সূরা ইনশিকাক
সূরা নাম্বারঃ৮৪ আয়াত সংখ্যাঃ ২৫ রুকুঃ ১ অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালঃ মক্কার প্রথম যুগে
ইনশিকাক শব্দের অর্থঃ ফেটে যাওয়া । সূরার এ নামকরণের মাধ্যমে একথা বলতে চাওয়া হয়েছে যে , এটি এমন একটি সূরা যাতে আকাশের ফেটে যাওয়ার উল্লেখ আছে।
বিষয়বস্তুঃ কিয়ামত ও আখেরাত ।
১-৫ আয়াতে কেবল কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনার সংগে কিয়ামত যে সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে তার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।
৬ – ১৯ আয়াতে মানুষ সচেতন বা অচেতন যে কোনভাবেই হোক না কেন আখেরাতের মনযিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে তার নিজেকে তার রবের সামনে পেশ করতে হবে। তখন সমস্ত মানুষ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।
২০-২৫ আয়াতে কাফেরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির খবর শুনানো হয়েছে। কারণ তারা কুরআনের বাণী শুনে আল্লাহর সামনে নত হওয়ার পরিবর্তে তার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে । এ সংগে যারা ঈমান এনে নেক আমল করে তাদেরকে অগণিত
পুরস্কার ও উত্তম প্রতিদানের সুখবর শুনানো হয়েছে।
কিয়ামতের বর্ননাঃ
এই শব্দের(أَذِنَتْ) আরবী ভাষার প্রবাদ অনুযায়ী হলো যে হুকুম শুনা ও সাথে সাথে সেটা মেনে কাজ করা। মহান আল্লাহর হুকুমেই আকাশ ফেটে যাবে।
যখন আকাশ ফেটে যাবে -ইনশিকাকঃ১
যখন আকাশ ফেটে যাবে -সূরা ইনফিতারঃ১
যে দিন আকাশ বিদীর্ণ হবে, সেদিন তা রক্ত রঙ্গে রঞ্জিত চামড়ার রুপ ধারন করবে’’ রাহমানঃ ৩৭
এবং আকাশ বিদীর্ণ হয়ে হয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে’’ হাক্কাহঃ ৩৭
(যেদিন সেই আযাব আসবে)সেদিন আসমান গলিত রূপার মত বর্ণ ধারণ করবো৷মায়ারিজঃ৮
(একটু ভেবে দেখুনঃ)- এতো সুন্দর আকাশ যা নিয়ে মানুষ কত কল্পনা, কত কবিতা, কত ভালো লাগা, কত বৈজ্ঞানিক সূত্র ও ব্যাখ্যা এবং সর্বোপরি কত কল্যানকর জিনিষ প্রাপ্তি হচ্ছে। এতো বিশাল আকাশ যা আমাদের নজরে আসে এবং যা নজরের বাইরে অবস্থিত কত সুন্দর নিয়মে অবস্থান করছে। এই আকাশটি এখন যেমন মহান রবের হুকুমে এইভাবে অবস্থান করছে ঠিক তেমনি মহান রবের হুকুমেই রক্তিম আকার ধারন করে বিদীর্ণ হয়ে যাবে। খুব বেশী দূরে নয়।
আর পৃথিবীকে যখন ছড়িয়ে দেয়া হবে৷ইনশিকাকঃ৩
এবং যমীনকে এমন সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেবেন যে, সেখানে তোমরা কোন উঁচু জায়গা ও ভাঁজ দেখতে পাবে না৷ ” সূরা ত্বাহাঃ( ১০৬ – ১০৭)
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “ কিয়ামতের দিন পৃথিবীকে একটি দস্তরখানের মতো খুলে বিছিয়ে দেয়া হবে৷ তারপর মানুষের জন্য সেখানে কেবলমাত্র পা রাখার জায়গাই থাকবে।(হাকেম মুসতাদরা)
সে দিন সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষের জন্ম হয়েছে ও হবে সবাইকে একই সংগে জীবিত করে আল্লাহর আদালতে হাসরের মাঠে পেশ করা হবে৷ এ বিরাট জনগোষ্ঠীকে এক জায়গায় দাঁড় করাবার জন্য সমস্ত সাগর , নদী , জলাশয় , পাহাড় , পর্বত , উপত্যকা , মালভূমি , তথা উঁচু – নীচু সব জায়গা ভেঙেচুরে ভরাট করে সারা দুনিয়াটাকে একটি বিস্তীর্ণ প্রান্তরে পরিণত করা হবে৷
যেদিন পরিবর্তিত করা হবে এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীতে এবং পরিবর্তিত করা হবে আকাশ সমূহকে এবং লোকেরা পরাক্রমশালী এবং আল্লাহর সামনে পেশ হবে। (সূরা: ইবরাহীম, আয়াত: ৪৮।)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কিয়ামতের দিন মানুষ একটি স্বচ্ছ চেপটা রুটির মত সাদাপ্রান্তরে একত্রিত হবে। সেখানে কারো কোন প্রতীক বা চিহ্ন থাকবে না। (-বোখারী ও মুসলিম।)
যা কিছু তার মধ্যে আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করে সে খালি হয়ে যাবে-ইনশিকাকঃ৪
এবং পৃথিবী যখন তার ভারসমূহ বের করে দেবে,-সূরা যিলযালঃ২
যত মৃত মানুষ তার মধ্যে রয়েছে সবাইকে ঠেলে বাইরে বের করে দেবে৷ আর এ ভাবে তাদের কৃতকর্মের যেসব প্রমাণপত্র তার মধ্যে রয়ে গেছে সেগুলোও পুরোপুরি বেরিয়ে আসবে৷ কোন একটি জিনিসও তার মধ্যে লুকিয়ে বা গোপন থাকবে না৷
এক. মরা মানুষ মাটির বুকে যেখানে যে অবস্থায় যে আকৃতিতে আছে দ্বিতীয় ফুঁৎকারের পরে তাদের সবাইকে বের করে এনে সে বাইরে ফেলে দেবে এবং যাবতীয় মৃতকে বের করে হাশরের মাঠের দিকে চালিত করবে। মানুষের শরীরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অংশগুলো এক জায়গায় জমা হয়ে নতুন করে আবার সেই একই আকৃতি সহকারে জীবিত হয়ে উঠবে যেমন সে তার প্রথম জীবনের অবস্থায় ছিল। এই বিষয়টি অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছে, “হে মানুষ! তোমাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন কর; কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ংকর ব্যাপার!” [সূরা আল-হাজ: ১] আরও এসেছে, “আর পৃথিবীকে যখন সম্প্রসারিত করা হবে এবং পৃথিবী তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে ও শূন্যগর্ভ হবে।” [সূরা আল-ইনশিকাক: ৩-৪]
দুই. এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, কেবলমাত্র মরা মানুষদেরকে সে বাইরে নিক্ষেপ করে ক্ষান্ত হবে না বরং তাদের প্রথম জীবনের সমস্ত কথা ও কাজ এবং যাবতীয় আচার-আচরণের রেকর্ড ও সাক্ষ্য-প্রমাণের যে স্তুপ তার গর্ভে চাপা পড়ে আছে সেগুলোকেও বের করে বাইরে ফেলে দেবে। পরবর্তী বাক্যটিতে একথারই প্ৰকাশ ঘটেছে। তাতে বলা হয়েছে, যমীন তার ওপর যা কিছু ঘটেছে তা বর্ণনা করবে। তিন. কোন কোন মুফাসসির এর তৃতীয় একটি অর্থও বর্ণনা করেছেন। সেটি হচ্ছে, সোনা, রূপা, হীরা, মণি-মাণিক্য এবং অন্যান্য যেসব মূল্যবান সম্পদ ভূ-গর্ভে সঞ্চিত রয়েছে সেগুলোর বিশাল বিশাল স্তুপও সেদিন যমীন উগলে দেবে। [দেখুন: আদওয়াউল বায়ান] আর যদি দুনিয়ার জীবনের শেষভাগে কিয়ামতের আলামত হিসেবে এ সম্পদ বের করা বোঝায় তবে এতদসংক্রান্ত একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “পৃথিবী তার কলিজার টুকরা বিশালাকার স্বর্ণ খণ্ডের আকারে উদগীরণ করে দেবে। তখন যে ব্যক্তি ধনসম্পদের জন্যে কাউকে হত্যা করেছিল, সে তা দেখে বলবে, এর জন্যেই কি আমি এতবড় অপরাধ করেছিলাম? যে ব্যক্তি অর্থের কারণে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল, সে বলবে, এর জন্যেই কি আমি এ কাণ্ড করেছিলাম? চুরির কারণে যার হাত কাটা হয়েছিল, সে বলবে, এর জন্যেই কি আমি নিজের হাত হারিয়েছিলাম? অতঃপর কেউ এসব স্বর্ণখণ্ডের প্রতি ভ্ৰক্ষেপও করবে না। [মুসলিম: ১০১৩]-(তাফসিরে যাকারিয়া)
হে মানুষ ! তুমি কঠোর পরিশ্রম করতে করতে তোমার রবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো, পরে তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে৷ ইনশিকাকঃ৬
এখানে জানা যায় মানুষ কঠোর বা অধিক পরিশ্রম করে করে আসল জায়গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর তা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক। আর সেই জায়গাটি হলো পরবর্তী বরযখের জীবনে।
একটি হাদীসে এসেছে, “কোন মানুষের জীবন যদি কোন সুনির্দিষ্ট স্থানে অবসান হওয়ার কথা থাকে তখন আল্লাহ তার জন্য সেখানে যাওয়ার একটি প্রয়োজন তৈরী করে দেন। তারপর যখন সে স্থানে পৌঁছে তখন তাকে মৃত্যু দেয়া হয়। তারপর যমীন কিয়ামতের দিন বলবে, হে রব! এটা তুমি আমার কাছে আমানত রেখেছিলে।” [ইবনে মাজাহ: ৪২৬৩]
যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসেব সহজ করে নেয়া হবে এবং সে প্রিয় জনের কাছে আনন্দে ফিরে যেতে চাইবে জানানোর জন্য।
হযরত আয়েশা ( রা) বলেন , হে আল্লাহর রসূল ! আল্লাহ কি একথা বলেননি , ” যার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে তার থেকে হালকা হিসেব নেয়া হবে ? ” রসূলুল্লাহ (সা) জবাব দেন : ” সেটি তো হলো কেবল আমলের উপস্থাপনা ৷ কিন্তু যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হযেছে সে মারা পড়েছে৷ ” আর একটি রেওয়ায়াতে হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আমি একবার নামাযে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নোক্ত দোয়া পড়তে শুনি : ” হে আল্লাহ ! আমার থেকে হাল্কা হিসেব নাও ” তিনি সালাম ফেরার পর আমি তাঁকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করি৷ তিনি বলেন : ” হাল্কা হিসেব মানে বান্দার আমলনামা দেখা হবে এবং উপেক্ষা করা হবে৷ যে আয়েশা ! সেদিন যার কাছ থেকে হিসেব নেয়া হয়েছে সে মারা পড়েছে৷ “
তার হিসেব নেয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হবে না৷ তাকে জিজ্ঞেস করা হবে না , উমুক উমুক কাজ তুমি কেন করেছিলে ? ঐসব কাজ করার ব্যাপারে তোমার কাছে কি কি ওজর আছে ? নেকীর সাথে সাথে গোনাহ অবিশ্য তার আমলনামায় লেখা থাকবে৷ কিন্তু গোনাহের তুলনায় নেকীর পরিমাণ বেশী হবার কারণে তার অপরাধগুলো উপেক্ষা করা হবে এবং সেগুলো মাফ করে দেয়া হবে৷ কুরআন মজিদে অসৎকর্মশীল লোকদের কঠিন হিসেব নিকেশের জন্য ” সু – উল হিসেব” ( খারাপভাবে হিসেব নেয়া ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷
যারা নিজেদের রবের দাওয়াত গ্রহণ করেছে তাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে আর যারা তা গ্রহণ করেনি তারা যদি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের মালিক হয়ে যায় এবং এ পরিমাণ আরো সংগ্রহ করে নেয় তাহলেও তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাচাঁর জন্য এ সমস্তকে মুক্তিপণ হিসেবে দিয়ে দিতে তৈরী হয়ে যাবে৷ ৩৩ এদের হিসেব নেয়া হবে নিকৃষ্টভাবে এবং এদের আবাস হয়ে জাহান্নাম, বড়ই নিকৃষ্ট আবাস৷ আর রা’দঃ ১৮
সৎ লোকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে :
এ ধরনের মানুষের কাছে থেকে তাদের উত্তম আমলসমূহ আমি গ্রহণ করে থাকি, তাদের মন্দ কাজসমূহ ক্ষমা করে দেই৷ যে প্রতিশ্রুতি তাদের দিয়ে আসা হয়েছে তা ছিলো সত্য প্রতিশ্রুতি৷ সেই প্রতিশ্রুতি অনুসারে এরা জান্নাতী লোকদের অন্তর্ভূক্ত হবে৷ ( আল আহকাফঃ১৬ আয়াত )
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যে ব্যাখ্যা করেছেন তাকে ইমাম আহমাদ, বুখারী , মুসলিম , তিরমিযী , নাসাঈ ,আবু দাউদ, হাকেম , ইবনে জারীর , আবদ ইবনে হুমাইদ ও ইবনে মারদুইয়া বিভিন্ন শব্দাবলীর সাহায্যে হযরত আয়েশা ( রা) থেকে বর্ণনা করেছেন৷ এক বর্ণনা মতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “যার থেকেই হিসেব নেয়া হয়েছে , সে মারা পড়েছে ৷ ”
১। সূরাটি পবিত্র কুরআনের কত তম সূরা? সূরাটির নামের অর্থ কি?
২। সূরাটিতে কতটি রুকু ও আয়াত আছে?
৩। সূরাটি রাসূল স.এর জীবনের কোন পর্যায়ে নাযিল হয়েছিল?
৪। এই সূরার মূল আলোচ্য বিষয় কি?
৫। মানুষ কি ধরনের পরিশ্রমে কোন দিকে অগ্রসর হছে বলে এখানে উল্লেখ হয়েছ?
৬। কোন ব্যক্তি আপনজনের কাছে হাসিমুখে ফিরে যাবে?
৭। কোন ব্যক্তি নিজেই নিজের ধ্বংস কামনা করবে?
৮। কাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহতা’আলা?
৯। সূরার শিক্ষা কি ও এই সূরার শিক্ষা থেকে করনীয় কী?