সূরা আল বাকারাঃ৩য় রুকু(আয়াত সংখ্যাঃ২১-২৯)

৩য় রুকু(আয়াত সংখ্যাঃ২১-২৯)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:২১ یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ

২১. হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই রব-এর ইবাদাত কর যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববতীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হও।

আয়াতে উল্লেখিত ‘নাস’ আরবী ভাষায় সাধারণভাবে মানুষ অর্থে ব্যবহৃত হয়।

ফলে পূর্বে আলোচিত মানব সমাজের মুমিন-কাফির ও মুনাফিক এ তিন শ্রেণীই এ আহবানের অন্তর্ভুক্ত। তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, তোমাদের রব-এর ইবাদাত কর।

যদিও কুরআনের দাওয়াত সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতির জন্য তবুও এ দাওয়াত থেকে লাভবান হওয়া না হওয়া মানুষের নিজের ইচ্ছা প্রবণতার ওপর এবং সেই প্রবণতা অনুযায়ী আল্লাহ প্রদত্ত সুযোগের ওপর নির্ভরশীল ৷

তাই প্রথমে মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে কোন্‌ ধরনের লোক এ কিতাবের পথনির্দেশনা থেকে লাভবান হতে পারে এবং কোন্‌ ধরনের লোক লাভবান হতে পারে না তা সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে ৷ তারপর এখন সমগ্র মানবজাতির সামনে সেই আসল কথাটিই পেশ করা হচ্ছে , যেটি পেশ করার জন্য কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল ৷

নাস শব্দটির কয়েকটি অর্থ আছে;

  • এর একটি উৎপত্তি “নিসিয়ান” শব্দ থেকে হয়েছে – যার অর্থ হলো ভুলে যাওয়া।

মানুষ ইতিমধ্যে আল্লাহর কাছে তাদের অঙ্গীকার ভুলে গিয়েছে, তাই তাদেরকে  নাস বলা হয়:

আমাদের আত্মা যখন প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছিল তখন আল্লাহর কাছে  আমরা সাক্ষ্য দিয়েছিলাম-

আমাদেরকে(আদম সন্তানদেরকে) আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) প্রশ্ন করেছিল, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? আমরা বলেছিলাম, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। তিঁনি বলেছিলেন, আবার কেয়ামতের দিন না বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। সূরা আল-আ’রাফ:১৭২

আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) শয়তানকে একটি ক্ষমতা দিয়েছেন, সে মানুষকে ভুলিয়ে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় বেপার যা মানুষ সবসময় ভুলে যায় তা হলো আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাদেরকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে ও তাদের কার্যকলাপের রেকর্ড রাখছে।

  • নাস আরেকটি শব্দ আনাসা থেকে এসেছে। ইনাস মানে দেখতে পায় বা গ্রহন করে।

জীন-(চোখের আড়ালে থাকে) জান্নাহ অর্থ আবৃত থাকা বা লুকিয়ে থাকা(জান্নাত যদিও আরেক অর্থ বাগান), বাচ্চা যখন ওম্বের ভিতর থাকে তখন ওম্বকে বলা হয় জেনিন যা বাচ্চাটিকে লুকিয়ে রাখে বা কভার করে রাখে।

  • নাস এসেছে ওনস যা বিপরীত ওয়াহাস( হিংস্রতা) পশুদের চরিত্র। মানুষ আসফালা সাফেলীন হয়ে যায় চরিত্রের পরিবর্তনের কারনে। মানুষ মূলত স্নেহ পরায়ন, সভ্যতার, মানবীয় গুনাবলী সম্পন্ন।

ইবাদাত শব্দটি কুর’আনের ধারাবাহিকতায় প্রথমে সূরা ফাতেহাতে এসেছে, এখানে বাকারাতে এসেছে ২য় বারে। প্রথম এসেছে সুরা ফাতেহাতে(ইয়্যা কানায়বুদু) যা আমরা বলেছি আল্লাহর ইবাদাত করি।কিন্তু এই বাকারাতে এসেছে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন ইবাদাত করতে।

সূরা ফাতেহাতে আলোচিত হয়েছে ৩টি গ্রুপ বা শ্রেনীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে। যা ইবাদাতের কথা বলার পর গ্রুপের কথা এসেছে।

বাকারাতেও ৩টি গ্রুপ বা শ্রেনীর কথা এসেছে(ইমানদার, কাফের, মুনাফিক) তবে প্রথমে এদের কথা বলে পরে ইবাদাতের কথা এসেছে।

সুতরাং এখন ইবাদাত করো রবের যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং ইবাদাতের মাধ্যমে যা লাভ হবে তা হলো নিজেকে রক্ষা করার জন্যই।

পুরো কুর’আনের মূল কথাই হলো আল্লাহকে প্রভু বা রব হিসেবে গ্রহন করা ও নিজেকে দাস হিসেবে মেনে নেয়া।

মানুষের জীবন কোন না কোন সম্পর্কে যুক্ত থাকে। পরিবারে বিভিন্ন সম্পর্ক, সমাজ ও রাষ্ট্রেও সম্পর্কের বিভিন্ন ধরন থাকে।

আল্লাহর সাথে সম্পর্কের মূল হলো এই কুর’আন যা রবের নির্দেশিকা সম্বলিত।

যেকোন সম্পর্কটা না বুঝলে হক আদায় হয় না, সম্পর্ক রক্ষা হয় না।

আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের মূল সুত্রই হলো তিনি রব আমরা আবদ বা দাস।

যখন রব বলা হয় তখনই বুঝা যায় আল্লাহ কিছু চান না আমাদের কাছে। তিনি অমুখাপেক্ষি। আমরা দাস হিসেবেই তাঁর দিকেই পূর্ণ মুখাপেক্ষি।

এই সম্পর্কের মূল চেতনাই হলো ভালোবাসা। মহান রব তাঁর দাসকে ভালোবেসেই সৃষ্টি করেছেন, পাঠিয়েছেন, গাইডেন্স দিয়েছেন।

তাকুন, তাত্তাকুন এর একটি অর্থ নিজেকে রক্ষা করা, সুরক্ষা করা। আল্লাহর ইবাদাতের মাধ্যমেই এই সুরক্ষা নিশ্চিত হতে পারে।

ইবাদাতের আভিধানিক অর্থ নম্র ও অনুগত হওয়া আর শরীআতের পরিভাষায় ইবাদাত হচ্ছেঃ আল্লাহ্ তা’আলা ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন এমন সব প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজের ব্যাপক একটি নাম। এ সমস্ত কথা ও কাজ পরিপূর্ণ ভালবাসা ও পরিপূর্ণ বিনয়ের সাথে আল্লাহর জন্য আদায় করলেই তা আমাদের পক্ষ থেকে ইবাদাত বলে গণ্য হবে।

সুতরাং আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমস্ত বিষয়ের ব্যাপারে আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তা’আলা সেসব কাজ বা কথা ভালবাসেন তার বাইরে কোন কিছুর মাধ্যমে আমরা তার ইবাদাত করতে পারব না। ইবাদাতের ভিত্তি তিনটি রুকনের উপর স্থাপিত।

এক. আল্লাহ্ তা’আলার জন্য পরিপূর্ণ ভালবাসা পোষণ করা।

যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ

কিন্তু( আল্লাহর একত্বের প্রমাণ নির্দেশক এসব সুস্পষ্ট নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও) কিছু লোক আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে তাঁর সমকক্ষ ও প্রতিপক্ষ দাঁড় করায় এবং তাদেরকে এমন ভালোবাসে যেমন আল্রাহকে ভালোবাসা উচিত – অথচ ঈমানদাররা সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে ভালোবাসে । হায়! আযাব সামনে দেখে এই যালেমরা যা কিছু অনুধাবন করার তা যদি আজই অনুধাবন করতো যে , সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর অধীন এবং শাস্তি ব্যাপারে আল্লাহ অত্যন্ত কঠোর ৷  [সূরা আল-বাকারাহঃ ১৬৫]

 দুই. পরিপূর্ণ আশা পোষণ করা।

যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ

এরা যাদেরকে ডাকে তারা তো নিজেরাই নিজেদের রবের নৈকট্যলাভের উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে যে, কে তাঁর নিকটতর হয়ে যাবে এবং এরা তাঁর রহমতের প্রত্যাশী এবং তাঁর শাস্তির ভয়ে ভীত৷ আসলে তোমার রবের শাস্তি ভয় করার মতো৷ সূরা আল ইসরাঃ ৫৭

তিন. আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে ভয় করা।

যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ “এবং তারা তার শাস্তিকে ভয় করে”। সূরা ইসরাঃ ৫৭

ইবাদত তিনটি ক্ষেত্রে বিভক্ত। যথা: অন্তর, মুখের ভাষা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।

▪অন্তর দ্বারা ইবাদত: যেমন, আল্লাহর প্রতি ভয়, ভরসা, ভালবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আগ্রহ, সৎ নিয়ত, আল্লাহকে মনে মনে স্বরণ করা, সৃষ্টিজীব নিয়ে ভাবা ইত্যাদি।

▪মুখের ভাষা ও অন্তর দ্বারা ইবাদত: যেমন, তাসবীহ, (সুবহানাল্লাহ), তাহলীল (লাইলাহা ইল্লাল্লাহ) ইত্যাদি দুআ ও যিকির পাঠ করা, আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত করা ইত্যাদি।

▪শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অন্তর দ্বারা ইবাদত: যেমন, সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদি ।

এছাড়া আরও অনেক ধরণের ইবাদত রয়েছে যেগুলো আদায়ের মাধ্যম হল, অন্তর, ভাষা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।

দুনিয়ার কাজ যা আল্লাহর ইবাদাতে ও আনুগত্যে সহায়ক সেকল কাজ খালেস নিয়্যত করলে ইবাদাতে পরিনত হবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“আর তোমাদের নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাস করাও সদকা। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে কেউ যখন যৌন আকাঙ্খা সহকারে স্ত্রীর সাথে সম্ভোগ করে, তাতেও কি সওয়াব হবে?

তিনি বলেন: “তোমরা জানো না যে, যখন কেউ হারাম পদ্ধতিতে যৌন সম্ভগ করে তখন সে গুনাহগার হয়!?

সুতরাং অনুরূপভাবে যখন সে ঐ কাজটি হালালপন্থায় সম্পন্ন করে তখন সে তার সওয়াব পায়।”

[মুসলিম: ১০০৬]

‘ইবাদাতের পরিচয়

‘ইবাদাত (عبادة) আরবী শব্দ। আরবী ভাষার শব্দ হলেও সকল ভাষাভাষী মুসলিমের কাছেই এটি অতীব পরিচিত। এটি একটি প্রসিদ্ধ ইসলামী পরিভাষা। আল কোরআনে এ শব্দটি বিভিন্নভাবে মোট ২৭৬ বার এসেছে।

‘ইবাদাত শব্দটি (عبد) ‘আবাদা’ শব্দের ক্রিয়ামূল, যার অর্থ (الطاعة) আনুগত্য করা, দাসত্ব করা, গোলামী করা, (التذلل والخضوع) বিনয়ী হওয়া, অনুগত হওয়া, (الاتباع والانقياد) মেনে চলা ইত্যাদি।

মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের অনুগত হওয়া ও তাঁর বিধান মেনে চলাকে শারী‘য়াতের পরিভাষায় ‘ইবাদাত বলা হয়।

কোরআনুল কারীমে মহান রাববুল ‘আলামীন ‘আব্দ ও ‘ইবাদ শব্দদ্বয়কে দাস ও গোলাম অর্থে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে (একবচনে) ‘আব্দ এবং (বহুবচনে ) ‘ইবাদ বলে সম্বোধন করেছেন।

আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দাহ হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহ অন্যান্য নবী-রাসূলদেরকে তিনি ‘আব্দ বলে পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য অনুগত বান্দাদেরকে তিনি ‘ইবাদুর রাহমান বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেকে আল্লাহর ‘আব্দ বা বান্দাহ হিসেবে পরিচয় দিতে খুবই স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন।

মা‘বুদ (معبود), ‘ইবাদাত (عبادة) ও ‘আব্দ (عبد):

‘আরবী মা‘বুদ (معبود) শব্দটি ‘ইবাদাত (عبادة) ধাতু থেকে কর্ম বাচক বিশেষ্য। অর্থাৎ যার ‘ইবাদাত করা হয়। ইংরেজীতে এর অর্থ করা হয়- Worshiped, Adored, Deity, Godhead, Idol and Master etc. এখান থেকেই ‘আব্দ (عبد) শব্দটি দাস বা চাকর অর্থে ব্যবহৃত। কেননা, ‘আব্দ যা করে তাই ‘ইবাদাত , দাস যা করে তাই দাসত্ব এবং চাকর যা করে তাই চাকুরী। মহান আল্লাহ হলেন আমাদের মা‘বুদ আর আমরা হলাম তাঁর ‘আব্দ। তিনি হলেন আমাদের মনিব আর আমরা হলাম তাঁর দাস। মা‘বুদ তথা মনিবের কাজ হলো হুকুম দেয়া , আর ‘আব্দ তথা দাসের কাজ হলো সে হুকুম পালন করা। এ কারণেই ‘আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বুদ নেই’- এ কথার অর্থ হলো তিনি ছাড়া কোন হুকুমকর্তা নেই, আইন ও বিধানদাতা নেই। আর তাই আমরা জীবনের সকল ক্ষেত্রে কেবল তাঁরই হুকুম মেনে চলতে আদিষ্ট।

আল্লাহর হুকুম তথা আইন ও বিধানগুলোই হলো ইসলাম। মানুষের জন্য এটিই আল্লাহর মনোনীত একমাত্র বিধান। এছাড়া অন্য কোন মত, পথ ও বিধান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ইরশাদ হয়েছে:

(إن الدين عند الله الإسلام)

‘‘নি:সন্দেহে আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দীন (জীবন ব্যবস্থা) হলো ইসলাম’’।

(ومن يبتغ غير الإسلام دينا فلن يقبل منه وهو في الآخرة من الخاسرين)

‘‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন বিধান অবলম্বন করতে চায়, কস্মিনকালেও তা তার থেকে গ্রহণ করা হবেনা। এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত’’।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئاً

তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। (সূরা আন নিসা আয়াত নং ৩৬)।

তাই মানুষের উচিত বিধানদাতা হিসেবে শুধু তাঁকেই মেনে নেয়া এবং নিজেদের আবিষ্কার করা মত ও পথকে আল্লাহর বিধানের উপর প্রাধান্য না দেয়া। কেননা বিশ্বলোকের মহান স্রষ্টা এবং এর একচ্ছত্র মালিক হিসেবে এটি আল্লাহ তা‘আলার জন্যই সংগত যে, তিনি তাঁর সৃষ্টির জন্য যথার্থ বিধান রচনা করবেন এবং তাদেরকে তাঁর সে বিধান মেনে চলার আদেশ করবেন। আর এ কারণেই তিনি হলেন একমাত্র মা’বূদ। তাঁর বিধানের অনুসরণই হলো ‘ইবাদাত এবং যারা এই বিধান অনুসরণের জন্য আদিষ্ট তাদেরকেই বলা হয় ‘আব্দ।

ইবাদাত ও ঈমান (إيمان):

‘ইবাদাত ও ঈমানের মাঝে রয়েছে এক চমৎকার আত্মিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক যথার্থরূপে নিরুপণ করতে পারলে ‘ইবাদাতের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করা সহজতর হবে। কেননা ঈমান হলো ‘ইবাদাত তথা আমলের ভিত্তি। ঈমান ছাড়া আমল মূল্যহীন। তাছাড়া সাধারণভাবে মানুষের কর্মে তার চিন্তা চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কারণ যা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাই সে কর্মে পরিণত করে। এবং সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে যা করা হয় তা অবশ্যই একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে করা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে যে কাজের পেছনে কোন লক্ষ্য-উদ্দ্যেশ্য কিংবা আকীদা-বিশ্বাস নেই, সে কাজে নিষ্ঠা থাকে না এবং তা গ্রহণযোগ্যও নয়। বিশেষ করে ইসলামের বেলায় ঈমান হলো আমলের পূর্বশর্ত। ঈমান বিহীন আমলের কোনই মূল্য নেই। এ কারণেই হাদীস শরীফে ঈমানকে ইসলামের প্রথম স্তম্ভ স্থির করা হয়েছে। এবং অন্যান্য স্তম্ভগুলোকে এ স্তম্ভটির উপর নির্ভরশীল বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

ঈমান শব্দটিও ‘আরবী। এর শাব্দিক অর্থ হলো বিশ্বাস স্থাপন। আর শারী‘য়াতের পরিভাষায় ঈমান হলো অন্তরে বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি ও তদনুযায়ী কাজ করার নাম। অর্থাৎ ইসলামী বিধিমালাকে গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও স্বীকৃতি দানই ঈমান। গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সদিচ্ছা না থাকলে মৌখিক স্বীকৃতির দ্বারা মু’মিন হওয়া যায়না। এ জন্যেই আরবের মুশরিকরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, রিযকদাতা ইত্যাদি হিসেবে মানা সত্বেও মু’মিন হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।

মহান আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়ার পর তাঁকে শুধু ‘খালিক’ বা স্রষ্টা হিসেবে মেনে নিলেই মু’মিন হওয়া যায় না। বরং তাঁর সমস্ত সৃষ্টির জন্য অবশ্য পালনীয় বিধি বিধান তিনিই রচনা করেছেন অন্য কেউ নয় এবং তিনি ছাড়া অন্য কারো বিধান পালন করা যাবে না- একথা অকপটে মেনে নিলেই সত্যিকার মু’মিন হওয়া যায়। এ কারণেই ঈমান তথা বিশ্বাসের অনিবার্য দাবী হিসেবে ‘ইবাদাত তথা বাস্তব কর্ম সম্পাদন করতে হয়। ঈমান বিহীন ‘ইবাদাত যেমন মূল্যহীন, আবার ‘ইবাদাত বিহীন ঈমানও তেমন মূল্যহীন। আরবের মুশরিকরা রব হিসেবে আল্লাহকে স্বীকার করত। কিন্তু তারা তাদের ‘ইবাদাত বা উপাসনার বেলায় আল্লাহর সাথে অন্যান্য মূর্তিদেরকে শরীক করত। মহান আল্লাহ বলেন:

বলুন পৃথিবী এবং পৃথিবীতে যারা আছে, তারা কার? যদি তোমরা জান, তবে বল। এখন তারা বলবেঃ সবই আল্লাহর। বলুন, তবুও কি তোমরা চিন্তা কর না? বলুনঃ সপ্তাকাশ ও মহা-আরশের মালিক কে? এখন তারা বলবেঃ আল্লাহ। বলুন, তবুও কি তোমরা ভয় করবে না? বলুনঃ তোমাদের জানা থাকলে বল, কার হাতে সব বস্তুর কর্তৃত্ব, যিনি রক্ষা করেন এবং যার কবল থেকে কেউ রক্ষা করতে পারে না? এখন তারা বলবেঃ আল্লাহর। বলুনঃ তাহলে কোথা থেকে তোমাদেরকে জাদু করা হচ্ছে? সুরা আল মুমিনুনঃ৮৪-৮৯

তুমি জিজ্ঞেস কর, কে রুযী দান করে তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে, কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো তারপরেও ভয় করছ না? ইউনুসঃ৩১

যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে নভোমন্ডল ও ভূ–মন্ডল সৃষ্টি করেছে, চন্দ্র ও সূর্যকে কর্মে নিয়োজিত করেছে? তবে তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। তাহলে তারা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে?… যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করে, অতঃপর তা দ্বারা মৃত্তিকাকে উহার মৃত হওয়ার পর সঞ্জীবিত করে? তবে তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। বলুন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বোঝে না। আনকাবুতঃ ৬১,৬৩

আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, নভোমন্ডল ও ভূ–মন্ডল কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। বলুন, সকল প্রশংসাই আল্লাহর। বরং তাদের অধিকাংশই জ্ঞান রাখে না। লুকমানঃ২৫

যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে-আল্লাহ। বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ আমার অনিষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তবে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ডাক, তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি রহমত করার ইচ্ছা করলে তারা কি সে রহমত রোধ করতে পারবে? বলুন, আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে। যুমারঃ ৩৮

উপরোক্ত আয়াতসমূহে একথা স্পষ্টরূপে প্রতিয়মান হচ্ছে যে, আরবের মুশরিকরা আল্লাহকে স্বীকার করত এবং তাঁকেই তারা নিজেদের এবং অন্যদেরও স্রষ্টা বলে জানত। তথাপি শুধুমাত্র তাঁরই দাসত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে না নেয়ায় তারা ছিল ঈমানের গন্ডি বহির্ভূত। এবং এই স্বীকৃতির পরও কোরআন তাদেরকে মু’মিন বলেনি, বরং মুশরিক বলেছে। অতএব, ঈমান ও ‘ইবাদাত একটি অপরটির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। ‘ইবাদাতের মাধ্যমে ঈমানের স্বীকৃতির বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মু’মিন হওয়া যাবে।

ঈমান হলো ‘ইবাদাতের প্রবেশদ্বার:

(بني الإسلام على خمس) ইসলাম পাঁচটি খুঁটি বা স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত।

কোন ঘর বা ইমারত যেমন কয়েকটি খুঁটির উপর দন্ডায়মান হয় ঠিক তেমনি ইসলাম নামক ইমারতটির ভিত্তিও পাঁচটি খুঁটি বা স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। সম্ভবত ইসলামকে একটি ইমারত বা প্রাচীর সদৃশ বুঝাবার জন্যেই মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীসে ‘বিনা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ হলো ভিত্তি স্থাপিত হওয়া, নির্মিত হওয়া, কোন কিছুর প্রারম্ভ হওয়া ইত্যাদি।

আর যেহেতু তৎকালীন আরবে তাঁবুর প্রচলন ছিল সমধিক, যা পাঁচটি খুঁটি ছাড়া হয়না , তাই এখানে পাঁচ সংখ্যাটির ব্যবহার প্রণিধান যোগ্য। তাছাড়া তাঁবুর বেলায় যেমনি পাঁচটি খুঁটির মধ্যে মাঝের খুঁটিটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি ছাড়া তাঁবুর অস্তিত্বই টিকেনা, বা তাঁবুটি সঠিক অর্থে বাসযোগ্য হয়না, তদ্রুপ ইসলামের পাঁচটি খুঁটির মধ্যেও ঈমানের গুরুত্ব সর্বাধিক। এবং ঈমানের অবর্তমানে অন্যান্য খুঁটিগুলো মূল্যহীন। ঈমানকে বাদ দিয়ে ইসলামকে কল্পনাই করা যায় না এবং ঈমান ছাড়া ইসলাম কিছুতেই পরিপূর্ণ হতে পারে না।

সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফে ইবন ‘উমার (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ

( بني الإسلام على خمس : شهادة أن لا إله إلا الله وأن محمدا عبده ورسوله ، وإقام الصلاة ، وإيتاء الزكاة ، وصيام رمضان ، والحج )

‘‘ইসলাম পাঁচটি খুঁটির উপর প্রতিষ্ঠিত। (এক) এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল। (দুই) সালাত প্রতিষ্ঠা করা। (তিন) যাকাত আদায় করা। (চার) রামাদানে সিয়াম পালন করা ও (পাঁচ) হজ্জ করা।’’

উপরোক্ত পাঁচটি বিষয় ইসলামের মৌলিক খুঁটি। যার প্রথমটি নিরেট বিশ্বাস এবং পরবর্তীগুলো বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়। অন্য কথায় প্রথমটি হলো ঈমান আর পরবর্তীগুলো হলো ‘আমল বা ‘ইবাদাত।

ইবাদাত হলো ইসলামের প্রথম নির্দেশ:

আল-কোরআন ইসলামের যাবতীয় নির্দেশাবলী ও নিষেধাবলীর সমন্বিত গ্রন্থ। এ গ্রন্থে মহান আল্লাহর সকল আদেশ ও নিষেধকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। মানুষের যত করণীয় এবং যত বর্জনীয় বিষয় আছে, তা সবই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এ গ্রন্থে বলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ সবগুলো আদেশ এবং নিষেধ কোরআনের একই জায়গায় স্থান পায়নি। কোনটি স্থান পেয়েছে কোরআনের শুরুতে, আবার কোনটি শেষে। কোনটি শুধু মু’মিন কিংবা আহলে কিতাবদের উদ্দেশ্যে, আবার কোনটি সমগ্র মানবতার উদ্দেশ্যে। তবে কোরআনে উল্লেখিত ইসলামের সর্বপ্রথম যে নির্দেশনা সেটি হলো সমগ্র মানবতাকে লক্ষ্য করে।

লাওহে মাহফুযে আল-কোরআন যেভাবে সংরক্ষিত আছে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশনায় তা যেভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সে হিসেবে এর প্রথম নির্দেশই হলো ‘ইবাদাত। এই নির্দেশের আগে আল-কোরআনের মধ্যে আর কোন আদেশ সূচক বাক্য নেই। আর এই বাক্যটিই হলো ‘ইবাদাতের নির্দেশ সম্বলিত মহান আল্লাহর সর্বপ্রথম নির্দেশ। তিনি ইরশাদ করেন:

(يا أيها الناس اعبدوا ربكم الذي خلقـكم والذين من قبلكم لعـلكم تتقون . الذي جعل لكم الأرض فراشا والسماء بناء وأنـزل من السماء ماء فأخـرج به من الثمـرات رزقا لكم فلا تجـعلوا لله أنـدادا وأنتـم تعلـمون )

‘‘হে মানব সকল! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ‘ইবাদাত করো, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায় যে, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে। যিনি তোমাদের জন্য ভূমিকে করেছেন বিছানা, আর আকাশকে করেছেন ছাদ স্বরূপ। আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফলমূল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে। অতএব আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে সমকক্ষ স্থির কর না। মূলত: এসব তো তোমরা জান।’’

উক্ত আয়াতে সমগ্র মানবতাকে কেবল আল্লাহর ‘ইবাদাত বা দাসত্বের দিকে আহবান জানানো হয়েছে এবং এই দাসত্বে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল-কোরআনের আয়াতগুলো যে পরম্পরায় আমাদের সামনে সাজানো আছে তাতে আদেশ ও নিষেধ সম্বলিত এটিই কোরআনের প্রথম আয়াত। সুতরাং ‘ইবাদাত হলো ইসলামের প্রথম আদেশ এবং শিরক হলো ইসলামের প্রথম নিষেধ। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তাঁর ‘ইবাদাত করার ব্যাপারে আমাদেরকে সর্বপ্রথম আদেশ করেছেন এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার ব্যাপারে সর্বপ্রথম নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন।

‘ইবাদাতের আরেক কোরআনী পরিভাষা হলো ‘আমলে সালেহ’:

কোরআনুল কারীমে ‘ইবাদাতকে আরেকটি পরিভাষায়ও প্রকাশ করা হয়েছে। তা হলো ‘আমলে সালেহ’ বা নেক/সৎ আমল। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

হে মুহাম্মাদ! বলো, আমি তো একজন মানুষ তোমাদেরই মতো, আমার প্রতি অহী করা হয় এ মর্মে যে, এক আল্লাহ তোমাদের ইলাহ, কাজেই যে তার রবের সাক্ষাতের প্রত্যাশী তার সৎকাজ করা উচিত এবং বন্দেগীর ক্ষেত্রে নিজের রবের সাথে কাউকে শরীক করা উচিত নয়৷সূরা কাহফঃ১১০

এ আয়াতের শুরুতে যাকে আমলে সালেহ বা নেক কাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তাকেই আবার পরক্ষণে ‘ইবাদাত বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ইবাদাতেরই অপর নাম হলো আমলে সালেহ। ইমাম ইবন কাছীর (রহ.) এ আয়াতের তাফসীরে লিখেন:

‘‘যে তার রবের সাথে সাক্ষাত করতে চায়, অর্থাৎ যে ব্যক্তি তাঁর রবের কাছে সওয়াব ও প্রতিদান চায়, সে যেন নেক আমল করে। অর্থাৎ সে যেন এমন কাজ করে যা আল্লাহর শারী‘য়াত সমর্থিত। আর তার রবের সাথে কাউকে যেন শরীক না বানায়। অর্থাৎ নেক কাজের মাধ্যমে ঐ আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে যিনি একক, যাঁর কোন শরীক নেই। আর এ দুটি হচ্ছে আল্লাহর দরবারে গৃহীত আমলের ভিত্তি। কাজটি অবশ্যই শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য হতে হবে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শারী‘য়াত অনুযায়ী হতে হবে।’’

আরেকজন বিদগ্ধ ইসলামী পন্ডিত ‘আল্লামা আশ্ শাওকানী (রহ.) (মৃ. ১২৫৫ হি./ ১৮৩৪ খৃ.) এ আয়াত প্রসঙ্গে লিখেন:

‘‘নেক আমল বলতে এমন কাজকে বুঝায় যার পক্ষে শারী‘য়াতের দলীল আছে যে, কাজটি ভাল এবং কাজটি যে করবে সে সওয়াব লাভ করবে। আর তার রবের ‘ইবাদাতে কাউকে যেন শরীক না বানায় এর অর্থ হলো – তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে ভাল হোক বা মন্দ, প্রাণী হোক বা জড়, কাউকে সে যেন আল্লাহর ‘ইবাদাতে শরীক না বানায়।’’

সুতরাং কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী ‘ইবাদাত বলতে বুঝায় এমন সব কাজকে, যার বিধান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিয়েছেন। আর সে কাজটি কেবল তখনি ‘ইবাদাত বলে গণ্য হয়, যখন তা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে করা হয় এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দেখানো ও শেখানো পন্থায় সম্পাদিত হয়। তাই শারী‘য়াত সমর্থিত কোন কাজে যদি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য না হয় তাহলে তা যেমন ‘ইবাদাত রূপে গণ্য নয়, তদ্রুপ কোন আমলের পক্ষে যদি শারী‘য়াতের দলীল না থাকে, তাহলে তা যতই আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে করা হোক না কেন তাও ‘ইবাদাত নয়।

‘ইবাদাত হলো সকল নবী-রাসূলের প্রথম আহবান:

শুধু শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ই নন; বরং পূর্বেকার সকল নবী-রাসূলগণও সর্বপ্রথম নিজ নিজ জাতিকে এক আল্লাহর ‘ইবাদাতের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। এবং অন্য সব উপাস্যকে পরিহার করে এক আল্লাহর উপাসনার জন্য আদেশ করেছেন। আল-কোরআনের ভাষায় তাঁরা সকলেই এভাবে বলেছিলেন:

তিনি আরো বলেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং পরিহার কর তাগুতকে। (সূরা আন নাহল ৩৬)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَمَا أُمِرُوا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ

আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল­াহর ইবাদত করে তারই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে। (সূরা আল-বাইয়িনাহ আয়াত নং ০৫)

আল্লাহ তা‘আলা তার খলীল ইবরাহীম আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে  আরো বলেন,

إِنَّنِي بَرَاءٌ مِمَّا تَعْبُدُونَ – إِلاَّ الَّذِي فَطَرَنِي

আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম স্বীয় পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলেছিল,

‘তোমরা সেগুলোর ইবাদত কর, নিশ্চয় আমি তাদের থেকে সম্পর্কমুক্ত। তবে (তিনি ব্যতীত) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর নিশ্চয় তিনি আমাকে শীঘ্রই হেদায়াত দিবেন। (সূরা যুখরুফ আয়াত ২৬-২৭)

এটাই হলো লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ। আল্লাহ আ‘ল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ

আমি জ্বীন এবং মানব জাতিকে শুধু আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াত আয়াত নং ৫১: ৫৬)

তাই সকল নবী এবং রাসূলগণেরই প্রথম এবং প্রধানতম দায়িত্ব ছিল আপন আপন সম্প্রদায়কে মহান আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহবান জানানো। তাঁরা নিজেরাও এক আল্লাহর দাসত্বের পথ বরণ করে নিয়েছেন, তিনি ছাড়া অন্য সব উপাস্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এবং নিজ নিজ উম্মাতকেও এই পথ অনুসরণ করতে বলেছেন।

‘ইবাদাত হলো নির্ভেজাল ভালবাসা ও একনিষ্ঠ আনুগত্যের সমন্বিত রূপ:

কাউকে ভালবাসার অনিবার্য দাবী হলো তাঁর আনুগত্য, আর এ আনুগত্যের অনিবার্য ফল হলো তাঁর প্রতি ভালবাসা। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে তাই আল্লাহর সাথে তাঁর বান্দার ভালবাসার সম্পর্ককে আনুগত্যের সাথে শর্তযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে:

(قل إن كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله ويغفر لكم ذنوبكم والله غفور رحيم)

‘‘আপনি (হে নবী) বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাক তাহলে আমার অনুসরণ কর। যাতে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’’

এই ভালবাসা ও আনুগত্যের বেলায় আল্লাহ ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাঁদের একজনকে ভাল না বাসলে আরেক জনের ভালবাসা পাওয়া যায় না। এবং একজনের আনুগত্য অস্বীকার করলে আরেক জনেরও আনুগত্য করা হয়না। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

(من أطاعني فقد أطاع الله ومن عصاني فقد عصى الله)

‘‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে যেন আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে আমার নাফরমানী করল, সে যেন আল্লাহরই নাফরমানী করল।’’ এ প্রসংগে আল-কোরআনে মহান আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণাও রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে:

(من يطع الرسول فقد أطاع الله ومن تولى فما أرسلناك عليهم حفيظا)

‘‘যে লোক রাসূলের হুকুম মান্য করবে, সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করলো আমি আপনাকে (হে মুহাম্মাদ) তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।’’

আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি ভালবাসা ও আনুগত্যের এই সমন্বিত রূপই হলো ‘ইবাদাত। কেননা আনুগত্যহীন ভালবাসা হলো অন্ত:সার শূন্য। আর ভালবাসাহীন আনুগত্য হলো কপটতার শামিল। কাউকে ভালবেসে থাকলে যেমন তার আনুগত্য অস্বীকার করা যায় না, তদ্রুপ কারো প্রতি ভালবাসা না থাকলে তার আনুগত্যও করা যায় না। এরূপ আনুগত্য কেউ প্রকাশ করে থাকলেও তা কখনো নির্ভেজাল হতে পারে না। যেমনটি ছিল মদীনার মুনাফিকদের অবস্থা। তারা প্রকাশ্যে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও গোপনে গোপনে তাঁকে মেরে ফেলার এবং তাঁর মিশনকে ব্যর্থ করে দেয়ারই চক্রান্তে লিপ্ত ছিল।

তাই এ দু’য়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করতে হবে এবং তাও আবার করতে হবে পূর্ণ মাত্রায়। অর্থাৎ আংশিক ভালবাসা কিংবা আংশিক আনুগত্য থাকলে চলবে না। কেননা, আংশিক ভালবাসা থাকলে পূর্ণ আনুগত্য করতে মন চাইবে না। আর আংশিক আনুগত্য করলে তা শিরকমুক্ত ‘ইবাদাত বলেও গণ্য হতে পারে না।

এ প্রসংগে ‘আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) (মৃ. ৭৫১ হি./ ১৩৫০ খৃ.) অত্যন্ত চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন:

(أصل العبادة محبة الله، بل إفراده بالمحبة، وأن يكون الحب كله لله، فلا يحب معه سواه، وإنما يحب لأجله وفيه)

‘‘ইবাদাতের মূল হলো- আল্লাহর ভালবাসা। বরং কেবল তাঁকেই ভালবাসা এবং পরিপূর্ণরূপে ভালবাসা। আর তাঁর ভালবাসায় অন্য কাউকে শামিল করবে না; বরং অন্যদের প্রতি ভালবাসাও হবে তাঁরই সন্তুষ্টির জন্যে এবং তাঁকে ভালবাসারই কারণে।’

মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একটি হাদীসেও এ কথারই প্রমাণ মেলে। তিনি বলেছেন:

(من أحب لله وأبغض لله وأعطى لله ومنع لله فقد استكمل الإيمان)

‘‘যে ব্যক্তি (কাউকে) ভালবাসল কিংবা ঘৃণা করল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য; আবার কাউকে সহযোগিতা করল কিংবা সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকল আল্লাহরই জন্য, তাহলে সে ঈমানকে পরিপূর্ণ করল।’’

অতএব, ‘ইবাদাত হলো নির্ভেজাল ভালবাসা ও একনিষ্ঠ আনুগত্যের সমন্বিত রূপ। ভালবাসাহীন আনুগত্য যেমন ‘ইবাদাত নয়, আনুগত্যবিহীন ভালবাসাও তেমনি ‘ইবাদাত নয়। আর এই নির্ভেজাল ভালবাসা ও একনিষ্ঠ আনুগত্য পাওয়ার সর্বপ্রথম অধিকারী হলেন কেবল মহান আল্লাহ। অতপর তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁর সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা। কেননা তাঁর সৃষ্টির প্রতি ভালবাসাও তাঁর ভালবাসা থেকেই উৎসারিত হয়।

‘ইবাদাত বিশেষ কোন কর্মের নাম নয়:

ইসলামী শারী‘য়াতে বিশেষ কোন কাজের নাম ‘ইবাদাত নয়। বরং এখানে একই কাজ একভাবে করলে হয় ‘ইবাদাত তথা পুণ্য; আবার অন্যভাবে করলে হয় মা‘সিয়াত বা পাপ। এক সময় করলে হয় পুণ্য, আবার আরেক সময় তা হয় পাপ। এমনকি নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি মৌলিক আনুগত্যের কাজগুলোও বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ নিয়মে করলে হয় পুণ্য এবং আমরা তা পালন করতে আদিষ্ট। পক্ষান্তরে নিজের ইচ্ছামত অন্য কোন নিয়মে করলে তা হয় পাপ এবং তাই আমরা তা বর্জন করতে আদিষ্ট। যেমন- পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য ইসলামী শারী‘য়াত যে সময় নির্ধারণ করেছে এবং যে নিয়ম পন্থা বাতলে দিয়েছে, সেভাবে তা পালন করা ‘ইবাদাত এবং পুণ্য। আবার সেই একই নামায নিষিদ্ধ সময়গুলোতে পড়া বর্জনীয় এবং তাতে নিজের ইচ্ছামত রুকু সিজদা ইত্যাদি বাড়ানো বা কমানো নিষিদ্ধ ও পাপের কাজ বলে গণ্য। রমাদান মাসে রোযা পালন করা ফরয বা অত্যাবশ্যক, কিন্তু ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম বা নিষিদ্ধ। রমাদানের চাঁদ দেখলে রোযা রাখা শুরু করতে হয়, আবার শাওয়ালের চাঁদ দেখলে রোযা রাখা বন্ধ করে ঈদ পালন করতে হয়। আর তাই চাঁদ দেখা সাপেক্ষে একই দিনে এক দেশে মুসলিমরা রোযা রাখে এবং আরেক দেশে মুসলিমরা রোযা রাখে না। এক দেশের মুসলিমরা ঈদ উদযাপন করে এবং আরেক দেশের মুসলিমরা রোযা অব্যাহত রাখে। অর্থাৎ রমাদান মাসে রোযা রাখা যেমন ‘ইবাদাত, ঈদের দিন রোযা না রাখাও তেমনি ‘ইবাদাত।

এমনিভাবে শারী‘য়াতের নির্ধারিত পন্থায় যখন কোন কাজ করা হয়, তখন তা হয় ‘ইবাদাত। কিন্তু শারী‘য়াতের নির্ধারিত পন্থায় না হলে ঐ একই কাজ করা আর ‘ইবাদাত বলে গণ্য নয়। অতএব ‘ইবাদাত কোন বিশেষ কাজের নাম নয়। বরং শারী‘য়াত কাউকে কোন কাজ করতে আদেশ করলে তা হয় তার জন্য করণীয় ‘ইবাদাত এবং তা করলে হয় পুণ্য। আর শারী‘য়াত কাউকে কোন কিছু নিষেধ করলে সে কাজটিই হয় তার জন্য বর্জনীয় ‘ইবাদাত এবং তা বর্জন না করলে হয় পাপ। একইভাবে শারী‘য়াত নির্ধারিত পন্থায় করলে যে কাজটি হয় ‘ইবাদাত, নিজের বানানো পন্থায় করলে সে কাজটিই হয় বিদ‘আত। অর্থাৎ যে কোন কাজই শারী‘য়াতের আদেশ কিংবা নিষেধের কারণে হালাল অথবা হারাম হয় কিংবা করণীয় অথবা বর্জনীয় হয়।

সুতরাং একই কাজ অবস্থাভেদে ভাল এবং মন্দ; পুণ্য এবং পাপ; আনুগত্য এবং নাফরমানি বলে গণ্য হয়। তাই ‘ইবাদাত বিশেষ কোন কাজের নাম নয়। বরং কাজটিকে যেভাবে করলে তা ভাল, পুণ্য এবং আনুগত্য হয়, সেভাবে করাই হলো ‘ইবাদাত। আর যেভাবে করলে মন্দ, পাপ এবং নাফরমানি হয়, সেভাবে করা ‘ইবাদাত নয়।

মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকাও ‘ইবাদাত:

‘ইবাদাত শুধু কতকগুলো ভাল কাজ করার নাম নয়। বরং ভাল কাজ করা যেমন ‘ইবাদাত, মন্দ কাজ করা থেকে বিরত থাকাও তেমনি ‘ইবাদাত। ইসলামী শারী‘য়াতে তাই ভাল কাজের আদেশ করার পাশাপাশি মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। কোরআন ও হাদীসের অনেক বর্ণনাভঙ্গী থেকে একথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন কোরআন বলছে:

(يا أيها الذين آمنوا اجتنبوا كثيرا من الظن إن بعض الظن إثم ولا تجسسوا ولا يغتب بعضكم بعضا أيحب أحدكم أن يأكل لحم أخيه ميتة فكرهتموه واتقوا الله إن الله تواب رحيم )

‘‘ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছ, বেশি বেশি ধারণা করা থেকে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কতক ধারণা গুনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। আর তোমাদের কেউ যেন অপর কারও (গীবত) পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? বস্ত্তত: তোমরা তো এটা ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’’

উক্ত আয়াতে অহেতুক ধারণা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে এবং সাথে সাথে এও বলা হয়েছে যে, কতক ধারণা গুনাহের কাজ হিসেবে গণ্য। অর্থাৎ অহেতুক ধারণা করা একটি মন্দ কাজ তথা গুনাহের কাজ। আর এ গুনাহের কাজটি থেকে আমাদেরকে বারণ করা হয়েছে। তাই এ মন্দ কাজটি থেকে বেঁচে থাকাও মহান আল্লাহর একটি নির্দেশ। আর মহান আল্লাহর সকল নির্দেশ (চাই তা করণীয় হোক অথবা বর্জনীয়) পালন করাই হলো ‘ইবাদাত। অতএব এ গুনাহ (অহেতুক ধারণা করা) থেকে বেঁচে থাকাটা একটি ‘ইবাদাত, যেমনিভাবে আয়াতের অপরাপর নির্দেশগুলো (অন্যের ছিদ্রান্বেষণ না করা, গীবত না করা ইত্যাদি) পালন করা ‘ইবাদাত। এবং এ আয়াতে উল্লেখিত মন্দ কাজগুলো বর্জন করার মাধ্যমে যেমনি আল্লাহর নির্দেশ মানা হবে এবং সাওয়াব পাওয়া যাবে, অপরাপর যে কোন মন্দ থেকে বিরত থাকলেও তেমনি আল্লাহর নির্দেশ মানা হবে এবং সাওয়াব পাওয়া যাবে।

অধিকন্তু অর্জনীয় ‘ইবাদাতের চেয়ে বর্জনীয় ‘ইবাদাতগুলো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা অর্জনীয় ‘ইবাদাতগুলো অর্জন না করলে ‘আবিদ (‘ইবাদাতকারী) নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু বর্জনীয় ‘ইবাদাতগুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বর্জন না করলে ‘আবিদ একাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, অন্যের অধিকারও লুন্ঠিত হয় এবং তার সাথে সাথে সমাজটাও কলুষিত হয়।

একটা পুণ্য সমাজকে যতটা না এগিয়ে দেয়, একটা পাপ সমাজকে তার চেয়ে বহুগুণ পিছিয়ে দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে তাই সৎকাজ করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করাও তদ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত: এ কারণেই হাদীস শরীফে যাবতীয় হারাম থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে অধিকতর ‘আবিদ (‘ইবাদাতকারী) হওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে-

(اتق المحارم تكن أعبد الناس وارض بما قسم الله لك تكن أغنى الناس وأحسن إلى جارك تكن مؤمنا وأحب للناس ما تحب لنفسك تكن مسلما ولا تكثر الضحك فإن كثرة الضحك تميت القلب )

‘‘তুমি হারামগুলো থেকে বেঁচে থাক, তাহলে তুমিই হবে অধিকতর ‘ইবাদাতকারী। আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাক, তাহলে তুমিই হবে অধিকতর ধনী। তোমার প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ কর, তাহলে তুমি হবে মু’মিন। নিজের জন্য যা পছন্দ কর অন্যের জন্যেও তাই পছন্দ কর, তাহলে তুমি হবে মুসলিম। আর বেশি পরিমাণে হেসো না, কেননা অধিক হাসি অন্তরাত্মাকে মৃত বানিয়ে দেয়।’’

এই হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী হারামকে বর্জনকারী ব্যক্তিও ‘আবিদ বা ‘ইবাদাতকারী বলে গণ্য। অতএব হালাল কাজ করা যেমনি ‘ইবাদাত, হারাম থেকে বিরত থাকাও তেমনি ‘ইবাদাত। আবার জেনে শুনে হারাম কাজ করে ফেললে যেমনি পাপ হয়, ইচ্ছাকৃত ফরয বা ওয়াজিব ছেড়ে দিলেও তেমনি পাপ হয়।

‘ইবাদাতের প্রকারভেদ:

‘ইবাদাত প্রতিপালনের মাধ্যম, পন্থা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘ইবাদাতকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়।

যেমন- দৈহিক ‘ইবাদাত ও আর্থিক ‘ইবাদাত।

জাহেরী (প্রকাশ্য) ‘ইবাদাত ও বাতেনী (অপ্রকাশ্য) ‘ইবাদাত।

এবং আবশ্যিক ‘ইবাদাত ও ঐচ্ছিক ‘ইবাদাত।

তবে এই প্রকরণ ‘ইবাদাতকে ছিন্ন-ভিন্ন কিংবা বিক্ষিপ্ত ও বিভক্ত করার জন্যে নয়, বরং ইসলামে এর গুরুত্ব ও অবস্থান চিহ্নিত করার জন্যে। কেননা উপরোক্ত সকল প্রকার ‘ইবাদাতই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া যা আর্থিক ‘ইবাদাত তার মধ্যে দেহের অংশগ্রহণও রয়েছে। আবার যা প্রকাশ্য তার একটি অপ্রকাশ্য দিকও রয়েছে। তেমনিভাবে যা ঐচ্ছিক তা ব্যক্তি ও অবস্থাভেদে আবশ্যিকেও রূপ নিতে পারে। আবার যা আবশ্যিক তা ব্যক্তি ও অবস্থাভেদে লাঘবও হতে পারে। তাই গুরুত্বের বিচারে একটি থেকে আরেকটি কম নয়।

দৈহিক ‘ইবাদাত ও আর্থিক ‘ইবাদাত:

সাধারণত যেসব ‘ইবাদাত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা পালন করা হয়, সেগুলোকে দৈহিক ‘ইবাদাত বলে। যেমন- নামায পড়া, রোযা রাখা, সত্য কথা বলা, সত্যের উপদেশ দেয়া, উপার্জনের জন্য দৈহিক পরিশ্রম করা, কারো মাথায় বোঝা তুলে দিতে সাহায্য করা, জিহাদের ময়দানে সশরীরে অংশগ্রহণ করা, রোগীর সেবা করা, সালাম দেয়া, জানাযায় শরীক হওয়া, পিতা-মাতার খেদমত করা, স্বামীর আনুগত্য করা, গৃহস্থালী কাজ করা ও এ কাজে সহযোগিতা করা ইত্যাদি। আর যেগুলো অর্থ দিয়ে সম্পাদন করা হয়, সেগুলোকে আর্থিক ‘ইবাদাত বলে। যেমন- যাকাত আদায় করা, হজ্জ পালন করা, সাদাকাতুল ফিতর দেয়া, করযে হাসানা দেয়া, আল্লাহর পথে জিহাদের কাজে অর্থ ব্যয় করা, মেহমানের আপ্যায়ন করা, স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণ করা, বিধবা-ইয়াতীম ও দু:স্থ-অসহায়দের সাহায্য করা ইত্যাদি। আবার এগুলোর মাঝে কোন কোনটিতে অর্থের পাশাপাশি দেহেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। যেমন- হজ্জের মধ্যে অর্থের পাশাপাশি যথেষ্ট দৈহিক কসরতও রয়েছে। এ কারণেই হজ্জ ফরয হওয়ার জন্যে আর্থিক যোগ্যতার পাশাপাশি দৈহিক সুস্থতারও শর্ত আরোপ করা হয়ে থাকে। এবং কোন ব্যক্তি দৈহিকভাবে হজ্জ পালনে অসমর্থ হলে সে নিজ অর্থে অন্যকে দিয়ে হজ্জ করাতে পারে।

প্রকাশ্য ‘ইবাদাত ও অপ্রকাশ্য ‘ইবাদাত:

যে কোন ‘ইবাদাতের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দুটো রূপ রয়েছে। প্রকাশ্য বা বাহ্যিক রূপটিকে আমরা জাহেরী বা প্রকাশ্য ‘ইবাদাত বলি। আর অপ্রকাশ্য বা অভ্যন্তরীণ রূপটিকে আমরা বাতেনী বা অপ্রকাশ্য ‘ইবাদাত বলি। যেমন – নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি সকল ‘ইবাদাতেরই একটি বাহ্যিক রূপ বিদ্যমান। যা আমরা চর্ম চক্ষু দিয়ে দেখতে পাই। পক্ষান্তরে এ ‘ইবাদাতগুলোর একটি বাতেনী বা আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে। যা চর্ম চক্ষুতে দৃষ্টিগোচর হয় না। যা ‘আব্দ এবং মা‘বূদ তথা যিনি ‘ইবাদাত করছেন এবং যার উদ্দেশ্যে করছেন তাদের দু’জনের মধ্যকার ব্যাপার। উদাহরণ স্বরূপ, অন্তরে কুফরী চেতনা লালনকারী ব্যক্তিও অনেক সময় বিশেষ পরিবেশে বাধ্য হয়ে জামা‘আতের সাথে নামায আদায়ের জন্য দাঁড়াতে পারে। যেমনটি ছিল মদীনার মুনাফিকদের অবস্থা। তারা মসজিদে নববীতে গিয়ে প্রকাশ্যে নামায আদায়ও করত। কিন্তু নামাযের ব্যাপারে আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্বের অনুভূতি তাদের মনে ছিল না। ফলে তারা আল্লাহকে খুশী করার অভিপ্রায় নিয়ে দাঁড়াত না। পক্ষান্তরে একজন মু’মিন ব্যক্তির নামাযে প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য উভয় দিকই হবে স্বচ্ছ ও নির্মল। তার অন্তরাত্মা যেমনি আল্লাহর ভয়ে ভীত হবে, তেমনি হবে তার বাহ্যিক অবয়ব। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে সে খুশী করতে চাইবে না। কিংবা নামাযের ভেতর দাঁড়ি, টুপি ও আঙ্গুল ইত্যাদি নিয়ে খেলবেও না।

আবূ হুরাইরা (রা.) বর্ণিত এক হাদীসে একথারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। এক ব্যক্তিকে নামাযের মধ্যে নিজের দাঁড়িতে হাতাহাতি করতে দেখে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন- (لو خشع قلبه لخشعت جوارحه ) ‘‘যদি তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত হত, তাহলে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও সেই ভীতির ছাপ (স্থিরতা) পরিলক্ষিত হত’’।

রমাদানের রোযার বেলায় যেমন সাহরী, ইফতার, তারাবীহ, ফিতরাহ ইত্যাদি সবই প্রকাশ্যে সংঘটিত হয়, তাই এগুলো প্রকাশ্য ‘ইবাদাত তথা রোযার বাহ্যিক দিক। অপরদিকে তাকওয়ার গুণ অর্জনের যে মহান উদ্দেশ্য এতে লুকায়িত রয়েছে, যা চর্ম চক্ষুতে দেখা যায় না, তা রোযার অভ্যন্তরীণ দিক তথা বাতেনী ‘ইবাদাত। এমনিভাবে যাকাত, হজ্জ এবং অন্যান্য সকল ‘ইবাদাতেরই প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দুটো দিক বিদ্যমান। এবং এ দুটো দিকই ‘ইবাদাতটির শুদ্ধাশুদ্ধির জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে অভ্যন্তরীণ বা আধ্যাত্মিক দিকটি এক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বের দাবী রাখে। কেননা বাহ্যিক দিকটি অবস্থাভেদে পরিবর্তন যোগ্য, কিন্তু অভ্যন্তরীণটি অপরিবর্তনীয়। যেমন- অসুস্থ এবং মুসাফির ব্যক্তির নামাযের বাহ্যিক রূপ সুস্থ এবং মুকীম ব্যক্তির তুলনায় ভিন্নতর। কিন্তু উভয়ের বেলাতেই নামাযের অভ্যন্তরীণ চেতনায় পার্থক্য সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই।

আবশ্যিক ‘ইবাদাত ও ঐচ্ছিক ‘ইবাদাত:

ইসলামী শারী‘য়াত যেসব কাজ আমাদেরকে করতে আদেশ করেছে এবং যা না করলে জবাবদিহিতা বা শাস্তির বিধান আছে, তা-ই আবশ্যিক ‘ইবাদাত। যেমন- ফরয নামায আদায় করা, ফরয রোযা পালন করা, ফরয হজ্জ আদায় করা, ফরয যাকাত প্রদান করা, ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা ইত্যাদি। এ জাতীয় কাজগুলো করতে আমরা আদিষ্ট এবং না করলে আমাদেরকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। তাই এগুলো আবশ্যিক ‘ইবাদাত। আর আবশ্যিক বলেই সাধারণত: এগুলোতে কোন সাওয়াবের পরিমাণ উল্লেখ থাকে না।

পক্ষান্তরে যেসব কাজ করলে ভাল, কিন্তু না করতে পারলে কিংবা পরিমাণে কম করলে কোন জবাবদিহিতা নেই, সেগুলো ঐচ্ছিক ‘ইবাদাত। যেমন- নফল নামায, নফল রোযা, সাদাকাহ বা দান-খয়রাত ইত্যাদি। জবাবদিহিতা নেই বলেই এগুলোকে ঐচ্ছিক ‘ইবাদাত বলা হয়। এসব কাজের ব্যাপারে আমাদেরকে উৎসাহিত করা হয় এবং কোন কোনটির ব্যাপারে বিপুল পরিমাণ নেকীর কথাও ঘোষণা করা হয়। যেমন- এক হাদীসে জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ বলবে, জান্নাতে তার জন্য একটি খেজুর বৃক্ষ লাগানো হবে।’’

অপর এক হাদীসে সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: ‘‘আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পাশে ছিলাম, তিনি আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: তোমরা কি প্রতিদিন এক হাজার নেকী অর্জন করতে সক্ষম নও? তখন উপস্থিত একজন সাথী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: এক হাজার নেকী কিভাবে অর্জন করা যাবে?! অত:পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: কেউ যদি একবার (সুবহানাল্লাহ) তাসবীহ পড়ে, তাহলে তার আমলনামায় এক হাজার নেকী লিখা হয় অথবা তার এক হাজার গুনাহ মুছে দেয়া হয়।’’

ঐচ্ছিক হওয়া সত্ত্বেও এ জাতীয় ‘ইবাদাতের এহেন বিপুল সাওয়াবের ঘোষণার মাধ্যমে মূলত: আবশ্যিক ‘ইবাদাতের গুরুত্বকে আরো বাড়ানো হয়েছে। কেননা পাহাড় সমান ঐচ্ছিক ‘ইবাদাত মিলেও কোন একটি আবশ্যিক ‘ইবাদাতের সমান হতে পারে না, কিংবা এর স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না, অথবা এর ক্ষতিপূরণও করতে পারে না। তবে আবশ্যিক ‘ইবাদাতগুলো যথাযথ পালনের পর ঐচ্ছিক ‘ইবাদাতগুলো আল্লাহর কাছে বান্দাহর মর্যাদাকে সমুন্নত করে। এবং তাকে জান্নাতের উচ্চাসনে সমাসীন করে। কিন্তু কোন একটি আবশ্যিক (ফরয) ‘ইবাদাতকে অবহেলা করে অসংখ্য ঐচ্ছিক (নফল) ‘ইবাদাতের ব্যাপারে তৎপর হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা থেকে বাঁচা যাবে না। এজন্যেই হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ফরয নামায ছেড়ে দিল, সে কুফরী করল।(ইবাদাতের ব্যখ্যা অংশটি সংগৃহিত- লেখকঃ মুহাম্মাদ শফিউল আলম ভুঁইয়া)

আল্লাহর ইবাদাত

আমরা দেখেছি যে, ইবাদত অর্থ ‘চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি’। ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন: (১) মারিফাত অর্জন করেই ঈমান অর্জন করতে হয়, এজন্য মারিফাতের ক্ষেত্রে সকল মুমিনই সমান। মুমিনের প্রকৃত প্রতিযোগিতা মারিফাতে নয়, বরং আল্লাহর ইবাদতে; কারণ প্রকৃত হক্ক আদায় করে ইবাদত কেউই করতে পারে না। (২) কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে তা জানার একমাত্র মাধ্যম আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত। এ বিষয়ে তিনি বলেন: ‘‘কেউই মহান আল্লাহর সঠিক পরিপূর্ণ ইবাদত করতে সক্ষম নয়, যেরূপ ইবাদত তাঁর পাওনা। তবে বান্দা তাঁর ইবাদত করে তাঁর নির্দেশ মত, যেভাবে তিনি তাঁর কিতাবে এবং তাঁর রাসূলের (ﷺ) সুন্নাতে নির্দেশ দিয়েছেন।’’

এখানে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) মুমিন জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর ইবাদতের আগ্রহ ও আবেগ অনেক সময় মুমিনকে অতি-উৎসাহী করে তোলে এবং অধিক ইবাদত, নৈকট্য ও বিলায়াতের আগ্রহে মুমিন দুটি ভুল করেন: (১) নিজের উপর কাঠিন্য আরোপ করেন এবং (২) সুন্নাতের অতিরিক্ত ইবাদত করেন।

দুটি বিষয় মূলত একই সূত্রে গাঁথা। কুরআন ও সুন্নাতের অতিরিক্ত আমলই কাঠিন্যের মধ্যে নিপতিত করে। এক্ষেত্রে মুমিনকে বুঝতে হবে যে, আল্লাহর ‘যথাযোগ্য’ (كما حقه) ইবাদত করা তার দায়িত্ব নয়, বরং ‘নির্দেশিত’ ইবাদত পালন তার দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: سَدِّدُوا وَقَارِبُوا وَأَبْشِرُوا فَإِنَّهُ لا يُدْخِلُ أَحَدًا الْجَنَّةَ عَمَلُهُ قَالُوا وَلا أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ وَلا أَنَا إِلا أَنْ يَتَغَمَّدَنِي اللَّهُ بِمَغْفِرَةٍ وَرَحْمَةٍ، وَاعْلَمُوا أَنَّ أَحَبَّ الْعَمَلِ إِلَى اللَّهِ أَدْوَمُهُ وَإِنْ قَلَّ…. إنَّ هذا الدِّين يُسْرٌ ولنْ يُشادَّ الدِّينَ أحدٌ إلا غَلَبَه.

‘‘তোমরা সঠিক আমল কর, কাছাকাছি থাক এবং আনন্দচিত্ত হও; কারণ কাউকেই তার নিজ কর্ম জান্নাতে প্রবেশ করাবে না। সাহাবীগণ বললেন: আপনিও নন, হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বলেন, না, আল্লাহ যদি আমাকে ক্ষমা ও করুণা দিয়ে অভিষিক্ত না করেন তবে আমিও শুধু নিজের আমলের কারণে জান্নাতের দাবিদার হতে পারব না। আর জেনে রাখ, আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় কর্ম হলো নিয়মিত কর্ম, তা যদি অল্পও হয়। বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৩৭৩ (কিতাবুর রিকাক, বাবুল কাসদি); মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২১৬৯; (কিতাবু সিফাতিল কিয়ামাতি ওয়াল জান্নাতি …, বাবু লান ইয়াদখুলা আহাদুন..)।

অন্য হাদীসে তিনি বলেন: ‘‘নিশ্চয় এ দীন সহজ, যে কোনো ব্যক্তি যদি এ দীনকে কঠিন করে নেয় তবে তা অবশ্যই তার অসাধ্যে পরিণত হবে।  বুখারী, আস-সহীহ ১/২৩ (কিতাবুল ঈমান, বাবুদ দীন ইউসরুন)

এ অর্থে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীসে ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে পূর্ণতা বা আধিক্যের চেয়ে বিশুদ্ধতা ও সঠিকত্বের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সঠিকত্বের একমাত্র মাপকাঠি সুন্নাতে রাসূল (ﷺ)। তাঁর সুন্নাতের মধ্যে থেকে অল্প হলেও নিয়মিত আমল করাই মুমিনের দায়িত্ব। অধিক ইবাদতের আবেগে সুন্নাতের ব্যতিক্রমের পরিণতি ভয়াবহ। এ বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেন, আমার আববা আমাকে বিবাহ দেন, কিন্তু ইবাদতের আগ্রহের কারণে আমি রাতদিন নামায রোযায় ব্যস্ত থাকতাম এবং আমার স্ত্রীর কাছে যেতাম না। তখন আমার আববা আমাকে অনেক রাগ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেন। আব্দুল্লাহ (রা) বলেন

‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন: তুমি কি প্রতিদিন রোযা রাখ? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বলেন: তুমি কি সারা রাত জেগে নামায পড়? আমি বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: কিন্তু আমি তো রোযাও রাখি আবার মাঝে মাঝে বাদ দিই, রাতে নামায পড়ি আবার ঘুমাই, স্ত্রীদেরকে সঙ্গ প্রদান করি। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে অপছন্দ করল আমার সাথে তার সম্পর্ক থাকবে না।… এরপর তিনি বলেন : প্রত্যেক আবিদের (ইবাদতকারীর) কর্মের উদ্দীপনার জোয়ার ভাটা আছে। ইবাদতের উদ্দীপনা কখনো তীব্র হয় আবার এ তীব্রতা এক সময় স্থিতি পায়, কখনো সুন্নাতের দিকে, কখনো বিদ‘আতের দিকে। যার স্থিতি সুন্নাতের প্রতি হবে সে হেদায়াত প্রাপ্ত হবে। আর যার স্থিতি সুন্নাতের ব্যতিক্রমের (বিদআতের) দিকে হবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’’ হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ২/৩৯৪, নং ৬৫৩, ইবনু আবী আসিম, আস-সুন্নাহ, পৃ: ২৭- ২৮, নং ৫১, আলবানী, সাহীহুত তারগীব ১/৯৮।

এ অর্থের আরো অনেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, তাঁর কর্ম ও বর্জনের সামগ্রিক রূপই সুন্নাত। ইবাদতের আবেগে সুন্নাতের ব্যতিক্রম ইবাদত ধ্বংসের পথ।

(ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৫০-৮৫।)

এ ক্ষেত্রে রব শব্দের পরিবর্তে আল্লাহ বা তার গুণবাচক নামসমূহের মধ্য থেকে অন্য যেকোন একটা ব্যবহার করা যেতে পারত, কিন্তু তা না করে রব শব্দ ব্যবহার করে বুঝানো হয়েছে যে, এখানে দাবীর সাথে দলীলও পেশ করা হয়েছে। কেননা, ইবাদাতের যোগ্য একমাত্র সে সত্তাই হতে পারে, যে সত্তা তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যিনি বিশেষ এক পালননীতির মাধ্যমে সকল গুণে গুনান্বিত করে মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করেছেন এবং পার্থিব জীবনে বেঁচে থাকার সকল ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন। মানুষ যত মূৰ্খই হোক এবং নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি ও দৃষ্টিশক্তি যতই হারিয়ে থাকুক না কেন, একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে, পালনের সকল দায়িত্ব নেয়া আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

আর সাথে সাথে এ কথাও উপলব্ধি করতে পারবে যে মানুষকে অগণিত এ নেয়ামত না পাথর-নির্মিত কোন মূর্তি দান করেছে, না অন্য কোন শক্তি। আর তারা করবেই বা কিরূপে? তারা তো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার বা বেঁচে থাকার জন্য নিজেরাই সে মহাশক্তি ও সত্তার মুখাপেক্ষী। যে নিজেই অন্যের মুখাপেক্ষী সে অন্যের অভাব কি করে দূর করবে? যদি কেউ বাহ্যিক অর্থে কারো প্রতিপালন করেও, তবে তাও প্রকৃতপ্রস্তাবে সে সত্তার ব্যবস্থাপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। এর সারমর্ম এই যে, যে সত্তার ইবাদাতের জন্য দাওয়াত দেয়া হয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্তা আদৌ ইবাদাতের যোগ্য নয়।

৩. এ আয়াতটি পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম নির্দেশ, আর সে নির্দেশই হচ্ছে তাওহীদের। ইসলামের মৌলিক আকীদা তাওহীদ বিশ্বাস। যা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষরূপে গঠন করার একমাত্র উপায়। এটি মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেয়, সকল সংকটে আশ্রয় দান করে এবং সকল দুঃখ-দুর্বিপাকের মর্মসাথী। তাওহীদ শব্দটি মাসদার বা মূলধাতু। যার অর্থ- কোন কিছুকে এক বলে জানা এবং ঘোষণা করা। সে অনুসারে আল্লাহর একত্ববাদ অর্থ- আল্লাহ যে এক তা ঘোষণা করা। শরীআতের পরিভাষায় তাওহীদ বলতে বুঝায় একথা বিশ্বাস করা যে, আল্লাহই একমাত্র মা’বুদ। তার কোন শরীক নাই। তার কোন সমকক্ষ নাই। একমাত্র তার দিকেই যাবতীয় ইবাদাতকে সুনির্দিষ্ট করা। তার যাবতীয় সুন্দর নাম ও গুণাবলী আছে বলে বিশ্বাস করা। এতে বুঝা গেল যে, তাওহীদ হলো আল্লাহকে রবুবিয়াত তথা প্রভূত্ত্বে, তার সত্তায়, নাম ও গুণে এবং ইবাদাতের ক্ষেত্রে একক সত্তা বলে স্বীকৃতি দেয়া। তাই এ তাওহীদ বিশুদ্ধ হতে হলে এর মধ্যে তিনটি অংশ অবশ্যই থাকতে হবে –

(১) আল্লাহর প্রভূত্বে ঈমান ও সে অনুসারে চলা। যা তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ নামে খ্যাত।

(২) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে ঈমান আর সেগুলো তার জন্যই নির্দিষ্ট করা। যাকে তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত বলা হয়। আর

(৩) যাবতীয় ইবাদাত একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করা। যাকে তাওহীদুল উলুহিয়াহ’ও বলা হয়। এ তিন অংশের কোন অংশ বাদ পড়লে তাওহীদ বা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা হবে না এবং দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তি পাবে না।

৪. তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বা একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করলেই তাকওয়ার অধিকারী হওয়া যাবে নতুবা নয়। যাদের কর্মকাণ্ডে শির্ক রয়েছে, তারা যত পরহেযগার বা যত আমলই করুক না কেন তারা কখনো মুত্তাকী হতে পারবে না। তাই জীবনের যাবতীয় ইবাদাতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য খালেসভাবে করতে হবে। এটা জানার জন্য ইবাদাত ও শির্ক সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। যার আলোচনা সাম

আয়াত ২২ এর তাফসীরঃ

২:২২ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِہٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّکُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰہِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿

২২. যিনি যমীনকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আসমানকে করেছেন ছাদ এবং আকাশ হতে পানি অবতীর্ণ করে তা দ্বারা তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেছেন। কাজেই তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিও না।

১. আয়াতে উল্লেখিত أنداد শব্দটি ند এর বহুবচন। যার অর্থ সমকক্ষ স্থির করা। এখানে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এ সমকক্ষ স্থির করাটাই শির্ক। আর শির্ক হচ্ছে সবচেয়ে বড় গোনাহ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় গোনাহ কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, অথচ তিনি সৃষ্টি করেছেন… [বুখারীঃ ৪৪৭৭]

শির্কের প্রকারভেদঃ শির্ক দু’প্রকার, যথা- বড় শির্ক ও ছোট শির্ক। বড় শির্ক আবার দু’প্রকার। আল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা প্রভূত্বে শির্ক করা। আল্লাহর উলুহিয়াত তথা ইবাদাতে শির্ক করা।

আল্লাহর রুবুবিয়্যাত বা প্রভূত্বে শির্ক দু’ভাবে হয়ে থাকে –

১) জগতের রব বা পালনকর্তা আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার না করা যেমন কম্যুনিষ্ট, নাস্তিক, মুলহিদ ইত্যাদি সম্প্রদায়। আল্লাহর নাম, গুণ ও কর্মকাণ্ডকে স্বীকার না করা, যেমন- ঈসমাঈলী সম্প্রদায়, বাহাই সম্প্রদায়, বুহরা সম্প্রদায়, জাহমিয়া ও মু’তাজিলা সমপ্রদায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে পার্থক্য না করে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক করে দেখা যেমন ওয়াহদাতুল অজুদে বিশ্বাসী সম্প্রদায়, যারা মনে করে যে, আল্লাহ কোন কিছুর সূরত ইখতিয়ার করে তাতে নিজেকে প্রকাশ করেন যেমন, হুলুলী সম্প্রদায় এবং যারা বিশ্বাস করে যে, কারো পক্ষে আল্লাহর সাথে একাকার হয়ে যাওয়া সম্ভব।

২) জগতের রব বা পালনকর্তা আল্লাহর সত্তা, নাম, গুণাবলী ও তাঁর কর্মকাণ্ডে কাউকে সমকক্ষ নির্ধারণ করা।

ক) আল্লাহর স্বত্ত্বার সমকক্ষ কোন সত্তা নির্ধারণ করার মত কোন শির্ক বনী আদমের মধ্যে বিরল। এ ধরণের দাবী প্রথম নমরূদ করেছিল, কিন্তু ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সাথে বিতর্কে সে তার সে দাবীর সপক্ষে যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়ে হেরে গিয়েছিল। অনুরূপভাবে ফিরআউনও প্রকাশ্যে এ ধরণের দাবী করেছিল। আল্লাহ তাকে স্বপরিবারে দলবলসহ ধ্বংস করে তার দাবীর অসারতা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

খ) আল্লাহর নামসমূহের কোন নাম অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করার মত শির্ক বিভিন্ন জাতিতে বিদ্যমান। যারাই তাদের উপাস্যদেরকে আল্লাহ্‌র নামের মত নাম দেয় তারাই এ ধরণের শির্কে লিপ্ত। যেমন হিন্দুগণ তাদের বিভিন্ন অবতারকে আল্লাহর নামসমূহের মত নাম দিয়ে থাকে। অনুরূপভাবে কোন কোন বাতেনী গ্রুপের লোকেরা যেমন, দ্রুজ সম্প্রদায়, নুসাইরী সম্প্রদায়, আগাখানী ঈসমাঈলী সম্প্রদায় তাদের ঈমামদেরকে আল্লাহর নামসমূহে অভিহিত করে।

গ) আল্লাহর গুণ ও কর্মকাণ্ডকে অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করা। আল্লাহর গুণ ও কর্মকাণ্ডের কোন শেষ নেই। সেগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। আল্লাহর অপার শক্তির সাথে সম্পৃক্ত, তাঁর জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত এবং হুকুম ও শরীআতের সাথে সম্পৃক্ত।

১. আল্লাহর অপার শক্তির সাথে যারা শির্ক করে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সৃষ্টি, মৃত্যু, জীবন, বিপদাপদ থেকে উদ্ধার, উদ্দেশ্য হাসিলকারী বলে বিশ্বাস করে। যেমন, অনেক অজ্ঞ মূৰ্খ মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, অনেক সুফীরা তাদের পীর সাহেব সম্পর্কে বিশ্বাস করে থাকে। অনুরূপভাবে অনেকে কবরবাসী কোন লোক সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। তদ্রুপ অনেকে জাদুকর জাতীয় লোকদের সম্পর্কেও এ ধরণের বিশ্বাস করে। অনুরূপভাবে শিয়া সম্প্রদায়ও তাদের ইমামদের ব্যাপারে এ ধরণের বিশ্বাস করে।

২. আল্লাহর পরিপূর্ণ জ্ঞানের সাথে যারা শির্ক করে থাকে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করে। যেমন, অনেক অজ্ঞ মূৰ্খ মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, অনেক সুকীরা তাদের পীর সাহেব সম্পর্কে বিশ্বাস করে যে তারা গায়েব জানে। আবার অনেকে কবরবাসী কোন কোন লোক সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। তদ্রুপ অনেকে গণক, জ্যোতিষ, জীন, প্রেতাত্মা, ইত্যাদীতে বিশ্বাস করে যে, তারাও গায়েব জানে। অনুরূপভাবে শিয়া সম্প্রদায়ও তাদের ইমামদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে যে, তারা গায়েব জানতো।

৩. আল্লাহর শরীআত ও হুকুমের সাথে যারা শির্ক করে থাকে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহর মত শরীআত প্রবর্তনের অধিকার তাদের আলেম ও শাসকদের দিয়ে থাকে। যেমন, ঐ সমস্ত জাতি যারা সরকার বা পার্লামেন্টকে আল্লাহর আইন বিরোধী আইন করে তদস্থলে অন্য আইনে বিচার করা শ্রেয় বা জায়েয বা আল্লাহর আইন ও অন্যান্য আইন সমমানের মনে করে থাকে। শির্কের এ সমস্ত প্রকার আল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা প্রভূত্বের সাথে সম্পৃক্ত।

আল্লাহর ইবাদাতে শির্কঃ আল্লাহর ইবাদাতে শির্ক বলতে বুঝায়, আল্লাহ যা কিছু ভালবাসেন সন্তুষ্ট হন বান্দার এমন সব কথা ও কাজ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা। যেমন আল্লাহ্ তাঁর কাছে দোআ করা ভালবাসেন, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া ভালবাসেন, তাঁর কাছে উদ্ধার কামনা ভালবাসেন, তাঁর কাছে পরিপূর্ণভাবে বিনয়ী হওয়া ভালবাসেন, তাঁর জন্যই সিজদা, রুকু, সালাত, যবেহ, মানত ইত্যাদী ভালবাসেন। এর কোন কিছু যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে করে তবে তা হবে আল্লাহর ইবাদাতে শির্ক। অন্য কারো কাছে পরিপূর্ণ আশা করলে, অন্য কাউকে গোপন ভয় করলেও তা শির্ক হিসাবে গণ্য হবে। যেহেতু বান্দার ইবাদাতসমূহ বিশ্বাস, কথা ও কাজের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে, সে হিসাবে ইবাদতের মধ্যেও এ তিন ধরণের শির্ক পাওয়া যায়। অর্থাৎ কখনো কখনো ইবাদত হয় মনের ইচ্ছার মাধ্যমে, আন্তরিক আনুগত্যের মাধ্যমে, আবার কখনো কখনো তা সংঘটিত হয় বাহ্যিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আবার কখনো কখনো তা সংঘটিত হয়ে থাকে কথাবার্তার মাধ্যমে।

দ্বিতীয় প্রকার শির্ক হলোঃ ছোট শির্ক, কিন্তু তাও কবীরাগুনাহ হতে মারাত্মক। ছোট শির্কের উদাহরণ হলো, এ প্রকার বলা যে, কুকুর না ডাকলে চোর আসত, আপনি ও আল্লাহ যা চান, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা, সামান্য লোক দেখানোর জন্য কোন কাজ করা। ইত্যাদি। [ইবনুল কাইয়্যেম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়ায়িশ শাফী’, শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সুলাইমান আততামীমী, আল-ওয়াজিবুল মুতাহাত্তিমাতুল মারিফাহ’; আশ-শির্ক ফিল কাদীম ওয়াল হাদীস গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত]

আয়াত নং ২৩ এর তাফসীরঃ

২:২৩ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِہٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُہَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ

২৩. আর আমরা আমাদের বান্দার প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা এর অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাক্ষী সাহায্যকারীকে আহবান কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।

সূর বলা হয় কোন একটি মূল্যবান স্থান বা বিশেষ অট্টালিকা যা বাইরে বড় দেয়াল দেয়া বা প্রাচীর দেয়া থাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য।সাধারনত রাজা বা গভর্নর এই প্রাচীর ব্যবস্থাপনা করে থাকেন।

সূরা হলো মহান রবের সেই রকম একটি যা সুরক্ষিত করে রেখেছে শরীয়তের বিভিন্ন মুল্যবান নির্দেশিকা যা আল্লাহর কথা। এটা নাযিল হয়েছে আসমান অর্থাৎ উপর থেকে নীচ পর্যন্ত। আল্লাহ একে সংরক্ষিত করে রেখেছেন।

মুশরিক ও আহলে কিতাবের যারা ঈমান আনেনি তাদের জন্য আল্লাহর এই শব্দ ব্যবহারের কারনে আর সাহস করে নি এই চ্যালেঞ্জ নিতে। এটা অসম্ভব যে সূরা নির্মিত করতে পারা।কারন তারা এর অর্থ বুঝতে পেরেছিলো। এর পর ক্রিটিসাইস করা দুঃসাধ্য কাজ। এই চ্যালেঞ্জ মক্কা জীবনে আল্লাহ দেন নি, সেখানে যারা ছিলো তাদের জন্য এই ধরনের চ্যালেঞ্জ প্রযোজ্য ছিলো না। মহান আল্লাহ মদিনার জীবনে যারা কিতাবধারী ছিলো ও জ্ঞানের অধিকারীও ছিলো তাদের জন্যই এই চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে। হাসসান ইবনে সাবেত কবি

পূর্ববর্তী আয়াতে তাওহীদ প্রমাণ করা হয়েছিল। আর এ আয়াত ও পরবর্তী আয়াতে নবুওয়ত ও রিসালাতের সত্যতা সাব্যস্ত করা হচ্ছে। [ইবনে কাসীর]

شُهَدَاء শব্দের ব্যাখ্যা ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মতে, أعْوَنُكُمْ বা সাহায্যকারীগণ। অর্থাৎ এমন সম্প্রদায় আহবান কর যারা তোমাদেরকে এ ব্যপারে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে।

আবু মালেক বলেন, এর অর্থ, شُرَكَاءَكُمْ তোমাদের অংশীদারদেরকে বা যাদেরকে তোমরা আমার সাথে শরীক করছ সে শরীকদেরকে আহবান করে দেখ তারা কি এর অনুরূপ কোন সূরা আনতে পারে কি না?

মুজাহিদ বলেন, شُهَدَاء শব্দটি এখানে সাধারণ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এমন লোকদের আহবান করে নিয়ে আস যারা এ ব্যাপারে সাক্ষ্য হবে যে, আল্লাহর কালামের বিপরীতে যা নিয়ে আসবে তা আল্লাহর কালামের মত হয়েছে। ভাষাবিদদের সাক্ষ্য এর সাথে যোগ করে দাও।

“এ কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচনা হওয়া সম্ভব নয়। বরং এর আগে যা নাযিল হয়েছে এটা তার সমর্থক এবং আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। তারা কি বলে, তিনি এটা রচনা করেছেন? বলুন, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পার ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও [সূরা ইউনুস ৩৭-৩৮)

তারা যদি কুরআন সম্পর্কে সন্দিহান হয় তবে তারা যেন এর মত একটি সূরা নিয়ে আসে। এর পূর্বে কাফেরদেরকে কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনার ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছিল। ইরশাদ হয়েছে

বলুন, যদি কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনার জন্য মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরূপ আনতে পারবে না। সূরা আল-ইসরাঃ ৮৮

নাকি তারা বলে, সে এটা নিজে রটনা করেছে? বলুন, তোমরা যদি (তোমাদের দাবীতে) সত্যবাদী হও তবে তোমরা এর অনুরূপ দশটি সূরা রচনা করে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পার (এ ব্যাপারে সাহায্যের জন্য) ডেকে নাও।সূরা হুদঃ ১৩

কিন্তু তারা তাতেও অপারগ হয়। তখন তাদেরকে এ আয়াতে কুরআনের সূরাসমূহের একটি সূরা নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করা হয় কিন্তু কাফের-মুশরিকগণ তাও আনতে সক্ষম হয়নি। আর তারা সেটা আনতে পারবেও না। [ইবন কাসীর] আল্লাহ বলেন, “অতএব যদি তোমরা তা করতে না পার আর কখনই তা করতে পারবে না” [সূরা আল-বাকারাহ: ২৪]

এ চ্যালেঞ্জ কুরআনের শুধু ভাষাশৈলীর উপর করা হয়নি। সাধারণভাবে লোকেরা এ চ্যালেঞ্জটিকে নিছক কুরআনের ভাষাশৈলী অলংকার ও সাহিত্য সুষমার দিক দিয়ে ছিল বলে মনে করে। কুরআন তার অনন্য ও অতুলনীয় হবার দাবীর ভিত্তি নিছক নিজের শাব্দিক সৌন্দর্য সুষমার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেনি। নিঃসন্দেহে ভাষাশৈলীর দিক দিয়েও কুরআন নজিরবিহীন। কিন্তু মূলত যে জিনিসটির ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, কোন মানবিক মেধা ও প্রতিভা এহেন কিতাব রচনা করতে পারে না, সেটি হচ্ছে তার বিষয়বস্তু, অলংকারিত ও শিক্ষা। [ইবন কাসীর]

কুরআন নিয়ে যারাই গবেষণা করেছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, এর ভাষাগত বাহ্যিক রূপ ও মর্মগত আত্মিক স্বরূপ উভয় দিক দিয়েই এটা অতুলনীয়।

মহান আল্লাহ বলেন, “আলিফ-লাম-রা, এ কিতাব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের কাছ থেকে; এর আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত ও পরে বিশদভাবে বিবৃত।” [সূরা হুদঃ ১]

সুতরাং কুরআনের ভাষা অত্যন্ত সুসংবদ্ধ ও তার মর্ম সূদুরপ্রসারী ও ব্যাপক। ভাব ও ভাষা উভয় ক্ষেত্রেই তা অতুলনীয় ও বিস্ময়কর। সব সৃষ্টিজগত তার সমকক্ষতার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অক্ষমতার স্বীকৃতি প্রদান করেছে। তাতে একদিকে যেমন অতীতের ইতিহাস উপযুক্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য ঘটনাবলীও সুস্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে। ন্যায় অন্যায় ও ভালো মন্দ সম্পর্কিত সব কিছুই সুনিপুণভাবে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে।তাই আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করলেন,

“সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ। তার বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”। [সূরা আল-আন’আম: ১১৫] অর্থাৎ যে সমস্ত সংবাদ দিয়েছেন সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত| আর যে সমস্ত বিধান দিয়েছেন বিধানদাতা হিসেবে সেগুলোর ন্যায়পরায়ণতা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। এর প্রতিটি বিষয়ই সত্য ও ন্যায়ের মাপকাঠি ও পথের দিশারী। এতে কোন ধারণাপ্রসূত কথা, রূপকথা কিংবা কাল্পনিক গালগল্প ও মিথ্যাচার যা সাধারণত কবিদের কাব্যে পাওয়া যায়, এতে এর বিন্দুমাত্র ছোয়াও নেই।

কুরআনের মজীদের পুরোটাই হচ্ছে উচ্চাঙ্গের কথামালা। অনন্য ভাষাশৈলীতা এবং হৃদয়স্পশী উপমায় ভরপুর। আরবী ভাষায় সুপণ্ডিত ও গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মনীষীরাই কেবল কুরআনের ভাষারীতি ও ভাব সম্পদের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম। কুরআন যখন কোন খবর প্রকাশ করে, হোক তা বিস্তারিত বা সংক্ষিপ্ত, আবার তা যদি একবারের জায়গায় বারবারও বলা হয়, তথাপি তার স্বাদ ও মাধুর্যে বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটে না। যতই পাঠ করবে ততই যেন অজানা এক স্বাদে মন উত্তরোত্তর উদ্বেলিত হয়েই চলবে। তার বারবার পাঠ করলে যেমন সাধারণ পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না। তেমনি অসাধারণ পাঠকরাও অনাগ্রহ প্রকাশ করেন না।

আল-কুরআনের ভীতি প্রদর্শনমূলক আয়াত ও কঠোর সতর্কবাণী ভালো করে অনুধাবন করলে কঠিন মানুষ তো দূরের কথা পাহাড় পর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে থাকে। অনুরূপভাবে তার আশ্বাসবাণী ও পুরস্কার বিবরণ দেখলে ও হৃদয়ঙ্গম করলে অন্ধ মনের বন্ধ দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যায়, অবরুদ্ধ শ্রবণশক্তি প্রত্যাশার পদ-ধ্বনি শুনতে পায়। আর মৃত মন ইসলামের অমিত শরবত পানের জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে। এসব কিছু মিলে অজান্তে হৃদয়ে শান্তিধাম জান্নাতের প্রতি আগ্রহ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আর মহান আল্লাহর আরশের কাছে থাকার তীব্র আকাংখা জাগ্রত হয়।

এ কুরআনের বিষয় বৈচিত্র আশ্চর্যজনক। ভাষার অলংকারের ঔজ্জ্বল্য, নসীহতের প্রাচুর্য, হাজারো যুক্তি প্রমাণ ও তত্ত্বজ্ঞানের আধিক্য কুরআনকে গ্রন্থ জগতে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। বিধিনিষেধের বাণীসমূহকে অত্যন্ত ন্যায়ানুগ, কল্যাণকর, আকর্ষণীয় ও প্রভাবময় করা হয়েছে।

ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ অনেক প্রাচীন মনীষী বলেছেন (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا) শোনার সাথে সাথে মনোযোগের সাথে কান পেতে পরবর্তী বক্তব্য শোন। কারণ, তারপর হয়ত কোন কল্যাণের পথে আহবান থাকবে, না হয় কোন অকল্যাণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ ঘোষিত হবে। [ইবন কাসীর]

আর যদি আল-কুরানে কিয়ামতের মাঠের ভয়াবহ চিত্র, চির সুখের জান্নাতের নেয়ামতরাজি, জাহান্নামের চিরন্তন দুর্ভোগের বিবরন, নেককারদের লোভনীয় পুরস্কার আর গুনাহগারদের নানা রকম ভয়াবহ শাস্তি, দুনিয়ার সম্পদ ও সুখ সম্ভোগের অসারতা ও পারলৌকিক জীবনের সুখ সম্ভোগের অবিনশ্বরতা সংক্রান্ত আলোচনার দিকে দৃষ্টি দেয়া যায় তবে তা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ও কল্যাণমূলক আলোচনায় সমৃদ্ধ। এসব বর্ণনা মানুষকে বার বার ন্যায়ের পথে উদ্বুদ্ধ করে, মনকে ভয়ে বিগলিত করে এবং শয়তানের প্ররোচণায় জমানো অন্তরের কালি ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়।

আল-কুরআনের এ ধরনের অবিস্মরণীয় ও আশ্চর্যজনক মু’জিযার কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মানুষের ঈমান আনার জন্য প্রত্যেক নবীকে কিছু কিছু মু’জিযা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত ওহী হচ্ছে আমার মু’জিযা। আমি আশা করি কিয়ামতের দিন অন্যান্য নবীর তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা অধিক হবে।” [বুখারী ৪৯৮১, মুসলিম: ১৫২]

কারণ, প্রত্যেক নবীর মু’জিযা তাদের ইন্তেকালের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কুরআনুল করীম কেয়ামত পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় বর্তমান থাকবে। সৰ্বকালের মানুষের কাছে অবিসংবাদিত হিসেবে থাকবে। [ইবনে কাসীর]

 

২:২৪ فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡ وَقُوۡدُہَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ ۚۖ اُعِدَّتۡ لِلۡکٰفِرِیۡنَ

২৪. অতএব যদি তোমরা তা করতে না পার আর কখনই তা করতে পারবে না, তাহলে তোমরা সে আগুন থেকে বাঁচার ব্যবস্থা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে কাফেরদের জন্য।

এটা কুরআনের বিশেষ মু’জিযা। একমাত্র কুরআনই নিঃসংকোচে সর্বকালের জন্য নিজ স্বীকৃত সত্তার এভাবে ঘোষণা দিতে পারে। যেভাবে রাসূলের যুগে কেউ এ কুরআনের মত আনতে পারে নি। তেমনি কুরআন এ ঘোষণাও নিঃশঙ্ক ও নিঃসংকোচে দিতে পেরেছে যে, যুগের পর যুগের জন্য, কালের পর কালের জন্য এই চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হচ্ছে যে, এ কুরআনের মত কোন কিতাব কেউ কোন দিন আনতে পারবে না। অনুরূপই ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। রাসূলের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ এ কুরআনের মত কিছু আনার দুঃসাহস দেখাতে পারে নি। আর কোনদিন পারবেও না। গোটা বিশ্বের যিনি সৃষ্টিকর্তা তার কথার সমকক্ষ কোন কথা কি কোন সৃষ্টির পক্ষে আনা সম্ভব?

ইবনে কাসীর বলেন, এখানে পাথর দ্বারা কালো গন্ধক পাথর বোঝানো হয়েছে। গন্ধক দিয়ে আগুন জ্বালালে তার তাপ ভীষণ ও স্থায়ী হয়। আসমান যমীন সৃষ্টির সময়ই আল্লাহ্ তা’আলা কাফেরদের জন্য তা সৃষ্টি করে প্রথম আসমানে রেখে দিয়েছেন। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে ঐ সমস্ত পাথর উদ্দেশ্য, যেগুলোর ইবাদাত করা হয়েছে। [ইবনে কাসীর]

আর জাহান্নামের আগুন সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, “তোমাদের এ আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ এক ভাগ দিয়ে শাস্তি দিলেই তো যথেষ্ট হতো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, জাহান্নামের আগুন তোমাদের আগুনের তুলনায় উনসত্তর গুণ বেশী উত্তপ্ত [বুখারী ৩২৬৫, মুসলিম: ২৪৮৩]

এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যা হচ্ছে, জাহান্নাম কাফেরদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখানে أُعِدَّتْ এর সর্বনামটির ইঙ্গিত সুস্পষ্টতই মানুষ ও পাথর দ্বারা প্রজ্জ্বলিত জাহান্নামের দিকে। অবশ্য এ সর্বনামটি পাথরের ক্ষেত্রেও হতে পারে। তখন অর্থ দাঁড়ায়, পাথরগুলো কাফেরদের শাস্তি প্রদানের জন্য তৈরী করে রাখা হয়েছে। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে অনুরূপ তাফসীর বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উভয় অর্থের মধ্যে বড় ধরনের কোন তফাৎ নেই। একটি অপরটির পরিপূরক ও পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আগুন বিহীন যেমন পাথর জ্বলে না, তেমনি পাথর বিহীন আগুনের দাহ্য ক্ষমতাও বাড়ে না। সুতরাং উভয় উপাদানই কাফেরদের কঠোর শাস্তি দেয়ার জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

জাহান্নাম বর্তমানে তৈরী করা অবস্থায় আছে। জাহান্নাম যে বাস্তবিকই বর্তমানে রয়েছে তার প্রমাণ অনেক হাদীস দ্বারা পাওয়া যায়। যেমন, জাহান্নাম ও জান্নাতের বিবাদের বর্ণনা সংক্রান্ত হাদীস [বুখারী ৪৮৪৯, মুসলিম: ২৮৪৬] ,

জাহান্নামের প্রার্থনা মোতাবেক তাকে বছরে শীত ও গ্রীষ্মে দুই বার শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণের অনুমতি প্রদানের বর্ণনা [বুখারী ৫৩৭, মুসলিম: ৬৩৭]

ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক হাদীসে আছে, “আমরা একটি বিকট শব্দ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার কারণ জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন, এটা সত্তর বছর পূর্বে জাহান্নামের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত পাথর জাহান্নামে পতিত হওয়ার আওয়ায। (মুসলিম: ২৮৪৪, মুসনাদে আহমাদ ২/৪৭১] তাছাড়া সূর্যগ্রহণের সালাত এবং মিরাজের রাত্রির ঘটনাবলীও প্রমাণ করে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়টিই তৈরী করে রাখা হয়েছে। [ইবনে কাসীর]

