সূরা আলে ইমরান ১৫ তম রুকু(১৪৪-১৪৭)+১৪৮

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

 

৩:১৪৪ وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوۡلٌ ۚ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِہِ الرُّسُلُ ؕ اَفَا۠ئِنۡ مَّاتَ اَوۡ قُتِلَ انۡقَلَبۡتُمۡ عَلٰۤی اَعۡقَابِکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّنۡقَلِبۡ عَلٰی عَقِبَیۡہِ فَلَنۡ یَّضُرَّ اللّٰہَ شَیۡئًا ؕ وَ سَیَجۡزِی اللّٰہُ الشّٰکِرِیۡنَ

১৪৪. আর মুহাম্মদ একজন রাসূল মাত্র; তার আগে বহু রাসূল গত হয়েছেন। কাজেই যদি তিনি মারা যান বা নিহত হন তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? আর কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না; আর আল্লাহ্‌ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন।

 

ওহুদ যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.)’র শাহাদাতের গুজব উঠেছিল। শত্রু সেনাদের আঘাতের ফলে রাসূল (সা.)এর কপাল থেকে রক্ত এমনভাবে গড়িয়ে পড়ছিল যে শত্রুদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলে ওঠে ‘মুহাম্মাদ’ নিহত হয়েছে। এই গুজব ছড়িয়ে পড়ায় কাফেররা উৎফুল্ল হয় এবং তাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে কোন কোন মুসলমানের মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং কেউ কেউ পালিয়ে যান। অবশ্য এ সময় অনেক মুসলমান তাদের উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে বলে ওঠেন মুহাম্মাদ যদি নাও থাকেন, তাঁর পথ ও তার খোদা তো জীবিত, কেন পালিয়ে যাচ্ছ? আল্লাহ এই আয়াতে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলছেন, তোমাদের আগেও অনেক নবী গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা মারা যাওয়ায় তাঁদের অনুসারীরা ধর্মের পথ থেকে ফিরে যায়নি । তাহলে তোমরা কেন মুহাম্মাদ (সা.) এর মৃত্যুর ফলে এত তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে গেছ এবং পালানোর চিন্তা করছ? অথচ তোমাদের নবী এখনও জীবিত এবং তাঁর মৃত্যুর কথা শত্রুদের গুজবমাত্র। মহানবী (সা.)কে পাওয়ার নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা কি এটা যে এত সহজেই তার ধর্ম থেকে ফিরে যাবে?

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাহাদাতের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অধিকাংশ সাহাবী সাহস হারিয়ে ফেলেন৷ এ অবস্থায় মুনাফিকরা (যারা মুসলমানদের সাথে সাথেই ছিল) বলতে থাকেঃ চলো আমরা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কাছে যাই৷ সে আমাদের জন্য আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে নিরাপত্তা এনে দেবে৷ আবার কেউকেউ এমন কথাও বলে ফেলেঃ যদি মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রসূলই হতেন,তাহলে নিহত হলেন কেমন করে? চলো, আমাদের বাপ-দাদাদের ধর্মের দিকে ফিরে যাই৷ এ সমস্ত কথার জবাবে বলা হচ্ছে, তোমাদের “সত্যপ্রীতি” যদি কেবল মুহাম্মাদের (সা) ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে এবং তোমাদের ইসলাম যদি এতই দুর্বল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে যে, মুহাম্মাদের (সা) দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার সাথে সাথে তোমরা আবার সেই কুফরীর দিকে ফিরে যাবে, যা থেকে তোমরা বের হয়ে এসেছিলে, তাহলে আল্লাহর দীন তোমাদের কোন প্রয়োজন অনুভব করে না৷

এই আয়াত থেকে জানা যায়-

অন্যান্য মানুষের মত নবীগণও প্রাকৃতিক বিধান তথা জীবন ও মৃত্যুর আওতাধীন। তাই নবীগণ চিরদিন বাঁচবেন এমন আশা করা উচিত নয়।

নবীগণের বয়স বা পার্থিব জীবন সীমিত। কিন্তু তাদের আদর্শ সীমিত নয়। আমরা আল্লাহর ইবাদত করব, কোন ব্যক্তির ইবাদত করব না। তাই ইসলাম ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কোন অবকাশ নেই।

মানুষ আল্লাহর ধর্ম থেকে দূরে সরে গেলে তাতে আল্লাহর ক্ষতি হয় না। কারণ, আল্লাহ মানুষের ইবাদত ও বন্দেগীর মুখাপেক্ষী হওয়া তো দূরের কথা, মানুষের কাছে কোনো ব্যাপারেই মুখাপেক্ষী নন।

আমাদের ঈমানকে এতটা দৃঢ় করা উচিত যে, মহানবী (সা.)’র মত ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতেও যেন ঈমান মোটেই নড়বড়ে না হয়।

 

৩:১৪৫ وَ مَا کَانَ لِنَفۡسٍ اَنۡ تَمُوۡتَ اِلَّا بِاِذۡنِ اللّٰہِ کِتٰبًا مُّؤَجَّلًا ؕ وَ مَنۡ یُّرِدۡ ثَوَابَ الدُّنۡیَا نُؤۡتِہٖ مِنۡہَا ۚ وَ مَنۡ یُّرِدۡ ثَوَابَ الۡاٰخِرَۃِ نُؤۡتِہٖ مِنۡہَا ؕ وَ سَنَجۡزِی الشّٰکِرِیۡنَ

১৪৫. আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু সেটার মেয়াদ সুনির্ধারিত(১)। কেউ পার্থিব পুরস্কার চাইলে আমরা তাকে তার কিছু দিয়ে থাকি এবং কেউ আখেরাতের পুরস্কার চাইলে আমরা তাকে তার কিছু দিয়ে থাকি এবং শীঘ্রই আমরা কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবো।

যুদ্ধ বা জিহাদের ময়দান থেকে মানুষের পালিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো মৃত্যুর ভয়। তাই এ আয়াতে বলা হচ্ছে- মানুষের মৃত্যু তো একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাধীন। হয়তো অনেক বৃদ্ধ মানুষও জিহাদের ময়দান থেকে বিজয়ী হয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পারে, আবার অনেক যুবকও ভীত হয়ে পালিয়ে যাবার পর রণাঙ্গনের বাইরে কোন দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারে। এরপর কোরআন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মনের ইচ্ছার কথা উল্লেখ করে বলছে- অনেকে গনীমত বা যুদ্ধে পাওয়া সম্পদের অংশীদার হবার জন্যেই যুদ্ধে অংশ নেয় এবং তা পেয়েও যায়। আবার অনেকে পরকালের পুরস্কার পাবার আশায় বা শাহাদাতের মর্যাদা লাভের জন্যেই জিহাদে অংশ নেয় এবং এদের উদ্দেশ্যও পূরণ হয়।

এ থেকে মুসলমানদের একথা বুঝানো হয়েছে যে, মৃত্যুর ভয়ে তোমাদের পালিয়ে যাওয়ার কোন অর্থ নেই ৷ মৃত্যুর জন্য আল্লাহ যে সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তার আগে কেউ মরতে পারে না এবং তার পরেও কেউ জীবিত থাকেত পারে না৷ কাজেই তোমরা মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার চিন্তা না করে বরং জীবিত থাকার জন্য যে সময়টুকু পাচ্ছো সেই সময়ে তোমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যে দুনিয়া না আখেরাত কোন্‌টি হবে, এ ব্যাপারে চিন্তা করো৷

. পুরস্কার মানে কাজের ফল৷ দুনিয়ার পুরস্কার মানে, মানুষ তার প্রচেষ্টা ও কাজের ফল স্বরূপ এ দুনিয়ার জীবনে যে লাভ, ফায়দা ও মুনাফা হাসিল করে৷ আর আখেরাতের পুরস্কার মানে হচ্ছে, ঐ প্রচেষ্টা ও কাজের বিনিময়ে মানুষ তার আখেরাতের চিরন্তন জীবনের জন্য যে ফায়দা, লাভ ও মুনাফা অর্জন করবে৷ জীবন যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ যে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সে ক্ষেত্রে তার দৃষ্টি ইহকালীন না পরকালীন ফল প্রাপ্তির দিকে নিবদ্ধ থাকবে, ইসলামের দৃষ্টিতে মানবিক নৈতিকতার ক্ষেত্রে এটিই হচ্ছে চূড়ান্ত এ সিদ্ধান্তকারী প্রশ্ন৷

. শোকরকারী বলতে এমন সব লোকের কথা বলা হয়েছে যারা আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের কদর করে৷ আল্লাহর এই বিশেষ নিয়ামতটি হচ্ছেঃ তিনি মানুষকে দীনের সঠিক ও নির্ভুল শিক্ষা দিয়েছেন৷ এ শিক্ষার মাধ্যমে তিনি মানুষকে এ দুনিয়া ও এর সীমিত জীবনকাল থেকে অনেক বেশী ব্যাপক একটি অনন্ত ও সীমাহীন জগতের সন্ধান দিয়েছেন এবং তাকে এ অমোঘ সত্যটিও জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানষের প্রচেষ্টা, সংগ্রাম-সাধনা ও কাজের ফল কেবলমাত্র এ দুনিয়ার কয়েক বছরের জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এ জীবনের পর আর একটি অনন্ত অসীম জগতে এর বিস্তার ঘটবে ৷ এ দৃষ্টির বাপকতা, দূরদর্শন ক্ষমতা ও পরিণামদর্শিতা অর্জিত হবার পর যে ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমকে এ দুনিয়ার জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে ফলপ্রসু হতে দেখে না অথবা তার বিপরীত ফল লাভ করতে দেখে এবং এ সত্ত্বে এ আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ করতে থাকে, কেননা আল্লাহ তাকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, আখেরাতে সে অবিশ্য এর ভালো ফল পাবে- এহেন ব্যক্তিই হচ্ছে আল্লাহর শোকর গুজার বান্দা৷ এর বিপরীতে যারা এরপরও সংকীর্ণ বৈষয়িক স্বার্থ পূজায় নিমগ্ন থাকে এবং দুনিয়ায় সঠিক প্রেচষ্টাগুলোর ফলবতী হবার আশা থাকে না অথবা সেগুলো ক্ষতি হবার আশংকা থাকে, সেখানে আখেরাতে সেগুলোর ভালো ফলের আশায় তাদের জন্য নিজেদের সময়, অর্থ-সম্পদ ও শক্তি-সামর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত হয় না, তারাই সত্যিকার অর্থে না-শোকরগুজার ও অকৃতজ্ঞ বান্দা৷ আল্লাহ তাদেরকে যে জ্ঞান দান করেছেন তাদের কাছে সেই জ্ঞানের কোন মূল্য নেই৷

(শোকর ও কৃতজ্ঞতা : ফযীলত ও পদ্ধতি

শিব্বীর আহমদ) সংগৃহিত

খোলাফায়ে রাশেদিনের বাইরে দু-চারজন সাহাবীর নামও যাদের জানা আছে, কিংবা মাঝেমধ্যে হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবীগণের  নাম যারা পড়েন বা শোনেন, তাদের কারও কাছেই ‘হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা.’ নামটি অজানা থাকার কথা নয়। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তাঁর এই প্রিয় সাহাবীটির হাত ধরে বললেন, ‘মুআয! আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ জানের শত্রু কুরাইশ কাফেররাও যার সততা আর বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি কখনো, প্রাণপ্রিয় সেই নবীর কোনো কথায় তাঁর কোনো সাহাবী সামান্য সন্দেহ পোষণ করবে- তা কি ভাবা যায়! সঙ্গীদের এ অকৃত্রিম আস্থা ও ভালোবাসার কথা তাঁরও অজানা নয়। অথচ তিনিই আল্লাহর নামে কসম করছেন, তাও আবার এক ঘনিষ্ঠ সাহাবীর সঙ্গে! সাহাবী মুআয রা.-ও তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘আমার মা-বাবা আপনার জন্যে উৎসর্গিত হোক! আল্লাহর কসম, আমিও আপনাকে ভালোবাসি।’ এভাবে ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘মুআয! আমি তোমাকে বলছি, কখনোই নামাযের পরে এ দুআটি পড়তে ভুল করো না-

اللّهُمَّ أَعِنِّيْ عَلٰى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ  .

হে আল্লাহ! আপনার জিকির, আপনার কৃতজ্ঞতা ও শোকর আদায় এবং সুন্দর করে আপনার ইবাদত করতে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১১৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫২৪

হাদীসের বাণী সূর্যালোকের ন্যায় পরিষ্কার, আল্লাহ তাআলার যিকির আর তাঁর সুন্দর ইবাদতের মতো তাঁর শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায়ও আমাদের ইসলামে এক পরম কাক্সিক্ষত বিষয়।

আল্লাহবিশ্বাসী প্রতিটি ঈমানদার ব্যক্তিই মনে করে, ভালো-মন্দ সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা সুখ-দুঃখ সবকিছুর তিনিই মালিক। তাঁর ইচ্ছাতেই পথের ফকির কখনো বড় অট্টালিকার মালিক হয়ে যায়, আর কাড়ি কাড়ি সম্পদের মালিকও সবকিছু হারিয়ে পথে নেমে আসে। মুমিনমাত্রই এ বিশ্বাস দৃঢ়তা ও আস্থার সঙ্গে হৃদয়ে লালন করে। এ বিশ্বাসে ভর করেই বিপদাক্রান্ত মুমিন ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ বলে সান্ত্বনা পায়। আবার কোনো নিআমত পেলে এ বিশ্বাসেই সে উচ্চারণ করে- শোকর আলহামদু লিল্লাহ কিংবা এসবই আল্লাহর দান।

হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা বলেছিলেন, তোমার পরবর্তীতে আমি এক উম্মত পাঠাব,  কাক্সিক্ষত কোনো বিষয় যদি তাদের হাসিল হয় তাহলে তারা আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং শুকরিয়া আদায় করবে, আর যদি অনাকাক্সিক্ষত কোনো কিছু তাদের পেয়ে বসে তাহলে তারা সওয়াবের আশায় ধৈর্যধারণ করবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭৫৪৫; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১২৮৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪১৬৫; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১৬৭০৪

উম্মতে মুহাম্মদীর এই চরিত্র এভাবেই আল্লাহ তাআলা প্রকাশ করেছেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের নিকট। আরেক হাদীসে বিষয়টি আরও পরিষ্কার প্রতিভাত হয়েছে। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ.

মুমিনের বিষয়াদি কত আশ্চর্যের! তার সবকিছুই কল্যাণকর। আর এটা তো কেবল মুমিনের ক্ষেত্রেই হতে পারে। সচ্ছলতায় সে শুকরিয়া আদায় করে, তখন তা তার জন্যে কল্যাণকর হয়। আর যদি তার ওপর কোনো বিপদ নেমে আসে তাহলে সে সবর করে, ফলে তাও তার জন্যে কল্যাণকর হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৯৯

কৃতজ্ঞতা আদায় যে কেবলই এক কাক্সিক্ষত বিষয় এমন নয়, বরং এর ব্যতিক্রম ঘটলে পবিত্র কুরআনে উচ্চারিত হয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারিও-

لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيْدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذابِيْ لَشَدِيْدٌ.

তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা আদায় কর তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অস্বীকার কর তাহলে আমার আজাব অবশ্যই কঠিন। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৭

এ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফে বর্ণিত একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনি ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি, তাদের একজন ছিল শ্বেতরোগী, একজনের মাথায় ছিল টাক, আরেকজন ছিল অন্ধ। আল্লাহ তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাই তাদের নিকট এক ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা প্রথমে শ্বেতরোগীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সবচেয়ে পছন্দনীয় জিনিস কোনটি? সে বলল, ‘(শরীরের) সুন্দর বর্ণ আর সুন্দর চামড়া। মানুষ যে আমাকে অপছন্দ করে!’ ফেরেশতা তখন তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার রোগ দূর হয়ে গেল এবং তার গায়ের রং ও চামড়া সুন্দর হয়ে গেল। এরপর ফেরেশতা তাকে বললেন, তোমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদের কথা বলো! সে বলল, উট। তখনি তাকে একটি গর্ভবতী উটনী দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্যে দুআ করলেন- আল্লাহ তাতে তোমার জন্যে বরকত দান করুন। এরপর ফেরেশতা চলে গেলেন টেকো ব্যক্তির কাছে। তাকেও জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সবচেয়ে পছন্দনীয় জিনিস কোনটি? সে বলল, ‘সুন্দর চুল। মানুষ যে আমাকে এ টাকের জন্যে অপছন্দ করে!’ ফেরেশতা তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার টাক দূর হয়ে গেল এবং তার মাথা সুন্দর সুন্দর চুলে ছেয়ে গেল। এরপর ফেরেশতা তাকে বললেন, তোমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদের কথা বলো! সে বলল, গরু। তখনি তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্যে দুআ করলেন- আল্লাহ তাতে তোমার জন্যে বরকত দান করুন। সবশেষে ফেরেশতা গেলেন অন্ধব্যক্তির কাছে। তার কাছেও একই প্রশ্ন; তোমার সবচেয়ে পছন্দনীয় জিনিস কোনটি? সে বলল, ‘আল্লাহ যদি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতেন, আমি তাহলে মানুষদের দেখতে পারতাম।’ ফেরেশতা তখন হাত বুলিয়ে দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে এল। এরপর ফেরেশতা তাকে বললেন, তোমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ কোনটি? সে বলল, ছাগল। তখনি তাকে একটি গর্ভবতী ছাগল দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্যে দুআ করলেন- আল্লাহ তাতে তোমার জন্যে বরকত দান করুন। এরপর তাদের উট গরু আর ছাগলে আল্লাহ যথেষ্ট বরকত দিলেন। কারও মাঠভর্তি উট, কারও মাঠভর্তি গরু আর কারও মাঠভর্তি ছাগল। ফেরেশতা আবার এলেন। প্রথমেই উটের মালিকের কাছে গিয়ে বললেন, আমি মিসকিন, সফরে আমার সবকিছু হারিয়ে গেছে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। তিনি তো তোমাকে সুন্দর গায়ের রং, সুন্দর চামড়া আর এ ধনসম্পদ দান করেছেন। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে একটি উট দাও, তাহলে আমি আমার সফর শেষ করে ফিরে যেতে পারব। সে বলল, আমার তো কত মানুষকে দিতে হয়!  (তোমাকে দিতে পারছি না।) ফেরেশতা এরপর বলল, আমি তো মনে হচ্ছে তোমাকে চিনতে পারছি। তোমার কি শ্বেতরোগ ছিল না, যে কারণে মানুষ তোমাকে অপছন্দ করত? এরপর আল্লাহ তোমাকে এসব দান করলেন। সে বলল : এগুলো তো আমার বাপ-দাদার সম্পদ! ফেরেশতা বললেন, যদি তুমি মিথ্যা বলে থাক, তাহলে তুমি যেমন ছিলে আল্লাহ যেন তোমাকে সে অবস্থাতেই ফিরিয়ে দেন। এরপর ফেরেশতা গেলেন গরুর মালিকের কাছে। তার কাছেও একই ভাষায় সাহায্যের আবদার করলেন। সেও একই ভাষায় ফিরিয়ে দিল। ফেরেশতাও তার জন্যে একই বদদুআ করলেন; যদি তুমি মিথ্যা বলে থাক, তাহলে তুমি যেমন ছিলে আল্লাহ যেন তোমাকে সে অবস্থাতেই ফিরিয়ে দেন। এবার ফেরেশতা ছাগলের মালিকের কাছে গিয়ে বললেন, আমি মিসকিন মুসাফির, সফরে আমার সবকিছু হারিয়ে গেছে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। তিনি তো তোমার চোখ ভালো করে দিয়েছেন আর এ ধনসম্পদ দান করেছেন। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে একটি ছাগল দাও,  যেন আমি আমার সফর শেষ করে ফিরে যেতে পারি। সে বলল, আমি তো অন্ধ ছিলাম, আল্লাহ আমার চোখ ভালো করে দিয়েছেন; আমি দরিদ্র ছিলাম, তিনি আমাকে ধনসম্পদ দান করেছেন। তুমি যা ইচ্ছা নিয়ে নিতে পার। তুমি যাই কিছু নেবে আমি তোমাকে কিছু বলব না। ফেরেশতা বললেন, তোমার সম্পদ তোমার কাছেই থাক; তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছে, আল্লাহ তোমার ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তোমার দুই সঙ্গীর ওপর তিনি অসন্তুষ্ট। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৬৪

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষ আল্লাহ তাআলার কী পরিমাণ নিআমত ভোগ করে তা কি কল্পনা করা যায়! সুস্থ দেহ, সুস্থ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, সুস্থ মন, সুস্থ পরিবেশ- সবকিছুই তো তাঁর নিআমত। সামান্য অসুস্থতায় আক্রান্ত হলেই বুঝে আসে এ নিআমতের মর্ম। সুস্থ মাথা নিয়ে দিব্যি ছুটে বেড়াচ্ছে যে, মাথাব্যথার মতো দেখা যায় না এমন একটি রোগেও সে কাবু হয়ে পড়ে। উঠতে-বসতে, নিদ্রা-জাগরণে, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আমরা তাঁর নিআমতের সাগরে ডুবে আছি সর্বক্ষণ। এ নিআমত গণনার সাধ্য নেই কারও। আল্লাহ পাক তো বলেই দিয়েছেন- وَإِنْ تَعُدُّوْا نِعْمَتَ اللهِ لا َتُحْصُوْهَا

তোমরা যদি আল্লাহর নিআমত গুনতে চাও তাহলে তা গুনে শেষ করতে পারবে না। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৩৪ প্রতিদিনকার প্রতিটি পদক্ষেপে তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন এ নিআমতের কৃতজ্ঞতাসম্বলিত বিভিন্ন দুআ। ভোরে ঘুম থেকে জাগার মধ্য দিয়ে যখন সূচনা হয় আমাদের দিনের, তখনকার দুআটি এমন-

اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ.

অর্থাৎ সকল প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দেয়ার পর আবার জীবন দান করলেন আর তাঁর কাছেই তো আমাদের একত্রিত করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১১২

খাবার খেলে আমরা পড়ি-

اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا، وَجَعَلَنَا مِنَ  الْمُسْلِمِيْنَ.

অর্থাৎ সকল প্রশংসা সেই আল্লাহ তাআলার, যিনি আমাদের পানাহার করিয়েছেন এবং আমাদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৫০

খাবার পেলেই যে কেউ খেতে পারে বিষয়টি এমন নয়। আমাদের চারপাশে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়, যথেষ্ট সচ্ছলতা থাকার পরও ডাক্তারি বিধিনিষেধের কারণে যারা নিজেদের পছন্দের খাবারটিও খেতে পারেন না। তাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত টাকাপয়সায় কেনা খাবার খাওয়ার পর এ দুআটি শিখিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন- খাবার জোগাড় করতে পারা যেমন একটি নিআমত, তেমনি খেতে পারাও একটি নিআমত। আর উক্ত দুআর মধ্য দিয়ে এ নিআমতটিরই শুকরিয়া আদায় করা হয়। কৃতজ্ঞতা সম্বলিত এ দুআর তালিকাও ছোট নয়। যে  কাজকর্মকে আমরা খুবই স্বাভাবিক মনে করি, স্বাভাবিকতায় সামান্য ব্যত্যয় ঘটলে আমরা বুঝি- আসলে এগুলোও আল্লাহর অনুগ্রহ। শুকরিয়া আদায়ের শিক্ষাও তাই জীবনের সর্বত্রই ছড়ানো। এমনকি যখন কেউ প্রস্রাব-পায়খানা সেরে বেরিয়ে আসে তখনো আমাদের শেখানো হয়েছে কৃতজ্ঞতার দুআ-

غُفْرَانَكَ. اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَذْهَبَ عَنِّيْ الْأَذٰى وَعَافَانِيْ.

অর্থাৎ তোমার কাছেই ক্ষমা চাই হে প্রভু! সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমার কষ্টকর বস্তুগুলো সরিয়ে দিয়েছেন এবং আমাকে নিরাপদ রেখেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩০১; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ, ইবনুস সুন্নী, হাদীস ২২

প্রতিদিনকার এসব সাধারণ নিআমতের পাশাপাশি আল্লাহ তাআলা অনেক বিশেষ নিআমতও দিয়ে থাকেন। আল্লাহর নিআমতের কথা আলোচনায় এলে আমাদের সামনে প্রথমে এ বিশেষ নিআমতগুলোই হাযির হয়। যেমন, কাউকে তিনি দিয়ে থাকেন তুখোড় মেধাশক্তি, কাউকে গভীর জ্ঞান, কাউকে রাশি রাশি ধনসম্পদ, কাউকে সুসন্তান, কাউকে সুনাম-সুখ্যাতি, আরও কত কী! মুমিন বান্দা জীবনে যা কিছু পায়, সবকিছুকেই সে আল্লাহর নিআমত বলেই বিশ্বাস করে। এসবকে নিজের মেধা-প্রতিভার ফসল মনে করবে সে কীভাবে, যেখানে মেধা-প্রতিভাকেই সে আল্লাহর দেয়া নিআমত বলে মেনে নেয়! নিজের যে কোনো অর্জনে তাই সে মহান প্রভুর দরবারেই সেজদাবনত হয়, কৃতজ্ঞচিত্তে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে সে উচ্চারণ করে- আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহবিশ্বাসী মুমিন বান্দার এ এক অনন্য গুণ।

কোনো নিআমতের শুকরিয়া আদায়ের জন্যে অপরিহার্য হলো, সে নিআমতটিকে কাজে লাগানোর সময় নিআমতদাতার ইচ্ছা ও চাওয়াকে গুরুত্ব দেয়া, তাঁর আনুগত্যে তা ব্যবহার করা। ব্যবসায় লাভ হলে আলহামদু লিল্লাহ বলার পর যদি সে লাভের অর্থ আল্লাহ তাআলার নাফরমানিতে খরচ করা হয় তাহলে এটা কেমন কৃতজ্ঞতা হলো!

আল্লাহর নিআমত পেলে বান্দা আনন্দিত হয়। আর সেই আনন্দ আল্লাহর অন্য বান্দাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়াটাও এক প্রকার কৃতজ্ঞতা। আল্লাহ নিজেই বলেছেন : وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ

আর তুমি তোমার প্রভুর নিআমতের কথা বলো। -সূরা দুহা (৯৩) : ১১

নিআমতের কথা অন্যকে জানানোই আনন্দ ভাগ করে নেয়ার একমাত্র পদ্ধতি নয়। বিয়ের পর ওলিমা অনুষ্ঠান, সন্তান জন্মের পর আকিকা- এসব তো আল্লাহর নিআমত স্মরণ করেই আয়োজিত হয়। তবে কথা হলো, এসব আনন্দ-আয়োজনের মধ্যে অবশ্যই কৃতজ্ঞতার মানসিকতা পোষণ করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে- আনন্দের এ উপলক্ষ অর্জন ব্যক্তিগত কোনো কৃতিত্ব নয়, বরং মহান প্রভু আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। পরীক্ষায় পাশ, নতুন চাকরি লাভ ইত্যাদি বিভিন্ন উপলক্ষে আমরা মিষ্টিমুখ বা এজাতীয় যে আয়োজন করি, উক্ত বিশ্বাস মনে ধারণ করতে পারলে এ আয়োজনেও কৃতজ্ঞতা আদায় হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সফর থেকে মদীনায় ফিরে আসতেন তখন তিনি একটি উট কিংবা গরু জবাই করে সাথী-সঙ্গী ও উপস্থিত সবার আপ্যায়নের আয়োজন করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০৮৯)

ইমাম বুখারী রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর আমলও বর্ণনা করেছেন এভাবে- যখন তিনি সফর থেকে ফিরে আসতেন তখন তার সঙ্গে যারা দেখা করতে আসত তাদের কারণে তিনি রোযা রাখতেন না। বাড়িতে থাকাবস্থায় তিনি বেশি বেশি নফল রোযা রাখতেন। কিন্তু সফরে থাকাকালীন নফল-ফরয কোনো রোযাই রাখতেন না। সফর থেকে ফিরে এসে আবার রোযা শুরু। যেদিন তিনি সফর থেকে ফিরে আসতেন, স্বাভাবিকভাবেই সেদিন তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে অনেক আপনজন ভিড় করত। তাদের সম্মানে তিনি সেদিন রোযা রাখতেন না। (ফাতহুল বারী, বাবুত তআমি ইনদাল কুদুম)

আল্লাহ তাআলার নিআমতের কৃতজ্ঞতা আদায়ে নফল রোযা-নামাযের কথাও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি সোমবারে রোযা রাখতেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ وَيَوْمٌ بُعِثْتُ أَوْ أُنْزِلَ عَلَيَّ فِيهِ .

এটা এমন দিন, যাতে আমার জন্ম হয়েছিল আর এ দিনেই আমার কাছে ওহী আসার সূচনা হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

আর রাত জেগে জেগে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে নফল নামায পড়তে গিয়ে কখনো তাঁর পা ফুলে যেত। হযরত আয়েশা রা. একদিন তাই জানতে চাইলেন- আপনি এত কষ্ট করেন কেন, আল্লাহ কি আপনার আগে-পরের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেননি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন,

أَفَلاَ أُحِبُّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا

আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হতে চাই না? -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৭

এ কৃতজ্ঞতা মুমিনের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। পরকালীন সমৃদ্ধির পাশাপাশি দুনিয়ার জীবনেও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আরও অধিক পরিমাণ নিআমত লাভের মাধ্যম এ কৃতজ্ঞতা। আর আখেরাতের অসীম পুরস্কারের ঘোষণা তো আছেই। উদাহরণস্বরূপ একটি হাদীস উদ্ধৃত করেই শেষ করছি- হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

الطَّاعِمُ الشَّاكِرُ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ الصَّائِمِ الصَّابِرِ খেয়ে যে আল্লাহর শোকর আদায় করে সে ধৈর্যশীল রোযাদার ব্যক্তির সমান পুরস্কার লাভ করবে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৬৫ 

যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব নয়। যুদ্ধে গেলেই মানুষ মারা যায় না। আর যারা ঘরে বসে থাকে, তারাও সবাই বেঁচে থাকে না।

মৃত্যু আমাদের ইচ্ছার অধীন নয়। তবে আমাদের তৎপরতা আমাদেরই ইচ্ছার অধীন। নশ্বর বা ধ্বংসশীল জগতকে আমাদের কাজকর্মের লক্ষ্য না করে পরকালকেই আমাদের কাজের লক্ষ্য করা উচিত। পরকালের জগত অসীম। মৃত্যু তার সূচনা মাত্র। সমাপ্তি নয়।

৩:১৪৬ وَ کَاَیِّنۡ مِّنۡ نَّبِیٍّ قٰتَلَ ۙ مَعَہٗ رِبِّیُّوۡنَ کَثِیۡرٌ ۚ فَمَا وَہَنُوۡا لِمَاۤ اَصَابَہُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَ مَا ضَعُفُوۡا وَ مَا اسۡتَکَانُوۡا ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الصّٰبِرِیۡنَ

১৪৬. আর বহু নবী ছিলেন, তাদের সাথে বিরাট সংখ্যক (ঈমান ও আমলে সালেহর উপর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত) লোক যুদ্ধ করেছেন। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি, দুর্বল হয়নি এবং নত হয়নি। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালবাসেন।

৩:১৪৭ وَ مَا کَانَ قَوۡلَہُمۡ اِلَّاۤ اَنۡ قَالُوۡا رَبَّنَا اغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوۡبَنَا وَ اِسۡرَافَنَا فِیۡۤ اَمۡرِنَا وَ ثَبِّتۡ اَقۡدَامَنَا وَ انۡصُرۡنَا عَلَی الۡقَوۡمِ الۡکٰفِرِیۡنَ

১৪৭. এ কথা ছাড়া তাদের আর কোন কথা ছিল না, হে আমাদের রব! আমাদের পাপ এবং আমাদের কাজের সীমালংঘন আপনি ক্ষমা করুন, আমাদের পা সুদৃঢ় রাখুন এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।

৩:১৪৮ فَاٰتٰىہُمُ اللّٰہُ ثَوَابَ الدُّنۡیَا وَ حُسۡنَ ثَوَابِ الۡاٰخِرَۃِ ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ

১৪৮. তারপর আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ার পুরস্কার এবং আখেরাতের উত্তম পুরস্কার দান করেন। আর আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালবাসেন।

আগের কয়েকটি আয়াতে ওহুদ যুদ্ধের বিপর্যয়ে হতাশ হওয়ায় এবং পালিয়ে যাওয়ায় কোন কোন মুসলমানকে তিরস্কার করা হয়েছে। এই আয়াতে পূর্ববর্তী নবীদের ইতিহাস উল্লেখ করে বলা হয়েছে- তোমাদের আগেও অনেক নবী আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের অনেক মুমিন সঙ্গী যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত হয়েছিলেন। কিন্তু বিপর্যয় সত্ত্বেও তারা ধর্ম থেকে দূরে সরে যাননি এবং কোন দুর্বলতা প্রদর্শন করেননি। তাহলে তোমরা কেন তাদের অনুসারী হবে না? কেন ইসলামের নবী (সা.)কে যুদ্ধের ময়দানে বিপুলসংখ্যক শত্রুর সামনে একা রেখে পালিয়ে যাচ্ছ? এরপর কোরআন জিহাদের বীর পুরুষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে বলছে- তারা এতসব কঠোর চেষ্টা সাধনা সত্ত্বেও আল্লাহর কাছে প্রার্থনাকে কখনও ভুলে যাননি বরং তারা আল্লাহর কাছে নিজেদের কৃতকর্মের দোষ-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে শত্রুদের ওপর বিজয় প্রার্থনা করেছেন। আর আল্লাহও তাদের বিজয়ী করেছেন। দুনিয়ায় তারা যুদ্ধলব্ধ সম্পদও পেয়েছেন,অন্যদিকে তারা পরকালেও পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।

যারা অতীতে সত্যের সংগ্রামে অবিচল ছিলেন সেইসব মহাপুরুষের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে হতাশা ও দুর্বলতা দূর করতে হবে।

আল্লাহর প্রতি ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাসই যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়তা এবং প্রতিরোধের শক্তি যোগায়।

আল্লাহর নবীরা আরাম-আয়েশে নয় বরং জিহাদ ও সংগ্রামের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন।

দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা প্রদর্শন ও অটল-অবিচল থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। সাফল্য ও পরাজয় এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়।

 

https://www.youtube.com/watch?v=kYJzc_G8rvg&list=PLmoW02zjC7gSJuUQVFraAuCetoJvM43sS&index=23