সূরা দোহা (শব্দার্থ ও তাফসীর)

সূরা দোহা

সূরাঃ ৯৩ নং, আয়াত সংখ্যাঃ ১১ –  মাক্কী

শব্দে শব্দে সূরা দোহা জানার জন্য-

https://www.hadithbd.com/quran/byword/detail/?sura=93

 

সূরা সম্পর্কেঃ

এই সূরা অবতরণের কারণ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, একদা নবী (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দু-তিন রাতে তিনি তাহাজ্জুদ পড়লেন না। এক মহিলা তাঁর নিকট এসে বলল, ‘ওহে মুহাম্মাদ! মনে হয় যেন তোমার শয়তান তোমাকে পরিত্যাগ করেছে। কেননা, দু-তিন রাত্রি থেকে দেখছি, সে তোমার নিকট আসে না।’ এর উত্তরে আল্লাহ তাআলা এই সূরা অবতীর্ণ করলেন। (সহীহ বুখারী, সূরা যুহা তাফসীর পরিচ্ছেদ) এই মহিলা আবু জাহলের স্ত্রী উম্মে জামীল ছিল। (ফাতহুল বারী) [বুখারী: ৪৯৫০, ৪৯৫১, ৪৯৮৩]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ওহী আসতে বিলম্ব হয়, এতে করে মুশরিকরা বলতে শুরু করে যে, মুহাম্মদকে তার আল্লাহ্ পরিত্যাগ করেছেন ও তার প্রতি রুষ্ট হয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে সূরা আদ-দ্বোহা অবতীর্ণ হয়। [মুসলিম: ১৭৯৭]

(মক্কায় অবতীর্ণ) এটি মক্কা মু’ আযযমার প্রথম যুগে নাযিল হয়।

বিষয়বস্তু ও মুল বক্তব্য

এর বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেয়া আর এই সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্য ছিল অহী নাযিলের সিলসিলা বন্ধ হয়ে যাবার কারণে তাঁর মধ্যে যে পেরেশানী দেখা দিয়েছিল তা দূর করা ।

প্রথমে আলো ঝলমল দিনের এবং রাতের নীরবতা ও প্রশান্তির কসম খেয়ে তাঁকে এই মর্মে নিশ্চিন্ততা দান করা হয়েছে যে , তার রব তাঁকে মোটেই পরিত্যাগ করেননি এবং তিনি তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হননি। এরপর তাঁকে সুসংবাদ দান করা হয়েছে যে , ইসলামী দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁকে যেসব কঠিন সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হতে হচ্ছে এগুলো মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার। তাঁর জন্য পরবর্তী প্রত্যেকটি পর্যায় পূর্ববর্তী পর্যায় থেকে উন্নততর হয়ে যেতেই থাকবে এবং কিছুদিনের মধ্যেই মহান আল্লাহ তাঁর ওপর এমনভাবে তাঁর দান বর্ষণ করতে থাকবেন যার ফলে তিনি খুশী হয়ে যাবেন। কুরআনের যেসব সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হয় এটি তার অন্যতম। অথচ যে সময় এ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তখন যেসব অসহায় সাহায্য – সম্বলহীন ব্যক্তি মক্কায় সমগ্র জাতির জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ছিল তারা যে কোনদিন এত বড় বিস্ময়কর সাফল্যের মুখ দেখবে এর কোন দূরবর্তী আলামতও কোথাও দেখা যায়নি।

তারপর মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন , আমি তোমাকে পরিত্যাগ করেছি এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছি – এ ধরনের পেরেশানীতে তুমি ভুগছো কেন ? আমি তো তোমার জন্মের দিন থেকেই তোমার প্রতি অবিরাম মেহেরবানী করে আসছি। তুমি এতিম অবস্থায় জন্মলাভ করেছিলে। আমি তোমার প্রতিপালন ও রক্ষাণাবেক্ষণের সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা করেছি। তুমি অনভিজ্ঞ ছিলে। আমি তোমাকে পথের সন্ধান দিয়েছি। তুমি অর্থ – সম্পদহীন ছিলে। আমি তোমাকে বিত্তশালী করেছি। এসব কথা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিচেছ যে , তুমি শুরু থেকেই আমার প্রিয়পাত্র আছো এবং আমার মেহেরবানী , অনুগ্রহ দান স্থায়ীভাবে তোমার সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে সূরা ত্বা- হা’র ৩৭ থেকে ৪২ পর্যন্ত আয়াতগুলোও সামনে রাখতে হবে।

আমি আর একবার তোমার প্রতি অনুগ্রহ করলাম৷

সে সময়ের কথা মনে করো যখন আমি তোমার মাকে ইশারা করেছিলাম, এমন ইশারা যা অহীর মাধ্যমে করা হয়, এই মর্মে এই এ শিশুকে সিন্দুকের মধ্যে রেখে দাও এবং সিন্দুকটি দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও, দরিয়া তাকে তীরে নিক্ষেপ করবে এবং আমার শত্রু ও এ শিশুর শত্রু একে তুলে নেবে৷

আমি নিজের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেছিলাম এবং এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে তুমি আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হও৷

স্মরণ করো, যখন তোমার বোন চলছিল, তারপর গিয়ে বললো, “আমি কি তোমাদের তার সন্ধান দেবো যে এ শিশুকে ভালোভাবে লালন করবে?”এভাবে আমি তোমাকে আবার তোমার মায়ের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি, যাতে তার চোখ শীতল থাকে এবং সে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ না হয়৷ এবং (এটাও স্মরণ করো) তুমি একজনকে হত্যা করে ফেলেছিলে, আমি তোমাকে এ ফাঁদ থেকে বের করেছি এবং তোমাকে বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এসেছি, আর তুমি মাদ্য়ানবাসীদের মধ্যে কয়েক বছর অবস্থান করেছিলে৷ তারপর এখন তুমি এখন তুমি ঠিক সময়েই এসে গেছো৷ হে মূসা!

আমি তোমার নিজের জন্য তৈরী করে নিয়েছি৷

যাও, তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনগুলোসহ এবং দেখো আমার স্মরণে ভুল করো না৷  সূরা ত্বাহাঃ৩৭-৪২

এই আয়াতগুলোতে হযরত মূসাকে ফেরাউনের মতো শক্তিশালী জালেমের বিরুদ্ধে পাঠাবার সময় আল্লাহ তাঁর পেরেশানী দূর করার জন্য তাঁর জন্মের পর থেকে কিভাবে আল্লাহর মেহেরবানী তাঁকে ঘিরে রেখেছিল সে কথা তাঁকে বলেন। এই সংগে তাঁকে একথাও বলেন যে এ অবস্থায় তুমি নিশ্চিত থাকো , এই ভয়াবহ অভিযানে তুমি একাকী থাকবে না বরং আমার মেহেরবানীও তোমার সাথে থাকবে।

সবশেষে মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি যেসব অনুগ্রহ করেছেন তার জবাবে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে তাঁর কি ধরনের আচরণ করা উচিত এবং তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া কিভাবে আদায় করতে হবে একথা তাঁকে জানিয়ে দেন।

৯৩:১ وَ الضُّحٰی ۙ﴿

১. শপথ পূর্বাহ্ণের,

ضُحى পূর্বাহ্ন বা চাশতের ওয়াক্ত ঐ সময়কে বলা হয়, যখন (সকালে) সূর্য একটু উঁচুতে ওঠে। কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য পূর্ণ দিন।

এখানে ‘দুহা’ শব্দটি রাতের মোকাবেলায় ব্যবহার করা হয়েছে তাই এর অর্থ উজ্জ্বল দিবা ৷ সূরা আ’রাফের নিম্নোক্ত আয়াতটিকে এর নজীর হিসেবে পেশ করা যায় :

কি এ ব্যাপারে নির্ভয় হয়ে পড়েছে যে , তাদের ওপর রাতে আমার আযাব আসবে যখন তারা ঘুমিয়ে থাকবে ? আর জনপদের লোকেরা কি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে যে তাদের ওপর দিন দুপুরে আমার আযাব আসবে যখন তারা খেলতে থাকবে ? ” (আরাফঃ৯৭-৯৮ আয়াত 

৯৩:২ وَ الَّیۡلِ اِذَا سَجٰی ۙ﴿

২. শপথ রাতের যখন তা হয় নিঝুম

سَجَى শব্দের অর্থ হল নিঝুম হওয়া। অর্থাৎ, যখন রাত্রি নিঝুম হয়ে যায় এবং তার অন্ধকার পূর্ণরূপে ছেয়ে যায়। যেহেতু তখনই প্রত্যেক জীব স্থির ও শান্ত হয়ে যায়।

এখানে سَجَىٰ এর আরেকটি অর্থ হতে পারে। আর তা হলো, অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া। এখানে দিনের আলো ও রাতের নীরবতা বা অন্ধকারের কসম খেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে, আপনার রব আপনাকে বিদায় দেন নি এবং আপনার প্রতি শক্রিতাও পোষণ করেন নি। একথার জন্য যে সম্বন্ধের ভিত্তিতে এই দুটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে তা সম্ভবত এই যে, রাতের নিঝুমতা ও অন্ধকারাচ্ছন্নতার পর দিনের আলোকমালায় উদ্ভাসিত হওয়ার মতই যেন বিরতির অন্ধকারের পর অহী আগমনের আলো উদ্ভাসিত হয়েছে। [বাদা’ইউত তাফসীর]

৯৩:৩ مَا وَدَّعَکَ رَبُّکَ وَ مَا قَلٰی ؕ﴿

৩. আপনার রব আপনাকে পরিত্যাগ করেন নি এবং শত্রুতাও করেন নি।

এ অনুবাদটি অনেক মুফাস্‌সির করেছেন। [মুয়াস্‌সার, জালালাইন]

এখানে ودع এর আরেকটি অর্থ হতে পারে, আর তা হলো, বিদায় দেয়া। [ফাতহুল কাদীর, আদওয়াউল বায়ান]

হাদীস থেকে জানা যায় ,

কিছুদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহী নাযিল বন্ধ ছিল৷ এ সময়টা কতদিনের ছিল , এ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে৷ ইবনে জুরাইজ ১২ দিন , কালবী ১৫ দিন , ইবনে আব্বাস ২৫ দিন , সুদ্দী ও মুকাতিল এর মেয়াদ ৪৫ দিন বলে বর্ণনা করেছেন৷ মোটকথা , সময়টা এত দীর্ঘ ছিল যে রসুলুল্লাহ ( সা) নিজে এ জন্য ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিলেন এবং বিরোধীরাও তাঁকে বিদ্রুপ করতে শুরু করেছিল৷ কারণ তাঁর ওপর নতুন নতুন সূরা নাযিল হলে তিনি তা লোকদের শুনাতেন৷ তাই দীর্ঘদিন যখন তিনি লোকদেরকে কোন অহী শুনালেন না তখন বিরোধীরা মনে করলো এ কালাম যেখান থেকে আসতো সে উৎস বন্ধ হয়ে গেছে৷

জন্দুব ইবনে আবদুল্লাহ আল বাজালী ( রা) রেওয়ায়াত করেন , যখন জিব্রীল আলাইহিস সালামের আসার সিলসিলা থেমে গেলো , মুশরিকরা বলতে শুরু করলো : মুহাম্মাদকে ( সা) তাঁর রব পরিত্যাগ করেছেন৷ ( ইবনে জারীর , তাবারানী, আবদ ইবনে হুমাইদ , সাঈদ ইবনে মনসূর ও ইবনে মারদুইয়া ) অন্যান্য বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় , রসূল ( সা) এর চাচী আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীলের ঘর ছির তাঁর ঘরের সাথে লাগোয়া৷ সে তাঁকে ডেকে বললো : ” মনে হচ্ছে তোমার শয়তান তোমাকে পরিত্যাগ করেছে৷ ” আউফী ও ইবনে জারীর হযরত ইবনে আব্বাস ( রা) থেকে রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করে বলেন : কয়েকদিন পর্যন্ত জিব্রীলের আসা বন্ধ থাকার কারণে রসূলুল্লাহ ( সা) পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন ৷ অন্যদিকে মুশরিকরা বলতে শুরু করলো , তার রব তার প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তিনি তাকে পরিত্যাগ করেছেন৷ কাতাদাহ ও যাহহাক বর্ণিত মুরসাল হাদীসেও প্রায় এই একই ধরনের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে৷ এ অবস্থায় বিভিন্ন হাদীসে রসূলুল্লাহ (সা) গভীর দুঃখ ও মর্মব্যাথার কথাও বর্ণিত হয়েছে৷ আর এমনটি হওয়াই তো স্বাভাবিক ছিল৷ কারণ প্রেমাম্পদের দিক থেকে বাহ্যত অমনোযোগিতা ও উপেক্ষা , কুফর ও ঈমানের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যাবার পর এই প্রাণন্তকর সংঘাত সংগ্রামের মাঝ দরিয়ায় যে শক্তিটি ছিল তাঁর একমাত্র সহায় তার সাহায্য থেকে বাহ্যত বঞ্চিত হওয়া এবং এর ওপর বাড়তি বিপদ হিসেবে শত্রুদের বিদ্রূপ -ভৎসনা ইত্যাদি এসব কিছু মিলে অবশ্যি তাঁর জন্য মারাত্মক ধরনের পেরেশানী সৃষ্টি করে দিয়েছিল৷ এ অবস্থায় তাঁর মনে বারবার এ সন্দেহ জেগে থাকবে যে , তিনি এমন কোন ভুল তো করেননি যার ফলে তাঁর রব তাঁর প্রতি নারাজ হয়ে গেছেন এবং তিনি হক ও বাতিলের এই লড়াইয়ে তাঁকে একাকী ছেড়ে দিয়েছেন৷

এই অবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেবার জন্য সূরাটি নাযিল হয়৷ এতে দিনের আলোর ও রাতের নিরবতার কসম খেয়ে রসূলুল্লাহকে (সা) বলা হয়েছে : তোমার রব তোমাকে পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি নারাজও হননি৷ একতার জন্য যে সম্বন্ধের ভিত্তিতে এই দু’টি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই যে দিনের আলোকমালায় উদ্ভাসিত হওয়া এবং রাতের নিঝুমতা ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়া যেমন আল্লাহর দিনে মানুষের প্রতি সন্তুষ্ট এবং রাতে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকার জন্য নয় বরং একটি বিরাট বিজ্ঞানময় ব্যবস্থা ও উদ্দেশ্যের আওতাধীনে এই দু’টি অবস্থার উদ্ভব ঠিক তেমনি তোমার কাছে কখনো অহী পাঠানো এবং তা পাঠানো বন্ধ করাও একটি বিরাট বিজ্ঞানময় ব্যবস্থা ও উদ্দেশ্যের আওতাধীনেই হয়ে থাকে৷

মহান আল্লাহ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে অহী পাঠান এবং যখন অহী পাঠান না তখন মনে করতে হবে , তিনি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট এবং তোমাকে ত্যাগ করেছেন — এ ধরনের কোন কথা বা বক্তব্যের কোন সম্পর্ক এখানে নেই৷

এ ছাড়া এই বিষয়বস্তুর সাথে এই কসমের আরো সম্পর্ক রয়েছে৷ তা হচ্ছে এই যে,দিনে সূর্যের কিরণ যদি অনবরত মানুষের ওপর পড়তে থাকে তাহলে তা তাকে ক্লান্ত ও অবশ করে দেবে৷ তাই একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত দিনের আলো বিরাজ করে৷এরপরে রাতের আসা অপরিহার্য হয়ে পড়ে ৷ এভাবে মানুষ ক্লান্তি দূর করতে ও প্রশান্তি লাভ করতে পারে ৷ অনুরূপভাবে অহীর কিরণ যদি অনবরত তোমার ওপর পড়তে থাকে তাহলে তা তোমার স্নায়ুর সহ্যের অতীত হয়ে পড়বে৷ তাই মাঝে মধ্যে ফাতরাতুল অহীর (অহী নাযিলের সিলসিলা বন্ধ হয়ে যাওয়া ) একটি সময়ও আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন৷ এভাবে অহী নাযিল হওয়ার কারণে তোমার ওপর যে চাপ পড়ে তার প্রভাব খতম যাবে এবং তুমি মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারবে৷ অর্থাৎ অহী সূর্যের উদয় যেন উজ্জ্বল দিনের সমতুল্য এবং ফাতরাতুল অহীর সময়টি রাতের প্রশান্তির পর্যায়ভুক্ত৷

*মুরসাল এমন এক ধরনের হাদীসকে বলা হয় যেখানে হাদীসের মূল বর্ণনাকারী হিসেবে সাহাবীর নাম উল্লেখিত হয়নি অর্থাৎ তাবেয়ী সাহাবীর নাম উল্লেখ ছাড়াই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন৷ ইমামদের মধ্যে আবু হানিফা (র) ও মালিক ( র) – ই একমাত্র এ ধরনের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন , এক বর্ণনামতে ইমাম ইবনে হাম্বল ( রা) মুরসাল হাদীসের ভিত্তিতে ফতওয়া দিয়েছেন এবং এর বিপরীত রায়কে রদ করেছেন৷ ( আ’ লামূল মুকিইন , ইবনে কাইয়েম ) –

৯৩:৪ وَ لَلۡاٰخِرَۃُ خَیۡرٌ لَّکَ مِنَ الۡاُوۡلٰی ؕ

৪. আর অবশ্যই আপনার জন্য পরবর্তী সময় পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে শ্রেয়।

মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ সুখবরটি এমন এক সময় দেন যখন মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক ছিল তাঁর সহযোগী এবং অন্যদিকে সমগ্র জাতি ছিল তাঁর বিরোধী৷ বাহ্যত সাফল্যের কোন দূরবর্তী চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না৷

 ইসলামের প্রদীপ মক্কাতে টিম টিম করে জ্বলছিল৷ চতুরদিকে ঝড় উঠেছিল তাকে নিভিয়ে দেবার জন্য ৷ সে সময় আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেন: প্রাথমিক যুগের সংকটে তুমি মোটেই পেরেশান হয়ো না৷ তোমার জন্য পরবর্তী প্রত্যেকটি যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো প্রমাণিত হবে৷ তোমার শক্তি , সম্মান, প্রতিপত্তি ও মর্যাদা দিনের পর দিন বাড়তে থাকবে ৷ তোমার প্রভাব ও অনুপ্রবেশের সীমানা বিস্তৃত হতেই থাকবে৷ আবার এই ওয়াদা কেবল দুনিয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়৷ এর মধ্যে এ ওয়াদাও আছে যে , আখেরাতে তুমি যে মর্যাদা লাভ করবে তা দুনিয়ায় তোমার অর্জিত মর্যাদা থেকে অনেক গুণ বেশী হবে৷ তাবারানী তাঁর আওসাত গ্রন্থে এবং বাইহাকী তাঁর দালায়েল গ্রন্থে ইবনে আব্বাস ( রা) বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন তাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ” আমার পরে আমার উম্মাত যেসব দেশ জয় করবে তা আমার সামনে পেশ করা হয়্‌ তাতে আমি খুব খুশী হই৷ তখন মহান আল্লাহ একথা নাযিল করেন যে , আখেরাত তোমার জন্য দুনিয়া থেকেও ভালো” ৷

এখানে الآخِرَة এবং الْأُولَىٰ শব্দদ্বয়ের প্রসিদ্ধ অর্থ আখেরাত ও দুনিয়া নেয়া হলে এর ব্যাখ্যা হবে যে, আমি আপনাকে আখেরাতে নেয়ামত দান করারও ওয়াদা দিচ্ছি। সেখানে আপনাকে দুনিয়া অপেক্ষা অনেক বেশী নেয়ামত দান করা হবে। [ইবন কাসীর]

তাছাড়া الآخِرَة কে শাব্দিক অর্থে নেয়াও অসম্ভব নয়। অতএব, এর অর্থ পরবর্তীর্ণ অবস্থা; যেমন الْأُولَىٰ শব্দের অর্থ প্রথম অবস্থা। তখন আয়াতের অর্থ এই যে, আপনার প্রতি আল্লাহর নেয়ামত দিন দিন বেড়েই যাবে এবং প্রত্যেক প্রথম অবস্থা থেকে পরবর্তী অবস্থা উত্তম ও শ্রেয় হবে। এতে জ্ঞানগরিমা ও আল্লাহর নৈকট্যে উন্নতিলাভসহ জীবিকা এবং পার্থিব প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি সব অবস্থাই অন্তর্ভুক্ত। আর আপনার জন্য আখেরাত তো দুনিয়া থেকে অনেক, অনেক বেশি উত্তম হবে। [সা’দী]

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ছাটাইতে শোয়ার কারণে তার পার্শ্বদেশে দাগ পড়ে গেল। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, আমাদেরকে অনুমতি দিলে আমরা আপনার জন্য একটি কিছু তৈরী করে দিতাম যা আপনাকে এরূপ কষ্ট দেয়া থেকে হেফাজত করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমার আর এ দুনিয়ার ব্যাপারটি কি? আমি ও দুনিয়ার উদাহরণ তো এমন যেমন কোন সওয়ারী কোন গাছের নীচে বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নিল তারপর সেটা ছেড়ে চলে গেল।” [ইবনে মাজাহঃ ৪১০৯, মুসনাদে আহমাদঃ ১/৩৯১]

৯৩:৫ وَ لَسَوۡفَ یُعۡطِیۡکَ رَبُّکَ فَتَرۡضٰی ؕ﴿

৫. আর অচিরেই আপনার রব আপনাকে অনুগ্রহ দান করবেন, ফলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন।

অর্থাৎ দিতে কিছুটা দেরী হলে সেসময় দূরে নয়,যখন তোমার ওপর তোমার রবের দান ও মেহেরবানী এমনভাবে বর্ষিত হবে যাতে তুমি খুশী হয়ে যাবে৷ এই ওয়াদাটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনেই পূর্ণ হয়েছে৷ সমগ্র আরব ভূখণ্ড ,দক্ষিণের সমুদ্র উপকূল থেকে উত্তরে রোম সাম্রাজ্যের সিরীয় ও পারস্য সাম্রাজ্যের ইরাকী সীমান্ত এবং পূর্বে পারস্য উপসাগর থেকে নিয়ে পশ্চিম লোহিত পর্যন্ত এলাকা তাঁর শাসনাধীনে চলে আসে৷ আরবের ইতিহাসে এই প্রথমবার এই সমগ্র ভূখণ্ডটি একটি আইন ও শাসন ব্যবস্থার আওতাধীন হয়৷যে শক্তিই এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়,সে চূর্ণ – বিচূর্ণ হয়ে যায়৷ লা -ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহর কালেমায় সমগ্র দেশ গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে ৷ যে দেশে মুশরিক ও আহলি কিতাবরা নিজেদের মিথ্যা মতবাদ ও আদর্শকে বিজয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল সেখানে মানুষ কেবল আনুগত্যের শিরই নত করেনি বরং তাদের মনও বিজিত হয়ে যায় এবং তাদের বিশ্বাসে ,নৈতিক চরিত্রে ও কর্মকাণ্ডে বিরাট বিপ্লব সাধিত হয়৷ জাহেলিয়াতের গভীর পংকে নিমজ্জিত একটি জাতি মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে এমনভাবে বদলে যায় যে ,সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে এর কোন নজীর নেই৷ এরপর নবী (সা ) যে আন্দোলনের বীজ বপন করে গিয়েছিলেন তা বিপুল শক্তিমত্তা সহকারে জেগে ওঠে এবং এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা তিন মহাদেশের বিরাট অংশে ছেয়ে যায় এবং দুনিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার প্রভাব চড়িয়ে পড়ে৷ এসব মহান আল্লাহ তাঁর রসূলকে দিয়েছেন দুনিয়ায়৷ আর আখেরাতে তাঁকে যা কিছু যা দেবেন তার বিপুলতা ও মহত্বের কল্পনাই করা যাবে না৷ ( দেখুন তাফহীমূল কুরআন ,সূরা ত্বা -হা ১১২ টীকা )

আপনার পালনকর্তা আপনাকে এত প্রাচুর্য দেবেন যে, আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। এতে কি দিবেন, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, প্রত্যেক কাম্যবস্তুই প্রচুর পরিমাণে দেবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাম্যবস্তুসমূহের মধ্যে ছিল ইসলামের ও কুরআনের উন্নতি, সারা বিশ্বে হিদায়াতের প্রসার, শত্রুর বিরুদ্ধে তার বিজয়লাভ, শত্রুদেশে ইসলামের কালেমা সমুন্নত করা ইত্যাদি। আর তার মৃত্যুর পর হাশরের ময়দানে ও জান্নাতেও তাকে আল্লাহ তা’আলা অনেক অনুগ্রহ দান করবেন। [বাদা’ইউত তাফসীর]

হাদীসে আছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট পরবর্তীতে যে সমস্ত জনপদ বিজিত হবে তা একটি একটি করে পেশ করা হচ্ছিল। এতে তিনি খুশী হলেন, তখন আল্লাহ্ তা’আলা “অচিরেই আপনার রব আপনাকে এমন দান করবেন যে আপনি সস্তুষ্ট হয়ে যাবেন” এ আয়াত নাযিল করলেন। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে জান্নাতে হাজার প্রাসাদের মালিক বানালেন। প্রতিটি প্রাসাদে থাকবে প্রাসাদ উপযোগী খাদেম ও ছোট ছোট বাচ্চারা। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৫২৬]

৯৩:৬ اَلَمۡ یَجِدۡکَ یَتِیۡمًا فَاٰوٰی ۪﴿

৬. তিনি কি আপনাকে ইয়াতীম অবস্থায় পান নি? অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন

তোমাকে ত্যাগ করার ও তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না ৷ যখন তুমি এতিম অবস্থায় জন্মলাভ করেছিলে তখন থেকেই তো আমি তোমার প্রতি মেহেরবানী করে আসছি৷ মায়ের গর্ভে থাকাকালীন ছয় মাসের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতা ইন্তিকাল করেন৷ কাজেই এতিম হিসেবেই তিনি পৃথিবীতে আসেন৷ কিন্তু এ অবস্থায় মহান আল্লাহ একদিনও তাঁকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেননি৷ ছ’বছর বয়স পর্যন্ত মা তাঁকে লালন -পালন করতে থাকেন ৷

 তাঁর স্নেহছায়া থেকে বঞ্চিত হবার পর থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর দাদা তাঁকে প্রতিপালন করেন৷ দাদা কেবল তাকে অত্যন্ত ভালোবাসাতেনই তাই না বরং তাঁর জন্য গর্বও করতেন৷তিনি লোকদের বলতেন, আমার এই ছেলে একদিন দুনিয়ায় বিপুল খ্যাতির অধিকারী হবে৷তার ইন্তিকালের পর চাচা আবু তালিব তাঁর লালন – পালনের দায়িত্ব নেন৷চাচা তাঁর সাথে এমন প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করেন যে , কোন পিতার পক্ষেও এর চেয়ে বেশী প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করা সম্ভব নয়৷ এমনকি নবুওয়াত লাভের পর সমগ্র জাতি যখন তাঁর শক্র হয়ে গিয়েছিল তখন দশ বছর পর্যন্ত তিনিই তার সাহায্যার্থে চীনের প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন৷

৯৩:৭ وَ وَجَدَکَ ضَآلًّا فَہَدٰی ۪﴿

৭. আর তিনি আপনাকে পেলেন পথ সম্পর্কে অনবহিত, অতঃপর তিনি পথের নির্দেশ দিলেন।

দ্বিতীয় নি’আমত হচ্ছে, আপনাকে ضال পেয়েছি।

এ শব্দটির অর্থ পথভ্রষ্টও হয় এবং অনভিজ্ঞ, অনবহিত বা গাফেলও হয়। এখানে দ্বিতীয় অর্থই উদ্দেশ্য। নবুওয়ত লাভের পূর্বে তিনি আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে, ঈমান সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন। অতঃপর নবুওয়তের পদ দান করে তাকে পথনির্দেশ দেয়া হয়, যা তিনি জানতেন না তা জানানো হয়; সর্বোত্তম আমলের তৌফিক দেওয়া হয়। [কুরতুবী, মুয়াস্‌সার]

মূলে “দাল্লান  শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এটি এসেছে “দালালাত ” থেকে ৷এর কয়েকটি অর্থ হয়৷

এর একটি অর্থ গোমরাহী৷

 দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে ,এক ব্যক্তি পথ জানে না , এক জায়গায় গিয়ে সে সামনে বিভিন্ন পথ দেখে কোন পথে যাবে তা ঠিক করতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে ৷

 এর আর একটি অর্থ হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া বা হারানো জিনিস৷

আরবী প্রবাদে বলা হয় অর্থাৎ পানি দুধের মধ্যে হারিয়ে গেছে৷ মরুভূমির মধ্যে যে গাছটি একাকি দাঁড়িয়ে থাকে এবং তার আশেপাশে কোন গাছ থাকে না তাকেও আরবীতে ” দাল্লাহ ” বলা হয়৷ নষ্ট হয়ে যাওয়া অর্থেও ” দালাল ” ( আরবী ) বলা হয়৷ আবার গাফলতির জন্যও ” দালাল ” ব্যবহার করা হয়৷ যেমন কুরআন মজীদে এর দৃষ্টান্ত ” দেখা যায় অর্থাৎ আমার রব না গাফেল হন আর না তিনি ভুলে যান৷ ( ত্বা- হা ৫২ )

এই বিভিন্ন অর্থের মধ্য থেকে প্রথম অর্থটি এখানে খাপ খায় না৷ কারণ ইতিহাসে রসূলের শৈশব থেকে নিয়ে নবুওয়াত লাভ করার পূর্ব পর্যন্ত সময় কালের যেসব অবস্থা লিপিবদ্ধ রয়েছে তাতে কোথাও তিনি কখনো মূর্তিপূজা , শিরক বা নাস্তিক্যবাদে লিপ্ত হয়েছিলেন অথবা তাঁর জাতির মধ্যে যেসব জাহেলী কার্যকলাপ , রীতিনীতি ও আচার আচরণের প্রচলন ছিল তার সাথেও তিনি কোনক্রমে জড়িতে হয়েছিলেন বলে সামান্যতম কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না৷ তাই বাক্যে কোনক্রমেই এ অর্থ হতে পারে না যে , আল্লাহ তাঁকে বিশ্বাস ও কর্মের দিক থেকে গোমরাহ হিসেবে পেয়েছিলেন৷ তবে অন্যান্য অর্থগুলো কোন না কোনভাবে এখানে খাপ খেতে পারে৷ বরং বিভিন্ন দিক থেকে হয়তো প্রত্যেকটি অর্থই এখানে কার্যকর হতে পারে৷ নবুওয়াত লাভের পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর অস্তিত্বে ও তাঁর একত্বে বিশ্বাসী ছিলেন , এতে সন্দেহ নেই৷ সে সময় তাঁর জীবন গোনাহ মুক্ত এবং নৈতিক গুণাবলী সমন্বিত ছিল৷ কিন্তু সত্যদীন এবং তার মূলনীতি ও বিধান সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না৷ যেমন কুরআনে বলা হয়েছে :

 ” তুমি জানতে না কিতাব কি এবং ঈমানই বা কি ৷” ( আশশুরা ৫২ আয়াত ) এ আয়াতের এ অর্থও হতে পারে যে , নবী ( সা) একটি জাহেলী সমাজের বুকে হারিয়ে গিয়েছিলেন এবং নবুওয়াত লাভের আগে একজন পথপ্রদর্শক ও পথের দিশা দানকারী হিসেবে তাঁর ব্যক্তিত্ব সুস্পষ্ট হয়ে সামনে আসেনি৷

এর এ অর্থও হতে পারে যে , জাহেলিয়াতের মরুভূমিতে আপনি দাঁড়িয়েছিলেন একটি নিসংগ বৃক্ষের মতো৷ এই বৃক্ষের ফল উৎপাদনের ও চারাগাছ বৃদ্ধি করে আর একটি বাগান তৈরি করার যোগ্যতা ছিল৷ কিন্তু নবুওয়াতের পূর্বে এ যোগ্যতা কোন কাজে লাগেনি৷

এ অর্থে হতে পারে যে , মহান আল্লাহ আপনাকে অসাধারন ক্ষমতা দান করেছিলেন৷ জাহেলিয়াতের অনুপযোগী ও বিরোধী পরিবেশে তা নষ্ট হতে বসেছিল৷ “দালাল” কে গাফলতির অর্থেও ব্যবহার করা যেতে পারে৷ অর্থাৎ নবুওয়াত লাভের পরে আল্লাহ তাঁকে যেসব জ্ঞান ও সত্যের সাথে পরিচিত করিয়েছেন ইতিপূর্বে তিনি সেগুলো থেকে গাফেল ছিলেন৷ কুরআনেও এক জায়গায় বলা হয়েছে৷

” আর যদিও তুমি ইতিপূর্বে এসব বিষয়ে গাফেল ছিলে৷” ( ইউসুফ ৩)

৯৩:৮ وَ وَجَدَکَ عَآئِلًا فَاَغۡنٰی ؕ

৮. আর তিনি আপনাকে পেলেন নিঃস্ব অবস্থায়, অতঃপর অভাবমুক্ত করলেন

তৃতীয় নেয়ামত হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা আপনাকে নিঃস্ব ও রিক্তহস্ত পেয়েছেন; অতঃপর আপনাকে অভাবমুক্ত করেছেন এবং ধৈর্যশীল ও সন্তুষ্ট করেছেন। এখানে أَغْنَىٰ বলতে দুটি অর্থ হতে পারে। এক অর্থ, তিনি আপনাকে ধনশালী করেছেন। অপর অর্থ, তিনি আপনাকে তাঁর নেয়ামতে সন্তুষ্ট করেছেন। [দেখুন: ইবন কাসীর, মুয়াস্‌সার]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৈতৃক সূত্রে উত্তরাধিকার হিসেবে শুধুমাত্র একটি উটনী ও একটি বাঁদী লাভ করেছিলেন৷ এভাবে দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের সূচনা হয়৷ তারপর এমন এক সময় আসে যখন মক্কার সবচেয়ে ধনী মহিলা হযরত খাদীজা (রা ) প্রথমে ব্যবসায়ে তাঁকে নিজের সাথে শরীক করে নেন৷তারপর তিনি তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হন৷ এভাবে তাঁর সমস্ত ব্যবসায়ের দায়িত্বও তিনি নিজের হাতে তুলে নেন৷এই সুবাদে তিনি কেবল ধনীই হননি এবং তাঁর ধনাঢ্যতা নিছক স্ত্রীর ধনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না বরং তাঁর ব্যবসায়ের উন্নতি বিধানে তাঁর নিজের যোগ্যতা ও শ্রম বিরাট ভূমিকা পালন করে৷

অভাবমুক্ত করলেন’ অর্থাৎ, তিনি ছাড়া অন্যান্য থেকে তোমাকে অমুখাপেক্ষী করলেন। সুতরাং তুমি অভাবী অবস্থায় ধৈর্যশীল এবং অভাবমুক্ত অবস্থায় কৃতজ্ঞ হলে। যেমন খোদ নবী (সাঃ)ও বলেছেন যে, মাল ও আসবাবপত্রের আধিক্যই ধনবত্তা নয়; বরং আসল ধনবত্তা হল অন্তরের ধনবত্তা। (সহীহ মুসলিম যাকাত অধ্যায়, অধিকাধিক মালের মালিক ধনী নয় পরিচ্ছেদ।)

৯৩:৯ فَاَمَّا الۡیَتِیۡمَ فَلَا تَقۡہَرۡ ؕ

. কাজেই আপনি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হবেন না।

এ নি’আমতগুলো উল্লেখ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কয়েকটি বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রথম নির্দেশ হচ্ছে, ইয়াতিমের সাথে কঠোর ব্যবহার করবেন না। অর্থাৎ আপনি কোন পিতৃহীনকে অসহায় ও বেওয়ারিশ মনে করে তার ধন-সম্পদ জবরদস্তিমূলকভাবে নিজ অধিকারভুক্ত করে নেবেন না। এর মাধ্যমে সকল উম্মতকেই ইয়াতীমের সাথে সহৃদয় ব্যবহার করার জোর আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং বেদনাদায়ক ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছেন। [বাদা’ই’উত তাফসীর]

যেহেতু তুমি নিজে এতিম ছিলে ,আল্লাহ তোমার প্রতি মেহেরবানী করেছেন এবং এতিম অবস্থায় সর্বোত্তম পদ্ধতিতে তোমাকে সাহায্য – সহায়তা দান করেছেন ,তাই আল্লাহর এই সাহায্যের জন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তুমি কখনো কোন এতিমের প্রতি জুলুম করবে না৷

৯৩:১০ وَ اَمَّا السَّآئِلَ فَلَا تَنۡہَرۡ ﴿ؕ

১০. আর প্রার্থীকে ভর্ৎসনা করবেন না।

এর দু’টি অর্থ হয়৷ যদি প্রার্থীকে সাহায্য প্রার্থনাকরী অভাবী হিসেবে ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হয় , তাকে সাহায্য করতে পারলে করো আর না করতে পারলে কোমল স্বরে তাকে নিজের অক্ষমতা বুঝিয়ে দাও৷ কিন্তু কোনক্রমে তার সাথে রূঢ় ব্যবহার করো না ৷

এই অর্থের দিক দিয়ে নির্দেশটিকে আল্লাহর সেই অনুগ্রহের জবাবে দেয়া হয়েছে বলা যেতে পারে , যাতে বলা হয়েছে ” তুমি অভাবী ছিলে তারপর আল্লাহ তোমাকে ধনী করে দিয়েছেন৷ আর যদি প্রার্থীকে জিজ্ঞেসকারী অর্থাৎ দীনের কোন বিষয় বা বিধান জিজ্ঞেসকারী অর্থে ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হয় , এই ধরনের লোক যতই মূর্খ ও অজ্ঞ হোক না কেন এবং যতই অযৌক্তিক পদ্ধতিতে সে প্রশ্ন করুক বা নিজের মানসিক সংকট উপস্থাপন করুক না কেন , সকল অবস্থায়ই স্নেহশীলতা ও কোমলতা সহকারে তাকে জবাব দাও এবং জ্ঞানের অহংকারে বদমেজাজ লোকদের মতো ধমক দিয়ে বা কড়া কথা বলে তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ো না৷ এই অর্থের দিক দিয়ে এই বাণীটিকে আল্লাহর সেই অনুগ্রহের জবাবে দেয়া হয়েছে বলা যেতে পারে , যাতে বলা হয়েছে

 — ” তুমি পথের খোঁজ জানতে না তারপর তিনিই তোমাকে পথনির্দেশনা দিয়েছে৷

” হযরত আবু দারদা (রা), হাসান বসরী ( র) , সুফিয়ান সওরী (র) এবং অন্যান্য কয়েকজন মনীষী এই দ্বিতীয় অর্থটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন ৷ কারণ তাদের মতে বক্তব্য বিন্যাসের দিক দিয়ে বিচার করলে এ বক্তব্যটি এর জবাবেই দেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়৷

প্রার্থীকে দিতে হবে ৩টি জিনিষঃ

১। দ্বীনের জ্ঞান

২। আর্থিক সাহায্য (লোন হতে পারে), ভিক্ষা

৩। পথের সন্ধান

৯৩:১১ وَ اَمَّا بِنِعۡمَۃِ رَبِّکَ فَحَدِّثۡ

১১. আর আপনি আপনার রবের অনুগ্রহের কথা জানিয়ে দিন।

নিয়ামত শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক৷ এর অর্থ এমন সব নিয়ামত হয় , যা এই সূরাটি নাযিল হওয়ার সময় পর্যন্ত আল্লাহ তাঁর রসূলকে দান করেছিলেন ৷ আবার এমন সব নিয়মিতও হয় , যা এই সূরায় প্রদত্ত নিজের ওয়াদা এবং পরবর্তীকালে তা পূর্ণতা দান প্রসংগে তিনি রসূলকে প্রদান করেছিলেন৷ এর ওপর আবার হুকুম দেয়া হয়েছে , হে নবী ! আল্লাহ তোমাকে যেসব নিয়মিত দান করেছেন তার প্রত্যেকটির কথা স্মরণ কর ৷ এ নিয়ামত বিশেষ আকারে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় ৷

সামগ্রিকভাবে সমস্ত নিয়ামত প্রকাশের পদ্ধতি নিম্নরূপ :

মুখে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে এবং একথার স্বীকৃতি দিতে হবে যে , আমি যেসব নিয়ামত লাভ করেছি সবই আল্লাহর মেহেরবানী ও অনুগ্রহের ফল৷ নয়তো এর মধ্যে কোন একটিও আমার নিজের ব্যক্তিগত উপার্জনের ফসল নয় ৷

দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করে নবুওয়াতের নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে ৷

লোকদের মধ্যে বেশী বেশী করে কুরআন প্রচার করে এবং তার শিক্ষাবলীর সাহায্যে মানুষের হৃদয়দেশ আলোকিত করে কুরআনের নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে৷

পথহারা মানুষদের সরল সত্য পথ দেখিয়ে দিয়ে এবং সবরের সাহায্যে এই কাজের যাবতীয় তিক্ততা ও কষ্টের মোকাবেলা করে হেদায়ত লাভের নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে৷

এতিম অবস্থায় সাহায্য – সহায়তা দান করে আল্লাহ যে অনুগ্রহ দেখিয়েছেন এতিমদের সাথে ঠিক তেমনি অনুগ্রহপূর্ণ ব্যবহার করে এই নিয়ামতটি প্রকাশ করা যেতে পারে৷

 দারিদ্র্য ও অভাব থেকে সচ্ছলতা ও ধনাঢ্যতা দান করার জন্য যে অনুগ্রহ আল্লাহ করেছেন অভাবী মানুষদের সাহায্য করেই সেই নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে৷

মোটকথা , আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ ও নিয়ামতসমূহ বর্ণনা করার পর একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যের মাধ্যমে তাঁর রসূলকে এই গভীর ও ব্যাপক অর্থপূর্ণ হেদায়াত দান করেন৷

তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে, মানুষের সামনে আল্লাহর নেয়ামতসমূহ বৰ্ণনা করুন, স্মরণ করুন। নিয়ামত শব্দটি ব্যাপক অৰ্থবোধক। এর অর্থ দুনিয়ার নিয়ামতও হতে পারে আবার এমন-সব নিয়ামতও হতে পারে যা আল্লাহ তা’আলা আখেরাতে দান করবেন। [সা’দী] এ নিয়ামত প্ৰকাশ করার পদ্ধতি বিভিন্ন হতে পারে। সামগ্রিকভাবে সমস্ত নিয়ামত প্রকাশের পদ্ধতি হলো আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, স্বীকৃতি দেয়া যে, আমি যেসব নিয়ামত লাভ করেছি সবই আল্লাহর মেহেরবানী ও অনুগ্রহের ফল। নবুওয়াতের এবং অহীর নিয়ামত প্রকাশ করা যেতে পারে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার করার মাধ্যমে। এ-ছাড়া, একজন অন্যজনের প্রতি যে অনুগ্রহ করে, তার শোকর আদায় করাও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক পন্থা। হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি অপরের অনুগ্রহের শোকর আদায় করে না, সে আল্লাহ তা’আলারও শোকর আদায় করে না। [আবু দাউদ: ৪৮১১, তিরমিযী: ১৯৫৫, মুসনাদে আহমাদ: ২/৫৮] [কুরতুবী]

لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيْدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذابِيْ لَشَدِيْدٌ.

তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা আদায় কর তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অস্বীকার কর তাহলে আমার আজাব অবশ্যই কঠিন। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৭

‘হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা.’ নামটি অজানা থাকার কথা নয়। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তাঁর এই প্রিয় সাহাবীটির হাত ধরে বললেন, ‘মুআয! আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

সাহাবী মুআয রা.-ও তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘আমার মা-বাবা আপনার জন্যে উৎসর্গিত হোক! আল্লাহর কসম, আমিও আপনাকে ভালোবাসি।’ এভাবে ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘মুআয! আমি তোমাকে বলছি, কখনোই নামাযের পরে এ দুআটি পড়তে ভুল করো না-

اللّهُمَّ أَعِنِّيْ عَلٰى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ  .

হে আল্লাহ! আপনার জিকির, আপনার কৃতজ্ঞতা ও শোকর আদায় এবং সুন্দর করে আপনার ইবাদত করতে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১১৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫২৪

সংগৃহিতঃ

তাফসীরে যাকারিয়া, আহসানুল বয়ান ও তাফহীমুল কুর’আন থেকে নেয়া।