সূরা কাহফ ৭ম রুকুঃ ( ৫০-৫৩ আয়াত)

সূরা কাহফ

৭ম রুকুঃ ( ৫০-৫৩ আয়াত)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

 

১৮:৫০ وَ اِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اسۡجُدُوۡا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوۡۤا اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ کَانَ مِنَ الۡجِنِّ فَفَسَقَ عَنۡ اَمۡرِ رَبِّهٖ ؕ اَفَتَتَّخِذُوۡنَهٗ وَ ذُرِّیَّتَهٗۤ اَوۡلِیَآءَ مِنۡ دُوۡنِیۡ وَ هُمۡ لَکُمۡ عَدُوٌّ ؕ بِئۡسَ لِلظّٰلِمِیۡنَ بَدَلًا ﴿

৫০. আর স্মরণ করুন, আমরা যখন ফিরিশতাদেরকে বলেছিলাম, আদমের প্রতি সিজদা কর, তখন তারা সবাই সিজদা করল ইবলীস ছাড়া; সে ছিল জিন্‌দের একজন সে তার রব-এর আদেশ অমান্য করল। তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে, অথচ তারা তোমাদের শত্রু। যালেমদের বিনিময় কত নিকৃষ্ট!

ইবলিস কি ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল নাকি ভিন্ন প্রজাতির ছিল এ নিয়ে দুটি মত দেখা যায়। [দুটি মতই ইবন কাসীর বর্ণনা করেছেন।] কোন কোন মুফাসসিরের মতে, সে ফিরিশতাদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন তাদের মতে, এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলার বাণী “সে জিনদের একজন” এর ‘জিন’ শব্দ দ্বারা ফেরেশতাদের এমন একটি উপদল উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে, যাদেরকে ‘জিন’ বলা হতো। সম্ভবত: তাদেরকে মানুষের মত নিজেদের পথ বেছে নেয়ার এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল। সে হিসেবে ইবলিস আল্লাহ তা’আলার নির্দেশের আওতায় ছিল। কিন্তু সে নির্দেশ অমান্য করে। অবাধ্য ও অভিশপ্ত বান্দা হয়ে যায়। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে ইবলীস ফেরেশতাদের দলভুক্ত ছিল না।

তারা আলোচ্য আয়াত থেকে তাদের মতের সপক্ষে দলীল গ্রহণ করেন। ফেরেশতাদের ব্যাপারে কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় বলে, তারা প্রকৃতিগতভাবে অনুগত ও হুকুম মেনে চলেঃ “আল্লাহ তাদেরকে যে হুকুমই দেন না কেন তারা তার নাফরমানী করে না এবং তাদেরকে যা হুকুম দেয়া হয় তাই করে” [সূরা আত-তাহরীমঃ ৬] আরো বলেছেনঃ

“তারা অবাধ্য হয় না, তাদের রবের, যিনি তাদের উপর আছেন, ভয় করে এবং তাদেরকে যা হুকুম দেয়া হয় তাই করে।” [সূরা আন-নাহলঃ ৫০]। তাছাড়া হাদীসেও এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে তৈরী করা হয়েছে, ইবলীসকে আগুনের ফুল্কি থেকে এবং আদমকে যা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা তোমাদের কাছে বিবৃত করা হয়েছে৷ [মুসলিম: ২৯৯৬]

এতে বুঝা যাচ্ছে যে, জিনরা মানুষের মতো একটি স্বাধীন ক্ষমতাসম্পন্ন সৃষ্টি। তাদেরকে জন্মগত আনুগত্যশীল হিসেবে সৃষ্টি করা হয়নি। বরং তাদেরকে কুফর ও ঈমান এবং আনুগত্য ও অবাধ্যতা উভয়টি করার ক্ষমতা দান করা হয়েছে। এ সত্যটিই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইবলীস ছিল জিনদের দলভুক্ত, তাই সে স্বেচ্ছায় নিজের স্বাধীন ক্ষমতা ব্যবহার করে ফাসেকীর পথ বাছাই করে নেয়। এখানে আল্লাহর নির্দেশ থেকে অবাধ্য হয়েছিল। এর দুটি অর্থ করা হয়ে থাকে।

এক, সে আল্লাহর নির্দেশ আসার কারণে অবাধ্য হয়েছিল। কারণ সিজদার নির্দেশ আসার কারণে সে সিজদা করতে অস্বীকার করেছিল। এতে বাহ্যত: মনে হবে যে, আল্লাহর নির্দেশই তার অবাধ্যতার কারণ। অথবা

দুইঃ আয়াতের অর্থ, আল্লাহর নির্দেশ ত্যাগ করে সে অবাধ্য হয়েছিল। [ফাতহুল কাদীর]

তবে ইবলীস ফেরেশতাদের দলভুক্ত না হয়েও নির্দেশের অবাধ্য কারণ হচ্ছে, যেহেতু ফেরেশতাদের সাথেই ছিল, সেহেতু সিজদার নির্দেশ তাকেও শামিল করেছিল। কারণ, তার চেয়ে উত্তম যারা তাদেরকে যখন সিজদা করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে তখন সে নিজেই এ নির্দেশের মধ্যে শামিল হয়েছিল এবং তার জন্যও তা মানা বাধ্যতামূলক ছিল। [ইবন কাসীর]

(৩) وَذُرِّيَّتَهُ এ শব্দ থেকে বোঝা যায় যে, শয়তানের সন্তান-সন্ততি ও বংশধর আছে। কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এখানে ذرّية অর্থাৎ বংশধর বলে সাহায্যকারী দল বোঝানো হয়েছে। কাজেই শয়তানের ঔরসজাত সন্তান-সন্ততি হওয়া জরুরী নয়। [ফাতহুল কাদীর]

(৪) উদ্দেশ্য হচ্ছে পথভ্রষ্ট লোকদেরকে তাদের এ বোকামির ব্যাপারে সজাগ করে দেয়া যে, তারা নিজেদের স্নেহশীল ও দয়াময় আল্লাহ যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যত নেয়ামত তোমার প্রয়োজন সবই সরবরাহ করেছেন এবং শুভাকাংখী নবীদেরকে ত্যাগ করে এমন এক চিরন্তন শত্রুর ফাঁদে পা দিচ্ছে যে সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই তাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সবসময় তোমার ক্ষতি করার অপেক্ষায় থাকে। [ফাতহুল কাদীর]

(৫) যালেম তো তারা, যারা প্রতিটি বস্তুকে তার সঠিক স্থানে না রেখে অন্য স্থানে রেখেছে। তাদের রবের ইবাদাতের পরিবর্তে শয়তানের ইবাদাত করেছে। এত কত নিকৃষ্ট অদল-বদল! আল্লাহকে বাদ দিয়ে শয়তানের ইবাদাত! [ফাতহুল কাদীর] অন্য আয়াতেও আল্লাহ্ তা’আলা তা বলেছেন, “আর হে অপরাধীরা! তোমরা আজ পৃথক হয়ে যাও, হে বনী আদম! আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেইনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? আর আমারই ইবাদাত কর, এটাই সরল পথ। শয়তান তো তোমাদের বহু দলকে বিভ্রান্ত করেছিল, তবুও কি তোমরা বুঝনি?” [সূরা ইয়াসীন: ৫৯–৬২]

আরবি ভাষায় শয়তান شَيْطَانٌ) মানে- সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক, স্বৈরাচারি। এই বৈশিষ্ট্যের জ্বীন এবং মানুষ উভয়ের জন্যেই শয়তান পরিভাষা ব্যবহার করা হয়।

شَيْطَانٌ-এর বহুবচন شَيَاطِيْنٌ। শয়তান শব্দটি একটি পরিভাষা হিসেবে প্রাচীন কাল থেকেই সকল ধর্মের লোকদের কাছে একটি সুপরিচিত শব্দ।

শয়তান কথাটি সর্বপ্রথম সেই জ্বীনটির জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে, যে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে প্রথম মানুষ আদম আলাইহিস্ সালামকে সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়। শয়তান বলতে কী বুঝায় সে ব্যাপারে আলেমদের বক্তব্য তুলে ধরা হল:

◈ বিশিষ্ট ভাষাবিদ, ফিকাহ বিদ ও হাদিস বিদ আবু উবাইদ কাসেম বিন সাল্লাম [জন্ম: ১৫৭ হি:-২২৪ হি:] বলেন:

الشيطان كل عات متمرد من إنس, أو جن

“প্রত্যেক অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘণকারীকে শয়তান বলা হয়।” (বাহরুল উলুম লিস সামারকান্দি ১/২৭৭)

শয়তান দু প্রকার। যথা:

◉ ক. জ্বীন রূপী শয়তান।

◉ খ. মানুষ রূপী শয়তান।

শয়তানকে কুরআন মজিদে ইবলিসও বলা হয়েছে।

بَلَسٌ ও اِبْلاَسٌ শব্দমূল থেকে اِبْلِيْسٌ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হলো, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া, ভয়ে ও আতংকে নিথর হয়ে যাওয়া, দু:খে ও শোকে মনমরা হয়ে যাওয়া, সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলা এবং হতাশা ও ব্যর্থতার ফলে মরিয়া (desperate) হয়ে উঠা।

শয়তানকে ইবলিস বলার কারণ হলো, হতাশা ও নিরাশার ফলে তার আহত অহমিকা প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মরণ খেলায় নেমে সব ধরণের অপরাধ সংঘটনে উদ্যত হয়।

শয়তান ফিরিশতাদের জাতিভুক্ত ছিল না। বরং স্বয়ং কুরআনের বিবৃতি অনুযায়ী সে ছিল জ্বিন জাতির একজন। (সূরা কাহা্ফ ৫০) তবে আসমানে ফিরিশতাদের সাথে থাকার কারণে সেও আল্লাহর সিজদা করতে বলার সেই আদেশের আওতাভুক্ত ছিল, যা তিনি ফিরিশতাদেরকে করেছিলেন। আর এই কারণেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তিরস্কারও করা হয়েছে। যদি সে এই আদেশে শামিল না থাকত, তাহলে না তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হত, আর না সে (আল্লাহর দরবার থেকে) বিতাড়িত হত।

قَالَ مَا مَنَعَکَ اَلَّا تَسۡجُدَ اِذۡ اَمَرۡتُکَ ؕ قَالَ اَنَا خَیۡرٌ مِّنۡهُ ۚ خَلَقۡتَنِیۡ مِنۡ نَّارٍ وَّ خَلَقۡتَهٗ مِنۡ طِیۡنٍ

তিনি বললেন, আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কি তোমাকে নিবৃত্ত করল যে, তুমি সিজদা করলে না? সে বলল, আমি তার চেয়ে শ্ৰেষ্ঠ; আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সূরা আরাফঃ১২

শয়তানের এই ওজর আরো অপরাধমূলক। যেমন, বলা হয় যে, পাপের জন্য ওজর পেশ করা আরো বড় পাপ। প্রথমতঃ তার এই ধারণাই ভুল যে, অধিক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারীকে তার থেকে কম শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ব্যক্তির সম্মান প্রদান করার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে না। কারণ, প্রকৃত জিনিস হল আল্লাহর নির্দেশ পালন। তাঁর নির্দেশের সামনে কে শ্রেষ্ঠ আর কে শ্রেষ্ঠ নয় এ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করাই হল তাঁর অবাধ্যতা।

দ্বিতীয়তঃ সে উত্তম হওয়ার দলীল এটাই দিল যে, আমি আগুন থেকে সৃষ্ট, আর সে মাটি থেকে। কিন্তু সে এই মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি ভ্রূক্ষেপও করল না যে, তাঁকে আল্লাহ তাঁর নিজ হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে তাঁর মধ্যে আত্মা দান করেছেন। দুনিয়ার কোন জিনিস কি এই সম্মানের মোকাবেলা করতে পারে?   সংগৃহিত।

ইবলিশ সাজদাহ না করার পিছনে যে কারন তুলে ধরেছিলো–

إِنِّى خَٰلِقٌۢ بَشَرًا مِّن طِينٍ

ইন্নি খা-লিকুন বাশারাম মিন ত্বীন

আমি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি মাটি বা কাদা থেকে।”সূরা সাদঃ ৭১

আল্লাহ যখন এই ঘোষণা দিচ্ছেন তখনো তিনি আদম আঃ কে সৃষ্টি করেননি অর্থাৎ আদম আঃ কে এখনো সৃষ্টি করা হয়নি কিন্তু ঘোষণা জারি করা হয়েছে যে, আল্লাহ এটা করতে যাচ্ছেন। আর এটা হলো খালিকুন বাশারাম মিন ত্বীন। এরপর আল্লাহ্ বলেন:

فَإِذَا سَوَّيْتُهُۥ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِى…

ফা ইজা ছাওওয়াইতুহু ওয়া নাফাখতু ফিইহি মির রুউহি…

তাঁকে যখন আমি ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলবো এবং তার ভিতরে আমার রূহ ফুঁকে দেব…” সূরা সাদঃ ৭১

এখানে فَإِذَا ‘ফা ইজা’র দিকে লক্ষ্য করুন। আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘ইজা’ ব্যবহৃত হয় ভবিষ্যতে ঘটতে যাচ্ছে এমন কিছু বুঝাতে। এগুলোর কোন কিছুই এখনো ঘটেনি কিন্তু সামনে ঘটতে যাচ্ছে। এরপর মহান আল্লাহ্ আরো বললেন-

فَقَعُوا۟ لَهُۥ سَٰجِدِينَ

ফাকা’য়ু লাহু ছা-জিদিইন

তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ে যাও”। সূরা সাদঃ ৭২

▪︎ আল্লাহ বর্ণনা করছেন তিনি আমাদের পিতাকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন এবং আমাদের সৃষ্টি করার জন্য যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে যাচ্ছেন তার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সবার আগে আমি তাঁকে طِينٍ- ‘ত্বীন’ থেকে সৃষ্টি করবো।

এই পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র সৃষ্টি নই যাদের ‘ত্বীন’ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। বস্তুত সকল প্রাণিকুল তথা যত ধরণের প্রজাতি এই পৃথিবীতে বর্তমান আছে তার সবই ‘ত্বীন’ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ এখন যাঁকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন তার মাঝে অতিরিক্ত কিছু ব্যাপারও রয়েছে।

প্রসঙ্গত আমাদের এবং পশুদের মাঝে কমন কিছু ব্যাপার রয়েছে।

খাদ্য সন্ধান করা;

এবং আশ্রয়/বাসস্থান খোঁজা।

এরপর আল্লাহ আরও যোগ করলেন- কেন কাদা থেকে নির্মিত এই সৃষ্টি পৃথিবীতে বর্তমান থাকা অন্য সকল সৃষ্টি থেকে আলাদা?

فَإِذَا سَوَّيْتُهُۥ

ফা ইজা ছাওওয়াইতুহু

যখন আমি তাকে সুষম করে তৈরি করবো বা ভারসাম্যপূর্ণ করবো।

▪︎ এখানে “تسويات” মানে কোনো কারূশিল্পকে নিখুঁত করা, ভারসাম্যপূর্ণ করা।

আল্লাহ তা’আলা এখানে বলছেন, এমনসব মুহূর্তেও ভারসাম্য রক্ষা করার বিস্ময়কর সামর্থ্য মানুষের থাকবে। এরপর তিনি বলেন:

وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِی…

ওয়া নাফাখতু ফিইহি মির রুউহি…

অর্থাৎ তাঁর ভিতরে আমার রূহ ফুঁকে দেব…।

▪︎ অর্থাৎ রুহ, যা আল্লাহ বিশেষভাবে ডিজাইন করেছেন এই মানুষের জন্য, বিশেষ আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, বিশেষ জিনিস যা মানুষকে অনন্য উপায়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত করবে; অসাধারণ শক্তিশালী উপায়ে। আর এ জিনিসটাই মানুষের ভেতর থাকবে। তো এই রুহ মানুষের ভেতর থাকবে, অন্যান্য প্রজাতি বা প্রাণীদের মত নয়। বিশেষ ধরণের এক আধ্যাত্মিক আলো মানুষের ভেতর থাকবে। সুতরাং, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে তিনটি জিনিসের সমন্বয়ে।

তাঁকে মাটি থেকে তৈরি করা হয়েছে,

তাঁকে ভারসাম্যসহ তৈরি করা হয়েছে,

এবং তাঁকে রুহ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

এ তিনটি উপাদান আল্লাহ বর্ণনা করেছেন এই আয়াতে। আর তিনি ফেরেশতাদের এগুলো জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই তিনটি অংশ মানুষ কে বিস্ময়কর করে তুলবে। যখন এই তিনটি জিনিসের সমন্বয় ঘটবে,

فَقَعُوا۟ لَهُۥ سَٰجِدِينَ

ফাকা’য়ু লাহু ছা-জিদিইন

তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ে যাও”।

সমগ্র কুরআনে যদি অনুসন্ধান চালান যে কোথায় আল্লাহ সিজদা নিয়ে কথা বলেছেন; আল্লাহ সিজদা নিয়ে কথা বলেছেন তখন, যখন বিস্ময়কর কিছু ঘটে।

যখন জাদুকরেরা দেখল যে, মূসা আঃ এর লাঠি সাপে পরিণত হয়ে গেলো এবং খেয়ে ফেললো “মা ইয়া’ফিকুন” তারা যা কিছু বানিয়েছিল তার সবকিছু, তারা নিজেদের আর থামিয়ে রাখতে পারেনি, তারা সিজদায় অবনত হয়ে গেলো।”

যখন খ্রিস্টানরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো, তারা কুরআনের তিলাওয়াত শুনল,

تَرٰۤی اَعۡیُنَهُمۡ تَفِیۡضُ مِنَ الدَّمۡعِ

তুমি দেখবে তাদের চক্ষু অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে…।”

یَخِرُّوۡنَ لِلۡاَذۡقَانِ سُجَّدًا

তখন তারা সিজদাবনত হয়ে লুটিয়ে পড়ে।”

▪︎ এখন এসব লোকেরা কেন সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিল? কারণ তারা কুরআনের অলৌকিকতায় এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিল।

কুরআন বার বার বর্ণনা করছে- যখন বিহ্বলকারী কিছু ঘটে, যখন অবিশ্বাস্য কিছু ঘটে, যা আল্লাহ ঘটান আর যা কেবল আল্লাহর পক্ষেই ঘটানো সম্ভব- তখন মানুষ আল্লাহর শক্তিমত্তাকে এতটাই উপলব্ধি করে যে, তাদের উভয় হাঁটু ভাঁজ হয়ে যায়, অহংকার ধূলিসাৎ হয়ে যায়, আর এই কপাল যা আমাদের অহমিকা বহন করে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে- যেটাকে কুরআন সিজদা হিসেবে বর্ণনা করেছে।

ঐতিহাসিকভাবে সকল সংস্কৃতিতে এই কপাল হলো দাম্ভিকতার জায়গা। এ জন্য রাজারা কপালে মুকুট পরে, কব্জিতে নয়। এখনকার সময়ে অবশ্য মানুষ উচ্চ স্ট্যাটাসের চিহ্ন হিসেবে হাতে দামী ঘড়ি পরে। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সকল সংস্কৃতিতে অহংকার প্রকাশের স্থান কোনটি? কপাল, যা কপালে পরা হয়। পাগড়ী কপালে পরা হয়, মুকুট কপালে পরা হয়। এর মাধ্যমে আপনার পদমর্যাদা প্রকাশ করা হয়। এই সমস্ত কিছু মাটি হয়ে যায় যখন আপনি আল্লাহর ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারেন, যখন তাঁর শক্তিমত্তার কাছে অভিভূত হয়ে পড়েন, তখন সাথে সাথে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। কুরআন এ ব্যাপারটাই বার বার তুলে ধরেছে।

আর আল্লাহ তাঁদেরকে বলছেন, এই সৃষ্টিটি এতটাই বিস্ময়কর…যে সুবিশাল মহাবিশ্ব তিনি সৃষ্টি করেছেন, যত কিছু তিনি রেখেছেন এই অত্যাশ্চার্য দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান কাউন-এ (كون), তিনি বলছেন সবকিছুর মাঝে এই একটি সৃষ্টি এতই শক্তিশালী যে, তোমাদের প্রত্যেকেরই বিস্ময়াভিভূত হয়ে যাওয়া উচিত, তিনি যেভাবে আদম আঃ কে সৃষ্টি করেছেন তা দেখে, তোমাদের হতভম্ভ হয়ে যাওয়া উচিত আল্লাহর অত্যাশ্চার্য এই সৃষ্টি দেখে। আর এটা দেখে তাঁরা কি করল? কুরআন এভাবে বলছে এরপর,

فَسَجَدَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ کُلُّهُمۡ اَجۡمَعُوۡنَ

ফেরেশতারা সবাই মিলে সিজদা করল। সূরা সাদঃ ৭৩

এই ঘটনায় আপনি পাচ্ছেন- আল্লাহ যত ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন সকলকে সিজদায় পড়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। কি বিশাল এক মিরাকল, কি বিস্ময়কর এক ব্যাপার ছিল আদম আঃ এর সৃষ্টি! কতটাই না শক্তিশালী এই সৃষ্টি!

যদি এ নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখেন…আবারো বলছি, আদম আঃ কে এখনো সৃষ্টি করা হয়নি। এটা ছিল শুধুমাত্র ঘোষণা যে- তাঁকে আমি (আল্লাহ্) সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। কেন তোমরা এই এতটা বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়বে, কোন কারণে এই সিজদা, কোন ব্যাপারটা এই সিজদাকে ন্যায়ানুগ করে? কেন তাঁরা তাঁদের চেহারা নত করে দিবে তখন? ঠিক এই তিনটা জিনিসের কারণে।

ইন্নি খা-লিকুন বাশারাম মিন ত্বীন- إِنِّى خَٰلِقٌۢ بَشَرًا مِّن طِينٍ

ফা ইজা ছাওওয়াইতুহু- فَإِذَا سَوَّيْتُهُۥ

ওয়া নাফাখতু ফিইহি মির রুউহি- وَ نَفَخۡتُ فِیۡهِ مِنۡ رُّوۡحِی

▪︎ এরপর এসেছে ‘ফা-فا’। এটি হলো ‘ফা সাবাবিইয়া’। অর্থাৎ, সেই জন্য বা সেই অনুসারে সিজদায় পড়ে যাও। ‘ফা’ এখানে সাবাবিইয়া হতে পারে। ‘এমতে’ তোমরা তার সামনে সিজদায় পড়ে যাও। এখন এই ঘোষণাটি জারি করা হলো। আমরা জানি, ইবলিশও ঘোষণাটি শুনলো। সে যদি এই ঘোষণা শুনে থাকে তাহলে, সেও জানে আদম আঃ কে সৃষ্টি করা হয়েছে তিনটি জিনিসের সমন্বয়ে। আমি বার বার তিনটি জিনিসের কথা উল্লেখ করছি। কারণ যেন এটা আপনাদের মাথায় একেবারে বদ্ধমূল হয়ে যায়। তিনটা জিনিস। তিনটা জিনিস। তিনটা জিনিস।

আর আমরা জানি, আল্লাহর আদেশে সকল ফেরেশতাগণ একসাথে আদম আঃ কে সিজদা করলেও ইবলিশ তা করেনি। কারণ সে সৃষ্টিগতভাবে জ্বীনদের অন্তর্ভুক্ত ছিল. কাজেই জ্বীন হিসেবে তার বৈশিষ্ট্য ছিল, সে ইচ্ছে করলেই মহান আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করতে পারে; অপরদিকে ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা মহান আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করতে পারে না। কারণ মানব ও জ্বীন জাতির মত ফেরেশতাদের নিজস্ব স্বাধীন ইচ্ছা নেই যার জন্য তাঁরা আল্লাহর কোন আদেশ স্বেচ্ছায় লঙ্ঘন করবে বরং তাঁরা আল্লাহর প্রতিটি আদেশেই অনুগত এক বান্দা। আমাদের পিতা আদম আঃ এর প্রতি ইবলিশের সিজদার ব্যপারে পবিত্র কুরআনে ঠিক এইভাবে বলা হয়েছে যে, যেখানে মহান আল্লাহ্ বলেছেন:

اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ اِسۡتَکۡبَرَ وَ کَانَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ

ইবলীস ব্যতীত; সে অহংকারী ছিল এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সূরা সাদঃ ৭৪

قَالَ يَٰٓإِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَىَّۖ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنتَ مِنَ ٱلْعَالِينَ

তিনি (আল্লাহ্) বললেনঃ হে ইবলীস! আমি যাঁকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সিজদাহবনত হতে তোকে কিসে বাধা দিল? তুই কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলি নাকি তুই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সূরা সাদঃ ৭৫

قَالَ اَنَا خَیۡرٌ مِّنۡهُ ؕ خَلَقۡتَنِیۡ مِنۡ نَّارٍ وَّ خَلَقۡتَهٗ مِنۡ طِیۡنٍ

সে বলল, “আমি তাঁর চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাঁকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।” সূরা সাদঃ ৭৬

সে শুধু বলেছিল- আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাঁকে (আদম আঃ) কাদা থেকে সৃষ্টি করেছেন। এটা শুধু তিনটা বিষয়ের একটা মাত্র। তাই না? আরও দুইটা জিনিস তো বাকি আছে। সে বাকি দুইটা সম্পর্কেও জানতো। সে ‘তাসবিয়াহ’ তথা মানুষের ভারসাম্য সম্পর্কে জানতো। সে মানুষের ভেতর ফুঁকে দেওয়া রুহ সম্পর্কেও জানতো। কিন্তু ইবলিশ আল্লাহর নিকট অভিযোগ করার সময় এমনভাবে অভিযোগ করলো যেন বাকি দুইটা সম্পর্কে সে অজ্ঞ। কিন্তু সে জানে। তার পূর্ণ জ্ঞান ছিল। কিন্তু সে মানুষের এই দুইটি গুণ সম্পর্কে জানা সত্বেও কেন তা অস্বীকার করেছিল? কারণ বাকি দুইটা বিষয় অস্বীকার করার কারণ হলো- সে যদি অবশিষ্ট দুইটি বিষয়ও স্বীকার করে নেয়, তাহলে তাকে স্বীকার করতে হবে মানুষ আসলে আল্লাহর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। কিন্তু সে যদি শুধু কাদার কথা স্বীকার করে, সে যদি শুধু মাটির কথা স্বীকার করে তাহলে আদম এবং একটি ঘোড়ার মাঝে আর কি পার্থক্য আছে? আদম এবং একটি গরু বা বানরের মাঝে কি আর এমন পার্থক্য আছে? তারা আহার করে, সেও আহার করে। তারা আশ্রয় খোঁজে, সেও আশ্রয় খোঁজে। তাদের বাচ্চাকাচ্চা আছে, তারও বাচ্চাকাচ্চা আছে। সে শুধু একজন আরও উন্নীত এক প্রাণী। এটাই সব। সে দুই পায়ে দাঁড়াতে পারে। তো কি হয়েছে! এটা আর বড় কিছু নয়! সে শুধু আরও বিকশিত এক প্রজাতি। তার মাঝে অতিরিক্ত আর কিছু নেই। তার মাঝে বৃহত্তর কিছুর অস্তিত্ব নেই

অতএব, ইবলিশ ইচ্ছা করেই আমাদের অস্তিত্বের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে অস্বীকার করে। তিনটার মধ্যে…দুইটাকে সে জেনেশুনে অস্বীকার করে। সে যদি এ দুইটা স্বীকার করে নেয় তাহলে আল্লাহর এই বিস্ময়কর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব তাকে স্বীকার করে নিতে হবে। এখন সে মানব জাতিকে ঘৃণা করে। আমাদেরকে এই পদমর্যাদা দেওয়ার কারণে সে আল্লাহকে দোষারোপ করে (নাউযুবিল্লাহ)। সে শপথ করে যে, সে শুধু আদম আঃ কে-ই ব্যর্থ দেখতে চায় না বরং সেই সাথে তাঁর অনাগত সন্তানদের পর্যন্ত সেই ব্যর্থতার ফাঁদে ফেলতে চায়- যা এই সূরায় পরের আয়াতের অংশে বর্ণিত হয়েছে।

কৃতজ্ঞতায়: উস্তাদ নোমান আলী খান        (সংগৃহিত ও সংক্ষিপ্ত)

১৮:৫১ مَاۤ اَشۡهَدۡتُّهُمۡ خَلۡقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لَا خَلۡقَ اَنۡفُسِهِمۡ ۪ وَ مَا کُنۡتُ مُتَّخِذَ الۡمُضِلِّیۡنَ عَضُدًا

৫১. আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকালে আমি তাদেরকে সাক্ষী করিনি এবং তাদের নিজেদের সৃষ্টির সময়ও নয়, আর আমি পথভ্রষ্টকারীদেরকে সাহায্যকারীরূপে গ্রহণকারী নই।

তাদের সৃষ্টি করার সময় আমার কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয়নি। যাদেরকে তোমরা আহ্বান করছ তারা সবাই তোমাদের মতই তাঁর বান্দাহ, কোন কিছুরই মালিক নয়। আসমান ও যমীন সৃষ্টি করার সময় তারা সেখানে ছিল না, তাই দেখার প্রশ্নও উঠে না। অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ

“বলুন, তোমরা ডাক তাদেরকে যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে ইলাহ মনে করতে। তারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছুর মালিক নয় এবং এ দুটিতে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ তার সহায়কও নয়। যাকে অনুমতি দেয়া হয় সে ছাড়া আল্লাহর কাছে কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।” [সূরা সাবা: ২২–২৩]

১৮:৫২ وَ یَوۡمَ یَقُوۡلُ نَادُوۡا شُرَکَآءِیَ الَّذِیۡنَ زَعَمۡتُمۡ فَدَعَوۡهُمۡ فَلَمۡ یَسۡتَجِیۡبُوۡا لَهُمۡ وَ جَعَلۡنَا بَیۡنَهُمۡ مَّوۡبِقًا

৫২. আর সেদিনের কথা স্মরণ করুন, যেদিন তিনি বলবেন, তোমরা যাদেরকে আমার শরীক মনে করতে তাদেরকে ডাক। তারা তখন তাদেরকে ডাকবে কিন্তু তারা তাদের ডাকে সাড়া দেবে না। আর আমরা তাদের উভয়ের মধ্যস্থলে রেখে দেব এক ধ্বংস-গহ্বর।

অর্থাৎ তারা যেহেতু তাদেরকে আল্লাহর শরীক নির্ধারণ করে নিয়েছে, তাই তাদের ধারণামতে তারা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করেছে তাদেরকে আহবান জানাতে বলা হয়েছে। নতুবা কোন শরীক হওয়া থেকে আল্লাহ সম্পূর্ণ পবিত্র ও মহান। [ফাতহুল কাদীর]

তোমরা আল্লাহর সাথে যাদের শরীক করতে তাদেরকে আহবান করে তাদের দ্বারা আল্লাহর আযাব থেকে উদ্ধার পাওয়া বা আযাবের বিপরীতে সাহায্য লাভ করো কি না দেখা। [ইবন কাসীর] তারা তাদেরকে আহবান করবে কিন্তু তাদের সে আহবান কোন কাজে আসবে না। ঐ সমস্ত উপাস্যের দল এদের ডাকে সাড়াও দিবে না, উদ্ধারও করবে না। কুরআনের অন্যত্র মহান আল্লাহ তা বর্ণনা করেছেন:

“পরে কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে লাঞ্চিত করবেন এবং তিনি বলবেন, কোথায় আমার সেসব শরীক যাদের সম্বন্ধে তোমরা বিতন্ডা করতে? যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছিল তারা বলবে, ‘আজ লাঞ্ছনা ও অমংগল কাফিরদের—” [সূরা আন-নাহল: ২৭]

আরও এসেছে, “এবং সেদিন তিনি তাদেরকে ডেকে বলবেন, “তোমরা যাদেরকে আমার শরীক গণ্য করতে, তারা কোথায়?” যাদের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়েছে তারা বলবে, হে আমাদের রব! এদেরকেই আমরা বিভ্রান্ত করেছিলাম; এদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলাম। যেমন আমরা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম; আপনার সমীপে আমরা দায়িত্ব হতে অব্যাহতি চাচ্ছি। এরা তো আমাদের ইবাদাত করত না।” তাদেরকে বলা হবে, “তোমাদের দেবতাগুলোকে ডাক” তখন তারা ওদেরকে ডাকবে। কিন্তু ওরা এদের ডাকে সাড়া দেবে না। আর এরা শাস্তি দেখতে পাবে। হায়! এরা যদি সৎপথ অনুসরণ করত।” [সূরা আল-ক্কাসাস: ৬২–৬৪]।

আরও এসেছে, “যেদিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বলবেন, আমার শরীকেরা কোথায়? তখন তারা বলবে, আমরা আপনার কাছে নিবেদন করি যে, এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আগে তারা যাকে ডাকত তারা উধাও হয়ে যাবে এবং অংশীবাদীরা উপলব্ধি করবে যে, তাদের নিস্কৃতির কোন উপায় নেই।” [সূরা ফুস্‌সিলাত: ৪৭–৪৮]। আরও বলেনঃ “এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো খেজুর আঁটির আবরণেরও অধিকারী নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না। তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছ তা তারা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞের মত কেউই আপনাকে অবহিত করতে পারে না।” [সূরা ফাতের: ১৩–১৪]

অন্যত্র বলেছেনঃ “সে ব্যক্তির চেয়ে বেশী বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাকে সাড়া দেবে না? এবং এগুলো তাদের প্রার্থনা সম্বন্ধে অবহিতও নয়। যখন কিয়ামতের দিন মানুষকে একত্র করা হবে তখন ঐগুলো হবে তাদের শত্রু এবং ঐগুলো তাদের ‘ইবাদাত অস্বীকার করবে।” [সূরা আল-আহকাফ: ৫–৬]

এখানে “তাদের উভয়ের” বলে কাদের বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে,

এক. তাদের এবং তারা যাদের ইবাদত করত সে সব বাতিল উপাস্যদের মধ্যে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন যে তারা একে অপরের কাছে পৌঁছতে পারবে না। তাদের মাঝখানে থাকবে ধ্বংস গহবর। [ফাতহুল কাদীর]

দুই. অথবা “তাদের উভয়ের” বলে ঈমানদার ও কাফের দু’দলকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [ইবন কাসীর] তখন আয়াতের অর্থ হবে, ঈমানদার ও কাফের এর মাঝে পার্থক্য করে দেয়া হবে। কাফেরদের সামনে থাকবে শুধু ধ্বংস গহবর।

এ অর্থে কুরআনের অন্যত্র এসেছে, “যেদিন কিয়ামত হবে সেদিন মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়বে। অতএব যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তারা জান্নাতে থাকবে; এবং যারা কুফরী করেছে এবং আমার নিদর্শনাবলী ও আখিরাতের সাক্ষাত অস্বীকার করেছে, তারাই শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।” [সূরা আর-রূম: ১৪–১৬]

আরও বলা হয়েছে, “আপনি সরল দ্বীনে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করুন, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে দিন অনিবার্য তা উপস্থিত হওয়ার আগে, সেদিন মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়বে। যে কুফরী করে কুফরীর শাস্তি তারই প্রাপ্য; যারা সৎকাজ করে তারা নিজেদেরই জন্য রচনা করে সুখশয্যা।” [সূরা আর-রূম: ৪৩–৪৪] আরও এসেছে,

“আর হে অপরাধীরা! তোমরা আজ পৃথক হয়ে যাও” [সূরা ইয়াসীন: ৫৯]

অন্য সূরায় এসেছে, “এবং যেদিন আমি ওদের সবাইকে একত্র করে যারা মুশরিক তাদেরকে বলব, তোমরা এবং তোমরা যাদেরকে শরীক করেছিলে তারা নিজ নিজ স্থানে অবস্থান কর; আমি ওদেরকে পরস্পরের থেকে পৃথক করে দিলাম এবং ওরা যাদেরকে শরীক করেছিল তারা বলবে, তোমরা তো আমাদের ইবাদাত করতে না।

আল্লাহ্ই আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট যে, তোমরা আমাদের ইবাদাত করতে এ বিষয়ে আমরা গাফিল ছিলাম। সেখানে তাদের প্রত্যেকে তার পূর্ব কৃতকর্ম পরীক্ষা করে নেবে এবং ওদেরকে ওদের প্রকৃত অভিভাবক আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে আনা হবে এবং ওদের উদ্ভাবিত মিথ্যা ওদের কাছ থেকে অন্তৰ্হিত হবে।” [সূরা ইউনুস: ২৮–৩০]

১৮:৫৩ وَ رَاَ الۡمُجۡرِمُوۡنَ النَّارَ فَظَنُّوۡۤا اَنَّهُمۡ مُّوَاقِعُوۡهَا وَ لَمۡ یَجِدُوۡا عَنۡهَا مَصۡرِفًا

৫৩. আর অপরাধীরা আগুন দেখে বুঝবে যে, তারা সেখানে পতিত হচ্ছে এবং তারা সেখান থেকে কোন পরিত্রাণস্থল পাবে না।

হাশরের দিন জাহান্নাম দেখার পর তারা স্পষ্ট বুঝতে ও বিশ্বাস করবে যে, তারা জাহান্নামে পতিত হচ্ছেই। তাদের বাঁচার কোন উপায় নেই। কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “হায়, আপনি যদি দেখতেন! যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শুনলাম, এখন আপনি আমাদেরকে আবার পাঠিয়ে দিন, আমরা সৎকাজ করব, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী।” [সূরা আস-সাজদাহ: ১২] আরও এসেছেঃ

“তুমি এ দিন সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে, এখন আমি তোমার সামনে থেকে পর্দা উন্মোচন করেছি। আজ তোমার দৃষ্টি প্রখর।” [সূরা ক্বাফ: ২২]

অনুরূপ এসেছে: “তারা যেদিন আমার কাছে আসবে সেদিন তারা কত স্পষ্ট শুনবে ও দেখবে! কিন্তু যালিমরা আজ স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে।” [সূরা মারইয়াম: ৩৮]

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিনের সময় কাফেরের জন্য পঞ্চাশ হাজার বছর নির্ধারণ করা হবে। আর কাফের চল্লিশ বছরের রাস্তা থেকে জাহান্নাম দেখে নিশ্চিত হয়ে যাবে সে তাতে পতিত হচ্ছে।” [মুসনাদে আহমাদ: ৩/৭৫]

সংগৃহিত

তাফসিরে যাকারিয়া ও আহসানুল বায়ান ও নোট