সূরা আন নিসাঃ ৫ম রুকু(২৬-৩৩)আয়াত

সূরা আন নিসাঃ ৫ম রুকু(২৬-৩৩)আয়াত

 

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

৪:২৬ یُرِیۡدُ اللّٰهُ لِیُبَیِّنَ لَکُمۡ وَ یَهۡدِیَکُمۡ سُنَنَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ یَتُوۡبَ عَلَیۡکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ

আল্লাহ ইচ্ছে করেন তোমাদের কাছে বিশদভাবে বিবৃত করতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি তোমাদেরকে অবহিত করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

আল্লাহ তা’আলা তোমাদের মা ও কন্যাদের হারাম হওয়ার ব্যাপারটি বিস্তারিত বর্ণনা করতে চান। আর এটাও জানিয়ে দিতে চান যে, এটা পূর্বে কখনও হালাল ছিল না। সব শরীআতেই মা ও মেয়ে হারাম ছিল। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

মানব সভ্যতার প্রাচীনতম যুগ থেকে প্রতি যুগের নবীগণ ও তাঁদের সৎ ও সত্যনিষ্ঠ অনুসারীগণ সমাজ, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার এই আইনগুলো কার্যকর করে এসেছেন৷ আল্লাহ তাঁর অসীম অনুগ্রহের বদৌলতে তোমাদেরকে জাহেলীয়াতের অবস্থা থেকে বের করে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ লোকদের জীবনধারার দিকে পরিচালিত করেছেন৷

৪:২৭ وَ اللّٰهُ یُرِیۡدُ اَنۡ یَّتُوۡبَ عَلَیۡکُمۡ ۟ وَ یُرِیۡدُ الَّذِیۡنَ یَتَّبِعُوۡنَ الشَّهَوٰتِ اَنۡ تَمِیۡلُوۡا مَیۡلًا عَظِیۡمًا

২৭. আর আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করতে চান। আর যারা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা চায় যে, তোমরা ভীষণভাবে পথচ্যুত হও।

এখানে মুনাফিক, রক্ষণশীল ও প্রাচীন পন্থী মূর্খ এবং মদীনার উপকণ্ঠের ইহুদীদের দিকে ইংগিত করা হয়েছে৷ সমাজ ও সংস্কৃতিতে শত শত বছরের পুঞ্জীভূত জাহেলী বংশ ও গোত্রপ্রীতি এবং রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধে যে সংস্কার অভিযান চলছিল মুনাফিক ও রক্ষণশীলদের কাছে তা ছিল অত্যন্ত অপ্রীতিকর৷ তারা এটাকে কোনক্রমেই বরদাশত করতে পারছিল না৷ মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে মেয়েদের অংশ লাভ, শ্বশুর বাড়ির বাঁধন থেকে বিধবাদের মুক্তি পাওয়া এবং ইদ্দত শেষ হবার পর যে কোন ব্যক্তিকে বিয়ে করার ব্যাপারে তাদের স্বাধীন ক্ষমতা লাভ, সৎ-মাকে বিয়ে কার হারাম হওয়া দুই বোনকে এই সাথে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করাকে অবৈধ গণ্য করা, পালকপুত্রকে বিয়ে করা হালাল গণ্য করা এবং এই ধরনের আরো অনেক সংস্কারমূলক কার্যাবলীর প্রত্যেকটির ওপর বয়োবৃদ্ধ ও বাপ-দাদার রীতি-রেওয়াজের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিরা চীৎকার করে উঠছিল৷ দীর্ঘদিন থেকে এই বিধানগুলোর বিরুদ্ধে নানান কথাবার্তা চলছিল৷ দুষ্ট লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সংস্কার মূলক দাওয়াতের বিরুদ্ধে এই বিরূপ কথাগুলো ব্যবহার করে লোকদেরকে উত্তেজিত করে চলছিল৷ যেমন, ইসলামী শরীয়াত যে ধরনের বিয়েকে হারাম গণ্য করছিল তেমনি ধরনের কোন বিয়ের ফলে ইতিপূর্বে যে ব্যক্তির জন্ম হয়েছিল তাকে এই বলে উত্তেজিত করা হচ্ছিলঃ “নিন জনাব, আজ যে নতুন বিধান ওখানে এসেছে তার দৃষ্টিতে তো আপনার বাপ ও মায়ের সম্পর্ক অবৈধ গণ্য হয়েছে”৷ এভাবে সেখানে আল্লাহর বিধানের আওতায় যে সংস্কারমূলক কাজ হচ্ছিল এই নির্বোধ লোকেরা তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল৷

অন্যদিকে ছিল ইহুদীরা৷ শত শত বছরের অপ্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম শাস্ত্রীয় বিশ্লেষনের মাধ্যমে তারা আল্লাহর শরীয়াতের গায়ে নিজেদের মনগড়া আইন-বিধানের একটি মোটা চামড়া জড়িয়ে দিয়েছিল৷ শরীয়াতের মধ্যে তারা অসংখ্য বিধি-নিষেধ, সূক্ষ্মতা ও কঠোরতা বৃদ্ধি করেছিল৷ বহু হালাল জিনিসকে তারা হারাম করে নিয়েছিল৷ অনেক কল্পনাভিত্তিক কুসংস্কারকে তারা আল্লাহর আইনের অন্তরভূক্ত করে নিয়েছিল৷ এখন কুরআন যে সহজ সরল শরীয়াত পেশ করছিল তার মর্যাদা অনুধাবন করা তাদের উলামা ও জনগণ উভয়ের মন-মানস ও রুচির সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল৷ কুরআনের বিধান শুনে তারা অস্থির হয়ে পড়তো৷ এক একটি বিষয়ের ওপর শত শত আপত্তি উত্থাপন করতো৷ তাদের দাবী ছিল, যদি কুরআন তাদের ফকীহদের সমস্ত ইজতিহাদ ও তাদের পূর্বপূরুষদের যাবতীয় কাল্পনিক কুসংস্কার ও পৌরানিকতাবাদকে আল্লাহর শরীয়াত হিসেবে গণ্য না করে, তাহলে এটি কখনোই আল্লাহর কিতাব হতে পারে না৷ যেমন, ইহুদীদের নিয়ম ছিল, মাসিক ঋতুস্রাবের সময় তারা মেয়েদেরকে সম্পূর্ণ নাপাক মনে করতো৷ তাদের রান্না করা খাবার খেতো না৷ তাদের হাতের পানি পান করতো না৷ তাদের সাথে এক বিছানায় বসতো না৷ এমনকি তাদের হাতে স্পর্শ লেগে যাওয়াকে মকরূহ মনে করা হতো৷ এই কদিন মেয়েরা তাদের নিজেদের ঘরে নিজেরা ‘অচ্ছুৎ’ হয়ে থাকতো৷ ইহুদীদের সংস্পর্শে এসে মদীনার আনসারদের মধ্যেও এই রেওয়াজ চালু হয়ে গিয়েছিল৷ রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় এলে তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়৷ জবাবে সূরা বাকারার ২৮ রুকূ’র প্রথম আয়াতটি নাযিল হয়৷ এই আয়াতের প্রেক্ষিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুকুম দেন,মাসিক ঋতুস্রাবের সময় স্ত্রীদের সাথে যে সমস্ত সম্পর্ক যেভাবে রাখা হতো সেগুলো ঠিক তেমনিভাবেই এখন তাদের সাথে রাখো৷ এতে ইহুদীরা হৈ চৈ করতে লাগলো৷ তারা বলতে থাকলো, এ ব্যক্তি তো কসম খেয়ে বসেছে, আমাদের এখানে যা কিছু হারাম হয়ে আছে সেগুলোকে সে হালাল করেই ছাড়বে এবং যেসব জিনিসকে আমরা নাপাক গণ্য করে এসেছিল সেগুলোকে পাক-পবিত্র গণ্য করবেই৷

৪:২৮ یُرِیۡدُ اللّٰهُ اَنۡ یُّخَفِّفَ عَنۡکُمۡ ۚ وَ خُلِقَ الۡاِنۡسَانُ ضَعِیۡفًا

আল্লাহ তোমাদের ভার কমাতে চান; আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দুর্বলরূপে।

 

আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে হালকা ও সহজ বিধান দিতে চান। তোমাদের অসুবিধা দূর করার জন্য বিয়ের ব্যাপারে এমন সরল বিধান তিনি দিয়েছেন, যা সবাই পালন করতে পার। স্বাধীন নারীদেরকে বিয়ে করার শক্তি না থাকার ক্ষেত্রে বাদীদেরকে বিয়ে করার অনুমতি দান করেছেন। [তাবারী] অনুরূপভাবে উভয়পক্ষকে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে মাহর নির্ধারণ করার ক্ষমতা দিয়েছেন এবং প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ইনসাফ ও সুবিচারের শর্তে একাধিক বিয়ে করার অনুমতিও দিয়েছেন। এসব কিছুই হাল্কা ও সহজ করার স্বার্থেই করা হয়েছে।

মানুষ সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল। তার মাঝে কাম-বাসনার উপাদানও নিহিত রয়েছে। যদি তাকে নারীদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকার আদেশ দেয়া হত, তবে সে আনুগত্য করতে অক্ষম হয়ে পড়ত। তার অক্ষমতা ও দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদেরকে বিয়ে করার শুধু অনুমতি দেয়া হয়নি; বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

৪:২৯ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَکُمۡ بَیۡنَکُمۡ بِالۡبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَ تِجَارَۃً عَنۡ تَرَاضٍ مِّنۡکُمۡ ۟ وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ بِکُمۡ رَحِیۡمًا

হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; কিন্তু তোমরা পরস্পর রাযী হয়ে ব্যবসা করা বৈধ এবং নিজেদেরকে হত্যা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।

আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, পরস্পরের মধ্যে অন্যায় পন্থায় একের সম্পদ অন্যের পক্ষে ভোগ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে আরও বুঝা যায় যে, নিজস্ব সম্পদও অন্যায় পথে ব্যয় করা কিংবা অপব্যয় করা নিষিদ্ধ।

আয়াতে উল্লেখিত ‘বাতিল’ শব্দটির তরজমা করা হয়েছে ‘অন্যায়ভাবে। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং অন্যান্য সাহাবীগণের মতে শরীআতের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ এবং নাজায়েয সবগুলো পস্থাকেই বাতিল বলা হয়। যেমন, চুরি, ডাকাতি, আত্মসাৎ, বিশ্বাসভঙ্গ, ঘুষ, সুদ, জুয়া প্রভৃতি সকল প্রকার অন্যায় পন্থাই এ শব্দের অন্তর্ভুক্ত। [বাহরে মুহীত]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিক্রির জন্য সন্তুষ্টি অপরিহার্য। [ইবন মাজাহঃ ২১৮৫। এ সন্তুষ্টি সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেচাকেনার ক্ষেত্রে আরও কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, যেমন, “বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ে সওদা করার স্থান ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত (সওদা বাতিল করার) সুযোগের অধিকারী থাকবে। তবে- পৃথক হওয়ার পরও এ সুযোগ তাদের জন্য থাকবে-যারা খেয়ার বা সুযোগের অধিকার দেয়ার শর্তে সওদা করবে।” [বুখারী: ২১০৭]

যেসব ক্ষেত্রে ব্যবসার নামে সুদ, জুয়া, ধোঁকা-প্রতারণা ইত্তাদির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হয়, সেসব পন্থায় সম্পদ অর্জন করা বৈধ পন্থার অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং হারাম ও বাতিল পন্থা। তেমনি যদি স্বাভাবিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও লেনদেনের মধ্যে উভয় পক্ষের আন্তরিক সন্তুষ্টি না থাকে, তবে সেরূপ ক্রয়-বিক্রয়ও বাতিল ও হারাম। কাতাদা বলেন, ব্যবসা আল্লাহর রিযক ও আল্লাহর হালালকৃত বিষয়, তবে শর্ত হচ্ছে, এটাকে সত্যবাদিতা ও সততার সাথে পরিচালনা করতে হবে। [তাবারী]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে বলে যে, আমি অন্য কোন ধর্মের উপর। তাহলে সে ঐ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বনী আদম যার মালিক নয় এমন মানত গ্রহণযোগ্য নয়। যে কেউ দুনিয়াতে নিজেকে কোন কিছু দিয়ে হত্যা করবে, এটা দিয়েই তাকে কেয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে। যে কোন মুমিনকে লা’নত করল সে যেন তাকে হত্যা করল। অনুরূপভাবে যে কেউ কোন মুমিনকে কুফরীর অপবাদ দিল, সেও যেন তাকে হত্যা করল। [বুখারীঃ ৬০৪৭, মুসলিমঃ ১৭৬]

অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কেউ পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে চিরস্থায়ীভাবে পাহাড় থেকে পড়ার অনুরূপ শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ পানে আত্মহত্যা করবে, সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের আগুনে বিষ পানের আযাব ভোগ করতে থাকবে। আর যে কেউ কোন ধারাল কিছু দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের আগুনে তা দ্বারা শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। [বুখারীঃ ৫৭৭৮, মুসলিমঃ ১৭৫]

৪:৩০ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ عُدۡوَانًا وَّ ظُلۡمًا فَسَوۡفَ نُصۡلِیۡهِ نَارًا ؕ وَ کَانَ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰهِ یَسِیۡرًا

আর যে কেউ সীমালংঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে, অবশ্যই আমরা তাকে আগুনে পোড়াবো; এসব আল্লাহর পক্ষে সহজ।

৪:৩১ اِنۡ تَجۡتَنِبُوۡا کَبَآئِرَ مَا تُنۡهَوۡنَ عَنۡهُ نُکَفِّرۡ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ نُدۡخِلۡکُمۡ مُّدۡخَلًا کَرِیۡمًا ﴿

তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা কবীরা গোনাহ তা থেকে বিরত থাকলে আমরা তোমাদের ছোট পাপগুলো ক্ষমা করব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ এমন প্রত্যেক গোনাহ যার পরিণতিতে কুরআন ও হাদীসে জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে অথবা আল্লাহর গযবের কথা এসেছে, অথবা লানতের কথা অথবা আযাবের কথা এসেছে, তাই কবীরা গোনাহ। কবীরা গোনাহর সংখ্যা অনেক। কেউ কেউ তা সাতশ’ পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন। [তাবারী, ইবন আবী হাতেম]

 

(২) উল্লেখিত আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হল যে, পাপ বা গোনাহ দুরকম। কিছু কবীরা অর্থাৎ কঠিন ও বড় রকমের পাপ, আর কিছু সগীরা অর্থাৎ হালকা ও ছোট পাপ।

এ কথাও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যদি কেউ সাহস করে কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তার সগীরা গোনাহগুলো নিজেই ক্ষমা করে দেবেন। যাবতীয় ফরয-ওয়াজিবগুলো সম্পাদন করাও কবীরা গোনাহ থেকে বাঁচার অন্তর্ভুক্ত। কারণ, ফরয-ওয়াজিবসমূহ ত্যাগ করাও কবীরা গোনাহ। বস্তুতঃ যে লোক ফরয-ওয়াজিবসমূহ পালনের ব্যাপারে যথাযথ অনুবর্তিতা অবলম্বন করে এবং যাবতীয় কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে, আল্লাহ স্বয়ং তার সগীরা গোনাহসমূহের কাফফারা করে দেবেন।

 

এখানে গোনাহের কাফফার হওয়ার অর্থ এই যে, কর্তার সৎকর্মসমূহকে সগীরা গোনাহের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেখিয়ে তার হিসাব সমান সমান করে দেয়া হবে। জাহান্নামের পরিবর্তে সে জান্নাত প্রাপ্ত হবে।

বিশুদ্ধ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, ‘কোন লোক যখন সালাত আদায়ের জন্য অযু করে, তখন প্রতিটি অঙ্গ ধৌত হওয়ার সাথে সাথে তার গোনাহর কাফফারা হয়ে যায়। মুখমণ্ডল ধুয়ে নিলে চোখ, কান ও নাক প্রভৃতি অঙ্গের পাপসমূহের কাফফারা হয়ে যায়। কুলি করার সঙ্গে সঙ্গে জিহবার পাপের কাফফারা হয়ে যায়; আর পা ধোয়ার সাথে সাথে ধুয়ে যায় পায়ের পাপসমূহ। তারপর যখন সে মসজিদের দিকে রওয়ানা হয়, তখন প্রতিটি পদক্ষেপে পাপের কাফফারা হতে থাকে [নাসায়ীঃ ১/১০৩, মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৩৪৯]

আলোচ্য আয়াতের দ্বারা এ কথাও বোঝা গেল যে, অযু, সালাত প্রভৃতি সৎকর্মের মাধ্যমে গোনাহর কাফফারা হওয়ার ব্যাপারে হাদীসে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তার অর্থ হল সগীরা গোনাহ্। কবীরা গোনাহ একমাত্র তাওবা ছাড়া মাফ হয় না। বস্তুতঃ সগীরা গোনাহ মাফের শর্ত হল, সাহস ও চেষ্টার মাধ্যমে কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা।

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কেউ আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকবে, তার জন্য রয়েছে জান্নাত। সাহাবীগণ কবীরা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, মুসলিম কোন আত্মাকে হত্যা করা এবং যুদ্ধের দিনে ময়দান থেকে পলায়ন করা। [মুসনাদে আহমাদ ৫/৪১৩]

৪:৩২ وَ لَا تَتَمَنَّوۡا مَا فَضَّلَ اللّٰهُ بِهٖ بَعۡضَکُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ ؕ لِلرِّجَالِ نَصِیۡبٌ مِّمَّا اکۡتَسَبُوۡا ؕ وَ لِلنِّسَآءِ نَصِیۡبٌ مِّمَّا اکۡتَسَبۡنَ ؕ وَ سۡئَلُوا اللّٰهَ مِنۡ فَضۡلِهٖ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمًا

আর যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারো উপর শ্ৰেষ্ঠত্ব দিয়েছেন তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। আর আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।

কুরআনের কোন কোন আয়াত এবং একাধিক হাদীসের বর্ণনায় সৎকর্মে প্রতিযোগিতা অর্থাৎ অন্যের চাইতে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় অগ্রণী হওয়ার নির্দেশ দেখতে পাওয়া যায়। অনুরূপ অন্যের মধ্যে যে গুণ-গরিমা রয়েছে, তা অর্জন করার জন্য সচেষ্ট হওয়ার প্রতিও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

এসব ক্ষেত্রে লক্ষণীয় এই যে, আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ঐ সমস্ত গুণ-বৈশিষ্টের ক্ষেত্রেই অন্যের সাথে প্রতিযেগিতামূলকভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন, যেগুলো মানুষের সাধ্যায়ত্ত, যেগুলো চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমে মানুষ অর্জন করতে পারে। যেমন, কারো গভীর জ্ঞান বা চারিত্রিক মহত্ত্ব দেখে তার কাছ থেকে তা অর্জন করার জন্য চেষ্টাসাধনা করা প্রশংসনীয় কাজ। তাই আয়াতের শেষাংশে সেরূপ চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ পুরুষরা যা কিছু সাধনার মাধ্যমে অর্জন করবে তারা তার অংশ পাবে এবং নারীরা যা কিছু অর্জন করবে তার অংশও তারা পাবে। এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং কর্মে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বৈশিষ্ট্য লাভ করার চেষ্টা ব্যর্থ হবে না। প্রত্যেকেই তার প্রচেষ্টার ফল অবশ্যই পাবে।

উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি অভিযোগের সুরে বলেছিলেনঃ পুরুষরা যুদ্ধ করে, আমরা মহিলারা যুদ্ধ করতে পারি না তদুপরি আমাদের জন্য মীরাসের অর্ধেক। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [মুসনাদে আহমাদঃ ৬/৩২২, তিরমিযীঃ ৩০২২]

অন্য এক বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ এক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললঃ হে আল্লাহ রাসূল, একজন পুরুষ দুই মহিলার সমান মীরাস পায়, একজন পুরুষের সাক্ষী দুইজন মহিলার সাক্ষীর সমান। আমরা যখন কোন নেক কাজ করব, তখনও কি অর্ধেক সওয়াব হবে? তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। যাতে বলা হয়েছে যে, এটা আমার ইনসাফ এবং এটা আমিই করেছি। [আল আহাদীসুল মুখতারাহঃ ১০/১১৬-১১৭, নং- ১১৫]

৪:৩৩ وَ لِکُلٍّ جَعَلۡنَا مَوَالِیَ مِمَّا تَرَکَ الۡوَالِدٰنِ وَ الۡاَقۡرَبُوۡنَ ؕ وَ الَّذِیۡنَ عَقَدَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ فَاٰتُوۡهُمۡ نَصِیۡبَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ شَهِیۡدًا

পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যাক্ত সম্পত্তির প্রত্যেকটির জন্য আমরা উত্তরাধিকারী করেছি এবং যাদের সাথে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ তাদেরকে তাদের অংশ দেবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বকিছুর সম্যক দ্রষ্টা।

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ মুহাজেররা যখন মদীনায় হিজরত করে আসত, তখন আনসারদের নিকটাত্মীয়দের বাদ দিয়ে যাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন মুহাজেররা তাদের ওয়ারিস হত। তারপর যখন আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়, তখন তা রহিত হয়ে যায়। [বুখারীঃ ২২৯২, ৪৫৮০, ৬৭৪৭]

(২) ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যখন ‘আর যাদের সাথে তোমরা অংগীকারাবদ্ধ তাদেরকে তাদের অংশ দেবে’ এ আয়াত নাযিল হয়, তখন কেউ কেউ অপর কারও সাথে বংশীয় কোন সম্পর্ক না থাকা সত্বেও চুক্তিবদ্ধ হতো, এর ফলে একে অপরের ওয়ারিশ হতো। তারপর যখন আল্লাহর বাণী ‘আর আত্মীয়রা আল্লাহর বিধানে একে অন্যের চেয়ে বেশী হকদার’ [সূরা আল-আনফাল: ৭৫; আল-আহযাব: ৬] এ আয়াত নাযিল হয়, তখন তাও রহিত হয়ে যায়। [মুস্তাদরাকে হাকিম ৪/৩৪৬; তাবারী]