছড়াবার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন ৷
প্রথমে তিনি নিজে সশরীরে ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তীন থেকে নিয়ে আরবের মরু অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পর্যন্ত বছরের পর বছর সফর করে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের (অর্থাৎ ইসলাম) দিকে আহবান করতে থাকেন ৷ অতপর এই মিশন সর্বত্র পৌছিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন ৷
পূর্ব জর্দানে নিজের ভাতিজা হযরত লূতকে নিযুক্ত করেন ৷
সিরিয়া ও ফিলিস্তীনে নিযুক্ত করেন নিজের ছেলে হযরত ইসহাককে এবং
আরবের অভ্যন্তরে নিযুক্ত করেন নিজের বড় ছেলে হযরত ইসমাঈলকে ৷
তারপর মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় কা’বাগৃহ নির্মাণ করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ মতো এটিকেই এই মিশনের কেন্দ্র গণ্য করেন ৷
দুই: হযরত ইবরাহীমের বংশধারা দু’টি বড় বড় শাখায় বিভক্ত হয় ৷
একটি শাখা হচ্ছে, হযরত ইসমাঈলের সন্তান-সন্ততিবর্গ ৷ এরা আরবে বসবাস করতো ৷ কুরাইশ ও আরবের আরো কতিপয় গোত্র এর অন্তরভুক্ত ছিল ৷ আর যেসব আরব গোত্র বংশগত দিক দিয়ে হযরত ইসমাঈলের সন্তান ছিল না তারাও তাঁর প্রচারিত ধর্মে কমবেশী প্রভাবিত ছিল বলেই তাঁর সাথেই নিজেদের সম্পর্ক জুড়তো ৷
দ্বিতীয় শাখাটি ছিল হযরত ইসহাকের সন্তানবর্গের ৷ এই শাখায় হযরত ইয়াকুব, হযরত ইউসূফ , হযরত মূসা, হযরত দাউদ, হযরত সুলাইমান , হযরত ইয়াহ্হিয়া, হযরত ঈসা প্রমুখ অসংখ্য নবী জন্মগ্রহণ করেন ৷
যেহেতু হযরত ইয়াকুবের আর এক নাম ছিল ইসরাঈল , তাই তাঁর বংশ বনী ইসরাঈল নামে পরিচিত হয় ৷তাঁর প্রচার অভিযানের ফলে যেসব জাতি তাঁর দীন গ্রহণ করে তারা তার মধ্যে নিজেদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বিলুপ্ত করে দেয় অথবা তারা বংশগতভাবে তাদের থেকে আলাদা থাকলেও ধর্মীয়ভাবে তাদের অনুসারী থাকে ৷ এই শাখায় অবনতি ও অধপতন সূচিত হলে প্রথমে ইহুদিবাদ ও পরে খৃস্টবাদের উদ্ভব হয় ৷
তিন : হযরত ইবরাহীমের আসল কাজ ছিল সমগ্র দুনিয়াবাসীকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহবান জানানো এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা পরিশুদ্ধ ও সংশোধিত করে গড়ে তোলা ৷ তিনি নিজে ছিলেন আল্লাহর অনুগত ৷ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান অনুযায়ী নিজের জীবনের সমস্ত কাজ-কারবার পরিচালনা করতেন সারা দুনিয়ায় এই জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটাতেন এবং চেষ্টা করতেন যাতে সমস্ত মানুষ বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভুর অনুগত হয়ে এ দুনিয়ায় জীবন যাপন করে ৷ এই মহান ও বিরাট কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে তাঁকে বিশ্বনেতার পদে অভিষিক্ত করা হয় ৷
তারপর তাঁর বংশধারা থেকে যে শাখাটি বের হয়ে হযরত ইসহাক ও হযরত ইয়াকুবের নামে অগ্রসর হয়ে বনী ইসরাঈল নাম ধারণ করে সেই শাখাটি তার এ নেতৃত্বের উত্তরাধিকার লাভ করে ৷ এই শাখায় নবীদের জন্ম হতে থাকে এবং এদেরকেই সত্য-সঠিক পথের জ্ঞানদান করা হয় ৷ বিশ্বের জাতিসমূহকে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার দায়িত্ব এদের ওপর সোপর্দ করা হয় ৷ এটি ছিল আল্লাহর মহান অনুগ্রহ ও নিয়ামত ৷ মহান আল্লাহ এ বংশের লোকদেরকে তাই একথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ৷
এ শাখাটি হযরত সুলাইমানের আমলে বাইতুল মাকদিসকে নিজেদের কেন্দ্র গণ্য করে ৷ তাই যতদিন পর্যন্ত এ শাখাটি নেতৃত্বের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিল ততদিন পর্যন্ত বাইতুল মাকদিসই ছিল দাওয়াত ইলাল্লাহ— মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাবার উদ্দেশ্যে পরিচালিত যাবতীয় কর্মকান্ডের কেন্দ্র ৷
চার: পেছনের দশটি রুকু’তে মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে তাদের ঐতিহাসিক অপরাধসমূহ এবং কুরআন নাযিল হবার সময়ে তাদের যে অবস্থা ছিল তা হুবহু বর্ণনা করেছেন ৷ এ সংগে তাদেরকে একথা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা আমার নিয়ামতের চরম অমর্যাদা করেছো ৷ তোমরা কেবল নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত থাকোনি বরং নিজেরাও সত্য ও সততার পথ পরিহার করেছো ৷ আর এখন তোমাদের একটি ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী ছাড়া তোমাদের সমগ্র দলের মধ্যে আর কোন যোগ্যতা অবশিষ্ট নেই৷
পাঁচ: অতপর এখন তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, বিশ্বমানবতার নেতৃত্ব ইবরাহীমের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার নয় ৷ বরং নবী ইবরাহীম নিজে যে নিষ্কলুষ আনুগত্যের মধ্যে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছিলেন এটি হচ্ছে তারই ফসল ৷ যারা ইবরাহীমের পথে নিজেরা চলে এবং সমগ্র বিশ্ববাসীকে চালাবার দায়িত্ব পালন করে একমাত্র তারাই এই নেতৃত্বের যোগ্যতা লাভ করতে পারে ৷ যেহেতু তোমরা এ পথ থেকে সরে গেছো এবং এ দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছো তাই নেতৃত্বের পদ থেকে তোমাদের অপসারিত করা হচ্ছে ৷
ছয়: সংগে সংগে ইশারা-ইংগিতে একথাও বলে দেয়া হচ্ছে , যেসব অইসরাঈলী জাতি মূসা ও ঈসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে নিজেদের সম্পর্ক জুড়েছিল তারাও ইবরাহীমের পথ থেকে সরে গেছে ৷ এই সংগে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে,আরবের মুশরিকরাও ইবরাহীম ও ইসমাঈলের সাথে নিজেদের সম্পর্ক রয়েছে বলে গর্ব করে বেড়ায় কিন্তু তারা আসলে নিজেদের বংশ ও গোত্রের অহংকারে মত্ত হয়ে পড়েছে ৷ ইবরাহীম ও ইসমাঈলের পথের সাথে এখন তাদের দূরবর্তী সম্পর্কও নেই ৷ কাজেই তাদের কেউই বিশ্বনেতৃত্বের যোগ্যতা ও অধিকার রাখে না ৷
সাত:আবার একথাও বলা হচ্ছে , এখন আমরা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশের দ্বিতীয় শাখা বনী ইসরাঈলের মধ্যে এমন এক নবীর জন্ম দিয়েছি যার জন্য ইবরাহীম ও ইসমাঈল উভয়েই দোয়া করেছিলেন ৷ ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক , ইয়াকুব ও অন্যান্য সকল নবী যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তিনিও সেই একই পথ অবলম্বন করেছেন ৷ আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় যত নবী ও রসূল এসেছেন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা তাদের সবাইকে সত্য নবী বলে স্বীকার করেন ৷ সকল নবী বিশ্ববাসীকে যে পথের দিকে আহবান জানিয়েছেন তিনি ও তাঁর অনুসারীগণও মানুষকে সেদিকে আহবান জানান ৷ কাজেই যারা এ নবীর অনুসরণ করে এখন একমাত্র তারাই বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের যোগ্যতা ও অধিকার রাখে ৷
আট: নেতৃত্ব পরিবর্তনের ঘোষণার সাথে সাথেই স্বাভাবিকভাবেই কিব্লাহ পরিবর্তনের ঘোষণা হওয়া জরুরি ছিল ৷ যতদিন বনী ইসরাঈলদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠত ছিল ততদিন বাইতুল মাকদিস ছিল ইসলামী দাওয়াতের কেন্দ্র এবং সেটিই ছিল সত্যপন্থীদের কিব্লাহ ৷ শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীগণও ততদিন বাইতুল মাকদিসকেই তাঁদের কিব্লাহ বানিয়ে রেখেছিলেন ৷ কিন্তু বনী ইসরাঈলকে এ পদ থেকে অপসারিত করার পর বাইতুল মাকদিসের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব আপনা-আপনি খতম হয়ে গেল ৷ কাজেই ঘোষণা করে দেয়া হলো , যেখান থেকে এ শেষ নবীর দাওয়াতের সূচনা হয়েছে সেই স্থানটিই হবে এখন আল্লাহর দীনের কেন্দ্র ৷ আর যেহেতু শুরুতে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াতের কেন্দ্রও এখানে ছিল তাই আহ্লি কিতাবও মুশরিকদের জন্যও এ স্থানটির অর্থাৎ কা’বার কেন্দ্র হবার সর্বাধিক অধিকারের দাবী স্বীকার করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই ৷ অবশ্যি হঠধর্মীদের কথা আলাদা ৷ তারা সত্যকে সত্য জেনেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ আনতে থাকে ৷
নয়: উম্মাতে মুহাম্মাদীয়ার নেতৃত্ব ও কা’বার কেন্দ্র হবার কথা ঘোষণা করার পরই মহান আল্লাহ ১৯ রুকূ’ থেকে সূরা বাকারার শেষ পর্যন্ত আলোচনায় ধারাবাহিক হেদায়াতের মাধ্যমে এ উম্মাতের জীবন গঠন ও জীবন পরিচালনার জন্য বিধান দান করেছেন ৷
২:১২৩ وَ اتَّقُوۡا یَوۡمًا لَّا تَجۡزِیۡ نَفۡسٌ عَنۡ نَّفۡسٍ شَیۡئًا وَّ لَا یُقۡبَلُ مِنۡهَا عَدۡلٌ وَّ لَا تَنۡفَعُهَا شَفَاعَۃٌ وَّ لَا هُمۡ یُنۡصَرُوۡنَ
১২৩. আর তোমরা সেদিনের তাকওয়া অবলম্বন কর যেদিন কোন সত্তা অপর কোন সত্তার কোন কাজে আসবে না। কারো কাছ থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ হবে না এবং কোন সুপারিশ কারো পক্ষে লাভজনক হবে না। আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।
مٰلِکِ یَوۡمِ الدِّیۡنِ
বিচার দিনের মালিক। সূরা ফাতিহাঃ৪
১. এখানে আল্লাহকে বিচার দিনের মালিক’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এই দিনের প্রকৃত রূপটি যে কি এবং জনগণের সম্মুখে এই দিন কি অবস্থা দেখা দিবে তা এখানে প্রকাশ করে বলা হয় নি। অন্যত্র তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে
وَمَا أَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ ٭ ثُمَّ مَا أَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ ٭ يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا وَالْأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ
“বিচারের দিনটি কি, তা কিসে আপনাকে জানাবে? আবার জিজ্ঞাসা করি, কিসে আপনাকে জানাবে বিচারের দিনটি কি? তাহা এমন একটি দিন, যে দিন কেউই নিজের রক্ষার জন্য কোনই সাহায্যকারী পাবে না, এবং সমগ্র ব্যাপার নিরঙ্কুশ ভাবে আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত হবে” [সূরা আল-ইনফিতার: ১৭-১৯]
আর يَوْمُ الدِّينِ বলিতে যে বিচারের দিন, প্রতিফল-তথা শাস্তি বা পুরষ্কার দানের দিন বুঝায়, তা অন্য আয়াতাংশে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে,
يَوْمَئِذٍ يُوَفِّيهِمُ اللَّهُ دِينَهُمُ الْحَقَّ “আজকের দিনে আল্লাহ লোকদের প্রকৃত কর্মফল পূর্ণ করে দিবেন” (সূরা আন-নূর: ২৫]
বিচার দিবসের গুরুগম্ভীর পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সামান্য আন্দাজ করা যায় এই কথা হতে যে, বিচারের দিন জিজ্ঞেস করা হবে, “আজকার দিনে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব কার?” তার উত্তরে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হবে, “তা সবই একমাত্র সার্বভৌম ও শক্তিমান আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট” [সূরা আল-গাফির: ৫৯],
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “এটা সে দিনের কথা যেদিন কোন লোকই অন্য কারও জন্য কিছু করতে সক্ষম হবে না। সে দিন সমস্ত কর্তৃত্বই হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য” [সূরা আল-ইনফিতার: ১৯] আল্লাহর এই নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব কার্যকর হবে প্রথম সিংগায় ফুঁক দেয়ার দিন হতেই। বলা হয়েছে, “আর তার নিরঙ্কুশ মালিকানা কার্যকর হবে সিংগায় ফুঁক দেয়ার দিনই [সূরা আল আন’আম: ৭৩]
আর তোমরা সে দিনের তাকওয়া অবলম্বন কর যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না। আর কারো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না এবং কারো কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না। আর তারা সাহায্যও প্রাপ্ত হবে না। বাকারাঃ ৪৮
সুতরাং (সেদিন) কি অবস্থা হবে? যেদিন আমি তাদেরকে একত্র করব যাতে কোন সন্দেহ নেই এবং প্রত্যেককে তাদের অর্জিত কাজের প্রতিদান পূর্ণভাবে দেয়া হবে। আর তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। আলে ইমরানঃ২৫
২:১২৪ وَ اِذِ ابۡتَلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ رَبُّهٗ بِکَلِمٰتٍ فَاَتَمَّهُنَّ ؕ قَالَ اِنِّیۡ جَاعِلُکَ لِلنَّاسِ اِمَامًا ؕ قَالَ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِیۡ ؕ قَالَ لَا یَنَالُ عَهۡدِی الظّٰلِمِیۡنَ
১২৪. আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, অতঃপর তিনি সেগুলো পূর্ণ করেছিলেন। আল্লাহ্ বললেন, নিশ্চয় আমি আপনাকে মানুষের ইমাম বানাবো। তিনি বললেন, ‘আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও?’ (আল্লাহ) বললেন, আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদেরকে পাবে না।
যে যে বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে কুরআনে শুধু كَلِمَات (বাক্যসমূহ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা প্রসংগে সাহাবী ও তাবেয়ীদের বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত আছে। কেউ আল্লাহর বিধানসমূহের মধ্য থেকে দশটি, কেউ ত্রিশটি এবং কেউ কমবেশী অন্য বিষয় উল্লেখ করেছেন। বাস্তব ক্ষেত্রে এতে কোন বিরোধ নেই, বরং সবগুলোই ছিল ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পরীক্ষার বিষয়বস্তু। প্রখ্যাত তাফসীরকারক ইবনে-জরীর ও ইবনে কাসীরের অভিমত তাই।
এ ধরনের পরীক্ষার বিষয়বস্তুর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এইঃ
আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা ছিল ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে স্বীয় বন্ধুত্বের বিশেষ মুল্যবান পোষাক উপহার দেয়া। তাই তাকে বিভিন্ন রকমের কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। সমগ্র জাতি, এমনকি তার আপন পরিবারের সবাই মূর্তি পূজায় লিপ্ত ছিল। সবার বিশ্বাস ও রীতি-নীতির বিপরীত একটি সনাতন দ্বীন তাকে দেয়া হয়। জাতিকে এ দ্বীনের দিকে আহবান জানানোর গুরুদায়িত্ব তার কাধে অর্পণ করা হয়। তিনি নবীসুলভ দৃঢ়তা ও সাহসিকতার মাধ্যমে নির্ভয়ে জাতিকে এক আল্লাহর দিকে আহবান জানান। বিভিন্ন পন্থায় তিনি মূর্তিপূজার নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করেন। প্রকৃতপক্ষে কার্যক্ষেত্রে তিনি মূর্তিসমূহের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। ফলে সমগ্র জাতি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়। বাদশাহ নমরূদ ও তার পরিবারবর্গ তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহর খলীল প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য এসব বিপদাপদ সত্ত্বেও হাসিমুখে নিজেকে আগুনে নিক্ষেপের জন্য পেশ করেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বন্ধুকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখে আগুনকে নির্দেশ প্রদান করলেন, ‘হে আগুন! ইবরাহীমের উপর সুশীতল ও নিরাপত্তার কারণ হয়ে যাও।” [সূরা আল-আম্বিয়া ৬৯]
এ পরীক্ষা শেষ হলে জন্মভূমি ত্যাগ করে সিরিয়ায় হিজরত করার পর দ্বিতীয় স্বগোত্র জন্মভূমিকেও হাসিমুখে ত্যাগ করে পরিবার-পরিজনসহ সিরিয়ায় হিজরত করলেন। সিরিয়ায় অবস্থান শুরু করতেই নির্দেশ এল, স্ত্রী হাজেরা ও তার দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-কে সংগে নিয়ে এখান থেকেও স্থানান্তরে গমন করুন। [ইবনে কাসীর] জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম আসলেন এবং তাদের সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন। চলতে চলতে যখন শুস্ক পাহাড় ও উত্তপ্ত বালুকাময় প্রান্তর এসে গেল (যেখানে ভবিষ্যতে বায়তুল্লাহ নিৰ্মাণ ও মক্কা নগরী আবাদ করা লক্ষ্য ছিল), তখন সেখানেই তাদেরকে থামিয়ে দেয়া হল। আল্লাহ্র বন্ধু তার রবের ভালবাসায় এ জনশূন্য তৃণলতাহীন প্রান্তরেই তাদের থাকতে বললেন। কিন্তু পরীক্ষার এখানেই শেষ হলো না। অতঃপর ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম নির্দেশ পেলেন যে, স্ত্রী হাজেরা ও শিশুকে এখানে রেখে নিজে সিরিয়ায় ফিরে যান। আল্লাহর বন্ধু নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তা পালন করতে তৎপর হলেন এবং সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক আমি চলে যাচ্ছি – স্ত্রীকে একটুকু কথা বলে যাওয়ার দেরীও তিনি সহ্য করতে পারলেন না। হাজেরা তাকে চলে যেতে দেখে বললেন, আপনি কি আল্লাহর কোন নির্দেশ পেয়েছেন? ইবারাহীম আলাইহিস সালাম বললেন, ‘হ্যাঁ। আল্লাহর নির্দেশের কথা জানতে পেরে হাজেরা বললেন, যান, যে প্রভূ আপনাকে চলে যেতে বলেছেন, তিনি আমাদের ধ্বংস হতে দেবেন না। [বুখারী ৩৩৬৪]
অতঃপর হাজেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে জন-মানবহীন প্রান্তরে কালাতিপাত করতে থাকেন। সাথের সংরক্ষিত পানি ফুরিয়ে যাওয়ায় এক সময় দারুন পিপাসা তাকে পানির খোঁজে বের হতে বাধ্য করল। তিনি শিশুকে উন্মুক্ত প্রান্তরে রেখে ‘সাফা’ ও ‘মারওয়া’ পাহাড়ে বার বার উঠা-নামা করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও পানির চিহ্নমাত্র দেখলেন না এবং এমন কোন মানুষও দৃষ্টিগোচর হলো না, যার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে পারেন। সাতবার ছুটোছুটি করে তিনি নিরাশ হয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যেই সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে সাতবার দৌড়ানো কেয়ামত পর্যন্ত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য হজের বিধি-বিধানে অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। হাজেরা যখন নিরাশ হয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন, তখন আল্লাহর রহমত নাযিল হল। জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম আগমন করলেন এবং শুস্ক মরুভূমিতে পানির একটি ঝর্ণাধারা বইয়ে দিলেন। [বুখারী ৩৩৬৫] বর্তমানে এ ধারার নামই যম্যম্। পানির সন্ধান পেয়ে প্রথমে জীব-জন্তু আগমন করল। জীব-জন্তু দেখে মানুষ এসে সেখানে আস্তানা গাড়ল। এভাবে মক্কায় জনপদের ভিত্তি রচিত হয়ে গেল। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় কিছু আসবাব পত্ৰও সংগৃহীত হল।
ইসমাঈল আলাইহিস সালাম নামে খ্যাত এই সদ্যজাত শিশু লালিত-পালিত হয়ে কাজ-কর্মের উপযুক্ত হয়ে গেল। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর ইংগিতে মাঝে মাঝে এসে স্ত্রী হাজেরা ও শিশুকে দেখে যেতেন। এ সময় আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় বন্ধুর তৃতীয় পরীক্ষা নিতে চাইলেন। বালক ইসমাঈল অসহায় ও দীন-হীন অবস্থায় বড় হয়েছিলেন এবং পিতার স্নেহ-বাৎসল্য থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। কুরআনে বলা হয়েছেঃ “বালক যখন পিতার কাজে কিছু সাহায্য করার যোগ্য হয়ে উঠল, তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি। এখন বল, তোমার কি অভিপ্রায়? পিতৃভক্ত বালক বলল, পিতা! আপনি যে আদেশ পেয়েছেন, তা পালন করুন। আপনি আমাকেও ইনশাআল্লাহ এ ব্যাপারে ধৈর্যশীল পাবেন”। [সূরা আস-সাফফাতঃ ১০২] এর পরবর্তী ঘটনা সবার জানা আছে যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্রকে জবাই করার উদ্দেশ্যে মিনা প্রান্তরে নিয়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহর আদেশ পালনে নিজের পক্ষ থেকে যা করণীয় ছিল, তা পুরোপুরিই সম্পন্ন করলেন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাত থেকে এর পরিপূরক নাযিল করে তা কুরবানী করার আদেশ দিলেন। এই রীতিটিই পরে ভবিষ্যতের জন্য একটি চিরন্তন রীতিতে পরিণতি লাভ করে। [তাফসীরে ইবনে কাসীর]
এগুলো ছিল বড়ই কঠিন পরীক্ষা, যার সম্মুখীন খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম-কে করা হয়। এর সাথে সাথেই আরও অনেকগুলো কাজ এবং বিধিবিধানের বাধ্যবাধকতাও তার উপর আরোপ করা হল। তন্মধ্যে দশটি কাজ ‘খাসায়েলে ফিতরাত’ বা প্রকৃতিসুলভ অনুষ্ঠান নামে অভিহিত।
এগুলো হলো শারীরিক পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কিত, ভবিষ্যত উম্মতের জন্যও এগুলো স্থায়ী বিধি-বিধানে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার উম্মতকে এসব বিধি-বিধান পালনের জোর তাকিদ দিয়েছেন৷ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, সমস্ত ইসলাম ত্রিশটি অংশে সীমাবদ্ধ। তন্মধ্যে দশটি সূরা আল-বারাআতে, দশটি সূরা আল-মু’মিনুনে এবং দশটি সূরা আল-আহযাবে বর্ণিত হয়েছে। [ইবনে কাসীর] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এগুলো পূর্ণরূপে পালন করেছেন এবং সব পরীক্ষায়ই উত্তীর্ণ হয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার উপরোদ্ধৃত উক্তির দ্বারা বুঝা গেল যে, মুসলিমদের জন্য যেসব জ্ঞান এবং কর্মগত ও নৈতিক গুণ অর্জন করা দরকার, তার সবই এ তিনটি সূরার কয়েকটি আয়াতে সন্নিবেশিত হয়েছে। এগুলোই কুরআনে উল্লেখিত كَلِمَات যেসব বিষয়ে খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম-এর পরীক্ষা নেয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে।
এ আয়াত দ্বারা একদিকে বুঝা গেল যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে সাফল্যের প্রতিদানে মাবনসমাজের নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে, অপরদিকে মানব সমাজের নেতা হওয়ার জন্য যে পরীক্ষা দরকার, তা পার্থিব পাঠশালা বা বিদ্যালয়ের পরীক্ষার অনুরূপ নয়। পার্থিব পাঠশালাসমূহের পরীক্ষায় কতিপয় বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান ও চুলচেরা বিশ্লেষণকেই সাফল্যের মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়। কিন্তু নেতৃত্ব লাভের পরীক্ষায় সূরা আল-বারাআত বা আত-তাওবার ১১২ নং আয়াত, সূরা আল-মুমিনূন এর ১-১১ এবং সূরা আল-আহযাবের ৩৫ নং আয়াতে বর্ণিত ত্রিশটি নৈতিক ও কর্মগত গুণে পুরোপুরি গুনান্বিত হওয়া শর্ত।
কুরআনের অন্য এক জায়গায় এ বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, “যখন তারা সবর করলো এবং আমার নিদর্শনাবলীতে নিশ্চিত বিশ্বাসী হল, তখন আমরা তাদেরকে নেতা করে দিলাম, যাতে আমার নির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে পথ প্রদর্শন করে”। [সূরা আস-সাজদাহ:২৪] এই আয়াতে বর্ণিত صَبر হলো শিক্ষাগত ও বিশ্বাসগত পূর্ণতা। আর يَقِيْن হলো কর্মগত ও নৈতিক পূর্ণতা। কারও মধ্যে এগুলোর পূর্ণতার ভিত্তিতেই নেতৃত্বের জন্য আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হন।
ত্রিশটি নৈতিক ও কর্মগত গুণে পুরোপুরি গুনান্বিত হওয়া শর্ত সমূহঃ—-
সূরা তাওবাঃ ১০টি
সূরা মুমিনুনঃ ১০টি
সূরা আহযাবঃ ১০
التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّهِ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ﴾
আল্লাহর দিকে বারবার প্রত্যাগমনকারী, তার ইবাদতকারী, তার প্রশংসা বানী উচ্চারণকারী, তার জন্য যমীনে বিচরণকারী, তার সামনে রুকূ ও সিজদাকারী, সৎকাজের আদেশকারী , অসৎকাজ থেকে বিরতকারী, এবং আল্লাহর সীমারেখা সংরক্ষণকারী (সেই সব মুমিন হয়ে থাকে যারা আল্লাহর সাথে কেনাবেচার সওদা করে) আর হে নবী! এ মুমিনদেরকে সুখবর দাও! সূরা তাওবাঃ১১২
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ
১) নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা
الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ
২) যারাঃ নিজেদের নামাযে বিনয়াবনত হয়,
وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ
৩) বাজে কাজ থেকে দূরে থাকে,
وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ
৪) যাকাতের পথে সক্রিয় থাকে,
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ
৫) নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে,
إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ
৬) নিজেদের স্ত্রীদের ও অধিকারভুক্ত বাঁদীদের ছাড়া, এদের কাছে (হেফাজত না করলে) তারা তিরষ্কৃত হবে না,
فَمَنِ ابْتَغَىٰ وَرَاءَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْعَادُونَ
৭) তবে যারা এর বাইরে আরো কিছু চাইবে তারাই হবে সীমালংঘনকারী,
وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ
৮) নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে
وَالَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ
৯) এবং নিজেদের নামাযগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে,
أُولَٰئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ
১০) তারাই এমন ধরনের উত্তরাধিকারী যারা নিজেদের উত্তরাধিকার হিসেবে ফিরদাউস, লাভ করবে
الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
১১) এবং সেখানে তারা থাকবে চিরকাল৷ সুরা মুমিনুনঃ ১-১১
إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا
একথা সুনিশ্চিত যে, যে পুরুষ ও নারী মুসলিম, মুমিন, হুকুমের অনুগত,সত্যবাদী, সবরকারী, আল্লাহর সামনে বিনত, সাদকাদানকারী, রোযা পালনকারী, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী এবং আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণকারী আল্লাহ তাদের জন্য মাগফিরাত এবং প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন৷ সূরা আহযাবঃ ৩৫
মহান আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্ত আশা পূর্ণ করেন, যার উল্লেখ কুরআন মাজীদেই রয়েছে। (وَجَعَلْنَا فِي ذُرِّيَّتِهِ النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ) অর্থাৎ, আমি তাঁর বংশধরদের মধ্যে নবুঅত ও কিতাব রাখলাম। (সূরা আনকাবূত ২৭ আয়াত)
কাজেই যে নবীই আল্লাহ প্রেরণ করেছেন, ইবরাহীম (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্য থেকেই করেছেন এবং তাঁর পর যে কিতাবই তিনি নাযিল করেছেন, তাও তাঁর সন্তানের মধ্য থেকেই কারো উপর নাযিল করেছেন। (ইবনে কাসীর) তারপর ‘আমার প্রতিশ্রুতি সীমালংঘনকারীদের প্রতি প্রযোজ্য নয়’ বলে যে বিষয়টি পরিষ্কার করে দেন তা হল এই যে, ইবরাহীম (আঃ)-এর ব্যক্তিত্ব এত উচ্চ এবং আল্লাহর নিকট তাঁর এত বড় মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও তাঁর সন্তানাদির মধ্যে যারা অযোগ্য, যালিম ও মুশরিক হবে, তাদেরকে হতভাগ্য ও বঞ্চিত হওয়া থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কেউ নবী বংশে জন্মগ্রহণ করলেই যে তার কোন গুরুত্ব থাকবে এখানে সে ধারণার মূল আল্লাহ কেটে দিয়েছেন। যদি ঈমান ও নেক আমল না থাকে, তাহলে পীরের বেটা ও রাজার বেটা হলেও আল্লাহর নিকট তার কি কোন মূল্য থাকবে? নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, (وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ ) যার আমল তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশমর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারবে না। (মুসলিম, অধ্যায়ঃ যিকর ও দু’আ, পরিচ্ছেদঃ তেলাওয়াতে কুরআনের জন্য একত্রিত হওয়ার ফযীলত)
আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বিভিন্ন পরীক্ষা, তাতে তার সাফল্য এবং পুরস্কার ও প্রতিদানের বিষয় বর্ণিত হয়েছে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন স্নেহপরবশ হয়ে স্বীয় সন্তান-সন্ততির জন্যেও এ পুরস্কারের প্রার্থনা জানালেন, তখন পুরস্কার লাভের জন্য একটি নিয়ম-নীতিও বলে দেয়া হল। এতে খলীলুল্লাহর প্রার্থনাকে শর্তসাপেক্ষে মঞ্জুর করে বলা হয়েছে যে, আপনার বংশধরগণও এই পুরস্কার পাবে, তবে তাদের মধ্যে যারা অবাধ্য ও যালিম হবে, তারা এ পুরস্কার পাবে না। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষার মাধ্যমে স্বীয় বন্ধুর লালন করে তাকে পূর্ণত্বের স্তর পর্যন্ত পৌছানো ৷ সন্তানদের জন্য এ দো’আর মধ্যে আরও একটি তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, সমাজে যারা গণ্য-মান্য, তাদের সন্তানরা পিতার পথ অনুসরণ করলে সমাজে তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম-এর এ দোআটিও কবুল হয়েছে। তার বংশধরদের মধ্যে কখনো সত্যদ্বীনের অনুসারী ও আল্লাহর আজ্ঞাবহ আদর্শ পুরুষের অভাব হয়নি। জাহেলিয়াত আমলে আরবে যখন সর্বত্র মূর্তিপূজার জয়-জয়কার, তখনো ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বংশধরের মধ্যে কিছু লোক একত্ববাদ ও আখেরাতে বিশ্বাসী এবং আল্লাহর আনুগত্যশীল ছিলেন। যেমন, যায়েদ ইবনে আমর, ওরাক ইবন নওফাল এবং কেস ইবন সায়েদা প্রমূখ।
২:১২৫ وَ اِذۡ جَعَلۡنَا الۡبَیۡتَ مَثَابَۃً لِّلنَّاسِ وَ اَمۡنًا ؕ وَ اتَّخِذُوۡا مِنۡ مَّقَامِ اِبۡرٰهٖمَ مُصَلًّی ؕ وَ عَهِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَهِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَ الۡعٰکِفِیۡنَ وَ الرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ
১২৫. আর স্মরণ করুন, যখন আমরা কাবাঘরকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ করো। আর ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ দিয়েছিলাম তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী, রুকু’ ও সিজদাকারীদের জন্য আমার ঘরকে পবিত্র রাখতে।
এই আয়াতে কা’বা গৃহের ইতিহাস, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কর্তৃক কা’বা গৃহের নির্মাণ, কাবা ও মক্কার কতিপয় বৈশিষ্ট্য এবং কা’বা গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধি-বিধান উল্লেখিত হয়েছে। এ বিষয়টি কুরআনের অনেক সূরায় ছড়িয়ে রয়েছে। পরবর্তী আয়াতসমূহে এর কিছু বর্ণনা আসছে।
এর আগের আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের সুউচ্চ মর্যাদা ও ইমামতের কথা বলা হয়েছে। আর এ আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের মহান অবদান পবিত্র কাবাঘরের কথা বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ঘর মানব ইতিহাসে একত্ববাদীদের মিলনস্থল। তাওয়াফ, নামাজ ও এবাদতের জন্য পবিত্র ও নিরাপদ কেন্দ্র। হজ্ব যাত্রীরা মক্কা শরীফে গিয়ে কাবাঘর তাওয়াফের পর দু”রাকাত নামাজ পড়েন। তাদের এ নামাজ পড়তে হয় মাকামে ইব্রাহীমকে সামনে রেখে। মাকামে ইব্রাহীম হলো কাবাঘর ঘেষা ওই পবিত্র স্থান যেখানে কাবাঘরের দেয়াল তৈরির সময় তিনি দাঁড়াতেন। আল্লাহপাক হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কষ্টের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে হাজীরা মাকামে ইব্রাহীমকে পেছনে রেখে নামাজ না পড়েন। হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) শুধু কাবাঘরের নির্মাতাই ছিলেন না, তারা একইসাথে ওই পবিত্র ঘরের খাদেম বা সেবকও ছিলেন। আল্লাহর নির্দেশে তারা মসজিদুল হারামকে যাবতীয় অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করতেন যাতে আল্লাহর বান্দারা সেখানে নামাজ ও এবাদত করতে পারেন। মূলত: মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর। আর এ ঘরের খাদেম বা সেবককেও হতে হবে পবিত্র এবং আল্লাহর অলী। যে কেউ মসজিদ দেখা শোনার মতো পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের অধিকারী হতে পারে না।
(২) مَثَابَةً শব্দের অর্থ প্রত্যাবর্তনস্থল। এ শব্দ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা’আলা কাবা গৃহকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। ফলে তা সর্বদাই মানবজাতির প্রত্যাবর্তনস্থল হয়ে থাকবে এবং মানুষ বার বার তার দিকে ফিরে যেতে আকাংখী হবে। মুফাসসির মুজাহিদ বলেন, কোন মানুষ কা’বা গৃহের যিয়ারত করে তৃপ্ত হয় না, বরং প্রতিবারই যিয়ারতের অধিক বাসনা নিয়ে ফিরে আসে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] কোন কোন আলেমের মতে, কা’বা গৃহ থেকে ফিরে আসার পর আবার সেখানে যাওয়ার আগ্রহ হজ কবুল হওয়ার অন্যতম লক্ষণ।
সাধারণভাবে দেখা যায়, প্রথমবার কা’বাগৃহ যিয়ারত করার যতটুকু আগ্রহ থাকে, দ্বিতীয়বার তা আরও বৃদ্ধি পায় এবং যতবারই যিয়ারত করতে থাকে, এ আগ্রহ উত্তরোত্তর ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ বিস্ময়কর ব্যাপারটি একমাত্র কা’বারই বৈশিষ্ট্য। নতুন জগতের শ্রেষ্ঠতম মনোরম দৃশ্যও এক দুবার দেখেই মানুষ পরিতৃপ্ত হয়ে যায়। পাঁচ-সাতবার দেখলে আর দেখার ইচ্ছাই থাকে না। অথচ এখানে না আছে কোন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট, না এখানে পৌছা সহজ এবং না আছে ব্যবসায়িক সুবিধা, তা সত্ত্বেও এখানে পৌছার আকুল আগ্রহ মানুষের মনে অবিরাম ঢেউ খেলতে থাকে। হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে অপরিসীম দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে এখানে পৌছার জন্য মানুষ ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। [তাফসীরে মা’আরিফুল কুরআন
(৩) أَمْنًا শব্দের অর্থ مأمن অর্থাৎ শান্তির আবাসস্থল। আর بيت শব্দের অর্থ ঘর। তবে এখানে শুধু কাবাগৃহ উদ্দেশ্য নয়, বরং সম্পূর্ণ মসজিদুল হারাম। কুরআনে بيت الله ও كعبة বলে সমগ্র হারাম শরীফকে বুঝানো হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, (ثُمَّ مَحِلُّهَا إِلَى الْبَيْتِ الْعَتِيقِ) “তারপর তাদের যবাইয়ের স্থান হচ্ছে প্রাচীন ঘরটির কাছে।” [সূরা আল-হাজ্জ: ৩৩] কারণ, এতে কুরবানী যবাই করার কথা আছে। কুরবানী কাবা গৃহের অভ্যন্তরে হয় না। কাজেই আয়াতের অর্থ হবে যে, ‘আমরা কাবার হারাম শরীফকে শান্তির আলয় করেছি’। শান্তির আলয় করার অর্থ মানুষকে নির্দেশ দেয়া যে, এ স্থানকে সাধারণ হত্যা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি অশান্তিজনিত কার্যকলাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
(৪) এখানে মাকামে ইবরাহীমের অর্থ ঐ পাথর, যাতে মু’জিযা হিসেবে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পদচিহ্ন অংকিত হয়ে গিয়েছিল। কা’বা নির্মাণের সময় এ পাথরটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন। [সহীহ আল-বুখারী]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি এই পাথরে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পদচিহ্ন দেখেছি। যিয়ারতকারীদের উপর্যুপরি স্পর্শের দরুন চিহ্নটি এখন অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে মাকামে ইবরাহীমের ব্যাখ্যা প্রসংগে বর্ণিত রয়েছে যে, সমগ্র হারাম শরীফই মাকামে ইবরাহীম। এর অর্থ বোধ হয় এই যে, তাওয়াফের পর যে দুরাকাআত সালাত মাকামে ইবরাহীমে আদায় করার নির্দেশ আলোচ্য আয়াতে রয়েছে, তা হারাম শরীফের যে কোন অংশে পড়লেই চলে। অধিকাংশ আলেম এ ব্যাপারে একমত।
আয়াতে মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের জায়গা করে নিতে বলা হয়েছে। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের সময় কথা ও কর্মের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। তিনি তাওয়াফের পর কা’বা গৃহের সম্মুখে অনতিদূরে রক্ষিত মাকামে ইবরাহীমের কাছে আগমন করলেন এবং এ আয়াতটি পাঠ করলেন, অতঃপর মাকামে ইবরাহীমের পিছনে এমনভাবে দাঁড়িয়ে দু’রাকাআত সালাত আদায় করলেন যে, কা’বা ছিল তার সম্মুখে এবং কাবা ও তার মাঝখানে ছিল মাকামে ইবরাহীম। [দেখুন, সহীহ মুসলিম: ১২১৮] আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাওয়াফ পরবর্তী দুই রাকাআত সালাত ওয়াজিব।
(৫) শব্দগুলো থেকে কতিপয় বিধি-বিধান প্রমাণিত হয়।
প্রথমতঃ কা’বা গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্য তাওয়াফ, ইতেকাফ ও সালাত।
দ্বিতীয়তঃ তাওয়াফ আগে আর সালাত পরে।
তৃতীয়তঃ ফরয হোক কিংবা নফল কা’বা গৃহের অভ্যন্তরে যে কোন সালাত আদায় করা বৈধ।
(৬) এখানে কা’বাগৃহকে পাক-সাফ করার নির্দেশ বর্ণিত হয়েছে। বাহ্যিক অপবিত্রতা ও আবর্জনা এবং আত্মিক অপবিত্রতা উভয়টিই এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কুফর, শির্ক, দুশ্চরিত্রতা, হিংসা, লালসা, কুপ্রবৃত্তি, অহংকার, রিয়া, নাম-যশ ইত্যাদির কলুষ থেকেও কা’বা গৃহকে পবিত্র রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর ঘরের আসল পবিত্রতা হচ্ছে এই যে, সেখানে আল্লাহ ছাড়া আর কারো নাম উচ্চারিত হবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘরে বসে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মালিক, প্রভু, মা’বুদ, অভাব পূরণকারী ও ফরিয়াদ শ্রবণকারী হিসেবে ডাকে, সে আসলে তাকে নাপাক ও অপবিত্র করে দিয়েছে। এ নির্দেশে بيتي শব্দ দ্বারা ইংগিত করা হয়েছে যে, এ আদেশ যে কোন মসজিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ, সব মসজিদই আল্লাহর ঘর। কুরআনে বলা হয়েছে, (فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرْفَعَ) উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে এক ব্যক্তিকে উচ্চঃস্বরে কথা বলতে শুনে বললেন, তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছ, জান না? অর্থাৎ মসজিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, এতে উচ্চঃস্বরে কথা বলা উচিত নয়। মোটকথা, আলোচ্য আয়াতে কা’বা গৃহকে যেমন যাবতীয় বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখতে বলা হয়েছে, তেমনি অন্যান্য মসজিদকেও পাক-পবিত্র রাখতে হবে ৷ দেহ ও পোষাক-পরিচ্ছদকে যাবতীয় অপবিত্রতা ও দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু থেকে পাক-সাফ করে এবং অন্তরকে কুফর, শির্ক, দুশ্চরিত্রতা, অহংকার, হিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদি থেকে পবিত্র করে মসজিদে প্রবেশ করা কর্তব্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেয়াজ, রসুন ইত্যাদি দুৰ্গন্ধযুক্ত বস্তু খেয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে বারণ করেছেন। [মাআরিফুল কুরআন]
২:১২৬ وَ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ رَبِّ اجۡعَلۡ هٰذَا بَلَدًا اٰمِنًا وَّ ارۡزُقۡ اَهۡلَهٗ مِنَ الثَّمَرٰتِ مَنۡ اٰمَنَ مِنۡهُمۡ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ قَالَ وَ مَنۡ کَفَرَ فَاُمَتِّعُهٗ قَلِیۡلًا ثُمَّ اَضۡطَرُّهٗۤ اِلٰی عَذَابِ النَّارِ ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ
১২৬. আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম বলেছিলেন, হে আমার রব! এটাকে নিরাপদ শহর করুন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনে তাদেরকে ফলমূল হতে জীবিকা প্রদান করুন। তিনি (আল্লাহ) বললেন, যে কুফরী করবে তাকেও কিছু কালের জন্য জীবনোপভোগ করতে দিব, তারপর তাকে আগুনের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করব। আর তা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল!
মানুষের স্বাভাবিক অবস্থানের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো নিরাপত্তা। আর নিরাপত্তার সাথে থাকার জন্য প্রয়োজন রিজিক। ইবরাহীম আ এই দুয়াটি প্রথমে করেছেন।
আলোচ্য আয়াতে মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে সমগ্র মক্কাবাসীর জন্য শান্তি ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দোআ করা হয়েছে। ইতঃপূর্বে এক দোআয় যখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বীয় বংশধরের মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তখন আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, মুমিনদের পক্ষে এ দোআ কবুল হল, যালিম ও মুশরিকদের জন্য নয়। সে দোআটি ছিল নেতৃত্ব লাভের দোআ। খলীল আলাইহিস সালাম ছিলেন আল্লাহর বন্ধুত্বের মহান মর্যাদায় উন্নীত ও আল্লাহভীতির প্রতীক। তাই এ ক্ষেত্রে সে কথাটি মনে পড়ে গেল এবং তিনি দোআর শর্ত যোগ করলেন যে, আর্থিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তির এ দোআ শুধু মুমিনদের জন্য করেছি। আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ভয় ও সাবধানতার মূল্য দিয়ে বলা হয়েছে (وَمَنْ كَفَرَ) অর্থাৎ পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আমি সমস্ত মক্কাবাসীকেই দান করব, যদিও তারা কাফের মুশরিক হয়। তবে মুমিনদেরকে দুনিয়া ও আখেরাত সর্বত্রই তা দান করব, কিন্তু কাফেররা আখেরাতে শাস্তি ছাড়া আর কিছুই পাবে না। [মাআরিফুল কুরআন]
কাফেরদের ধন সম্পদ প্রচুর ছিলো,তারপরেও মহান আল্লাহ আরো দিয়েছেন। এর সাথে এই শিক্ষাও দিয়েছেন-
আর আপনি নিজকে ধৈর্যের সাথে রাখবেন তাদেরই সংসর্গে যারা সকাল ও সন্ধ্যায় ডাকে তাদের রবকে তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং আপনি দুনিয়ার জীবনের শোভা কামনা করে তাদের থেকে আপনার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। আর আপনি তার আনুগত্য করবেন না—যার চিত্তকে আমরা আমাদের স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেছে ও যার কর্ম বিনষ্ট হয়েছে। সূরা কাহাফঃ২৮
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর স্মরণে অনুষ্ঠিত মজলিসে যারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে একত্রিত হবে তাদের ব্যাপারে আকাশ থেকে আহবান করে বলা হয় তোমরা যখন তোমাদের মজলিস শেষ করবে তখন তোমরা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। আর তোমাদের গোনাহসমূহ সৎকাজে পরিবর্তিত হবে। [মুসনাদে আহমাদ: ৩/১৪২]
২:১২৭ وَ اِذۡ یَرۡفَعُ اِبۡرٰهٖمُ الۡقَوَاعِدَ مِنَ الۡبَیۡتِ وَ اِسۡمٰعِیۡلُ ؕ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّا ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
১২৭. আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবাঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিলেন, (তারা বলছিলেন) হে আমাদের রব! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ
এখানে লক্ষণীয় যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম رب (রব্বা)শব্দ দ্বারা দোআ আরম্ভ করেছেন। তিনি এই শব্দের মাধ্যমে দো’আ করার রীতি শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ এ জাতীয় শব্দ আল্লাহর রহমত ও কৃপা আকৃষ্ট করার ব্যাপারে খুবই কার্যকর ও সহায়ক।
সূরা কাহাফ এ রাব্বুনা বলা, যা একটি স্টেটমেন্ট দুয়া নয়।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ইসমাঈলকে বললেন, হে ইসমাঈল। আল্লাহ আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসমাঈল বললেন, আপনার রব আপনাকে যা নির্দেশ করেছেন তা বাস্তবায়িত করুন। ইবরাহীম বললেন, তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? ইসমাঈল বললেন, আমি আপনাকে সাহায্য করব। ইবরাহীম পাশের একটি উঁচু জায়গা দেখিয়ে বললেন, আল্লাহ আমাকে এখানে একটি ঘর বানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইবনে আব্বাস বলেন, তারপর তারা দু’জনে ঘরের ভিত্তি স্থাপন করে তা উঁচু করছিলেন। ইসমাঈল পাথর নিয়ে আসতেন আর ইবরাহীম ঘর বানাতেন। তারপর যখন ঘর উঁচু হয়ে গেল তখন ইসমাঈল এ পাথরটি এনে ইবরাহীমের পায়ের নীচে রাখলেন। তখন ইবরাহীম তাতে দাঁড়িয়ে ঘর বানাতে থাকলেন। এমতাবস্থায় তাদের মুখ থেকে এ দোআ বের হচ্ছিল।” [বুখারী ৩৬৬৪]
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহ্র নির্দেশে সিরিয়ার সুজলা-সুফলা সুদর্শন ভূ-খণ্ড ছেড়ে মক্কার বিশুস্ক পাহাড়সমূহের মাঝখানে স্বীয় পরিবার-পরিজনকে এনে রাখেন এবং কা’বা গৃহের নির্মাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এরূপ ক্ষেত্রে অন্য কোন আত্মত্যাগী ইবাদতকারীর অন্তরে অহংকার দানা বাধতে পারত এবং সে তার ক্রিয়াকর্মকে অনেক মূল্যবান মনে করতে পারত। কিন্তু এখানে ছিলেন আল্লাহর এমন একজন বন্ধু যিনি আল্লাহর প্রতাপ এবং মহিমা সম্পর্কে যথার্থভাবে অবহিত। তিনি জানতেন, আল্লাহর উপযুক্ত ইবাদাত ও আনুগত্য কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে। তাই আমল যত বড়ই হোক সেজন্য অহংকার না করে কেঁদে কেঁদে এমনি দোআ করা প্রয়োজন যে, হে আমার রব! আমার এ আমল কবুল হোক। কা’বা গৃহ নির্মাণের আমল প্রসংগে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাই বলেছেন, (رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا) হে রব! আমাদের এ আমল কবুল করুন। কেননা, আপনি শ্রোতা, আপনি সর্বজ্ঞ। [মা’আরিফুল কুরআন]
সন্তানের প্রতি স্নেহ ও মমতা শুধু একটি স্বাভাবিক ও সহজাত বৃত্তিই নয়; বরং এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলারও নির্দেশ রয়েছে। উল্লেখিত আয়াতসমূহ এর প্রমাণ। তিনি সন্তানদের দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আল্লাহর কাছে দোআ করেছেন। এখানেও আমাদের দু’আ কবুল করুন বলে সন্তানকে অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
২:১২৮ رَبَّنَا وَ اجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَیۡنِ لَکَ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِنَاۤ اُمَّۃً مُّسۡلِمَۃً لَّکَ ۪ وَ اَرِنَا مَنَاسِکَنَا وَ تُبۡ عَلَیۡنَا ۚ اِنَّکَ اَنۡتَ التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ
১২৮. ‘হে আমাদের রব। আর আমাদের উভয়কে আপনার একান্ত অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধর হতে আপনার এক অনুগত জাতি উত্থিত করুন। আর আমাদেরকে ইবাদতের নিয়ম পদ্ধতি দেখিয়ে দিন এবং আমাদের তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনিই বেশী তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
আমাদের সেইরকম মুসলিম বানাও যে সব সময়ের জন্যই আত্মসমর্পনকারী। দুজনেই।
আল্লাহ যা চান সেটা মেনে নেয়াতে সমর্পন। পুরুপুরি সঁপে দেয়ার মতো মুসলিম হওয়ার দু’আ করেছেন।
অন্তত একটি উম্মাকে এই পথে অটল রাখার দু’আ করা হয়েছে। অনেক জাতি ধারাবাহিকতা রাখতে পারে নি। ইবরাহীম আ রবের কাছে দু’আ করেন যেনো অন্তত একটি উম্মাহ ধরে রাখতে পারে এই পথটিকে।
যেহেতু আল্লাহর ঘর নির্মান করেছেন এখন ইবাদাতের পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়ার জন্য দু’আ করা হয়েছে।
ইবরাহীম আ এর দু’আ কবুলে মহান আল্লাহ রাসূল সা কে হজ্জের নিয়ম পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন।
তাওবা কবুল হওয়ার জন্যই এই হজ্জ। হাদীস থেকে জানা যায় মাবরুর হজ্জ কবুল হওয়া হজ্জ, মানেই হলো তাওবা কবুল করে নেয়া।ইবরাহীম আ ও ইসমাইল আ এর তাওবা বলতে কি বুঝানো হচ্ছে!
এখানে অনেক উন্নত লেভেল এর কথা এসেছে। ওনারা যে কাজ করেছেন তাতে কোন ঘাটতি আছে কি না সেকারনে সেই চিন্তায় তাওবা করেছেন। একজন নবী কত উন্নত মানের কাজ আমল, তারপরেও তাওবা করেছেন। সুবহানাআল্লাহ।
(১) আয়াতে বর্ণিত مَنَاسِك এর অর্থ ইবাদতও হয়, যেমনটি উপরে করা হয়েছে। কাতাদাহ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, হজের নিয়মাবলী। [তাবারী
২:১২৯ رَبَّنَا وَ ابۡعَثۡ فِیۡهِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡهُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِکَ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُزَکِّیۡهِمۡ ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۱۲۹﴾
১২৯. হে আমাদের রব! আর আপনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রাসূল পাঠান, যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করবেন; তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন, আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’
বায়াস শব্দটি নিয়োগ দেয়া বা উন্নত মর্যাদায় নেয়া।
মিনহুম বলে বলা হয়েছে তাদের মাঝে থেকে, অন্য জাতি বা জায়গা থেকে নয়। এটা দাওয়ার একটি বিশেষত্ব যে নিজ জাতি বা গোত্র থেকে হলে দাওয়া গ্রহন যোগ্যতা বেড়ে যায়।
হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি আমার সূচনা বলে দিচ্ছি, আমার পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দোআ, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর সুসংবাদ এবং আমার মা স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তার থেকে একটি আলো বের হল, যে আলোতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়েছে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২৬২]
ঈসা আলাইহিস সালাম-এর সুসংবাদের অর্থ তার এ উক্তি (وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ) “আমি এমন এক নবীর সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আসবেন। তার নাম আহমাদ”। [সূরা আস-সাফঃ ৬] তার জননী গর্ভাবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে, তার পেট থেকে একটি নূর বের হয়ে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছে।
এই আয়াতে ইবরাহীম আ যে দু’আ করেছিলেন তা থেকে জানতে পারা যায়ঃ একজন রাসূল পাঠাতে আবেদন করেছেন যিনি ৪টি কাজ করবেন মূলতঃ
১। তিলাওয়াত
২। কিতাবের শিক্ষা
৩। হিকমাহ শিক্ষা
৪। জীবন পরিশুদ্ধ করা
কুরআনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের আলোচনা প্রসংগে দু’জায়গায়, সূরা আলে-ইমরানের ১৬৪তম আয়াতে এবং সূরা জুমুআয় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দোআয় উল্লেখিত ভাষারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তবে একটু পার্থক্য আছে কাজের সিরিয়ালে।
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
আসলে ঈমানদারদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন নবী পাঠিয়ে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন৷ সে তাঁর আয়াত তাদেরকে শোনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করে এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেয়৷ অথচ এর আগে এই লোকেরাই সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল৷ সূরা আলে-ইমরানেরঃ ১৬৪
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾
তিনিই মহান সত্তা যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত শুনায়, তাদের জীবনকে সজ্জিত ও সুন্দর করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়৷ অথচ ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল৷ সূরা জুমুআঃ২
﴿كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ﴾
যেমনিভাবে (তোমরা এই জিনিসটি থেকেও সাফল্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছো যে,)আমি তোমাদের মধ্যে স্বয়ং তোমাদের থেকেই একজন রসূল পাঠিয়েছি, যে তোমাদেরকে আমার আয়াত পড়ে শুনায় , তোমাদের জীবন পরিশুদ্ধ করে সুসজ্জিত করে , তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয় এবং এমন সব কথা তোমাদের শেখায় , যা তোমরা জানতে না ৷সূরা বাকারাঃ ১৫১
এখানে যে কাজের সিরিয়াল জানা যায় তা হলো—
১। তিলাওয়াত
২। জীবন পরিশুদ্ধ করা
৩। কিতাবের শিক্ষা
৪। হিকমাহ শিক্ষা
এটার ব্যখ্যা প্রসংগে তাফসিরকার উল্লেখ করেছেন যে ইবরাহীম আ এর সন্তানেরা তাজকিয়া অগ্রসর ছিলেন কিন্তু রাসূল সা যে জাতির কাছে এসেছিলেন সেখানে এর প্রয়োজনীয়তা ছিলো অনেক বেশী।
﴿وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
(এ রসূলের আগমন) তাদের অন্য লোকদের জন্যও যারা এখনো তাদের সাথে যোগ দেয়নি৷ আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও জ্ঞানময়৷ সূরা জুমুআঃ ৩
এভাবে ইংগিত করা হয়েছে যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে নবীর জন্য দোআ করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দোআর কারণে আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ৪টি। তন্মধ্যে
প্রথম হচ্ছে, আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা।
তিলাওয়াতের আসল অর্থ পড়া ও অনুসরণ করা। কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় এ শব্দটি কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব পাঠ করার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, যে লোক এসব কালাম পাঠ করে, এর অনুসরণ করাও তার একান্ত কর্তব্য। আসমানী গ্রন্থ ঠিক যেভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়, হুবহু তেমনিভাবে পাঠ করা জরুরী। নিজের পক্ষ থেকে তাতে কোন শব্দ অথবা স্বরচিহ্নটিও পরিবর্তন পরিবর্ধন করার অনুমতি নেই। ইমাম রাগেব বলেন, “আল্লাহর কালাম ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থ অথবা কালাম পাঠ করাকে সাধারণ পরিভাষায় তিলাওয়াত বলা যায় না’। [মুফরাদাতুল কুরআন]
রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দ্বিতীয় কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দান।
এখানে কিতাব বলে আল্লাহর কিতাব বুঝানো হয়েছে। যা বিভিন্ন আইন কানুন, শরীয়া শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আল্লাহর আইন জানানো এই কিতাবের মাধ্যমে। রাসূল সা একজন শিক্ষক। আইনের শিক্ষক যিনি শিক্ষা দিবেন।
‘হিকমত’ শব্দটি আরবী অভিধানে একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যথা– সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি। ইমাম রাগেব বলেন, এ শব্দটি আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় সকল বস্তুর পূর্ণজ্ঞান ও সুদৃঢ় উদ্ভাবন। অন্যের জন্য ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয়, বিদ্যমান বস্তুসমূহের বিশুদ্ধ জ্ঞান, সৎকর্ম, ন্যায়, সুবিচার, সত্য কথা ইত্যাদি। এখন লক্ষ্য করা দরকার যে, আয়াতে হিকমতের অর্থ কি?
মূলত: এখানে হিকমত শব্দের অর্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ। ইবনে কাসীর ও ইবনে জরীর রাহিমাহুল্লাহ কাতাদাহ থেকে এ ব্যাখ্যাই উদ্ধৃত করেছেন। হিকমত অর্থ কেউ কুরআনের তাফসীর, কেউ দ্বীনের গভীর জ্ঞান, কেউ শরীআতের বিধি-বিধানের জ্ঞান, কেউ এমন বিধিবিধানের জ্ঞান অর্জন বলেছেন, যা শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা থেকেই জানা যায়। নিঃসন্দেহে এসব উক্তির সারমর্ম হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ।
হিকমাত মূলত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়।কিতাবের জ্ঞানে আমল শুরু করলেই অভিজ্ঞতায় হিকমাহ অর্জন হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ৪র্থ কর্তব্য হচ্ছে পরিশুদ্ধি ও পবিত্রকরণ।
আয়াতে উল্লেখিত يُزَكِّيهِمْ শব্দটি زكاة শব্দ থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ পবিত্রতা। বাহ্যিক ও আত্মিক সকল প্রকার পবিত্রতার অর্থেই এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বাহ্যিক না-পাকী সম্পর্কে সাধারণ মুসলিমরাও ওয়াকিফহাল। আত্মিক না-পাকী হচ্ছে কুফর, শির্ক, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপর ভরসা করা, অহংকার, হিংসা, শক্রতা, দুনিয়াপ্রীতি ইত্যাদি। কুরআন ও সুন্নাহতে এসব বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
তাযকিয়া হচ্ছে আত্নোন্নতির নিমিত্তে এমন একটি মানবীয় কাজ এবং অর্জিত প্রচেষ্টা যা অসৎকাজের পরিহার এবং সৎকাজের বাস্তবায়নে সহযোগীতা করে। এর অপর নাম নফসের সাথে জিহাদ কিংবা নফসের যাকাত। এটি একটি বাস্তবমুখী, প্রযোজ্য, এবং ভারসাম্যপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি কুরআন সুন্নাহ্ এবং সাহাবাদের জীবন পদ্ধতি থেকে উৎকলিত”
দেহও হৃদয় উভয়ের সমন্বয়ে একজন মানব। তাই মানুষের দেহের যেমনি চাহিদা রয়েছে, তেমনি হৃদয় ও আত্মারও চাহিদা রয়েছে। জন্মগতভাবেই মহান আল্লাহ মানুষের প্রকৃতিতে ভাল ও মন্দ উভয় কাজ করার ইচ্ছা ও প্রবণতা দিয়েছেন। এ মর্মে কুরআনে এসেছে:
﴿وَنَفۡسٖ وَمَا سَوَّىٰهَا ٧ فَأَلۡهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقۡوَىٰهَا ٨﴾ [الشمس: ٧، ٨]
‘‘এবং শপথ মানুষের এবং তার যিনি তাকে সুঠাম করেছেন অতঃপর তার মধ্যে পাপ ও পুণ্য উভয়ের প্রবণতা নিহিত করে দিয়েছেন।’’ [সূরা আশ-শামস ৭-৮]
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে পাপ ও পুণ্যের এই সংঘর্ষ আদম ‘আলাইহিস সালামের সময় হতে চলে আসছে। এবং কিয়ামত অবধি চালু থাকবে।
এই সংঘর্ষে আধ্যাত্মিক শক্তি মানুষকে এমন কাজে উৎসাহিত করে যা পাপের উপর বিজয়ী হতে থাকে। আর এভাবে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। এটি একমাত্র তাযকিয়া তথা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমেই সম্ভব। এ তাযকিয়ার দিকে আহবান জানিয়ে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন:
﴿قَدۡ أَفۡلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩ وَقَدۡ خَابَ مَن دَسَّىٰهَا ١٠ كَذَّبَتۡ ثَمُودُ بِطَغۡوَىٰهَآ ١١﴾ [الشمس: ٩، ١١]
‘নিশ্চয় যে সফলকাম হল যে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করল, আর যে ব্যর্থ হলো সে নিজেকে কলুষিত করল।’’ [সূরা আশ-শামস: ৯-১১]
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি করণ। তিনি স্বয়ং প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে বিভিন্ন উপায় উপকরণ অবলম্বন পূর্বক তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেছিলেন। মূলতঃ এটা রিসালাতের অন্যতম গুরু দায়িত্ব। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূলকে এ দায়িত্ব দিয়ে মহান আল্লাহ প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেছেন:
﴿كَمَآ أَرۡسَلۡنَا فِيكُمۡ رَسُولٗا مِّنكُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡكُمۡ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمۡ﴾ [البقرة: ١٥١]‘যেমন আমরা তোমাদের থেকেই তোমাদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছি। সে তোমাদের কে আমার আয়াত পড়ে শুনাবে, তোমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও বিকশিত করে তুলবেন। [সুরা আল-বাকারাহ,: ১৫১] অতএব, মানবিক জীবনে আধ্যাত্মিক দিকটি মৌলিক ও অন্যতম প্রধান দিক। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«الا ان فى الجسد لمضفة اذا صلحت صلح الجسد كله واذافسد الجسد كله الا وهى القلب»
‘নিশ্চয় মানুষের শরীরে একটি টুকরা আছে, এটা যদি ভাল হয় তবে সারা শরীর ভালো। আর এটা যদি নষ্ট হয়ে যায়,তবে সারা শরীর নষ্ট হয়ে যায়। আর এটা হলো কালব বা হৃদয়। সহীহ মুসলিম।
দুনিয়ার তাযকিয়া ছাড়া আখেরাতে তাযকিয়া পাওয়া যাবে নাঃ
﴿إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلَ اللَّهُ مِنَ الْكِتَابِ وَيَشْتَرُونَ بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا ۙ أُولَٰئِكَ مَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ إِلَّا النَّارَ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
মূলত আল্লাহ তাঁর কিতাবে যে সমস্ত বিধান অবতীর্ণ করেছেন সেগুলো যারা গোপন করে এবং সামান্য পার্থিব স্বার্থের বেদীমূলে সেগুলো বিসর্জন দেয় তারা আসলে আগুন দিয়ে নিজেদের পেট ভর্তি করছে ৷ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথাই বলবেন না, তাদের পত্রিতার ঘোষণাও দেবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ৷ বাকারাঃ১৭৪
তাযকিয়ার নীতিমালা কিঃ
১। এটি চর্চার বিষয়, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় নয়
২। তাযকিয়া অর্জিত কাজ অহীর আলোকে
قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّىٰ
সে সফলকাম হয়েছে , যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে। সূরা আলাঃ ১৪
পবিত্রতা অর্থ কুফর ও শিরক ত্যাগ করে ঈমান আনা , অসৎ আচার – আচরণ ত্যাগ করে সদাচার অবলম্বন করা এবং অসৎ কাজ ত্যাগ করে সৎ কাজ করা ৷ সফলতা বলতে পার্থিব সমৃদ্বি বুঝানো হয়নি বরং আসল ও সত্যিকার সফলতার কথা বুঝানো হয়েছে৷ এর সাথে পার্থিব সমৃদ্ধি অর্জিত হোক বা না হোক তাতে কিছু আসে যায় না
৩। তাযকিয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা’আলা
﴿أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يُزَكُّونَ أَنفُسَهُم ۚ بَلِ اللَّهُ يُزَكِّي مَن يَشَاءُ وَلَا يُظْلَمُونَ فَتِيلًا﴾
তুমি কি তাদেরকেও দেখেছো, যারা নিজেদের আত্মশুদ্ধি ও আত্মপবিত্রতার বড়াই করে বেড়ায় ? অথচ শুদ্ধি ও পবিত্রতা আল্লাহ যাকে চান তাকে দেন৷ আর (তারা যে শুদ্ধি ও পবিত্রতা লাভ করে না সেটা আসলে) তাদের ওপর বিন্দুমাত্রও জুলুম করা হয় না৷ সূরা নিসাঃ৪৯
৩। তাযকিয়া কে অর্জন করেছে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন, এটা দাবী করার বিষয় নয়ঃ
যারা বড় বড় গোনাহ এবং প্রকাশ্য ও সর্বজনবিদিত অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে -তবে ছোটখাট ক্রুটি -বিচ্যুতি হওয়া ভিন্ন কথা -নিশ্চয়ই তোমার রবের ক্ষমাশীলতা অনেক ব্যাপক৷ যখন তিনি মাটি থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন৷ এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্রূণ আকারে ছিলে তখন থেকে তিনি তোমাদের জানেন৷ অতএব তোমরা নিজেদের পবিত্রতার দাবী করো না৷ সত্যিকার মুত্তাকী কে তা তিনিই ভাল জানেন৷ নাজমঃ ৩২
৪। এটি ব্যক্তির নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ,অন্যের তাযকিয়া সনদ প্রদানে অক্ষমঃ
কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা উঠাবে না৷ আর যদি ভারাক্রান্ত ব্যক্তি নিজের বোঝা উঠাবার জন্য ডাকে, তাহলে তার বোঝার সামান্য একটি অংশ উঠাবার জন্য ও কেউ আসবে না, সে তার নিকটতম আত্মীয় স্বজন হলেও৷ (হে নবীঃ) তুমি কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পারো যারা না দেখে তাদের রবকে ভয় করে এবং নামায কায়েম করে৷ আর যে ব্যক্তিই পবিত্রতা অবলম্বন করে সে নিজেরই ভালোর জন্য করে এবং ফিরে আসতে হবে সবাইকে আল্লাহরই দিকে। সূরা ফাতিরঃ ১৮
তাযকিয়ার উপকরনঃ
১। জ্ঞানঃ
২। তাদাব্বুরে কুর’আন- ইউনুসঃ৫৭
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ
হে লোকেরা! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নসীহত এসে গেছে৷ এটি এমন জিনিস যা অন্তরের রোগের নিরাময় এবং যে তা গ্রহণ করে নেয় তার জন্য পথনির্দেশনা ও রহমত৷
৩। দু’আ, যিকির,দরুদ
৪। পাপ ও অশ্লিলতা থেকে দৃষ্টি এড়ানো
৫। সৎ সংগ গ্রহন
৬। কিয়ামুল লাইল/তাহাজ্জুদ
৭। নফসকে বাধা দেয়াঃ নাযিয়াতঃ ৪০-৪১
﴿وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ﴾
﴿فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَىٰ﴾
আর যে ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফসকে খারাপ কামনা থেকে বিরত রেখেছিল। তার ঠিকানা হবে জান্নাত ৷
৮। যুহদ(পার্থিব ভোগ বিলাসে অনীহা) ভারসাম্যতা রক্ষা
৯। ইহসান
১০। ইবাদাত
১১। খুশু (বিনয় ও একাগ্রতা)
১১। ধৈর্য
১২। কৃতজ্ঞতা
১৩। তাওয়াক্কুল
১৪। আল্লাহর ভালোবাসা
১৫। আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা
১৬। আশাবাদী হওয়া
প্রশিক্ষনের প্রথম অংশ হলো—
ক) আকীদা-বিশ্বাসের সংশোধনকারী
তিনি মানব জাতিকে জাহেলিয়াতের যাবতীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস প্রভৃতির অজ্ঞতা থেকে ঈমানের আলোর দিকে পথ দেখিয়েছেন, তাঁর উপর অবতীর্ণ আল-কুরআন ও মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা দিতে অবতীর্ণ হয়েছে। এ মর্মে পবিত্র কুরআনের সূরা ইবরাহীমে এসেছে:
﴿الٓرۚ كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ لِتُخۡرِجَ ٱلنَّاسَ مِنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِ رَبِّهِمۡ إِلَىٰ ٰطِ ۡعَزِيزِ ۡحَمِيدِ ١﴾ [ابراهيم: ١]
‘আলিফ, লাম, রা। এটি একটি গ্রন্থ। যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন, পরাক্রান্ত ও প্রশংসার যোগ্য রবের নির্দেশে তাঁরই পথের দিকে। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১] অতঃপর, সব মানুষকে অন্ধকার তথা তাগুতের পথ থেকে বের করে আলোর পথ তথা সরল সঠিক পথে আসার জন্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
খ) একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম পথিকৃৎ। তিনিই বিশ্ব মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। বিশ্বশান্তির প্রত্যক্ষ প্রতীক একমাত্র তিনিই। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে এক কথায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতি স্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্ব মানবের জন্য একমাত্র আদর্শ। পবিত্র কুরআনের পরিপূর্ণ অনুকরণ ও অনুসরণ ব্যতীত হিদায়াতের আশা সুদূর পরাহত। মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন:
﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ﴾ [ال عمران: ٣١]
‘হে নবী! আপনি বলে দিন যে, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো তাহলে আমার অনুকরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসেন।’’ [সূরা আলে ইমরান: ৩১]
তাই জীবন সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে ইসলামী জীবনাদর্শের সার্থকতা তথা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি মাত্র পন্থাই রয়েছে, আর তা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান আদর্শের পরিপূর্ণ অনুকরণ ও অনুসরণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন সর্বোত্তম সৃষ্টি, শ্রেষ্ঠতম পথিকৃৎ, আর তাঁর আদর্শ যেমন গ্রহণযোগ্য আদর্শ, তেমনিভাবে তার আদর্শই সম্পূর্ণ এবং সার্বজনীন। মানবজীবনের সব দিকের প্রতিই তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ। মানবজাতির সকল গোষ্ঠী, সমষ্টি এবং শ্রেণির জন্য তাঁর পুত পবিত্র জীবনে রয়েছে এক মহান আদর্শ। এ মর্মে আল-কুরআনে এসেছে:
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ﴾ [الاحزاب: ٢١]
“নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের উচ্চ সোপানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর আদর্শ শুধু স্বীয় অনুসারীদের হিদায়াত লাভের মাধ্যমই ছিল না বরং তাঁর উম্মাতের বিকীরিত হিদায়াত দ্বারা অন্যান্য উম্মতও অন্ধকার হতে আলোর পথের দিশা পেত।
গ) চরিত্র সংশোধনঃ
আল্লাহ বলেন,
﴿وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٖ ٤﴾ [القلم: ٤]
‘নিশ্চয় আপনি উত্তম চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’’ [সূরা আল-কলম, আয়াত: ৪]
মূলতঃ তাঁর চরিত্র হলো পবিত্র কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তাঁর গোটা জীবন কাহিনী তথা সীরাত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁর চরিত্রে ছিল ভীতিজড়িত বিনয়, বীরত্ব ও সাহসিকতা মিশ্রিত লজ্জা, প্রচার বিমুখ দানশীলতা, সর্বজনবিদিত আমানতদারী, বিশ্বস্ততা,কথা ও কাজে সত্য ও সততা। পার্থিব ভোগ-বিলাস থেকে সম্পূর্ণ বিমুখতা, নিষ্ঠা, ভাষার বিশুদ্ধতা ও হৃদয়ের দৃঢ়তা, অসাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা, ছোট-বড় সকলের প্রতি দয়া ও ভালবাসা, নম্র আচরণ, অপরাধীর প্রতি ক্ষমা প্রিয়তা, বিপদাপদে ধৈর্য ও সত্য বলার দুর্বার সাহসিকতা। তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার দৃষ্টিতে كان خلقه الفرآن ‘‘পবিত্র কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র।’ সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৪৬।
ঘ) তাকওয়া সম্পন্ন মানুষ তৈরি করা
তাকওয়া হলো উত্তম চারিত্রিক ভূষণ, যা একজন দা‘ঈর জীবনে প্রতিফলিত হওয়া অত্যাবশ্যক। তাকওয়া মানুষকে যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, প্রভৃতি হতে রক্ষা করে সৎকর্ম সম্পাদনে সাহায্য করে। এ গুণে গুণান্বিত দাঈর প্রভাব মাদ‘উদের উপর খুব সহজেই পড়ে। যুগে যুগে পৃথিবীতে প্রেরিত সকল নবী-রাসূল মানুষকে এ গুণের অধিকারী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাকওয়া ঢালস্বরূপ, যা মানুষকে পাপকাজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মুত্তাকীদের জন্যই হিদায়াতবর্তিকা। এ মহাগ্রন্থ থেকে তারাই উপদেশ গ্রহণ করে। অতএব, কুরআন অবতীর্ণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তাকওয়া বিষয়ে সচেতন করে দেয়া। পবিত্র কুরআনে তাই ধ্বনিত হচ্ছে,
﴿مَآ أَنزَلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡقُرۡءَانَ لِتَشۡقَىٰٓ ٢﴾ [طه: ٢
‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি কুরআন অবতীর্ণ করি নি। এটা তাদের জন্য উপদেশস্বরূপ যারা তাকওয়া অবলম্বন করে। [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১-২
মানুষের পরিপূর্ণ সফলতা হচ্ছে পরকালীন সফলতা। আর এটা একমাত্র তাকওয়ার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। সূরা ত্বা-হা‘তে এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন
﴿وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلتَّقۡوَىٰ﴾ [طه: ١٣٢]
‘শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য।’’ সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১৩২]
এ তাকওয়া গুণে গুণান্বিত করার লক্ষ্যেই আল্লাহ তা‘আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মানব জাতির জন্যে গাইড বুক হিসেবে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করেছেন। এটি মানুষকে তাকওয়ার পথ নির্দেশ করে চিরস্থায়ী জান্নাতে দীক্ষিত হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ যোগায় এবং জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে মুক্তি লাভের উপায় বাতলে দেয়। ফলে, এ মহামূল্যবান গ্রন্থে উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদানের পাশা-পাশি ভীতি সঞ্চারমূলক অসংখ্য বিধান ও বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে:
﴿وَكَذَٰلِكَ أَنزَلۡنَٰهُ قُرۡءَانًا عَرَبِيّٗا وَصَرَّفۡنَا فِيهِ مِنَ ٱلۡوَعِيدِ لَعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ أَوۡ يُحۡدِثُ لَهُمۡ ذِكۡرٗا ١١٣﴾ [طه: ١١٣]
‘‘অনুরূপভাবে আমরা আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করেছি এবং এতে নানাভাবে সতর্কবাণী ব্যক্ত করেছি, যাতে তারা আল্লাহভীরু হয় অথবা তাদের অন্তরে চিন্তার খোরাক যোগায়।’’ [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১১৩]
পৃথিবীতে নবী-রাসুলদের আগমনের ধারাক্রম মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে শেষ হয়েছে। তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না। ফলে তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষ ও জিন তাঁর আনীত শরিয়ত (জীবনবিধান) মানতে বাধ্য।
হে মুহাম্মাদ ! বলে দাও ,হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদের জন্য সেই আল্লাহর রসূল হিসেবে এসেছি, যিনি পৃথিবী ও আকাশ মণ্ডলীর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী৷ তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই৷ তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনি মৃত্যু ঘটান৷ কাজেই ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি এবং তার প্রেরিত সেই নিরক্ষর নবীর প্রতি , যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীর প্রতি ঈমান আনে এবং তার আনুগত্য করে৷ আশা করা যায়,এভাবে তোমরা সঠিক পথ পেয়ে যাবে৷ সুরা আরাফ : ১৫৮)
আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে মানবতার মুক্তির দূত ও সৃষ্টিজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘আমি আপনাকে সমগ্র জগতের প্রতি শুধু রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি। ’ (সুরা আম্বিয়া: ১০৭)
‘‘তিনি সেই সত্তা (আল্লাহ) যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে অপরাপর সকল দীন ও মতাদর্শের ওপর একে (ইসলামকে) বিজয়ী ঘোষণা দেওয়া যায়।’’ [সূরা আস-সাফ, আয়াত: ৯]
কুর’আনের কিছু আয়াত এসেছে যা রাসূল সা কে সরাসরি আহবান করে সংশোধন বা প্রশিক্ষন দিয়েছে।
এই আয়াতগুলো মহান আল্লাহ ব্যক্তিগতভাবে রাসুল সা কে বলতে পারতেন তাকে সংশোধন করার জন্য। অথবা তিনি মুসলিমদেরকে শেখানোর জন্য আলাদা করে কিছু উপদেশ বাণী দিতে পারতেন, যেখানে রাসুলের প্রতি কোনো ইঙ্গিত থাকতো না। কিন্তু না। আল্লাহর স্ট্যান্ডার্ড এতটাই উপরে যে, তিনি রাসুলকে উদ্দেশ্য করে আয়াতগুলো দিয়ে সেগুলো তিনি কুরআনেই অন্তর্ভুক্ত করে দিলেন, যেন মুসলিম জাতি যুগ যুগ ধরে শিখতে পারে— কী পর্যায়ের স্ট্যান্ডার্ড তিনি রাসুলের কাছ থেকে এবং সর্বোপরি মুসলিমদের কাছ থেকে আশা করেন। এই আয়াতগুলো রাসুল নিজে সাহাবিদের কাছে তিলাওয়াত করতেন। তিনি নিজে তার ভুলের কথা এবং আল্লাহর تعالى সাবধান বাণী সাহাবিদের কাছে নির্দ্বিধায় পড়ে শোনাতেন। কুরআন তিলাওয়াতের সময় কখনো তিনি চক্ষুলজ্জায় এই সুরাহ এড়িয়ে যেতেন না। সাহাবিরাও কখনো এই আয়াতগুলো তিলাওয়াত করা এড়িয়ে যেতেন না। কী অসাধারণ একটি স্ট্যান্ডার্ড আল্লাহর রাসুল আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন এবং সাহাবিরা নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়ন করে গেছেন!
ইসলামী দাওয়াহ কার্যক্রমের মাঝেই যে ইসলামের প্রাণশক্তি। সারাজীবন তিনি স্বীয় কর্মকাণ্ড দ্বারা তা প্রমাণ করে গেছেন। জীবন সায়াহ্ন বিদায় হজের ভাষণেও তিনি স্বীয় অনুসারিদেরকে এ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন:
«بلغوا عني ولو آية»
“একটি আয়াত হলেও আমার পক্ষ থেকে (অন্যের নিকট) পৌঁছে দাও।’’ সহিহ বুখারী (৩৪৬১)
সূরা ইউসুফে তো এটাকেই একমাত্র কাজ বা প্রধানতম কাজ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে:
﴿قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ﴾ [يوسف: ١٠٨]
আল্লাহ তাআলা বলেন: “বলুন, এটাই আমার পথ, আমি জেনে-বুঝে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারা। আর আল্লাহ্ কতই না পবিত্র এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১০৮] মূলতঃ এটি ছিল রাব্বুল আলামীনের ঘোষণারই প্রতিফলন।
তিনি বলেন,
﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِ﴾ [النحل: ١٢٥]
‘‘আল্লাহর পথে মানুষকে হিকমত ও উত্তম উপদেশ সহকারে দাওয়াত দাও।’’ [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১২৫]
﴿فَذَكِّرۡ إِنَّمَآ أَنتَ مُذَكِّرٞ ٢١ لَّسۡتَ عَلَيۡهِم بِمُصَيۡطِرٍ ٢٢﴾ [الغاشية: ٢١، ٢٢]
‘‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে উপদেশ দিন, আপনি কেবল উপদেশদাতা, আপনাকে দারোগা বানিয়ে পাঠানো হয় নি যে আপনি তাদের বাধ্য করবেন।’’ [সূরা আল-গাশিয়াহ, আয়াত: ২১-২২]
অন্যত্র এসেছে:
﴿فَإِنَّمَا عَلَيۡكَ ٱلۡبَلَٰغُ﴾ [النحل: ٨٢]
‘‘অতঃপর নিশ্চয় আপনার দায়িত্ব শুধু পৌঁছানো।” [সূরা আর-রাদ, আয়াত: ৪০]
সুসংবাদ-দাতা
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত লাভের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানব জাতির কল্যাণ ও শান্তি বিধানের নিমিত্তে জান্নাতের সুসংবাদ দান। আল্লাহর দীন কবুল করে মানুষ দুনিয়ায় ও আখিলাতে কী কী কল্যাণ পাবে এ ব্যাপারে মানুষকে অভিহিত করা তার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত দরদ ভরা মন নিয়ে আবেগপূর্ণ ভাষায় উপস্থাপন করতেন। ফলে মানুষ তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দীন গ্রহণে উৎসাহ উদ্দীপনা ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা অনুভব করে। এ লক্ষ্যেই পবিত্র কুরআন তাঁকে ‘বাসীর’ বলে সম্বোধন করেছে। স্বয়ং তিনি নিজে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করত: উম্মতে মুহাদীকে দাওয়াতের ক্ষেত্রে তা গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন:
يسروا ولا تعسروا بشروا ولا تنفروا
‘‘তোমাদেরকে সহজ পন্থা কার্যকর করার জন্য পাঠানো হয়েছে, কঠোরতা আরোপের জন্য নয়। তোমরা সুসংবাদ দাও, ভীতিপ্রদর্শন করো না।’’[14]
ভয়ভীতি প্রদর্শন
আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে نذير (ভীতিপ্রদর্শক) রূপে প্রেরণ করেছেন। তিনি স্বজাতিকে আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তির ভয় প্রদর্শন করতেন। ভয়ভীতি মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত হতে সাহায্য করে। যখন মানুষ ভয়হীন হয়ে এ পৃথিবীর বুকে চলাফেরা করে তখন তার দ্বারা যে কোনো ধরণের অন্যায় হতে বিরত থাকতে পারে এবং সকল সঠিক পথের দিশা পায়। সেজন্যে আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে তাদের অনুভূতিকে জাগ্রত করেছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে স্বয়ং একজন প্রকাশ্য ভীতিপ্রদর্শকরূপে স্বজাতির কাছে পেশ করেছেন। এ মর্মে তিনি ওহী লাভের প্রাক্কালে আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট হয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন, قُمۡ فَأَنذِرۡ ٢﴾ [المدثر: ٢] ‘‘হে নবী! আপনি উঠুন এবং সতর্ক করুন।’’ [সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ২] ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় জাতিকে জাহান্নামের কঠিন আযাব সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন করে দিয়েছেন। সহীহ মুসলিম শরীফে এ মর্মে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ আয়াতখানি নাযিল হয়, তখন তিনি কুরাইশদের সকল গোত্রকে একত্রিত করে প্রত্যেক গোত্রের নাম ধরে বলতে লাগলেন, হে বনী কা‘ব ইবন লুয়াই! তোমরা তোমাদের নিজেদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। এভাবে তিনি মুররাহ ইবন কা‘ব, আবদে শামস, আবদে মানাফ, হাশেম, বনী আব্দুল মোত্তালিবের বংশধরকে সমভাবে আহবান জানান। এমনকি স্বীয় কন্যা ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকেও একই সম্বোধন করেন এবং পরকালে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রক্তের সম্পর্কের হওয়া সত্ত্বেও কোনো কাজে আসবে না মর্মে তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিলেন।[15] ফলে একথা সহজেই অনুমেয় যে, ভয়-ভীতি প্রদর্শন দাওয়াতের অন্যতম একটি মাধ্যম। তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ এ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ঐ সকল ভয়-ভীতি সম্পন্ন লোকদের জন্যই উপদেশস্বরূপ। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿طه ١ مَآ أَنزَلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡقُرۡءَانَ لِتَشۡقَىٰٓ ٢ إِلَّا تَذۡكِرَةٗ لِّمَن يَخۡشَىٰ ٣﴾ [طه: ١، ٣]
‘‘ত্বা-হা! আপনাকে ক্লেশ দেবার জন্য আমি আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করি নি, কিন্তু এটা তাদেরই উপদেশের জন্য যারা ভয় করে।’’ [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১-৩]
তাছাড়াও এ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মানব জাতির জন্য অসংখ্য সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, যেন মানবজাতি উপদেশ গ্রহণ করে এবং নিজেদের অনুভূতি জাগ্রত রাখে।[16]
আলোকবর্তিকা
মানুষের জন্য দু’টি জীবন রয়েছে, একটি ইহ-লৌকিক আর একটি পারলৌকিক। উভয় জীবনের কল্যাণ শান্তি ও মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধরাধামে আগমন করেছেন। বর্বর, অসভ্য, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাহিলিয়াতের ঘোর অমানিশায় তাঁর রিসালাত ছিল আলোকবর্তিকা স্বরূপ।সে সমাজে মানুষেরা ভালো-মন্দের মাঝে পার্থক্য করার মতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, রীতিমত অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল, সে সমাজে আলোর মশাল জ্বালিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আগমনে মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত হয়। সমাজে অন্যায় অশান্তি দূরীভূত হয়ে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পারস্পরিক যুদ্ধ বিগ্রহ, কলহ ও সন্ত্রাসের মোকাবিলায় সন্ধি স্থাপিত হয়। তাইতো মহান আল্লাহ তাঁর রিসালাতকে (سراجا منيرا) উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে আখ্যা দিয়েছেন। কুরআনে এসেছে:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ شَٰهِدٗا وَمُبَشِّرٗا وَنَذِيرٗا ٤٥ وَدَاعِيًا إِلَى ٱللَّهِ بِإِذۡنِهِۦ وَسِرَاجٗا مُّنِيرٗا ٤٦﴾ [الاحزاب: ٤٥، ٤٦]
‘‘হে নবী! আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদ দাতা, ভীতি প্রদর্শক ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।’’ [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪৫-৪৬]
আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধিকরণ
দেহও হৃদয় উভয়ের সমন্বয়ে একজন মানব। তাই মানুষের দেহের যেমনি চাহিদা রয়েছে, তেমনি হৃদয় ও আত্মারও চাহিদা রয়েছে। জন্মগতভাবেই মহান আল্লাহ মানুষের প্রকৃতিতে ভাল ও মন্দ উভয় কাজ করার ইচ্ছা ও প্রবণতা দিয়েছেন। এ মর্মে কুরআনে এসেছে:
﴿وَنَفۡسٖ وَمَا سَوَّىٰهَا ٧ فَأَلۡهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقۡوَىٰهَا ٨﴾ [الشمس: ٧، ٨]
‘‘এবং শপথ মানুষের এবং তার যিনি তাকে সুঠাম করেছেন অতঃপর তার মধ্যে পাপ ও পুণ্য উভয়ের প্রবণতা নিহিত করে দিয়েছেন।’’ [সূরা আশ-শামস, আঢাত: ৭-৮]
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে পাপ ও পুণ্যের এই সংঘর্ষ আদম ‘আলাইহিস সালামের সময় হতে চলে আসছে। এবং কিয়ামত অবধি চালু থাকবে।
এই সংঘর্ষে আধ্যাত্মিক শক্তি মানুষকে এমন কাজে উৎসাহিত করে যা পাপের উপর বিজয়ী হতে থাকে। আর এভাবে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। এটি একমাত্র তাযকিয়া তথা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমেই সম্ভব। এ তাযকিয়ার দিকে আহবান জানিয়ে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন:
﴿قَدۡ أَفۡلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩ وَقَدۡ خَابَ مَن دَسَّىٰهَا ١٠ كَذَّبَتۡ ثَمُودُ بِطَغۡوَىٰهَآ ١١﴾ [الشمس: ٩، ١١]
‘‘নিশ্চয় যে সফলকাম হল যে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করল, আর যে ব্যর্থ হলো সে নিজেকে কলুষিত করল।’’ [সূরা আশ-শামস, আয়াত: ৯-১১]
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি করণ। তিনি স্বয়ং প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে বিভিন্ন উপায় উপকরণ অবলম্বন পূর্বক তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেছিলেন। মূলতঃ এটা রিসালাতের অন্যতম গুরু দায়িত্ব। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূলকে এ দায়িত্ব দিয়ে মহান আল্লাহ প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেছেন:
﴿كَمَآ أَرۡسَلۡنَا فِيكُمۡ رَسُولٗا مِّنكُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡكُمۡ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمۡ﴾ [البقرة: ١٥١]
‘‘যেমন আমরা তোমাদের থেকেই তোমাদের মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছি। সে তোমাদের কে আমার আয়াত পড়ে শুনাবে, তোমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও বিকশিত করে তুলবেন।’’ [সুরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৫১] অতএব, মানবিক জীবনে আধ্যাত্মিক দিকটি মৌলিক ও অন্যতম প্রধান দিক। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«الا ان فى الجسد لمضفة اذا صلحت صلح الجسد كله واذافسد الجسد كله الا وهى القلب»
‘‘নিশ্চয় মানুষের শরীরে একটি টুকরা আছে, এটা যদি ভাল হয় তবে সারা শরীর ভালো। আর এটা যদি নষ্ট হয়ে যায়,তবে সারা শরীর নষ্ট হয়ে যায়। আর এটা হলো কালব বা হৃদয়।’’[17]
মানব জাতির আদর্শ শিক্ষক
মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিসালাতের যে গুরু দায়িত্ব নিয়ে এ বসুন্ধরায় আগমন করেছেন, তার সমূদয় শিক্ষার শিক্ষক স্বয়ং তিনি নিজেই। যে শিক্ষার মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর সেবা মানব দল তৈরি করেছেন রাসূল নিজেই ছিলেন তার শিক্ষক। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মানব জাতির শিক্ষক হিসাবেই প্রেরণ করেছেন। এ মর্মে তিনি বলেছেন, بعثت معلما আমি শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছি।
এ শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েই তৎকালীন আরবের অসভ্য ও বর্বর জাতি শিক্ষা ও সাহিত্যে চরম উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই শিক্ষানীতি মানুষকে যেভাবে গড়ে তুলবার পরিকল্পনা দিয়েছে, তা হলো মানুষ এক লা শরীক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। রাসূলের মাধ্যমে প্রদত্ত বিধানের (দীন ও শরী‘আত) ভিত্তিতে তার দাসত্ব করবে। সে শুধু নিজের একার মুক্তির জন্যই কাজ করবে না, বরং আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের ভিত্তিতে গোটা বিশ্ব মানবতার পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ, মুক্তি ও উন্নয়নের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবে। তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতির ধারা বিধৃত করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢﴾ [الجمعة: ٢]
‘‘তিনি (আল্লাহ) নিরক্ষরদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব শিক্ষা দেন। ইতোপূর্বে যদিও তারা প্রকাশ্যে পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত ছিল।’’ [সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত: ২]
একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম পথিকৃৎ। তিনিই বিশ্ব মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। বিশ্বশান্তির প্রত্যক্ষ প্রতীক একমাত্র তিনিই। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে এক কথায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতি স্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্ব মানবের জন্য একমাত্র আদর্শ। পবিত্র কুরআনের পরিপূর্ণ অনুকরণ ও অনুসরণ ব্যতীত হিদায়াতের আশা সুদূর পরাহত। মহান আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন:
﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ﴾ [ال عمران: ٣١]
‘‘হে নবী! আপনি বলে দিন যে, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো তাহলে আমার অনুকরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসেন।’’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১]
তাই জীবন সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে ইসলামী জীবনাদর্শের সার্থকতা তথা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি মাত্র পন্থাই রয়েছে, আর তা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান আদর্শের পরিপূর্ণ অনুকরণ ও অনুসরণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন সর্বোত্তম সৃষ্টি, শ্রেষ্ঠতম পথিকৃৎ, আর তাঁর আদর্শ যেমন গ্রহণযোগ্য আদর্শ, তেমনিভাবে তার আদর্শই সম্পূর্ণ এবং সার্বজনীন। মানবজীবনের সব দিকের প্রতিই তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ। মানবজাতির সকল গোষ্ঠী, সমষ্টি এবং শ্রেণির জন্য তাঁর পুত পবিত্র জীবনে রয়েছে এক মহান আদর্শ। এ মর্মে আল-কুরআনে এসেছে:
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ﴾ [الاحزاب: ٢١]
“নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]
উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন
চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। এটি তলোয়ারের চেয়েও তীক্ষ্ণ হয়ে মানব জীবনে ধ্বংস ও উন্নতির সোপান হিসাবে কাজ করে। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিত্ব সকলের নিকট সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সে ধরণের উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এক মহা মানব।
বাল্যকালেই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় কাওম কর্তৃক ‘আস সাদিক’ বা সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত হন। আমানতদার, দৃঢ়তা, সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, সাধুতা, স্বভাবগত চারিত্রিক মাহাত্ম্য প্রভৃতি গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র মাধুর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٖ ٤﴾ [القلم: ٤]
‘‘নিশ্চয় আপনি উত্তম চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’’ [সূরা আল-কলম, আয়াত: ৪]
মূলতঃ তাঁর চরিত্র হলো পবিত্র কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তাঁর গোটা জীবন কাহিনী তথা সীরাত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁর চরিত্রে ছিল ভীতিজড়িত বিনয়, বীরত্ব ও সাহসিকতা মিশ্রিত লজ্জা, প্রচার বিমুখ দানশীলতা, সর্বজনবিদিত আমানতদারী, বিশ্বস্ততা,কথা ও কাজে সত্য ও সততা। পার্থিব ভোগ-বিলাস থেকে সম্পূর্ণ বিমুখতা, নিষ্ঠা, ভাষার বিশুদ্ধতা ও হৃদয়ের দৃঢ়তা, অসাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা, ছোট-বড় সকলের প্রতি দয়া ও ভালবাসা, নম্র আচরণ, অপরাধীর প্রতি ক্ষমা প্রিয়তা, বিপদাপদে ধৈর্য ও সত্য বলার দুর্বার সাহসিকতা। তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার দৃষ্টিতে كان خلقه الفرآن ‘‘পবিত্র কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র।’’সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৪৬।
আকীদা-বিশ্বাসের সংশোধনকারী
তিনি মানব জাতিকে জাহেলিয়াতের যাবতীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস প্রভৃতির অজ্ঞতা থেকে ঈমানের আলোর দিকে পথ দেখিয়েছেন, তাঁর উপর অবতীর্ণ আল-কুরআন ও মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা দিতে অবতীর্ণ হয়েছে। এ মর্মে পবিত্র কুরআনের সূরা ইবরাহীমে এসেছে:
﴿الٓرۚ كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ لِتُخۡرِجَ ٱلنَّاسَ مِنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِ رَبِّهِمۡ إِلَىٰ ٰطِ ۡعَزِيزِ ۡحَمِيدِ ١﴾ [ابراهيم: ١]
‘‘আলিফ, লাম, রা। এটি একটি গ্রন্থ। যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন, পরাক্রান্ত ও প্রশংসার যোগ্য রবের নির্দেশে তাঁরই পথের দিকে।’’ [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১] অতঃপর, সব মানুষকে অন্ধকার তথা তাগুতের পথ থেকে বের করে আলোর পথ তথা সরল সঠিক পথে আসার জন্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’’
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের উচ্চ সোপানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর আদর্শ শুধু স্বীয় অনুসারীদের হিদায়াত লাভের মাধ্যমই ছিল না বরং তাঁর উম্মাতের বিকীরিত হিদায়াত দ্বারা অন্যান্য উম্মতও অন্ধকার হতে আলোর পথের দিশা পেত। তাঁর সত্তাগত আবির্ভাবের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,
﴿هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢﴾ [الجمعة: ٢]
‘‘তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের নিকট আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে। তাদেরকে পবিত্র করবে এবং শিক্ষা দিবে কিতাব ও হিকমত।’’ [সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত: ২]
আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষক
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে সর্বপ্রথম আল্লাহর বিশ্বাস স্থাপনের আহ্বান জানান। এক আল্লাহর আহ্বান মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করে। রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালোর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, তাঁর সাথে কোনো শরীক নেই। তিনি চিরস্থায়ী, চিরঞ্জীব, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্ববিষয়ে তিনি অধিক জ্ঞাত, তিনি সর্বময় ক্ষমতার আঁধার। তাঁর ইশারায় রাতদিন আবর্তিত হয়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাওহীদ বাণী তাদের এসব বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করে। আল্লাহর অনুপম সৃষ্টি ও অসংখ্য নি‘আমতরাজি নিয়ে একটু ভেবে দেখার জন্য তিনি স্বজাতিকে উদাত্ত আহবান জানান। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে এসেছে:
﴿قُلۡ أَرَءَيۡتُمۡ إِن جَعَلَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمُ ٱلَّيۡلَ سَرۡمَدًا إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ مَنۡ إِلَٰهٌ غَيۡرُ ٱللَّهِ يَأۡتِيكُم بِضِيَآءٍۚ أَفَلَا تَسۡمَعُونَ ٧١ قُلۡ أَرَءَيۡتُمۡ إِن جَعَلَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمُ ٱلنَّهَارَ سَرۡمَدًا إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ مَنۡ إِلَٰهٌ غَيۡرُ ٱللَّهِ يَأۡتِيكُم بِلَيۡلٖ تَسۡكُنُونَ فِيهِۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ ٧٢ وَمِن رَّحۡمَتِهِۦ جَعَلَ لَكُمُ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَ لِتَسۡكُنُواْ فِيهِ وَلِتَبۡتَغُواْ مِن فَضۡلِهِۦ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٧٣﴾ [القصص: ٧١، ٧٣]
‘‘হে রাসূল! আপনি বলে দিন, ভেদে দেখ তো, আল্লাহ যদি রাত্রিকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত এমন উপাস্য কে আছে, যে তোমাদেরকে আলোক দান করতে পারে? তোমরা কি তবুও কর্ণপাত করবে না? আর আল্লাহ যদি দীনকে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে, তবে আল্লাহ ব্যতীত এমন উপাস্য কে আছে যে তোমাদেরকে রাত্রিদান করতে পারে, যাতে তোমরা বিশ্রাম করবে, তোমরা কি তবুও ভেবে দেখবে না? তিনি স্বীয় অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৭১-৭৩]
আল্লাহর ইবাদতকারী ও তাগুতের অস্বীকারকারী
সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে পরিচয় করে দিতে এবং স্রষ্টার ইবাদতের দিকে আহবান জানানো ছিল নবী-রাসূলদের অন্যতম কাজ। আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন না করে একমাত্র তাঁরই আনুগত্য করার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥﴾ [الانبياء: ٢٥]
‘‘আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলকে পাঠিয়েছি তাকে এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছি যে, নিশ্চয় আমি ব্যতীত তাদের কোনো উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫] কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষ আল্লাহর ইবাদত থেকে বিমুখ হয়ে বিভিন্ন দেব-দেবী, গাছ, সূর্য, চন্দ্র, তারকা প্রভৃতির ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়ে। ফলে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে তাঁর ইবাদতের দিকে ধাবিত করতে এবং তাগুতকে অস্বীকার করার আহ্বান বার্তা নিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেন। সে কারণে কিছু লোক হিদায়াতপ্রাপ্ত হলো এবং কিছু সংখ্যক লোক গোমরাহীর পথে রয়ে গেল। তিনি (রাসূল) তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং এর মাধ্যমেই তাদের একমাত্র সফলতা নিহিত রয়েছে, এ মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন।নিশ্চয় আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তারা আমার ইবাদত করবে এবং তাগুত থেকে বিরত থাকবে। অতঃপর তাদের কিছু সংখ্যক হিদায়াতপ্রাপ্ত হলো এবং কিছু সংখ্যক গোমরাহ হয়ে পড়ল।’’ [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৫]
সহমর্মিতার হাত বাড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে
যুলুম নির্যাতন একটি সমাজের অন্যতম ব্যাধি। এর মাধ্যমে সাংঘাতিকরূপে সমাজের আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়। সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা নষ্ট হয়। সমাজের মানুষ শাসিত ও শোষিত হয়ে দু‘শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক শ্রেণীর মানুষ শোষকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে অপর শ্রেণির ওপর অন্যায়ভাবে যুলুম নির্যাতন চালাতে থাকে। ইসলাম মানবজাতির শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্যে সকল প্রকার যুলুম নিষিদ্ধ করেছে এবং এর বিপরীতে পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতার হাত বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবক বয়সেই যুলুমের বিরুদ্ধে আপোষহীন ছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে তিনি ২০ বছর বয়সে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক শান্তিসংঘে যোগ দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে এসবের মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে ইসলাম জিহাদকে ফরজ করেছে এবং রিসালাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে সেটিকে গ্রহণ করা হয়েছে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَا لَكُمۡ لَا تُقَٰتِلُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلۡمُسۡتَضۡعَفِينَ مِنَ ٱلرِّجَالِ وَٱلنِّسَآءِ وَٱلۡوِلۡدَٰنِ ٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَآ أَخۡرِجۡنَا مِنۡ هَٰذِهِ ٱلۡقَرۡيَةِ ٱلظَّالِمِ أَهۡلُهَا وَٱجۡعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ وَلِيّٗا وَٱجۡعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ نَصِيرًا ٧٥﴾ [النساء: ٧٥]
‘‘তোমাদের কী হয়েছে! তোমরা কেন আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করছ না? অথচ নির্যাতিত নারী পুরুষ, শিশু যারা চিৎকার দিচ্ছে এ বলে, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের এ যালিম সম্প্রদায় হতে মুক্তি দিন, আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন অভিভাবক পাঠান এবং সাহায্যকারী মনোনীত করুন।’’ [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭৫] এরই ফলশ্রুতিতে কাফিরদের সাথে বিভিন্ন সংঘাত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এমনকি সশরীরে নিজে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হন।
মানুষের মাঝে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা
কোনো জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য যে কাজটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে তা হলো, পারস্পরিক যুলুম-নির্যাতন। এর মাধ্যমে মানুষ অন্যায় ও অসত্যের পথে পা বাড়ায়। আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করে। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পথভ্রষ্ট হয়। যুগে যুগে এ সব যুলুম-নির্যাতনের ব্যাপারে নবী রাসূলগণের কণ্ঠ ছিল খুবই উচ্চকিত। তারা যুলুম নির্যাতনের বিপরীতে ইনসাফ ও সুবিচার সমাজে কায়েম করেছেন। মানুষের মাঝে যখনই কোনো মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল তখনই রাসূলগণ কিতাব ও মীযান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুবিচার কায়েম করে যুলুমের মূলোৎপাটন করেন। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও যুলুম নির্যাতনের চরম পর্যায়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং এর বিপরীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নবুয়ত লাভের পূর্বে যুবক বয়সেই তিনি সমাজ হতে যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, যুলুম-নির্যাতন ও অসত্যকে দূর করার মাধ্যমে তৎকালীন সমাজেও বিচারকের আসনে সমাসীন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ফলে বহু বিবাদ নিরসনে স্বয়ং তাঁর শত্রুরাও তাঁকে বিচারক হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়।
রাসূল সা. এর কিছু মৌলিক কাজ, তাঁর নিরক্ষরতাঃ একটি আয়াতের বিশ্লেষণ
তিনি নিরক্ষরদের মাঝে তাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের মাঝে তাঁর আয়াত পাঠ করেন, তাদের পবিত্র করেন, তাদের শিক্ষা দেন কিতাব ও হেকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত। (সূরা জুমআ, আয়াত-২)
হযরত ইবরাহিম আ. বায়তুল্লাহ পুনঃনির্মাণের পর তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তথা আখেরী জমানার উম্মতের জন্য কিছু দু’আ করেছিলেন। তার মধ্যে একটি দু’আর পরিপ্রেক্ষিতে (সূরা বাক্বারা, আয়াত-১২৯) এই আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হয়। এতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে বিষয়গুলোর ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনার চেষ্টা করবো।
আয়াতের শুরুর দিকেই বলা হয়েছে, উম্মি তথা নিরক্ষর আরবদের মাঝে তাদের মধ্য থেকেই একজন উম্মি রাসূল প্রেরণ করেছেন। আরবরা উম্মি হিসেবে সুবিদিত ছিল। তাদের মধ্যে লেখাপড়ার প্রচলন খুব একটা ছিল না। আল্লাহ পাক তাঁর মহাশক্তি প্রকাশের জন্য এখানে বিশেষভাবে আরবদের উম্মি বলেছেন। ব্যাপারটা এরকম, একটি গোটা জাতি নিরক্ষর, তাদের কাছে প্রেরিত রাসূলও নিরক্ষর। তাহলে এতো পান্ডিত্যপূর্ণ কুরআন, তার শিক্ষামূলক ও সংস্কারমূলক মর্ম রাসূল সা. কী করে ঐ জাতিকে বুঝিয়েছেন? রাসূল সা. বুঝিয়েছেন আল্লাহ প্রদত্ত অপার শক্তির দ্বারা। রাব্বুল আলামীনের কুদরতের বলে বলীয়ান হয়ে তিনি যখন কুরআনে পাকের সুমহান শিক্ষার প্রচার ও তদানুযায়ী সংস্কারের কাজ শুরু করলেন, তখন এই উম্মি আরবদের মধ্য থেকেই এমন সুপন্ডিত ও দার্শনিকের উত্থান হল, যাদের প্রজ্ঞা ও কুশলতা সারা বিশ্ব মানতে বাধ্য হয়েছে।
আয়াতের এই অংশ থেকে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। যথাঃ * রাসূল সা. আরবদের মধ্য থেকে ছিলেন। * রাসূল সা. উম্মি ছিলেন
উম্মি মানে নিরক্ষর। পড়তে বা লিখতে না জানা মানুষ। আল কুরআনের প্রথম আয়াত নাজিলের ঘটনা থেকেই বোঝা যায় রাসূল সা. উম্মি ছিলেন। সেখানে সূরা আলাকের আয়াতগুলো পড়তে বলার পর হুজুর সা. বলেছিলেন, আমি পড়তে জানি না। কুরআনের আরো অনেক স্থানে আল্লাহ পাক রাসূলকে সা. উম্মি বলেছেন। হোদাইবিয়ার সন্ধিসহ বিভিন্ন ঘটনার দ্বারাও এটা বোঝা যায়।
রাসূল সা. কেমন উম্মি ছিলেন? :এখানে ভালোভাবে বুঝতে হবে রাসূল সা. নিরক্ষর বা উম্মি ছিলেন বটে কিন্তু মূর্খ বা জাহেল ছিলেন না। নিরক্ষরতা আর মূর্খতা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। রাসূল সা. ছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, মহাজ্ঞানী। আবার উম্মিও ছিলেন। অর্থাৎ তিনি মহাজ্ঞানী ছিলেন বটে তবে বিশেষ কিছু কারণে রাব্বুল আলামিন তাঁকে স্বাক্ষরতা দান করেননি।
রাসূল সা. কেন উম্মি ছিলেন?
মুফাসসিরিনে কেরাম এর উত্তরে কয়েকটি কারণ বলেন, যথাঃ * রাসূল যদি স্বাক্ষর হতেন, পড়তে বা লিখতে পারতেন, তবে কাফেররা নিশ্চিতভাবে প্রচার করতো যে, কুরআন রাসূলের সা. নিজের রচনা করা। তখন তাদের এই দাবীর কিছুটা হলেও যৌক্তিকতা থাকতো। কিন্তু কাফেররা ভালোভাবেই জানতো রাসূল সা. উম্মি, তাই কখনোই ‘কুরআন রাসূলের রচনা করা’ এই কথা বলার সুযোগ পায়নি।
* রাসূল সা. কে স্বাক্ষর হতে হলে দরকার ছিল অক্ষর জ্ঞান শিক্ষা নেয়া। যার দরূন শিক্ষকেরও প্রয়োজন ছিল। আর শিক্ষক ছাত্রের চেয়ে সম্মানিত হয়। এতে করে যিনি তাঁকে শেখাবেন, সেই ব্যক্তি রাসূলের চেয়েও সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হতেন। এটা রাসূলের নবুওয়াতের শানের খেলাফ হত। তাই আল্লাহ পাক তাঁর হাবীবকে কারো ছাত্র না বানিয়ে খোদ নিজের কুদরতী জ্ঞান দান করে মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন।
আয়াতের ক্রমানুসারে রাসূলের সা. মৌলিক কাজসমূহের মধ্যে প্রথমেই দাওয়াত। কুরআনের ভাষায়, তিনি তাদের মাঝে তাঁর (আল্লাহর) আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন। অর্থাৎ ব্যাপক দাওয়াতী কাজ করবেন। কুরআনভিত্তিক দাওয়াত দিবেন। রাসূল সা. তাই করতেন। কালামে পাকের প্রত্যেকটা আয়াতের তেলাওয়াত, তার দাওয়াত, তার মর্মবাণীকে ছড়িয়ে দেয়াসহ দাওয়াতের সকল কাজ পূর্ণভাবে আঞ্জাম দিতেন তিনি।
তারপর তাযকিয়াহ/ আত্মশুদ্ধি। শব্দটি আত্মিক পরিশুদ্ধতার ব্যাপারেই বেশী ব্যবহার হয়। তবে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় বিষয়কে একসাথেও বোঝায়। এখানে এই ব্যপক অর্থটাই উদ্দেশ্য। মনুষ্য সমাজ থেকে জুলুম, অত্যাচার, খুন, অন্যায়, অনাচার, ব্যভিচার ইত্যকার সমস্ত দোষ যেমন তিনি দূর করেছেন তেমনি মানুষের মন মনন থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, রিয়া, অহমিকা, গিবত, দুশ্চরিত্রতা ইত্যাদি আত্মিক দোষ দূর করার ব্যাপারেও তিনি সমান ব্রতী হয়েছেন। কুরআনে পাকের অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করল, সে সফল হল।
– প্রশিক্ষণ। কুরআনে পাকের তেলাওয়াতের শিক্ষা, তার তত্ত্ব ও তথ্যগত বিষয়াদি শিক্ষা, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধিবিধান বাস্তবায়নের জন্য সার্বিক প্রশিক্ষণ, কুরআনিক সমাজ বিনির্মাণের প্রশিক্ষণসহ দ্বীনভিত্তিক যাবতীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এর অন্তর্ভূক্ত। রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরামকে কুরআনে পাকের তত্ত্ব ও তথ্যগত বিষয়াদি শিক্ষা ও কুরআনিক সমাজ বিনির্মাণের প্রশিক্ষণ, উভয়দিকেই সমান গুরুত্বারোপ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামও তাঁর প্রশিক্ষণে এমন প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন, যে জিহাদের ময়দানে যেমন সীসাঢালা প্রাচীরের মত বাতিলকে রুখতেন, তেমনি কুরআনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াদির তালিমের বেলায়ও একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতেন।
এটা ইবরাহীম (আঃ)-এর শেষ দু’আ। তাঁর এ দু’আও আল্লাহ তাআলা কবুল করেন এবং ইসমাঈল (আঃ)-এর সন্তানের মধ্য থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে প্রেরণ করেন। আর এই জন্যই রসূল (সাঃ) বলেছেন, আমি হলাম আমার পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর দু’আ, ঈসা (আঃ)-এর সুসংবাদ এবং আমার জননীর স্বপ্ন । (ফাতহুররাব্বানী ২০/১৮১-১৮৯)
‘কিতাব’ বলতে কুরআন মাজীদ, আর ‘হিকমত’ বলতে হাদীস। আয়াতসমূহ তেলাঅত বা আবৃত্তি করার পর কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন মাজীদের কেবল তেলাঅতও উদ্দিষ্ট ও বাঞ্ছিত এবং তা সওয়াব ও নেকী লাভের মাধ্যম। তবে তার অর্থ ও তাৎপর্যও যদি বুঝা যায়, তাহলে তা হবে সোনার উপর সোহাগা। কিন্তু যদি কেউ কুরআনের তরজমা ও অর্থ না জানে, তবুও তার জন্য তেলাঅতের ব্যাপারে উদাসীনতা জায়েয নয়। কারণ, তেলাঅত করাই পৃথক একটি নেকীর কাজ। তবে যথাসম্ভব তার অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করা উচিত।
তেলাওয়াত এবং কিতাব ও হিকমতের শিক্ষার পর রসূল (সাঃ)-এর আগমনের এটা হল চতুর্থ উদ্দেশ্য। আর তা হল, তাদেরকে শিরক ও কুসংস্কারের আবর্জনা থেকে এবং চরিত্র ও কর্মের সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করা।
জীবন পরিশুদ্ধ করে সুসজ্জিত করা বলতে চিন্তা –ভাবনা, আচার-আচরণ , চরিত্র-নৈতিকতা, সমাজ-সংস্কৃতি,রাজনীতি ইত্যাকার সবকিছুকেই সুসজ্জিত করা বুঝাচ্ছে৷
সংগ্রহে–
তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন
পবিত্র কুরআনের আলোকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রিসালাত (মো: আব্দুল কাদের)