সূরা আল বাকারাঃ ১ম রুকু (আয়াত সংখ্যাঃ১-৭)

 সূরা আল বাকারাঃ ১ম রুকু (আয়াত সংখ্যাঃ১-৭)

Quran Academy

 

২:২ ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚۖۛ فِیۡهِ ۚۛ هُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ۙ     ২:১ الٓـمّٓ ۚ

২:৩ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ

২:৪ وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ هُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ

২:৫ اُولٰٓئِکَ عَلٰی هُدًی مِّنۡ رَّبِّهِمۡ ٭ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ

২:৬ اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا سَوَآءٌ عَلَیۡهِمۡ ءَاَنۡذَرۡتَهُمۡ اَمۡ لَمۡ تُنۡذِرۡهُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ

২:৭ خَتَمَ اللّٰهُ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ وَ عَلٰی سَمۡعِهِمۡ ؕ وَ عَلٰۤی اَبۡصَارِهِمۡ غِشَاوَۃٌ ۫ وَّ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ

১. আলিফ-লাম-মীম

২। এটা সে কিতাব; যাতে কোন সন্দেহ নে, মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত,

৩. যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে , সালাত কায়েম করে এবং তাদেরকে আমরা যা দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।

৪। আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে এবং যা আপনার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে, আর যারা আখেরাতে নিশ্চিত বিশ্বাসী

৫. তারাই তাদের রব-এর নির্দেশিত হেদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।

৬. যারা কুফরী করেছে আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন বা না করুন তারা ঈমান আনবে না।

৭।আল্লাহ তাদের হৃদয়সমূহ ও তাদের শ্রবনশক্তির উপর মোহর করে দিয়েছেন, এবং তাদের দৃষ্টির উপর রয়েছে আবরণ। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।

 

১. আলিফ-লাম-মীম

আলিফ, লাম, মীমঃ এ হরফগুলোকে কুরআনের পরিভাষায় হরফে মুকাত্তা’আত’ বলা হয়। উনত্রিশটি সূরার প্রারম্ভে এ ধরনের হরফে মুকাত্তা’আত ব্যবহার করা   হয়েছে। এগুলোর সংখ্যা ১৪ টি।

একত্র করলে দাঁড়ায়: نَصُّ حَكِيْمٌ قَاطِعٌ لَهُ سِرٌ “প্রাজ্ঞ সত্বার পক্ষ থেকে অকাট্য বাণী যাতে তার কোন গোপন ভেদ রয়েছে”। মূলতঃ এগুলো কতগুলো বিচ্ছিন্ন বর্ণ দ্বারা গঠিত এক-একটা বাক্য, যথা المص – حم – الم  এ অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথকভাবে সাকিন করে পড়া   হয়ে  থাকে। যথা  الف – لام – ميم (আলিফ-লাম-মীম্)। এ বর্ণগুলো তাদের নিকট প্রচলিত ভাষার বর্ণমালা হতে গৃহীত। যা দিয়ে তারা কথা বলে এবং শব্দ তৈরী করে। কিন্তু কি অর্থে এবং এসব আয়াত বর্ণনার কি রহস্য রয়েছে এ ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বমোট প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে চারটি:

১) এগুলোর কোন অর্থ নেই, কেবলমাত্র আরবী বর্ণমালার হরফ হিসেবে এগুলো পরিচিত।

২) এগুলোর অর্থ আছে কিনা তা আল্লাহই ভাল জানেন, আমরা এগুলোর অর্থ সম্পর্কে কিছুই জানিনা। আমরা শুধুমাত্র তিলাওয়াত করবো।

৩) এগুলোর নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে, কারণ কুরআনের কোন বিষয় বা কোন আয়াত বা শব্দ অর্থহীনভাবে নাযিল করা হয়নি। কিন্তু এগুলোর অর্থ শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলাই জানেন। অন্য কেউ এ আয়াতসমূহের অর্থ জানেনা, যদি কেউ এর কোন অর্থ নিয়ে থাকে তবে তা সম্পূর্ণভাবে ভুল হবে। আমরা শুধু এতটুকু বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ্ তা’আলা তার কুরআনের কোন অংশ অনর্থক নাযিল করেননি।

৪) এগুলো মুতাশাবিহাত বা অস্পষ্ট বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। এ হিসাবে অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও ওলামার মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত মত হচ্ছে যে, হরফে মুকাত্তা’আতগুলো এমনি রহস্যপূর্ণ যার প্রকৃত মর্ম ও মাহাত্ম্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই জানেন। কিন্তু মুতাশবিহাত আয়াতসমূহের প্রকৃত অর্থ আল্লাহ্ তা’আলার কাছে থাকলেও গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমগণ এগুলো থেকে হেদায়াত গ্রহণ করার জন্য এগুলোর বিভিন্ন অর্থ করেছেন। কোন কোন তাফসীরকারক এ হরফগুলোকে সংশ্লিষ্ট সূরার নাম বলে অভিহিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, এগুলো আল্লাহর নামের তত্ত্ব বিশেষ। আবার অনেকে এগুলোর স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন অর্থও করেছেন। যেমন আলেমগণ الم এ আয়াতটি সম্পর্কে নিম্নোক্ত মতামত প্রদান করেছেনঃ

১) এখানে আলিফ দ্বারা আরবী বর্ণমালার প্রথম বর্ণ যা মুখের শেষাংশ থেকে উচ্চারিত হয়, লাম বর্ণটি মুখের মধ্য ভাগ থেকে, আর মীম বর্ণটি মুখের প্রথম থেকে উচ্চারিত হয়, এ থেকে আল্লাহ্ তা’আলা উদ্দেশ্য নিয়েছেন যে এ কুরআনের শব্দগুলো তোমাদের মুখ থেকেই বের হয়, কিন্তু এগুলোর মত কোন বাক্য আনতে তোমাদের সামর্থ্য নেই।

২) এগুলো হলো শপথ বাক্য। আল্লাহ তা’আলা এগুলো দিয়ে শপথ করেছেন।

৩) এগুলো কুরআনের ভূমিকা বা চাবির মত যা দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা তার কুরআনকে শুরু করেন।

৪) এগুলো কুরআনের নামসমূহ হতে একটি নাম।

৫) এগুলো আল্লাহর নামসমূহের একটি নাম।

৬) এখানে আলিফ দ্বারা أنا (আমি) আর লাম দ্বারা আল্লাহ এবং মীম দ্বারা أعْلَمُ (আমি বেশী জানি), অর্থাৎ আমি আল্লাহ এর অর্থ বেশী জানি।

৭) আলিফ দ্বারা আল্লাহ, লাম দ্বারা জিবরীল, আর মীম দ্বারা মুহাম্মাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বোঝানো হয়েছে। [দেখুন, তাফসীর ইবনে কাসীর ও আত-তাফসীরুস সহীহ]

৮) এভাবে এ আয়াতের আরও অনেকগুলো অর্থ করা হয়েছে। তবে আলেমগণ এসব আয়াতের বিভিন্ন অর্থ উল্লেখ করলেও এর কোন একটিকেও অকাট্যভাবে এগুলোর অর্থ হিসেবে গ্রহণ করেননি। এগুলো উল্লেখের একমাত্র কারণ আরবদেরকে অনুরূপ রচনার ক্ষেত্রে অক্ষম ও অপারগ করে দেয়া। কারণ এ বর্ণগুলো তাদের ব্যবহৃত ভাষার বর্ণমালা এবং তারা যা দিয়ে কথা বলে থাকে ও শব্দ তৈরী করে থাকে, তা থেকে নেয়া হয়েছে।

৯) মোটকথা, এ শব্দ দ্বারা আমরা বিভিন্ন অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে হেদায়াতের আলো লাভ করতে পারি, যদিও এর মধ্যকার কোন অর্থ আল্লাহ তা’আলা উদ্দেশ্য নিয়েছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে আমরা জানি না। তবে এ কথা সুস্পষ্ট যে, কুরআন থেকে হিদায়াত লাভ করা এ শব্দগুলোর অর্থ বুঝার উপর নির্ভরশীল নয়। অথবা, এ হরফগুলোর মানে না বুঝলে কোন ব্যক্তির সরল-সোজা পথ লাভের মধ্যে গলদ থেকে যাবে এমন কোন কথাও নেই। তাই এর অর্থ নিয়ে ব্যাকুল হয়ে অনুসন্ধান করার অতবেশী প্রয়োজনও নেই। তাফসীরে জাকারিয়া

 

২. এটা সে কিতাব; যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত,

 

ذَٰلِكَ শব্দের অর্থ- ঐটা, সাধারণতঃ কোন দূরবতী বস্তুকে ইশারা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এখানে ذَٰلِكَ দ্বারা কি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে এ ব্যাপারে আলেমগণ থেকে কয়েকটি মত বর্ণিত হয়েছেঃ

১) ذَٰلِكَ শব্দের অর্থ তাওরাত ও ইঞ্জিল বুঝানো হয়েছে, তখন তার অর্থ হবেঃ হে মুহাম্মাদ (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঐ কিতাব যা আমি তাওরাত ও ইঞ্জিলে উল্লেখ করেছিলাম, তা-ই আপনার উপর নাযিল করেছি। অথবা, হে ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়! তোমাদেরকে যে কিতাবের ওয়াদা আমি তোমাদের কিতাবে করেছি সেটা এই কিতাব যা আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নাযিল করেছি।

২) এখানে ذَٰلِكَ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এ আয়াতসমূহের পূর্বে মক্কা ও মদীনায় নাযিল কুরআনের অন্যান্য সূরা ও আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করা। আর যেহেতু সেগুলো আগেই গত হয়েছে, সেহেতু এ দ্বারা সম্বোধন শুদ্ধ হয়েছে।

৩) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এখানে কিতাব বলতে ঐ কিতাবকে বুঝিয়েছেন, যা আল্লাহ তা’আলা তাঁর কাছে রেখে দিয়েছেন। যা লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত।

৪) এখানে কিতাব দ্বারা ঐ কিতাব উদ্দেশ্য, যাতে আল্লাহ্ তা’আলা বান্দার ভাল-মন্দ, রিযক, আয়ু ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

৫) এখানে ঐ কিতাব বুঝানো হয়েছে যা তিনি নিজে লিখে রেখেছেন তাঁর কাছে আরশের উপর, যেখানে লেখা আছে, “আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রাধান্য পাবে”। [বুখারী: ৭৫৫৩, মুসলিম: ২৭৫১]

৬) الم দ্বারা যদি পবিত্র কুরআন বুঝানো হয়ে থাকে, অর্থাৎ কুরআনের নাম হয়ে থাকে, তাহলে ذَٰلِكَ الْكِتَاب দ্বারা الم বুঝানো হয়েছে।

৭) এখানে ذلك দ্বারা هذا বুঝানো হয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] অর্থাৎ এই কিতাব যার আলোচনা হচ্ছে, বা সামনে আসছে। সুতরাং এর দ্বারা কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। আর এ শেষোক্ত মতই সবচেয়ে বেশী বিশুদ্ধ। সুতরাং الْكِتَاب দ্বারা কুরআন মাজীদকে বোঝানো হয়েছে।

যেমন অন্য আয়াতে এসেছে, ;এ কিতাবের অবতরণ বিশ্বপালনকর্তার নিকট থেকে এতে কোন সন্দেহ নেই।’’ (সূরা সাজদা ২) কোন কোন আলেমগণ বলেছেন, বাক্যটি ঘোষণামূলক হলেও তার অর্থ নিষেধমূলক। অর্থাৎ, لاَ تَرتَابُوا فِيهِ (এতে সন্দেহ করো না)।

এ আয়াতে উল্লেখিত ريب শব্দের অর্থ এমন সন্দেহ যা অস্বস্তিকর। এ আয়াতের বর্ণনায় মুফাসসিরগণ বিভিন্ন মত পোষন করেছেনঃ

১) এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এ কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে।

২) তোমরা এ কুরআনের মধ্যে কোন সন্দেহ করো না। [ইবনে কাসীর]

৩) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এর অর্থ তোমরা এ কুরআনের মধ্যে কোন সন্দেহে নিপতিত হবে না। অর্থাৎ এর সবকিছু স্পষ্ট।

৪) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ যদি কিতাব দ্বারা ঐ কিতাব উদ্দেশ্য হয়, যাতে আল্লাহ্ তা’আলা সবকিছুর ভালমন্দ হওয়া লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তাহলে لَا رَيْبَ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এতে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন নেই।

 

‘মুত্তাকীন’ শব্দটি ‘মুত্তাকী’-এর বহুবচন। মুত্তাকী শব্দের মূল ধাতু তাকওয়া।

তাকওয়া হলো, নিরাপদ থাকা, নিরাপত্তা বিধান করা। শরীআতের পরিভাষায় তাকওয়া হলো, বান্দা যেন আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, আর তা করতে হলে যা করতে হবে তা হলো, তাঁর নির্দেশকে পুরোপুরি মেনে নেয়া, এবং তাঁর নিষেধকৃত বস্তুকে পুরোপুরি ত্যাগ করা। আর মুত্তাকী হলেন, যিনি আল্লাহর আদেশকে পুরোপুরি মেনে নিয়ে এবং তার নিষেধ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থেকে তাঁর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। [ইবনে কাসীর]

বর্ণিত আছে যে, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনি কি কখনো কাঁটাযুক্ত পথে চলেছেন? তিনি বললেন, অবশ্যই। উবাই বললেন, কিভাবে চলেছেন? উমর বললেন, কাপড় গুটিয়ে অত্যন্ত সাবধানে চলেছি। উবাই বললেনঃ এটাই হলো, তাকওয়া। [ইবনে কাসীর] তবে প্রশ্ন হতে পারে যে, মুত্তাকীগণকে কেন হেদায়াত প্রাপ্তির জন্য নির্দিষ্ট করেছেন? এ ব্যাপারে আলেমগণ বলেন, মূলতঃ মুত্তাকীরাই আল্লাহর কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করতে পারেন, অন্যান্য যারা মুত্তাকী নন তারা হেদায়াত লাভ করতে পারেন না। যদিও কুরআন তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেন। আর পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এ অর্থের উপর প্রমাণবহ।

আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় এ কুরআন হিদায়াত করে সে পথের দিকে যা আকওয়াম তথা সুদৃঢ় এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার”। [সূরা আল-ইসরা ৯]

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, এ কুরআন তাদের জন্য হিদায়াত যারা হেদায়াত চেনার পর তা গ্রহণ না করার শাস্তির ভয়ে সদা কম্পমান। আর তারা তাঁর কাছ থেকে যা এসেছে তার সত্যায়নের মাধ্যমে রহমতের আশাবাদী। [তাফসীরে ইবনে কাসীর ও আত-তাফসীরুস সহীহ]

তাছাড়া হিদায়াতের কোন শেষ নেই, মুত্তাকীরা সর্বদা আল্লাহর নাযিল করা হেদায়াতের মুখাপেক্ষী বিধায় হেদায়াতকে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তবে অন্যান্য আয়াতে কুরআনকে সমস্ত মানবজাতির জন্য হেদায়াতকারী বলে উল্লেখ করেছেন, সেখানে এর অর্থ হলো, হিদায়াতের পথ তাদের দেখাতে পারে যদি তারা তা থেকে হিদায়াত নিতে চায়।

আর এভাবে মানুষ, জীব-জনোয়ার ও গৃহপালিত জন্তুও বিভিন্ন বর্ণের রয়েছে।আসল ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একমাত্র জ্ঞান সম্পন্নরাই তাঁকে ভয় করে।নিঃসন্দেহে আল্লাহ‌ পরাক্রমশালী এবং ক্ষমাশীল।{ফাতেরঃ ২৮ }

 

 ৩। যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে , সালাত কায়েম করে এবং তাদেরকে আমরা যা দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।

غيب এর অর্থ হচ্ছে এমনসব বস্তু যা বাহ্যিকভাবে মানবকুলের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে এবং যা মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারে না, চক্ষু দ্বারা দেখতে পায় না, কান দ্বারা শুনতে পায় না, নাসিকা দ্বারা ঘ্রাণ নিতে পারে না, জিহবা দ্বারা স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না, হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারে না, ফলে সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভও করতে পারে না।

কুরআনে غيب শব্দ দ্বারা সে সমস্ত বিষয়কেই বোঝানো হয়েছে যেগুলোর সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন এবং মানুষ যে সমস্ত বিষয়ে স্বীয় বুদ্ধিবলে ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান লাভে সম্পূর্ণ অক্ষম। এখানে غيب শব্দ দ্বারা ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তা, সিফাত বা গুণাবলী এবং তাকদীর সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, জান্নাত-জাহান্নামের অবস্থা, কেয়ামত এবং কেয়ামতে অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাসমূহ, ফেরেশতাকুল, সমস্ত আসমানী কিতাব, পূর্ববর্তী সকল নবী ও রাসূলগণের বিস্তারিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত যা সূরা আল-বাকারাহর (آمَنَ الرَّسُولُ) আয়াতে দেয়া হয়েছে। এখানে ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আর এ সূরারই শেষে ২৮৫ নং আয়াতে ঈমানের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

. ঈমান এবং গায়েব। শব্দ দুটির অর্থ যথার্থভাবে অনুধাবন করলেই ঈমানের পুরোপুরি তাৎপর্য ও সংজ্ঞা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হবে।

ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোন বিষয়ে মুখের স্বীকৃতির মাধ্যমে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা এবং তা কাজে পরিণত করা। এখানে ঈমানের তিনটি দিক তুলে ধরা হয়েছে।

প্রথমতঃ অন্তরে অকপট চিত্তে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা।

দ্বিতীয়তঃ সে বিষয়ের স্বীকৃতি মুখে দেয়া।

তৃতীয়তঃ কর্মকাণ্ডে তার বাস্তাবায়ন করা। শুধু বিশ্বাসের নামই ঈমান নয়। কেননা খোদ ইবলিস, ফিরআউন এবং অনেক কাফেরও মনে মনে বিশ্বাস করত। কিন্তু না মানার কারণে তারা ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।

তদ্রুপ শুধু মুখে স্বীকৃতির নামও ঈমান নয়। কারণ মুনাফেকরা মুখে স্বীকৃতি দিত। বরং ঈমান হচ্ছে জানা ও মানার নাম। বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকৃতি দেয়া এবং কার্যে পরিণত করা -এ তিনটির সমষ্টির নাম ঈমান।

তাছাড়া ঈমান বাড়ে ও কমে। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে ঈমান বিল-গায়েব অর্থ এই দাঁড়ায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হেদায়াত এবং শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, সে সবগুলোকে আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া। তবে শর্ত হচ্ছে যে, সেগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা হিসেবে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হতে হবে। আহলে-ইসলামের সংখ্যাগরিষ্ট দল ঈমানের এ সংজ্ঞাই দিয়েছেন। [ইবনে কাসীর]

‘ঈমান বিল-গায়েব’ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘গায়েবের বিষয়াদির উপর ঈমান আনার চেয়ে উত্তম ঈমান আর কারও হতে পারে না। তারপর তিনি এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৬০]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনার সাথে জিহাদ করেছি, আমাদের থেকে উত্তম কি কেউ আছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তারা তোমাদের পরে এমন একটি জাতি, যারা আমাকে না দেখে আমার উপর ঈমান আনবে [সুনান দারমী: ২/৩০৮, মুস্তাদরাকে হাকিম: ৪/৮৫]

মূলত: এটি ঈমান বিল গায়েব এর একটি উদাহরণ। সাহাবা, তাবেয়ীনদের থেকে বিভিন্ন বর্ণনায় ঈমান বিল গায়েবের বিভিন্ন উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। কেউ বলেছেন, কুরআন। আবার কেউ বলেছেন, জান্নাত ও জাহান্নাম। [আত-তাফসীরুস সহীহ: ৯৯]

এ সবগুলোই ঈমান বিল গায়েবের উদাহরণ। ঈমানের ছয়টি রুকন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি ঈমান বিল গায়েবের মূল অংশ।

ইমান বিল-গায়েব বলতে বুঝায়, যা কিছু মানুষের জানা নেই তা কোন জ্ঞানী লোকের কাছে থেকে জেনে নিয়ে তার উপর প্রত্যয় পোষণ করবে। আল্লাহ তা’য়ালার সত্তা ও গুণরাজি সম্পর্কে মানুষ কিছুই অবগত নয়। তাঁর ফিরেশতারা তাঁর হুকুম অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন এবং সব দিক দিয়ে মানুষকে ঘিরে রয়েছেন, তাও কেউ জানে না। আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করার পন্থা কি তার খবরও কারো জানা নেই।আখেরাতের জীবনের সঠিক অবস্থা সকলেরই অজ্ঞাত। এর সবকিছুর জ্ঞান মানুষকে এমন এক লোকের কাছ থেকে হাসিল করতে হবে, যাঁর বিশ্বস্ততা, সত্যনিষ্ঠা, সরলতা আল্লাহভীতি, পাক-পবিত্র জীবন ও জ্ঞানগর্ব আলোচনা তার মনে বিশ্বাস জন্মাবে যে, তিনি যা বলেন, তা নির্ভুল এবং তার সব কথাই প্রত্যেয়ের যোগ্য, একেই বলে ঈমান বিল-গায়েব। আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্য ও তার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার জন্য ঈমান বিল-গায়েব অপরিহার্য, কেননা পয়গাম্বর ব্যতিত অপর কোন মাধ্যম দ্বারা সঠিক জ্ঞান লাভ করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব এবং সঠিক জ্ঞান ব্যতীত ইসলামের পথে সঠিকভাবে চলাও সম্ভব হবে না।

ঈমান ও ইসলামের দিক দিয়ে বিচার করলে গোটা মানব- সমাজকে চার শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে :

একঃ

যাদের ভিতরে ঈমান রয়েছে এবং তাদের ঈমান তাদেরকে আল্লাহর আদেশ-নিষেধের পূর্ণ অনুগত করে দেয়। যেসব কাজ আল্লাহ অপছন্দ করেন তা থেকে তারা এমন করে দূরে থাকে, যেমন মানুষ আগুনের স্পর্শ থেকে দূরে থাকে। যা কিছু আল্লাহ পছন্দ করেন তা তারা তেমনি উৎসাহের সাথে করে যায় যেমন করে মানুষ ধন-দৌলত কামাই করবার জন্য উৎসাহ সহকারে কাজ করে যায়। এরাই হচ্ছে সত্যিকারের মুসলমান।

দুই:

যাদের ভিতরে ঈমান রয়েছে, কিন্তু তাদের ঈমান এতটা শক্তিশালী নয় যে, তা তাদেরকে পুরোপুরি আল্লাহর আজ্ঞাবহ করে তুলবে। তারা কিছুটা নিম্নতর পর্যায়ের লোক হলেও অবশ্যি মুসলমান। তারা না-ফরমান হলেও অবশ্যি মুসলমান। তারা না-ফরমানী করলে নিজস্ব অপরাধের মাত্রা হিসাবে শাস্তির যোগ্য হবে, কিন্তু তারা অপরাধী হলেও বিদ্রোহী নয়। কারণ তারা বাদশাহকে বাদশাহ বলে মানে এবং তাঁর আইনকে আইন বলে স্বীকার করে।

তিন:

যাদের ঈমান নেই;কিন্তু প্রকাশ্যে তারা এমন সব কাজ করে, যা আল্লাহর আইন মুতাবিক বলে মনে হয়। প্রকৃত পক্ষে এরা বিদ্রোহী, এদের প্রকাশ্য সৎকর্ম প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর আনুগত্য ও আজ্ঞানুবর্তীতা নয়, তাই তার উপর নির্ভর করা চলে না। তাদের তুলনা চলতে পারে সেই শ্রেণীর লোকের সাথে, যারা বাদশাহকে বাদশাহ বলে মানে না, তার আইনকে আইন বলে গণ্য করে না। এ ধরনের লোকের কার্যকলাপ যদি আইন বিরোধী নাও হয়, তথাপি তাদেরকে বাদশাহর বিশ্বস্ত ও তাঁর আইনের অনুসারী বলতে পারা যায় না। তারা অবশ্যি বিদ্রোহীদের মধ্যেই গণ্য হবে।

চার:

যাদের ঈমান নেই এবং কর্মের দিক দিয়ে ও যারা দুর্জন ও দুষ্কৃতিকারী। এরাই হচ্ছে নিকৃষ্টতম স্তরের লোক, কেননা এরা যেমন বিদ্রোহী তেমনি বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী।

মানব জাতির এ শ্রেণী বিভাগ থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে মানুষের সাফল্য নির্ভর করে একমাত্র ঈমানের উপর। ইসলাম-পূর্ণ হোক আর অপূর্ণ হোক- জন্ম নেয় একমাত্র ঈমানের বীজ থেকে। যেখানে ঈমান নেই সেখানে ঈমানের স্থান অধিকার করে কুফুর-আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তা তার তীব্রতা বেশী হোক আর কমই হোক।

ইসলামঃ

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সুসম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যএকমাত্র দীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৩]

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

﴿إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ﴾ [ال عمران: ١٩]

‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দীন হলো একমাত্র ইসলাম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত, ১৯]

“(হে নবী) বলে দিন, হে মানবমণ্ডলী, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যিনি সমগ্র আসমান ও যমিনের সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্যিকার উপাস্য নেই। তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। সুতরাং তোমরা ঈমান আন আল্লাহর ওপর, তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর ওপর, যিনি ঈমান রাখেন আল্লাহ ও তাঁর সমস্ত কালামের ওপর। তাঁর অনুসরণ কর, যাতে তোমরা সঠিক সরল পথপ্রাপ্ত হতে পার।’’ [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮]

সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘সেই মহান আল্লাহর কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, এই উম্মতের মধ্যকার লোক হোক সে ইয়াহূদী কিংবা খ্রিস্টান; যে লোক আমার আবির্ভাব সম্পর্কে অবহিত হবে, অতঃপর সে ইসলাম গ্রহণ ব্যতিরেকে মারা যাবে সে জাহান্নামে যাবে।”

ইসলাম হচ্ছে আক্বীদা ও শরী‘আতের সামষ্টিক নাম।

ইসলামী আক্বীদার ভিত্তিসমূহ যা পবিত্র কুরআনে কারীম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তা হলো: ৬টি

আল্লাহর ওপর, তাঁর ফিরিশতাগণের ওপর, তাঁর কিতাবসমূহের ওপর, তাঁর রাসূলগণের ওপর, শেষ দিবসের ওপর ও ভাল মন্দসহ তক্বদীরের প্রতি ঈমান স্থাপন করা।

উক্ত ভিত্তিসমূহের প্রমাণ কুরআনে কারীম ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহীহ সুন্নাহতে এসেছে।

যেমন, আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে বলেন,

﴿لَّيۡسَ ٱلۡبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ قِبَلَ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلۡكِتَٰبِ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ﴾ [البقرة: ١٧٧]

“সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাবে; বরং সৎকাজ হলো, ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামতদিবসের ওপর, ফিরিশতাদের ওপর, আসমানী কিতাবসমূহের ওপর এবং সমস্ত নবী-রাসূলগণের ওপর।’’ [সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ১৭৭]

আর তাক্বদীর সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّا كُلَّ شَيۡءٍ خَلَقۡنَٰهُ بِقَدَرٖ ٤٩ وَمَآ أَمۡرُنَآ إِلَّا وَٰحِدَةٞ كَلَمۡحِۢ بِٱلۡبَصَرِ ٥٠﴾ [القمر: ٤٩،  ٥٠]

“নিশ্চয় আমরা প্রত্যেকটি বস্তু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাণে (তাকদীর অনুযায়ী)। আমার কাজ তো সম্পন্ন হয় এক মুহুর্তে, চোখের পলকের মতো।’’ [সূরা আল-ক্বামার, আয়াত: ৪৯-৫০]

অনুরূপভাবে প্রসিদ্ধ হাদীসে জিবরীলে বর্ণিত আছে যে, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামকে ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, ‘‘ঈমান হলো, তুমি আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসূলগণের প্রতি, শেষ দিবসের প্রতি ও ভালো-মন্দসহ তাঁর তাক্বদীরের প্রতি ঈমান স্থাপন করবে।” [সহীহ মুসলিম]

আল্লাহর প্রতি ইমানঃ

ঈমানের প্রথম ভিত্তি হলো আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান

আল-ঈমান বিল্লাহ (الإيمان بالله) বা আল্লাহে বিশ্বাস অর্থ আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাস। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

তোমরা কি জান ঈমান বিল্লাহ বা আল্লাহে বিশ্বাস কী… এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর রাসূল। অন্য বর্ণনায়: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল।’

বুখারী, আস-সহীহ ১/২৯ (কিতাবুল ঈমান, বাবু আদায়িল খুমুসি মিনাল ঈমান), মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৮ (কিতাবুল ঈমান, বাবুল আমরি বিল ঈমান বিল্লাহ), তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়্যীন ১/৩৪৬; বূসীরী, ইতহাফুল খিয়ারাতিল মাহরাহ ১/১৩৫।

এখানে আমরা দেখছি যে, ঈমান বিল্লাহ বলতে আল্লাহর ইবাদতের একত্বে বিশ্বাস করা বুঝায়। আর এর অবিচ্ছেদ্য অংশ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের বিশ্বাস।

আল্লাহর ওপর ঈমানের মধ্যে চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:

এক: আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের ওপর ঈমান:

দুই: আল্লাহ তা‘আলার রবুবিয়্যাতের ওপর ঈমান:

আরবীতে একে ‘তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ্’ (توحيد الربوبية) ‘‘প্রতিপালনের একত্ব’’ বলা হয়। অর্থাৎ এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহই এ মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সংহারক, রিযিকদাতা, নিয়ন্ত্রক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

তিন: আল্লাহর উলূহিয়্যাতের ওপর ঈমান:

আরবীতে একে ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’ বা ‘তাওহীদুল ইবাদত’ বলা হয়। উলুহিয়্যাহ শব্দটি ‘ইলাহ’ থেকে গৃহীত। ‘‘ইলাহ (إله) শব্দের অর্থ ‘‘মাবুদ, অর্থাৎ উপাস্য বা পূজ্য। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ আহমদ ইবনু ফারিস (৩৯৫ হি) বলেন

‘হামযা, লাম ও হা=ইলাহ: ধাতুটির একটিই মূল অর্থ, তা হলো ইবাদত করা। আল্লাহ ‘ইলাহ কারণ তিনি মাবুদ বা ইবাদতকৃত। ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাইসিল্লুগাহ ১/১২৭।

আরবী ভাষায় সকল পূজিত ব্যক্তি, বস্ত্ত বা দ্রব্যকেই ‘ইলাহ’ বলা হয়। এজন্য সূর্যের আরেক নাম ‘আল-ইলাহাহ’ (الإلاهة); কারণ কোনো কোনো সম্প্রদায় সূর্যের উপাসনা বা পূজা করত। ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাইসিল্লুগাহ ১/১২৭; রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃ. ২১।

চার: আল্লাহর নাম ও তাঁর গুণাবলীর ওপর ঈমান:

তাওহীদুল আসমায়ি ওয়াস সিফাত’ (توحيد الأسماء والصفات) বা ‘নাম ও গুনাবলির তাওহীদ’ অর্থ: দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ সকল পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন হাদীসে আল্লাহর বিভিন্ন নাম ও বিশেষণের উল্লেখ করেছেন। এ সকল নাম ও বিশেষণের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে, সকল প্রকার বিকৃতি, অপব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহর কোনো কর্ম, গুণ বা বিশেষণ কোনো সৃষ্টজীবের কর্ম, গুণ বা বিশেষণের মত নয়, তুলনীয় নয় বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়

———-সংগৃহিতঃ

ফিত্বরাত, (স্বাভাবিক প্রকৃতি) যুক্তি ও শরী‘আত এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দলীল সবই আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের প্রমাণ করে,

(১) ফিত্বরাতের আলোকে আল্লাহর অস্তিত্ব:

আল্লাহর অস্তিত্বের ওপর ফিত্বরাত তথা স্বাভাবিক প্রকৃতিগত প্রমাণ হলো, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে চিন্তা ও শিক্ষা ছাড়াই স্রষ্টার ওপর ঈমান গ্রহণের যোগ্যতা নিহিত রেখেছেন। ফিত্বরাতের এ দাবী থেকে কেউ বিমুখ হয় না, যদি না সেখানে তা থেকে নিরোধকারী কোনো বিষয়ের প্রতিক্রিয়া পড়ে। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلاَ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ»

“প্রতিটি শিশুই ইসলামী ফিত্বরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু তার পিতা-মাতা তাকে ইয়াহূদী, খ্রিস্টান অথবা অগ্নিউপাসকে পরিণত করে।’’ [সহীহ বুখারী]

(২) বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তির আলোকে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ:

পূর্বাপর সৃষ্টি-জগতের সকল কিছু প্রমাণ করে যে, এসবকিছুর এমন একজন স্রষ্টা আছেন যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন। কেননা জগতের কোনো বস্তু নিজেই নিজকে অস্তিত্ব দান করেনি অথবা এসব কিছু হঠাৎ করেই আপনা-আপনি অস্তিত্ব লাভ করে নি। আর কোনো কিছুর নিজেই নিজেকে অস্তিত্ব দান করা কখনো সম্ভব নয়। কারণ, বস্তু কখনো নিজেই নিজকে সৃষ্টি করতে পারে না। কেননা, তা অস্তিত্ব লাভের পূর্বে ছিল অস্তিত্বহীন এবং যা ছিল অস্তিত্বহীন তা কীভাবে নিজের স্রষ্টা হতে পারে? আবার হঠাৎ করেই আপনা-আপনি অস্তিত্ব লাভ করাও সম্ভব নয়; কেননা প্রতিটি ঘটনার কোনো না কোনো ঘটক থাকে। আর সমগ্র বিশ্ব-জগৎ এবং এর মধ্যকার সকল ঘটনা- প্রবাহ এমন এক অভূতপূর্ব নিয়মে এবং একে অপরের সাথে সুন্দর ও সুচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে যে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ বিশ্বজগতের হঠাৎ করে আপনা-আপনি অভ্যুদয় ঘটে নি। হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো কিছু নিয়ম বহির্ভূতভাবে হয়ে থাকে, এর মূল কোনো নিয়ম থাকে না, তা হলে এ সৃষ্টি এত সুশৃঙ্খলভাবে দীর্ঘ পরিক্রমায় কীভাবে টিকে আছে? তাহলে সৃষ্টিজগত যখন নিজকে নিজে অস্তিত্ব দান করতে পারে নি এবং হঠাৎ করেও তা সৃষ্টি হয় নি, তাই এ থেকে প্রমাণিত হলো যে এর একজন স্রষ্টা আছেন, যিনি হলেন সমস্ত জগতের রব আল্লাহ।

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের সূরা আত্ব-তুরে এই যুক্তিসঙ্গত দলীল উল্লেখ করে বলেন,

﴿أَمۡ خُلِقُواْ مِنۡ غَيۡرِ شَيۡءٍ أَمۡ هُمُ ٱلۡخَٰلِقُونَ ٣٥ أَمۡ خَلَقُواْ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۚ بَل لَّا يُوقِنُونَ ٣٦ أَمۡ عِندَهُمۡ خَزَآئِنُ رَبِّكَ أَمۡ هُمُ ٱلۡمُصَۜيۡطِرُونَ ٣٧﴾ [الطور: ٣٥،  ٣٧]

‘‘তারা কি নিজেরাই আপনা-আপনি সৃষ্ট হয়ে গেছে, না তারা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা? না তারা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে না। তাদের কাছে কি আপনার পালনকর্তার ভাণ্ডার রয়েছে, নাকি তারাই সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক? [সূরা আত্ব-তূর, আয়াত: ৩৫-৩৭]

তাই জুবাইর ইবনুল মুত‘য়িম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘‘ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আমি একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাগরিবের সালাতে সূরা আত্ব-তূর পড়তে শুনি। তিনি যখন উল্লিখিত আয়াতে পৌঁছলেন তখন জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মনে হলো যেন আমার অন্তর উড়ে যাচ্ছে। তাঁর কুরআন শ্রবণের এটাই ছিল আমার প্রথম ঘটনা।” তিনি বলেন, “সে দিনই আমার অন্তরে ঈমান স্থান করে নিয়েছিল।’’ (বুখারী ভিন্ন ভিন্ন স্থানে তা বর্ণনা করেন)

আরেকটি উদাহরণ দিয়ে এ যুক্তিটাকে আরো স্পষ্ট ভাবে অনুধাবন করা যায়। যেমন, কোনো লোক যদি আপনাকে এমন একটি বিরাট প্রাসাদের কথা বলে যার চর্তুপাশ্বে বাগান, ফাঁকে-ফাঁকে রয়েছে প্রবাহমান নদ-নদী ও ঝর্ণাধারা, প্রাসাদে রয়েছে এর পূর্ণতা দানকারী সব সরঞ্জামাদি। অতঃপর যদি সে বলে যে, এ প্রাসাদ ও এর মধ্যে যে পরিপূর্ণতা রয়েছে সব কিছু নিজেই নিজকে সৃষ্টি করেছে বা আপনা-আপনি আকস্মিকভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে। তখন আপনি বিনা দ্বিধায় তা অস্বীকার করবেন, তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবেন বরং তার কথাকে বড় ধরনের বোকামী বলে আখ্যায়িত করবেন। তাহলে এ বিশাল আসমান, জমিন ও এতদুভয়ের মাঝে লক্ষ-লক্ষ অনুপম সৃষ্টি কি নিজেই নিজের স্রষ্টা বা স্রষ্টা ছাড়াই কি তা আপনা-আপনিই অস্তিত্ব লাভ করেছে?

