সূরা কাহফ
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
১ম রুকুঃ ১-১২ আয়াত
এখানে আলোচিত হয়েছে ১-৮ আয়াতের
১৮:১ اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ عَلٰی عَبۡدِهِ الۡکِتٰبَ وَ لَمۡ یَجۡعَلۡ لَّهٗ عِوَجًا
১. যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর বান্দার উপর কিতাব নাযিল করেছেন এবং তাতে তিনি বক্রতা রাখেননি;
اَلْ অর্থ ‘যাবতীয়’ حَمْدُ ‘প্রশংসা’ ِللهِ ‘আল্লাহর জন্য
হামদ’ শব্দের অর্থ আরবি ভাষায় ২টি জিনিস বুঝায়। এর প্রথম প্রশংসা। দ্বিতীয়টি হল, ধন্যবাদ। প্রশংসা এবং ধন্যবাদ। এগুলো দুটি ভিন্ন জিনিস। তারা একরকম নয়।
ধন্যবাদ দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনি তখনই কাউকে ধন্যবাদ দেন যখন কেউ আপনার জন্য কিছু করে। যখন কেউ আপনার জন্য কিছু করে, সুতরাং যখন আপনি মনোমুগ্ধকর কিছু দেখেন, যখন আপনি সুন্দর কিছু দেখেন, যখন আপনি এমন কিছু দেখেন যা আপনাকে মুগ্ধ করে এবং কৌতুহলী করে, তখন আপনি এর প্রশংসা করেন। যখন কেউ আপনার উপকার করে, যখন কেউ আপনার জন্য ভাল কিছু করে আপনি তাকে ধন্যবাদ দেন তবে নেহাত প্রশংসা করেন না, যখন আপনি কারো প্রশংসা করেন তার মানে এই না যে আপনি তাকে ধন্যবাদও দেন, এটা পরিষ্কার তো?
প্রশংসা ছাড়াও ধন্যবাদ জানানো সম্ভব । কুর’আন মাতা পিতার অধিকারের কথা বলে। মাতা-পিতারা এটা জানেন কারণ তারা এটা নিয়ে সব সময় কথা বলেন। কুর’আন মাতা পিতার অধিকারের কথা বলে। আর, মাতা পিতার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, কৃতজ্ঞ হও আমার প্রতি ও তোমার মাতা পিতার প্রতি। তোমার বাবা মা যদি তোমাকে শিরক করতে বাধ্য করে… শিরক তো খুবই খারাপ। আমার মনে হয়না এর থেকে খারাপ কিছু হতে পারে। তোমার বাবা মা যদি তোমাকে শিরক করতে বলে, তাদের কথা শুনবে না। কিন্তু আয়াতের শুরুতেই বলেছেন, তবুও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে। তাহলে তারা যদি শিরক করে, আপনি কি তার প্রশংসা করবেন? না, আপনি প্রশংসা করবেন না। কিন্তু যেহেতু তারা আপনার বাবা মা, আপনি কি করবেন? তবুও তাদের ধন্যবাদ দিবেন। ইব্রাহিম (আঃ) এর কথা ভাবুন, তিনি তার বাবার কাজটার প্রশংসা করতেন না। কিন্তু তবুও তিনি কৃতজ্ঞ ছিলেন, তাই না? (নু’মান আলী খানের আলোচনার অংশ)
সূরার শুরুতে মহান আল্লাহ নিজেই নিজের প্রশংসা করছেন। এ ধরনের প্রশংসা একমাত্র তাঁরই। প্রথম ও শেষ সর্বাবস্থায় শুধু তাঁরই প্রশংসা করা যায়। তিনি তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কিতাব নাযিল করেছেন সুতরাং তিনি প্রশংসিত; কারণ এর মাধ্যমে তিনি মানুষদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছেন। এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কী-ই বা আছে। [ইবন কাসীর]
কিতাব নাযিলের কারনে আলহামদুলিল্লাহ বলা। ইরশাদ হয়েছে—
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ (57) قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ (58)
“হে মানুষ! তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের অন্তরের রোগ-ব্যাধি নিরাময় তথা সব মুমিনের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে হেদায়াত বা পথনির্দেশনা।” (১০:৫৭)
“(হে রাসূল! আপনি মুমিনদেরকে) বলে দিন, তারা যেন কেবল আল্লাহর অনুগ্রহ এবং দয়াতেই আনন্দিত হয়। কেননা- তারা যা জমায়, তার চেয়ে এটাই তাদের জন্যে শ্রেয়।” (১০:৫৮)
বক্র না হওয়া ও সোজা হওয়া – উভয়ের অর্থে কোন পার্থক্য নেই। তা সত্ত্বেও দুটি শব্দ এখানে একত্রিত হবার ফায়দা হলো, কোন কোন সোজা বস্তু সোজা হয়েও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাতে অতি সাধারণ বক্রতা থেকে যায়, যা সাধারণত অনুভব করা যায় না। এ কারণে এখানে “قَيِّمًا” (সোজা) দ্বারা “لَمْ يَجْعَل لَّهُ عِوَجًا” এর তাকীদ করা হয়েছে যাতে একথা সুষ্ঠু বুঝা যায় যে, পবিত্র কুরআনে অতি সাধারণ বক্রতাও নেই। (তাফসীরে মাযহারী)
অর্থাৎ এর মধ্যে এমন কোন কথাবার্তা নেই যা বুঝতে পারা যায় না। আবার সত্য ও ন্যায়ের সরল রেখা থেকে বিচুত এমন কথাও নেই যা মেনে নিতে কোন সত্যপন্থী লোক ইতস্তত করতে পারে। [ইবন কাসীর]
‘বক্রতা’ অর্থাৎ, অসঙ্গতি, পরস্পরবিরোধিতা, মতবিরোধিতা বা জটিলতা রাখেননি। অথবা এতে (যে পথ নির্দেশিত হয়েছে তার মধ্যে) কোন বক্রতা রাখেননি এবং মধ্যম পন্থা হতে বিচ্যুতি ঘটার কোন কিছু এতে নেই। বরং এটাকে সুপ্রতিষ্ঠিত, সরল ও সোজা রাখা হয়েছে। অথবা قَيِّم অর্থ, এমন কিতাব, যাতে বান্দাদের সেই সব ব্যাপারের প্রতি খেয়াল রাখা ও যত্ন নেওয়া হয়েছে, যাতে তাদের দ্বীন ও দুনিয়ার মঙ্গল নিহিত আছে।
১৮:২ قَیِّمًا لِّیُنۡذِرَ بَاۡسًا شَدِیۡدًا مِّنۡ لَّدُنۡهُ وَ یُبَشِّرَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ اَجۡرًا حَسَنًا ۙ
২. সরলরূপে, তাঁর কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য এবং মুমিনগণ যারা সৎকাজ করে, তাদেরকে এ সুসংবাদ দেয়ার জন্য যে, তাদের জন্য আছে উত্তম পুরস্কার
ক্বাইয়্যেমা দুটি জিনিষ- কিতাব যা নাযিল হয়েছে সেটা যেমন প্রতিষ্ঠিত তেমনি এই কিতাব যাদের জন্য তাদেরকেও প্রতিষ্ঠিত বা ইস্তিকাম করে রাখতে চায়। আল কুর’আনে ইরশাদ হয়েছে-
১৭:৯ اِنَّ هٰذَا الۡقُرۡاٰنَ یَهۡدِیۡ لِلَّتِیۡ هِیَ اَقۡوَمُ وَ یُبَشِّرُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ اَجۡرًا کَبِیۡرًا ۙ
৯. নিশ্চয় এ কুরআন হিদায়াত করে সে পথের দিকে যা আকওয়াম (সরল, সুদৃঢ়) এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার। বনি ইসরাইলঃ ৯
কুরআন যে পথনির্দেশ করে, তাকে ‘আকওয়াম’ বলা হয়েছে। ‘আকওয়াম’ সে পথ, যা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে নিকটবর্তী, সহজ এবং বিপদাপদমুক্তও। সুতরাং কুরআনের প্রদর্শিত পথটি সহজ, সরল, সঠিক, কল্যাণকর, ইনসাফপূর্ণ। [আদওয়াউল বায়ান] এ থেকে বোঝা গেল যে, কুরআন মানুষের জীবনের জন্যে যেসব বিধি-বিধান দান করে, সেগুলোতে এ উপরোক্ত গুণগুলো বিদ্যমান রয়েছে। তাতে রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ
১৮:৩ مَّاکِثِیۡنَ فِیۡهِ اَبَدًا ۙ
৩. যাতে তারা স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে,
১৮:৪ وَّ یُنۡذِرَ الَّذِیۡنَ قَالُوا اتَّخَذَ اللّٰهُ وَلَدًا ٭
৪. আর সতর্ক করার জন্য তাদেরকে যারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন,
যারা আল্লাহর সন্তান-সন্ততি আছে বলে দাবী করে এদের মধ্যে রয়েছে নাসারা, ইহুদী ও আরব মুশরিকরা। [ফাতহুল কাদীর] তাছাড়া পাক-ভারতের হিন্দুরাও আল্লাহর জন্য সন্তান-সন্ততি সাব্যস্ত করে থাকে।
১৮:৫ مَا لَهُمۡ بِهٖ مِنۡ عِلۡمٍ وَّ لَا لِاٰبَآئِهِمۡ ؕ کَبُرَتۡ کَلِمَۃً تَخۡرُجُ مِنۡ اَفۡوَاهِهِمۡ ؕ اِنۡ یَّقُوۡلُوۡنَ اِلَّا کَذِبًا
৫. এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না। তাদের মুখ থেকে বের হওয়া বাক্য কী সাংঘাতিক! তারা তো শুধু মিথ্যাই বলে।
) অৰ্থাৎ তাদের এ উক্তি যে, অমুক আল্লাহর পুত্র অথবা অমুককে আল্লাহ পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এগুলো তারা এ জন্য বলছে না যে, তাদের আল্লাহর পুত্র হবার বা আল্লাহর কাউকে পুত্র বানিয়ে নেবার ব্যাপারে তারা কিছু জানে। বরং নিছক নিজেদের ভক্তি শ্রদ্ধার বাড়াবাড়ির কারণে তারা একটি মনগড়া মত দিয়েছে এবং এভাবে তারা যে কত মারাত্মক গোমরাহীর কথা বলছে এবং বিশ্বজাহানের মালিক ও প্রভু আল্লাহর বিরুদ্ধে যে কত বড় বেয়াদবী ও মিথ্যাচার করে যাচ্ছে তার কোন অনুভূতিই তাদের নেই। এভাবে তারা নিজেরা যেমন পথভ্রষ্ট হচ্ছে তেমনি ভ্রষ্ট করছে তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকেও। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]
১৮:৬ فَلَعَلَّکَ بَاخِعٌ نَّفۡسَکَ عَلٰۤی اٰثَارِهِمۡ اِنۡ لَّمۡ یُؤۡمِنُوۡا بِهٰذَا الۡحَدِیۡثِ اَسَفًا ﴿
৬. তারা এ বাণীতে ঈমান না আনলে সম্ভবত তাদের পিছনে ঘুরে আপনি দুঃখে আত্ম-বিনাশী হয়ে পড়বেন
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে সে সময় যে মানসিক অবস্থার টানাপোড়ন চলছিল এখানে সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। তিনি তাদের হিদায়াতের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তারা আল্লাহ্র আযাবের সম্মুখীন হবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তার এ মানসিক অবস্থাকে একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “আমার ও তোমাদের দৃষ্টান্ত এমন এক ব্যক্তির মতো যে আলোর জন্য আগুন জ্বালালো কিন্তু পতংগরা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো পুড়ে মরার জন্য। সে এদেরকে কোনক্রমে আগুন থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে। কিন্তু এ পতংগরা তার কোন প্রচেষ্টাকেই ফলবতী করতে দেয় না। আমার অবস্থাও অনুরূপ। আমি তোমাদের হাত ধরে টান দিচ্ছি। কিন্তু তোমরা আগুনে লাফিয়ে পড়ছো।” [বুখারীঃ ৩২৪৪, ৬১১৮ ও মুসলিমঃ ২২৮৪] সূরা আশ শু’আরার ৩ নং আয়াতেও এ ব্যাপারে আলোচনা এসেছে।
উম্মতের জন্য ভালোবাসা—
রাসূল (স) একবার কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন আর তিনি কিছু বিশেষ আয়তের সংস্পর্শে এলেন … তার একটা হলো বিখ্যাত এই আয়াতটি, যখন ইব্রাহীম (আঃ) বলেন – رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ ۖ فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي ۖ وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (সূরা ইব্রাহীম ৩৬)। ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য দোয়া করছেন – “ও আল্লাহ! যে আমার অনুসরণ করে, সে আমার। এবং কেউ আমার অবাধ্যতা করলে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” ও আল্লাহ! এমনকি তাঁকেও ক্ষমা করে দিন। এটাই ইব্রাহীম (আঃ) বলছিলেন- যে আমার অনুসরণ করে সে আমার সাথে আছে, তাকে রক্ষা করুন। কিন্তু যারা আমার অবাধ্য হয় তাদেরকেও ক্ষমা করে দিন।
তারপর তিনি ঈসা (আঃ) এর দোয়া সংক্রান্ত একটি আয়াত পড়লেন। এই আয়াতটি সূরা মায়েদার- إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ ۖ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ — যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ। অন্য কথায়, আমি চাই আপনি তাদের ক্ষমা করে দেন।
তো, তিনি দুইটি আয়াত তিলাওয়াত করেন। উভয় আয়াতে নবীরা তাদের স্ব স্ব উম্মার জন্য দোয়া করছেন। তারপর তিনি তাঁর নিজের উম্মার জন্য চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হাত উত্তোলন করে বলতে শুরু করলেন – ইয়া আল্লাহ! আমার উম্মাহ, আমার উম্মাহ। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মাহর কথা চিন্তা করে কাঁদতে শুরু করেন। আর আমরা তাঁর সেই উম্মাহর সদস্য। স্ব স্ব উম্মাহর জন্য ইব্রাহীম এবং ঈসা আলাইহিস সালামের দোয়া পড়ার পর রাসূলুল্লাহ (স) তাঁর নিজ উম্মাহ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি আল্লাহর কাছে দোআ করলে লাগলেন – “ও আল্লাহ! আমার উম্মাহ, আমার উম্মাহ।”
তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জিব্রিল আলাইহিস সালামকে বললেন – “মুহাম্মদ (স) এর নিকট যাও, এবং তাকে জিজ্ঞেস করো কেন সে কাঁদছে। ” এই হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, খুবই সুন্দর হাদিস। অতঃপর, জিব্রিল (আ) আসলেন এবং রাসূল (স) কে জিজ্ঞেস করলেন কেন তিনি কাঁদছেন? [ আর অবশ্যই আল্লাহ জানেন কেন তিনি কাঁদছেন। আল্লাহ যখন জিব্রিল (আ) কে পাঠান তখন তিনি জানতেন কেন রাসূল (স) কাঁদছেন।] রাসূল (স) বললেন – “আমি আমার উম্মাহর কথা চিন্তা করে কাঁদছি।” তাদের ভাগ্য কী হবে তা চিন্তা করে আমি কাঁদছি।
অতঃপর, জিব্রিল (আঃ) আল্লাহর নিকট ফেরত গেলেন। আল্লাহ বললেন – “হে জিব্রিল! মুহাম্মাদের নিকট ফেরত যাও, এবং তাকে বলো – আমি আপনার উম্মাহর জন্য আপনাকে সন্তুষ্ট করে দিবো।” কারণ আমরা তাঁকে সন্তুষ্ট করতে চাই, আর তাই তাঁর উম্মাহকে পবিত্র করবো। আর আমরা আপনাকে কোনো কষ্ট দিবো না। অন্য কথায়, আপনার জন্য ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার উম্মাহর বিষয়ে আপনাকে সন্তুষ্ট করে দিবো। আর আমরা আপনাকে কোনো কষ্ট দিবো না।
১৮:৭ اِنَّا جَعَلۡنَا مَا عَلَی الۡاَرۡضِ زِیۡنَۃً لَّهَا لِنَبۡلُوَهُمۡ اَیُّهُمۡ اَحۡسَنُ عَمَلًا
৭. নিশ্চয় যমীনের উপর যা কিছু আছে আমরা সেগুলোকে তার শোভা করেছি, মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কাজে কে শ্রেষ্ঠ।
অর্থাৎ পৃথিবীর জীবজন্তু, উদ্ভিদ, জড় পদার্থ এবং ভূগর্ভস্থ বিভিন্ন বস্তুর খনি- এগুলো সবই পৃথিবীর সাজ-সজ্জা ও চাকচিক্য।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “দুনিয়া সুমিষ্ট নয়নাভিরাম দৃশ্যে ভরা, আল্লাহ এতে তোমাদেরকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করে দেখতে চান তোমরা এতে কি ধরনের আচরণ কর। সুতরাং তোমরা দুনিয়ায় মত্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাক এবং মহিলাদের থেকেও বেঁচে থাক। কেননা; বনী ইসরাঈলের মধ্যে প্রথম ফিতনা ছিল মহিলাদের মধ্যে।” [মুসলিম: ২৭৪২]
زُیِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوٰتِ مِنَ النِّسَآءِ وَ الۡبَنِیۡنَ وَ الۡقَنَاطِیۡرِ الۡمُقَنۡطَرَۃِ مِنَ الذَّهَبِ وَ الۡفِضَّۃِ وَ الۡخَیۡلِ الۡمُسَوَّمَۃِ وَ الۡاَنۡعَامِ وَ الۡحَرۡثِ ؕ ذٰلِکَ مَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ اللّٰهُ عِنۡدَهٗ حُسۡنُ الۡمَاٰبِ
. নারী, সন্তান, সোনারূপার স্তুপ, বাছাই করা ঘোড়া, গবাদি পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট সুশোভিত করা হয়েছে। এসব দুনিয়ার জীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহ্, তাঁরই নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল। আলে ইমরানঃ ১৪
