সূরা কাহফঃআসহাবে কাহফের ঘটনাঃ ৪র্থ পর্ব।৪র্থ রুকুঃ ১ম পর্বঃ( ২৩-২৬ আয়াত)

সূরা কাহফ

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

৪র্থ রুকুঃ ১ম পর্বঃ( ২৩-২৬ আয়াত)

আসহাবে কাহফের ঘটনাঃ ৪র্থ/ শেষ পর্ব

 

১৮:২৩ وَ لَا تَقُوۡلَنَّ لِشَایۡءٍ اِنِّیۡ فَاعِلٌ ذٰلِکَ غَدًا

২৩. আর কখনই আপনি কোন বিষয়ে বলবেন না, আমি তা আগামীকাল করব,

১৮:২৪ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰهُ ۫ وَ اذۡکُرۡ رَّبَّکَ اِذَا نَسِیۡتَ وَ قُلۡ عَسٰۤی اَنۡ یَّهۡدِیَنِ رَبِّیۡ لِاَقۡرَبَ مِنۡ هٰذَا رَشَدًا

২৪. ‘আল্লাহ ইচ্ছে করলে’ এ কথা না বলে আর যদি ভুলে যান তবে আপনার রবকে স্মরণ করবেন এবং বলবেন, সম্ভবত আমার রব আমাকে এটার চেয়ে সত্যের কাছাকাছি পথ নির্দেশ করবেন।

এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার উম্মতকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতকালে কোন কাজ করার ওয়াদা বা স্বীকারোক্তি করলে এর সাথে “ইনশাআল্লাহ” বাক্যটি যুক্ত করতে হবে। কেননা, ভবিষ্যতে জীবিত থাকবে কিনা তা কারো জানা নেই। জীবিত থাকলেও কাজটি করতে পারবে কিনা, তারও নিশ্চয়তা নেই। কাজেই মুমিনের উচিত মনে মনে এবং মুখে স্বীকারোক্তির মাধ্যমে আল্লাহর উপর ভরসা করা। ভবিষ্যতে কোন কাজ করার কথা বললে এভাবে বলা দরকারঃ যদি আল্লাহ চান, তবে আমি এ কাজটি আগামী কাল করব। ইনশাআল্লাহ বাক্যের অর্থ তাই।

মুমিন তার জীবনের প্রতিটি কাজে আল্লাহকে স্মরণ করবে। সে নির্ভর করবে একমাত্র আল্লাহর উপর, নিজের শক্তি সামর্থের ও উপায় উপকরণের উপর নয়। তাইতো মুমিন ভবিষ্যতের কোনো কাজের কথা বলতে ‘‘ইনশাআল্লাহ’’ বলে। ‘‘ইনশাআল্লাহ’ অর্থ ‘‘যদি আল্লাহ চান। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আদব, যা আল্লাহ কুরআনে শিখিয়েছেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন (অর্থ) ‘‘তোমরা ইচ্ছা করবে না (তোমাদের ইচ্ছা বাস্তবে রূপ নিবে না) যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।-সূরা তাকভীর : ২৯

হাদিস দ্বারাও সাব্যস্ত যে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কাজ শুরুর আগে ইনশাআল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করতেন। হাদিসে এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কেউ ইনশাআল্লাহ বলে কোনো কসম করলে তার গুনাহ হবে না। ( তিরমিজি, ১৪৫১)

ইনশাআল্লাহ শব্দটি দুটি ভাগে বিভক্ত: ইনশা এবং আল্লাহ। ইনশা একটি আরবি শব্দ যা “যদি” অর্থে ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ আরবি শব্দ যা “আল্লাহ” অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই ইনশাআল্লাহ শব্দটি “আল্লাহ যদি চান” বা “আল্লাহর ইচ্ছায়” অর্থে ব্যবহৃত হয়।

ইনশাআল্লাহ বলার ফজিলতগুলির মধ্যে রয়েছে:

এটি আমাদেরকে আল্লাহর উপর ভরসা করতে এবং তাঁর ইচ্ছার উপর নির্ভর করতে সাহায্য করে।

এটি আমাদেরকে অহংকার এবং আত্মবিশ্বাস থেকে দূরে রাখে।

এটি আমাদেরকে ধৈর্যশীল এবং আশাবাদী হতে সাহায্য করে।

এটি আমাদেরকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা এবং রহমত প্রার্থনা করতে সাহায্য করে।

এটি আমাদেরকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে সাহায্য করে।

ইনশাল্লাহ এবং ইনশাআল্লাহ শব্দের মাঝে ইনশাআল্লাহ শব্দটি সঠিক

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “সুলাইমান ইবনে দাউদ ‘আলাইহিমোস সালাম বললেনঃ আমি আজ রাতে আমার সত্তর জন স্ত্রীর উপর উপগত হব। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে- নব্বই জন স্ত্রীর উপগত হব, তাদের প্রত্যেকেই একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেবে যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। তখন তাকে ফিরিশতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন যে, বলুনঃ ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তিনি বললেন না। ফলে তিনি সমস্ত স্ত্রীর উপর উপনীত হলেও তাদের কেউই কোন সন্তান জন্ম দিল না। শুধু একজন স্ত্রী একটি অপরিণত সন্তান প্রসব করল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ যার হাতে আমার প্রাণ, সে যদি বলত ইনশাআল্লাহ, তবে অবশ্যই তার ওয়াদা ভঙ্গ হত না। আর তা তার ওয়াদা পূর্ণতায় সহযোগী হত’৷ [বুখারীঃ ৩৪২৪, ৫২৪২,৬৬৩৯, ৭৪৬৯, মুসলিমঃ ১৬৫৪, আহমাদঃ ২/২২৯, ৫০৬]

কোন কোন মুফাসসির বলেন, আয়াতের অর্থ হলো, যখনি আপনি কোন কিছু ভুলে যাবেন তখনই আল্লাহকে স্মরণ করবেন। কারণ, ভুলে যাওয়াটা শয়তানের কারসাজির ফলে ঘটে। আর মহান আল্লাহর স্মরণ শয়তানকে দূরে তাড়িয়ে দেয় যা পুনরায় স্মরণ করতে সাহায্য করবে। এ অর্থটির সাথে পরবর্তী বাক্যের মিল বেশী। অপর কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতটি পূর্বের আয়াতের সাথে মিলিয়ে অর্থ করতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি ইনশাল্লাহ ভুলে যান তবে যখনই মনে হবে তখনই ইনশাআল্লাহ বলে নেবেন। [দেখুন, ইবন কাসীর]

১৮:২৫ وَ لَبِثُوۡا فِیۡ کَهۡفِهِمۡ ثَلٰثَ مِائَۃٍ سِنِیۡنَ وَ ازۡدَادُوۡا تِسۡعًا

২৫. আর তারা তাদের গুহায় ছিল তিনশ বছর, আরো নয় বছর বেশী।

অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এটাকে আল্লাহর উক্তি গণ্য করেছেন। সৌর মাস হিসাবে ৩০০ এবং চান্দ্র মাস হিসাবে ৩০৯ বছর হয়। কোন কোন আলেমের ধারণা হল, এটা তাদেরই কথা, যারা তাদের সংখ্যার ব্যাপারে বিভিন্ন মত পেশ করছিল। আর এর দলীল হল আল্লাহর এই বাণী, ‘‘তুমি বল, তারা কত কাল ছিল, তা আল্লাহই ভাল জানেন।’’ বলা বাহুল্য তাঁরা এরই ভিত্তিতে (আয়াতে) উল্লিখিত মেয়াদের খন্ডন করার অর্থ নিয়ে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ মুফাসসিরদের তফসীর অনুযায়ী এর অর্থ এই যে, আহলে-কিতাব অথবা অন্য কেউ যদি (আয়াতে) বর্ণিত এই সময়-কালের ব্যাপারে বিরোধিতা করে, তবে তুমি তাদেরকে বলে দাও যে, তোমরা বেশী জান, না আল্লাহ? তিনি যখন ৩০৯ বছরের কথা বলেছেন, তখন এটাই সঠিক। কেননা, তিনিই জানেন তারা কত বছর গুহায় ছিল?

১৮:২৬ قُلِ اللّٰهُ اَعۡلَمُ بِمَا لَبِثُوۡا ۚ لَهٗ غَیۡبُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اَبۡصِرۡ بِهٖ وَ اَسۡمِعۡ ؕ مَا لَهُمۡ مِّنۡ دُوۡنِهٖ مِنۡ وَّلِیٍّ ۫ وَّ لَا یُشۡرِکُ فِیۡ حُکۡمِهٖۤ اَحَدًا

২৬. আপনি বলুন, তারা কত কাল অবস্থান করেছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন, আসমান ও যমীনের গায়েবের জ্ঞান তাঁরই। তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্রোতা! তিনি ছাড়া তাদের অন্য কোন অভিভাবক নেই। তিনি কাউকেও নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না।

মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই গল্প শুনতে পছন্দ করে। গল্পচ্ছলে শিক্ষার্জনও প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের জন্য সহজসাধ্য। এ কারণে মহান আল্লাহ আজ্জা ওয়া যাল অতীতের বিভিন্ন সত্য ঘটনা উল্লেখ করার মাধ্যমে আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিক্ষা দিয়েছেন। এমনই একটি ঘটনা হলো আসহাবে কাহফ বা গুহাবাসীদের ঘটনা। আল-কোরআনে বর্ণিত অন্যান্য ঘটনার মতো এটিও অনেক শিক্ষণীয় এবং প্রত্যেক বিশ্বাসীর জন্য এতে রয়েছে চিন্তার খোরাক। এই ঘটনাটি সূরা কাহফের ৯-২৬ আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। এই সত্য অথচ বাখ্যাতীত ঘটনাটির মূলকথা হলো- “ঈমানের পরীক্ষা”।

  শিক্ষাঃ

এছাড়াও এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে শেখাচ্ছেন-

১। ইসলামি একত্ববাদের জন্য আত্মত্যাগঃ

এই ঘটনার মূল শিক্ষা হলো ইসলাম ও একত্ববাদের জন্য আমাদের আত্মত্যাগ কেমন হতে পারে। যে তরুণদের ঘিরে এই ঘটনাটি, তাদের সমকালীন সমাজ ও শাসক আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করেছিল। কতিপয় যুবক যারা এই কাজে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, তারা যদি আল্লাহর সাথে অন্যান্য মিথ্যা মা’বুদের ইবাদাত করতো তবে হয়তো তাদের সমাজের রোষানলে পড়তে হতো না; কিন্তু তারা তা করেনি, ফলশ্রুতিতে আল্লাহর সাহায্যে কোনো ক্ষতিই তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। বর্তমানে অনেক যুবকদের দেখা যায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বিলাসী জীবনযাপন করে পরিবারের সামান্য বাধার মুখে পড়লেই হা-হুতাশ করে। অথচ আলোচ্য ঘটনার যুবকেরা তাদের পরিবার, ঘর, সমাজ এবং নিশ্চিত জীবন ছেড়ে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়িয়েছিলো। দৃশ্যতই দ্বীনের স্বার্থে এ ছিল অনেক বড় আত্মত্যাগ।

২। যেকোনো পরিস্থিতিতে একমাত্র আল্লাহর ওপর আস্থা পোষণঃ

তরুণরা পালিয়ে এসে সম্পূর্ণ নির্জন, অচেনা ও অজানা গুহার মাঝে আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো এই বলে-

“হে আমাদের প্রভু! আমাদের ওপর আপনার রহমত বর্ষিত করুন এবং সঠিক উপায়ে আমাদের জন্য ব্যবস্থা করুন।” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ১০]

আল্লাহর ওপর অসীম আস্থা স্থাপনের এ এক অনন্য উদাহরণ। এ থেকে আমরা তাওয়াক্কুলের একটি মূলনীতিও জানতে পারি- সর্বসাধ্য চেষ্টার সাথে আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে।

৩। যুবকরা সমাজে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারেঃ

যুগে যুগে প্রতিটি সভ্যতার কারিগর হিসেবে থেকেছে ন্যয়নিষ্ঠ যুবকেরাই। তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়-অনাচারের প্রতিবাদে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। অন্যায্য সামাজিক প্রথাকে তারা তোয়াক্কা করে না। ঈমানদার তরুণদের হৃদয়ে আল্লাহ তা’আলা অগাধ সাহসিকতা দান করেন। আলোচ্য গল্পের যুবকেরা সমাজের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে শাসকের অত্যাচারের শিকার হয়েছিলো। কিন্তু তা তাদের মত প্রকাশে দমাতে পারেনি। হাদীস থেকে জানা যায়, মুসলিম হিসেবে যেসব তরুণ তাদের তারুণ্য ব্যয় করে আল্লাহ তাদেরকে তাঁর আরশের নিচে আশ্রয় দিবেন বিচার দিবসের সেই কঠিন দিনে যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। এভাবেই ঈমানদার মুসলিম যুবকেরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম হয়।

৪। যারা কেবল আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহই তাদের জন্য যথেষ্টঃ

আল্লাহ তা’আলা গুহার যুবকদের হৃদয়ে সাহস যুগিয়ে, ঘুমন্ত রেখে এবং মাটির গ্রাস থেকে নিরাপদ রেখে তাদের রক্ষা করেছিলেন। তাই পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন, আল্লাহ আমাদেরকে প্রতিটি অবস্থায় সাহায্য করার সামর্থ্য রাখেন। এজন্য আমাদের করণীয় হলো, তাঁর ওপর অগাধ আস্থা রাখা এবং সুখের দিনগুলোতেও তাঁর আদেশকে যথাযথভাবে মেনে চলা। কেবলমাত্র তাহলেই আল্লাহ আমাদের বিপদের দিনগুলোতে আমাদের ডাকে দ্রুত সাড়া দিবেন। কোনো ঘটনায় আমরা আশার আলো দেখতে না পেলে সেখানেও আল্লাহ অপ্রত্যাশিতভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতে পারেন, সমাধান এনে দিতে পারেন। আল্লাহ বলেন-

“যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পরিত্রাণের পথ খুলে দিবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রিযক দান করবেন; যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।” [সূরা আত-ত্বলাক(৬৫): ২-৩]

তিরমিযী ও ইবনে মাজায় বর্ণিত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যদি তোমরা আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা করতে, তবে আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে পাখির ন্যায় রিযিক দান করতেন। পাখি সকাল বেলায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় উদরপূর্তি করে ফিরে আসে।” [মুসনাদে আহমাদ: ১/৩০, তিরমিযী: ২৩৪৪, ইবনে মাজাহঃ ৪১৬৪]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ আমার উম্মত থেকে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্ৰবেশ করবে। তাদের অন্যতম গুণ এই যে, তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করবে। [বুখারী: ৫৭০৫, মুসলিম: ২১৮, মুসনাদে আহমাদ: ১/৪০১]

মূলত কেউ আল্লাহর জন্য আত্মত্যাগে এগিয়ে এলে আল্লাহ তার হৃদয়ে শক্তি যোগান এবং তার এ কাজকে সহজ করে দেন। এটা আল্লাহর ওয়াদা যা তিনি একটি হাদীসে কুদসীর মাধ্যমে জানিয়েছেন- কেউ যদি আল্লাহর দিকে হেঁটে আসে, আল্লাহ তার দিকে দৌড়ে আসবেন। এভাবেই ক্রমান্বয়ে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে নৈকট্য বাড়তে থাকে।

৫। দাওয়াহর মূলনীতিঃ

যুবকদের কথোপকথন থেকে আমরা দা’ওয়াহর মূলনীতি আহরণ করতে পারি। প্রথমেই মানুষকে তাওহীদের প্রতি আহবান করতে হবে এবং আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করার কুফল বোঝাতে হবে। শুধু গ্রন্থগত তাত্ত্বিক উদাহরণ দেওয়া নয় বরং আলোচনামূলক বিতর্ক এবং যুক্তি ও সাধারণ বুদ্ধির দ্বারা সত্যকে বুঝাতে হবে। যুবকেরা তাওহীদ আর-রুবুবিয়াহ এবং তাওহীদ আল-উলুহিয়াহর দাওয়াত দিয়েছিলো এভাবে-

“আমাদের রব আসমান ও জমিনের রব। আমরা তাঁর পাশে আর কোনো প্রভু গ্রহণ করতে পারি না…” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ১৯]

অতঃপর তারা শিরকের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে আলোচনা করেছিলো,

“…যদি আমরা করতাম, তবে তা অতিশয় গর্হিত কাজ হতো।” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ১৪]

এরপর সমাজের লোকদেরকে তাদের মতের পেছনে প্রমাণ দেখানোর আহবান করে তারা বলেছিলো,

“…তারা এসব মা’বূদ সম্বন্ধে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন?…” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ১৫]

যখন তাদের দাওয়াহ প্রত্যাখ্যাত হলো, তারা একে অপরকে ধৈর্য ও সত্যের ওপর অটল থাকার উপদেশ দিলো এই বলে-

“…তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করবার ব্যবস্থা করবেন।” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ১৬]

আল্লাহ তা’আলা সূরা আল-আসরেও একে অপরকে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দেওয়ার ঠিক একই নির্দেশ দিয়েছেন।

৬। গায়েবের বিষয়ে মাথা না ঘামানোঃ

আল্লাহ তা’আলা মানবজাতিকে তাঁর অসীম জ্ঞানের তুলনায় খুব নগণ্যই জ্ঞান দান করেছেন। আমাদের তিনি যেসব জ্ঞান দান করেছেন তার অধিকাংশই দৃশ্যমান জগত সম্পর্কে। অদৃশ্য জগতের জ্ঞান (যেমন, কিয়ামাতের আলামত, বিচার দিবসের ঘটনাসমূহ, মৃত্যু পরবর্তী পুরষ্কার ও শাস্তি ইত্যাদি) একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই জানেন। তিনি কেবলমাত্র তাঁর ইচ্ছামাফিক বিষয়গুলোই আমাদের জানিয়েছেন তাঁর নবী ও রসূলদের মাধ্যমে। তাই অদৃশ্যের ব্যাপারে গবেষণা ও অতিরিক্ত মাথা ঘামানো অনুচিত, বরং এসব ব্যাপার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। যুবকেরাও একই কাজটি করেছিল,

“…তোমরা কতকাল অবস্থান করেছো, তা তোমাদের প্রতিপালকই ভালো জানেন…” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ১৯]

৭। কিছু ফিক্বহী নীতিমালা আহরণঃ

ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর যুবকেরা একে অপরকে বলেছিলো

“…এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে প্রেরণ কর; সে যেন দেখে কোন খাদ্য উত্তম ও তা হতে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য…” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ১৯]

আলিমগণ এই আয়াত থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে অনুমতির নীতিমালা তুলে এনেছেন,

১। অন্যদেরকে ক্রয়-বিক্রয়ে নিয়োগ দান বৈধ,

২। সবচেয়ে ভালো খাবারের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করাতে কোনো সমস্যা নেই,

৩। বিক্রয়ের সময় কোনো কিছুকে “সবচেয়ে ভালো” বলে বর্ণনা দেওয়াতে দোষের কিছু নেই

৮। পরীক্ষার মুহূর্তে করণীয়ঃ

গুহায় ঘুম থেকে উঠার পর বাইরে লোক পাঠানোর ব্যাপারে যুবকেরা আলোচনা করতে লাগলো-

“…সে যেন বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে ও কিছুতেই যেন তোমাদের সম্বন্ধে কাউকেও কিছু জানতে না দেয়। তারা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে, তবে তোমাদেরকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নিবে এবং সেক্ষেত্রে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না।” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ১৯-২০]

এ থেকে আমরা ধৈর্য ধারণের মূলনীতি এবং সমাজের পরীক্ষা ও দুর্যোগ থেকে দূরে থাকার শিক্ষা পাই। বহু সহীহ হাদীস আমাদের বলে যে, কিয়ামাতের আগে ফিতনা জমিনে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে এবং মুসলিমরা নানাভাবে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এসব ফিতনা থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে এবং তাওহীদ ও সুন্নাহর পথে অবিচল থাকতে হবে। এই আয়াত আমাদের এ-ও শিক্ষা দেয় যে, নিজেদের ও আমাদের দ্বীনী ভাইদের ব্যাপারে গোপনীয়তা সর্বোতভাবে আমাদের রক্ষা করে চলতে হবে।

৯। আলিম ও বয়স্কদের কাছে বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে নেওয়াঃ

এটা বর্তমান ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রবাহের যুগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শত শত বই, লেকচার এবং তথ্যের উৎস ইন্টারনেটে ছড়িয়ে আছে। এসব উৎসকে বিশ্বাস করার পূর্বে সতর্কতার সাথে যাচাই করে নিতে হবে, বিশেষত ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারগুলোতে। এই মূলনীতিটি আমরা তরুণদের এই কথা থেকে পাই,

“এবং এভাবেই আমি তাদেরকে জাগ্রত করলাম, যাতে তারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে…” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ১৯]

তরুণেরা তাদের ঘুমের সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে একে অপরকে জিজ্ঞেস করেছিলো। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই গ্রহণ ও প্রচারের কারণে সাধারণ মানুষ তো বটেই, অনেক ‘আলিমদের মধ্যেই ভুল বোঝাবুঝি এবং তা থেকে পারস্পরিক দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ ও প্রচার করা তাই মুমিন মাত্রেরই দাবী। হাদীস থেকেও আমরা এই শিক্ষা পাই যেখানে রাসূল (সা) বলেছেন একজন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শুনবে তাই যাচাই না করেই প্রচার করবে।

১০। অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বিতর্কে না জড়ানোঃ

মহান আল্লাহ বলেন-

“অজানা বিষয়ে অনুমানের ওপর নির্ভর করে কেউ কেউ বলবে, তারা ছিল তিনজন, তাদের চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর; এবং কেউ কেউ বলে, তারা ছিল পাঁচজন এবং তাদের ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর; আর কেউ কেউ বলে, তারা ছিল সাতজন, তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর; বলো, আমার প্রতিপালকই তাদের সংখ্যা ভালো জানেন; তাদের সংখ্যা অল্প কয়েকজনই জানে; সাধারণ আলোচনা ব্যতীত তুমি তাদের বিষয়ে বিতর্ক কোরো না এবং তাদের কাউকেও তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করো না।” [সূরা আল-কাহফ(১৮): ২২]

উপরের আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বিতর্কে জড়ানো আমাদের নিজেদের ও অন্যদের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। বর্তমান যুগের মানুষের জন্য এটি একটি মারাত্মক সমস্যা। যেমন, দুনিয়াবি ও ধর্মীয় এমন বিষয়ে অনেকেই বিতর্ক করে যেগুলো কখনোই কোনো ফলপ্রসূ সমাধান আনে না। এ জাতীয় বিতর্ক সচেতনভাবে আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত।

আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন। collected from-

https://www.muslimmedia.info/2016/08/13/surah-kahf-story-of-the-youths-of-the-cave

নিচের অংশটি সংগ্রহ করা হয়েছে—সংকলন ও গ্রন্থনা : শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ (লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদী আরব)

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা যে সমস্ত ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তার প্রত্যেকটি ঘটনাতেই আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কিন্তু আমাদের অনেকেই সেই ঘটনাগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে শিক্ষণীয় বস্তুগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে না। বক্তাগণ এ সমস্ত ঘটনা বলে শ্রোতাদেরকে কখনও হাসান আবার কখনও কাঁদান ঠিকই, কিন্তু যেই উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ্ ঘটনাগুলো উল্লেখ করেছেন, সেই সুমহান উদ্দেশ্যগুলো অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্টই থেকে যায়। কুরআনে বর্ণিত আসহাফে কাহাফ বা গুহাবাসীর আশ্চর্যজনক ঘটনাও কুরআনের শিক্ষণীয় ঘটনাসমূহের অন্যতম একটি ঘটনা। আসুন আমরা তাফসীরে ইবনে কাছীর ও কাসাসুল কুরআনের আলোকে এই শিক্ষণীয় ঘটনা এবং তার শিক্ষণীয় বিষয়গুলো জেনে নেই।

ঘটনা:

সেই যুগে কোন এক ঈদের দিন জনগণ মূর্তি পূজার অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে বের হল। এতে তারা তাদের মূর্তিগুলোর নৈকট্য লাভের জন্য পশু যবাই বা অন্যান্য যা যা করার তাই করবে। কিন্তু তাদের সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত বংশের একজন যুবক মূর্তি পূজার এই মহড়া কোন ক্রমেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা যে সমস্ত কল্পিত মাবুদের উপাসনা করছিল, তা দেখে তিনি বিবেকের কাছে থমকে দাঁড়ালেন। সন্দেহ তাঁর মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাঁর চিন্তা ও চেতনায় এক নতুন গতির সঞ্চার হল। তিনি জন সমাবেশ ত্যাগ করে চুপ করে বের হয়ে গেলেন। একটি গাছের নীচে গিয়ে পেরেশান হয়ে বসে রইলেন।

কিছুক্ষণ পর তার মতই আরেকজন যুবক এসে তার সাথে বসে পড়লেন। তার মনেও একই সন্দেহ। এক এক করে সাতজন যুবক এসে একত্রিত হলেন। সকলের মনে প্রশ্ন একটাই। নিজ হাতে গড়া কাঠের ও পাথরের মূর্তি কি করে আমাদের মাবুদ হতে পারে? কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতাই বা কোথায় পেল তারা? যিনি এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, এই আকাশ-বাতাস তৈরী করেছেন, যিনি আমাদের জীবন ও মরণের একমাত্র মালিক, তাঁকে বাদ দিয়ে এগুলোর এবাদত কি করে সম্ভব? এই সাতজনের মধ্যে কোন প্রকার রক্তের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঈমানের বন্ধনে তাদের একজন অন্যজনের সাথে আটকে গেলেন। তারা সকলেই এক বাক্যে পরস্পরের নিকট জাতির লোকদের মূর্তি পূজা ও শির্কের প্রতি মনের সন্দেহের কথা প্রকাশ করলেন।

অতঃপর তারা মহা বিশ্বের মাঝে তাদের প্রখর দৃষ্টি ঘুরালেন। এতে তাদের অন্তরসমূহ তাওহীদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল এবং আল্লাহর মনোনিত দ্বীনের সন্ধান পেয়ে তাদের আত্মা এক অনাবিল প্রশান্তি লাভ করল। তারা সকলেই ঈমান গোপন রাখার উপর একমত হলেন। কারণ তাদের বাদশাহ ছিল মূর্তি পূজক, মুশরিক যে তার প্রজাদেরকে শিরক করতে বাধ্য করত।

তারা সমাজের অন্যান্য লোকদের সাথেই বাস করতে থাকলেন। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেই যখন একাকী হন তখন আল্লাহর এবাদতের দিকে মনোনিবেশ করেন। কোন এক রাতে তারা যখন একত্রিত হলেন, তখন তাদের একজন নীচু আওয়াজে এবং পূর্ণ সতর্কতার সাথে বললেনঃ হে আমার বন্ধুগণ! গতকাল আমি একটি খবর শুনেছি। এটি যদি সত্য হয়, (আমার ধারণাও তাই) তাহলে অচিরেই আমাদেরকে আমাদের দ্বীন হতে ফিরিয়ে রাখা হতে পারে অথবা আমাদের জীবন নাশ করা হতে পারে। আমি শুনলামঃ আমাদের ব্যাপারটি এখন আর বাদশাহর কাছে গোপন নয়, আমাদের দ্বীন ও আকীদাহর বিষয়টি এখন তার কাছে অস্পষ্ট নয়। যেই দ্বীনকে আমরা হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছি এবং যা আমাদের চিন্তা-চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে, তা এখন বিপন্ন হওয়ার পথে। সুতরাং তোমরা চিন্তা কর এবং তোমাদের সিদ্বান্ত তোমরাই গ্রহণ কর।

দ্বিতীয়জন বললেনঃ খবরটি আমিও শুনেছি। তবে তা মুনাফেক এবং অজ্ঞদের অপপ্রচার মনে করে উড়িয়ে দিয়েছি। পরক্ষণেই খবরটির সত্যতা প্রমাণিত হল। তারা বললেনঃ আমরা আমাদের দ্বীনের উপর অবিচল থাকবো। যে বিপদই আসুক না কেন, তা মাথা পেতে মেনে নিবো। আল্লাহর সত্য দ্বীনকে জানার পর কোনভাবেই পূর্বের সেই মূর্তি পূজার দিকে ফেরত যাবো না।

গুজব এখন সত্যে পরিণত হল। বাদশাহ তাদের খবরটি জেনে ফেলল। তাদেরকে ঘর থেকে বের করে বাদশাহর দরবারে হাজির করা হল। বাদশাহ বললঃ তোমরা তোমাদের ব্যাপারটি গোপন রাখতে চেষ্টা করেছ। কিন্তু সফল হতে পার নি। আমি জানতে পেরেছি যে, তোমরা বাদশাহ এবং তার প্রজাদের ধর্ম ত্যাগ করেছ। তোমরা এমন এক নতুন ধর্মে প্রবেশ করেছ, যে সম্পর্কে আমি জানি না। কোথা থেকে তা তোমাদের আসল? আমি তোমাদেরকে কখনই এভাবে ছেড়ে দিবো না। আমি জানি তোমরা সম্ভ্রান্ত বংশের লোক। তাই অন্যরা তোমাদের কারণে বিভ্রান্ত হতে পারে। এমন আশঙ্কা যদি না থাকত তাহলে তোমাদেরকে বাঁধা প্রদান করতাম না।

যাই হোক, আমি তোমাদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতে চাচ্ছি না। তোমরা চিন্তা কর। হয় তোমরা আমার ধর্মে ফেরত আসবে অন্যথায় তোমাদের মাথাগুলো দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।

কিন্তু তাদের অন্তরগুলোকে আল্লাহ মজবুত করে দিলেন। ঈমানকে শক্তিশালী করে দিলেন। তারা বললেনঃ হে বাদশাহ! আমরা এই দ্বীনে কারও অন্ধ অনুসরণ করে প্রবেশ করি নি, বাধ্য হয়েও নয় এবং অজ্ঞাত বশত:ও নয়। আমাদের সুস্থ বিবেক ও ফিতরাত আমাদেরকে ডাক দিয়েছে। আমরা সেই ডাকে সাড়া দিয়েছি। বিবেক আমাদেরকে আলোকিত করেছে। তার আলোতেই আমরা চলছি। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তার কোন শরীক নেই। আমরা তাঁকে ছাড়া আর কাউকেই ডাকবো না। আর আমাদের জাতির লোকেরা অন্ধ হয়ে অন্যের তাকলীদ করে মূর্তি পূজা করছে, যে ব্যাপারে তাদের কাছে কোন দলীল-প্রমাণ নেই। এই হল আমাদের শেষ কথা। এখন আপনার যা খুশী করতে পারেন।

এরপর বাদশাহ বললঃ এবার যাও। আগামীকাল অবশ্যই আসবে। আমি তোমাদের ব্যাপারে ফয়সালা প্রদান করবো। তারা ফিরে এসে পরামর্শ করতে লাগলেন এবং প্রত্যেকেই স্বীয় মতের চাকা ঘুরাতে লাগলেন। তাদের একজন বললেনঃ বাদশাহ যেহেতু আমাদের ব্যাপারটি জেনেই ফেলেছে, তাই তার ধমকি ও হুমকির মধ্যে থেকে আমাদের কোন লাভ নেই। আমরা ঐ গুহার দিকে দ্বীন নিয়ে পালিয়ে যাবো। যদিও তা হবে এই প্রশস্ত দেশের তুলনায় খুব অন্ধকার ও সংকীর্ণ। কিন্তু আমরা সেখানে প্রশস্ত মনে এক আল্লাহর এবাদত করতে পারবো, যা আমরা এই বিশাল রাজ্যে করতে করতে পারছি না। এমন দেশে আমাদের বসবাস করাতে কোন কল্যাণ নেই, যেখানে আমরা নিরাপদে আমাদের আকীদাহ-বিশ্বাস অনুযায়ী দ্বীন পালন করতে পারি না এবং এমন দেশে আমাদের বসবাস করা ঠিক হবে না, যেখানে আমাদের সঠিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অন্য একটি বাতিল মত চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

সুতরাং সকলেই এই কথায় একমত হয়ে গেলেন। তারা সফর সামগ্রী তৈরী করে নিজ দেশ ছেড়ে এক অজানা পথের উদ্দেশ্যে দ্বীন নিয়ে হিজরত শুরু করলেন। পথে একটি কুকুর তাদের সাথী হয়ে গেল, একই পথে চলতে লাগল, তাদের সাথে ভালবাসার বন্ধনে আটকে গেল এবং তাদের প্রহরী হওয়ার দায়িত্ব পালনে নিজেকে নিজেই মনোনিত করল। ভালকে ভালবাসলে এবং সৎ লোকের সাহচর্যে গেলে আল্লাহর প্রিয় হওয়া যায়, এই প্রাণীটি হয়তবা তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল। পথ চলতে চলতে এক সময় তারা গুহায় পৌছে গেলেন। হয়তবা সেখানে তারা আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে ফল-ফলাদি পেয়ে গেলেন এবং ঝর্ণার পরিচ্ছন্ন মিষ্টি পানি পান করলেন। দীর্ঘ পথ চলার পর সফরের ক্লান্তি দূর করার জন্য পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে সেখানে তারা সামান্য বিশ্রামের নিয়তে গুহার মধ্যকার যমীনে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই হালকা ঘুম অনুভব করলেন এবং সেই হালকা ঘুমের পথ ধরেই গভীর নিদ্রা চলে আসল।

পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে বাদশাহর দরবারে হাজির না হওয়াতে তার লোকেরা তাদের অনুসন্ধানে বের হল। এমন কি তারা সেই গুহার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। কিন্তু হিজরতের পথে মক্কার মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর (রাঃ)এর সন্ধানে বের হয়ে গারে ছাওর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েও যেভাবে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল আল্লাহ তায়ালা সেভাবেই তাদেরকে অন্ধ করে দিলেন।

এখানে ঘটে গেল আল্লাহ তায়ালার এক বিষ্ময়কর ঘটনা।

দিনের পর আসে রাত। রাতের পর দিন। পার হয়ে গেল বছরের পর বছর। যুবকগণ শুয়ে আছেন। গভীর নিদ্রা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে আছে। বাইরের কর্ম ব্যস্ত জীবনের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই, আকাশে বিজলীর গর্জন, বাতাসের প্রচন্ডতা এবং পৃথিবীর কোন ঘটনাই তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে নি। সূর্য উদিত হওয়ার সময় ডান পাশে হেলে গিয়ে গুহার ছিদ্র দিয়ে সামান্য আলো প্রবেশ করে এবং আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে সামান্য আলো ও তাপ প্রদান করে। কিন্তু সূর্যের প্রখর উত্তাপ তাতে প্রবেশ করে না। আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের শরীরকে হেফাজতের জন্য অস্ত যাওয়ার সময়ও সূর্য একটু বাম দিকে হেলে যায়। কুকুরটি তার দুই বাহু প্রসারিত করে বীরের মত প্রহরীর কাজে গুহার বাইরে অবস্থানরত।

তারা সেখানে মাঝে মাঝে ডানে বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করছেন। কে আছে এমন যে এই দৃশ্য দেখে ভয় পাবে না?

গভীর নিদ্রায় তিনশ নয় বছর পার হয়ে গেল।এবার তারা ক্ষুধা ও পিপাসায় দুর্বল শরীর নিয়ে জাগ্রত হলেন। তারা ভাবলেন সময় বেশী অতিক্রম হয় নি এবং ইতিহাসের চাকা গুহার মুখেই থমকে রয়েছে। তাদের একজন বললেনঃ হে বন্ধগণ! আমার মনে হয় এখানে আমরা দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে পার করেছি। তোমাদের মতামত কি?

অন্যজন বললেনঃ আমার মনে হয় পূর্ণ একদিন আমরা নিদ্রিত ছিলাম। কারণ যে ধরণের ক্ষুধা ও পিপাসা আমরা অনুভব করছি, তাতে তাই মনে হয়।

তৃতীয়জন বললেনঃ সকালে ঘুমিয়েছি। এই দেখো সূর্য এখনও ডুবে যায় নি। আমার মনে হয় একটি দিবসের কিয়দাংশই আমরা নিদ্রায় অতিক্রম করেছি।

চতুর্থজন বললেনঃ ছাড়ো এ সব মতভেদ। আল্লাহই ভাল জানেন, আমরা কতকাল এখানে ঘুমিয়েছি। মূল কথা হচ্ছে আমার প্রচুর ক্ষুধা অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে কয়েক দিন যাবৎ না খেয়ে আছি। আমাদের একজনের উচিত এখনই শহরে গিয়ে কিছু খাদ্য ক্রয় করে নিয়ে আসুক। তবে তাকে অবশ্যই সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ লোকেরা যদি আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জেনে ফেলে তবে তারা আমাদেরকে হত্যা করতে পারে কিংবা আমাদেরকে ফিতনায় ফেলে দ্বীন পালন থেকে বিরত রাখতে পারে। তাকে আরেকটি বিষয়ে সাবধান হতে হবে। কোনভাবেই যেন হারাম খাদ্য ক্রয় করা না হয়। সে জন্য সে যাচাই-বাছাই করে হালাল খাদ্যটিই ক্রয় করবে।

তাদের একজন সাবধানতা ও পূর্ণ সতর্কতার সাথে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় শহরে প্রবেশ করলেন। তিনি দেখলেন কোন কিছুই আর আগের মত নেই। ঘরবাড়িগুলো পরিবর্তন হয়ে গেছে। পুরাতন পরিত্যাক্ত ঘরের স্থলে বিশাল প্রাসাদ শোভা পাচ্ছে। আগের রাজপ্রাসাগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি এখন যে সমস্ত চেহারা দেখছেন সেগুলো পরিচিত কোন লোকের চেহারা নয়। নদীর স্রোত আগের মতই চলছে বয়ে, পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে ঘরবাড়ি ও বন-বনানী ঠিকই আছে। শুধু নেই আগের মানুষগুলো।

তার দৃষ্টি বিচলিত হল, এদিক সেদিক চোখ ঘুরানোতে লোকেরা সন্দেহ পোষণ করতে লাগল এবং তার চলার ভঙ্গিতে মানুষের সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। পরিশেষে লোকেরা তাকে ঘিরে ধরল। উপস্থিত লোকদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করলঃ আপনি কি এখানে অন্য দেশ থেকে এসেছেন? এত চিন্তা করছেন কি নিয়ে? অনুসন্ধানই বা করছেন কী?

তিনি বললেনঃ আমি এখানে অপরিচিত কেউ নই। আমি কিছু খাদ্য ক্রয় করতে চাই। কিন্তু কোথায় তা বিক্রি হচ্ছে আমি তা জানি না। একজন লোক তার হাত ধরে খাদ্যের দোকানে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে তিনি রোপার তৈরী কয়েকটি দিরহাম বের করলেন। দোকানের মালিক দিরহামগুলো হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেনঃ এ তো তিনশ বছরের অধিক সময় আগের তৈরী! সে ভাবল এই ব্যক্তি হয়ত কোন গুপ্তধন পেয়েছেন। সম্ভবতঃ এই দিরহামগুলো ছাড়াও তার কাছে বিপুল পরিমাণ দিরহাম রয়েছে। দোকানের মালিক বাজারের লোকদেরকে ডেকে একত্রিত করল।

এবার গুহাবাসী লোকটি বললেনঃ হে লোক সকল! দেখুনঃ আপনার যা ভাবছেন, বিষয়টি আসলে তেমন নয়। এই মূদ্রাগুলো লুকায়িত অসংখ্য সম্পদের কোন অংশ নয়। গতকাল মানুষের সাথে কোন এক লেনদেনের সময় তা আমার হস্তগত হয়েছে। আর এই তো আজ আমি তা দিয়ে কিছু খাদ্য ক্রয় করতে চাচ্ছি। আপনারা তাতে এত আশ্চর্যবোধ করছেন কেন? এর কোন কারণ তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আর কেনই বা সন্দেহের উপর নির্ভর করে আমার বিরুদ্ধে গুপ্তধন পাওয়ার এবং তা লুকিয়ে রাখার অপবাদ দিচ্ছেন?

এই কথা বলে তাদের ব্যাপারটি মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করতে চাইলেন। কিন্তু লোকেরা কিছুতেই তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হল না। ভিড় ভেঙ্গে দিয়ে কিছু লোক একাকী তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলতে লাগল। কথা-বার্তার এক পর্যায়ে তারা যখন জানতে পারল যে, তিনি হচ্ছেন তিন শত নয় বছর পূর্বে জালেম ও কাফের বাদশাহর পাকড়াও থেকে পলায়নকারী সম্ভ্রান্ত বংশের সাত জন যুবকের একজন তখন তারা আরও আশ্চার্যান্বিত হল। তারা আরও জানতে পারল যে, তারা হলেন ঐ সমস্ত যুবক যাদের অনুসন্ধানে বাদশাহ সকল প্রচেষ্টাই করেছিল, কিন্তু তাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। যুবকটি এবার আরও শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। কারণ এখন লোকেরা তাদের ব্যাপারটি জেনে ফেলেছে। তাই তিনি নিজের ও তাঁর সাথীদের জীবন নাশের ভয়ে পালাতে উদ্যোত হলেন।

লোকদের মধ্যে হতে একজন বললঃ হে ভাই! তুমি ভয় করো না। তুমি যেই জালেম বাদশাহর ভয় করছ, সে তো প্রায় তিনশ বছর আগেই ধ্বংস হয়েছে। এখন যিনি এই রাজ্যের বাদশাহ তিনি আপনিও আপনার সাথীদের মতই একজন মুমিন বান্দা। এবার বলুনঃ আপনার অন্যান্য সাথীগণ কোথায়?

যুবকটি এবার আসল ঘটনা জানতে পারলেন। ইতিহাসের সেই দীর্ঘ দূরত্বও তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন, যা তাকে মানব সমাজ থেকে আলাদা করে রেখেছে। তিনি বুঝতে পারলেনঃ এখন তিনি মানুষের মাঝে চলমান একটি ছায়া ব্যতীত আর কিছুই নন। এরপর তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ আমাকে গুহার অভ্যন্তরে বন্ধুদের কাছে যেতে দাও। আমি তাদেরকে আমার ও আপনাদের অবস্থা সম্পর্কে সংবাদ দেব। তারা দীর্ঘক্ষণ যাবৎ আমার অপেক্ষায় আছেন। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তারা আমার ব্যাপারে চিন্তিত আছেন।

তখনকার বাদশাহও তাদের খবরটি জেনে ফেললেন। তিনি গুহাবাসীদের সাথে সাক্ষাত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন এবং দ্রুত গুহার দিকে চলে আসলেন। তিনি তাদেরকে উজ্জল চেহারায় জীবিত অবস্থায় দেখতে পেলেন। তাদের সাথে মুসাফাহা ও আলিঙ্গন করলেন। তিনি তাদেরকে রাজপ্রাসাদে আহবান জানালেন এবং তথায় স্থায়ীভাবে বসবাসের আমন্ত্রণ জানালেন।

তারা সাফ জানিয়ে দিলেনঃ নতুনভাবে জীবন যাপনে আমাদের কোন আগ্রহ নেই। আমাদের ঘরবাড়িগুলো বিলীন হয়ে গেছে, পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্তদির কেউ জীবিত নেই এবং আমাদের মাঝে এবং স্বাভাবিক জীবন-যাপনের মাঝে দীর্ঘ দিন যাবৎ কোন যোগসূত্রও নেই। সুতরাং এই পার্থিব জীবনের দিকে ফিরে গিয়ে আর লাভ কি?

অতঃপর তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের আবেদন করলেন, তাঁর কাছে ফেরত যাওয়াকেই পছন্দ করলেন এবং তাঁর প্রশস্ত রহমত দ্বারা তাদেরকে ঢেকে নিতে প্রার্থনা করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। দেহ থেকে তাদের প্রাণ চির দিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

এই ঘটনা থেকে কতিপয় শিক্ষা:

১) তাওহীদকে মেনে নেওয়া মানুষের ফিতরাতি তথা সৃষ্টিগত স্বভাব। অর্থাৎ কোন মানুষকে যদি তার স্বভাজাত ধর্মের উপর ছেড়ে দেয়া হয় এবং বাইরের কোন গোমরাহ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে বিভ্রান্ত না করে, তাহলে সে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিবে, তারই এবাদত করবে এবং তাঁর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করবে না। যেমনটি হয়েছেলি ঘটনায় বর্ণিত যুবকদের ক্ষেত্রে।

২) পৃথিবীতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় যুবকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৩) মূর্তি পূজা, অলী-আওলীয়াদের পূজা এবং শির্কের পক্ষে কোন দলীল নেই।

৪) প্রয়োজনে সত্য গোপন করা জায়েয আছে। কিন্তু তা সকল সময়ের জন্য নয়।

৫) সাহসের সাথে তাওহীদের বাণী প্রকাশ্যে প্রচার করা জরুরী।

৬) নিজ দেশে দ্বীন পালন করতে গিয়ে ফিতনার ভয় থাকলে দ্বীন নিয়ে পলায়ন করা আবশ্যক।

৭) আসহাবে কাহাফের ঘটনা আল্লাহর বিশেষ একটি বড় নিদর্শন। তবে তার চেয়েও বড় নিদর্শন হচ্ছে, আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্যের সৃষ্টি এবং দিবা রাত্রির আগমণ ও প্রস্থান।

৮) বিপদাপদে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তাঁর দয়া কামনা করা জরুরী।

৯) কোন মতবাদ, মাজহাব ও আমল গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কারও অন্ধ অনুসরণ না করে দলীল অনুসন্ধান করা জরুরী।

১০) আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদের খেদমতের জন্য বড় বড় মাখলুককে বাধ্য করেন।

১১) একজন দাঈ প্রয়োজনে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। বিশেষ করে যখন তাঁর পিছনে শত্রুরা ষড়যন্ত্র শুরু করে।

১২) সুখে-দুঃখে হালাল রুজী অনুসন্ধান করা জরুরী।

১৩) চিন্তা ও গবেষণা করে কুরআন ও কুরআনে বর্ণিত ঘটনাগুলো অধ্যয়ন করা উচিৎ।

১৪) বিনা প্রয়োজনে মতভেদ করা অর্থহীন। যেমন গুহাবাসীদের নাম, কুকুরটির নাম ও তার রং সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করে কোন লাভ নেই।

১৫) ভবিষ্যতে কোন কাজ করতে ইচ্ছা করলে প্রথমে ইনশা-আল্লাহ্ বলতে হবে।

১৬) প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সত্যের উপর অবিচল থাকার গুরুত্ব অপরিসীম।

১৭) আসহাবে কাহাফের স্থান ও কাল কুরআন ও সহীহ হাদীছে উল্লেখ করা হয় নি। সুতরাং তা খুঁজে বেড়ানোতে আমাদের কোন লাভ নেই। ঘটনাটি ঐ প্রকার গায়েবের অন্তর্ভূক্ত, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে জানিয়েছেন। তবে তার স্থান ও কাল আমরা জানতে পারি নি।

১৮) নবী সাল্লাল্লাহু গায়েবের সকল খবর জানতেন না। যদি জানতেন, তাহলে অহীর অপেক্ষায় না থেকে প্রশ্ন করার সাথে সাথেই তাদেরকে ঘটনাটি বলে দিতেন।

১৯) আসহাবে কাহাফগণ যে গুহায় অবস্থান করেছিলেন তাও গায়েবের অন্তর্ভূক্ত। এর ঠিকানা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। কেউ যদি এর স্থান নির্দিষ্ট করে বলে সে আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনাকারীর অন্তর্ভূক্ত হবে।

২০) কারামতে আওলীয়া সত্য। তাতে বিশ্বাস করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহর অন্তর্ভূক্ত।

২১) তাওহীদ ও শির্কের মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা অর্জন করা জরুরী। অন্যথায় তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সম্ভব নয়।

২২) তিন শত নয় বছর পর তাদেরকে জীবিত করা এটাই প্রমাণ করে যে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সত্য, কিয়ামত সত্য। এতে কোন সন্দেহ নেই।

২৩) রূহ এবং দেহ উভয়েরই পুনরুত্থান হবে। কেননা আসহাবে কাহাফগণ এভাবেই জীবিত হয়েছিলেন।

২৪) রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ঈমানের সম্পর্ক অধিক মজবুত হওয়া আবশ্যক। ঘটনায় বর্ণিত যুবকদের মধ্যে রক্তের কোন সম্পর্ক না থাকলেও ঈমান ও তাওহীদের বন্ধনে তারা আবদ্ধ হয়ে একই পথের পথিক হয়ে যান।

২৫) হেদায়াত আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর বান্দার প্রতি বিরাট একটি নেয়ামত। বান্দার উচিত সর্ব অবস্থায় আল্লাহর কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করা।

২৬) ঘরের মধ্যে কুকুর রাখা নিষিদ্ধ। তাই কুকুরটিকে গুহার বাইরে রাখা হয়েছিল।

২৭) ভাল লোকের সঙ্গে থাকলে ভাল হওয়া যায় এবং ভাল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায়। কুকুরটি তাদের সাথে থাকার কারণে কুরআনে তার সেটির কথা উল্লেখিত হয়েছে। অপর পক্ষে অসৎ লোকের সঙ্গে থাকলে অসৎ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে নিরাপদ নয়।

২৮) কবরের উপর মসজিদ বা গম্বুজ নির্মাণ করা আমাদের শরীয়তে নিষিদ্ধ।

২৯) বাতিল পন্থীরা সন্দেহ এবং অনুমানের অনুসরণ করে থাকে। সঠিক কোন দলীল তাদের হাতে নেই।

৩০) বয়স বৃদ্ধি হলে এবং অভিজ্ঞতা দীর্ঘ হলেই মানুষ জ্ঞানী হয়ে যায় না। এই যুবকগণ বয়সে কম হলেও তারা সত্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। অথচ সেই জাতির মধ্যে অসংখ্য বয়স্ক ও অভিজ্ঞ লোক থাকা সত্ত্বেও সঠিক পথের সন্ধান পায় নি।

৩১) এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে সূর্য চলমান; স্থির নয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডানদিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়।

৩২) প্রহরী হিসেবে কুকুর প্রতিপালন করা জায়েয আছে।

৩৩) কোন বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে তা আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে বলতে হবে আল্লাহই ভাল জানেন।

৩৪) আল্লাহ কখনও দ্বীনের দাঈদের ঈমানী শক্তি পরীক্ষা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে শত্রুদেরকে শক্তিশালী করে দেন। তখন দাঈদের উচিত ধৈর্য ধারণ করা।

৩৫) তারা সংখ্যায় ছিলেন সাত জন। কারণ আল্লাহ তাআলা প্রথম দু’টি সংখ্যার প্রতিবাদ করে তৃতীয়টির ক্ষেত্রে কিছুই বলেন নি। এতে বুঝা গেল শেষ সংখ্যাটিই সঠিক।

৩৬) যে ব্যক্তি ফতোয়া দেয়ার যোগ্য নয়, তার কাছে ফতোয়া চাওয়া ঠিক নয়।

এছাড়াও আরও অসংখ্য শিক্ষণীয় দিক আছে উক্ত ঘটনায়। যা হয়ত একজন দুজন মানুষের দ্বারা বের করা সম্ভব নয়। তাই আপনাদের নিকট অনুরোধ যদি উক্ত ঘটনা থেকে আপনার নিকট বিশেষ কোন শিক্ষণীয় দিক থাকে তবে তা নিচে মতমতের ঘরে উল্লেখ করে দিবেন। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দ্বীনের উপর অবিচল থাকার তওফীক দান করুন।

সংকলন ও গ্রন্থনা : শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ (লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদী আরব)