সূরা আলে ইমরান -৩য় রুকু(২১-৩০ আয়াত)

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

 

৩:২১ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡفُرُوۡنَ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ یَقۡتُلُوۡنَ النَّبِیّٖنَ بِغَیۡرِ حَقٍّ ۙ وَّ یَقۡتُلُوۡنَ الَّذِیۡنَ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡقِسۡطِ مِنَ النَّاسِ ۙ فَبَشِّرۡہُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ

২১. নিশ্চয় যারা আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহে কুফরী করে, অন্যায়ভাবে নবীদের হত্যা করে এবং মানুষের মধ্যে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে হত্যা করে, আপনি তাদেরকে মর্মম্ভদ শাস্তির সংবাদ দিন।

৩:২২ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ حَبِطَتۡ اَعۡمَالُہُمۡ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ۫ وَ مَا لَہُمۡ مِّنۡ نّٰصِرِیۡنَ

২২. এসব লোক, এদের কার্যাবলী দুনিয়া ও আখেরাতে নিস্ফল হয়েছে এবং তাদের কোন সাহায্যকারী নেই।

সেই সমস্ত ব্যক্তিরা যারা তাদের অবাধ্যতা ও হঠকারিতা এত দূর পর্যন্ত পৌঁছে ছিল যে, কেবল তারা নবীদেরকেই অন্যায়ভাবে হত্যা করেনি, বরং এমন লোকদেরকেও তারা হত্যা করেছিল যারা ন্যায়সংগত ও সুবিচারপূর্ণ কথা বলত। অর্থাৎ, যাঁরা নিষ্ঠাবান মু’মিন, সত্যের প্রতি আহবানকারী এবং ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দানকারী ছিলেন তাঁদেরকে নবীদের পাশাপাশি উল্লেখ করে মহান আল্লাহ তাঁদের মাহাত্ম্য ও ফযীলতের কথাও পরিষ্কার করে দিলেন।

অর্থাৎ তারা নিজেদের শক্তি ও প্রচেষ্টাসমূহ এমন সব কাজে নিয়োজিত করেছে যার ফল দুনিয়াতে যেমন খারাপ তেমনি আখেরাতেও খারাপ৷

অর্থাৎ এমন কোন শক্তি নেই, যে তাদের এসব ভুল প্রচেষ্টা ও অসৎকার্যাবলীকে সুফলদায়ক করতে অথবা কমপক্ষে খারাপ পরিণতি থেকে বাঁচাতে পারে৷ দুনিয়ায় বা আখেরাতে অথবা উভয় স্থানে তাদের কাজে লাগবে বলে যেসব শক্তির ওপর তারা ভরসা করে, তাদের মধ্য থেকে আসলে কেউই তাদের সাহায্যকারী প্রমাণিত হবে না৷

“নিশ্চয়ই আপনার পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের সাথেও উপহাস করা হয়েছে। অতঃপর যারা তাঁদের সাথে উপহাস করেছিল, তাদেরকে ঐ শাস্তি বেষ্টন করে নিল, যা নিয়ে তারা উপহাস করত।” –[সূরা আন’আমঃ আয়াত ১০]

“যে কেউ রসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান।” -[ সূরা নিসাঃ আয়াত ১১৫]

 

তিনি আরও বলেনঃ “আমি রাসূলগনকে সুসংবাদ দাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী স্বরূপই প্রেরণ করি আর কাফেররাই মিথ্যা অবলম্বনে বিতর্ক করে, তা দ্বারা সত্যকে ব্যর্থ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এবং তারা আমার নিদর্শনাবলীও যে সব বিষয় দ্বারা তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করা হয়, সেগুলোকে ঠাট্টা স্বরূপ গ্রহণ করেছে।” -( সূরা কাহফঃ আয়াত ৫৬)

আর তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে তার নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং এগুলো বিরাণ করার চেষ্টা করে? অথচ ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে তাদের জন্য সেগুলোতে প্রবেশ করা সঙ্গত ছিল না। দুনিয়াতে তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও আখেরাতে রয়েছে মহাশাস্তি।বাকারাঃ১১৪

“আর যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস করো, তাদের বিদ্রুপ পূর্ণ আচরণের বিষয়ে তবে তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলেছিলাম এবং কৌতুক করেছিলাম। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সাথে, তাঁর হুকুম আহকামের সাথে এবং তাঁর রসূলের সাথে ঠাট্টা করছিলে। ছলনা করনা, তোমরা কাফের হয়ে গেছ, ঈমান প্রকাশ করার পর।” -(সূরা তাওবাঃ আয়াত ৬৫-৬৬)