(৩) শরী‘আতের আলোকে আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের প্রমাণ:

সকল আসমানীগ্রন্থে আল্লাহর অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং ঐ সব গ্রন্থে বিদ্যমান সৃষ্টিজগতের কল্যাণ সংবলিত হুকুম আহকাম প্রমাণ করে যে, এ সব কিছু এমন প্রজ্ঞাময় প্রতিপালকের পক্ষ হতে এসেছে যিনি অবহিত আছেন সৃষ্টি জগতের সার্বিক কল্যাণ সম্পর্কে। আর সেসব গ্রন্থে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে যে সব সংবাদ এসেছে আর বাস্তব যা সত্য বলে সাক্ষ্য দিচ্ছে তা প্রমাণ করছে যে, এ সৃষ্টিজগত এমন মহান রবের পক্ষ থেকে এসেছে যিনি তাঁর দেওয়া সংবাদ অনুযায়ী অস্তিত্বদানে সক্ষম।

নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হলেন আল্লাহ! যিনি আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি ‘আরশের উপর আসীন হয়েছেন। তিনি রাতকে দিনের উপর সমাচ্ছন্ন করে দেন, যাতে রাত দ্রুত গতিতে দিনের অনুসরণ করে চলে। আর তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি। সবই তার নির্দেশে পরিচালিত। জেনে রেখো, সৃষ্টি আর হুক্‌ম প্রদানের মালিক তিনিই। চির মঙ্গলময় মহান আল্লাহ, তিনিই সর্বজগতের রাব্‌। আল আ‘রাফ- ৫৪

এই প্রকার তাওহীদে পূর্ববর্তী মুশরিকরাও বিশ্বাসী ছিল, কিন্তু এই বিশ্বাস ও স্বীকৃতিদান তাদেরকে ইছলামে প্রবেশ করাতে পারেনি। কারণ তারা এ তাওহীদের অপরিহার্য বিষয় তাওহীদুল উলূহিয়্যূাহ্‌কে অস্বীকার করত।

(৪) ইন্দ্রিয় অনুভুতির আলোকে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ:

এ ধরণের প্রমাণ আমরা দু’দিক থেকে পেশ করতে পারি:

প্রথমত: আমরা শুনি ও দেখি যে, প্রার্থনাকারীদের অনেক প্রার্থনা কবুল হচ্ছে, অসহায় ব্যক্তিগণ বিপদ থেকে উদ্ধার পাচ্ছেন। এর দ্বারা আল্লাহর অস্তিত্ব অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَنُوحًا إِذۡ نَادَىٰ مِن قَبۡلُ فَٱسۡتَجَبۡنَا لَهُۥ فَنَجَّيۡنَٰهُ وَأَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلۡكَرۡبِ ٱلۡعَظِيمِ ٧٦﴾ [الانبياء: ٧٦]

“স্মরণ করো নূহকে, সে যখন আহ্বান করেছিল তখন আমরা তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম।’’[সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৭৬]

অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

{إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ }

“স্মরণ করো, তোমরা যখন তোমাদের রবের কাছে উদ্ধার প্রার্থনা করছিলে তখন তিনি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করেছিলেন।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৯]

সহীহ বুখারীতে আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুৎবা প্রদানের সময় এক বেদুঈন মসজিদে প্রবেশ করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর পরিবার-পরিজন ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে। আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য দো‘আ করুন। আল্লাহর নবী দু’হাত তুলে দো‘আ করলেন। ফলে আকাশে পর্বত সদৃশ মেঘ জমলো এবং আল্লাহর নবী মিম্বার হতে অবতরণ করার পূর্বেই বৃষ্টিপাত শুরু হলো। এমনকি বৃষ্টির কারণে রাসূলের দাড়ী হতে পানির ফোটা পড়তে লাগলো।

দ্বিতীয় জুমু‘আয় সে বেদুঈন বা অন্য কেউ এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে এবং ধন-সম্পদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের জন্য দো‘আ করুন।

অতঃপর তিনি দু’হাত তুলে বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের চতুর্পার্শ্বে, (বৃষ্টি বর্ষণ করুন) আমাদের ওপর নয়। এমনকি তিনি যেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন সে দিক থেকেই মেঘ কেটে গিয়েছিল।’ [বুখারী ও মুসলিম]

দো‘আ কবুল হওয়ার শর্ত পূরণ করে সত্যিকারার্থে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে দো‘আ করলে এখনও যে দো‘আ কবুল হয় তা এখনো দৃশ্যমান প্রমাণিত বিষয়।

দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণের হাতে তাঁদের রিসালাত ও নবুওয়াত প্রমাণ করার জন্য যেসব নিদর্শন, যাকে মু‘জিযা বলা হয়, (সাধারণের সাধ্যাতীত অলৌকিক ঘটনাসমূহ) যা মানুষ প্রত্যক্ষ করে থাকে অথবা শুনে থাকে, সেগুলো ঐ মু’জিযা প্রকাশক নবী-রাসূলদের প্রেরণকারী আল্লাহর অস্তিত্বের ওপর অকাট্য প্রমাণ। কারণ এগুলো মানুষের ক্ষমতার বাইরের বিষয়, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সংঘটিত করেন। তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ:

প্রথম উদাহরণ: মুসা আলাইহিস সালামের নিদর্শন, যখন আল্লাহ তা‘আলা মুসা আলাইহিস সালামকে নির্দেশ দিলেন যে, স্বীয় লাঠি দ্বারা সমুদ্রের মধ্যে আঘাত কর। মুসা আলাইহিস সালাম আঘাত করলেন। ফলে, সমুদ্রের মধ্যে বারটি শুষ্ক রাস্তা হয়ে যায় এবং দু-পার্শ্বের পানি বিশাল পবর্তসদৃশ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَأَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ مُوسَىٰٓ أَنِ ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ ٱلۡبَحۡرَۖ فَٱنفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرۡقٖ كَٱلطَّوۡدِ ٱلۡعَظِيمِ ٦٣﴾ [الشعراء: ٦٣]

“অতঃপর আমরা মুসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর, ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতসদৃশ হয়ে গেল।’’ [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ৬৩]

দ্বিতীয় উদাহরণ: ঈসা আলাইহিস সালামের নিদর্শন: তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতেন এবং তাদেরকে কবর থেকে বের করে আনতেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

﴿وَأُحۡيِ ٱلۡمَوۡتَىٰ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۖ﴾ [ال عمران: ٤٩]

‘‘আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে।’’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৪৯]

﴿وَإِذۡ تُخۡرِجُ ٱلۡمَوۡتَىٰ بِإِذۡنِيۖ﴾ [المائ‍دة: ١١٠]

“এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দিতে।’’ [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ১১০]

তৃতীয় উদাহরণ: নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিদর্শন: কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তাঁর রিসালাতের স্বপক্ষে কোনো নিদর্শন চাইলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাঁদের দিকে ইশারা করেন অতঃপর চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় এবং উপস্থিত সবাই এ ঘটনা অবলোকন করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱقۡتَرَبَتِ ٱلسَّاعَةُ وَٱنشَقَّ ٱلۡقَمَرُ ١ وَإِن يَرَوۡاْ ءَايَةٗ يُعۡرِضُواْ وَيَقُولُواْ سِحۡرٞ مُّسۡتَمِرّٞ ٢﴾ [القمر: ١،  ٢]

“কিয়ামত আসন্ন এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা যদি কোনো নিদর্শন দেখে তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এটা তো চিরাচরিত এক প্রকার যাদু।’’ [সূরা আল-ক্বামার, আয়াত: ১-২]

ইন্দ্রিয় শক্তি দ্বারা অনুধাবন যোগ্য উক্ত নিদর্শন ও অলৌকিক ঘটনাসমূহ যেগুলো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য ঘটিয়েছিলেন, সেসব আল্লাহর অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ।

দুই: আল্লাহ তা‘আলার রবুবিয়্যাতের ওপর ঈমান:

এর অর্থ হলো, তিনিই একমাত্র রব, তাঁর কোনো শরীক নেই, নেই কোনো সাহায্যকারী।

আর রব তো তিনিই যিনি সৃষ্টিকর্তা, মালিক এবং সার্বিক (শরী‘আতগত ও পরিচালনাগত) নির্দেশ প্রদানকারী। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত কোনো স্রষ্টা নেই, তিনি ব্যতীত কোনো মালিকও নেই আর তিনি ব্যতীত অন্য কারও নির্দেশও সর্বত্র চলে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَلَا لَهُ ٱلۡخَلۡقُ وَٱلۡأَمۡرُۗ﴾ [الاعراف: ٥٤]

“জেনে রেখো, সৃষ্টি আর হুকুম প্রদানের কাজ একমাত্র তাঁরই।” [সূরা আল আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ لَهُ ٱلۡمُلۡكُۚ وَٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ مَا يَمۡلِكُونَ مِن قِطۡمِيرٍ﴾ [فاطر: ١٣]

“তিনি আল্লাহ, তোমাদের রব, সাম্রাজ্য একমাত্র তাঁরই। তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা তুচ্ছ খর্জুর আঁটির আবরণেরও অধিকারী নয়। [সূরা ফাতির, আয়াত: ১৩]

কতিপয় অহংকারী, মিথ্যা বাগড়ম্বরকারী, অন্তরের বিশ্বাস থেকে নয় শুধু মুখে দাবীকারী ব্যক্তি ব্যতীত সৃষ্টি জগতের কেউই আল্লাহর রবুবিয়্যাতকে অস্বীকার করে নি। যেমন, ফির‘আউনের বেলায় তা ঘটেছিল। সে তার জাতিকে বললো,

﴿فَقَالَ أَنَا۠ رَبُّكُمُ ٱلۡأَعۡلَىٰ ٢٤﴾ [النازعات: ٢٤]

“সে (ফির‘আউন) বলল, আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব।” [সূরা আন-নাযি‘আত, আয়াত: ২৪-২৫]

ফির‘আউন আরো বলল,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡمَلَأُ مَا عَلِمۡتُ لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرِي﴾ [القصص: ٣٨]

“হে পরিষদবর্গ, আমি জানি না যে, আমি ব্যতীত তোমাদের আর কোনো উপাস্য আছে।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৩৮]

ফির‘আউন একথা অহংকার করে বলেছিল; কিন্তু তার অন্তরের বিশ্বাস এমনটি ছিল না। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَجَحَدُواْ بِهَا وَٱسۡتَيۡقَنَتۡهَآ أَنفُسُهُمۡ ظُلۡمٗا وَعُلُوّٗاۚ ﴾ [النمل: ١٤]

“তারা অন্যায় ও অহংকার করে নিদর্শনাবলীকে প্রত্যাখ্যান করল। অথচ তাদের অন্তর এগুলো সত্য বলে বিশ্বাস করেছিল।” [সূরা আন-নামল, আয়াত, ১৪]

অনুরূপভাবে মুসা আলাইহিস সালাম ফির‘আউনকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,

﴿لَقَدۡ عَلِمۡتَ مَآ أَنزَلَ هَٰٓؤُلَآءِ إِلَّا رَبُّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ بَصَآئِرَ وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَٰفِرۡعَوۡنُ مَثۡبُورٗا ﴾ [الاسراء: ١٠٢]

“তুমি জান যে আসমান ও জমিনের পালনকর্তাই এসব নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ নাযিল করেছেন। হে ফির‘আউন, আমার ধারণায় তুমি ধ্বংস হতে চলেছ।” [সূরা বনী-ইসরাঈল, আয়াত: ১০২]

আর তাই দেখা যায় আরবের মুশরিকরা ও আল্লাহর উলূহিয়্যাত বা ইবাদাতে শির্ক করা সত্বেও তাঁর রবুবিয়্যাতকে স্বীকার করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُل لِّمَنِ ٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهَآ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٨٤ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ٨٥ قُلۡ مَن رَّبُّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ ٱلسَّبۡعِ وَرَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِيمِ ٨٦ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٨٧ قُلۡ مَنۢ بِيَدِهِۦ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيۡهِ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٨٨ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ فَأَنَّىٰ تُسۡحَرُونَ ٨٩﴾ [المؤمنون: ٨٤،  ٨٩]

“বল, পৃথিবী এবং পৃথিবীতে যারা আছে তারা কার? যদি তোমরা জান, তবে বল। তখন তারা বলবে, সবই আল্লাহর। বল, তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?। বল, সপ্তাকাশ ও মহা-‘আরশের মালিকানা কার? অচিরেই তারা বলবে, আল্লাহর। বল, তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না? বলুন, তোমাদের জানা থাকলে বল, কার হাতে সব বস্তুর কর্তৃত্ব, যিনি রক্ষা করেন এবং যার কবল থেকে কেউ রক্ষা করতে পারে না? তখন তারা বলবে, আল্লাহর। বল, তাহলে কেমন করে তোমাদেরকে যাদু করা হচ্ছে? [সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত: ৮৪-৮৯]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡعَلِيمُ ٩﴾ [الزخرف: ٩]

‘‘(হে রাসূল) আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তবে অবশ্যই তারা বলবে, সৃষ্টি করেছেন পরাক্রান্ত সর্বজ্ঞ আল্লাহ।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৯]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَهُمۡ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُۖ فَأَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ ٨٧﴾ [الزخرف: ٨٧]

“আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তবে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ। সুতরাং তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৭]

আর ‘আল্লাহর আদেশ’ কথাটি তাঁর সৃষ্টিগত ও শরী‘আত সংশ্লিষ্ট উভয় প্রকার বিষয়াদি শামিল করে। তিনি যেমন তাঁর হিকমতানুসারে সৃষ্টিজগতে যা ইচ্ছা তার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও ব্যবস্থাপক, তেমনি তিনি তাঁর হিকমতানুযায়ী যাবতীয় আইন, বিধি-বিধান ও ইবাদাত ও পারষ্পারিক লেনদেনের হুকুম রচনার একচ্ছত্র অধিকারী। অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ইবাদতের বিধান প্রদানকারী অথবা লেন-দেনের হুকুমদাতা হিসাবে গ্রহণ করে তা হলে সে আল্লাহর সাথে শরীক করলো এবং ঈমান বাস্তবায়ণ করলো না।

মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে খোদাপোরোস্তীর প্রান্ত সীমানায় দাড়িয়ে তার ইবাদত করে। কল্যাণ লাভ হলে তা নিয়ে শান্ত-তুষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য কোন অসুবিধা দেখলে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ায়। এমন ব্যক্তি দুনিয়া-আখেরাত-দু-ই বরবাদ করলো। আর এটাই হচ্ছে স্পষ্ট ক্ষতি। সে আল্লাহ্‌কে বাদ দিয়ে এমন কাউকে ডাকে, যারা তার কোন অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখে না, ক্ষমতা রাখে না কোন কল্যাণ করারও। এটাই হচ্ছে বড় গোমরাহী-বিরাট পথ-ভ্রষ্টতা। সে সাহায্যের জন্যে এমন কাউকে ডাকে, যাকে ডাকায় লাভের তুলনায় ক্ষতি অনেক নিকটতর। কতই না নিকৃষ্ট বন্ধু আর কতই না নিকৃষ্ট সাথী।-আল-হাজ্জ-১১-১৩

বল, আল্লাহ্ কিন্তু সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করেন। তবে বল, অনুসরণীয় হওয়ার অধিক যোগ্য কে? যিনি সত্যের পথ প্রদর্শন করেন, না সে, যাকে পথ প্রদশর্ন না করা হলে সে নিজেই কোন সন্ধান লাভ করতে পারে না? তোমাদের হয়েছে কি? কেমন ফয়সালা করেছো তোমরা? ইউনুস-৩৫

———————– তারা আল্লাহ্‌কে ছেড়ে এমন কারো ইবাদত করছে, যারা অকল্যাণও করতে পারে না, পারে না কল্যাণও করতে। এবং তারা বলে; আল্লাহ্‌র হুজুরে তারা আমাদের সুপারিশকারী। বল, আসমান-যমীনে আল্লাহ্‌র জ্ঞানে নেই -তোমরা কি আল্লাহ্‌কে এমন কিছুর সংবাদ দিচ্ছো? তারা যে শিরক করছে, তা থেকে আল্লাহ্‌ পবিত্র- মুক্ত।-ইউনুস-১৮

যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি কেন তাঁর ইবাদাত করবো না, যাঁর দিকে তোমাদের সকলকে ফিরে যেতে হবে? তাঁকে ত্যাগ করে আমি কি ওদেরকে ইলাহ বানাবো, যাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, রহমান যদি আমার কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা করেন, তখন তাদের সুপারিশ আমার কোন কাজেই আসবে না, পারবে না তারা আমাকে মুক্ত করতে ? – ছুরা: ইয়াছিনঃ ২২-২৩

তিন: আল্লাহর উলূহিয়্যাতের ওপর ঈমান:

উলূহিয়্যাত অর্থ ইবাদাত। ইবাদাত শব্দটি ‘আবদ’ বা ‘দাস’ শব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতে ‘উবূদিয়্যাত’ ও ‘ইবাদত’ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবূদিয়্যাত অর্থ লৌকিক বা জাগতিক দাসত্ব এবং ‘ইবাদত’ অর্থ অলৌকিক বা অপার্থিব দাসত্ব। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ রাগিব ইস্পাহানী (৫০২ হি) বলেন:

اَلْعُبُوْدِيَّةُ إِظْهَارُ التَّذَلُّلِ وَالْعِبَادَةُ أَبْلَغُ مِنْهَا لأَنَّهَا غَايَةُ التَّذَلُّلِ وَلاَ يَسْتَحِقُّهَا إِلاَّ مَنْ لَهُ غَايَةُ الأَفْعَالِ (الإِفْضَالِ)

‘‘‘উবূদিয়াত’ (slavery, serfdom, bondage) হলো বিনয়-ভক্তি-অসহায়ত্ব প্রকাশ করা। আর ‘ইবাদত’ (worship, veneration) এর চেয়েও অধিক গভীর অর্থজ্ঞাপক। কারণ ইবাদত হলো চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি-অসহায়ত্ব প্রকাশ, যিনি চূড়ান্ত কর্ম-ক্ষমতা বা দয়ার মালিক তিনি ছাড়া কেউ এরূপ চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।’’ রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃ. ৩১৯।

অন্যান্য আলিমও অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের ভাষায়:

اَلْعِبَادَةُ عَلَى الْمَعْنَى اللُّغَوِيِّ غَايَةُ التَّذَلُّلِ وَالاِفْتِقَارِ وَالاِسْتِكَانَةِ

‘‘ইবাদাতের আভিধানিক অর্থ চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি, অসহায়ত্ব ও মুখাপেক্ষিতা।’’ আযীম আবাদী, আউনুল মা’বূদ ৪/২৪৭; মুবারকপূরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/২২০; মুনাবী, আব্দুর রাউফ, ফাইদুল কাদীর ৩/৫৪০।

তাহলে এর অর্থ হলো, এই কথা স্বীকার করা যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সত্যিকার মা‘বুদ বা উপাস্য, এতে অন্য কেউ তাঁর শরীক নেই।

আর ‘‘ইলাহ’’ শব্দটি মালূহ শব্দের অর্থে। যার অর্থ মা‘বুদ। অর্থাৎ সে উপাস্য যাকে পূর্ণ ভালোবাসা ও পূর্ণ সম্মানের সাথে ইবাদাত বা দাসত্ব করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٣﴾ [البقرة: ١٦٣]

“আর তোমাদের উপাস্য একমাত্র একই উপাস্য। তিনি ব্যতীত আর কোনো সত্য মা‘বুদ নেই, তিনি মহা করুণাময় দয়ালু।” [সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ১৬৩] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨﴾ [ال عمران: ١٨]

“আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ছাড়া সত্যিকার কোনো মা‘বুদ নেই এবং ফিরিশতাগণ, ন্যায়নিষ্ট জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মা‘বুদ নেই। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮]

তাই আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে তার ইবাদাত করা হলে তার সে উপাস্যরূপে গ্রহণ বাতিল বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,

﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ هُوَ ٱلۡبَٰطِلُ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡكَبِيرُ ٦٢﴾ [الحج: ٦٢]

“তা এই জন্য যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তিনিই সত্য এবং তাঁর পরিবর্তে তারা যাদের ডাকে তারা অসত্য এবং আল্লাহ, তিনিই হলেন সুমহান সর্বশ্রেষ্ঠ।” [সূরা আল-হজ, আয়াত: ৬২]

(আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা করা হয়) সেগুলোকে মা‘বুদ বলে নাম রাখলেই তা সত্যিকার উপাস্যের মর্যাদায় আসীন হয় না; বরং শুধু নাম সর্বস্বই থেকে যায়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে লাত, মানাত, ওযযা ইত্যাদি সম্পর্কে বলেন,

﴿إِنۡ هِيَ إِلَّآ أَسۡمَآءٞ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ﴾ [النجم: ٢٣]

“এগুলো কতেক নাম বৈ কিছু নয়, যে সমস্ত নাম তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষরা রেখেছ। এর সমর্থনে আল্লাহ কোনো দলীল নাযিল করেন নি।”  [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৩]

অনুরূপভাবে ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) তাঁর কারাগারের সঙ্গীদেরকে বলেন,

﴿يَٰصَٰحِبَيِ ٱلسِّجۡنِ ءَأَرۡبَابٞ مُّتَفَرِّقُونَ خَيۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَٰحِدُ ٱلۡقَهَّارُ ٣٩ مَا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ أَسۡمَآءٗ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ﴾ [يوسف: ٣٩،  ٤٠]

“হে কারাগারের সাথীদ্বয়! পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভালো, নাকি পরাক্রমশালী এক আল্লাহ ভালো? তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদাত কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারাই সাব্যস্ত করে নিয়েছ। আল্লাহ এদের পক্ষে কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি।” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৯-৪০]

তাই সকল নবী রাসূলগণ তাঁদের স্ব স্ব জাতিকে বলতেন,

﴿ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُ﴾ [الاعراف: ٥٩]

“তোমরা আল্লাহরই ইবাদাত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য সত্যিকার কোনো মা‘বুদ বা উপাস্য নেই। [সূরা আল-আ‘রাফ: ৫৯]

কিন্তু যুগে যুগে মুশরিকগণ এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বিভিন্ন ধরণের বাতিল উপাস্যকে আল্লাহর সাথে শরীক করে ওদের উপাসনা করেছে। তাদের নিকট সাহায্য কামনা করেছে এবং তাদের কাছে ফরিয়াদ করেছে।

 আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের এ প্রকার উপাস্য গ্রহণের বিষয়কে দু’টি যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করেছেন:

প্রথম: যাদেরকে তারা মা‘বুদ সাব্যস্ত করে নিয়েছে ওদের মধ্যে উপাস্যগত কোনো গুণ নেই। তারা সামান্যতম শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী নয়। যেমন, তারা কোনো একটি বস্তুও সৃষ্টি করে নি; বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট। আর ঐ সব মা‘বুদ তাদের পুজারীদের না কোনো উপকার সাধন করতে পারে, না তাদের কোনো মুসিবত দূর করতে পারে এবং তাদের জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনেরও তারা মালিক নয়। আসমান, জমিনেরও কোনো কিছুর মালিক নয় এবং এতে তাদের অংশও নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةٗ لَّا يَخۡلُقُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ وَلَا يَمۡلِكُونَ لِأَنفُسِهِمۡ ضَرّٗا وَلَا نَفۡعٗا وَلَا يَمۡلِكُونَ مَوۡتٗا وَلَا حَيَوٰةٗ وَلَا نُشُورٗا ٣﴾ [الفرقان: ٣]

‘‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং তারা নিজেদের ভালোও করতে পারে না, মন্দও করতে পারে না এবং জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনেরও তারা মালিক নয়।’’ [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৩]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا لَهُمۡ فِيهِمَا مِن شِرۡكٖ وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢ وَلَا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ عِندَهُۥٓ إِلَّا لِمَنۡ أَذِنَ لَهُ﴾ [سبا: ٢٢،  ٢٣]

“বল, তোমরা আহ্বান কর, যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে করতে আল্লাহ ব্যতীত। তারা তো নভোমণ্ডল ও ভু-মণ্ডলের অণু পরিমাণ কোনো কিছুর মালিক নয়। এতে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহর সহায়কও নয়। আল্লাহর নিকট কারো জন্য সুপরিশ ফলপ্রসু হবে না; কিন্তু যার জন্য অনুমতি দেওয়া হয় সে ব্যতীত।’’ [সূরা সাবা, আয়াত: ২২-২৩]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَيُشۡرِكُونَ مَا لَا يَخۡلُقُ شَيۡ‍ٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ ١٩١ وَلَا يَسۡتَطِيعُونَ لَهُمۡ نَصۡرٗا وَلَآ أَنفُسَهُمۡ يَنصُرُونَ ١٩٢﴾ [الاعراف: ١٩١،  ١٩٢]

“তারা কি এমন কাউকে শরীক সাব্যস্ত করে, যে একটি বস্তুও সৃষ্টি করতে পারে না? বরং তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর তারা না তাদের সাহায্য করতে পারে, না নিজেদের সাহায্য করতে পারে।’’ [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৯১-১৯২]

আর যখন এই বাতেল উপাস্যদের এরূপ অসহায় অবস্থা, তখন তাদেরকে উপাস্য নির্ধারণ করা চরম বোকামী ও বাতিল কর্ম বৈ কিছু নয়।

দ্বিতীয়: যখন মুশরিকরা স্বীকার করে যে এ নিখিল বিশ্বের রব ও স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, যাঁর হাতে সবকিছুর ক্ষমতা, যিনি আশ্রয় দান করেন, তাঁর ওপর কোনো আশ্রয়দানকারী নেই; তখন তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠে এ বিষয় স্বীকার করা যে, একমাত্র মহান আল্লাহ তা‘আলাই সর্বপ্রকার ইবাদাত বা উপাসনা পাওয়ার অধিকারী, যেমনিভাবে তারা স্বীকার করে যে, আল্লাহ তা‘আলা রবুবিয়্যাতে একক ও অদ্বিতীয়, এতে তাঁর কোনো শরীক নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢﴾ [البقرة: ٢١،  ٢٢]

“হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পার। যে মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ স্থাপন করেছেন। আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে। অতএব, আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে সমকক্ষ করো না। বস্তুত তোমরা এসব অবগত আছ।” [সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২১-২২]

আল্লাহ আরো বলেন,

﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَهُمۡ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُۖ فَأَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ ٨٧﴾ [الزخرف: ٨٧]

“যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তবে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ। অতঃপর তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৭]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٣١ فَذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمُ ٱلۡحَقُّۖ فَمَاذَا بَعۡدَ ٱلۡحَقِّ إِلَّا ٱلضَّلَٰلُۖ فَأَنَّىٰ تُصۡرَفُونَ ٣٢ ﴾ [يونس: ٣١،  ٣٢]

“বলুন, কে রুযী দান করেন তোমাদেরকে আসমান ও জমিন থেকে? কিংবা কে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কে-ই-বা মৃত্যুকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন এই বিশ্বের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ। তখন আপনি বলুন, তারপরেও কেন তোমরা তাঁকে ভয় করো না? অতএব, এ আল্লাহই তোমাদের সত্যিকার রব। আর সত্য ত্যাগ করার পর বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কী থাকে? সুতরাং তোমরা কোথায় পরিচালিত হচ্ছ?” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩১-৩২]

 

তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ বা তাওহীদুল ‘ইবাদাহ হলো:-

আল্লাহ  মানব জাতিকে যে কাজের জন্য; যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, সেই কাজে তথা ‘ইবাদাতে আল্লাহ্‌র এককত্ব অক্ষুন্ন রাখা এবং ‘ইবাদাতে আল্লাহ্‌কে একক ও অদ্বিতীয় প্রমাণিত করা। মোটকথা, সকল প্রকার ‘ইবাদাত এক আল্লাহ্‌র জন্য নিবেদিত করা। তিনি ব্যতীত তাঁর সৃষ্টি; আর কাউকে আহবান না করা এবং ‘ইবাদতের বিন্দুমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে নিবেদন না করা। এমনকি আল্লাহর নৈকট্যশীল কোন ফিরিশতাকে কিংবা আল্লাহ্‌র প্রেরিত কোন নাবীকেও না। যে ব্যক্তি এসকল ‘ইবাদাত থেকে সামান্য কিছু গায়রুল্লাহ্‌র (আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো) জন্য নিবেদন করবে, সে মুশরিক-কাফির বলে গণ্য হবে।

আল্লাহ্  ইরশাদ করেছেন:-

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ.

অর্থাৎ- আপনি বলুন! নিশ্চয়ই আমার নামায ও আমার ক্বোরবানী এবং আমার জীবন ও মৃত্যু বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ্‌র জন্য নিবেদিত। তার কোন শরীক নেই এবং এজন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি। আর আমি প্রথম আত্মসমর্পণকারী একজন। আনআম- ১৬২-১৬৩

আল্লাহ  আরো ইরশাদ করেছেন:-

وَمَنْ يَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ لَا بُرْهَانَ لَهُ بِهِ فَإِنَّمَا حِسَابُهُ عِنْدَ رَبِّهِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الْكَافِرُونَ.৩

 

অর্থাৎ- যে কেউ আল্লাহ্‌র সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে, তার কাছে যার ছনদ (প্রমাণ) নেই, তার হিসাব তার পালনকর্তার কাছে আছে। নিশ্চয় কাফিররা সফলকাম হবে না। আল মু’মিনূন- ১১৭

রাছূলের  সাথে তাঁর উম্মাতের দ্বন্দ্ব-বিবাদের মূল বিষয়-বস্তু ছিল এই তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ। কেননা পূর্ববর্তী অধিকাংশ মুশরিকগণ আল্লাহ্‌র রুবূবিয়্যাতের (প্রতিপালকত্বের) এককত্বে বিশ্বাসী ছিল। তারা এটা স্বীকার করতো যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সৃষ্টিকর্তা এবং জগত পরিচালনাকারী নেই। কিন্তু তারা তাঁর সাথে ‘ইবাদাতে অন্যকে শরীক করতো। তাদের ধারণা ছিল যে, এ সকল অংশীদার তাদের জন্য আল্লাহ্‌র  কাছে সুপারিশকারী হবে।

যেমন- আল্লাহ  তাদের কথা বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন:-

অর্থাৎ- যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকে অলী হিসেবে গ্রহণ করে রেখেছে এবং বলে যে, আমরা তাদের (দেব-দেবীদের) উপাসনা কেবল এ জন্যই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী করে দেয়। নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে তাদের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফায়সালা করে দেবেন। আল্লাহ মিথ্যাবাদী কাফিরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।আয্‌যুমার- ৩

 

আর এ জন্যই আল্লাহ সমস্ত রাছূলদেরকে খালিস আল্লাহ্‌র এককত্বের প্রতি দাওয়াত দেয়ার জন্য প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ  ইরশাদ করেছেন:-

অর্থাৎ- আর আমি আপনার পূর্বে যে রাছূলই প্রেরণ করেছি, তার প্রতি এই প্রত্যাদেশই করেছি যে, আমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। সুতরাং তোমরা আমারই ‘ইবাদাত করো।আল আম্বিয়া- ২৫

বর্তমান যুগের মুশরিক এবং পূর্ববর্তী যুগের মুশরিকদের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, পূর্বেকার যুগের মুশরিকদের তুলনায় বর্তমান যুগের মুশরিকদের শিরক আরো জঘন্য ও মারাত্মক। পূর্ববর্তী যুগের মুশরিকগণ সুখে-আনন্দে আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করতো, কিন্তু তারা দুঃখ-কষ্টে, বিপদে-আপদে আল্লাহকে ডাকতো, আল্লাহ্‌র আশ্রয় গ্রহণ করতো এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতো। যেমন- এ সম্পর্কে আল্লাহ  ইরশাদ করেছেন:-

অর্থাৎ- তারা যখন নৌযানে আরোহন করতো তখন তারা আল্লাহ্‌কে ডাকতো দ্বীনকে তাঁর জন্য খালিস করে একনিষ্ঠভাবে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্থলের আশ্রয় দিতেন তখনই তারা তাঁর সাথে অংশীদার স্থাপন করত। আল ‘আনকাবুত- ৬৫

আর বর্তমান যুগের মুশরিকরা তারা সুখে-শান্তিতে, আনন্দে, বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় গায়রুল্লাহ্‌র আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তাদেরকে আহবান করে। যেমন আমাদের সমাজে অহরহ দেখা যায়, মুছলমান বলে দাবিদার অনেকে মুর্তি, পাথর অথবা মৃত ক্বাব্‌রবাসীর নিকট বালা-মুসীবত থেকে মুক্তি ও নিষ্কৃতি কামনা করছে, তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছে এবং তাদের উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ ও নয্‌র-মানত করছে। নিজের মনোবাসনা পূরণ হওয়ার জন্য ক্বাব্‌রের পাশে অবস্থান করছে, ক্বাব্‌র ত্বাওয়াফ করছে, আর সাথে সাথে মৃত ক্বাব্‌রবাসীর প্রতি নিজের প্রয়োজন পূরণ করে দেওয়ার আশা পোষণ করছে। তাদের অনেককে আবার একথাও বলতে শুনা যায়:- “যখন তোমরা কোন বিষয়ের সমাধান না পেয়ে দিশেহারা হয় যাবে, তখন তোমরা ক্বাব্‌রবাসীদের আশ্রয় গ্রহণ করো”। أَعَاذَنَا اللَّهُ مِنْ ذَلِكَ

এদের সম্পর্কেই আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:-

অর্থাৎ- যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র পরিবর্তে এমন বস্তুর পূজা করে, যে ক্বিয়ামাত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দেবে না, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? তারা তো তাদের পূজা সম্পর্কেও বেখবর। যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রু হবে এবং তাদের ‘ইবাদাত অস্বীকার করবে।আল আহ্‌ক্বাফ- ৫-৬

অথচ মৃতরা ক্বাব্‌রে তাদের নিজেদেরই কোন উপকারের সাধ্য বা অধিকার রাখেনা, অন্যদের উপকারের সাধ্য বা অধিকার রাখা তো দূরের কথা। যারা নিজেদের কোন উপকার করতে পারে না, তারা অন্যের উপকার করবে কি করে? উপকার-অপকারের কর্তা ও মালিক তো একমাত্র  আল্লাহ । এ সম্পর্কে আল্লাহ  ইরশাদ করেছেন:-

অর্থাৎ- আল্লাহ্ যদি তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নেই। আর যদি তিনি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।আল আনআম- ১৭

লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ” এর ৭টি শর্ত এবং এসবের ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন। এগুলোকে সঠিকভাবে জানা-বুঝা ও বাস্তবায়ন করা বিশেষতঃ প্রত্যেক মুছলমানের উপর ওয়াজিব। “লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ” এর শর্তগুলো হলো, যথা- ১) আল ‘ইল্‌ম বা জ্ঞান (“লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ” এই শাহাদাহ্‌র অর্থ, তাৎপর্য ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন)। ২) আল ইয়াক্বীন বা বিশ্বাস। ৩) আল ইখলাস বা নিয়্যাতের বিশুদ্ধতা। ৪) আস্‌সিদ্‌ক্ব বা সত্যবাদীতা। ৫) আল মাহাব্বাহ বা আন্তরিক ভালোবাসা। ৬) আল ইনক্বিয়াদ বা যথাযথ আনুগত্য। ৭) আল ক্বাবূল বা মনে-প্রাণে মেনে নেয়া।

চার: আল্লাহর নাম ও তাঁর গুণাবলীর ওপর ঈমান:    আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমানের চতুর্থ দিক হলো, তিনি তাঁর জন্য তাঁর কিতাবে যে সব নাম উল্লেখ করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত সহীহ হাদীস দ্বারা তাঁর সর্ব সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর মহৎ গুণরাজি যে ভাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে ঠিক সে ভাবে কোনো প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন অস্বীকৃতি ও উপমা-সাদৃশ্য আরোপ ব্যতীত এবং কোনো ধরণ-গঠন নির্ণয় না করে যে ভাবে আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য সে ভাবে তা সাব্যস্ত করা। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِيٓ أَسۡمَٰٓئِهِۦۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٨٠﴾ [الاعراف: ١٨٠]

“আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সর্বোত্তম নামসমূহ। কাজেই তোমরা সে নাম ধরেই তাঁকে ডাক। আর ওদেরকে বর্জন কর, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বিকৃতি সাধন করে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৮০]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَهُ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ﴾ [الروم: ٢٧]

“আকাশ ও পৃথিবীতে সবের্বাচ্চ মর্যাদা তাঁরই এবং তিনিই পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’’ [সূরা আর-রূম: ২৭]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ﴾ [الشورا: ١١]

“তাঁর অনুরূপ কোনো কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’ [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১১]

আল্লাহ তা‘আলা নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে দু’টি দল পথভ্রষ্ট হয়েছে:

প্রথম দল: আল-মু‘আত্তিলাহ: যারা আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত নাম বা কোনো কোনো নাম ও গুণাবলীকে অস্বীকার করে, তাদের ধারণা যে আল্লাহর জন্য গুণাবলী প্রতিষ্ঠা করলে আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য বা সমতুল্য করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। বস্তুত তাদের এ ধারণা কয়েক কারণে বাতিল:

১। যদি আল্লাহর নাম ও গুণাবলী নেই বলা হয় তাহলে একারণে কয়েকটি বাতিল কথা মানা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেমন মহান আল্লাহর কথার মধ্যে স্ববিরোধিতা এসে যাওয়া। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাঁর নাম ও গুণাবলী আছে বলে আমাদের জানিয়েছেন এবং তাতে তাঁর কোনো সদৃশ বা সমতুল্য নেই বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। এখন যদি আল্লাহর জন্য গুণাবলী প্রতিষ্ঠা করলে আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য বা সমতুল্য করা হয়ে যাবে মনে করা হয় তবে তো আল্লাহর কথাকেই সাংঘর্ষিক বলতে হয়; আর তাঁর বাণীর একাংশ অপর অংশে মিথ্যারোপ করে বলতে হবে।

২। দুটি বস্তু নাম বা গুণে অভিন্ন হলেও উভয় বস্তু সার্বিক দিক দিয়ে সদৃশ হওয়া আবশ্যক নয়। আপনি দেখতে পান, দু’ব্যক্তি মানুষ হওয়া, শ্রবণ, দৃষ্টি ও বাকশক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মানবিক গুণ, শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও বাকশক্তির দিক থেকে তারা সমান নয়।

অনুরূপভাবে আপনি দেখবেন, সব জন্তুদের হাত, পা ও চক্ষু রয়েছে, কিন্তু নাম এক হওয়ার কারণে তাদের হাত, পা ও চক্ষু এক রকম নয়।

সুতরাং যদি সৃষ্টির মধ্যে নাম ও গুণাবলীর অভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এভাবে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তাহলে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে অধিকতর স্পষ্ট ও বড় পার্থক্য ও ভিন্নতা থাকাই অধিকতর স্বাভাবিক।

দ্বিতীয় দল: আল মুশাব্বিহা: এ দলটি আল্লাহর নাম ও তাঁর গুণাবলী আছে বলে বিশ্বাস করে, তবে সাথে সাথে তারা আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির গুণাবলীর অনুরূপ মনে করে। তাদের যুক্তি হলো যে, কুরআন ও সুন্নাহর উদ্ধৃতি থেকে এটাই বুঝা যায়। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর গুণাবলীর বিষয়ে তাদের বোধগম্য ভাষাতেই সম্বোধন করেছেন। বস্তুত তাদের এ ধরনের বিশ্বাস ভিত্তিহীন এবং কয়েক কারণে বাতিল:

১। যুক্তি ও শরী‘আতের আলোকে যাচাই করলে উপলব্দি করা যায় যে, মহান রাব্বুল আলামীন কখনও সৃষ্টির সদৃশ হতে পারেন না। আর কুরআন ও সুন্নাহর দাবী কোনো বাতিল বিষয় হওয়াও সম্ভব নয়।

২। আল্লাহ তা‘আলা যদিও এমন ভাষা ও শব্দ দিয়ে তাঁর বান্দাদেরকে সম্বোধন করেছেন, যেগুলো মৌলিক অর্থগত দিক দিয়ে তাদের বোধগম্য’ কিন্তু তাঁর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রকৃত অবস্থা ও আসল তত্ত্বের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কাউকে অবহিত করেন নি; বরং আল্লাহ তা‘আলা নিজ সত্ত্বা ও গুণাবলী সম্পর্কিত বিষয়ের প্রকৃত জ্ঞানকে নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজেকে ‘‘আস-সামী‘’’ বা ‘সর্বশ্রোতা’ নামে বিশেষিত করেছেন। শ্রবণের অর্থটা আমাদের বোধগম্য (শব্দ পাওয়া) কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার শ্রবণ গুণের মূল তত্ত্ব আমাদের জানা নেই। কেননা, শ্রবণশক্তির দিক থেকে সৃষ্টিকুলও সমান নয়, তাই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এই ক্ষেত্রে অধিকতর তফাৎ থাকাই স্বাভাবিক।

অনুরূপভাবে যখন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন, তখন ‘উপরে উঠা’র বিষয়টি অর্থের দিক থেকে আমাদের বোধগম্য; কিন্তু মহান রাব্বুল ‘আলামীনের ‘উপরে উঠা’র প্রকৃত রূপ, ধরণ আমাদের জানা নেই। কারণ, সৃষ্টির মধ্যেও ‘উপরে উঠা’র ক্ষেত্রে ভিন্নতা আমাদের চোখে ধরা পড়ে। কেননা একটি স্থিতিশীল চেয়ারের উপরে উঠা আর একটি চঞ্চল পলায়নপর উটের পিঠের উপর উঠা সমান নয়। আর যখন সৃষ্টিকুলের ‘উপরে উঠা’র মধ্যে এতটুকু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, তখন ‘উপরে উঠা’র ক্ষেত্রে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে ঢের ব্যবধান থাকা অধিকতর স্পষ্ট ও নিশ্চিত।

উপরোক্ত বর্ণনানুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান আনলে মু’মিনদের জন্য যেসব ফলাফল সাধিত হয় তন্মধ্যে অন্যতম হলো:

প্রথমত: আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদ যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়; ফলে বান্দার মধ্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি কোনো প্রকার ভয়-ভীতি বা আশা-ভরসার লেশমাত্র থাকে না এবং তিনি ছাড়া আর কারো ইবাদাত সে করে না।

দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ ভালোবাসা ও সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন সম্ভব হয়; আর তা হবে আল্লাহর সর্বসুন্দর নামসমূহ ও তার সুউচ্চ গুণাবলীর দাবী অনুযায়ী।

তৃতীয়ত: আল্লাহর ইবাদাত যথাযথরূপে বাস্তবায়ণ; আর তা সম্ভব আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ইবাদাত পালন এবং তাঁর নিষেধাবলী বর্জন করার মাধ্যমে।

 

শির্ক (شِرْك) অর্থ অংশীদার হওয়া (to share, participate, be partner, associate)। ইশরাক (إشراك) ও তাশ্রীক (تَشْرِيك) অর্থ অংশীদার করা বা বানানো। ‘শির্ক’ শব্দটিও ‘অংশীদার করা’ বা ‘সহযোগী বানানো’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা বা আল্লাহর প্রাপ্য কোনো ইবাদাত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য পালন করাকে শিরক বলা হয়। কুরআনের ভাষায় কাউকে ‘আল্লাহর সমতুল্য’ করাই শিরক। আল্লাহ বলেন:

فَلا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ

অতএব তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমতুল্য বানাবে না।সূরা  বাকারা: ২২ আয়াত।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন,

سَأَلْتُ أَوْ سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ أَيُّ الذَّنْبِ عِنْدَ اللَّهِ أَكْبَرُ قَالَ أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ

‘‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করলাম, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে কঠিন পাপ কী? তিনি বলেন: সবচেয়ে কঠিন পাপ এই যে, তুমি আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬২৬, ৫/২২৩৬, ৬/২৪৯৭ (কিতাবুত তাফসীর, সূরাতুল বাকারা, বাব ফালা তাজআলু…) মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯০-৯১ (কিতাবুল ঈমান, বাবু কওনিশ শিরকি আকবাহুয যুনূব, ভারতীয় ছাপা ১/৬৩)

তাহলে কাউকে আল্লাহর ‘নিদ্দ’ মনে করাই শিরক। আরবীতে ‘নিদ্দ’’ (الندّ) অর্থ সমতুল্য, মত বা তুলনীয়। কাউকে নাম, বিশেষণ, প্রতিপালন বা ইবাদাতের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সমতুল্য মনে করা, আল্লাহকে যে ভক্তি প্রদর্শন করা হয় বা আল্লাহর জন্য যে ইবাদাত করা হয় তা অন্য কারো জন্য করাই শিরক। তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১/১৬৩-১৬৪।

দুভাবে মানুষ শিরকে নিপতিত হয়:

(১) আল্লাহর কোনো সৃষ্টির প্রতি অতি-সুধারণা অথবা

(২) মহান আল্লাহর প্রতি কু-ধারণা বা অবধারণা।

মুশরিকগণ কখনো ফিরিশতা, নবী, ওলী, পাহাড়, সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি কোনো সৃষ্টির বিষয়ে ভক্তিতে অতিরঞ্জন করে তাদের মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা কল্পনা করেছে। অথবা আল্লাহর পূর্ণতার গুণের প্রতি কু-ধারণা পোষণ করে তাঁকে সৃষ্টির মতই পরিষদ প্রভাবিত বলে কল্পনা করেছে।

বৈধ ভক্তি-শ্রদ্ধা থেকেই শিরকী অতিভক্তির জন্ম। পিতামাতা, উস্তাদ, পীর ও গুরুজনদের সর্বোচ্চ মানবীয় ভক্তিশ্রদ্ধা করতে হবে। কিন্তু যখনই উক্ত ব্যক্তির মধ্যে অলৌকিক শক্তি বা মঙ্গল-অমঙ্গলের ক্ষমতা কল্পনা করা হয় তখনই শিরক শুরু হয়। মহান আল্লাহ পিতামাতা বা নেককার মানুষের দুআ কবুল করেন। তবে তাঁদের দুআ নির্বিচারে গ্রহণ করেন, তাঁদেরকে অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছেন অথবা তাঁদের দুআর মাধ্যম ছাড়া আল্লাহর কাছে কিছু পাওয়া যাবে না মনে করা থেকে শিরকের যাত্রা।

তাওহীদের মত শিরকও দু প্রকারের হতে পারে:

(১) রুবূবিয়্যাতে শিরক এবং

(২) ইবাদাতে শিরক। আল্লাহ সব কিছু জানেন, দেখেন, শুনেন, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সৃষ্টির কল্যাণ-অকল্যাণ তাঁরই হাতে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে এ সকল গুণ আছে বা আল্লাহ কাউকে এরূপ ক্ষমতা প্রদান করেছেন বলে বিশ্বাস করা রুবুবিয়্যাতের শিরক।

‘ইবাদত’-এর ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বলে বিশ্বাস করা বা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করা ‘ইবাদাতের শির্ক’। উভয় প্রকারের শিরক পরস্পরে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কোনো সৃষ্টি বা মাখলূকের মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা বা ঐশ্বরিক শক্তি বিদ্যমান থাকার ধারণা থেকেই তাঁর প্রতি অলৌকিক ভক্তি, প্রার্থনা, সাজদা, মানত, উৎসর্গ, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি শিরকের জন্ম হয়।

 সালাত’-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা বা দো’আ। শরীআতের পরিভাষায় সে বিশেষ ইবাদাত, যা আমাদের নিকট ‘নামায’ হিসেবে পরিচিত।

ফার্সি ভাষায় ‘নামাজ’, আরবিতে ‘সালাহ’ শব্দটির একটি অর্থ হলো ‘সংযোগ’। নামাজের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর تعالى সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করি, সবসময় তাঁকে মনে রাখি। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ একারণেই দিয়েছেন, যেন আমরা কাজের চাপে পড়ে, হিন্দি সিরিয়াল বা খেলা দেখতে গিয়ে, বা রাতভর ভিডিও গেম খেলতে গিয়ে তাঁকে ভুলে না যাই। কারণ তাঁকে ভুলে যাওয়াটাই হচ্ছে আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ। যখনি আমরা একটু একটু করে আল্লাহকে تعالى ভুলে যাওয়া শুরু করি, তখনি আমরা আস্তে আস্তে অনুশোচনা অনুভব না করে খারাপ কাজ করতে শুরু করি। আর সেখান থেকেই শুরু হয় আমাদের পতন। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আমাদেরকে এই একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখে, আল্লাহর تعالى সাথে সংযোগ কিছুটা হলেও ধরে রাখে।

কুরআনুল কারীমে যতবার সালাতের তাকীদ দেয়া হয়েছে – সাধারণতঃ ‘ইকামত’ শব্দের দ্বারাই দেয়া হয়েছে। সালাত আদায়ের কথা শুধু দু’এক জায়গায় বলা হয়েছে। এ জন্য ইকামাতুস সালাত (সালাত প্রতিষ্ঠা)-এর মর্ম অনুধাবন করা উচিত। ‘ইকামত’ এর শাব্দিক অর্থ সোজা করা, স্থায়ী রাখা। সাধারণতঃ যেসব খুঁটি, দেয়াল বা গাছ প্রভৃতির আশ্রয়ে সোজাভাবে দাঁড়ানো থাকে, সেগুলো স্থায়ী থাকে এবং পড়ে যাওয়ার আশংকা কম থাকে। এজন্য ‘ইকামত’ স্থায়ী ও স্থিতিশীল অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় ইকামাতুস সালাত অর্থ, নির্ধারিত সময় অনুসারে যাবতীয় শর্তাদি ও নিয়মাবলী রক্ষা করে সালাত আদায় করা। শুধু সালাত আদায় করাকে ‘ইকামাতুস সালাত বলা হয় না। সালাতের যত গুণাবলী, ফলাফল, লাভ ও বরকতের কথা কুরআন হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, তা সবই ‘ইকামাতুস সালাত’ (সালাত প্রতিষ্ঠা)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত।

যেমন, কুরআনুল কারীমে আছে – নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। [সূরা আল-আনকাবুত: ৪৫]

বস্তুত: সালাতের এ ফল ও ক্রিয়ার তখনই প্রকাশ ঘটবে, যখন সালাত উপরে বর্ণিত অর্থে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ জন্য অনেক সালাত আদায়কারীকে অশ্লীল ও নক্ক্যারজনক কাজে জড়িত দেখে এ আয়াতের মৰ্ম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ঠিক হবে না। কেননা, তারা সালাত আদায় করেছে বটে, কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেনি। সুতরাং সালাতকে সকল দিক দিয়ে ঠিক করাকে প্রতিষ্ঠা করা বলা হবে। ইকামত অর্থে সালাতে সকল ফরয-ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, এতে সব সময় সুদৃঢ় থাকা এবং এর ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করা সবই বোঝায়।

তাছাড়া সময়মত আদায় করা। সালাতের রুকু, সাজদাহ, তিলাওয়াত, খুশু, খুযু ঠিক রাখাও এর অন্তর্ভুক্ত। [ইবনে কাসীর] ফরয-ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল প্রভৃতি সকল সালাতের জন্য একই শর্ত।

এক কথায় সালাতে অভ্যস্ত হওয়া ও তা শরীআতের নিয়মানুযায়ী আদায় করা এবং এর সকল নিয়ম-পদ্ধতি যথার্থভাবে পালন করাই ইকামতে সালাত।

তন্মধ্যে রয়েছে – জামা’আতের মাধ্যমে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করা। আর তা বাস্তাবায়নের জন্য সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করা। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে তার তদারকির ব্যবস্থা করা। আল্লাহ তা’আলা ইসলামী কল্যাণ-রাষ্ট্রের যে রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন তার মধ্যে সালাত কায়েম করাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের অন্যতম কর্ম বলে ঘোষণা করে বলেনঃ “যাদেরকে আমরা যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে, সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে”।[সূরা আল-হাজ্জঃ ৪১]

 আল্লাহর পথে ব্যয় অর্থে এখানে ফরয যাকাত, ওয়াজিব সদকা এবং নফল দানসদকা প্রভৃতি যা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা হয় সে সবকিছুকেই বোঝানো হয়েছে। [তাফসীর তাবারী] কুরআনে সাধারণত ইনফাক নফল দান-সদকার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে ফরয যাকাত উদ্দেশ্য সেসব ক্ষেত্রে ‘যাকাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমে গায়েবের উপর ঈমান, এরপর সালাত প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

فَاتَّقُوۡا اللّٰهَ مَا اسۡتَطَعۡتُمۡ وَاسۡمَعُوۡا وَاَطِيۡعُوۡا وَاَنۡفِقُوۡا خَيۡرًا لِّاَنۡفُسِكُمۡ‌ؕ وَمَنۡ يُّوۡقَ شُحَّ نَفۡسِهٖ فَاُولٰٓٮِٕكَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ‏

তাই যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো।শোন, আনুগত্য করো এবং নিজেদের সম্পদ ব্যয় করো। এটা তোমাদের জন্যই ভালো। যে মনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকলো সেই সফলতা লাভ করবে।{আত তাগাবুনঃ ১৬

আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় আসার পূর্বেই তা থেকে খরচ করো। সে সময় সে বলবেঃ হে আমার রব, তুমি আমাকে আরো কিছুটা অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি দান করতাম এবং নেককার লোকদের মধ্যে শামিল হয়ে যেতাম। অথচ যখন কারো কাজের অবকাশ পূর্ণ হয়ে যাওয়ার সময় এসে যায় তখন আল্লাহ‌ তাকে আর কোন অবকাশ মোটেই দেন না। তোমরা যা কিছু কর সে বিষয়ে আল্লাহ‌ পুরোপুরি অবহিত। {আল মুনাফিকুনঃ ১০-১১}

হে নবী! আমার যে বান্দারা ঈমান এনেছে তাদেরকে বলে দাও, তারা যেন নামায কায়েম করে এবং যা কিছু আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে (সৎপথে) ব্যয় করে – সেই দিন আসার আগে যেদিন না বেচা-কেনা হবে আর না হতে পারবে বন্ধু বাৎসল্য। {ইবরাহীমঃ ৩১

৪ নং আয়াতঃ

২:৪ وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ هُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ

   আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে এবং যা আপনার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে, আর যারা আখেরাতে নিশ্চিত বিশ্বাসী।

১. এখানে মুত্তাকীদের এমন আরও কতিপয় গুণাবলীর বর্ণনা রয়েছে, যাতে ঈমান বিল গায়েব এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের প্রসঙ্গটা আরও একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে মুমিন ও মুত্তাকী দুই শ্রেণীর লোক বিদ্যমান ছিলেন,

এক শ্রেণী তারা যারা প্রথমে মুশরিক ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন।

অন্য শ্রেণী হলেন যারা প্রথমে আহলে-কিতাব ইয়াহুদী-নাসারা ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। পূর্ববতী আয়াতে প্রথম শ্রেণীর বর্ণনা ছিল। এ আয়াতে দ্বিতীয় শ্রেণীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তাই এ আয়াতে কুরআনের প্রতি ঈমান আনার সাথে সাথে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে বিশ্বাস করার কথাও বলা হয়েছে। হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী এ দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কোন না কোন আসমানী কিতাবের অনুসারী ছিলেন, তারা দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী হবেন। [দেখুন, বুখারী ৩০১১, মুসলিম ১৫৪]

প্রথমতঃ কুরআনের প্রতি ঈমান এবং আমলের জন্য,

দ্বিতীয়তঃ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে ঈমান আনার জন্য। তবে পার্থক্য এই যে, সেগুলো সম্পর্কে বিশ্বাসের বিষয় হবে, কুরআনের পূর্বে আল্লাহ্‌ তা’আলা যেসব কিতাব নাযিল করেছেন, সেগুলো সত্য ও হক এবং সে যুগে এর উপর আমল করা ওয়াজিব ছিল। আর এ যুগে কুরআন নাযিল হবার পর যেহেতু অন্যান্য আসমানী কিতাবের হুকুম-আহকাম এবং পূর্ববর্তী শরীআতসমূহ মনসুখ হয়ে গেছে, তাই এখন আমল একমাত্র কুরআনের আদেশানুযায়ীই করতে হবে। [ইবনে কাসীর থেকে সংক্ষেপিত]

২. এ আয়াতে মুত্তাকীগণের আরেকটি গুণ বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তারা আখেরাতে নিশ্চিত বিশ্বাস বা দৃঢ় প্রত্যয় রাখে। যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য সেগুলোর মধ্যে এ বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ঈমান অনুযায়ী আমল করার প্রকৃত প্রেরণা এখান থেকেই সৃষ্টি হয়। ইসলামী বিশ্বাসগুলোর মধ্যে আখেরাতের প্রতি ঈমান আনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস, যা দুনিয়ার রূপই পাল্টে দিয়েছে। এ বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়েই ওহীর অনুসারীগণ প্রথমে নৈতিকতা ও কর্মে এবং পরবর্তীতে মোকাবেলায় একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আসনে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়েছে। পরন্তু তাওহীদ ও রিসালাতের ন্যায় এ আকীদাও সমস্ত নবী-রাসূলের শিক্ষা ও সর্বপ্রকার ধর্ম-বিশ্বাসের মধ্যেই সর্বসম্মত বিশ্বাসরূপে চলে আসছে।

যেসব লোক জীবন ও এর ভোগ-বিলাসকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে গণ্য করে, জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যে তিক্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সে তিক্ততাকেই সর্বাপেক্ষা কষ্ট বলে মনে করে, আখেরাতের জীবন, সেখানকার হিসাব-নিকাশ, শাস্তি ও পুরস্কার প্রভৃতি সম্পর্কে যাদের এতটুকুও আস্থা নেই, তারা যখন সত্য-মিথ্যা কিংবা হালাল-হারামের মধ্যে পার্থক্য করাকে তাদের জীবনের সহজ-স্বাচ্ছন্দ্যের পথে বাধারূপে দেখতে পায়, তখন সামান্য একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে সকল মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে এতটুকুও কুষ্ঠাবোধ করে না, এমতাবস্থায় এ সমস্ত লোককে যে কোন দুস্কর্ম থেকে বিরত রাখার মত আর কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

যা কিছু অন্যায়, অসুন্দর বা অসামাজিক জীবনের শান্তি-শৃংখলার পক্ষে ক্ষতিকর, সেসব অনাচার কার্যকরভাবে উৎখাত করার কোন শক্তি কোন আইনেরও নেই, এ কথা পরীক্ষিত সত্য। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কোন দুরাচারের চরিত্রশুদ্ধি ঘটানোও সম্ভব হয় না। অপরাধ যাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, আইনের শাস্তি সাধারণত তাদের দাত-সওয়া হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আর তাদের মধ্যে শাস্তিকে যারা ভয় করে, তাদের সে ভয়ের আওতাও শুধুমাত্র ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে, যকটুকুতে ধরা পড়ার ভয় বিদ্যমান। কিন্তু গোপনে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেখানে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না, সেরূপ পরিবেশে এ সমস্ত লোকের পক্ষেও যে কোন গৰ্হিত কাজে লিপ্ত হওয়ার পথে কোন বাধাই থাকে না।

আসলে যারা আখেরাত বিশ্বাস করে না তাদের জন্য আমি তাদের কৃতকর্মকে সুদৃশ্য করে দিয়েছি, ফলে তারা দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ায়।{আন নামলঃ ৪

এদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট শাস্তি এবং আখেরাতে এরাই হবে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত। {আন নামলঃ ৫

প্রকারান্তরে আখেরাতের প্রতি ঈমানই এমন এক কার্যকর নিয়ন্ত্রণবিধি, যা মানুষকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্বত্রই যে কোন গৰ্হিত আচরণ থেকে অত্যন্ত কার্যকারভাবে বিরত রাখে। তার অন্তরে এমন এক প্রত্যয়ের অম্লান শিখা অবিরাম সমুজ্জ্বল করে দেয় যে, আমি প্রকাশ্যেই থাকি আর গভীর নির্জনেই থাকি, রাজপথে থাকি কিংবা কোন বদ্ধঘরে লুকিয়েই থাকি, মুখে বা ভাব-ভঙ্গিতে প্রকাশ করি আর নাই করি, আমার সকল আচরণ, আমার সকল অভিব্যক্তি, এমনকি অন্তরে লুকায়িত প্রতিটি আকাংখা পর্যন্ত এক মহাসত্তার সামনে রয়েছে। তার সদাজাগ্রত দৃষ্টির সামনে কোন কিছুই আড়াল করার সাধ্য আমার নেই। আমার সংগে রয়েছে এমনসব প্রহরী, যারা আমার প্রতিটি আচরণ এবং অভিব্যক্তি প্রতিমুহুর্তেই লিপিবদ্ধ করছেন।

উপরোক্ত বিশ্বাসের মাধ্যমেই প্রাথমিক যুগে এমন মহোত্তম চরিত্রের অগণিত লোক সৃষ্টি হয়েছিলেন, যাদের চাল-চলন এবং আচার-আচরণ দেখেই মানুষ ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়ত। এখন লক্ষণীয় আর একটি বিষয় হচ্ছে, আয়াতের শেষে يُؤْمِنُون শব্দ ব্যবহার না করে يُوقِنُونَ ব্যবহার করা হয়েছে। ইয়াকীন অর্থ দৃঢ় প্রত্যয় যার দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আখেরাতের প্রতি এমন দৃঢ় প্রত্যয় রাখতে হবে, যে প্রত্যয় স্বচক্ষে দেখা কোন বস্তু সম্পর্কেই হতে পারে। এ দৃঢ় প্রত্যয়ের গুরুত্ব নির্ধারণে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “সবর হচ্ছে ঈমানের অর্ধেক, আর ইয়াকীন হচ্ছে পূর্ণ ঈমান” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৪৪৬]

মুত্তাকীদের এই গুণ আখেরাতে আল্লাহ তা’আলার সম্মুখে উপস্থিতি এবং হিসাবনিকাশ, প্রতিদান এবং সবকিছুরই একটি পরিপূর্ণ নকশা তার সামনে দৃশ্যমান করে রাখবে। যে ব্যক্তি অন্যের হক নষ্ট করার জন্য মিথ্যা মামলা করে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহর আদেশের বিপরীত পথে হারাম ধন-দৌলত উপার্জন করে এবং দুনিয়ার হীন উদ্দেশ্য সফল করার জন্য শরীআত বিরোধী কাজ করে, সে ব্যক্তি আখেরাতে বিশ্বাসী হয়ে, প্রকাশ্যে ঈমানের কথা যদি স্বীকার করে এবং শরীআতের বিচারে তাকে মুমিনও বলা হয়, কিন্তু কুরআন যে ইয়াকীনের কথা ঘোষণা করেছে, এমন লোকের মধ্যে সে ইয়াকীন থাকতে পারে না। আর সে কুরআনী ইয়াকীনই মানবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দিতে পারে। আর এর পরিণামেই মুত্তাকীগণকে হেদায়াত এবং সফলতার সে পুরস্কার দেয়া হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, তারাই সরল-সঠিক পথের পথিক, যা তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দান করা হয়েছে আর তারাই সম্পূর্ণ সফলকাম হয়েছে।

যে আখেরাতের কৃষিক্ষেত্র চায় আমি তার কৃষিক্ষেত্র বাড়িয়ে দেই। আর যে দুনিয়ার কৃষিক্ষেত্র চায় তাকে দুনিয়ার অংশ থেকেই দিয়ে থাকি। কিন্তু আখেরাতে তার কোন অংশ নেই।{আশ শূরাঃ ২০ }

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রসুল (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) —এর ওপর ঈমান আনো।তাহলে আল্লাহ‌ তোমাদেরকে দ্বিগুণ রহমত দান করবেন, তোমাদেরকে সেই জ্যোতি দান করবেন যার সাহায্যে তোমরা পথ চলবেএবং তোমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ করে দেবেন।আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। {আল হাদীদঃ ২৮ }

৫. নং আয়াতঃ   

২:৫ اُولٰٓئِکَ عَلٰی هُدًی مِّنۡ رَّبِّهِمۡ ٭ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ

তারাই তাদের রব-এর নির্দেশিত হেদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।

যারা মুত্তাকী তারাই সফলকাম। এখানে মুত্তাকীদের গুণাগুণ বর্ণনা করার পরে হিদায়াতের জন্য তাদেরকে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, তারাই তাদের রব-এর দেয়া হিদায়াত পাবে এবং তারাই সফলকাম হবে। আল্লাহর এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে সৎলোকেরা জান্নাতে স্থান পাবে। বর্তমান জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অসমৃদ্ধি, সাফল্য ও ব্যর্থতা আসল মানদণ্ড নয়। বরং আল্লাহর শেষ বিচারে যে ব্যক্তি উত্‌রে যাবে, সে-ই হচ্ছে সফলকাম। আর সেখানে যে উতরোবে না, সে ব্যর্থ।

আর সফলকাম তারাই যারা আল্লাহ‌ ও রসূলের হুকুম মেনে চলে এবং আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকে।{আন্ নূরঃ ৫

اِنَّ الَّذِيۡنَ يَخۡشَوۡنَ رَبَّهُمۡ بِالۡغَيۡبِ لَهُمۡ مَّغۡفِرَةٌ وَّاَجۡرٌ كَبِيۡرٌ

যারা না দেখেও তাদের রবকে ভয় করে,নিশ্চয়ই তারা লাভ করবে ক্ষমা এবং বিরাট পুরস্কার।{আল মুলকঃ ১২ ২ }

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا اصۡبِرُوۡا وَصَابِرُوۡا وَرَابِطُوۡا وَاتَّقُوۡا اللّٰهَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ

হে ঈমানদারগণ! সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মোকাবিলায় দৃঢ়তা দেখাও,হকের খেদমত করার জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে। {আলে ইমরানঃ ২০০

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর দরবারে নৈকট্য লাভের উপায় অনুসন্ধান করোএবং তাঁর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করো,সম্ভবত তোমরা সফলকাম হতে পারবে। {আল মায়েদাহঃ ৩৫ }

 

সূরা আল-বাকারার প্রথম পাঁচটি আয়াতে কুরআনকে হিদায়াত বা পথপ্রদর্শনের গ্রন্থরূপে ঘোষণা করে সকল সন্দেহ ও সংশয়ের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়ার পর সে সমস্ত ভাগ্যবান ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা এ গ্রন্থের হিদায়াতে পরিপূর্ণভাবে উপকৃত ও লাভবান হয়েছেন এবং যাদেরকে কুরআনের পরিভাষায় মুমিন ও মুত্তাকী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।

বাকারা সূরার (৬-২০) পনরটি আয়াত যারা কুরআন অমান্য করে তাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।

তন্মধ্যে ৬ ও ৭নং আয়াতে যারা প্রকাশ্যে অস্বীকার করে তাদের কথা ও স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে।

আর পরবর্তী তেরটি আয়াতই মুনাফেকদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এরা দুটি দলে বিভক্ত।

একদল প্রকাশ্যে কুরআনকে অস্বীকার করে বিরুদ্ধাচারণের পথ অবলম্বন করেছে। কুরআন তাদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছে।

অপর দল হচ্ছে, যারা হীন পার্থিব উদ্দেশ্যে অন্তরের ভাব ও বিশ্বাসের কথাটি খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করতে সাহস পায়নি, বরং প্রতারণার পথ অবলম্বন করেছে; মুসলিমদের নিকট বলে, আমরা মুসলিম; কুরআনের হিদায়াত মানি এবং আমরা তোমাদের সাথে আছি। অথচ তাদের অন্তরে লুক্কায়িত থাকে কুফর বা অস্বীকৃতি। আবার কাফেরদের নিকট গিয়ে বলে, আমরা তোমাদের দলভুক্ত, তোমাদের সাথেই রয়েছি।মুসলিমদের ধোঁকা দেয়ার জন্য এবং তাদের গোপন কথা জানার জন্যই তাদের সাথে মেলামেশা করি। কুরআন তাদেরকে ‘মুনাফিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।

এ আয়াতগুলোর বিস্তারিত আলোচনায় মনোনিবেশ করলে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা’আলা সূরা আল-বাকারার প্রথম বিশটি আয়াতে একদিকে হিদায়াতের উৎসের সন্ধান দিয়ে বলেছেন যে, এর উৎস হচ্ছে তার কিতাব এই কুরআন; অপরদিকে সৃষ্টিজগতকে এ হিদায়াত গ্রহণ করা ও না করার নিরিখে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছেন। যারা গ্রহণ করেছে, তাদেরকে মুমিন-মুত্তাকী বলেছেন, আর যারা অগ্রাহ্য করেছে তাদেরকে কাফের ও মুনাফেক বলেছেন।

কুরআনের এ শিক্ষা থেকে একটি মৌলিক জ্ঞাতব্য বিষয় এও প্রমাণিত হয় যে, বিশ্ববাসীকে এমনভাবে দুটি ভাগ করা যায়, যা হবে আদর্শভিত্তিক। বংশ, গোত্র, দেশ, ভাষা ও বর্ণ এবং ভৌগলিক বিভক্তি এমন কোন ভেদরেখা নয়, যার ভিত্তিতে মানবজাতিকে বিভক্ত করা যেতে পারে।

 

২:৬ اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا سَوَآءٌ عَلَیۡہِمۡ ءَاَنۡذَرۡتَہُمۡ اَمۡ لَمۡ تُنۡذِرۡہُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ

৬. যারা কুফরী করেছে আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন বা না করুন তারা ঈমান আনবে না।

কাফের শব্দের অর্থ অস্বীকারকারী, কাফের শব্দটি মুমিন শব্দের বিপরীত। বিভিন্ন কারণে কেউ কাফের হয়, তন্মধ্যে বিশেষ করে ঈমানের ছয়টি রুকনের কোন একটির প্রতি ঈমান না থাকলে সে নিঃসন্দেহে কাফের।

এ ছাড়াও ইসলামের আরকানসমূহও যদি কেউ অস্বীকার করে তাহলেও সে কাফের হবে। অনুরূপভাবে কেউ দ্বীনের এমন কোন আহকামকে অস্বীকার করলেও কাফের বলে বিবেচিত হবে যা দ্বীনের বিধিবিধান বলে সাব্যস্ত হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহর আয়াত ও হাদীসসমূহ বিশ্লেষণ করে আমরা কুফরীকে দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। বড় কুফর, ছোট কুফর।

প্রথমতঃ বড় কুফর। আর তা পাঁচ প্রকারঃ

১) মিথ্যা প্রতিপন্ন করার সাথে সম্পৃক্ত কুফর।

আর তা হল রাসূলগণের মিথ্যাবাদী হওয়ার বিশ্বাস পোষণ করা। অতএব তারা যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তাতে যে ব্যক্তি তাদেরকে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে মিথ্যা সাব্যস্ত করল, সে কুফরী করল। এর দলীল হল আল্লাহর বাণীঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে অথবা তার কাছে সত্যের আগমণ হলে তাকে সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তার অপেক্ষা অধিক যালিম আর কে? জাহান্নামেই কি কাফিরদের আবাস নয়”? [সূরা আল-আনকাবুতঃ ৬৮]

২) অস্বীকার ও অহংকারের মাধ্যমে কুফরঃ

এটা এভাবে হয় যে, রাসূলের সত্যতা এবং তিনি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য নিয়ে এসেছেন সে সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা, কিন্তু অহংকার ও হিংসাবশতঃ তার হুকুম না মানা এবং তার নির্দেশ না শোনা। এর দলীল আল্লাহর বাণীঃ “যখন আমরা ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল। সে অমান্য করল ও অহংকার করল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হল”। [সূরা আল-বাকারাহঃ ৩৪]

৩) সংশয়-সন্দেহের কুফরঃ

আর তা হল রাসূলগণের সত্যতা এবং তারা যা নিয়ে এসেছেন সে সম্পর্কে ইতস্তত করা এবং দৃঢ় বিশ্বাস না রাখা। একে ধারণা সম্পর্কিত কুফুরও বলা হয়। আর ধারণা হল একীন ও দৃঢ় বিশ্বাসের বিপরীত। এর দলীল আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ

“আর নিজের প্রতি যুলুম করে সে তার উদ্যানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না যে, এটি কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি মনে করি না যে, কিয়ামত হবে। আর আমি যদি আমার রবের নিকট প্রত্যাবর্তিত হই-ই, তবে আমি তো নিশ্চয়ই এ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্থান পাব। তদুত্তরে তার বন্ধু বিতর্কমূলকভাবে জিজ্ঞাসা করতঃ তাকে বলল, তুমি কি তাঁকে অস্বীকার করছ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা ও পরে শুক্র হতে এবং তার পর পূর্ণাঙ্গ করেছেন পুরুষ আকৃতিতে? কিন্তু তিনিই আল্লাহ আমার রব এবং আমি কাউকেও আমার রবের শরীক করি না”। [সূরা আল-কাহফঃ ৩৫-৩৮]

৪) বিমুখ থাকার মাধ্যমে কুফরঃ

এদ্বারা উদ্দেশ্য হল দ্বীন থেকে পরিপূর্ণভাবে বিমুখ থাকা এমনভাবে যে, স্বীয় কর্ণ, হৃদয় ও জ্ঞান দ্বারা ঐ আদর্শ থেকে দূরে থাকা যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছেন। এর দলীল আল্লাহর বাণীঃ “কিন্তু যারা কুফরী করেছে তারা সে বিষয় থেকে বিমুখ যে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে”। [সূরা আল-আহকাফঃ ৩]

৫) নিফাকের মাধ্যমে কুফরঃ

এদ্বারা বিশ্বাসগত নিফাক বুঝানো উদ্দেশ্য, যেমন ঈমানকে প্রকাশ করে গোপনে কুফর লালন করা। এর দলীল আল্লাহর বাণীঃ “এটা এজন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফর করেছে। ফলে তাদের হৃদয়ে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে। অতএব তারা বুঝে না”। [সূরা আল-মুনাফিকূনঃ ৩]

দ্বিতীয়তঃ ছোট কুফর

এ ধরনের কুফরে লিপ্ত ব্যক্তি মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হয়ে যাবে না এবং চিরতরে জাহান্নামে অবস্থান করাকেও তা অপরিহার্য করে না। এ কুফরে লিপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে শুধু কঠিন শাস্তির ধমক এসেছে। এ প্রকার কুফুর হল নেয়ামত অস্বীকার করা।

কুরআন ও সুন্নার মধ্যে বড় কুফর পর্যন্ত পৌছে না এ রকম যত কুফরের উল্লেখ এসেছে, তার সবই এ প্রকারের অন্তর্গত।

এর উদাহরণের মধ্যে রয়েছে, আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ “আল্লাহ্ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এমন এক জনপদের যা ছিলো নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত, যেখানে সর্বদিক হতে তার প্রচুর জীবিকা আসত। অতঃপর তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করল। ফলে তারা যা করত তজ্জন্য আল্লাহ সে জনপদকে আস্বাদন করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছাদন”। [সূরা আন-নাহলঃ ১১২] এখানে অনুগ্রহ অস্বীকার করাকে কুফর বলা হয়েছে, যা ছোট কুফর। [আল-ওয়াজিবাতুল মুতাহাত্তিমাতু]

 

২. আয়াতে ব্যবহৃত ‘ইনযার’ শব্দের অর্থ, এমন সংবাদ দেয়া যাতে ভয়ের সঞ্চার হয়। এর বিপরীত শব্দ হলো, ‘ইবশার’ আর তা এমন সংবাদকে বলা হয়, যা শুনে আনন্দ লাভ হয়।

সাধারণ অর্থে ‘ইনযার’ বলতে ভয় প্রদর্শন করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শুধু ভয় প্রদর্শনকে ইনযার’ বলা হয় না, বরং শব্দটি দ্বারা এমন ভয় প্রদর্শন বুঝায়, যা দয়ার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। যেভাবে মা সন্তানকে আগুন, সাপ, বিচ্ছু এবং হিংস্র জীবজন্তু হতে ভয় দেখিয়ে থাকেন। ‘নাযীর’ বা ভয়-প্রদর্শনকারী ঐ সমস্ত ব্যক্তি যারা অনুগ্রহ করে মানবজাতিকে যথার্থ ভয়ের খবর জানিয়ে দিয়েছেন। এ জন্যই নবী-রাসূলগণকে খাসভাবে ‘নাযীর’ বলা হয়। কেননা, তারা দয়া ও সতর্কতার ভিত্তিতে অবশ্যম্ভাবী বিপদ হতে ভয় প্রদর্শন করার জন্যই প্রেরিত হয়েছেন।

নবীগণের জন্য ‘নাযীর’ শব্দ ব্যবহার করে একদিকে ইংগিত করা হয়েছে যে, যারা দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষের প্রতি যথার্থ মমতা ও সমবেদনা সহকারে কথা বলা। এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্তনা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে যে, এ সমস্ত জেদী-অহংকারী লোক, যারা সত্যকে জেনে-শুনেও কুফরীর উপর দৃঢ় হয়ে আছে, অথবা অহংকারের বশবর্তী হয়ে কোন সত্য কথা শুনতে কিংবা সুস্পষ্ট দলীলপ্রমাণ দেখতেও প্রস্তুত নয়, তাদের পথে এনে ঈমানের আলোকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিরামহীন চেষ্টা করেছেন তা ফলপ্রসূ হওয়ার নয়।

এদের ব্যাপারে চেষ্টা করা না করা একই কথা। এ আয়াত দ্বারা বুঝা গেল যে, কুফর ও অন্যান্য সব পাপের আসল শাস্তি তো আখেরাতে হবেই; তবে কোন কোন পাপের আংশিক শাস্তি দুনিয়াতেও হয়ে থাকে। দুনিয়ার এ শাস্তি ক্ষেত্রবিশেষে নিজের অবস্থা সংশোধন করার সামর্থ্যকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। শুভবুদ্ধি লোপ পায়।

মানুষ আখেরাতের হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে গাফেল হয়ে গোমরাহীর পথে এমন দ্রুততার সাথে এগুতে থাকে; যাতে অন্যায়ের অনুভূতি পর্যন্ত তাদের অন্তর থেকে দূরে চলে যায়। এ আয়াত থেকে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এ আয়াতে কাফেরদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নসীহত করা না করা সমান বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে তাদেরকে জানানোর এবং সংশোধনের চেষ্টা করার সওয়াব অবশ্যই পাওয়া যাবে।

তাই সমগ্র কুরআনে কোন আয়াতেই এসব লোককে ঈমান ও ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়া নিষেধ করা হয়নি। এতে বুঝা যাচ্ছে, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইসলামের দাওয়াত দেয়ার কাজে নিয়োজিত, তা ফলপ্রসূ হোক বা না হোক, সে এ কাজের সওয়াব পাবেই।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল যে, সমস্ত মানুষই ঈমান আনুক এবং তার অনুসরণ করে হিদায়াত প্রাপ্ত হউক। তাই আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করে এটা জানিয়ে দিলেন যে, ঈমান আনা ও হিদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। পূর্বে যার জন্য সৌভাগ্য লিখা হয়েছে সেই ঈমান আনবে। আর যার জন্য দূর্ভাগ্য লিখা হয়েছে সে পথভ্রষ্ট হবে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

 

২:৭ خَتَمَ اللّٰہُ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ وَ عَلٰی سَمۡعِہِمۡ ؕ وَ عَلٰۤی اَبۡصَارِہِمۡ غِشَاوَۃٌ ۫ وَّ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ

৭. আল্লাহ তাদের হৃদয়সমূহ ও তাদের শ্রবনশক্তির উপর মোহর করে দিয়েছেন, এবং তাদের দৃষ্টির উপর রয়েছে আবরণ। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।

এ আয়াতে ‘সীলমোহর’ বা আবরণ শব্দের দ্বারা এরূপ সংশয় সৃষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, যখন আল্লাহ্ই তাদের অন্তরে সীলমোহর এঁটে দিয়েছেন এবং গ্রহণ-ক্ষমতাকে রহিত করেছেন, তখন তারা কুফরী করতে বাধ্য। কাজেই তাদের শাস্তি হবে কেন?

এর জবাব হচ্ছে যে, তারা নিজেরাই অহংকার ও বিরুদ্ধাচরণ করে নিজেদের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে, তাই এজন্য তারাই দায়ী। যেহেতু বান্দাদের সকল কাজের সৃষ্টি আল্লাহ্ই করেছেন, তিনি এস্থলে সীলমোহরের কথা বলে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা নিজেরাই যখন সত্য গ্রহণের ক্ষমতাকে রহিত করতে উদ্যত হয়েছে, তখন আমি আমার কর্ম-পদ্ধতি অনুযায়ী তাদের এ খারাপ যোগ্যতার পরিবেশ তাদের অন্তরে সৃষ্টি করে দিয়েছি। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে সীলমোহর মারার অর্থ হচ্ছে, যখন তারা উপরের বর্ণিত মৌলিক বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং নিজেদের জন্য কুরআনের উপস্থাপিত পথের পরিবর্তে অন্য পথ বেছে নিয়েছিল, তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়ে ও কানে সীলমোহর মেরে দিয়েছিলেন।

এতে বুঝা যাচ্ছে যে, তাদের কর্ম-কাণ্ডই তাদের হৃদয়সমূহকে সীলমোহর মারার উপযুক্ত করে দিয়েছে। আর এ অর্থই কুরআনের অন্য এক আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে, যথাঃ

“কখনো নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের হৃদয়ে জঙ ধরিয়েছে”। [সূরা আল-মুতাফফিফীনঃ ১৪]

তাতে বোঝানো হয়েছে যে, তাদের মন্দকাজ ও অহংকারই তাদের অন্তরে মরিচা আকার ধারণ করেছে। ইমাম তাবারী বলেন, গোনাহ যখন কোন মনের উপর অনবরত আঘাত করতে থাকে তখন সেটা মনকে বন্ধ করে দেয়। আর যখন সেটা বন্ধ হয়ে যায় তখন সেটার উপর সীলমোহর ও টিকেট এঁটে দেয়া হয়। ফলে তাতে আর ঈমান ঢোকার কোন পথ পায় না। যেমনিভাবে কুফরী থেকে মুক্তিরও কোন সুযোগ থাকে না। আর এটাই হচ্ছে এ আয়াতে বর্ণিত خَتَمَ আর অন্য আয়াতে বর্ণিত طَبَعَ। [ত্বাবারী]

হাদীসে এসেছে, মানুষ যখন কোন একটি গোনাহর কাজ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। সাদা কাপড়ে হঠাৎ কালো দাগ পড়ার পর যেমন তা খারাপ লাগে, তেমনি প্রথম অবস্থায় অন্তরে পাপের দাগও অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় যদি সে ব্যক্তি তাওবা না করে, আরও পাপ করতে থাকে, তবে পর পর দাগ পড়তে পড়তে অন্তঃকরণ দাগে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এমতবস্থায় তার অন্তর থেকে ভাল-মন্দের পার্থক্য সম্পর্কিত অনুভূতি পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যায়। [তিরমিযি: ৩৩৩৪, ইবনে মাজাহঃ ৪২৪৪]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ফেতনা মনের ওপর বেড়াজালের কাজ করে। ফলে তা অন্তরকে ধাপে ধাপে বিন্দু বিন্দু কালো আস্তরে আবৃত করে দেয়। যে অন্তর ফেতনার প্রভাব অস্বীকার করে, তা অন্তরকে শুভ্র সমুজ্জ্বল করে দেয়। ফলে কোন দিনই ফেতনা তার ক্ষতি করতে পারে না। ও গ্রহণের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়ে। [মুসলিম: ২৩১]

কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, তাদের উপর শয়তান ভর করেছে ফলে তারা তার অনুসরণ থেকে পিছপা হয় না। আর একারণেই আল্লাহ তাদের অন্তর, শ্রবণেন্দ্রিয় ও চোখের উপর পর্দা এঁটে দিয়েছেন। সুতরাং তারা হেদায়াত দেখবে না, শুনবে না, বুঝবে না এবং উপলব্ধি করতে পারবে না। [ইবনে কাসীর]

যে ব্যক্তি কখনো দাওয়াতী কাজ করেছেন, তিনি অবশ্যই এ সীলমোহর লাগার অবস্থার ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকবেন। আপনার উপস্থাপিত পথ যাচাই করার পর কোন ব্যক্তি একবার যখন তাকে প্রত্যাখ্যান করে তখন উল্টোপথে তার মনমানস এমনভাবে দৌড়াতে থাকে যার ফলে আপনার কোন কথা তার আর বোধগম্য হয় না। আপনার দাওয়াতের জন্য তার কান হয়ে যায় বধির। আপনার কার্যপদ্ধতির গুণাবলী দেখার ব্যাপারে তার চোখ হয়ে যায় অন্ধ তখন সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয় যে, সত্যিই তার হৃদয়ের দুয়ারে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

হেদায়েত আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আর উপায়-উপকরণ বান্দার পক্ষ থেকে

একটি প্রশ্ন উত্তরঃ————-

আল্লাহ্‌ তাআলার বাণী:

وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَن تُؤْمِنَ إِلاَّ بِإِذْنِ اللّه

আল্লাহ্‌র অনুমতি ছাড়া ঈমান আনা কারো সাধ্য নয়) ও তাঁর বাণী:

وَاللَّهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ

আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন) এর মাঝে সমন্বয় করতে পারি? আল্লাহ্‌ আমাদেরকে যে ফিতরাতের উপর সৃষ্টি করেছেন আমি সে ফিতরাতের উপর থাকার চেষ্টা করি এবং তিনি যা কিছুর উপর ঈমান আনতে আমাদেরকে আদেশ করেছেন সেগুলোর উপর ঈমান আনার মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করার চেষ্টা করি। কিন্তু ইদানিং আমার কাছে এই বিষয়ে শয়তানের কুমন্ত্রণা আসা শুরু হয়েছে। তাই আমি এ বিষয়ে জবাব পেতে চাই।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

তাওফিক ও হেদায়েত আল্লাহ্‌র হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিতে চান তাকে হেদায়েত দেন; আর যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান তাকে পথভ্রষ্ট করেন।

আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “এটা আল্লাহ্‌র পথনির্দেশ, তিনি তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন। আল্লাহ্‌ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন হেদায়াতকারী নেই।”[সূরা যুমার, ৩৯:২৩]

তিনি আরও বলেন: “আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে রাখেন।”[সূরা আনআম, ৬:৩৯]

তিনি আরও বলেন: “আল্লাহ্‌ যাকে পথ দেখান সে-ই পথ পায় এবং যাদেরকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।”[সূরা আল-আরাফ, ৭:১৭৮]

 

একজন মুসলিম তার নামাযে দোয়া করে: “আমাকে সরল পথে অটল রাখুন।”[সূরা ফাতিহা, ১:৬] যেহেতু বান্দা জানে যে, হেদায়েত আল্লাহ্‌র হাতে। তা সত্ত্বেও বান্দা হেদায়েতের উপায়-উপকরণ গ্রহণ করতে আদিষ্ট। ধৈর্য রাখা, অবিচল থাকা এবং সরল পথে পথচলা শুরু করতে আদিষ্ট। কারণ আল্লাহ্‌ তাকে প্রোজ্জ্বল বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন; যা দিয়ে সে ভাল কিংবা মন্দ, হেদায়েত কিংবা পথভ্রষ্টতা নির্বাচন করতে পারে। যদি বান্দা প্রকৃত উপকরণগুলো ব্যবহার করে এবং আল্লাহ্‌ তাকে হেদায়েত দিন এর জন্য সচেষ্ট থাকে তখন আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সে তাওফিকপ্রাপ্ত হয়।

আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “এভাবেই আমি একদলকে আরেকদল দ্বারা পরীক্ষা করেছি; কেননা তারা বলতে পারত, ‘আল্লাহ্‌কি আমাদের মধ্য থেকে এদেরকেই অনুগ্রহ করলেন?’ কৃতজ্ঞদের সম্পর্কে আল্লাহ্‌ই কি সবচেয়ে বেশী অবগত নন?”[সূরা আনআম, ৬:৫৩]

এই যে মাসয়ালাটি কিছু কিছু মানুষের কাছে জটিলতা তৈরী করে সেটা নিয়ে শাইখ উছাইমীন (রহঃ) দীর্ঘ আলোচনা করেছেন; তিনি বলেন:

“যদি সব কিছুর উৎস হয় আল্লাহ্‌তাআলার ইচ্ছা এবং সব কিছু তাঁর হাতেই থাকে তাহলে মানুষের পথ কী? যদি আল্লাহ্‌তাআলা মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়া ও হেদায়েত না-পাওয়া তাকদীরে রাখেন তাহলে মানুষের উপায় কী?

আমরা বলব: এর জবাব হচ্ছে আল্লাহ্‌তাআলা কেবল তাকেই হেদায়েত দান করেন যে হেদায়েত পাওয়ার উপযুক্ত এবং তাকেই পথভ্রষ্ট করেন যে পথভ্রষ্ট হওয়ার উপযুক্ত।

আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “কিন্তু তারা যখন বাঁকা পথ ধরল, তখন আল্লাহ্‌ও তাদের অন্তরকে বাঁকা করে দিলেন।”[সূরা আছ-ছফ, ৬১:৫]

তিনি আরও বলেন:”অতএব তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে আমি তাদেরকে অভিসম্পাত দিয়েছি এবং তাদের অন্তরসমূহ কঠিন করেছি। তারা শব্দসমূহের সঠিক অর্থ বিকৃত করে। তাদেরকে যা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তারা ভুলে গিয়েছে।”[সূরা আল-মা’ইদাহ, ৫:১৩]

আল্লাহ্‌ পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যে বান্দাকে পথভ্রষ্ট করেছেন তাকে পথভ্রষ্ট করার কারণ সে বান্দার পক্ষ থেকেই। বান্দা তো জানে না আল্লাহ্‌ তার তাকদীরে কী রেখেছেন। যেহেতু তাকদীরকৃত বিষয়টি সংঘটিত হওয়ার পর সে তাকদীরের কথা জানতে পারে। সে জানে না যে, আল্লাহ্‌কি তাকে পথভ্রষ্ট হিসেবে তাকদীরে রেখেছেন; নাকি হেদায়েতপ্রাপ্ত হিসেবে? সুতরাং সে নিজে ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করে কেন আপত্তি আরোপ করবে যে আল্লাহ্‌ই তার জন্য সেটা চেয়েছেন! তার জন্য কী এটাই উপযুক্ত ছিল না যে, সে নিজে হেদায়েতের পথে চলবে এবং এরপর বলবে: নিশ্চয় আল্লাহ্‌ আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।

এটা কী তার জন্য সমীচীন যে পথভ্রষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সে জাবারিয়া (নিয়তিবাদী) হবে, আর আনুগত্যের সময় সে কাদারিয়া (তাকদীর অস্বীকারকারী) হবে! কক্ষনো নয়, পথভ্রষ্টতা ও গুনাহর ক্ষেত্রে কোন মানুষের জাবারিয়া হওয়া সমীচীন নয় যে, পথভ্রষ্ট হয়ে কিংবা গুনাহ করে সে বলবে: এটি আমার জন্য লেখা ছিল ও তাকদীরে ছিল, আল্লাহ্‌আমার জন্য যা ফয়সালা করে রেখেছেন সেটা থেকে বের হওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।

প্রকৃতপক্ষে মানুষের ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। রিযিকের বিষয়টির চেয়ে হেদায়েতের বিষয় অধিক প্রচ্ছন্ন নয়। সকলের কাছেই সুবিদিত যে, মানুষের রিযিক পূর্বনির্ধারিত (তাকদীরকৃত)। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ রিযিক লাভের উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার চেষ্টা করে; নিজের দেশে থেকে, বিদেশে গিয়ে, ডানে, বামে। কেউ নিজ বাড়ীতে বসে থেকে বলে না যে: আমার জন্য যে রিযিক নির্ধারণ করা আছে সেটা আমার কাছে আসবেই। বরং রিযিক লাভের উপায়-উপকরণগুলো গ্রহণ করার চেষ্টা করে। অথচ রিযিকের সাথে আমলের কথাও আছে; যেমনটি হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে।

নেক আমল বা বদ আমল করা যেমন লিপিবদ্ধ ঠিক তেমনি রিযিকও লিপিবদ্ধ। তাহলে দুনিয়ার রিযিক তালাশ করার জন্য আপনি ডানে যান, বামে যান, পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ান; অথচ আখিরাতের রিযিক তালাশ করা ও চূড়ান্ত সুখ লাভে সফল হওয়ার জন্য আপনি নেক আমল করবেন না!!

অথচ দুটো একই ধরণের। দুটোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আপনি যেমন রিযিকের জন্য চেষ্টা করেন, নিজের জীবন ও বয়সকে প্রলম্বিত করার প্রচেষ্টা করেন: আপনি অসুস্থ হলে পৃথিবীর আনাচেকানাচে ভাল ডাক্তারের অনুসন্ধান করেন যিনি আপনার রোগের চিকিৎসা দিতে পারবে। অথচ আপনার আয়ু যতটুকু নির্ধারণ করা আছে তার চেয়ে একটুও বাড়বে না, কিংবা কমবে না। আপনি তো এর উপর নির্ভর করে বসে থাকেন না এবং বলেন না যে, আমি অসুস্থ হয়ে আমার ঘরে পড়ে থাকব; আল্লাহ্‌ যদি আমার আরও দীর্ঘ হায়াত নির্ধারণ করে রাখেন (তাকদীরে রাখেন) তাহলে হায়াত দীর্ঘায়িত হবেই। বরং আমরা দেখতে পাই যে, আপনি আপনার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেন, সন্ধান করেন যাতে করে এমন কোন ডাক্তার খুঁজে পান যার হাতে রোগ থেকে সুস্থ হওয়া আল্লাহ্‌ নির্ধারণ করে রেখেছেন।

তবে আপনার আখিরাতের ও সৎকর্মের পন্থা কেন দুনিয়ার কর্মপন্থার মত হয় না? ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ক্বাযা বা আল্লাহ্‌র ফয়সালা হচ্ছে এমন এক গোপন গূঢ় রহস্য যা জানা সম্ভবপর নয়।

এখন আপনার সামনে দুটো পথ খোলা আছে:

এক পথ আপনাকে নিরাপত্তা, সফলতা, সুখ ও সম্মানে পৌঁছাবে।

অপর পথ আপনাকে ধ্বংস, অনুতপ্ততা ও অসম্মানে পৌঁছাবে।

আপনি এখন এ দুটো রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং আপনি স্বাধীন। এমন কেউ নাই যে আপনাকে ডানের রাস্তায় চলতে বাধা দিবে কিংবা বামের রাস্তায় চলতে বাধা দিবে। আপনি চাইলে এই পথেও যেতে পারেন এবং ঐ পথেও যেতে পারেন।

এ আলোচনার মাধ্যমে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মানুষ তার স্বনির্বাচিত কর্মে স্বাধীনভাবে অগ্রসর হতে পারে। অর্থাৎ সে তার দুনিয়াবী কর্মে যেভাবে স্বাধীনভাবে অগ্রসর হতে পারে; অনুরূপভাবে সে তার আখিরাতের পথেও এভাবে স্বাধীনভাবে চলতে পারে। বরং আখিরাতের পথগুলো দুনিয়ার পথগুলোর চেয়ে আরো বেশি সুস্পষ্ট। কারণ আখিরাতের পথগুলোর বর্ণনাকারী আল্লাহ্‌তাআলা নিজে; তাঁর নাযিলকৃত গ্রন্থে ও তাঁর রাসূলের মুখে। তাই আখিরাতের পথগুলো দুনিয়ার পথগুলোর চেয়ে অধিক স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। তা সত্ত্বেও মানুষ দুনিয়ার পথগুলো ধরে অগ্রসর হয়; যার ফলাফলের গ্যারান্টি নাই। কিন্তু আখিরাতের পথগুলো বর্জন করে; অথচ সেগুলোর ফলাফল গ্যারান্টিযুক্ত ও সুবিদিত; কেননা এর ফলাফল আল্লাহ্র প্রতিশ্রুত। আল্লাহ্‌তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।

এই আলোচনার পর আমরা বলব: আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত এই আকিদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা তাদের আকিদা-বিশ্বাস এভাবে ঠিক করেছেন যে, মানুষ নিজ ইচ্ছায় তার কর্ম করে এবং তার ইচ্ছানুযায়ী সে কথা বলে। কিন্তু তার ইচ্ছা ও এখতিয়ার আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের অনুবর্তী।

আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআত ঈমান রাখে যে, আল্লাহ্‌র অভিপ্রায় তাঁর হেকমত (প্রজ্ঞা)-র অনুবর্তী। আল্লাহ্‌র তাআলার হেকমত বর্জিত কোন অভিপ্রায় নাই; বরং তাঁর অভিপ্রায় তাঁর হেকমতের অনুবর্তী। কেননা আল্লাহ্‌র নামসমূহের মধ্যে রয়েছে الحكيم “আল-হাকীম” (বিচারক, নিপুণ ও প্রজ্ঞাবান)। “আল-হাকীম” হচ্ছেন— যিনি সবকিছুর অস্তিত্বগত ও আইনগত সিদ্ধান্ত দেন এবং কর্ম ও সৃষ্টির দিক থেকে সবকিছুকে নিপুণভাবে সম্পাদন করেন। আল্লাহ্‌তাআলা তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে যার জন্য ইচ্ছা হেদায়েত নির্ধারণ করে রাখেন, যার ব্যাপারে জানেন যে সে সত্যকে গ্রহণ করতে চায় ও তার অন্তর সঠিক পথে আছে এবং যে এমন নয় তার জন্য পথভ্রষ্টতা নির্ধারণ করে রাখেন, যার কাছে ইসলামকে পেশ করা হলে তার অন্তর সংকুচিত হয়ে পড়ে যেন সে আকাশে আরোহণ করছে। আল্লাহ্‌ তাআলার প্রজ্ঞা এমন ব্যক্তির হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়াকে অস্বীকার করে; তবে যদি না আল্লাহ্‌তাআলা তাঁর সংকল্পকে নবায়ন করেন এবং তাঁর পূর্ব ইচ্ছাকে অন্য কোন ইচ্ছা দিয়ে পরিবর্তন করে নেন। আল্লাহ্‌তাআলা সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। কিন্তু আল্লাহ্‌তাআলার হেকমত (প্রজ্ঞা)-র দাবী হচ্ছে— হেতুর ফলাফল সাথে সম্পৃক্ত থাকা।”[রিসালা ফিল কাযা ওয়াল ক্বাদর (পৃষ্ঠা-১৪-২১) থেকে সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]

 

একজন মুসলিম ক্বাযা ও ক্বাদর (ভাগ্য ও নিয়তি)-এর বিষয়টি যে কর্মের দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে তার সাথে এভাবেই বুঝে থাকে। যে কর্মের উপর তার সুখ ও দুঃখ নির্ভর করে। হেদায়েতপ্রাপ্তি ও জান্নাতে প্রবেশের কারণ হচ্ছে— নেক আমল। আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “এই হল জান্নাত; তোমাদের কর্মের প্রতিদানে তোমাদেরকে এর উত্তরাধিকারী করা হয়েছে।”[সূরা আরাফ, ৭:৪৩]

তিনি আরও বলেন: “তোমরা যেসব (ভাল) কাজ করতে তার প্রতিদানস্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ কর।”[সূরা নাহল, ১৬:৩২]

আর পথভ্রষ্টতা ও জাহান্নামের প্রবেশের কারণ হচ্ছে— আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা ও তাঁর আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। জাহান্নামবাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ্‌তাআলা বলেন: “তারপর অন্যায়কারীদেরকে বলা হবে, ‘চিরন্তন শাস্তি আস্বাদন কর। তোমরা যা উপার্জন করতে তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হচ্ছে।”[সূরা ইউনুস, ১০:৫২]

তিনি আরও বলেন: “তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য চিরস্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে থাক।”[সূরা আস-সাজদাহ, ৩২:১৪]

এভাবে বুঝলে একজন মুসলিম সঠিক পথে তার প্রথম পদক্ষেপ ফেলতে পারবে। সে তার জীবনের একটি মুহূর্তও আল্লাহ্‌র পথে আমল করা ছাড়া নষ্ট করবে না। একই সময়ে সে তার রবের প্রতি বিনয়ী থাকবে এবং উপলব্ধি করবে যে, তাঁর হাতেই রয়েছে আসমান ও জমিনের নিয়ন্ত্রণ। তখন সে সার্বক্ষণিক তাঁর কাছে ভিখারি হয়ে থাকা ও তাঁর তাওফিকপ্রাপ্তির প্রয়োজন অনুভব করবে।

আমরা আল্লাহ্‌তাআলার কাছে আমাদের জন্য ও আপনাদের জন্য হেদায়েতপ্রাপ্তি এবং সকল ভাল কর্মের তাওফিক প্রার্থনা করছি। আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

 

হেদায়াতের প্রকার ও যারা হেদায়াত পায় এবং যারা পায় না

————————————————————-

হেদায়াত দুই প্রকারঃ

প্রথমটি হলো আল্লাহর সাধারণ হেদায়াত এবং দ্বিতীয়টি হলো তাঁর স্বর্গীয় আসমানী হেদায়াত।

সাধারণ হেদায়াত সমস্ত মানবজাতির জন্য বৈশ্বিক। আরো বিশেষভাবে বলতে গেলে, আল্লাহ প্রত্যেককেই তাঁর বিশুদ্ধ পথে আহবান করেন; তিনি নবী এবং রাসূল পাঠান ও তাদেরকে মুজিযা এবং কিতাব দিয়ে প্রতিটি মানুষের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছানোর জন্য সহযোগিতা করেন। আল্লাহ তাঁর পথ অনুসরণের ফল এবং পরিত্যাগের পরিণতি স্পষ্ট করে দেন। সুতরাং যেকেউ ইচ্ছে করলে তাঁর সিরাতাল মুস্তাকিমের অনুসরণ করতে পারে আর যে চায় এ পথ পরিত্যাগ করতে পারে। দুংখের বিষয় হলো, আল্লাহ-র হেদায়াত সত্ত্বেও অনেক মানুষ আল্লাহর বাণীর পাওয়ার পর ভিন্ন পথে যাওয়ার জন্য তারা ভিন্ন পথ বাছাই করে। চলুন আল-কুরআন থেকে একটি উদাহরণ নিইঃ

“আর সামূদ (জাতির অবস্থা ছিলো), আমি তাদেরকেও সৎ পথ প্রদর্শন করেছিলাম, অতঃপর তারা সৎপথের পরিবর্তে অন্ধ থাকাই বেশি পছন্দ করলো। অতঃপর তাদের (অন্যায়) কৃতকর্মের কারণে আমি তাদের ওপর অবমাননাকর শাস্তি দিয়ে পাকড়াও করলাম।”

⦗সূরা হা-মীম সেজদাহঃ ১৭⦘

এসব লোকেরা তাদের স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে জেনেছিলো যে আল্লাহ তাদেরকে সিরাতাল মুস্তাকিমের পথ দেখিয়েছিলেন কিন্তু তারা সে সরল পথের অনুসরণ করে নি। কিন্তু যারা এই পথ অনুসরণ করে তাদের অবস্থা কেমন?…তারা কেমন সহায়তা পেয়েছিলো? আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে স্বর্গীয় হেদায়াত দিয়েছিলেন; আল্লাহ তাদের অন্তরে ঈমান ও তাকওয়াকে প্রিয় করে দিয়েছেন, এবং জান্নাতে যাওয়ার কাজগুলো তাদের জন্য সহজ করে করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাদেরকে পাপ ও ক্ষতি থেকে সুরক্ষিত রেখেছেন ও কষ্টের সময় তাদেরকে সহায়তা করেছেন। স্বর্গীয় হেদায়াত মুমিনদের জন্য নির্দিষ্টি, যেমনটি আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ

“আর যারা সৎপথ প্রাপ্ত হয়েছে, তাদের সৎপথ প্রাপ্তি আরও বেড়ে যায় এবং আল্লাহ তাদেরকে তাকওয়া দান করেন।”

⦗সূরা মুহাম্মাদঃ ১৭⦘

আল্লাহর সমস্ত মানবজাতির জন্য সাধারণ হেদায়াত এবং মুমিনদের জন্য স্বর্গীয় হেদায়াতের মাঝে পার্থক্য হলো যেমন পার্থক্য একজন ব্যক্তির কাছে শুধু একটি ম্যাপ আছে, আর আপনার সাথে আছে একজন পথপ্রদর্শক (ঠিক অপরিচিত জায়গায় ট্যুরিস্ট গাইডের মতো), যিনি আপনাকে প্রত্যেক মোড়ে, প্রতিটি অবস্থায় সেরা পথটিই দেখান। যে ব্যক্তি তাকওয়ার সৎ পথ অবলম্বন করে সে তাঁর জীবনের সমস্ত বিষয়েই আল্লাহর সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। অপরপক্ষে যারা তাঁর পথ থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে আল্লাহ তাদেরকে ত্যাগ করেন এবং তাদেরকে ভ্রান্ত পথে ছেড়ে দেন। আল-কুরআনে এ বিষয়টি উল্লেখ হয়েছে এই আয়াতেঃ

“যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে একটি শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী। ”

⦗সূরা যুখরুফঃ ৩৬⦘

আপনি কুরআন পড়তে থাকবেন, আপনি দেখবেন আল্লাহর স্বর্গীয় হেদায়াত থেকে তিন শ্রেণির মানুষ বঞ্চিত থাকে। আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে নীচের আয়াতগুলোতে তালিকাবদ্ধ করেছেনঃ

“(আল্লাহকে অস্বীকার করা এবং এর শাস্তি পাওয়া) এটা এ জন্যে যে, তারা পার্থিব জীবনকে পরকালের চাইতে প্রিয় মনে করেছে এবং আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।”

⦗সূরা নাহলঃ ১০৭⦘

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ

“এটি এ বিষয়ের সহজতম উপায় যে, তারা ঠিক ঠিক সাক্ষ্য নিয়ে আসবে অথবা ভয় করবে যে, তাদের কসম আবার অন্য কারো কসম দ্বারা বাতিল করে দেয়া হবে। আল্লাহকে ভয় কর এবং শুন, আল্লাহ দুরাচারী-দুর্নীতিগ্রস্ত পাপীদের সৎপথ প্রদর্শন করবেন না।”

⦗সূরা আল মায়েদাহঃ ১০৮⦘

এবং সর্বশেষঃ

“তুমি কি সে লোকের অবস্থা দেখনি, আল্লাহ তাকে রাজ্য দেওয়ার পর সে স্বয়ং মালিকের ব্যাপারে বাদানুবাদ করেছিল ইব্রাহীমের সাথে? ইব্রাহীম যখন বললেন, আমার পালনকর্তা হলেন তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমি জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি। ইব্রাহীম বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন এবার তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর। তখন সেই কাফের হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ সীমালংঘণকারী জালিম সম্প্রদায়কে সরল পথ প্রদর্শন করেন না”।

⦗সূরা আল বাক্বারাহঃ ২৫৮⦘

অতএব,

সত্য অবিশ্বাসী-অস্বীকারকারী (কাফির),

দুরাচার-দুর্নীতিগ্রস্ত (ফাসিক) এবং

অন্যায়-জুলুমকারীরা (যালিম)

এই তিন শ্রেণীর লোকেরা আল্লাহর সিরাতাল মুস্তাকিমের স্বর্গীয় হেদায়াত থেকে নির্বাসিত, তাড়িত, বঞ্চিত।

————————————————————————————

উৎস বইঃ আল-ফাতিহা –মূল ইমাম মুতওয়াল্লী আল-শারাওয়ী রাহিমাহুল্লাহ

 

আল্লাহ অনুগ্রহ করে যাকে ইচ্ছা, তাকে হেদায়াত, আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করেন। আর যাকে ইচ্ছা ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পথভ্রষ্ট করেন, অপমানিত করেন ও বিপদগ্রস্ত করেন।

ইমাম ইবনে আবীল ইয আল-হানাফী (রহিমাহুল্লাহ)

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَيَعْصِمُ وَيُعَافِي فَضْلًا وَيُضِلُّ مَنْ يَشَاءُ وَيَخْذُلُ وَيَبْتَلِي عَدْلًا

আল্লাহ অনুগ্রহ করে যাকে ইচ্ছা, তাকে হেদায়াত, আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করেন। আর যাকে ইচ্ছা ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পথভ্রষ্ট করেন, অপমানিত করেন ও বিপদগ্রস্ত করেন।

……………………………

ব্যাখ্যা: এখানে মুতাযেলাদের ঐ কথার প্রতিবাদ করা হয়েছে, যেখানে তারা বলেছে যে, বান্দার জন্য যা কিছু কল্যাণকর ও উপকারী আল্লাহ তা‘আলার উপর তার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। এ মাস‘আলাটি বান্দাকে সঠিক পথ দেখানো এবং বিপথগামী করার মাস‘আলার সাথে সম্পৃক্ত। মুতাযেলারা বলেছে, আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দাকে হেদায়াত করার অর্থ হলো, বান্দার জন্য সঠিক পথ বর্ণনা করে দেয়া। এর বাইরে তাকে হেদায়াত গ্রহণের তাওফীক দেয়া কিংবা সাহায্য করা তার কাজ নয়। আর তাকে গোমরাহ করার অর্থ হলো বান্দাকে কেবল গোমরাহ হিসাবে নামকরণ করা এবং বান্দা যখন নিজের জন্য গোমরাহী সৃষ্টি করে তখন তাকে গোমরাহ হিসাবে নাম দেয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। আল্লাহ বান্দাকে গোমরাহ করেন কিংবা বান্দার জন্য গোমরাহী সৃষ্টি করেন, এমনটি নয়। তারা তাদের বাতিল মূলনীতির উপরই এ কথার ভিত্তি রচনা করেছে। তাদের অন্যতম মূলনীতি হলো, বান্দারাই তাদের কাজ-কর্ম সৃষ্টি করে।

আল্লাহ তা‘আলাই বান্দাকে স্বীয় অনুগ্রহে প্রকৃতপক্ষেই হেদায়াত করেন এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতেই কাউকে গোমরাহ করেন। এ বিষয়ে অনেক দলীল রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ

‘‘তুমি যাকে পছন্দ করো, তাকে হেদায়াত করতে পারবে না[1], তবে আল্লাহ্ তা‘আলাই যাকে ইচ্ছা হেদায়াতের পথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই অধিক অবগত আছেন’’। (সূরা কাসাস: ৫৬)

সুতরাং হেদায়াত অর্থ যদি শুধু রাস্তা বলে দেয়া হতো, তাহলে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হেদায়াতকে নাকোচ করা সঠিক হতো না। কেননা তিনি তার শত্রু-বন্ধু সকলের জন্যই পরিস্কারভাবে রাস্তা বলে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلَوْ شِئْنَا لَآتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا

‘আমি যদি ইচ্ছা করতাম তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই সৎপথে আনয়ন করতাম’। (সূরা সাজদাহ: ১৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

يُضِلُّ اللَّهُ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ

‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান হেদায়াত দান করেন’। (সূরা মুদ্দাছ্ছির: ৩১)

আল্লাহর পক্ষ হতে হেদায়াতের অর্থ যদি কেবল রাস্তা বর্ণনা করাই হতো, তাহলে ইচ্ছার সাথে শর্তযুক্ত করা হতো না। কেননা তিনি সকল সৃষ্টির জন্যই সঠিক পথ বর্ণনা করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلَوْلَا نِعْمَةُ رَبِّي لَكُنتُ مِنَ الْمُحْضَرِينَ

‘‘আমার রবের মেহেরবাণী না হলে আমিও আটক ব্যক্তিদের মধ্যে শামিল হতাম’’। (সূরা সাফফাত: ৫৭) আল্লাহ তা‘আলা সূরা আন‘আমের ৩৯ নং আয়াতে বলেন,

مَن يَشَإِ اللَّهُ يُضْلِلْهُ وَمَن يَشَأْ يَجْعَلْهُ عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন আবার যাকে চান সত্য সরল পথে পরিচালিত করেন।

সুতরাং বুঝা গেল, আল্লাহ তা‘আলা যে বান্দাদের শুধু হেদায়াতের পথ বর্ণনা করেন, তাই নয়; বরং তিনি হেদায়াতের তাওফীকও দান করেন।

[1]. রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে হেদায়াতের মালিক নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে, তা হচ্ছে হেদায়াতের তাওফীক দেয়া। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কেউ এ প্রকার হেদায়াতের মালিক নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تُؤْمِنَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ

‘‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ ঈমান আনতে পারে না’’। (সূরা ইউনূস: ১০০) নূহ (আ.) তার পুত্রকে হেদায়াত করতে পারেননি, স্ত্রীকেও সৎ পথে আনতে পারেননি। ইবরাহীম খলীল (আ.) তার পিতাকে দ্বীনের পথে আনয়ন করার চেষ্টা করেও সফল হননি। লুত (আ.)এর ক্ষেত্রেও একই কথা। তার স্ত্রীকে সুপথে আনতে পারেননি। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম ও ইসহাক (আ.)এর ব্যাপারে বলেন,

وَبَارَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَى إِسْحَاقَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمٌ لِنَفْسِهِ مُبِينٌ

‘তাকে (ইবরাহীমকে) এবং ইসহাককে আমি বরকত দান করেছি। তাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মী এবং কতক নিজেদের উপর স্পষ্ট যুলুমকারী। (সূরা সাফফাত: ১১৩)

আর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে প্রকার হেদায়াত করতে সক্ষম বলে কুরআন সাক্ষ্য দিয়েছে, তা হচ্ছে হেদায়াতের পথ দেখানো। তিনি এবং সকল নাবী-রসূলই মানুষকে হেদায়াতের পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা সূরা শুরার ৫২ নং আয়াতে বলেন, وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‘‘নিশ্চয় আপনি সরল পথপ্রদর্শন করেন’’।

 

*** আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে খুব ভালোবেসে সর্বোৎকৃষ্ট অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা ত্বীন : ৪।)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আমি কি তাকে দুটো চোখ, একটি জিহ্বা ও দুটো ঠোঁট দিইনি? আমি কি তাকে দুইটি সুস্পষ্ট পথ দেখাইনি?’ (সূরা বালাদ : ৮-১০)।

অর্থাৎ তাকে সৃষ্টি করেই ছেড়ে দিইনি। ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায় চেনার জন্য বোধশক্তিও দিয়েছি। (যাদুল মুসীর ফী ইলমিত তাফসীর)।

আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের আত্মা ও সেই সত্তার শপথ! যিনি তাকে সঠিকভাবে গঠন করেছেন। তারপর তাকে পাপ ও তাকওয়ার প্রতি ইলহাম করেছেন, অর্থাৎ জানিয়েছেন-চিনিয়েছেন।’ (সূরা শামস : ৭-৮)।

‘এখন চাইলে সে কৃতজ্ঞ হবে নয়তো কুফরের পথ অনুসরণ করবে।’ (দাহর/ইনসান : ৩)। –

যা এখানে তা তুলে ধরা হলো-

رَبَّنَا اَتِنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً وَّ هَيِّئْ لَنَامِنْ أَمْرِنَا رَشَداً

উচ্চারণ : ‘রাব্বানা- আতিনা- মিল্লাদুনকা রাহমাতাও ওয়া হাইয়্যিই লানা- মিন আমরিনা- রাশাদা।

‏ اللَّهُمَّ انْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي وَعَلِّمْنِي مَا يَنْفَعُنِي وَزِدْنِي عِلْمًا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ عَلَى كُلِّ حَالٍ وَأَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ عَذَابِ النَّارِ ‏”‏ ‏.‏

হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে জ্ঞান দান করেছো, তার দ্বারা আমাকে উপকৃত করো, আমার জন্য উপকারী জ্ঞান আমাকে শিখিয়ে দাও এবং আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করো। সর্বাবস্থায় সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর! আমি জাহান্নামের শাস্তি থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি। তিরমিযী ৩৫৯৯।

১। আল-ফিকহুল আকবর  আল-ফিকহুল আকবারের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা  ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)

২। ঈমানের মূলনীতিসমূহের ব্যাখ্যা  মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উছাইমীন

https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=44&section=566

তাফসিরে যাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন, অন্যান্য আর্টিকল