সূরা ফালাক্ব (প্রভাতকাল)
মদীনায় অবতীর্ণ। সূরা ১১৩, আয়াত ৫।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ
(১) বল! আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের প্রতিপালকের
مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
(২) যাবতীয় অনিষ্ট হ’তে, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন
وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ
(৩) এবং অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট হ’তে, যখন তা সমাগত হয়
وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ
(৪) এবং গ্রন্থিতে ফুঁকদানকারিণীদের অনিষ্ট হ’তে
وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
(৫) এবং হিংসুকের অনিষ্ট হ’তে যখন সে হিংসা করে।
নাযিল হওয়ার সময় ও ফায়দাঃ
সূরা ফালাক ও পরবর্তী সূরা নাস একই সাথে একই ঘটনায় অবতীর্ণ হয়েছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রাহেমাহুল্লাহ উভয় সূরার তাফসীর একত্রে লিখেছেন। তাতে বলেছেন যে, এ সূরাদ্বয়ের উপকারিতা ও কল্যাণ অপরিসীম এবং মানুষের জন্যে এ দু’টি সূরার প্রয়োজন অত্যধিক। বদনজর এবং সমস্ত দৈহিক ও আত্মিক অনিষ্ট দূর করায় এ সূরাদ্বয়ের কার্যকারিতা অনেক। বলতে গেলে মানুষের জন্যে শ্বাসপ্রশ্বাস, পানাহার ও পোষাক-পরিচ্ছদ যতটুকু প্রয়োজনীয়, এ সূরাদ্বয় তার চেয়ে বেশী প্রয়োজনীয়।
সূরা ফালাক-এ দুনিয়াবী বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে সূরা আন-নাসে আখেরাতের আপদ ও মুসীবত থেকে আশ্রয় প্রার্থনার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহে এ সূরা এবং সূরা আন-নাস উভয় সূরার অনেক ফযীলতা ও বরকত বর্ণিত আছে।
উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা লক্ষ্য করেছ কি, আজ রাত্রিতে আল্লাহ তায়ালা আমার প্রতি এমন আয়াত নাযিল করেছেন, যার সমতুল্য আয়াত দেখা যায় না; অর্থাৎ (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) ও (قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) আয়াতসমূহ। [মুসলিমঃ ৮১৪]
অন্য বর্ণনায় আছে, তাওরাত, ইঞ্জিল, যবূর এবং কুরআনেও অনুরূপ অন্য কোন সূরা নেই। [মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৪৮, ১৫৮–১৫৯]
এক সফরে রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করালেন, অতঃপর মাগরিবের সালাতে এ সূরাদ্বয়ই তেলাওয়াত করে বললেনঃ এই সূরাদ্বয় নিদ্রা যাওয়ার সময় এবং নিদ্রা থেকে গাত্রোত্থানের সময়ও পাঠ করো। [আবু দাউদ: ১৪৬২, মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৪৮]
অন্য হাদীসে তিনি প্রত্যেক সালাতের পর সূরাদ্বয় পাঠ করার আদেশ করেছেন। [আবু দাউদ: ১৫২৩ তিরমিযী: ২৯০৩, নাসায়ী: ১৩৩৬, মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৫৫]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন রোগে আক্রান্ত হলে এই সূরাদ্বয় পাঠ করে হাতে ফুঁক দিয়ে সর্বাঙ্গে বুলিয়ে দিতেন। ইন্তেকালের পূর্বে যখন তাঁর রোগযন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়, তখন আমি এই সূরাদ্বয় পাঠ করে তার হাতে ফুঁক দিতাম। অতঃপর তিনি নিজে তা সর্বাঙ্গে বুলিয়ে নিতেন। আমার হাত তাঁর পবিত্র হাতের বিকল্প হতে পারতনা। তাই আমি এরূপ করতাম। [বুখারী: ৫০১৬, মুসলিম: ২১৯২]
উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমি কি সূরা ইউসুফ ও সূরা হূদ থেকে পড়ব? তিনি বললেন, ‘বরং তুমি কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক দিয়ে পড়। কেননা, তুমি এর চেয়ে আল্লাহর নিকট প্রিয় ও অধিক অর্থপূর্ণ আর কোন সূরা পড়তে পারবে না। যদি তুমি পার, তবে এ সূরা যেন তোমার থেকে কখনো ছুটে না যায়” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৫৪০]
সারকথা এই যে, যাবতীয় বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার জন্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম এই সূরাদ্বয়ের আমল করতেন।
একদা আবু হাবেস জুহ্নী (রাঃ)-কে নবী (সাঃ) বললেন, ‘‘হে আবু হাবেস! আমি তোমাকে উত্তম ঝাড়-ফুঁকের কথা বলে দেব না কি, যার মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনাকারীরা আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে?’’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই বলে দিন।’ মহানবী (সাঃ) এই সূরা দুটিকে উল্লেখ করে বললেন, ‘‘এ সূরা দুটি হল মুআবিবযাতান (ঝাড়-ফুঁকের মন্ত্র)।’’ (সহীহ নাসাঈ আলবানী ৫০২০নং)
নবী (সাঃ) মানুষ ও জিনের বদ নজর থেকে (আল্লাহর) নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। যখন এই দুটি সূরা অবতীর্ণ হল, তখন থেকে তিনি ঐ দুটিকে প্রত্যহ পড়ার অভ্যাস বানিয়ে নিলেন এবং বাকী অন্যান্য (দু’আ) বর্জন করলেন। (সহীহ তিরমিযী আলবানী ২১৫০ নং)
যখন নবী (সাঃ)-কে যাদু করা হল, তখন জিবরাঈল (আঃ) এই দুই সূরা নিয়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হলেন। আর বললেন যে, এক ইয়াহুদী (লাবীদ বিন আ’সাম) আপনাকে যাদু করেছে। আর সেই যাদুর বস্তু যারওয়ান কুয়ায় রাখা হয়েছে। তিনি আলী (রাঃ)-কে পাঠিয়ে তা উদ্ধার করলেন। (তা ছিল একটি চিরুনী, কয়েকটি চুল, একটি সুতো। তাতে দেওয়া ছিল এগারোটি গিরা। এ ছাড়া একটি নর খেজুর গাছের শুকনো মোছা এবং মোমের একটি পুতুল ছিল; যাতে কয়েকটি সুচ ঢুকানো ছিল।) জিবরাঈল (আঃ)-এর নির্দেশে তিনি উক্ত দুই সূরা থেকে এক একটি আয়াত পাঠ করলেন এবং তার সাথে একটি করে গিরা খুলতে লাগল এবং সুচও বের হতে লাগল। শেষ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে সমস্ত গিরাগুলি খুলে গেল এবং সুচগুলিও বের হয়ে গেল। এরপর তিনি সঙ্গে সঙ্গে আরোগ্য লাভ করলেন। (সহীহ বুখারী ফাতহুলবারীসহ, তিবব্ অধ্যায়, যাদু পরিচ্ছেদ, মুসলিম সালাম অধ্যায় যাদু পরিচ্ছেদ)
নবী (সাঃ)-এর অভ্যাস ছিল যে, তিনি রাত্রে শয়নকালে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও নাস পাঠ করে দুই হাতের তালুতে ফুঁক মেরে সারা শরীরে ফিরাতেন। প্রথমে মাথা, মুখমন্ডল তারপর শরীরের অগ্রভাগে হাত ফিরাতেন। তারপর যতদূর পর্যন্ত তাঁর হাত পৌঁছত, ততদূর তা ফিরাতেন এবং তিনি এইরূপ তিনবার করতেন। (সহীহ বুখারী ফাযায়েলে কুরআন, মুআবিবযাত পরিচ্ছেদ)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ, ক্বুল আঊযু বিরাবিবল ফালাক ও ক্বুল আঊযু বিরাবিবন্নাস’ সকাল সন্ধ্যায় তিনবার করে বল; প্রত্যেক জিনিস থেকে তাই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে।’’ (আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, সহীহ তারগীব ৬৪৩ নং)
প্রশ্ন হ’তে পারে যে, রাসূল (সা)-এর উপরে জাদুর ক্রিয়া কেন হ’ল? তিনি তো আল্লাহর রাসূল। এর জবাব এই যে, আগুন ও পানির ন্যায় জাদুরও একটি স্বাভাবিক ক্রিয়া আছে। নবীগণ মানুষ ছিলেন। তাই তাঁরাও এসবের প্রতিক্রিয়ার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তবে সেই প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতি হওয়া না হওয়াটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন বিষয়।
যেমন আল্লাহর হুকুমে আগুন ইবরাহীম (আঃ)-এর কোন ক্ষতি করেনি (আম্বিয়া ২১/৬৯)।
হযরত ইউনুস (আঃ)-কে নদীর পানি ও মাছ কোন ক্ষতি করেনি (ছাফফাত ৩৭/১৪০-১৪৫)।
তেমনিভাবে আল্লাহর হুকুমে জাদু ক্রিয়া রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আত্মিক ও জ্ঞানগত কোন ক্ষতি করতে পারেনি। অহি-র প্রচার ও প্রসারেও কোন ব্যত্যয় ঘটেনি, যেটা শত্রুরা কামনা করেছিল। ফালিল্লাহিল হামদ। নবী ছাড়াও আল্লাহর অন্যান্য নেক বান্দাদেরকেও আল্লাহ এমনিভাবে রক্ষা করে থাকেন। ঈমানদারগণের ইতিহাসে এর বহু নযীর রয়েছে।
ব্যখ্যাঃ
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ
বল! আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের প্রতিপালকের
الفَلَق এর সহীহ অর্থ হল, ঊষা বা প্রভাতকাল। এখানে বিশেষ করে ‘ঊষার প্রতিপালক’ এই জন্য বলা হয়েছে যে, যেমন আল্লাহ তাআলা রাতের অন্ধকারকে দূরীভূত করে দিনের উজ্জ্বলতা নিয়ে আসতে পারেন, তেমনি তিনি ভয় ও আতঙ্ক দূর করে আশ্রয় প্রার্থীকে নিরাপত্তা দান করতে পারেন। অথবা মানুষ যেমন রাত্রে এই অপেক্ষা করে যে, সকালের উজ্জ্বলতা এসে উপস্থিত হবে, ঠিক তেমনিভাবে ভীত মানুষ আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে (নিরাপত্তা লাভে) সফলতার প্রভাত উদয়ের আশায় থাকে। (ফাতহুল ক্বাদীর) যেমন তিনি বলেন,
وَإِنْ يََّمْسَسْكَ اللهُ بِضُرٍّ فَلاَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ وَإِنْ يُّرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلاَ رَادَّ لِفَضْلِهِ-
‘যদি আল্লাহ তোমাকে কোন অমঙ্গল স্পর্শ করান, তবে তা দূর করার কেউ নেই তিনি ব্যতীত। আর যদি তিনি তোমার মঙ্গল চান, তবে তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই’ (ইউনুস ১০৭)
অন্যত্র আল্লাহ নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছেন,
فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَى ‘বীজ ও আঁটি থেকে অংকুরোদ্গমকারী’ এবং فَالِقُ الْإِصْبَاحِ ‘প্রভাত রশ্মির উন্মেষকারী’ (আন‘আম ৫/৯৫-৯৬)।
উক্ত মর্মে এখানে ‘ফালাক্ব’ অর্থ কেবল ‘প্রভাতকাল’ নয়; বরং সকল মাখলূক্বাত হতে পারে। কেননা সকল সৃষ্টিই অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে আল্লাহর হুকুমে এবং তিনিই সকল মাখলূক্বাতের সৃষ্টিকর্তা ও একক পালনকর্তা। অতএব তিনি ‘রাববুল ফালাক্ব’ এবং তিনিই ‘রাববুল মাখলূক্বাত’।
ইমাম তাবারী বলেন, আল্লাহ এখানে আয়াতকে অনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, নির্দিষ্ট কোন অর্থে বেধে দেননি। তাই এখানে ফালাক বলতে যা বুঝায় তার সবই উদ্দেশ্য হবে। [আদওয়াউল বায়ান, তাবারী]
আশ্রয় চাওয়া কাজটির তিনটি অপরির্হায অংশ রয়েছে৷
এক ,আশ্রয় চাওয়া ৷
দুই , যে আশ্রয় চায়৷
তিন, যার কাছে আশ্রয় চাওয়া হয়৷
আশ্রয় চাওয়ার অর্থ, কোন জিনিসের ব্যাপারে ভয়ের অনুভূতি জাগার কারণে নিজেকে তার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য অন্য কারো হেফাজতে চলে যাওয়া ,তার অন্তরাল গ্রহণ করা , তাকে জড়িয়ে ধরা বা তার ছায়ায় চলে যাওয়া৷
