আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ.
بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ
সূরা কাফিরুন
সূরা নংঃ১০৬, আয়াত সংখ্যাঃ৬
এটি মক্কী সূরা
বিভিন্ন হাদীসে এ সূরার বেশ কিছু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওয়াফের দু’ রাকাআত সালাতে ‘কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন’ ও ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ পড়তেন।” [মুসলিম: ১২১৮]
অন্য হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দু’টি সূরা দিয়ে ফজরের সুন্নাত সালাত আদায় করেছেন”। [মুসলিম: ৭২৬] ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফজরের পূর্বের দু’ রাকাআতে এবং মাগরিবের পরের দুরাকাআতে এ দু’ সূরা পড়তে বিশোর্ধ বার বা দশোর্ধ বার শুনেছি।” [মুসনাদে আহমাদ: ২/২৪]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, “চব্বিশোর্ধ অথবা পঁচিশোর্ধবার শুনেছি”। [মুসনাদে আহমাদ: ২/৯৫] ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক মাস পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। তিনি ফজরের পূর্বের দু’ রাকাআতে এ দু’সূরা পড়তেন।” [তিরমিযী: ৪১৭, ইবনে মাজহ: ১১৪৯, মুসনাদে আহমাদ: ২/৯৪]
তাছাড়া জনৈক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে আরয করলেন, আমাকে নিদ্রার পূর্বে পাঠ করার জন্যে কোন দোআ বলে দিন। “তিনি সূরা কাফিরূন পাঠ করতে আদেশ দিলেন এবং বললেন এটা শির্ক থেকে মুক্তিপত্র।” [আবু দাউদ: ৫০৫৫, সুনান দারমী: ২/৪৫৯, মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৫৩৮]
অন্য হাদীসে এসেছে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সূরা ‘কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন’ কুরআনের এক চতুর্থাংশ”। [তিরমিযী: ২৮৯৩, ২৮৯৫]
এই সূরার বিষয়াবলী কুর’আনের চারভাগের একভাগ যা এই সূরাতে বর্নিত হয়েছে।
প্রেক্ষাপটঃ
রাসূল (সাঃ) যখন মক্কায় তাওহীদের দাওয়াত শুরু করলেন, তখন মক্কার কুরাইশগণ নানা কৌশলে তাঁকে এই দাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করল। আবু তালেবের কাছেও তারা একাধিকবার প্রতিনিধি পাঠিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)কে সত্য দ্বীনের দাওয়াত থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। অমানষিক নির্যাতন করেও কোন কাজ হয় নি। এমন কি তারা আরবের বাদশাহ বানিয়ে দেয়ার প্রস্তাবও করেছিল।
সকল প্রকার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা এক নতুন কৌশল অবলম্বন করল।তারা বুঝতে পারছিলো মুহাম্মদ এই দাওয়াত থেকে নিবৃত্ত হবে না, তখন কাফেররা নতুন ফন্দি আটলো, তারা তাওহীদের দাওয়াত ও কুফরীর মধ্যে একট আপোস ও মীমাংসার প্রস্তাব দিল। কুরাইশদের কাফের সম্প্রদায় মুর্খতার কারণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আহবান করলেনঃ তিনি এক বছর তাদের মূর্তির পূজা করবেন, আর তারাও তাঁর মা’বূদ আল্লাহর এক বছর ইবাদত করবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এই সূরাটি নাযিল করেন এবং তাঁর রাসূলকে আদেশ করেন, তিনি যেন তাদের ধর্ম থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করেন।
“ ওদের বলে দাও , হে মূর্খের দল ! তোমরা কি আমাকে বলছো , আল্লাহ ছাড়া আমি আর কারো ইবাদাত করবো ? ” ইবনে আব্বাসের (রা) অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে , কুরাইশরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললো :“ হে মুহাম্মাদ ! যদি তুমি আমাদের উপাস্য মুর্তিগুলোকে চুম্বন করো তাহলে আমরা তোমার মাবুদের ইবাদাত করবো। ” একথায় এই সূরাটি নাযিল হয়। ( আবদ ইবনে হুমাইদ )
আবুল বখতরীর আযাদকৃত গোলাম সাঈদ ইবনে মীনা রেওয়ায়াত করেন , অলীদ ইবনে মুগীরাহ , আস ইবনে ওয়ায়েল , আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব ও উমাইয়া ইবনে খালফ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করে বলে : “ হে মুহাম্মাদ ! এসো আমরা তোমার মাবুদের ইবাদাত করি এবং তুমি আমাদের মাবুদদের ইবাদাত করো। আর আমাদের সমস্ত কাজে আমরা তোমাকে শরীক করে নিই। তুমি যা এনেছো তা যদি আমাদের কাছে যা আছে তার চেয়ে ভালো হয় তাহলে আমরা তোমার সাথে তাতে শরীক হবো এবং তার মধ্য থেকে নিজেদের অংশ নিয়ে নেবো। আর আমাদের কাছে যা আছে তা যদি তোমার কাছে যা আছে তার চাইতে ভালো হয় , তাহলে তুমি আমাদের সাথে তাতে শরীক হবে এবং তা থেকে নিজের অংশ নেবে। ” একথায় মহান আল্লাহ এ আল কাফেরুন সূরাটি নাযিল করেন। ( ইবনে জারীর ও ইবনে আবী হাতেম । ইবনে হিশামও সীরাতে এ ঘটনাটি উদ্ধৃত করেছেন। )
বিষয়স্তু ও মূল বক্তব্য
সূরাটি উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করলে জানা যাবে , আসলে ধর্মীয় উদারতার উপদেশ দেবার জন্য সূরটি নাযিল হয়নি, যেমন আজকাল কেউ কেউ মনে করে থাকেন।
বরং কাফেরদের ধর্ম , পূজা অনুষ্ঠান ও তাদের উপাস্যদের থেকে পুরোপুরি দায়িত্ব মুক্তি এবং তার প্রতি অনীহা , অসন্তুষ্টি ও সম্পর্কহীনতার ঘোষনা দেয়া আর এই সাথে কুফরী ধর্ম ও দীন ইসলাম পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং তাদের উভয়ের মিলে যাবার কোন সম্ভাবনাই নেই- একথা ঘোষণা করে দেয়ার জন্যই এ সূরাটি নাযিল হয়েছিল। যদিও শুরুতে একথাটি কুরাইশ বংশীয় কাফেরদেরকে সম্বোধন করে তাদের আপোস ফরমূলার জবাবে বলা হয়েছিল কিন্তু এটি কেবল এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং একথাগুলোকে কুরআনের অন্তরভূক্ত করে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে কিয়ামত পর্যন্ত এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে,
- যে কুফরী ধর্ম দুনিয়ার যেখানেই যে আকৃতিতে আছে তার সাথে সম্পর্কহীনতা ও দায়িত্ব মুক্তির ঘোষণ তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত।
- কোন প্রকার দ্বিধা – দ্বন্দ্ব ছাড়াই তাদের একথা জানিয়ে দেয়া উচিত যে,দীনের ব্যাপারে তারা কাফেরদের সাথে কোন প্রকার আপোস বা উদারনীতির আশ্রয় গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় ।
- এ কারণেই যাদের কথার জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়েছিল তারা মরে শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এটি পঠিত হতে থেকেছে।
- যারা এর নাযিলের সময় কাফের ও মুশরিক ছিল তারা মুসলমান হয়ে যাওয়ার পরও এটি পড়তে থেকেছে।
- আবার তাদের দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় নেবার শত শত বছর পর আজো মুসলমানরা এটি পড়ে চলেছে। কারণ কুফরী ও কাফেরের কার্যকলাপ থেকে সম্পর্কহীনতা ও অসন্তুষ্টি ঈমানের চিরন্তন দাবী ও চাহিদা ।
সরল বঙ্গাবনুবাদঃ
১) বলুনঃ হে কাফের সম্প্রদায়!
২) তোমরা যার ইবাদত কর আমি তার ইবাদত করি না।
৩) তোমরাও ইবাদতকারী নও যার আমি ইবাদত করি ।
৪) আর আমি ইবাদতকারী নই তোমরা যার ইবাদত কর।
৫) তোমরা ইবাদতকারী নও যার আমি ইবাদত করি।
৬) তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য আমার দ্বীন আমার জন্য।
এ আয়াতে কয়েকটি কথা বিশেষভাবে ভেবে দেখার মতো —
১) এককভাবে আল্লাহ্ জন্য ইবাদতকে খালেছ বা একনিষ্ঠ করা ওয়াজিব।
২) শির্ক এবং তার অনুসারীদের থেকে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ করা অতি আবশ্যক।
৩) তা’আলা হক ও বাতিলের মাঝে সুষ্পষ্ট পার্থক্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ইসলামই একমাত্র হক ধর্ম। তা ছাড়া অন্যান্য সকল ধর্ম বাতিল।
৪) ইমাম শাফেয়ী (রঃ) (لكم دينكم ولي دين) “তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য আমার দ্বীন আমার জন্য।” এ আয়াতটি থেকে এ দলীল নিয়েছেন যে, সকল কাফেরের ধর্ম একই।
﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ
১) বলে দাও , হে কাফেররা !
পূর্বের সূরাতে আল্লাহ জানিয়েই দিয়েছেন যে আবতার বা নির্বংস কারা। সুতরাং আল্লাহ তাঁর রাসূল সা কে ভয় না পেয়ে সাহস করে সম্বোধন করেছেন। হে কাফেররা।
রাসুল সা কুর‘আনের নির্দেশ অনুসারে সুন্দর মার্জিতভাবে বিধর্মীদের ইসলামের পথে ডেকেছেন। তাহলে এই সূরাহ’য় তাকে এই কঠিন ভাষায় বিধর্মীদের সম্বোধন করতে বলা হলো কেন? একদিকে কুর‘আন বলে যে,
তাকে সবার জন্য রহমত রূপে পাঠানো হয়েছে (২১:১০৭)।
মানুষকে প্রজ্ঞার সাথে এবং মার্জিতভাবে ইসলামের পথে ডাকতে, সুন্দরভাবে তাদের সাথে যুক্তিতর্ক করতে (১৬:১২৫)।
কিন্তু এই সূরায় ‘কাফিরুন’ অর্থাৎ সত্য অস্বীকারকারীরা কারা। আল্লাহ এই সূরায় দুইবার বলতে বলেছেন,“আর আমি যার উপাসনা করি, তোমরা তার উপাসক নও।” অর্থাৎ, তারা আগেও এক আল্লাহর উপাসক ছিল না, এখনও না, ভবিষ্যতেও হবে না। এরা কোনোভাবেই ইসলাম মানবে না। একইসাথে আয়াতের ভাষা থেকে পরিষ্কার যে, তারা জানে রাসুল কীসের উপাসক, তিনি কী উপাসনা করার কথা বলছেন এবং তারা এও জানে তিনি কী উপাসনা করেন না, যা তারা নিজেরা করে। অর্থাৎ তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে এবং তারা জানে তাদের ধর্মের সাথে ইসলামের পার্থক্য কোথায়।
যারা সত্য অস্বীকার করবেই, তাদের তুমি সাবধান করো, আর না-ই করো, তাদের কাছে তা একই কথা—তারা বিশ্বাস করবে না। আল্লাহ তাদের হৃদয়ের উপর এবং তাদের শোনার ক্ষমতার উপর সিল করে দিয়েছেন; তাদের দৃষ্টির উপরে আছে এক পর্দা। তাদের জন্য আছে এক প্রচণ্ড শাস্তি। [আল-বাক্বারাহ ৬-৭]
আল্লাহ বলেন: “আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না, তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে যুলুম করেছে। আর তোমরা বল, আমাদের প্রতি এবং তোমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে, তাতে আমরা ঈমান এনেছি। আর আমাদের ইলাহ্ ও তোমাদের ইলাহ্ তো একই। আর আমরা তাঁরই প্রতি মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী)।”[সূরা আনকাবুত, আয়াত: ৪৬]
যারা সত্য অস্বীকার করেছিল, তাদেরকে দলে দলে জাহান্নামের দরজার দিকে ধেয়ে নেওয়া হবে। যখন তারা সেখানে পৌঁছুবে, তখন তার দরজা খুলে যাবে, আর তার প্রহরীরা বলবে, “তোমাদের কাছে কি তোমাদেরই মধ্য থেকে বার্তাবাহক যায়নি, যে তোমাদেরকে তোমাদের প্রভুর বাণী শুনিয়েছিল এবং তোমাদেরকে সাবধান করেছিল যে এই দিন আসবে?” তারা বলবে, “হ্যাঁ”। কিন্তু ততক্ষণে সত্য অস্বীকারকারীদের উপর শাস্তির বিধান কার্যকর হয়ে গেছে। [আয-যুমার ৩৯:৭১]
ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ’র ‘কিতাবুল ঈমান’ বইয়ে তিনি বলেছেন—
“কুর‘আনের এই আয়াতগুলোতে ‘কুফর’ শব্দটি দুই ক্ষেত্রে এসেছে—
১) মুনাফেক: যে গোপনে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে,
২) কাফির: যে প্রকাশ্যে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে।”
সুতরাং কাফির হচ্ছে যারা গোপনে বা প্রকাশ্যে ইসলাম বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে। এদের কাছে কুর‘আনের বাণী পৌঁছান হয়েছে। কিন্তু তারা মানতে অস্বীকার করেছে।
আজকাল অনেক মুসলিম নামধারী আছেন, যাদেরকে কুর‘আনের আয়াত দেখিয়ে বার বার সাবধান করেও কোনো লাভ হয় না, এরা কোনোভাবেই শুনবে না। এরা ধর্মের ব্যাপারে বিবেক-বুদ্ধি খাটায় না। সংস্কৃতি, কুসংস্কার, বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণে গা ভাসিয়ে দেয়। এদের কাছে কুর‘আনের নিষেধ থেকে সংস্কৃতি, ফ্যাশন, বিনোদন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এদের অনেকে মনে করে যে, নবীরা যা বলে গেছেন, সেগুলো হাজার বছর আগে চলতো, আজকে আর চলে না। নবীদের কথা, কাজ নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে। এরা যদিও নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ভালো কোনো অর্জন হলে, তাদের সম্মান, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি বেড়ে গেলে, এরা ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে। ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের প্রতি তাদের গোপন বিতৃষ্ণা অনেক সময় তাদের লেখা, কথা, কাজের মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে আসে।
(ক) যদিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম দেয়া হয়েছে , তুমি কাফেরদের পরিস্কার বলে দাও ৷ তবুও সামনের আলোচনা জানিয়ে দিচ্ছে , পরবর্তী আয়াতগুলোতে যেসব কথা বলা হযেছে প্রত্যেক মু’মিনের সে কথাগুলোই কাফেরদেরকে জানিয়ে দিতে হবে৷ এমনকি যে ব্যক্তি কুফরী থেকে তাওবা করে ঈমান এনেছে তার জন্যও কুফরী ধর্ম , তার পূজা – উপাসনা ও উপাস্যদের থেকে নিজের সম্পর্কহীনতা ও দায়মুক্তির কথা প্রকাশ করতে হবে৷ কাজেই ‘ কুল’ বলে দাও৷ শব্দটির মাধ্যমে প্রধানত ও প্রথমত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে ৷ কিন্তু এ হুকুমটি বিশেষভাবে শুধু তাঁকেই করা হয়নি বরং তাঁর মাধ্যমে প্রত্যেক মু’মিনকে করা হয়েছে৷
(খ) এ আয়াতে প্রতিপক্ষকে যে ” কাফের ” বলে সম্বোধন করা হয়েছে , এটা তাদের জন্য কোন গালি নয়৷ বরং আরবী ভাষায় কাফের মানে অস্বীকারকারী ও অমান্যকারী (Unbeliever)৷ এর মোকাবিলায় ‘ মু’মিন ‘ শব্দটি বলা হয় , মেনে নেয়া ও স্বীকার করে নেয়া অর্থে (Believer) ৷ কাজেই আল্লাহর নির্দেশক্রমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ( হে কাফেররা ! ) বলার অর্থই হচ্ছে এই যে , ” হে লোকেরা ! তোমরা যারা আমার রিসালাত ও আমার প্রদত্ত শিক্ষা মেনে নিতে অস্বীকার করছো৷ ” অনুরূপভাবে একজন মু’মিন যখন একথা বলবে অর্থাৎ যখন সে বলবে , ” হে কাফেররা ! ” তখন কাফের বলতে তাদেরকে বুঝানো হবে যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান আনেনি৷
(গ) ” হে কাফেররা !” বলা হয়েছে , ” হে মুশরিকরা ” বলা হয়নি৷ কাজেই এখানে কেবল মুশরিকদের উদ্দেশ্যেই বক্তব্য পেশ করা হয়নি বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যারা আল্লাহর রসূল এবং তিনি যে শিক্ষা ও হিদায়াত দিয়েছেন তাকে আল্লাহর শিক্ষা ও হিদায়াত বলে মেনে নেয় না , তারা ইহুদী খৃষ্টান ও অগ্নি উপাসক বা সারা দুনিয়ার কাফের , মুশরিক ও নাস্তিক যেই হোক না কেন , তাদের সবাইকে এখানে সম্বোধন করা হয়েছে৷ এ সম্বোধনকেই শুধুমাত্র কুরাইশ বা আরবের মুশরিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কোন কারণ নেই৷
(ঘ) অস্বীকারকরীদেরকে ‘হে কাফেররা ‘ বলে সম্বোধন করা ঠিক তেমনি যেমন আমরা কিছু লোককে সম্বোধন করি “ওহে শত্রুরা ” বা ” ওহে বিরোধীরা” বলে৷ এ ধরনের সম্বোধনের ক্ষেত্রে আসলে বিরোধী ব্যক্তিরা লক্ষ্য হয় না , লক্ষ হয় তাদের বিরোধিতা ও শত্রুতা ৷ আর এ সম্বোধন ততক্ষণের জন্য হয় যতক্ষণ তাদের মধ্যে এ গুণগুলো থাকে৷ যখন তাদের কেউ এ শত্রুতা ও বিরোধিতা পরিহার করে অথবা বন্ধু ও সহযোগী হয়ে যায় তখন সে আর এ সম্বোধনের লক্ষ থাকে না৷ অনুরূপভাবে যাদেরকে ” হে কাফেররা ” বলে সম্বোধন করা হয়েছে তারাও তাদের কুফরীর কারণে এ সম্বোধনের লক্ষস্থলে পরিণত হয়েছে , তাদের ব্যক্তি সত্তার কারণে নয়৷ তাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আমৃত্যু কাফের থাকে তার জন্য এ সম্বোধন হবে চিরন্তন৷ কিন্তু যে ব্যক্তি ঈমান আনবে তার প্রতি আর এ সম্বোধন আরোপিত হবে না৷
(ঙ) অনেক মুফাসসিরের মতে এ সূরায় ” হে কাফেররা ” সম্বোধন কেবলমাত্র কুরাইশদের এমন কিছু লোককে করা হয়েছে যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দীনের ব্যাপারে সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল এবং যাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাঁর রসূলকে (সা) বলে দিয়েছিলেন , এরা ঈমান আনবে না৷ দু’টি কারণে তারা এ মত অবলম্বন করেছেন৷
لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ
২) আমি তাদের ইবাদাত করি না যাদের ইবাদাত তোমরা করো৷
লোকদেরকে এ ছাড়া আর কোন হুকুম দেয়া হয়নি যে , তারা পুরোপুরি একমুখী হয়ে নিজেদের দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে তাঁর ইবাদাত করবে ৷
“নিশ্চিত জেনো, মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে চলে যাবে এবং তোমরা কাউকে তাদের সাহায্যকারী হিসেবে পাবে না৷তবে তাদের মধ্য থেকে যারা তাওবা করবে, নিজেদের কর্মনীতি সংশোধন করে নেবে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং নিজেদের দীনকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নেবে,তারা মুমিনদের সাথে থাকবে৷ আর আল্লাহ নিশ্চিয়ই মুমিনদেরকে মহাপুরস্কার দান করবেন৷” সূরা নিসাঃ১৪৫-১৪৬
হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাও আমার রব তো সততা ও ইনসাফের হুকুম দিয়েছেন৷তাঁর হুকুম হচ্ছে, প্রত্যেক ইবাদত নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখো এবং নিজের দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্য করে নিয়ে তাঁকেই ডাকো ৷ যেভাবে তিনি এখান তোমাদের সৃষ্টি করেছেন ঠিক তেমনিভাবে তোমাদের আবার সৃষ্টি করা হবেও। আরাফঃ২৯
এর অর্থ হচ্ছে, তোমাদের এসব অর্থহীন রীতি- আনুষ্ঠানিকতার সাথে আল্লাহর দীনের কি সম্পর্ক ? তিনি যে দীনের শিক্ষা দিয়েছেন তার মূলনীতিগুলো নিম্নরূপঃ
একঃ মানুষের নিজের জীবনকে সত্য, সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, ও ভারসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷
দুইঃ ইবাদতের ক্ষেত্র সঠিক লক্ষ্যের ওপর অবিচল থাকতে হবে অর্থাৎ তার ইবাদতের আল্লাহ ছাড়া আর কারোর বন্দেগীর সামান্যতম স্পর্শও থাকবে না৷ আসল মাবুদ আল্লাহর দিকে ফিরে ছাড়া আর কোন দিকে ফিরে তার আনুগত্য, দাসত্ব , হীনতা, ও দীনতার সামান্যতম প্রকাশও ঘটতে পারবে না৷
তিনঃ পথনির্দেশনা , সাহায্য, সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা,হেফাজত ও সংরক্ষণের জন্যে একমাত্র আল্লাহরই কাছে দোয়া চাইতে হবে৷ কিন্তু এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, এসব বিষয়ের জন্যে দোয়া প্রার্থীকে পূর্বাহ্নেই নিজের দীনকে একান্তভাবে আল্লাহ জন্য নিদির্ষ্ট করতে হবে৷ জীবনের সমগ্র ব্যবস্থা , কুফরী , শিরক, গোনাহ ও অন্যের বন্দগীর ভিত্তিতে পরিচালিত হবে৷কিন্তু সাহায্য চাওয়া হবে আল্লাহর কাছে এ বলে , হে আল্লাহ! তোমার বিরুদ্ধে আমার এ বিদ্রোহে আমাকে সাহায্য করো, এমনটি যেন না হয়৷
চারঃ এ মর্মে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে, এ দুনিয়ায় সে যেভাবে জন্ম নিয়েছে ঠিক তেমনিভাবে অন্য একটি জগতেও তার জনম হবে এবং সেখানে আল্লাহর কাছে তার সমস্ত কাজের হিসেব দিতে হবে৷
“বলে দাও, আমি আনুগত্যসহ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্ব করবো৷তোমরা তাঁর ছাড়া আর যাদের ইচ্ছা দাসত্ব করতে থাকো৷ বলো, প্রকৃত দেউলিয়া তারাই যারা কিয়ামতের দিন নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে ক্ষতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে৷ ভাল করে শুনে নাও, এটিই হচ্ছে স্পষ্ট দেউলিয়াপনা৷” যুমারঃ১৪-১৫
সুতরাং হে প্রত্যাবর্তনকারীরা,) দীনকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে তাঁকে ডাকো, তোমাদের এ কাজ কাফেরদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন৷ মুমিনঃ ১৪
একটি হাদীসে কুদসীতে ও উপস্থাপিত হয়েছে ৷ তাতে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক শরীকের অংশীদারিত্ব থেকে আমি সব চেয়ে বেশী মুক্ত ৷ যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করেছে যার মধ্যে আমার সাথে অন্য কাউকেও শরীক করেছে , তা থেকে আমি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত এবং আমার সাথে যাকে সে ঐ কাজে শরীক করেছে , ঐ সম্পূর্ণ কাজটি তারই জন্য ( মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজাহ )৷
কাজেই আল্লাহকে দুই, তিন বা বহু ইলাহের একজন গণ্য করা এবং তাঁর সাথে অন্যদের বন্দেগী উপাসনা ও পূজা করাই হচ্ছে আসল কুফরী এবং এ ধরনের কুফরীর সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীনতার কথা ঘোষণা করাই এ সূরার উদ্দেশ্য )
وَلَا أَنتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ
৩) আর না তোমরা তার ইবাদাত করো যার ইবাদাত আমি করি ৷
وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدتُّمْ
৪) আর না আমি তাদের ইবাদাত করবো যাদের ইবাদাত তোমরা করে আসছো৷
وَلَا أَنتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ
৫) আর না তোমরা তার ইবাদাত করবে যার ইবাদাত আমি করি ৷
এ সূরায় কয়েকটি বাক্য পুনঃপুনঃ উল্লিখিত হওয়ায় স্বভাবত প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এ ধরনের আপত্তি দূর করার জন্যে বুখারী অনেক তাফসীরবিদ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একই বাক্য একবার বর্তমানকালের জন্যে এবং একবার ভবিষ্যৎকালের জন্যে উল্লেখ করা হয়েছে। [ফাতহুল বারী] অর্থাৎ আমি এক্ষণে কার্যত তোমাদের উপাস্যদের ইবাদত করি না এবং তোমরা আমার উপাস্যের ইবাদত কর না এবং ভবিষ্যতেও এরূপ হতে পারে না। ইমাম তাবারীও এ মতটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে কাসীর এখানে অন্য একটি তাফসীর অবলম্বন করেছেন।
তিনি প্রথম জায়গায় আয়াতের অর্থ করেছেন এই যে, তোমরা যেসব উপাস্যের ইবাদত কর, আমি তাদের ইবাদত করি না এবং আমি যে উপাস্যের ইবাদত করি তোমরা তার ইবাদত করা না।
আর দ্বিতীয় জায়গায় আয়াতের অর্থ করেছেন এই যে, আমার ও তোমাদের ইবাদতের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। আমি তোমাদের মত ইবাদত করতে পারি না এবং বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত তোমরাও আমার মত ইবাদত করতে পার না। এভাবে প্রথম জায়গায় উপাস্যদের বিভিন্নতা এবং দ্বিতীয় জায়গায় ইবাদত পদ্ধতির বিভিন্নতা বিধৃত হয়েছে। [ইবন কাসীর]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমদের ইবাদতপদ্ধতি তাই; যা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে বলে দেয়া হয়েছে।
আর মুশরিকদের ইবাদত পদ্ধতি স্বাকল্পিত। ইবনে-কাসীর এই তাফসীরের পক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ কলেমার অর্থ তাই হয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন হক্ক উপাস্য নেই। ইবাদত-পদ্ধতি তা-ই গ্রহণযোগ্য, যা মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌছেছে। কোন কোন অভিজ্ঞ আলেম বলেন, ২ নং আয়াতের অর্থ, আমি তোমাদের উপাস্যদের ইবাদত কখনো করবো না। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় আয়াতের অর্থ, আমি এ ইবাদতটা কখনো, কিছুতেই গ্রহণ করবো না। অর্থাৎ তোমাদের উপাস্যদের ইবাদত করা আমার দ্বারা কখনো ঘটবে না। অনুরূপভাবে তা শরীয়তেও এটা হওয়া সম্ভব নয়। [মাজমূ’ ফাতাওয়া শাইখিল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ, ১৬/৫৪৭-৫৬৭; ইবন কাসীর]
এর আরেকটি তাফসীরও হতে পারে। আর তা হলো, প্রথমত ২নং আয়াত (لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ) অর্থ “আমি বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে তার ইবাদত করি না, তোমরা যার ইবাদত কর’। এর পরে এসেছে, (وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ) অর্থাৎ তোমরাও বর্তমানে ও ভূবিষ্যতে ইবাদতকারী নও। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, (وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ) অর্থাৎ অতীতে আমার পক্ষ থেকে এরূপ কিছু ঘটেনি। অতীত বোঝানোর জন্য عَبَدْتُمْ অতীতকালীন ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে। আর এর পরে এসেছে, (وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ) অর্থাৎ তোমরাও অতীতে তার ইবাদত করতে না, যার ইবাদত আমি সবসময় করি। ইবনুল কায়্যিম এ মতটি গ্ৰহণ করেছেন। [বাদায়ি’উল ফাওয়ায়িদ, ১/১২৩–১৫২]
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
৬। তোমাদের দীন তোমাদের জন্য এবং আমার দীন আমার জন্য ৷
অর্থাৎ আমার দীন আলাদা এবং তোমাদের দীন আলাদা ৷ আমি তোমাদের মাবুদদের পূজা – উপাসনা – বন্দেগী করি না এবং তোমরা ও আমার মাবুদের পূজা – উপাসনা করো না৷ আমি তোমাদের মাবুদদের বন্দেগী করতে পারি না এবং তোমরা আমার মাবুদের বন্দেগী করতে প্রস্তুত নও৷ তাই আমার ও তোমার পথ কখনো এক হতে পারে না৷
এটা কাফেরদের প্রতি উদারনীতি নয় বরং তারা কাফের থাকা অবস্থায় চিরকালের জন্য তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তি , সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষের ঘোষণাবাণী ৷
আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারা দীনের ব্যাপারে কখনো তাদের সাথে সমঝোতা করবে না এ ব্যাপারে কাফেরদেরকে সর্বশেষ ও চূড়ান্তভাবে নিরাশ করে দেয়াই এর উদ্দেশ্য৷
অনেকেই বলে থাকে—মানুষ যে যার মত ধর্ম পালন করলে কোনো সমস্যা নেই। যাকে তাকে ইসলামের কথা বলে বিরক্ত করার দরকার নেই। “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” —এই ধরনের অবাস্তব কথাকে সমর্থন করার জন্য অনেক সময় এই আয়াত টানা হয়।
বরং আয়াতের ভাষা হচ্ছে, তোমাদের ধর্ম শুধুই তোমাদের থাকবে। এর সাথে আমার কোনোই সম্পর্ক নেই। এটা কখনই আমার হবে না। আমি কোনোদিনও তোমাদের ধর্ম মানবো না। আর আমার ধর্ম শুধুই আমার থাকবে। আমি কোনোদিন আমার ধর্মকে তোমাদের কাছে বেঁচে দিবো না। তোমাদের কথা শুনে আমার ধর্মে কোনো পরিবর্তন আনব না।
এ সূরার পরে নাযিল হওয়া কয়েকটি মক্কী সূরাতে পর পর এ দায়মুক্তি , সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষ প্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে৷
সূরা ইউনুসে বলা হয়েছে : ” এরা যদি তোমাকে মিথ্যা বলে তাহলে বলে দাও , আমার কাজ আমার জন্য এবং তোমাদের কাজ তোমাদের জন্য ৷ আমি যা কিছু করি তার দায় – দায়িত্ব থেকে তোমরা মুক্ত৷ ” ( ৪১ আয়াত )
এ সূরাতেই তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলা হয়েছে৷ : ” হে নবী ! বলে দাও , হে লোকেরা , যদি তোমরা আমার দীনের ব্যাপারে ( এখানে ) কোন রকম সন্দেহের মধ্যে থাকো তাহলে ( শুনে রাখো) , আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের বন্দেগী করছো আমি তাদের বন্দেগী করি না বরং আমি শুধুমাত্র সেই আল্লাহর বন্দেগী করি যার কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে তোমাদের মৃত্যু৷ ” ( ১০৪ আয়াত )
সূরা আশ শু’আরায় বরেছেন : ” হে নবী ! যদি এরা এখন তোমার কথা না মানে তাহলে বলে দাও , তোমরা যা কিছু করছো তা থেকে আমি দায়মুক্ত৷” (২১৬ আয়াত )
সূরা সাবায় বলেছেন : এদেরকে বলো , আমাদের ত্রুটির জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কিছু করে যাচ্ছো সে জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে না৷ বলো , আমাদের রব একই সময় আমাদের ও তোমাদের একত্র করবেন এবং আমাদের মধ্যে ঠিকমতো ফায়সালা করবেন৷” ( ২৫-২৬ আয়াত )
সূরা যুমার – এ বলেছেন : ” এদেরকে বলো , হে আমার জাতির লোকেরা ! তোমরা নিজেদের জায়গায় কাজ করে যাও৷ আমি আমার কাজ করে যেতে থাকবো ৷ শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে কার ওপর আসছে লাঞ্ছনাকর আযাব এবং কে এমন শাস্তি লাভ করছে যা অটল৷ ” (৩৯-৪০ আয়াত )
আল্লাহ তাআলা বলেন: “বলুন, এটাই আমার পথ, আমি জেনে-বুঝে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারা। আর আল্লাহ্ কতই না পবিত্র এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।”[সূরা ইউসূফ, আয়াত: ১০৮]
আবার মদীনা তাইয়েবার সমস্ত মুসলমানকে ও এই একই শিক্ষা দেয়া হয় ৷ তাদেরকে বলা হয় : তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে রয়েছে একটি ভালো আদর্শ ৷ ( সেটি হচ্ছে 🙂 তারা নিজেদের জাতিকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে , আমরা তোমাদের থেকে ও তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে সব মাবুদদের পূজা করো তাদের থেকে পুরোপুরি সম্পর্কহীন ৷ আমরা তোমাদের কুফরী করি ও অস্বীকৃতি জানাই এবং যতক্ষণ তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনো ততক্ষণ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালীন শক্রতা সৃষ্টি হয়ে গেছে ৷ ” (আল মুমতাহিনা ৪ আয়াত )
কুরআন মজীদের একের পর এক এসব সুস্পষ্ট বক্তব্যের পর তোমরা তোমাদের ধর্ম মেনে চলো এবং আমাকে আমার ধর্ম মেনে চলতে দাও -“লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন “- এর এ ধরনের কোন অর্থের অবকাশই থাকে না ৷ বরং সূরা যুমার – এ যে কথা বলা হয়েছে , একে ঠিক সেই পর্যায়ে রাখা যায় যেখানে বলা হয়েছে : “হে নবী ! এদেরকে বলে দাও , আমি তো আমার দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে তাঁরই ইবাদাত করবো , তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে যার যার বন্দেগী করতে চাও করতে থাক না কেন ৷” ( ১৪ আয়াত )
এ আয়াতের ভিত্তিতে ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম শাফেয়ী এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে , কাফেরদের ধর্ম পরস্পর যতই বিভিন্ন হোক না কেন সামগ্রিকভাবে সমস্ত কাফেররা মূলত একই গোষ্ঠীভুক্ত৷ কাজেই তাদের মধ্যে যদি বংশ বা বিবাহের ভিত্তিতে অথবা অন্য কোন কারণে এমন কোন সম্পর্ক থাকে যা একের সম্পত্তিতে অন্যের উত্তরাধিকারী স্বত্ব দাবী করে তাহলে একজন খৃষ্টান একজন ইহুদীর , একজন ইহুদী একজন খৃষ্টানের এক ধর্মের কাফের অন্য ধর্মের কাফেরের উত্তরাধিকারী হতে পারে৷ বিপরীত পক্ষে ইমাম মালিক , ইমাম আওযায়ী ও ইমাম আহমাদের মতে এক ধর্মের লোকেরা অন্য ধর্মের লোকদের উত্তরাধিকারী হতে পারে না৷ তারা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে এ মত পোষণ করেন৷ এ হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “দুই ভিন্ন ধর্মের লোক পরস্পরের ওয়ারিশ হতে পারে না৷ ” ( মুসনাদে আহমাদ , আবু দাউদ , দারে কুতনী)৷
প্রায় একই ধরনের বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস ইমাম তিরমিযী হযরত জাবের (রা) থেকে , ইবনে হিব্বান হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওপর (রা) থেকে এবং বাযযার আবু হুরাইরা (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন৷ এ বিষয়টি আলোচনা প্রসংগে হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম শাসসুল আয়েম্মা সারাখসী লিখেছেন : যে সমস্ত কারণে মুসলমানরা পরস্পরের ওয়ারিশ হয় সে সমস্ত কারণে কাফেররাও পরস্পরের ওয়ারিশ হতে পারে৷ আবার তাদের মধ্যে এমন কোন কোন অবস্থায়ও উত্তরাধিকার স্বত্ব জারী হতে পারে যে অবস্থায় মুসলমানদের মধ্যে হয় না৷
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে দীন হচ্ছে দু’টি একটি সত্য দীন এবং অন্যটি মিথ্যা দীন৷ তাই তিনি বলেছেন : এই সাথে তিনি মানুষদের দু’দলে বিভক্ত করেছেন ৷ একদল জান্নাতী এবং তারা হচ্ছে মুমিন৷ একদল জাহান্নামী এবং সামগ্রিকভাবে তারা হচ্ছে কাফের সমাজ৷ এ দু’দলকে তিনি পরস্পরের বিরোধী গণ্য করেছেন
তাই তিনি বলেছেন : এই দু’টি পরস্পর বিরোধী দল৷ এদের মধ্যে রয়েছে নিজেদের রবের ব্যাপারে বিরোধ ৷ -আল হজ্জ ১৯ আয়াত ) অর্থাৎ সমস্ত কাফেররা মিলে একটি দল৷
তাদের বিরোধ ঈমানদার বা মু’মিনদের সাথে ৷ তাদের নিজেদের আকীদা- বিশ্বাসের দিক দিয়ে আলাদা আলাদা মিল্লাতে তথা মানব গোষ্ঠীর অন্তরভুক্ত বলে আমরা মনে করি না৷ বরং মুসলমানদের মোকাবিলায় তারা সবাই একটি মিল্লাতের অন্তরভুক্ত৷ কারণ মুসলমানরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত ও কুরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকার করে৷ অন্যদিকে তারা এসব অস্বীকার করে ৷ এ জন্য তাদেরকে কাফের বলা হয়৷ মুসলমানদের মোকাবিলায় তারা একই গোষ্ঠীভুক্ত হয়।
, ” মিল্লাতাইন ” ( দুই মিল্লাত তথা দুই গোষ্ঠী ) শব্দের ব্যাখ্যা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিম্নোক্ত হাদীসের মাধ্যমে করে দিয়েছেন : ” মুসলমান কাফেরের ওয়ারিশ হতে পারে না এবং কাফের হতে পারে না মুসলমানের ওয়ারিশ ৷ ” [ আল মাবসূত ৩ খণ্ড , ৩০-৩২ পৃষ্ঠা ৷ ইমাম সারাখসী এখানে যে হাদীসটির বরাত দিয়েছেন সেটি বুখারী , মুসলিম , নাসায়ী , আহমাদ , তিরমিযী , ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদ হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা) থেকে রেওয়ায়াত করেছেন ৷]
মদীনায় হিজরত করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- তার ও ইয়াহুদীদের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। তাই সম্পর্কচ্যুতির অর্থ এ নয় যে, তাদের সাথে প্রয়োজনে সন্ধিচুক্তি করা যাবে না। মূলত সন্ধির বৈধতা ও অবৈধতার আসল কারণ হচ্ছে স্থান-কাল-পাত্র এবং সন্ধির শর্তাবলি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফয়সালা দিতে গিয়ে বলেছেন- “সে সন্ধি অবৈধ, যা কোন হারামকে হালাল কিংবা হালালকে হারাম করে।” [আবু দাউদ: ৩৫৯৪, তিরমিযী: ১৩৫২, ইবনে মাজহ: ২৫৫৩] ইয়াহুদীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে ইসলামের মূলনীতিবিরুদ্ধ কোন বিষয় ছিল না। উদারতা, সদ্ব্যবহার ও শান্তি অন্বেষায় ইসলামের সাথে কোন ধর্মের তুলনা হয় না। কিন্তু এরূপ শান্তিচুক্তি মানবিক অধিকারের ব্যাপারে হয়ে থাকে- আল্লাহ তা’আলার আইন ও দ্বীনের মূলনীতিতে কোন প্রকার দরকষাকষির অবকাশ নেই। [দেখুন: ইবন তাইমিয়্যাহ, আল-জাওয়াবুস সহীহ, ৩/৫৯-৬২; ইবনুল কাইয়্যিম, বাদায়ি’উল ফাওয়ায়িদ, ১/২৪৬–২৪৭]
তাফহীমুল কুর’আন ও তাফসিরে যাকারিয়া ও কিছু বিক্ষিপ্ত সংগৃহিত।
https://www.youtube.com/watch?v=Whj_3-iASUE