সূরা নিসাঃ২য় রুকু (১১-১৪)

 

সূরা নিসাঃ২য় রুকু (১১-১৪)

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

 

﴿يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ ۖ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنثَيَيْنِ ۚ فَإِن كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ ۖ وَإِن كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ ۚ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِن كَانَ لَهُ وَلَدٌ ۚ فَإِن لَّمْ يَكُن لَّهُ وَلَدٌ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلِأُمِّهِ الثُّلُثُ ۚ فَإِن كَانَ لَهُ إِخْوَةٌ فَلِأُمِّهِ السُّدُسُ ۚ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ ۗ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ لَا تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا ۚ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا﴾

১১) তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেনঃ পুরুষদের অংশ দুজন মেয়ের সমান৷ যদি (মৃতের ওয়ারিস) দুয়ের বেশী মেয়ে হয়, তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দুভাগ তাদের দাও৷ আর যদি একটি মেয়ে ওয়ারিস হয়, তাহলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক তার৷ যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে , তাহলে তার বাপ-মা প্রত্যেকে সম্পত্তির ছয় ভাগের একভাগ পাবে৷আর যদি তার সন্তান না থাকে এবং বাপ-মা তার ওয়ারিস হয়, তাহলে মাকে তিন ভাগের একভাগ দিতে হবে ৷ যদি মৃতের ভাই-বোনও থাকে, তাহলে মা ছয় ভাগের একভাগ পাবে৷ (এ সমস্ত অংশ বের করতে হবে) মৃত ব্যক্তি যে অসিয়ত করে গেছে তা পূর্ণ করার এবং এ যে ঋণ রেখে গেছে তা আদায় করার পর৷ তোমরা জানো না তোমাদের বাপ-মা ও তোমাদের সন্তানদের মধ্যে উপকারের দিক দিয়ে কে তোমাদের বেশী নিকটবর্তী ৷ এসব অংশ আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন ৷ আর আল্লাহ অবশ্যি সকল সত্য জানেন এবং সকল কল্যাণময় ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন৷

﴿وَلَكُمْ نِصْفُ مَا تَرَكَ أَزْوَاجُكُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّهُنَّ وَلَدٌ ۚ فَإِن كَانَ لَهُنَّ وَلَدٌ فَلَكُمُ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْنَ ۚ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِينَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ ۚ وَلَهُنَّ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْتُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّكُمْ وَلَدٌ ۚ فَإِن كَانَ لَكُمْ وَلَدٌ فَلَهُنَّ الثُّمُنُ مِمَّا تَرَكْتُم ۚ مِّن بَعْدِ وَصِيَّةٍ تُوصُونَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ ۗ وَإِن كَانَ رَجُلٌ يُورَثُ كَلَالَةً أَوِ امْرَأَةٌ وَلَهُ أَخٌ أَوْ أُخْتٌ فَلِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ ۚ فَإِن كَانُوا أَكْثَرَ مِن ذَٰلِكَ فَهُمْ شُرَكَاءُ فِي الثُّلُثِ ۚ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَىٰ بِهَا أَوْ دَيْنٍ غَيْرَ مُضَارٍّ ۚ وَصِيَّةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَلِيمٌ﴾

১২) তোমাদের স্ত্রীরা যদি নিঃসন্তান হয়, তাহলে তারা যা কিছু ছেড়ে যায় তার অর্ধেক তোমরা পাবে৷ অন্যথায় তাদের সন্তান থাকলে যে অসিয়ত তারা করো গেছে তা পূর্ণ করার এবং যে ঋণ তারা রেখে গেছে তা আদায় করার পর পরিত্যক্ত সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ পাবে৷ অন্যথায় তোমাদের সন্তান থাকলে তোমাদের অসিয়ত পূর্ণ করার ও তোমাদের রেখে যাওয়া ঋণ আদায় করার পর তারা সম্পত্তির আট ভাগের একভাগ পাবে৷ আর যদি পুরুষ বা স্ত্রীলোকের ( যার মীরাস বন্টন হবে) সন্তান না থাকে এবং বাপ-মাও জীবিত না থাকে কিন্তু এক ভাই বা এক বোন থাকে, তাহলে ভাই ও বোন প্রত্যেকেই ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে৷ তবে ভাই-বোন একজনের বেশী হলে সমগ্র পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের একভাগে তারা সবাই শরীক হবে, যে অসিয়ত করা হয়েছে তা পূর্ণ করার এবং যে ঋণ মৃত ব্যক্তি রেখে গেছে তা আদায় করার পর যদি তা ক্ষতিকর না হয় ৷ এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ, আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী ও সহিষ্ণু৷

 

মীরাছ-এর আভিধানিক অর্থ :

আরবী ‘মীরাছ’ (ميراث ) শব্দটি ক্রিয়ামূল, যা وَرَثَ يَرِثُ إرْثًا ومِيْرَاثًا থেকে উদগত। আভিধানিক অর্থ : অংশীদার হওয়া, হকদার হওয়া।

যেমন আল্লাহ বলেন,وَوَرِثَ سُلَيْمَانُ دَاوُودَ ‘সুলায়মান দাঊদের ওয়ারিছ হয়েছে’ (নামল ২৭/১৬)।

কোন বস্ত্ত এক সম্প্রদায় থেকে অপর সম্প্রদায় বা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে স্থানান্তরিত হওয়া, চাই তা বিদ্যা, পদমর্যাদা বা সম্পদ হোক।

যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন

,وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلاَ دِرْهَمًا وَإِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ

‘আলেমগণ নবীগণের ওয়ারিছ। নিশ্চয়ই নবীগণ কোন দিরহাম বা দীনারের ওয়ারিছ করেননি। বরং তাঁরা জ্ঞানের (ইলম) ওয়ারিছ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অর্জন করেছে, সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’। আবুদাঊদ হা/৩৬৪১; তিরমিযী হা/২৮৯৮; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; মিশকাত হা/২১২, সনদ ছহীহ।

 

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُوْنَ ‘তারাই ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে, যেখানে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে’ (মুমিনূন ২৩/১১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,وَنَحْنُ الْوَارِثُوْنَ  ‘আমরাই উত্তরাধিকারী’ (হিজর ১৫/২৩)।

পারিভাষিক অর্থ :

মীরাছ হ’ল মৃত ব্যক্তি হ’তে তার জীবিত ওয়ারিছদের নিকট মালিকানা স্থানান্তরিত হওয়া। যা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অথবা শারঈ যেকোন হক হোক।

মীরাছের বিষয়টি মানুষের মরণোত্তর সময়ের সাথে সম্পৃক্ত, তাই এর সংশ্লিষ্ট জ্ঞানকে ‘নিছফুল ইলম’ বা জ্ঞানের অর্ধেক বলা হয়েছে। আল-মাওয়ারীছ, পৃঃ ৩৪।

জাহেলী ও ইসলামী যুগে মীরাছের বিধান :

 

জাহেলী যুগে আরবে মীরাছ হ’তে মহিলাদেরকে কোন অংশ দেয়া হ’ত না। এক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ বা অন্য কোনভাবে নিজ সম্প্রদায়কে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে না। তারা বলত, ‘যারা ঘোড়ায় চড়তে পারে না, তরবারী ব্যবহার করতে জানে না এবং শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে না, আমরা কিভাবে তাদেরকে সম্পদ প্রদান করতে পারি’? তাই তারা শিশুদের মত মেয়েদেরকেও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করত।

 

ইসলামী শরী‘আত মীরাছে তাদের হক প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্মান ও ইযযতের সাথে তা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এটা কারো দয়া বা অনুগ্রহ-অনুকম্পা নয়; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য নির্ধারিত অংশ।

মীরাছের আয়াত অবতীর্ণের কারণ :

একদা সা‘দ বিন রাবী‘ (রাঃ)-এর স্ত্রী সা‘দের ঔরষজাত দু’টি মেয়েকে সাথে নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এরা দুইজন সা‘দ ইবনে রাবীর কন্যা। তাদের পিতা সা‘দ ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এখন তাদের চাচা তাদের সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, তাদের জন্য কিছুই রাখেনি। অর্থ ছাড়া তাদেরকে বিয়েও দেয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এ ব্যাপারে আল্লাহ ফায়ছালা দিবেন। এর পরেই উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يُوصِيكُمُ اللهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (মধ্যে মীরাছ বণ্টনের) ব্যাপারে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান’ (নিসা ৪/১১)। এরপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের চাচাকে এ নির্দেশ পাঠালেন যে, সা‘দের মেয়েদেরকে দুই-তৃতীয়াংশ ও তাদের মাকে এক অষ্টমাংশ দাও এবং অবশিষ্টাংশ তোমার জন্য রাখো। তিরমিযী হা/২০৯২; আবুদাঊদ হা/২৮৯১; আত-তাহকীকাতুল মারযিয়্যাহ, পৃঃ ২২।

হাদীছে মীরাছের বিধান :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন,فَالثُّلُثُ، وَالثُّلُثُ كَثِيرٌ، إِنَّكَ أَنْ تَدَعَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَدَعَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ فِى أَيْدِيهِمْ،

‘এক-তৃতীয়াংশ। আর এক-তৃতীয়াংশই অধিক। ওয়ারিছকে সম্পদশালী অবস্থায় রেখে যাওয়া, তাদেরকে মানুষের নিকট মুখাপেক্ষী অবস্থায় রেখে যাওয়া অপেক্ষা উত্তম। ইবনু মাজাহ হা/২৭০৮; ছহীহ ইবনে খুযায়মা হা/২৩৫৫।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ، وَلاَ الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ ‘মুসলমান কাফেরের এবং কাফের মুসলমানের ওয়ারিছ হবে না’। বুখারী হা/৬৭৬৪; মুসলিম হা/৪২২৫; মিশকাত হা/৩০৪৩।

পরিত্যক্ত সম্পদের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলী :

মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের সাথে বেশ কিছু কর্তব্য রয়েছে।

প্রথমতঃ মৃত্যুর সময় থেকে মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ দ্বারা তার গোসল, কাফন, দাফন পর্যন্ত সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে হবে। সেক্ষেত্রে তার সম্পদের উপর ভিত্তি করে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে মৃতের দাফন সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী সমাপ্ত করতে হবে।

 

দ্বিতীয়তঃ তার ঋণ পরিশোধ করা। মৃতের নিকটে কোন মানুষের ঋণ থাকলে তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে ঋণ পরিশোধের পর বাকী সম্পদ ওয়ারিছদের মাঝে বণ্টিত হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,نَفْسُ الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهِ حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ ‘মুমিনের আত্মা ঋণ পরিশোধের পূর্ব পর্যন্ত ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে’। তিরমিযী হা/১০৭৮; ইবনু মাজাহ হা/২৫০৬; মিশকাত হা/২৯১৫।

তৃতীয়তঃ মৃতের অছিয়ত পূরণ করা। মৃতের অছিয়ত বাস্তবায়ন করতে হবে দাফন, কাফন ও ঋণ পরিশোধের পর।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,إِنَّ اللهَ تَصَدَّقَ عَلَيْكُمْ عِنْدَ وَفَاتِكُمْ بِثُلُثِ أَمْوَالِكُمْ زِيَادَةً لَكُمْ فِىْ أَعْمَالِكُمْ ‘

আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের মৃত্যুবরণের সময় এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ (অর্থাৎ অছিয়ত) দান করেছেন তোমাদের আমল বৃদ্ধি করার জন্য’। ইবনু মাজাহ হা/২৭০৯; মুসনাদে আহমাদ হা/২৬২১০, সনদ হাসান। সুতরাং কেউ চাইলে এক-তৃতীয়াংশ দান করতে পারে, তার বেশী নয়।

 

চতুর্থতঃ পরিত্যক্ত সম্পদ ওয়ারিছদের মাঝে বণ্টন করতে হবে।আল-মাওয়ারীছ, পৃঃ ৩৫-৩৬।

 

পুরুষের অংশ মহিলার দ্বিগুণ কেন?

এ বিধান মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। যিনি সৃষ্টিকুলের কল্যাণ সর্বাধিক পরিজ্ঞাত।

ইসলামী শরী‘আত বেশ কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণে মীরাছে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হ’ল।-

১. মহিলার প্রয়োজনীয় ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার ছেলে, পিতা, ভাই বা অন্যান্য আত্মীয়ের উপর ন্যস্ত।

২. মহিলা নিজে কারো ব্যয়ভার বহনে বাধ্য নয়। অথচ পুরুষ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও দাবীদারদের ভারণ-পোষণে আদিষ্ট।

৩. পুরুষের ব্যয় পরিমাণহীন ও তার সম্পদের আবশ্যকতা অধিক। সেহেতু তার অর্থের প্রয়োজন মহিলার চেয়ে বেশী।

৪. পুরুষ তার স্ত্রীর মোহর প্রদান করে এবং সন্তানদের ও স্ত্রীর অন্ন-বস্ত্রের ব্যয়ভার ও বাসস্থান নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে।

৫. সন্তানদের লেখা-পড়া, চিকিৎসা, স্ত্রীর সকল ব্যয়ভার পুরুষের উপরই ন্যস্ত, মহিলার উপরে নয়।

একটি পরিবার ও তৎসংশ্লিষ্টদের সব ধরনের ভরণ-পোষণ ও খরচের বিষয়াদি পুরুষের উপরে ন্যস্ত। যা ইসলামী শরী‘আত স্বীকৃত ও নির্দেশিত।আল-মাওয়ারীছ,পৃঃ ১৮-১৯।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর বাণী হ’ল- لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللهُ ‘সম্পদশালীদের উচিৎ যে, সে যেন স্বীয় সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করে এবং যার আয়-উপার্জন কম তার উচিৎ যে, আল্লাহ তাকে যতটুকু দান করেছেন, তা হ’তে সে ব্যয় করবে’ (তালাক ৬৫/৭)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘আর সন্তানের খাদ্য ও বস্ত্র নিয়ম মাফিক জন্মদাতার উপর ন্যস্ত’ (বাক্বারাহ ২/২৩৩)।

মীরাছের বিধান লংঘনের পরিণতি :

মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে সূরা নিসার ১১-১২ ও ১৭৬ নং আয়াতে মীরাছ বণ্টনের নিয়ম-নীতি বর্ণনা করেছেন। যে এই নীতি বাস্তবায়ন করবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত এবং যে তালবাহানা ও কৌশল অবলম্বন করে এ বণ্টনে কম-বেশী করবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

تِلْكَ حُدُودُ اللهِ وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ، وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُوْدَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيْهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِيْنٌ-

‘এগুলি হ’ল আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে এবং তাঁর সীমাসমূহ লংঘন করবে, তিনি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে চিরদিন থাকবে। আর তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি’ (নিসা ৪/১৩-১৪)।

ইসলাম প্রদত্ত মীরাছের বিধান দ্বারা ব্যক্তির অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মহান আল্লাহ মানব জাতির ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্যই এ বিধান অবতীর্ণ করেছেন।

ব্যক্তির হক নষ্টের জন্য ব্যক্তির নিকট থেকেই ক্ষমা নিতে হবে। যদি কেউ ব্যক্তির হক নষ্ট করে মৃত্যুবরণ করে তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন নিজের পুণ্য দিয়ে বা তার পাপ গ্রহণ করে তা পরিশোধ করতে হবে।

 

মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوْا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوْا فَرِيْقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না এবং অন্যের সম্পদ গর্হিত পন্থায় গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তোমরা জেনেশুনে তা বিচারকদের নিকট পেশ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৮)।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

‘তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? ছাহাবীগণ বললেন, আমাদের মাঝে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যার কোন অর্থ ও সামগ্রী নেই। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমার উম্মতের নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যে ছালাত, ছিয়াম ও যাকাতের নেকী নিয়ে ক্বিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে। অথচ সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করেছে, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। তখন তার নেকী হ’তে তাদেরকে পরিশোধ করা হবে। প্রাপ্য পরিশোধের পূর্বে তার নেকী শেষ হয়ে গেলে তাদের পাপ নিয়ে তার উপর চাপানো হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।মুসলিম হা/৪৬৭৮; মিশকাত হা/৫১২৮।

 

বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই মীরাছ বণ্টনের শারঈ বিধান লংঘন করে চলেছে। মীরাছ বণ্টনে শরী‘আতের সীমাকে উপেক্ষা করে নিজ স্বার্থ হাছিলের চেষ্টা করছে। যেমন পিতা কর্তৃক পুত্র সন্তানদেরকে মীরাছ প্রদান করা এবং কন্যাদেরকে বঞ্চিত করা। চাচা কর্তৃক নাবালিকা ভাতিজাদের মীরাছ থেকে বঞ্চিত করা। বিধবা পিতা-মাতাকে বশীভূত করে প্রভাবশালী সন্তান কর্তৃক সম্পদ আত্মসাৎ করা। বড় ভাই কর্তৃক পিতার সম্পদ সুষ্ঠু বণ্টন না করে অন্যান্য ভাই-বোনদের সাধ্যমত বঞ্চিত করা। অপরিচিতা কোন মহিলাকে ফুফু বানিয়ে নিজ ফুফুর জমি জাল দলীল করে আত্মসাৎ করা। কাউকে পিতা বানিয়ে নিজ পিতার জমি জাল দলীল করে প্রভাবশালী পুত্রের আত্মসাৎ করা। অনুরূপ বহু ঘটনা বর্তমান সমাজে অহরহ ঘটছে। ফলে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে অশান্তির দাবানল দাউদাউ করে জ্বলছে।

পরিশেষে বলা যায়, ইসলামের মীরাছ বিধান ন্যায়-নীতিপূর্ণ। এ বিধান পালনে আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর লংঘনে রয়েছে কঠিন শাস্তি। সুতরাং আমরা প্রত্যেককে তার ন্যায্য মীরাছ প্রদান করে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন-আমীন!– ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ

 

 

জাবির ইব্‌নু ‘আবদুল্লাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, একবার আমি অসুস্থ হলাম। তখন রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আবূ বকর (রাঃ) আমার সেবা করলেন। তাঁরা উভয়েই একবার পায়ে হেঁটে আমার কাছে উপস্থিত হলেন। আমি তখন জ্ঞানশূন্য ছিলাম। রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অযু করলেন এবং আমার উপর অযূর পানি ঢেলে দিলেন। আমার জ্ঞান ফিরলে বললাম, হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমার সম্পদের ব্যাপারে কী করব। আমার সম্পদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেব? তিনি আমাকে কোন জওয়াব দিলেন না। অবশেষে উত্তরাধিকারের আয়াত অবতীর্ণ হল। বুখারি (আধুনিক প্রকাশনী- ৬২৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬২৬৮)

ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, (প্রাথমিক অবস্থায় মৃতের ছেড়ে যাওয়া) মাল ছিল সন্তানাদির জন্য আর ওসিয়াত ছিল পিতামাতার জন্য। অতঃপর আল্লাহ্‌ তাত্থেকে কিছু রহিত করে দিয়ে অধিকতর পছন্দনীয়টি প্রবর্তন করেছেন। পুরুষের জন্য দু’জন নারীর অংশের সমান নির্ধারণ করেছেন। আর পিতা–মাতার প্রত্যেকের জন্য এক-ষষ্ঠাংশ নির্ধারণ করেছেন। স্ত্রীর জন্য নির্ধারণ করেছেন (সন্তানের বর্তমানে) এক-অষ্টমাংশ এবং (সন্তানের অবর্তমানে) এক-চতুর্থাংশ। আর স্বামীর জন্য (সন্তানের অবর্তমানে-) অর্ধেক আর (সন্তানের বর্তমানে) চার ভাগের একভাগ। বুখারি  (আধুনিক প্রকাশনী- ৬২৭১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬২৮৩)হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

 

﴿تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ ۚ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ وَذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾

১৩) এগুলো আল্লাহ নির্ধারিত সীমারেখা ৷ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অনুগত্য করবে, তাকে আল্লাহ এমন বাগীচায় প্রবেশ করাবেন, যার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত হবে, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল৷ এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য ৷ 

﴿وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِينٌ﴾

১৪) আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানি করবে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করে যাবে, তাকে আল্লাহ আগুনে ফেলে দেবেন৷ সেখানে সে থাকবে চিরকাল, আর তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনা ও অপমানজনক শাস্তি৷

 

https://www.youtube.com/watch?v=Yp-5Ka4G_co

 

https://www.youtube.com/watch?v=HNxMgdiUY7M

https://www.youtube.com/watch?v=OHGVuYnHp0I