সূরা আন নিসাঃ ৮ম রুকু(৫১-৫৯)আয়াত
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
৪:৫১ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ اُوۡتُوۡا نَصِیۡبًا مِّنَ الۡکِتٰبِ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡجِبۡتِ وَ الطَّاغُوۡتِ وَ یَقُوۡلُوۡنَ لِلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا هٰۤؤُلَآءِ اَهۡدٰی مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا سَبِیۡلًا ﴿۵۱﴾
আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিল, তারা জিব্ত ও তাগুতে বিশ্বাস করে? তারা কাফেরদের সম্বন্ধে বলে, এদের পথই মুমিনদের চেয়ে প্রকৃষ্টতর।
জিব্ত’ মানে অসত্য, অমূলক, ভিত্তিহীন ও অকল্যাণকর জিনিস৷ ইসলামের পরিভাষায় যাদু, টোনা, টোটকা, ভাগ্য গণনা, জ্যোতিষ, তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাকার কুসংসার ও অন্যান্য যাবতীয় কাল্পনিক বানোয়াট কথা ও ক্রিয়াকর্মকে জিব্ত বলা হয়েছে৷ হাদীসে বলা হয়েছেঃ
“পশুর ধ্বনি থেকে আন্দাজে ভালো-মন্দ অর্থ গ্রহণ করা, মাটির ওপর পশুর পদচিহ্ন থেকে সৌভাগ্য দুর্ভাগ্য মূলক ভালো-মন্দ ধারণা নেয়া এবং এই ধরনের কাল্পনিক আন্দাজ অনুমানভিত্তিক সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য চিহ্নিত করার বিভিন্ন পদ্ধতি জিব্ত এর অন্তরভূক্ত”৷ কাজেই আমাদের ভাষায় আমরা যাকে কুসংস্কার বলি এবং ইংরাজীতে যাকে বলা হয় Superstition সেটিই আসলে জিব্ত
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আবিসিনীয় ভাষায় জ্বিবত বলা হয় জাদুকরকে। আর তাগূত বলা হয় গণক বা জ্যোতিষীকে। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, জ্বিবত অর্থ জাদু এবং তাগুত অর্থ শয়তান। মালেক ইবন আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, আল্লাহ ব্যতীত যে সমস্ত জিনিসের উপাসনা করা হয়, সে সবই তাগূত বলে অভিহিত হয়।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, ইয়াহুদীদের সর্দার হুইয়াই ইবন আখতাব ও কাব ইবন আশরাফ ওহুদ যুদ্ধের পর নিজেদের একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে কুরাইশদের সাথে সাক্ষাত করার উদ্দেশ্যে মক্কায় এসে উপস্থিত হয়। ইয়াহুদী সর্দার কাব ইবন আশরাফ আবু সুফিয়ানের কাছে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে তাদের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন মক্কাবাসীরা কাব ইবন আশরাফকে বলল, তোমরা হলে একটি প্রতারক সম্প্রদায়। সত্য সত্যই যদি তোমরা তোমাদের এই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সত্য হয়ে থাক, তবে আমাদের এ দুটি মূর্তির (জ্বিবত ও তাগূতের) সামনে সিজদা কর।
সুতরাং সে কুরাইশদেরকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাই করল। তারপর কা’ব কুরাইশদেরকে বলল, তোমাদের মধ্য থেকে ত্রিশ জন এবং আমাদের মধ্য থেকে ত্ৰিশ জন লোক এগিয়ে আস, যাতে আমরা সবাই মিলে কা’বার প্রভূর সামনে দাঁড়িয়ে এ ওয়াদা করে নিতে পারি যে, আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। কা’বের এ প্রস্তাব কুরাইশরাও পছন্দ করল এবং সেভাবে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যজোট গঠন করল। অতঃপর আবু সুফিয়ান কা’বকে বলল, তোমরা হলে শিক্ষিত লোক; তোমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব রয়েছে, কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ মূর্খ।
সুতরাং তুমিই আমাদেরকে বল, প্রকৃতপক্ষে আমরা ন্যায়ের উপর রয়েছি, নাকি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ন্যায়ের উপর রয়েছেন? তখন কাব জিজ্ঞেস করল, তোমাদের দ্বীন কি? আবু সুফিয়ান উত্তরে বলল, আমরা হজের জন্য নিজেদের উট জবাই করি এবং সেগুলোর দুধ খাওয়াই, মেহমানদিগকে দাওয়াত করি, নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখি এবং বায়তুল্লাহ (আল্লাহর ঘর)-এর তাওয়াফ করি, পক্ষান্তরে এর বিপরীতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পৈত্রিক দ্বীন পরিহার করেছেন, নিজের আত্মীয়-স্বজন থেকে পৃথক হয়ে গেছেন এবং সর্বোপরি তিনি আমাদের সনাতন দ্বীনের বিরুদ্ধে নিজের এক নতুন দ্বীন উপস্থাপন করেছেন। এসব কথা শোনার পর কা’ব ইবন আশরাফ বলল, তোমরাই ন্যায়ের উপর রয়েছ। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোমরাহ হয়ে গেছেন। এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা আলোচ্য আয়াতটি নাযিল করে ওদের মিথ্যা ও প্রতারণার নিন্দা করেন। [দেখুনঃ সহীহ ইবন হিব্বানঃ ৬৫৭২]
৪:৫২ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ لَعَنَهُمُ اللّٰهُ ؕ وَ مَنۡ یَّلۡعَنِ اللّٰهُ فَلَنۡ تَجِدَ لَهٗ نَصِیۡرًا ﴿ؕ۵۲﴾
এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা’নত করেছেন(১) এবং আল্লাহ যাকে লা’নত করেন আপনি কখনো তার কোন সাহায্যকারী পাবেন না।
আল্লাহর অভিসম্পাত দুনিয়া ও আখেরাতের অপমানের কারণ। লা’নত ও অভিসম্পাত এর অর্থ হল, আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে দূরে সরে পড়া- চরম অপমান, অপদস্থতা। যার উপর আল্লাহর লা’নত পতিত হয় সে কখনো আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে না। তাদের সম্পর্কে অতি কঠিন ভৎসনার কথা বলা হয়েছে। অন্যত্র বলা হয়েছে, “যাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত হয়েছে, তাদের যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই নিহত অথবা ধৃত হবে।” [সূরা আল-আহযাব: ৬১] এটা তাদের পার্থিব অপমান। আখেরাতে তাদের অপমান এর চেয়েও কঠিন হবে।
আল্লাহর লানতের যোগ্য কারা?
1.এক হাদীসে আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহীতা এবং সুদ দাতা, সুদ সংক্রান্ত দলীল সম্পাদনকারী এবং সুদের লেনদেনের সাক্ষী সবার প্রতিই অভিসম্পাত করেছেন। এদের সবাই পাপের ক্ষেত্রে সমান। [মুসলিমঃ ১৫৯৮]
- এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে লোক লুত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের অনুরূপ কর্মে লিপ্ত হবে সে অভিশপ্ত হবে।’ [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ৪/৩৯৬)
3.অতঃপর তিনি বলেছেন, আল্লাহ্ তাআলা চোরদের প্রতিও অভিসম্পাত করেন। যে ডিম কিংবা রশির মত সাধারণ বস্তুও চুরি থেকে বিরত থাকে না, তারও হাত কাটা হয়। [বুখারীঃ ৬৪০১]
4.সুদ গ্রহীতা ও দাতার উপর আল্লাহ তা’আলার লা’নত এবং সে সমস্ত নারীর উপর যারা নিজেদের শরীর কেটে উল্কি আকে, যে অন্যের শরীর কেটেও উল্কি একে দেয়, তেমনিভাবে চিত্রকারের উপরও আল্লাহর লা’নত। [বুখারীঃ ১৯৮০]
- অপর এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তা’আলা লা’নত করেন মদ্যপায়ীর প্রতি, মদ যে ব্যক্তি পান করায় তার প্রতি, তার বিক্রেতা ও ক্রেতার প্রতি, যে মদের নির্যাস বের করে তার প্রতি এবং যারা মদ্য বহন করে তাদের সবার প্রতি। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩৭]
৪:৫৩ اَمۡ لَهُمۡ نَصِیۡبٌ مِّنَ الۡمُلۡکِ فَاِذًا لَّا یُؤۡتُوۡنَ النَّاسَ نَقِیۡرًا
তবে কি রাজশক্তিতে তাদের কোন অংশ আছে? সে ক্ষেত্রেও তো তারা কাউকে এক কপর্কও দেবে না
এখানে জিজ্ঞাসাসূচক বাক্যটি অস্বীকৃতিসূচক। অর্থাৎ, তাঁর রাজ্যে তাদের কোন অংশ নেই। এতে তাদের কোন অংশ থাকলে এই ইয়াহুদীরা এত কৃপণ কেন যে, তারা মানুষকে বিশেষ করে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে একটি ‘নাক্বীর’ পরিমাণও কিছু দেয় না। আর نَقِيْرٌ (নাক্বীর) বলা হয় খেজুরের আঁটির পিঠের বিন্দুকে। (ইবনে কাসীর)
কে সত্য পথে আছে আর কে সত্য পথে নেই, একথা বলার ক্ষমতা তারা কোথায় থেকে পেলো? আল্লাহর রাজত্বের কোন অংশ কি তাদের অধিকারে এসেছে? যদি এমন হতো, তাহলে অন্যেরা তাদের হাত থেক একটি কানাকড়িও পেতো না৷ কারণ তাদের মন বড়ই সংকীর্ণ, সত্যের স্বীকৃতিটুকু পর্যন্ত দিতেও তারা অপরাগ৷ এর দ্বিতীয় অর্থ এই হতে পারেঃ তাদের হাতে কি কোন দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা আছে যে, অন্যেরা তাতে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছে এবং তারা ওদেরকে তা থেকে কিছুই দিতে চায় না? এখানে নিছক অধিকারের স্বীকৃতির প্রশ্ন ওঠে৷ আর এ ব্যাপারেও তারা কার্পণ্য করছে৷
৪:৫৪ اَمۡ یَحۡسُدُوۡنَ النَّاسَ عَلٰی مَاۤ اٰتٰهُمُ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖ ۚ فَقَدۡ اٰتَیۡنَاۤ اٰلَ اِبۡرٰهِیۡمَ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ اٰتَیۡنٰهُمۡ مُّلۡکًا عَظِیۡمًا ﴿۵۴
অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন সে জন্য কি তারা তাদেরকে ঈর্ষা করে?(১) তবে আমরা তো ইবরাহীমের বংশধরকেও কিতাব ও হিকমত দিয়েছিলাম এবং আমরা তাদেরকে বিশাল রাজ্য করেছিলাম।
ঈর্ষা কি? আর তার পরিণামই বা কি? আলেমগণ বলেন, হাসাদ বা ঈর্ষা হচ্ছে, অন্যের প্রাপ্ত নেয়ামতের অপসারণ কামনা করা। যা হারাম ও নিন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পরের প্রতি মুখ ফিরিয়ে রেখো না; বরং আল্লাহর বান্দা ও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও। আর কোন মুসলিম ভাইয়ের পক্ষে অন্য মুসলিম ভাইয়ের প্রতি তিন দিনের বেশী সময় পর্যন্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখা জায়েয নয়। [বুখারী: ৬০৭৬; মুসলিমঃ ২৫৫৮]
এ আয়াতে ইয়াহুদীদের হিংসার কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে জ্ঞানৈশ্বর্য ও শান-শওকত দান করেছিলেন, তা দেখে ইয়াহুদীরা হিংসার অনলে জ্বলে মরত। আল্লাহ্ তাআলা এখানে তাদের সে হিংসা বিদ্বেষের কঠোর নিন্দা করেছেন এবং তাদের বিদ্বেষকে একান্ত অযৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করে পরবর্তী আয়াতগুলোতে তার কারণ বর্ণনা করেছেন। তা হল এই যে, তোমাদের এই হিংসা ঈর্ষা ও বিদ্বেষের কারণটা কি? যদি এ কারণ হয়ে থাকে যে, তোমরাই প্রকৃত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী অথচ তা তোমাদের হাতে না এসে তিনি পেয়ে গেছেন, তাহলে তোমাদের এ ধারণা যে একান্তই ভ্রান্ত তা সুস্পষ্ট।
কারণ এখন তোমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু তোমরা যদি তা থেকে কোন অংশ প্রাপ্ত হতে, তাহলে তোমরা তো অন্য কাউকে একটি কড়িও দিতে না। পক্ষান্তরে যদি তোমাদের এ বিদ্বেষ এ কারণে হয়ে থাকে যে, রাজ-ক্ষমতা না হয় আমরা নাই পেলাম, কিন্তু তার হাতে যাবে কেন? রাষ্ট্রের সাথে তার কি সম্পর্ক? তাহলে তার উত্তর হল এই যে, ইনিও নবীগণেরই বংশধর, যাদের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পূর্ব থেকেই ছিল। কাজেই রাষ্ট্র কোন অপাত্রে অর্পিত হয়নি। অতএব, তোমাদের ঈর্ষা একান্তভাবেই অযৌক্তিক।
‘বিরাট রাজত্ব’ মানে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব৷ আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান লাভ করার এবং সেই জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করার অনিবার্য ফল স্বরূপ পৃথিবীর জাতিদের নেতৃত্ব দান করার এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা অর্জিত হয়৷
৪:৫৫ فَمِنۡهُمۡ مَّنۡ اٰمَنَ بِهٖ وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ صَدَّ عَنۡهُ ؕ وَ کَفٰی بِجَهَنَّمَ سَعِیۡرًا ﴿
অতঃপর তাদের কিছু সংখ্যক তাতে ঈমান এনেছিল এবং কিছু সংখ্যক তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল; আর দগ্ধ করার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট।
ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর বানী-ইস্রাঈলদেরকে আমি নবুঅত এবং বিশাল রাজত্ব ও বাদশাহীও দিয়েছি। তা সত্ত্বেও ইয়াহুদীদের সমস্ত লোক তাঁদের উপর ঈমান আনেনি। কিছু লোক ঈমান এনেছিল এবং কিছু লোক ঈমান আনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অর্থাৎ, হে মুহাম্মাদ! এদের আপনার নবুঅতের উপর ঈমান না আনা কোন নতুন কথা নয়। ওদের ইতিহাস তো নবীদেরকে মিথ্যাজ্ঞান করায় পরিপূর্ণ; এমন কি নিজেদের বংশোদ্ভূত নবীদের উপরও ঈমান আনেনি। কেউ কেউ آمَنَ بِهِ তে ‘হি’ সর্বনাম থেকে নবী করীম (সাঃ)-কে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, এই ইয়াহুদীদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক মানুষ নবী করীম (সাঃ)-এর উপর ঈমান এনেছে এবং কিছু সংখ্যক মানুষ অস্বীকার করেছে। নবুঅতের এই অস্বীকারকারীদের পরিণাম হল জাহান্নাম।
এখানে বনী ইসরাঈলদের হিংসা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জবাব দেয়া হচ্ছে৷ এই জবাবের অর্থ হচ্ছে, তোমরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছো কেন? তোমরাইও ইবরাহীমের সন্তান৷ আর এই বনী ইসরাঈলরাও তো ইবরাহীমের সন্তান৷ দুনিয়ার নেতৃত্ব দানের জন্য ইবরাহীমের কাছে আমি যে ওয়াদা করেছিলাম তা ইবরাহীম সন্তানদের মধ্য থেকে কেবল মাত্র তাদের জন্য ছিল যারা আমার প্রদত্ত কিতাব ও হিকমত তথা শরীয়াত বিধান মেনে চলবে৷ এই কিতাব ও হিকমত প্রথমে আমি তোমাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম৷ কিন্তু নিজেদের নির্বুদ্ধিতার জন্য তোমরা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো৷ এখন সেই জিনিসটি আমি বনী ইসমাঈলকে দিয়েছি৷ তারা এর ওপর ঈমান এনেছে, এটি তাদের সৌভাগ্য৷
৪:৫৬ اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِنَا سَوۡفَ نُصۡلِیۡهِمۡ نَارًا ؕ کُلَّمَا نَضِجَتۡ جُلُوۡدُهُمۡ بَدَّلۡنٰهُمۡ جُلُوۡدًا غَیۡرَهَا لِیَذُوۡقُوا الۡعَذَابَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَزِیۡزًا حَکِیۡمًا
নিশ্চয় যারা আমাদের আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে অবশ্যই তাদেরকে আমরা আগুনে পোড়াব; যখনই তাদের চামড়া পুড়ে পাকা দগ্ধ হবে তখনই তার স্থলে নতুন চামড়া বদলে দেব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
জাহান্নামের স্তর
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের পাপ অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করার জন্য জাহান্নামের বিভিন্ন স্তর এবং স্তরভেদে তাপের তারতম্য সৃষ্টি করেছেন। যেমন- তিনি মুনাফিকদের স্তর উল্লেখ করে বলেছেন, ‘মুনাফিকগণ জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে’ {সূরা নিসা: ১৪৫}।
তিনি অন্যত্র বলেন, ‘প্রত্যেকে যা করে তদনুসারে তার স্থান রয়েছে।’ {সূরা আনআম: ১৩২}
এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে মু’আয রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন যে, তাদের শরীরের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন সেগুলো পাল্টে দেয়া হবে এবং এ কাজটি এত দ্রুতগতিতে সম্পাদিত হবে যে, এক মুহুর্তে শতবার চামড়া পাল্টানো যাবে। হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আগুন তাদের চামড়াকে একদিনে সত্তর হাজার বার খাবে। যখন তাদের চামড়া খেয়ে ফেলবে, অমনি সেসব লোককে বলা হবে, তোমরা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাও। সাথে সাথে সেগুলো পূর্বের মত হয়ে যাবে। [ইবন কাসীরঃ ১/৫১৪]
আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামীদের তিন দিনের পথ সমপরিমাণ পোর বা মোটা চামড়াকে দুনিয়ার আগুনের চেয়ে উনসত্তর গুণ বেশী তাপ সম্পন্ন জাহান্নামের আগুন দ্বারা ভাজা-পোড়া করবেন। চামড়া পুড়ে ছাই হয়ে গেলে পুনরায় নতুন চামড়া তৈরী করে পোড়াবেন। এইভাবে অনবরত পোড়াতে থাকবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘যারা আমার আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে অগ্নিতে দগ্ধ করবই, যখনই তাদের চর্ম দগ্ধ হবে তখনই তার স্থলে নতুন চর্ম সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ {সূরা নিসা: ৫৬}।
অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেছেন, জাহান্নামীদের মধ্যে কাফিরের শরীরের চামড়া হবে বিয়াল্লিশ হাত মোটা, দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের সমান এবং জাহান্নামে তার বসার স্থান হবে মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী ব্যবধান পরিমাণ। তিরমিযী, ‘জাহান্নামীদের বিশালাকৃতি’ অধ্যায়, তাহক্বীক আলবানী, হা/২৫৭৭, মিশকাত, ‘জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদের বর্ণনা’ অধ্যায়, হা/৫৪৩১, বাংলা অনুবাদ, এমদাদিয়া ১০/১৬৩।
৪:৫৭ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ سَنُدۡخِلُهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَاۤ اَبَدًا ؕ لَهُمۡ فِیۡهَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَهَّرَۃٌ ۫ وَّ نُدۡخِلُهُمۡ ظِلًّا ظَلِیۡلًا
আর যারা ঈমান আনে এবং ভাল কাজ করে, অচিরেই আমরা তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাব, যার পাদদেশে নদী-নালাসমূহ প্রবাহিত; যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে, সেখানে তাদের জন্য পবিত্র স্ত্রী থাকবে এবং তাদেরকে আমরা চিরস্নিগ্ধ ছায়ায় প্রবেশ করাব।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতে এমন একটি বৃক্ষ আছে এর ছায়ায় যদি কোন আরোহণকারী ভ্রমণ করতে চায় তাহলে একশত বছর ভ্রমণ করতে পারবে। তোমরা ইচ্ছা করলে এ আয়াত পড়তে পার “আর সম্প্রসারিত ছায়া।” [সূরা আল ওয়াকিয়াঃ ৩০, বুখারীঃ ৩২৫২]
কাফেরদের বিপরীত ঈমানদারদের জন্য জান্নাতে নিরবচ্ছিন্ন যে নিয়ামত হবে এই আয়াতে তার আলোচনা করা হচ্ছে। তবে ঈমানদার বলতে এমন ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ যাদের থাকবে অধিকহারে সৎকর্মের সম্বল। – جَعَلَنَا اللهُ مِنْهُم – মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদের প্রত্যেক স্থানে ঈমানের সাথে সাথে সৎকর্মের কথা উল্লেখ করে এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, এরা (ঈমান ও সৎকর্ম) আপোসে একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নেক আমল ছাড়া ঈমান হল ঐরূপ, যেরূপ সুবাসবিহীন ফুল এবং ফলবিহীন গাছ। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এবং ইসলামের স্বর্ণযুগের মুসলিমরা এ কথা অনুধাবন করে নিয়েছিলেন। তাই তাঁদের জীবন ছিল ঈমানের ফল আমল দ্বারা পরিপূর্ণ। সে যুগে আমলবিহীন বা মন্দ আমলের সাথে ঈমানের কথা কল্পনাই করা যেত না। পক্ষান্তরে বর্তমানে কেবল মৌখিক জমা-খরচের নাম হয়েছে ঈমান। ঈমানের দাবীদারদের ঝুলি নেক আমল থেকে খালি।-هَدَانَا اللهُ تَعَالى- আবার অনেকে সততা, আমানতদারী, দয়া-দাক্ষিণ্য এবং অপরের দুঃখ মোচনের কাজ সহ আরো অনেক নৈতিকতার এমন কাজ করে, যা সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু ঈমানের মূলধন থেকে সে বঞ্চিত থাকে। ফলে তার এই কর্মসমূহ দুনিয়াতে তার প্রসিদ্ধি এবং সুনামের মাধ্যম সাব্যস্ত হলেও আখেরাতে আল্লাহর নিকট তার কোন মূল্য থাকবে না। কারণ, নেক আমলকে আল্লাহর নিকট লাভদায়ক সাব্যস্তকারী ঈমানই তার মধ্যে নেই। বরং তার নেক আমলের ভিত্তি ছিল পার্থিব স্বার্থ অথবা জাতিগত অভ্যাস ও নৈতিকতা।
৪:৫৮ اِنَّ اللّٰهَ یَاۡمُرُکُمۡ اَنۡ تُؤَدُّوا الۡاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَهۡلِهَا ۙ وَ اِذَا حَکَمۡتُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ اَنۡ تَحۡکُمُوۡا بِالۡعَدۡلِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ نِعِمَّا یَعِظُکُمۡ بِهٖ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا ﴿
নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে ফিরিয়ে দিতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট! নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা।
আলোচ্য আয়াতগুলোর মধ্যে প্রথম আয়াতটি নাযিল হওয়ার একটি বিশেষ ঘটনা রয়েছে। তা হল এই যে, ইসলাম-পূর্বকালেও কা’বা ঘরের সেবা করাকে এক বিশেয মর্যাদার কাজ মনে করা হত। কাবার কোন বিশেষ খেদমতের জন্য যারা নির্বাচিত হত, তারা গোটা সমাজ তথা জাতির মাঝে সম্মানিত ও বিশিষ্ট বলে পরিগণিত হত। সে জন্যই বায়তুল্লাহর বিশেষ খেদমত বিভিন্ন লোকের মাঝে ভাগ করে দেয়। হত। জাহেলিয়াত আমল থেকেই হজের মওসুমে হাজীদেরকে যমযম কূপের পানি পান করানোর সেবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতৃব্য আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর ন্যস্ত ছিল। একে বলা হত ‘সিকায়া’।
অনুরূপই কাবা ঘরের চাবি নিজের কাছে রাখা এবং নির্ধারিত সময়ে তা খুলে দেয়া ও বন্ধ করার ভার ছিল উসমান ইবন তালহার উপর। এ ব্যাপারে স্বয়ং উসমান ইবন তালহার ভাষ্য হল এই যে, জাহেলিয়াত আমলে আমরা সোমবার ও বৃহস্পতিবার দিন বায়তুল্লাহর দরজা খুলে দিতাম এবং মানুষ তাতে প্রবেশ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করত। হিজরতের পূর্বে একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় সাহাবীসহ বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে গেলে উসমান (যিনি তখনো পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি) তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে বাধা দিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত ধৈর্য ও গাম্ভীর্য সহকারে উসমানের কটুক্তিসমূহ সহ্য করে নিলেন।
অতঃপর বললেন, হে উসমান হয়ত তুমি এক সময় বায়তুল্লাহর এই চাবি আমার হাতেই দেখতে পাবে। তখন যাকে ইচ্ছা এই চাবি অর্পণ করার অধিকার আমারই থাকবে। উসমান ইবন তালহা বলল, তাই যদি হয়, তবে সেদিন কুরাইশরা অপমানিত অপদস্থ হয়ে পড়বে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, তা নয়। তখন কুরাইশরা আযাদ হবে, তারা হবে যথার্থ সম্মানে সম্মানিত। এ কথা বলতে বলতে তিনি বায়তুল্লাহর ভিতরে প্রবেশ করলেন।
(উসমান বললেন) তারপর আমি যখন আমার মনের ভিতর অনুসন্ধান করলাম, তখন আমার যেন নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে গেল যে, তিনি যা কিছু বললেন, তা অবশ্যই ঘটবে। সে মুহুর্তেই আমি মুসলিম হয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে নিলাম। কিন্তু আমি আমার সম্প্রদায়ের মতিগতি পরিবর্তিত দেখতে পেলাম। তারা আমাকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করতে লাগল। কাজেই আমি আর আমার (মুসলিম হওয়ার) সংকল্প বাস্তবায়িত করতে পারলাম না। অতঃপর মক্কা বিজিত হয়ে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বায়তুল্লাহর চাবি চাইলেন। আমি তা পেশ করে দিলাম। তখন তিনি পুনরায় আমার হাতেই সে চাবি ফিরিয়ে দিলেন এবং বললেনঃ এই নাও, এখন থেকে এ চাবি কেয়ামত পর্যন্ত তোমার বংশধরদের হাতেই থাকবে। অন্য যে কেউ তোমাদের হাত থেকে ফিরিয়ে নিতে চাইবে, সে হবে যালেম, অত্যাচারী। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তোমাদের হাত থেকে এ চাবি ফিরিয়ে নেবার কোন অধিকার কারোরই থাকবে না। [দেখুন- তাবারানী ১১/১২০]
আয়াতের সারমর্ম হচ্ছে এই যে, যার দায়িত্বে কোন আমানত থাকবে, সে আমানত প্রাপককে পৌছে দেয়া তার একান্ত কর্তব্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমানত প্রত্যপণের ব্যাপারে বিশেষ তাকীদ প্রদান করেছেন। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এমন খুব কম হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন ভাষণ দিয়েছেন অথচ তাতে একথা বলেননি – ‘যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার মধ্যে ঈমান নেই। আর যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিয়মানুবর্তিতা নেই, তার দ্বীন নেই’। [মুসনাদে আহমাদ ৩/১৩৫] তাছাড়া আমানতদারী না থাকা মুনাফেকীর একটি আলামত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন মুনাফেকীর লক্ষণসমূহ বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি লক্ষণ এটাও বলেছিলেন যে, যখন তার কাছে কোন আমানত রাখা হয় তখন সে তাতে খেয়ানত করে। [বুখারী ৩৩; মুসলিম: ৫৯]
এখানে লক্ষণীয় যে, কুরআনুল কারীম আমানতের বিষয়টিকে أَمَانَات বহুবচনে উল্লেখ করেছে। এতে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে, কারো নিকট অপর কারো কোন বস্তু বা সম্পদ গচ্ছিত রাখাটাই শুধুমাত্র আমানত নয়, যাকে সাধারণতঃ আমানত বলে অভিহিত করা হয় এবং মনে করা হয়; বরং আমানতের আরো কিছু প্রকারভেদ রয়েছে। আয়াতের শানে-নুযূল প্রসঙ্গে উপরে যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, তাও কোন বস্তুগত আমানত ছিল না। কারণ, বায়তুল্লাহর চাবি বিশেষ কোন বস্তু নয়, বরং তা ছিল বায়তুল্লাহর খেদমতের একটা পদের নিদর্শন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রীয় যত পদ ও পদমর্যাদা রয়েছে, সেসবই আল্লাহ তা’আলার আমানত।
যাদের হাতে নিয়োগ-বরখাস্তের অধিকার রয়েছে সে সমস্ত কর্মকর্তা ও অফিসারবৃন্দ হলেন সে পদের আমানতদার। কাজেই তাদের পক্ষে কোন পদ এমন কাউকে অর্পণ করা জায়েয নয়, যে লোক তার যোগ্য নয়, বরং প্রতিটি পদের জন্য নিজের ক্ষমতা ও সাধ্যানুযায়ী যোগ্য ব্যক্তির অনুসন্ধান করা কর্তব্য। যোগ্যতা ও পরিপূর্ণ শর্ত মোতাবেক কোন লোক পাওয়া না গেলে উপস্থিত লোকদের মধ্যে যোগ্যতা ও আমানতদারী তথা সততার দিক দিয়ে যে সবচেয়ে অগ্রবর্তী হবে, তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমানতের গুরুত্ব লক্ষ্য করে এক বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদ সমস্ত গোনাহের কাফফারা হলেও আমানতের কাফফারা হয় না। জিহাদে শহীদ ব্যক্তিকে সেদিন হাজির করে বলা হবে, আমানত আদায় কর, সে বলবে, কোথেকে তা আদায় করব? দুনিয়া তো শেষ হয়ে গেছে।
তখন তাকে হাবীয়া জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হবে। সে সেখানে গেলে আমানতকে যেদিন ত্যাগ করেছিল সেদিনের রূপে দেখতে পাবে। সে তখন তা ধরে কাধে নিয়ে আসতে চাইবে, যখনি সেখান থেকে সে বের হতে যাবে, তখন আমানত পালিয়ে যাবে, আর এভাবে সে আমানতের পিছনে সবসময় ছুটতে থাকবে। তারপর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উপরোক্ত আয়াত পাঠ করলেন। [আল-মাতালিবুল আলীয়া, হিলইয়াতুল আউলিয়া, মাকারিমুল আখলাক] এ আমানতের পরিচয় সম্পর্কে আবুল আলীয়া বলেন, যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং যা নিষেধ করা হয়েছে তা সবই আমানত। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
এ আয়াতে ইসলামের কয়েকটি মৌলিক নীতির আলোচনাও এসে গেছে। প্রথমতঃ প্রকৃত হুকুম ও নির্দেশ দানের মালিক আল্লাহ তা’আলা। পৃথিবীর শাসকবর্গ তার আজ্ঞাবহ। এতে প্রতীয়মান হয় যে, শাসনক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের মালিকও একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই। দ্বিতীয়তঃ সরকারী পদসমূহ অধিবাসীদের অধিকার নয়, যা জনসংখ্যার হারে বন্টন করা যেতে পারে; বরং এগুলো হল আল্লাহ প্রদত্ত আমানত, যা শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দায়িত্বের পক্ষে যোগ্য ও যথার্থ লোককেই দেয়া যেতে পারে। তৃতীয়তঃ পৃথিবীতে মানুষের যে শাসন, তা শুধুমাত্র একজন প্রতিনিধি ও আমানতদার হিসেবেই হতে পারে।
তারা দেশের আইন প্রণয়নে সে সমস্ত নীতিমালার অনুসরণে বাধ্য থাকবে যা একক ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে বাতলে দেয়া হয়েছে। চতুর্থতঃ তাদের নিকট যখন কোন মোকদ্দমা আসবে, তখন বংশ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা এমনকি দ্বীন ও মতবাদের পার্থক্য না করে সঠিক ও ন্যায়সংগত মীমাংসা করে দেয়া শাসন কর্তৃপক্ষের উপর ফরয। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, শাসনকর্তৃপক্ষের উপর ওয়াজিব হলো, আল্লাহর আইন অনুসারে বিচার করা, আমানত আদায় করা। যদি তারা সেটা করে তবে জনগনের উপর কর্তব্য হবে তার কথা শোনা, আনুগত্য করা, তার আহবানে সাড়া দেয়া। [তাবারী]
এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তোমাদিগকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা খুবই উত্তম। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা সবার ফরিয়াদই শোনেন এবং যে লোক বলার কিংবা ফরিয়াদ করার সামর্থ্য রাখে না, তিনি তার অবস্থাও উত্তমভাবে দেখেন। অতএব তার রচিত নীতিমালাই সর্বদা সকল রাষ্ট্রের জন্য সর্বযুগে উপযোগী হতে পারে। পক্ষান্তরে মানব রচিত নীতিমালা শুধুমাত্র নিজেদের পরিবেশেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেগুলোরও পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
এ আয়াতের তাফসীর ইমাম আবু দাউদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি তার কানের উপর রাখলেন এবং পরবর্তী আঙ্গুলটি রাখলেন তার চোখের উপর। অর্থাৎ আল্লাহর চোখ ও কান রয়েছে। [আবু দাউদ: ৪৭২৮]
৪:৫৯ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡهُ اِلَی اللّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا
হে ঈমাদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের, অতঃপর কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।
اُولُو الأمر (উলুল আম্র) বলতে কেউ বলেছেন, নেতা ও শাসকগণ। কেউ বলেছেন, উলামা ও ফুক্বাহাগণ। অর্থের দিক দিয়ে উভয় শ্রেণীর মান্যবরদেরকেই বুঝানো যেতে পারে। উদ্দেশ্য এই যে, প্রকৃত আনুগত্য তো আল্লাহর প্রাপ্য। কারণ তিনি বলেছেন,
أَلاَ لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ‘জেনে রাখো, সৃষ্টি করা এবং নির্দেশদান তাঁরই কাজ। (আ’রাফঃ ৫৪)
[اِنِ الْحُكْمُ إلاَّ للهِ] ‘‘বিধান দেওয়ার অধিকার শুধু আল্লাহরই। (ইউসুফঃ ৪০)
কিন্তু রসূল (সাঃ) যেহেতু মহান আল্লাহর ইচ্ছার এক নিষ্ঠাবান প্রকাশক এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথগুলো (মানুষের কাছে) তুলে ধরার ব্যাপারে তিনি তাঁর প্রতিনিধি, এ জন্যই মহান আল্লাহর স্বীয় আনুগত্যের সাথে সাথে রসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য করাকেও ওয়াজেব করে দেন এবং বলেন যে,
রসূলের আনুগত্য করলে প্রকৃতপক্ষে তাঁরই আনুগত্য করা হয়। [مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ] ‘‘যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। (নিসাঃ ৮০)
এ থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হাদীসও কুরআনের মত দ্বীনের দলীল।
এ ছাড়া আমীর ও শাসকের আনুগত্য করাও জরুরী। কারণ, হয় তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশের বাস্তবায়ন করেন অথবা সকল মানুষের কল্যাণ সাধনের ব্যবস্থাপনা ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আমীর ও শাসকের আনুগত্য করা জরুরী হলেও তা একেবারে শর্তহীনভাবে নয়, বরং তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের শর্তসাপেক্ষ।
আর এই কারণেই أَطِيْعُوا الله এর পরই أَطِيْعُوا الرَّسُوْل বলেছেন। কেননা, এই উভয় আনুগত্যই স্বতন্ত্র ও ওয়াজেব।
পক্ষান্তরে وَأَطِيْعُوا أُولِي الأَمْر বলেননি, কারণ উলুল আম্র বা শাসকদের আনুগত্য স্বতন্ত্র নয়। আর হাদীসে বলা হয়েছে যে, ((لا طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِي مَعْصِيَةِ الخَالِقِ)) ‘‘আল্লাহর অবাধ্যাচরণে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।’’ (মিশকাত ৩৬৯৬, আল্লামা আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।) মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে, ‘‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন আনুগত্য নেই। (মুসলিম ১৮৪০নং)
((إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي المَعْرُوْفِ)) ‘‘আনুগত্য হবে কেবল ভালো কাজে।(বুখারী ৭১৪৫)
‘শাসকের কথা শুনতে হবে ও তাঁর আনুগত্য করতে হবে যতক্ষণ না (আল্লাহ ও তাঁর রসূলের) অবাধ্যতা হবে।’ আলেম-উলামার ব্যাপারটাও অনুরূপ। (যদি তাঁদেরকে শাসকদের মধ্যে শামিল করা হয়) অর্থাৎ, তাঁদের আনুগত্য এই জন্যই করতে হবে যে, তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের যাবতীয় বিধি-বিধান বর্ণনা করেন এবং তাঁর দ্বীনের জন্য পথ-প্রদর্শকের কাজ করেন। বুঝা গেল যে, দ্বীনি বিষয়ে এবং দ্বীন সম্পর্কীয় কার্যকলাপে আলেম-উলামা শাসকদের মতই এমন কেন্দ্রীয়-মর্যাদাসম্পন্ন যে, জনসাধারণ তাঁদের প্রতি রুজু করে থাকে। তবে তাঁদের আনুগত্য ততক্ষণ পর্যন্ত করা যাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা জনসাধারণকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা শুনাবেন। কিন্তু তাদের বিপথগামী (বা কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীতগামী) হওয়ার কথা স্পষ্ট হলে তাঁদের আনুগত্য করা যাবে না। বরং এই অবস্থায় তাঁদের আনুগত্য করলে বড় অপরাধ ও গুনাহ হবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের ওপর এমন সব লোকও শাসন কর্তৃত্ব চালাবেন যাদের অনেক কথাকে তোমরা মারুফ (বৈধ) ও অনেক কথাকে মুনকার ( অবৈধ ) পাবে৷ এ ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি তাদের মুনকারের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে, সে দায়মুক্ত হয়ে গেছে৷ আর যে ব্যক্তি তা অপছন্দ করেছে, সেও বেঁচে গেছে৷ কিন্তু যে ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্টি হয়েছে এবং তার অনুসরণ করেছে সে পাকড়াও হবে৷ সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, তাহলে এ ধরনে শাসকদের শাসনামলে কি আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবো না ? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দেনঃ না, যতদিন তারা নামায পড়তে থাকবে (ততদিন তাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারবে না)৷ -(মুসলিম)
আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ, কুরআনের দিকে রুজু করা এবং এখন রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ হল, (সহীহ) হাদীসের দিকে রুজু করা। বিবাদী সমস্যার সমাধানের জন্য এটা হল অতি উত্তম এক মৌলিক নীতি। আর এই মৌলিক নীতি থেকে এ কথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তৃতীয় কোন ব্যক্তিত্বের আনুগত্য ওয়াজেব নয়। যেমন, ব্যক্তি অনুকরণ অথবা নির্দিষ্ট করে কারো অন্ধানুকরণ করার সমর্থকরা তৃতীয় আর এক আনুগত্যকে জরুরী সাব্যস্ত করেছে। আর কুরআনের আয়াতের প্রকাশ্য বিরোধী তৃতীয় এই আনুগত্য মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ এক উম্মতে পরিণত করার পরিবর্তে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন উম্মতে পরিণত করেছে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াকে প্রায় অসম্ভব করে দিয়েছে।