الَّذِیۡ خَلَقَ الۡمَوۡتَ وَ الۡحَیٰوۃَ لِیَبۡلُوَکُمۡ اَیُّکُمۡ اَحۡسَنُ عَمَلًا ؕ وَ هُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡغَفُوۡرُ ۙ﴿۲﴾
২. যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য—কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম? তিনি পর্যক্রমশালী, ক্ষমাশীল। সূরা মূলকঃ২
وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّمَاۤ اَمْوَالُكُمْ وَ اَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَّ اَنَّ اللهَ عِنْدَهٗۤ اَجْرٌ عَظِیْمٌ۠.
জেনে রেখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আর আল্লাহরই নিকট রয়েছে মহা পুরস্কার। -সূরা আনফাল (৮) : ২৮
وَ لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ
আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও। [আল-বাক্বারাহ ১৫৫]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “দুনিয়া অভিশপ্ত এবং যা কিছু এতে আছে তা অভিশপ্ত। তবে যা আল্লাহর যিকর বা স্মরণে করা হয় ও তার সাথে সম্পৃক্ত হয় এবং দ্বীনী জ্ঞানে আলেম ও দ্বীনী জ্ঞান অর্জনকারী। [তিরমিযী: ২৩২২; ইবন মাজাহ: ৪১১২]
হাদীস শরীফে এসেছে, বান্দা যখন আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন আল্লাহ তাআলা তাকে বলবেন-
أَيْ فُلْ أَلَمْ أُكْرِمْكَ، وَأُسَوِّدْكَ، وَأُزَوِّجْكَ، وَأُسَخِّرْ لَكَ الْخَيْلَ وَالْإِبِلَ، وَأَذَرْكَ تَرْأَسُ وَتَرْبَعُ؟
হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মান দান করিনি? আমি কি তোমাকে নেতা বানাইনি? আমি কি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করিনি? আমি কি উট-ঘোড়া তোমার বশীভূত করিনি? আমি কি তোমাকে এই সুযোগ দিইনি যে, তুমি নেতৃত্ব দিবে এবং যুদ্ধলব্দ সম্পদের এক-চতুর্থাংশ গ্রহণ করে প্রাচুর্যের মাঝে জীবনযাপন করবে? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৬৮
নিয়ামত যখন পরীক্ষা হয়ঃ
ثُمَّ لَتُسْـَٔلُنَّ یَوْمَىِٕذٍ عَنِ النَّعِیْمِ.
অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে নিআমতরাজি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। -সূরা তাকাসুর (১০২) : ৮
হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মান দান করিনি? আমি কি তোমাকে নেতা বানাইনি? আমি কি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করিনি? আমি কি উট-ঘোড়া তোমার বশীভূত করিনি? আমি কি তোমাকে এই সুযোগ দিইনি যে, তুমি নেতৃত্ব দিবে এবং যুদ্ধলব্দ সম্পদের এক-চতুর্থাংশ গ্রহণ করে প্রাচুর্যের মাঝে জীবনযাপন করবে? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৬৮
তোমাদের ব্যাপারে দরিদ্রতার আশঙ্কা করি না। বরং আমার আশঙ্কা হয়, তোমাদের উপর অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য হবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের হয়েছিল। আর তোমরা প্রতিযোগিতা শুরু করবে, যেমন তারা করেছিল। তখন দুনিয়া তোমাদেরকে ধ্বংস করবে, যেমন তাদেরকে ধ্বংস করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১৫৮
মসিবতের পরীক্ষার তুলনায় সুখ-শান্তির পরীক্ষা কঠিন। এজন্যেই তো হযরত উমর রা. বলেছেন-
بُلِيْنَا بِالضّرّاءِ فَصَبَرْنَا، وَبُلِيْنَا بِالسّراءِ فَلَمْ نَصْبِرْ.
আমাদের উপর বিপদের পরীক্ষা এসেছিল। তখন আমরা সবর করেছি। কিন্তু যখন আমাদের উপর সুখের পরীক্ষা এল তখন আমরা ছবর (শোকর) করতে পারিনি।
হযরত আলী রা. বলেছেন-
من وُسِّعَ عَلَيْهِ دُنْيَاهُ، فَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّه قَدْ مُكِرَ به، فَهُوَ مَخْدُوْعٌ فِيْ عَقْلِه.
যাকে সচ্ছলতা দান করা হয়েছে, আর সে বুঝতে পারেনি যে, তাকে পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে তাহলে সে আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার। -বাসাইরু যাবিত তামঈয ফী লাতাইফিল কিতাবিল আযীয ২/২৭৪-২৭৫ : রিসালাতুল মুস্তারশিদীন, (টীকা) পৃ. ৮৫-৮৯
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ فِتَنًا كَأَنَّهَا قِطَعُ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ فِيهَا مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا وَيَبِيعُ فِيهَا أَقْوَامٌ خَلَاقَهُمْ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا
‘‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের পূর্বে অন্ধকার রাত্রির মত ঘন কালো অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে। সকালে একজন লোক মুমিন অবস্থায় ঘুম থেকে জাগ্রত হবে। বিকালে সে কাফেরে পরিণত হবে। বহু সংখ্যক লোক ফিতনায় পড়ে দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে তাদের চরিত্র ও আদর্শ বিক্রি করে দিবে।মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
অপর বর্ণনায় এসেছে, তোমাদের একজন দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে তার দ্বীন বিক্রি করে দিবে – তিরমিজী, ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেনঃ সহীহুল জামে আস্ সাগীর হাদীছ নং- ৫১২৫।
وَ اِنَّا لَجٰعِلُوۡنَ مَا عَلَیۡهَا صَعِیۡدًا جُرُزًا ؕ
৮. আর তার উপর যা কিছু আছে তা অবশ্যই আমরা উদ্ভিদশূন্য ময়দানে পরিণত করব।
অর্থাৎ পৃথিবী পৃষ্ঠে তোমরা এই যেসব সাজ সরঞ্জাম দেখছো এবং যার মন ভুলানো চাকচিক্যে তোমরা মুগ্ধ হয়েছ, এতো নিছক একটি সাময়িক সৌন্দর্য, নিছক তোমাদের পরীক্ষার জন্য এর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। এসব কিছু আমি তোমাদের আয়েশ আরামের জন্য সরবরাহ করেছি, তোমরা এ ভুল ধারণা করে বসেছে। এগুলো আয়েশ আরামের জিনিস নয়, বরং পরীক্ষার উপকরণ। যেদিন এ পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে সেদিনই ভোগের এসব সরঞ্জাম খতম করে দেয়া হবে এবং তখন এ পৃথিবী একটি লতাগুল্মহীন ধূ ধূ প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]
২১:১ اِقۡتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمۡ وَ هُمۡ فِیۡ غَفۡلَۃٍ مُّعۡرِضُوۡنَ ۚ
১. মানুষের হিসেব-নিকেশের সময় আসন্ন, অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। আম্বিয়াঃ ১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর একটি হাদীসে একথাই বলেছেন। তিনি নিজের হাতের দুটি আঙ্গুল পাশাপাশি রেখে বলেনঃ “আমার আগমন এমন সময়ে ঘটেছে। যখন আমি ও কেয়ামত এ দুটি আঙ্গুলের মতো অবস্থান করছি।” [বুখারীঃ ৪৯৯৫]
‘তোমার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন আসবে। (মনে রেখ) যেদিন তোমার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন (যেমন ক্বিয়ামত প্রাক্কালে সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠা) এসে যাবে, সেদিন তাদের ঈমান কোন কাজে আসবে না, যারা ইতিপূর্বে ঈমান আনেনি অথবা তাদের ঈমান দ্বারা কোন সৎকর্ম করেনি। বলে দাও যে, তোমরা অপেক্ষায় থাক, আমরাও অপেক্ষায় রইলাম’ (আন‘আম ৬/১৫৮)।
সংগৃহিত ও সহায়কঃ তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, ন্যাক বাংলা