সূরা বাকারাঃ ১৩তম রুকু (১০৪–১১২)আয়াত

সূরা বাকারাঃ ১৩তম রুকু (১০৪–১১২)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:১০৪ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقُوۡلُوۡا رَاعِنَا وَ قُوۡلُوا انۡظُرۡنَا وَ اسۡمَعُوۡا ؕ وَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ

হে বিশ্বাসীগণ! (তোমরা মুহাম্মাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাকে) ‘রায়িনা’ বলো না, বরং ‘উনযুরনা’ (আমাদের খেয়াল করুন) বল এবং (তার নির্দেশ) শুনে নাও। আর অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।

رَاعِنَا এর অর্থ আমাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ ও আমাদের দিকে খেয়াল করুন! কোন কথা বুঝা না গেলে এই শব্দ ব্যবহার করে শ্রোতা নিজের প্রতি বক্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করত।

কিন্তু ইয়াহুদীরা বিদ্বেষ ও অবাধ্যতাবশতঃ এই শব্দের কিছুটা বিকৃতি ঘটিয়ে ব্যবহার করত যাতে তার অর্থের পরিবর্তন ঘটতো এবং তাদের অবাধ্যতার স্পৃহায় মিষ্ট স্বাদ পেত। যেমন তারা বলত, رَاعِيْنَا ‘রায়ীনা’ (আমাদের রাখাল) অথবা رَاعِنَا ‘রায়েনা’ (নির্বোধ)।  এ শব্দটি ইয়াহুদীদের ভাষায় এক প্রকার গালি ছিল, যা দ্বারা বুঝা হতো বিবেক বিকৃত লোক। তারা এ শব্দটি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে উপহাসসূচক ব্যবহার করত। মুমিনরা এ ব্যাপারটি উপলব্ধি না করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে ব্যবহার করা শুরু করে, ফলে আল্লাহ তা’আলা এ ধরণের কথাবার্তা বলতে নিষেধ করে আয়াত নাযিল করেন।

নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথ আলোচনার সময় ইহুদিদের যখন একথা বলার প্রয়োজন হতো যে, থামুন বা ‘কথাটি আমাদের একটু বুঝে নিতে দিন’ বা তখন তারা ‘রাইনা’ বলতো ৷ এ শব্দটির বাহ্যিক অর্থ ছিল , ‘আমাদের একটু সুযোগ দিন’ বা ‘আমাদের কথা শুনুন ৷’কিন্তু এর আরো কয়েকটি সম্ভাব্য অর্থও ছিল ৷ যেমন হিব্রু ভাষায় অনুরূপ যে শব্দটি ছিল তার অর্থ ছিলঃ’শোন, তুই বধির হয়ে যা৷ ‘ আরবী ভাষায়ও এর একটি অর্থ ছিল , ‘মূর্খ ও নির্বোধ ‘৷আলোচনার মাঝখানে এমন সময় শব্দটি প্রয়োগ করা হতো যখন এর অর্থ দাড়াত , তোমরা আমাদের কথা শুনলে আমরাও তোমাদের কথা শুনবো ৷ আবার মুখটাকে একটু বড় করে ‘রা-ঈয়ানা’ ( ) ও বলার চেষ্টা করা হতো ৷ এর অর্থ দাঁড়াত ‘ওহে, আমাদের রাখাল !’তাই মুসলমানদের হুকুম দেয়া হয়েছে, তোমরা এ শব্দটি ব্যবহার না করে বরং ‘উন্‌যুরনা’ বলো ৷

অনুরূপভাবে তারা السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ এর পরিবর্তে السَّامُ عَلَيْكُمْ (আপনার মৃত্যু হোক!) বলত। তাই মহান আল্লাহ বললেন, তোমরা اُنْظُرْنَا বলো। এ শব্দটির অর্থ ‘আমাদের প্রতি তাকান’। এ শব্দের মাঝে ইয়াহুদীদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং এ ধরণের শব্দ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মানে ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ থেকে প্রথম একটি বিষয় এই জানা গেল যে, এমন শব্দসমূহ যার মধ্যে দোষ ও অপমানকর অর্থের আভাস পর্যন্ত থাকবে, আদব ও সম্মানার্থে এবং (বেআদবীর) ছিদ্রপথ বন্ধ করতে তার ব্যবহার ঠিক নয়।

আর দ্বিতীয় যে বিষয় প্রমাণিত হয় তা হল, কথা ও কাজে কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা থেকে দূরে থাকা জরুরী। যাতে মুসলিম সেই তিরস্কারে শামিল না হয়, যাতে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, যে কোন জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই একজন গণ্য হবে। (আবূ দাউদ, কিতাবুল্লিবাস, আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।)

২:১০৫ مَا یَوَدُّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ اَهۡلِ الۡکِتٰبِ وَ لَا الۡمُشۡرِکِیۡنَ اَنۡ یُّنَزَّلَ عَلَیۡکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ یَخۡتَصُّ بِرَحۡمَتِهٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ

কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তারা এবং মুশরিকরা এটা চায় না যে, তোমাদের রব-এর কাছ থেকে তোমাদের উপর কোন কল্যাণ নাযিল হোক। অথচ আল্লাহ যাকে ইচ্ছে নিজ রহমত দ্বারা বিশেষিত করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।

আহলে-কিতাব শব্দদ্বয়ের অর্থ কিতাবওয়ালা বা গ্রন্থধারী। আল্লাহ তা’আলা আহলে কিতাব বলে তাদেরকেই বুঝিয়েছেন, যাদেরকে তিনি ইতঃপূর্বে তার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত সম্বলিত গ্রন্থ প্রদান করেছেন। ইয়াহুদী এবং নাসারারা সর্বসম্মতভাবে আহলে কিতাব। এর বাইরে আল্লাহ তা’আলা অন্য কোন জাতিকে কিতাব দিয়েছেন বলে সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়নি।

২:১০৬ مَا نَنۡسَخۡ مِنۡ اٰیَۃٍ اَوۡ نُنۡسِهَا نَاۡتِ بِخَیۡرٍ مِّنۡهَاۤ اَوۡ مِثۡلِهَا ؕ اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰهَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ

আমরা কোন আয়াত রহিত করলে বা ভুলিয়ে দিলে তা থেকে উত্তম অথবা তার সমান কোন আয়াত এনে দেই। আপনি কি জানেন না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

ইহুদিরা মুসলমানদের মনে যেসব সন্দেহ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাতো তার মধ্য থেকে একটি বিশেষ সন্দেহের জবাব এখানে দেয়া হয়েছে ৷ তাদের অভিযোগ ছিল , পূর্ববর্তী কিতাবগুলো যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে থাকে এবং এ কুরআনও আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে , তাহলে ঐ কিতাবগুলোর কতিপয় বিধানের জায়গায় এখানে ভিন্নতর বিধান দেয়া হয়েছে কেন ? একই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিধান কেমন করে হতে পারে ?

আবার তোমাদের কুরআন এ দাবী উত্থাপন করেছে যে, ইহুদিরা ও খৃস্টানরা তাদেরকে প্রদত্ত এ শিক্ষার একটি অংশ ভুলে গেছে ৷ আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা হাফেজদের মন থেকে কেমন করে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে ? সঠিক অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে তারা এসব কথা বলতো না ৷ বরং কুরআনের আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হবার ব্যাপারে মুসলমানদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তারা এগুলো বলতো ৷ এর জবাবে আল্লাহ বলেছেনঃ আমি মালিক ৷ আমার ক্ষমতা সীমাহীন ৷ আমি নিজের ইচ্ছা মতো যে কোন বিধান ‘মান্‌সুখ’ বা রহিত করে দেই এবং যে কোন বিধানকে হাফেজদের মন থেকে মুছে ফেলি ৷ কিন্তু যে জিনিসটি আমি ‘মান্‌সুখ’ করি তার জায়গায় তার চেয়ে ভালো জিনিস আনি অথবা কমপক্ষে সেই জিনিসটি নিজের জায়গায় আগেরটির মতই উপযোগী ও উপকারী হয় ৷

রহিতকরণ কী?

আরবি নাসখ (نسخ) শব্দের অর্থ রহিত করা। একদম সহজ করে বললে, নাসখ বলতে স্রষ্টার একটি বিধান নতুন আরেকটি বিধান দ্বারা বাতিল বা পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াকে বোঝায়।

কেউ কেউ নাসখের ধারণা বোঝাতে নাকল (نقل) বা স্থানান্তর শব্দটা ব্যবহার করেছেন। শায়খ আব্দুর রহমান আস সা’দি (রহ) তার তাফসিরে লিখেছেন,

“নাসখ বলতে আসলে স্থানান্তর বোঝায়। অর্থাৎ, (শরিয়ার) কোনো হুকুম অন্য হুকুম দ্বারা স্থানান্তর করা বা সরিয়ে ফেলা কিংবা পুরো হুকুমটাই সরিয়ে ফেলা।”  তাফসিরে সা’দি, ১/৬১

(নসখ) এর আভিধানিক অর্থ হল, নকল করা। কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় তা হল, কোন বিধানকে রহিত করে তার পরিবর্তে অন্য বিধান অবতীর্ণ করা। আর এই রহিতকরণ বা পরিবর্তন হয়েছে আল্লাহরই পক্ষ থেকে। যেমন, আদম (আঃ)-এর যুগে সহোদর ভাই-বোনদের আপোসে বিবাহ বৈধ ছিল। পরবর্তীকালে তা হারাম করা হয়। এইভাবে কুরআনেও আল্লাহ কিছু বিধানকে রহিত করে তার পরিবর্তে নতুন বিধান অবতীর্ণ করেছেন। এর সংখ্যার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।

বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নাসখ সংক্রান্ত ঘটনার সংখ্যা অল্প কয়েকটি। আর সেগুলো সনাক্ত করার সুনির্দিষ্ট তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো হলো-

■ নবি (সা) কিংবা তাঁর কোনো সাহাবির সুষ্পষ্ট বক্তব্য।

■ রহিতকারী ও রহিত- উভয়ের আইনের ব্যাপারে প্রথম দিকের মুসলিম বিশেষজ্ঞদের ইজমা বা ঐক্যমত থাকা।

■ এ বিষয়ের নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক জ্ঞান যে, যে আইনটিকে রহিত করা হয়েছে সেটি রহিতকারী আইনটির পূর্বে নাযিল হয়েছে এবং তা রহিতকারী আইনটির কোন সম্পূরক বিধি নয়, বরং তার সাথে সুষ্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক।

শাহ ওলীউল্লাহ ‘আল-ফাউযুল কাবীর’ নামক কিতাবে এর সংখ্যা পাঁচ বলেছেন। এই রহিতকরণ তিন প্রকারের হয়েছেঃ যথা

(ক) সাধারণভাবে বিধান রহিতকরণঃ অর্থাৎ, কোন বিধান (আয়াতসহ) রহিত করে তার স্থলে অন্য বিধান (ও আয়াত) অবতীর্ণ করা হয়েছে।

(খ) তেলাঅত ব্যতিরেকে বিধান রহিত করা। অর্থাৎ, প্রথম বিধানের আয়াতগুলো কুরআনে বিদ্যমান রাখা হয়, তার তেলাঅতও হয় আবার দ্বিতীয় বিধানও যা পরে অবতীর্ণ করা হয় তাও কুরআনে বিদ্যমান থাকে। অর্থাৎ, ‘নাসেখ’ (রহিতকারী) এবং ‘মানসুখ’ (রহিতকৃত) উভয় আয়াতই বিদ্যমান থাকে।

(গ) কেবল তেলাঅত রহিত করা। অর্থাৎ, নবী করীম (সাঃ) ঐ আয়াতকে কুরআনের মধ্যে শামিল করেননি, কিন্তু তার বিধানের উপর আমল বহাল রাখা হয়েছে। যেমন,

{وَالشّيْخُ وَالشَّيخَةُ إِذَ زَنَيَا فَارْجُمُوْهُمَا الْبَتَّةَ} বৃদ্ধ (বিবাহিত) পুরুষ ও বৃদ্ধা (বিবাহিতা) নারী যদি ব্যভিচার করলে, তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই পাথর মেরে হত্যা কর। (মুআত্তা ইমাম মালিক)

আলোচ্য আয়াতে ‘নাসখ’ এর প্রথম দুই প্রকারের বর্ণনা রয়েছে। (مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ) শব্দে দ্বিতীয় প্রকারের এবং (أَوْ نُنْسِهَا) শব্দে প্রথম প্রকারের নসখের কথা বলা হয়েছে। (نُنْسِهَا) (আমি ভুলিয়ে দিই)এর অর্থ হল, তার বিধান ও তেলাঅত দুটোই উঠিয়ে নিই। যেন আমি তা ভুলিয়ে দিলাম এবং নতুন বিধান নাযিল করলাম। অথবা নবী করীম (সাঃ)-এর হৃদয় থেকেই আমি তা মিটিয়ে দিয়ে একেবারে বিলুপ্ত করে দিলাম।

ইয়াহুদীরা তাওরাতের বাক্য রহিত হওয়াকে অসম্ভব মনে করত। ফলে কুরআনের কিছু আয়াত রহিত হওয়ার কারণে তার উপরও আপত্তি উত্থাপন করল। মহান আল্লাহ তাদের খন্ডন করে বললেন, যমীন ও আসমানের রাজত্ব তাঁরই হাতে। তিনি যা উচিত মনে করেন তা-ই করেন। যে সময় যে বিধান লক্ষ্য ও কৌশলের দিক দিয়ে উপযুক্ত মনে করেন, সেটাকেই তিনি বহাল করেন এবং যেটাকে চান রহিত ঘোষণা করেন। এটা তাঁর মহাশক্তির এক নিদর্শন। পূর্বের কিছু ভ্রষ্টলোক (যেমন, আবূ মুসলিম আসফাহানী মুতাযেলী) এবং বর্তমানের কিছু লোক ইয়াহুদীদের মত ‘নসখ’ মানতে অস্বীকার করেছে। তবে সঠিক কথা তা-ই যা পূর্বের আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়েছে। ‘নসখ’সুসাব্যস্ত হওয়ারই আকীদা রাখতেন পূর্বের সলফগণ। তাফসীরে আহসানুল বায়ান

উসূলে ফিক্বহ (ফিক্বহের মূলনীতি)  রহিতকরণ (النسخ)  শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ)

প্রকারভেদ

النسخ তিন প্রকার। যথা:

প্রথম প্রকার:   হুকুম মানসুখ-রহিত হয় কিন্তু তার শব্দ বহাল থাকে।

কুরআনের এ ধরণের نسخ বেশী। এর উদাহরণ হলো: ايتا المصابرة বা ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করা সম্পর্কিত আয়াতদ্বয়। আয়াত দু’টি হলো:

إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ

‘‘যদি তোমাদের মাঝে বিশ জন ধৈর্যশীল মুজাহিদ থাকে, তবে তারা দু’শত জনের মোকাবেলায় জয়ী হবে (সূরা আল-আনফাল ৮:৬৫)।’’

অত্র আয়াতের হুকুম নিচের আয়াত দ্বারা রহিত হয়েছে।

الْآَنَ خَفَّفَ اللَّهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ أَلْفٌ يَغْلِبُوا أَلْفَيْنِ بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ

‘‘এখন আল্লাহ তোমাদের উপর বোঝা হালকা করে দিয়েছেন। আর তিনি জানেন যে, নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে দুর্বলতা রয়েছে। এতএব, তোমাদের মাঝে একশত জন মুজাহিদ থাকলে, তারা দু’শত জনের মোকাবেলায় জয়ী হবে (সূরা আল-আনফাল ৮:৬৬)।’’

শব্দ রহিত না করে হুকুম রহিত করার হিকমত হলো: তিলাওয়াতের ছাওয়াব অবশিষ্ট রাখা এবং জাতীকে نسخ এর হিকমত-তাৎপর্য স্মরণ করিয়ে দেয়া।

দ্বিতীয় প্রকার:  শব্দ রহিত হয়, তবে হুকুম বহাল থাকে

যেমন: রজম (বিবাহিত ব্যভিচারী নর-নারীকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা) বিষয়ক সংশ্লিষ্ট আয়াত। ছহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের সূত্রে প্রমাণিত যে, উমার (রা.) বলেন, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তন্মধ্যে রজম সংশ্লিষ্ট আয়াত ছিলো। আমরা সেই আয়াত পড়েছি, বুঝেছি ও মুখস্থ করেছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে অনুযায়ী রজম করেছেন। পরবর্তীতে আমরাও রজম করেছি।

উপরন্তু আমার আশংকা হয়, দীর্ঘ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর কেউ হয়তো বলবে, ‘আলাহর কসম আমরা তো কুরআনে রজমের আয়াত পাচ্ছি না!’ ফলে আল্লাহর নাযিলকৃত একটি ফরয বর্জন করার কারণে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। অথচ আল্লাহর কিতাবে রজম যথার্থ সে সব নারী-পুরুষের জন্য, যারা বিবাহিত হওয়ার পর ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয় অথবা গর্ভবতী হয় অথবা স্বীকার করে।

হুকুম রহিত না করে শব্দ রহিত করার হিকমত-তাৎপর্য হলো যে আমলের শব্দ কুরআনে পাওয়া যায় না, তদানুযায়ী আমল করার ক্ষেত্রে উম্মাহকে পরীক্ষা করা এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, সে বিষয়ে তাদের ঈমান যাচাই করা। এক্ষেত্রে ইহুদিদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা, তারা তাওরাতে রজম সংশ্লিষ্ট نص কে গোপন করার চেষ্টা করেছিলো।

তৃতীয় প্রকার:  শব্দ ও হুকুম উভয়টি রহিত হওয়া। যেমন: দশ চোষণ সম্পর্কিত আয়েশা (রা.) বর্ণিত পূর্বের হাদীছটির ‘রহিতকরণ’।

 

ناسخ বা রহিতকারী দলীলের দিক দিয়ে النسخ তিন প্রকার। যথা:

প্রথম প্রকার: কুরআন দ্বারা কুরআন রহিত হওয়া। এর উদাহণ হলো ধৈর্যের সাথে কাফেরদের মোকাবেলা সম্পর্কিত আয়াতদ্বয়। সূরা আনফাল ৮: ৬৫-৬৬

এ ক্ষেত্রে কুরআনের পূর্ববর্তী একটি আইন পরবর্তী আইন দ্বারা রহিত হয়। যেমন, যেসব নারীরা ব্যভিচার করে, তাদের শাস্তি সম্পর্কে কুরআনে নাযিল করা হয়ঃ

“আর তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচারিণী, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চার জন পুরুষকে সাক্ষী হিসেবে নিয়ে এসো। আর যদি তারা সাক্ষ্য প্রদান করে তবে সংশ্লিষ্টদেরকে গৃহে আবদ্ধ রাখো, যে পর্যন্ত মৃত্যু তাদেরকে তুলে না নেয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোনো পথ নির্দেশ না করেন।” সূরা আন নিসা (৪): ১৫

এ আইনটি পরবর্তীতে বাতিল করা হয়। যারা এ ধরনের মন্দ কাজ করবে তাদের শাস্তি সম্পর্কে নাযিল করা হয়,

“ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করার কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়- যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলিমদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” সূরা আন নূর (২৪): ২

দ্বিতীয় প্রকার: কুরআন দ্বারা হাদীছ রহিত হওয়া।

উদাহরণ হলো হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত বায়তুল মাকদিসের দিকে মুখ করে ছ্বলাত আদায় করার বিধান আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীর দ্বারা সাব্যস্ত কা‘বার দিকে মুখ করে ছ্বলাত আদায় করার বিষয়ের মাধ্যমে রহিতকরণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُمَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ

‘‘এখন আপনি মাসজিদুল-হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর (সূরা আল-বাক্বারা ২:১৪৪)।’’

রাসূল (সাঃ) এর একটি নির্দেশ কিংবা তিনি পালন করতেন এমন কোনো সুন্নাহ পবিত্র কুরআনের কোনো আয়াত দ্বারা রহিত হয়ে যায়। “নবি (সা) যখন মদিনায় এলেন, তখন দেখলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তখন তিনি বললেন, “কেন তোমরা এ দিনে রোজা রাখো?” তারা বললো, “এটি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করেছেন; তাই মুসা (আ) এ দিনে রোজা রাখতেন।” তখন নবি (সা) বললেন, “তোমাদের চেয়ে আমি মুসার অধিক নিকটবর্তী। তাই তিনি এ দিন রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।”সহিহ বুখারি, হাদিস নংঃ ২০০৪

রাসূল (সা)- এর এই নির্দেশের পর সবাই বাধ্যতামূলকভাবে আশুরা’র দিন সিয়াম পালন করতো। তখনো রমাদানে সিয়াম রাখার বিধান নাযিল হয়নি। পরবর্তীতে আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন,

“রমাদান মাসই হলো সে মাস, যে মাসে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে।”  সূরা বাকারা (২): ১৮৫

ইবনে উমার (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস অনুযায়ী, এ আয়াতটি নাযিল হবার পর মুসলিমরা আশুরা’র সিয়ামকে বাধ্যতামূলক হিসেবে পালন করেনি। বরং তা ঐচ্ছিক হয়ে যায়। তিনি বলেন, “নবি (সা) আশুরার দিন সিয়াম পালন করতেন এবং আমাদেরকেও পালন করতে নির্দেশ দিতেন। তারপর যখন রমাদানের সিয়াম ফরজ করা হলো তখন আশুরার সিয়াম ছেড়ে দেয়া হলো।” সহিহ বুখারি, হাদিস নংঃ ১৮৯২

তৃতীয় প্রকার:  এক হাদীছ দ্বারা অপর হাদীছ রহিত করা। এর দৃষ্টান্ত হলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী:

كنت نهيتكم عن النبيذ في الأوعية فاشربوا فيما شئتم ولا تشربوا مسكرا

‘‘আমি তোমাদেরকে পানির পাত্রে নাবীয তৈরী করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমরা যে কোন নাবীয তৈরী করে তা পান করতে পারো। তবে নেশা দ্রব্য কোন কিছু পান করবে না।’’. ছহীহ মুসলিম/৯৭৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নং ২১২৯, মুসনাদে আহমাদ (৩/২৩৭/১৩৫১২), আবু ইয়ালা (৬/৩৭৩/৩৭০৭), আল্লামা হায়সামী তার ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’ (৫/৬৬) গ্রন্থে বলেন, এ হাদীছের সনদে ইয়াহইয়া বিন আব্দুল্লাহ আল জাবির রয়েছে। তাকে অধিকাংশ বিদ্বান দুর্বল বলেছেন। ইমাম আহমাদ বলেন, তার কোন সমস্যা নেই। সনদের অন্যান্য রাবী নির্ভরযোগ্য।

যখন রাসূল ﷺ এর কোনো নির্দেশ পরবর্তীতে তাঁর আরেকটি নির্দেশ দ্বারা বাতিল হয়ে যায়। যেমন, ইসলামের প্রথম দিকে কেউ রান্না করা খাবার খেলে রাসুল (সা) তাকে সালাত আদায়ের পূর্বে ওযু করার নির্দেশ দিতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তা রহিত হয়ে যায়। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেন, “আল্লাহর রাসুল (সা) এর দুটি নির্দেশের শেষেরটিতে আগুনে পাকানো বস্তু খাবার পর ওযু না ভাঙ্গার কথা বলা হয়েছে।সহিহ  ইবনে হিব্বান, হাদিস নংঃ ১১৩৪”  অর্থাৎ রান্না করা খাবার খেলে পুনরায় ওযু করার প্রয়োজন নেই।

আলবানি (রহ)- এর মতে হাদিসটি সহিহ। (আত-তালিকাতুল হিসসান ‘আলা সহিহ ইবনে হিব্বান, ২/৩৯৬)

এ ব্যাপারে শায়খ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়ার এই আলোচনাটি দেখা যেতে পারেঃ

“কুরআনে নাসেখ ও মানসুখ কী_কুরআনের কিছু আয়াত কি আসলেই হারিয়ে গেছে?”

https://response-to-anti-islam.com/show/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9E%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B6%E0%A6%A8-%E2%80%93-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%96-/66

২:১০৭ اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰهَ لَهٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیۡرٍ

আপনি কি জানেন না যে, আসমান ও যমীনের সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর? আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবকও নেই, নেই সাহায্যকারীও।

২:১০৮ اَمۡ تُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ تَسۡـَٔلُوۡا رَسُوۡلَکُمۡ کَمَا سُئِلَ مُوۡسٰی مِنۡ قَبۡلُ ؕ وَ مَنۡ یَّتَبَدَّلِ الۡکُفۡرَ بِالۡاِیۡمَانِ فَقَدۡ ضَلَّ سَوَآءَ السَّبِیۡلِ

তোমরা কি তোমাদের রাসূলকে সেরূপ প্রশ্ন করতে চাও যেরূপ প্রশ্ন পূর্বে মূসাকে করা হয়েছিল? আর যে ঈমানকে কুফরে পরিবর্তন করবে, সে অবশ্যই সরল পথ হারাল।

ইহুদিরা তিলকে তাল করে এবং সূক্ষ্ম বিষয়ের অবতারণা করে মুসলমানদের সামনে নানা ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতো ৷ তোমাদের নবীর কাছে এটা জিজ্ঞেস করো ওটা জিজ্ঞেস করো বলে তারা মুসলমানদের উস্কানী দিতো ৷ তাই এ ব্যাপারে আল্লাহ মুসলমানদেরকে ইহুদিদের নীতি অবলম্বন করা থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করে দিচ্ছেন ৷

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এ ব্যাপারে মুসলমানদেরকে বার বার সতর্ক করে দিয়েছেন ৷ তিনি বলতেন , অনর্থক প্রশ্ন করা এবং তিলকে তাল করার কারণে পূর্ববর্তী উম্মাতরা ধ্বংস হয়েছে , কাজেই তোমরা এ পথে পা দিয়ো না ৷ আল্লাহ ও তাঁর রসূল যে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেননি সেগুলোর পেছনে জোঁকের মতো লেগে থেকো না ৷ তোমাকে যে নির্দেশ দেয়া হয় তা মেনে চলো এবং যে বিষয়গুলো থেকে নিষেধ করা হয় সেগুলো করো না ৷ অপ্রয়োজনীয় কথা বাদ দিয়ে কাজের কথার প্রতি মনোযোগ দাও ৷

এ আয়াতে মূসা আলাইহিস সালামের কাছে তার সাথীরা কি চেয়েছিল, তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়নি। সেটা অন্য আয়াতে বিস্তারিত এসেছে।

বলা হয়েছে, “কিতাবীগণ আপনার কাছে তাদের জন্য আসমান হতে একটি কিতাব নাযিল করতে বলে; তারা মূসার কাছে এর চেয়েও বড় দাবী করেছিল। তারা বলেছিল, ‘আমাদেরকে প্রকাশ্যে আল্লাহকে দেখাও’ [সূরা আন-নিসা ১৫৩]

অন্য বর্ণনায় ইবনে আব্বাস বলেন, রাফে ইবনে হারিমলাহ এবং ওয়াহাব ইবনে যায়েদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলল যে, হে মুহাম্মদ! আমাদের জন্য একটি কিতাব আসমান থেকে নাযিল করে আন, যা আমরা পড়ে দেখব। আর আমাদের জন্য যমীন থেকে প্রস্রবণ প্রবাহিত করে দাও।যদি তা কর তবে আমরা তোমার অনুসরণ করব ও তোমার সত্যয়ন করব। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অযথা প্রশ্ন করা উচিত নয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ঐ মুসলিম সবচেয়ে বড় অপরাধী, যে হারাম নয় এমন কোন বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করার কারণে সেটি হারাম করে দেয়া হয়” [বুখারী: ৭২৮৯, মুসলিম: ২৩৫৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন “যতক্ষণ আমি তোমাদেরকে কিছু না বলি ততক্ষণ তোমরা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ অতিরিক্ত প্রশ্ন এবং নবীদের সাথে মতবিরোধের কারণে ধ্বংস হয়েছিল”। [বুখারী: ৭২৮৮, মুসলিম: ১৩৩৭]

২:১০৯ وَدَّ کَثِیۡرٌ مِّنۡ اَهۡلِ الۡکِتٰبِ لَوۡ یَرُدُّوۡنَکُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ اِیۡمَانِکُمۡ کُفَّارًا ۚۖ حَسَدًا مِّنۡ عِنۡدِ اَنۡفُسِهِمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمُ الۡحَقُّ ۚ فَاعۡفُوۡا وَ اصۡفَحُوۡا حَتّٰی یَاۡتِیَ اللّٰهُ بِاَمۡرِهٖ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ

কিতাবীদের অনেকেই চায়, যদি তারা তোমাদেরকে তোমাদের ঈমান আনার পর কাফেররূপে ফিরিয়ে নিতে পারত! সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে বিদ্বেষবশতঃ (তারা এটা করে থাকে)। অতএব, তোমরা ক্ষমা কর এবং উপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ তার কোন নির্দেশ দেন– নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

 

ওদের(ইহুদী বা কিতাবীদের) হিংসা ও বিদ্বেষ দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ো না ৷ নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলো না ৷ এদের সাথে তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া করে নিজের মূল্যবান সময় ও মর্যাদা নষ্ট করো না ৷ ধৈর্য সহকারে দেখতে থাকো আল্লাহ কি করেন ৷ অনর্থক আজেবাজে কাজে নিজের শক্তি ক্ষয় না করে আল্লাহর যিকির ও সৎকাজে সময় ব্যয় করো ৷ এগুলোই আল্লাহর ওখানে কাজে লাগবে ৷ বিপরীত পক্ষে ঐ বাজে কাজগুলোর আল্লাহর ওখানে কোন মূল্য নেই ৷

তখনকার অবস্থানুযায়ী ক্ষমার নির্দেশই ছিল বিধেয়। পরবর্তীকালে আল্লাহ স্বীয় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেন এবং জিহাদের আয়াতসমূহ নাযিল করেন। অতঃপর ইয়াহুদীদের প্রতিও আইন বলবৎ করা হয় এবং অপরাধের ক্রমানুপাতে দুষ্টদের হত্যা, নির্বাসন, জিযিয়া আরোপ ইত্যাদি শাস্তি দেয়া হয়। সূরা আত-তাওবাহ এর ৫ ও ২৯ নং আয়াতের মাধ্যমে এ আয়াতের এ ক্ষমার বিধান রহিত করা হয়। [তাবারী]

ইরশাদ হয়েছে-

অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা কর, তাদেরকে পাকড়াও কর, অবরোধ কর এবং প্রত্যেক ঘাটিতে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে থাক; কিন্তু যদি তারা তাওবাহ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আত তাওবাঃ৫

যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহতে ঈমান আনে না এবং শেষ দিনেও নয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম গণ্য করে না, আর সত্য দ্বীন অনুসরণ করে না; তাদের সাথে যুদ্ধ কর, যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে নিজ হাতে জিযইয়া দেয়। আত তাওবাঃ২৯

জিযিয়া-কর দিয়ে মুসলিমদের অধীনে বসবাস-অধিকার গ্রহণ করে নিক। জিযিয়া হল, নির্ধারিত কিছু অর্থ; যা বাৎসরিকভাবে সেই অমুসলিমদের নিকট থেকে আদায় করা হয়, যারা কোন মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস করতে চায়। এর বিনিময়ে তাদের জান-মাল ও মান-ইজ্জতের হিফাযতের দায়িত্ব মুসলিম রাষ্ট্রের উপর বর্তায়।

যুদ্ধের চারটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে, প্রথমতঃ তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে না। দ্বিতীয়তঃ আখেরাতের প্রতিও তাদের বিশ্বাস নেই। তৃতীয়তঃ আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে তারা হারাম মনে করে না। চতুর্থতঃ সত্য দ্বীন গ্রহণে তারা অনিচ্ছুক। [কুরতুবী]

২:১১০ وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ تَجِدُوۡهُ عِنۡدَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ

আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা কর ও যাকাত দাও এবং তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু নিজেদের জন্য পেশ করবে আল্লাহর কাছে তা পাবে। নিশ্চয় তোমরা যা করছ আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।

ইয়াহুদীদের যেহেতু ইসলাম ও নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ ছিল, তাই তারা মুসলিমদেরকে ইসলাম থেকে দূরে রাখার জঘন্য প্রচেষ্টা চালাতো। সুতরাং এখানে মুসলিমদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমরা ধৈর্য ও উপেক্ষার পথ অবলম্বন কর এবং ইসলামের বিধি-বিধান ও ফরয কাজগুলো পালন কর, যার নির্দেশ তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে।

২:১১১ وَ قَالُوۡا لَنۡ یَّدۡخُلَ الۡجَنَّۃَ اِلَّا مَنۡ کَانَ هُوۡدًا اَوۡ نَصٰرٰی ؕ تِلۡکَ اَمَانِیُّهُمۡ ؕ قُلۡ هَاتُوۡا بُرۡهَانَکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ

আর তারা বলে, ইয়াহুদী অথবা নাসারা ছাড়া অন্য কেউ কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। এটা তাদের মিথ্যা আশা। বলুন, “যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ পেশ কর”।

আসলে এটা নিছক তাদের অন্তরের বাসনা এবং আকাংখা মাত্র ৷ কিন্তু তারা এটাকে এমনভাবে বর্ণনা করছে যেন সত্যি সত্যিই এমনটি ঘটবে ৷

আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তা’আলা ইয়াহুদী ও নাসারাদের পারস্পরিক মতবিরোধের উল্লেখ করে তাদের নির্বুদ্ধিতা ও মতবিরোধের কুফল বর্ণনা করেছেন। অতঃপর আসল সত্য উদঘাটন করেছেন। নাসারা ও ইয়াহুদী উভয় সম্প্রদায়ই দ্বীনের প্রকৃত সত্যকে উপেক্ষা করে ধর্মের নাম-ভিত্তিক জাতীয়তা গড়ে তুলেছিল এবং তারা প্রত্যেকেই স্বজাতিকে জান্নাতী ও আল্লাহর প্রিয়পাত্র বলে দাবী করত এবং তাদের ছাড়া অন্যান্য জাতিকে জাহান্নামী ও পথভ্রষ্ট বলে বিশ্বাস করত। আল্লাহ তা’আলা তাদের মূর্খতা সম্পর্কে মন্তব্য করছেন যে, এরা জান্নাতে যাওয়ার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে উদাসীন। জানাতে যাওয়ার প্রকৃত উপায় পরবর্তী আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে।

২:১১২ بَلٰی ٭ مَنۡ اَسۡلَمَ وَجۡهَهٗ لِلّٰهِ وَ هُوَ مُحۡسِنٌ فَلَهٗۤ اَجۡرُهٗ عِنۡدَ رَبِّهٖ ۪ وَ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ

হ্যাঁ, যে কেউ আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মশীল হয় তার প্রতিদান তার রব-এর কাছে রয়েছে। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।

{اَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلّه} (আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে)এর অর্থ হল, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে। আর {وَهُوَ مُحْسِنٌ} (বিশুদ্ধচিত্ত)র অর্থ হল, (শিরকমুক্ত হয়ে খাঁটি মনে) নিষ্ঠার সাথে শেষ নবীর তরীকা অনুযায়ী সে কাজ করা। আমল গৃহীত হওয়ার জন্য এই দু’টি হল মৌলিক শর্ত। আখেরাতের মুক্তি এই মৌলিক নীতি অনুযায়ী কৃত নেক আমলের উপরই নির্ভরশীল। কেবল আশা ও কামনা করলেই মুক্তি পাওয়া যাবে না।

আল্লাহর কাছে কোন বান্দার আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে দু’টি বিষয়ঃ

এক, ইখলাস তথা বান্দা মনে-প্রাণে নিজেকে আল্লাহর কাছে সমৰ্পন করবে।

দুই রাসূলের পরিপূর্ণ অনুসরণ।

অর্থাৎ যদি কেউ মনে-প্রাণে আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্যের সংকল্প গ্রহণ করে কিন্তু আনুগত্য ও ইবাদাত নিজের খেয়াল-খুশীমত মনগড়া পন্থায় সম্পাদন করে, তবে তাও জান্নাতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, বরং এ ক্ষেত্রেও আনুগত্য ও ইবাদাতের সে পন্থাই অবলম্বন করতে হবে, যা আল্লাহ্ তাআলা রাসূলের মাধ্যমে বর্ণনা ও নির্ধারণ করেছেন।

প্রথম বিষয়টি (بَلَىٰ مَنْ أَسْلَمَ) বাক্যাংশের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয় বিষয়টি (وَهُوَ مُحْسِنٌ) বাক্যাংশের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে।

এতে জানা গেল যে, আখেরাতের মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশের জন্য শুধু ইখলাসই যথেষ্ট নয়, বরং সৎকর্মও প্রয়োজন। বস্তুতঃ কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যশীল শিক্ষা ও পন্থাই সৎকর্ম। আল্লাহর ইখলাস ও রাসূলের আনুগত্যের ব্যাপারে মানুষের অবস্থান চার পর্যায়েঃ

ক) কারো কারো ইখলাস নেই, রাসূলের আনুগত্যও নেই, সে ব্যক্তি মুশরিক, কাফের।

খ) কারো কারো ইখলাস আছে, কিন্তু রাসূলের আনুগত্য নেই, সে ব্যক্তি বিদ’আতকারী।

গ) কারো কারো ইখলাস নেই, কিন্তু রাসূলের আনুগত্য আছে (প্রকাশ্যে), সে ব্যক্তি মুনাফেক।

ঘ) কারো কারো ইখলাসও আছে, রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণও আছে, সে ব্যক্তি হলো প্রকৃত মুমিন [তাজরীদুত তাওহীদিল মুফীদ]

্সংগ্রহে—-

তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন