সূরা কাহফঃ(কাহাফবাসীর ঘটনাঃ ৩য় পর্ব) ৩য় রুকুঃ (১৮-২২ আয়াত)

সূরা কাহফ

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

৩য় রুকুঃ ১৮-২২

(কাহাফবাসীর ঘটনাঃ ৩য় পর্ব)

১৮:১৮ وَ تَحۡسَبُهُمۡ اَیۡقَاظًا وَّ هُمۡ رُقُوۡدٌ ٭ۖ وَّ نُقَلِّبُهُمۡ ذَاتَ الۡیَمِیۡنِ وَ ذَاتَ الشِّمَالِ ٭ۖ وَ کَلۡبُهُمۡ بَاسِطٌ ذِرَاعَیۡهِ بِالۡوَصِیۡدِ ؕ لَوِ اطَّلَعۡتَ عَلَیۡهِمۡ لَوَلَّیۡتَ مِنۡهُمۡ فِرَارًا وَّ لَمُلِئۡتَ مِنۡهُمۡ رُعۡبًا

১৮. আর আপনি মনে করতেন তারা জেগে আছে, অথচ তারা ছিল ঘুমন্ত। আর আমরা তাদেরকে পাশ ফিরাতাম ডান দিকে ও বাম দিকে এবং তাদের কুকুর ছিল সামনের পা দুটি গুহার দরজায় প্রসারিত করে। যদি আপনি তাদের প্রতি তাকিয়ে দেখতেন, তবে অবশ্যই আপনি পিছন ফিরে পালিয়ে যেতেন। আর অবশ্যই আপনি তাদের ভয়ে আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়তেন;

أَيْقَاظٌ হল, يَقِظٌ (জাগ্রত) এর বহুবচন। আর رُقُوْدٌ হল, رَاقِدٌ (নিদ্রিত)এর বহুবচন। তারা জাগ্রত এই জন্য মনে হচ্ছিল যে, তাদের চোখগুলো জাগ্রত ব্যক্তির মত খোলা ছিল। কেউ কেউ বলেন, খুব বেশী পার্শ্ব পরিবর্তন করার কারণে তাদেরকে জাগ্রত মনে হত।

কোরআনে ‘জাগ্রত মনে হবে’ বলার একটি অর্থ হতে পারে তাঁদের চোখের পাতা স্থির ছিল না। কেননা তাঁদের চোখের পাতা বন্ধ থাকলে রক্ত সঞ্চালনের অভাবে শিরাগুলো শুকিয়ে গিয়ে চোখ অন্ধ হয়ে যেত, আবার চোখের পাতা খোলা থাকলে তা ‘কর্নিয়া জেরোসিস’-এ আক্রান্ত হতো

আপনি যদি তাদেরকে গুহায় অবস্থানকালে দেখতে পেতেন তাহলে মনে করতেন যে, তারা জেগে আছে অথচ তারা ঘুমন্ত। তাদেরকে জেগে আছে মনে করার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, তারা পাশ ফিরাচ্ছে। আর যারা পাশ ফিরে শুতে পারে তারা সামান্য হলেও জাগ্রত হয়। অথবা কারও কারও মতে, তারা ঘুমন্ত হলেও তাদের চোখ খোলা থাকত। [ফাতহুল কাদীর]

কেউ বাইর থেকে উঁকি দিয়ে দেখলেও তাদের সাতজনের মাঝে মাঝে পার্শ্বপরিবর্তন করতে থাকার কারণে এ ধারণা করতো যে, এরা এমনিই শুয়ে আছে, ঘুমুচ্ছে না। পার্শ্ব পরিবর্তনের কারণ কারও কারও মতে, যাতে যমীন তাদের শরীর খেয়ে না ফেলে। উই ধরে না যায়।) [ফাতহুল কাদীর]

পাহাড়ের মধ্যে একটি অন্ধকার গুহায় কয়েকজন লোকের এভাবে অবস্থান করা এবং সামনের দিকে কুকুরের বসে থাকা এমন একটি ভয়াবহ দৃশ্য পেশ করে যে, উঁকি দিয়ে যারা দেখতো তারাই ভয়ে পালিয়ে যেতো। তাছাড়া আল্লাহ তাদের উপর ভীতি ঢেলে দিয়েছিলেন, সুতরাং যে কেউ তাদের দেখত, তারই ভয়ের উদ্রেক হতো। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

তাদের হেফাযতের জন্য এ ছিল আল্লাহ কর্তৃক ব্যবস্থাপনা। যাতে কেউ যেন তাদের নিকটে যেতে না পারে।

একটি সুগঠিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে একটি গতিশীল ক্রমহ্রাসমান সিস্টেম সক্রিয় থাকে।

আরইএম((REM র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ- দ্রুত চোখের চলাচলের ঘুম) ঘুম হল যখন আমরা স্বপ্ন দেখি , এবং গভীরতম এনআরইএম(NREM  ঘুম হল যখন শরীর পুরোপুরি শিথিল হয় এবং নিজেকে মেরামত করে।

ফলে যখন অনিদ্রা থেকে এনআরইএম ঘুমের (স্বপ্নহীন ঘুম) সময় ঘুম যত গভীর হয়, মস্তিষ্কের বেশির ভাগ নিউরন সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইলেকট্রয়েন্সফ্লোগ্রাফিক (ইইজি) রেকর্ডে দেখা গেছে, এনআরইএম ঘুমের সময় মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলো ধীর হয় এবং ভোল্টেজ থাকে উচ্চ। শ্বাস-প্রশ্বাস ও হূত্স্পন্দন ধীর ও নিয়মিত থাকে এবং রক্তচাপও কম থাকে। এতে ব্যক্তি তুলনামূলক বেশি স্থির থাকে। (https://bit.ly/2FmFR2h) চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের দাবি, কোমার রোগীরা এক ধরনের এনআরইএম ঘুমের মধ্যে থাকে। পার্থক্য হলো, স্বাভাবিক মানুষের ঘুমের একটি টাইম সার্কেল থাকে আর কোমার রোগীদের এই টাইম সার্কেলটা থাকে না।

মস্তিষ্ক কোমায় থাকা অবস্থায় অনেক কম শক্তি ব্যবহার করে, আপনার সবচেয়ে গভীর ঘুম থেকেও ১০-২০% কম শক্তি, আর জাগ্রত অবস্থার তুলনায় ৫০-৬০% কম। এই কম শক্তির ব্যবহার থেকেই বোঝা যায়, সারা মস্তিষ্কের কার্যক্রম তখন কতটা শিথিল রয়েছে। এই শিথিল থাকার কারণে, মস্তিষ্কে তখন আর রেগুলার স্লিপ সাইকেল থাকে না।

হয়তো কোরআনে বর্ণিত ‘আসহাবে কাহফে’র ঘুমটি ছিল ‘টাইম সার্কেল’হীন। সংগৃহিত

ঘুম সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

اَللّٰهُ یَتَوَفَّی الۡاَنۡفُسَ حِیۡنَ مَوۡتِهَا وَ الَّتِیۡ لَمۡ تَمُتۡ فِیۡ مَنَامِهَا ۚ فَیُمۡسِکُ الَّتِیۡ قَضٰی عَلَیۡهَا الۡمَوۡتَ وَ یُرۡسِلُ الۡاُخۡرٰۤی اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ

আল্লাহই জীবসমূহের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যাদের মৃত্যু আসেনি তাদের প্রাণও নিদ্রার সময়। তারপর তিনি যার জন্য মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অন্যগুলো ফিরিয়ে দেন, এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে। সূরা যুমারঃ ৪২

“তিনিই রাতে তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং দিনে তোমরা যা কর তা তিনি জানেন। তারপর দিনে তোমাদেরকে তিনি আবার জীবিত করেন যাতে নির্ধারিত সময় পূর্ণ হয়। তারপর তাঁর দিকেই তোমাদের ফিরে যাওয়া। তারপর তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন।” [সূরা আল-আন’আম: ৬০]

আয়াতে আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মানুষকে এ অনুভূতি দিতে চাচ্ছেন যে, জীবন ও মৃত্যু কিভাবে তাঁর অসীম ক্ষমতার করায়ত্ব। শয়নে, জাগরণে, ঘরে অবস্থানের সময় কিংবা কোথাও চলাফেরা করার সময় মানব দেহের আভ্যন্তরীণ কোন ত্রুটি অথবা বাইরের অজানা কোন বিপদ অকস্মাৎ এমন মোড় নিতে পারে যা তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। যে মানুষ আল্লাহর হাতে এতটা অসহায় সে যদি সেই আল্লাহ সম্পর্কে এতটা অমনোযোগী ও বিদ্রোহী হয় তাহলে সে কত অজ্ঞ। সে জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুমাবার আগে এবং ঘুম থেকে উঠে যে দো’আ করতেন তাতে রূহ ফেরত পাওয়ায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন।

হাদীসে এসেছে, তিনি ঘুমাবার সময় বলতেন: بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ أَمُوتُ وَأَحْيَا “

হে আল্লাহ! আপনার নামেই আমি মারা যাই এবং জীবিত হই।” আর যখন ঘুম থেকে জাগতেন তখন বলতেনঃ

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে আমাদের মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করেছেন। আর তাঁর কাছেই আমরা উত্থিত হবো। [বুখারী: ৬৩১২]

১৮:১৯ وَ کَذٰلِکَ بَعَثۡنٰهُمۡ لِیَتَسَآءَلُوۡا بَیۡنَهُمۡ ؕ قَالَ قَآئِلٌ مِّنۡهُمۡ کَمۡ لَبِثۡتُمۡ ؕ قَالُوۡا لَبِثۡنَا یَوۡمًا اَوۡ بَعۡضَ یَوۡمٍ ؕ قَالُوۡا رَبُّکُمۡ اَعۡلَمُ بِمَا لَبِثۡتُمۡ ؕ فَابۡعَثُوۡۤا اَحَدَکُمۡ بِوَرِقِکُمۡ هٰذِهٖۤ اِلَی الۡمَدِیۡنَۃِ فَلۡیَنۡظُرۡ اَیُّهَاۤ اَزۡکٰی طَعَامًا فَلۡیَاۡتِکُمۡ بِرِزۡقٍ مِّنۡهُ وَ لۡـیَؔ‍‍‍تَلَطَّفۡ وَ لَا یُشۡعِرَنَّ بِکُمۡ اَحَدًا

১৯. আর এভাবেই আমরা তাদেরকে জাগিয়ে দিলাম যাতে তারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের একজন বলল, তোমরা কত সময় অবস্থান করেছ? কেউ কেউ বলল, আমরা অবস্থান করেছি এক দিন বা এক দিনের কিছু অংশ। অপর কেউ বলল, তোমরা কত সময় অবস্থান করেছ তা তোমাদের রবই ভাল জানেন। সুতরাং তোমরা তোমাদের একজনকে তোমাদের এ মুদ্রাসহ বাজারে পাঠাও। সে যেন দেখে কোন খাদ্য উত্তম তারপর তা থেকে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য। আর সে যেন বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে। আর কিছুতেই যেন তোমাদের সম্বন্ধে কাউকেও কিছু জানতে না দেয়।

وَكَذَٰلِكَ এ শব্দটি তুলনামূলক ও দৃষ্টান্তমূলক অর্থ দেয়। এখানে দু’টি ঘটনার পারস্পরিক তুলনা বোঝানো হয়েছে। প্রথম ঘটনা আসহাবে কাহফের দীর্ঘকাল পর্যন্ত নিদ্রাভিভূত থাকা, যা কাহিনীর শুরুতে (فَضَرَبْنَا عَلَىٰ آذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ) আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে।

দ্বিতীয় ঘটনা দীর্ঘকালীন নিদ্রার পর সুস্থ থাকা এবং খাদ্য না পাওয়া সত্বেও সবল ও সুঠাম দেহে জাগ্রত হওয়া।

উভয় ঘটনা আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন হওয়ার ব্যাপারে পরস্পর তুল্য। তাই এ আয়াতে তাদেরকে জাগ্রত করার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে كَذَٰلِكَ ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তাদের নিদ্রা যেমন সাধারণ মানুষের নিদ্রার মত ছিল না, তেমনি তাদের জাগরণও স্বতন্ত্র ছিল। [দেখুন, ইবন কাসীর]।

এখানে বর্ণিত لِيَتَسَاءَلُوا এর ل টিকে বলা হয়, لام صيرورة বা لام العاقبة যার অর্থ পরিণামে যাতে এটা হয়। অর্থাৎ তাদেরকে জাগ্রত করার পরিণাম যেন এই দাঁড়ায়। [কুরতুবী]

মোটকথা, তাদের দীর্ঘ নিদ্রা যেমন কুদরতের একটি নিদর্শন ছিল, এমনিভাবে শতশত বছর পর পানাহার ছাড়া সুস্থ-সবল অবস্থায় জাগ্রত হওয়াও ছিল আল্লাহর অপার শক্তির একটি নিদর্শন। [দেখুন, ইবন কাসীর]

আল্লাহর এটাও ইচ্ছা ছিল যে, শত শত বছর নিদ্রামগ্ন থাকার বিষয়টি স্বয়ং তারাও জানুক। তাই পারস্পরিক জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এর সূচনা হয় এবং সে ঘটনা দ্বারা চূড়ান্ত রূপ নেয়, যা পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ তাদের গোপন রহস্য শহরবাসীরা জেনে ফেলে এবং সময়কাল নির্ণয়ে মতানৈক্য সত্বেও দীর্ঘকাল গুহায় নিদ্রামগ্ন থাকার ব্যাপারে সবার মনেই বিশ্বাস জন্মে। আর তারা মৃত্যু ও পুনরুত্থান সম্পর্কে আল্লাহর শক্তির কথা স্মরণ করে। [ফাতহুল কাদীর] বস্তুত: যে অদ্ভূত পদ্ধতিতে তাদেরকে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল এবং দুনিয়াবাসীকে তাদের অবস্থা সম্পর্কে বেখবর রাখা হয়েছিল ঠিক তেমনি সুদীর্ঘকাল পরে তাদের জেগে উঠাও ছিল আল্লাহর শক্তিমত্তার বিস্ময়কর প্রকাশ।

আসহাবে কাহ্‌ফের এক ব্যক্তি প্রশ্ন তুলল যে, তোমরা কতকাল নিদ্রামগ্ন রয়েছ? কেউ কেউ উত্তর দিল: একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ। কেননা, তারা সকাল বেলায় গুহায় প্রবেশ করেছিল এবং জাগরণের সময়টি ছিল বিকাল। তাই মনে করল যে, এটা সেই দিন যেদিন আমরা গুহায় প্রবেশ করেছিলাম। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] কিন্তু তাদের মধ্য থেকেই অন্যরা অনুভব করল যে, এটা সম্ভবতঃ সেই দিন নয়। তাহলে কতদিন গেল জানা নেই। তাই তারা বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে (رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثْتُمْ) অতঃপর তারা এ আলোচনাকে অনাবশ্যক মনে করে জরুরী কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল যে, শহর থেকে কিছু খাদ্য আনার জন্য একজনকে পাঠানো হোক। [ফাতহুল কাদীর]

আসহাবে কাহ্‌ফ নিজেদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে শহরে প্রেরণের জন্য মনোনীত করে এবং খাদ্য আনার জন্য তার কাছে অর্থ অর্পণ করে। এ থেকে কয়েকটি বিষয় জানা যায়।

(এক) অর্থ-সম্পদে অংশীদারিত্ব জায়েয।

(দুই) অর্থ-সম্পদের উকিল নিযুক্ত করা জায়েয এবং শরীকানাধীন সম্পদ কোন এক ব্যক্তি অন্যদের অনুমতিক্রমে ব্যয় করতে পারে।

(তিন) খাদ্যদ্রব্যে কয়েকজন সঙ্গী শরীক হলে তা জায়েয; যদিও খাওয়ার পরিমাণ বিভিন্নরূপ হয়- কেউ কম খায়। আর কেউ বেশী খায়। [দেখুন, কুরতবী]

একটু চিন্তা করা প্রয়োজন যে এতোগুলো বছর পার হলেও যেনো মনে হয়েছে একটি বেলা,ঠিক আমাদের এই দুনিয়ার জীবনটাও আখেরাতের তুলনায় এমনই মনে হবে বলে জানা যায়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

আখেরাতের জীবন ও দুনিয়ার জীবনের সময়ের তুলনা—–

کَاَنَّهُمۡ یَوۡمَ یَرَوۡنَهَا لَمۡ یَلۡبَثُوۡۤا اِلَّا عَشِیَّۃً اَوۡ ضُحٰهَا ﴿

যেদিন তারা তা দেখতে পাবে সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দুনিয়ায় মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাত অবস্থান করেছে! নাযিয়াতঃ ৪৬

وَ یَسۡتَعۡجِلُوۡنَکَ بِالۡعَذَابِ وَ لَنۡ یُّخۡلِفَ اللّٰهُ وَعۡدَهٗ ؕ وَ اِنَّ یَوۡمًا عِنۡدَ رَبِّکَ کَاَلۡفِ سَنَۃٍ مِّمَّا تَعُدُّوۡنَ ﴿

আর তারা আপনাকে শাস্তি তরান্বিত করতে বলে, অথচ আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি কখনো ভঙ্গ করেন না। আর নিশ্চয় আপনার রব-এর কাছে একদিন তোমাদের গণনার হাজার বছরের সমান। হজ্জঃ ৪৭

আখেরাতের একদিন সার্বক্ষণিকভাবে দুনিয়ার এক হাজার বছরের সমান হওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন হাদীসে এর পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘নিঃস্ব মুসলিমগণ ধনীদের থেকে অর্ধেক দিন পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে যাবে।” [তিরমিযিঃ ২৩৫৩, ২৩৫৪]। সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে, বান্দাদের এক হাজার বছরের সমান হচ্ছে আল্লাহর একদিন। [ইবন কাসীর]

১৮:২০ اِنَّهُمۡ اِنۡ یَّظۡهَرُوۡا عَلَیۡکُمۡ یَرۡجُمُوۡکُمۡ اَوۡ یُعِیۡدُوۡکُمۡ فِیۡ مِلَّتِهِمۡ وَ لَنۡ تُفۡلِحُوۡۤا اِذًا اَبَدًا

২০.তারা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে তবে তো তারা তোমাদেরকে পাথরের আঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে তাদের মিল্লাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আর সে ক্ষেত্রে তোমরা কখনো সফল হবে না।

অর্থাৎ, আখেরাতের যে সফলতার জন্য আমরা এত কঠিনতা ও কষ্ট সহ্য করলাম, পরিষ্কার কথা যে, শহরের লোকেরা যদি পুনরায় আমাদেরকে পূর্বপুরুষদের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য করে, তাহলে আমাদের আসল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের পরিশ্রমও বরবাদে যাবে এবং আমরা না দ্বীন পাব, আর না দুনিয়া।

১৮:২১ وَ کَذٰلِکَ اَعۡثَرۡنَا عَلَیۡهِمۡ لِیَعۡلَمُوۡۤا اَنَّ وَعۡدَ اللّٰهِ حَقٌّ وَّ اَنَّ السَّاعَۃَ لَا رَیۡبَ فِیۡهَا ۚ٭ اِذۡ یَتَنَازَعُوۡنَ بَیۡنَهُمۡ اَمۡرَهُمۡ فَقَالُوا ابۡنُوۡا عَلَیۡهِمۡ بُنۡیَانًا ؕ رَبُّهُمۡ اَعۡلَمُ بِهِمۡ ؕ قَالَ الَّذِیۡنَ غَلَبُوۡا عَلٰۤی اَمۡرِهِمۡ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَیۡهِمۡ مَّسۡجِدًا

২১. আর এভাবে আমরা মানুষদেরকে তাদের হদিস জানিয়ে দিলাম যাতে তারা জানে যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং কিয়ামতে কোন সন্দেহ নেই। যখন তারা তাদের কর্তব্য বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করছিল তখন অনেকে বলল, তাদের উপর সৌধ নির্মাণ করা। তাদের রব তাদের বিষয় ভাল জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল তারা বলল, আমরা তো নিশ্চয় তাদের পাশে মসজিদ নির্মাণ করব।

সুরিয়ানী বর্ণনা অনুযায়ী সেকালে সেখানে কিয়ামত ও পরকাল সম্পর্কে বিষম বিতর্ক চলছিল ৷ যদিও রোমান শাসনের প্রভাবে সাধারণ লোক ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং পরকাল এ ধর্মের মৌলিক আকীদা বিশ্বাসের অংগ ছিল তবুও তখনো রোমীয় শিরক ও মূর্তি পূজা এবং গ্রীক দর্শনের প্রভাব ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী ৷ এর ফলে বহু লোক আখেরাত অস্বীকার অথবা কমপক্ষে তার অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতো ৷ আবার এ সন্দেহ ও অস্বীকারকে যে জিনিসটি শক্তিশালী করছিল সেটি ছিল এই যে, এফিসুসে বিপুল সংখ্যক ইহুদী বাস করতো এবং তাদের একটি সম্প্রদায় ( যাদেরকে সাদুকী বলা হতো ) প্রকাশ্যে আখেরাত অস্বীকার করতো ৷ তারা আল্লাহর কিতাব ( অর্থাৎ তাওরাত ) থেকে আখেরাত অস্বীকৃতির প্রমাণ পেশ করতো ৷ এর মোকাবিলা করার জন্য ঈসায়ী আলেমগণের কাছে শক্তিশালী যুক্তি – প্রমাণ ছিল না ৷

সেকালে সেখানে কেয়ামত ও আখেরাত সম্পর্কে বিষম বিতর্ক চলছিল। যদিও রোমান শাসনের প্রভাবে সাধারণ লোক ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং আখেরাত এ ধর্মের মৌলিক আকীদা বিশ্বাসের অংগ ছিল তবুও তখনো রোমীয় শির্ক ও মূর্তি পূজা এবং গ্রীক দর্শনের প্রভাব ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। এর ফলে বহু লোক আখেরাত অস্বীকার অথবা কমপক্ষে তার অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতো। ঠিক এ সময় আসহাবে কাহফের ঘুম থেকে জেগে উঠার ঘটনাটি ঘটে এবং এটি মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের সপক্ষে এমন চাক্ষুষ প্রমাণ পেশ করে যা অস্বীকার করার কোন উপায় ছিল না। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

কাফিররা ধারণা করে যে, তাদেরকে কখনো পুনরুত্থিত করা হবে না। বলুন, অবশ্যই হ্যাঁ, আমার রবের শপথ! তোমাদেরকে অবশ্যই পুনরুত্থিত করা হবে। তারপর তোমরা যা করতে সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে অবশ্যই অবহিত করা হবে। আর এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। তাগাবুনঃ ৭

আর তোমরা সে দিনের তাকওয়া অবলম্বন কর যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না(১)। আর কারো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে ন এবং কারো কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না। আর তারা সাহায্যও প্রাপ্ত হবে না। বাকারাঃ৪৮

রসুল (স.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন মানব জাতিকে মথিত আটার ন্যায় লালিমাযুক্ত শ্বেতবর্ণ -যমীনে একত্রিত করা হবে, যেখানে কারো কোন ঘরবাড়ির চিহ্ন থাকবে না (বুখারী-মুসলিম)।

রসুল (স.) বলেন, “হে মোহাম্মদের কন্যা ফাতিমা! আমার ধন-সম্পদ থেকে তোমার যা ইচ্ছা তা চেয়ে নিতে পার। কিন্তু পরকালীন আজাব থেকে (আমার কন্যা হবার কারণে) তোমাকে রক্ষা করতে পারবো না (বুখারী)।

আখেরাতের অবস্থা সম্পর্কে জানি-

لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ اَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِیْۤ اَصْحٰبِ السَّعِیْرِ.

আমরা যদি শুনতাম এবং বুদ্ধিকে কাজে লাগাতাম, তবে (আজ) আমরা জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম না। -সূরা মুলক (৬৭) : ১০

আরও বলবে-یٰلَیْتَنِیْ قَدَّمْتُ لِحَیَاتِی.

হায়! আমি যদি আমার এই জীবনের জন্য অগ্রিম কিছু পাঠাতাম! -সূরা ফাজর (৮৯) : ২৪

জান্নাতীদের সঙ্গে তাদের এমন কথাও হবে যে, জান্নাতীরা জিজ্ঞেস করবে, তোমরা জাহান্নামে কেন? তারা উত্তরে বলবে, (তরজমা) ‘আমরা নামায পড়তাম না, মিসকীনদেরকে খাওয়াতাম না,… আখেরাত দিবসকে অস্বীকার করতাম। এখন এই নিশ্চিত বিষয়টি আমাদের সামনে এসে গেছে।’ -সূরা মুদ্দাছ্ছির (৭৪) : ৪৩-৪৭

