সূরা ইউনুসঃ ৪র্থ রুকু (আয়াত ৩১-৪০নং)
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
১০:৩১ قُلۡ مَنۡ یَّرۡزُقُکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ اَمَّنۡ یَّمۡلِکُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ مَنۡ یُّخۡرِجُ الۡحَیَّ مِنَ الۡمَیِّتِ وَ یُخۡرِجُ الۡمَیِّتَ مِنَ الۡحَیِّ وَ مَنۡ یُّدَبِّرُ الۡاَمۡرَ ؕ فَسَیَقُوۡلُوۡنَ اللّٰهُ ۚ فَقُلۡ اَفَلَا تَتَّقُوۡنَ ﴿
৩১. বলুন, কে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে জীবনোপকরুণ সরবরাহ করেন অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন, জীবিতকে মৃত থেকে কে বের করেন এবং মৃতকে জীবিত হতে কে বের করেন এবং সব বিষয় কে নিয়ন্ত্রণ করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। সুতরাং বলুন, ‘তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না?
অর্থাৎ যিনি তোমাদেরকে শোনার শক্তি ও দেখার শক্তি দান করেছেন তিনি যদি ইচ্ছে করেন সেগুলোকে নিয়ে যেতে পারেন। সেগুলো তোমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেন। [ইবন কাসীর]
৬৭:২৩ قُلۡ هُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡشَاَکُمۡ وَ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۲
অন্য আয়াতেও আল্লাহ বলেছেন, “বলুন, তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ।” [সূরা আল-মুলক; ২৩]
আরও বলেন, “বলুন, তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ যদি তোমাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেন এবং তোমাদের হৃদয় মোহর করে দেন তবে আল্লাহ ছাড়া আর কোন প্রকৃত ইলাহ আছে যে তোমাদের এগুলো ফিরিয়ে দেবে? [সূরা আল-আনআমঃ ৪৬]
আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াতসমূহে মুশরিকদের উপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করছেন যে, তাদেরই স্বীকৃতি মোতাবেক যদি তিনি আল্লাহই একমাত্র রব হয়ে থাকেন, তবে একমাত্র তার ইবাদত কেন করা হবে না? তাই তিনি বলছেন যে, কে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে জীবনোপকরণ সরবরাহ করেন? অর্থাৎ কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তার ক্ষমতায় যমীন ফাটিয়ে তা থেকে বের করে আনেন,
“নিশ্চয় আমরা প্রচুর বারি বর্ষণ করি, তারপর আমরা যমীনকে যথাযথভাবে বিদীর্ণ করি, অতঃপর তাতে আমরা উৎপন্ন করি শস্য; আংগুর, শাক-সবজি, অনেক গাছবিশিষ্ট উদ্যান, ফল এবং গবাদি খাদ্য [সূরা আবাসাঃ ২৫–৩১] তিনি ছাড়া কি আর কোন ইলাহ আছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তারা অবশ্যই বলবে যে, এটা শুধু আল্লাহই করে থাকেন।
অন্য আয়াতেও আল্লাহ বলেন,
اَمَّنۡ هٰذَا الَّذِیۡ یَرۡزُقُکُمۡ اِنۡ اَمۡسَکَ رِزۡقَهٗ ۚ بَلۡ لَّجُّوۡا فِیۡ عُتُوٍّ وَّ نُفُوۡرٍ ﴿
“এমন কে আছে, যে তোমাদেরকে রিযক দান করবে, যদি তিনি তার রিযক বন্ধ করে দেন? [সূরা আল-মুলকঃ ২১]।
৩২ فَذٰلِکُمُ اللّٰهُ رَبُّکُمُ الۡحَقُّ ۚ فَمَا ذَا بَعۡدَ الۡحَقِّ اِلَّا الضَّلٰلُ ۚۖ فَاَنّٰی تُصۡرَفُوۡنَ ﴿
৩২. অতএব, তিনিই আল্লাহ, তোমাদের সত্য রব। সত্য ত্যাগ করার পর বিভ্রান্তি ছাড়া আর কী থাকে? কাজেই তোমাদেরকে কোথায় ফেরানো হচ্ছে?
অর্থাৎ যদি এসবই আল্লাহর কাজ হয়ে থাকে, যেমন তোমরা নিজেরাও স্বীকার করে থাকো, তাহলে তো প্রমাণিত হলো যে, একমাত্র আল্লাহই তোমাদের প্রকৃত মালিক, রব, প্রভু এবং তোমাদের বন্দেগী ও ইবাদাতের হকদার। [ইবন কাসীর] কাজেই অন্যের, যাদের এসব কাজে কোন অংশ নেই তারা কেমন করে রবের দায়িত্বে শরীক হয়ে গেলো। কিভাবে তারা ইবাদত পেতে পারে?
রব শব্দটি নিম্নোক্ত অর্থ সমূহ প্রকাশ করেঃ
একঃ প্রতিপালক, প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহকারী, তরবিয়ত ও ক্রমবিকাশ দাতা।
দুইঃ জিম্মাদার, তত্ত্বাবধায়ক, দেখাশোনা এবং অবস্থার সংশোধন- পরিবর্তনের দায়িত্বশীল।
তিনঃ যিনি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লোক সমবেত হয়।
চারঃ নেতা- সর্দার, যার আনুগত্য করা হয়, ক্ষমতাশালী কর্তা ব্যক্তি, যার নির্দেশ চলে, যার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়, হস্তক্ষেপ ও বল প্রয়োগের অধিকার আছে যার।
পাঁচঃ মালিক-মুনিব।
কোরআন মজীদে রব শব্দটি এসব অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও এসবের কোন এক বা দুই অর্থ উদ্দেশ্য; কোথাও এর চেয়েও বেশী, আর কোথাও পাঁচটি অর্থই এক সাথে বোঝান হয়েছে। কোরআনের আয়াত বিভিন্ন উদাহরণ
——— قَالَ مَعَاذَ اللّٰهِ اِنَّهٗ رَبِّیۡۤ اَحۡسَنَ مَثۡوَایَ ؕ اِنَّهٗ لَا یُفۡلِحُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۲۳
প্রথম অর্থেঃ একঃ প্রতিপালক, প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহকারী, তরবিয়ত ও ক্রমবিকাশ দাতা।
সে বললো, আল্লাহর আশ্রয়! যিনি আমাকে ভালোভাবে রেখেছেন, তিনিই তো আমার রব। (আর আমি এ কাজ করবো!)৷ এ ধরনের জালেমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারে না৷ সূরা ইউসুফ-২৩
(১) কেউ যেন ধারনা করে না বসে যে, হযরত ইউসুফ (আঃ) আজীজ মিসরকে তাঁর রব বলেছেন। কোন কোন তফসীরকার এমন সন্দেহও করেছেন। মূলত ‘সে’ বলে আল্লাহর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তিনি যাঁর আশ্রয় চেয়েছেন।
দ্বিতীয় অর্থেঃ দুইঃ জিম্মাদার, তত্ত্বাবধায়ক, দেখাশোনা এবং অবস্থার সংশোধন- পরিবর্তনের দায়িত্বশীল।
প্রথম অর্থের ধারণাও যাতে অল্প-বিস্তর শামিল রয়েছেঃ
২৬:৭৭ فَاِنَّهُمۡ عَدُوٌّ لِّیۡۤ اِلَّا رَبَّ الۡعٰلَمِیۡنَ
২৬:৭৮ الَّذِیۡ خَلَقَنِیۡ فَهُوَ یَهۡدِیۡنِ
২৬:৭৯ وَ الَّذِیۡ هُوَ یُطۡعِمُنِیۡ وَ یَسۡقِیۡنِ
২৬:৮০ وَ اِذَا مَرِضۡتُ فَهُوَ یَشۡفِیۡنِ
২৬:৮১ وَ الَّذِیۡ یُمِیۡتُنِیۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡنِ
বিশ্ব জাহানের রব, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমাকে পথ প্রদর্শন করেন, পানাহার করান, আমি পীড়িত হলে আরোগ্য দান করেন, তিনি ব্যতীত তোমাদের এ সকল রব তো আমার দুশমন। আর তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাবেন, তারপর আমাকে পুনর্জীবিত করবেন।শোয়ারা-৭৭-৮১
তিনি মাশরিক-মাগরিব-প্রাচ্য-প্রতীচ্যের রব। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, সুতরাং তাঁকেই তোমার উকিল (নিজের সকল ব্যাপারে জামিন ও জিম্মাদার) হিসাবে গ্রহণ করো। -আল-মুজ্জাম্মিল- ৯
অতপর তোমাদের রব- এর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন।- যুমার-৭
সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া মাত্রই তারা নিজ নিজ ঠিকানা থেকে আপণ রব-এর দিকে বেরিয়ে পড়বে।-ইয়াসীন-৫১
তৃতীয় ও চতুর্থ অর্থে: তিনঃ যিনি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লোক সমবেত হয়। চারঃ নেতা- সর্দার, যার আনুগত্য করা হয়, ক্ষমতাশালী কর্তা ব্যক্তি, যার নির্দেশ চলে, যার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়, হস্তক্ষেপ ও বল প্রয়োগের অধিকার আছে যার।
اِتَّخَذُوۡۤا اَحۡبَارَهُمۡ وَ رُهۡبَانَهُمۡ اَرۡبَابًا مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ الۡمَسِیۡحَ ابۡنَ مَرۡیَمَ ۚ وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡۤا اِلٰـهًا وَّاحِدًا ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ سُبۡحٰنَهٗ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿
তারা আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগিদেরকে তাদের রবরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়াম-পুত্র মসীহকেও। অথচ এক ইলাহের ইবাদাত করার জন্যই তারা আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তা থেকে তিনি কত না পবিত্ৰ।! (তওবা-৩১)
আর আমাদের কেউ যেন আল্লাহ ছাড়া কাউকে নিজের রব না বানায়।
(ইউসুফ বললেন) অবশ্য তোমাদের একজন তার রবকে শরাব পান করাবে-। তাদের দু’জনের মধ্যে যার সম্পর্কে ইউসুফের ধারণা ছিল, সে মুক্তি লাভ করবে। ইউসুফ তাকে বললেনঃ তোমরা রব- এর কাছে আমার কথা বলো। কিন্তু শয়তান তাকে ভুলিয়ে দিলো, তাই আপন রব-এর কাছেইউসুফের কথা উল্লেখ করতে তার স্মরণ ছিল না। (ইউসুফ-৪১-৪২)
বার্তাবাহক ইউসুফের কাছে হাযির হলে ইউসুফ তাকে বললোঃ তোমার রব-এর কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো, যেসব মহিলারা নিজেরাই নিজেদের হাত কেটেছিল, তাদের কি অবস্থা। আমার রবতো তাদের চক্রান্ত সম্পর্কে ওয়াকিফহাল আছেনই।-ইউসুফ-৫০
এসব আয়াতে হযরত ইউসুফ (আঃ) মিসরীয়দের সাথে কথাবার্তাকালে মিসরের শাসনকর্তা ফিরাউনকে তাদের রব বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। কারণ তারা তখন তার কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব, সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতো, তাকে আদেশ-নিষেধের মালিক মনে করেন।
পঞ্চম অর্থেঃ পাঁচঃ মালিক-মুনিব।
সুতরাং তাদের উচিত, এ ঘরের মালিকের ইবাদত করা, যিনি তাদের রিজিক সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন এবং ভয়-ভীতি থেকে তাদের নিরাপদ রেখেছেন। কোরাইশ-৩-৪
তোমার রব- যিনি সম্মান ও ক্ষমতার মালিক-ওরা তাঁর সম্পর্কে যেসব দোষ- ত্রুটির কথা বলছে, তিনি সেসব থেকে মুক্ত-পবিত্র।
আল্লাহ, যিনি আরশের মালিক-তারা যেসব দোষ-ত্রুটির কথা বলছে তিনি সে সব হতে মুক্ত পবিত্র। আল-আম্বিয়া-২২
রুবুবিয়াত সম্পর্কে পথভ্রষ্ট জাতিসমুহের ভ্রান্ত ধারণা——-
হে নবী! তাদের জিজ্ঞেস করো, যমীন এবং তাতে যা কিছু আছে, তা কার মালিকানায়? তোমরা জানলে বলো। তারা বলবে; আল্লাহর মালিকানায়। বলো; তবুও তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? জিজ্ঞেস করো; সাত আসমান ও মহান আরশের রব কে? তারা বলবে, আল্লাহ। তবুও তোমরা ভয় করবে না? বলো, সকল বস্তুর রাজকীয় ক্ষমতা কার হাতে ন্যস্ত? কে তিনি যিনি আশ্রয় দান করেন? অথচ তাঁর মোকাবিলায় আশ্রয় দানের ক্ষমতা কারুর নেই। বলো, যদি তোমরা জানো। তারা বলবে; এই গুন-বৈশিষ্ট্য শুধু আল্লাহর।বলো,তাহলে কোথেকে তোমরা প্রতারিত হচ্ছো? আসল কথা এই যে, আমরা তাদের সামনে বাস্তব সত্য তুলে ধরেছি্ আর তারা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। আল মুমিনুন-৮৪-৯০
সমুদ্রে তোমাদের কোন বিপদ দেখা দিলে এক আল্লাহ ব্যতীত আর যাদের যাদের তোমরা ডাকতে, তারা সকলেই গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু তিনি যখন তোমাদের রক্ষা করে স্থলভাগে পৌছিয়ে দেন, তখন তোমরা তাঁর থেকে বিমুখ হয়ে যাও। সত্য কথা এই যে, ইনসান বড়ই অকৃতজ্ঞ-একান্ত না- শোকর বান্দা। বনী-ইসরাইল-৬৭
নিজেদের মাবুদ (উপাস্য) সম্পর্কে তাদের যে ধারনা ছিল, স্বয়ং তাদেরই জবানীতে কোরআন তা এভাবেই উল্লেখ করেছেঃ
আর যারা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বন্ধু ও কার্যোদ্ধারকারী হিসাবে গ্রহণ করে, তারা বলে; এরা আমাদের আল্লাহর নিকটবর্তী করবে-এজন্যেই তো আমরা তাদের ইবাদত করি। আয-যুমারঃ৩
তারা আল্লাহকে ছেড়ে এমন কারো ইবাদত করছে, যারা অকল্যাণও করতে পারে না, পারে না কল্যাণও করতে। এবং তারা বলে; আল্লাহর হুজুরে তারা আমাদের সুপারিশকারী। বল, আসমান-যমীনে আল্লাহর জ্ঞানে নেই -তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন কিছুর সংবাদ দিচ্ছো? তারা যে শিরক করছে, তা থেকে আল্লাহ্ পবিত্র- মুক্ত। ইউনুসঃ১৮
সুতরাং মনে রাখতে হবে যে—-
রব الرَّبُّ শব্দের অর্থ: প্রভু, প্রতিপালক, স্রষ্টা, পরিচালক, মালিক, অধিপতি ইত্যাদি।
এটি মহান আল্লাহর একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ নাম।
তিনি সমগ্র বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা, অধিপতি, পরিচালক এবং প্রতিপালক। তিনি সৃষ্টি জগতকে অসংখ্য নিয়ামত সহকারে প্রতিপালন করেন আর তার প্রিয়ভাজনদেরকে এমনভাবে প্রতিপালন করেন যেন তাদের অন্তরগুলো সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
তিনিই সৃষ্টিকুলকে তাঁর নেয়ামতরাজি দিয়ে প্রতিপালন করেন, তাদেরকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন। তিনি মুমিন বন্ধুদের অন্তর যেভাবে সংশোধন হয় সেভাবে যত্নসহকারে লালন-পালন করেন। তিনিই মালিক, স্রষ্টা, নেতা ও পরিচালক।কুরআনে এ নামটি ৯০০ বার উল্লেখিত হয়েছে।
যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন:
الْحَمْدُ لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।” (সূরা ফাতিহা: ২)
ইনিই হলেন সেই মহান সত্তা যাঁর গুণ-পরাকাষ্ঠার বিবরণ এইমাত্র বর্ণিত হলো, তারপরে পথভ্রষ্টতা ছাড়া আর কি থাকতে পারে? অর্থাৎ যখন আল্লাহ্ তা’আলার নিশ্চিত উপাস্য হওয়া প্রমাণিত হয়ে গেল, তখন প্রমাণিত হলো যে, তিনি ছাড়া আর সবই বাতিল। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তাঁর কোন শরীক নেই। [ইবন কাসীর] সুতরাং সেই নিশ্চিত সত্যকে পরিহার করে অন্যান্যদের প্রতি মনোনিবেশ করা কঠিন নির্বুদ্ধিতার কাজ। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়ে যায় যে, ঈমান ও কুফরির মাঝে কোন সংযোগ নেই। যা ঈমান হবে না, তাই কুফর হবে। [কুরতুবী]
বলা হচ্ছে, “তোমাদেরকে কোথায় ফেরানো হচ্ছে?” অর্থাৎ যখন তোমরা জানতে পারলে যে, আল্লাহই একমাত্র রব, তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন,সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন তখন কিভাবে তাঁর ইবাদত ছেড়ে অন্যের ইবাদতের দিকে তোমাদের ফেরানো হয়? [ইবন কাসীর] এ থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, এমন কিছু বিভ্রান্তকারী রয়েছে যারা লোকদেরকে সঠিক দিক থেকে টেনে নিয়ে ভুল দিকে ফিরিয়ে দেয়। তাই মানুষকে আবেদন জানানো হচ্ছে, তোমরা অন্ধ হয়ে ভুল পথপ্রদর্শনকারীদের পেছনে ছুটে যাচ্ছে কেন? নিজেদের বুদ্ধি ব্যবহার করে চিন্তা করছে না কেন যে, প্রকৃত সত্য যখন এই, তখন তোমাদেরকে কোন দিকে চালিত করা হচ্ছে?
তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একই ব্যাক্তি হতে। তারপর তিনি তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি তোমাদের জন্য নাযিল করেছেন আট জোড়া আন’আম। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভের ত্রিবিধ অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আল্লাহ; তোমাদের রব; সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই; তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। অতঃপর তোমাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে? যুমারঃ ৬
তিনি আসমান যমীনের মালিক (রব), মালিক সেসব বস্তুর যা আসমান -যমীনে আছে। সুতরাং তুমি তাঁরই বন্দেগী কর আর তাঁর ওপর দৃঢ় থাকো। তোমার জানামতে আর কেউ কি আছে তাঁর মতো? সুরা-মারইয়াম -৬৫
বস্তুত তোমাদের এ উম্মত একই উম্মত। আর আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমারই বন্দেগী করো। লোকেরা রবুবিয়াতের এই কার্য এবং জীবনের কার্যাবলীকে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নিয়েছে। কিন্তু যা-ই হোক, তাদের সকলকে আমার নিকটেই ফিরে আসতে হবে। সুরা আন-নিসাঃ৯৩-৯৬
তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে যে কিতাব নাজিল হয়েছে, তোমরা তার অনুসরণ করো। তা ত্যাগ করে অন্য কাউকে কার্যোদ্ধারকারী হিসাবে অনুসরণ করো না। আল-আরাফঃ৩
১০:৩৩ کَذٰلِکَ حَقَّتۡ کَلِمَتُ رَبِّکَ عَلَی الَّذِیۡنَ فَسَقُوۡۤا اَنَّهُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ
৩৩. যারা অবাধ্য হয়েছে এভাবেই তাদের সম্পর্কে আপনার রবের বাণী সত্য প্রতিপন্ন হয়েছে যে, তারা ঈমান আনবে না
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে যে—
বল, আল্লাহর নিকট ফাসেকদের চেয়েও নিকৃষ্টতর পরিণতি কাদের, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেবো? তারা, যাদের ওপর আল্লাহ লা’নত করেছেন, যাদের ওপর আল্লাহর গজব নিপতিত হয়েছে, যাদের অনেকেই তাঁর নির্দেশে বানর-শূকরে পরিণত হয়েছে, আর তারা তাগুতের ইবাদত-বন্দেগী করেছে। এরাই হচ্ছে নিকৃষ্টতর পর্যায়ের লোক। আর সত্য সরল পথ থেকে ওরা তো অনেক দূরে সরে গিয়েছে। -(আল মায়েদা-৬০)
এ মুশরিকরা যেহেতু কুফরী করেছে এবং কুফরি চালিয়েই যাচ্ছে, আর আল্লাহর সাথে অন্যের ইবাদাত করছে, অথচ তারা জানে ও স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, তিনিই স্রষ্টা, তাঁর রাজত্বের সবকিছুর একমাত্র নিয়ন্ত্রক, সেহেতু তাদের উপর আল্লাহর বাণী সত্য হয়ে গেছে যে, তারা হতভাগা। জাহান্নামের অধিবাসী। [ইবন কাসীর] অন্যত্রও আল্লাহ তা’আলা তা বলেছেন, “তারা বলবে, অবশ্যই হ্যাঁ। কিন্তু শাস্তির বাণী কাফিরদের উপর বাস্তবায়িত হয়েছে। [সূরা আয-যুমার: ৭১]
১০:৩৪ قُلۡ هَلۡ مِنۡ شُرَکَآئِکُمۡ مَّنۡ یَّبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُهٗ ؕ قُلِ اللّٰهُ یَبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُهٗ فَاَنّٰی تُؤۡفَکُوۡنَ ﴿
৩৪. বলুন, তোমরা যাদের শরীক কর তাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে, যে সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনে ও পরে সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটায়? বলুন, ‘আল্লাহই সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনেন ও পরে সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন। কাজেই (সত্য থেকে) তোমাদেরকে কোথায় ফেরানো হচ্ছে?
সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে মুশরিকরাও স্বীকার করতো যে, এটা একমাত্র আল্লাহরই কাজ। তাঁর সাথে যাদেরকে তারা শরীক করে তাদের কারো এ কাজে কোন অংশ নেই। আর সৃষ্টির পুনরাবৃত্তির ব্যাপারটিও সুস্পষ্ট। অর্থাৎ প্রথমে যিনি সৃষ্টি করেন তাঁর পক্ষেই দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা সম্ভব। কিন্তু যে প্রথমবারই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি সে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে পারে কেমন করে? অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা ঘোষণা করেছেন।
তিনি বলেন, “আল্লাহ, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি তোমাদেরকে জীবিত করবেন। (আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্তকৃত) তোমাদের মা’বুদগুলোর এমন কেউ আছে কি, যে এসবের কোন কিছু করতে পারে? তারা যাদেরকে শরীক করে, তিনি (আল্লাহ) সে সব (শরীক) থেকে মহিমাময়-পবিত্র ও অতি উর্ধ্বে। [সূরা আর-রুম ৪০] আরও বলেন,
“আর তারা তার পরিবর্তে ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে অন্যদেরকে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না, বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং তারা নিজেদের অপকার কিংবা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না এবং মৃত্যু, জীবন ও উত্থানের উপরও কোন ক্ষমতা রাখে না। [সূরা আল-ফুরকানঃ ৩]
১০:৩৫ قُلۡ هَلۡ مِنۡ شُرَکَآئِکُمۡ مَّنۡ یَّهۡدِیۡۤ اِلَی الۡحَقِّ ؕ قُلِ اللّٰهُ یَهۡدِیۡ لِلۡحَقِّ ؕ اَفَمَنۡ یَّهۡدِیۡۤ اِلَی الۡحَقِّ اَحَقُّ اَنۡ یُّتَّبَعَ اَمَّنۡ لَّا یَهِدِّیۡۤ اِلَّاۤ اَنۡ یُّهۡدٰی ۚ فَمَا لَکُمۡ ۟ کَیۡفَ تَحۡکُمُوۡنَ
৩৫. বলুন, তোমরা যাদেরকে শরীক কর তাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে যে সত্যের পথ নির্দেশ করে? বলুন, ‘আল্লাহই সত্য পথ নির্দেশ করেন। যিনি সত্যের পথ নির্দেশ করেন তিনি আনুগত্যের অধিকতর হকদার, না যাকে পথ না দেখালে পথ পায় না সে? সুতরাং তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা কেমন বিচার করছ?
আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সমস্ত মুশরিককে এবং নবীর শিক্ষা মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এমন সকল লোককে জিজ্ঞেস করে, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের বন্দেগী করো তাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি যার মাধ্যমে তোমরা সত্যের পথনির্দেশনা লাভ করতে পারো? অবশ্য সবাই জানে, এর জবাব না ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি না পারে তবে কেবলমাত্র যিনি পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত কে হিদায়াত দিতে পারেন তিনি হচ্ছেন আল্লাহ। যিনি ব্যতীত কোন হক ইলাহ নেই। তাহলে বান্দা কি তার অনুসরণ করবে যে হকের দিকে পথ দেখাতে পারে, যে অন্ধত্ব থেকে চক্ষুষ্মান করতে পারে, নাকি অনুসরণ করবে তার যে তার অন্ধ ও বোবা হওয়ার কারণে কোন কিছুর দিকেই পথ দেখাতে পারে না? [ইবন কাসীর]
এ ব্যাপারটিই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার পিতাকে বলেছিলেন, “হে আমার প্রিয় পিতা! আপনি তার ইবাদাত করেন কেন যে শুনে না, দেখে না এবং আপনার কোন কাজেই আসে না? [সূরা মারইয়ামঃ ৪২]
১০:৩৬ وَ مَا یَتَّبِعُ اَکۡثَرُهُمۡ اِلَّا ظَنًّا ؕ اِنَّ الظَّنَّ لَا یُغۡنِیۡ مِنَ الۡحَقِّ شَیۡئًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌۢ بِمَا یَفۡعَلُوۡنَ ﴿
৩৬. আর তাদের অধিকাংশ কেবল অনুমানেরই অনুসরণ করে, সত্যের পরিবর্তে অনুমান তো কোন কাজে আসে না, তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবগত।
অর্থাৎ তাদের নেতারা যারা বিভিন্ন ধর্ম প্রবর্তন করেছে, দর্শন রচনা করেছে তারাও এসব কিছু জ্ঞানের ভিত্তিতে নয় বরং আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে এগুলোকে ইলাহ সাব্যস্ত করে নিয়েছে। অনুমান করেই বলছে যে এগুলো শাফা’আত করবে। অথচ এ ব্যাপারে তাদের কোন দলীল-প্রমাণ নেই। আর যারা এসব ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের আনুগত্য করেছে তারাও জেনেবুঝে নয় বরং নিছক অন্ধ অনুকরণের ভিত্তিতে তাদের পেছনে চলেছে। [কুরতুবী]
কারণ তারা মনে করে, এত বড় বড় লোকেরা যখন একথা বলেন এবং আমাদের বাপ-দাদারা এসব মেনে আসছেন আবার এ সংগে দুনিয়ার বিপুল সংখ্যক লোক এগুলো মেনে নিয়ে এ অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে তখন নিশ্চয়ই এই লোকেরা ঠিক কথাই বলে থাকবেন।
বাপ-দাদারা কি এতদিন ভুল করে আসছেন!?
. অধিকাংশ মানুষই কি ভুল করে আসছে!?
. এত বড় বড় আলেম তো এভাবেই আমল করে আসছেন! তারা কি
ভুল করে গেছেন!?
মূলতঃ এই তিনটি অজুহাতে মানুষ কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর
দাওয়াতকে পরিত্যাগ করে। অথচ “অধিকাংশ” মানুষ কোন দলীল নয়; দলীল হল কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ। অধিকাংশদের ব্যাপারে আল্লাহ্ তায়ালা কুরআনে কি
বলেছেন–
- “অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে অবগত নয়” [সূরা ইউসুফ : ৬৮]
- “অধিকাংশই নির্বোধ” [সূরা মায়িদাহ : ১০৩]
- “অধিকাংশ লোকই অবগত নয়” [সূরা আনআম : ৩৭]
- “অধিকাংশই অজ্ঞ” [সূরা আনআম : ১১১]
- “অধিকাংশই জানে না” [সূরা আরাফ : ১৩১]
- “তুমি যতই প্রবল আগ্রহ ভরেই চাও না কেন, মানুষদের অধিকাংশই ঈমান আনবে না” [সূরা ইউসুফ : ১০৩]
- “আমি তোমার নিকট সুস্পষ্ট আয়াত নাজিল করেছি, ফাসিকরা ছাড়া অন্য কেউ তা অস্বীকার করে না; বরং তাদের অধিকাংশই ঈমান রাখে না” সূরা বাকারাহ : ৯৯-১০০]
- “আমি তো তোমাদের কাছে সত্য নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই ছিলে সত্য অপছন্দকারী”[সূরা যুখরুফ:৭৮]
আমি কি তোমাদের জানাব কাদের নিকট শয়তানরা অবতীর্ণ হয়? তারা অবতীর্ণ হয় প্রত্যেকটি চরম মিথ্যুক ও পাপীর নিকট। ওরা কান পেতে থাকে আর তাদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী। [সূরা শু’আরা : ২২১-২২৩]
অধিকাংশ মানুষ জ্ঞানহীনঃ
পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে তাদের যেকোনো বিষয়ে কোনো প্রকার জ্ঞান নেই। অর্থাৎ তারা কোনো কিছু নিয়ে জ্ঞান চর্চা করে না। তাদের চিন্তা চেতনায় আছে শুধু দুনিয়াদারী। তারা সৃষ্টি, সৃষ্টিকর্তা, সৃষ্টিজগত সম্পর্কে জানার বা চর্চার করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। তাই আল্লাহ্ বলেন,
“তাদের অধিকাংশই জ্ঞান রাখে না।” (আর রূম-৬,সূরা লোকমান- ২৫)
সুতরাং অধিকাংশ মানুষ জ্ঞান দিয়ে কথা বলে না। কারণ আল্লাহ্ বলেন,
তাদের অধিকাংশেরই বিবেক বুদ্ধি নেই”। (৫/সূরা মায়েদাহ, ১০৩)
অতএব যাদের বিবেক বুদ্ধি নেই সেইসব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুসরণ করা যাবে না।
অধিকাংশ হুকুম অমান্যকারীঃ
মানুষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা অপরাধপ্রবণ। মানুষের কষ্ট হলে তারা কোনো কিছু মানতে চায় না। আর আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য। যেহেতু মানুষকে তিনি পরীক্ষা করবেন সেহেতু তাদের বিভিন্ন হুকুম আহকাম মানতে হবে। অথচ মানুষ তা মানতে নারাজ। তাই আল্লাহ্ বলেন,
” আর তাদের অধিকাংশ লোককেই আমি প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নকারীরূপে পাইনি; বরং তাদের অধিকাংশকে পেয়েছি হুকুম অমান্যকারী”। (সূরা আল আ’রাফ, ১০২)
সুতরাং অধিকাংশ মানুষ যেহেতু হুকুম মান্য করে না, সেহেতু অধিকাংশ মানুষের মতামত কখনোই গ্রহণ করা যাবে না।
আর হে মুহাম্মাদ ! যদি তুমি দুনিয়ায় বসবাসকারী অধিকাংশ লোকের কথায় চলো তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে৷ তারা তো চলে নিছক আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে এবং তারা কেবল আন্দাজ-অনুমানই করে থাকে। সূরা আন’আমঃ১১৬
১০:৩৭ وَ مَا کَانَ هٰذَا الۡقُرۡاٰنُ اَنۡ یُّفۡتَرٰی مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ لٰکِنۡ تَصۡدِیۡقَ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡهِ وَ تَفۡصِیۡلَ الۡکِتٰبِ لَا رَیۡبَ فِیۡهِ مِنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۟
৩৭. আর এ কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচনা হওয়া সম্ভব নয়। বরং এর আগে যা নাযিল হয়েছে এটা তার সত্যায়ন এবং আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে।
“যা কিছু আগে এসে গিয়েছিল তার সত্যায়ন” অৰ্থাৎ তাওরাত, ইঞ্জীল সহ অন্যান্য কিতাবাদির সত্যায়ন। কারণ, সেগুলোতে এ কুরআনের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল। তারপর এ কুরআন সে সুসংবাদকে সত্যায়ন করে আগমন করেছে। শুরু থেকে নবীদের মাধ্যমে মানুষকে যে মৌলিক শিক্ষা দেয়া হয়েছে তথা তাওহীদ, আখেরাতের উপর ঈমান ইত্যাদিকে পাকাপোক্ত করছে। কারও কারও মতে, এখানে অর্থ হচ্ছে, কিন্তু এ কুরআন তার সামনে যে নবী রয়েছেন অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার সত্যায়ন করছে। কেননা তারা কুরআন শোনার আগ থেকেই তাকে দেখেছে। [কুরতুবী]
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-
وَ هٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰهُ مُبٰرَکٌ مُّصَدِّقُ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡهِ وَ لِتُنۡذِرَ اُمَّ الۡقُرٰی وَ مَنۡ حَوۡلَهَا ؕ وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ یُؤۡمِنُوۡنَ بِهٖ وَ هُمۡ عَلٰی صَلَاتِهِمۡ یُحَافِظُوۡنَ ﴿
৯২. আর এটি বরকতময় কিতাব, যা আমরা নাযিল করেছি, যা তার আগের সব কিতাবের সত্যায়নকারী এবং যা দ্বারা আপনি মক্কা ও তার চারপাশের মানুষদেরকে সতর্ক করেন। আর যারা আখেরাতের উপর ঈমান রাখে, তারা এটাতেও ঈমান রাখে এবং তারা তাদের সালাতের হিফাযত করে। সূরা আন’আমঃ ৯২
وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡهِ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ مُهَیۡمِنًا عَلَ
আর আমরা আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি ইতোপূর্বেকার কিতাবসমূহের সত্যতা প্রতিপন্নকারী ও সেগুলোর তদারককারীরূপে। মায়েদাঃ ৪৮
তারপর বলা হয়েছে যে, এটি “আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা” —অর্থাৎ সমস্ত আসমানী কিতাবের সারমর্ম যে মৌলিক শিক্ষাবলীর সমষ্টি, সেগুলো এর মধ্যে দিয়ে যুক্তি-প্রমাণ সহকারে উপদেশ দান ও বুঝাবার ভংগীতে, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং বাস্তব অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। অথবা এর অর্থ, এতে যে বিধানাবলী রয়েছে সেগুলোকে স্পষ্ট করে বিস্তারিত বর্ণনা করছে। [বাগভী; কুরতুবী]
(২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক নবীকেই তার (যুগ) উপযোগী মু’জিযা প্রদান করা হয়েছে। সে অনুসারে মানুষ তার উপর ঈমান এনেছে। আর নিশ্চয়ই আমাকে অহী দেয়া হয়েছে, যা আল্লাহ তা’আলা আমার উপর নাযিল করেছেন। অতএব, আমি আশা করছি যে, কিয়ামতের দিন আমার অনুগামী তাদের থেকে বেশী হবে। [বুখারীঃ ৪৯৮১]
এটা সে কিতাব; যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত, বাকারাঃ২
لَا رَیۡبَ فِیۡهِ
এ আয়াতে উল্লেখিত ريب শব্দের অর্থ এমন সন্দেহ যা অস্বস্তিকর। এ আয়াতের বর্ণনায় মুফাসসিরগণ বিভিন্ন মত পোষন করেছেনঃ
১) এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এ কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে।
২) তোমরা এ কুরআনের মধ্যে কোন সন্দেহ করো না। [ইবনে কাসীর]
৩) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এর অর্থ তোমরা এ কুরআনের মধ্যে কোন সন্দেহে নিপতিত হবে না। অর্থাৎ এর সবকিছু স্পষ্ট।
৪) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ যদি কিতাব দ্বারা ঐ কিতাব উদ্দেশ্য হয়, যাতে আল্লাহ্ তা’আলা সবকিছুর ভালমন্দ হওয়া লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তাহলে لَا رَيْبَ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এতে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন নেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মানুষের ঈমান আনার জন্য প্রত্যেক নবীকে কিছু কিছু মু’জিযা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত ওহী হচ্ছে আমার মু’জিযা। আমি আশা করি কিয়ামতের দিন অন্যান্য নবীর তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা অধিক হবে।” [বুখারী ৪৯৮১, মুসলিম: ১৫২]
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘তোমরা কোন ব্যাপারে কিতাবীদেরকে কেন জিজ্ঞেস কর? অথচ তোমাদের কাছে রয়েছে তোমাদের রাসূলের কাছে নাযিলকৃত আল্লাহর কিতাব। যা সবচেয়ে আধুনিক, (আল্লাহর কাছ থেকে আসার ব্যাপারে) নবীন। তোমরা সেটা পড়ছ। আর সে কিতাবে আল্লাহ জানিয়েছেন যে, কিতাবীরা সে কিতাব লিপিবদ্ধ করে বলেছে যে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। তোমাদের কাছে এ সমস্ত জ্ঞান আসার পরও তা তোমাদেরকে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করা থেকে নিষেধ করছে না। না, আল্লাহর শপথ! তাদের একজনকেও দেখিনি যে, সে তোমাদেরকে তোমাদের কাছে কি নাযিল হয়েছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। [বুখারী: ৭৩৬৩] সুতরাং আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে কোন কিছুতেই ইয়াহুদী-নাসারাদের কোন বর্ণনার প্রয়োজন আমাদের নেই।
১০:৩৮ اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ افۡتَرٰىهُ ؕ قُلۡ فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّثۡلِهٖ وَ ادۡعُوۡا مَنِ اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿
৩৮. নাকি তারা বলে, তিনি এটা রচনা করেছেন? বলুন, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য যাকে পার ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
এটা আল-কুরআনের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তৃতীয় চ্যালেঞ্জ। [ইবন কাসীর] তারা যদি কুরআন সম্পর্কে সন্দিহান হয় তবে তারা যেন এর মত একটি সূরা নিয়ে আসে। এর পূর্বে কাফেরদেরকে কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনার ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছিল।
বলুন, যদি কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনার জন্য মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরূপ আনতে পারবে না।[সূরা আল-ইসরাঃ ৮৮]
তারপর তাদেরকে বলা হয়েছিল যে,
অথবা তারা কি এটা বলে নাকি যে সে (মুহাম্মাদ) নিজেই এটা রচনা করেছে? (তাদের) বল, ‘যদি তাই হয়, তাহলে তোমরাও এর অনুরূপ (মাত্র) দশটি সূরাহ নিয়ে আসো এবং আল্লাহ্ ছাড়া তোমারা আর যাদের উপাসনা কর তাদেরকেও সাহায্য করতে বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” [সূরা হূদ: ১১:১৩]
কিন্তু তারা তাতেও অপারগ হয়।
তখন তাদেরকে এ আয়াতে কুরআনের সূরাসমূহের একটি সূরা নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করা হয় কিন্তু কাফের-মুশরিকগণ তাও আনতে সক্ষম হয়নি। আর তারা সেটা আনতে পারবেও না। [ইবন কাসীর]
আল্লাহ বলেন,
আর আমরা আমাদের বান্দার প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা এর অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর( এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাক্ষী সাহায্যকারীকে আহবান কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।[সূরা আল-বাকারাহ: ২৩
“অতএব যদি তোমরা তা করতে না পার আর কখনই তা করতে পারবে না” [সূরা আল-বাকারাহ: ২৪]
এ চ্যালেঞ্জ কুরআনের শুধু ভাষাশৈলীর উপর করা হয়নি। সাধারণভাবে লোকেরা এ চ্যালেঞ্জটিকে নিছক কুরআনের ভাষাশৈলী অলংকার ও সাহিত্য সুষমার দিক দিয়ে ছিল বলে মনে করে। কুরআন তার অনন্য ও অতুলনীয় হবার দাবীর ভিত্তি নিছক নিজের শাব্দিক সৌন্দর্য সুষমার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেনি। নিঃসন্দেহে ভাষাশৈলীর দিক দিয়েও কুরআন নজিরবিহীন। কিন্তু মূলত যে জিনিসটির ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, কোন মানবিক মেধা ও প্রতিভা এহেন কিতাব রচনা করতে পারে না, সেটি হচ্ছে তার বিষয়বস্তু, অলংকারিত ও শিক্ষা। [ইবন কাসীর]
অনেক অমুসলিম চেষ্টা করেছে কু’রআনের সূরার মতো সূরা তৈরি করার। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কুরআনের সূরার মতো নকল সূরা তৈরি করার। ইন্টারনেটে এরকম বানানো সূরা আপনি অনেক পাবেন। যেকোনো অভিজ্ঞ আরব ভাষাবিদকে দিয়ে আপনি সেগুলো দেখালেই সে আপনাকে বলে দিতে পারবে সেগুলো কতখানি হাস্যকর। কু’রআন হচ্ছে একমাত্র বই যেখানে একজন সমাজবিদ, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসাবিদ, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, ইতিহাসবিদ, আবহাওয়া-বিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, গৃহিণী, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভিক্ষুক, দাগি আসামী, মানসিক রোগী সবার জন্য বিশেষ ভাবে উপকার হবে, এমন কোনো না কোনো বাণী রয়েছে। এটি মানব জাতির ইতিহাসে একমাত্র বই, যা একটি বিশাল ভূখণ্ডে একই সাথে নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিপ্লব নিয়ে এসেছিল। এটি হচ্ছে একমাত্র বই, যেটা পড়ে মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে, একটা পুরো জাতি অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে পেরেছিল। মানুষের ইতিহাসে কোনো একটি বই, কখনও একই সাথে এতগুলো প্রেক্ষাপটে, এত বড় অবদান রাখতে পারেনি। একারণেই মানুষ এবং জ্বিন জাতি—যাদের সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা আছে—তাদের উভয়কেই, এই বইয়ের স্রস্টা মহান সৃষ্টিকর্তা নিজে চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, তারা কখনই এর ধারে কাছে কিছু কোনোদিন তৈরি করতে পারবে না।
এই চ্যালেঞ্জগুলা কিন্তু নিছক কথার কথা ছিল না যে, কেউ এর জবাব দিতে চায়নি কিংবা কোরআনকে ভুল প্রমাণিত করতে চায়নি। প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা:) মানুষদের আল্লাহ্র একত্ববাদ, সকল ধরণের মূর্তিপূজা বাতিল এবং দাস-দাসী ও মনিবের মধ্যে যে সাম্যবাদের ডাক দিচ্ছিলেন তা সাধারণভাবে মাক্কার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠী কুরাইশ গোত্রের জন্য তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। আরবের প্রধান বাণিজ্য ও ধর্মীয় কেন্দ্র মাক্কার অধিবাসীরা রাসূল (সা:) এর সেই সাম্যবাদের বিস্তার রোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ছিল। এর জন্য তাদের শুধু এটুকু করলেই চলত, যদি তারা কোরআনের অনুরূপ মাত্র একটি সূরা বানিয়ে আনতে পারত! বহু কুরাইশ কবি ও বাকপটু লোক উক্ত চ্যালেঞ্জের উত্তর দিয়ে গিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। চ্যালেঞ্জে ব্যর্থ হয়ে তারা বরঞ্চ তাঁকে অনেক সম্পদ, সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসন এমনকি গোত্রের সবচাইতে অভিজাত এবং সুন্দরী মেয়েদেরকে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। আর তা করেছিল শুধুমাত্র এই জন্যে যে, যাতে তিনি ইসলামের এই দা’ওয়াত বন্ধ করে দেন।
উল্টো তিনি তাদের সূরা ফুসসিলাত এর প্রথম তেরটি আয়াতের আবৃত্তির মাধ্যমে তাদের জবাব দেন। এতে তারা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে তাঁকে থামতে বলেন [ আল হাকীম, আল-বাইহাক্বী, আবূ ইয়’লা ও ইবন্ হিশাম কর্তৃক সংগৃহীত, ইব্রহীম আল-‘আলী তাঁর সহীহ্ আস-সীরাহ্ আন-নাবাওয়ীয়্যাহ-তে এই বর্ণনাকে ‘হাসান’ বলেছেন, পৃঃ৬৪]। প্রিয় নবী (সা:) কে প্ররোচিত করতে ব্যর্থ হয়ে কুরাইশরা তাদের দাস-দাসী ও আত্মীয়দের মধ্যে যারা ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করছিল, তাদেরকে পৌত্তলিক ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য নির্যাতন করে যাচ্ছিল। যদিও তারা ইসলাম থেকে ফিরে আসেননি।
একজন কবি যতই বড় হোকনা কেন, এভাবে ঠিকই তাঁর রচনাশৈলীর অনুকরণ করা যায়। অনেক বড় এবং বিখ্যাত চিত্রকরের চিত্রকর্ম ঠিক যেমন অনুকরণ করা সম্ভব হয়েছে। [প্রকৃত পক্ষে অনেক ইংরেজ সাহিত্যিকদের মতে শেক্সপীয়ার এর সাহিত্যকর্ম হিসেবে যেগুলা ধরা হয়, তার বেশকিছু আসলে তারই সমসাময়িক লেখক ক্রিস্টোফার মার্ল এর লেখা।] কোরআন এই ক্ষেত্রে অনেক বেশীই উপরে। কেননা, ১৪০০ বছর আগ থেকে এখন পর্যন্ত অনেকেই কোরআন এর অনুরূপ সূরা নকল করে লেখার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভাল করে পরীক্ষা করার পর দেখা গেছে ওগুলো নিরর্থক পণ্ডশ্রম; নান্দনিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কোরআনের সামান্য একটি আয়াতের ধারেকাছে যাওয়ারও ক্ষমতা এদের নেই। যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তখন কোরআন এর অনুকরণ করার চেষ্টা ছিল এখনকার যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় সময়ের দাবি, যখন কোরআন নাযিল হচ্ছিল, যখন সাহিত্যের চর্চা ছিল সর্বোচ্চ শিখরে। অথচ তখনই কেউ এর অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি, আর এখনতো প্রশ্নই উঠে না! (ডঃ আবু আমীনাহ বিলাল ফিলিপস্) |
১০:৩৯ بَلۡ کَذَّبُوۡا بِمَا لَمۡ یُحِیۡطُوۡا بِعِلۡمِهٖ وَ لَمَّا یَاۡتِهِمۡ تَاۡوِیۡلُهٗ ؕ کَذٰلِکَ کَذَّبَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿
৩৯. বরং তারা যে বিষয়ের জ্ঞান আয়ত্ত করেনি তাতে মিথ্যারোপ করেছে, আর যার প্রকৃত পরিণতি এখনো তাদের কাছে আসে নি। এভাবেই তাদের পূর্ববতীরাও মিথ্যা আরোপ করেছিল, কাজেই দেখুন, যালিমদের পরিণাম কি হয়েছে!
অর্থাৎ তারা কুরআনকে এ জন্যই মিথ্যা সাব্যস্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে যে, তারা এটাকে বুঝতে পারেনি, চিনতে পারেনি। [কুরতুবী] তাদের অজ্ঞতাই কুরআনকে মানতে নিষেধ করছে। অন্য আয়াতেও আল্লাহ এ রকম কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “আর যখন তারা এটা দ্বারা হেদায়াত পায়নি তখন তারা অচিরেই বলবে, এ এক পুরোনো মিথ্যা।” [সূরা আল-আহকাফ: ১১]
(২) এখানে تَأْوِيلُهُ এর মর্মার্থ হলো প্রতিফল ও শেষ পরিণতি। অর্থাৎ এরা নিজেদের গাফলতী ও নির্লিপ্ততার দরুন কুরআন সম্পর্কে কোন চিন্তা-ভাবনা করেনি। তারা একটু চিন্তা করতে পারত যে পূর্ববর্তী যে সমস্ত সংবাদ এ কুরআন দিয়েছে তা সত্য কি না? বা ভবিষ্যতের যে সমস্ত সংবাদ দিচ্ছে তা সঠিকভাবে ঘটে কি না? কিন্তু তারা কোন কিছু ভাল করে বুঝার আগে তা অস্বীকার করে বসেছে। ফলে এর প্রতি মিথ্যারোপে লিপ্ত রয়েছে। যদি তারা সত্যিকারভাবে এটা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করত তাহলে অবশ্যই কুরআনকে বুঝতে পারত। আর এটাও বুঝত যে, এটা আল্লাহর বাণী। [ফাতহুল কাদীর]
আর যে বিষয়ে তাদের জ্ঞান কাজ করে না যেমন পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম, ইত্যাদি সেগুলোকে তারা অস্বীকার করে বসেছে, সেগুলোর সাথে কুফরি করেছে, অথচ এখনও কিতাবে তাদের উপর যা আপতিত হওয়ার ওয়াদা করা হচ্ছে তার প্রকৃত অবস্থা আসেনি। আর এ মুশরিকরা যেভাবে আল্লাহর ভীতি প্রদর্শনে মিথ্যারোপ করেছে তাদের পূর্বেকার উম্মতরাও তা অস্বীকার করেছিল। [মুয়াস্সার]
১০:৪০ وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ یُّؤۡمِنُ بِهٖ وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ لَّا یُؤۡمِنُ بِهٖ ؕ وَ رَبُّکَ اَعۡلَمُ بِالۡمُفۡسِدِیۡنَ
৪০. আর তাদের মধ্যে কেউ এর উপর ঈমান আনে আবার কেউ এর উপর ঈমান আনে না এবং আপনার রব ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের সম্বন্ধে অধিক অবগত।
অর্থাৎ যারা কুরআনে মিথ্যারোপ করে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের অন্তরে এর প্রতি ঈমান পোষণ করে এবং ভাল করেই জানে যে, এটি সত্য ও হক। কিন্তু সে অহংকার ও গোঁড়ামী করে তাতে মিথ্যারোপ করে থাকে। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা এর উপর অন্তর থেকেই অবিশ্বাসী। তারা মূলত না জেনে এর উপর মিথ্যারোপ করছে। অথবা আয়াতের অর্থ, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন এ কুরআনে মিথ্যারোপ করলেও ভবিষ্যতে ঈমান আনবে। আবার কেউ কেউ ভবিষ্যতেও এর উপর ঈমান আনবে না বরং অস্বীকার ও অবিশ্বাসের উপর অটল থাকবে। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে কুরআনকে বোঝানো হয়নি। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বোঝানো হয়েছে। তখনও উপরে বর্ণিত উভয় প্রকার অর্থ হতে পারে। তাছাড়া কারও কারও মতে, আয়াতটি মক্কাবাসীদের সাথে নির্দিষ্ট। অপর কারও কারও মতে সেটি সকল কাফেরের জন্য ব্যাপক। [ফাতহুল কাদীর]
যারা ঈমান আনবে না
নিশ্চয় যারা কাফের হয়েছে, তাদের আপনি ভয় দেখান বা না দেখান, উভয়ই তাদের জন্য সমান, তারা ঈমান আনবে না (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ২:৬)।
তোমরা (হে ঈমানদারগণ!) কি আশা কর যে, তারা (ইয়াহুদীগণ) তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের (ইয়াহুদীদের) মধ্যে তো একদল ছিল, যারা আল্লাহর বানী শুনত, তারপর হৃদয়ংগম করে তা বিকৃত করত তারা সজ্ঞানে (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ২:৭৫)।
আপনি জিজ্ঞেস করুনঃ আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তার মালিকানা কার? আপনিই বলে দিনঃ আল্লাহর। তিনি (আল্লাহ) অনুগ্রহ করাকে নিজের উপর কর্তব্য হিসেবে স্থির করে নিয়েছেন। তিনি অবশ্যই তোমাদের একত্র করবেন কেয়ামতের দিন, এতে কোন সন্দেহ নেই। যারা নিজেরা নিজেদের ক্ষতি করেছে তারা ঈমান আনবে না (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ৬:১২)।
আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ আপনার দিকে কান পেতে রাখে। আমি তাদের অন্তরের উপর পর্দা ফেলে রেখেছি যেন তারা তা বুঝতে না পারে এবং তাদের কানে ছিপি ভরে দিয়েছি। যদি তারা সকল নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে তবুও তারা তাতে ঈমান আনবে না। এমনকি তারা যখন আপনার কাছে এসে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, তখন কাফেররা বলেঃ এ তো পূর্ববর্তীদের কিচ্ছা কাহিনী ছাড়া আর কিছু নয় (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ৬:২৫)। আনয়ামঃ২৫
আর তারা আল্লাহর নামে শক্ত কসম করে বলে, যদি তাদের কাছে কোন নিদর্শন আসে, তবে অবশ্যই তারা তাতে ঈমান আনবে। আপনি বলুনঃ নিদর্শনাবলী তো একমাত্র আল্লাহর অধিকারে। কিভাবে তোমাদের বুঝান যাবে যে, নির্দশনাবলী তাদের কাছে এসে গেলেও তারা ঈমান আনবে না (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ৬:১০৯)?
আমি ফিরিয়ে দেব আমার আয়াতসমূহ থেকে তাদের যারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার করে বেড়ায়। তারা যদি প্রতিটি নিদর্শনও দেখে তবুও তারা তাতে ঈমান আনবে না। যদি তারা সৎপথ দেখতে পায় তবুও তারা সে পথকে পথরূপে গ্রহণ করবে না, অথচ যদি তারা ভ্রান্ত পথ দেখতে পায় তবে তাকেই পথ হিসেবে গ্রহণ করবে। তা এ কারণে যে, তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, আর তারা (কাফেরগণ) ছিল সে সম্বন্ধে গাফেল (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ৭:১৪৬)। আরাফঃ১৪৬
এভাবে সত্য প্রমাণিত হল আপনার রবের বাণী ফাসিকদের সম্পর্কে যে, তারা ঈমান আনবে না (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ১০:৩৩)। ইউনুসঃ৩৩
এবং আপনি কখনও তাদের দলভূক্তও হবেন না যারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করেছে, তাহলে আপনিও ক্ষতিগ্রস্তদের শামিল হয়ে পড়বেন। নিশ্চয় যাদের ব্যাপারে আপনার রবের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে তারা ঈমান আনবে না (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ১০:৯৫-৯৬)।
যেন আপনি সতর্ক করেন এমন লোকদেরকে, যাদের পূর্বপুরুষদেরকে সতর্ক করা হয়নি, ফলে তারা গাফেল রয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশের জন্য বাণী অবধারিত হয়ে আছে। সুতরাং তারা ঈমান আনবে না (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ৩৬:৬-৭)। ইয়াসীনঃ ৬-৭
আপনি তাদেরকে সতর্ক করেন কিংবা সতর্ক না করেন, তাদের পক্ষে উভয়ই সমান, তারা ঈমান আনবে না (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ৩৬:১০-১২)।
এরপর আল্লাহ বলছেন যে, তিনি বিপর্যয়সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে অধিক অবগত। সে অনুসারে তাদেরকে তিনি প্রতিফল দিবেন। যারা গোঁড়ামী করে কুফরিতে অটল রয়েছে তিনি তাদের ভাল করেই জানেন। অথবা আয়াতের অর্থ, যারা ঈমান আনবে আর যারা ঈমান আনবে না তাদের সবাইকে তিনি ভালভাবে জানেন। তাদের মধ্যে যারা বিপর্যয়সৃষ্টিকারী তাদের সম্পর্কে তিনি সম্যক অবগত। অনুরূপভাবে কারা অন্তরে ঈমান থাকার পরও মুখে স্বীকার করছে না, আর কারা অন্তর থেকেই না জেনে এর উপর কুফরী করছে তিনি সবাইকে ভালভাবেই জানেন। [ফাতহুল কাদীর]
সংগ্রহে-
তাফসিরে জাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন, আহসানুল বায়ান