আশ্রয় প্রার্থী অবশ্যি এমন এক ব্যক্তি হয় যে অনুভব করে যে সে যে জিনিসের ভয়ে ভীত তার মোকাবেলা করার ক্ষমতা তার নেই৷ বরং তার হাত থেকে বাঁচার জন্য তার অন্যের আশ্রয় গ্রহণ করা প্রয়োজন৷
তারপর যার আশ্রয় চাওয়া হয় সে অবশ্যি এমন কোন ব্যক্তিত্ব বা সত্তা হয় যার ব্যাপারে আশ্রয় গ্রহনকারী মনে করে সেই ভয়ংকর জিনিস থেকে সেই তাকে বাঁচাতে পারে৷ এখন এক প্রকার আশ্রয়ের প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী কার্যকারণের জগতে কোন অনুভূত জড় পদার্থ ব্যক্তি বা শক্তির কাছে গ্রহণ করা যেতে পারে৷ যেমন শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোন দুর্গের আশ্রয় নেয়া ,গোলাগুলিও বর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য পরিখা ,বালি ভর্তি থলের প্রাচীর বা ইটের দেয়ালের আড়াল নেয়া ,কোন শক্তিশালী জালেমের হাত থেকে বাঁচার জন্য কোন ব্যক্তি ,জাতি বা রাষ্ট্রের আশ্রয় গ্রহণ করা অথবা রোদ থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য কোন গাছ বা দালানের ছায়ায় আশ্রয় নেয়া৷
এর বিপরীতের দ্বিতীয় প্রকারের আশ্রয় হচ্ছে ,প্রত্যেক ধরনের বিপদ , প্রত্যেক ধরনের বস্তুগত , নৈতিক ও আধ্যাত্মিক এবং ক্ষতিকর বস্তু থেকে কোন অতি প্রাকৃতিক সত্তার আশ্রয় এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে গ্রহণ করা যে ইন্দ্রিয় বহির্ভূত অননূভূত পদ্ধতিতে তিনি আশ্রয় গ্রহণকারীকে অবশ্যি সংরক্ষণ করতে পারবেন৷
শুধু এখানেই নয়, কুরআন ও হাদীসের যেখানেই আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার কথা এসেছে সেখানেই এ বিশেষ ধরনের আশ্রয় চাওয়ার অর্থেই তা বলা হয়েছে৷ আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে এ ধরনের আশ্রয় প্রার্থনা না করাটাই তাওহীদী বিশ্বাসের অপরির্হায অংগ৷ মুশরিকরা আল্লাহর ছাড়া অন্যান্য সত্তা যেমন জিন,দেবী ও দেবতাদের কাছে এ ধরনে আশ্রয় চাইতো এবং আজো চায়৷
বস্তুবাদীরা এ জন্য বস্তুগত উপায় – উপকরণের দিকে মূখ ফিরায়৷ কারণ,তারা কোন অতি প্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাসী নয় ৷
কিন্তু মু’মিন যেসব আপদ – বিপদ ও বালা মুসিবতের মোকাবেলা করার ব্যাপারে নিজেকে অক্ষম মনে করে, সেগুলোর ব্যাপারে সে একমাত্র আল্লাহর দিকে মুখ ফিরায় এবং একমাত্র তাঁরই সঙ্গে আশ্রয় প্রার্থনা করে৷ উদাহরণ স্বরূপ মুশরিকদের ব্যাপরে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে :
“আর ব্যাপার হচ্ছে এই যে ,মানব জাতির অন্তরভূক্ত কিছু লোক জিন জাতির অন্তরভূক্ত কিছু লোকের কাছে আশ্রয় চাইতো ৷”( আল জিন ,৬ )
এর ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা ) বর্ণিত একটি হাদীসে উদ্ধৃত করছি৷তাতে বলা হয়েছে : আরব মুশরিকদের যখন কোন রাতে জনমানবহীন উপত্যকায় রাত কাটাতে হতো তখন তারা চিৎকার করে বলতো : ” আমরা এ উপত্যকার রবের ( অর্থাঃ এ উপত্যকার ওপর কর্তৃত্বশালী জিন বা এ উপত্যকার মালিক )আশ্রয় চাচ্ছি৷”
অন্যদিকে, ফেরাউন সম্পর্কে বলা হয়েছে : হযরত মূসার (আ ) পেশকৃত মহান নিশানীগুলো দেখে “নিজের শক্তি সামর্থের ওপর নির্ভর করে সে সদর্পে নিজের ঘাড় ঘুরিয়ে থাকলো৷” (আয যারিয়াত,৩৯ )৷
কিন্তু কুরআন আল্লাহ বিশ্বাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি বর্ণনা প্রসংগে বলা হয়েছে : তারা বস্তগত ,সৎনৈতিক বা আধ্যাত্মিক যে কোন জিনিসের ভীতি অনুভব করলে তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে৷ কাজেই হযরত মরিয়াম সম্পর্কে বলা হয়েছ : যখন অকস্মাৎ নির্জনে আল্লাহর ফেরেশতা মানুষের বেশ ধরে তাঁর কাছে এলেন ( তিনি তাঁকে আল্লাহর ফেরেশতা বলে জানতেন না )৷ তখন তিনি বললেন :” যদি তোমার আল্লাহর ভয় থাকে , তাহলে আমি দয়াময় আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি৷” (মারয়াম ,১৮ ) হযরত নূহ (আ ) যখন আল্লাহর কাছে অবাস্তব দোয়া করলেন এবং জবাবে আল্লাহ তাঁকে শাসালেন তখন তিনি সংগে সংগেই আবেদন জানালেন :
” হে আমার রব! যে জিনিস সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই তেমন কোন জিনিস তোমার কাছে চাওয়া থেকে আমি তোমার পানাহ চাই৷ ” ( হুদ, ৪৭ )
হযরত মূসা (আ ) যখন বনি ইসরাঈলদের গাভী যবেহ করার হুকুম দিলেন এবং তারা বললো , আপনি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছেন ? তখন তিনি তাদের জবাবে বললেন :
“আমি মূর্খ – অজ্ঞদের মতো কথা বলা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি৷ (আল বাকারাহ,৬৭ )
হাদীসে গ্রন্থগুলোতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যেসব ” তাআউউয ” উদ্ধৃত হয়েছে সবগুলো এ একই পর্যায়ের উদাহরণ স্বরূপ তাঁর নিম্মোক্ত দোয়াগুলো দেয়া যেতে পারে :
