আউযুবিল্লাহি মিনাস শাইতোয়ানির রজীম
দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে-
﴿إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَن تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُم مِّنَ اللَّهِ شَيْئًا ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمْ وَقُودُ النَّارِ﴾
১০. নিশ্চয় যারা কুফরী করে আল্লাহর নিকট তাদের ধন-সম্পদ ও সস্তান-সন্তুতি কোন কাজে আসবে না এবং এরাই আগুনের ইন্ধন।
কুফরের আসল মানে হচ্ছে গোপন করা,লুকানো ৷ এ থেকেই অস্বীকারের অর্থ বের হয়েছে ৷ ঈমানের বিপরীত পক্ষে এ শব্দটি বলা হয় ৷ ঈমান অর্থ মেনে নেয়া, কবুল করা, স্বীকার করা৷ এর বিপরীতে ‘কুফর’- এর অর্থ না মানা , প্রত্যাখ্যান করা, অস্বীকার করা ৷ কুরআনের বর্ণনার প্রেক্ষিতে কুফরীর মনোভাব ও আচরণ বিভিন্ন প্রকার হতে পারে ৷
এক: আল্লাহকে একেবারেই না মানা ৷ অথবা তাঁর সার্বভৌম কতৃত্ব ও ক্ষমতা স্বীকার না করা এবং তাঁকে নিজের ও সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মালিক ও মাবুদ বলে না মানা ৷
দুই:আল্লাহকে মেনে নেয়া কিন্তু তাঁর বিধান ও হিদায়াতসমূহকে জ্ঞান ও আইনের একমাত্র উৎস হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করা ৷
তিন: নীতিগতভাবে একথা মেনে নেয়া যে, তাকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী চলতে হবে কিন্তু আল্লাহ তাঁর বিধান ও বাণীসমূহ যেসব নবী-রসূলের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন তাদেরকে অস্বীকার করা
চার: নবীদের মধ্যে পার্থক্য করা এবং নিজের পছন্দ ও মানসিক প্রবণতা বা গোত্রীয় ও দলীয়প্রীতির কারণে তাদের মধ্য থেকে কাউকে মেনে নেয়া এবং কাউকে না মানা ৷
পাঁচ: নবী ও রসূলগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে আকীদা-বিশ্বাস , নৈতিক চরিত্র ও জীবন যাপনের বিধান সম্বলিত যেসব শিক্ষা বিবৃত করেছেন সেগুলো অথবা সেগুলোর কোন কোনটি গ্রহণ করা ৷
ছয়: এসব কিছুকে মতবাদ হিসেবে মেনে নেয়ার পর কার্যত জেনে বুঝে আল্লাহর বিধানের নাফরমানী করা এবং এই নাফরমানীর ওপর জোর দিতে থাকা ৷ আর এই সংগে দুনিয়ার জীবনে আনুগত্যের পরিবর্তে নাফরমানীর ওপর নিজের কর্মনীতির ভিত্তি স্থাপন করা ৷
আল্লাহর মোকাবিলায় এসব বিভিন্ন ধরনের চিন্তা ও কাজ মূলত বিদ্রোহাত্মক ৷ এর মধ্য থেকে প্রতিটি চিন্তা ও কর্মকে কুরআন কুফরী হিসেবে চিহ্নত করেছে ৷ এ ছাড়াও কুরআনের কোন কোন জায়গায় ‘কুফর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহর দান, অনুগ্রহ ও নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়ার অর্থে ৷ সেখানে শোকর বা কৃতজ্ঞতার বিপরীতে এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ৷ ‘শোকর’ –এর অর্থ হচ্ছে , যিনি অনুগ্রহ করেছেন তাঁর প্রতি অনুগৃহীত থাকা , তাঁর অনুগ্রহকে যথাযথ মূল্য ও মর্যাদা দান করা, তাঁর প্রদত্ত অনুগ্রহকে তাঁর সন্তুষ্টি ও নির্দেশ অনুসারে ব্যবহার করা এবং অনুগৃহীত ব্যক্তির মন অনুগ্রহকারীর প্রতি বিশ্বস্ততার আবেগে পরিপূর্ণ থাকা৷ এর বিপরীত পক্ষে কুফর বা অনুগ্রহের প্রতি অকৃজ্ঞতা হচ্ছেঃ অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহ স্বীকার না করা এবং এই অনুগ্রহকে নিজের যোগ্যতা বা অন্য কারোর দান বা সুপারিশের ফল মনে করা অথবা অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহ প্রদান করা সত্তেও তার সথে বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণ করা ৷ এই ধরনের কুফরীকে আমরা নিজেদের ভাষায় সাধারণত কৃতঘ্নতা, অকৃতজ্ঞতা, নিমকহারামী ও বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকি ৷
(১) মহান আল্লাহ এ আয়াতে কাফেরদের সম্পর্কে এটা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তারা জাহান্নামের ইন্ধন হবে।
“যেদিন যালেমদের কোন ওজর-আপত্তি কাজে আসবে না, আর তাদের জন্য থাকবে লা’নত এবং তাদের জন্য থাকবে খারাপ আবাস” [গাফের: ৫২]
দুনিয়াতে তাদেরকে যে সমস্ত সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দেয়া হয়েছিল তাও তাদের কোন উপকার দিবে না এবং তাদেরকে আল্লাহর কঠোর শাস্তি ও কঠিন পাকড়াও থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হবে না। অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা
এ বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন, “কাজেই ওদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আপনাকে যেন বিমুগ্ধ না করে, আল্লাহ তো এসবের দ্বারাই ওদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান। ওরা কাফের থাকা অবস্থায় ওদের আত্মা দেহত্যাগ করবে” [আত-তাওবাহঃ ৫৫]
আরও বলেন, “যারা কুফরী করেছে, দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন কিছুতেই আপনাকে বিভ্রান্ত না করে। এ তো স্বল্পকালীন ভোগ মাত্র; তারপর জাহান্নাম তাদের আবাস আর ওটা কত নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল! [সূরা আলে ইমরান: ১৯৬–১৯৭]
﴿كَدَأْبِ آلِ فِرْعَوْنَ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۚ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا فَأَخَذَهُمُ اللَّهُ بِذُنُوبِهِمْ ۗ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ
১১. তাদের অভ্যাস ফির’আউনী সম্প্রদায় ও তাদের পূর্ববর্তীদের অভ্যাসের ন্যায়, তারা আমার আয়াতগুলোতে মিথ্যারোপ করেছিল, ফলে আল্লাহ্ তাদের পাপের জন্য তাদেরকে পাকড়াও করেছিলেন(১)। আর আল্লাহ্ শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর।
আল্লামা শানকীতী বলেন, এ আয়াতে ফিরআউনের পূর্বেকার যে সমস্ত সম্প্রদায়কে তাদের অপরাধের কারণে পাকড়াও করা হয়েছিল তাদের পরিচয় ও অপরাধের বিবরণ দেয়া হয়নি। পক্ষান্তরে পবিত্র কুরআনের অন্যত্র তাদেরকে নুহ, হুদ, সালেহ, লুত ও শু’আইবের সম্প্রদায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সে সমস্ত স্থানে তাদের অপরাধ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর সাথে কুফরী করেছিল এবং রাসূলদের উপর মিথ্যারোপ করেছিল। যেমন, সামূদ সম্প্রদায় কর্তৃক উষ্ট্রী হত্যা, লুত সম্প্রদায়ের সমকামিতা, শু’আইব এর সম্প্রদায় কর্তৃক মাপ ও ওজনে কম দেয়া ইত্যাদি। [আদওয়াউল বায়ান]
﴿قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُوا سَتُغْلَبُونَ وَتُحْشَرُونَ إِلَىٰ جَهَنَّمَ ۚ وَبِئْسَ الْمِهَادُ﴾
১২. যারা কুফরী করে তাদেরকে বলুন, তোমরা শীঘ্রই পরাভূত হবে এবং তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে একত্রিত করা হবে। আর তা কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থল।
এখানে কাফের বা অবিশ্বাসী বলতে ইয়াহুদীদেরকে বুঝানো হয়েছে। আর এই ভবিষ্যদ্বাণী খুব শীঘ্রই বাস্তবায়িত হয়েছিল। যেমন, বানু ক্বাইনুক্বা’ ও বানু নাযীরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং বানু ক্বুরায়যাকে হত্যা করা হয়েছিল। অতঃপর খায়বার বিজয়ের পর সমস্ত ইয়াহুদীদের উপর জিযিয়া-কর আরোপ করা হয়েছিল। (ফাতহুল ক্বাদীর)
﴿قَدْ كَانَ لَكُمْ آيَةٌ فِي فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا ۖ فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأُخْرَىٰ كَافِرَةٌ يَرَوْنَهُم مِّثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ ۚ وَاللَّهُ يُؤَيِّدُ بِنَصْرِهِ مَن يَشَاءُ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَعِبْرَةً لِّأُولِي الْأَبْصَارِ﴾
১৩. দু’টি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। একদল যুদ্ধ করছিল আল্লাহর পথে, অন্য দল ছিল কাফের; তারা তাদেরকে চোখের দেখায় দেখছিল তাদের দ্বিগুণ। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা আপন সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন(১)। নিশ্চয়ই এতে অস্তদৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।(২)
(১) আলোচ্য আয়াতে বদর যুদ্ধের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এ যুদ্ধে কাফেরদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। তাদের কাছে সাতশ উট ও একশ’ অশ্ব ছিল। অপরপক্ষে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিনশ’র কিছু বেশী। তাদের কাছে সর্বমোট সত্তরটি উট, দুটি অশ্ব, ছ’টি লৌহবর্ম এবং আটটি তরবারী ছিল। মজার ব্যাপার ছিল এই যে, প্রত্যেক দলের দৃষ্টিতেই প্রতিপক্ষ দলের সংখ্যা নিজেদের চেয়ে দ্বিগুণ প্রতিভাত হচ্ছিল। এর ফলে মুসলিমদের আধিক্য কল্পনা করে কাফেরদের অন্তর উপর্যুপরি শঙ্কিত হচ্ছিল এবং মুসলিমগণও নিজেদের অপেক্ষা প্রতিপক্ষের সংখ্যা দ্বিগুণ দেখে আল্লাহ তা’আলার দিকে অধিকতর মনোনিবেশ করছিলেন। তারা পূর্ণ ভরসা ও দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর ওয়াদা- “যদি তোমাদের মধ্যে একশ ধৈর্যশীল যোদ্ধা থাকে, তবে তারা দুইশ’র বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে” [সূরা আল-আনফালঃ ৬৬]-এর ওপর আস্থা রেখে আল্লাহর সাহায্যের আশা করছিলেন। কাফেরদের প্রকৃত সংখ্যা ছিল তিনগুণ। তা যদি মুসলিমদের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়ে যেত, তবে তাদের মনে ভয়-ভীতি সঞ্চার হওয়াটা ছিল সাধারণ। আবার কোন কোন অবস্থায় উভয় দলই প্রতিপক্ষকে কম দেখেছিল। [সীরাতে ইবন হিশাম]
(২) বদর যুদ্ধের কয়েকটি বিষয় ছিল অত্যন্ত শিক্ষণীয়ঃ (এক) মুসলিম ও কাফেররা যেভাবে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল, তাতে উভয় দলের নৈতিক ও চারিত্রিক পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাদের একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছিল, অপরদল তাগুত, শির্ক ও শয়তানের পথে যুদ্ধ করছিল। আল্লাহ তার পথে যুদ্ধকারীদের অন্যদের উপর বিজয় দিয়েছিলেন। এ থেকে ইয়াহুদীরা শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল। [আইসারুত তাফসীর] (দুই) মুসলিমরা সংখ্যায় নগণ্য ও অস্ত্রে অপ্রতুল হওয়া সত্বেও যেভাবে কাফেরদের বিশাল সংখ্যা ও উন্নত অস্ত্র-সস্ত্রের মোকাবেলা করেছে, তাতে এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, তারা আল্লাহর সাহায্যপুষ্ট। [সা’দী] (তিন) আল্লাহর প্রবল প্রতাপ ও অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে গাফেল হয়ে যারা সংখ্যাধিক্য ও সমরাস্ত্রের শক্তিতে আত্মম্ভ্রিতায় মেতে উঠেছিল, আল্লাহ্ তাদেরকে পরাজিত করেছিলেন। [মানার]
﴿زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ۗ ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الْمَآبِ﴾
১৪. নারী, সন্তান, সোনারূপার স্তুপ, বাছাই করা ঘোড়া, গবাদি পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট সুশোভিত করা হয়েছে। এসব দুনিয়ার জীবনের ভোগ্য বস্তু।(১) আর আল্লাহ্, তাঁরই নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।
(১) আয়াতের সারমর্ম এই যে, আল্লাহ তা’আলা মানুষের মনে এসব বস্তুর প্রতি স্বভাবগতভাবেই আকর্ষণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে যে, কে এগুলোর আকর্ষণে মত্ত হয়ে আখেরাতকে ভুলে যায় এবং কে এসবের আসল স্বরূপ ও ধ্বংসশীল হওয়ার বিষয় অবগত হয়ে শুধু যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অর্জনে সচেষ্ট হয় ও আখেরাতের কল্যাণ আহরণের লক্ষ্যে তার সুচারু ব্যবহার করে। আল্লাহ্ তা’আলা যেসব বস্তুকে মানুষের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে দিয়েছেন, শরীয়ত অনুযায়ী সেগুলো পরিমিত উপার্জন করলে এবং যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সঞ্চয় করলে দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবী হাসিল হবে।
‘আমি পৃথিবীস্থ সব কিছুকে পৃথিবীর জন্য শোভা করেছি মানুষকে পরীক্ষার জন্য—।’’ (সূরা কাহ্ফ ৭ আয়াত)
আলোচ্য আয়াতে কমনীয় জিনিসের মধ্যে সর্বপ্রথম মহিলার কথা উল্লেখ হয়েছে। কারণ, সাবালক হওয়ার পর প্রত্যেক মানুষের সব থেকে বেশী প্রয়োজন বোধ হয় একজন সঙ্গিনীর। তাছাড়া রমণী পুরুষের কাছে সর্বাধিক বেশী রমণীয় ও কমনীয়। স্বয়ং নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘মহিলা এবং সুগন্ধি আমার নিকট অতি প্রিয় জিনিস।’’ (মুসনাদে আহমাদ) অনুরূপ তিনি বলেছেন, ‘‘নারী হল দুনিয়ার সব চেয়ে উৎকৃষ্টমানের সামগ্রী।’’ সুতরাং যদি নারীর প্রতি ভালবাসা শরীয়তের সীমা অতিক্রম না করে, তাহলে তা হল উত্তম জীবন সঙ্গিনী এবং আখেরাতের সম্বলও। পক্ষান্তরে (এত প্রয়োজনীয় বলেই) এই নারীই হল দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা বড় ফিৎনা। রসূল (সাঃ) বলেন, ‘‘আমার পর যেসব ফিৎনা সংঘটিত হবে তার মধ্যে পুরুষদের জন্য সব থেকে বড় ক্ষতিকর ফিৎনা হবে নারী।’’ (বুখারী ৫০৯৬নং)
পক্ষান্তরে অবৈধ পন্থায় সেগুলো ব্যবহার করলে অথবা বৈধ পন্থায় হলেও এগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত নিমজ্জিত হয়ে আখেরাত বিস্মৃত হয়ে গেলে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়বে। [সা’দী] অর্থাৎ এসব হচ্ছে পার্থিব জীবনে ব্যবহার করার জন্য; মন বসাবার জন্য নয়। আর আল্লাহর কাছে রয়েছে উত্তম ঠিকানা। সেখানে চিরকাল থাকতে হবে এবং যার নেয়ামত ধ্বংস হবে না, হ্রাসও পাবে না। আখেরাতে আল্লাহ্ তা’আলা মুমিনের জন্য যে নেয়ামত রেখেছেন, তার তুলনা দুনিয়ার জীবনের সামগ্ৰীসমূহের কোন কিছু দিয়েই দেয়া যায় না।
“এবং নিশ্চয় আখেরাত তোমার জন্য দুনিয়ার তুলনায় শ্রেষ্ঠ।” (৯৩-সূরা আদ দোহাঃ আয়াত-৪)
“তারা কি মনে করে যে আমি যে তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি বাড়াচ্ছি তাতে তাদের কল্যাণের ব্যাপারে ত্বরান্বিত করছি? তা নয়, বরং তারা তা বুঝে না।” (২৩-সূরা আল মু’মিনূনঃ আয়াত-৫৫-৫৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “দুনিয়া অভিশপ্ত এবং যা কিছু এতে আছে তা অভিশপ্ত। তবে যা আল্লাহর যিকর বা স্মরণে করা হয় ও তার সাথে সম্পৃক্ত হয় এবং দ্বীনী জ্ঞানে আলেম ও দ্বীনী জ্ঞান অর্জনকারী। [তিরমিযী: ২৩২২; ইবন মাজাহ: ৪১১২]
না, তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী। -সূরা আ‘লা (৮৭) : ১৬-১৭
তারা দুনিয়ার বাহ্যিক দিক খুব ভাল জানে। কিন্তু আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল। -সূরা রূম (৩০) : ৭
আমরা যখন মারা যাব এবং মাটিতে পরিণত হব তখনো কি (আমরা পুনরুত্থিত হব)? এ প্রত্যাবর্তন সুদূর পরাহত! -সূরা কফ (৫০) : ৩
উমর (রাঃ) যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘরে প্রবেশ করলেন তখন তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পার্শ্ব দেশে খেজুরের চাটাইয়ের দাগ দেখতে পেলেন, যা চাটাইয়ে শোয়ার ফলে সৃষ্ট হয়েছে এবং তিনি ঘরের দৈন্যদশাও দেখলেন। এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু দরদর করে গড়িয়ে পড়তে লাগল। সকলের আদর্শ ও নেতা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন অবস্থায়!
“আর তারা বলে এ রাসূলের কী হলো যে সে আমাদের মতো বা মানুষের মত খায়-দায় ও বাজারে চলা-ফিরা করে।” (২৫-সূরা ফুরকানঃ আয়াত-৭)
উমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো জানেন যে খসরু ও জার কিভাবে জীবন যাপন করে!
(আপনি তো সেভাবে জাকজমকভাবে জীবন যাপন করতে পারেন। -অনুবাদক)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন-
أفي شكٍّ أنت يا ابن الخطَّاب اما ترضى ان تكون لنا الاخرة ولهم الدنيا
“হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি সন্দেহে ভুগছ? আমাদের জন্য আখেরাত আর তাদের জন্য দুনিয়া এতে কি তুমি সন্তুষ্ট নও?”
এটা হলো ন্যায়সঙ্গত ভারসাম্যতা ও সুন্দর বণ্টন। অতএব, তারা যদি ডলার, টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, দালান-কোঠা ও গাড়ি-ঘোড়ায় সুখ খুঁজে পায় তবে পাক। আল্লাহর কসম নিশ্চয় তারা কখনও সেসব জিনিসের মাঝে তা খুঁজে পাবে না।
“যারা দুনিয়ার জীবন ও তার সৌন্দর্য চায় আমি সেখানে তাদেরকে তাদের পুণ্যকর্মফল দিই আর সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হয় না। তাদের জন্যই পরকালে (আখেরাতে) দোযখ ছাড়া অন্য কিছু নেই এবং সেখানে (দুনিয়াতে) তারা যা করেছে তা আখেরাতে বৃথা যাবে ও তারা যা (দুনিয়াতে) করত তা আখেরাতে বাতিল হয়ে যাবে।” (১১-সূরা হুদঃ আয়াত-১৫-১৬)
﴿قُلْ أَؤُنَبِّئُكُم بِخَيْرٍ مِّن ذَٰلِكُمْ ۚ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ﴾
১৫. বলুন, আমি কি তোমাদেরকে এসব বস্তু থেকে উৎকৃষ্টতর কোন কিছুর সংবাদ দেব? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর পবিত্র স্ত্রীগণ এবং আল্লাহর নিকট থেকে সন্তুষ্টি(১)। আর আল্লাহ্ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।
অর্থাৎ আল্লাহ অপাত্রে দান করেন না৷ উপরি উপরি বা ভাসাভাসাভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তার নীতি নয়৷ তিনি তার বান্দাহদের কার্যাবলী, সংকল্প ও ইচ্ছা পুরোপুরি ও ভালোভাবেই জানেন৷ কে পুরুস্কার লাভের যোগ্য আর কে যোগ্য নয়, তাও তিনি ভালোভাবেই জানেন৷
(১) আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন, “আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাতবাসীদেরকে বলবেন, হে জান্নাতবাসী! তখন তারা বলবে, আমরা হাজির, তখন তিনি বলবেনঃ তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছ? তারা বলবে, আমরা কেন সন্তুষ্ট হব না অথচ আপনি আমাদেরকে এমন কিছু দান করেছেন যা আর কোন সৃষ্টিকে দান করেননি। তখন তিনি বলবেনঃ আমি তোমাদেরকে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু দান করব। তারা বলবে, হে রব! এর চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে? তিনি বলবেন; আমি তোমাদের উপর আমার সন্তুষ্টি অবতরণ করাব, এর পর আমি আর কখনও তোমাদের উপর ক্রোধাম্বিত হব না।” [বুখারী: ৬৫৪৯, মুসলিম: ২৮২৯]
﴿الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ﴾
১৬. যারা বলে, হে আমাদের রব! নিশ্চয় আমরা ঈমান এনেছি; কাজেই আপনি আমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন।
অর্থাৎ সত্য পথে পূর্ণ অবিচলতার সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে৷ কোন ক্ষতি বা বিপদের মুখে কখনো সাহস ও হিম্মতহারা হয় না৷ ব্যর্থতা এদের মনে কোন চিড় ধরায় না৷ লোভ-লালসায় পা পিছলে যায় না৷ যখন আপাতদৃষ্টিতে সাফল্যের কোন সম্ভাবনাই দেখা যায় না তখনো এরা মজবুতভাবে সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকে৷
﴿الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنفِقِينَ وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ﴾
১৭. তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত, ব্যয়কারী এবং শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থী।(১)
(১) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমাদের রব আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাত্রে যখন রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে তখন প্রথম আসমানে নেমে এসে বলতে থাকেন, কে আমাকে ডাকবে যে আমি তার ডাকে সাড়া দিব? কে আমার কাছে চাইবে যে আমি তাকে দিব? কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে যে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব? [বুখারী: ১১৪৫; মুসলিম: ৭৫৮] এর দ্বারা শেষ রাত্রির ইবাদতের গুরুত্ব বোঝা যায়। এ সময়কার দোআ কবুল হয়। এটা মূলত: তাহাজ্জুদের সময়।
﴿شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
১৮. আল্লাহ সাক্ষ্য দেন(১) যে, নিশ্চয় তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। আর ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও, আল্লাহ ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই, (তিনি) পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
অর্থাৎ যে আল্লাহ বিশ্ব-জাহানের সমস্ত তত্ব, সত্য ও রহস্যের প্রত্যক্ষ জ্ঞান রাখেন, যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে আবরণহীন অবস্থায় দেখছেন এবং যার দৃষ্টি থেকে পৃথিবী ও আকাশের কোন একটি বস্তুও গোপন নেই-এটি তার সাক্ষ্য এবং তার চাইতে আর বেশী নির্ভরযোগ্য চাক্ষুষ সাক্ষ্য আর কে দিতে পারে? কারণ সমগ্র সৃষ্টিজগতে তিনি ছাড়া আর কোন সত্তা খোদায়ী গুণান্বিত নয়৷ আর কোন সত্তা খোদায়ী কর্তৃত্বের অধিকারী নয় এবং আর কারোর খোদায়ী করার যোগ্যতাও নেই৷
আল্লাহর পর সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য হচ্ছে ফেরেশতাদের৷ কারণ তারা হচ্ছে বিশ্বরাজ্যের ব্যবস্থাপনার কার্যনির্বাহী ও কর্মচারী৷ তারা সরাসরি নিজেদের ব্যক্তিগত জ্ঞানের ভিত্তিতে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এই বিশ্বারাজ্যে আল্লাহ ছাড়া আর আরো হুকুম চলে না এবং পৃথিবী ও আকাশের পরিচালনা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তিনি ছাড়া আর কোন সত্তা এমন নেই যার কাছ থেকে তারা নির্দেশ গ্রহণ করতে পারে৷ ফেরেশতাদের পরে এই সৃষ্টিজগতে আর যারাই প্রকৃত সত্য সম্পর্কে কম বেশী কিছুটা জ্ঞান রাখে, সৃষ্টির আদি থেকে নিয়ে আজ পর্যন্তকার তাদের সবার সর্বসম্মত সাক্ষ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ একাই এই সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মালিক, পরিচাল ও প্রভু৷
(১) অর্থাৎ যে আল্লাহ বিশ্ব জাহানের সমস্ত তত্ত্ব, সত্য ও রহস্যের প্রত্যক্ষ জ্ঞান রাখেন, যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে আবরণহীন অবস্থায় দেখছেন এবং যার দৃষ্টি থেকে পৃথিবী ও আকাশের কোন একটি বস্তুও গোপন নেই এটি তার সাক্ষ্য। আর তার চেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য আর কে দিতে পারে? কারণ পৃথিবীতে ইলাহের স্বত্ব দাবী করার অধিকার ও যোগ্যতা কারও নেই। তিনি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ব্যতীত আর কোন হক্ক ইলাহ নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করা যুলুম ও অন্যায়। আল্লাহ্ তা’আলার এ সাক্ষ্যের সাথে তিনি আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাদেরকেও শরীক করেছেন। তারাও এ মহৎ সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। তারপর আল্লাহ তা’আলা আলেম তথা দ্বীনের জ্ঞানে জ্ঞানীদেরকেও এ সাক্ষ্য প্রদানের জন্য গ্রহণ করে সম্মানিত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি মূলত: আলেম তথা দ্বীনের জ্ঞানে জ্ঞানীদের সম্মান বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। [ইবনুল কাইয়্যেম: মিফতাহু দারিস সা’আদাহ; তাফসীরে সা’দী]
﴿إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ ۗ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ۗ وَمَن يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ﴾
১৯. নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন।(১) আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তারা কেবলমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ তাদের নিকট জ্ঞান আসার মতানৈক্য ঘটিয়েছিল। আর কেউ আল্লাহ্র আয়াতসমূহে কুফরী করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ দ্রুত হিসাব গ্রহনকারী।
অর্থাৎ আল্লাহর কাছে মানুষের জন্য একটি মাত্র জীবন ব্যবস্থা ও একটি মাত্র জীবন বিধান সঠিক ও নির্ভুল বলে গৃহীত৷ সেটি হচ্ছে, মানুষ আল্লাহকে নিজের মালিক ও মাবুদ বলে স্বীকার করে নেবে এবং তাঁর ইবাদাত, বন্দেগী ও দাসত্বের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেবে৷ আর তাঁর বন্দেগী করার পদ্ধতি নিজের আবিষ্কার করবে না৷ বরং তিনি নিজের নবী-রসূলগণের মাধ্যমে যে হিদায়ত ও বিধান পাঠিয়েছেন কোন প্রকার কমবেশী না করে তার অনুসরণ করবে৷ এই চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির নাম ”ইসলাম” আর বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টার ও প্রভর নিজের সৃষ্টিকূল ও প্রজা সাধারনের জন্য ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কর্মপদ্ধতির বৈধতার স্বীকৃতি না দেয়াও পুরোপুরি ন্যায়সংগত৷ মানুষ তার নির্বুদ্ধিতার কারণে নাস্তিক্যবাদ থেকে নিয়ে শিরক ও মূর্তিপূজা পর্যন্ত যে কোন মতবাদ ও যে কোন পদ্ধতির অনুসরণ করা নিজের জন্য বৈধ মনে করতে পারে কিন্তু বিশ্ব-জাহানের প্রভুর দৃষ্টির এগুলো নিছক বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছুই নয়৷
মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ হতে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত। (সূরা আলে ইমরান ৮৫ আয়াত)
নবী করীম (সাঃ)-এর নবুঅত ও রিসালাত সমগ্র মানবতার জন্য। [قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا] ‘‘বলে দাও, হে মানবমন্ডলী! তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহর প্রেরিত রসূল। (সূরা আ’রাফ ১৫৮ আয়াত)
[تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا] ‘‘পরম বরকতময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে সমগ্র বিশ্বের জন্য সতর্ককারী হয়।’’ (সূরা ফুরকান ১ আয়াত)
হাদীসে রসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘‘সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ আছে! ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের যে কেউ আমার উপর ঈমান না এনেই মারা যাবে, সে জাহান্নামী হবে। (সহীহ মুসলিম) তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি সাদা-কালো সকলের প্রতি প্রেরিত হয়েছি।’ (অর্থাৎ, সকল মানুষের জন্য নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছি।) আর এই কারণেই তিনি সেই সময়ের সমস্ত বাদশাহদের প্রতি পত্র প্রেরণ করে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। (বুখারী, মুসলিম, ইবনে কাসীর)
আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ার যে কোন অঞ্চলে যে কোন যুগে যে নবীই এসেছেন, তাঁর দীনই ছিল ইসলাম৷ দুনিয়ার যে কোন জাতির ওপর যে কিতাবই নাযিল হয়েছে, তা ইসলামেরই শিক্ষা দান করেছে৷ এই আসল দীনকে বিকৃত করে এবং তার মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে যেসব ধর্ম মানুষের মধ্যে প্রচলিত হয়েছে, তাদের জন্ম ও উদ্ভবের কারণ ও ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, লোকেরা নিজেদের বৈধ সীমা অতিক্রম নিজেদের খেয়াল খুশী মতো আসল দীনের আকীদা-বিশ্বাস, মূলনীতি ও বিস্তারিত বিধান পরিবর্তন করে ফেলেছে৷ আর এই সকল মতবিরোধ কোন দলীলের ভিত্তিতে ছিল না। কেবল হিংসা-বিদ্বেষ এবং শত্রুতার কারণে ছিল। অর্থাৎ, তারা সত্যকে জেনে ও চিনেছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও কেবল দুনিয়ার খেয়ালী স্বার্থের পিছনে পড়ে ভ্রান্তমূলক কথার উপরে কায়েম থাকত এবং সেটাকেই দ্বীন বুঝানোর চেষ্টা করত। যাতে তাদের নাকও যেন উঁচু থাকে এবং জনগণের মাঝে তাদের বিশ্বস্ততাও যেন প্রতিষ্ঠিত থাকে। পরিতাপের বিষয় যে, ইদানীং মুসলিম উলামাদের এক বিরাট সংখ্যক দল ঠিক এই ধরনেরই জঘন্য উদ্দেশ্য সাধনের তাকীদে তাদের মতনই ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করে চলেছে। আল্লাহ তাদেরকে ও আমাদেরকে হিদায়াত করুন। আমীন।
﴿فَإِنْ حَاجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ ۗ وَقُل لِّلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ ۚ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوا ۖ وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ ۗ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ﴾
২০. সুতরাং যদি তারা আপনার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয় তবে আপনি বলুন, আমি আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পণ করছি এবং আমার অনুসারিগণও। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে ও নিরক্ষরদেরকে বলেন, তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে নিশ্চয় তারা হেদায়াত পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে তবে আপনার কর্তব্য শুধু প্রচার করা। আর আল্লাহ্ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।(১)
(১) আয়াতে বর্ণিত أَسْلَمْتُمْ শব্দটির মূল অর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে ‘আত্মসমর্পণ করা’ অনুবাদ করা হয়েছে। এর আরেক অনুবাদ এভাবেও করা যায় যে, যদি তারা আপনার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয় তবে আপনি বলুন, আমি ইসলামকে কবুল করেছি এবং আমার অনুসারিগণও। এর মাধ্যমে অপরাপর ধর্মের অনুসারীরা মুসলিমদের ব্যাপারে হতাশ হয়ে যাবে যে, তাদেরকে আবার বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই। [সা’দী] আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে অর্থাৎ ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে ও নিরক্ষর অর্থাৎ মক্কার কুরাইশ ও তাদের অনুসারীদেরকে বলুন, ‘তোমরাও কি ইসলামকে গ্রহণ করে নিয়েছ? যদি তারা তোমরা যেভাবে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছ সেভাবে ইসলামকে কবুল করে তবে নিশ্চয় তারা হেদায়াত পাবে এবং তারা তোমাদের ভাই-বন্ধুতে পরিণত হবে। আর যদি তারা ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তাদের পূর্ববর্তী ধর্ম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে, তবে আপনার কর্তব্য শুধু প্রচার করা। প্রচারের সওয়াব আপনি অবশ্যই পাবেন। তাদের উপরও আল্লাহর পক্ষ থেকে যাতে করে তাদের শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হয়। [সা’দী]