সূরা আলে ইমরান ১৬তম রুকু (১৪৮-১৫৫)

 

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

(১৪৮ নং আয়াত পূর্বে ১৫তম রুকুর সাথে আলোচিত)

 

৩:১৪৯ یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تُطِیۡعُوا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یَرُدُّوۡکُمۡ عَلٰۤی اَعۡقَابِکُمۡ فَتَنۡقَلِبُوۡا خٰسِرِیۡنَ ﴿

১৪৯. হে মুমিনগণ! যদি তোমরা কাফেরদের আনুগত্য কর তবে তারা তোমাদেরকে বিপরীত দিকে ফিরিয়ে দেবে ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

যে কুফরীর অবস্থা থেকে তোমরা বের হয়ে এসেছো, তারা আবার তোমাদের সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়৷ ওহোদের পরাজয়ের পর মুনাফিক ও ইহুদীরা মুসলমানদের মধ্যে একথা প্রচার করার চেষ্টা করছিল যে, মুহাম্মাদ (সা) যদি সত্যি সত্যিই আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন, তাহলে যুদ্ধে পরাজিত হলেন কেন? তিনি তো একজন সাধারণ লোক৷ তাঁর অবস্থাও সাধারণ লোকদের থেকে আলাদা নয়৷ আজকে জিতে গেলেন আবার কালকে হেরে গেলেন৷ এই তাঁর অবস্থা৷ তিনি তোমাদেরকে আল্লাহর যে সাহায্য ও সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছেন, তা নিছক একটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ (নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক)

সমাজের উদাহরনঃ

يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلاَ تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য তার রাসূলের। আর তোমরা তোমাদের আমলগুলিকে বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)।

এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতামূলক কোন কাজই আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। সর্বোপরি কুফরী সকল সৎকর্ম বিনষ্ট করে দেয়।

যেমন অন্যত্র এসেছে

,قُلْ أَطِيعُوا اللهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْكَافِرِينَ-

‘তুমি বল, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। যদি তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে (তারা জেনে রাখুক যে) আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না’ (আলে ইমরান ৩/৩২)। অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা কাফেরদের স্বভাব। যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন না।

সূরা বাকারাতে–

১২০. আর ইয়াহুদী ও নাসারারা আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করেন। বলুন নিশ্চয় আল্লাহর হেদায়াতই প্রকৃত হেদায়াত। আর যদি আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেন আপনার কাছে জ্ঞান আসার পরও, তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার কোন অভিভাবক থাকবে না এবং থাকবে না কোন সাহায্যকারীও।

সুরা আনকাবুতে ১২-১৩ আয়াতে এসেছে-

এ কাফেররা মু’মিনদেরকে বলে, তোমরা আমাদের পথ অনুসরণ করো এবং আমরা তোমাদের গুনাহখাতাগুলো নিজেদের ওপর চাপিয়ে নেবো, অথচ তাদের গুনাহখাতার কিছুই তারা নিজের ওপর চাপিয়ে নেবে না,  তারা ডাহা মিথ্যা বলছে৷

হ্যাঁ নিশ্চয়ই তারা নিজেদের বোঝাও বইবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে অন্য অনেক বোঝাও৷  আর তারা যে মিথ্যাচার চালিয়ে এসেছে কিয়ামতের দিন নিশ্চয়ই তাদেরকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে৷

যে ব্যক্তি সঠিক পথের দিকে আহ্বান জানায় সে তাদের সমান প্রতিদান পাবে যারা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করে , এ জন্য তাদের প্রাপ্য কোন কমতি করা হবে না৷ আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর দিকে আহ্বান জানায় সে তাদের সবার সমান গোনাহের ভাগী হবে যারা তার অনুসরণ করে এবং এ জন্য তাদের গোনাহের মধ্যে কোন কমতি করা হবে না৷ ” (মুসলিম)

সূরা নহলে এসেছে-

“যাতে কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের বোঝাও পুরোপুরি বহন করে এবং এমনসব লোকদের বোঝার একটি অংশও বহন করে যাদেরকে তারা জ্ঞান ছাড়াই গোমরাহ করে৷” (আন নাহলঃ ২৫)

এ ছাড়াও তাঁর নির্দেশ হচ্ছে এইঃ এটিই আমার সোজা পথ৷ তোমরা এ পথেই চলো এবং অন্য পথে চলো না৷ কারণ তা তোমাদের তাঁর পথ থেকে সরিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে৷ এ হেদায়াত তোমাদের রব তোমাদেরকে দিয়েছেন, সম্ভবত তোমরা বাঁকা পথ অবলম্বন করা থেকে বাঁচতে পারবে৷  আনকাবুতঃ১৫৩

মহান আল্লাহ বলেন,

“হে ইমানদারগন, আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হও।” [সুরা আত্-তাওবা, আয়াত : ১১৯]

৩:১৫০ بَلِ اللّٰہُ مَوۡلٰىکُمۡ ۚ وَ ہُوَ خَیۡرُ النّٰصِرِیۡنَ ﴿

১৫০. বরং আল্লাহই তো তোমাদের অভিভাবক এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।

আল্লাহ সুরা বাকারাতে এই কথাটি এইভাবে জানিয়েছেন—

বাকারাঃ ২৫৭. আল্লাহ তাদের অভিভাবক যারা ঈমান আনে, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান। আর যারা কুফরী করে তাগূত তাদের অভিভাবক, এরা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।

বাকারাঃ ১০৭. আপনি কি জানেন না যে, আসমান ও যমীনের সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর? আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবকও নেই, নেই সাহায্যকারীও।

নিশ্চয় মানুষের মধ্যে তারাই ইবরাহীমের ঘনিষ্ঠতম যারা তার অনুসরণ করেছে এবং এ নবী ও যারা ঈমান এনেছে; আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক। আলে ইমরানঃ৬৮

নবী করীম (সাঃ)-কে ইবরাহীম (আঃ)-এর মিল্লাতের অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا]

এ ছাড়া হাদীসেও মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘নবীদের মধ্য থেকে প্রত্যেক নবীর কিছু বন্ধু হয়, তাঁদের মধ্য থেকে আমার বন্ধু হল আমার পিতা এবং আমার মহান প্রতিপালকের খলীল (অতীব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইবরাহীম (আঃ))।’’ অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেন। (তিরমিযী ২৯৯৫নং)

আল্লাহ তোমাদের শক্ৰদেরকে ভালভাবে জানেন। আর অভিভাবকত্বে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সাহায্যেও আল্লাহই যথেষ্ট। সূরা নিসাঃ ৪৫

নিশ্চয় তারা আল্লাহ্‌র মুকাবেলায় আপনার কোনই কাজে আসবে না; আর নিশ্চয় যালিমরা একে অন্যের বন্ধু; এবং আল্লাহ মুত্তাকীদের বন্ধু। জাসিয়াঃ১৯

আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে সব নবি রাসুলদের প্রকৃত অভিভাবক ছিলেন, যা তিনি কুরআনে তুলে ধরেছেন। যেমন অভিভাবক ছিলেন হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের। কুরআনের ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে পালনকর্তা আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতাও দান করেছেন এবং আমাকে বিভিন্ন তাৎপর্য সহ ব্যাখ্যা করার বিদ্যা শিখিয়ে দিয়েছেন। হে নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের স্রষ্টা, আপনিই আমার কার্যনির্বাহী ইহকাল ও পরকালে। আমাকে ইসলামের উপর মৃত্যুদান করুন এবং আমাকে স্বজনদের সাথে মিলিত করুন।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ১০১)

৩:১৫১ سَنُلۡقِیۡ فِیۡ قُلُوۡبِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوا الرُّعۡبَ بِمَاۤ اَشۡرَکُوۡا بِاللّٰہِ مَا لَمۡ یُنَزِّلۡ بِہٖ سُلۡطٰنًا ۚ وَ مَاۡوٰىہُمُ النَّارُ ؕ وَ بِئۡسَ مَثۡوَی الظّٰلِمِیۡنَ

১৫১. অচিরেই আমরা কাফেরদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব, যেহেতু তারা আল্লাহর সাথে শরীক করেছে, যার সপক্ষে আল্লাহ কোন সনদ পাঠাননি। আর জাহান্নাম তাদের আবাস এবং কত নিকৃষ্ট আবাস যালেমদের।

মুসলিমদের পরাজয় দেখে কোন কোন কাফেরের অন্তরে এই খেয়াল জন্মালো যে, মুসলিমদেরকে একেবারে নিঃশেষ করে দেওয়ার এটা অতি উত্তম সুযোগ। ঠিক এই মুহূর্তে মহান আল্লাহ তাদের অন্তরে মুসলিমদের ভয় ঢুকিয়ে দিলেন। ফলে তারা নিজেদের পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সাহস করতে পারেনি। (ফাতহুল ক্বাদীর) বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘আমাকে পাঁচটি এমন জিনিস দেওয়া হয়েছে, যা আমার পূর্বে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। তার মধ্যে একটি হল, এক মাসের দূরত্বে অবস্থিত শত্রুর অন্তরে আমার ত্রাস (ভয়) ঢুকিয়ে দিয়ে আমার সাহায্য করা হয়েছে।’’

এই হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, রসূল (সাঃ)-এর ভয় স্থায়ীভাবে শত্রুর অন্তরে ভরে দেওয়া হয়েছিল। আর এই আয়াত দ্বারা জানা যায় যে, রসূল (সাঃ)-এর সাথে তাঁর উম্মত অর্থাৎ, মুসলিমদের ভয়ও মুশরিকদের অন্তরে ভরে দেওয়া হয়েছে এবং তার কারণ হল, তাদের শিরক। অর্থাৎ, শিরককারীদের অন্তর সব সময় অন্যের ত্রাস ও ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। আর সম্ভবতঃ এই কারণেই মুসলিমদের এক বিরাট সংখ্যা শিরকী আকীদা ও আমলে জড়িয়ে পড়ার ফলে শত্রুরা তাদেরকে ভয় করে না, বরং তারাই শত্রুদের ভয় ও ত্রাসে ভীত-সন্ত্রস্ত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আমাকে একমাসে অতিক্রম করার মত রাস্তার দূরত্ব থেকে কাফেরদের মনে ভয় ঢুকিয়ে সাহায্য করা হয়েছে।” [বুখারীঃ ৩৩৫, মুসলিমঃ ৫২১, ৫২৩]

 

৩:১৫২ وَ لَقَدۡ صَدَقَکُمُ اللّٰہُ وَعۡدَہٗۤ اِذۡ تَحُسُّوۡنَہُمۡ بِاِذۡنِہٖ ۚ حَتّٰۤی اِذَا فَشِلۡتُمۡ وَ تَنَازَعۡتُمۡ فِی الۡاَمۡرِ وَ عَصَیۡتُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَاۤ اَرٰىکُمۡ مَّا تُحِبُّوۡنَ ؕ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّرِیۡدُ الدُّنۡیَا وَ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّرِیۡدُ الۡاٰخِرَۃَ ۚ ثُمَّ صَرَفَکُمۡ عَنۡہُمۡ لِیَبۡتَلِیَکُمۡ ۚ وَ لَقَدۡ عَفَا عَنۡکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ ذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿

১৫২. অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের সাথে তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিনাশ করছিলে, যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করলে এবং যা তোমরা ভালবাস তা তোমাদেরকে দেখাবার পর তোমরা অবাধ্য হলে। তোমাদের কিছু সংখ্যক দুনিয়া চাচ্ছিল এবং কিছু সংখ্যক চাচ্ছিল আখেরাত। তারপর তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য তাদের (তোমাদের শক্ৰদের) থেকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে দিলেন। অবশ্য তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন এবং আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আয়াতের এ অংশ নাযিল হবার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের মধ্যে কেউ দুনিয়া চায়, এটি আমার ধারনাও আসে নি। [মুসনাদে আহমাদ ১/৪৬৩]

বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদের যুদ্ধে পঞ্চাশ জনের এক দল সাহাবীকে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের নেতৃত্বে দিয়ে বললেনঃ যদি তোমরা দেখ যে, পাখি আমাদেরকে ছুঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে তাতেও তোমরা তোমাদের স্থান ত্যাগ করে যাবে না। যতক্ষন না আমি তোমাদেরকে ডেকে পাঠাই। অনুরূপভাবে যদি তোমরা দেখ যে, আমরা শক্রদের পর্যুদস্ত করে দিয়েছি তাতেও তোমরা স্থান ত্যাগ করবে না যতক্ষণ আমি তোমাদের ডেকে না পাঠাই। তারপর মুসলিমগণ কাফেরদের পরাজিত করল। বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি মহিলাদের চুড়ি, পায়ের গোড়ালি ইত্যাদিও দেখছিলাম, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের সাথীগণ বলতে আরম্ভ করলঃ গনীমতের মাল এসে পড়েছে, তোমাদের সাথীরা কাফেরদের উপর জয়লাভ করেছে, সুতরাং তোমরা কিসের অপেক্ষা করছ?

আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর তাদেরকে বললেনঃ তোমরা কি রাসূলের নির্দেশ ভুলে গেছ? তারা বললঃ আমরা মানুষের কাছে গিয়ে গনীমতের মাল জমা করব। একথা বলে তারা স্থান ত্যাগ করতে আরম্ভ করল। আর এতেই যুদ্ধের পট পরিবর্তিত হয়ে জয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হয়ে গেল। সবাই পালাতে আরম্ভ করল। রাসূলের সাথে মাত্র বার জন লোক ছিল। রাসূল তাদেরকে ডাকতে থাকলেন। এভাবে মুসলিমদের সত্তর জন লোক শহীদ হয়ে গেল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথীরা বদরের দিন একশত চল্লিশ জন কাফেরকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছিলেন, তাদের সত্তর জন মারা যায় আর বাকী সত্তর জন আহত হয়ে বন্দী হয়। তখন আবু সুফিয়ান তিন বার বললঃ এখানে কি মুহাম্মাদ আছে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবায়ে কেরামকে উত্তর দিতে নিষেধ করলেন। তারপর আবু সুফিয়ান তিন বার বললঃ এখানে কি ইবনে আবি কুহাফা আছে? তারপর আবু সুফিয়ান তিনবার বললঃ এখানে কি ইবনুল খাত্তাব আছে? তারপর সে তার সাথীদের কাছে ফিরে গিয়ে বললঃ এরা সবাই মারা পড়েছে। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না। তিনি বলে বসলেনঃ হে আল্লাহর দুশমন! তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি যাদের কথা বলেছ তারা সবাই জীবিত। আর তোমার যাতে খারাপ লাগে তা অবশ্যই বাকী আছে।

তখন আবু সুফিয়ান বলে বসলঃ বদরের দিনের বদলে একটি দিন হলে আজ। আর যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছেই। তুমি তোমাদের মৃতদের মাঝে কিছু বিকৃত লাশ দেখতে পাবে। আমি বিকৃত করার নির্দেশ দেইনি। কিন্তু আমার খারাপও লাগেনি। তারপর সে আবৃতি করতে লাগলঃ হুবলের জয় হোক, হুবলের জয় হোক। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা কি তার জবাব দিবে না? সাহাবায়ে কেরাম বললেনঃ আমরা কি বলব? তিনি বললেনঃ ‘তোমরা বলঃ আল্লাহ মহান ও সর্বোচ্চ। তখন আবু সুফিয়ান বললঃ আমাদের উযযা আছে তোমাদের উযযা নেই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা জবাব দিবে না? সাহাবগণ বললেনঃ কি জবাব দেব? তিনি বললেনঃ বল যে, আল্লাহ্‌ আমাদের অভিভাবক-সাহায্যকারী, তোমাদের কোন অভিভাবক-সাহায্যকারী নেই। [বুখারীঃ ৩০৩৯, ৩৯৮৬, ৪০৪৩, ৪০৬৭, ৪৫৬১]

সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের কর্মে ত্রুটি ও অবহেলা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাঁদেরকে যে মর্যাদা-সম্মান দান করেছেন, সে কথাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁরা যাতে ভবিষ্যতে আর ভুল না করেন। তাই মহান আল্লাহ তাঁদের ভুলের কথা উল্লেখ করে তাঁদের ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছেন। যাতে মন্দ অন্তরের লোকেরা তাঁদের ব্যাপারে কোন কটূক্তি না করতে পারে।

কারণ, মহান আল্লাহই যখন কুরআনে কারীমে তাঁদের ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, তখন অন্যের কি এ ব্যাপারে আর কোন নিন্দাপূর্ণ বাক্য ব্যবহার ও কটূক্তি করার অবকাশ থাকে?

সহীহ বুখারীতে একটি ঘটনা উল্লেখ আছে যে, কোন এক হজ্জের সময় এক ব্যক্তি উষমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপন করল। যেমন, তিনি বদর যুদ্ধে এবং বায়আতে রিযওয়ানে শরীক হননি এবং উহুদের যুদ্ধে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইবনে উমার (রাঃ) (এই অভিযোগ খন্ডন করে) বললেন, বদর যুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রী (রসূল (সাঃ)-এর কন্যা) অসুস্থ ছিলেন। বায়আতে রিযওয়ানে তিনি রসূল (সাঃ)-এর দূত হয়ে মক্কায় গিয়েছিলেন এবং উহুদের দিনে পালিয়ে যাওয়াকে তো আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। (বুখারী, উহুদের যুদ্ধ পরিচ্ছেদ)

 

৩:১৫৩ اِذۡ تُصۡعِدُوۡنَ وَ لَا تَلۡوٗنَ عَلٰۤی اَحَدٍ وَّ الرَّسُوۡلُ یَدۡعُوۡکُمۡ فِیۡۤ اُخۡرٰىکُمۡ فَاَثَابَکُمۡ غَمًّۢا بِغَمٍّ لِّکَیۡلَا تَحۡزَنُوۡا عَلٰی مَا فَاتَکُمۡ وَ لَا مَاۤ اَصَابَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ

১৫৩. স্মরণ কর, তোমরা যখন উপরের (পাহাড়ের) দিকে ছুটছিলে এবং পিছন ফিরে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলে না, আর রাসূল তোমাদেরকে পিছন দিক ডাকছিলেন। ফলে তিনি তোমাদেরকে বিপদের উপর বিপদ দিলেন, যাতে তোমরা যা হারিয়েছ এবং যে বিপদ তোমাদের উপর এসেছে তার জন্য তোমরা দুঃখিত না হও। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।

কাফেরদের একাধারে হঠাৎ আক্রমণের ফলে মুসলিমদের মধ্যে যে ছত্রভঙ্গ অবস্থা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং তাঁদের অনেকেই যে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যান, এখানে সেই চিত্রই তুলে ধরা হচ্ছে। تُصْعِدُوْنَ ক্রিয়াপদ إِصْعَادٌ ক্রিয়ামূল থেকে গঠিত। যার অর্থ হল, উপত্যকা বেয়ে (পাহাড়ে) চড়া কিংবা পালিয়ে যাওয়া।

নবী করীম (সাঃ) তাঁর কিছু সাথী সহ পিছনে ছিলেন। তিনি তাঁদেরকে ডাক দিয়ে বলছিলেন, ‘‘আল্লাহর বান্দারা! আমার দিকে ফিরে এসো। আল্লাহর বান্দারা! আমার দিকে ফিরে এসো।’’ কিন্তু সেই চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতিতে তাঁর এই ডাক কে শোনে?

সামান্য ত্রুটির কারণে তোমাদের উপর নেমে এল দুঃখের উপর দুঃখ। ইবনে জারীর এবং ইবনে কাসীরের নিকট প্রাধান্য প্রাপ্ত উক্তি অনুযায়ী প্রথম ‘গাম্ম’ (দুঃখ)এর অর্থ, গনীমতের মাল এবং কাফেরদের উপর বিজয় লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ‘গাম্ম’ (দুঃখ)।

আর দ্বিতীয় ‘গাম্ম’ (দুঃখ)এর অর্থ, মুসলিমদের শহীদ ও আহত হওয়ার ‘গাম্ম’ (দুঃখ) এবং নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশের বিরোধিতা ও তাঁর শহীদ হওয়ার মিথ্যা খবর থেকে সৃষ্ট দুঃখ।

অর্থাৎ, তোমাদের উপর দুঃখের উপর দুঃখ আপতিত হওয়ার কারণ হল, যাতে তোমাদের মধ্যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার শক্তি এবং দৃঢ়সংকল্প ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়।

৩:১৫৪ ثُمَّ اَنۡزَلَ عَلَیۡکُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ الۡغَمِّ اَمَنَۃً نُّعَاسًا یَّغۡشٰی طَآئِفَۃً مِّنۡکُمۡ ۙ وَ طَآئِفَۃٌ قَدۡ اَہَمَّتۡہُمۡ اَنۡفُسُہُمۡ یَظُنُّوۡنَ بِاللّٰہِ غَیۡرَ الۡحَقِّ ظَنَّ الۡجَاہِلِیَّۃِ ؕ یَقُوۡلُوۡنَ ہَلۡ لَّنَا مِنَ الۡاَمۡرِ مِنۡ شَیۡءٍ ؕ قُلۡ اِنَّ الۡاَمۡرَ کُلَّہٗ لِلّٰہِ ؕ یُخۡفُوۡنَ فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ مَّا لَا یُبۡدُوۡنَ لَکَ ؕ یَقُوۡلُوۡنَ لَوۡ کَانَ لَنَا مِنَ الۡاَمۡرِ شَیۡءٌ مَّا قُتِلۡنَا ہٰہُنَا ؕ قُلۡ لَّوۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ بُیُوۡتِکُمۡ لَبَرَزَ الَّذِیۡنَ کُتِبَ عَلَیۡہِمُ الۡقَتۡلُ اِلٰی مَضَاجِعِہِمۡ ۚ وَ لِیَبۡتَلِیَ اللّٰہُ مَا فِیۡ صُدُوۡرِکُمۡ وَ لِیُمَحِّصَ مَا فِیۡ قُلُوۡبِکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ

১৫৪. তারপর দুঃখের পর তিনি তোমাদেরকে তন্দ্রারূপে প্রশান্তি, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করেছিল এবং একদল জাহিলী যুগের অজ্ঞের ন্যায় আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা করে নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল এ বলে যে, আমাদের কি কোন কিছু করার আছে? বলুন, সব বিষয় আল্লাহরই ইখতিয়ারে। যা তারা আপনার কাছে প্রকাশ করে না, তারা তাদের অন্তরে সেগুলো গোপন রাখে। তারা বলে, এ ব্যাপারে আমাদের কোন কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না। বলুন, যদি তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান করতে তবুও নিহত হওয়া যাদের জন্য অবধারিত ছিল তারা নিজেদের মৃত্যুস্থানে বের হত। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা পরীক্ষা করেন এবং তোমাদের মনে যা আছে তা পরিশোধন করেন। আর অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবগত।

অর্থাৎ এ কঠিন বিপদের সময় তাদের উপর তন্দ্রা নেমে এসে তাদেরকে প্রশান্ত করে দিচ্ছিল। আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা ওহুদের দিন কাতারবন্দী অবস্থাতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম। এমনকি আমাদের হাত থেকে তরবারী পড়ে যাচ্ছিল আর আমি বারবার তা উঠিয়ে নিচ্ছিলাম। [বুখারী ৪৫৬২]

আর এটাই আল্লাহর বাণী “তারপর দুঃখের পর তিনি তোমাদেরকে প্রদান করলেন তন্দ্রারূপে প্রশান্তি, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করেছিল, এবং একদল জাহিলী যুগের অজ্ঞের ন্যায় আল্লাহ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা করে নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল” এর তাৎপর্য। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যুদ্ধের মধ্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর সালাতের মধ্যে শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। [ইবন আবী হাতেম আত-তাফসীরুস সহীহ]

এখানে আরেক দল বলে মুনাফিকদের বুঝানো হয়েছে। তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তারা সবচেয়ে ভীতু ও কাপুরুষ ও হকের বিপরীতে অবস্থানকারী সম্প্রদায় ছিল। [তাবারী] আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ উহুদের যুদ্ধের দিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, আল্লাহ আমাদের উপর ঘুম পাঠালেন, আমাদের প্রত্যেকের থুতনি বুকে লেগে যাচ্ছিল। আল্লাহর শপথ আমি যেন মু’আত্তাব ইবনে কুসাইরের কথা স্বপ্নের মাঝে শুনছিলাম। সে বলছিলঃ ‘এ ব্যাপারে আমাদের কোন কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না’ এ ব্যাপারেই আল্লাহর উপরোক্ত বাণী নাযিল হয়। [আল-আহাদিসুল মুখতারাহঃ ৩/৬০, ৮৬৪]

এ থেকে মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে তারা কেবল নিজেদের প্রাণ নিয়েই চিন্তিত ছিল।

যেমন ভাবত যে, নবী করীম (সাঃ)-এর সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই মিথ্যা। তিনি যে দ্বীনের প্রতি আহবান করেন, তার ভবিষ্যৎ আশঙ্কাজনক। তিনি তো আল্লাহর সহযোগিতা থেকেই বঞ্চিত ইত্যাদি ইত্যাদি।

অর্থাৎ, আমাদের জন্য কি আল্লাহর পক্ষ হতে আর কোন বিজয় ও সহযোগিতার সম্ভাবনা আছে? অথবা আমাদের কি কোন কথা চলতে পারে এবং মেনে নেওয়া যেতে পারে?

তোমাদের কিংবা শত্রুদের এখতিয়ারে কিছুই নেই। সাহায্য-সহযোগিতা তাঁর পক্ষ থেকেই আসবে, সফলতা তিনিই দান করবেন এবং আদেশ-নিষেধ কেবল তাঁরই চলবে।

নিজেদের অন্তরে মুনাফিক্বী গোপন রেখে ভাব এমন দেখাত যে, তারা পথ নির্দেশের মুখাপেক্ষী।

এটা তারা আপোসে বলাবলি করত অথবা মনে মনে বলত।

মহান আল্লাহ বললেন, এই ধরনের কথার লাভ কি? যেভাবেই হোক না কেন, মৃত্যু তো আসবেই এবং তা সেই স্থানেই আসবে, যেখানে আল্লাহর পক্ষ হতে লিখে দেওয়া হয়েছে। যদি তোমরা নিজেদের বাড়িতে অবস্থান কর, আর তোমাদের মৃত্যু কোন যুদ্ধের ময়দানে লিখা থাকে, তাহলে আল্লাহ কর্তৃক এই ফায়সালা তোমাদেরকে সেখানেই টেনে নিয়ে যাবে।

(যুদ্ধের ময়দানে) যা কিছু ঘটেছে তার পিছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল, তোমাদের অন্তরে বিদ্যমান ঈমানকে পরীক্ষা করা (যাতে মুনাফিকরা তোমাদের থেকে পৃথক হয়ে যায়) এবং তোমাদের অন্তঃকরণকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে পবিত্র করা।

অর্থাৎ, খাঁটি মুসলিম কে এবং মুনাফিক হয়ে বাহ্যিকভাবে ইসলামের পোশাক কে পরে আছে, তা তো তিনি জানেন। জিহাদের বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে এটাও একটি কৌশল যে, এতে মু’মিন ও মুনাফিকের প্রকৃত রূপ বিকশিত হয়ে সামনে চলে আসে; ফলে সাধারণ মানুষও তাদেরকে দেখে ও চিনে নিতে পারে।

৩:১৫৫ اِنَّ الَّذِیۡنَ تَوَلَّوۡا مِنۡکُمۡ یَوۡمَ الۡتَقَی الۡجَمۡعٰنِ ۙ اِنَّمَا اسۡتَزَلَّہُمُ الشَّیۡطٰنُ بِبَعۡضِ مَا کَسَبُوۡا ۚ وَ لَقَدۡ عَفَا اللّٰہُ عَنۡہُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ حَلِیۡمٌ ﴿

১৫৫. যেদিন দু’ দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল সেদিন তোমাদের মধ্য থেকে যারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল, তাদের কোন কৃতকর্মের ফলে শয়তানই তাদের পদস্খলন ঘটিয়েছিল। অবশ্য আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাপরায়ণ ও পরম সহনশীল।

সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা ও বিশ্বাস এই যে, যদিও সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম নিস্পাপ নন, তাদের দ্বারা বড় কোন পাপ সংঘটিত হয়ে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু তা সত্বেও উম্মতের জন্য তাদের কোন দোষচর্চা কিংবা দোষ আরোপ করা জায়েয নয়। আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদের এত বড় পদস্খলন ও অপরাধ মার্জনা করে তাদের প্রতি দয়া ও করুণাপূর্ণ ব্যবহার করেছেন এবং তাদের (رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ) অর্থাৎ “তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট” [সূরা আত-তাওবাহঃ ১০০, সূরা আল-মুজাদালাহঃ ২২]

-এ মহাসম্মানজনক মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, তখন তাদেরকে কোন প্রকার অশালীন উক্তিতে স্মরণ করার কোন অধিকার অপর কারো পক্ষে কেমন করে থাকতে পারে? সে জন্যই এক সময় কোন এক সাহাবী যখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য কয়েকজন সাহাবী সম্পর্কে ওহুদ যুদ্ধের এই ঘটনার আলোচনায় বলেছেন যে, এরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বললেনঃ আল্লাহ নিজে যে বিষয়ের ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছেন, সে বিষয়ে সমালোচনা করার কোন অধিকার কারো নেই। [বুখারী ৪০৬৬]

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আহলে-সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা হলো সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যেসব মতবিরোধ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটেছে, সে সম্পর্কে কারো প্রতি কোন আপত্তি উত্থাপন কিংবা প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা। কারণ, ইতিহাসে যেসব বর্ণনায় তাদের ক্রটি-বিচূতিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মিথ্যা ও ভ্রান্ত; যা শক্ররা রটিয়েছে। আর কোন কোন ব্যাপার রয়েছে যে গুলোতে কম-বেশী করা হয়েছে এবং যেগুলো প্রকৃতই শুদ্ধ সেগুলোও একান্তই সাহাবীগণের স্ব স্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে বিধায় তাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করা সমীচীন নয়। বস্তুতঃ ঘটনা বিশেষের মধ্যে যদি তারা সীমালজান করেও থাকেন, তবুও আল্লাহ তা’আলার রীতি হলো (إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ) সৎকাজের মাধ্যমে অসৎ কর্মের কাফফারা হয়ে যায়। বলাবাহুল্য সাহাবায়ে কেরামের সৎকর্মের সমান অন্য কারো কর্মই হতে পারে না। কাজেই তারা আল্লাহ্ তা’আলার ক্ষমার যতটুকু যোগ্য, তেমন অন্য কেউ নয়। সে জন্যই তাদের আমল সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার অন্য কারো নেই। তাদের ব্যাপারে কটুক্তি বা অশালীন মন্তব্য করার অধিকারও অন্য কারো নেই। [আল-আকিদাতুল ওয়াসেতিয়্যা]

তাফসিরে যাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন, আহসানুল বায়ান সংগৃহিত