২:২৫ وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَہُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ؕ کُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡہَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا ہٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَ اُتُوۡا بِہٖ مُتَشَابِہًا ؕ وَ لَہُمۡ فِیۡہَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَہَّرَۃٌ ٭ۙ وَّ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ

২৫. আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদেরকে শুভ সংবাদ দিন যে, তাদের জুন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। যখনই তাদেরকে ফলমূল খেতে দেয়া হবে তখনই তারা বলবে, আমাদেরকে – পূর্বে জীবিকা হিসেবে যা দেয়া হত এতো তাই’। আর তাদেরকে তা দেয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করেই এবং সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র সঙ্গিনী। আর তারা সেখানে স্থায়ী হবে।

জান্নাতের তলদেশে নদী প্রবাহিত’ বলে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, এর গাছের নীচ দিয়ে ও এর কামরাসমূহের নীচ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, জান্নাতের নদী-নালাসমূহ মিশকের পাহাড় থেকে নির্গত। [সহীহ ইবনে হিব্বান: ৭৪০৮]

আনাস ও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, ‘জান্নাতের নহরসমূহ খাদ হয়ে প্রবাহিত হবে না। [সহীহুত তারগীব]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, হাউজে কাউসারের দুই তীর লালা-মোতির গড়া বিরাট গম্বুজ বিশিষ্ট হবে। [বুখারী: ৬৫৮১]

আর তার মাটি হবে মিশকের সুগন্ধে ভরপুর। তার পথে বিছানো কাঁকরগুলো হলো লাল-জহরত, পান্না-চুন্নি সদৃশ। [ইবনে কাসীর]

. জান্নাতবাসীদেরকে একই আকৃতি বিশিষ্ট বিভিন্ন ফলমূল পরিবেশনের উদ্দেশ্য হবে পরিতৃপ্তি ও আনন্দ সঞ্চার। কোন কোন তাফসীরকারের মতে ফলমূল পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার অর্থ জান্নাতের ফলাদি আকৃতিগতভাবে ইহজগতে প্রাপ্ত ফলের অনুরূপই হবে। সেগুলো যখন জান্নাতবাসীদের মধ্যে পরিবেশন করা হবে, তখন তারা বলে উঠবে, অনুরূপ ফল তো আমরা দুনিয়াতেও পেতাম। কিন্তু স্বাদ ও গন্ধ হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। অপর কোন কোন তাফসীরকারকের মতে, ফলমূল পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার অর্থ, জান্নাতে পরিবেশিত ফল-মূলাদি দেখে জান্নাতিগণ বলবে যে, এটা তো গতকালও আমাদের দেয়া হয়েছে, তখন জান্নাতের খাদেমগণ তাদের বলবে যে, দেখতে একই রকম হলেও এর স্বাদ ভিন্ন। ইবনে আব্বাস বলেন, দুনিয়ার ফলের সংগে আখেরাতের ফল-মূলের কোন তুলনাই চলবে না, শুধু নামের মিল থাকবে। [ইবনে কাসীর]

মূল আরবী বাক্যে ازواج ‘আযওয়াজ’শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বহুবচন। এর এক বচন হচ্ছে زوج ‘যওজ, অর্থ হচ্ছে জোড়া। এ শব্দটি স্বামী বা স্ত্রী অর্থে ব্যবহার করা হয়। স্বামীর জন্য স্ত্রী হচ্ছে ‘যওজ’! আবার স্ত্রীর জন্য স্বামী হচ্ছে ‘যওজ’। তবে আখেরাতে আযওয়াজ অর্থাৎ জোড়া হবে পবিত্রতার গুণাবলী সহকারে। জান্নাতে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন স্ত্রী লাভের অর্থ, তারা হবে পার্থিব যাবতীয় বাহ্যিক ও গঠনগত ক্রটি-বিচূতি ও চরিত্রগত কলুষতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং প্রস্ৰাব-পায়খানা, রজঃস্রাব, প্রসবোত্তর স্রাব প্রভৃতি যাবতীয় ঘৃণ্য বিষয়ের উর্ধ্বে। অনুরূপভাবে নীতিভ্রষ্টতা, চরিত্রহীনতা, অবাধ্যতা প্রভৃতি আভ্যন্তরীণ ক্রটি ও কদৰ্যতার লেশমাত্রও তাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না। তাদের গুণাগুণ সম্পর্কে বিভিন্ন আয়াতে এসেছে যে, “তাদের সংগে থাকবে আয়তনয়না, ডাগর চোখ বিশিষ্টাগণ” [সূরা আস-সাফফাত: ৪৮]

আরও বলা হয়েছে, “তারা যেন পদ্মরাগ ও প্রবাল” [সূরা আর-রহমান: ৫৮] আরও এসেছে, “আর তাদের জন্য থাকবে ডাগর চক্ষুবিশিষ্টা হুর, যেন তারা সুরক্ষিত মুক্তা [সূরা আল-ওয়াকি’আ: ২২-২৩) অনুরূপভাবে এসেছে, “আর সমবয়স্কা উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণী” [সূরা আন-নাবা ৩৩] যদি দুনিয়ার কোন সৎকর্মশীল পুরুষের স্ত্রী সৎকর্মশীলা না হয় তাহলে আখেরাতে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ঐ সৎকর্মশীল পুরুষটিকে অন্য কোন সৎকর্মশীলা স্ত্রী দান করা হবে। আর যদি দুনিয়ায় কোন স্ত্রী হয় সৎকর্মশীলা এবং তার স্বামী হয় অসৎ, তাহলে আখেরাতে ঐ অসৎ স্বামী থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে কোন সৎ পুরুষকে তার স্বামী হিসেবে দেয়া হবে। তবে যদি দুনিয়ায় কোন স্বামী-স্ত্রী দুজনই সৎকর্মশীল হয়, তাহলে আখেরাতে তাদের এই সম্পর্কটি চিরন্তন ও চিরস্থায়ী সম্পর্কে পরিণত হবে।

. বলা হয়েছে যে, জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ-বিলাসের উপকরণসমূহকে যেন দুনিয়ার পতনশীল ও ক্ষীয়মান উপকরণসমূহের ন্যায় মনে না করা হয় যাতে যেকোন মূহুর্তে ধ্বংস ও বিলুপ্তির আশংকা থাকে। বরং জান্নাতবাসীগণ অনন্তকাল সুখস্বাচ্ছন্দ্যের এই অফুরন্ত উপকরণসমূহ ভোগ করে বিমল আনন্দ-স্ফূর্তি ও চরম তৃপ্তি লাভ করতে থাকবেন। [ইবনে কাসীর]

২:২৬ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَسۡتَحۡیٖۤ اَنۡ یَّضۡرِبَ مَثَلًا مَّا بَعُوۡضَۃً فَمَا فَوۡقَہَا ؕ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّہُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّہِمۡ ۚ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَیَقُوۡلُوۡنَ مَا ذَاۤ اَرَادَ اللّٰہُ بِہٰذَا مَثَلًا ۘ یُضِلُّ بِہٖ کَثِیۡرًا ۙ وَّ یَہۡدِیۡ بِہٖ کَثِیۡرًا ؕ وَ مَا یُضِلُّ بِہٖۤ اِلَّا الۡفٰسِقِیۡنَ

২৬. নিশ্চয় আল্লাহ মশা কিংবা তার চেয়েও ক্ষুদ্র কোন বস্তুর উপমা দিতে সংকোচ বোধ করেন না। অতঃপর যারা ঈমান এনেছে তারা জানে যে, নিশ্চয় এটা তাদের রব-এর পক্ষ হতে সত্য। কিন্তু যারা কুফরী করেছে তারা বলে যে, আল্লাহ কি উদ্দেশ্যে এ উপমা পেশ করেছেন? এর দ্বারা অনেককেই তিনি বিভ্রান্ত করেন, আবার বহু লোককে হেদায়াত করেন। আর তিনি ফাসিকদের ছাড়া আর কাউকে এর দ্বারা বিভ্রান্ত করেন না

যখন মহান আল্লাহ অকাট্য দলীল দ্বারা সাব্যস্ত করে দিলেন যে, ক্বুরআন এক মুজিযা (অলৌকিক নিদর্শন), তখন কাফেররা অন্যভাবে অভিযোগ উত্থাপন করে বলল যে, যদি এটা আল্লাহর বাণী হত, তাহলে এমন মহান সত্তার অবতীর্ণ করা বাণীতে এত ছোট ছোট জিনিসের দৃষ্টান্ত থাকত না। আল্লাহ তাআলা তাদের কথার উত্তর দিয়ে বলেন যে, কথার পরিষ্কার ব্যাখ্যা দানের উদ্দেশ্যে এবং কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে দৃষ্টান্তসমূহ পেশ করাতে কোন দোষ নেই। আর এ জন্য এতে কোন লজ্জা-সংকোচও নেই। فَوقَها মশার উপরে; অর্থাৎ, তার ডানা বরাবর। অর্থ হল, এই মশার থেকেও ছোট জিনিস। কিংবা فَوق এর অর্থ হল, এই মশার চেয়েও উচ্চ। অর্থ দাঁড়াবে, মশা বা তার থেকে উচ্চ কোন কিছু। فَوقَهَا শব্দের মধ্যে উভয় অর্থেরই প্রশস্ততা রয়েছে।

আল্লাহর উপস্থাপিত দৃষ্টান্তসমূহ দ্বারা ঈমানদারদের ঈমান বর্ধিত হয় এবং কাফেরদের কুফরী বৃদ্ধি পায়। আর এ সব কিছু আল্লাহর কুদরতী নিয়ম এবং তাঁর ইচ্ছার ভিত্তিতেই হয়।

যেটাকে ক্বুরআনে (نُوَلِّهِ مَا تَوَلّى) আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে। (সূরা নিসা ১১৫ আয়াত) এবং

হাদীসে كُلٌّ مُيَسَّرٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ অর্থাৎ, প্রত্যেকের জন্য সে জিনিস সহজ করা হয় যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী, তাফসীর সূরাতুল লাইল) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

হে লোকেরা! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, মনোযোগ দিয়ে শোনো৷ আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব উপাস্যকে তোমরা ডাকো তারা সবাই মিলে একটি মাছি সৃষ্টি করতে চাইলেও করতে পারবে না৷ বরং যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কোনো জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাহলে তারা তা ছাড়িয়েও নিতে পারবে না৷ সাহায্য প্রার্থীও দুর্বল এবং যার কাছে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে সেও দুর্বল৷হজ্জঃ ৭৩

যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পৃষ্ঠপোষক বানিয়ে নিয়েছে তাদের দৃষ্টান্ত হলো মাকড়সা৷ সে নিজের একটি ঘর তৈরি করে এবং সব ঘরের চেয়ে বেশি দুর্বল হয় মাকড়সার ঘর৷ হায় যদি এরা জানতো। আনকাবুতঃ৪১

فِسق আল্লাহর আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়াকে বলে। আল্লাহর হুকুম যে মানে না, নাফরমানি করে সেই ফাসেক। ফুয়াইসিকা ছোট ফাসেক-ছোট ইদুর, খাবার নষ্ট করে,ক্ষতিকর পশুকেও ফাসিক বলে

যেমন-হাদীসে এসেছে-৫টি ফাসেক আছে যা মেরে ফেলার কথা হয়েছে।

কালো কাক, পাখি যা মুরগীর বাচ্চা খেয়ে ফেলে চিল, বিচ্ছু, ইদুর,পাগল কুকুর যা কামড়ায়।

মুসলিম ও কাফের এর মাঝেও ফাসেক আছে। তবে দুই গ্রুপের মাঝে পার্থক্য আছে।

এই আয়াতে বলা হয়েছে তারা কাফের।

ইবলিসকেও আল্লাহ বলেছেন ফাসেক।

আর এটা (আল্লাহর আনুগত্য থেকে বের হওয়া) সাময়িকভাবে একজন মু’মিনের দ্বারাও হতে পারে। তবে এখানে ‘ফিসক্ব’-এর অর্থ হল, আল্লাহর আনুগত্য থেকে সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, কুফরী করা ও সৎপথ পরিত্যাগ করা। আর এ কথা পরবর্তী আয়াত দ্বারা আরো পরিষ্কার হয়ে যায়, যাতে মু’মিনদের মোকাবেলায় কাফেরদের গুণাবলীর উল্লেখ হয়েছে।

ফাসিক শব্দের অর্থ ‘সত্যত্যাগী’। ফাসিক শব্দটি পবিত্র কুরআনে মোট এসেছে ৫৪ বার। ফাসিক শব্দ দিয়ে আল্লাহ্ কুরআনের আয়াত অস্বীকারকারী কাফেরদেরকেই বুঝিয়েছেন।

আল-বাকারাহ :৯৯    وَلَقَدْ أَنزَلْنَآ إِلَيْكَ ءَايَٰتٍۭ بَيِّنَٰتٍۖ وَمَا يَكْفُرُ بِهَآ إِلَّا ٱلْفَٰسِقُونَ এবং আমি তোমার নিকট সুস্পষ্ট আয়াত নাযিল করেছি, ফাসিকরা ছাড়া অন্য কেউ তা অস্বীকার করে না।

আলি ‘ইমরান :৮২   فَمَن تَوَلَّىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُو۟لَٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَٰسِقُونَ   অতঃপর যারা(সত্য থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিবে তারাই হল ফাসেক।

আল-মা’ইদাহ :৫ قُلْ يَٰٓأَهْلَ ٱلْكِتَٰبِ هَلْ تَنقِمُونَ مِنَّآ إِلَّآ أَنْ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبْلُ وَأَنَّ أَكْثَرَكُمْ فَٰسِقُونَ

বল, ‘ওহে কিতাবধারী সম্প্রদায়! তোমরা এ ছাড়া অন্য কারণে আমাদের প্রতি রাগান্বিত নও যে, আমরা আল্লাহর প্রতি এবং আমাদের প্রতি আর আমাদের পূর্বে যা নাযিল হয়েছিল তার প্রতি ঈমান এনেছি, তোমাদের অধিকাংশই তো হচ্ছে ফাসিক।’

আল-মা’ইদাহ :৮১ তারা যদি আল্লাহর, নাবীর ও তার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তার উপর ঈমান আনতো তবে তাদেরকে (অর্থাৎ কাফিরদেরকে) বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না, কিন্তু তাদের অধিকাংশই ফাসিক।

মুসলিম মিল্লাতের কোন ফাসেক ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়না এবং মৃত্যুর পর তারা তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামীও মনে করেনা। ফাসেকের মধ্যে মূল ঈমান বজায় থাকবে এবং তার জন্য ‘মুমিন’ নামও ঠিক থাকবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَن يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَأً وَمَن قَتَلَ مُؤْمِنًا خَطَأً فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُّؤْمِنَة﴾

কোন মুমিনের কাজ নয় অন্য মুমিনকে হত্যা করা, তবে ভুলবশত হতে পারে৷ আর যে ব্যক্তি ভুলবশত কোন মুমিনকে হত্যা করে তার কাফ্ফারা হিসেবে একজন মুমিনকে গোলামী থেকে মুক্ত করতে হবে’’। (সূরা নিসাঃ ৯২)

আল্লাহ মুমিন ও কাফের বলে ঈমান ও কুফরের দুই প্রান্তসীমাকে বুঝিয়েছেন। মধ্যবর্তী ফাসেকী অবস্থাকে উহ্য রেখেছেন (কুরতুবী)। ফাসেকরা ছগীরা অথবা কবীরা গোনাহগার হবে। মুমিনরাও তেমনি নিম্নস্তরের ও উঁচু স্তরের হবে।

ত্রুটিপূর্ণ মুমিনগণ ‘ফাসেক’।

কিন্তু ‘কাফের’ বা ইসলাম থেকে খারিজ ও ‘মুরতাদ’ নয়। যেমন বনু মুছত্বালিক্বদের নিকট থেকে ‘যাকাত’ সংগ্রহের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অলীদ বিন ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বকে প্রেরণ করেন। কিন্তু মাঝপথ থেকে ফিরে এসে বলেন যে, তারা ‘মুরতাদ’ হয়ে গিয়েছে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। তখন রাসূল (ছাঃ) খালেদ বিন অলীদকে পাঠিয়ে জানতে পারেন যে, তারা আদৌ মুরতাদ হয়নি। বরং মুমিন ও পূর্ণ আনুগত্যশীল রয়েছে। ফলে রাসূল (ছাঃ) তাদের দমনে সৈন্য পাঠানো থেকে বিরত হন।

উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে নাযিল হয়

,يَآأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَآءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ-

‘হে মুমিনগণ! যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহ’লে তোমরা সেটা যাচাই কর, যাতে অজ্ঞতাবশে তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধন না করে বস। অতঃপর নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হও’ (হুজুরাত ৪৯/৬)। ভুল তথ্য প্রদানের জন্য ঐ ব্যক্তিকে কুরআনে ‘ফাসেক’ বলা হয়েছে। কিন্তু তাকে কাফের বা ‘মুরতাদ’ বলা হয়নি। রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যাও করেননি। একইভাবে মক্কা বিজয়ের অভিযানের খবর ফাঁস করে কুরায়েশ নেতাদের নিকট গোপনে পত্র প্রেরণকারী ছাহাবী হাতেব বিন আবু বালতা‘আহকে রাসূল (ছাঃ) ‘কাফের’ বলেননি বা তাকে হত্যা করেননি। বরং কৈফিয়ত নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন।বুখারী হা/৪২৭৪।

২:২৭ الَّذِیۡنَ یَنۡقُضُوۡنَ عَہۡدَ اللّٰہِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِیۡثَاقِہٖ ۪ وَ یَقۡطَعُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰہُ بِہٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ

২৭. যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, আর যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনের উপর ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।

মুফাসসিরীনগণ عَهد (অঙ্গীকার) শব্দের বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করেছেন। যেমন,

(ক) আল্লাহ তাআলার সেই অসিয়ত যা তিনি তাঁর সকল আদেশ পালন এবং নিষিদ্ধ বর্জন করার ব্যাপারে আম্বিয়া (আলাইহিমুসসালাম)-দের মাধ্যমে সৃষ্টিকুলকে করেছেন। (খ) আহলে কিতাবের নিকট থেকে তাওরাতে নেওয়া অঙ্গীকার। আর তা হল, শেষ নবী (সাঃ)-এর আগমনের পর তাঁর সত্যায়ন করা এবং তাঁর নবুঅতের উপর ঈমান আনা তোমাদের জন্য অত্যাবশ্যক হবে।

(গ) যে অঙ্গীকার আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করার পর সকল আদম-সন্তানদের নিকট থেকে নেওয়া হয়েছে এবং যার উল্লেখ ক্বুরআন মাজীদে করা হয়েছে। {وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آَدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ} (আর যখন তোমার পালনকর্তা আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন—সূরা আ’রাফ ১৭২ আয়াত) আর অঙ্গীকার ভঙ্গের অর্থ তার কোন পরোয়া না করা। (ইবনে কাসীর)

এটা তো পরিষ্কার কথা যে, ক্ষতি আল্লাহর অবাধ্যজনদেরই হবে। এতে আল্লাহর, তাঁর নবীদের এবং দ্বীনের প্রতি আহবানকারীদের কিছুই হবে না।

ক্ষতিগ্রস্থ কারা তা আমরা সূরা আসর থেকেও জানতে পারি।

২:২৮ کَیۡفَ تَکۡفُرُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ کُنۡتُمۡ اَمۡوَاتًا فَاَحۡیَاکُمۡ ۚ ثُمَّ یُمِیۡتُکُمۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡکُمۡ ثُمَّ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ

২৮. তোমরা কিভাবে আল্লাহর সাথে কুফরী করছ? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জীবিত করেছেন। তারপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনরায় জীবিত করবেন, তারপর তারই দিকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।

উক্ত আয়াতে দু’টি মরণ ও দু’টি জীবনের কথা উল্লেখ হয়েছে।

প্রথম মরণের অর্থ, অস্তিত্বহীনতা (কিছুই না থাকা)।

আর প্রথম জীবনের অর্থ, মায়ের পেট থেকে বের হয়ে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত জীবন। অতঃপর মৃত্যু আসবে এবং তখন থেকে আখেরাতের যে জীবন শুরু হবে সেটা হবে দ্বিতীয় জীবন।

কাফেরগণ এবং কিয়ামতকে অস্বীকারকারিগণ এ জীবনকে অস্বীকার ক’রে থাকে। ইমাম শাওকানী কোন কোন আলেমের অভিমত উল্লেখ করেছেন যে, (মৃত্যুর পর হতে কিয়ামত পর্যন্ত) কবরের জীবন দুনিয়ার জীবনেরই শামিল। (ফাতহুল ক্বাদীর) তবে সঠিক কথা হল, বারযাখী (কবরের) জীবন আখেরাতের জীবনের প্রারম্ভ এবং তার শিরোনাম, কাজেই তার সম্পর্ক আখেরাতের জীবনের সাথেই।

আল্লাহকে চেনার সর্বোত্তম উপায় হলো বিশ্বজগত এবং মানব সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা। জীবন ও মৃত্যু নিয়ে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে মানুষ এ সত্য উপলদ্ধি করতে পারে যে, আমি যদি নিজেই আমার স্রষ্টা হতাম তাহলে অবশ্যই চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী হতাম। কিন্তু একসময় আমরা ছিলাম না, পরে অস্তিত্ব লাভ করেছি এবং পূনরায় আমাদেরকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কাজেই এই প্রাণ বা জীবনই হচ্ছে আমাদের জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ বা নেয়ামত।

মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত অগ্রসর হবার পরও এখন পর্যন্ত এই প্রাণের স্বরূপ উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের জন্ম ও মৃত্যু পুরোপুরি আল্লাহর হাতে। আমরা নিজের ইচ্ছায় আসিনি, কাজেই নিজ ইচ্ছায় যেতেও পারব না। স্রষ্টা আমাদের অস্তিত্ব দিয়েছেন এবং তিনিই আমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আমল বা কাজই হচ্ছে আমাদের একমাত্র সম্বল। সুতরাং যে স্রষ্টার হাতে আমাদের শুরু এবং শেষ, তার অস্তিত্বকে আমরা কিভাবে অস্বীকার করব? অথবা মৃত্যুর পর মানুষের পুনরুত্থানকে আমরা কিভাবে অস্বীকার করবো? কেননা পুনরুত্থান বা মৃত্যুর পর পূনরায় জীবিত করা প্রথমবার সৃষ্টির করার চেয়ে অনেক সহজ কাজ। যে স্রষ্টা আমাদেরকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে, অস্তিত্ব বা প্রাণ দিয়েছেন, তিনি কি মৃত্যুর পর মানুষকে পূনরায় জীবিত করতে পারবেন না?

. মানুষকে হেদায়েতের জন্য কুরআনের একটি বিশেষ পন্থা হচ্ছে, মানুষের বুদ্ধি বিবেক এবং সহজাত প্রবৃত্তির কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া। যাতে চিন্তার মাধ্যমে মানুষ সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারে।

. মানুষের জীবন আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে, আর মৃত্যু পুনরুত্থান দিবসের ইঙ্গিত বহন করে।

. নিজেকে জানা, আল্লাহকে চেনারই ভূমিকা মাত্র। আত্মপরিচয় লাভের মাধ্যমে মানুষ স্রষ্টাকেও চিনতে পারে। কেননা সে বুঝতে পারে তার নিজস্ব বলতে কিছুই নেই, সব কিছু মহান আল্লাহর।

. মৃত্যুই মানব জীবনের সমাপ্তি নয়, বরং এর মাধ্যমে নতুন জীবনের সূচনা হয়।

 

২:২৯ ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ لَکُمۡ مَّا فِی الۡاَرۡضِ جَمِیۡعًا ٭ ثُمَّ اسۡتَوٰۤی اِلَی السَّمَآءِ فَسَوّٰىہُنَّ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ ؕ وَ ہُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ

২৯. তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আসমানের প্রতি মনোনিবেশ করে সেটাকে সাত আসমানে বিন্যস্ত করেছেন; আর তিনি সবকিছু সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।

এখানে যমীন সৃষ্টির পরে আসমান সৃষ্টি করা হয়েছে বলে বর্ণিত হয়েছে।

অথচ সূরা আন-নাযিআতের ৩০ নং আয়াত বাহ্যতঃ এর বিপরীত মনে হয়। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের সূরা ফুসসিলাতের ১০ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এখানে শুধু এটা জানাই যথেষ্ট যে, সহীহ সনদে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, “আল্লাহ্ তা’আলা যমীনকে আসমানের আগেই সৃষ্টি করেছিলেন এবং তার মধ্যে খাবার জাতীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সেটাকে আসমান সৃষ্টির পূর্বে প্রসারিত ও সামঞ্জস্যবিধান করেন নি। তারপর তিনি আকাশের প্রতি মনোযোগী হয়ে সেটাকে সাত আসমানে বিন্যস্ত করেন। তারপর তিনি যমীনকে সুন্দরভাবে প্রসারিত ও বিস্তৃত করেছেন। এটাই এ আয়াত এবং সূরা আন-নাযি’আতের ৩০ নং আয়াতের মধ্যে বাহ্যতঃ উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর। [আত-তাফসীরুস সহীহ] মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা আসমান সৃষ্টি করার আগেই যমীন সৃষ্টি করেন। যমীন সৃষ্টির পর তা থেকে এক ধোয়া বা বাষ্প উপরের দিকে উঠতে থাকে। আর সেটাই আল্লাহর বাণীঃ “তারপর তিনি আসমান সৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করলেন এমতাবস্থায় যে, সেটা ছিল ধুম্রাকার” [সূরা ফুসসিলাত: ১১] [ইবনে কাসীর]

প্রথমতঃ জানা গেল যে, আসমান (আকাশ) এক অনুভূত বস্তু এবং বাস্তব জিনিস। কেবল উচ্চতা (মহাশূন্য)-কে আসমান বলে আখ্যায়িত করা হয়নি।

দ্বিতীয়তঃ জানা গেল যে, আসমানের সংখ্যা হল সাত। আর হাদীস অনুযায়ী দুই আসমানের মধ্যেকার দূরত্ব হল পাঁচ শত বছরের পথ।

আর যমীন সম্পর্কে ক্বুরআনে কারীমে এসেছে, {وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ} এবং পৃথিবীও সেই পরিমাণে। (ত্বালাক্ব ১২ আয়াত) এ থেকে যমীনের সংখ্যাও সাত বলে জানা যায়। নবী (সাঃ)-এর হাদীস দ্বারা এ কথা আরো বলিষ্ঠ হয়।

বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত যমীনও আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন সাত তবক যমীনকে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী ২৯৫৯নং) উক্ত আয়াত থেকে এ কথাও জানা যায় যে, আসমানের পূর্বে যমীন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সূরা নাযিআত (৩০ আয়াতে) আসমানের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, {وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَلِكَ دَحَاهاَ} যমীনকে এর পর বিস্তৃত করেছেন। এর ব্যাখ্যা এই করা হয়েছে যে, প্রথমে যমীনই সৃষ্টি হয়েছে, তবে পরিষ্কার ও সমতল করে বিছানো হল সৃষ্টি থেকে ভিন্ন ব্যাপার, যেটা আসমান সৃষ্টির পর সম্পাদিত হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর)

আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং তাদের মত পৃথিবীও, তাদের মধ্যে নেমে আসে তার নির্দেশ; যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।” [সূরা আত-তালাকঃ ১২]

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাত আসমান ও এর ভিতরে যা আছে এবং এর মাঝখানে যা আছে তা সবই কুরসীর মধ্যে যেন বিস্তীর্ণ যমীনের মধ্যে একটি আংটি আর কুরসী হলো মহান আরশের মধ্যে তদ্রুপ একটি আংটি স্বরূপ যা এক বিস্তীর্ণ যমীনে পড়ে আছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর আরশ তার পরিমাণ তো মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ নির্ধারণ করে বলতে পারবে না। [তাবারী]

الَّذِیۡ خَلَقَ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ طِبَاقًا ؕ مَا تَرٰی فِیۡ خَلۡقِ الرَّحۡمٰنِ مِنۡ تَفٰوُتٍ ؕ فَارۡجِعِ الۡبَصَرَ ۙ ہَلۡ تَرٰی مِنۡ فُطُوۡرٍ

ثُمَّ ارۡجِعِ الۡبَصَرَ کَرَّتَیۡنِ یَنۡقَلِبۡ اِلَیۡکَ الۡبَصَرُ خَاسِئًا وَّ ہُوَ حَسِیۡرٌ

যিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আসমান। রহমানের সৃষ্টিতে আপনি কোন খুঁত দেখতে পাবেন না; আপনি আবার তাকিয়ে দেখুন, কোন ত্রুটি দেখতে পান কি? সূরা মূলকঃ৩

২. পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে اسْتَوٰى শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, স্থান বিশেষে বিভিন্ন প্রকার অর্থে সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায় তা তিনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে:

(১) اسْتَوٰى শব্দটি যেখানে পূর্ণ ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ তার পরে –على বা إلى কিছুই না আসে তখন তার অর্থ হবে, সম্পূর্ণ হওয়া বা পূর্ণতা লাভ করা। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেনঃ

(وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَاسْتَوَىٰ) অর্থাৎ আর যখন মূসা যৌবনে পদার্পণ করলেন এবং পূর্ণতা লাভ করলেন। [সূরা আল-কাসাসঃ ১৪]

(২) اسْتَوٰى শব্দটির সাথে যদি على আসে তখন তার অর্থ হবে- উপরে উঠা, আরোহণ করা। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা তার নিজের সম্পর্কে বলেনঃ

(ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ) [আ’রাফ ৫৪, ইউনুস ৩, রা’দ ২, ফিরকান ৫৯, সাজদা ৪, হাদীদ ৪] অর্থাৎ তারপর তিনি আরশের উপর উঠলেন।

অনুরূপভাবে সূরা ত্ব-হা-তে এসেছেঃ (الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ) অর্থাৎ দয়াময় (রহমান) আরশের উপর উঠলেন।

اسْتَوٰى শব্দটির সাথে যদি إلى আসে তখন তার অর্থ হবে- ইচ্ছা করা, সংকল্প করা, মনোনিবেশ করা। আর সে অর্থই এ আয়াতে ব্যবহৃত (ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ) এর অর্থ করা হবে- আকাশ সৃষ্টির ইচ্ছা করলেন। তবে মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানেও উপরে উঠার অর্থ হবে।

শেষোক্ত দু’অবস্থায় اسْتَوَى শব্দটি যখন আল্লাহ্ তা’আলার সাথে সম্পৃক্ত হবে তখন তা তার একটি সিফাত বা গুণ হিসেবে গণ্য হবে। আর আল্লাহর জন্য সে সিফাত বা গুণ কোন প্রকার অপব্যাখ্যা, পরিবর্তন, সদৃশ নির্ধারণ ছাড়াই সাব্যস্ত করা ওয়াজিব।

সংগ্রহঃ

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন