সূরা আলে ইমরানঃ ১২তম রুকু(আয়াত ১১০-১২০)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ.

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

১২তম রুকু(১১০-১২০)

৩:১১০ کُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡہَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ ؕ وَ لَوۡ اٰمَنَ اَہۡلُ الۡکِتٰبِ لَکَانَ خَیۡرًا لَّہُمۡ ؕ مِنۡہُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ اَکۡثَرُہُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ

১১০. তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির জন্য যাদের বের করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে। আর আহলে কিতাবগণ যদি ঈমান আনতো তবে তা ছিল তাদের জন্য ভাল। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুমিন আছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশই ফাসেক।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের বলা হচ্ছে, নিজেদের অযোগ্যতার কারণে বনী ইসরাঈলদেরকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের যে আসন থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে সেখানে এখন তোমাদেরকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে৷ কারণ নৈতিক চরিত্র ও কার্যকলাপের দিক দিয়ে এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী৷ সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য যেসব গুণাবলীর প্রয়োজন সেগুলো তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে৷ অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে ন্যায় ও সৎবৃত্তির প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় ও অসৎবৃত্তির মূলোৎপাটন করার মনোভাব ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টি হয়ে গেছে৷ আর এই সংগে তোমরা এক ও লা-শরীক আল্লাহকেও বিশ্বাসগত দিক দিয়ে এবং কার্যতও নিজেদের ইলাহ, রব ও সর্বময় প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছো৷ কাজেই এ কাজের দায়িত্ব এখন তোমাদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে৷ তোমরা নিজেদের দায়িত্ব অনুধাবন করো এবং তোমাদের পূর্ববর্তীরা যেসব ভুল করে গেছে তা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখো ৷

কিছু বিষয় জানা থাকা প্রয়োজন-

এক।

হজরত নূহের পরে হযরত ইবরাহীম প্রথম বিশ্বজনীন নবী ৷ মহান আল্লাহ তাঁকে ইসলামের বিশ্বজনীন দাওয়াত ছড়াবার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন ৷ প্রথমে তিনি নিজে সশরীরে ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তীন থেকে নিয়ে আরবের মরু অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পর্যন্ত বছরের পর বছর সফর করে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের (অর্থাৎ ইসলাম) দিকে আহবান করতে থাকেন ৷

অতপর এই মিশন সর্বত্র পৌছিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন ৷ পূর্ব জর্দানে নিজের ভাতিজা হযরত লূতকে নিযুক্ত করেন ৷

সিরিয়া ও ফিলিস্তীনে নিযুক্ত করেন নিজের ছেলে হযরত ইসহাককে এবং আরবের অভ্যন্তরে নিযুক্ত করেন নিজের বড় ছেলে হযরত ইসমাঈলকে ৷

তারপর মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় কা’বাগৃহ নির্মাণ করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ মতো এটিকেই এই মিশনের কেন্দ্র গণ্য করেন ৷

দুই:

হযরত ইবরাহীমের বংশধারা দু’টি বড় বড় শাখায় বিভক্ত হয় ৷

একটি শাখা হচ্ছে , হযরত ইসমাঈলের সন্তান-সন্ততিবর্গ ৷ এরা আরবে বসবাস করতো ৷ কুরাইশ ও আরবের আরো কতিপয় গোত্র এরই অন্তরভুক্ত ছিল ৷ আর যেসব আরব গোত্র বংশগত দিক দিয়ে হযরত ইসমাঈলের সন্তান ছিল না তারাও তাঁর প্রচারিত ধর্মে কমবেশী প্রভাবিত ছিল বলেই তাঁর সাথেই নিজেদের সম্পর্ক জুড়তো ৷

দ্বিতীয় শাখাটি ছিল হযরত ইসহাকের সন্তানবর্গের ৷ এই শাখায় হযরত ইয়াকুব, হযরত ইউসূফ , হযরত মূসা, হযরত দাউদ, হযরত সুলাইমান , হযরত ইয়াহ্‌হিয়া, হযরত ঈসা প্রমুখ অসংখ্য নবী জন্মগ্রহণ করেন ৷

যেহেতু হযরত ইয়াকুবের আর এক নাম ছিল ইসরাঈল , তাই তাঁর বংশ বনী ইসরাঈল নামে পরিচিত হয় ৷তাঁর প্রচার অভিযানের ফলে যেসব জাতি তাঁর দীন গ্রহণ করে তারা তার মধ্যে নিজেদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বিলুপ্ত করে দেয় অথবা তারা বংশগতভাবে তাদের থেকে আলাদা থাকলেও ধর্মীয়ভাবে তাদের অনুসারী থাকে ৷ এই শাখায় অবনতি ও অধপতন সূচিত হলে প্রথমে ইহুদিবাদ ও পরে খৃস্টবাদের উদ্ভব হয়

তিন :

হযরত ইবরাহীমের আসল কাজ ছিল সমগ্র দুনিয়াবাসীকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহবান জানানো এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা পরিশুদ্ধ ও সংশোধিত করে গড়ে তোলা ৷ তিনি নিজে ছিলেন আল্লাহর অনুগত ৷ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান অনুযায়ী নিজের জীবনের সমস্ত কাজ-কারবার পরিচালনা করতেন সারা দুনিয়ায় এই জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটাতেন এবং চেষ্টা করতেন যাতে সমস্ত মানুষ বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভুর অনুগত হয়ে এ দুনিয়ায় জীবন যাপন করে ৷ এই মহান ও বিরাট কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে তাঁকে বিশ্বনেতার পদে অভিষিক্ত করা হয় ৷

তারপর তাঁর বংশধারা থেকে যে শাখাটি বের হয়ে হযরত ইসহাক ও হযরত ইয়াকুবের নামে অগ্রসর হয়ে বনী ইসরাঈল নাম ধারণ করে সেই শাখাটি তার এ নেতৃত্বের উত্তরাধিকার লাভ করে ৷ এই শাখায় নবীদের জন্ম হতে থাকে এবং এদেরকেই সত্য-সঠিক পথের জ্ঞানদান করা হয় ৷ বিশ্বের জাতিসমূহকে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার দায়িত্ব এদের ওপর সোপর্দ করা হয় ৷ এটি ছিল আল্লাহর মহান অনুগ্রহ ও নিয়ামত ৷ মহান আল্লাহ এ বংশের লোকদেরকে তাই একথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ৷

এ শাখাটি হযরত সুলাইমানের আমলে বাইতুল মাকদিসকে নিজেদের কেন্দ্র গণ্য করে ৷ তাই যতদিন পর্যন্ত এ শাখাটি নেতৃত্বের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিল ততদিন পর্যন্ত বাইতুল মাকদিসই ছিল দাওয়াত ইলাল্লাহ— মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাবার উদ্দেশ্যে পরিচালিত যাবতীয় কর্মকান্ডের কেন্দ্র ৷

চার:

পেছনের দশটি রুকু’তে মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে তাদের ঐতিহাসিক অপরাধসমূহ এবং কুরআন নাযিল হবার সময়ে তাদের যে অবস্থা ছিল তা হুবহু বর্ণনা করেছেন ৷ এ সংগে তাদেরকে একথা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা আমার নিয়ামতের চরম অমর্যাদা করেছো ৷ তোমরা কেবল নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত থাকোনি বরং নিজেরাও সত্য ও সততার পথ পরিহার করেছো ৷ আর এখন তোমাদের একটি ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী ছাড়া তোমাদের সমগ্র দলের মধ্যে আর কোন যোগ্যতা অবশিষ্ট নেই৷

পাঁচ:

অতপর এখন তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, বিশ্বমানবতার নেতৃত্ব ইবরাহীমের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার নয় ৷ বরং নবী ইবরাহীম নিজে যে নিষ্কলুষ আনুগত্যের মধ্যে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছিলেন এটি হচ্ছে তারই ফসল ৷ যারা ইবরাহীমের পথে নিজেরা চলে এবং সমগ্র বিশ্ববাসীকে চালাবার দায়িত্ব পালন করে একমাত্র তারাই এই নেতৃত্বের যোগ্যতা লাভ করতে পারে ৷ যেহেতু তোমরা এ পথ থেকে সরে গেছো এবং এ দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছো তাই নেতৃত্বের পদ থেকে তোমাদের অপসারিত করা হচ্ছে ৷

ছয়:

সংগে সংগে ইশারা-ইংগিতে একথাও বলে দেয়া হচ্ছে , যেসব অইসরাঈলী জাতি মূসা ও ঈসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে নিজেদের সম্পর্ক জুড়েছিল তারাও ইবরাহীমের পথ থেকে সরে গেছে ৷ এই সংগে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে,আরবের মুশরিকরাও ইবরাহীম ও ইসমাঈলের সাথে নিজেদের সম্পর্ক রয়েছে বলে গর্ব করে বেড়ায় কিন্তু তারা আসলে নিজেদের বংশ ও গোত্রের অহংকারে মত্ত হয়ে পড়েছে ৷ ইবরাহীম ও ইসমাঈলের পথের সাথে এখন তাদের দূরবর্তী সম্পর্কও নেই ৷ কাজেই তাদের কেউই বিশ্বনেতৃত্বের যোগ্যতা ও অধিকার রাখে না ৷

সাত:

আবার একথাও বলা হচ্ছে , এখন আমরা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশের দ্বিতীয় শাখা বনী ইসরাঈলের মধ্যে এমন এক নবীর জন্ম দিয়েছি যার জন্য ইবরাহীম ও ইসমাঈল উভয়েই দোয়া করেছিলেন ৷ ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক , ইয়াকুব ও অন্যান্য সকল নবী যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তিনিও সেই একই পথ অবলম্বন করেছেন ৷ আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় যত নবী ও রসূল এসেছেন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা তাদের সবাইকে সত্য নবী বলে স্বীকার করেন ৷ সকল নবী বিশ্ববাসীকে যে পথের দিকে আহবান জানিয়েছেন তিনি ও তাঁর অনুসারীগণও মানুষকে সেদিকে আহবান জানান ৷ কাজেই যারা এ নবীর অনুসরণ করে এখন একমাত্র তারাই বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের যোগ্যতা ও অধিকার রাখে ৷

আট:

নেতৃত্ব পরিবর্তনের ঘোষণার সাথে সাথেই স্বাভাবিকভাবেই কিব্‌লাহ পরিবর্তনের ঘোষণা হওয়া জরুরি ছিল ৷ যতদিন বনী ইসরাঈলদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছিল ততদিন বাইতুল মাকদিস ছিল ইসলামী দাওয়াতের কেন্দ্র এবং সেটিই ছিল সত্যপন্থীদের কিব্‌লাহ ৷ শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীগণও ততদিন বাইতুল মাকদিসকেই তাঁদের কিব্‌লাহ বানিয়ে রেখেছিলেন ৷

কিন্তু বনী ইসরাঈলকে এ পদ থেকে অপসারিত করার পর বাইতুল মাকদিসের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব আপনা-আপনি খতম হয়ে গেল ৷ কাজেই ঘোষণা করে দেয়া হলো , যেখান থেকে এ শেষ নবীর দাওয়াতের সূচনা হয়েছে সেই স্থানটিই হবে এখন আল্লাহর দীনের কেন্দ্র ৷ আর যেহেতু শুরুতে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াতের কেন্দ্রও এখানে ছিল তাই আহ্‌লি কিতাবও মুশরিকদের জন্যও এ স্থানটির অর্থাৎ কা’বার কেন্দ্র হবার সর্বাধিক অধিকারের দাবী স্বীকার করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই ৷ অবশ্যি হঠধর্মীদের কথা আলাদা ৷ তারা সত্যকে সত্য জেনেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ আনতে থাকে ৷

নয়:

উম্মাতে মুহাম্মাদীয়ার নেতৃত্ব ও কা’বার কেন্দ্র হবার কথা ঘোষণা করার পরই মহান আল্লাহ সূরা বাকারার ১৯ রুকূ’ থেকে সূরা বাকারার শেষ পর্যন্ত আলোচনায় ধারাবাহিক হেদায়াতের মাধ্যমে এ উম্মাতের জীবন গঠন ও জীবন পরিচালনার জন্য বিধান দান করেছেন ৷

যেসব কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁকে বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করার যোগ্য প্রমাণ করেছিলেন কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে ৷ সত্যের আলো তাঁর সামনে সুস্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হবার পর থেকে নিয়ে মৃত্যুকাল পর্যন্ত সমগ্র জীবন ছিল কুরবানী ও ত্যাগের মূর্ত প্রতীক ৷ দুনিয়ার যেসব বস্তুকে মানুষ ভালোবাসতে পারে এমন প্রতিটি বস্তুকে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সত্যের জন্য কুরবানী করেছিলেন ৷ দুনিয়ার যে সমস্ত বিপদকে মানুষ ভয় করে সত্যের খাতিরে তার প্রত্যেকটিকে তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন ৷

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সত্তরটি জাতিকে পূর্ণ করবে, তন্মধ্যে তোমরাই হলে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম এবং সবচেয়ে বেশী সম্মানিত। [তিরমিযীঃ ৩০০১, ৪২৮৭]

(অর্থাৎ তোমাদের পূর্বে বহু জাতি গত হয়েছে, যাদের সংখ্যা সত্তরটি। এর দ্বারা সংখ্যা বা আধিক্য বোঝানো উদ্দেশ্য। মানাওয়ী, ফায়দুল কাদীর)

অপর হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “জান্নাতীদের কাতার হবে একশ’ বিশটি। তন্মধ্যে আশিটি কাতার হবে এই উম্মতের।” [তিরমিযীঃ ২৫৪৬, ইবনে মাজাহঃ ৪২৮৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৫৫]

অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, এ উম্মত হবে জান্নাতীদের অর্ধেক। [বুখারীঃ ৬৫২৮, মুসলিমঃ ২২১]

আরেক হাদীসে এসেছে, এ উম্মত সবার আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুসলিমঃ ৮৫৫, ইবনে মাজাহঃ ১০৮৩]

মুসলিম উম্মতকে ‘শ্রেষ্ঠতম সম্প্রদায়’ বলে ঘোষনা করার কারণসমূহ কুরআনুল কারীম একাধিক আয়াতে বর্ণনা করেছে। আলোচ্য ১১০ নং আয়াতে মুসলিম উম্মতের শ্রেষ্ঠতম সম্প্রদায় হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা মানব জাতির উপকারার্থে সমুত্থিত হয়েছে। আর তাদের প্রধান উপকার এই যে, মানব জাতির আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক সংশোধনের চেষ্টাই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের তুলনায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মাধ্যমে সৎকাজে আদেশ দান এবং অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব অধিকতর পুর্ণত্বলাভ করেছে। পুর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে ব্যাপক ঔদাসীন্যের দরুন দ্বীনের অন্যান্য বিশেষ কার্যাবলীর ন্যায় সৎকাজে আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধ করার কর্তব্যটিও পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল।

সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ

المعروف এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে : المعلوم বা জ্ঞাত ও জানা বস্তু বা বিষয়। عرف يعرف معرفة وعرفانا এর অর্থ জানা। المنكر- المعروف (অজ্ঞাত ও অপরিচিত) এর বিপরীত।

المعروف শব্দটি المعرفة (জানা) এবং الاستحسان (কল্যাণকরন) উভয়কে শামিল করে।

শরিয়তের পরিভাষায় মারুফ বলা হয় :—

اسم جامع لكل ما عرف من طاعة الله والتقرب إليه بفعل الواجبات والمندوبات.

অর্থাৎ, যে সকল ফরজ ও নফল কাজের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ পায় এবং নৈকট্য সাধিত হয় তাকে মারূফ বলে।

আর মুনকার হচ্ছে মারূফের বিপরীত

وهو كل ما قبحه الشرع وحرمه وكرهه.

এমন কথা ও কাজ যাকে শরিয়ত হারাম, অপছন্দ ও ঘৃণা করে হারাম সাব্যস্ত করেছে। উপরোক্ত সংজ্ঞা দ্বয়কে সামনে রাখলে আমরা দেখতে পাব যে শরিয়তের মৌলিক ও আনুষঙ্গিক সব বিষয় যেমন আক্বিদা-বিশ্বাস, ইবাদত, আখলাক-সুলুক ও মুআমালাত-ফরয হোক বা হারাম, মোস্তাহাব কিংবা মাকরূহ-সবই উভয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর মধ্যে যা ভাল ও কল্যাণকর তা মারূফের অন্তর্ভুক্ত আর যা খারাপ ও অকল্যাণকর মুনকারের অন্তর্ভুক্ত।

আমার বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার ওয়াজিব। এ মর্মে অনেক আয়াত ও অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তা ছাড়া এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এটি ওয়াজিবে কেফায়া। উম্মতের যথেষ্ট পরিমাণ অংশ এ দায়িত্ব পালন করলে অন্যদের থেকে গুনাহ রহিত হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:-

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (آل عمران:104)

আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত, যারা সৎকাজের প্রতি আহ্বান করবে, নির্দেশ করবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই হল সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান:১০৪)

আয়াতে (ولتكن) শব্দটি أمر তথা নির্দেশ সূচক বাক্য। যা আবশ্যকীয়তাকে প্রমাণ করে। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:-

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ. (التوبة:71)

আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভাল কাজের নির্দেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে। জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তাআলা দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা:৭১)

আর মুনাফেক সম্পর্কে বলেছেন :

الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُمْ مِنْ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ.(التوبة: 67)

মুনাফেক নর, মুনাফিক নারী একে অপরের অনুরূপ। অসৎকর্মের এবং সৎকর্ম নিষেধ করে। (সূরা তাওবা : ৬৭)

আল্লাহ তাআলা আমর বিল মারূফ এবং নেহি আনিল মুনকারকে (সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ) মোমিন ও মুনাফেকদের সাথে পার্থক্যকারী নিদর্শন হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। সাহাবি আবু সাইদ খুদরী রা, থেকে বর্ণিত তিনি বলেন :

سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: من رأى منكم منكرا فليغيره بيده، فإن لم يستطع فبلسانه، فان لم يستطع فبقلبه، و ذلك أضعف الإيمان.

আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি তোমাদের কেউ অন্যায় অশ্লীল কর্ম দেখলে শক্তি দ্বারা প্রতিহত করবে। যদি সমর্থ না হও তাহলে কথার দ্বারা প্রতিবাদ করবে এতেও সমর্থ না হলে মন থেকে ঘৃণা করবে। আর এটিই হচ্ছে সবচে দুর্বল ঈমান। হাদিসে বর্ণিত فليغيره শব্দটি নির্দেশ সূচক বাক্য যা আবশ্যকীয়তার দাবিদার। ইজমা প্রসঙ্গে আল্লামা ইমাম নববী রহ. বলেন-

وقد تطابق على وجوب الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر الكتاب والسنة والإجماع.

আমার বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার ওয়াজিব হওয়া প্রসঙ্গে, কোরআন, সুন্নাহ, এবং ইজমা অভিন্ন মত পোষণ করেছে। বাকি থাকল ওয়াজিবে কেফায়া হওয়া। এটিও জমহুরে উম্মতের মতামতের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, আল্লামা ইবনুল আরাবী মালেকি রহ. আল্লাহর বাণী ولتكن منكم أمة প্রসঙ্গে বলেন। আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার যে ফরযে কেফায়া তার প্রমাণ এ আয়াতের মধ্যেই বিদ্যমান।

আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের তিনটি তাৎপর্য :—

(এক) সৃষ্টির বিরুদ্ধে إقامة حجة الله على خلقه আল্লাহর হুজ্জত প্রতিষ্ঠিত করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :—

رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ . النساء:165)

সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শনকারী রাসূল প্রেরণ করেছি যাতে রাসূল আসার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ আরোপ করার মত অবকাশ না থাকে। (সূরা নিসা:১৬৫)

(দুই) আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বারণকারী আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালনের জামানত থেকে মুক্তি পাওয়া। যেমন শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়ের ভাল ও সৎ লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :—

وَإِذْ قَالَتْ أُمَّةٌ مِنْهُمْ لِمَ تَعِظُونَ قَوْمًا اللَّهُ مُهْلِكُهُمْ أَوْ مُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا قَالُوا مَعْذِرَةً إِلَى رَبِّكُمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ. (الأعراف:164)

তারা বলল, তোমাদের পালনকর্তার নিকট দায়িত্ব-মুক্তির জন্য এবং যাতে তারা সাবধান হয় এ জন্য। (সূরা আরাফ : ১৬৪)

(তিন) যাকে সৎ কাজের আদেশ দেয়া হয় বা অসৎ কাজ থেকে বারণ করা হয় তার উপকারের প্রত্যাশা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:-

وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِينَ (الذاريات:55)

আপনি উপদেশ দিতে থাকুন। কারণ উপদেশ মোমিনদের উপকারে আসবে। (যারিয়াত : ৫৫)

আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের ফজিলত :

আমর বিল মারূফ এবং নেহি আনিল মুনকার ইসলামের একটি অত্যবশ্যকীয় দায়িত্ব। একটি মৌলিক স্তম্ভ এবং এ ধর্মের অনন্য বৈশিষ্ট্য। সংস্কার ও সংশোধনের বিশাল মাধ্যম। তার মাধ্যমে সত্যের জয় হয় এবং মিথ্যা ও বাতিল পরাভূত হয়। তার মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধির বিস্তার ঘটে। কল্যাণ ও ঈমান বিস্তৃতি লাভ করে। যিনি আন্তরিকতা ও সততার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার ও মর্যাদাপূর্ণ পারিতোষিক।

কোরআনে অসংখ্য আয়াত ও প্রিয় নবীর অগণিত হাদিস এর প্রমাণ বহন করে। এর অল্প কিছু নীচে প্রদত্ত হল।

(১) আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ. (التوبة:71)

অর্থাৎ আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক-সুহৃদ। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। সালাত প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয়, এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ রহম ও দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী। প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা : ৭১)

আয়াতে পরিষ্কার দেখা গেল যে আল্লাহ তাআলা আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের উপর রহমতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

(২) মহান রাব্বুল আলামীন আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন কারীদের প্রশংসা এবং তাদের পরিণাম ও শেষ ফল কল্যাণময় বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন :—

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (آل عمران:104)

আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই সফল কাম। (আলে ইমরান : ১০৪)

(৩) আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার পার্থিব মুসিবত ও পারলৌকিক শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়। আল্লাহ বলেছেন :—

فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ أَنْجَيْنَا الَّذِينَ يَنْهَوْنَ عَنِ السُّوءِ وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ .(الأعراف:165)

যে উপদেশ তাদের দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হয়ে গেল। তখন আমি সে সব লোকদের মুক্তি দান করালাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম গুনাহ্গার জালিমদেরকে নিকৃষ্ট আজাবের মাধ্যমে তাদের নাফরমানির ফলস্বরূপ। (সূরা আরাফ : ১৬৫)

(৪) আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার পরিত্যাগ করা আল্লাহর লানত, গজব ও ঘৃণার কারণ এবং এ কারণেই দুনিয়া ও পরকালে কঠিন শাস্তি নেমে আসবে। আল্লাহ তাআলা বলেন : –

لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ ﴿78﴾ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ ﴿79﴾.(المائدة:78-79)

অর্থাৎ বনী ঈসরাইলের মধ্যে যারা কাফের তাদেরকে দাউদ ও মরিয়ম তনয় ঈসার মুখে অভিসম্পাত করা হয়েছে। এ কারণে যে তারা অবাধ্যতা করত এবং সীমালঙ্ঘন করত। তারা পরস্পরকে মন্দ কাজে নিষেধ করত না যা তারা করত। তারা যা করত অবশ্যই মন্দ ছিল। (সূরা মায়েদা : ৭৮-৭৯)

মন্দ কাজে বাধা প্রদান ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলি :

প্রথমত : আদেশদান ও বাধা প্রদানকারীর সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি :

(১) ঈমান। অমুসলিমদের উপর এ দায়িত্ব ওয়াজিব নয়।

(২) মুকাল্লাফ বা শরিয়ত কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া। অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানকারীকে বুদ্ধিমান (عاقل) ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। নির্বোধ ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের উপর আদেশ ও নিষেধ করা ওয়াজিব নয়।

(৩) সামর্থ্য। যিনি এ কাজে ক্ষমতা রাখেন তার উপরই ওয়াজিব। আর যার ক্ষমতা নেই, অক্ষম ও অসমর্থ তার উপর ওয়াজিব নয়। তবে তাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতে ও অপছন্দ করতে হবে। করা আবশ্যক।

দ্বিতীয়ত: অসৎ কাজ (যা প্রতিহত করা হবে তার সাথে) সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি।

(১) কাজটি মন্দ ও নিষিদ্ধ এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। ধারণা ও সম্ভাবনার উপর নির্ভর করে বাধা প্রদান বা প্রতিহত করণ জায়েজ হবে না।

(২) যে মন্দ কাজ প্রতিহত করার ইচ্ছা তাকে সম্পাদনকারী সহ প্রতিহত করার সময় কাজে লিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যেতে হবে।

(৩) প্রতিরোধ উদ্দিষ্ট অসৎকর্মটি স্পষ্ট ও দৃশ্যমান হতে হবে। অনুমান নির্ভর হলে প্রতিহত করণ জায়েজ হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন: – ولا تجسسوا তোমরা দোষ ও গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না। (সূরা হুজুরাত : ১৩)

তাছাড়া ঘর ও এ জাতীয় (সংরক্ষিত) জিনিসের একটি স্বকীয় মর্যাদা আছে। শরয়ি কোন কার্যকারণ ব্যতীত সেটি বিনষ্ট কর বৈধ হবে না।

আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার সম্পাদন কারীর কিছু আদব :

ইখলাস ও আন্তরিকতা। কারণ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের বাধা প্রধান একটি অন্যতম শীর্ষ ইবাদত ; আর ইবাদত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:-

فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ. (الزمر:2)

অতএব আপনি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর ইবাদত করুন।

(২) ইলম তথা প্রয়োজনীয় জ্ঞান। ইলম ব্যতীত অসৎ কাজে বাধা প্রদান করতে যাবে না। কারণ এতে শরয়ি নিষিদ্ধ কাজ সমূহে পতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:-

قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي . يوسف 108

বলে দিন, এটাই আমার পথ আমি আল্লাহর দিকে বুঝে শুনে সজ্ঞানে আহ্বান করি-আমি এবং আমার অনুসারীরা (ইউসুফ : ১০৮)

(৩) আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের ক্ষেত্রে হক স্পষ্ট করার পাশাপাশি হিকমত ও সুকৌশল, সদুপদেশ এবং সূক্ষ্ম পন্থার সাহায্য নেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন

ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ. (النجل:125)

অর্থাৎ আপনি মানুষদের আপনার প্রতিপালকের পথে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করুন। (সূরা নাহল : ১২৫)

আল্লাহ তাআলা মূসা ও হারুন আ.-কে ফেরআউনকে দাওয়াত দেয়ার কৌশল শিক্ষা দিয়ে বলেছেন :—

فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى. (طه:44)

অত:পর তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে এতে করে হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে। (ত্ব-হা:৪৪)

আমাদের নবী মুহম্মদ সা.-কে লক্ষ্য করে বলেন :—

وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ. (آل عمران:159)

আপনি যদি রূঢ় ও কঠোর হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত। (সূরা আল ইমরান : ১৫৯)

(৪) আমর বিল মারূফ ও নেহি আমিল মুনকার-এর ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য সর্বাপেক্ষা জরুরি বিষয় হচ্ছে : সবর ধৈর্য এবং সহনশীলতা। লোকমান আ. স্বীয় পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন :—

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ (لقمان:17)

হে বৎস ! সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও। মন্দকাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর, এটিই তো দৃঢ় সংকল্পের কাজ। (সূরা লোকমান : ১৭)

(৫) কল্যাণ ও অকল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখা। সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ তখনই করবে যখন অকল্যাণের চেয়ে কল্যাণের দিকটি প্রবল থাকে আর যদি অবস্থা বিপরীত হয় যে এটি করতে গেলে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের সম্ভাবনাই বেশি তাহলে আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকার জায়েজ হবে না। কারণ এতে অপেক্ষাকৃত ছোট মুনকার দূর করতে গিয়ে আরো বড় মুনকারে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।

(৬) মুনকার ও অসৎকাজ দূর করার ক্ষেত্রে সবচে সহজ কাজের সাথে সংগতিপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করা। সুতরাং, সংগতি পূর্ণ পন্থা ও মাধ্যম বাদ দিয়ে আরো বড় মাধ্যম গ্রহণ করা জায়েজ হবে না।

(৭) আবু সাইদ খুদরী রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের বিন্যাস অনুযায়ী ধারাবাহিকতা ও স্তর বিবেচনায় রেখে মন্দ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানের পদক্ষেপ নেয়া।

আবু সাইদ খুদরী রা. বলেন. আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি। তোমাদের কেউ মন্দ কাজ হতে দেখলে (শক্তি প্রয়োগ করে) প্রতিহত করবে, সম্ভব না হলে (মুখের মাধ্যমে) প্রতিবাদ করবে। এও সম্ভব না হলে (মনে মনে) ঘৃণা করবে। আর এটি হচ্ছে ঈমানের সর্ব নিম্ন স্তর। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, সহজ পন্থা ও পদ্ধতিতে কাজ সম্ভব হলে কঠোর পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়োজন নেই। বরং এটি ঠিকও হবে না। যেমন, যে মন্দ কাজ প্রতিবাদের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব সেখানে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিহত করা শরিয়তের দৃষ্টিতে ঠিক নয়। এ নীতিমালা সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের উপকারিতা :

সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানে অনেক ফায়দা ও উপকারিতা রয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নে প্রদত্ত হল।

(১) মন্দ ও অন্যায় দেখে তা প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার পদক্ষেপ না নেয়া শাস্তি যোগ্য অপরাধ। কোরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী এসেছে। সুতরাং আমার বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের মাধ্যমে আল্লাহর সে শাস্তি হতে দূরে থাকা যায় ও পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

(২) আল্লাহ তাআলা কল্যাণ ও নেক কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করার উৎসাহ-বরং নির্দেশ দিয়েছেন। আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের মাধ্যমে উক্ত নির্দেশের বাস্তবায়ন হয় এবং কল্যাণ ও নেকের কাজে সহযোগিতা হয়।

 

(৩) সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কারণ এর মাধ্যমে যাবতীয় অকল্যাণ ও অনিষ্ট বিদূরিত হয়। ফলে মানুষ স্বীয় দ্বীন-জান-সম্পদ ও সম্মানের ব্যাপারে নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বোধ করে।

 

(৪) এর মাধ্যমে অন্যায় ও অনিষ্টের হার হ্রাস পায়। সমাজ থেকে মন্দ ও অশ্লীল কাজের প্রতিযোগিতা প্রদর্শনী বিলুপ্ত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যেগুলো মূলত সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করত। ফলে সমাজ শান্তি শৃঙ্খলা, মিল-মহব্বত ও সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠে।

ওয়েব গ্রন্থনা : আবুল কালাম আযাদ আনোয়ার /সার্বিক যত্ন : আবহাছ এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি, বাংলাদেশ

কিন্তু এ উম্মতের মধ্যে কেয়ামত পর্যন্ত এমন একটি দল থাকবে- যারা “সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ”- এর কর্তব্য পুরোপুরি পালন করে যাবে। আবুল আলিয়া বলেন, এ উম্মতের চেয়ে বেশী কোন উম্মত ইসলামের আহবানে সাড়া দেয়নি, ফলে তাদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। [ইবন আবী হাতেম] আয়াতে এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ বলার সাথে সাথে তাদের কর্ম কেমন হওয়া উচিত তা বলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তারা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, মা’রূফ বা সৎকাজ হচ্ছে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষী দেয়া, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেগুলোর স্বীকৃতি দেয়া এবং তার উপর কাফের মুশরিকদের সাথে জিহাদে থাকা। আর সবচেয়ে বড় মা’রূফ বা সৎকাজ হচ্ছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র স্বীকৃতি আদায় করা। পক্ষান্তরে সবচেয়ে বড় মুনকার বা অসৎকাজ হচ্ছে, মিথ্যারোপ করা। [তাবারী]

এ বাক্যাংশে মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী উম্মতদের তুলনায় তাদের ঈমানের বিশেষ স্বাতন্ত্র থাকার কারণে বিশেষকরে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথমত: অন্যায় অশ্লীলতা ও অপবিত্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া শুধু মুখে সৎ কাজের পরামর্শ দেয়া খুব একটা ফলপ্রসূ নয়। কারণ, সৎ কাজের আদেশ দেয়ার পাশাপাশি মন্দ ও দুষ্টের দমনের কথাও বলা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত : অন্যদের প্রতি সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বয়স, বংশ, শিক্ষা, সম্পদ ও পদমর্যাদা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। একজন মুসলমান যে কোন পদে আসলে অন্য একজন মুসলমানকে সৎ কাজের নির্দেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেয়ার অধিকার রাখে।

তৃতীয়ত : শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম মানদণ্ড হলো, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। যারা সমাজের শুভাকাঙ্ক্ষী তারাই এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

চতুর্থত : শ্রেষ্ঠ জাতি হবার জন্য ঈমান ও সৎ কাজ জরুরী। আর সৎ কাজ করতে হবে সমাজ সংশোধনের উদ্দেশ্যে, শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনের জন্য নয়।

৩:১১১ لَنۡ یَّضُرُّوۡکُمۡ اِلَّاۤ اَذًی ؕ وَ اِنۡ یُّقَاتِلُوۡکُمۡ یُوَلُّوۡکُمُ الۡاَدۡبَارَ ۟ ثُمَّ لَا یُنۡصَرُوۡنَ

সামান্য কষ্ট দেয়া ছাড়া তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তবে তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে; তারপর তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।

أَذًى (কষ্ট দেওয়া) বলতে মৌখিকভাবে মিথ্যা অপবাদ রটানো। এর দ্বারা সাময়িকভাবে অবশ্যই কষ্ট হয়। তবে যুদ্ধের ময়দানে তোমাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। হলও তা-ই। মদীনা থেকেও ইয়াহুদীদেরকে বের হতে হল। অতঃপর খায়বার জয় করলে সেখান থেকেও বের হল। অনুরূপ শাম (সিরিয়া) অঞ্চলে খ্রিষ্টানদেরকে মুসলিমদের হাতে পরাজিত হতে হয়।

ক্রুসেড যুদ্ধে খ্রিষ্টানরা এর প্রতিশোধ গ্রহণ করার প্রচেষ্টা চালায় এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করে নেয়। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আয়্যূবী ৯০ বছর পর পুনরায় তা ফিরিয়ে আনেন।

বর্তমানে মুসলিমদের ঈমানী দুর্বলতার ফল স্বরূপ এবং ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের মিলিত চক্রান্ত ও প্রচেষ্টায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস আবারও মুসলিমদের হাতছাড়া হয়েছে। তবে অতি সত্বর এমন সময় আসবে যে, অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, বিশেষ করে ঈসা (আঃ)-এর অবতরণের পর খ্রিষ্টবাদের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং সহীহ হাদীসসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত হবে। (ইবনে কাসীর)

এই আয়াতে মুসলমানদেরকে সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলছেন, যদি ঈমানের ওপর অটল থাক এবং ঐক্য ও সহমর্মিতা নিয়ে সমাজ সংস্কারের জন্য সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পালন কর তাহলে শত্রুদের মোকাবেলায় শত্রুরা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে পরাজিত হবে এবং তারা লাঞ্ছনা ও দারিদ্রের শিকার হবে। ইহুদীদের সম্পর্কে এই আয়াতে ঘোষিত ভবিষ্যদ্বাণী ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। ইহুদীরা সব সময়ই ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে এবং তারা কখনোই সম্মান ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বর্তমান যুগেও বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ব প্রচারণার মাধ্যম ইহুদী পুঁজিবাদীদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও ইহুদী ধর্মের ভিত্তিতে কোন স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে না। এমনকি ইহুদীবাদী ইসরাইল একটি অবৈধ ও দখলদার রাষ্ট্র। এজন্যে বিশ্বের জনগণ এই সরকারকে ঘৃণা করে। ইসরাইলের অবস্থা হচ্ছে চোর ও ডাকাতের মত, যারা মানুষের সম্পদ লুট করে বিপুল সম্পদের অধিকারী হলেও কখনও মর্যাদার অধিকারী নয়। বরং মানুষ সব সময়ই তাদের ঘৃণা করে। এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, একটি শক্তিশালী দূর্গের মত। এই বিশ্বাস শত্রুদের অনুপ্রবেশ বা প্রভাবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং শত্রুদেরকে পালিয়ে যেতে ও পরাজিত হতে বাধ্য করে।

দ্বিতীয়ত : সম্মান অর্জনের উপায় হলো দু’টি। প্রথম উপায় হলো আল্লাহর সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয় উপায় হলো, জনগণের সাথে কল্যাণকর সম্পর্ক রাখা। মানুষ যদি এই দুই সূত্র অনুযায়ী চলে তাহলে অন্য কোন শক্তিই সমাজে প্রভাব ও কর্তৃত্ব সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না।

তৃতীয়ত : অপরাধ ও আগ্রাসনই লাঞ্ছনা এবং অপমানের প্রধান কারণ।

 

৩:১১২ ضُرِبَتۡ عَلَیۡہِمُ الذِّلَّۃُ اَیۡنَ مَا ثُقِفُوۡۤا اِلَّا بِحَبۡلٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ حَبۡلٍ مِّنَ النَّاسِ وَ بَآءُوۡ بِغَضَبٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ ضُرِبَتۡ عَلَیۡہِمُ الۡمَسۡکَنَۃُ ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ کَانُوۡا یَکۡفُرُوۡنَ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ وَ یَقۡتُلُوۡنَ الۡاَنۡۢبِیَآءَ بِغَیۡرِ حَقٍّ ؕ ذٰلِکَ بِمَا عَصَوۡا وَّ کَانُوۡا یَعۡتَدُوۡنَ

আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও মানুষের প্রতিশ্রুতির বাইরে যেখানেই তাদেরকে পাওয়া গেছে সেখানেই তারা লাঞ্ছিত হয়েছে। আর তারা আল্লাহ্‌র ক্রোধের পত্র হয়েছে এবং তাদের উপর দারিদ্র নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এটা এ জন্যে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করত এবং অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করত; তা এ জন্যে যে, তারা অবাধ্য হয়েছিল এবং সীমালংঘন করত।

আল্লাহর গযবের ফল স্বরূপ ইয়াহুদীদের উপর যে লাঞ্ছনা ও দরিদ্রতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে সাময়িকভাবে বাঁচার দু’টি উপায় বলা হয়েছে।

এক হল, তাদেরকে আল্লাহর আশ্রয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ, হয় তারা ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা ইসলামী দেশে কর বা ট্যাক্স দিয়ে আশ্রিত হয়ে থাকা পছন্দ করবে। দ্বিতীয় হল, তারা মানুষের আশ্রয় লাভ করবে। আর এর দু’টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে,

(ক) ইসলামী দেশের সরকার নয়, বরং কোন সাধারণ মুসলিম তাদের আশ্রয় দেবে। আর এই অধিকার প্রত্যেক মুসলিমের আছে এবং দেশের সরকারকে তাকীদ করা হয়েছে যে, সে যেন কোন নিম্ন পর্যায়ের মুসলিমের দেওয়া আশ্রয়কেও প্রত্যাখ্যান না করে। (খ) তারা বড় কোন অমুসলিম শক্তির সহায়তা লাভ করবে। কারণ, ‘নাস’ (মানুষ) সাধারণ শব্দ যা মুসলিম ও অমুসলিম সকলকেই শামিল করে।

এ হল তাদের কুকর্ম, যার প্রতিফল স্বরূপ তাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

৩:১১৩ لَیۡسُوۡا سَوَآءً ؕ مِنۡ اَہۡلِ الۡکِتٰبِ اُمَّۃٌ قَآئِمَۃٌ یَّتۡلُوۡنَ اٰیٰتِ اللّٰہِ اٰنَآءَ الَّیۡلِ وَ ہُمۡ یَسۡجُدُوۡنَ

তারা সবাই একরকম নয়। কিতাবীদের মধ্যে অবিচলিত এক দল আছে; তারা রাতে আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে এবং তারা সিজদা করে।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার সালাত অনেক দেরী করে আদায় করলেন, তারপর মসজিদের দিকে বের হয়ে দেখতে পেলেন যে, লোকেরা সালাতের অপেক্ষা করছে। তখন তিনি বললেনঃ কোন দ্বীনের কেউই তোমাদের মত এ সময়ে সালাত আদায় করে না। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তখন এ আয়াত নাযিল হল। [মুসনাদে আহমাদঃ ১/৩৯৬]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, যখন আবদুল্লাহ ইবন সালাম, সালাবাহ ইবন সাইয়াহ, উসাইদ ইবন সা’ইয়াহ ও আসাদ ইবন উবাইদ সহ একদল ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনল, তখন ইয়াহুদী নেতারা বলতে লাগল, মুহাম্মাদের উপর যারা ঈমান এনেছে তারা হচ্ছে আমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট লোক। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [তাবারী; আত-তাফসীরুস সহীহ] অর্থাৎ ইয়াহুদী-নাসারা সবাই যে ক্ষতিগ্রস্ত তা কিন্তু নয়। তাদের মধ্যে যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান এনেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে মুক্তি পাবে।

পূর্বের আয়াতে যেসব আহলে-কিতাবের নিন্দাবাদ আলোচিত হয়েছে, তাদের সকলে এক রকম ছিল না, বরং তাদের মধ্যে কিছু ভাল মানুষও ছিলেন। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম, উসায়েদ ইবনে উবায়েদ, সালাবা ইবনে সায়্যাহ এবং উসায়েদ ইবনে সা’য়্যাহ প্রভৃতি যাঁরা আল্লাহর তাওফীকে ইসলাম কবুল করার মর্যাদা লাভে ধন্য হন এবং তাঁদের মধ্যে ঈমান ও আল্লাহভীরুতার গুণ বিদ্যমান ছিল- রাযীআল্লাহু আনহুম অ রাযু আনহু- (আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।)  أمَّة قَائِمَةٌ (হকপন্থী দল) এর অর্থ হল, শরীয়তের এবং নবী করীম (সাঃ)-এর অনুসরণ ও আনুগত্যকারী দল।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয় গ্রন্থধারীদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছে যারা আল্লাহতে, তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আল্লাহর নিকট বিনয়াবনত হয়ে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর আয়াতকে স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করে না; এরাই তো সেই সকল লোক যাদের জন্য আল্লাহর নিকট পুরস্কার রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।’’ (সূরা আলে ইমরান ১৯৯ আয়াত)

৩:১১৪ یُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡہَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ یُسَارِعُوۡنَ فِی الۡخَیۡرٰتِ ؕ وَ اُولٰٓئِکَ مِنَ الصّٰلِحِیۡنَ

তারা আল্লাহ এবং শেষ দিনে ঈমান আনে, সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অসৎকাজে নিষেধ করে এবং তারা কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা করে। আর তারাই পূণ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত।

এ আয়াতে আহলে কিতাব তথা ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তাদের কিছু গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে যে,

প্রথমত: তারা হকের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে, কোন কিছুই তাদেরকে হক পথ থেকে টলাতে পারে না।

দ্বিতীয়ত: তারা রাতের বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে।

তৃতীয়ত: তারা সালাত আদায় করে।

চতুর্থত: তারা আল্লাহর উপর পূর্ণ ঈমান রাখে,

পঞ্চমত: তারা সৎকাজের আদেশ দেয়,

ষষ্টত; তারা অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে।

আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্কদৃষ্টে মনে হয়, যখন আল্লাহ্ তা’আলা এ উম্মাতে মুহাম্মদীকে সবচেয়ে উত্তম উম্মত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তার কারণ হিসেবে ঈমান ও সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করার গুণ তাদের জন্য সাব্যস্ত করেছেন, তখন এ গুণগুলো অন্যান্য উম্মত বিশেষ করে আহলে কিতাবদের যাদের মধ্যে পাওয়া যাবে, তাদেরকেও উত্তম উম্মতের অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন।

পবিত্র কুরআনের অন্যান্য স্থানে এ ঈমানদার আহলে কিতাবদের আরও কিছু গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে, “আর যাদেরকে আমরা কিতাব দিয়েছি, তাদের মধ্যে যারা যথাযথভাবে তা তিলাওয়াত করে, তারা তাতে ঈমান আনে ৷ [সূরা আল-বাকারাহ: ১২১]

৩:১১৫ وَ مَا یَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ فَلَنۡ یُّکۡفَرُوۡہُ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌۢ بِالۡمُتَّقِیۡنَ

আর উত্তম কাজের যা কিছু তারা করে তা থেকে তাদেরকে কখনো বঞ্চিত করা হবে না। আর আল্লাহ মুত্তাকীদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবগত।

আগের কয়েকটি আয়াতে মুমিনদের বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে আহলে কিতাবদের কোন কোন দলের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বক্তব্যের পর এই কয়েকটি আয়াতে আহলে কিতাবদের ভালো লোকদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, এমন ধারণা করা ঠিক নয় যে, আহলে কিতাবদের মধ্যে সবাই ষড়যন্ত্রকারী, তাদের মধ্যে তোমাদের মুসলমানদের মত সৎ লোকও রয়েছে। তাদের অনেকেই গভীর রাতে আল্লাহর ইবাদত করে। তারা আল্লাহর ওপর ও বিচার দিবসের ওপরও ঈমান রাখে। নিজেদের মধ্যে এবং সমাজে সৎ কাজের প্রসার ও অসৎ কাজের প্রতিরোধে সক্রিয় থাকে। বিশেষ করে, তারা সৎ কাজে অগ্রগামী। আল্লাহ তাদের সৎ কাজ উপেক্ষা করবেন না এটাই স্বাভাবিক এবং তারা অবশ্যই আল্লাহর অনুগ্রহ পাবে। কারণ, বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলরা যেই বা যারাই হোক না কেন আল্লাহর কাছে গ্রহণীয়। আহলে কিতাবের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণের ব্যাপারে এটাই কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি। অমুসলমানদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে এই মানদণ্ড মনে রাখতে হবে। আমরাও যদি সৎ ও ন্যায় পরায়ণ হই, তাহলে আমাদের সৎ আচরণই ইসলামের প্রতি অন্যদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট হবে এবং এজন্যে ব্যাপক প্রচারের দরকার নেই।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : যারাই সৎ কাজ করুক না কেন তার উপযুক্ত সম্মান ও মূল্য দেয়া উচিত এবং তা স্বীকার করতে হবে। কোন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে একদল মন্দ বললে তাদের সৎ লোকদের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

দ্বিতীয়ত : মানুষ রাতের বেলায় যখন ঘুমে থাকে, তখনই প্রার্থনা ও আল্লাহর কাছে নিজের অন্তরকে খুলে দেয়ার শ্রেষ্ঠ সময়।

তৃতীয়ত : মুসলমানরা ছাড়াও অন্যান্য খোদায়ী ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের প্রতিরোধের প্রচলন ছিল।

চতুর্থত : রাতের বেলায় ব্যক্তিগত ইবাদত ও প্রার্থনা যেমন জরুরী, তেমনি দিনের বেলায় সৎ কাজের প্রসার ও অসৎকাজ প্রতিরোধের দায়িত্ব পালনও জরুরী।

পঞ্চমত : পবিত্র কোরআন সৎ কাজের প্রসারকে অসৎ কাজ প্রতিরোধের পূর্বশর্ত হিসেবে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ, সৎ কাজের প্রসার ঘটলে অসৎ কাজের পথ এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। যদি সমাজে বিয়ের প্রথা সহজ হয়ে যায়, তাহলে জেনা ও ব্যভিচারের ক্ষেত্র আপনা আপনিই সংকুচিত হয়ে পড়বে।

ষষ্ঠতম : সৎকাজের অভিজ্ঞতা ও সক্রিয়তা এর মূল্য বৃদ্ধি করে। তাই সৎ কাজে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে।

৩:১১৬ اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَنۡ تُغۡنِیَ عَنۡہُمۡ اَمۡوَالُہُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُہُمۡ مِّنَ اللّٰہِ شَیۡـًٔا ؕ وَ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ

. নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর কাছে কখনো কোন কাজে আসবে না। আর তারাই অগ্নিবাসী, তারা সেখানে স্থায়ী হবে।

৩:১১৭ مَثَلُ مَا یُنۡفِقُوۡنَ فِیۡ ہٰذِہِ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا کَمَثَلِ رِیۡحٍ فِیۡہَا صِرٌّ اَصَابَتۡ حَرۡثَ قَوۡمٍ ظَلَمُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ فَاَہۡلَکَتۡہُ ؕ وَ مَا ظَلَمَہُمُ اللّٰہُ وَ لٰکِنۡ اَنۡفُسَہُمۡ یَظۡلِمُوۡنَ

এ পার্থিব জীবনে যা তারা ব্যয় করে তার দৃষ্টান্ত হিমশীতল বায়ু, যা আঘাত করে ঐ জাতির শস্যক্ষেতে, যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছে; অতঃপর তা ধ্বংস করে দেয়। আর আল্লাহ্ তাদের প্রতি কোন যুলুম করেননি, তারাই নিজেদের প্রতি যুলুম করে।

এই উপমাটিতে শস্যক্ষেত মানে হচ্ছে জীবন ক্ষেত্র৷ আখেরাতে মানুষকে তার এই জীবনক্ষেতের ফসল কাটতে হবে৷ বাতাস বলতে মানুষের বাহ্যিক কল্যাণাকাংখাকে বুঝানো হয়েছে৷ যার ভিত্তিতে কাফেররা জনকল্যাণমূলক কাজ এবং দান খয়রাত ইত্যাদিতে অর্থ ব্যয়্ করে থাকে৷

আর তূষারকণা হচ্ছে, সঠিক ঈমান ও আল্লাহর বিধান অনুসৃতির অভাব, যার ফলে তাদের সমগ্র জীবন মিথ্যায় পর্যবসিত হয়৷ এ উপমাটির সাহায্যে আল্লাহ একথা বলতে চাচ্ছেন যে, শস্যক্ষেতের পরিচর্যার ক্ষেত্রে বাতাস যেমন উপকারী তেমনি আবার এই বাতাসের মধ্যে যদি তূষারকণা থাকে তাহলে তা শস্যক্ষেতকে সবুজ শ্যামল করার পরিবর্তে ধ্বংস করে দেয়৷ ঠিক তেমনি দান-খয়রাত যদিও মানুষের আখেরাতের ক্ষেতের পরিচর্যা করে কিন্তু তার মধ্যে কুফরীর বিষ মিশ্রিত থাকলে তা লাভজনক হবার পরিবর্তে মানুষের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়৷

একথা সুস্পষ্ট যে,মানুষের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ এবং মানুষ যে ধন-সম্পদ ব্যয় করছে তার মালিকও আল্লাহ৷ এখন যদি আল্লাহর এই দাস তার মালিকের সার্বভৌম কর্তৃত্ব স্বীকার না করে অথবা তাঁর বন্দেগীর সাথে আর কারো অবৈধ বন্দেগী শরীক করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ ব্যয় করে ও তাঁর রাজ্যের মধ্যে চলাফেরা ও বিভিন্ন কাজ কারবার করে তাঁর আইন ও বিধানের আনুগত্য না করে, তাহলে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার এ সমস্ত কাজ অপরাধে পরিণত হয়৷ প্রতিদান-পাওয়া তো দূরের কথা বরং এই সমস্ত অপরাধ তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করার ভিত্তি সরবরাহ করে৷ তার দান খয়রাতের দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ কোন চাকর যেন তার মনিবের অনুমতি ছাড়াই তার অর্থ ভাণ্ডারের দরজা খুলে নিজের ইচ্ছামত যেখানে সংগত মনে করলো সেখানে ব্যয় করে ফেললো৷

“যেদিন যালেমদের কোন ওজর-আপত্তি কাজে আসবে না, আর তাদের জন্য থাকবে লা’নত এবং তাদের জন্য থাকবে খারাপ আবাস” [গাফের: ৫২]

দুনিয়াতে তাদেরকে যে সমস্ত সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দেয়া হয়েছিল তাও তাদের কোন উপকার দিবে না এবং তাদেরকে আল্লাহর কঠোর শাস্তি ও কঠিন পাকড়াও থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হবে না। অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা

এ বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন, “কাজেই ওদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আপনাকে যেন বিমুগ্ধ না করে, আল্লাহ তো এসবের দ্বারাই ওদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান। ওরা কাফের থাকা অবস্থায় ওদের আত্মা দেহত্যাগ করবে” [আত-তাওবাহঃ ৫৫]

আরও বলেন, “যারা কুফরী করেছে, দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন কিছুতেই আপনাকে বিভ্রান্ত না করে। এ তো স্বল্পকালীন ভোগ মাত্র; তারপর জাহান্নাম তাদের আবাস আর ওটা কত নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল! [সূরা আলে ইমরান: ১৯৬–১৯৭]

 

৩:১১৮ یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوۡا بِطَانَۃً مِّنۡ دُوۡنِکُمۡ لَا یَاۡلُوۡنَکُمۡ خَبَالًا ؕ وَدُّوۡا مَا عَنِتُّمۡ ۚ قَدۡ بَدَتِ الۡبَغۡضَآءُ مِنۡ اَفۡوَاہِہِمۡ ۚۖ وَ مَا تُخۡفِیۡ صُدُوۡرُہُمۡ اَکۡبَرُ ؕ قَدۡ بَیَّنَّا لَکُمُ الۡاٰیٰتِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ

হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের অনিষ্ট করতে ক্রটি করবে না; তারা যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে তা-ই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং তাদের হৃদয় যা গোপন রাখে তা আরো গুরুতর। তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর.

মদীনার আশেপাশে যেসব ইহুদী বাস করতো আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের সাথে প্রাচীন কাল থেকে তাদের বন্ধুত্ব চলে আসছিল৷ এ দুই গোত্রের লোকেরা ব্যক্তিগতভাবেও বিভিন্ন ইহুদীরা সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতো এবং গোত্রীয়ভাবেও তারা ছিল পরস্পরের প্রতিবেশী ও সহযোগী৷

আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা মুসলমান হয়ে যাবার পরও ইহুদীদের সাথে তাদের সেই পুরাতন সম্পর্ক বজায় রেখেছিল৷ ব্যক্তিগতভাবেও তারা তাদের পুরাতন ইহুদী বন্ধুদের সাথে আগের মতই প্রীতি ও আন্তরিকতার সাথে মেলামেশা করতো৷ কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর মিশনের বিরুদ্ধে ইহুদীদের মধ্যে যে শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল তার ফলে তারা এই নতুন আন্দোলনে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে প্রস্তুত ছিল না৷ আনসারদের সাথে তারা বাহ্যত আগের সম্পর্ক বজায় রেখেছিল৷ কিন্তু মনে মনে তারা হয়ে গিয়েছিল তাদের চরম শত্রু ৷ ইহুদীরা তাদের এই বাহ্যিক বন্ধুত্বকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে মুসলমানদের জামায়াতে অভ্যন্তরীণ ফিত্‌না ও ফাসাদ সৃষ্টি করার এবং তাদের জামায়াতের গোপন বিষয়গুলোর খবর সংগ্রহ করে শত্রুদের হাতে পৌছিয়ে দেবার জন্য সর্বক্ষন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল৷ মহান আল্লাহ এখানে তাদের এই মুনাফেকী কর্মনীতি থেকে মুসলমানদের সাবধান থাকার নির্দেশ দিয়েছেন৷

 

অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ মিত্ররূপে গ্রহণ করো না। بطانة শব্দের অর্থ অভিভাবক, বন্ধু, বিশ্বস্ত, রহস্যবিদ। কাপড়ের অভ্যন্তর ভাগকেও بطانة বলা হয়, যা শরীরের সাথে মিশে থাকে। কোন ব্যক্তির অভিভাবক, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং যার সাথে পরামর্শ করে কাজ করা হয়, এরূপ ব্যক্তিকে তার بطانة বলা হয়। এখানে بطانة বলে বন্ধু, বিশ্বস্ত, গোপন তথ্যের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য লোককে বোঝানো হয়েছে। অতএব আলোচ্য আয়াতে মুসলিমদের উপদেষ্টারূপে গ্রহণ করে তাদের কাছে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য প্রকাশ করতে যেও না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তাআলা যখনই কোন নবী পাঠিয়েছেন বা কোন খলীফা বা রাষ্ট্রনায়ককে ক্ষমতা প্রদান করেছেন, তখনই তার দু’ধরনের মিত্রের সমাহার ঘটে।

এক ধরনের মিত্র তাকে সৎকাজের আদেশ দেয় এবং সেটার উপর উৎসাহ যোগায়। অপর ধরনের মিত্র তাকে খারাপ কাজের নির্দেশ দেয় এবং সেটার উপর উদ্দীপনা দিতে থাকে।

আল্লাহ যাকে হেফাযত করতে ইচ্ছা করেন তিনি ব্যতীত সে মিত্রের অকল্যাণ থেকে বাঁচার কোন পথ থাকে না।” [বুখারী: ৭১৯৮]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, অন্ধকার যুগে কোন কোন মুসলিমের সাথে কোন কোন ইয়াহুদীর সন্ধিচুক্তি ছিল। সে চুক্তির কারণে ইসলাম গ্রহণের পরও মুসলিমরা তাদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় রাখত। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করে ইয়াহুদী-নাসারা তথা অমুসলিমদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশ দেন। [ইবন আবী হাতেম, আততাফসীরুস সহীহ]

(২) অর্থাৎ তারা তোমাদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে কসুর করবে না। তারা তোমাদের বিপদ কামনা করে। এ ধরনের কিছু বিষয় স্বয়ং তাদের মুখেও প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু অন্তরে যে শক্রতা গোপন রাখে, তা আরও মারাত্নক। আমি তোমাদেরকে সামনে সব আলামত প্রকাশ করে দিয়েছি; এখন তোমরা যদি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পার তবে তা থেকে উপকার পেতে পার।

উদ্দেশ্য এই যে, ইয়াহুদী হোক কিংবা নাসারা, কপট বিশ্বাসী মুনাফেক হোক কিংবা মুশরেক- কেউ তোমাদের সত্যিকার হিতাকাঙ্খী নয়। তারা সর্বদাই তোমাদের বোকা বানিয়ে তোমাদের ক্ষতি সাধনে ব্যাপৃত এবং ধর্মীয় ও পার্থিব অনিষ্ট সাধনে সচেষ্ট থাকে। তোমরা কষ্টে থাক এবং কোন না কোন উপায়ে তোমাদের দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি হোক, এটাই হলো তাদের কাম্য। তাদের অন্তরে যে শক্রতা লুক্কায়িত রয়েছে, তা খুবই মারাত্নক। কিন্তু মাঝে মাঝে দুর্দমনীয় জিঘাংসায় উত্তেজিত হয়ে এমন সব কথাবার্তা বলে ফেলে, যা তাদের গভীর শক্ৰতার পরিচায়ক। শক্রতা ও প্রতিহিংসায় তাদের মুখ থেকে অসংলগ্ন কথা বের হয়ে পড়ে। সুতরাং এহেন শক্রদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আল্লাহ তা’আলা শত্রু-মিত্রের পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপনের বিধান বলে দিয়েছেন, সুতরাং মুসলিমদের এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া খুবই সমীচীন।

 

(৩) ইসলাম বিশ্বব্যাপী করুণার ছায়াতলে মুসলিমগণকে অমুসলিমদের সাথে সহানুভুতি, শুভেচ্ছা, মানবতা ও উদারতার অসাধারণ নির্দেশ দিয়েছে। এটা শুধু মৌখিক নির্দেশই নয়; বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ একে কার্যে পরিণত করেও দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মুসলিমদের নিজস্ব রাষ্ট্র ও তার বৈশিষ্ট্যপুর্ণ কার্যাবলী সংরক্ষণের স্বার্থে ইসলাম এ নির্দেশও দিয়েছে যে, ইসলামী আইনে অবিশ্বাসী ও বিদ্রোহীদের সাথে সম্পর্ক একটি বিশেষ সীমার বাইরে এগিয়ে নেয়ার অনুমতি মুসলিমদের দেয়া যায় না। কারণ, এতে ব্যক্তি ও জাতি উভয়েরই সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি যুক্তিপুর্ণ, সঙ্গত ও জরুরী ব্যবস্থা। এতে ব্যক্তি ও জাতি উভয়েরই হেফাজত হয়। যে সব অমুসলিম মুসলিম রাষ্ট্রের বাসিন্দা কিংবা মুসলিমদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ, তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষনের জন্যে জোরদার নির্দেশাবলী ইসলামী আইনের গুরুত্বপুর্ণ অংশ।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “সাবধান! যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের প্রতি অত্যাচার করে কিংবা তার প্রাপ্য হ্ৰাস করে কিংবা তার উপর সামর্থ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয় অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কাছ থেকে কোন জিনিস গ্রহণ করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি তার পক্ষ থেকে উকিল হবো”। [আবু দাউদঃ ৩০৫২]

কিন্তু এসব উদারতার সাথে সাথে মুসলিমদের নিজস্ব সত্তার হেফাযতের স্বার্থে এ নির্দেশও দেয়া হয়েছে যে, ইসলাম ও মুসলিমদের শক্রদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু কিংবা বিশ্বস্ত মুরুব্বীরূপে গ্রহণ করো না।

উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলা হলো যে, এখানে একজন হস্তলিপিতে সুদক্ষ অমুসলিম বালক রয়েছে। আপনি তাকে ব্যক্তিগত মুনশী হিসাবে গ্রহণ করে নিলে ভালই হবে।

উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তরে বলেনঃ এরূপ করলে মুসলিমদের ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিশ্বস্তরূপে গ্রহণ করা হবে, যা কুরআনে নির্দেশের পরিপন্থী। [ইবন আবী হাতেম; আত-তাফসীরুস সহীহ]

ইমাম কুরতুবী হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর বিখ্যাত আলেম ও তফসীরবিদ। তিনি অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে মুসলিমদের মধ্যে এ শিক্ষার বিরুদ্ধাচরন ও তার অশুভ পরিণাম এভাবে বর্ণনা করেনঃ “আজকাল অবস্থা এমন পাল্টে গেছে যে, ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্যরূপে গ্রহণ করা হচ্ছে এবং এভাবে ওরা মুর্খ বিত্তশালী ও শাসকদের ঘাড়ে চেপে বসেছে।” আধুনিক সভ্যতার যুগেও বিশেষ মতাদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে সংশ্লিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়- এমন কোন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা ও মুরুব্বীরূপে গ্রহণ করা হয় না। তাই মুসলিম শাসকগণেরও এ ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত।তাফসীরে জাকারিয়া

(১১৮) হে বিশ্বাসিগণ! তোমাদের আপনজন ব্যতীত অন্য (অবিশ্বাসী) কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।  তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোন ত্রুটি করবে না। যাতে তোমরা বিপন্ন হও, তাই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং যা তাদের অন্তর গোপন রাখে, তা আরও গুরুতর। তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর।

 

এই বিষয়টা পূর্বেও আলোচিত হয়েছে। বিষয়টা যেহেতু অতীব গুরুত্বপূর্ণ তাই এখানে তার পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। بِطَانَة বলা হয় অন্তরঙ্গ ও বিশ্বস্ত বন্ধু এবং রহস্যবিদকে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফের ও মুশরিকরা যে সব অসদিচ্ছা ও দুরভিসন্ধি রাখে এবং তার মধ্যে যা তারা প্রকাশ করে আর যা নিজেদের অন্তরে গোপন রাখে, তার সব কিছুকেই মহান আল্লাহ (কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে) চিহ্নিত করে দিয়েছেন। এই আয়াত এবং এই ধরনের অন্য আয়াতসমূহের ভিত্তিতে উলামা ও ফক্বীহগণ লিখেছেন যে, কোন ইসলামী দেশে অমুসলিমদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কোন (নেতৃত্ব) পদে নিযুক্ত করা জায়েয নয়।

বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ মুসা আশআরী (রাঃ) একজন অমুসলিমকে সেক্রেটারী (কর্মসচিব) নিযুক্ত করেন। উমার (রাঃ) এ ব্যাপার জানতে পারলে তাঁকে কঠোর ধমক দিয়ে বলেন, ‘তুমি ওদেরকে তোমার কাছে টেনে নিও না, যখন আল্লাহ ওদেরকে দূর করে দিয়েছেন। তুমি ওদের সম্মান দান করো না, যখন আল্লাহ ওদেরকে লাঞ্ছিত করেছেন। আর তুমি ওদেরকে বিশ্বস্ত ও গোপন তথ্যের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য মনে করো না, কারণ আল্লাহ ওদেরকে বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত করেছেন।’ উমার (রাঃ) এই আয়াতের ভিত্তিতেই এই ধরনের কথা বলেছেন। ইমাম ক্বুরত্বুবী বলেন, ‘এই যুগে আহলে-কিতাবকে সেক্রেটারী নিযুক্ত এবং বিশ্বস্ত মনে করার কারণে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই কারণেই নির্বোধ ও বোকা প্রকৃতির লোকেরা নেতা ও আমীর হয়ে বসে আছে।’ (তাফসীর ক্বুরত্বুবী) দুর্ভাগ্যবশতঃ বর্তমানে বহু মুসলিম দেশেও কুরআন কারীমের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই নির্দেশের কোনই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাই তো অমুসলিমরা মুসলিম দেশেও বড় বড় পদে এবং বিশেষ বিশেষ দায়িত্বে বহাল রয়েছে। আর এর অনিষ্টকারিতা যে কত বড় তা সকলের কাছে পরিষ্কার। যদি মুসলিম দেশগুলো স্বীয় দেশের সবরাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রীয় নীতির ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশকে গুরুত্ব দিত, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা বহু ফিতনা-ফাসাদ ও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেত।

لاَ يَألُوْنَ  ত্রুটি ও কসুর করবে না। خَبَالًا এর অর্থঃ বিশৃঙ্খলা, অনিষ্ট ও কষ্ট। مَا عَنِتُّمْ (যাতে তোমরা বিপন্ন হও, কষ্টে পতিত হও) عَنَتٌ মানে কষ্ট, বিপদ।

 

৩:১১৯ ہٰۤاَنۡتُمۡ اُولَآءِ تُحِبُّوۡنَہُمۡ وَ لَا یُحِبُّوۡنَکُمۡ وَ تُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡکِتٰبِ کُلِّہٖ ۚ وَ اِذَا لَقُوۡکُمۡ قَالُوۡۤا اٰمَنَّا ۚ٭ۖ وَ اِذَا خَلَوۡا عَضُّوۡا عَلَیۡکُمُ الۡاَنَامِلَ مِنَ الۡغَیۡظِ ؕ قُلۡ مُوۡتُوۡا بِغَیۡظِکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ

দেখ, তোমরাই তাদেরকে ভালবাস কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না অথচ তোমরা সব কিতাবে ঈমান রাখ। আর তারা যখন তোমাদের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি; কিন্তু তারা যখন একান্তে মিলিত হয় তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে তারা নিজেদের আঙ্গুলের অগ্রভাগ দাঁত দিয়ে কাটতে থাকে। বলুন, ‘তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মর। নিশ্চয় অন্তরে যা রয়েছে সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবগত।

অর্থাৎ এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপারই বলতে হবে, কোথায় তোমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে,তা নয় বরং তারা তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে৷ তোমরা তো কুরআনের সাথে তাওরাতকেও মানো, তাই তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ করার কোন যুক্তিসংগত কারণ থাকেত পারে না৷ বরং তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের অভিযোগ থাকতে পারতো৷কারণ তারা কুরআনকে মানে না৷

অর্থাৎ, তোমরা ঐ মুনাফিকদের নামায এবং (মৌখিকভাবে) তাদের ঈমান প্রকাশ করার কারণে ধোঁকায় পড়ে তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন কর।

عَضَّ يَعُضُّ এর অর্থ হল দাঁত দিয়ে কাটা। এই শব্দ দ্বারা তাদের রোষ ও ক্রোধের ভীষণতা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন পরের [اِنْ تَمْسَسْكُمْ] আয়াতেও তাদের ক্রোধের ধরন প্রকাশ করা হয়েছে।

৩:১২০ اِنۡ تَمۡسَسۡکُمۡ حَسَنَۃٌ تَسُؤۡہُمۡ ۫ وَ اِنۡ تُصِبۡکُمۡ سَیِّئَۃٌ یَّفۡرَحُوۡا بِہَا ؕ وَ اِنۡ تَصۡبِرُوۡا وَ تَتَّقُوۡا لَا یَضُرُّکُمۡ کَیۡدُہُمۡ شَیۡـًٔا ؕ اِنَّ اللّٰہَ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ مُحِیۡطٌ

তোমাদের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা তাতে আনন্দিত হয়। তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকী হও তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ্ তা পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।

অর্থাৎ তাদের কাফেরসুলভ মনোভাবের আরো প্রমাণ হলো, তাদের অবস্থা এই যে, তোমরা কোন সুখকর অবস্থার সম্মুখীন হলে তারা দুঃখিত হয়, আর তোমরা কোন বিপদে পতিত হলে তারা আনন্দে গদগদ হয়ে ওঠে। অতঃপর আয়াতে এ ধরনের লোকদের চক্রান্ত এবং শক্রতার অশুভ পরিণাম থেকে নিরাপদ থাকার জন্যে একটি সহজ সুন্দর ব্যবস্থা বাতলে দেয়া হচ্ছেঃ “তোমরা ধৈর্য ধারণ করলে এবং তাকওয়া অবলম্বন করলে ওদের চক্রান্ত তোমাদের বিন্দুমাত্রও অনিষ্ট করতে পারবে না”। কাতাদা বলেন, আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যখন তারা মুসলিমদের মধ্যে পরস্পর বন্ধুত্ব ও ঐক্যবদ্ধতা দেখে এবং শক্রদের উপর মুসলিমদের বিজয় প্রত্যক্ষ করে, তখন তারা কষ্ট পায়। আর যখন মুসলিমদের মধ্যে দলাদলি ও মতবিরোধ হয়েছে দেখতে পায়, অথবা মুসলিমদের কোন পরাজয় লক্ষ্য করে, তখনি তারা খুশীতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। যখনি তাদের এ ধরনের লোকের আবির্ভাব হবে, তখনি আল্লাহ্ তাআলা তাদের গোপন অবস্থা প্রকাশ করে দিবেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের এ অবস্থা চলতে থাকবে। [তাবারী]

মুনাফিকরা মু’মিনদের সাথে যে কঠোর শত্রুতা পোষণ করত, সে কথা এখানে তুলে ধরে বলা হচ্ছে যে, যখন মুসলিমরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করত, আল্লাহর পক্ষ হতে যখন তারা সমর্থন ও সাহায্য পেত এবং তাদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি লাভ করত, তখন মুনাফিকদেরকে বড়ই খারাপ লাগত। আর যখন মুসলিমরা অনাবৃষ্টি ও সংকীর্ণতার শিকার হত অথবা আল্লাহর ইচ্ছা ও কৌশলের ভিত্তিতে শত্রু সাময়িকভাবে তাদের উপর জয়লাভ করত (যেমন উহুদ যুদ্ধে হয়েছিল), তখন এরা বড়ই খুশী হত। বলার উদ্দেশ্য হল, যাদের অবস্থা হল এই, তারা কি এই যোগ্যতার অধিকারী যে, মুসলিমরা তাদের প্রতি সম্প্রীতির হাত বাড়াবে এবং তাদেরকে রহস্যবিদ্ ও অন্তরঙ্গ বন্ধু বানিয়ে নেবে? এই কারণেই মহান আল্লাহ ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের সাথেও বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করেছেন (যেমন কুরআনের অন্যত্র এসেছে)। কেননা, তারাও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করে। মুসলিমদের সফলতায় তারা নিরানন্দ এবং তাদের অসফলতায় তারা আনন্দ বোধ করে।

এটা হল তাদের প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা থেকে বাঁচার পথ ও চিকিৎসা। অর্থাৎ, মুনাফিক এবং ইসলাম ও মুসলিমদের অন্যান্য সকল শক্রর চক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্য ধৈর্য ও আল্লাহভীরুতার প্রয়োজন অত্যধিক। মুসলিমদের মাঝে এই ধৈর্য ও তাকওয়া না থাকার ফলেই অমুসলিমদের যাবতীয় চক্রান্ত সাফল্যমন্ডিত হয়েছে। মানুষ মনে করে যে, কাফেরদের সফলতার কারণ হল, আর্থিক উপায়-উপকরণের প্রাচুর্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় তাদের উন্নতি। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হল, মুসলিমদের অবনতির মূল কারণ তাদের দ্বীনের উপর ধৈর্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত না থাকা এবং তাকওয়া-শূন্যতা। পক্ষান্তরে এই দু’টি জিনিসই হল মুসলিমদের উন্নতির চাবিকাঠি এবং আল্লাহর বিজয় লাভের অসীলা।

তাফসীরে জাকারিয়া, তাফহীমুল কুর’আন ও তাফসীরে আহসানুল বায়ান