بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
৩:৪১ قَالَ رَبِّ اجۡعَلۡ لِّیۡۤ اٰیَۃً ؕ قَالَ اٰیَتُکَ اَلَّا تُکَلِّمَ النَّاسَ ثَلٰثَۃَ اَیَّامٍ اِلَّا رَمۡزًا ؕ وَ اذۡکُرۡ رَّبَّکَ کَثِیۡرًا وَّ سَبِّحۡ بِالۡعَشِیِّ وَ الۡاِبۡکَارِ
৪১. তিনি বললেন, হে আমার রব! আমাকে একটি নিদর্শন দিন। তিনি বললেন, আপনার নিদর্শন এই যে, তিন দিন আপনি ইঙ্গিত ছাড়া কথা বলবেন না, আর আপনার রবকে অধিক স্মরণ করুন এবং সন্ধ্যায় ও প্রভাতে তার পবিত্রতা-মহিমা ঘোষণা করুন।
প্রতিশ্রুত সেই সুসংবাদটি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতি এবং পুত্র জন্মগ্রহণের পূর্বেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশে মশগুল হওয়ার উদ্দেশ্যে যাকারিয়্যা আলাইহিস সালাম নিদর্শন জানতে চেয়েছিলেন। [কাশশাফ; ফাতহুল কাদীর]
আল্লাহ তা’আলা তাকে এ নিদর্শন দিলেন যে, তিন দিন পর্যন্ত তুমি মানুষের সাথে ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া কথা বলতে সমর্থ হবে না। এ নিদর্শনের মধ্যে সূক্ষ্মতা এই যে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে নিদর্শন চাওয়া হয়েছিল। আল্লাহ্ তা’আলা এমন নিদর্শন দিলেন যে, তাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া যাকারিয়্যা আলাইহিস সালাম অন্য কোন কাজের যোগ্যই থাকবেন না। [ফাতহুল কাদীর]
এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, কথা বলতে অক্ষম হলে ইশারা-ইঙ্গিত কথার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। এক হাদীসে বর্ণিত আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক দাসীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আল্লাহ কোথায়? উত্তরে সে আকাশের দিকে ইশারা করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ দাসী মুসলিম। তাকে আযাদ করে দাও। [মুসলিমঃ ৫৩৭]
৩:৪২ وَ اِذۡ قَالَتِ الۡمَلٰٓئِکَۃُ یٰمَرۡیَمُ اِنَّ اللّٰہَ اصۡطَفٰکِ وَ طَہَّرَکِ وَ اصۡطَفٰکِ عَلٰی نِسَآءِ الۡعٰلَمِیۡنَ
৪২. আর স্মরণ করুন, যখন ফেরেশতাগণ বলেছিল, হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে মনোনীত করেছেন এবং পবিত্র করেছেন আর বিশ্বজগতের নারীগণের উপর আপনাকে মনোনীত করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সবচেয়ে উত্তম মহিলা হলেন মারইয়াম বিনতে ইমরান। অনুরূপভাবে সবচেয়ে উত্তম মহিলা হলেন খাদীজা বিনতে খুয়াইলেদ। বুখারীঃ ৩৪৩২, মুসলিমঃ ২৪৩০]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পুরুষের মধ্যে অনেকেই পূর্ণতা লাভ করেছে। মেয়েদের মধ্যে কেবলমাত্র ফিরআউনের স্ত্রী আছিয়া এবং ইমরানের কন্যা মারইয়াম পূর্ণতা লাভ করেছে আর সমস্ত নারীদের উপর আয়েশার শ্রেষ্ঠত্ব যেমন সমস্ত খাবারের উপর ‘ছারীদ’-এর শ্রেষ্ঠত্ব। [বুখারী ৩৪৩৩; মুসলিম: ২৪৩১]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সৃষ্টিকুলের মহিলাদের মধ্যে শুধু উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মারইয়াম বিনতে ইমরান, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ ও ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া।” [তিরমিযী: ৩৮৭৮; মুসনাদে আহমাদ ৩/১৩৫; মুসান্নাফে আবদির রাযযাক ১১/৪৩০]
৩:৪৩ یٰمَرۡیَمُ اقۡنُتِیۡ لِرَبِّکِ وَ اسۡجُدِیۡ وَ ارۡکَعِیۡ مَعَ الرّٰکِعِیۡنَ
৪৩. হে মারইয়াম! আপনার রবের অনুগত হন এবং সিজদা করুন আর রুককারীদের সাথে ‘রুকূ’ করুন।
৩:৪৪ ذٰلِکَ مِنۡ اَنۡۢبَآءِ الۡغَیۡبِ نُوۡحِیۡہِ اِلَیۡکَ ؕ وَ مَا کُنۡتَ لَدَیۡہِمۡ اِذۡ یُلۡقُوۡنَ اَقۡلَامَہُمۡ اَیُّہُمۡ یَکۡفُلُ مَرۡیَمَ ۪ وَ مَا کُنۡتَ لَدَیۡہِمۡ اِذۡ یَخۡتَصِمُوۡنَ
৪৪. এটা গায়েবের সংবাদের অন্তর্ভুক্ত, যা আমরা আপনাকে ওহী দ্বারা অবহিত করছি। আর মারইয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে এর জন্য যখন তারা তাদের কলম নিক্ষেপ করছিল(১)
অর্থাৎ তারা কলম ফেলে লটারী করে মারইয়াম আলাইহাস সালাম কার তত্ত্বাবধানে থাকবেন সেটা নির্ধারণ করছিলেন। ইসলামী শরীয়তে লটারী সম্পর্কিত বিধান এই যে, যেসব হকের কারণ শরীয়তানুযায়ী নির্দিষ্ট ও জানা আছে, সেসব হকের মীমাংসা লটারীযোগে করা নাজায়েয এবং তা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণতঃ শরীকানাধীন বস্তুর মীমাংসা লটারীযোগে করা এবং লটারীতে যার নাম বের হয় তাকে সম্পূর্ণ বস্তুটি দিয়ে দেয়া অথবা কোন শিশুর পিতৃত্বে মতবিরোধ দেখা দিলে লটারযোগে একজনকে পিতা মনে করে নেয়া। পক্ষান্তরে যেসব হকের কারণ জনগণের রায়ের ওপর ন্যস্ত, সেসব হকের মীমাংসা লটারযোগে করা জায়েয। যথা- কোন শরীককে কোন অংশ দেয়া হবে, সেটা লটারীর মাধ্যমে মীমাংসা করা। এক্ষেত্রে লটারীর মাধ্যমে একজনকে পূর্বের অংশ অন্যজনকে পশ্চিমের অংশ দেয়া জায়েয। এর কারণ এই যে, লটারী ছাড়াই উভয়পক্ষ একমত হয়ে যদি এভাবে অংশ নিত অথবা বিচারকের রায়ের ভিত্তিতে এভাবে নিত, তবুও তা জায়েয হত। অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে সব শরীকের অংশ সমান হয়, সেখানে কোন এক দিককে এক শরীকের জন্যে নির্দিষ্ট করার উদ্দেশ্যে লটারী জায়েয। [দেখুন, কুরতুবী]
আপনি তখন তাদের নিকট ছিলেন না এবং তারা যখন বাদানুবাদ করছিল তখনো আপনি তাদের নিকট ছিলেন না।
৩:৪৫ اِذۡ قَالَتِ الۡمَلٰٓئِکَۃُ یٰمَرۡیَمُ اِنَّ اللّٰہَ یُبَشِّرُکِ بِکَلِمَۃٍ مِّنۡہُ ٭ۖ اسۡمُہُ الۡمَسِیۡحُ عِیۡسَی ابۡنُ مَرۡیَمَ وَجِیۡہًا فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ وَ مِنَ الۡمُقَرَّبِیۡنَ
৪৫. স্মরণ করুন, যখন ফেরেশতাগণ বললেন, হে মারইয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে তার পক্ষ থেকে একটি কালেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মসীহ, মারইয়াম তনয় ঈসা, তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম হবেন।
ঈসা (আঃ)-কে ‘কালিমাতুল্লাহ’ (আল্লাহর কালেমা) এই জন্য বলা হয়েছে যে, তাঁর জন্ম আল্লাহর অলৌকিক শক্তির প্রকাশ স্বরূপ, মানুষ সৃষ্টির নিয়ম-বহির্ভূত বিনা পিতায় মহান আল্লাহর বিশেষ কুদরতে ‘কুন’ কালেমা (বাণী) দ্বারা হয়েছে।
مَسِيْحٌ (মাসীহ) مَسَحَ ধাতু থেকে গঠিত। খুব বেশী যমীনে ভ্রমণকারীকে বলা হয় مَسَحَ الأَرْضَ । অথবা এর অর্থ হল, হাত বুলিয়ে দেওয়া। কেননা, ঈসা (আঃ) রোগীদের উপর হাত বুলিয়ে দিলে তারা আল্লাহর নির্দেশে আরোগ্য লাভ করত। এই উভয় অর্থের দিক দিয়ে فَعِيل এখানে فَاعِل এর অর্থে ব্যবহার হয়েছে। কিয়ামতের নিকটতম সময়ে প্রকাশ লাভকারী দাজ্জালকে যে মাসীহ বলা হয়, সেটা হয় مَمسوح العَين (কানা) অর্থের দিক দিয়ে অথবা সেও যেহেতু সারা দুনিয়া ভ্রমণ করবে এবং মক্কা ও মদীনা ব্যতীত সব স্থানেই প্রবেশ করবে। (বুখারী-মুসলিম)
কোন কোন বর্ণনায় বায়তুল মুক্বাদ্দাসেরও উল্লেখ আছে। এ জন্য তাকেও ‘মাসীহুদ্ দাজ্জাল’ বলা হয়। অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এই কথাটাই লিখেছেন।
কোন কোন গবেষক বলেন, ‘মাসীহ’ ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের পরিভাষায় আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশপ্রাপ্ত বড় বড় পয়গম্বরদেরকে বলা হয়। অর্থাৎ, তাদের পরিভাষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ পয়গম্বরদের কাছাকাছি অর্থে এটা ব্যবহার হয়।
দাজ্জালকে ‘মাসীহ’ এই জন্য বলা হয় যে, ইয়াহুদীদেরকে বিপ্লব সৃষ্টিকারী সে মাসীহের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং যার জন্য তারা এখনো পর্যন্ত ভ্রান্তিময় অপেক্ষায় রয়েছে, দাজ্জাল এই মাসীহর নাম নিয়েই আসবে। অর্থাৎ, সে নিজেকে তাদের সেই অপেক্ষিত মাসীহ বলেই প্রকাশ করবে। কিন্তু সে তার এই দাবী সহ অন্যান্য সমস্ত দাবীতে এত বড় প্রতারক ও ধোঁকাবাজ হবে যে, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মধ্যে তার কোন নজির মিলবে না। আর এই জন্য তাকে ‘দাজ্জাল’ (ভীষণ মিথ্যুক ও ধোঁকাবাজ) বলা হয়। عِيْسَى অনারবী শব্দ। কেউ কেউ বলেছেন, এটা আরবী শব্দ যা عَاسَ يَعُوْسَ ধাতু থেকে গঠিত এবং যার অর্থ হল, রাজনীতি ও নেতৃত্বদান। (ক্বুরত্বুবী ও ফাতহুল ক্বাদীর)
৩:৪৬ وَ یُکَلِّمُ النَّاسَ فِی الۡمَہۡدِ وَ کَہۡلًا وَّ مِنَ الصّٰلِحِیۡنَ
৪৬. আর তিনি দোলনায়(১) ও বয়োঃপ্রাপ্ত অবস্থায় মানুষের সাথে কথা বলবেন(২)। এবং তিনি হবেন পূণ্যবানদের একজন।
ঈসা (আঃ)-এর শিশু অবস্থায় দোলনায় কথা বলার ব্যাপারটা সূরা মারয়্যামেও উল্লিখিত হয়েছে। তাছাড়া সহীহ হাদীসে আরো দু’টি শিশুর কথা উল্লেখিত হয়েছে (যারা মায়ের কোলে কথা বলেছে)। একটি শিশু হল জুরায়েজ সম্পর্কিত ঘটনায় এবং অপরটি একজন ইস্রাঈলী মহিলার শিশু। (বুখারী ৩৪৩৬নং)
তিনি তার কাওমের লোকদেরকে তার নিজের পরিচয় দিয়ে তার মাকে বিব্রত অবস্থা থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
“আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন, যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকে ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত, হতভাগ্য; আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হব। [সূরা মারইয়াম: ৩০-৩৩]
ঈসা আলাইহিস সালাম শৈশব ও পৌঢ় বয়সে মানুষের সাথে কথা বলবেন। নিঃসন্দেহে শৈশবে পূর্ণ বয়স্কদের মত জ্ঞানীসুলভ, মেধাসম্পন্ন প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধভাবে কথা বলা একটি মু’জিযা। কিন্তু তার সাথে পৌঢ় বয়সে কথা বলার ব্যাপারটির কি সম্পর্ক থাকতে পারে? অধিকাংশ আলেমদের নিকট এর উত্তর এই যে, মূলত: শৈশব অবস্থায় কথা বলার মু’জিযা বর্ণনা করাই এখানে উদ্দেশ্য। তার সাথে পৌঢ় বয়সেও কথা বলবেন বলা দ্বারা উভয় অবস্থায়ই তার কথা পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও জ্ঞানীসুলভ হবে এমনটি বোঝানো হয়েছে। কোন কোন আলেম বলেন, তিনি যেহেতু যুবক বয়সে পৌঢ় হবার পূর্বেই আসমানে উত্থিত হয়েছেন, সেহেতু এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, তিনি পৌঢ় অবস্থায় আবার ফিরে এসে মানুষের সাথে কথা বলবেন। সুতরাং আবার ফিরে আসার ব্যাপারটি এ আয়াতের মাধ্যমেও প্রমাণিত হয়ে গেল। যা আরেকটি অলৌকিক ব্যাপার।
৩:৪৭ قَالَتۡ رَبِّ اَنّٰی یَکُوۡنُ لِیۡ وَلَدٌ وَّ لَمۡ یَمۡسَسۡنِیۡ بَشَرٌ ؕ قَالَ کَذٰلِکِ اللّٰہُ یَخۡلُقُ مَا یَشَآءُ ؕ اِذَا قَضٰۤی اَمۡرًا فَاِنَّمَا یَقُوۡلُ لَہٗ کُنۡ فَیَکُوۡنُ
৪৭. সে বলল, হে আমার রব! আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি, এমতাবস্থায় আমার সন্তান হবে কিভাবে? তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘এভাবেই’, আল্লাহ যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায়।
আল কুর’আনে অন্যত্র এসেছে—সে বলল, “এ রূপই হবে। তোমার রব বলেছেন, ‘এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমরা তাকে এজন্যে সৃষ্টি করব যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমাদের কাছ থেকে এক অনুগ্রহ; এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার। তারপর সে তাকে গর্ভে ধারণ করল; [১৬-২২]
এখানেও গর্ভে ধারনের প্রক্রিয়াটি কিভাবে সম্পন্ন হয়েছে সেটা বলা হয়নি।
সূরা আল-আম্বিয়ায় বলা হয়েছে যে, “অতঃপর আমরা তার (মারইয়ামের) মধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম.[৯১]। আর যিনি রূহ ফুঁকে দেয়ার কাজটি করেছিলেন, তিনি ছিলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম। কারণ, সূরা আলে ইমরান ও সূরা মারইয়ামের আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, মারইয়ামের কাছে যিনি এসেছিলেন, তিনি স্বয়ং জিবরীল আলাইহিস সালাম। এ সমস্ত বর্ণনা একত্রিত করলে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মকাহিনী স্পষ্ট হয়ে পড়ে।
৩:৪৮ وَ یُعَلِّمُہُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ التَّوۡرٰىۃَ وَ الۡاِنۡجِیۡلَ ﴿ۚ
৪৮. আর তিনি তাকে শিক্ষা দেবেন কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইঞ্জীল।
كِتَابٌ এর অর্থ লিখন বা লেখা; যেমন অনুবাদে তা-ই গ্রহণ করা হয়েছে। অথবা কিতাব বলতে ইঞ্জীল ও তাওরাত ছাড়াও আরো একটি কিতাব যার জ্ঞান আল্লাহ ওদেরকে দিয়েছিলেন। (ক্বুরত্ববী) অথবা তাওরাত ও ইঞ্জীল হল ‘কিতাব’ আর ‘হিকমাহ’ তার তফসীর বা ব্যাখ্যা
৩:৪৯ وَ رَسُوۡلًا اِلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ۬ۙ اَنِّیۡ قَدۡ جِئۡتُکُمۡ بِاٰیَۃٍ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ۙ اَنِّیۡۤ اَخۡلُقُ لَکُمۡ مِّنَ الطِّیۡنِ کَہَیۡـَٔۃِ الطَّیۡرِ فَاَنۡفُخُ فِیۡہِ فَیَکُوۡنُ طَیۡرًۢا بِاِذۡنِ اللّٰہِ ۚ وَ اُبۡرِیٴُ الۡاَکۡمَہَ وَ الۡاَبۡرَصَ وَ اُحۡیِ الۡمَوۡتٰی بِاِذۡنِ اللّٰہِ ۚ وَ اُنَبِّئُکُمۡ بِمَا تَاۡکُلُوۡنَ وَ مَا تَدَّخِرُوۡنَ ۙ فِیۡ بُیُوۡتِکُمۡ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿ۚ۴۹﴾
৪৯. আর তাকে বনী ইসরাঈলের জন্য রাসূলরূপে (প্রেরণ করবেন, তিনি বলবেন) নিশ্চয় আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি যে, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য কাদামাটি দ্বারা একটি পাখিসদৃশ আকৃতি গঠন করব, তারপর তাতে আমি ফুঁ দেব, ফলে আল্লাহ্র হুকুমে সেটা পাখি হয়ে যাবে। আর আমি আল্লাহ্র হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থকে নিরাময় করব এবং মৃতকে জীবিত করব। আর তোমরা তোমাদের ঘরে যা খাও এবং মজুদ কর তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব। নিশ্চয় এতে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা মুমিন হও।
أَخْلُقُ لَكُمْ أَي: أُصَوِّرُ لَكُمْ ‘‘আমি তোমাদের জন্য আকৃতি বানাবো ও গঠন করব।’’ (ক্বুরত্বুবী) অর্থাৎ, ক্রিয়াপদ خَلَقَ এখানে সৃষ্টি করার অর্থে ব্যবহার হয়নি। কারণ, সৃষ্টি করার ক্ষমতা তো কেবল মহান আল্লাহরই। তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। সুতরাং এখানে خلق এর অর্থ বাহ্যিক আকৃতি গড়া ও বানানো।
দ্বিতীয়বার ‘আল্লাহর অনুমতিক্রমে’ বলার উদ্দেশ্য হল, কোন মানুষ যেন এমন ভুল বোঝার শিকার না হয়ে পড়ে যে, আমিও আল্লাহর গুণাবলী অথবা কোন এখতিয়ারের অধিকারী।
না, আমি তো কেবল তাঁর একজন অক্ষম বান্দা এবং রসূল। আমার দ্বারা যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে, তা হল নিছক মু’জিযা যা কেবল আল্লাহরই নির্দেশে সংঘটিত হয়। ইমাম ইবনে কাসীর বলেন, আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক নবীকে তাঁর যুগের অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী মু’জিযাসমূহ দান করেছিলেন। যাতে তাঁর সত্যতা ও মহত্ত্ব প্রকাশিত হয়। মূসা (আঃ)-এর যুগে যাদু-বিদ্যার বড়ই চর্চা ছিল। তাই তাঁকে এমন মু’জিযা দান করেছিলেন যে, তাঁর সামনে যাদুকররা নিজেদের যাদুর ভেলকি দেখাতে অক্ষম প্রমাণিত হয়েছিল এবং এ থেকে তাদের নিকট মূসা (আঃ)-এর সত্যতা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছিল; ফলে তারা ঈমান এনেছিল। ঈসা (আঃ)-এর যামানায় চিকিৎসা বিদ্যার বেশ চর্চা ছিল। তাই তাঁকে মৃতকে জীবিত করার এবং জন্মান্ধ ও ধবল-কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলার মু’জিযা দান করেছিলেন। আর এ কাজ কোন ডাক্তারই তার ডাক্তারী বিদ্যার দ্বারা করতে সক্ষম নয়, তাতে সে যত বড়ই বিশেষজ্ঞ হোক না কেন। আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর যামানায় কবিতা, সাহিত্য এবং বাকপটুতার খুবই চর্চা ছিল। তাই তাঁকে এমন মু’জিযাপূর্ণ কুরআন দান করলেন যা ছন্দে-মাধুর্যে এবং সাহিত্যে পরিপূর্ণ। যার নজীর পেশ করতে বিশ্বের বড় বড় সাহিত্যিক ও কবিরা অপারগ সাব্যস্ত হয়েছে। চ্যালেঞ্জ দেওয়া সত্ত্বেও আজও পর্যন্ত অপারগ সাব্যস্ত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অপরাগই থাকবে। (ইবনে কাসীর)তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩:৫০ وَ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیَّ مِنَ التَّوۡرٰىۃِ وَ لِاُحِلَّ لَکُمۡ بَعۡضَ الَّذِیۡ حُرِّمَ عَلَیۡکُمۡ وَ جِئۡتُکُمۡ بِاٰیَۃٍ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ۟ فَاتَّقُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوۡنِ
৫০. আর আমার সামনে তাওরাতের যা রয়েছে তার সত্যায়নকারীরূপে এবং তোমাদের জন্য যা হারাম ছিল তার কিছু হালাল করে দিতে। এবং আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। কাজেই তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং আমার আনুগত্য কর।
অর্থাৎ আমি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছি এটি তার আর একটি প্রমাণ৷ যদি আমি তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত না হতাম বরং একজন মিথ্যা দাবীদার হতাম, তাহলে আমি নিজেই একটি ধর্ম তৈরী করে ফেলতাম এবং দক্ষতা সহকারে তোমাদের আগের পুরাতন ধর্ম থেকে বিচুত করে নিজের নতুন উদ্ভাবিত ধর্মের দিকে টেনে আনার প্রচেষ্টা চালাতাম৷ কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নবীরা আমার পূর্বে যেসব দীন এনেছিলেন আমি তো সেই আসল দীনকে মানি এবং তার শিক্ষাকে সঠিক গণ্য করি৷
বর্তমানে প্রচলিত ইনজীল থেকেও একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, মূসা আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবীগণ যে দীনের প্রচার করেছিলেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামও সেই একই দীনের প্রচারক ছিলেন৷ যেমন মথির বর্ণনা মতে পাহাড় থেকে প্রদত্ত ভাষণে ঈসা আলাইহিস সালাম পরিষ্কার বলেনঃ
”একথা মনে করো না যে, আমি তাওরাত বা নবীদের কিতাব রহিত করতে এসেছি৷ রহিত করতে নয় বরং সম্পূর্ণ করতে এসেছি৷” (৫:১৭)৷
একজন ইহুদী আলেম হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করলেন, দীনের বিধানের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য হুকুম কোন্টি? জবাবে তিনি বললেনঃ
” তোমার সমস্ত অন্ত:করণ তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত মন দিয়ে তোমার ইশ্বর প্রভুকে প্রেম করবে৷ এটি মহৎ ও প্রথম হুকুম ৷ আর দ্বিতীয়টি এর তুল্য; তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসবে৷ এই দু’টি হুকুমের ওপরই সমস্ত তাওরাত ও নবী রসূলদের সহীফা ও গ্রন্থসমূহ নির্ভরশীল৷”´(মথি ২২: ৩৭-৪০)
আবার হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর শিষ্যদের বলেনঃ
” ধর্মগুরু ও ফরীসীরা মূসার আসনে বসেছে৷ তারা তোমাদের যা কিছু বলে তা পালন করো ও মানো৷ কিন্তু তাদের মতো কাজ করো না৷ কারণ তারা বলে কিন্তু করে না৷” (মথি ২৩: ২-৩)৷
৩:৫১ اِنَّ اللّٰہَ رَبِّیۡ وَ رَبُّکُمۡ فَاعۡبُدُوۡہُ ؕ ہٰذَا صِرَاطٌ مُّسۡتَقِیۡمٌ ﴿
৫১. নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার রব এবং তোমাদেরও রব, কাজেই তোমরা তারই ইবাদাত কর। এটাই সরল পথ।
৩:৫২ فَلَمَّاۤ اَحَسَّ عِیۡسٰی مِنۡہُمُ الۡکُفۡرَ قَالَ مَنۡ اَنۡصَارِیۡۤ اِلَی اللّٰہِ ؕ قَالَ الۡحَوَارِیُّوۡنَ نَحۡنُ اَنۡصَارُ اللّٰہِ ۚ اٰمَنَّا بِاللّٰہِ ۚ وَ اشۡہَدۡ بِاَنَّا مُسۡلِمُوۡنَ
৫২. যখন ঈসা তাদের থেকে কুফরী উপলব্ধি করলেন তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারীগণ বলল, “আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহতে ঈমান এনেছি। আর আপনি সাক্ষী থাকুন যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।
حَوَارِيُّوْنَ (হাওয়ারিয়্যুন) حَوَارِي (হাওয়ারী) শব্দের বহুবচন। যার অর্থ হল, সাহায্যকারী (শিষ্য)। যেমন, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক নবীর একজন বিশেষ সাহায্যকারী ছিল। আমার বিশেষ সাহায্যকারী হল যুবায়ের।’’ (বুখারী ২৮৪৭, মুসলিম ২৪১৫নং)
এ আয়াতের দুটি অর্থ হতে পারে। মুজাহিদ বলেনঃ এর অর্থ হল কে আমার অনুসরণ করবে আল্লাহর পথে? সুফিয়ান সাওরী বলেনঃ এর অর্থ কে আল্লাহর সাথে আমাকে সহযোগিতা করবে? মুজাহিদের কথা এখানে সবচেয়ে বেশী প্রণিধানযোগ্য। তবে সবচেয়ে স্পষ্ট মত হল, এর অর্থ, কে আমাকে সাহায্য করবে আল্লাহর পথে আহবানের ক্ষেত্রে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের মৌসুমে ডেকে ডেকে বলতেনঃ ‘এমন কে আছে যে আমাকে আশ্রয় দেবে, যাতে করে আমি আমার প্রভুর বাণী প্রচার করতে পারি। কেননা, কুরাইশরা আমাকে আমার রবের বাণী প্রচারে বাধা দিচ্ছে’। [মুসনাদে আহমাদঃ ৩/৩৩৯-৩৪০]
ঈসা আলাইহিস সালামের খাঁটি ভক্তদের উপাধি ছিল হাওয়ারী- তাদের আন্তরিকতা ও মনের স্বচ্ছতার কারণে অথবা যেহেতু তারা সাদা পোষাক পরিধান করতেন এ জন্য তাদেরকে হাওয়ারী নামে অভিহিত করা হত। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীদের উপাধি ছিল সাহাবী। কোন কোন তাফসীরবিদ হাওয়ারীদের সংখ্যা দ্বাদশ উল্লেখ করেছেন। ‘হাওয়ারী’ শব্দটি কোন সময় শুধু সাহায্যকারী অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ অর্থেই এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘প্রত্যেক রাসূলের একজন হাওয়ারী অর্থাৎ খাঁটি সহচর থাকে আমার হাওয়ারী হলেন যুবায়ের [বুখারীঃ ২৬৯১, মুসলিমঃ ২৪১৫]
৩:৫৩ رَبَّنَاۤ اٰمَنَّا بِمَاۤ اَنۡزَلۡتَ وَ اتَّبَعۡنَا الرَّسُوۡلَ فَاکۡتُبۡنَا مَعَ الشّٰہِدِیۡنَ
৫৩. হে আমাদের রব! আপনি যা নাযিল করেছেন তার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি এবং আমরা এ রাসূলের অনুসরণ করেছি কাজেই আমাদেরকে সাক্ষ্যদানকারীদের তালিকাভুক্ত করে নিন।
৩:৫৪ وَ مَکَرُوۡا وَ مَکَرَ اللّٰہُ ؕ وَ اللّٰہُ خَیۡرُ الۡمٰکِرِیۡنَ ﴿۵
৫৪. আর তারা কুটকৌশল করেছিল আল্লাহও কৌশল করেছিলেন; আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী।
ঈসা (আঃ)-এর যামানায় শাম (সিরিয়া) অঞ্চল রোমক শাসনের অন্তর্গত ছিল। এখানে রোমকদের পক্ষ থেকে যাকে শাসক নির্বাচিত করা হয়েছিল সে কাফের ছিল। ইয়াহুদীরা ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে এই শাসকের কান ভারী করল। যেমন, তিনি (নাঊযু বিল্লাহ) বিনা বাপের (জারজ সন্তান) এবং বড়ই ফাসাদী ইত্যাদি। শাসক তাদের দাবী অনুযায়ী তাঁকে শূলে চড়ানোর ফায়সালা গ্রহণ করে। কিন্তু মহান আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে সযত্নে আসমানে উঠিয়ে নেন, আর এরা তাঁর স্থানে তাঁরই মত দেখতে অন্য এক ব্যক্তিকে শূলে চড়িয়ে দেয় এবং মনে করে যে, তারা ঈসা (আঃ)-কে শূলে চড়িয়ে দিয়েছে। مَكْرٌ আরবী ভাষায় কোন কার্য সিদ্ধির জন্য সূক্ষ্ণ ও গোপনভাবে তদবির (বা কৌশল অবলম্বন) করাকে বলা হয়। আর এই অর্থেই এখানে মহান আল্লাহকে خَيْرُ المَاكِرِيْنَ (সর্বোত্তম কৌশলী) বলা হয়েছে। পরন্তু কৌশল মন্দও হতে পারে, যদি মন্দ উদ্দেশ্যে হয় (আর তখন তাকে চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র বলা হয়) এবং ভালও হতে পারে, যদি তা ভাল উদ্দেশ্যে হয়।