” হযরত আয়েশা (রা ) থেকে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের দোয়াগুলোতে বলতেন : হে আল্লাহ ! আমি যেসব কাজ করেছি এবং যেসব কাজ করিনি তা থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি৷ অর্থাৎ কোন খারাপ কাজ করে থাকলে তার খারপ ফল থেকে পানাহ চাই এবং কোন কাজ করা উচিত ছিল কিন্তু তা আমি করিনি, যদি এমন ব্যাপার ঘটে থাকে তাহলে তার অনিষ্ট থেকে ও তোমার পানাহ চাই ৷ অথবা যে কাজ করা উচিত নয় কিন্তু তা আমি কখনো করে ফেলবো , এমন সম্ভাবনা থাকলে তা থেকেও তোমার আশ্রয় চাই৷ ” (মুসলিম)
” ইবনে উমর থেকে বর্ণিত ৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের একটি দোয়া ছিল : হে আল্লাহ ! তোমার যে নিয়ামত আমি লাভ করেছি তা যাতে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে না নেয়া হয় , তোমার কাছ থেকে যে নিরাপত্তা আমি লাভ করেছি তা থেকে যাতে আমাকে বঞ্চিত না করা হয় , তোমার গযব যাতে অকস্মাৎ আমার ওপর আপতিত না হয় সে জন্য এবং তোমার সব ধরনের অসন্তুষ্টি থেকে আমি তোমার আশ্রয় চাচ্ছি” (মুসলিম )
যায়েদ ইবনে আরকাম (রা) থেকে বর্ণিত ৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন : যে ইলম উপকারী নয় , যে হৃদয় তোমার ভয়ে ভীত নয় , যে সফস কখনো তৃপ্তি লাভ করে না এবং যে দোয়া কবুল করা হয় না , আমি সেসব থেকে তোমার আশ্রয় চাচ্ছি” (মুসলিম )
” হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন : হে আল্লাহ ! আমি ক্ষুধা থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷ কারণ , মানুষ যেসব জিনিসের সাথে রাত অতিবাহিত করে তাদের মধ্যে ক্ষুধা সবচেয়ে খারাপ জিনিস৷ আর আত্মসাৎ থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷ কারণ এটা বড়ই কলুষিত হৃদয়ের পরিচায়ক৷” (আবু দাউদ)৷
” হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত ৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন : হে আল্লাহ ! আমি শ্বেতকুষ্ঠ , উন্মাদনা , কুষ্ঠরোগ ও সমস্ত খারাপ রোগ থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷ ” (আবু দাউদ)
” আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নোক্ত কথাগুলো সহ দোয়া চাইতেন : হে আল্লাহ ! আমি আগুনের ফিতনা এবং ধনী ও দরিদ্র হওয়ার অনিষ্ট থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷” ( তিরমিযী ও আবু দাউদ )
” কুতবাহ ইবনে মালেক বলেন , নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন , হে আল্লাহ ! আমি অসৎ চরিত্র , অসৎ কাজ ও অসৎ ইচ্ছা থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷”
শাকাল ইবনে হুমাইদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন , আমাকে কোন দোয়া বলে দিন৷ জবাবে তিনি বলেন :
” হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই আমার শ্রবণশক্তির অনিষ্ট থেকে , আমার দৃষ্টিশক্তির অনিষ্ট থেকে , আমার বাকশক্তির অনিষ্ট থেকে , আমার হৃদয়ের অনিষ্ট থেকে এবং আমার যৌন ক্ষমতার অনিষ্ট থেকে ৷ ” (তিরমিযী ও আবু দাউদ )
” আনাস ইবনে মালেক থেকে বর্ণিত ৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন : হে আল্লাহ ! আমি অক্ষমতা , কুড়েমি , কাপুরুষতা , বার্ধক্য ও কৃপণতা থেকে আমার আশ্রয় চাই ৷ আর তোমার আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে এবং জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে ৷ ( মুসলিমের অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে : ) আর ঋণের বোঝা থেকে এবং লোকেরা আমার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে , এ থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই৷” বুখারী ও মুসলিম )
“খাওলা বিনতে হুকাইম সুলামীয়া থেকে বর্ণিত৷ তিনি বলেন , আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা বলতে শুনেছি : যে ব্যক্তি কোন নতুন মনযিলে নেমে একথাগুলো বলবে — আমি সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে আল্লাহর নিষ্কলংক কালেমাসমূহের আশ্রয় চাই , সেই মনযিল থেকে রওয়ানা হবার আগে পর্যন্ত তাকে কোন জিনিস ক্ষতি করতে পারবে না৷ ” (মসলিম )
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে যেভাবে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন হাদীস থেকে তার কয়েকটি নমুণা এখানে আমরা তুলে ধরলাম৷ এ থেকে জানা যাবে , প্রতিটি বিপদ – আপদ ও অনিষ্টকরিতার মোকাবেলায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়াই মু’মিনের কাজ৷ তাছাড়া আল্লাহর প্রতি বিমুখ ও অনির্ভর হয়ে নিজের ওপর ভরসা করাও তার কাজ নয়৷
জাদু, ঝাড়-ফুঁক ও তাবীয-কবচ :
ইসলামে জাদু করা নিষিদ্ধ এবং তা কবীরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) এরশাদ করেন যে, তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী পাপ হ’তে বেঁচে থাক। (১) আল্লাহর সাথে শরীক করা (২) জাদু করা (৩) অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা (৪) সূদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করা (৬) যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং (৭) নির্দোষ ঈমানদার নারীর উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া। বুখারী হা/২৭৬৬, মুসলিম হা/৮৯, মিশকাত হা/৫২।
ইসলামে ঝাড়-ফুঁক সিদ্ধ। কিন্তু তাবীয-কবচ নিষিদ্ধ। ঝাড়-ফুঁক স্রেফ আল্লাহর নামে হতে হবে। ফালাক্ব ও নাস ছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন সূরা ও ছহীহ হাদীছ সমূহে বর্ণিত দো‘আ সমূহ দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করতে হবে। কোনরূপ শিরক মিশ্রিত কালাম ও জাহেলী পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না। মুসলিম হা/২২০০, মিশকাত হা/৪৫৩০ ‘চিকিৎসা ও ঝাড়-ফুঁক’ অধ্যায়-২৩।
এমনিভাবে তাবীয ঝুলানো, বালা বা তাগা বাঁধা যাবেনা।
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ ‘
যে ব্যক্তি তাবীয ঝুলালো, সে ব্যক্তি শিরক করল’।আহমাদ হা/১৭৪৫৮; হাকেম; ছহীহাহ হা/৪৯২
তিনি বলেন, مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ ‘যে ব্যক্তি কোন কিছু লটকায়, তাকে তার প্রতি সোপর্দ করা হয়’। তিরমিযী হা/২০৭২, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৪৫৫৬
অর্থাৎ কোন বস্ত্তর উপরে নয়, স্রেফ আল্লাহর কালাম পড়ে আল্লাহর উপরে ভরসা করতে হবে। এটি হ’ল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনোচিকিৎসা। যা দৈহিক চিকিৎসাকে প্রভাবিত করে। যেমন রাসূল (সা) একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে জিব্রীল (আঃ) এসে তাঁকে নিম্নোক্ত দো‘আর মাধ্যমে ঝাড়িয়ে দেন।–
بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيْكَ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ يُؤْذِيْكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ اللهُ يَشْفِيْكَ، بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيْكَ
‘আমি আল্লাহর নামে তোমাকে ঝেড়ে দিচ্ছি এমন সকল বিষয় হ’তে, যা তোমাকে কষ্ট দেয়। প্রত্যেক হিংসুক ব্যক্তির বা হিংসুক চোখের অনিষ্ট হ’তে আল্লাহ তোমাকে নিরাময় করুন। আল্লাহর নামে তোমাকে ঝেড়ে দিচ্ছি’। মুসলিম হা/২১৮৬,
জিব্রীল (আঃ) এখানে শুরুতে ও শেষে বিসমিল্লাহ বলেছেন এদিকে ইঙ্গিত করার জন্য যে, আল্লাহ ব্যতীত আরোগ্যদাতা কেউ নেই। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখনই কোন অসুখে পড়তেন, তখনই জিব্রীল এসে তাঁকে ঝেড়ে দিতেন।মুসলিম হা/২১৮৫
উল্লেখ্য যে, জিব্রীল পঠিত উপরোক্ত দো‘আ পড়ে যেকোন মুমিন বান্দা অন্য মুমিনকে ঝাড়-ফুঁক করতে পারেন।
রাসূলুল্লাহ (সা) হাসান-হোসায়েনকে নিম্নোক্ত দো‘আর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করেছেন, أُعِيْذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ
‘আমি তোমাদের দু’জনকে আল্লাহর পূর্ণ বাক্য সমূহের আশ্রয়ে নিচ্ছি প্রত্যেক শয়তান হ’তে, বিষাক্ত কীট হ’তে ও প্রত্যেক অনিষ্টকারী চক্ষু হ’তে’।বুখারী হা/৩৩৭১, মিশকাত হা/১৫৩৫।
مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
(২) যাবতীয় অনিষ্ট হতে, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রাহেমাহুল্লাহ বলেন, شر শব্দটি দু’প্রকার বিষয়বস্তুকে শামিল করে- (এক) প্রত্যক্ষ অনিষ্ট ও বিপদ, যা দ্বারা মানুষ সরাসরি কষ্ট পায়,
(দুই) যা মুসীবত ও বিপদাপদের কারণ হয়ে থাকে, যেমন কুফর ও শির্ক।
কুরআন ও হাদীসে যেসব বস্তু থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা আছে, সেগুলো এই প্রকারদ্বয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেগুলো হয় নিজেই বিপদ, না হয় কোন বিপদের কারণ।
এখানে লক্ষণীয় যে, আয়াতে বলা হয়েছে, “তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি।” এ বাক্যে অনিষ্টকারিতা সৃষ্টির ব্যাপারটিকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করা হয়নি। বরং সৃষ্টিজগতের সৃষ্টিকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। আর অনিষ্টকারিতাকে সম্পর্কিত করা হয়েছে সৃষ্টির সাথে। অর্থাৎ একথা বলা হয়নি যে, আল্লাহ যে অনিষ্টকারিতাসমূহ সৃষ্টি করেছেন সেগুলো থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। এ থেকে জানা যায়, মহান আল্লাহ কোন সৃষ্টিকে অনিষ্টকারিতার জন্য সৃষ্টি করেননি। বরং তাঁর প্রত্যেকটি কাজ কল্যাণকর এবং কোন না কোন কল্যাণমূলক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যই হয়ে থাকে। তবে সৃষ্টির মধ্যে তিনি যেসব গুণ সমাহিত করে রেখেছেন, যেগুলো তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজন, সেগুলো থেকে অনেক সময় এবং অনেক ধরনের সৃষ্টি থেকে প্রায়ই অনিষ্টকারিতার প্রকাশ ঘটে। [বাদায়ে’উল ফাওয়ায়িদ: ২/৪৩৬]
অনিষ্টকারিতা শব্দটি ক্ষতি , কষ্ট , ব্যথা ও যন্ত্রণার জন্য ও ব্যবহার করা হয়৷ আবার যে কারণে ক্ষতি , কষ্ট , ব্যথা ও যন্ত্রণা সৃষ্টি হয় সে জন্যও ব্যবহার করা হয়, যেমন রোগ , অনাহার , কোন যুদ্ধ বা ঘটনায় আহত হওয়া , আগুনে পুড়ে যাওয়া , সাপ বিচ্ছু ইত্যাদি দ্বারা দংশিত হওয়া , সন্তানের মৃত্যু শোকে কাতর হওয়া এবং এ ধরনের আরো অন্যান্য অনিষ্টকারিতা প্রথমোক্ত অর্থের অনিষ্টকারিতা৷ কারণ , এগুলো যথার্থই কষ্ট ও যন্ত্রণা ৷ অন্যদিকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ কুফরী , শিরক এবং যেসব ধরনের গোনাহ ও জুলুম দ্বিতীয় প্রকার অনিষ্টকারিতা ৷ কারণ , এগুলোর পরিণাম কষ্ট ও যন্ত্রণা৷ যদিও আপাত দৃষ্টিতে এগুলো সাময়িকভাবে কোন কষ্ট ও যন্ত্রণা দেয় না বরং কোন কোন গোনাহ বেশ আরামের৷ সেসব গোনাহ করে আনন্দ পাওয়া যায় এবং লাভের অংকটাও হাতিয়ে নেয়া যায়৷ কাজেই এ দু’অর্থেই অনিষ্টকারিতা থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়৷
অনিষ্টকারিতা থেকে আশ্রয় চাওয়ার মধ্যে আরো দু’টি অর্থও রয়েছে৷ যে অনিষ্ট ইতিমধ্যে হয়ে গেছে৷ বান্দা আল্লাহর কাছে দোয়া করছে , হে আল্লাহ ! তাকে খতম করে দাও৷ আর যে অনিষ্ট এখনো হয়নি , তার সম্পর্কে বান্দা দোয়া করছে , হে আল্লাহ ! এ অনিষ্ট থেকে আমাকে রক্ষা করো৷
(৩) وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ
‘এবং অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট হতে, যখন তা সমাগত হয়’।
পূর্বোক্ত আয়াতের ভাষায় সমগ্র সৃষ্টির অনিষ্টই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কাজেই আশ্রয় গ্রহণের জন্যে এ বাক্যটিই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এস্থলে আরও তিনটি বিষয় আলাদা করে উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রায়ই বিপদ ও মুসীবতের কারণ হয়ে থাকে।
প্রথমে বলা হয়েছে, (وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ) এখানে غسق শব্দের অর্থ অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া। কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ নিয়েছেন রাত্রি। وقب এর অর্থ অন্ধকার পূর্ণরূপে বৃদ্ধি পাওয়া বা ছেয়ে যাওয়া। আয়াতের অর্থ এই যে, আমি আল্লাহর আশ্রয় চাই রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তার অন্ধকার গভীর হয়। রাতের অন্ধকারের অনিষ্টকারিতা থেকে বিশেষ করে পানাহ চাওয়ার নির্দেশ দেবার কারণ হচ্ছে এই যে, রাত্ৰিবেলায় জিন, শয়তান, ইতরপ্রাণী কীট-পতঙ্গ ও চোর-ডাকাত বিচরণ করে এবং অপকার করতে পারে। তাই রাতের বেলা যেসব অনিষ্টকারিতা ও বিপদ-আপদ নাযিল হয় সেগুলো থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার হুকুম দেয়া হয়েছে। [আদওয়াউল বায়ান, সা’দী]
সহীহ হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, এক রাতে আকাশে চাঁদ ঝলমল করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার হাত ধরে তার দিকে ইশারা করে বললেন, আল্লাহর কাছে পানাহ চাও: هٰذَا الغَاسِقُ إذا وَقَبَ অর্থাৎ এ হচ্ছে সেই গাসেক ইযা ওয়াকাব [মুসনাদে আহমাদ: ৬/৬১, তিরমিযী: ৩৩৬৬]। চাঁদের উদয় যেহেতু রাতের বেলায়ই হয়ে থাকে এবং দিনের বেলা চাঁদ আকাশের গায়ে থাকলেও উজ্জ্বল থাকে না, তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্তির অর্থ হচ্ছে এর (অর্থাৎ চাঁদের) আগমনের সময় অর্থাৎ রাত থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাও। [ইবন কাসীর]।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন সূর্য ডুবে যায়, তখন শয়তানরা সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই শিশুদেরকে তখন ঘরের মধ্যে রাখো এবং নিজেদের গৃহপালিত পশুগুলোও বেঁধে রাখে। যতক্ষণ রাতের আধার খতম না হয়ে যায়৷” [বুখারী: ৩২৮০, ৩৩১৬, মুসলিম: ২০১২]।
الغَسَق অর্থ أول ظلمة الليل ‘রাত্রির প্রথম অন্ধকার’। غَسَقَ يَغْسِقُ غَسَقًا অর্থأَظْلَمَ ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া’ (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ বলেন, أَقِمِ الصَّلاَةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ ‘তুমি ছালাত কায়েম কর সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির প্রথম অন্ধকার পর্যন্ত’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৮)। এর মধ্যে যোহর, আছর, মাগরিব ও এশার ছালাতের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সূর্য ঢলার পর থেকে যোহরের ওয়াক্ত এবং সূর্যাস্তের পর প্রথম অন্ধকারের আগমন থেকে এশার ওয়াক্ত শুরু হয়।
وَقَبَ يَقِبُ وَقْبًا অর্থ أظلم، دخل، نزل، سكن ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া’, ‘প্রবেশ করা’, ‘অবতীর্ণ হওয়া’, ‘স্থিতিশীল হওয়া’ প্রভৃতি। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এখানে অর্থ হবে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া’। অর্থাৎ রাত্রির অন্ধকার যখন গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়। আর অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতেই মানুষের অনিষ্টকারিতা বৃদ্ধি পায়। হাদীছে চন্দ্রকে غَاسِقٌ বলা হয়েছে। যেমন আয়েশা (রাঃ)-কে এক রাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَا عَائِشَةُ اسْتَعِيْذِيْ بِاللهِ مِنْ شَرِّ هَذَا فَإِنَّ هَذَا هُوَ الْغَاسِقُ إِذَا وَقَبَ- ‘হে আয়েশা! এর অনিষ্টকারিতা হ’তে আল্লাহর নিকটে পানাহ চাও। কেননা এটি হ’ল ‘গাসেক্ব’ বা আচ্ছন্নকারী যখন সে সমাগত হয়’। তিরমিযী হা/৩৩৬৬; মিশকাত হা/২৪৭৫ সনদ ছহীহ।
১১৩:৪ وَ مِنۡ شَرِّ النَّفّٰثٰتِ فِی الۡعُقَدِ
৪. আর অনিষ্ট হতে সমস্ত নারীদের, যারা গিরায় ফুক দেয়,
(১) দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, (وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ) এখানে نفث এর অর্থ ফুঁ দেয়া। عُقَد শব্দটি عقدة এর বহুবচন। অর্থ গ্রন্থি। যারা জাদু করে, তারা ডোর ইত্যাদিতে গিরা লাগিয়ে তাতে জাদুর মন্ত্র পড়ে ফুঁ দেয়। এখানে نَفَّاثَاتِ লিঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছে। বাহ্যত এটি নারীর বিশেষণ। এটি খারাপ আত্মাকেও বুঝাতে পারে। তখন অর্থ হবে ফুঁকদানকারী খারাপ আত্মা থেকে আমি আশ্রয় চাচ্ছি। আবার এটা ফুঁ দানকারীদের সমষ্টিকেও নির্দেশ করতে পারে, যাতে পুরুষ ও নারী উভয়ই দাখিল আছে। [আদওয়াউল বায়ান, ফাতহুল কাদীর]
সুলাইমান কুফরী করেনি৷ বরং শয়তানরা কুফরী করেছিল৷ তারা লোকদেরকে যাদু শেখাতো৷ ” ( আল বাকারা , ১০২ )
কিন্তু তার মধ্যে কোন কুফরী কালেমা বা শিরকী কাজ না থাকলেও তা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে এমন সাতটি কবীরা গোনাহের অন্তরভুক্ত করেছেন , যা মানুষের আখেরাত বরবাদ করে দেয়৷ এ প্রসংগে বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , সাতটি ধ্বংসকর জিনিস থেকে দূরে থাকো৷ লোকেরা জিজ্ঞেস করলো , হে আল্লাহর রসূল ! সেগুলো কি ? বলবেন , আল্লাহ সাথে কাউকে শরীক করা , যাদু , আল্লাহ যে প্রাণ নাশ হারাম করেছেন ন্যায়সংগত কারণ ছাড়া সেই প্রাণ নাশ করা , সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পত্তি গ্রাস করা , জিহাদে দুশমনের মোকাবিলায় পালিয়ে যাওয়া এবং সরল সতীসাধ্বী মু’মিন মেয়েদের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের দোষারোপ করা ৷
৫। وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ ‘
এবং হিংসুকের অনিষ্ট হ’তে যখন সে হিংসা করে’।
হিংসা সকল আদম সন্তানের মধ্যে পরিব্যপ্ত এবং এটি সবচেয়ে কষ্টদায়ক ও সর্বাধিক ক্ষতিকর। কোন নবী-রাসূল হিংসুকদের হামলা থেকে রেহাই পাননি। সৎ ও ঈমানদার ব্যক্তিগণ দুনিয়াতে সর্বদা হিংসুকদের নিকৃষ্ট হামলার শিকার হয়ে থাকেন।
আলোচ্য আয়াতে إِذَا حَسَدَ অর্থাৎ ‘হিংসুক যখন হিংসা করে’ বলার কারণ হ’ল এই যে, যতক্ষণ কথায় বা কর্মে হিংসার বাস্তবায়ন না ঘটে, ততক্ষণ তা অন্যের কোন ক্ষতি করে না। যদিও হিংসার আগুনে হিংসুক নিজেই সর্বদা জ্বলতে থাকে। বস্ত্ততঃ এটাই হ’ল হিংসুকের জন্য নগদ দুনিয়াবী আযাব। আর পরকালের কঠিন আযাব তো আছেই।
হিংসুক কাকে বলে?
الَّذِى يَتَمَنَّى زَوَالَ نِعْمَةِ الْمَحْسُوْدِ
‘হিংসুক ঐ ব্যক্তি যে হিংসাকৃত ব্যক্তির নে‘মত বিদূরিত হওয়ার আকাংখা করে’ (কুরতুবী, তানতাভী)। যখন সে কর্মের মাধ্যমে তার হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, তখন তার অনিষ্ট হ’তে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَجْتَمِعَانِ فِىْ قَلْبِ عَبْدٍ الإِيْمَانُ وَالْحَسَدُ ‘কোন বান্দার অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না’।নাসাঈ হা/৩১০৯, সনদ হাসান।
অর্থাৎ একটি অন্তরে হয় ঈমান থাকবে, নয় হিংসা থাকবে। ঈমানদারের অন্তরে হিংসা থাকবে না, হিংসুকের অন্তরে ঈমান থাকবে না। মুমিন কখনো হিংসুক নয়, হিংসুক কখনো মুমিন নয়। অর্থাৎ পূর্ণ মুমিন নয়।
উল্লেখ্য যে, অন্যের মত নে‘মতের অধিকারী হওয়ার কামনা করা বৈধ। কিন্তু অন্যের নে‘মতের ধ্বংস কামনা করা অবৈধ। প্রথমটিকে বলা হয় الْغِبْطَةُ أو الْمُنَافَسَةُ ঈর্ষা বা আকাংখা এবং দ্বিতীয়টিকে বলা হয় الْحَسَدُ বা হিংসা। হিংসা নিষিদ্ধ ও নিন্দিত। ঈর্ষা সিদ্ধ ও কাংখিত। ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِى اثْنَتَيْنِ ‘হিংসা নেই দু’টি বিষয়ে ব্যতীত। ১. যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন। সাথে সাথে তাকে হক-এর পথে তা ব্যয় করার শক্তি দান করেছেন। ২. যাকে আল্লাহ প্রজ্ঞা দান করেছেন। যা দিয়ে সে কার্য নির্বাহ করে ও যা সে লোকদের শিক্ষা দেয়’।মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২০২ ‘ইল্ম’ অধ্যায়।
এখানে ‘হিকমত’ অর্থ সুন্নাহ। এখানে ‘হিংসা’ (حسد) দ্বারা ‘ঈর্ষা’ (الغِبْطة) বুঝানো হয়েছে। ফুযায়েল ইবনু ‘ইয়ায বলেন, الْمُؤْمِنُ يَغْبِطُ، وَالْمُنَافِقُ يَحْسُدُ ‘মুমিন ঈর্ষা করে ও মুনাফিক হিংসা করে’। কুরতুবী, ইসমাঈল ‘আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/২৯৫; তাযকেরাতুল মাওযূ‘আত ১/১৪।
আল্লাহ মুমিনদেরকে জান্নাতে মিশকের মোহরাংকিত বিশুদ্ধতম শরাব পান করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেন,وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُوْنَ ‘অতএব প্রতিযোগীরা এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করুক’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/২৬)।
ইমাম কুরতুবী বলেন, হিংসা হ’ল প্রথম পাপ, যা আসমানে করা হয় এবং প্রথম পাপ যা পৃথিবীতে করা হয়। আসমানে ইবলীস আদমকে হিংসা করেছিল। আর পৃথিবীতে ক্বাবীল তার ছোট ভাই হাবীলকে হিংসা করেছিল। অতএব হিংসুক ব্যক্তি অভিশপ্ত, বহিষ্কৃত ও বিদ্বিষ্ট’ (কুরতুবী)।
জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন, হিংসুক ব্যক্তি তার প্রভুর সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয় পাঁচভাবে। (১) সে অন্যের উপর আল্লাহর দেওয়া নে‘মতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। (২) সে আল্লাহর অনুগ্রহ বণ্টনের উপরে ক্রুদ্ধ থাকে। (৩) সে আল্লাহর কাজের বিরোধিতাকারী হয়। কেননা আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ যাকে খুশী তাকে দিতে পারেন। কিন্তু হিংসুক তার হিংসাকৃত ব্যক্তির জন্য সেটা চায় না। (৪) সে আল্লাহর বন্ধুদের লজ্জিত করে। অথবা লজ্জিত করতে চায় ও উক্ত নে‘মতের ধ্বংস কামনা করে। (৫) সে আল্লাহর শত্রু ইবলীসকে সাহায্য করে’ (কুরতুবী)।
বাঁচার উপায় :
প্রশ্ন হ’তে পারে, বর্ণিত তিন প্রকার অনিষ্ট হ’তে বাঁচার পথ কি?
উত্তর : এ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হ’ল আল্লাহর উপর ভরসা করা। সব ফায়ছালা তাঁর উপরে ন্যস্ত করা এবং সূরা ফালাক্ব, নাস ও অন্যান্য দো‘আ সমূহ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া। অর্থ বুঝে অন্তর ঢেলে দিয়ে পূর্ণ আস্থাসহ দো‘আ করতে হবে। আল্লাহর আশ্রয় হ’ল বড় আশ্রয়। যা পৃথিবীর সকল আশ্রয়ের চাইতে বড় ও নিরাপদ। এই আশ্রয় নমরূদের হুতাশন থেকে ইবরাহীমকে বাঁচিয়েছে, ফেরাঊনের হামলা থেকে মূসাকেবাঁচিয়েছে। যুগে যুগে অসংখ্য মুমিন বান্দাকে আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। তিনি বলেন, وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘আমার দায়িত্ব হ’ল মুমিনদের সাহায্য করা’ (রূম ৩০/৪৭)।
আল্লাহ বলেন,
قُلْ لَنْ يُصِيبَنَا إِلاَّ مَا كَتَبَ اللهُ لَنَا هُوَ مَوْلاَنَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ
‘তুমি বল, আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কোন বিপদ আমাদের উপর আসতে পারে না। তিনিই আমাদের কর্মবিধায়ক। অতএব সকল মুমিনগণ তাঁর উপরেই ভরসা করে’ (তওবা ৯/৫১)। তিনি বলেন,
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيْبَةٍ إِلاَّ بِإِذْنِ اللهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ- اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ
‘যে বিপদই আসুক তা আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আসেনা। যে ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তিনি তার হৃদয়কে সুপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ সকল বিষয়ে অবগত’। …‘আল্লাহ। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব মুমিনগণ যেন আল্লাহর উপরেই ভরসা করে’ (তাগাবুন ৬৪/১১, ১৩)।
হৃদয়কে হিংসামুক্ত রাখার উপায় :
(১) হিংসা হ’ল শয়তানী আমল। শয়তান সর্বদা মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে থাকে। তাই তার হাত থেকে বাঁচার জন্য শয়তানের প্রতি তীব্র ঘৃণা থাকা এবং তার বিরুদ্ধে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা আবশ্যক। সেইসাথে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে সর্বদা ছালাত শেষে বা ঘুমাতে যাবার সময় বা যেকোন সময় সূরা ফালাক্ব ও নাস পড়া। (২) এছাড়া নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়া আবশ্যক। আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীকে শিখিয়ে দিয়েছেন, رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيْمَانِ وَلاَ تَجْعَلْ فِيْ قُلُوْبِنَا غِلاَّ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوْفٌ رَحِيْمٌ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ও আমাদের সেইসব ভাইকে তুমি ক্ষমা কর। যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে। আর তুমিআমাদের অন্তরে মুমিনদের বিরুদ্ধে কোনরূপ বিদ্বেষ সঞ্চার করো না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই তুমি স্নেহশীল ও দয়াবান’ (হাশর ৫৯/১০)। মনে রাখতে হবে যে, ভালোর প্রতি হিংসা চিরন্তন। আসমানে প্রথম হিংসা করেছে ইবলীস আদম (আঃ)-কে এবং যমীনে প্রথম হিংসা করেছে ক্বাবীল ও তার ভাই হাবীলকে। যুগে যুগে এটাই ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এজন্য প্রবাদ বাক্য হয়ে রয়েছে, هل مَاتَ الْبُخَارِيُّ غَيْرَ مَحْسُوْدٍ ؟ ‘ইমাম বুখারী কি হিংসুকের হামলা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করতে পেরেছেন’?
বস্ত্ততঃ হিংসুক ব্যক্তি আল্লাহর নে‘মতের শত্রু। সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যায়। সে মজলিসে কেবল লজ্জা পায়। ফেরেশতাদের কাছে লা‘নতপ্রাপ্ত হয়। একাকী সে ক্ষোভের আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরে এবং আখেরাতে সে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধীভূত হয়। ফলে হিংসুকের দুনিয়া ও আখেরাত সবই বরবাদ। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন- আমীন!
সংগ্রহে-
তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন