সূরা আন নিসাঃ ৭ম রুকু(৪৩-৫০)আয়াত

সূরা আন নিসাঃ ৭ম রুকু(৪৩-৫০)আয়াত

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

৪:৪৩ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقۡرَبُوا الصَّلٰوۃَ وَ اَنۡتُمۡ سُکٰرٰی حَتّٰی تَعۡلَمُوۡا مَا تَقُوۡلُوۡنَ وَ لَا جُنُبًا اِلَّا عَابِرِیۡ سَبِیۡلٍ حَتّٰی تَغۡتَسِلُوۡا ؕ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ مَّرۡضٰۤی اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ اَوۡ جَآءَ اَحَدٌ مِّنۡکُمۡ مِّنَ الۡغَآئِطِ اَوۡ لٰمَسۡتُمُ النِّسَآءَ فَلَمۡ تَجِدُوۡا مَآءً فَتَیَمَّمُوۡا صَعِیۡدًا طَیِّبًا فَامۡسَحُوۡا بِوُجُوۡهِکُمۡ وَ اَیۡدِیۡکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَفُوًّا غَفُوۡرًا ﴿۴۳﴾

হে মুমিনগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার এবং যদি তোমরা মুসাফির না হও তবে অপবিত্র অবস্থাতেও নয়, যতক্ষন পর্যন্ত না তোমরা গোসল কর। আর যদি তোমরা পীড়িত হও অথবা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ শৌচস্থান থেকে আসে অথবা তোমরা নারী সম্ভোগ কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটির দ্বারা তায়াম্মুম কর সুতরাং মাসেহ কর তোমরা তোমাদের চেহারা ও হাত, নিশ্চয় আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল।

 

এটি মদ সম্পর্কে দ্বিতীয় নির্দেশ৷ প্রথম নির্দেশটি সূরা বাকারার ২১৯ আয়াতে দেয়া হয়েছে৷

২১৯) তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছেঃ মদও জুয়ার ব্যাপারে নির্দেশ কি? বলে দাওঃ ঐ দু’টির মধ্যে বিরাট ক্ষতিকর বিষয় রয়েছে যদিও লোকদের জন্য তাতে কিছুটা উপকারিতাও আছে, কিন্তু তাদের উপকারিতার চেয়ে গোনাহ অনেক বেশী. বাকারাঃ ২১৯

সেখানে কেবল একথা বলেই শেষ করা হয়েছিল যে, মদ খারাপ জিনিস৷ আল্লাহ এটি পছন্দ করেন না৷ একথা বলার পর মুসলমানদের একটি দল মদ পরিহার করেছিল৷ কিন্তু তখনো অনেক লোক আগের মতোই মদ পান করে চলছিল৷ এমনকি অনেক সময় নেশায় মাতাল অবস্থায় তারা নামাযে শামিল হয়ে যেতো এবং নামাযে পড়ার তা ছাড়া অন্য কিছু পড়ে ফেলতো৷

সম্ভবত চতুর্থ হিজরীর গোড়ার দিকে এই দ্বিতীয় নির্দেশটি নাযিল হয়৷ এখানে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে লোকদের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে৷ তারা নিজেদের মদপানের সময় বদলে ফেলে৷ যখন নেশা থাকা অবস্থায় নামাযের সময় হয়ে যাবার আশংকা থাকতো তখন তারা মদপান থেকে বিরত থাকতো৷

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ মদ হারাম হওয়ার পূর্বে আমাদেরকে এক আনসার দাওয়াত দিল। দাওয়াত শেষে আব্দুর রহমান ইবন আউফ এগিয়ে গিয়ে মাগরিবের সালাতের ইমামতি করলেন। তিনি সূরা আল-কাফেরুন তেলাওয়াত করতে গিয়ে এলোমেলো করে ফেললেন। ফলে এ আয়াত নাযিল হয় যাতে মদ খাওয়ার পর বিবেকের সুস্থতা না ফেরা পর্যন্ত সালাত আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে। [আল-আহাদীসুল মুখতারাহঃ ২/১৮৮ নং ৫৬৭, অনুরূপ ২/১৮৭ নং ৫৬৬; আবু দাউদঃ ৩৬৭১; তিরমিযী: ৩০২৬]

 

এর কিছুকাল পরে মদপানের বিরুদ্ধে চরম নিষেধজ্ঞা আসে৷ মদপান হারাম হবার এ নির্দেশটি এসেছে সূরা মায়েদার ৯০-৯১ আয়াতে৷

 

হে ঈমানদারগণ ! এ মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকালাপ ৷ এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে৷শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদের বিরত রাখতে৷ তাহলে তোমরা কি এসব থেকে বিরত থাকবে ? সূরা মায়েদাঃ ৯০-৯১

এখানে একথাও প্রণিধানযোগ্য যে, আয়াতে, ‘সুফর’ এবং ‘নেশা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে৷ তাই এ নির্দেশটি কেবল মদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না বরং প্রত্যেটি নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুর সাথেই এর সম্পর্ক৷ এ নির্দেশটি আজো পুরোপুরি কার্যকর৷ একদিকে নেশাকর বস্তু ব্যবহার করা হারাম এবং অন্যদিকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়া দ্বিগুণ এবং আরো অনেক বড়ো গোনাহ৷

আল্লাহ জানিয়েছেন—

যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তারা পূর্বে যা কিছু পানাহার করেছিল সে জন্য তাদেরকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না, তবে এ জন্য শর্ত হচ্ছে, তাদেরকে অবশ্যি ভবিষ্যতে যেসব জিনিস হারাম করা হয়েছে সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে, ঈমানের ওপর অবিচল থাকতে হবে এবং ভাল কাজ করতে হবে তারপর যে যে জিনিস থেকে বিরত রাখা হয় তা থেকে তাদের বিরত থাকতে হবে এবং আল্লাহর যেসব হুকুম নাযিল হয় সেগুলো মেনে চলতে হবে৷ অতপর আল্লাহভীতি সহকারে সদাচরণ অবলম্বন করতে হবে৷ আল্লাহ সদাচারীদের ভালবাসেন৷             মায়েদাঃ ৯৩

******এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন, যখন ব্যক্তির ওপর ঘুমের আক্রমণ হয় এবং নামায পড়তে গিয়ে সে বারবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তখন তার নামায রেখে ঘুমিয়ে পড়া দরকার৷ কোন কোন লোক এই আয়াত থেকে এই মর্মে প্রমাণ পেশ করেছেন যে, যে ব্যক্তি নামাযে পঠিত আরবী ইবারতের অর্থ বোঝে না তার নামায হবে না৷ কিন্তু এটা আসলে একটা অযথা কাঠিন্য ছাড়া আর কিছুই নয়৷ কুরআনের শব্দাবলীও এর সমর্থন করে না৷ কুরআনে ‘হাত্তা তাফ্‌কাহু’ বা ‘হাত্তা তাফহামু মা তাকূলূন’ (অর্থাৎ যতক্ষণ তোমরা যা বলো তা তোমরা হৃদয়ংগম না করো অথবা বুঝতে না পারো) বলা হয় নি৷ বরং বলা হয়েছে, ‘হাত্তা তা’লামূ মা তাকূলূন’৷ অর্থাৎ নামাযে এক ব্যক্তিকে এতটুকুন সজাগ থাকতে হবে যে, সে নিজের মুখে কি কথা বলছে, তা তাকে অবশ্যি জানতে হবে৷ সে নামায পড়তে দাঁড়িয়ে যেন গজল গাইতে শুরু না করে দেয়৷

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”যে ব্যক্তি সালাতের সময় হলে সুন্দরভাবে ওজু করে এবং সুন্দরভাবে রুকু-সেজদা ও একাগ্রতাসহ সালাত আদায় করে, তার এ সালাত পূর্বের সকল গুনাহের কাফ্‌ফারা হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো কবিরা গুনায় লিপ্ত না হয়। আর এ সুযোগ জীবন ভর।( সহিহ মুসলিম : ১/২০৬)

একাগ্রতা ও খুশুর পরিমাণ অনুপাতে সালাতে সাওয়াব অর্জিত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বান্দাগণ সালাত আদায় করে কেউ পায় দশভাগ, নয়ভাগ, আটভাগ, সাতভাগ, ছয়ভাগ, পাঁচভাগ, চারভাগ, তিনভাগ আবার কেউ মাত্র অর্ধেক সাওয়াব অর্জন করে।

)رواه الإمام أحمد (৪/৩২১) وهو في صحيح الجامع (১৬২৬).(

যতটুকু মনোযোগ ততটুকু সাওয়াব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে আব্বাস রা.-কে বলেন, সালাতে তুমি যতটুকু মনোযোগ দিবে ততটুকু সাওয়াব অর্জন করবে।

مجموع الفتاوى لابن تيمية (২২/৬১২).

একাগ্রতাসহ পরিপূর্ণভাবে সালাত আদায় করলেই গুনাহ মাফ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”মানুষ সালাতে দাড়ালে সমস্ত গুনাহ তার মাথায় ও কাঁধে এনে রেখে দেয়া হয়। রুকু-সেজদা করতে থাকে আর তার গুনাহগুলো ঝরে পড়তে থাকে।”

আনাস বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ”তোমাদের কারো সালাতে তন্দ্রাভাব হলে ঘুমিয়ে নাও। যাতে যা বল তা বুঝতে পার।” (সহিহ মুসলিম : ৫৬০)

অর্থাৎ শুয়ে পড় যাতে ঘুম চলে যায়। আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, ”যখন তোমাদের কারো সালাতে তন্দ্রাচ্ছন্নভাব হবে শুয়ে পড়বে। যাতে ঘুম চলে যায়। কারণ, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় এস্তেগফার করার সময় হয়তো নিজেকে অভিসম্পাত করে বসবে।” ( সহিহ বোখারি : ২০৯)

নামাযে খুশু-খুযু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন-হাদীসে এ সম্পর্কে অনেক তাকীদ করা হয়েছে। খুশু-খুযুর দুটি অংশ রয়েছে : এক. নামাযে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্থির রাখা। দুই. মনোযোগ ও একাগ্রতা রক্ষা করা। এ দুটি বৈশিষ্ট্যের সাথে যে নামায আদায় করা হয় তাকে খুশু-খুযুযুক্ত নামায বলে।

খুশু’-এর আভিধানিক অর্থ হ’ল দীনতার সাথে অবনত হওয়া, ধীরস্থির হওয়া ইত্যাদি।

খুযু এর অর্থ মানুষ তার বাহ্যিক অঙ্গগুলোকে আল্লাহ তায়ালার সামনে ঝুঁকিয়ে দেয়া। আর খুশু- অর্থ হলো মানুষ তার হৃদয় কে আল্লাহ তাআলার দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়া।

ইবনু কাছীর বলেন, খুশু অর্থ- স্থিরতা, ধীরতা, গাম্ভীর্য, বিনয় ও নম্রতা। ইবনুল ক্বাইয়ম বলেন, খুশু হল হৃদয়কে দীনতা ও বিনয়ের সাথে প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থাপন করা।[মাদারিজুস সালেকিন ১/৫১৬]

আল্লাহ তা’আলা বলেন,

“ঐ সকল মুমিনরা সফল যারা তাদের সালাতে বিনয়াবণত”(সূরা মুমিনুন, ১-২)

হুযাইফা (রাদ্বী) বলেন,

“তোমরা তোমাদের দ্বীনের বিষয়সমূহ থেকে সর্বপ্রথম খুশুকে(বিনয়) হারাবে, আর সর্বশেষ হারাবে সালাত। অনেক সালাত আদায়কারী আছে, তাদের মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। অচিরেই তোমরা মসজিদে প্রবেশ করবে, কিন্তু কোনো বিনয়াবণত সালাত আদায়কারী দেখতে পাবে না।”(মাদারিজুস সালাকিন, ১/৫২১)

.

খুশুই হলো, সালাতের প্রাণ এবং তার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য। তাই খুশুহীন সালাত হলো, প্রাণহীন দেহের ন্যায়।

তাই সালাতে খুশু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা খুব দ্রুত হারিয়ে যায় এবং যার অস্তিত্ব অত্যন্ত দুর্লভ। বিশেষ করে আমাদের এ শেষ যুগে তথা আখেরি যামানায়।

সালাতে খুশু তখন হাসিল হয়, যখন অন্তর সালাতের জন্য অবসর হয়। অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে কেবল সালাত নিয়েই ব্যস্ত হয় এবং সব কিছুর পর কেবল সালাতকেই প্রাধান্য দেয়। তখন সালাত তার জন্য প্রশান্তি হয় এবং সালাত তার চোখের শীতলতা আনয়নকারী হয়। যেমন রাসূল বলেছেন, ‘আমার চোখের প্রশান্তি দেওয়া হয়েছে সালাতের মধ্যে’ ( মুসনাদ আহমাদ, ৩/১২৮)

****** কুরআনে উল্লেখিত মূল শব্দ হচ্ছে, ‘জুনুবান’৷ এর মানে হচ্ছে, দূর হয়ে যাওয়া, দূরত্ব ও সম্পর্কহীনতা৷ এ থেকে ‘আজনবী’ (অপরিচিত) শব্দটি বের হয়েছে৷ শরীয়াতের পরিভাষায় জুনুব বা জানাবাত অর্থ হচ্ছে, যৌন প্রয়োজন পূর্ণ করার এবং স্বপ্নের মধ্যে বীর্যপাত হবার ফলে যে, ‘নাজাসাত’ বা নাপাকী সৃষ্টি হয়৷ কারণ এর ফলে মানুষ তাহারাত বা পবিত্রতা শূন্য হয়ে পড়ে৷

অপবিত্র অবস্থা থেকে গোসল করার নিয়ম বর্ণনায় হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জানাবতের গোসল করতেন, তখন প্রথমে দু’ হাত ধুয়ে নিতেন। তারপর সালাতের অজুর মত অজু করতেন। তারপর পানিতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে তা দিয়ে মাথার চুলের গোড়ায় পানি পৌছাতেন। তারপর তার মাথায় তিন ক্রোশ পানি দিতেন এবং সারা শরীরে পানি প্রবাহিত করতেন। [বুখারী: ২৪৮]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পা ধোয়া ব্যতীত সালাতের অজুর মত অজু করলেন, তার লজ্জাস্থান ধৌত করলেন, যে সমস্ত ময়লা লেগেছিল তাও ধৌত করলেন, তারপর তার নিজের শরীরে পানি প্রবাহিত করলেন। তারপর দু’ পা সরিয়ে নিয়ে ধৌত করলেন। এটাই ছিল তার অপবিত্রতা থেকে গোসল করার পদ্ধতি। [বুখারী: ২৪৯]

 

তায়াম্মুম অর্থ হচ্ছে, ইচ্ছা বা সংকল্প করা৷ অর্থাৎ যদি পানি না পাওয়া যায় অথবা পাওয়া গেলেও তার ব্যবহার সম্ভব না হয়, তাহলে পাক-পবিত্র মাটি ব্যবহা করার সংকল্প করা৷

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, এক সফরে তিনি তার বোন আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে একটি হার ধার করে নিয়েছিলেন। তিনি সেটা হারিয়ে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা খুঁজতে এক ব্যক্তিকে পাঠান এবং তিনি তা খুঁজে পান ইত্যবসরে সালাতের ওয়াক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তাদের নিকট পানি ছিল না। লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অভিযোগ করল। তখন তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল হয়। উসাইদ ইবনে হোদাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, আল্লাহ্‌ আপনাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। যখনি কোন অপছন্দনীয় ব্যাপার আপনার উপর ঘটে গেছে, তখনি তা আপনার এবং উম্মতে মুসলিমার জন্য কল্যাণের কারণ হয়েছে। [বুখারীঃ ৩৩৬, মুসলিমঃ ৩৬৭]

এখানের যাদের জন্য তায়াম্মুম বিধেয়, তাদের কথা বলা হচ্ছেঃ (ক) অসুস্থ ব্যক্তি বলতে এমন রোগীকে বুঝানো হয়েছে, যে ওযু করলে ক্ষতি অথবা রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা করে। (খ) সফর বা মুসাফির সাধারণ শব্দ তাতে সফর লম্বা হোক বা সংক্ষিপ্ত; পানি না পেলে তায়াম্মুম করার অনুমতি আছে। পানি না পাওয়া গেলে তায়াম্মুম করার অনুমতি তো গৃহবাসী (অমুসাফির)-এরও আছে, কিন্তু রোগী ও মুসাফিরের এই ধরনের প্রয়োজন সাধারণতঃ বেশী দেখা দেয়, তাই বিশেষ করে তাদের জন্য এই অনুমতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। (গ) পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন পূরণকারী এবং (ঘ) স্ত্রীর সাথে সহবাসকারীও যদি পানি না পায়, তাহলে তাদের জন্যও তায়াম্মুম করে নামায পড়ার অনুমতি আছে। আর তায়াম্মুম করার নিয়ম হল, পবিত্র মাটিতে একবার হাত দু’টিকে মেরে উভয় হাতকে কবজি পর্যন্ত বুলিয়ে নিয়ে (কনুই পর্যন্ত নয়) মুখে বুলিয়ে নিবে। নবী করীম (সাঃ) তায়াম্মুম সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘উভয় হাত এবং মুখমন্ডলের জন্য একবার মাটিতে মারতে হবে।’’ (মুসনাদ আহমাদ ৪/২৬৩) [صَعِيْدًا طَيِّبًا] এর অর্থ হল, পবিত্র মাটি। মাটি থেকে উৎপন্ন প্রতিটি জিনিস নয়, যেমন অনেকে মনে করে। হাদীসে এটা আরো পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছেঃ((جُعِلَتْ تُرْبَتُهَا لَنَا طَهُوْرًا إِذَا لَمْ نَجِدِ المَاءَ))  ‘‘পানি না পাওয়া গেলে যমীনের মাটিকে আমাদের জন্য পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। (মুসলিম ৫২২নং)

 

৪:৪৪ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ اُوۡتُوۡا نَصِیۡبًا مِّنَ الۡکِتٰبِ یَشۡتَرُوۡنَ الضَّلٰلَۃَ وَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ تَضِلُّوا السَّبِیۡلَ

৪৪. আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিল? তারা ভ্রান্ত পথ ক্রয় করে এবং তোমরাও পথভ্রষ্ট হও- এটাই তারা চায়।

এই আয়াতে একদল ইহুদী পণ্ডিতের কথা বলা হচ্ছে, যারা ইসলামের আবির্ভাবের সময় মদীনায় ছিলেন আল্লাহর বাণী সম্পর্কে জানার কারণে তারা ইসলামের নবী ও পবিত্র কোরআনের প্রতি সবার আগে ঈমান আনবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক এবং কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু এর পরির্বতে তারা প্রথম থেকেই নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে শত্রুতা শুরু করে এমনকি মক্কার মুশরিকদের সাথেও তারা ঐক্যবদ্ধ হয়। এই আয়াতে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই ইহুদী পণ্ডিতরা তাওরাত বা ঐশী বাণীর সাথে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে নিজেদের ও অন্যদের জন্য মুক্তি এবং সৌভাগ্যের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেনি। বরং তারা অন্যদের পথভ্রষ্ট করতো এবং তাদের ঈমানের পথে বাধা সৃষ্টি করতো, এরপর মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলছেন, তোমরা তাদের শত্রুতার জন্য ভয় পেয়ো না। কারণ, তারা আল্লাহর কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত নয়। আর তোমাদের জন্যে রয়েছে আল্লাহর সাহায্য।

আহ্‌লি কিতাবদের আলেম সমাজ সম্পর্কে কুরআন অনেক ক্ষেত্রে এ বক্তব্য পেশ করেছে যে, “তাদেরকে কিতাবের জ্ঞানের কিছু অংশ দেয়া হয়েছে”৷ এর কারণ হচ্ছে এই যে, প্রথমত তারা আল্লাহর কিতাবের একটি অংশ হারিয়ে ফেলেছিল৷ তারপর আল্লাহর কিতাবের যা কিছু তাদের কাছে ছিল তার প্রাণসত্তা এবং তার উদ্দেশ্য ও মূল বক্তব্য বিষয়ও তাদের কাছে অপরিচিত হয়ে উঠেছিল৷ তাদের সমস্ত আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয়ে গিয়েছিল শাব্দিক বিতর্ক, বিধান ও নির্দেশাবলীর খুঁটিনাটি আলোচনা এবং আকীদা-বিশ্বাসের দার্শনিক জটিলতার মধ্যে৷ এ কারণেই তারা দীনের তাৎপর্য ও সারবস্তুর সাথে অপরিচিত ছিল৷ তাদের মধ্যে যথার্থ দীনদারীর চিহ্নমাত্রও ছিল না৷ অথচ আদেরকে ধর্মীয় আলেম ও জাতির নেতা বলা হতো৷

এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ইয়াহুদী নাসারারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ঈমানদারদেরকেও পথভ্রষ্ট করতে চায়। অন্য আয়াতে তাদের সংখ্যা অনেক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে, তারা মুসলিমদের মুর্তাদ হয়ে যাওয়া কামনা করে। আরও বলা হয়েছে যে, তাদের কাছে সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও কেবলমাত্র হিংসার বশবর্তী হয়েই তারা এটা করে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন,

“কিতাবীদের অনেকেই চায়, যদি তারা তোমাদেরকে তোমাদের ঈমান আনার পর কাফেররূপে ফিরিয়ে নিতে পারত! সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে বিদ্বেষবশতঃ (তারা এটা করে থাকে) [সূরা আল-বাকারাহ: ১০৯]

আরও বলেন, “কিতাবীদের একদল চায় যেন তোমাদেরকে বিপথগামী করতে পারে, অথচ তারা নিজেদেরকেই বিপথগামী করে। আর তারা উপলব্ধি করে না।” [সূরা আলে ইমরান: ৬৯]

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ইয়াহুদীদের নেতাদের মধ্যে রিফা’আ ইবন যায়েদ যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে কথা বলত, তখন সে তার জিহবা ঘুরিয়ে বলত: হে মুহাম্মাদ! তুমি ভাল করে আমাদেরকে শোনাও যাতে আমরা বুঝতে পারি। তারপর সে ইসলামের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়াত। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

وَ لَا تُطِعِ الۡکٰفِرِیۡنَ وَ الۡمُنٰفِقِیۡنَ وَ دَعۡ اَذٰىهُمۡ وَ تَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰهِ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ وَکِیۡلًا

আর আপনি কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য করবেন না, তাদের নির্যাতন উপেক্ষা করুন এবং নির্ভর করুন আল্লাহর উপর এবং কর্মবিধায়করূপে আল্লাহই যথেষ্ট। আহযাবঃ৪৮

৪:৪৫ وَ اللّٰهُ اَعۡلَمُ بِاَعۡدَآئِکُمۡ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ وَلِیًّا ٭۫ وَّ کَفٰی بِاللّٰهِ نَصِیۡرًا

৪৫. আল্লাহ তোমাদের শত্রুদেরকে ভালভাবে জানেন। আর অভিভাবকত্বে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সাহায্যেও আল্লাহই যথেষ্ট।

 

وَ لِلّٰهِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ وَکِیۡلًا

আসমানে যা আছে ও যমীনে যা আছে সব আল্লাহরই এবং কার্যোদ্ধারে আল্লাহই যথেষ্ট। সূরা নিসাঃ১৩২

এদেরকে লোকেরা বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জড়ো হয়েছে, কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু এ কথা তাদের ঈমানকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক। আলে ইমরানঃ১৭৩

আল-ওয়াকীল (তত্ত্বাবধায়ক, সহায় প্রদানকারী, আস্থাভাজন উকিল)

আল-ওয়াকিল হলেন যিনি সৃষ্টিকুলকে তাঁর ইলম, পূর্ণ কুদরত ও ব্যাপক হিকমত অনুসারে পরিচালনা করেন ও তত্ত্বাবধায়ন করেন। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের অভিভাবক, তাদেরকে তিনি সহজ করেন, কঠোরতা পরিহার করেন এবং তিনি তাদের জন্য সব কাজে যথেষ্ট। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহকে অভিভাবক বানাবে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ ٱللَّهُ وَلِيُّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ يُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ٢٥٧﴾ [البقرة: ٢٥٧]

“যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৭]

﴿ٱللَّهُ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ وَكِيلٞ٦٢﴾ [الزمر: ٦١]

“আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬১]

তাওয়াক্‌কুলের’ অর্থ হলো আল্লাহকে নিজের অভিভাবক নিযুক্ত করা এবং তাঁর উপর পূর্ণভাবে ভরসা করা। অভিভাবক তাকেই বলে যিনি তার অধীনস্ত লোকের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন এবং অকল্যাণ হতে বাঁচিয়ে রাখেন। হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকার নাম আল্লাহর উপর ভরসা (তাওয়াক্কুল) নয়, বরং আল্লাহর দেয়া সুযোগ সুবিধা ও উপায় উপকরণসমূহ কাজে লাগিয়ে ফলাফলের জন্য তাঁর উপর নির্ভর করার নামই হচ্ছে তাওয়াক্কুল।

‘তিনিই তোমাদের মালিক। অতএব তিনি কতই না উত্তম মালিক এবং কতইনা উত্তম সাহায্যকারী।’ (হজ ৭৮)

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।’ (তালাক ৩)

(হে রাসূল) বলুন, আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। তাওয়াক্‌কুলকারীরা তাঁর উপরই নির্ভর করে।’ (যুমার ৩৮)

আমি আমার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করছি। নিশ্চয় বান্দারা আল্লাহর দৃষ্টিতে রয়েছে।’ (মুমিন ৪৪)

‘আমি আল্লাহর উপর নিশ্চিত ভরসা করেছি যিনি আমার এবং তোমাদের পরওয়ারদেগার। পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যা তাঁর পূর্ণ আয়ত্ত্বাধীন নয়।’ (হুদ ৫৬)

‘আপনিই আমার কার্যনির্বাহী ইহকাল ও পরকালে। আমাকে ইসলামের উপর মৃত্যুদান করুন এবং আমাকে স্বজনদের সঙ্গে মিলিত করুন।’ (ইউসুফ ১০১)

হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি উট বেঁধে রেখে আল্লাহর উপর ভরসা করব, না বন্ধনমুক্ত রেখে? তিনি বললেন, উট বেঁধে নাও, অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা কর। (তিরমিযি)

উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, তোমরা যদি সত্যিকারভাবেই আল্লাহর উপর ভরসা কর তবে তিনি পাখিদের মতই তোমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করবেন। ভোরবেলা পাখিরা খালি পেটে বেরিয়ে যায় এবং সন্ধ্যা বেলা ভরা পেটে ফিরে আসে। (তিরমিযি)

ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তখন বলেছিলেন, ‘হাসবুনাল্লাহ ওয়া’ নি’মাল ওয়াকীল (আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম পৃষ্ঠপোষক)। এ বাক্যটি মুহাম্মদ (সা.) বলেন : যখন লোকেরা (মুসলমানদের) বলল, তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লোকরা (শত্রুবাহিনী) একতাবদ্ধ হয়েছে তাদের ভয় কর। (এ হুমকি) মুসলমানদের ঈমান আরো বৃদ্ধি করে দেয় এবং তারা বলে ‘হাসবুনাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকীল’ (আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম পৃষ্ঠপোষক)। (বুখারী)

৪:৪৬ مِنَ الَّذِیۡنَ هَادُوۡا یُحَرِّفُوۡنَ الۡکَلِمَ عَنۡ مَّوَاضِعِهٖ وَ یَقُوۡلُوۡنَ سَمِعۡنَا وَ عَصَیۡنَا وَ اسۡمَعۡ غَیۡرَ مُسۡمَعٍ وَّ رَاعِنَا لَـیًّۢا بِاَلۡسِنَتِهِمۡ وَ طَعۡنًا فِی الدِّیۡنِ ؕ وَ لَوۡ اَنَّهُمۡ قَالُوۡا سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا وَ اسۡمَعۡ وَ انۡظُرۡنَا لَکَانَ خَیۡرًا لَّهُمۡ وَ اَقۡوَمَ ۙ وَ لٰکِنۡ لَّعَنَهُمُ اللّٰهُ بِکُفۡرِهِمۡ فَلَا یُؤۡمِنُوۡنَ اِلَّا قَلِیۡلًا

ইয়াহুদীদের মধ্যে কিছু লোক কথাগুলো স্থানচ্যুত করে বিকৃত করে এবং বলে, “শুনলাম ও অমান্য করলাম” এবং শোনে না শোনার মত; আর নিজেদের জিহবা কুঞ্চিত করে এবং দ্বীনের প্রতি তাচ্ছিল্ল করে বলে, রাইনা। কিন্তু তারা যদি বলত, শুনলাম ও মান্য করলাম এবং শুনুন ও আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন, তবে তা তাদের জন্য ভাল ও সঙ্গত হত। কিন্তু তাদের কুফরীর জন্য আল্লাহ্‌ তাদেরকে লা’নত করেছেন। ফলে তাদের অল্প সংখ্যকই ঈমান আনে।

 

‘যারা ইহুদী’ না বলে বলেছেন, ‘যারা ইহুদী হয়েছে’৷ এর কারণ প্রথম তারাও মুসলমানই ছিল, যেমন প্রত্যেক নবীর উম্মাত আসলে মুসলমান হয়৷ কিন্তু পরে তারা কেবলমাত্র ইহুদী হয়েই রয়ে গেছে৷

. এর তিনটি অর্থ হয়৷

এক, তারা আল্লাহর কিতাবের শব্দের মধ্যে হেরফের করে দেয়৷

দুই, তারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যার সাহায্যে কিতাবের আয়াতের অর্থের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন আনে৷

তিন, তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের সাহচর্যে এসে তাদের কথা শোনে এবং সেখান থেকে ফিরে গিয়ে লোকদের সামনে তাঁদের সম্পর্কে বানোয়াট কথা বলে৷

একটি কথা একভাবে বলা হয় এবং তারা নিজেদের শয়তানী মনোবৃত্তি ও দুষ্টবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে তাকে ভিন্নরূপ দিয়ে লোকদের সামনে এনে হাজির করে৷ এভাবে তারা নবী ও তাঁর অনুসারীদের দুর্নাম করে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে ইসলামী দাওয়াতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে৷

অর্থাৎ তাদেরকে আল্লাহর বিধান শুনানো হলে তারা উচ্চৈস্বরে বলে ওঠে, “সামে’না” (আমরা শুনেছি) এবং নীচু স্বরে বলে, “আসাইনা” (আমরা অমান্য করলাম)৷ অথবা তারা “আতা’য়না” (আমরা আনুগত্য করলাম) শব্দটি এমনভাবে নিজেদের কণ্ঠ বাঁকিয়ে ওলটপালট করে উচ্চারণ করে যার ফলে তা “আসাইনা” (আমরা অমান্যকরলাম) হয়ে যায়৷

অর্থাৎ কথাবার্তার মাঝখানে যখন তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোন কথা বলতে চায় তখন বলে, “ইস্‌মা” (শুনুন)৷ আবার সাথে সাথেই বলে ওঠে, “গাইরা মুসমাঈন”৷ এই “গাইরা মুসমাঈন” শব্দের দুই অর্থ হতে পারে৷ এর একটি অর্থ হতে পারেঃ আপনি এমনি একজন সম্মানিত বুযর্গ, যাকে তার ইচ্ছা বিরোধী কোন কথা শুনানো যেতে পারে না৷ এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারেঃ তোমাকে কেউ কিছু শুনাবে এমন যোগ্যতা তোমার নেই৷ এর আর একটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ করুন তুমি যেন বধির হয়ে যাও৷

নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথ আলোচনার সময় ইহুদিদের যখন একথা বলার প্রয়োজন হতো যে, থামুন বা ‘কথাটি আমাদের একটু বুঝে নিতে দিন’ বা তখন তারা ‘রাইনা’ বলতো ৷ এ শব্দটির বাহ্যিক অর্থ ছিল , ‘আমাদের একটু সুযোগ দিন’ বা ‘আমাদের কথা শুনুন ৷’কিন্তু এর আরো কয়েকটি সম্ভাব্য অর্থও ছিল ৷ যেমন হিব্রু ভাষায় অনুরূপ যে শব্দটি ছিল তার অর্থ ছিলঃ’শোন, তুই বধির হয়ে যা৷ ‘ আরবী ভাষায়ও এর একটি অর্থ ছিল , ‘মূর্খ ও নির্বোধ ‘৷আলোচনার মাঝখানে এমন সময় শব্দটি প্রয়োগ করা হতো যখন এর অর্থ দাড়াত , তোমরা আমাদের কথা শুনলে আমরাও তোমাদের কথা শুনবো ৷ আবার মুখটাকে একটু বড় করে ‘রা-ঈয়ানা’ ( ) ও বলার চেষ্টা করা হতো ৷ এর অর্থ দাঁড়াত ‘ওহে, আমাদের রাখাল !’তাই মুসলমানদের হুকুম দেয়া হয়েছে, তোমরা এ শব্দটি ব্যবহার না করে বরং ‘উন্‌যুরনা’ বলো ৷ এর অর্থ হয়, ‘আমাদের দিকে দেখুন ‘ ‘আমাদের প্রতি দৃষ্টি দিন ‘ অথবা ‘আমাদের একটু বুঝতে দিন৷ ‘

তাদের মধ্যে ঈমান আনয়নকারী লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য হবে। পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, ইয়াহুদীদের মধ্য থেকে ঈমান আনয়নকারীদের সংখ্যা দশ পর্যন্তও পৌঁছেনি। অথবা এর অর্থ হল, তারা অনেক অল্প বিষয়ের উপর ঈমান আনবে। অথচ ফলপ্রসূ ঈমানের দাবী হল, সমস্ত বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।

৪:৪৭ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ اٰمِنُوۡا بِمَا نَزَّلۡنَا مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ نَّطۡمِسَ وُجُوۡهًا فَنَرُدَّهَا عَلٰۤی اَدۡبَارِهَاۤ اَوۡ نَلۡعَنَهُمۡ کَمَا لَعَنَّاۤ اَصۡحٰبَ السَّبۡتِ ؕ وَ کَانَ اَمۡرُ اللّٰهِ مَفۡعُوۡلً

৪৭. হে কিতাবপ্রাপ্তগণ, তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে আমরা যা নাযিল করেছি তাতে তোমরা ঈমান আন, আমরা মুখমণ্ডলগুলোকে বিকৃত করে তারপর সেগুলোকে পিছনের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার আগে অথবা আসহাবুস সাবতকে যেরূপ লা’নত করেছিলাম সেরূপ তাদেরকে লা’নত করার আগে। আর আল্লাহর আদেশ কার্যকরী হয়েই থাকে।

 

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার একদল ইয়াহুদী সর্দার যেমন আব্দুল্লাহ ইবন সুওরিয়া, কাব ইবন আসওয়াদ প্রমুখদের সাথে কথোপকথন চলার সময় বলেছিলেন, হে ইয়াহুদীরা তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং ঈমান আন। আল্লাহর শপথ, তোমরা জান যে, আমি যা নিয়ে এসেছি তা বাস্তবিকই হক। তখন তারা বলল, মুহাম্মাদ আমরা তা জানি না। তারা যা জানত তা অস্বীকার করল এবং কুফরতে বহাল রইলো। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [তাবারী]

(২) ঘুরিয়ে দেয়া বা উল্টে দেয়ার মধ্যে দুটি সম্ভাবনাই থাকতে পারে মুখমণ্ডলের আকার অবয়ব মুছে দিয়ে গোটা চেহারাকে পশ্চাদিকে ফিরিয়ে দেয়াও হতে পারে, আবার মুখমণ্ডলকে গর্দানের মত সমান্তরাল করে দেয়াও হতে পারে। অর্থাৎ মুখমণ্ডলকে গদানের দিকে উল্টে না দিয়ে বরং গর্দানের মত পরিস্কার ও সমান্তরাল করে দেয়া। [রুহুল মা’আনী] তবে মুজাহিদ বলেন, এখানে পশ্চাদিকে ফিরিয়ে দেয়ার অর্থ, হক পথ থেকে তাদেরকে বিচ্যুত করে দেয়া যাতে তারা পশ্চাতে ফেলে আসা ভ্রষ্ট পথেই ফিরে যায়। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

(৩) ‘আসহাবুস সাবত’ অর্থ শনিবারের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ। আল্লাহ্ তাআলা ইয়াহুদীদেরকে শনিবারে মাছ শিকার করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তারা সে নির্দেশকে হীলা-বাহানা করে অমান্য করেছিল। তখন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বানরে রুপান্তরিত করেছিলেন। [দেখুন, সূরা আল-বাকারাহ: ৬৫] তা ছিল নিঃসন্দেহে অভিশাপ। এ আয়াতে সে ধরনের অভিশাপের ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। [তাবারী]

এখানে বনি ইসরাইলীদের আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি হল- মহান আল্লাহ তাদের জন্য শনিবারকে বিশ্রামের দিন ঘোষণা করেছিলেন। অর্থাৎ শনিবারে কাজ-কর্ম নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সমুদ্র উপকূলে বসবাসকারী একদল ইহুদী এক ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শনিবারে মাছ ধরতো। তারা সাগরের প্রান্তে এক ধরনের ফাঁদ বা গর্ত তৈরি করতো এবং ওইসব গর্তে মাছ প্রবেশ করার পর গর্তের মুখ বা প্রবেশপথ বন্ধ করে দিত এবং পরের দিন অর্থাৎ রোববারে ওইসব মাছ ধরতো। আর এভাবে তারা আল্লাহর নির্দেশকে অবজ্ঞা করেছিল। আল্লাহও তার বিধানকে অমান্য করা ও ঐশি বিধি-বিধানকে অবজ্ঞা করার শাস্তি হিসাবে তাদের চেহারাকে বিকৃত করে দেন এবং তাদেরকে বানরে রূপান্তরিত করেন যাতে অন্যরাও এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।

৪:৪৮ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِهٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰهِ فَقَدِ افۡتَرٰۤی اِثۡمًا عَظِیۡمًا

৪৮. নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন। আর যে-ই আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে এক মহাপাপ রটনা করে।

আয়াতে আল্লাহ তা’আলার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে যেসব বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে, যে কোন সৃষ্ট বস্তুর ব্যাপারে তেমন কোন বিশ্বাস পোষণ করাই হল শির্ক। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন সৃষ্ট বস্তুকে ইবাদাত কিংবা মহব্বত ও সম্মান প্রদর্শনে আল্লাহর সমতুল্য মনে করাই শির্ক।

জাহান্নামে পৌছে মুশরিকরা যে উক্তি করবে, আল্লাহ তা’আলা তা উল্লেখ করেছেন যে, “আল্লাহর শপথ, আমরা প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত ছিলাম যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব-পালনকর্তার সমতুল্য স্থির করেছিলাম।” [সূরা আশ-শু’আরাঃ ৯৭-৯৮]

শির্কের প্রকারভেদঃ শির্ক দু’প্রকার, যথা- বড় শির্ক ও ছোট শির্ক।

বড় শির্ক আবার দু’প্রকার। আল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা প্রভূত্বে শির্ক করা। আল্লাহর উলুহিয়াত তথা ইবাদাতে শির্ক করা।

আল্লাহর রুবুবিয়্যাত বা প্রভূত্বে শির্ক দু’ভাবে হয়ে থাকে –

১) জগতের রব বা পালনকর্তা আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার না করা যেমন কম্যুনিষ্ট, নাস্তিক, মুলহিদ ইত্যাদি সম্প্রদায়।

আল্লাহর নাম, গুণ ও কর্মকাণ্ডকে স্বীকার না করা, যেমন- ঈসমাঈলী সম্প্রদায়, বাহাই সম্প্রদায়, বুহরা সম্প্রদায়, জাহমিয়া ও মু’তাজিলা সমপ্রদায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে পার্থক্য না করে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক করে দেখা যেমন ওয়াহদাতুল অজুদে বিশ্বাসী সম্প্রদায়, যারা মনে করে যে, আল্লাহ কোন কিছুর সূরত ইখতিয়ার করে তাতে নিজেকে প্রকাশ করেন যেমন, হুলুলী সম্প্রদায় এবং যারা বিশ্বাস করে যে, কারো পক্ষে আল্লাহর সাথে একাকার হয়ে যাওয়া সম্ভব।

২) জগতের রব বা পালনকর্তা আল্লাহর সত্তা, নাম, গুণাবলী ও তাঁর কর্মকাণ্ডে কাউকে সমকক্ষ নির্ধারণ করা।

ক) আল্লাহর স্বত্ত্বার সমকক্ষ কোন সত্তা নির্ধারণ করার মত কোন শির্ক বনী আদমের মধ্যে বিরল। এ ধরণের দাবী প্রথম নমরূদ করেছিল, কিন্তু ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সাথে বিতর্কে সে তার সে দাবীর সপক্ষে যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়ে হেরে গিয়েছিল। অনুরূপভাবে ফিরআউনও প্রকাশ্যে এ ধরণের দাবী করেছিল। আল্লাহ তাকে স্বপরিবারে দলবলসহ ধ্বংস করে তার দাবীর অসারতা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

খ) আল্লাহর নামসমূহের কোন নাম অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করার মত শির্ক বিভিন্ন জাতিতে বিদ্যমান। যারাই তাদের উপাস্যদেরকে আল্লাহ্‌র নামের মত নাম দেয় তারাই এ ধরণের শির্কে লিপ্ত। যেমন হিন্দুগণ তাদের বিভিন্ন অবতারকে আল্লাহর নামসমূহের মত নাম দিয়ে থাকে। অনুরূপভাবে কোন কোন বাতেনী গ্রুপের লোকেরা যেমন, দ্রুজ সম্প্রদায়, নুসাইরী সম্প্রদায়, আগাখানী ঈসমাঈলী সম্প্রদায় তাদের ঈমামদেরকে আল্লাহর নামসমূহে অভিহিত করে।

গ) আল্লাহর গুণ ও কর্মকাণ্ডকে অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করা। আল্লাহর গুণ ও কর্মকাণ্ডের কোন শেষ নেই। সেগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। আল্লাহর অপার শক্তির সাথে সম্পৃক্ত, তাঁর জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত এবং হুকুম ও শরীআতের সাথে সম্পৃক্ত।

১. আল্লাহর অপার শক্তির সাথে যারা শির্ক করে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সৃষ্টি, মৃত্যু, জীবন, বিপদাপদ থেকে উদ্ধার, উদ্দেশ্য হাসিলকারী বলে বিশ্বাস করে। যেমন, অনেক অজ্ঞ মূর্খ মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, অনেক সুফীরা তাদের পীর সাহেব সম্পর্কে বিশ্বাস করে থাকে। অনুরূপভাবে অনেকে কবরবাসী কোন লোক সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। তদ্রুপ অনেকে জাদুকর জাতীয় লোকদের সম্পর্কেও এ ধরণের বিশ্বাস করে। অনুরূপভাবে শিয়া সম্প্রদায়ও তাদের ইমামদের ব্যাপারে এ ধরণের বিশ্বাস করে।

২. আল্লাহর পরিপূর্ণ জ্ঞানের সাথে যারা শির্ক করে থাকে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করে। যেমন, অনেক অজ্ঞ মূর্খ মানুষ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে, অনেক সুকীরা তাদের পীর সাহেব সম্পর্কে বিশ্বাস করে যে তারা গায়েব জানে। আবার অনেকে কবরবাসী কোন কোন লোক সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করে থাকে। তদ্রুপ অনেকে গণক, জ্যোতিষ, জীন, প্রেতাত্মা, ইত্যাদীতে বিশ্বাস করে যে, তারাও গায়েব জানে। অনুরূপভাবে শিয়া সম্প্রদায়ও তাদের ইমামদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে যে, তারা গায়েব জানতো।

৩. আল্লাহর শরীআত ও হুকুমের সাথে যারা শির্ক করে থাকে তাদের উদাহরণ হলো, ঐ সমস্ত লোকেরা যারা আল্লাহর মত শরীআত প্রবর্তনের অধিকার তাদের আলেম ও শাসকদের দিয়ে থাকে। যেমন, ঐ সমস্ত জাতি যারা সরকার বা পার্লামেন্টকে আল্লাহর আইন বিরোধী আইন করে তদস্থলে অন্য আইনে বিচার করা শ্রেয় বা জায়েয বা আল্লাহর আইন ও অন্যান্য আইন সমমানের মনে করে থাকে। শির্কের এ সমস্ত প্রকার আল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা প্রভূত্বের সাথে সম্পৃক্ত।

আল্লাহর ইবাদাতে শির্কঃ

আল্লাহর ইবাদাতে শির্ক বলতে বুঝায়, আল্লাহ যা কিছু ভালবাসেন সন্তুষ্ট হন বান্দার এমন সব কথা ও কাজ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা। যেমন আল্লাহ্ তাঁর কাছে দোআ করা ভালবাসেন, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া ভালবাসেন, তাঁর কাছে উদ্ধার কামনা ভালবাসেন, তাঁর কাছে পরিপূর্ণভাবে বিনয়ী হওয়া ভালবাসেন, তাঁর জন্যই সিজদা, রুকু, সালাত, যবেহ, মানত ইত্যাদী ভালবাসেন।

এর কোন কিছু যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে করে তবে তা হবে আল্লাহর ইবাদাতে শির্ক। অন্য কারো কাছে পরিপূর্ণ আশা করলে, অন্য কাউকে গোপন ভয় করলেও তা শির্ক হিসাবে গণ্য হবে। যেহেতু বান্দার ইবাদাতসমূহ বিশ্বাস, কথা ও কাজের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে, সে হিসাবে ইবাদতের মধ্যেও এ তিন ধরণের শির্ক পাওয়া যায়।

অর্থাৎ কখনো কখনো ইবাদত হয় মনের ইচ্ছার মাধ্যমে, আন্তরিক আনুগত্যের মাধ্যমে, আবার কখনো কখনো তা সংঘটিত হয় বাহ্যিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আবার কখনো কখনো তা সংঘটিত হয়ে থাকে কথাবার্তার মাধ্যমে।

 

দ্বিতীয় প্রকার শির্ক হলোঃ ছোট শির্ক, কিন্তু তাও কবীরাগুনাহ হতে মারাত্মক। ছোট শির্কের উদাহরণ হলো, এ প্রকার বলা যে, কুকুর না ডাকলে চোর আসত, আপনি ও আল্লাহ যা চান, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা, সামান্য লোক দেখানোর জন্য কোন কাজ করা। ইত্যাদি। [ইবনুল কাইয়্যেম, আল-জাওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়ায়িশ শাফী’, শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সুলাইমান আততামীমী, আল-ওয়াজিবুল মুতাহাত্তিমাতুল মারিফাহ’; আশ-শির্ক ফিল কাদীম ওয়াল হাদীস গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত]

এখানে এটা জানা আবশ্যক যে, যুলুম ও অবিচার তিন প্রকার। এক প্রকার যুলুম যা আল্লাহ্ তাআলা কখনো ক্ষমা করবেন না। দ্বিতীয় প্রকার যুলুম যা মাফ হতে পারে। আর তৃতীয় প্রকার যুলুমের প্রতিশোধ আল্লাহ তা’আলা না নিয়ে ছাড়বেন না। প্রথম প্রকার যুলুম হচ্ছে শির্ক, দ্বিতীয় প্রকার আল্লাহর হকে ক্রটি করা এবং তৃতীয় প্রকার বান্দার হক বিনষ্ট করা। [ইবন কাসীর]

এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তিনি তার সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করবেন না। এর বাইরে যত গোনাহ আছে সবই তিনি যার জন্যে ইচ্ছে ক্ষমা করে দিবেন। আর যে তার সাথে কাউকে শরীক করে সে অবশ্যই এক বড় মিথ্যা অপবাদ রটনা করল। অন্য আয়াতে অবশ্য আল্লাহ্ তা’আলা শির্ককারীদের মধ্যে যারা তাওবা করবে তাদেরকে ক্ষমা করার কথা ঘোষণা করেছেন।

আল্লাহ বলেন, “আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে ডাকে না, … তবে যদি তারা তাওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে।” [সূরা আল-ফুরকান: ৭০] সুতরাং তাওবাহ করলে শির্কও মাফ হয়ে যায়।

(২) আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ আমরা কবীরা গোনাহকারীর জন্য ইস্তেগফার করা থেকে বিরত থাকতাম। শেষ পর্যন্ত যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ আয়াত শুনলাম এবং আরো শুনলাম যে, তিনি বলছেনঃ আমি আমার দো’আকে গচ্ছিত রেখেছি আমার উম্মতের কবীরা গোনাহগারদের সুপারিশ করার জন্য। ইবন উমর বলেনঃ এরপর আমাদের অন্তরে যা ছিল, তা অনেকটা কেটে গেল ফলে আমরা ইস্তেগফার করতে থাকলাম ও আশা করতে থাকলাম। [মুসনাদে আবি ইয়া’লাঃ ৫৮১৩]

৪:৪৯ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ یُزَکُّوۡنَ اَنۡفُسَهُمۡ ؕ بَلِ اللّٰهُ یُزَکِّیۡ مَنۡ یَّشَآءُ وَ لَا یُظۡلَمُوۡنَ فَتِیۡلًا

৪৯. আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা নিজেদেরকে পবিত্র মনে করে? বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছে পবিত্র করেন।(১) আর তাদের উপর সূতা পরিমাণও যুলুম করা হবে না।

আয়াতের ভাষ্য হচ্ছে, নিজেকে কেউ যেন দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে মনে না করে। মূলত: আত্মপ্রশংসা এবং নিজেকে ক্রটিমুক্ত মনে করা বৈধ নয়। ইয়াহুদীরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে বর্ণনা করত। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতে তাদের পবিত্রতা বর্ণনা করে; তাদের ব্যাপারে বিস্মিত হওয়াই উচিত। এতে প্রতীয়মান হয় যে, কারো পক্ষে নিজের কিংবা অন্য কারো পবিত্রতা বর্ণনা করা জায়েয নয়। এই নিষিদ্ধতার কয়েকটি কারণ রয়েছে-

অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মপ্রশংসার কারণ হয়ে থাকে অহমিকা বা আত্মগৰ্ব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর প্রশংসা করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, তা হচ্ছে জবাই করা।’ [ইবন মাজাহঃ ৩৭৪৩] কাতাদা বলেন, এখানে ইয়াহুদীদেরকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। তারা নিজেদের প্রশংসায় কোন প্রকার কসুর করত না। তারা নিজেদেরকে আল্লাহর সন্তান-সন্তুতি ও তার প্রিয়পাত্র বলে দাবী করত। [তাবারী]

মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না, তিনিই সম্যক জানেন কে আল্লাহভীরু।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ৩২)

দ্বিতীয়তঃ শেষ পরিণতি সম্পর্কে শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই অবগত যে, তা পবিত্রতা কিংবা পরহেযগারীর মধ্যেই হবে কিনা। কাজেই নিজে নিজেকে পবিত্র বলে আখ্যায়িত করা তাকওয়ার পরিপন্থি। এক বর্ণনায় এসেছে, সালমা বিনতে যয়নব রাদিয়াল্লাহু আনহা তার মাতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি? তখন যেহেতু আমার নাম ছিল بَرَّة (বাররাহ বা পাপমুক্ত), কাজেই আমি তাই বললাম। তাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে পাপমুক্ত বলে বর্ণনা করো না। কারণ, একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই জানেন, তোমাদের মধ্যে কে পবিত্র। অতঃপর বাররাহ নামটি পাল্টিয়ে তিনি যয়নব রেখে দিলেন। [বুখারীঃ ৫৮৩৯, মুসলিমঃ ২১৪১]

নিষিদ্ধতার আরো এক কারণ এই যে, অধিকাংশ সময় এ ধরনের দাবী করতে গিয়ে মানুষের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি হতে থাকে যে, সে লোক আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে এজন্য প্রিয় যে, সে যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। অথচ কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। কারণ, মানুষের মধ্যে অসংখ্য ক্রটি-বিচ্যুতি বিদ্যমান থাকে।

নিষিদ্ধতার আরেক কারণ হল, মানুষ জানে না তার কৃত আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হচ্ছে কিনা। কেননা, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, যখন (وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَىٰ رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ) ‘আর যারা তাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তা দেয় এমতাবস্থায় যে, তাদের অন্তর ভীত-সন্ত্রস্ত এজন্যে যে তারা তাদের রব এর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে’। [সূরা আল-মু’মিনূনঃ ৬০] এ আয়াত নাযিল হল, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম তারা কি ঐ সম্প্রদায় যারা মদ খায় এবং চুরি করে? তিনি বললেন, না, হে সিদ্দিকের মেয়ে! তারা হল ঐ সমস্ত ব্যক্তি যারা সালাত-সাওম আদায় করে এবং ভয় করে যে তাদের থেকে কবুল করা হবে না। [তিরমিযীঃ ৩১৭৫, ইবন মাজাহঃ ৪১৯৮, মুসনাদে আহমাদঃ ৬/১৫৯]

৪:৫০ اُنۡظُرۡ کَیۡفَ یَفۡتَرُوۡنَ عَلَی اللّٰهِ الۡکَذِبَ ؕ وَ کَفٰی بِهٖۤ اِثۡمًا مُّبِیۡنًا

৫০. দেখুন! তারা আল্লাহ সম্বন্ধে কিরূপ মিথ্যা উদ্ভাবন করে; আর প্রকাশ্য পাপ হিসেবে এটাই যথেষ্ট।

তাদের পবিত্র হওয়ার দাবী তাদের মিথ্যুক হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কুরআনে কারীমের এই আয়াত এবং তার শানে নুযুলের বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একে অপরের প্রশংসা করা বিশেষ করে আত্মপ্রশংসা করার দাবী করা ঠিক ও জায়েয নয়। এই কথাটাকেই মহান আল্লাহ কুরআনের অন্যত্র এইভাবে বলেছেন, [فَلا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى] (النجم: 32) ‘‘অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। আল্লাহই ভাল জানেন তোমাদের মধ্যে আল্লাহভীরু কে?’’ (সূরা নাজমঃ ৩২)

মিকদাদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে এসেছে যে, নবী করীম (সাঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন মুখোমুখি প্রশংসাকারীদের মুখে ধুলো ছিটিয়ে দিই।(মুসলিম ৩০০২নং)

অপর এক হাদীসে এসেছে যে, রসূল (সাঃ) এক ব্যক্তিকে অপরজনের মুখোমুখি প্রশংসা করতে দেখলে বললেন, হায় হায়! তুমি তোমার সঙ্গীর গর্দান কেটে ফেললে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের যদি কখনো কাউকে প্রশংসা করতেই হয় তাহলে বলবেঃ

أحسب فلانا والله حسيبه ولا أزكي على الله أحدا أحسبه كذا وكذا

“আমি অমুককে এইরূপ মনে করি, আল্লাহই তাকে ভালো জানেন (তার পরিপূর্ণ হিসাব সংরক্ষক), আল্লাহর উপরে আমি কাউকে ভালো বলছি না। আমি তাকে অমুক অমুক গুণের অধিকারী বলে মনে করি। সহীহ বুখারী ২/৯৪৬, ৫/২২৮১, সহীহ মুসলিম ৪/২২৯৬।

কারো মুখোমুখি প্রশংসা করা হলে-

আল্লাহর সাথে শিরক হতে পারে।

মনের মাঝে অহঙ্কার সৃষ্টি হতে পারে।

নিয়্যাহ ও ইখলাস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

লোকদেখানো আমলের প্রবণতা বাড়তে পারে।

অন্তরে শয়তানের কুমন্ত্রণা সৃষ্টি হতে পারে।

অসত্য বলতে হতে পারে।

অবৈধ সুবিধা আদায়ের কারণ হতে পারে।

প্রশংসার ছলে তিরস্কার করাও উদ্দেশ্য হতে পারে। ইত্যাদি।

সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إذا كان أحدكم مادحا صاحبه لامحالة، فليقل : احسب فلانا والله حسيبه، ولا ازكى على الله أحدا، احسبه -ان كان يعلم ذاك- كذا وكذا

তোমাদের কেউ যখন তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রশংসা করবেই তখন তার সম্পর্কে যেন কেবল এতটুকুই বলে যে, ‘আমি অমুককে এমন-এমন মনে করি, তবে বাস্তবে সে কেমন সে হিসাব আল্লাহ তাআলার কাছেই আছে, আমি আল্লাহর জ্ঞানের বিপরীতে কারও সাফাই দিচ্ছি না। এটাও বলবে কেবল তখনই যখন তার সম্পর্কে সেরকম জানা থাকে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৩০০০ )

মুমিন মানুষের প্রশংসাকে দোয়া হিসেবে গ্রহণ করে। কেউ সাহাবিদের প্রশংসা করলে তাঁরা বলতেন, হে আল্লাহ! তারা যা জানে না সে বিষয়ে আমাকে ক্ষমা করুন, তারা যা বলেছে সে ব্যাপারে আমাকে পাকড়াও করবেন না এবং তারা যেমন ধারণা করে আমাকে তার চেয়ে উত্তম বানিয়ে দিন।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৭৬১)