সূরা ইউনুসঃ ৭ম রুকু (আয়াত ৬১-৭০নং)
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
১০:৬১ وَ مَا تَکُوۡنُ فِیۡ شَاۡنٍ وَّ مَا تَتۡلُوۡا مِنۡهُ مِنۡ قُرۡاٰنٍ وَّ لَا تَعۡمَلُوۡنَ مِنۡ عَمَلٍ اِلَّا کُنَّا عَلَیۡکُمۡ شُهُوۡدًا اِذۡ تُفِیۡضُوۡنَ فِیۡهِ ؕ وَ مَا یَعۡزُبُ عَنۡ رَّبِّکَ مِنۡ مِّثۡقَالِ ذَرَّۃٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا فِی السَّمَآءِ وَ لَاۤ اَصۡغَرَ مِنۡ ذٰلِکَ وَ لَاۤ اَکۡبَرَ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ
৬১. আর আপনি যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন এবং আপনি সে সম্পর্কে কুরআন থেকে যা-ই তিলাওয়াত করেন এবং তোমরা যে আমলই কর না কেন, আমরা তোমাদের সাক্ষী থাকি, যখন তোমরা তাতে প্রবৃত্ত হও। আর আসমানসমূহ ও যমীনের অণু পরিমাণও আপনার রবের দৃষ্টির বাইরে নয় এবং তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তর কিছুই নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।
নবীকে সান্ত্বনা দেয়া এবং তাঁর বিরোধীদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যেই এখানে এ কথার উল্লেখ করা হয়েছে৷ একদিকে নবীকে বলা হচ্ছে, সত্যের বাণী লোকদের কাছে প্রচার এবং আল্লাহর বান্দাদের সংশোধন করার জন্য তুমি যেভাবে জানপ্রাণ দিয়ে এবং সবর ও সহিষ্ণুতা সহকারে কাজ করে যাচ্ছো তার প্রতি আমি নজর রাখছি৷ এমন নয় যে, এ বিপদসংকুল কাজে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি তোমাকে অসহায় ছেড়ে দিয়েছি৷ যা কিছু তুমি করছো তাও আমি দেখছি এবং যে আচরণ তোমার সাথে করা হচ্ছে সে সম্বন্ধেও আমি বেখবর নই৷ অন্যদিকে নবীর বিরোধীদেরকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, একজন সত্যের আহবায়ক ও মানব হিতৈষীর সংস্কারধর্মী প্রচেষ্টার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তোমরা একথা মনে করে নিয়ো না যে, তোমাদের এসব কাজ কারবার দেখার মতো কেউ নেই এবং কখনো তোমাদেরকে এহেন কাজের জন্য কোন জবাবদিহি করতে হবে না৷ জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করছো সবই আল্লাহ রেকর্ডে সংরক্ষিত হচ্ছে৷
আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী (সাঃ) এবং মু’মিনদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন যে, তিনি সমস্ত সৃষ্টির অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন এবং সর্বক্ষণ তিনি মানুষের সকল অবস্থা অবলোকন করছেন। আকাশ ও পৃথিবীর ছোট-বড় কোন বস্তুই তাঁর নিকট লুক্কায়িত নয়। উক্ত বিষয়টি ইতিপূর্বে সূরা আন্আমের ৫৯নং আয়াতে পার হয়ে গেছে। তাঁরই নিকট অদৃশ্যের চাবি রয়েছে; তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে-স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত। তাঁর অজ্ঞাতসারে (বৃক্ষের) একটি পাতাও পড়ে না, মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণা অথবা রসযুক্ত কিম্বা শুষ্ক এমন কোন বস্তু পড়ে না, যা সুস্পষ্ট কিতাবে (লিপিবদ্ধ) নেই।’’
অনুরূপ সূরা আন্আমের ৩৮নং আয়াতে এবং সূরা হূদের ৬নং আয়াতেও উক্ত বিষয়কে বর্ণনা করা হয়েছে। যখন ঘটনা এই যে, তিনি আকাশ ও পৃথিবীতে অবস্থিত সকল বস্তুর নড়া-চড়ার খবর রাখেন, তখন তিনি মানুষ ও জীন জাতি, যারা আল্লাহর ইবাদতের ভারপ্রাপ্ত ও আদেশপ্রাপ্ত তাদের চলা-ফেরা ও কর্মকান্ড থেকে কিভাবে বেখবর থাকবেন?
১০:৬২ اَلَاۤ اِنَّ اَوۡلِیَآءَ اللّٰهِ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ
৬২. জেনে রাখা আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।
১০:৬৩ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ
৬৩. যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করত।
১০:৬৪ لَهُمُ الۡبُشۡرٰی فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ ؕ لَا تَبۡدِیۡلَ لِکَلِمٰتِ اللّٰهِ ؕ ذٰلِکَ هُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ
৬৪. তাদের জন্যই আছে সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে, আল্লাহর বাণীর কোন পরিবর্তন নেই; সেটাই মহাসাফল্য।
আরবী (الوِلايَة، الوَلايَة بكسرة الواو وفتحها) বিলায়াত, বেলায়াত বা ওয়ালায়াত অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব বা অভিভাবকত্ব (closeness, friendship, guardianship)। ‘বেলায়াত’ অর্জনকারীকে ‘ওলী’ বা ‘ওয়ালী’ (الولى) বলা হয়। ওলী অর্থ নিকটবর্তী, বন্ধু, সাহায্যকারী, অভিভাবক ইত্যাদি। বেলায়াত ধাতু থেকে নির্গত ‘ওলী অথের্রই আরেকটি সুপরিচিত শব্দ ‘মাওলা’ (مولى)। ‘মাওলা’ অর্থও অভিভাবক, বন্ধু, সঙ্গী ইত্যাদি (master, protector, friend, companion)।
ইসলামী পরিভাষায় ‘বেলায়াত’ ‘ওলী’ ও ‘মাওলা’ শব্দের বিভিন্ন প্রকারের ব্যবহার রয়েছে। উত্তরাধিকার আইনের পরিভাষায় ও রাজনৈতিক পরিভাষায় এ সকল শব্দ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। তবে বেলায়াত বা ওলী শব্দদ্বয় সর্বাধিক ব্যবহৃত (ولاية الله) ‘আল্লাহর বন্ধুত্ব’ ও (ولى الله) ‘আল্লাহর বন্ধু’ অর্থে। এই পুস্তকে আমরা ‘বেলায়াত’ বলতে এই অর্থই বুঝাচ্ছি।(রাহে বেলায়েত বই, ড আবদুল্লাহ জাহাংগীর রহ)
আশ্শাইখ ‘আব্দুর্ রায্যাক্ব ইবনু ‘আব্দিল মুহ্ছিন আল ‘আব্বাদ আল বাদ্র حَفِظَهُ اللهُ আলোচনা থেকেঃ
যে ব্যক্তি ঈমানদার ও মুত্তাক্বী (তাক্বওয়া অবলম্বনকারী) হবেন, তিনিই হবেন আল্লাহ্র অলী। ওয়ালায়াত (বেলায়াত) বা আল্লাহ্র বন্ধুত্ব লাভের মূল উপায় হলো – ঈমান ও তাক্বওয়া।
“ঈমান ও তাক্বওয়া” এ দু’টি বিষয় যখন একই বাক্যে উল্লেখ করা হয়, তখন ঈমান দ্বারা আল্লাহ সুবহানা তায়ালা ও তাঁর রাছূলের সা আনুগত্যমূলক কাজ সম্পাদনকে বুঝায় এবং তাক্বওয়া দ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাছূলের নিষেধকৃত বিষয়াদী বর্জনকে বুঝায়।
তাই প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহ্র অলী,তারা আল্লাহ ও তাঁর রাছূলের সা আদেশকৃত বিষয়াদী যথাযথভাবে পালন করে থাকেন এবং তাদের নিষেধকৃত বিষয়বস্তু সম্পূর্ণরূপে পরিহার ও বর্জন করে থাকেন।
আল্লাহ্র আদেশকৃত কর্মগুলো হলো-ফার্য বা আবশ্যকীয় এবং মুছ্তাহাব্ব বা পছন্দনীয়, আর আল্লাহ্র নিষেধকৃত কর্মসমূহ হলো – হারাম ও মাকরূহ।
ওয়ালায়াত বা বন্ধুত্বের স্তর হলো— দু’টি। একটি হলো- মুক্বতাসিদূনের স্তর, অপরটি হলো মুক্বার্রাবূন (নৈকট্যশীল) বা ছাবিক্বোন ফিল খাইরাত (কল্যাণের কাজে অগ্রগামীদের) স্তর। আর এই উভয় স্তরের অধিকারীগণই ক্বিয়ামাতের দিন কোনরূপ হিসাব ও শাস্তি ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
১। মুক্বতাসিদ (ইকোনমী বা মধ্যম مُّقْتَصِد) স্তরের অলীঃ
আল্লাহ্র আদেশকৃত বিষয়াদী পালনের ক্ষেত্রে যিনি কেবল ফার্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন, অর্থাৎ যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহ্র নির্দেশিত ফার্য-ওয়াজিব বা আবশ্যকীয় বিধানসমূহ সম্পাদন করবেন, আর আল্লাহ্র নিষিদ্ধ বিষয়াদী বর্জনের ক্ষেত্রে যারা কেবল হারাম বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন, অর্থাৎ শুধুমাত্র হারাম বিষয়বস্তু বর্জন করে চলবেন, তাহলে তাদের সাথে আল্লাহ্র অলীত্ব বা বন্ধুত্বের স্তর হবে মুক্বতাসিদূনের স্তর। অর্থাৎ সে মুক্বতাসিদ (ইকোনমী বা মধ্যম) স্তরের অলী বলে গণ্য হবে।
২। মুক্বার্রাবূন (নৈকট্যশীল) বা ছাবিক্বোন বিল খাইরাত سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ
যিনি ফার্য-ওয়াজিব তথা আল্লাহ্র আদেশকৃত আবশ্যকীয় বিষয়াদী পালনের পর মুছ্তাহাব্ব বা আল্লাহ্র পছন্দনীয় বিষয়াদী পালনের মাধ্যমে এবং হারাম বিষয়াদী বর্জনের পর মাকরূহ বা আল্লাহ্র নিকট অপছন্দনীয় বিষয়াদী বর্জনের মাধ্যমে নিজের অবস্থা আরো উচ্চ স্তরে নিয়ে যাবেন, তাদের সাথে আল্লাহ্র ওয়ালায়াত বা বন্ধুত্বের স্তর হবে ছাবিক্বোন ফিল খাইরাত বা কল্যাণের কাজে অগ্রগামীদের স্তর বা মর্যাদা। আর এটিই হলো বন্ধুত্বের সবচেয়ে মহান ও সর্বোচ্চ স্তর।
দু’টি উচ্চ স্তরের অধিকারীগণের সুস্পষ্ট বিবরণ এসেছে সাহীহ্ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীছে। আবূ হুরাইরাহ থেকে বর্ণিত এ হাদীছটি ‘উলামায়ে কিরামের নিকট হাদীছে অলী বলেই বহুল পরিচিত।
কেননা এই হাদীছে অলী কারা? তাদের স্তর বা মর্যাদা কী? তাদের জন্য কী ছাওয়াব বা প্রতিদান রয়েছে? এসব বিষয়ের বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। এটি একটি মহান হাদীছে ক্বোদছী, যাতে রাছূলুল্লাহ সা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ বলেছেন:—
অর্থঃ- যে ব্যক্তি আমার অলীর শত্রুতা করবে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। ফার্য ‘ইবাদাতের চেয়ে আমার নিকট অধিক পছন্দনীয় এমন কোন বস্তু নেই যদ্বারা আমার বান্দাহ আমার নৈকট্য লাভ করে থাকে। আর আমার বান্দাহ সব সময় নাফ্ল ‘ইবাদাতের দ্বারা আমার (অধিক) নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে যে পর্যন্ত না আমি তাকে ভালোবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালোবেসে নেব, তখন আমি তার কর্ণ হয়ে যাব যদ্বারা সে শুনতে পাবে, আমি তার চক্ষু হয়ে যাব যদ্বারা সে দেখতে পাবে, আমি তার হাত হয়ে যাব যদ্বারা সে ধরতে পারবে এবং পা হয়ে যাব যদ্বারা সে চলাফেরা করবে। তখন সে যদি আমার নিকট কোন কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে অবশ্যই আমি তাকে তা দান করব, সে যদি আমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তাহলে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেব।২
৩। মুছলিম যালিম লি—নাফছিহী
আর কেউ যদি ওয়ালায়াতের বা আল্লাহ্র বন্ধুত্ব লাভের এই দুই স্তরের কোন স্তরে উন্নিত হতে না পারে, সে যদি আল্লাহ্র আদেশকৃত অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং আল্লাহ্র নিষেধকৃত অবশ্য বর্জনীয় বিষয়গুলো যথাযথভাবে বর্জন করতে না পারে, তবে তার এইসব ত্রুটি বিচ্যুতি যদি কুফ্রের (আল্লাহ্কে অস্বীকার করার) পর্যায়ে না যায়, তাহলে সে “মুছলিম যালিম লি—নাফছিহী”অর্থাৎ নিজের প্রতি অন্যায়-অত্যাচারকারী মুছলিম বলে গণ্য হবে। ক্বিয়ামাতের দিন তাকে আল্লাহ্র শাস্তির মুখোমুখি করা হবে। তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে কেবল পাপ থেকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ করার জন্য। অতঃপর (শাস্তি ভোগের পর) তার শেষ গন্তব্য হবে জান্নাত; সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
এই তিন প্রকার লোকের কথা আল্লাহ ক্বোরআনে কারীমে একসাথে একটি আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:-
ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِيْنَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللهِ ذٰلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيْرُ. جَنَّاتُ عَدْنٍ يَّدْخُلُوْنَهَا يُحَلَّوْنَ فِيْهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَّلُؤْلُؤًا وَلِبَاسُهُمْ فِيْهَا حَرِيْرٌ.
অর্থাৎ— অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করেছি তাদেরকে যাদেরকে আমি আমার বান্দাহ্দের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি, তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্র নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে অগ্রগামী। এটাই হলো বিরাট অনুগ্রহ। তারা প্রবেশ করবে বসবাসের জান্নাতে। তথায় তারা স্বর্ণনির্মিত মোতি খচিত চিরুণী দ্বারা অলংকৃত হবে। সেখানে তাদের পোষাক হবে রেশমের। (সূরা ফাত্বিরঃ৩২—৩৩)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:—
جَنَّاتُ عَدْنٍ يَّدْخُلُوْنَهَا
অর্থাৎ— বসবাসের জান্নাতে তারা প্রবেশ করবে।
এখানে সাধারণভাবে “তারা”বলতে আয়াতে উল্লেখিত তিন প্রকারের লোককেই বুঝানো হয়েছে। যালিম লি—নাফছিহী, মুক্বতাসিদ এবং ছাবিক্ব ফিল খাইরাত— এই তিন প্রকার লোকই বসবাসের জান্নাতে প্রবেশ করবে। তবে মুক্বতাসিদ এবং ছাবিক্ব বিল খাইরাত— এই দুই প্রকার লোক হিসাব—নিকাশ ছাড়া এবং কোনরূপ শাস্তিভোগ ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবেন। আর যে ব্যক্তি কুফ্র ব্যতীত আল্লাহ্র নাফরমানী এবং পাপ ও অসৎকর্ম সম্পাদনের দ্বারা নিজের প্রতি অন্যায়—অত্যাচার করবে, তারও শেষ ঠিকানা হবে জান্নাত, তবে এর আগে শাস্তিভোগের মাধ্যমে তাকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ হতে হবে। তাই প্রথমে যদিও তাকে জাহান্নামে যেতে হবে তবে সেখানে তাকে আজীবন থাকতে হবে না, বরং জাহান্নামে শাস্তিভোগের পর যখন সে পাপমুক্ত হয়ে যাবে তখন তাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসা হবে এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর তখন থেকে জান্নাতই হবে তার চিরস্থায়ী আবাসস্থল।
আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর তা হলো, প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যই উচিত- (সে যতই আল্লাহ্র আনুগত্য মূলক কাজকর্ম তথা ‘ইবাদাত – বন্দেগী করুক না কেন) নিজেকে সাধু ও পুতঃপবিত্র দাবি করা থেকে সতর্ক ও সাবধান থাকা। এ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:-
فَلَا تُزَكُّوا أَنفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَىٰ
অর্থাৎ- তোমরা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতা দাবি করো না। তিনিই ভালো জানেন- কে তাক্বওয়া অবলম্বনকারী। আন্নাজ্ম— ৩২
আল্লাহ্র অলী হওয়া বা তাঁর বন্ধুত্ব লাভের বিষয়টি এরূপ কোন বিষয় নয়, যা কেউ নিজে নিজের জন্যে দাবী করতে পারে। যারা একাজটি করে থাকে (অর্থাৎ, যারা নিজে নিজেকে আল্লাহ্র অলী, দরবেশ, বযুর্গ, সূফী-সাধক, পীরে কামিল ইত্যাদি বলে দাবী করে থাকে) তারা মূলত অন্যায় ও বাতিল উপায়ে মানুষের সম্পদ ভক্ষণের নিমিত্ত কিংবা আল্লাহ্র বান্দাহ্দের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের হীন উদ্দেশ্যে অথবা সমাজে কথিত সুনাম ও সাময়িক খ্যাতি লাভের জন্য এরূপ করে থাকে। অতএব সাবধান! (এ ধরনের লোক থেকে এবং এরূপ কর্মকান্ড থেকে)!
মূলত ওয়ালায়াত বা আল্লাহ্র অলী হওয়া- এটি একজন মূমিন বান্দাহ ও আল্লাহ্র মধ্যকার বিষয়। একজন প্রকৃত মূমিন আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভের আশায় আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ ও তাঁর অলী হওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন। তাই সত্যিকার অর্থে যিনি আল্লাহ্র অলী হয়ে থাকেন তিনি কখনোই নিজেকে আল্লাহ্র অলী বলে দাবি করেন না, বা করতে পারেন না। তিনি বরং সবসময় নিজেকে আল্লাহ্র নিকট পাপী, অপরাধী ও যথাযথভাবে আল্লাহ্র হাক্ব আদায় করতে পারছেন না বলে মনে করে থাকেন।
কুরআনে কারীমে আল্লাহ তার পরিপূর্ণ মু’মিন বান্দাহ্দের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন:—
وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا آتَوا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلٰى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ
অর্থাৎ— আর যারা যা দেয়ার তা ভীত কম্পিত হৃদয়ে এ কারণে দেয় যে, তারা তাদের পালনকর্তার নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। সূরা মূমিনূন— ৬০
এ আয়াত দ্বারা একথা বুঝানো হয়েছে যে, প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মূমিন; ছাবিক্ব বিল খাইরাত বা কল্যাণের কাজে অগ্রগামী হলেন তারা, যারা আল্লাহ্র আনুগত্যমূলক যা কিছু করার সবকিছুই করে থাকেন অথচ তাদের অন্তর সব সময় এই ভয়ে ভীত থাকে যে, যদি তাদের ‘আমাল সমূহ আল্লাহ ক্বাবূল না করেন। আবুদ্ দারদা রা বলেছেন:-
لَأَنْ أَسْتَيْقِنَ أَنَّ اللهَ تَقَبَّلَ مِنِّيْ صَلَاةً وَاحِدَةً أَحَبُّ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا
অর্থ- আমার একটি সালাত আল্লাহ ক্বাবূল করেছেন, নিশ্চিতভাবে একথাটি জানা আমার কাছে সমগ্র দুন্ইয়া এবং তাতে যা কিছু আছে এসব থেকে অধিকতর পছন্দনীয়। (সূরা আল মাইয়েদাহ এর ২৭নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু কাছীর রহ এই আছারটি বর্ণনা করেছেন)
হাছান বাসারী র বলেছেন:-
إِنَّ الْمُؤْمِنَ جَمَعَ إِحْسَانًا وَشَفَقَةً ، وَإِنَّ الْمُنَافِقَ جَمَعَ إِسَاءَةً وَأَمْنًا
অর্থ- মূমিনের মধ্যে দু’টি বিষয় একসাথে থাকে। সে ভালো কাজ করে এবং ভয়ে থাকে (এই ভয়ে যে, আল্লাহ তার এই ‘আমাল ক্বাবূল করলেন কি-না)। আর মুনাফিক্বের মধ্যেও দু‘টি বিষয় একসাথে থাকে – সে মন্দ কাজ করে এবং নিশ্চিন্ত থাকে (আল্লাহ্র ‘আযাবের ভয় তার মধ্যে থাকে না)। সূরা আল মূমিনূনের ৫৭—৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফছীরু ইবনি কাছীর ও তাফছীরুত ত্বাবারী— ১৭/৬৮ আশ্শাইখ ‘আব্দুর্ রায্যাক্ব ইবনু ‘আব্দিল মুহ্ছিন আল ‘আব্বাদ আল বাদ্র حَفِظَهُ اللهُ) আলোচনা
রাহে বেলায়েত( ড আব্দুল্লাহ জাহাংগীর রহ বই থেকে)
কুরআন-সুন্নাহের আলোকে আমরা দেখি যে, বেলায়াতের পথের কর্মগুলির পর্যায়, তথা মুমিন জীবনের সকল কর্মের গুরুত্ব ও পর্যায়গুলি নিম্নরূপ
প্রথমত, ঈমান : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবকিছুর মূল বিশুদ্ধ ঈমান। ঈমানের ক্ষেত্রে ত্রুটিসহ পরবর্তী সকল নেক কর্ম ও ধার্মিকতা পন্ডশ্রম ও বাতুলতা মাত্র।
দ্বিতীয়ত, বৈধ উপার্জন : ঈমানের পরে সর্বপ্রথম দায়িত্ব বৈধভাবে উপার্জিত জীবিকার উপর নির্ভর করা। সুদ, ঘুষ, ফাঁকি, ধোঁকা, জুলুম ইত্যাদি সকল প্রকার উপার্জন অবৈধ। অবৈধ উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির্বাহকারীর ইবাদত আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় নয়।
তৃতীয়ত, বান্দার হক সংশ্লিষ্ট হারাম বর্জন : কর্মের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ও সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফরয কর্ম। ফরয কর্ম দুই প্রকার: প্রথম প্রকার যা করা ফরয ও দ্বিতীয় প্রকার যা বর্জন করা ফরয, যা “হারাম” নামে অভিহিত। হারাম দুই প্রকার: এক প্রকার পৃথিবীর অন্যান্য মানুষ ও সৃষ্টির অধিকার বা পাওনা নষ্ট বা তাদের কোনো ক্ষতি করা বিষয়ক হারাম। এগুলি বর্জন করা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ।
চতুর্থত, আল্লাহর অন্যান্য আদেশ নিষেধ বিষয়ক হারাম বর্জন।
পঞ্চমত, ফরয কর্মগুলি পালন।
ষষ্ঠত, মাকরূহ তাহরীমি বর্জন ও সুন্নাতে মু‘আক্কাদা কর্ম পালন।
সপ্তমত, মানুষ ও সৃষ্টির সেবা ও কল্যাণমূলক সুন্নাত-নফল ইবাদত পালন।
অষ্টমত, ব্যক্তিগত সুন্নাত-নফল ইবাদত পালন।
উপরের সাতটি পর্যায়ের কর্ম যদি আমাদের জীবনে না থাকে তাহলে এই অষ্টম পর্যায়ের কর্ম অর্থহীন হতে পারে বা ভন্ডামীতে পরিণত হতে পারে। আমরা অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে লক্ষ্য করি যে, আমাদের সমাজের ধার্মিক মানুষেরা প্রায়শ এই অষ্টম পর্যায়ের কাজগুলিকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দেন, অথচ পূর্ববর্তী বিষয়গুলির প্রকৃত গুরুত্ব আলোচনা বা অনুধাবনে ব্যর্থ হন। মহান রাব্বুল ‘আলামীন ও তাঁর প্রিয়তম রাসূল (সা.) যে কর্মের যতটুকু গুরুত্ব প্রদান করেছেন তাকে তার চেয়ে কম গুরুত্ব প্রদান করা যেমন কঠিন অপরাধ ও তাঁদের শিক্ষার বিরোধিতা, বেশি গুরুত্ব প্রদানও একই প্রকার অপরাধ।
আলহামদু লিল্লাহ।.
এক: ওয়াজিব: যা পালন করার জন্য শরিয়তপ্রণেতা আবশ্যকীয়ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।
এর উদাহরণ হচ্ছে- পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রমযানের রোযা, যাকাত দেয়ার সামর্থ্যবান হলে যাকাত, হজ্জ করার সামর্থ্য থাকলে হজ্জ।
‘ওয়াজিব’-কে فرض (ফরয), فريضة (আবশ্যকীয়), حتم (অপরিহার্য), لازم (অনিবার্য) ইত্যাদিও বলা হয়। এ ধরণের আমল সম্পাদনকারী সওয়াব পাবেন এবং না করলে শাস্তি পাবে
দুই: মানদুব: যা পালন করার জন্য শরিয়তপ্রণেতা নির্দেশ দিয়েছেন; তবে আবশ্যকীয়ভাবে বা অপরিহার্যরূপে নয়।
এর উদাহরণ হচ্ছে- কিয়ামুল লাইল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথের সুন্নত নামাযগুলো ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের অতিরিক্ত নামাযগুলো, প্রতি মাসে তিনদিন রোযা রাখা, শাওয়াল মাসে ছয় রোযা রাখা, গরীবদেরকে দান-সদকা করা এবং নিয়মিত যিকির-আযকার ও ওযিফাগুলো পড়া।
‘মানদুব’-কে মুস্তাহাব, সুন্নত, মাসনূন, নফল ইত্যাদিও বলা হয়। এ ধরণের আমল পালনকারী সওয়াব পাবেন; তবে বর্জনকারী শাস্তি পাবে না।
তিন: হারাম বা নিষিদ্ধ: যাতে লিপ্ত হওয়া থেকে শরিয়তপ্রণেতা আবশ্যকীয়ভাবে নিষেধ করেছেন। যেমন- ব্যভিচার, মদপান, পিতামাতার অবাধ্যতা, দাঁড়ি না রাখা, নারীদের বেপর্দা চলাফেরা করা।
হারাম কাজ বর্জনকারী সওয়াব পাবেন, আর হারামে লিপ্ত ব্যক্তি শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত হবে।
চার: মাকরুহ: যাতে লিপ্ত হওয়া থেকে শরিয়তপ্রণেতা নিষেধ করেছেন; তবে আবশ্যকীয়ভাবে নয়। যেমন- কোন কিছু বাম হাতে গ্রহণ করা ও বাম হাতে প্রদান করা। নারীদের জন্য মৃতব্যক্তির জানাযার সাথে যাওয়া। এশার নামাযের পর আলাপ-আলোচনা করা, কাঁধ খালি রেখে এক কাপড়ে নামায আদায় করা, ফজরের নামাযের পর সূর্যোদয়ের আগে নফল নামায পড়া এবং আছরের নামাযের পর সূর্যাস্তের আগে নফল নামায পড়া।
মাকরুহ আমল বর্জনকারী সওয়াব পাবেন; কিন্তু মাকরুহ আমলে লিপ্ত হলে শাস্তি দেওয়া হবে না।
পাঁচ: মুবাহ বা হালাল বা জায়েয: যে আমলের সাথে সত্তাগতভাবে কোন আদেশ বা নিষেধ সম্পৃক্ত নয়।
যেমন- পানাহার করা, বেচাকেনা করা, পর্যটনমূলক বা জীবিকার সন্ধানে ভ্রমণ, রযমানের রাতেরবেলা স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা।
মুবাহ –এর সংজ্ঞাতে ‘সত্তাগতভাবে’ কথাটি এ জন্য বলা হয়েছে যেহেতু হতে পারে এর সাথে তৃতীয় কোন একটি বিষয় সম্পৃক্ত হয়ে সেটাকে নির্দেশিত কিংবা নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত করবে।
উদাহরণত: ‘পানি খরিদ করা’ মূলত একটি মুবাহ কাজ। কিন্তু, যদি পানি খরিদ করার উপর ফরয নামাযের জন্য ওযু করা আটকে থাকে সেক্ষেত্রে পানি খরিদ করা ওয়াজিব। কেননা যে মাধ্যম ছাড়া কোন ওয়াজিব কর্ম সম্পাদিত হয় না সে মাধ্যমও ওয়াজিব।
আরেকটি উদাহরণ- পর্যটনমূলক ভ্রমণ মূলত একটি মুবাহ কাজ। কিন্তু, এ ভ্রমণ যদি হয় বিধর্মী কোন দেশে যেখানে ফিতনা, পাপাচার ও ব্যভিচার ইত্যাদির সয়লাব; এমন ভ্রমণ হারাম। কেননা এ ভ্রমণ হারাম কর্মে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যম।
এ বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন: ইবনে কুদামার লিখিত ‘রওযাতুন নাযের ওয়া জুন্নাতুল মুনাযির’ (১/১৫০-২১০), যারকাশির লিখিত ‘আল-বাহরুল মুহিত’ (১/১৪০-২৪০) এবং ইবনে উছাইমীনের ‘শারহুল উসুল মিন ইলমিল উসুল’ (৪৬-৬৮)। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ। সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব
সুন্নত ও নফল নামাজের মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর : নফল হচ্ছে অতিরিক্ত ইবাদত, যেগুলো ফরজ নয়। এটি এমন ইবাদত, যে ইবাদত অতিরিক্ত হিসেবে ধরা হয়েছে। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। যেমন—আপনি অতিরিক্ত একটি সিয়াম পালন করলেন। আর সুন্নত হলো, যেটির জন্য রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে নির্দেশনা পাওয়া গেছে। এটি অতিরিক্ত ইবাদতের অন্য একটি ধরন। রাসুল (সা.) এই অতিরিক্ত কাজটি করেছেন এবং করার নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন—আরাফার দিন আপনি একটি সিয়াম পালন করবেন। এর জন্য রাসুল (সা.) নির্দেশনা দিয়েছেন। দুটিই অতিরিক্ত। একটির জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, আরেকটির জন্য দেওয়া হয়নি। নফল ও সুন্নতের মধ্যে পার্থক্য এতটুকুই।
(১) আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহর অলীদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তাদের প্রশংসা ও পরিচয় বর্ণনার সাথে সাথে তাদের প্রতি আখেরাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- যারা আল্লাহর অলী তাদের না থাকবে কোন অপছন্দনীয় বিষয়ের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা, আর না থাকবে কোন উদ্দেশ্যে ব্যর্থতার গ্লানি। এদের জন্য পার্থিব জীবনেও সংবাদ রয়েছে এবং আখেরাতেও। দুনিয়াতেও তারা দুঃখ-ভয় থেকে মুক্ত। আর আখেরাতে তাদের মনে কোন চিন্তা-ভাবনা না থাকার অর্থ জান্নাতে যাওয়া। এতে সমস্ত জান্নাতবাসীই অন্তর্ভুক্ত।
আয়াতে উল্লেখিত ‘আওলিয়া’ শব্দটি অলী শব্দের বহুবচন। আরবী ভাষায় অলী অর্থ নিকটবর্তীও হয় এবং দোস্ত-বন্ধুও হয়। শরীআতের পরিভাষায় অলী বলতে বুঝায়ঃ যার মধ্যে দুটি গুণ আছেঃ ঈমান এবং তাকওয়া। মহান আল্লাহ বলেন, “জেনে রাখ! আল্লাহর অলী তথা বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবেনা, যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।” [সূরা ইউনুসঃ ৬২–৬৩]
যদি আল্লাহর অলী বলতে ঈমানদার ও মুত্তাকীদের বুঝায় তাহলে বান্দার ঈমান ও তাকওয়া অনুসারে আল্লাহর কাছে তার বেলায়াত তথা বন্ধুত্ব নির্ধারিত হবে। সুতরাং যার ঈমান ও তাকওয়া সবচেয়ে বেশী পূর্ণ, তার বেলায়াত তথা আল্লাহর বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশী হবে। ফলে মানুষের মধ্যে তাদের ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে আল্লাহর বেলায়াতের মধ্যেও তারতম্য হবে।
আল্লাহর অলীদের সম্পর্কে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ
১. আল্লাহর নবীরা তার সর্বশ্রেষ্ঠ অলী হিসাবে স্বীকৃত। নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন তার রাসূলগণ। রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেনঃ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ তথা নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর সমস্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেনঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
মহান আল্লাহ বলেন,
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ
‘হে নবী! তুমি রাসূলগণের মধ্যে থেকে যারা উলুল আযম বা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সাহসী রাসূল তাদের মত ধৈর্যধারণ কর’ (আহকাফ ৩৫/৩৫)।
মহান আল্লাহ বলেন,
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ وَآتَيْنَا عِيْسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوْحِ الْقُدُسِ-
‘এই যে রাসূলগণ, এদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। এদের মধ্যে এমনও আছে যাদের সাথে মহান আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাদের কাউকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। ঈসা ইবনু মারিয়ামকে স্পষ্ট প্রমাণ দান করেছি এবং তাকে রুহুল কুদুস (জিব্রীল) দ্বারা সহযোগিতা করেছি’ (বাক্বারাহ ২/২৫৩)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে শুরু করে সকল মুফাসসিরে কুরআন এই বিষয়ে একমত যে, এই উলুল আযম রাসূল হচ্ছেন ৫ জন- মুহাম্মাদ (ছাঃ), ইবরাহীম, নূহ, মূসা ও ঈসা (আঃ)। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
خِيَارُ وَلَدِ آدَمَ خَمْسَةٌ نُوْحٌ وإبْراهِيْمُ ومُوْسَى وَعِيْسَى ومُحَمَّدٌ وَخَيْرُهُمْ مُحَمَّد
‘আদম (আঃ)-এর শ্রেষ্ঠ সন্তান হচ্ছেন পাঁচ জন, নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা, ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)। আর তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন মুহাম্মাদ (ছাঃ)।মুসনাদে বাযযার, সিলসিলাতুল আছার আছ-ছাহীহাহ হা/৪৬৪, সনদ হাসান, মাজমাঊয যাওয়ায়েদ হা/১৩৯২৯, যঈফুল জামে‘ হা/২৮৭৬ ।
২. এখানে এটা জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর অলীগণ দুশ্রেণীতে বিভক্তঃ
প্রথম শ্রেণীঃ যারা অগ্রবর্তী ও নৈকট্যপ্রাপ্ত।
দ্বিতীয় শ্রেণীঃ যারা ডান ও মধ্যম পন্থী।
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাদের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ “যখন যা ঘটা অবশ্যম্ভাবী (কিয়ামত) তা ঘটবে, তখন তার সংঘটনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কেউ থাকবে না। তা কাউকে নীচ করবে, কাউকে সমুন্নত করবে। যখন প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে যমীন। পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়বে। ফলে তা উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পর্যবসিত হবে। এবং তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়বে তিন শ্রেনীতে- ডান দিকের দল; ডান দিকের দলের কি মর্যাদা! আর বাম দিকের দল; বাম দিকের দলের কি অসম্মান। আর অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী। তারাই নৈকট্যপ্রাপ্ত- নেয়ামত পূর্ণ জান্নাতে। [সূরা আল-ওয়াকি’আহঃ ১–১২]
এখানে তিন শ্রেণীর লোকের উল্লেখ করা হয়েছেঃ যাদের একদল জাহান্নামের, তাদেরকে বামদিকের দল বলা হয়েছে।
আর বাকী দু’দল জান্নাতের, তারা হলেনঃ ডানদিকের দল এবং অগ্রবর্তী ও নৈকট্যপ্রাপ্তগণ। তাদেরকে আবার এ সূরা আল ওয়াকি’আরই শেষে আল্লাহ তা’আলা উল্লেখ করে বলেছেন, “তারপর যদি সে নৈকট্যপ্রাপ্তদের একজন হয় তবে তার জন্য রয়েছে আরাম, উত্তম জীবনোপকরণ ও নেয়ামত পূর্ণ জান্নাত। আর যদি সে ডান দিকের একজন হয় তবে তোমার জন্য সালাম ও শান্তি; কারণ সে ডানপন্থীদের মধ্যে”। [সূরা আল-ওয়াকি’আহঃ ৮৮–৯১]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও অলীদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত হাদীসে বলেনঃ “মহান আল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি আমার কোন অলীর সাথে শক্রতা পোষণ করে আমি তার সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। আমার বান্দার উপর যা আমি ফরয করেছি তা ছাড়া আমার কাছে অন্য কোন প্রিয় বস্তু নেই যার মাধ্যমে সে আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে। আমার বান্দা আমার কাছে নফল কাজসমূহ দ্বারা নৈকট্য অর্জন করতেই থাকে, শেষ পর্যন্ত আমি তাকে ভালবাসি। তারপর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণশক্তি হয়ে যাই যার দ্বারা সে শুনে, তার দৃষ্টি শক্তি হয়ে যাই যার দ্বারা সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই যার দ্বারা সে ধারণ করে আর তার পা হয়ে যাই যার দ্বারা সে চলে। তখন আমার কাছে কিছু চাইলে আমি তাকে তা অবশ্যই দেব, আমার কাছে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে অবশ্যই উদ্ধার করব।” [বুখারী: ৬৫০২]
এর মর্ম হলো এই যে, তার কোন গতি-স্থিতি ও অন্য যে কোন কাজ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয় না। বস্তুতঃ এই বিশেষ ওলীত্ব বা নৈকট্যের স্তর অগণিত ও অশেষ। এর সর্বোচ্চ স্তর নবী-রাসূলগণের প্রাপ্য। কারণ, প্রত্যেক নবীরই ওলী হওয়া অপরিহার্য। আর এর সর্বোচ্চ স্তর হলো সাইয়্যেদুল আম্বীয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর। এর পর প্রত্যেক ঈমানদার তার ঈমানের শক্তি ও স্তরের বৃদ্ধি-ঘাটতি অনুসারে বেলায়েতের অধিকারী হবে। সুতরাং নেককার লোকেরা হলোঃ ডান দিকের দল, যারা আল্লাহর কাছে ফরয আদায়ের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করে। তারা আল্লাহ তাদের উপর যা ফরয করেছেন তা আদায় করে, আর যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ করে। তারা নফল কাজে রত হয় না। কিন্তু যারা অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল তারা আল্লাহর কাছে ফরয আদায়ের পর নফলের মাধ্যমে নৈকট্য লাভে রত হয়।
৩. এখানে আরও একটি বিষয় জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর অলীগণ অন্যান্য মানুষদের থেকে প্রকাশ্যে কোন পোষাক বা বেশ-ভূষা দ্বারা বিশেষভাবে পরিচিত হন না। বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাতের মধ্যে প্রকাশ্য বিদ’আতকারী ও অন্যায়কারী ছাড়া সর্বস্তরে আল্লাহর অলীগণের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাদের অস্তিত্ব রয়েছে কুরআনের ধারক-বাহকদের মাঝে, জ্ঞানী-আলেমদের মাঝে, জিহাদকারী ও তরবারী-ধারকদের মাঝে, ব্যবসায়ী, কারিগর ও কৃষকের মাঝে।
৪. আল্লাহর অলীগণের মধ্যে নবী-রাসূলগণ ছাড়া আর কেউ নিষ্পাপ নন, তাছাড়া কোন অলীই গায়েব জানেনা, সৃষ্টি বা রিযক প্রদানে তাদের কোন প্রভাবও নেই। তারা নিজেদেরকে সম্মান করতে অথবা কোন ধন-সম্পদ তাদের উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে মানুষদেরকে আহবান করেন না। যদি কেউ এমন কিছু করে তাহলে সে আল্লাহর অলী হতে পারে না, বরং মিথ্যাবাদী, অপবাদ আরোপকারী, শয়তানের আলী হিসাবে বিবেচিত হবে।
৫. আল্লাহর অলী হওয়ার জন্য একটিই উপায় রয়েছে, আর তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রঙে রঞ্জিত হওয়া, তার সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ করা। যারা এ ধরনের অনুসরণ করতে পেরেছেন তাদের মর্যাদাই আলাদা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহর এমন কিছু বান্দা রয়েছে যাদেরকে শহীদরাও ঈর্ষা করবে। বলা হলোঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? হয়ত তাদের আমরা ভালবাসবো। রাসূল বললেনঃ “তারা কোন সম্পদ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ব্যতীতই একে অপরকে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবেসেছে। নূরের মিম্বরের উপর তাদের চেহারা হবে নূরের। মানুষ যখন ভীত হয় তখন তারা ভীত হয় না। মানুষ যখন পেরেশান ও অস্থির হয় তখন তারা অস্থির হয় না।” তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন। [ইবনে হিব্বানঃ ৫৭৩, আবু দাউদঃ ৩৫২৭]
অন্য বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ আসবে এবং বিভিন্ন গোত্র থেকে মানুষ এসে জড়ো হবে, যাদের মাঝে কোন আতীয়তার সম্পর্ক থাকবে না। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একে অপরকে ভালবেসেছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে স্থাপন করবেন, তারপর তাদেরকে সেগুলোতে বসাবেন। তাদের বৈশিষ্ট হলো মানুষ যখন ভীত হয় তখন তারা ভীত হয় না, মানুষ যখন পেরেশান হয় তখন তারা পেরেশান হয় না। তারা আল্লাহর অলী, তাদের কোন ভয় ও পেরেশানী কিছুই থাকবে না। [মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৪৩]। [উসুলুল ঈমান ফী দাওয়িল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং প্রেস থেকে মুদ্রিত, পৃ. ২৮২–২৮৬ (বাংলা সংস্করণ)]
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ঐক্যমতে অলীদের কারামত সত্য। কুরআনুল কারীম ও সহীহ সুন্নাত দ্বারা ইহা প্রমাণিত। বিদআতী, মু‘তাযিলা, জাহমীয়া এবং তাদের অনুসারীরাই কেবল অলীদের কারামত অস্বীকার করে। সুতরাং তারা কুরআন ও সহীহ সুন্নাত দ্বারা একটি সাব্যস্ত বিষয়কেই অস্বীকার করেছে।
কুরআনুল কারীমে আসহাবে কাহাফের ঘটনা, মারইয়াম আলাইহিস সালামের ঘটনাসহ আরো কিছু কারামতের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। সহীহ সুন্নাত দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, উসাইদ ইবনে হুযায়েরের কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করার জন্য অসংখ্য প্রদীপ আকারে মেঘ সদৃশ বস্তুর মধ্যে ফেরেশতা নামার কথা সাব্যস্ত হয়েছে এবং ইমরান ইবনে হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ফেরেশতাগণ সালাম দিয়েছেন। এ রকম উদাহরণ আরো অনেক রয়েছে।
অলীদের কারামত সম্পর্কে যে আরো বেশি জানতে চায়, সে যেন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর الفرقان بين أولياء الرحمن وأولياء الشيطان ‘‘আল্লাহর অলী ও শয়তানের অলীর মধ্যে পার্থক্য’’ নামক বইটি অধ্যায়ন করে। অলীদের কারামত বিষয়ে মানুষের মাঝে অনেক অস্পষ্ট ধারণা এবং বিরাট বিভ্রান্তি রয়েছে।
আরেক দল লোক কারামত সাব্যস্ত করতে গিয়ে চরম বাড়াবাড়ি করেছে। অজ্ঞ, মূর্খ এবং গোমরাহ আলেমরাই এ শ্রেণীর লোকের অন্তর্ভুক্ত। তারা ফাসেক, পাপিষ্ঠ এবং এমন লোকদের জন্য কারামত সাব্যস্ত করেছে, যারা আল্লাহর অলী নয়; বরং শয়তানের অলী। মিথ্যা বর্ণনা, স্বপ্ন এবং শয়তানী অবস্থার উপর নির্ভর করেই তারা তাদের জন্য কারামত সাব্যস্ত করেছে। শুধু তাই নয়; তারা যাদুকর, ভেলকিবাজ এবং সুফী তরীকার মিথ্যুক শাইখদের জন্যও কারামত সাব্যস্ত করেছে।
কারামতের ব্যাপারে লোকেরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়েছে।
এক শ্রেণীর লোক কারামত অস্বীকার করতে গিয়ে সীমালংঘন করেছে এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত মুত্তাকী অলীদের জন্য কুরআনুল কারীম ও সহীহ সুন্নাত দ্বারা সুসাব্যস্ত কারামতগুলোকে অস্বীকার করেছে।
আরেক শ্রেণীর লোক কারামত সাব্যস্ত করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে এবং যাদু, ভেলকিবাজি এবং মিথ্যাচারকে কারামতের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এগুলোকে তারা শিরকের মাধ্যম বানিয়েছে এবং এগুলোর জীবিত ও মৃত উদ্ভাবনকারীদের ব্যাপারে নিকৃষ্ট আকীদা পোষণ করেছে। এ থেকে শুরু হয়েছে বড় শিরক, কবর পূজা, ব্যক্তি বিশেষের প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনায় বাড়াবাড়ি। কেননা লোকেরা তাদের থেকে কারামত ও অলৌকিক ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার ধারণা করেছে।
আর তৃতীয় শ্রেণী হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। তারা কারামত সাব্যস্ত করার ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছে। তারা এ বিষয়ে কড়াকড়ি অবলম্বন করেনি এবং শৈথিল্য প্রদর্শন করেনি। তারা কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা সাব্যস্ত কারামতগুলোতে বিশ্বাস করেছে এবং যাদের হাতে এগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তাদের প্রশংসায় তারা বাড়াবাড়ি করেনি ও আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে এদের উপর নির্ভরও করেনি।
একটি বিশেষ দিক আলোচনা—
৩৯:৩ اَلَا لِلّٰهِ الدِّیۡنُ الۡخَالِصُ ؕ وَ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِهٖۤ اَوۡلِیَآءَ ۘ مَا نَعۡبُدُهُمۡ اِلَّا لِیُقَرِّبُوۡنَاۤ اِلَی اللّٰهِ زُلۡفٰی ؕ اِنَّ اللّٰهَ یَحۡکُمُ بَیۡنَهُمۡ فِیۡ مَا هُمۡ فِیۡهِ یَخۡتَلِفُوۡنَ ۬ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِیۡ مَنۡ هُوَ کٰذِبٌ کَفَّارٌ
জেনে রাখুন, অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্ৰহণ করে তারা বলে, আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে সে ব্যাপারে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না। সূরা যুমারঃ৩
মানুষের জীবনের ইহলৌকিক সমস্যা ও তা সমাধানের মাধ্যম:
মানুষের জীবনের সমস্যাদি মোট দু’ভাগে বিভক্ত :
এক, জীবন ও জীবিকার সমস্যা। দুই, পরকালীন সমস্যা। প্রতিটি মানুষই পৃথিবীতে ভাল জীবন ও জীবিকা পেতে চায় এবং প্রতিটি মু’মিন মাত্রই আখেরাতে শান্তিময় জীবন লাভ করতে চায়। পৃথিবীতে ভাল জীবন ও জীবিকা লাভের বিষয়টি মানুষের ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত। ভাগ্য নির্ধারণ সম্পর্কে আমরা এ বই এর প্রথম অধ্যায়ে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তাই এখানে এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু না বলে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আল্লাহর ইনসাফ ও বিচারে যে মানুষকে যে জীবন ও জীবিকা প্রদান করা উচিত ও তার জন্য মঙ্গলজনক বলে তিনি মনে করেছেন, তাকে তিনি সে জীবন ও জীবিকা প্রদানের পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করে রেখেছেন। প্রতিটি মানুষের ভাগ্যে কী জীবন ও জীবিকা রয়েছে তা খতিয়ে দেখার মাধ্যম সে নিজেই।
সুস্থ জীবন ও উত্তম জীবিকা লাভ করার জন্য তাকে শরী‘আতসম্মত বৈধ উপায় ও পন্থায় প্রয়োজনীয় কর্ম করতে হবে। যে সকল কর্ম করার ক্ষেত্রে জীবিত মানুষেরা একে অন্যের স্বাভাবিকভাবে কর্ম বা দো‘আ করার মাধ্যমে সাহায্য করতে পারে, সে সকল ক্ষেত্রে অন্যের কর্ম বা দো‘আর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে নিজে ও প্রয়োজনে অন্য জীবিত মানুষের সাহায্য নিয়ে কর্ম করে কর্মের ফল প্রাপ্তির জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছেই তাঁর দয়া কামনা করতে হবে। ধৈর্যের সাথে যাবতীয় সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। ভাগ্য পরিবর্তনে বিলম্ব হচ্ছে দেখে কোনো অবস্থাতেই ধৈর্যহারা হয়ে কোনো বিকল্প পথে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো পীর, ফকীর ও ওলির কবরে এ জন্য কোনো আবেদন-নিবেদন করা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে, ভাগ্যে সুস্থ জীবন, সন্তান ও উত্তম জীবিকা লেখা থাকলে বৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে তা আজ হোক কাল হোক, পাওয়া যাবেই। কেউ হাজার ষড়যন্ত্র করেও তা ঠেকাতে পারবে না। আর ভাগ্যে তা লেখা না থাকলে সারা দুনিয়ার জীবিত ও মৃত মানুষেরা সাহায্য ও দো‘আ করলেও তা পাইয়ে দিতে পারবে না। বৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তিত হলে তা যেমন আল্লাহরই দান হয়ে থাকবে, তেমনি অবৈধ পন্থা অবলম্বনের পর তা পরিবর্তিত হলে তাও আল্লাহরই দ্বারা হয়ে থাকবে। দুয়ের মাঝে পার্থক্য এটুকু যে, যারা বৈধ পন্থা অবলম্বন করে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে, তারাই হবে প্রকৃত মু’মিন ও আল্লাহর প্রিয়ভাজন বান্দা। আর যারা অধৈর্য হয়ে কবর ও কবরে যেয়ে রোগ মুক্তি, সন্তান দান ও উত্তম জীবিকা ইত্যাদি চাইবে, তারা হবে মুশরিক ও আল্লাহর বিরাগভাজন।
পরকালীন সমস্যা সমাধানের মাধ্যম:
এ ক্ষেত্রে শরী‘আতের একক শিক্ষা হলো : ঈমান ও সৎ ‘আমলই হচ্ছে মানুষের পরকালীন সমস্যা সমাধানের একক মাধ্যম বা ওসীলা। এ দু’টি গুণ ব্যতীত যারা অন্য কোনো উপায়ে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায় বলে মনে করে, তারা মূলত কল্পনার জগতেই বসবাস করে। মুহাজির, আনসার ও তাঁদের অনুসারী পরবর্তী মনীষীগণ এ বিষয়টি অনুধাবন করেই ঈমান ও ‘আমলে সালেহ এর ক্ষেত্রে অধিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। যার ফলেই সাহাবীদের মধ্যকার দশজন ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দুনিয়াতে থাকতেই জান্নাতের আগাম সনদ লাভ করেছিলেন। বাকিরা সনদ লাভ না করলেও তা লাভ করার যোগ্য হয়েছিলেন। এক কথায় আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য কুরআনুল কারীমে বর্ণিত
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱبۡتَغُوٓاْ إِلَيۡهِ ٱلۡوَسِيلَةَ﴾ [المائدة: ٣٥]
‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর’’।সূরাহ মা-ইদাহ : ৩৫।
এ আয়াতে ওসীলা অন্বেষণের যে নির্দেশ রয়েছে, এর দ্বারা তাঁরা ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করার প্রতি নির্দেশ করার কথাই বুঝেছিলেন।
জ্ঞানী ও সৎ মানুষদের সাহচর্য গ্রহণ :ঈমান কী এবং কিভাবে ‘আমলে সালেহ করতে হয়, তা তাঁদের কারো জানা না থাকলে সে জন্য তাঁরা জ্ঞানী ও সৎ জনের সাহচর্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের শিক্ষার অনুসরণ ও অনুকরণ করে সে অনুযায়ী ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করাকেই তাঁরা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একক ওসীলা হিসেবে গণ্য করেছিলেন। ঈমান ও ‘আমলে সালেহ না করে কেবলমাত্র সৎ মানুষদের সাহচর্য গ্রহণ করা বা তাঁদের হাতে বায়‘আত করাকেই তাঁরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মূল উপায় হিসেবে নির্ধারণ করেন নি। যদিও এ ধরনের বাই‘আত গ্রহণ জঘন্য বিদ‘আত। এর অধিকার তাদের নেই। এ অধিকার শাসকদের জন্য নির্ধারিত। সংগৃহিত অংশ
প্রশ্ন: আল্লাহর ওলি কারা?
আল্লাহর ওলিগণ কি কবরে জীবিত?
উত্তর:
নিম্নে উক্ত দুটি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হল:
◈ ক. আল্লাহর ওলি কারা?
আল্লাহর ওলি অর্থ, আল্লাহর প্রিয়পাত্র বা বন্ধু।
আর তারাই আল্লাহর প্রিয়পাত্র বা বন্ধু, যারা সত্যিকার ভাবে আল্লাহকে ভয় করে জীবন পরিচালনা করে, সৎ আমল করে, তাঁর আদেশগুলো বাস্তবায়ন করে, নিষেধ কৃত বিষয়গুলো থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদিসকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّـهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ- الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ – لَهُمُ الْبُشْرَىٰ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ ۚ-لَا تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللَّـهِ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“মনে রেখো, আল্লাহর ওলি বা বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দু:শ্চিন্তাগ্রস্থ হবে না। (তারা হল ঐ সকল লোক ) যারা ঈমান এনেছে এবং (আল্লাহকে) ভয় করে। তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হেরফের হয় না। এটাই হল মহা সফলতা।” (সূরা ইউনুস: ৬২, ৬৩ ও ৬৪)
তিনি আরও বলেন:
إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلَّا الْمُتَّقُونَ
“তাঁর ওলি বা বন্ধু কেউ নয় একমাত্র মুত্তাকী-পরহেজগার ব্যক্তিগণ ছাড়া।” (সূরা আনফাল: ৩৪)
ইমাম ইবনে কাসির রহঃ উল্লেখিত প্রথম দুটি আয়াতের তাফসিরে বলেন:
“এখানে আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, ঐ সকল লোক তাঁর ওলি (বন্ধু) যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) অবলম্বন করে-যেমনটি আল্লাহ নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং যেই তাকওয়াবান হবে সেই আল্লাহর ওলি হবে। কিয়ামতের আসন্ন বিপর্যয় ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে তাদের কোন ভয় ও আশঙ্কা নেই এবং দুনিয়ার ফেলে আসা কোন বিষয়ে তাদের দু:শ্চিন্তার কোনও কারণ নাই।” (তাফসিরুল কুরআনিল আযীম, সূরা সূরা ইউনুস এর ৬৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা)
মোটকথা: উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বেলায়াত বা বন্ধুত্ব পাওয়ার দুটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। যথা:
- ১. ঈমান আনয়ন করা।
- ২. তাকওয়া অবলম্বন করা অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে তাঁর আদেশগুলো মেনে চলা এবং নিষিদ্ধ ও হারাম কর্ম থেকে দূরে থাকা।
সুতরাং এ দুটি শর্ত যার মধ্যে যত বেশি পরিমাণে থাকবে অর্থাৎ যার মধ্যে ঈমানি দৃঢ়তা, তেজস্বিকতা ও প্রখরতা যত বেশি থাকবে এবং তাকওয়া-পরহেজাগরিতা ও আল্লাহর অনুগত্য যত নিখাদ ও গভীর হবে সে তত আল্লাহর বেলায়াত তথা বন্ধুত্ব ও ভালবাসা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
এ সকল গুণাবলী অর্জন করার চেষ্টা করা প্রত্যেক ইমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। এটি সকল যুগে সকল স্থানে সর্বশ্রেণীর মুমিন ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য।
কিন্তু সাধারণ মুসলিমদের মাঝে একটা ভুল ধারণা খুব প্রবল যে, আল্লাহর ওলি বলতে বুঝায় বিশেষ একশ্রেণীর মানুষকে, যারা বিভিন্ন কেরামতি বা অলৌকিক ক্ষমতা দেখাতে পারে, যাদের বিশাল খানকা, জাঁকজমকপূর্ণ দরবার এবং অনেক ভক্ত ও মুরিদান আছে। এগুলো কখনো ওলি হওয়ার আলামত নয়। কেননা অনেক সময় যাদু বিদ্যা এবং জিন ও শয়তানের সাহায্যে অদ্ভুত ও মতিভ্রষ্ট করার মত কিছু দেখানো হয়। যেগুলো দেখে সাধারণ মানুষ তাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা-সেজদা এবং মানত ও পূজা দিতে শুরু করে। অথচ সে সব কথিত আল্লাহর ওলিরা বা নেংটা পীর ও নেকড়া বাবারা শিরক-বিদআত, নানা রকম বেশরিয়তি কাজ ও আল্লাহর নাফরমানীতে হাবুডুবু খায়।
আরেকটি মারাত্মক ভুল কাজ যে, কোন ব্যক্তিরবাহ্যিক চেহারা-সুরাত, আলখেল্লা-পাগড়ী, আর পরহেজগারিতা দেখে তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়া যে, ওমুক ব্যক্তি বা উমুক পীর/বুজুর্গ আল্লাহর ওলি। এটি মোটেও উচিৎ নয়। কারণ, কে কতটুকু ইমানদার ও তাকওয়াবান তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা জনেন। কারো
ভিতরের অবস্থা, অন্তরের তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কারো দ্বারাই সম্ভব নয়। অবশ্য যদি তার দিকে তাকালে অন্তরে আল্লাহর কথা স্বরণ হয় এবং তার বাহ্যিক আচরণ ও ইবাদত-বন্দেগী সুন্নাহ মোতাবেক হয় তাহলে আমরা তার ব্যাপারে অবশ্যই সৎ, দ্বীনদার এবং আল্লাহর ওলি বলে সু ধারণা পোষণ করতে পারি।
আল্লাহ আমাদেরকে তার ওলি বা বন্ধু হওয়ার যে সকল গুণাবলী অর্জন করা প্রয়োজন সেগুলো অর্জন করার তওফিক দান করুন। আমীন
◈ খ. আল্লাহর ওলিগণ কি কবরে জীবিত?
উত্তর:
কবরে জীবিত থাকার ব্যাপারে সংক্ষেপে কথা হল, প্রতিটি মানুষ কবরে জীবিত থাকে- চাই সে মুসলিম হোক অথবা কাফের হোক, নেককার হোক অথবা বদকার হোক কিন্তু সে জীবন হল, বরজখী জীবন-যা দুনিয়ার জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন যা ইলমে গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ জানেন। এ জীবনকে পার্থিব জীবনের সাথে সামঞ্জস্য দেয়া বৈধ নয়।
দলিল হল, প্রতিটি মানুষকে ফেরেশতা মণ্ডলী কবরে উঠিয়ে বসাবেন এবং তিনটি প্রশ্ন করবেন। কেউ সঠিক উত্তর দিবে আর কেউ সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হবে। অতঃপর উত্তর দানের উপর ভিত্তি করে হয় সেখানে তারা জান্নাতি সুখ এবং আল্লাহর নিয়ামত-সম্ভারে অবস্থান করবে অথবা সাপ-বিচ্ছুর দংশন, ফেরেশতাদের হাতুড়ি দ্বারা নির্মম প্রহার এবং জাহান্নামের আগুনের বিছানা ও লেলিহান আগুনের শাস্তি মধ্যে থাকবে। এ অবস্থা চলতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। (আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন) তবে আল্লাহর নবী, শহিদ ও আল্লাহর প্রিয়ভাজন ওলিগণ নি:সন্দেহে সেখানে অন্যান্য সাধারণ ইমানদারদের চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ জীবন লাভ করবে।
এ বিষয়টি বিভিন্ন সহিহ হাদিস দ্বারা সুপ্রমাণিত। আল হামদুলিল্লাহ।
সুতরাং এ কথায় কোন সন্দেহ নাই যে, কবরের মধ্যে প্রতিটি মানুষই বরজখী জীবন লাভ করবে। আল্লাহু আলাম।
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।
১০:৬৫ وَ لَا یَحۡزُنۡکَ قَوۡلُهُمۡ ۘ اِنَّ الۡعِزَّۃَ لِلّٰهِ جَمِیۡعًا ؕ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ
৬৫. আর ওদের কথা যেন তোমাকে দুঃখ না দেয়। নিশ্চয়ই যাবতীয় শক্তি-সম্মান আল্লাহরই জন্য, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা।
এখানে যারা রাসূল সা এর দাওয়াত গ্রহন করে নাই, তার উপর বিভিন্নভাবে রাসূল সা কে আঘাত দিতেও কুন্ঠা হতোনা, তাের বিষয়ে রাসূল সা কে সান্তনা দিচ্ছেন মহান আল্লাহ।
কাফেররা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত নানারূপ মানসিক কষ্ট দেয়। এ সময় আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন
,وَاصْبِرْ عَلَى مَا يَقُوْلُوْنَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيْلاً
‘তারা যেসব কথা বলে, তাতে তুমি ছবর কর এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে পরিহার করে চল’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১০)।
তিনি আরও বলেন
,إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ
‘বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৫)।
قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ
বলুন, তোমাদের আক্রোশে তোমরাই মর। (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১১৯)
৩ : ২৬ قُلِ اللّٰهُمَّ مٰلِکَ الۡمُلۡکِ تُؤۡتِی الۡمُلۡکَ مَنۡ تَشَآءُ وَ تَنۡزِعُ الۡمُلۡکَ مِمَّنۡ تَشَآءُ ۫ وَ تُعِزُّ مَنۡ تَشَآءُ وَ تُذِلُّ مَنۡ تَشَآءُ ؕ بِیَدِکَ الۡخَیۡرُ ؕ اِنَّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
বলুন, ‘হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! আপনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন; যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন আর যাকে ইচ্ছা আপনি হীন করেন। কল্যাণ আপনারই হাতে। নিশ্চয়ই আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আলে ইমরানঃ ২৬
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেছেনঃ অকল্যাণ আপনার পক্ষ থেকে নয়। [মুসলিমঃ ৭৭১] কেননা, আল্লাহ্ তা’আলা বান্দার জন্য অকল্যাণ চান না। মানুষের যাবতীয় অকল্যাণ মানুষের হাতের কামাই করা।
১০:৬৬ اَلَاۤ اِنَّ لِلّٰهِ مَنۡ فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَنۡ فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ مَا یَتَّبِعُ الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ شُرَکَآءَ ؕ اِنۡ یَّـتَّبِعُوۡنَ اِلَّا الظَّنَّ وَ اِنۡ هُمۡ اِلَّا یَخۡرُصُوۡنَ
৬৬. জেনে রাখ! নিশ্চয় যারা আসমানসমূহে আছে এবং যারা যমীনে আছে তারা আল্লাহরই। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে শরীকরূপে ডাকে, তারা কিসের অনুসরণ করে? তারা তো শুধু ধারণারই অনুসরণ করে এবং তারা শুধু মিথ্যা কথাই বলে।
আয়াতের অন্য অনুবাদ হচ্ছে, যারা আল্লাহকে ছাড়া অন্যদের ডাকে, তারা মূলত শরীকদের অনুসরণ করে না। কেননা, যাকে প্রকৃত অর্থে ডাকতে হবে, তিনি হবেন রব। আর এ সমস্ত শরীকগুলো কখনও রব হতে পারে না। তাদেরকে তারা শরীক বললেও প্রকৃত প্রস্তাবে তারা আল্লাহর শরীক নয়। আল্লাহর রবুবিয়াতে শরীক সাব্যস্ত করা অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং তারা কেবল ধারণার অনুসরণ করে থাকে। [কুরতুবী] তারা ডাকে, তারা তো তাদের ধারণা অনুসারে তাদেরই সাব্যস্ত করা শরীক। প্রকৃত অর্থে তারা শরীক নয়। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতে, এর অর্থ, তারা যাদেরকে আল্লাহ ছাড়া শরীক সাব্যস্ত করে থাকে সে সমস্ত নবী ও ফিরিশতাগণ তো আল্লাহর সাথে শরীক করেন না। সুতরাং তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক করো? [ফাতহুল কাদীর]
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন–
দেখুন, তারা নিজেদের প্রতি কিরূপ মিথ্যাচার করে এবং যে মিথ্যা তারা রটনা করত তা কিভাবে তাদের থেকে উধাও হয়ে গেল। সূরা আন’আমঃ২৪
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলা হয়েছে যে, দেখুন, তারা নিজেদের বিপক্ষে কেমন মিথ্যা বলছে; আল্লাহর বিরুদ্ধে যাদেরকে মিছেমিছি শরীক তৈরী করেছিল, আজ তারা সবাই উধাও হয়ে গেছে। নিজেদের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অর্থ এই যে, এ মিথ্যার শাস্তি তাদের উপরই পতিত হবে। মনগড়া তৈরী করার অর্থ এই যে, দুনিয়াতে তাদেরকে আল্লাহর অংশীদার করার ব্যাপারটি ছিল মিছামিছি (শরীক) ও মনগড়া। আজ বাস্তব সত্য সামনে এসে যাওয়ায় এ মিথ্যা অকেজো হয়ে গেছে। মনগড়া তৈরীর অর্থ মিথ্যা কসমও হতে পারে, যা হাশরের ময়দানে উচ্চারণ করবে। অতঃপর হস্তপদ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাক্ষ্য দ্বারা সে মিথ্যা ধরা পড়ে যাবে।
কোন কোন মুফাসসির বলেছেনঃ মনগড়া তৈরী করা বলতে মুশরিকদের ঐ সব অপব্যাখ্যাকে বুঝানো হয়েছে, যা তারা দুনিয়াতে মিথ্যা উপাস্যদের সম্পর্কে মনে করত। উদাহরণতঃ তারা বলতো
(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَىٰ)
অর্থাৎ আমরা উপাস্য মনে করে মূর্তির উপাসনা করি না, বরং উপাসনা করার কারণ এই যে, তারা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে আমাদেরকে তার নিকটবর্তী করে দেবে। হাশরে তাদের এ মনগড়া ব্যাখ্যা এমনভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হবে যে, তাদের মহাবিপদের সময় কেউ তাদের সুপারিশ করবে না।
উভয় আয়াতে এ বিষয়টি বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য যে, হাশরের ভয়াবহ ময়দানে মুশরিকদেরকে যা ইচ্ছা বলার স্বাধীনতা দানের মধ্যে সম্ভবতঃ ইঙ্গিত রয়েছে যে, মিথ্যা বলার অভ্যাস এমন খারাপ অভ্যাস যা পরিত্যাগ করা অতি কঠিন। সুতরাং যারা দুনিয়াতে মিথ্যা কসম খেত, তারা এখানেও তা থেকে বিরত থাকতে পারেনি। ফলে সমগ্র সৃষ্ট জগতের সামনে তারা লাঞ্ছিত হয়েছে। এ কারণেই কুরআন ও হাদীসে মিথ্যা বলার নিন্দা জোরালো ভাষায় করা হয়েছে। কুরআনের স্থানে স্থানে মিথ্যাবাদীদের প্রতি অভিসম্পাত বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, মিথ্যা পাপাচারের দোসর। মিথ্যা ও পাপাচার উভয়ই জাহান্নামে যাবে। [ইবনে হিব্বান: ৫৭৩৪]
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ যে কাজের দরুন মানুষ জাহান্নামে যাবে, তা কি? তিনি বললেনঃ সে কাজ হচ্ছে মিথ্যা। [মুসনাদে আহমাদ: ২/১৭৬]
অনুরূপভাবে, মে’রাজের রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে, এক ব্যক্তির চোয়াল চিরে দেয়া হচ্ছে। তার সাথে এ কার্যধারা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তিনি জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে জিজ্ঞাসা করলেনঃ ‘এ ব্যক্তি কে? জিবরীল বললেনঃ ‘এ হলো মিথ্যাবাদী’। [বুখারী ১৩৮৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫/১৪]
১০:৬৭ هُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الَّیۡلَ لِتَسۡکُنُوۡا فِیۡهِ وَ النَّهَارَ مُبۡصِرًا ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّسۡمَعُوۡنَ
৬৭. তিনিই তৈরী করেছেন তোমাদের জন্য রাত, যেন তোমরা বিশ্রাম করতে পার এবং দেখার জন্য দিন। যে সম্প্রদায় কথা শুনে নিশ্চয় তাদের জন্য এতে আছে অনেক নিদর্শন।
ঘুম শুধু মানুষের শারীরিক এবং মানসিক চাহিদাই পূরণ করে না, একই সাথে এটি প্রতিদিনের জীবন সংগ্রাম থেকে আত্মাকে একটু সময়ের জন্য হলেও বিরতি দেয়। ঘুমের মধ্যে এক অনাবিল প্রশান্তিতে ডুবে যাওয়ার এই যে চাহিদা মানুষের রয়েছে, তা খাবার এবং পানীয়ের চাহিদা থেকে কোনো অংশে কম নয়।
وَ هُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الَّیۡلَ لِبَاسًا وَّ النَّوۡمَ سُبَاتًا وَّ جَعَلَ النَّهَارَ نُشُوۡرًا
আর তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণস্বরূপ, বিশ্রামের জন্য তোমাদের দিয়েছেন নিদ্রা এবং ছড়িয়ে পড়ার জন্য করেছেন দিন। ফুরকানঃ ৪৭
রাত্রিকে ‘লেবাস’ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। লেবাস যেমন মানবদেহকে আবৃত করে, রাত্ৰিও তেমনি একটি প্রাকৃতিক আবরণ, যা সমগ্র সৃষ্টজগতের উপর ফেলে দেয়া হয়।
৭৮:৯ وَّ جَعَلۡنَا نَوۡمَکُمۡ سُبَاتًا
৭৮:১০ وَّ جَعَلۡنَا الَّیۡلَ لِبَاسًا
৭৮:১১ وَّ جَعَلۡنَا النَّهَارَ مَعَاشًا
আমি কি তোমাদের ঘুমকে একধরনের বিরতি, রাতকে একরকম আবরণ এবং জীবিকা অন্বেষণের জন্য দিন তৈরি করে দিইনি? আন-নাবা ৯-১১
سُبَاتًا শব্দটি سبت থেকে উদ্ভূত। এর আসল অর্থ ছিন্ন করা।
سُبَاتٌ এমন বস্তু যদ্দারা অন্য বস্তুকে ছিন্ন করা হয়। নিদ্রাকে আল্লাহ্ তা’আলা এমন করেছেন যে, এর ফলে সারাদিনের ক্লান্তি ও শ্রান্তি ছিন্ন তথা দূর হয়ে যায়। চিন্তা ও কল্পনা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মস্তিষ্ক শান্ত হয়। তাই سُبَاتٌ এর অর্থ করা হয় আরাম, শান্তি। আয়াতের অর্থ এই যে, আমি রাত্রিকে আবৃতকারী করেছি, অতঃপর তাতে মানুষ ও প্রাণীদের উপর নিদ্রা চাপিয়ে দিয়েছি, যা তাদের আরাম ও শান্তির উপকরণ। [দেখুন: কুরতুবী, আদওয়াউল বায়ান]
মহান আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে নিদ্রা অন্যতম নিদর্শন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمِنْ آيَاتِهِ مَنَامُكُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَابْتِغَاؤُكُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَسْمَعُون
অর্থাৎ, তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন হল, রাত্রে ও দিবাভাগে তোমাদের নিদ্রা এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ। (সূরা রূম ২৩ আয়াত)
ঘুমের এই স্বাদ ঘুমের আগে, পরে এবং ঘুমন্ত অবস্থায় অনুভূত হয়। ঘুমের মাঝেই মানুষ তার কর্মশক্তি পুনরায় নতুন ও সতেজভাবে ফিরিয়ে পায়।
ঘুম যা মৃত্যুর এক ভাই। দিনে মানুষ ঘুম থেকে উঠে নিজের কাজকর্মে লিপ্ত হয়। হাদীসে এসেছে, নবী (সাঃ) যখন ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন, তখন এই দু’আ পাঠ করতেনঃ
الحَمْدُ للهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيهِ النُّشُور।
অর্থাৎ, সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমাদেরকে মারার পর জীবিত করেছেন। আর তার কাছেই ফিরে যেতে হবে। (বুখারী, মিশকাতঃ দাওয়াত অধ্যায়)
ঘুমের প্রয়োজনীয়তা
- পৃথিবীতে যত প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র আছে, যার মধ্যে মানুষ একটি, তাদের সবার জন্য ঘুম অত্যাবশ্যকীয়। সম্প্রতি আবিষ্কার হয়েছে যে, এই ধরনের প্রাণীরা যতক্ষণ বেঁচে থাকে ততক্ষণ তাদের কোষের ক্রোমোজোমে নানা ধরনের ক্ষতি হতে থাকে। ঘুমের সময় শরীরের কোষগুলো তাদের ডিএনএর মধ্যে এই ক্ষতিগুলোকে মেরামত করে ফেলে। যতক্ষণ ঘুমাতে থাকে, ততক্ষণ শরীরের এই স্বয়ংক্রিয় মেরামত প্রক্রিয়া সচল থাকে। নিয়মিত মেরামতের ফলে কোষগুলো সুস্থ সবল থাকে। Sleep increases chromosome dynamics to enable reduction of accumulating DNA damage in single neurons. (2019, March 5). Retrieved from https://www.nature.com/articles/s41467-019-08806-w
- গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের মস্তিষ্ক জেগে থাকার সময় ক্রমাগত কাজ করতে থাকলে নানা ধরণের টক্সিন জমা হয়। ঘুমের সময় মস্তিষ্ক এই টক্সিনগুলো পরিষ্কার করার সুযোগ পায়। একারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম না হলে মস্তিষ্কে টক্সিন জমতে জমতে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে থাকে, যা থেকে হতাশা, অবসাদ, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, স্কিটজোফ্রেনিয়া সহ নানা ধরণের জটিল মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। মলমূত্র ত্যাগ করে শরীর যেভাবে ক্ষতিকারক পদার্থ পরিষ্কার করে, তেমনি ঘুমের সময় মস্তিষ্কের গ্লিমফেটিক সিস্টেম মস্তিষ্কে জমে থাকা ক্ষতিকারক পদার্থ পরিষ্কার করে ফেলে। এ কারণেই দেখা যায় যে, যারা রাতের বেলা ঠিকমতো ঘুমায় না, তাদের মানসিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর যাদের মানসিক সমস্যা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, তারা যখন রাতের বেলা ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না, তখন তাদের সমস্যা আরও প্রকট হতে থাকে। মানসিক রোগীদের একারণেই ঘুমের ওষুধ দিয়ে বেশিক্ষণ ঘুমাতে দেয়া হয়। কারণ ঘুম হচ্ছে মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেকে মেরামত করার অত্যন্ত কার্যকরী একটি ব্যবস্থা।
- যারা নিয়মিত ঠিকমতো ঘুমায় না, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে থাকে এবং তারা সহজেই নানা ধরনের অসুখের আক্রমণের শিকার হয়। কেউ যদি ঘন ঘন সর্দিকাশিতে ভোগে, তাহলে তার জন্য ঘুম ঠিকমতো না হওয়াটা দায়ী হতে পারে, কারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়ার একটা কারণ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব।
- যারা দিনে সাত ঘন্টার কম ঘুমায়, তাদের মোটা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। কারণ যারা কম ঘুমায়, তাদের খাবার খেয়ে তৃপ্ত হওয়ার বোধ কমে যায় এবং তাদের ক্ষুধার হরমোন বেশি বের হয়। একারণে তারা বেশি বেশি খায় এবং মোটা হতে থাকে।
- ঘুম হলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশেষ নেয়ামত যা কোরআন এবং আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত। এটি মানুষের খুব গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক প্রয়োজন। ঘুমের মাধ্যমে শরীরের অনেক প্রক্রিয়া রিকন্সট্র্রাকশন হয়। এর মাধ্যমে শক্তি অর্জন হয়, ব্রেন হরমোন যেমন এপিনিফেরিন, সেরিটোনিন এবং গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয়, ফলে পরদিন মানুষ কাজ করার শক্তি পায়। ঘুম নার্ভাস সিস্টেমকে উন্নত করে, শরীরের ক্ষয়পূরণ করে এবং শরীরকে শক্তিশালী করে। ঘুমের ফলে আমাদের স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়। ঘুম উদ্বিগ্নতা কমায় যে কারণে অসুস্থ এবং প্রচণ্ড ব্যথা বা কষ্ট হলে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়, যাতে করে তার কষ্ট কমে যায়
- ইমাম শাফেয়ী (রহ) চার ধরনের ঘুমের কথা বলেছেন : ১. পিঠ বিছানার সঙ্গে লাগিয়ে সোজা হয়ে ঘুমান- নবীজি এভাবে ঘুমাতেন। ২. ডান দিকে কাত হয়ে ঘুমান যা আমাদের জন্য বলা হয়েছে। ৩. বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমান-যা শাসকগণ ঘুমাতেন, কারণ তাদের রাজ্য পরিচালনা করার যোগ্যতার জন্য খুব গভীর ঘুম ঘুমাতে হতো। ৪. উপুড় হয়ে ঘুমান-যাকে শয়তানের ঘুম বলা হয়। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন যারা আসর নামাজের পর ঘুমাবে তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা নষ্ট করবে। বিজ্ঞানের সূত্র মতে আসরের নামাজের পর বিভিন্ন রশ্মি বিকিরণ হয়ে থাকে যা মানুষের হার্ট ও মনের ওপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু আমাদের অনেকেই আসরের পরে ঘুমিয়ে থাকেন যা মোটেই ঠিক নয়।
ঘুম পর্যাপ্ত না হওয়ার জন্য যা হতে পারে––
শুকনো চোখ:
এন্টেরিয়র ইস্কেমিক অপটিক নিউরোপ্যাথি (AION): AION হল চোখের একটি গুরুতর অবস্থা যা সাধারণত মধ্যবয়সী থেকে 60 বছরের বেশি বয়সী রোগীদের মধ্যে দেখা যায়। এটি ঘটতে পারে যখন লোকেরা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুমের বঞ্চনায় ভোগে। AION হল বার্ধক্যজনিত কারণে রক্তনালীগুলির একটি প্রদাহজনক রোগ। দীর্ঘমেয়াদে এই ঘটনাটি আমাদের চোখের রক্ত সরবরাহ হ্রাস করার কারণে অপটিক স্নায়ুকে প্রভাবিত করতে পারে যা স্থায়ী দৃষ্টিশক্তি হ্রাস করতে পারে।
চোখের খিঁচুনি: চোখের খিঁচুনিগুলিকে অনিচ্ছাকৃত চোখের মোচড় হিসাবে উল্লেখ করা হয় যা ঘটে যখন আপনার চোখের পাতায় হঠাৎ অনিচ্ছাকৃত পেশী সংকোচন হয়। এগুলোকে মায়োকিমিয়াও বলা হয়। যদিও, চোখের খিঁচুনি ব্যথা বা দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে না; যাইহোক, তারা খুব বিরক্তিকর হতে পারে এবং অনেক অস্বস্তি এবং মানসিক যন্ত্রণার দিকে নিয়ে যায়।
বেশী ঘুম হলেও ক্ষতিকর।
আবু হামিদ গাজালি (রা:) বলেন, ‘বেশি খানা খেয়ে বেশি পান করো না। অন্যথায় বেশি ঘুমাবে এবং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর বেশি ঘুমের ফলে নিজের জীবন (সময়) নষ্ট হয়, তাহাজ্জুদ ছুটে যায়, অলসতা পেয়ে বসে এবং হৃদয় কঠিন হয়ে যায় । কেননা, জীবন তো কিছু শ্বাসের সমষ্টি । এটি বান্দার মূলধন, যা দিয়ে সে ব্যবসা করবে। আর ঘুম হলো মৃত্যু। বেশি ঘুমে হায়াত কমে যায়।’
ফুজাইল বিন ইয়াজ (রা:) বলেন, ‘দুটি অভ্যাস মানুষের হৃদয়কে কঠিন করে দেয়: অধিক ঘুম ও অধিক আহার।
ইবনুল কাইয়িম (রা:) বলেন, ‘ঘুম হৃদয়কে মেরে ফেলে এবং শরীরকে ভারী করে তোলে, সময় নষ্ট করে, উদাসীনতা ও অলসতা তৈরি করে। আর উপকারী নিদ্রা হলো, যা কঠিন প্রয়োজনে গ্রহণ করা হয়ে থাকে । রাতের শুরু অংশের নিদ্রা অধিক প্রশংসনীয় এবং শেষের অংশের চেয়ে উপকারী।
করনীয়ঃ —————–
ঘুমকে ইবাদতে পরিণত করা।
ক্ষমা ও ফেরেশতাদের দুআর মাধ্যমে সফলতা লাভ করা: রাসুল বলেন: ‘যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় ঘুমায়, তার শিয়রে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখনই সে জাগ্রত হয়, ফেরেশতা বলে, “হে আল্লাহ, আপনার অমুক বান্দাকে ক্ষমা করুন; কেননা, সে পবিত্র অবস্থায় ঘুমিয়েছে।’ [সহিহু ইবনি হিব্বান: ১০৫১, শুআবুল ইমান : ২৫২৬]
সময় থেকে উপকৃত হওয়া এবং জীবনকে দীর্ঘায়ত করা।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নবিজি -এর অনুসরণ করে উপকৃত হওয়া।
‘সার্কেডিয়ান রিদম’ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যা তিনজন বিজ্ঞানীকে ২০১৭ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে। তারা অবিস্কার করেন কোষের ভেতরে বিশেষ কিছু প্রোটিন কীভাবে চব্বিশ ঘণ্টার একটি চক্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে ছোট বেলা থেকে একদম বুড়ো বয়স পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের উপর সার্কেডিয়ান রিদম-এর ব্যাপক ভূমিকা আবিষ্কার করে সেই তিন বিজ্ঞানী এই অনন্য সম্মান লাভ করেন।
জীবিকা অন্বেষণের জন্য দিন
প্রায় সব প্রাণীর মস্তিষ্কে একটি ঘড়ি রয়েছে, যা দেহের বেশিরভাগ শারীরিক প্রক্রিয়া এবং আচরণকে সময় অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করে। একে বলা হয় ‘সার্কেডিয়ান রিদম’। মানব দেহে প্রায় বিশ হাজার নিউরন নিয়ে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে এই ঘড়িটি গঠিত, যা চব্বিশ ঘণ্টার একটি চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। দিনের আলো চোখের রেটিনাতে আঘাত করলে তা মস্তিষ্কের সেই অংশে এক ধরনের সিগনাল পাঠায়, যা মস্তিষ্ককে ধারণা দেয় যে, এখন কি দিন, নাকি রাত? মস্তিষ্কের এই ঘড়িটি প্রভাবিত হয় আলোর উপস্থিতিতে।
এই ঘড়ি অনুসারে দেহের বেশিরভাগ শারীরিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ঘড়ি বলে দেয় যে, দিনের বেলা বেশি করে রক্ত সঞ্চালন করতে হবে; শ্বাসে অক্সিজেন বেশি নিতে হবে, বেশি করে কোষের খাদ্য ভাণ্ডার খরচ করে শক্তি যোগান দিতে হবে; শরীরের পেশিগুলোকে বেশি পরিশ্রমের জন্য দুপুর থেকে প্রস্তুত রাখতে হবে; সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্মৃতি এবং মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা বেশি সক্রিয় রাখতে হবে; শরীরের তাপমাত্রাকে ভোরের আলো ফোটা থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে হবে ইত্যাদি। আর এই ঘড়িটিকে তৈরি করা হয়েছে এমনভাবে যে, এটি দিনের বেলা দেহকে কাজের জন্য বেশি প্রস্তুত রাখবে এবং রাতের বেলা দেহকে কম সক্রিয় করে বিশ্রাম নেবার জন্য প্রস্তুত করবে —ঠিক যেভাবে আল্লাহ تعالى এই আয়াতটিতে বলেছেন।
যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করেন, তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। ভোর থেকে দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়া শুরু করে, যা দুপুর পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। একারণে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মানুষের কার্যকর স্মৃতি, সতর্কতা, সক্রিয়তা এবং মনোযোগ দেবার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে। সকাল বেলা হালকা গরম পানিতে গোসল করলে তা আরও সহায়তা করে।
অন্যদিকে যারা শারীরিক কাজ করেন, দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেহে সেই সব হরমোন বেশি নিঃসরণ হয়, যা পেশির শক্তি বৃদ্ধি এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া করতে সাহায্য করে। এই সময় পেশির জোড়াগুলো ২০% বেশি নমনীয় থাকে। একারণে এই সময় খেলাধুলা, ব্যায়াম এবং অন্যান্য শারীরিক কাজ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।
শরীরের এই স্বাভাবিক ঘড়িতে যদি ব্যঘাত ঘটানো হয়, তাহলে ডিপ্রেশন, ডায়াবিটিস, ডেমেনশিয়া এবং অতিরিক্ত মেদ জনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়। রাতে জেগে থেকে মানুষ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে না। রাতে জেগে থাকার জন্য তাকে ঘন ঘন চা-কফির আশ্রয় নিতে হয়, যা তার শরীরে আরও ক্ষতি করে। অনেক সময় চা-কফি খেয়েও রাতের বেলা যথেষ্ট কর্মক্ষমতা আসে না। তখন নানা ধরনের ওষুধে ঝুঁকতে হয়। তার উপর দিনের বেলা আলোর উপস্থিতি, বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা এবং চারিদিকের কোলাহলের কারণে ঠিকমতো ঘুম হয় না। যার ফলে দেহের নিয়মিত মেরামতও ঠিক মতো হয় না। এভাবে মানুষ ধীরে ধীরে জটিল অসুখের দিকে এগিয়ে যায়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেহের এই স্বাভাবিক দিন এবং রাতের চক্র ব্যহত হলে এবং রাতে আগে ঘুমিয়ে ভোর বেলা না উঠলে মানুষের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। একসাথে এই চক্র দেহের ইনসুলিন নিঃসরণ, গ্লুকোজ শোষণ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এই চক্র ব্যাহত হয় ঠিকমতো না ঘুমানোর কারণে, তখন মানুষের টাইপ ২ ডায়াবিটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। S. Masri and P. Sassone-Corsi. The emerging link between cancer, metabolism, and circadian rhythms. Nature Medicine, 24(12):1795–1803, 2018.
[৪৮০] D. J. Stenvers, F. A. J. L. Scheer, P. Schrauwen, S. E. la Fleur, and A. Kalsbeek. Circadian clocks and insulin resistance. Nature Reviews Endocrinology, 15(2):75–89, 2019.
আধুনিক যুগে মানব দেহ এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। রাতের বেলা টিভি, উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি এবং মোবাইল ফোনের আলোর কারণে মানুষের স্বাভাবিক দিন এবং রাতের চক্র ব্যাপকভাবে ব্যহত হচ্ছে। বিশেষ করে রাতে বিছানায় শুয়ে মোবাইল করার কারণে এই সমস্যা মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। রাতের বেলা চোখে সাদা আলো পড়ার কারণে দেহের ঘড়িটি উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। দেহ বুঝতে পারছে না যে, এখন কি দিন, নাকি রাত? রাতে কীভাবে দিনের মতো তীব্র আলো আসছে? —একারণে দেহ ঠিকমতো রাতের মেরামত কাজ করে না। যার ফলে নিয়মিত দেহে ক্ষতি বেড়ে যায়, মেরামত কমে যায়। রাতে ঘুম কম হয়, বা হলেও ঘুমের মান কমে যায়। যার ফলে মানুষ আর ভোর বেলা উঠতে পারে না, যা মানুষের দেহের জন্য স্বাভাবিক। দেরী করে সকালে উঠে দেহ ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্থ হয়ে থাকে। কাজেকর্মে যথেষ্ট আগ্রহ, উদ্যম আসে না। সকাল বেলা উঠে মন প্রফুল্ল হয় না। ঘুম থেকে উঠে জড়তা এবং বিরক্তি নিয়ে। সারাদিন কাজে কর্মে পুরোপুরি আগ্রহ আসে না। ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার আগ্রহ কম থাকে, মান খারাপ হয়। দিনের বেলা দেহ চাঙ্গা করার জন্য চা-কফি, এনার্জি ড্রিঙ্কের আশ্রয় নিতে হয়। দেহের স্বতঃস্ফূর্ত শক্তি, উদ্যম তখন নষ্ট হয়ে যায়। নিয়মিত কৃত্রিম কোনো ব্যবস্থা ছাড়া মানুষ আর স্বাভাবিক কাজের ক্ষমতা ফিরে পায় না। সেই কৃত্রিম ব্যবস্থার উপর মানুষ তখন আসক্ত হয়ে যায়। Zhu, L., & Zee, P. C. (2012). Circadian rhythm sleep disorders. Neurologic clinics, 30(4), 1167–1191. doi:10.1016/j.ncl.2012.08.011
১০:৬৮ قَالُوا اتَّخَذَ اللّٰهُ وَلَدًا سُبۡحٰنَهٗ ؕ هُوَ الۡغَنِیُّ ؕ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ اِنۡ عِنۡدَکُمۡ مِّنۡ سُلۡطٰنٍۭ بِهٰذَا ؕ اَتَقُوۡلُوۡنَ عَلَی اللّٰهِ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿
৬৮. তারা বলে, ‘আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি মহান পবিত্র! তিনি অভাবমুক্ত! যা কিছু আছে আসমানসমূহে ও যা কিছু আছে যমীনে তা তাঁরই। এ বিষয়ে তোমাদের কাছে কোন সনদ নেই। তোমরা কি আল্লাহর উপর এমন কিছু বলছ যা তোমরা জান না?
আর যিনি কারোর মুখাপেক্ষী নন, তাঁর সন্তানেরও প্রয়োজন নেই। কারণ সন্তান সাহায্য-সহযোগিতার জন্যই প্রয়োজন হয়। আর তিনি যখন সহযোগিতার মুখাপেক্ষী নন, তখন তাঁর সন্তানের প্রয়োজনই বা কি?
আকাশ ও পৃথিবীর সকল বস্তু যখন তাঁরই, তখন সকল বস্তু তাঁরই দাস ও গোলাম। তার পরেও তাঁর সন্তানের আর কি প্রয়োজন আছে? সন্তানের প্রয়োজন তারই হয়, যার কোন সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। আর যাঁর আকাশ ও পৃথিবীর সকল বস্তুর উপর কর্তৃতত্ত্ব চলে, তাঁর প্রয়োজনই বা কি হতে পারে? তাছাড়া ঐ ব্যক্তি সন্তানের প্রয়োজন অনুভব করে, যে ব্যক্তি নিজের মৃত্যুর পর সম্পদের ওয়ারিস দেখতে বা বানাতে পছন্দ করে। আর আল্লাহ তাআলার সত্তা কখনো ধ্বংস হবে না। সুতরাং তাঁর সন্তান নির্ধারণ করা এত বড় অপরাধ যে, সে সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
(تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنْشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْجِبَالُ هَدًّا، أَنْ دَعَوْا لِلرَّحْمَنِ وَلَدًا) অর্থাৎ, এতে যেন আকাশসমূহ বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী খন্ড-বিখন্ড হবে এবং পর্বতসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে। যেহেতু তারা পরম দয়াময়ের প্রতি সন্তান আরোপ করে। (সূরা মারয়্যাম ৯০-৯১)
১০:৬৯ قُلۡ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَفۡتَرُوۡنَ عَلَی اللّٰهِ الۡکَذِبَ لَا یُفۡلِحُوۡنَ
৬৯. বলুন, যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করবে তারা সফলকাম হবে না।
افتراء এর অর্থ হল মিথ্যারোপ করা। এর পরেও বাড়তি كذب ‘মিথ্যা’ শব্দটি তাকীদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
এখানে সফলকাম বা কৃতকার্য বলতে পরকালের কৃতকার্যতাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর ক্রোধ ও তাঁর শাস্তি থেকে নিষ্কৃতিলাভ। যেহেতু শুধু পার্থিব ক্ষণস্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ কৃতকার্যতা নয়। যেমন অনেকে কাফেরদের ক্ষণস্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখে ভুল ধারণা এবং সন্দেহ ও সংশয়ের শিকার হয়। এই জন্যই পরবর্তী আয়াতে বলেছেন যে, ‘‘দুনিয়ায় কিছু সুখ-সম্ভোগ; তারপর আমারই দিকে তাদেরকে ফিরে আসতে হবে।’’ অর্থাৎ, পৃথিবীর আরাম-আয়েশ আখেরাতের তুলনায় একেবারে নগণ্য, যার কোন গণনাই হয় না। তার পর তাদেরকে কঠিন শাস্তি আস্বাদন করতে হবে। অতএব ভালভাবে জেনে রাখা দরকার যে, কাফের, মুশরিক এবং আল্লাহর অবাধ্যজনদের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থনৈতিক উন্নতি এই কথার প্রমাণ নয় যে, এই জাতি সফলকাম ও কৃতকার্য এবং আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। তাদের এই জাগতিক উন্নতি তাদের নিরলস প্রচেষ্টার ফল, যা বাহ্যিক উপায়-উপকরণ অনুযায়ী প্রত্যেক সেই জাতি অর্জন করতে পারে, যে উপায়-উপকরণ সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে তা অর্জনের জন্য তাদের মত চেষ্টা-চরিত্র করবে; তাতে সে জাতি মু’মিন হোক বা কাফের। তাছাড়া এই ক্ষণস্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অবকাশ ও ঢিল দেওয়ার ফলও হতে পারে। যার আলোচনা এর পূর্বে বিভিন্ন স্থানে করা হয়েছে।
১০:৭০ مَتَاعٌ فِی الدُّنۡیَا ثُمَّ اِلَیۡنَا مَرۡجِعُهُمۡ ثُمَّ نُذِیۡقُهُمُ الۡعَذَابَ الشَّدِیۡدَ بِمَا کَانُوۡا یَکۡفُرُوۡنَ
৭০. দুনিয়াতে তাদের জন্য আছে কিছু সুখ-সম্ভোগ; পরে আমাদেরই কাছে তাদের ফিরে আসা। তারপর তাদেরকে আমরা কঠোর শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করাব; কারণ তারা কুফরী করত।
আর অবিশ্বাসিগণ যেন কখনো মনে না করে যে, তারা (আমার) আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। তারা নিশ্চয়ই (আমাকে) হতবল করতে পারবে না। আনফালঃ৫৯
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আলিফ-লাম-র, এগুলো কিতাবের এবং সুস্পষ্ট কোরআনের আয়াতসমূহ। এমন একটা সময় আসবে যখন অবিশ্বাসীরা আক্ষেপ করে বলবে, ‘হায়, আমরা যদি মুসলিম হয়ে যেতাম!’ ছেড়ে দাও ওদেরকে, ওরা খেতে থাক আর ভোগ করতে থাক, আর (মিথ্যা) আশা ওদেরকে উদাসীনতায় ডুবিয়ে রাখুক, শিগগিরই ওরা (ওদের আমালের পরিণতি) জানতে পারবে। আমি কোনো জনপদকে তার নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ধ্বংস করিনি। কোনো জাতিই তাদের সুনির্ধারিত সময় থেকে আগে বাড়তে পারে না আর পিছাতেও পারে না। ’ (সূরা: হিজর, আয়াত: ১-৫)
আর প্রত্যেক জাতির এক নির্দিষ্ট সময় আছে। সুতরাং যখন তাদের সময় আসবে, তখন তারা মুহূর্তকালও বিলম্ব বা ত্বরা করতে পারবে না। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩৩-৩৪)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ জালিমকে অবকাশ দেন, তারপর যখন পাকড়াও করেন তখন আর কোনো ছাড় দেন না।’ (মুসলিম)
সহায়কঃ
তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান, রাহে বেলায়েত,