নিশ্চয়ই যারা কাফের এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখে এবং নিজেদের জন্যে সৎপথ ব্যক্ত হওয়ার পর রসূলের (সঃ) বিরোধিতা করে, তারা আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না এবং তিনি ব্যর্থ করে দিবেন তাদের কর্মসমূহকে।” -(সূরা মুহাম্মাদঃ আয়াত ৩২)

কারা সাহায্যকারী পাবে ও কারা পাবে নাঃ

নিশ্চয়ই জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে হবে মুনাফিকদের অবস্থান, আর আপনি তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবেন না।সূরা নিসাঃ১৪৫

‘হে মুমিনরা! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের কদম (অবস্থান) দৃঢ় করবেন।’ (সুরা মুহাম্মদ : ৭)।

 আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহকে সাহায্য করবে আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাহায্য করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান ও পরাক্রমশালী।’ (সুরা হজ : ৪০)

৩:২৩ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ اُوۡتُوۡا نَصِیۡبًا مِّنَ الۡکِتٰبِ یُدۡعَوۡنَ اِلٰی کِتٰبِ اللّٰہِ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ یَتَوَلّٰی فَرِیۡقٌ

مِّنۡہُمۡ وَ ہُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ 

২৩. আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদেরকে কিতাবের অংশ প্রদান করা হয়েছিল? তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের দিকে আহবান করা হয়েছিল যাতে তা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়; তারপর তাদের একদল ফিরে যায় বিমুখ হয়ে।

অর্থাৎ তাদের বলা হয়, আল্লাহর কিতাবকে চূড়ান্ত সনদ হিসেবে মেনে নাও এবং তাঁর ফায়সালার সামনে মাথা নত করে দাও৷ এই কিতাবের দৃষ্টিতে যা হক প্রমাণিত হয় তাকে হক বলে এবং যা বাতিল প্রমাণিত হয় তাকে বাতিল বলে মেনে নাও৷ এখানে মনে রাখতে হবে, আল্লাহর কিতাব বলতে এখানে তাওরাত ও ইনজীলকে বুঝানো হয়েছে৷ আর কিতাবের জ্ঞানের কিছু অংশ লাভকারী বলতে ইহুদী ও খৃষ্টান আলেমদের কথা বুঝানো হয়েছে৷

কাতাদা বলেন, এ আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদীরা। তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল যাতে তাদের মধ্যে মীমাংসা করা হয়, তাদেরকে আল্লাহর নবীর প্রতিও আহবান জানানো হয়েছিল যাতে তাদের মধ্যে বিভিন্ন মতপার্থক্যজনিত বিষয়ে তিনি ফয়সালা করে দেন। যে নবীর বর্ণনা তারা তাদের কিতাবে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে। তারপরও তারা সে কিতাব ও নবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। [তাবারী]

 

৩:২৪ ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ قَالُوۡا لَنۡ تَمَسَّنَا النَّارُ اِلَّاۤ اَیَّامًا مَّعۡدُوۡدٰتٍ ۪ وَ غَرَّہُمۡ فِیۡ دِیۡنِہِمۡ مَّا کَانُوۡا یَفۡتَرُوۡنَ

২৪. এটা এজন্যে যে তারা বলে থাকে, মাত্র কয়েকদিন ছাড়া আগুন আমাদেরকে কখনই স্পর্শ করবে না। আর তাদের নিজেদের দ্বীন সম্পর্কে তাদের মিথ্যা উদ্ভাবন তাদেরকে প্রবঞ্চিত করেছে।

তারা নিজেদেরকে আল্লাহর প্রিয়পাত্র মনে করে বসেছে৷ তাদের মনে এই ভুল ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, তারা যাই কিছু করুক না কেন জান্নাত তাদের নামে লিখে দেয়া হয়ে গেছে, তারা ঈমানদার গোষ্ঠী, তারা উমুকের সন্তান, উমুকের উম্মাত, উমুকের মুরীদ এবং উমুকের হাতে হাত রেখেছে,কাজেই জাহান্নামের আগুনের কোন ক্ষমতাই নেই তাদেরকে স্পর্শ করার৷ আর যদিওবা তাদেরকে কখনো জাহান্নামে দেয়া হয়,তাহলেও তা হবে মাত্র কয়েক দিনের জন্য৷ গোনাহের যে দাগগুলো গায়ে লেগে গেছে সেগুলো মুছে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে তাদেরকে সোজা জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়া হবে৷ এ ধরনের চিন্তাধারা তাদের এমনি নির্ভিক বানিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে তারা নিশ্চিন্তে কঠিন থেকে কঠিনতর অপরাধ করে যেতো, নিকৃষ্টতম গোনাহের কাজ করতো, প্রকাশ্যে সত্যর বিরোধিতা করতো এবং এ অবস্থায় তাদের মনে সামান্যতম আল্লাহ ভয়ও জাগতো না৷

তারা দাবী করে বলে থাকে যে, ‘আমরা আল্লাহর সন্তান-সন্তুতি ও প্রিয় মানুষ।[সূরা আল-মায়িদাহ: ১৮] এটা অবশ্যই তাদের মিথ্যা উদ্ভাবন। [তাবারী]

আর ওরা বলে, “আগুন আমাদেরকে মাত্র কয়েকটা দিনই স্পর্শ করবে।” বল, “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোনো অঙ্গীকার নিয়েছ, কারণ আল্লাহ তার অঙ্গীকার ভাঙ্গেন না? নাকি তোমরা আল্লাহর সম্পর্কে না জেনেই কথা বল?” [আল-বাক্বারাহ ৮০]

সাইকোলজির ভাষায় এটা হচ্ছে এক ধরনের ‘কনফারমেশন বায়াস’।

মানুষের ভেতরে একধরনের ঝোঁক বা প্রবণতা থাকে: সে যা বিশ্বাস করে সেটাকে সঠিক হিসেবে প্রমাণ করার। তার কাছে যখন কোনো তথ্য বা প্রমাণ আসে, সে সেটাকে এমনভাবে বুঝে নেয়, যা তার আগে থেকে ধরে রাখা বিশ্বাসকে সমর্থন করে। এমনকি তার কাছে যদি অপ্রাসঙ্গিক কোনো তথ্যও আসে, সে সেটাকে এমনভাবে গ্রহণ করে, যেন সেটা তারই বিশ্বাসকে সমর্থন করছে। তার বিশ্বাসের পক্ষের যুক্তিগুলো সে খুব ভালো করে শোনে, খুব ভালো করে মনে রাখে। কিন্তু তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধের যুক্তিগুলো তার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন তাকে তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু বললেও কোনো লাভ হয় না। সে ঘুরে ফিরে বিভিন্নভাবে নিজেকে নানাভাবে বোঝাতে থাকে, যেন সে তার বিশ্বাসে অটুট থাকতে পারে। এই কনফারমেশন বায়াস সবার ভেতরেই কম বেশি আছে।

 

এই ধরনের মানুষদের কনফারমেশন বায়াসকে আল্লাহ تعالى ভেঙ্গে দিচ্ছেন: “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোনো অঙ্গীকার নিয়েছ, কারণ আল্লাহ তার অঙ্গীকার ভাঙ্গেন না?”

৩:২৫ فَکَیۡفَ اِذَا جَمَعۡنٰہُمۡ لِیَوۡمٍ لَّا رَیۡبَ فِیۡہِ ۟ وَ وُفِّیَتۡ کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ ہُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ

২৫. সুতরাং (সেদিন) কি অবস্থা হবে? যেদিন আমি তাদেরকে একত্র করব যাতে কোন সন্দেহ নেই এবং প্রত্যেককে তাদের অর্জিত কাজের প্রতিদান পূর্ণভাবে দেয়া হবে। আর তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।

 

তারা আপনাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে (বলে) তা কখন ঘটবে? বলুন, এ বিষয়ের জ্ঞান শুধু আমার রবেরই নিকট। শুধু তিনিই যথাসময়ে সেটার প্রকাশ ঘটাবেন; আসমানসমূহ ও যমীনে সেটা ভারী বিষয়। হঠাৎ করেই তা তোমাদের উপর আসবে। আপনি এ বিষয়ে সবিশেষ জ্ঞানী মনে করে তারা আপনাকে প্রশ্ন করে। বলুন, এ বিষয়ের জ্ঞান শুধু আল্লাহরই নিকট, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। আরাফঃ১৮৭

“বিচারের দিনটি কি, তা কিসে আপনাকে জানাবে? আবার জিজ্ঞাসা করি, কিসে আপনাকে জানাবে বিচারের দিনটি কি? তাহা এমন একটি দিন, যে দিন কেউই নিজের রক্ষার জন্য কোনই সাহায্যকারী পাবে না, এবং সমগ্র ব্যাপার নিরঙ্কুশ ভাবে আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত হবে” [সূরা আল-ইনফিতার: ১৭-১৯]

“আজকের দিনে আল্লাহ লোকদের প্রকৃত কর্মফল পূর্ণ করে দিবেন” (সূরা আন-নূর: ২৫]

জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কেবলমাত্র কেয়ামতের দিনই তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হবে। অতঃপর যাকে আগুন থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ছাড়া আর কিছু নয়। আলে ইমরানঃ১৮৫

আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কোন প্রকৃত ইলাহ নেই; অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই আর আল্লাহ্‌র চেয়ে বেশী সত্যবাদী কে? নিসাঃ৮৭

যারা আল্লাহর সাক্ষাতকে মিথ্যা বলেছে তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমনকি হঠাৎ তাদের কাছে যখন কিয়ামত উপস্থিত হবে তখন তারা বলবে, হায়! এটাকে আমরা যে অবহেলা করেছি তার জন্য আক্ষেপ। আর তারা তাদের পিঠে নিজেদের পাপ বহন করবে। সাবধান, তারা যা বহন করবে তা খুবই নিকৃষ্ট। আন’আমঃ৩১

৩:২৬ قُلِ اللّٰہُمَّ مٰلِکَ الۡمُلۡکِ تُؤۡتِی الۡمُلۡکَ مَنۡ تَشَآءُ وَ تَنۡزِعُ الۡمُلۡکَ مِمَّنۡ تَشَآءُ ۫ وَ تُعِزُّ مَنۡ تَشَآءُ وَ تُذِلُّ مَنۡ تَشَآءُ ؕ بِیَدِکَ الۡخَیۡرُ ؕ اِنَّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ

২৬. বলুন, ‘হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! আপনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন; যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন আর যাকে ইচ্ছা আপনি হীন করেন। কল্যাণ আপনারই হাতে। নিশ্চয়ই আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

 

৩:২৭ تُوۡلِجُ الَّیۡلَ فِی النَّہَارِ وَ تُوۡلِجُ النَّہَارَ فِی الَّیۡلِ ۫ وَ تُخۡرِجُ الۡحَیَّ مِنَ الۡمَیِّتِ وَ تُخۡرِجُ الۡمَیِّتَ مِنَ الۡحَیِّ ۫ وَ تَرۡزُقُ مَنۡ تَشَآءُ بِغَیۡرِ حِسَابٍ

২৭. আপনি রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে প্রবিষ্ট করান; আপনি মৃত থেকে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটান, আবার জীবন্ত থেকে মৃতের আবির্ভাব ঘটান। আর আপনি যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযক দান করেন।

মানুষ যখন একদিকে কাফের ও নাফরমানদের কার্যলাপ দেখে এবং তারপর দেখে কিতাবে দিনের পর দিন তাদের বিত্ত ও প্রাচুর্য বেড়ে যাচ্ছে, আবার অন্যদিকে দেকে ঈমানদারদের আনুগত্যের পসরা এবং তারপর তাদের দারিদ্র্য, অভাব অনাহারে জর্জরিত জীবন, আর দেখে তাদের একের পর এক বিপদ মুসিবত ও দ:খ দুর্দশার শিকার হতে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবীগণ তৃতীয় হিজরী ও তার কাছাকাছি সময়ে যার শিকার হয়েছিলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার মনের মধ্যে একটি অদ্ভুত আক্ষেপ মিশ্রিত জিজ্ঞাসা জেগে উঠে৷ আল্লাহ এখানে এই জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন৷ এমন সূক্ষ্মভাব দিয়েছেন, যার চেয়ে বেশী সুক্ষ্মতার কথা কল্পনাই করা যায় না৷

নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৭০)

আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ কেউ সম্মান চাইলে জেনে রাখুন, সমস্ত সম্মান আল্লাহরই জন্যে। (সূরা ফাতিরঃ ১০)

আল্লাহ তায়া’লা বলেছেনঃ তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু আছে নভোমন্ডলে, যা কিছু আছে ভুমন্ডলে, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি পর্বতরাজি বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং অনেক মানুষ। আবার অনেকের উপর অবধারিত হয়েছে শাস্তি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন, তাকে কেউ সম্মান দিতে পারে না। আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন। (সূরা হাজ্জঃ ১৮)

আল্লাহ তায়া’লা বলেনঃ আসলে সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর। (সূরা ইউনুসঃ ৬৫)

এই আয়াতে রয়েছে মহান আল্লাহর সীমাহীন শক্তি ও তাঁর মহা কুদরতের প্রকাশ। তিনি বাদশাহকে ফকীর করেন এবং ফকীরকে বাদশাহ। তিনিই সমস্ত কর্তৃত্বের মালিক। الْخَيْرُ بِيَدِكَ (যাবতীয় কল্যাণ তোমার হাতে) না বলে, بِيَدِكَ الْخَيْرُ (তোমারই হাতে যাবতীয় কল্যাণ) বলা হয়েছে। অর্থাৎ, বিধেয় পদকে আগে আনা হয়েছে। উদ্দেশ্য নির্দিষ্টীকরণ। অর্থাৎ, সমস্ত কল্যাণ কেবল তোমার হাতেই। তুমি ছাড়া কল্যাণদাতা আর কেউ নেই। অকল্যাণের স্রষ্টা যদিও মহান আল্লাহই, তবুও এখানে কেবল কল্যাণের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে, অকল্যাণের নয়।

কারণ, কল্যাণ আল্লাহর নিছক অনুগ্রহ। পক্ষান্তরে অকল্যাণ হল মানুষের কর্মের ফল যা তাদেরকে ভুগতে হয়। অথবা অকল্যাণও যেহেতু তাঁরই নির্ধারিত নিয়তির অংশ, সুতরাং তাতেও কোন না কোন প্রকার মঙ্গল আছে। এই দিক দিয়ে তাঁর সমস্ত কাজই কল্যাণময়। (ফাতহুল ক্বাদীর)

যেমন (মৃত) বীর্য যা জীবন্ত মানুষ থেকে বের হয়। অতঃপর সেই মৃত (বীর্য) থেকে বের হয় জীবন্ত মানুষ। অনুরূপ মৃত ডিম থেকে প্রথমে মুরগী, তারপর জীবন্ত মুরগী থেকে (মৃত) ডিম অথবা কাফের থেকে মু’মিন এবং মু’মিন হতে কাফের সৃষ্টি হয়।

কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, মুআ’য (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-কে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার অভিযোগ করলে তিনি তাকে বললেন, তুমি [اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ] আয়াতটি পাঠ করে এই দু’আটি করো, (رَحْمَنَ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَرَحِيْمَهُمَا تُعْطِيْ مَنْ تَشَاءُ مِنْهُمَا وَتَمْنَعُ مَنْ تَشَاءُ، ارْحَمْنِيْ رَحْمَةً تُغْنِيْنِيْ بِهَا عَنْ رَحْمَةِ مَنْ سِوَاكَ، اللَّهُمَّ أَغْنِنِيْ مِنَ الْفَقْرِ، وَاقْضِ عَنِّيْ الدَّيْنَ)

অপর আর এক বর্ণনায় এসেছে, ‘‘এটা এমন একটি দু’আ যে, তোমার উপর উহুদ পাহাড় সমানও যদি ঋণ থাকে, মহান আল্লাহ সে ঋণকেও তোমার জন্য আদায় করার ব্যবস্থা করে দিবেন।’’

(মাজমাউয্ যাওয়ায়েদ ১০/১৮৬ হাদীসের বর্ণনাকারীরা সবাই নির্ভরযোগ্য)

 

৩:২৮ لَا یَتَّخِذِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الۡکٰفِرِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ مِنۡ دُوۡنِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ فَلَیۡسَ مِنَ اللّٰہِ فِیۡ شَیۡءٍ اِلَّاۤ اَنۡ تَتَّقُوۡا مِنۡہُمۡ تُقٰىۃً ؕ وَ یُحَذِّرُکُمُ اللّٰہُ نَفۡسَہٗ ؕ وَ اِلَی اللّٰہِ الۡمَصِیۡرُ

২৮. মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্‌র কোন সম্পর্কে থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন(২) এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।

 

আউলিয়া ওলীর বহুবচন। আর ওলী এমন বন্ধুকে বলা হয়, যার সাথে থাকে আন্তরিক ভালবাসা এবং বিশেষ সম্পর্ক।

যেমন, মহান আল্লাহ নিজেকে ঈমানদারদের ওলী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। [اَللهُ ولِيُّ الَّذِيْنَ آمَنُوا] ‘‘আল্লাহ হলেন ঈমানদারদের ওলী।’’ আলোচ্য আয়াতের অর্থ হল, ঈমানদারদের পারস্পরিক ভালবাসা এবং বিশেষ সম্পর্ক থাকে। তারা আপোসে একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। এখানে মহান আল্লাহ মু’মিনদেরকে কাফেরদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কারণ, কাফেররা আল্লাহর শত্রু এবং মু’মিনদেরও। সুতরাং তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা কিভাবে বৈধ হতে পারে? আর এই কারণেই আল্লাহ তাআলা এই বিষয়টাকে কুরআনের আরো কয়েক স্থানে অতীব গুরুত্বের সাথে পেশ করেছেন। যাতে মু’মিনরা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব এবং বিশেষ সম্পর্ক কায়েম করা থেকে বিরত থাকে।

অবশ্য (পার্থিব) প্রয়োজন ও সুবিধার দাবীতে তাদের সাথে সন্ধি ও চুক্তি হতে পারে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেনও। অনুরূপ যে কাফের মুসলিমদের সাথে শত্রুতা রাখে না, তার সাথে উত্তম ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার করা বৈধ। (এর বিস্তারিত আলোচনা সূরা মুমতাহিনায় আছে।) কারণ, এ সব কার্যকলাপ (বন্ধুত্ব ও ভালবাসা থেকে) ভিন্ন জিনিস।

এই অনুমতি সেই মুসলিমদের জন্য যারা কোন কাফের দেশে বসবাস করে। যদি কোন সময় তাদের (কাফেরদের) সাথে বন্ধুত্বের প্রকাশ করা ব্যতীত তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে মৌখিকভাবে বন্ধুত্বের প্রকাশ করতে পারবে। তাফসীরে আহসানুল বায়ান

‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৫১)

আল্লাহ ওই সব লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেনে, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর, স্বদেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং তাদেরকে বের করার জন্য একে অপরকে সাহায্য করেছে। (তাদের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম) আর তাদের সঙ্গে যারা বন্ধুত্ব করে তারাই তো জালেম বা অত্যাচারী।’ (সুরা মুমতাহিনা : আয়াত ৯)

“হে ঈমান-দারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরিকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম”। [সূরা তাওবাহ, আয়াত: ২৩]

“যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয় তবুও। এদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতসমূহে যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এরা হল আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম”। [সূরা মুজাদালাহ: ২২]

মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়। [সূরা ফাতহ, আয়াত: ২৯]

ইমাম আহমদ রহ. বলেন, আবু মুসা আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«قلتُ لعمرَ رضى الله عنه لي كاتبٌ نصرانيٌ، قال: مالَكَ قاتلَكَ اللهُ ، أما سمعتَ قولَه تعالى ﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾ [ سورة المائدة:51]. ألا اتخذتَ حنيفاً ! قلتُ: يا أميرَ المؤمنينَ لي كتابتُه وله دينُه ، قال:لا أُكرمُهم إذ أهانَهم اللهُ ، ولا أُعزُهم إذ أَذلَهم اللهُ ، ولا أُدينهم وقد أقصاهم اللهُ»

অর্থ, একদিন আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলি, আমার একজন সচিব আছে, সে খৃষ্টান। এ কথা শুনে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুন! তুমি খৃষ্টানকে কেন তোমার সচিব বানালে? তুমি কি আল্লাহ তা’আলার বাণী শুনোনি? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾ [سورة المائدة:51].

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইয়াহুদি ও খৃষ্টানদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। তারা নিজেরা পরস্পর বন্ধু”। [সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৫১] তুমি একজন খাটি মুসলিমকে কেন তোমার কাতেব বানালে না। তার কথা শুনে আমি বললাম, হে আমীরুল মুমীনিন! আমি তার থেকে কিতাবত আদায় করব, আর সে তার দ্বীন আদায় করবে। উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহ যাদের অপমান করে আমি তাদের সম্মান করব না। আর আল্লাহ যাদের বে-ইজ্জত করে আমি তাদের ইজ্জত দেবো না এবং আমি তাদেরকে কাছে টানবো না, যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন।

৩:২৯ قُلۡ اِنۡ تُخۡفُوۡا مَا فِیۡ صُدُوۡرِکُمۡ اَوۡ تُبۡدُوۡہُ یَعۡلَمۡہُ اللّٰہُ ؕ وَ یَعۡلَمُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ اللّٰہُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ

২৯. বলুন, ‘তোমাদের অন্তরে যা আছে তা যদি তোমরা গোপন কর বা ব্যক্ত কর, আল্লাহ তা অবগত আছেন। আর আসমানসমূহে যা আছে এবং যমীনে যা আছে তাও তিনি জানেন। আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।

আল্লাহ তা’আলা প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছু সম্যকরূপে জানেন। মানুষের অন্তরে কি আছে, এমনকি কি উদিত হবে তাও আল্লাহ জানেন। কারণ, হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলা যখন প্রথম কলম সৃষ্টি করলেন, তখন তাকে বললেন, লিখ। তখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যা হবে তা সবই লিখা হতে লাগল। [মুসনাদে আহমাদ ৫/৩১৭]

সুতরাং মানুষের মনে কি উদিত হবে সেটাও কলম লিখে রেখেছে।

৩:৩০ یَوۡمَ تَجِدُ کُلُّ نَفۡسٍ مَّا عَمِلَتۡ مِنۡ خَیۡرٍ مُّحۡضَرًا ۚۖۛ وَّ مَا عَمِلَتۡ مِنۡ سُوۡٓءٍ ۚۛ تَوَدُّ لَوۡ اَنَّ بَیۡنَہَا وَ بَیۡنَہٗۤ اَمَدًۢا بَعِیۡدًا ؕ وَ یُحَذِّرُکُمُ اللّٰہُ نَفۡسَہٗ ؕ وَ اللّٰہُ رَءُوۡفٌۢ بِالۡعِبَادِ

৩০. যেদিন প্রত্যেকে সে যা ভাল আমল করেছে এবং সে যা মন্দ কাজ করেছে তা উপস্থিত পাবে, সেদিন সে কামনা করবে- যদি তার এবং এর মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকত, আল্লাহ তার নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন। আর আল্লাহ বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল।

আবূ হুরাইরাহ আব্দুর রহমান ইবনু সাখর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দেহ এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’’সহীহুল বুখারী ৫১৪৪, ৬০৬৬,

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নিশ্চয় দুনিয়া মধুর ও সবুজ (সুন্দর আকর্ষণীয়)। আর নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে এর প্রতিনিধি নিয়োজিত করে দেখবেন যে, তোমরা কিভাবে কাজ করছ? অতএব তোমরা (যদি সফলকাম হতে চাও তাহলে) দুনিয়ার ধোঁকা থেকে বাঁচ এবং নারীর (ফিৎনা থেকে) বাঁচ। কারণ, বানী ঈস্রাইলের সর্বপ্রথম ফিৎনা নারীকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল।মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১, ইবনু মাজাহ ৪০০০, আহমাদ ১০৭৫৯, ১০৭৮৫, ১১০৩৪, ১১১৯৩

“অবশেষে যখন তাদের কারো মৃত্যু আসে, সে বলে, হে আমার রব, আমাকে ফেরত পাঠান, যেন আমি সৎকাজ করতে পারি যা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।’ কখনো নয়, এটি একটি বাক্য যা সে বলবে। যেদিন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে সেদিন পর্যন্ত তাদের সামনে থাকবে বরযখ।” [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ৯৯-১০০]

﴿ وَٱعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأۡتِيَكَ ٱلۡيَقِينُ ٩٩ ﴾ [الحجر: ٩٩]

অর্থাৎ “আর তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর।” (সূরা হিজর ৯৯ আয়াত)

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামতের দিন যে কারো হিসাব নেয়া হবে; সে ধ্বংস হবে।’ আমি (আয়েশা) বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহা! আল্লাহ তাআলা কি এরশাদ করেন নাই, ‘আর যার ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে তার হিসাব-নিকাশ সহজ হবে।’ (সুরা ইনশিকাক : আয়াত ৭-৮)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এতো শুধু (আমলনামা) পেশ মাত্র; কারণ কিয়ামতের দিন যে কারো হিসাব পর্যবেক্ষণ করা হবে সে নির্ঘাত আজাবে নিপতিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ছোট-বড় সব ব্যাপারেই প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদে যদি সত্য বলে তাহলে ভালই। আর যদি মিথ্যা বলার বা গোপন করার চেষ্টা করে, তবে হিসাব-নিকাশের দিন তার মুখে মোহর মেরে দেয়া হবে এবং তার অঙ্গ-প্রতঙ্গকে কথা বলার জন্য বলা হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর মেরে দেব; তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।’ (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৬৫)

“আর তারা বলেছিল, আমাদের এ দুনিয়ার জীবন ছাড়া কিছু নেই এবং আমরা পুনরুজ্জীবিত হব না। আর যদি তুমি দেখতে যখন তাদেরকে দাঁড় করানো হবে তাদের রবের সামনে এবং তিনি বলবেন, এটা কি সত্য নয়? তারা বলবে, হ্যাঁ, আমাদের রবের কসম! তিনি বলবেন, সুতরাং তোমরা যে কুফুরী করতে তার কারণে আযাব আস্বাদন কর। যারা আল্লাহর সাক্ষাৎ অস্বীকার করেছে তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমনকি যখন হঠাৎ তাদের কাছে কিয়ামত এসে যাবে, তারা বলবে, হায় আফসোস! সেখানে আমরা যে ত্রুটি করেছি তার উপর। তারা তাদের পাপসমূহ তাদের পিঠে বহন করবে; সাবধান! তারা যা বহন করবে তা কত নিকৃষ্ট! আর দুনিয়ার জীবন খেলাধুলা ও তামাশা ছাড়া কিছু না। আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য আখিরাতের আবাস উত্তম। অতএব তোমরা কি বুঝবে না?” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ২৯-৩২]

“আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হলো”। [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১২৪-১২৬]

“আর চিরঞ্জীব, চিরপ্রতিষ্ঠিত সত্তার সামনে সকলেই অবনত হবে। আর সে অবশ্যই ব্যর্থ হবে যে যুলুম বহন করবে। এবং যে মুমিন অবস্থায় ভালো কাজ করবে সে কোনো যুলুম বা ক্ষতির আশংকা করবে না”। [সূরা ত্বাহা আয়াত: ১১১-১১২]

“আমরা শেষে এসেছি কিন্তু কিয়ামতের দিন সকলের আগে থাকবো। যদিও অন্য সকল জাতিগুলো (ইয়াহূদী ও খৃষ্টান) কে গ্রন্থ দেওয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে, আমাদের গ্রন্থ দেওয়া হয়েছে তাদের পরে। অতঃপর জেনে রাখো এই (জুমু‘আর) দিনটি আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের সঠিক পথে দিশা দিয়েছেন। আর অন্য লোকেরা এ ব্যাপারে আমাদের পিছনে আছে। ইয়াহূদীরা জুমার পরের দিন (শনিবার) উদযাপন করে আর খৃষ্টানেরা তার পরের দিন (রবিবার) উদযাপন করে”। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৭৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৫৫।

আবু হুরায়রা ও হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আরেকটি বর্ণনায় এসেছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«نَحْنُ الْآخِرُونَ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا، وَالْأَوَّلُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، الْمَقْضِيُّ لَهُمْ قَبْلَ الْخَلَائِقِ».

“পৃথিবীতে বসবাসকারী জাতিগুলোর মধ্যে আমাদের আগমন সর্বশেষে আর কিয়ামতের দিনে আমাদের ফয়সালা করা হবে সকল সৃষ্টি জীবের পূর্বে”। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৫৬।

হাদীসে আরো এসেছে: ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«نَحْنُ آخِرُ الْأُمَمِ، وَأَوَّلُ مَنْ يُحَاسَبُ، يُقَالُ: أَيْنَ الْأُمَّةُ الْأُمِّيَّةُ، وَنَبِيُّهَا؟ فَنَحْنُ الْآخِرُونَ الْأَوَّلُونَ »

“আমরা হলাম জাতিসমূহের সর্বশেষ। কিন্তু কেয়ামতে আমাদের হিসাব সর্ব প্রথম করা হবে। তখন বলা হবে: উম্মী (আসল) জাতি ও তাদের নবী কোথায়? তাই আমরা সর্বশেষ অথচ (মর্যাদায়) প্রথম”।ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪২৯০, আলবানী রহ. সহীহ আল জামে গ্রন্থে হাদীসটিকে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।