সূরা বাকারাঃ ১৪তম রুকু (১১৩–১২১)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:১১৩ وَ قَالَتِ الۡیَهُوۡدُ لَیۡسَتِ النَّصٰرٰی عَلٰی شَیۡءٍ ۪ وَّ قَالَتِ النَّصٰرٰی لَیۡسَتِ الۡیَهُوۡدُ عَلٰی شَیۡءٍ ۙ وَّ هُمۡ یَتۡلُوۡنَ الۡکِتٰبَ ؕ کَذٰلِکَ قَالَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ مِثۡلَ قَوۡلِهِمۡ ۚ فَاللّٰهُ یَحۡکُمُ بَیۡنَهُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ فِیۡمَا کَانُوۡا فِیۡهِ یَخۡتَلِفُوۡنَ
আর ইয়াহুদীরা বলে, ‘নাসারাদের কোন ভিত্তি নেই’ এবং ‘নাসারারা বলে ইয়াহুদীদের কোন ভিত্তি নেই’ অথচ তারা কিতাব পড়ে। এভাবে যারা কিছুই জানেনা তারাও একই কথা বলে। কাজেই যে বিষয়ে তারা মতভেদ করতো কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের মধ্যে (সে বিষয়ে) মীমাংসা করবেন।
ইয়াহুদী হোক অথবা নাসারা কিংবা মুসলিম- যে কেউ উপরোক্ত মৌলিক বিষয়াদির মধ্য থেকে কোন একটি ছেড়ে দেয়, অতঃপর শুধু নামভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নিজেদেরকে জান্নাতের একমাত্র উত্তরাধিকারী মনে করে নেয়, সে আত্মপ্রবঞ্চনা বৈ কিছুই করে না; আসল সত্যের সাথে এর কোনই সম্পর্ক নেই। এসব নামের উপর ভরসা করে কেউ আল্লাহর নিকটবর্তী ও মকবুল হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তার মধ্যে ঈমান ও সৎকর্ম থাকে। প্রত্যেক নবীর শরীআতেই ঈমানের মূলনীতি এক ও অভিন্ন।
يَهُود (ইয়াহুদ) হয় هَوَادَة (যার অর্থ, ভালবাসা) ধাতু থেকে গঠিত অথবা تَهَوّد (যার অর্থ, তাওবা করা) ধাতু থেকে গঠিত। অর্থাৎ, তাদের এই নামকরণ প্রকৃতপক্ষে তাওবা করার কারণে অথবা একে অপরকে ভালবাসার কারণে হয়েছে। এ ছাড়া মূসা (আঃ)-এর অনুসারীদেরকে ‘ইয়াহুদী’ বলা হয়।
نَصَارَى (নাসারা) نَصرَان এর বহুবচন। যেমন, سكَارَى سَكرَان এর বহুবচন। এর মূল ধাতু হল نصر (যার অর্থ সাহায্য-সহযোগিতা)। আপোসে একে অপরের সাহায্য করার কারণে তাদের এই নামকরণ হয়েছে। ওদেরকে ‘আনসার’ও বলা হয়। যেমন তারা ঈসা (আঃ)-কে বলেছিল, {نَحْنُ اَنْصَارُ اللهِ} ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীদেরকে নাসারা (খ্রিষ্টান) বলা হয় এবং তাদেরকে ঈসায়ীও বলা হয়।
তবে সৎকর্মের আকার-আকৃতিতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। তাওরাতের যুগে যেসব কাজ-কর্ম মূসা আলাইহিস সালাম ও তাওরাতের শিক্ষার অনুরূপ ছিল, তাই ছিল সৎকর্ম। তদ্রুপ ইঞ্জীলের যুগে নিশ্চিতরূপে তা-ই ছিল সৎকর্ম, যা ঈসা আলাইহিস সালাম ও ইঞ্জীলের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল। এখন কুরআনের যুগে ঐসব কাজ-কর্মই সৎকর্মরূপে অভিহিত হওয়ার যোগ্য, যা সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী এবং তার মাধ্যমে আসা গ্রন্থ কুরআনুল কারীমের হেদায়াতের অনুরূপ।
মোটকথা, ইয়াহুদী ও নাসারাদের মতবিরোধ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলার ফয়সালা এই যে, উভয় সম্প্রদায় মূর্খতাসুলভ কথাবার্তা বলছে, তাদের কেউই জান্নাতের ইজারাদার নয়। ভুল বুঝাবুঝির প্রকৃত কারণ হচ্ছে এই যে, ওরা দ্বীনের আসল প্রাণ ও বিশ্বাস, সৎকর্মকে বাদ দিয়ে বংশ অথবা দেশের ভিত্তিতে কোন সম্প্রদায়কে ইয়াহুদী আর কোন সম্প্রদায়কে নাসারা নামে অভিহিত করেছে। কুরআনুল কারীমে আহলে-কিতাবদের মতবিরোধ ও আল্লাহর ফয়সালা উল্লেখ করার মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলিমদেরকে সতর্ক করা, যাতে তারাও ভুল বুঝাবুঝিতে লিপ্ত হয়ে একথা না বলে যে, আমরা পুরুষানুক্রমে মুসলিম, প্রত্যেক অফিসে ও রেজিষ্টারে আমাদের নাম মুসলিমদের কোটায় লিপিবদ্ধ এবং আমরা মুখেও নিজেদেরকে মুসলিম বলি, সুতরাং জান্নাত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে মুসলিমদের সাথে ওয়াদাকৃত সকল পুরস্কারের যোগ্য হকদার আমরাই।
এ ফয়সালা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শুধু দাবী করলে, মুসলিমরূপে নাম লিপিবদ্ধ করালে অথবা মুসলিমের ঔরসে কিংবা মুসলিমদের আবাসভূমিতে জন্ম গ্রহণ করলেই প্রকৃত মুসলিম হয় না, বরং মুসলিম হওয়ার জন্য পরিপূর্ণভাবে ইসলাম গ্রহণ করা অপরিহার্য। ইসলামের অর্থ আত্মসমর্পণ। দ্বিতীয়তঃ সৎকর্ম অর্থাৎ সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করাও জরুরী।
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ
আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তারাই জান্নাতবাসী, তারা সেখানে স্থায়ী হবে। বাকারাঃ ৮২
নাকি তোমরা মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত অবস্থা আসেনি? অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত-কম্পিত হয়েছিল এমনকি রাসূল ও তার সংগী-সাথী ঈমানদারগণ বলে উঠেছিল, আল্লাহ্র সাহায্য কখন আসবে? জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে। বাকারাঃ ২১৪
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সবচাইতে অধিক বালা-মুসীবতে পতিত হয়েছেন নবী-রাসূলগণ। তারপর (মর্যাদার দিক থেকে) তাদের নিকটবর্তী ব্যক্তিবর্গ’। [ইবনে মাজাহঃ ৪০২৩]
এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; তারা সেখানে স্থায়ী হবে আর এটাই হলো মহাসাফল্য। নিসাঃ১৩
আর যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে, আমরা তাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। আর কে আল্লাহর চেয়ে কথায় সত্যবাদী? নিসাঃ১২২
আর পুরুষ বা নারীর মধ্যে কেউ মুমিন অবস্থায় সৎকাজ করলে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না। নিসাঃ১২৪
২:১১৪ وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰهِ اَنۡ یُّذۡکَرَ فِیۡهَا اسۡمُهٗ وَ سَعٰی فِیۡ خَرَابِهَا ؕ اُولٰٓئِکَ مَا کَانَ لَهُمۡ اَنۡ یَّدۡخُلُوۡهَاۤ اِلَّا خَآئِفِیۡنَ ۬ؕ لَهُمۡ فِی الدُّنۡیَا خِزۡیٌ وَّ لَهُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
আর তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে তার নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং এগুলো বিরাণ করার চেষ্টা করে? অথচ ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে তাদের জন্য সেগুলোতে প্রবেশ করা সঙ্গত ছিল না। দুনিয়াতে তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও আখেরাতে রয়েছে মহাশাস্তি।
যারা মসজিদে আল্লাহর যিকর করতে বাধা দান করেছিল, তারা কারা? তাদের ব্যাপারে মুফাসসিরদের দু’টি মত রয়েছে।
একটি মত হল, এ থেকে খ্রিষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। যারা রোমসম্রাটের সাথে নিয়ে ইয়াহুদীদেরকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নামায পড়তে বাধা দিয়েছিল এবং তার বিনাশ সাধনে অংশ নিয়েছিল। ইবনে জারীর ত্বাবারী এই মতকেই পছন্দ করেছেন।
কিন্তু হাফেয ইবনে কাসীর এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, এ থেকে মক্কার মুশরিকদের বুঝানো হয়েছে। তারা নবী করীম (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাদেরকে মক্কা থেকে বের হতে বাধ্য করেছিল এবং কাবা শরীফে মুসলিমদেরকে ইবাদত করতে বাধা দিয়েছিল। আবার হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় একই আচরণের পুনরাবৃত্তি করে বলেছিল যে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের হত্যাকারীদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেবো না, অথচ কাবা শরীফে ইবাদত করতে বাধা দেওয়ার অনুমতি ও তার প্রচলন ছিল না।
ইসলাম-পূর্বকালে ইয়াহুদীরা ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করলে নাসারারা তার প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর হয়। তারা ইরাকের একজন অগ্নি-উপাসক সম্রাটের সাথে মিলিত হয়ে ইয়াহুদীদের উপর আক্রমণ চালায় – তাদের হত্যা ও লুন্ঠন করে, তাওরাতের কপিসমূহ জ্বলিয়ে ফেলে, বায়তুল মুকাদ্দাসে আবর্জনা ও শুকর নিক্ষেপ দেয়। এতে ইয়াহুদীদের শক্তি পদদলিত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাস এমনিভাবে পরিত্যক্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফত আমলে যখন সিরিয়া ও ইরাক বিজিত হয়, তখন তারই নির্দেশক্রমে বায়তুল মুকাদ্দাস পুনঃনির্মিত হয়। এরপর দীর্ঘকাল পর্যন্ত সমস্ত সিরিয়া ও বায়তুল-মুকাদ্দাস মুসলিমদের অধিকারে ছিল। অতঃপর বায়তুল-মুকাদ্দাস মুসলিমদের হস্তচ্যুত হয় এবং প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল পর্যন্ত ইউরোপীয় নাসারাদের অধিকারে থাকে। অবশেষে হিজরী ষষ্ট শতকে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বায়তুল-মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করেন। এ আয়াত থেকে কতিপয় প্রয়োজনীয় মাসআলা ও বিধানও প্রমাণিত হয়।
প্রথমতঃ
শিষ্টতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বিশ্বের সকল মসজিদ একই পর্যায়ভুক্ত। বায়তুল-মুকাদ্দাস, মসজিদে হারাম ও মসজিদে-নববীর অবমাননা, যেমনি বড় যুলুম, তেমনি অন্যান্য মসজিদের বেলায়ও তা সমভাবে প্রযোজ্য। তবে এই তিনটি মসজিদের বিশেষ মাহাত্ম্য ও সম্মান স্বতন্ত্রভাবে স্বীকৃত। এক সালাতের সওয়াব মসজিদে হারামে একলক্ষ সালাতের সমান এবং মসজিদে নববীতে এক হাজার সালাতের সমান। আর বায়তুল-মুকাদ্দাস মসজিদে পাঁচশত সালাতের সমান। এই তিন মসজিদে সালাত আদায় করার উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত থেকে সফর করে সেখানে পৌছা বিরাট সওয়াব ও বরকতের বিষয়। কিন্তু অন্য কোন মসজিদে নেই।
দ্বিতীয়তঃ
মসজিদে যিকর ও সালাতে বাধা দেয়ার যত পন্থা হতে পারে সে সবগুলোই হারাম। তন্মধ্যে একটি প্রকাশ্য পন্থা এই যে, মসজিদে গমন করতে অথবা সেখানে সালাত আদায় ও তিলাওয়াত করতে পরিস্কার ভাষায় নিষেধাজ্ঞা প্রদান। দ্বিতীয় পন্থা এই যে, মসজিদে হট্টগোল করে অথবা আশে-পাশে গানবাজনা করে মুসল্লীদের সালাত আদায় ও যিকরে বিঘ্ন সৃষ্টি করা।
তৃতীয়তঃ
মসজিদ জনশূন্য করার জন্য সম্ভবপর যত পন্থা হতে পারে সবই হারাম। খোলাখুলিভাবে মসজিদকে বিধ্বস্ত করা ও জনশূন্য করা যেমনি এর অন্তর্ভুক্ত তেমনিভাবে এমন কারণ সৃষ্টি করাও এর অন্তর্ভুক্ত, যার ফলে মসজিদ জনশূন্য হয়ে পড়ে। মসজিদ জনশূন্য হওয়ার অর্থ এই যে, সেখানে সালাত আদায় করার জন্য কেউ আসে না কিংবা সালাত আদায়কারীর সংখ্যা হ্রাস পায়।
এখানে শব্দগুলো ঘোষণামূলক হলেও এর অর্থ হবে বাঞ্ছনার। অর্থাৎ, যখন মহান আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিষ্ঠা ও বিজয় দান করবেন, তখন তোমরা মুশরিকদেরকে সেখানে সন্ধি ও জিযিয়াকর ব্যতীত সেখানে (প্রবেশ বা) অবস্থান করার অনুমতি না দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। তাই যখন ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় হল, তখন নবী করীম (সাঃ) ঘোষণা করলেন যে, আগামী বছর কোন মুশরিক কাবায় এসে হজ্জ করার এবং উলঙ্গ তওয়াফ করার অনুমতি পাবে না এবং যার সাথে যে চুক্তি আছে, সে চুক্তির (নির্ধারিত) সময় পর্যন্ত সে এখানে থাকার অনুমতি পাবে। কেউ বলেছেন, এটা একটা সুসংবাদ ও ভবিষ্যদ্বাণী যে, অতি সত্বর মুসলিমরা জয়লাভ করবে এবং মুশরিকরা এই ভেবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে প্রবেশ করবে যে, আমরা মুসলিমদের উপর যে যুলুম-অত্যাচার করেছি তার বদলায় হয়তো আমাদেরকে শাস্তি ও হত্যারও শিকার হতে হবে। বলা বাহুল্য, অতি সত্বর এই সুসংবাদ বাস্তবে রূপান্তরিত হয়।
২:১১৫ وَ لِلّٰهِ الۡمَشۡرِقُ وَ الۡمَغۡرِبُ ٭ فَاَیۡنَمَا تُوَلُّوۡا فَثَمَّ وَجۡهُ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
আর পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই; সুতরাং যেদিকেই তোমরা মুখ ফিরাও না কেন, সেদিকই আল্লাহর দিক। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।
আল্লাহ পূর্বেরও নয়, পশ্চিমেরও নয় ৷ তিনি সকল দিকের ও সকল স্থানের মালিক ৷ কিন্তু নিজে কোন স্থানের পরিসরে সীমাবদ্ধ নেই ৷ কাজেই তাঁর ইবাদাতের জন্য কোন দিক বা স্থান নিদিষ্ট করার অর্থ এ নয় যে , আল্লাহ সেদিকে বা সে স্থানে থাকেন ৷ কাজেই ইতিপূর্বে তোমরা ওখানে বা ঐ দিকে ফিরে ইবাদাত করতে আর এখন সেই জায়গা বা দিক পরিবর্তন করলে কেন –একথা নিয়ে ঝগড়া বা বিতর্ক করার কোন অবকাশ নেই।
وَجْهُ اللَّهِ
শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর চেহারা। মুসলিমদের আকীদা বিশ্বাস হলো এই যে, আল্লাহর চেহারা রয়েছে। তবে তা সৃষ্টির কারও চেহারার মত নহে। কিন্তু এ আয়াতের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো – সকল দিকই যেহেতু আল্লাহর সুতরাং মুসল্লী পূর্ব ও পশ্চিম যেদিকেই মুখ ফিরাক না কেন সেদিকেই আল্লাহর কিবলা রয়েছে। কেউ কেউ এ আয়াতটিকে আল্লাহ্ তা’আলার সিফাত মুখমণ্ডল বা চেহারা সাব্যস্ত করার জন্য দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। মূলতঃ এ আয়াতটিতে ‘ওয়াজহ’ শব্দটি দিক বা কেবলা বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। তাই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ এ আয়াতটিকে সিফাতের আয়াতের মধ্যে গণ্য করাকে ভুল আখ্যায়িত করেছেন। [দেখুন – মাজমু ফাতাওয়াঃ ২/৪২৯, ৩/১৯৩, ৬/১৫-১৬]
কোন কোন মুফাসসির (فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ) আয়াতকে এই নফল সালাতেরই বিধান বলে সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু স্মরণ রাখা দরকার যে, এই বিধান সে সমস্ত যানবাহনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যাতে সওয়ার হয়ে চলার সময় কেবলার দিকে মুখ করা কঠিন। পক্ষান্তরে যেসব যানবাহনে সওয়ার হলে কেবলার দিকে মুখ করা কঠিন নয়, যেমন রেলগাড়ী, সামুদ্রিক জাহাজ, উড়োজাহাজ ইত্যাদিতে নফল সালাতেও কেবলার দিকেই মুখ করতে হবে। তবে সালাতরত অবস্থায় রেলগাড়ী অথবা জাহাজের দিক পরিবর্তন হয়ে গেলে এবং আরোহীর পক্ষে কেবলার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অবকাশ না থাকলে সে অবস্থায়ই সালাত পূর্ণ করবে। এমনিভাবে কেবলার দিক সম্পর্কে সালাত আদায়কারীর জানা না থাকলে, রাতের অন্ধকারে দিক নির্ণয় করা কঠিন হলে এবং বলে দেয়ার লোক না থাকলে সেখানেও সালাত আদায়কারী অনুমান করে যেদিকেই মুখ করবে, সেদিকই তার কেবল বলে গণ্য হবে। [তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন]
এখানে কেবলামুখী হওয়ার সম্পূর্ণ স্বরূপ বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে যে, এর উদ্দেশ্য (নাউযুবিল্লাহ) বায়তুল্লাহ অথবা বায়তুল- মুকাদ্দাসের পূজা করা নয়। সমস্ত সৃষ্টিজগত তার কাছে অতি ছোট। এরপরও বিভিন্ন তাৎপর্যের কারণে বিশেষ স্থান অথবা দিককে কেবলা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আয়াতের শেষে মহান আল্লাহর দুটি গুরুত্বপূর্ণ গুণবাচক নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথমে বলা হয়েছে, তিনি وَاسِعٌ এ শব্দটির দুটি অর্থ রয়েছে।
এক, প্রাচুর্যময়; অর্থাৎ তাঁর দান অপরিসীম। তিনি যাকে ইচ্ছা তার কর্মকাণ্ড দেখে বিনা হিসেবে দান করবেন। পূর্ব বা পশ্চিম তাঁর কাছে মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। তিনি দেখতে চাইছেন যে, কে তার কথা শুনে আর কে শুনে না।
দুই, وَاسِعٌ শব্দটির দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, সর্বব্যাপী। অর্থাৎ তিনি যেহেতু সবদিক ও সবস্থান সম্পর্কে পূর্ণ খবর রাখেন সুতরাং তাঁর জন্য কোন কাজটি করা হল সেটা তিনি ভাল করেই জানেন। সে অনুসারে তিনি তার বান্দাকে পুরস্কৃত করবেন। এ অর্থের সাথে পরে উল্লেখিত দ্বিতীয় গুণবাচক নাম عَلِيْمٌ শব্দটি বেশী উপযুক্ত।
ক্বিবলা (আরবি: قبلة, “দিক”), এছাড়াও কেবলা হিসাবে বর্ণান্তরিত, একটি দিক যার সম্মুখীন হয়ে মুসলিমরা নামাজের সময় প্রার্থনা করেন। এটি মক্কায় অবস্থিত কাবার দিক হিসাবে স্থিরীকৃত। অধিকাংশ মসজিদে মিহরাবের মাধ্যমে কাবাঘরের দিক নির্দেশ করা হয়।
২:১১৬ وَ قَالُوا اتَّخَذَ اللّٰهُ وَلَدًا ۙ سُبۡحٰنَهٗ ؕ بَلۡ لَّهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ کُلٌّ لَّهٗ قٰنِتُوۡنَ
আর তারা বলে, ‘আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন’। তিনি (তা থেকে) অতি পবিত্র। বরং আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। সবকিছু তারই একান্ত অনুগত।
নাসারারা বলে থাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সন্তান গ্রহণ করেছেন। অথচ এটা সম্পূর্ণ একটি অপবাদ। কুরআনের অন্যত্র এসেছে, তারা দয়াময়ের প্রতি সন্তান আরোপ করে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা দয়াময়ের শোভন নয়! আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের কাছে বান্দারূপে উপস্থিত হবে না। [সূরা মারইয়ামঃ ৯১-৯৩]
এ সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহ বলেন, মানুষ আমার উপর মিথ্যারোপ করে, অথচ তাদের এটা উচিত নয়। মানুষ আমাকে গালি দেয়, অথচ তাও তাদের জন্য উচিত নয়। মিথ্যারোপ করার অর্থ হলো, তারা বলে, আমি তাদের মৃত্যুর পর জীবিত করে পূর্বের ন্যায় করতে সক্ষম নই। আর গালি দেয়ার অর্থ হলো, তারা বলে যে, আমার পুত্র আছে। অথচ স্ত্রী বা সন্তান গ্রহণ করা থেকে আমি পবিত্র।” [বুখারীঃ ৪৪৮২]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, “কষ্টদায়ক কথা শুনার পর আল্লাহর চেয়ে বেশী ধৈর্যশীল আর কেউ নেই, মানুষ তার জন্য সন্তান সাব্যস্ত করে, তারপরও তিনি তাদেরকে নিরাপদে রাখেন ও রিযিক দেন।” [বুখারী: ৭৩৭৮, মুসলিম: ২৮০৪]
২:১১৭ بَدِیۡعُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ اِذَا قَضٰۤی اَمۡرًا فَاِنَّمَا یَقُوۡلُ لَهٗ کُنۡ فَیَکُوۡنُ
তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের উদ্ভাবক। আর যখন তিনি কোন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার জন্য শুধু বলেন, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায়।
অর্থাৎ, তিনি সেই আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীনের প্রতিটি জিনিসের (সৃষ্টিকর্তা ও) মালিক। প্রত্যেকটি জিনিস তাঁর অনুগত। আসমান ও যমীনকে কোন নমুনা ছাড়াই তিনিই সৃষ্টি করেছেন। এ ছাড়াও তিনি যা করতে চান তার জন্য কেবল ‘কুন’ (হও) শব্দই তাঁর জন্য যথেষ্ট হয়। এমন সুমহান সত্তার আবার সন্তানাদির প্রয়োজন হয় কি করে?
তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে একথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ (ভুল অনুবাদ ‘এবং’ হবে-আরবি ‘وَ ‘এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘এবং’) তা হয়ে যায়।সূরা বাকারা-১১৭
প্রথমেই যে বিষয়টি আমরা ভুল করে ফেলি সেটা হচ্ছে ‘‘কুন ফায়াকুন‘‘ হও এবং হয়ে যায়’ ব্যাপারটিকে মনের অজান্তেই আমরা একটি তড়িৎ পরিবর্তন বা চোখের পলকে ঘটে যাওয়া ব্যাপার হিসেবে ধরে নিয়েছি। এটা চোখের পলকেই হতে হবে এমন কোন বিষয় নয়। সে বিষয়টি আমরা কুরআনের অন্য আরেকটি আয়াতের মাধ্যমে জানতে পারি। ঈসা(আঃ)এর জন্মের বিষয়ে মরিয়ম (আঃ) এবং ফেরেশতাদের কথোপকথনটি আল্লাহ কোরআনে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বললেন, পরওয়ারদেগার! কেমন করে আমার সন্তান হবে; আমাকে তো কোন মানুষ স্পর্শ করেনি। বললেন এ ভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যখন কোন কাজ করার জন্য ইচ্ছা করেন তখন বলেন যে, ‘হয়ে যাও’ অমনি তা হয়ে যায়। ৩:৪৭
এ আয়াতের ও “কুন ফায়াকুন” ব্যবহার করা হয়েছে। স্পষ্টতঃ এখানে আল্লাহ হঠাৎ করে ঈসা আ এর জম্ম হওয়ার কথা বলছেন না, কিংবা আমরা ও হঠাৎ করে ইসা আ জম্মের কথা চিন্তা করছিনা। এখানে ‘‘কুন ফায়াকুন ’’ দ্বারা আল্লাহর আদেশ একটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
অপরদিকে আল্লাহ বলেননি যে হও বলার সাথে সাথে পূর্নকার্য সম্পাদিত হয়ে যায়। বরং উপরের আয়াতগুলো হতে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হল-
আল্লাহ “হও” বলার সাথে সাথেই তার নিধারির্ত প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়, কার্যক্রম শেষ হয় আল্লাহ যেভাবে ঠিক করে দিবেন ঠিক সেভাবেই।
২:১১৮ وَ قَالَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ لَوۡ لَا یُکَلِّمُنَا اللّٰهُ اَوۡ تَاۡتِیۡنَاۤ اٰیَۃٌ ؕ کَذٰلِکَ قَالَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ مِّثۡلَ قَوۡلِهِمۡ ؕ تَشَابَهَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ ؕ قَدۡ بَیَّنَّا الۡاٰیٰتِ لِقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ
আর যারা কিছু জানে না তারা বলে, ‘আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন? অথবা আমাদের কাছে কেন আসে না কোন আয়াত? এভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও তাদের মত কথা বলতো। তাদের অন্তর একই রকম। অবশ্যই আমরা আয়াতসমূহকে স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি, এমন কওমের জন্য, যারা দৃঢ়বিশ্বাস রাখে।
এ আয়াতে উদ্দিষ্ট হল আরবের সেই মুশরিকগণ, যারা ইয়াহুদীদের মত দাবী করেছিল যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের সাথে সরাসরি কথা বলেন না কেন অথবা কোন বড় নিদর্শন দেখান না কেন? যা দেখে আমরা মুসলিম হয়ে যাব।
সূরা বনী ইসরাইলঃ ৮৯-৯৬ আয়াত এ এসেছে—–
আমি এ কুরআনে লোকদেরকে নানাভাবে বুঝিয়েছি কিন্তু অধিকাংশ লোক অস্বীকার করার ওপরই অবিচল থাকে৷
তারা বলে, “আমরা তোমার কথা মানবো না যতক্ষণ না তুমি ভূমি বিদীর্ণ করে আমাদের জন্য একটি ঝরণাধারা উৎসারিত করে দেবে৷ অথবা তোমার খেজুর ও আংগুরের একটি বাগান হবে এবং তুমি তার মধ্যে প্রবাহিত করে দেবে নদী-নালা৷
অথবা তুমি আকাশ ভেংগে টুকরো টুকরো করে তোমার হুমকি অনুযায়ী আমাদের ওপর ফেলে দেবে৷ অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে৷ অথবা তোমার জন্য সোনার একটি ঘর তৈরি হবে৷ অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে এবং তোমার আরোহণ করার কথাও আমরা বিশ্বাস করবো না যতক্ষণ না তুমি আমাদের প্রতি একটি লিখিত পত্র আনবে, যা আমরা পড়বো৷” হে মুহাম্মাদ ! এদেরকে বলো, পাক-পবিত্র আমার পরওয়ারদিগার, আমি কি একজন বাণীবাহক মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ?
লোকদের কাছে যখনই কোনো পথনির্দেশ আসে তখন তাদের একটা কথাই তাদের ঈমান আনার পথ রুদ্ধ করে দেয়৷ কথাটা এই যে, “আল্লাহ কি মানুষকে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন ?”
তাদেরকে বলো, যদি পৃথিবীতে ফেরেশতারা নিশ্চিন্তভাবে চলাফেরা করতো তাহলে নিশ্চয়ই আমি কোনো ফেরেশতাকেই তাদের কাছে রসূল বানিয়ে পাঠাতাম৷
হে মুহাম্মদ ! তাদেরকে বলে দাও, আমার ও তোমাদের শুধু একমাত্র আল্লাহর সাক্ষই যথেষ্ট৷ তিনি নিজের বান্দাদের অবস্থা জানেন এবং সবকিছু দেখছেন৷বনী ইসরাইলঃ৮৯-৯৬
সূরা যারিয়াতের ৫২-৫৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
{كَذَلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ* أَتَوَاصَوْا بِهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ}
এমনিভাবে, তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোন রসূল আগমন করেছে তারা বলেছে, যাদুকর, না হয় উন্মাদ। তারা কি একে অপরকে এই উপদেশই দিয়ে গেছে? বস্তুতঃ ওরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। অর্থাৎ, কমবেশী এদের সকলের মধ্যে সীমালংঘন করে অবাধ্য হওয়ার প্রবণতা আছে। আর এই জন্য সত্যের প্রতি আহবানকারীদের সামনে নতুন নতুন দাবী রাখতো কিংবা তাঁদেরকে পাগল আখ্যা দিত।
২:১১৯ اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ بِالۡحَقِّ بَشِیۡرًا وَّ نَذِیۡرًا ۙ وَّ لَا تُسۡئَلُ عَنۡ اَصۡحٰبِ الۡجَحِیۡمِ
নিশ্চয় আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি সত্যসহ সুসংবাদদাতা সতর্ককারীরূপে আর জাহান্নামীদের সম্পর্কে আপনাকে কোন প্রশ্ন করা হবে না।
এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গুণে ভূষিত করা হয়েছে।
প্রথম. ‘আল-মুরসাল বিল হক্ক’ বা যথাযথভাবে প্রেরিত, আল্লাহ্ তা’আলা স্বয়ং তার রাসূল প্রেরণের উপর সাক্ষী হচ্ছেন যে, তিনি তাকে যথাযথভাবে হক সহ প্রেরণ করেছেন।
দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে, তিনি বাশীর বা সুসংবাদ প্রদানকারী। তিনি নেককারদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ প্রদানকারী।
তৃতীয় গুণ হচ্ছে, তিনি নাযীর বা ভীতি প্রদর্শনকারী। যারা তার অবাধ্য হবে তারা জাহান্নামবাসী হবে এ ভীতিপ্রদ সংবাদ তিনি সবাইকে প্রদান করেছেন।
পবিত্র কুরআনের অন্যত্রও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরূপ গুণে গুণান্বিত করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে,
وَبِالْحَقِّ أَنزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ ۗ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا مُبَشِّرًا وَنَذِيرًا
এ কুরআনকে আমি সত্য সহকারে নাযিল করেছি এবং সত্য সহকারেই এটি নাযিল হয়েছে৷ আর হে মুহাম্মাদ! তোমাকে আমি এছাড়া আর কোনো কাজে পাঠাইনি যে, (যে মেনে নেবে তাকে) সুসংবাদ দিয়ে দেবে এবং (যে মেনে নেবে না তাকে) সাবধান করে দেবে। সূরা আল-ইসরা: ১০৫
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا مُبَشِّرًا وَنَذِيرًا
হে মুহাম্মদ৷ তোমাকে তো আমি শুধুমাত্র একজন সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী করে পাঠিয়েছিআল-ফুরকান: ৫৬
﴿وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
আর (হে নবী) আমি তো তোমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী করে পাঠিয়েছি কিন্তু বেশীর ভাগ লোক জানে না [সূরা সাবা: ২৮]
﴿إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا ۚ وَإِن مِّنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ﴾
আমি তোমাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছি সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী বানিয়ে৷ আর এমন কোন সম্প্রদায় অতিক্রান্ত হয়নি যার মাধ্যে কোন সতর্ককারী আসেনি) সূরা ফাতির: ২৪]
﴿إِنَّا أَرْسَلْنَا إِلَيْكُمْ رَسُولًا شَاهِدًا عَلَيْكُمْ كَمَا أَرْسَلْنَا إِلَىٰ فِرْعَوْنَ رَسُولًا﴾
আমি তোমাদের নিকট একজন রসূল পাঠিয়েছি তোমাদের জন্য সাক্ষী স্বরূপ যেমন ফেরাউনের নিকট একজন রসূল পাঠিয়েছিলাম ৷ [সূরা আল-মুযযাম্মিল: ১৫]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ গুণটি শুধু কুরআনে নয়; পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহেও বর্ণিত হয়েছে। [ বুখারী: ২১২৫, মুসনাদে আহমাদ: ২/১৭৪]
আতা ইবনু ইয়াসার (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু আস (রাঃ)-কে বললাম, আপনি আমাদের কাছে তাওরাতে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গুণাবলী বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, আচ্ছা। আল্লাহর কসম! কুরআনে বর্ণিত তাঁর কিছু গুণাবলী তাওরাতেও উল্লেখ করা হয়েছেঃ ‘‘হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীরূপে প্রেরণ করেছি’’ এবং উম্মীদের রক্ষক হিসাবেও। আপনি আমার বান্দা ও আমার রাসূল। আমি আপনার নাম মুতাওয়াক্কিল (আল্লাহর উপর ভরসাকারী) রেখেছি। তিনি বাজারে কঠোর রূঢ় ও নির্দয় স্বভাবের ছিলেন না। তিনি মন্দর প্রতিশোধ মন্দ দ্বারা নিতেন না বরং মাফ করে দিতেন, ক্ষমা করে দিতেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ততক্ষণ মৃত্যু দিবেন না যতক্ষণ না তাঁর দ্বারা বিকৃত মিল্লাতকে ঠিক পথে আনেন অর্থাৎ যতক্ষণ না তারা (আরববাসীরা) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর ঘোষণা দিবে। আর এ কালিমার মাধ্যমে অন্ধ-চক্ষু, বধির-কর্ণ ও আচ্ছাদিত হৃদয় খুলে যাবে।
আবদুল ‘আযীয ইবনু আবূ সালামাহ (রহ.) হিলাল (রহ.) হতে হাদীস বর্ণনায় ফুলাইহ (রহ.)-এর অনুসরণ করেছেন। সা‘ঈদ (রহ.) ……. ইবনু সালাম (রহ.) হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (৪৮৩৮) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৯৭৭ , ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯৯২)। বুখারী: ২১২৫
২:১২০ وَ لَنۡ تَرۡضٰی عَنۡکَ الۡیَهُوۡدُ وَ لَا النَّصٰرٰی حَتّٰی تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمۡ ؕ قُلۡ اِنَّ هُدَی اللّٰهِ هُوَ الۡهُدٰی ؕ وَ لَئِنِ اتَّبَعۡتَ اَهۡوَآءَهُمۡ بَعۡدَ الَّذِیۡ جَآءَکَ مِنَ الۡعِلۡمِ ۙ مَا لَکَ مِنَ اللّٰهِ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیۡرٍ
. আর ইয়াহুদী ও নাসারারা আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করেন। বলুন নিশ্চয় আল্লাহর হেদায়াতই প্রকৃত হেদায়াত। আর যদি আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেন আপনার কাছে জ্ঞান আসার পরও, তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার কোন অভিভাবক থাকবে না এবং থাকবে না কোন সাহায্যকারীও।
এর অর্থ হচ্ছে তাদের অসন্তষ্টির কারণ এ নয় যে তারা যথার্থই সত্যসন্ধানী এবং তুমি সত্যকে তাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেনি ৷বরং তোমার প্রতি তাদের অসন্তুষ্টির কারণ হচ্ছে এই যে, তুমি আল্লাহর নিদর্শনসমূহ ও তাঁর দীনের সাথে তাদের মতো মুনাফিকসূলভ ও প্রতারণামুলক আচরণ করছো না কেন? আল্লাহ-পূজার ছদ্মবেশে তারা যেমন আত্মপূজা করে যাচ্ছে তুমি তেমন করছো না কেন? দীনের মূলনীতি ও বিধানসমূহের নিজের চিন্তা-ধারণা-কল্পনা এবং নিজের ইচ্ছা –কামনা –বাসনা অনুযায়ী পরিবর্তিত করার ব্যাপারে তাদের মতো দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছো না কেন? তাদের মতো প্রদর্শনীমূলক আচরণ, ছল-চাতুরী ও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছো না কেন ?কাজেই তাদেরকে সন্তুষ্ট করার চিন্তা ছেড়ে দাও ৷ কারণ যতদিন তুমি নিজে তাদের রঙে রঞ্জিত হয়ে তাদের স্বভাব আচরণ গ্রহণ করবে না, নিজেদের ধর্মের সাথে তারা যে আচরণ করে যতদিন তুমি তোমার দীনের সাথে অনুরূপ আচরণ করবে না এবং যতদিন তুমি ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মের ব্যাপারে তাদের মতো ভ্রষ্টনীতি অবলম্বন করবে না , ততদিন পর্যন্ত তারা কোনক্রমেই তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না ৷
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, হে নবী, আপনি ইহুদি ও মুশরেকদেরকে মুসলমানদের কঠোর শত্রু হিসাবে দেখতে পাবেন। (সূরা মায়েদা : ৮২)।
এখানে ধমকি দেওয়া হচ্ছে যে, যদি জ্ঞান আসার পরেও তুমি ঐ শ্রেণীর ভ্রষ্ট লোকদেরকে কেবল সন্তুষ্ট করার জন্য তাদের আনুগত্য কর, তাহলে তোমার কোন সাহায্যকারী থাকবে না। এখানে আসলে উম্মতে মুহাম্মাদীকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, বিদআতী ও ভ্রষ্ট লোকদের সন্তুষ্টি লাভের জন্য তারা যেন এমন কাজ না করে এবং কোন দ্বীনী ব্যাপারে তোষামোদ ও তার অযথা অপব্যাখ্যা না করে।
এখানেই বিধর্মীদের সাথে আমাদের সমস্যা। আমরা যতই ভালো মানুষ হই, তারা আমাদের কথা, কাজ, গুণের যতই প্রশংসা করুণ না কেন, শেষ পর্যন্ত গিয়ে একটা ব্যাপারে তাদের অনেকেই আমাদের সাথে কোনো আপোষ করবে না, সেটা হলো ইসলাম। আমরা তাদের সাথে যতই ওঠাবসা করি, একসাথে পড়ালেখা করি, চাকরি-ব্যবসা করি, ছুটি কাটাতে বেড়াতে যাই, যখনি রাসুলের عليه السلام শেষ নবি হওয়ার কথা আসবে, বা আল্লাহ تعالى একমাত্র উপাসনার যোগ্য প্রভু দাবি করা হবে, তখন তাদের অনেকেই তাদের ধর্মের শিক্ষার ব্যাপারে একদম কঠোর অবস্থান নেবে এবং আমাদের সাথে কোনো আপোষ করবে না।
মুসলিমরা হিন্দুদের বিয়ের রীতিনীতি অনুসরণ করে বিয়ে করলেও, হিন্দুদেরকে কখনো দেখবেন না মুসলিমদের রীতিনীতি অনুসরণ করে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে।মুসলিমদেরকে ক্রিস্টমাসে যীশুর জয়গানে অংশগ্রহণ, হ্যালোইন উদযাপন করতে দেখলেও, খ্রিস্টানদেরকে কখনো দেখবেন না ঈদ-উল-আযহায় কুরাবানি করে গরিবদের খাওয়াতে। যখনি মুসলিমরা এমন কিছু করবে, যেটা শুধু ইসলামেই রয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে নেই, তখনি অন্য ধর্মের লোকেরা, বিশেষ করে ইহুদি, খ্রিস্টানরা, যারা তাদের ধর্মের ব্যাপারে কিছুটা হলেও জানে, তারা অনেকেই আর মুসলিমদের ধারে কাছেও ঘিরবে না। তারা ঠিকই তাদের ধর্মের ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর।
যদি কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুকে ধর্ম হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা করে, সেটা তার কাছ থেকে কোনোভাবেই গ্রহণ করা হবে না। সে আখিরাতে সর্বহারাদের একজন হয়ে যাবে। [আলে-ইমরান ৩:৮৫]
আহলে কিতাবের (ইহুদি, খ্রিস্টান) মানুষদের সাথে সুন্দরভাবে ছাড়া যুক্তিতর্ক করবে না। তবে যারা অন্যায় করে, তাদের কথা আলাদা। বল, “আমরা বিশ্বাস করি যা আমাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে, এবং যা তোমাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে; আমাদের এবং তোমাদের উপাস্য প্রভু একই সত্তা, আমরা তাঁরই প্রতি নিজেদেরকে সমর্পণ করি।” [আল-আনকাবুত ২৯:৪৬]
সূরা জাসিয়াতে এসেছে—
অতপর হে নবী, আমি দীনের ব্যাপারে তোমাকে একটি সুস্পষ্ট রাজপথের (শরীয়তের) ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি৷ সুতরাং তুমি তার ওপরেই চলো এবং যারা জানে না তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না৷
আল্লাহর মোকাবিলায় তারা তোমরা কোন কাজেই আসতে পারে না৷ জালেমরা একে অপরের বন্ধু এবং মুত্তাকীনদের বন্ধু আল্লাহ৷
এটা সব মানুষের জন্য দূরদৃষ্টির আলো এবং যারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে তাদের জন্য হিদায়াত ও রহমত৷
যেসব লোক অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে তারা কি মনে করে নিয়েছে যে, আমি তাদেরকে এবং মু’মিন ও সৎকর্মশীলদেরকে সমপর্যায়ভুক্ত করে দেবো যে তাদের জীবন ও মৃত্যু সমান হয়ে যাবে? তারা যে ফায়সালা করে তা অত্যন্ত জঘন্য৷জাসিয়াঃ১৮-২১
২:১২১ اَلَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰهُمُ الۡکِتٰبَ یَتۡلُوۡنَهٗ حَقَّ تِلَاوَتِهٖ ؕ اُولٰٓئِکَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِهٖ ؕ وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِهٖ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ
যাদেরকে আমরা কিতাব দিয়েছি, তাদের মধ্যে যারা যথাযথভাবে তা তিলাওয়াত করে, তারা তাতে ঈমান আনে। আর যারা তার সাথে কুফরী করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
আহলে-কিতাবের অযোগ্য উত্তরসুরিদের নিকৃষ্ট চরিত্র ও কর্মকান্ডের প্রয়োজনীয় আলোচনার পর তাদের মধ্যে যে কিছু সৎ ও উন্নত চরিত্রের লোক ছিল, এই আয়াতে তাদের গুণাবলী এবং তারা যে মুমিন ছিল সেই সংবাদ দেওয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন সালাম এবং আরো কিছু অন্য লোক ছিলেন। ইয়াহুদীদের মধ্য থেকে এদেরকেই ইসলাম কবুল করার তাওফীক হয়েছিল।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যার হাতে আমার প্রাণ, তার শপথ করে বলছি, ইয়াহুদী ও নাসারাদের যে কেউ আমার কথা শোনার পর আমার উপর ঈমান আনবে না, সে অবশ্যই জাহান্নামে যাবে”। [মুসলিম: ১১৫৩]
আল্লাহ্ পবিত্র কুর’আনে বলেন :
وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآَنَ مَهْجُورًا
“রাসূল বললেন, ‘হে আমার প্রভু, আমার জনগণ এই কুর’আনকে এক মাহজুর বস্তু (যা এড়িয়ে চলা হয় বা অবজ্ঞা করা হয়) হিসাবে গ্রহণ করেছে ।” (সূরা ফুরক্বান, ২৫:৩০)
আবদুল আজীজ বিন বায, আবদুর রাজ্জাক আল আফিফী, আবদুল্লাহ বিন গুদিয়ান এবং আবদুল্লাহ বিন ক্বাউদ এর সমন্বয়ে গঠিত কমিটির উত্তর ছিল নিম্নরূপ:
“কুর’আন তিলাওয়াত সম্বন্ধে আল্লাহ্ সাধারণভাবে যে আদেশ দিয়েছেন : ‘ওহীর মাধ্যমে কিতাবের যেটুকু তোমাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে তা তিলাওয়াত কর’ (সূরা আনকাবুত, ২৯:৪৫),
‘তোমাদের প্রভুর কিতাবের যা তোমাদের কাছে নাযিল করা হয়েছে তা আবৃত্তি কর’ (সূরা কাহফ, ১৮:২৭)
আবূ উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে।(মুসলিম ১৯১০)
এবং তাঁর রাসূল (সা.) সম্বন্ধে আল্লাহর বাণী, ‘যারা আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে এবং কুর’আন তিলাওয়াত করবে, আমাকে তাদের মাঝে একজন হতে আদেশ করা হয়েছে’ (আল নামল, ২৭:৯১-৯২)
– এসবের সাথে সঙ্গতি রেখে একজন মুসলিমের উচিত, তার সামর্থ অনুযায়ী কুর’আন তিলাওয়াত অব্যাহত রাখা এবং যত ঘন ঘন সম্ভব তাতে আত্মনিয়োগ করা। আল্লাহর রাসূল (সা.) এ সম্বন্ধে আরো বলেছেন, ‘কুর’আন তিলাওয়াত কর, কেননা পুনরুত্থান দিবসে তা তার সঙ্গীদের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দাঁড়াবে’ (সহীহ মুসলিম)।
কুরআন তিলাওয়াত (কুর’আন অধ্যয়ন সহায়িকা)
তিলাওয়াত এমন একটি শব্দ, যা কুরআন পড়ার কাজটি বোঝার জন্য কুরআনে ব্যাবহার করা হয়েছে। ইংরেজী বা অন্য কোন ভাষায় এক শব্দে সরাসরি এর অনুবাদ করা যায় না। ‘অনুসরণ’করা শব্দটির প্রাথমিক অর্থের সবচাইতে কাছাকাছি, পড়ার ব্যাপারটি দ্বিতীয় পর্যায়ের। কেননা, পড়ার মধ্যেও শব্দ শব্দকে অনুসরণ করে, একটির পর আরেকটি অত্যন্ত গভীরভাবে, সুশৃংখল এবং তাৎপর্যময় ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। যদি একটি শব্দ অপরটিকে অনুসরণ না করে অথবা যদি বিন্যাস এবং ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে অর্থ বিকৃত হয়ে যায়।
সুতরাং প্রাথমিকভাবে তিলাওয়াত অর্থ ঘনিষ্ঠভাবে পশ্চাতে চলা, সামনে অগ্রসর হওয়া, ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত হওয়া, অভীষ্ট লক্ষয়ে পৌঁছার চেষ্টা চালানো, পথ-প্রদর্শোক, নেতা, প্রভু এবং আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা, কর্তৃত্ব গ্রহণ করা, স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা, আমল করা, পথ চলা, জীবন ব্যাবস্থার অনুশীলন করা, বুঝা, চিন্তার বাহনকে অনুসরণ করা অথবা অনুকরণ করা। কুরআন পাঠ করা, কুরআন বুঝা, কুরআন অনুসরণ করা। যারা দাবী করে যে, কুরআনের প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে, এইভাবেই তারা নিজেদের জীবনকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট করতে পারে।
তিলাওয়াত বা আবৃত্তি করা এমনই একটি কাজ যাতে একজন মানুষকে তার দেহ, হৃদয়, মন, ভাষা অর্থাৎ সংক্ষেপে গোটা মানবীয় অস্তিত্ব সহকারেই এতে অংশ নিতে হয়। কুরআন পড়তে দেহ ও মন, যুক্তি ও অনুভূতি তাদের পার্থক্য হারিয়ে ফেলে এবং সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। যখন জিহবার সাহায্যে আবৃত্তি করা হয়, তখন ঠোঁট থেকে শব্দ বের হয়ে আসে, মন চিন্তা করতে করতে থাকে, হৃদয় প্রতিফলিত করে, আত্মা গ্রহণ করে, চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হয়, শরীরে শিহরণ জাগে। আর এভাবেই সে তার প্রভুর আলোয় পথ চলে।
আল্লাহ অতি উত্তম কালাম নাযিল করেছেন-
এ এমন এক কিতাব যার সমস্ত অংশ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যাতে বার বার একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তা শুনে তাদের গাত্রে লোমহর্ষণ দেখা দেয়, যারা নিজেদের আল্লাহকে ভয় করে। পরে তাদের দেহ ও তাদের দিল নরম হয়ে আল্লাহর স্মরণে উৎসাহী ও উৎসুক হয়ে ওঠে। এ হচ্ছে আল্লাহর হিদায়াত, এর দ্বারা তিনি হিদায়াতের পথে নিয়ে আসেন যাকে তিনি চান। আর আল্লাহ যাকে হিদায়াত না করেন, তার জন্য হিদায়াতকারী কেউ নেই। (আয-যুমার-৩৯ : ২৩)।
যেভাবে কুরআন পাঠ করা উচিৎ, সেভাবে কুরআন পড়া সহজ কাজ নয়, কিন্তু খুব কঠিন বা অসম্ভবও নয়। অন্যথায় আমাদের মত সাধারণ লোকদের জন্য কুরআন পাঠানো হতো না কিংবা কুরআন সত্যিকার অর্থে যে করুণা ও পথ-নির্দেশনা দিয়ে থাকে, তা কেউ পেত না। কিন্তু স্পষ্টতই কুরআন অধ্যয়নে অনিবার্যভাবে হৃদয় ও মন, দেহ ও আত্মার কঠিন পরিশ্রম হতে বাধ্য। তাছাড়া অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিকভাবে কতগুলো শর্ত মেনে চলতে হবে এবং অনিবার্য দাবী পূরণ করতে হবে। কুরআনের মহিমান্বিত জগতে প্রবেশের আগেই ঐসব বিষয় জানতে এবং তা পালনে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
কেবলমাত্র তখনই মহান গ্রন্থ আল-কুরআনে মানুষের জন্য যে কল্যাণ ও মহিমা রয়েছে তা থেকে ফায়দা গ্রহণ বা ফল লাভ সম্ভব হবে। তখনই কুরআনের দরজা একজন মানুষের জন্য খুলে যাবে, কেবলমাত্র তখনই তিনি কুরআনের অভ্যন্তরে ঢুকতে পারবেন এবং কুরআন তার মধ্যে গভীর চিন্তা ও ভাবাবেগের উদ্রেক করবে। মায়ের গর্ভে নয় মাস অতিবাহিত করার পর এক ফোঁটা পানি হতে রূপান্তরিত হয়ে আপনি শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও চিন্তাশক্তির অধিকারী একজন জীবন্ত মানুষে পরিণত হন। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন জীবনের কতটা সময় আপনি কুরআনের সাথে অতিবাহিত করতে পারেন- অনুসন্ধান, শ্রবণ, দেখা, চিন্তা ও সংগ্রাম করে এবং এটা আপনার জন্য কত প্রয়োজনে আসতে পারে। এটা আপনাকে এক সম্পূর্ণ নতুন মানুষে পরিণত করতে পারে
কুরআনে গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ এবং কুরআনের সাথের মুহুর্তগুলো অতিক্রমের মাধ্যমে আপনি অনুভব করবেন যে, আপনি ঊর্ধ্বমুখে আরোহণ করছেন। কুরআনের প্রবহমাণ শক্তি ও সৌন্দর্য আপনাকে আঁকড়ে ধরবে এবং আপনি হৃদয় দিয়ে তা উপলদ্ধি করতে থাকবেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেছেন
কুরআনের সাথীকে বলা হবে, তিলাওয়াত কর এবং ঊর্ধ্বে আরোহণ কর। দৃঢ়ভাবে আরোহণ করতে থাকো ঠিক যেইভাবে সাবলীলভাবে তুমি কুরআন তিলাওয়াত করতে দুনিয়ায়। তোমার চূড়ান্ত প্রতীক্ষা হচ্ছে সেই উচ্চতা যা তুমি সর্বশেষ আয়াতে পাঠ করেছ। (আবু দাউদ, তিরমিযী, আহমাদ, নাসাঈ)।
তারা যথাযথভাবে তা পাঠ করে (তারা তার হক আদায় করে তেলাওয়াত করে) এর কয়েকটি অর্থ বলা হয়েছে। যেমনঃ
(ক) অত্যধিক একাগ্রতা ও মনোযোগের সাথে পড়ে। জান্নাতের কথা এলে জান্নাত কামনা করে এবং জাহান্নামের কথা এলে তা থেকে পানাহ চেয়ে নেয়।
(খ) তার হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম মনে করে এবং আল্লাহর কালামের কোন বিকৃতি ঘটায় না। (যেমন, ইয়াহুদীরা করত।)
(গ) এতে যা কিছু লেখা আছে, তা সবই লোকমাঝে প্রচার করে, এর কোন কিছুই গোপন করে না। এর সুস্পষ্ট আয়াতগুলোর উপর আমল করে, অস্পষ্ট আয়াতগুলোর উপর ঈমান রাখে এবং যে কথাগুলো বুঝে আসে না, তা আলেমদের মাধ্যমে বুঝে নেয়।
(ঘ) এর প্রত্যেকটি কথার অনুসরণ করে। (ফাতহুল ক্বাদীর) বস্তুতঃ (উল্লিখিত) সব অর্থই যথাযথভাবে তেলাওয়াতের আওতায় পড়ে। আর হিদায়াত এমন লোকদের ভাগ্যেই জুটে, যারা উল্লিখিত কথাগুলির প্রতি যত্ন নেয়।
মোটকথা: আল্লাহর আয়াতকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করাই এর যথাযথ তেলাওয়াত বলে বিবেচিত হবে। [ইবনে কাসীর] যথাযথ তেলাওয়াতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনা এবং তার যাবতীয় আদেশ নিষেধ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয়া।
আমাদের ওপর কোরআনের যে হকগুলো রয়েছে তা এখানে আলোচনা করা হলো:
১. ঈমান আনা
২. সহীহভাবে পড়তে জানা
৩. তেলাওয়াত করা ও শ্রবণ করা
৪. অপরকে শিক্ষা দেয়া
৫. হিফয বা মুখস্ত করা
৬. বুঝা ও উপলব্ধি করা
৭. আমল করা (বাস্তবায়িত করা)
৮. যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া
৯. কোরআন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা।
(১) ঈমান আনা: কোরআনের হকসমূহের মধ্যে প্রধানতম হক বা অধিকার হলো কোরআনের প্রতি ঈমান আনা। কোরআনের প্রতি ঈমান আনার অর্থ হলো, কোরআন আল্লাহর কালাম, ইহা আসমানী শেষ কিতাব এবং এই কিতাবের মধ্য দিয়ে সকল আসমানী কিতাব রহিত হয়ে গিয়েছে। কোরআন বিশ্ব মানবমন্ডলীর জন্য হেদায়াত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর বা আলো। কোরআনে এসেছে, ‘অতএব তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং আমি যে নূর অবতীর্ণ করেছি তার প্রতি ঈমান আন। আর তোমরা যে আমল করছ আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।’ (সূরা আত-তাগাবুন : ০৮)।
‘তোমরা কী কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর, সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লানত ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে! আর কিয়ামাতের দিন তাদেরকে কঠিনতম আজাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আর আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।’ (সূরা আল-বাকারাহ : ৮৫)।
(২) সহীহভাবে পড়তে জানা: কোরআন শিক্ষা করা ফরজ করা হয়েছে। প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। কেননা কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (সূরাহ আলাক : ১)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা কোরআন শিক্ষা কর এবং তা তেলাওয়াত কর’ (মুসনাদ আল-জামি: ৯৮৯০)।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, মহান আল্লাহ এভাবে উৎকর্ণ হয়ে কোন কথা শোনেন না, যেভাবে সেই মধুরকণ্ঠী পয়গম্বরের প্রতি উৎকর্ণ হয়ে শোনেন, যিনি মধুর কণ্ঠে উচ্চ স্বরে কুরআন মাজীদ পড়তেন।(বুখারী ৫০২৪, মুসলিম ১৮৮৩
(৩) তেলাওয়াত করা ও শুনা: কোরআন তেলাওয়াত করা কোরআনের অন্যতম হক। কোরআন মাজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তেলাওয়াত কর’ (সূরাহ আনকাবুত : ৪৫)। সহীহভাবে কোরআন তেলাওয়াত করতে হবে। তেলাওয়াতের আদবগুলো রক্ষা করতে হবে। বাংলাভাষায় উচ্চারণ করে পড়লে হবে না।
আবূ হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কোরআন সুন্দর উচ্চারণে পড়ে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল নয়’ (সহীহ বুখারী : ৭৫২৭)। ধীরস্থীরভাবে তেলাওয়াত করার নির্দেশ দিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে।‘তুমি কোরআনকে তারতীলের সঙ্গে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে তেলাওয়াত কর’ (সূরা আল-মুযযাম্মিল : ৪)।
আর কোরআন তেলাওয়াতে রয়েছে বিরাট সাওয়াব। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’ (সুনান আত-তিরমিযি : ২৯১০)। কোরআন তেলাওয়াত শুনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তামীম দারী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এক রাতে একশ’টি আয়াত পাঠ করবে, সে ব্যক্তির আমলনামায় ঐ রাত্রির কিয়াম (নামাযের) সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে।
(আহমাদ ১৬৯৫৮, নাসাঈর কুবরা ১০৫৫৩, ত্বাবারানী ১২৩৮, দারেমী ৩৪৫০, সিলসিলাহ সহীহাহ ৬৪৪)
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করা হল, কুরআন পাঠে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আওয়াজ কার? উত্তরে তিনি বললেন, তার, যার কুরআন পাঠ করা শুনে মনে হয়, সে আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। (যুহদ, ইবনুল মুবারক, দারেমী ৩৪৮৯, ত্বাবারানী ৬৭৩)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, (হে ইবনে মাসঊদ!) আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনাকে পড়ে শোনাব, অথচ আপনার উপরে তা অবতীর্ণ করা হয়েছে?’ তিনি বললেন, অপরের মুখ থেকে (কুরআন পড়া) শুনতে আমি ভালবাসি। সুতরাং তাঁর সামনে আমি সূরা নিসা পড়তে লাগলাম, পড়তে পড়তে যখন এই (৪১) আয়াতে পৌঁছলাম—যার অর্থ, তখন তাদের কী অবস্থা হবে, যখন প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকেও তাদের সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব? তখন তিনি বললেন, যথেষ্ট, এখন থাম। অতঃপর আমি তাঁর দিকে ফিরে দেখি, তাঁর নয়ন যুগল অশ্রু ঝরাচ্ছে।(বুখারী ৪৫৮২, মুসলিম ১৯০৩-১৯০৫)
(৪) অপরকে শিক্ষা দেয়া: কোরআনের অন্যতম হক হলো তা অপরকে শিক্ষা দেয়া। আমাদের প্রিয় নবীর (সা.) অন্যতম কাজ ছিল মানুষকে কোরআন শিক্ষা দেয়া। আল-কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৬৪)।
কোরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। হাদিসে এসেছে, হজরত উসমান রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কোরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’ (সহীহ বুখারী : ৫০২৭)। যদি কেউ অপরকে কোরআন শিক্ষা দেয়, তবে তার জন্য শিক্ষাগ্রহণকারীর সমান সওয়াবের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘ভালো কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরুপ সাওয়াব পাবে।’ (সুনান আত-তিরমীযি : ২৬৭০)
(৫) হিফয বা মুখস্থ করা: কোরআন হিফয করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তায়ালা নিজেই কোরআন হিফযের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ হিফযেরই এক প্রকার হচ্ছে, বান্দাদেরকে কোরআন হিফয করানো। যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর কোরআনকে সংরক্ষণ করেছেন। কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী।’ (সূরা আল-হিজর : ০৯)।
যে যত বেশি অংশ হিফয করতে পারবে তা তার জন্য ততই উত্তম। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোরআনের হাফেযকে বলা হবে কোরআন পড়ে যাও, আর উপরে উঠতে থাক, ধীর-স্থিরভাবে তারতীলের সঙ্গে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সঙ্গে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হয়।’ (সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১৪)।
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুরআনের (শুদ্ধভাবে পাঠকারী ও পানির মত হিফযকারী পাকা) হাফেয মহাসম্মানিত পুণ্যবান লিপিকার (ফিরিশতাবর্গের) সঙ্গী হবে। আর যে ব্যক্তি (পাকা হিফয না থাকার কারণে) কুরআন পাঠে ‘ওঁ-ওঁ’ করে এবং পড়তে কষ্টবোধ করে, তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব। (একটি তেলাঅত ও দ্বিতীয়টি কষ্টের দরুন।)(বুখারী ৪৯৩৭, মুসলিম ১৮৯৮)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দু’জনের ক্ষেত্রে ঈর্ষা করা সিদ্ধ। (১) যাকে আল্লাহ কুরআন (মুখস্থ করার শক্তি) দান করেছেন, সুতরাং সে ওর (আলোকে) দিবা-রাত্রি পড়ে ও আমল করে। (২) যাকে আল্লাহ তাআলা মালধন দান করেছেন এবং সে (আল্লাহর পথে) দিন-রাত ব্যয় করে।(বুখারী ৫০২৫, মুসলিম ১৯৩০)
আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এই কুরআনের প্রতি যত্ন নাও। (অর্থাৎ, নিয়মিত পড়তে থাক ও তার চর্চা রাখ।) সেই মহান সত্তার কসম, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন আছে, উট যেমন তার রশি থেকে অতর্কিতে বের হয়ে যায়, তার চেয়ে অধিক অতর্কিতে কুরআন (স্মৃতি থেকে) বের হয়ে (বিস্মৃত হয়ে) যায়। (অর্থাৎ, অতিশীঘ্র ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে।)(বুখারী ৫০৩৩, মুসলিম ১৮৮০)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কারো এ কথা বলা নিকৃষ্ট যে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি। বরং তাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।(বুখারী ৫০৩৯, মুসলিম ১৮৭৭)
(৬) বুঝা ও উপলব্ধি করা: কোরআনের অর্থ বুঝা ও অনুধাবন করা কোরআনের অন্যতম হক। কোরআনের অর্থ না বুঝতে পারলে কোরআন নাজিলের উদ্দেশ্য ও দাবী আমরা কেউ পালন করতে পারবো না। না বুঝে পড়লে কোরআনের আসল মজা পাওয়া যাবে না। কোরআন বুঝার জন্য শব্দের অর্থ, আয়াতের ব্যাখ্যা, অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বা প্রেক্ষাপট এবং কোরআনের আয়াতসমূহের শিক্ষা জানতে হবে। কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয় আমি একে আরবী কোরআনরূপে নাজিল করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ (সূরা ইউসুফ: ০২)
কোরআন বুঝার ক্ষেত্রে হাদিসের সাহায্য না নিলে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে হাদিসের সাহায্য নিলেই কেবল সহীহভাবে কোরআন বুঝা সম্ভব।
আল-কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও।’ (সূরা আল-হাশর: ৭)।
কোরআন বুঝার পাশাপাশি তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। ‘তবে কী তারা কোরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে।’ (সূরা মুহাম্মাদ : ২৪)।
(৭) আমল করা: কোরআনের আমল করার অর্থ, কোরআনের অনুসরণ করা। কোরআন অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা। এ বিষয়ে কোরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাজিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সূরা আল-আরাফ : ৩)।
কোরআনের জ্ঞানে পারদর্শী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কোরআনের দশটি আয়াত শিক্ষা গ্রহণ করতাম, এরপর ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরবর্তী দশটি আয়াত শিক্ষা করতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই দশ আয়াতের ইলম ও আমল শিখতাম।’ (শরহে মুশকিলুল আছার : ১৪৫০)।
(৮) যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া: কোরআন মাজীদ সম্মানিত এবং যারা কোরআনের সঙ্গে থাকবে তারাও সম্মানের অধিকারী। এজন্য কোরআনের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। কোরআন তেলাওয়াতের সময় তার হক আদায় করতে হবে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তারাই তার প্রতি ঈমান আনে। আর যে তা অস্বীকার করে, সে-ই ক্ষতিগ্রস্থ।’ (সূরা আল-বাকারাহ : ১২১)। কোরআনকে মহববত করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মহববত করার শামিল। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যে কোরআনকে মহববত করল সে যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মহববত করল।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ৩২৯)।
(৯) কোরআন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা: কোরআনের প্রচার, প্রসার ও তা প্রতিষ্ঠার কাজ করা কোরআনের অন্যতম হক। নিজ ব্যবস্থাপনায় কোরআন শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতা, হিফয প্রতিযোগিতা, কোরআন বুঝার আসর, তাফসীর প্রতিযোগিতা, মকতব চালু করা, বিভিন্ন এলাকায় কোরআনের মুয়াল্লিম প্রেরণ বা মুয়াল্লিম স্পন্সর করা, কোরআন বিতরণ করা, কোরআনের মুয়াল্লিম তৈরি করা, কোরআনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত সংস্থাকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা, এ কাজের অন্তর্ভুক্ত। সর্বোপরি কোরআনের বিধান সমাজে প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। কোরআন মাজীদে বলা হয়েছে, ‘আর আমি যেন আল-কোরআন অধ্যয়ন করি, অতঃপর যে হেদায়াত লাভ করল সে নিজের জন্য হেদায়াত লাভ করল; আর যে পথভ্রষ্ঠ হলো তাকে বল, আমিতো সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আন-নামল : ৯২)
‘হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও।’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৬৭)। কোরআন তেলাওয়াত, হিফয, প্রচার, প্রসার এবং প্রতিষ্ঠার কাজে আনন্দ প্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে। কোরআন এমন একটি কিতাব যা নিয়ে ঈমানদার বান্দাহগণ আনন্দ প্রকাশ করতে পারে। কেননা আল-কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত। বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম।’ (সূরা ইউনুস : ৫৭-৫৮)। আবূ সাইদ খুদরী রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ হলো আল-কোরআন এবং এর অধিকারী হওয়াই রহমত।’ (শুয়াবুল ঈমান)।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখনই কোন সম্প্রদায় আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোন এক ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর গ্রন্থ (কুরআন) পাঠ করে, তা নিয়ে পরস্পরের মধ্যে অধ্যয়ন করে, তাহলে তাদের প্রতি (আল্লাহর পক্ষ থেকে) প্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং তাদেরকে তাঁর রহমত ঢেকে নেয়, আর ফিরিশতাবর্গ তাদেরকে ঘিরে ফেলেন। আল্লাহ স্বয়ং তাঁর নিকটস্থ ফিরিশতামণ্ডলীর কাছে তাদের কথা আলোচনা করেন। (মুসলিম ৭০২৮, আবূ দাঊদ ১৪৫৭)
একজন মুসলিম যে সব বিবিধ উপায়ে কুর’আন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে বলে ওলামারা চিহ্নিত করেছেন, তার যে কোনটির মাধ্যমেই কুর’আন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা, সে সব সময় এড়িয়ে চলবে। [উত্তরের এই পর্যায়ে এসে তাঁরা সূরা আল ফুরক্বানের ৩০ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা ও ‘মাহজুর’ শব্দের অর্থ সংক্রান্ত বর্ণনা ইবনে কাসীরের তাফসীর থেকে তুলে দিয়েছেন]।”
وَ قَالَ الرَّسُوۡلُ یٰرَبِّ اِنَّ قَوۡمِی اتَّخَذُوۡا هٰذَا الۡقُرۡاٰنَ مَهۡجُوۡرًا
রসূল বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করেছে। সূরা ফুরকানঃ ৩০
আজকের দিনে যে কেউ যুক্তি সহকারে দেখিয়ে দিতে পারবেন যে, রাসূলের (সা.) অনেক উম্মতই পবিত্র কুর’আনকে, অবজ্ঞার বা দূরে সরিয়ে রাখার মত এক বস্তুতে পরিণত করেছে। কোন মুসলিমই জেনে বুঝে এমন একটা কাজ করতে পারে না সত্যি। কিন্তু অসচেতন ভাবে একজন মুসলিম এ ধরনের একটা গর্হিত কাজও করতে পারে – আর এখানেই নিহিত রয়েছে আজকের বিশ্বের প্রধান সমস্যার একটি। কুর’আনকে মাহজুর হিসেবে নেবার অনেক কারণ ও পদ্ধতি থাকতে পারে। নিম্নলিখিত উপায়ে আমরা কুর’আনকে এক অবহেলার বস্তুতে বা পরিহাসের বস্তুতে পরিণত করতে পারি বলে ইবনুল কাইয়্যিম মতামত ব্যক্ত করেছেন :
১। কুর’আন তিলাওয়াত না করা, এতে বিশ্বাস না করা, এর প্রতি মনোযোগ না দেওয়া অথবা এর প্রতি আকর্ষণ বোধ না করা।
২। পবিত্র কুর’আন যা কিছুকে হালাল অথবা হারাম বলে ঘোষণা করে, সেসব বিধিনিষেধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা – যদিও বা কেউ নিয়মিত কুর’আন তিলাওয়াত করে এবং সেটাতে বিশ্বাসও করে।
৩। দ্বীনের মূল ও আনুষঙ্গিক সকল বিষয়ে পবিত্র কুর’আনকে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী হিসাবে না মানা – অথবা কুর’আনের প্রতিটি বিষয়ে নিশ্চিত বিশ্বাসকে অপরিহার্য মনে না করা।
৪। এর অর্থ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা না করা, তা বুঝতে ব্যর্থ হওয়া এবং আল্লাহ্ কুর’আনের পাঠকের কাছ থেকে কি ধরনের কার্যকলাপ দাবী করেন তা জানতে ব্যর্থ হওয়া।
৫। অন্তরের রোগসমূহের নিরাময়ে পবিত্র কুর’আনকে ব্যবহার না করে, অন্যান্য উৎসের কাছে রোগ নিরাময়ের প্রত্যাশায় ছুটে যাওয়া।
ইবনুল কাইয়্যিম যেসব বলেছেন তা ছাড়াও আরেকটি গুরুতর উপায়ে আমরা কুর’আনকে মাহজুর হিসেবে দেখে থাকি – যেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা ব্যাপার, কারণ কেউ হয়তো ব্যাপারটা বুঝতেই পারবেন না অথবা স্বীকারও করতে চাইবেন না – সেটা হচ্ছে এই যে, কুর’আনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে একপাশে সরিয়ে রেখে, গৌণ ব্যাপারগুলোকে মুখ্য মনে করা এবং সেগুলোর ব্যাপারে সর্বতোভাবে মনোনিয়োগ করা বা কেবল সেগুলো নিয়েই মেতে থাকা।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) কে এক ব্যক্তি বলল, ‘আমি এক রাকআতে মুফাস্স্বাল (সূরা ক্বাফ থেকে সূরা নাস পর্যন্ত অংশ) পাঠ করি।’ এ কথা শুনে তিনি বললেন, ‘কবিতা আওড়ানোর মত পড়? কিছু সম্প্রদায় আছে যারা কুরআন পড়ে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠের নিচে নামে না। আসলে সেই কুরআন পাঠ কাজে দেবে, যা হৃদয়ে এসে গেঁথে যাবে এবং তা পাঠকারীকে উপকৃত করবে—। (বুখারী ৭৭৫, মুসলিম ১৯৪৫)
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সে ব্যক্তি কুরআন বুঝে না, যে তিন দিনের কম সময়ে তা খতম করে।
(আবূ দাঊদ ১৩৯৬, তিরমিযী ২৯৪৯, ইবনে মাজাহ প্রমুখ, সহীহুল জামে’ ৭৭৪৩)
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে (সূরা মারয়্যামের ৫৯ আয়াত পাঠ করার পর) বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘‘ষাট বছর পর কিছু অপদার্থ পরবর্তীগণ আসবে, তারা নামায নষ্ট করবে ও প্রবৃত্তিপরায়ণ হবে; সুতরাং তারা অচিরেই অমঙ্গল প্রত্যক্ষ করবে। অতঃপর এক জাতি আসবে, যারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠের অক্ষকাস্থি পার হবে না। (হৃদয়ে জায়গা পাবে না।) কুরআন তিন ব্যক্তি পাঠ করে; মু’মিন, মুনাফিক ও ফাজের।’’
বর্ণনাকারী বাশীর বলেন, আমি অলীদকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওরা তিন ব্যক্তি কে কে?’ তিনি বললেন, ‘মুনাফিক তা অস্বীকার করে, ফাজের তার অসীলায় পেট চালায় এবং মু’মিন তার প্রতি ঈমান রাখে।’
(আহমাদ ১১৩৬০, হাকেম ৩৪১৬, ৮৬৪৩, সিলসিলাহ সহীহাহ ১/২৫৭)
মুমিনদের প্রতি আহবান—
দ্বীন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাসমূহের একটি হচ্ছে ‘আল ওয়ালার’ ধারণা – আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ধারণা – আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করার ধারণা। রাসূল (সা.) বলেছেন :
“ঈমানের সবচেয়ে শক্ত বন্ধন হচ্ছে আল্লাহর ওয়াস্তে আনুগত্য, আল্লাহর জন্য অন্যের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করা, আল্লাহর জন্য (কাউকে) ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্য (কাউকে) ঘৃণা করা।” (আল তায়ালিসী, আল-হাকিম, আল-তাবারানী ইত্যাদি – আলবানীর মতে সহীহ)
আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের(সা.) প্রতি একজন ব্যক্তির যে ভালবাসা, তাই হচ্ছে কুর’আনের প্রতি তার ভালবাসার উৎস। কারো পক্ষে এরকম হওয়া সম্ভব নয় যে, সে আল্লাহকে ভালবাসবে অথচ আল্লাহর বাণী এবং মানবকুলের কাছে তাঁর ওহীকে ভালবাসবে না। বরং কেউ যে কুর’আনকে ভালবাসে, তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকেও (সা.) ভালবাসে।
বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, “কেউ যদি পরখ করতে চায় যে, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল(সা.)-কে ভালবাসে কিনা, তবে তার উচিত এই ব্যাপারটা যাচাই করা যে সে কুর’আন ভালবাসে কিনা – যদি সে কুর’আন ভালবাসে, তবে সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে।” (আল-তাবারানী)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি চায় যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে (অধিক) ভালবাসুক (অথবা আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাকে ভালবাসুন), সে যেন কুরআন দেখে পাঠ করে।(বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ২২১৯, সিলসিলাহ সহীহাহ ২৩৪২)
আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানবমণ্ডলীর মধ্য হতে আল্লাহর কিছু বিশিষ্ট লোক আছে; আহলে কুরআন (কুরআন বুঝে পাঠকারী ও তদনুযায়ী আমলকারী ব্যক্তিরাই) হল আল্লাহর বিশেষ ও খাস লোক।(আহমাদ ১২২৭৯, নাসাঈ, বাইহাক্বী, হাকেম, সহীহুল জামে ২১৬৫)
কুর’আনের প্রতি কারো দায়-দায়িত্বের ব্যাপারে রাসূলের (সা.) একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীসে তিনি বলেন :
“দ্বীন হচ্ছে নসীহাত।” লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো, “কার প্রতি?” নবী (সা.) উত্তর দিলেন, “আল্লাহর প্রতি ও তাঁর কিতাবের প্রতি, এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ও মুসলিমদের নেতৃবৃন্দের প্রতি এবং সাধারণ মুসলিমদের প্রতি।” (মুসলিম)
এই হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, যে কারো আল্লাহর কিতাবের নসীহাত করা উচিত।
নসীহাত হচ্ছে এমন একটি শব্দ যার ভাষান্তর করা দুরূহ। শব্দটির ভাষাগত মূল ও কুর’আনে এর ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে আল রাগিব আল ইসফাহানী এর শরীয়াভিত্তিক সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে : “নসীহাত হচ্ছে এমন একটা কর্মপন্থা বা বক্তব্যের সন্ধান করা যাতে অপর ব্যক্তির জন্য কল্যাণ ও উৎকর্ষের ব্যাপার রয়েছে।” ইবনে আল সালাহ বলেছেন যে, নসীহাতের অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে এরকম যে, যিনি নসীহাত (বিশ্বস্তভাবে অন্যের মঙ্গল কামনা করা) করছেন, তিনি সত্যি সত্যি যাকে নসীহাত করছেন, তার জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম কল্যাণ কামনা করছেন। আরেকভাবে বলতে গেলে তার নিয়তে ও তার কর্মে তিনি অপর সেই ব্যক্তির জন্য সর্বোত্তম মঙ্গল
কুর’আনের প্রতি বিশ্বাসীদের এই ধরনের মনোভাব থাকা উচিত। অর্থাৎ, কুর’আনের প্রতি আচরণে একজন বিশ্বাসীর বিশ্বস্ত হওয়া উচিত এবং এমন কাজ করা উচিত যা “এর জন্য কল্যাণকর” – এখানে যা র অর্থ হবে এটা পড়া, এটা বোঝা, এবং জীবনে এর প্রয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اسۡتَجِیۡبُوۡا لِلّٰهِ وَ لِلرَّسُوۡلِ اِذَا دَعَاکُمۡ لِمَا یُحۡیِیۡکُمۡ
হে ঈমানদারগণ, রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে ডাকে যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে তখন তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের ডাকে সাড়া দেবে। আনফালঃ ২৪
….যে কেউ আমার দিক-নির্দেশনা অনুসরণ করলে তাদের জন্য ভয়ের বা দুঃখের কোন কারণ থাকবে না। যারা অবিশ্বাসী এবং যারা আমাদের আয়াতসমূহের ব্যাপারে মিথ্যা আরোপ করে, তারা হচ্ছে জ্বলন্ত আগুনের বাসিন্দা এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে।” (সূরা বাক্বারা, ২:৩৮-৩৯)
“তোমরা যারা ঈমান এনেছো! আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন তাঁরা তোমাদের, যা তোমাদের জীবন দান করে, তার দিকে ডাকেন।….” (সূরা আনফাল, ৮:২৪)
“নিশ্চয়ই এই কুর’আন যা সবচেয়ে সঠিক তার দিকেই পরিচালিত করে এবং ঐ বিশ্বাসীদের চমৎকার পুরস্কারের সুসংবাদ দেয় যারা সৎকাজ করে। আর যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের জন্য আমরা যে বাস্তবিকই এক কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেছি, এটা তারও ঘোষণা দেয়।” (সূরা আল-ইসরা, ১৭:৯-১০)
“এবং এটা হচ্ছে এমন একটি কিতাব, যা আমরা এক রহমত স্বরূপ তোমাদের কাছে প্রেরণ করেছি : সুতরাং এটা অনুসরণ কর ও ন্যায়পরায়ণ হও – যেন তোমরা রহমত লাভ করতে পার।” (সূরা আন্‘আম, ৬:১৫৫
আবূ মূসা আল আশ্‘আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআন পাঠকারী মু’মিনের দৃষ্টান্ত হলো তুরঞ্জ ফল বা কমলা লেবুর ন্যায়। যার গন্ধ ভাল, স্বাদও উত্তম। যে মু’মিন কুরআন পড়ে না, তার দৃষ্টান্ত হলো খেজুরের ন্যায়। এর কোন গন্ধ নেই বটে, কিন্তু উত্তম স্বাদ আছে। কুরআন পাঠ করে না যে মুনাফিক, সে হানাযালাহ্ (তিতা) ফলের মতো, যার কোন গন্ধ নেই অথচ স্বাদ তিতা। আর ওই মুনাফিক যে কুরআন পড়ে তার দৃষ্টান্ত ঐ ফুলের মতো, যার গন্ধ আছে কিন্তু স্বাদ তিতা। (বুখারী, মুসলিম।)
অন্য এক বর্ণনায় আছে, যে মু’মিন, কুরআন পড়ে ও সে অনুযায়ী ‘আমল করে সে কমলা লেবুর মতো। আর যে মু’মিন কুরআন পড়ে না, কিন্তু এর উপর ‘আমল করে সে খেজুরের মতো।) সহীহ বুখারী ৫৪২৭, ৫০৫৯, মুসলিম ৭৯৭,
মুহাম্মদ বিন হুসাইন (তিনিই আজুর্রি) বলেন: আপনাদের প্রতি আল্লাহ্ রহম করুন! আপনারা কি দেখছেন না যে, আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর বাণী অনুধাবন করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করছেন। যে ব্যক্তি তাঁর বাণী অনুধাবন করে সে রব্বকে চিনতে পারে, তাঁর মহা ক্ষমতা ও শক্তি জানতে পারে, ঈমানদারদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ অবগত হতে পারে, জানতে পারে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের উপর যা কিছু ফরয করেছেন; তখন ওয়াজিব পালন করাকে সে নিজের উপর অবধারিত করে নেয় এবং তার মহান মনিব যা কিছু থেকে থেকে সতর্ক করেছেন সেটা থেকে সতর্ক হয় এবং যা কিছুর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন সেগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়।
নিজে কুরআন তেলাওয়াত করার সময় কিংবা অন্যের তেলাওয়াত শ্রবণ করার সময় যে ব্যক্তির অবস্থা এমন হবে তার জন্য কুরআন নিরাময়ক। সে ব্যক্তির সম্পদ না থাকলেও সে ধনী। আত্মীয়-স্বজন না থাকলেও সে শক্তিমান। যখন অন্যেরা নির্জনতা অনুভব করে তখন সে তা অনুভব করে না। সে যখন কোন সূরা পড়া শুরু করে তখন তার লক্ষ্য থাকে কখন আমি যা তেলাওয়াত করছি সেটা থেকে নসীহত গ্রহণ করতে পারব? তার উদ্দেশ্য এটা থাকে না যে কখন আমি সূরাটি শেষ করতে পারব? তার উদ্দেশ্য থাকে কখন আমি আল্লাহ্র ভাষ্য উপলব্ধি করতে পারব? কখন আমি (নিষেধ) থেকে বিরত হব? কখন আমি শিক্ষা গ্রহণ করব? কেননা তার কুরআন তেলাওয়াত হচ্ছে- ইবাদত। গাফলতি নিয়ে কোন ইবাদত হয় না। আল্লাহ্ই তাওফিকদাতা।[“আখলাকু হামালাতিল কুরআন”, পৃষ্ঠা-৩]
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে যা পাঠ করতেন-
১ম যে কোন সময় রাতে
সূরা সাজদা, মূলক, যুমার, বনী ইসরাইল, কাফেরুন, ইখলাস
২য় নির্দিষ্ট——– ঘুমের পূর্বে (কাফেরুন, ইখলাস, ফালাক, নাস)
আয়াত যা তেলাওয়াত করতেন—
ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে—আয়াতুল কুরসী ও সূরা বাকারার শেষ ২ আয়াত
রাতের যখন ঘুম থেকে উঠতেন বিশেষ করে তাহাজ্জুদের সময়- সূরা আলে ইমরান ১৯১-২০০
মাগরিব সালাতঃ সূরা তুর
ইশা সালাতেঃ সূরা ত্বীন
জুমুয়ার দিনঃ জুময়া, মুনাফিকুন সূরা
সুরা ফাতিহাঃ
আলী ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) … আবূ সাঈদ ইবনু মু’আল্লা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সালাত (নামায/নামাজ)-রত ছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন; কিন্তু আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম না। পরে আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি সালাতরত ছিলাম। তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা কি বলেননি, “হে মু’মিনগণ, আল্লাহ ও রাসূল যখন তোমাদেরকে আহবান করেন তখন আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দাও”। তারপর তিনি বললেন, মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে আমি কি তোমাকে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা শিক্ষা দেব না? তখন তিনি আমার হাত ধরলেন। যখন আমরা মসজিদ থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করলাম তখন আমি বললাম, ইয়া, রাসূলাল্লাহ! আপনি তো বলেছেন মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে আমাকে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরার কথা বলবেন। তিনি বললেন, তা হলঃ “আল হামদুলিল্লাহ রাব্বিল আলামীন”। এটা বারবার পঠিত সাতটি আয়াত (সাবআ মাছানী) এবং কুরআন আজীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে। সহিহ বুখারি, ই ফা নাম্বারঃ ৪৬৪০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫০০৬
বাকারা ও আলে ইমরানঃ
আবু উমামাহ বাহেলী (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শুনেছি, তিনি বলেছেন, তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, তা কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীদের জন্য সুপারিশকারীরূপে উপস্থিত হবে। তোমরা দুই জ্যোতির্ময় সূরা; বাক্বারাহ ও আ-লে ইমরান পাঠ কর। কারণ উভয়েই মেঘ অথবা উড়ন্ত পাখীর ঝাঁকের ন্যায় কিয়ামতের দিন উপস্থিত হয়ে তাদের পাঠকারীদের হয়ে (আল্লাহর নিকট) হুজ্জত করবে। তোমরা সূরা বাক্বারাহ পাঠ কর। কারণ তা গ্রহণ করায় বরকত এবং বর্জন করায় পরিতাপ আছে। আর বাতেলপন্থীরা এর মোকাবেলা করতে পারে না। মুআবিয়াহ বিন সাল্লাম বলেন, আমি শুনেছি যে, বাতেলপন্থীরা অর্থাৎ যাদুকরদল।(মুসলিম ১৯১০)
নাউওয়াস বিন সামআন কিলাবী (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন কুরআনকে হাজির করা হবে এবং আহলে কুরআনকেও; যারা তার মুতাবেক আমল করত। যার সর্বাগ্রে থাকবে সূরা বাক্বারাহ ও আ-লে ইমরান। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সূরা দুটি যেরূপ হাজির হবে তার) তিনটি উদাহরণ দিয়েছেন, আমি এখনও ভুলে যাইনি; তিনি বলেছেন, যেন সে দুটি দুই খণ্ড মেঘ অথবা কালো ছায়া যার মাঝে থাকবে দীপ্তি, অথবা যেন উড়ন্ত পাখীর ঝাঁক; উভয়েই তাদের সপক্ষে (পরিত্রাণের জন্য আল্লাহর নিকট) হুজ্জত করবে। (মুসলিম ১৯১২)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা নিজেদের ঘর-বাড়িগুলোকে কবরে পরিণত করো না। কেননা, যে বাড়িতে সূরা বাক্বারাহ পাঠ করা হয়, সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে।
(অর্থাৎ সুন্নাত ও নফল নামায তথা পবিত্র কুরআন পড়া ত্যাগ ক’রে ঘরকে কবর বানিয়ে দিয়ো না। যেহেতু কবরে এ সব বৈধ নয়।)(মুসলিম ১৮৬০)
আয়াতুল কুরসীঃ
আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয নামাযের পশ্চাতে ‘আয়াতুল কুরসী’ পাঠ করবে, সে ব্যক্তির জন্য তার মৃত্যু ছাড়া আর অন্য কিছু জান্নাত প্রবেশের পথে বাধা হবে না।
(নাসাঈ কুবরা ৯৯২৮, ত্বাবারানী ৭৫৩২, সহীহুল জামে ৬৪৬৪)
উসমান ইব্ন হায়সাম (রহঃ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমযানে প্রাপ্ত যাকাতের মাল হেফাজতের দায়িত্ব দিলেন। এ সময় জনৈক ব্যাক্তি এসে খাদ্য-দ্রব্য উঠিয়ে নিতে উদ্যত হল। আমি তাকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, আমি তোমাকে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নিয়ে যাব। এরপর পুরো হাদীস বর্ণনা করে। তখন লোকটি বলল, যখন আপনি ঘুমাতে যাবেন, তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করবেন। এর ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন পাহারাদার নিযুক্ত করা হবে এবং ভোর পর্যন্ত শয়তান আপনার কাছে আসতে পারবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এ ঘটনা শুনে) বললেন, (যে তোমার কাছে এসেছিল) সে সত্য কথা বলেছে, যদিও সে বড় মিথ্যাবাদী শয়তান। সহিহ বুখারি হাদিস নং ৫০০৮, ৫০০৯ ও ৫০১০
সূরা বাকারা শেষ ২ আয়াতঃ
আবূ মাসঊদ বদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারার শেষ আয়াত দু’টি পাঠ করবে, তার জন্য সে দু’টি যথেষ্ট হবে।’
বলা হয়েছে যে, সে রাতে অপ্রীতিকর জিনিসের মোকাবেলায় যথেষ্ট হবে। অথবা তাহাজ্জুদের নামায থেকে যথেষ্ট হবে।
(বুখারী ৪০০৮, মুসলিম ১৯১৪-১৯১৬)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা জিবরীল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বসে ছিলেন। এমন সময় উপর থেকে একটি শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি (জিবরীল) মাথা তুলে বললেন, ‘এটি আসমানের একটি দরজা, যা আজ খোলা হল। ইতোপূর্বে এটা কখনও খোলা হয়নি। ওদিক দিয়ে একজন ফিরিশতা অবতীর্ণ হল। এই ফিরিশতা যে দুনিয়াতে অবতরণ করেছে, ইতোপূর্বে কখনও অবতরণ করেনি।’ সুতরাং তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘‘আপনি দু’টি জ্যোতির সুসংবাদ নিন। যা আপনার আগে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। (সে দু’টি হচ্ছে) সূরা ফাতেহা ও সূরা বাক্বারার শেষ আয়াতসমূহ। ওর মধ্য হতে যে বর্ণটিই পাঠ করবেন, তাই আপনাকে দেওয়া হবে।
(মুসলিম ১৯১৩)
সূরা আল ইখলাসঃ
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সূরা) ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ সম্পর্কে বলেছেন, সেই মহান সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে, নিঃসন্দেহে এটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল। (বুখারী ৫০১৩, ৬৬৪৩, ৭৩৭৪)
অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণকে বললেন, তোমরা কি এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়তে অপারগ? প্রস্তাবটি তাঁদের পক্ষে ভারী মনে হল। তাই তাঁরা বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রসূল! এ কাজ আমাদের মধ্যে কে করতে পারবে? (অর্থাৎ, কেউ পারবে না।) তিনি বললেন, ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস স্বামাদ’ (সূরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল। (অর্থাৎ, এই সূরা পড়লে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়ার সমান নেকী অর্জিত হয়।) (ঐ ৫০১৫)
মুআয বিন আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ‘ক্বুল হুঅল্লা-হু আহাদ’ শেষ পর্যন্ত ১০ বার পাঠ করবে, আল্লাহ সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতে এক মহল নির্মাণ করবেন। এ কথা শুনে উমার বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) বললেন, তাহলে আমরা বেশি বেশি করে পড়ব হে আল্লাহর রসূল! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহও বেশি দানশীল ও বেশি পবিত্র।(আহমাদ ১৫৬১০, প্রমুখ, সিসিলাহ সহীহাহ ৫৮৯)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নিবেদন করল, হে আল্লাহর রসূল! আমি এই (সূরা) ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ভালবাসি। তিনি বললেন, এর ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।(তিরমিযী ২৯০১ হাসান সূত্রে, বুখারী বিচ্ছিন্ন সনদে ৭৭৫ এর আগে
সূরা ফালাক ও নাসঃ
একদা ইবনে আবেস জুহানী (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে ইবনে আবেস! আমি তোমাকে উত্তম ঝাড়-ফুঁকের কথা বলে দেব না কি, যার মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনাকারীরা আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে? তিনি বললেন, অবশ্যই বলে দিন, হে রাসূলাল্লাহ! তিনি ফালাক ও নাস সূরা দুটিকে উল্লেখ করে বললেন, এ সূরা দুটি হল মুআব্বিযাতান (ঝাড়-ফুঁকের মন্ত্র)।
(আহমাদ ১৫৪৪৮, ১৭২৯৭, নাসাঈ কুবরা ৭৮৪৭)
আবদুল্লাহ ইবনু ইউসুফ (রহঃ) … আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, যখনই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হতেন তখনই তিনি ‘সূরায়ে মু’আবিযাত’ পাঠ করে নিজের উপর ফুঁক দিতেন। যখন তাঁর রোগ কঠিন আকার ধারন করল, তখন বরকত লাভের জন্য আমি এই সকল সূরা পাঠ করে হাত দিয়ে শরীর মাসেহ্ করিয়ে দিতাম। সহিহ বুখারিঃ ই ফা নাম্বারঃ ৪৬৪৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫০১৬
সূরা কাফিরুনঃ
আনাস বিন মালিক (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ‘ক্বুল ইয়া-আইয়্যুহাল কা-ফিরূন’ পাঠ করবে, তার এক চতুর্থাংশ কুরআন পাঠের সমান সওয়াব লাভ হবে। আর যে, ব্যক্তি ‘ক্বুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ’ পাঠ করবে তার এক তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠের সমান সওয়াব লাভ হবে। (তিরমিযী ২৮৯৩, সহীহুল জামে’ ৬৪৬৬)
সূরা মূলকঃ
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুরআনে ত্রিশ আয়াতবিশিষ্ট একটি সূরা এমন আছে, যা তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে এবং শেষাবধি তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে, সেটা হচ্ছে ‘তাবা-রাকাল্লাযী বিয়্যাদিহিল মুলক’ (সূরা মুলক)।(আবূ দাঊদ ১৪০২, তিরমিযী ২৮৯১, হাসান)
কাহফঃ
আবূ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুরা কাহফের প্রথম দিক থেকে দশটি আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের (ফিৎনা) থেকে পরিত্রাণ পাবে। অন্য বর্ণনায় ‘কাহফ সূরার শেষ দিক থেকে’ উল্লেখ হয়েছে। (মুসলিম ১৯১৯-১৯২০)
আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরা কাহফ পাঠ করে, সে ব্যক্তির জন্য দুই জুমআর মধ্যবর্তী কাল জ্যোতির্ময় হয়ে যায়।(হাকেম, বাইহাক্বী, সহীহুল জামে’ ৬৪৭০)
‘Abd-Allah ibn Mas’ud (may Allah be pleased with him) said concerning Bani Israil (al-Isra), al-Kahf , Maryam, Taha and al-Anbiya: They are among the best of the earliest ones that I learned by heart. (Narrated by al-Bukhari, 4994)
Abu Umamah (may Allah be pleased with him) narrated that the Messenger of Allah (peace and blessings of Allah be upon him) said: “The greatest name of Allah appears in three surahs of the Quran: in al-Baqarah
, Al ‘Imran and Taha.” (Narrated by Ibn Majah (3856) and al-Hakim (1/686); classed as hasan (sound) by al-Albani in al-Silsilah al-Sahihah (746)
It was narrated from Ibn ‘Abbaas that the Prophet (peace and blessings of Allaah be upon him) said: “Hood, al-Waaqi’ah, al-Mursalaat, ‘Amma yatsaa’iloon [al-Naba’] and Idha al-‘shamsu kuwwirat [al-Takweer] have made my hair grey.”
(Narrated by al-Tirmidhi, 3297. classed as saheeh by Shaykh al-Albaani, al-Saheehah, 955)
সংগ্রহে
তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন ও অন্যান্য