বক্তব্যের তাৎপর্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এটি ছিল ঈসায়ী সজ্জনদের উক্তি। তাদের মতে আসহাবে কাহফ গুহার মধ্যে যেভাবে শুয়ে আছেন সেভাবেই তাদের শুয়ে থাকতে দাও এবং গুহার মুখ বন্ধ করে দাও। তাদের রবই ভাল জানেন তারা কারা, তাদের মর্যাদা কি এবং কোন ধরনের প্রতিদান তাদের উপযোগী। [ইবন কাসীর]

সম্ভবত: এখানে রোম সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ এবং খৃষ্টীয় গীর্জার ধর্মীয় নেতৃবর্গের কথা বলা হয়েছে, যাদের মোকাবিলায় সঠিক আকীদা-বিশ্বাসের অধিকারী ঈসায়ীদের কথা মানুষের কাছে ঠাই পেতো না। পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে পৌঁছতে পৌঁছতে সাধারণ নাসারাদের মধ্যে বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক গীর্জাসমূহে শির্ক, আউলিয়া পূজা ও কবর পূজা পুরো জোরেশোরে শুরু হয়ে গিয়েছিল। বুযর্গদের আস্তানা পূজা করা হচ্ছিল এবং ঈসা, মারইয়াম ও হাওয়ারীগণের প্রতিমূর্তি গীর্জাগুলোতে স্থাপন করা হচ্ছিল। আসহাবে কাহফের নিদ্রাভিংগের মাত্র কয়েক বছর আগে মতান্তারে ৪৩১ খৃষ্টাব্দে সমগ্র খৃষ্টীয় জগতের ধর্মীয় নেতাদের একটি কাউন্সিল এ ‘আফসোস’ নগরীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিলর

সেখানে ঈসা আলাইহিস সালামের ইলাহ হওয়া এবং মারইয়াম আলাইহাস সালামের “ইলাহ-মাতা” হওয়ার আকীদা চার্চের সরকারী আকীদা হিসেবে গণ্য হয়েছিল। এ ইতিহাস সামনে রাখলে পরিষ্কার জানা যায়, এখানে (الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَىٰ أَمْرِهِمْ) বাক্যে যাদেরকে প্রাধান্য লাভকারী বলা হয়েছে তারা হচ্ছে এমনসব লোক যারা ঈসা আলাইহিস সালামের সাচ্চা অনুসারীদের মোকাবিলায় তৎকালীন খৃষ্টান জনগণের নেতা এবং তাদের শাসকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়াবলী যাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। মূলত এরাই ছিল শির্কের পতাকাবাহী এবং এরাই আসহাবে কাহফের সমাধি সৌধ নির্মাণ করে সেখানে মসজিদ তথা ইবাদাতখানা নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা রাহেমাহুল্লাহ এ সম্ভাবনাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। [দেখুন, ইকতিদায়ুস সিরাতিল মুস্তাকীম: ১/৯০]

মুসলিমদের মধ্যে কিছু লোক কুরআন মজীদের এ আয়াতটির সম্পূর্ণ উল্টা অর্থ গ্রহণ করেছে। তারা এ থেকে প্রমাণ করতে চান যে, নবী-রাসূল সাহাবী ও সৎ লোকদের কবরের উপর সৌধ ও মসজিদ নির্মাণ জায়েয। অথচ কুরআন এখানে তাদের এ গোমরাহীর প্রতি ইংগিত করছে যে, এ যালেমদের মনে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও আখেরাত অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রত্যয় সৃষ্টি করার জন্য তাদেরকে যে নির্দশন দেখানো হয়েছিল তাকে তারা শির্কের কাজ করার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একটি সুযোগ মনে করে নেয় এবং ভাবে যে, ভালই হলো পূজা করার জন্য আরো কিছু আল্লাহর অলী পাওয়া গেলো।

তাছাড়া এই আয়াত থেকে “সালেহীন” তথা সৎ লোকদের কবরের উপর মসজিদ তৈরী করার প্রমাণ কেমন করে সংগ্রহ করা যেতে পারে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন উক্তির মধ্যে এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছেঃ

কবর যিয়ারতকারী নারী ও কবরের উপর মসজিদ নির্মাণকারীদের প্রতি আল্লাহ্‌ লানত বর্ষণ করেছেন।” [সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৩১৮০, মুসনাদে আহমদঃ ১/২২৯, ২৮৭, ৩২৪, তিরমিযীঃ ৩২০, আবু দাউদঃ ৩২৩৬]।

আরো বলেছেনঃ “সাবধান হয়ে যাও, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবীদের কবরকে ইবাদাতখানা বানিয়ে নিতো। আমি তোমাদের এ ধরনের কাজ থেকে নিষেধ করছি।” [মুসলিমঃ ৫৩২]। আরো বলেনঃ

“আল্লাহ ইয়াহুদী ও নাসারাদের প্রতি লানত বর্ষণ করেছেন। তারা নিজেদের নবীদের কবরগুলোকে ইবাদতখানায় পরিণত করেছে।” [আহমদঃ ১/২১৮, মুসলিমঃ ৩৭৬]।

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “এদের অবস্থা এ ছিল যে, যদি এদের মধ্যে কোন সৎ লোক থাকতো তার মৃত্যুর পর এরা তার কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করতো এবং তার ছবি তৈরী করতো। এরা কিয়ামতের দিন নিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসেবে গণ্য হবে।” [বুখারীঃ ৪১৭, মুসলিমঃ ৫২৮]।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ সুস্পষ্ট বিধান থাকার পরও কোন আল্লাহভীরু ব্যক্তি কুরআন মজীদে ঈসায়ী পাদ্রী ও রোমীয় শাসকদের যে ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড কাহিনীচ্ছলে বর্ণনা করা হয়েছে তাকেই ঐ নিষিদ্ধ কর্মটি করার জন্য দলীল ও প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করাবার দুঃসাহস কিভাবে করতে পারে? [এ ব্যাপারে আরও দেখুন, কুরতুবী; ইবন কাসীর]

১৮:২২ سَیَقُوۡلُوۡنَ ثَلٰثَۃٌ رَّابِعُهُمۡ کَلۡبُهُمۡ ۚ وَ یَقُوۡلُوۡنَ خَمۡسَۃٌ سَادِسُهُمۡ کَلۡبُهُمۡ رَجۡمًۢا بِالۡغَیۡبِ ۚ وَ یَقُوۡلُوۡنَ سَبۡعَۃٌ وَّ ثَامِنُهُمۡ کَلۡبُهُمۡ ؕ قُلۡ رَّبِّیۡۤ اَعۡلَمُ بِعِدَّتِهِمۡ مَّا یَعۡلَمُهُمۡ اِلَّا قَلِیۡلٌ ۬۟ فَلَا تُمَارِ فِیۡهِمۡ اِلَّا مِرَآءً ظَاهِرًا ۪ وَّ لَا تَسۡتَفۡتِ فِیۡهِمۡ مِّنۡهُمۡ اَحَدًا

২২. কেউ কেউ বলবে, তারা ছিল তিনজন তাদের চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর এবং কেউ কেউ বলবে, তারা ছিল পাঁচজন, তাদের ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর, গায়েবী বিষয়ে অনুমানের উপর নির্ভর করে। আবার কেউ কেউ বলবে, তারা ছিল সাতজন, তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলুন, আমার রবই তাদের সংখ্যা ভাল জানেন; তাদের সংখ্যা কম সংখ্যক লোকই জানে। সুতরাং সাধারণ আলোচনা ছাড়া আপনি তাদের বিষয়ে বিতর্ক করবেন না এবং এদের কাউকেও তাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন না।

এ থেকে জানা যায়, এ ঘটনার পৌনে তিনশো বছর পরে কুরআন নাযিলের সময় এর বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে নাসারাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাহিনী প্রচলিত ছিল। তবে নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি সাধারণ লোকদের জানা ছিল না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মৌখিক বর্ণনার সাহায্যে ঘটনাবলী চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো এবং সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তাদের বহু বিবরণ গল্পের রূপ নিতো। তবুও যেহেতু তৃতীয় বক্তব্যটির প্রতিবাদ আল্লাহ করেননি তাই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সঠিক সংখ্যা সাতই ছিল। তাছাড়া ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলতেন। আমি সেই কম সংখ্যক লোকদের অন্যতম যারা তাদের সংখ্যা জানে, তারা সংখ্যায় ছিল সাতজন।” [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

তাদের সংখ্যাটি জানা আসল কথা নয়। বরং আসল জিনিস হচ্ছে এ কাহিনী থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করা। [দেখুন, ইবন কাসীর]

এই কথাগুলোর উপরেই ক্ষান্ত থাক, যা তোমাকে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথবা সংখ্যা নির্দিষ্টীকরণের ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করো না। কেবল এতটা বলে দাও যে, এই নির্দিষ্টীকরণের কোন দলীল নেই।

অর্থাৎ, বিতর্ককারীদেরকে কিছুই জিজ্ঞাসা করো না। কারণ, যাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তার জ্ঞান জিজ্ঞাসাকারীর চেয়েও অধিক থাকা উচিত। আর এখানে তো ব্যাপার উল্টা। তোমার কাছে তবুও নিশ্চিত জ্ঞানের একটি মাধ্যম — অহী — রয়েছে। পক্ষান্তরে অন্যদের কাছে অনুমান ও ধারণা ব্যতীত কিছুই নেই।

নুমান আলী খানের লেকচারে জানা যায়-

এই আয়াতের আরেকটি নির্দেশনা হলো-ইহুদী নাসারাদের গ্রন্থে যা উল্লেখ আছে এই কাহফবাসী সম্পর্কে সেখানে অনেক পরিবর্তন ও বিকৃত রুপেই আছে, আর কুর’আন হলো অবিকৃত,মহান রবের বানী। আরেকটি মেসেজ হলো এই সংক্রান্ত বা ফিকাহ সংক্রান্ত কোন কিছু জানতেও ওদের সাহায্য বা কিতাব পড়তে না যেতে।

তাফহিমুল কুর’আনে-

এ থেকে জানা যায়, এই ঘটনার পৌনে তিনশো বছর পরে কুরআন নাযিলের সময় এ বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে খৃষ্টানদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাহিনী প্রচলিত ছিল ৷ তবে নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি সাধারণ লোকদের জানা ছিল না ৷ আসলে তখন তো ছাপাখানার যুগ ছিল না ৷ কাজেই যেসব বইতে তাদের সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে বেশী সঠিক তথ্যাদি ছিল সেগুলো সাধারণভাবে প্রকাশ করার কোন সুযোগ ছিল না ৷ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মৌলিক বর্ণনার সাহায্যে ঘটনাবলী চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো এবং সময় অথিবাহিত হবার সাথে সাথে তাদের বহু বিররণ গল্পের রূপ নিতো ৷ তবুও যেহেতু তৃতীয় বক্তব্যটির প্রতিবাদ আল্লাহ করেননি তাই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সঠিক সংখ্যা সাতই ছিল ৷

তাদের সংখ্যাটি আসল নয় বরং আসল জিনিস হচ্ছে এ কাহিনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা ৷ এ কাহিনী থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, একজন সাচ্চা মুমিনের কোন অবস্থায়ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং মিথ্যার সামনে মাথা নত করে দেবার জন্য তৈরী থাকা উচিত নয় ৷ এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, মুমিনের ভরসা দুনিয়াবী উপায় উপকরণের উপর নয় বরং আল্লাহর উপর থাকতে হবে এবং সত্যপথানুসারী হবার জন্য বাহ্যত পরিবেশের মধ্যে কোন অনুকূল্যের চিহ্ন না দেখা গেলেও আল্লাহর উপর ভরসা করে সত্যের পথে এগিয়ে যেতে হবে ৷ এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে,যে ” প্রচলিত নিয়ম”কে লোকেরা ” প্রাকৃতিক আইন ” মনে করে এবং এ আইনের বিরুদ্ধে দুনিয়ায় কিছুই হতে পারে না বলে ধারণা করে, আসলে আল্লাহর মোটেই তা মেনে চলার প্রয়োজন নেই ৷ তিনি যখনই এবং যেখানেই চান এ নিয়ম পরিবর্তন করে যে অস্বাভাবিক কাজ করতে চান করতে পারেন ৷ কাউকে দু’শো বছর ঘুম পাড়িয়ে এমনভাবে জাগিয়ে তোলা যে, সে যেন মাত্র কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়েছে এবং তার বয়স, চেহারা – সুরত, পোশাক, স্বাস্থ্য তথা কোনকিছুর ওপর একালের বিবর্তনের কোন প্রভাব না পড়া, এটা তাঁর জন্য কোন বড় কাজ নয় ৷ এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, মানব জাতির অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত বংশধরদেরকে একই সংগে জীবিত করে উঠিয়ে দেয়া, যে ব্যাপারে নবী গণ ও আসমানী কিতাবগুলো আগাম খবর দিয়েছে, আল্লাহর কুদরতের পক্ষে মোটেই কোন অসম্ভব ব্যপার নয় ৷ এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, অজ্ঞ ও মূর্খ মানুষেরা কিভাবে প্রতি যুগে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে নিজেদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও শিক্ষার সম্পদে পরিণত করার পরিবর্তে উল্টা সেগুলোকে নিজেদের বৃহত্তর ভ্রষ্টতার মাধ্যমে পরিণত করতো ৷ আসহাবে কাহফের অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ মানুষকে এ জন্য দেখিয়েছিলেন যে, মানুষ তার মাধ্যমে পরকাল বিশ্বাসের উপকরণ লাভ করতে, ঠিক সেই ঘটনাকেই তারা এভাবে গ্রহণ করলো যে, আল্লাহ তাদেরকে পূজা করার জন্য আরো কিছু সংখ্যক অলী ও পূজনীয় ব্যক্তিত্ব দিয়েছেন ৷ — এ কাহিনী থেকে মানুষকে এ আসল শিক্ষাগুলো গ্রহণ করা উচিত এবং এর মধ্যে এগুলোই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত বিষয় ৷ এ বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে এ মর্মে অনুসন্ধান ও গবেষণা শুরু করে দেয়া যে, আসহাবে কাহফ কতজন ছিলেন, তাদের নাম কি ছিল, তাদের কুকুরের গায়ের রং কি ছিল এসব এমন ধরনের লোকের কাজ যারা ভেতরের শাঁস ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র বাইরের ছাল নিয়ে নাড়াচাড়া করা পছন্দ করে ৷ তাই মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে মুমিনদেরকে এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, যদি অন্য লোকেরা এ ধরনের অসংলগ্ন বিতর্কের অবতারণা করেও তাহলে তোমরা তাতে নাক গলাবে না এবং এ ধরনের প্রশ্নর জবাব দেবার জন্য অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়ে নিজেদের সময় নষ্ট করবে না ৷ বরং কেবলমাত্র কাজের কথায় নিজেদের সময় ক্ষেপন করবে ৷ এ কারণেই আল্লাহ নিজেও তাদের সঠিক সংখ্যা বর্ণনা করেননি ৷ এর ফলে আজে বাজে বিষয়ের মধ্যে নাক গলিয়ে অযথা সময় নষ্ট করতে যারা অভ্যস্ত তারা নিজেদের এ অভ্যাসকে জিইয়ে রাখার মাল মসলা পাবে না ৷

সংগ্রহে-

তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন