সূরা আন নিসাঃ ৪র্থ রুকু(২৩-২৫)

 সূরা আন নিসাঃ ৪র্থ রুকু(২৩-২৫)

 

৪:২৩ حُرِّمَتۡ عَلَیۡکُمۡ اُمَّهٰتُکُمۡ وَ بَنٰتُکُمۡ وَ اَخَوٰتُکُمۡ وَ عَمّٰتُکُمۡ وَ خٰلٰتُکُمۡ وَ بَنٰتُ الۡاَخِ وَ بَنٰتُ الۡاُخۡتِ وَ اُمَّهٰتُکُمُ الّٰتِیۡۤ اَرۡضَعۡنَکُمۡ وَ اَخَوٰتُکُمۡ مِّنَ الرَّضَاعَۃِ وَ اُمَّهٰتُ نِسَآئِکُمۡ وَ رَبَآئِبُکُمُ الّٰتِیۡ فِیۡ حُجُوۡرِکُمۡ مِّنۡ نِّسَآئِکُمُ الّٰتِیۡ دَخَلۡتُمۡ بِهِنَّ ۫ فَاِنۡ لَّمۡ تَکُوۡنُوۡا دَخَلۡتُمۡ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡکُمۡ ۫ وَ حَلَآئِلُ اَبۡنَآئِکُمُ الَّذِیۡنَ مِنۡ اَصۡلَابِکُمۡ ۙ وَ اَنۡ تَجۡمَعُوۡا بَیۡنَ الۡاُخۡتَیۡنِ اِلَّا مَا قَدۡ سَلَفَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿ۙ۲۳﴾

২৩. তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে(১) তোমাদের মা(২), মেয়ে(৩), বোন(৪), ফুফু(৫) খালা(৬), ভাইয়ের মেয়ে(৭), বোনের মেয়ে(৮), দুধমা(৯), দুধবোন(১০), শাশুড়ী ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সংগত হয়েছ তার আগের স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত মেয়ে, যারা তোমাদের অভিভাবকত্ব আছে(১১), তবে যদি তাদের সাথে সঙ্গত না হয়ে থাক, তাতে তোমাদের কোন অপরাধ নেই। আর তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরসজাত ছেলের স্ত্রী(১২) ও দুই বোনকে একত্র করা, আগে যা হয়েছে, হয়েছে(১৩)। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

যাদের সাথে বিয়ে হারাম, এমন নারীদের বিবরণ দেয়া হয়েছে। তারা তিনভাগে বিভক্তঃ

এক. ঐ সমস্ত হারাম নারী কোন অবস্থাতেই হালাল হয় না, তাদেরকে ‘মুহাররামাতে আবাদীয়্যা’ বা ‘চিরতরে হারাম মহিলা’ বলা হয়। এ জাতীয় মহিলা তিন শ্রেণীরঃ

(১) বংশগত হারাম নারী, (২) দুধের কারণে হারাম নারী এবং (৩) শ্বশুর সম্পর্কের কারণে হারাম নারী চিরতরে হারাম।

দুই. কোন কোন নারী চিরতরে হারাম নয়, কোন কোন অবস্থায় তারা হালালও হয়ে যায়। তাদেরকে ‘মুহাররামাতে মুআক্কাতাহ’ বা সাময়িক কারণে হারাম বলা হয়। এরা আবার দু’ শ্রেণীতে বিভক্তঃ

(১) পরস্ত্রী সে যতক্ষণ পর্যন্ত পরের স্ত্রী থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত হারাম। কিন্তু যখনই অপরের স্ত্রী হওয়া থেকে মুক্ত হবে তখনই সে হালাল হয়ে যাবে। (২) কোন কোন মহিলা শুধুমাত্র অন্যের সাথে একসাথে বিবাহ করা হারাম। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিবাহ করা হারাম নয়। যেমন, দুই বোনকে একসাথে স্ত্রী হিসেবে রাখা। খালা ও বোনঝিকে একসাথে স্ত্রী হিসেবে রাখা।

* অর্থাৎ আপন জননীদেরকে বিয়ে করা তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে। অর্থের ব্যাপকতায় দাদী, নানী সবই এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

* স্বীয় ঔরসজাত কন্যাকে বিয়ে করা হারাম। কন্যার কন্যাকে এবং পুত্রের কন্যাকেও বিয়ে করা হারাম। মোটকথা, কন্যা, পৌত্রী, প্রপৌত্রী, দৌহিত্রী, প্রদৌহিত্রী এদের সবাইকে বিয়ে করা হারাম।

* সহদোরা বোনকে বিয়ে করা হারাম। এমনিভাবে বৈমাত্রেয়া ও বৈপিত্রেয়া বোনকেও বিয়ে করা হারাম

* পিতার সহোদরা, বৈমাত্রেয়া ও বৈপিত্রেয়া বোনকে বিয়ে করা হারাম। তিন প্রকার ফুফুকেই বিয়ে করা যায় না।

* আপন জননীর তিন প্রকার বোন, প্রত্যেকের সাথেই বিয়ে করা হারাম।

* ভ্রাতুষ্পপুত্রীর সাথেও বিয়ে হারাম; আপন হোক বৈমাত্রেয় হোক – বিয়ে হালাল নয়।

* বোনের কন্যা অর্থাৎ ভাগ্নেয়ীর সাথেও বিয়ে হারাম। এখানেও বোনকে ব্যাপক অর্থে বুঝতে হবে।

* যেসব নারীর স্তন্য পান করা হয়, তারা জননী না হলেও বিবাহ হারাম হওয়ার ব্যাপারে জননীর পর্যায়ভুক্ত এবং তাদের সাথে বিবাহ হারাম। ফেকাহবিদগণের পরিভাষায় একে ‘হুরমাতে রেযাআত বলা হয়। তবে কেবলমাত্র শিশু অবস্থায় দুধ পান করলেই এই হুরমাত কার্যকরী হয়।

 এ দুধপান দু বছরের মধ্যে হয়েছে কি না সে ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন জরুরী; কারণ, হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুধ পানের সময়টুকু যেন ঐ সময়েই সংঘটিত হয় যখন সন্তানের দুধ ছাড়া আর কোন খাবার দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ হতো না। [বুখারী ৫১০২; মুসলিম: ১৪৫৫]

 কি পরিমাণ দুধ পানে দুধ সম্পর্কের দিক দিয়ে বিয়ে করা হারাম হয় যায় সে ব্যাপারে মতবিরোধ আছে৷ ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালেকের মতে যে পরিমাণ দুধ পান করলে একজন রোযাদারের রোযা ভেঙে যেতে পারে কোন স্ত্রীলোকের সেই পরিমাণ দুধ যদি শিশু পান করে,তাহলে হারামের বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে৷ কিন্তু ইমাম আহমাদের মতে তিনবার পান করলে এবং ইমাম শাফেঈর মতে পাঁচ বার পান করলে এ হারামের বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়৷

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘরে ছিলেন। এমতাবস্থায় আয়েশা শুনতে পেলেন যে, হাফসার ঘরে যাওয়ার জন্য একজন পুরুষ লোক অনুমতি চাচ্ছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! একলোক আপনার পরিবারভুক্ত ঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার তো মনে হয় এটা অমুক ব্যক্তি। হাফসার কোন এক দুধ চাচা। তখন আয়েশা বললেন, অমুক যদি জীবিত থাকত- আয়েশার কোন এক দুধ চাচা, তাহলে কি সে আমার কাছে প্রবেশ করতে পারত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, জন্মগত কারণে যা হারাম হয়, দুধগত কারণেও তা হারাম হয়। [বুখারী ৫০৯৯; মুসলিম: ১৪৪৪]

  • এখানে অভিভাবকত্ব থাকার কথাটা শর্ত হিসাবে নয়; বরং সাধারণতঃ এ ধরনের মেয়েরা মায়ের সাথেই থাকে আর মা দ্বিতীয় বিবাহের কারণে তার স্বামীর কাছেই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এ ধরনের মেয়েদের অভিভাবকত্ব থাকা না থাকা উভয় অবস্থাতেই তাদের বিয়ে করা হারাম।

সৎ-বাপের ঘরে লালিত হওয়াই এই ধরনের মেয়ের হারাম হওয়ার জন্য শর্ত নয়৷ মহান আল্লাহ নিছক এই সম্পর্কটির নাজুকতা বর্ণনা করার জন্য এ শব্দাবলী ব্যবহার করেছেন৷ এ ব্যাপারে মুসলিম ফকীহগণের প্রায় ‘ইজমা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে যে, সৎ-মেয়ে সৎ-বাপের ঘরের লালিত হোক বা না হোক সর্বাবস্থায়ই সে সৎ-বাপের জন্য হারাম ৷

উম্মে হাবীব রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আবু সুফিয়ানের মেয়েকে বিয়ে করবেন? রাসূল বললেন যে, তাকে বিয়ে করা আমার জন্য জায়েয হবে না। আমি বললাম, আমি শুনেছি আপনি নাকি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন। রাসূল বললেন, তুমি কি উম্মে সালামার মেয়ের কথা বলছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, যদি সে আমার রাবীবা নাও হত তারপরও আমার জন্য জায়েয হত না। কেননা, আমাকে এবং তার পিতাকে সুআইবাহ দুধ পান করিয়েছেন। তোমরা তোমাদের কন্যাদের এবং তোমাদের বোনদের আমার কাছে বিয়ের জন্য পেশ করো না। [বুখারীঃ ৫১০৬

 অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন, জন্মের কারণে যাদেরকে হারাম গণ্য করো দুধ পানের কারণেও তাদেরকে হারাম গণ্য করবে। [মুসলিম: ১৪৪৫]

  • অর্থাৎ আপন পুত্রের বিবাহিতা স্ত্রীকে বিবাহ করা হারাম। যদিও পুত্র শুধু বিবাহই করে-সহবাস না করে।
  • এখানে বুঝানো হয়েছে যে, পূর্বে এ ধরনের যা কিছু ঘটেছে তা আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু যদি কেউ এরূপ অবস্থায় ইসলামে প্রবেশ করে তবে তাদের মধ্য থেকে দুজনের একজনকে তালাক দিতে হবে। হাদীসে এসেছে, ফাইরোয আদ-দাইলামী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললামঃ আমি ঈমান এনেছি অথচ দুই বোন আমার স্ত্রী হিসেবে আছে। রাসূল বললেনঃ তুমি তাদের যে কোন একজনকে তালাক দিয়ে দাও। [ইবন মাজাহঃ ১৯৫১, তিরমিযীঃ ১১২৯] অনুরূপভাবে এ একত্রিতকরণের মাসআলার মধ্যে এমন দুজনকেও একত্রে বিয়ে করা জায়েয নাই, যাদের একজন পুরুষ সাব্যস্ত হলে অন্যজনের জন্য তাকে বিয়ে করা জায়েয হত না। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন মহিলা এবং তার ফুফু। অনুরূপভাবে কোন মহিলা ও তার খালাকে একত্রে বিয়ে করা যাবে না। [বুখারীঃ ৫১০৯]

 

৪:২৪ وَّ الۡمُحۡصَنٰتُ مِنَ النِّسَآءِ اِلَّا مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ ۚ کِتٰبَ اللّٰهِ عَلَیۡکُمۡ ۚ وَ اُحِلَّ لَکُمۡ مَّا وَرَآءَ ذٰلِکُمۡ اَنۡ تَبۡتَغُوۡا بِاَمۡوَالِکُمۡ مُّحۡصِنِیۡنَ غَیۡرَ مُسٰفِحِیۡنَ ؕ فَمَا اسۡتَمۡتَعۡتُمۡ بِهٖ مِنۡهُنَّ فَاٰتُوۡهُنَّ اُجُوۡرَهُنَّ فَرِیۡضَۃً ؕ وَ لَا جُنَاحَ عَلَیۡکُمۡ فِیۡمَا تَرٰضَیۡتُمۡ بِهٖ مِنۡۢ بَعۡدِ الۡفَرِیۡضَۃِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا

২৪. আর নারীদের মধ্যে তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী ছাড়া সব সধবা তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ, তোমাদের জন্য এগুলো আল্লাহর বিধান। উল্লেখিত নারীগণ ছাড়া অন্য নারীকে অর্থব্যয়ে বিয়ে করতে চাওয়া তোমাদের জন্য বৈধ করা হল, অবৈধ যৌন সম্পর্কের জন্য নয়। তাদের মধ্যে যাদেরকে তোমর সম্ভোগ করেছ তাদের নির্ধারিত মাহর অর্পণ করবে। মাহর নির্ধারণের পর কোন বিষয়ে পস্পর রাযী হলে তাতে তোমাদের কোন দোষ নেই।নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

 

কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় দাস-দাসীর রাখার প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। কুরআন এ প্রথাকে উচ্ছেদ তো করেনি, তবে তাদের ব্যাপারে এমন কৌশল ও যুক্তিময় পথ অবলম্বন করা হয়, যাতে তারা খুব বেশী বেশী সুযোগ-সুবিধা অর্জন করতে পারে এবং দাস-প্রথার প্রবণতা হ্রাস পায়।

 দুটি মাধ্যমে এই প্রথা প্রচলিত ছিল।

প্রথমটি হল, কোন কোন গোত্র এমন ছিল যাদের পুরুষ ও নারীকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ক্রয়-বিক্রয় করা হত। এই ক্রীত নর-নারীকেই ক্রীতদাস ও দাসী বলা হয়। মনিবের অধিকার হত তাদের দ্বারা সর্ব প্রকার ফয়দা ও উপকার অর্জন করা।

 আর দ্বিতীয়টি হল, যুদ্ধে বন্দী হওয়ার মাধ্যমে। কাফেরদের বন্দী মহিলাদেরকে মুসলিম যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হত এবং তারা দাসী হয়ে তাঁদের সাথে জীবন-যাপন করত। বন্দিনীদের জন্য এটাই ছিল উত্তম ব্যবস্থা। কারণ, তাদেরকে যদি সমাজে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া হত, তাহলে তাদের মাধ্যমে ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি হত।

(বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্যঃ মৌলানা সাঈদ আহমদ আকবার আবাদী রচিত বই আররিক্কু ফীল ইসলাম (ইসলামে দাসত্বের তাৎপর্য)

মোট কথা হল, (স্বামীর বিবাহ বন্ধনে থাকা অবস্থায়) সধবা মুসলিম মহিলাদেরকে বিবাহ করা যেমন হারাম, তেমনি সধবা কাফের মহিলারাদেরকেও বিবাহ করা হারাম, তবে যদি তারা মুসলিমদের অধিকারে এসে যায়, তাহলে তারা গর্ভমুক্ত কি না এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁদের জন্য (যৌন-সংসর্গ) হালাল হবে।

অধিকারভুক্ত দাসী বলতে ঐ সমস্ত নারীদেরকে বুঝায়, যারা কাফের ছিল। মুসলিমগণ যুদ্ধে তাদের পুরুষদের পরাজিত করে তাদেরকে নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসে, তখন তাদেরকে মুসলিমদের জন্য বিয়ে ছাড়াই হালাল করা হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ হুনাইনের যুদ্ধের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল যোদ্ধাকে আওতাস-এর দিকে পাঠান। তারা কাফেরদের উপর জয়ী হয়ে তাদের নারীদেরকে নিয়ে আসে। কিন্তু এরা কাফের নারী হওয়ার কারণে মুসলিমগণ তাদেরকে হালাল মনে করছিল না। তখন এই আয়াত নাযিল হয়ে জানিয়ে দেয়া হয় যে, এরা তাদের জন্য হালাল, তবে শর্ত হলো এদের ইদ্দত শেষ হতে হবে। [মুসলিমঃ ১৪৫৬]

যুদ্ধ-বন্দিনী দাসীদের সাথে সংগম করার ব্যাপারে কিছু নিয়মনীতি রয়েছে-

 

(এক) অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, এটা শুধুমাত্র মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে যুদ্ধ হলেই হতে পারে। কোন কারণে যদি মুসলিমদের মধ্যে পরস্পর যুদ্ধ হয়, কিংবা মুসলিম দুটি রাষ্ট্রে যুদ্ধের সূচনা হয়, অথবা মুসলিমদের কোন জাতিগত বা ভাষাগত বা রাজনৈতিক দাঙ্গা হয় সেখানে যে যুদ্ধ হবে সে যুদ্ধের কারণে কাউকে অধিকারভুক্ত দাস-দাসী বানানোর অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। যদি কেউ এটা করতে চায় তবে সেটা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ ও ব্যভিচার। এ ধরনের লোকদেরকে ব্যভিচারের শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

 

(দুই) যে সমস্ত মেয়ে বন্দী হয় তাদেরকে ইসলামী আইন অনুযায়ী সরকারের হাতে সোপর্দ করে দিতে হবে। সরকার চাইলে তাদেরকে বিনা শর্তে মুক্ত করে দিতে পারে, মুক্তিপণ গ্রহণ করতে পারে, শক্রর হাতে যে সমস্ত মুসলিম বন্দী রয়েছে তাদের সাথে এদের বিনিময়ও করতে পারে এবং চাইলে তাদেরকে সৈন্যদের মাঝে বন্টনও করে দিতে পারে। তাই বন্দী করার সাথে সাথেই কোন সৈনিক তাদের সাথে সংগম করার অধিকার লাভ করে না। তাছাড়া কোন ক্রমেই যুদ্ধাবস্থায় এ অধিকার কারও থাকবে না। যদি কেউ যুদ্ধাবস্থায় এ কাজ করে তবে তাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

 

(তিন) মেয়েটি গর্ভবতী নয় এতটুকু নিশ্চিত হওয়ার জন্য কমপক্ষে এক মাসিক ঋতুশ্রাব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বে সংগম করা যাবে না।

 

(চার) যে মেয়েকে যার ভাগে দেয়া হবে সে-ই শুধু তাকে ভোগ করতে পারবে: অন্য কেউ নয়।

 

(পাঁচ) সন্তানের জননী হওয়ার পর এ মেয়েকে আর বিক্রয় করা যাবে না। মালিকের মৃত্যুর পরপরই সে স্বাধীন হয়ে যাবে।

 

(ছয়) মালিক ইচ্ছে করলে তাকে অন্য কারো কাছে বিয়ে দিতে পারবে। তখন তার খেদমত মালিকের হবে কিন্তু মালিক তার সাথে যৌন সম্পর্ক রাখতে পারবে না।

 

(সাত) কোন সেনাপতি যদি নিছক সাময়িকভাবে তার সৈন্যদেরকে বন্দিনী মেয়েদের মাধ্যমে নিজেদের যৌন তৃষ্ণা মেটানোর অনুমতি দেয়, তবে তা হবে সম্পূর্ণ অবৈধ। কেননা, এ কাজ ও ব্যভিচারের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

কুরআন ও হাদীসে যে মহিলাদের সাথে বিবাহ করা হারাম বলে ঘোষিত হয়েছে, তাদেরকে ছাড়া অন্য মহিলাদেরকে বিবাহ করা জায়েয চারটি শর্তের ভিত্তিতে।

(ক) তলব করতে হবে। অর্থাৎ, উভয় পক্ষের মধ্যে ইজাব ও কবুল (প্রস্তাব ও গ্রহণ) হতে হবে (এক পক্ষ প্রস্তাব দিবে এবং অপর পক্ষ কবুল করবে)।

(খ) দেনমোহর আদায় করতে হবে।

(গ) তাকে সব সময়ের জন্য বিবাহ বন্ধনে রাখা উদ্দেশ্য হবে, কেবল কাম-প্রবৃত্তি চরিতার্থ করাই লক্ষ্য হবে না। (যেমন, ব্যভিচারে অথবা শীয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত মুতআ তথা কেবল যৌনক্ষুধা নিবারণের লক্ষ্যে কয়েক দিন বা কয়েক ঘণ্টার জন্য সাময়িকভাবে চুক্তিবিবাহ হয়ে থাকে)।

(ঘ) গোপন প্রেমের মাধ্যমে যেন না হয়, বরং সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিবাহ হবে। এই চারটি শর্ত আলোচ্য আয়াত থেকেই সংগৃহীত।

 

হাদীসে এসেছে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বার যুদ্ধের কালে মুত’আ বিয়ে ও গৃহপালিত গাধার গোস্ত হারাম করেছেন। [বুখারী ৫১১৫, ৫৫২৩; আরও দেখুন বুখারীঃ ৪২১৬, মুসলিমঃ ১৪০৬, ১৪০৭]

সহীহ হাদীসে এসেছে যে, মক্কা থেকে বের হওয়ার আগেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এ জাতীয় বিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত হারাম করে দেয়া হয়েছে। [মুসলিম: ১৪০৬]

এ ব্যাপারে তাকীদ করা হচ্ছে যে, যে মহিলাদের সাথে তোমরা বৈধ বিবাহের মাধ্যমে যৌনসুখ ও স্বাদ গ্রহণ কর, তাদেরকে তাদের নির্দিষ্ট মোহর অবশ্যই আদায় করে দাও।ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, মাহর নির্ধারণের পর কোন বিষয়ে পরস্পর রাযী হওয়ার অর্থ হচ্ছে, ধার্যকৃত পূর্ণ মাহর প্রদান করে স্ত্রীকে তার মাহরের ব্যাপারে পূর্ণ অধিকার প্রদান করা। [তাবারী; আত-তাফসীরুস সহীহ]

 

৪:২৫ وَ مَنۡ لَّمۡ یَسۡتَطِعۡ مِنۡکُمۡ طَوۡلًا اَنۡ یَّنۡکِحَ الۡمُحۡصَنٰتِ الۡمُؤۡمِنٰتِ فَمِنۡ مَّا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ مِّنۡ فَتَیٰتِکُمُ الۡمُؤۡمِنٰتِ ؕ وَ اللّٰهُ اَعۡلَمُ بِاِیۡمَانِکُمۡ ؕ بَعۡضُکُمۡ مِّنۡۢ بَعۡضٍ ۚ فَانۡکِحُوۡهُنَّ بِاِذۡنِ اَهۡلِهِنَّ وَ اٰتُوۡهُنَّ اُجُوۡرَهُنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ مُحۡصَنٰتٍ غَیۡرَ مُسٰفِحٰتٍ وَّ لَا مُتَّخِذٰتِ اَخۡدَانٍ ۚ فَاِذَاۤ اُحۡصِنَّ فَاِنۡ اَتَیۡنَ بِفَاحِشَۃٍ فَعَلَیۡهِنَّ نِصۡفُ مَا عَلَی الۡمُحۡصَنٰتِ مِنَ الۡعَذَابِ ؕ ذٰلِکَ لِمَنۡ خَشِیَ الۡعَنَتَ مِنۡکُمۡ ؕ وَ اَنۡ تَصۡبِرُوۡا خَیۡرٌ لَّکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۲۵

২৫. আর তোমাদের মধ্যে কারো মুক্ত ঈমানদার নারী বিয়ের সামর্থ্য না থাকলে তোমরা তোমাদের অধিকারভুক্ত ঈমানদার দাসী বিয়ে করবে; আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। তোমরা একে অপরের সমান; কাজেই তোমরা তাদেরকে বিয়ে করবে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে এবং তাদেরকে তাদের মাহর ন্যায়সংগতভাবে দেবে। তারা হবে সচ্চরিত্রা, ব্যভিচারিণী নয় ও উপপতি গ্রহণকারিণীও নয়। অতঃপর বিবাহিতা হওয়ার পর তাদের শাস্তি মুক্ত নারীর অর্ধেক; তোমাদের মধ্যে যারা ব্যভিচারকে ভয় করে এগুলো তাদের জন্য; আর ধৈর্য ধারণ করা তোমাদের জন্য মঙ্গল। আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু।

যার স্বাধীন নারীদেরকে বিয়ে করার শক্তি-সামর্থ্য নেই কিংবা প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নেই, সে ঈমানদার দাসীদেরকে বিয়ে করতে পারে। এতে বোঝা গেল যে, যতটা সম্ভব স্বাধীন নারীকেই বিয়ে করা উচিত, দাসীকে বিয়ে না করাই বাঞ্ছনীয়। অগত্যা যদি দাসীকে বিয়ে করতেই হয়, তবে ঈমানদার দাসী খোঁজ করতে হবে। স্বাধীন ইয়াহুদী-নাসারা নারীদেরকে বিয়ে করা যদিও বৈধ, কিন্তু তা থেকে বেঁচে থাকা উত্তম। বর্তমান যুগে এর গুরুত্ব অত্যাধিক। কেননা, ইয়াহুদী ও নাসারা নারীরা আজকাল সাধারণতঃ স্বয়ং স্বামীকে ও স্বামীর সন্তানদেরকে স্বধর্মে আনার উদ্দেশ্যেই মুসলিমদেরকে বিয়ে করে।

ঈমানদার নয় এমন দাসী বিয়ে করা জায়েয নেই। অন্য আয়াতেও বলা হয়েছে, আর কিতাবী মহিলাদের মধ্যে যারা মুহসিনা [সূরা আল-মায়িদাহ: ৫] অর্থাৎ তাদেরকে বিয়ে করা হালাল করা হয়েছে। এখানে মুহসিনা বলে কোন কোন মুফাসসিরের মতে স্বাধীন বোঝানো হয়েছে। সুতরাং কোন অবস্থাতেই কাফের দাসীদেরকে বিয়ে করা জায়েয নেই। যদিও তারা কিতাবী হয়। [তাবারী; আদওয়াউল বায়ান]

 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন মহিলা অপর মহিলাকে বিয়ে দেবে না। অনুরূপভাবে কোন মহিলা নিজেকেও বিয়ে দেবে না। যে মহিলা নিজেকে নিজে বিয়ে দেয়, সে ব্যভিচারে লিপ্ত। [ইবন মাজাহঃ ১৮৮২] অর্থাৎ বিয়ের ব্যাপারে অবশ্যই অভিভাবকদের অনুমতি নিতে হবে।

ক্রীতদাসীদের মালিক বা মনিবই তাদের ওলী ও অভিভাবক। কাজেই মনিবের অনুমতি ব্যতীত তার বিবাহ হতে পারে না। অনুরূপ ক্রীতদাসও তার মালিকের অনুমতি ছাড়া কোথাও বিয়ে করতে পারে না।

 

মুক্ত নারীর শাস্তির কথা এখানে বলা হয় নি। অন্যত্র বলে দেয়া হয়েছে যে, ব্যভিচারিনী মহিলা ও ব্যভিচার পুরুষের প্রত্যেককে একশত বেত্ৰাঘাত করা [সূরা আন-নূর: ২] সে হিসেবে এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, ব্যভিচারিনী দাসীর শাস্তি হবে পঞ্চাশ বেত্ৰাঘাত। কিন্তু ব্যভিচারী দাসের ব্যাপারটি ভিন্ন কোন আয়াতে আসে নি। তাই ব্যাভিচারিনী দাসীর শাস্তি যেভাবে অর্ধেক হয়েছে সেভাবে ব্যভিচারী দাসের ক্ষেত্রেও তেমনি অর্ধেক শাস্তি হবে; কারণ দাসত্বের দিক থেকে উভয়েই সমান। এটাও এক প্রকার কিয়াস। [আদওয়াউল বায়ান] তবে এটা জানা আবশ্যক যে, দাস-দাসীরা বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত হোক তাদের কোন রজম তথা প্রস্তারাঘাতে মৃত্যুদণ্ড বা দেশান্তর নেই। [তাবারী]

এই রুকূ’তে ‘মুহসানাত’ (সংরক্ষিত মহিলা) শব্দটি দু’টি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ একটি হচ্ছে, “বিবাহিতা মহিলা”, যারা স্বামীর সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করে এবং অন্যটি “সম্ভ্রান্ত মহিলা”, যারা বিবাহিতা না হলেও পরিবারের সংরক্ষণ লাভ করে৷ আলোচ্য আয়াতে ‘মুহসানাত’ শব্দটি ক্রীতদাসীর মোকাবিলায় সম্ভ্রান্ত মহিলাদের জন্য দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, প্রথম অর্থে নয়৷

আয়াতে উল্লেখিত বিষয়বস্তু থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে,বিপরীতপক্ষে ক্রীতদাসীদের জন্য ‘মুহসানাত’ শব্দটি প্রথম অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷

এখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,যখন তারা বিয়ের সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করবে৷ কেবলমাত্র তখনই তাদের জন্য যিনা করলে উল্লেখিত শাস্তির ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে৷ এখন গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে একথা একেবারেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে,

সম্ভ্রান্ত মহিলারা দু’টি সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করে৷ একটি হচ্ছে, পরিবারের সংরক্ষণ ব্যবস্থা৷ এর কারণে তারা বিবাহিতা না হয়েও ‘মুহসিনা’ অর্থাৎ সংরক্ষিত হয়ে যায়৷ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, স্বামীর সংরক্ষণ ব্যবস্থা৷

এর ফলে তারা পরিবারের সংরক্ষণের ওপর আর একটা বাড়তি সরংক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করে৷ বিপরীত পক্ষে ক্রীতদাসী যতদিন ক্রীতদাসী অবস্থায় থাকে ততদিন সে ‘মুহসিনা’ নয়৷ কারণ সে কোন পরিবারের সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করেনি৷ তবে হ্যাঁ, বিয়ে হবার পর সে কেবল স্বামীর সংরক্ষণ ব্যবস্থা লাভ করে এবং তাও অসম্পূর্ণ৷ কারণ স্বামীর সংরক্ষণ ব্যবস্থার আওতায় আসার পরও তারা মালিকের সেবা ও চাকরী থেকে মুক্তি লাভ করেনা৷ কাজেই তাদেরকে যে শাস্তি দেয়া হবে তা হবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের অবিবাহিতা মেয়েদের শাস্তির অর্ধাংশ, সম্ভান্ত পরিবারের বিবাহিতা মেয়েদের শাস্তির অর্ধাংশ নয়৷

এ ছাড়াও এখান থেকে একথাও জানা গেছে যে, সূরা নূর-এর আয়াতে কেবলমাত্র অবিবাহিতা সম্ভ্রান্ত মহিলাদের যিনার শাস্তির কথা উল্লেখিত হয়েছে এবং এর মোকাবিলায় এখানে বিবাহিতা ক্রীতদাসীদের শাস্তি অর্ধেক বলা হয়েছে৷ আর বিবাহিতা সম্ভ্রান্ত মহিলারা তো অবিবাহিতা সম্ভ্রান্ত মহিলাদের তুলনায় কঠিন শাস্তি লাভের যোগ্য৷ কারণ তারা দু’টি সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলে৷ যদিও কুরআন তাদের ব্যাপারে রজমের শাস্তির বিধান সুস্পষ্ট করেনি তবুও অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সেদিকে ইংগিত করেছে৷ এ বিষয়টি স্থুল বুদ্ধির লোকদের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতে পারে কিন্তু নবীর সূক্ষ্ম ও সুতীক্ষ্ম অন্তরালে থাকা তার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না

অর্থাৎ দাসী বিয়ে করার চেয়ে ধৈর্যধারণ করা উত্তম। যাতে করে আল্লাহ্ তাআলা যখন তাকে সামর্থ দিবে, তখন যেন স্বাধীনা নারী বিয়ে করতে পারে। [তাবারী; আত-তাফসীরুস সহীহ]

প্রশ্ন

প্রশ্ন: আমি বিশ বছর বয়সী মুসলিম মেয়ে। আমি একজন বিদেশী খ্রিস্টান ছেলেকে ভালবাসি, সে আরবী বলতে পারে না। আমার জন্যে খ্রিস্টান ছেলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া কি জায়েয; যদি আমার ধর্ম নিরাপদে থাকে। আমি পরিপূর্ণ নিশ্চিত যে, আমার ইসলামের উপর তা কোন প্রভাব ফেলবে না। এ প্রশ্নের উত্তর যদি ‘না-বোধক’ হয়; তাহলে আমি কিভাবে তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করতে পারি? আপনাদের নিকট কি ইসলামের দিকে আহ্বান করার সংস্থা আছে; যাতে আমি তাকে সেসব সংস্থাতে যোগ দিতে বলতে পারি।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আলহামদুলিল্লাহ।

মুসলমানদের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে- কোন মুসলিম নারীর জন্য কাফেরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয নেই। সে কাফের ইহুদী হোক, খ্রিস্টান হোক, কিংবা অন্য কিছু হোক। আল্লাহ তাআলা বলেন: “ঈমান না আনা পর্যন্ত মুশরিক পুরুষদের সাথে বিয়ে দিও না। মুশরিক পুরুষ তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও অবশ্যই মুমিন ক্রীতদাস তার চেয়ে উত্তম। ওরা জাহান্নামের দিকে ডাকে; আর আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ ইচ্ছায় জান্নাত ও ক্ষমার দিকে ডাকেন এবং তিনি মানুষের জন্য তাঁর আয়াতমালা (নিদর্শনাবলি) সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তারা শিক্ষা নিতে পারে।” [সূরা বাকারা, আয়াত: ২২১] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: “অতঃপর যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা মুমিন নারী, তবে তাদেরকে কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিও না। মুমিন নারীগণ কাফিরদের জন্য বৈধ নয় এবং কাফিরগণ মুমিন নারীদের জন্য বৈধ নয়।”[সূরা মুমতাহিনা, আয়াত: ১০]

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন: “মুসলমানগণ একমত যে, কোন কাফের মুসলমান থেকে মিরাছ (পরিত্যক্ত সম্পত্তি) পাবে না। কোন কাফের মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না।”[আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা (৩/১৩০) থেকে সমাপ্ত]

এছাড়াও এটি নাজায়েয হওয়ার কারণ হচ্ছে- “ইসলাম মাথা উঁচু করতে এসেছে; মাথা নত করতে নয়” যেমনটি বলেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।[হাদিসটি দারাকুতনী বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহিহ জামে গ্রন্থে (নং ২৭৭৮) হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন]

স্ত্রীর উপর স্বামীর কর্তৃত্ব রয়েছে। তাই কোন মুসলিম নারীর উপর কাফেরকে কর্তৃত্ব দেয়া নাজায়েয। কারণ ইসলাম সত্য ধর্ম; ইসলাম ছাড়া অন্য সকল ধর্ম বাতিল। যদি এ বিধান জেনেশুনে কোন মুসলিম মেয়ে কাফেরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাহলে সে মেয়ে ব্যভিচারী গণ্য হবে। তার শাস্তি হচ্ছে- ব্যভিচারিনীর শাস্তি। আর যদি না জেনে বিয়েতে জড়িয়ে যায় তাহলে সে নারীর অপারগতা গ্রহণযোগ্য; তবে তালাক ছাড়াই তাদের দুজনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা ফরজ। কারণ এ বিয়ে বাতিল।

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে বলতে চাই, যে মুসলিম নারীকে আল্লাহ তাআলা ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন তার উপর ফরজ ও তার অভিভাবকের উপর ফরজ এ ধরণের সম্পর্ক করা থেকে সাবধান হওয়া, আল্লাহ তাআলার দেয়া সীমারেখা লঙ্ঘন না করা, ইসলামকে নিয়ে গৌরববোধ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর যে কেউ সম্মান-প্রতিপত্তি চায়, তবে সকল সম্মান-প্রতিপত্তির মালিক তো আল্লাহ্‌ই।”[সূরা ফাতির, আয়াত: ১০]

আমরা এই নারীকে উপদেশ দিচ্ছি তিনি যেন এ খ্রিস্টান ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কারণ কোন নারীর জন্য বেগানা কোন পুরুষের সাথে সম্পর্ক করা নাজায়েয। ইতিপূর্বে নং 23349 প্রশ্নোত্তরে সে বিধান উল্লেখ করা হয়েছে।

আর যদি সে খ্রিস্টান ছেলে নিজের মন থেকে আগ্রহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে তখন সে ছেলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে কোন আপত্তি নেই; যদি তার অভিভাবক এতে রাজী হন।

আমরা এ নারীকে সে উপদেশ দিচ্ছি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নির্দেশ দিয়েছেন, সে যেন দ্বীনদার ও চরিত্রবান ছেলে নির্বাচন করে

আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন, তার দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধন করে দেন, তাকে প্রজ্ঞা দান করেন।

গুরুত্বপূর্ণ বিধায় 83736 নং প্রশ্নোত্তরটিও দেখা যেতে পারে।

আল্লাহই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

ইসলাম খ্রিস্টান ও ইহুদী নারীকে বিয়ে করা জায়েয করেছে। এর মানে— সে নারী বিয়ের পর তার ধর্মের উপর অটুট থাকতে পারবে। সুতরাং স্বামীর এ অধিকার নেই যে, স্বামী তাকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করবে কিংবা তার নিজস্ব উপাসনা পালনে বাধা দিবে। তবে স্বামী নিজ স্ত্রীকে ঘর থেকে বের হতে না দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করবে। এমনকি সেটা যদি গির্জাতে যাওয়ার জন্যে হয় সে ক্ষেত্রেও। কারণ স্ত্রী স্বামীর আনুগত্য করার জন্য আদিষ্ট। ঘরের মধ্যে গর্হিত কিছু করা থেকে স্ত্রীকে নিবৃত রাখার অধিকার স্বামীর থাকবে; যেমন- মূর্তি টানাতে বাধা দেয়া, ঘণ্টা বাজাতে বাধা দেয়া। এর মধ্যে রয়েছে- বিদআতি উৎসবগুলো উদযাপন; যেমন- ইস্টার পালনে বাধা দেয়া। কারণ ইস্টার পালন ইসলামে দুইটি কারণে গর্হিত: এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি উপাসনা- যেমন ঈদে মিলাদুন্নবী বা মা দিবস ভিত্তিহীন। অন্যদিকে এর ভিত্তি হচ্ছে- কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস; যেমন- ঈসা (আঃ) কে হত্যা করা হয়েছে, শূলে চড়ানো হয়েছে, কবরে প্রবেশ করানো হয়েছে; এরপর তিনি কবর থেকে উঠেছেন। বাস্তব সত্য হচ্ছে- ঈসা (আঃ) নিহত হননি, তাঁকে শূলে চড়ানো হননি। বরঞ্চ তাঁকে জীবিত অবস্থায় আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আরও জানতে 10277 ও 43148 নং প্রশ্নোত্তর দেখুন। স্বামীর এই অধিকার নেই যে, খ্রিস্টান স্ত্রীকে তার এই বিশ্বাস পরিহারে বাধ্য করবে। কিন্তু স্বামী গর্হিত কিছুর প্রচার করা ও জাহির করার বিরোধিতা করতে পারে। তাই খ্রিস্টান স্ত্রীর তার ধর্মের উপর টিকে থাকা ও স্বামীর গৃহে গর্হিত বিষয়াদি জাহির করা— এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। এর উদাহরণ হচ্ছে— স্ত্রী যদি মুসলিম হয় এবং সে কোন একটি বিষয়কে ‘মুবাহ’ বা বৈধ বিশ্বাস করে; কিন্তু ঐ বিষয়কে স্বামী ‘হারাম’ হিসেবে বিশ্বাস করে সে ক্ষেত্রে স্বামীর এই অধিকার থাকবে স্ত্রীকে ঐ বিষয় থেকে বাধা দিবে। যেহেতু স্বামী হচ্ছে—পরিবারের কর্তা। তাই স্বামী যেটাকে গর্হিত বিশ্বাস করবে সেটাতে বাধা দিতে পারে। ৩- অধিকাংশ আলেমের মতে, কাফেরেরা ঈমান আনার প্রতি যেমন আদিষ্ট; তেমনি শরিয়তের শাখা-বিধানগুলো মানতেও আদিষ্ট। এর মানে—মুসলমানদের জন্য যা কিছু হারাম তাদের জন্যেও সেসব কিছু হারাম; যেমন- মদপান, শুকরের গোশত ভক্ষণ, বিদআত চালুকরণ ও বিদআতী অনুষ্ঠান উদযাপন। স্বামীর কর্তব্য হচ্ছে- স্ত্রীকে এ ধরনের কিছু করা থেকে বাধা দেয়া। যেহেতু- আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে আগুন থেকে বাঁচাও। যে আগুনের ইন্ধন হচ্ছে- মানুষ ও পাথর।”[সূরা আল-তাহরীম, আয়াত: ৬] এ বিধানের আওতার বাইরে থাকবে স্ত্রীর বিশ্বাস ও তার ধর্মে অনুমোদিত উপাসনাসমূহ; যেমন খ্রিস্টানদের নামায ও তাদের ধর্মে অবশ্য পালনীয় রোজা; স্বামী স্ত্রীকে এসব পালন করা থেকে বারণ করতে পারবে না। মদপান, শুকর খাওয়া, পাদ্রী ও পুরোহিতগণ কর্তৃক নবপ্রচলিত বিভিন্ন উৎসব পালন করা— তার ধর্মে তথা খ্রিস্টান ধর্মে নেই।

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন: “স্বামী তার স্ত্রীকে গির্জা বা সিনাগগে যেতে বাধা দেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করবেন।” যে ব্যক্তির খ্রিস্টান স্ত্রী রয়েছে তার ব্যাপারে ইমাম আহমাদ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন: “খ্রিস্টানদের উৎসব বা গির্জাতে যাওয়ার অনুমতি দিবে না।” যে ব্যক্তির খ্রিস্টান দাসী রয়েছে সে যদি খ্রিস্টানদের উৎসবে বা গির্জাতে কিংবা সমাবেশে যাওয়ার অনুমতি চায় তার ব্যাপারে তিনি বলেন: “তাকে অনুমতি দিবে না।” ইবনুল কাইয়্যেম বলেন: “এ অনুমতি না দেয়ার কারণ হলো- কুফরের আহ্বায়ক ও কুফরের নিদর্শনবহনকারী কোন কিছুতে তাকে সহযোগিতা না করা।” তিনি আরও বলেন: “স্ত্রী তার ধর্মমতে যে রোজা রাখাকে আবশ্যকীয় বিশ্বাস করেন স্বামী স্ত্রীকে সে রোজা রাখতে বাধা দিতে পারবে না; যদিও এর ফলে স্ত্রীর রোজা রাখাকালীন সময়ে স্বামী তার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। স্ত্রীকে নামায পড়তেও বাধা দিতে পারবে না; যদিও স্ত্রী স্বামীর ঘরেই পূর্বদিকে ফিরে নামায আদায় করবে। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদেরকে মসজিদে নববীতে তাদের কিবলার দিকে ফিরে নামায আদায় করার সুযোগ করে দিয়েছেন।[আহকামু আহলুয যিম্মাহ (২/৮১৯-৮২৩]

মসজিদে নববীতে নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধির নামায পড়ার বিষয়টি ইবনুল কাইয়্যেম তাঁর ‘যাদুল মাআদ’ গ্রন্থ (৩/৬২৯) এ উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটির মুহাক্কিক (পাঠোদ্ধারকারী) লিখেছেন: “এ রেওয়ায়েতটির বর্ণনাকারীগণ ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য); কিন্তু সনদ মুনকাতি (বিচ্ছিন্ন)। অর্থাৎ সনদ দূর্বল”। আরও দেখুন 3320 নং প্রশ্ন। আল্লাহই ভাল জানেন।

১. আহলে কিতাবি কারা?

২. আহলে কিতাবি মেয়েকে বিয়া করা বৈধ কি?

৩. আহলে কিতাবি মেয়েকে বিয়ে করার শর্ত কি?

৪. বর্তমান আহলে কিতাবিরা প্রকৃত নাকি পরিবর্তিত?

৫. বর্তমান আহলে কিতাবি মেয়েকে বিয়া করা জায়েজ হবে কি? আরব বিশ্বের আলেমদের অভিমত কি?

[[ চেষ্টা করব – ইনশা আল্লাহ – উপরের প্রতিটা প্রশ্নের দালিলিক উত্তর দেওয়ার। পূর্ণাঙ্গ লেখাটা পড়ে – আশাকরি – আর কারো বিভ্রাট থাকার কথা না ]]

1⃣ প্রথম প্রশ্ন – কোরানে বর্ণিত আহলে কিতাব কারা?

🅰 উত্তর – যেসব উম্মাহের নবীগনের উপর আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, সেই জাতীকেই ব্যাপকার্থে ‘ আহলে কিতাব ‘বলা হয়। যেমন ইয়াহুদী ও খ্রিষ্ট্রান জাতী। খৃষ্টান বলা হয় হযরত ঈসা আঃ অনুসারীদের এবং ইহুদী বলা হয় হযরত মুসা আঃ এর অনুসারীদের। তবে, কোরানের স্পেসিফিক আয়াতে আহলুল কিতাব দ্বারা ” ইহুদি ও খৃষ্টানদের ” বুঝানো হয়েছে।

2⃣ দ্বিতীয় প্রশ্ন – আহলে কিতাব মেয়েকে বিয়া করা বৈধ কি ?

🅰 উত্তর – উত্তরটি যথেষ্ট ব্যাখ্যা ও আলোচনার দাবী রাখে। সাদামাটা হ্যাঁ কিংবা না বলে ফতোয়া দেওয়া অপরিপক্কতার পরিচায়ন হবে৷ নিচে বিস্তারিত –

ফুকাহায়ে কেরাম আহলে কিতাবি মেয়েকে প্রথমে দু’ভাগে ভাগ করেন –

→ কাফের রাষ্ট্রের আহলে কিতাবি মেয়ে।

→ মুসলিম রাষ্ট্রের আহলে কিতাবি মেয়ে।

১. কাফের রাষ্ট্রের আহলে কিতাবি মেয়েকে বিয়ে করার হুকুম –

(( বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ্য দু’টি তুলে ধরলাম))

√ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা: বলেন –

” قال ابن عباس : لا يحل نساء أهل الكتاب إذا كانوا حربا”

‘আহলে কিতাব মহিলাগণ ‘হারবী’ তথা কাফের রাষ্ট্রের অধিবাসিনী হলে তাদের সাথে বিবাহ বন্ধন হালাল নয়।

[[ সূত্র- মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১৬৪৩১]]

√ সুপ্রসিদ্ধ ফক্বীহ আল্লামা ইবনে হুমাম রহ. বলেন –

(( وتكره كتابية الحربية إجماعا، لانتفاح باب الفتنة من إمكان التعلق المستدعي للمقام معها في دار الحرب، و تعريض الولد على التخلق بأخلاف أهل الكفر.))

“কাফের রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মহিলাকে বিয়ে করা ফকিহদের সর্বসম্মতিক্রমে মাকরূহ (তাহরীমী বা না জায়েয) কারণ,স্বামীকে কাফের রাষ্ট্রে তার সাথে বসবাস করতে হবে ফলে সকল প্রকার ফিতনার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে এবং এতে সন্তানদেরকে কাফেরদের সমাজে তাদের মতো করে বেড়ে উঠতে বাধ্য করা হবে

[[ সূত্রঃ ফাতহুল কাদীর – ৩/১৩৫ ]]

পুনঃ উপরোক্ত হাদিস ও ফতোয়া থেকে স্পষ্ট জানলাম যে, কাফের রাষ্ট্রের কোন আহলে কিতাব মেয়েকে বিবাহ করা বৈধ নয়।

২. মুসলিম রাষ্ট্রের আহলে কিতাবি মেয়েকে বিয়ে করার হুকুম ??

আহলে কিতাব নারী যদি মুসলমান রাষ্ট্রে বসবাসকারিনীহয় এবং তাদেরকে বিয়ে করলে স্বামী বা সন্তান বিধর্মী ওহয়ার আশঙ্কা নাও থাকে তবুও সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও চার মাযহাবের আলেমগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদেরকে বিয়ে করা মাকরূহ বলেছেন –

১.

” সাহাবী হুযায়ফা রা. এক ইহুদী মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। হযরত উমর রা. পত্র মারফত ওই মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার পারমর্শ দিলেন। তখন তিনি লিখে পাঠালেন, যদি তাকে বিয়ে করা হারাম হয়ে থাকে তাহলে আমি ছেড়ে দিব।উত্তরে হযরত জানালেন, আমি হারাম হওয়ার কথা বলি না, তবে আমার আশঙ্কা হয় এভাবে তাদের ব্যভিচারিনীদেরকেও বিবাহ করা শুরু হবে। ”

[[ সূত্র: ইবনে আবি শাইবা, হা : ১৬৪১৭ ]]

২.

এছাড়াও চার মাযহাবের ফকীহগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে মুসলিম দেশে বসবাসকারিনী আহলে কিতাব মহিলাদেরকেও বিয়ে করা মাকরূহ তথা অনুত্তম বলেছেন।

[[ সূত্র : আদদুররুল মুখতার ৩/৪৫ ]]

পুনঃ- তাহলে আমরা জানলাম যে, উলামায়ে কেরামের ঐক্য মতে মুসলিম দেশের আহলে কিতাব হলেও তাকে বিবাহ করা মাকরুহ৷

3⃣ তৃতীয় প্রশ্ন – আহলে কিতাবি মেয়েকে বিবাহ করার শর্ত সমূহ কি??

🅰 উত্তর – ইমাম কুরতুবী রাঃ বলেন – কোরান ও হাদিসের আলোকে আহলে কিতাবি মেয়েদের বিবাহ করার শর্ত হলো –

১. প্রকৃত আহলে কিতাব হতে হবে। শুধু নামে ইহুদী কিংবা খ্রিস্টান হলে চলবে না। নামে ইহুদী-খ্রিস্টান অথচ সে নাস্তিক কিংবা নিজ ধর্মকে বিশ্বাস করে না; তাহলে চলবে না।

২. অবশ্যই তাকে পবিত্র হতে হবে। ব্যভিচারিণী হলে চলবে না। আগে এটা নিশ্চিত হতে হবে যে, সে ব্যভিচারীণী না।

৩. এমন কাউকে বিয়ে করা যাবে না যার জাতি পুরো মুসলিম উম্মতের সাথে ঘোর শত্রুতা পোষণ করে, যেমন : বর্তমান সময়ের ইহুদী – খৃষ্টানরা।

৪. বিয়ের কারণে স্বামীর সন্তানের কোনো ধর্মীয় ক্ষতি থাকার আশংকা থাকলেও আহলে কিতাব বিয়ে করা যাবে না। যেমন, বাচ্চা অমুসলিম হয়ে যাওয়া।

[[ সূত্রঃ- তাফসিরে কুরতুবি -৩/৭৭ ]]

পুনঃ- আচ্ছা, আপনারাই বলেন তো, এমন আহলে কিতাবি মহিলা আজ-কাল পাওয়া যাবে কি? আর মহিলা ব্যভিচারী কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যাবে কি ?

4⃣ চতুর্থ প্রশ্ন – বর্তমান আহলে কিতাবিরা প্রকৃত নাকি পরিবর্তিত? প্রকৃত আহলে কিতাবি কারা?

🅰 উত্তর – এ বিষয়ে অনেক মতামত রয়েছে। তন্মধ্যে দু’টি মত তুলে ধরছি –

১. ইমাম শাফী রাঃ বলেন –

\\ يقول الإمام الشافعي – رحمه الله – فى اهل الكتاب : إنهم اليهود والنصارى من بني إسرائيل، وأما الأمم الأخرى التي قد انتحلت اليهودية أو النصرانية فلا تطلق عليها كلمة «أهل الكتاب»، لأنه ما أرسل موسى ولا عيسى عليها السلام إلا إلى بني إسرائيل //

সার কথা হচ্ছে, আহলে কিতাব হচ্ছে বনি ইসরাইল জাতির ইহুদী-নাসারাগণ। অন্যান্য জাত,যারা নিজেদেরকে আহলে দাবী করে, তাদেরকে আহলুল কিতাব ধরা যাবে না।।

পুনঃ বর্তমান আহলে কিতাব বনী ইসরাইল জাত কি!!??

২. শায়খ আহমদ শাকীর রাঃ তার অনবদ্য গ্রন্থ হুকমুল জাহিলিয়্যাহ’তে বলেন –

// قال الشيخ أحمد شاكر فى كتابه حكم الجاهلية “هذا كله في طعام أهل الكتاب، إذا كانوا أهل كتاب أما المنتسبون الآن للنصرانية واليهودية في أوربا وأمريكا وغيرهما -فنحن نقطع أنهم ليسوا أهل كتاب، لأنهم كفروا بأديانهم، وإن اصطنع بعضهم رسومها الظاهرة فقط، فأكثرهم ملحدون لا يؤمنون بالله ولا بالأنبياء، وكتبهم وأخبارهم بين أيدينا، فهم قد خرجوا على كل دين \\

সার কথা, বর্তমান সময়ের ইউরোপ-আমেরিকা বা অন্যান্য দেশের নামদারী ইহুদী-নাসারাগণ প্রকৃত আহলে কিতাব না। কেননা, তারা তাদের ধর্মকে অস্বীকার করেছে। তাদের অধিকাংশই মুলহীদ, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে না। নবীদের উপর বিশ্বাস রাখে না৷

5⃣ পঞ্চম প্রশ্ন -. বর্তমান আহলে কিতাবি মেয়েকে বিয়া করা জায়েজ হবে কি? আরব বিশ্বের আলেমদের অভিমত কি?

🅰 উত্তর – উপরের দীর্ঘালোচনা থেকে জানতে পারি যে, আহলে কিতাবি মেয়েকে শর্ত শাপেক্ষ বিবাহ বৈধ মতান্তরে মাকরুহ। তবে শর্তগুলা পাওয়া যাবে কি না, তা দূরহ ব্যাপার। তাছাড়া বিশেষত, বর্তমান আহলুল কিতাবের অধিকাংশই মুলহিদ বা স্ব-ধর্ম ত্যাগী। যেমনটি, উপরে আহমদের শাকীরের কুটেশন রয়েছে। তবুও উলামায়ে কেরাম আহলে কিতাবী মেয়েকে বিবাহ করা অনুত্তম মনে করেন। যদিও সকল শর্ত পাওয়া যায়। আর শর্ত না পাওয়া গেলে তো নিঃসন্দেহে জাইজ নয়।

এ ব্যাপারে কয়েকটি অভিমত –

১. ইমাম মালেক রাঃ বলেন –

// قال الإمام مالك – رحمه الله – : نكاح اليهودية والنصرانية وإن كان قد أحلّه الله تعالى، مُستثقل\\

ইহুদী-নাসারা মেয়েদেরকে বিবাহ করা কঠিন বা অসম্ভব। যদিও আল্লাহ তা’লা হালাল করেছেন।

২. ইবনে কুদামা রাঃ বলেন –

قال ابن قدامة رحمه الله : ( إذا ثبت هذا , فالأولى أن لا يتزوج كتابية ; لأن عمر قال للذين تزوجوا من نساء أهل الكتاب : طلقوهن . فطلقوهن إلا حذيفة , فقال له عمر : طلقها . قال : تشهد أنها حرام ؟ قال : هي جمرة , طلقها . قال : تشهد أنها حرام ؟ قال : هي جمرة . قال : قد علمت أنها جمرة , ولكنها لي حلال . فلما كان بعدُ طلقها , فقيل له : ألا طلقتها حين أمرك عمر ؟ قال : كرهت أن يرى الناس أني ركبت أمرا لا ينبغي لي . ولأنه ربما مال إليها قلبه ففتنته ,

وربما كان بينهما ولد فيميل إليها )

সার কথা, যদি এটা প্রমাণিত হয় – তথা সকল শর্ত পাওয়া যায় – তথাপি উত্তম হলো আহলে কিতাবি মেয়েকে বিয়া না করা। কেননা, উমার রাঃ সাহাবাদেরকে তাদের স্ত্রী তালাক দিতে বললেন, যারা আহলে কিতাবী মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন,,,,,, ।

((اهـ . المغني 7/99 সূত্র ))

৩. শায়খ বিন বাজ রাঃ বলেন –

قال الشيخ ابن باز رحمه الله : ( فإذا كانت الكتابية معروفة بالعفة والبعد عن وسائل الفواحش جاز

لكن في هذا العصر يُخشى على من تزوجهن شر كثير ، وذلك لأنهن قد يدعونه إلى دينهن وقد يسبب ذلك تنصر أولاده ، فالخطر كبير ، والأحوط للمؤمن ألا يتزوجها ، ولأنها لا تؤمن في نفسها في الغالب من الوقوع في الفاحشة ، وأن تعلّق عليه أولادا من غيره … لكن إن احتاج إلى ذلك فلا بأس حتى يعف بها فرجه ويغض بها بصره ، ويجتهد في دعوتها إلى الإسلام ، والحذر من شرها وأن تجره هي إلى الكفر أو تجر الأولاد ) اهـ .

সার কথা, যখন আহলে কিতাবি মেয়ের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ জানা হবে যে, মেয়েটি জিনা ও সকল প্রকার পাপাচার-অনাচার ইত্যাদি থেকে বিরত, তাহলে বিয়ে বৈধ।

তবে এই যুগে আহলে কিতাবি মেয়েদেরকে বিবাহ করাতে ক্ষতির আশংকা বেশী রয়েছে৷ কেননা, আহলে কিতাবি মহিলারা তাদের স্বামীদেরকে স্বীয় ধর্মে আহবান করে। কখনো এটা তাদের বাচ্চারা নাসার হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহে ফায়দার চেয়ে ক্ষতি বেশী। মুমীনের জন্য উচিত হলো আহলে কিতাবি মেয়েকে বিবাহ না করা। ইত্যাদি!

((فتاوى إسلامية 3/17 সূত্র))

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আহলে কিতাবি মেয়েকে বিবাহ বৈধ নাকি অবৈধ ___ তা বিস্তর আলোচনা ও শর্ত শাপেক্ষ। যা অগত্যা যেমন-তেমন ফতোয়া মেরে দেওয়ার বিষয় না। কিছু কিছু ফতোয়া ব্যাক্তি, সময় ও স্থান ভেদে দিতে হয়। যেমন ঃ উল্লিখিত বিষয় একটি। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝার তাওফীক দান করুক!

আব্দুল কারীম চৌধুরী,

ইসলামিক আইন ও বিচার বিভাগ,

মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।

 

আহলি কিতাবীরা কী মুসলিম?

আহলি কিতাবীরা কী মুসলিম? আহলি কিতাবীদের ধর্ম কী ইসলাম? আহলি কিতাবী ঈসায়ী ও মূসায়ী তথা ইহুদী ও নাসারাদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর মধ্যকার বিয়ে কী বৈধ? এ প্রশ্ন এখন ঘুরে-ফিরে আসছেই। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আলোচনার পরেই বিষয়টি আলোচিত। অনেক সম্মানিত মুফাস্সির মনে করেন যে, এটা একটি মিমাংসিত বিষয়। ফলে নতুন করে আলোচনা আসা কেন?

শুরুতেই একটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা দরকার যে, আহলি কিতাব কী বা কারা আহলি কিতাব? পবিত্র কুরআন মজিদে বলা হয়েছে, “যাদের কাছে আগের নবীদের আনা কোন আসমানী কিতাব ছিল, তা যত বিকৃত আকারেই থাক না কেন, তারা তা মেনে চলতো, তাদেরকে বলা হয় আহলি কিতাব। আহলি কিতাব ও মুশরিক উভয় দলই কুফরী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেও দু’দলকে দু’টি পৃথক নামে ডাকা হয়। আর তা হচ্ছে আহলি কিতাব ও মুশরিক। যারা কোন নবীর অনুসারী ছিল না, কোন আসমানী কিতাবও মানতো না বা মানে না তারা মুশরিক।” কুরআন মজিদের বহু স্থানে আহলি কিতাবদের শিরকের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন খ্রীস্টানদের (নাসারাদের) সম্পর্কে বলা হয়েছে ঃ “তারা বলে, আল্লাহ্ তিন খোদার একজন।” (সূরা আল মায়েদাহ ৭৩) “তারা মসীহকেও খোদা বলে।” (সূরা আল মায়েদাহ ১৭) “তারা মসীহকে আল্লাহ্র পুত্র গণ্য করে।” (সূরা আত তাওবা ৩০) আবার ইহুদিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ঃ “তারা উযাইরকে আল্লাহ্র পুত্র বলে” (সূরা আত তাওবা ৩০) কিন্তু এসব সত্ত্বেও কুরআনের কোথাও তাদের জন্য মুশরিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়নি। বরং তাদের উল্লেখ করা হয়েছে “আহলি কিতাব” বা “যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল” শব্দের মাধ্যমে। অথবা ইহুদী ও নাসারা শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে। কারণ তারা আসল তাওহিদী ধর্ম মানতো, তারপর ক্রমান্বয়ে তারা শিরকে লিপ্ত হয়।

এখানে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আহলি কিতাবীরা মুসলিম (ছিলেন)। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, তাদের ধর্ম ইসলাম, এতে কোন সন্দেহ নেই। এবং তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আহলি কিতাবী ঈশায়ী ও মূসায়ী বা ইহুদী ও নাসারাদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী সা.-এর মধ্যকার বিয়ে একসময় বৈধ ছিল। তবে এখন সেই বিয়ে বৈধ নয়। কোন আহলি কিতাবী উম্মতে মুহম্মদী স. হওয়ার পরেই বিয়ে বৈধ। আহলি কিতাবীরা মুসলিম ছিলেন। ব্রাকেট দিয়ে বলা হয়েছে ‘ছিলেন’। কেউ শিরকে লিপ্ত হলে মুসলিম থাকার প্রশ্নই আসে না।

উত্থাপিত প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর নিন্মের আলোচনা থেকে পেতে পারি। আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআন মজিদে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, আহলী কিতাবীরাও মুসলিম এবং তাদের ধর্মও ইসলাম।

পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল কাসাস-এর ৫২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, “যাদেরকে আমি এর আগে কিতাব দিয়েছিলাম তারা এর (কুরআন) প্রতি ঈমান আনে।”

এর অর্থ এই নয় যে, সমস্ত আহলে কিতাব (ইহুদী ও ঈসায়ী) এর প্রতি ঈমান আনে। বরং এ সূরা নাযিল হবার সময় যে ঘটনা ঘটেছিলো এখানে আসলে সেদিকে ইশারা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মক্কাবাসীদেরকে লজ্জা দেয়াই উদ্দেশ্য যে, তোমাদের নিজেদের বাড়িতে যে নিয়ামত এসেছে তাকে তোমরা প্রত্যাখ্যান করছো। অথচ দূরদেশ থেকে লোকেরা এর খবর শুনে আসছে এবং এর মূল্য অনুধাবন করে এ থেকে লাভবান হচ্ছে। যেমন সে সময় হাবশা ও ইয়াসরীবের লোকজন এসে আল্লাহ্র নবী স.-এর কাছে বাইয়াত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

পবিত্র কুরআন মজিদ-এর সূরা আল কাসাস-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আর যখন তাদেরকে এটা শুনানো হয় তখন তারা বলে, “আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এটি যথার্থই সত্য আমাদের রবের পক্ষ থেকে, আমরা তো আগে থেকেই মুসলিম।”

এর মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এর আগেও আমরা নবীদের এবং আসমানী কিতাবের আনুগত্য করে এসেছি। তাই ইসলাম ছাড়া আমাদের অন্য কোনো দীন ছিলো না। আর এখন যে নবী আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কিতাব নিয়ে এসেছেন তাকেও আমরা মেনে নিয়েছি। কাজেই মূলত আমাদের দীনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং আগেও যেমন আমরা মুসলমান ছিলাম তেমনি এখনও মুসলমান আছি।

একথা থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স. যে দীনের দাওয়াত দিয়েছেন তার নামই শুধু ইসলাম নয় এবং ‘মুসলিম’ পরিভাষাটি শুধুমাত্র নবী করীম স.-এর অনুসারীগণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সব সময় এ ইসলামই ছিলো সকল নবীর দীন এবং সব জমানায় তাঁদের সবার অনুসারীগণ মুসলমানই ছিলেন। হযরত আদম আ. ছিলেন প্রথম মানুষ এবং প্রথম নবী। সেই থেকে শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ স. পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণ ইসলামই প্রচার করেছেন। শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ স. এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর মনোনীত জীবন বিধান পূর্ণাঙ্গ ইসলামেরই প্রচার করেছেন। তাই পরবর্তী যে কোন নবী-রাসূলের আনীত বিধানের সাথে পূর্ববর্তী কোন নবীর আনীত অবিকৃত ইসলামী বিধানের উপর বিশ্বাস স্থাপন ঈমানের অন্যতম শর্ত। মুসলমানরা যদি কখনো পরবর্তীকালে আগত কোনো সত্য নবীকে মানতে অস্বীকার করে থাকে তাহলে কেবল তখনই তারা কাফের হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু যারা পূর্বের নবীকে মানতো এবং পরের আগত নবীকেও মেনে নিয়েছে তাদের ইসলামে কোনো ছেদ পড়েনি। তারা পূর্বেও যেমন মুসলমান ছিলো, পরেও তেমনি মুসলমান।

প্রকৃত পক্ষে, পবিত্র কুরআন মজিদ কেবলমাত্র এই একটি স্থানেই নয়, বরং অসংখ্য জায়গায় এ সত্যটি বর্ণনা করেছেন। কুরআন বলছে, আসল দীন হচ্ছে একমাত্র ‘ইসলাম’ (আল্লাহ্র আনুগত্য) এবং আল্লাহ্র বিশ্ব-জাহানে আল্লাহ্র সৃষ্টির জন্য এছাড়া দ্বিতীয় কোনো দীন বা ধর্ম হতে পারে না। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে যে নবীই মানুষকে পথনির্দেশ দেবার জন্য এসেছেন তিনি এ দীনই নিয়ে এসেছেন। আর নবীগণ হামেশাই নিজেরা মুসলিম থেকেছেন, নিজেদের অনুসারীদেরকে মুসলিম হয়ে থাকার তাকিদ দিয়েছেন এবং তাঁদের যেসব অনুসারী নবুওয়াতের মাধ্যমে আগত আল্লাহ্র ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছেন তারাও প্রতিটি যুগে মুসলমিই ছিলেন। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত স্বরূপ শুধুমাত্র কয়েকটি আয়াত পেশ করা যায়-

পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আলে ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত, “আসলে আল্লাহ্র কাছে ইসলামই একমাত্র দীন।”

পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ইউনুস-এর ৭২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত, “আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন অবলম্বন করে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না।”

পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ১৩১, ১৩২ ও ১৩৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত, “যখন তার রব তাকে বললেন, মুসলিম (ফরমানের অনুগত) হয়ে যাও, সে বললো, আমি মুসলিম হয়ে গেলাম রব্বুল আলামীনের জন্য। আর এ জিনিসটিরই ওসিয়াত করে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়া’কূবও ঃ হে আমার সন্তানরা! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ দীনটিই পছন্দ করেছেন। কাজেই মুসলমি না হয়ে তোমরা কখনো মৃত্যুবরণ করো না। তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে যখন ইয়া’কূবের মৃত্যুর সময় এসে গিয়েছিলো, যখন সে তার পুত্রদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলো, আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা জবাব দিয়েছিল, আমরা ইবাদত করবো আপনার ইলাহ-এর এবং আপনার বাপ-দাদা ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহ-এর, তাঁকে একক ইলাহ হিসেবে মেনে নিয়ে। আর আমরা তাঁরই অনুগত-মুসলিম।”

“ইবরাহীম ইহুদী ছিলো না, খৃষ্টানও ছিলো না, বরং ছিলো একনিষ্ট মুসলিম।”

পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ১২৮ নম্বর আয়াতে স্বয়ং হযরত ইবরাহীম আ. ও হযরত ইসমাঈল আ. দোয়া করেন এভাবে, “হে আমাদের রব! আমাদেরকে তোমার মুসলিম (অনুগত) করো এবং আমাদের বংশ থেকে একটি উম্মত সৃষ্টি করো যে হবে তোমার অনুগত (মুসলিম)।”

হযরত ইউসূফ আ. মহিমান্বিত রবের দরবারে নিবেদন করেন :

“আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দান করো এবং সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিয়ে দাও।”

পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ইউনুস এর ৮৪ নম্বর আয়াতে হযরত মূসা আ. তঁাঁর নিজের জাতিকে বলেন :

“হে আমার জাতি! যদি তোমরা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এনে থাকো, তাহলে তাঁর ওপরই ভরসা করো যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো।”

বনী ইসরাঈলের আসল ধর্ম ইহুদীবাদ নয়, বরং ইসলাম ছিলো। বন্ধু ও শত্রু সবাই একথা জানতো। কাজেই ফেরাঊন সাগরে ডুবে যেতে যেতে যে শেষ কথাটি বলে তা হচ্ছে ঃ পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা ইউনুস এর ৯০ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “আমি মেনে নিলাম বনী ইসরাঈল যার প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং আমি মুসলিমদের অন্তরভুক্ত।”

বনী ইসরাঈলের সকল নবীর দীনও ছিলো এ ইসলাম। যা সূরা আল মায়েদাহ-এর ৪৪ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “আমি তাওরাত নাযিল করেছি, যাতে ছিলো হেদায়াত ও আলো, সে অনুযায়ী সে নবীগণ যারা মুসলিম ছিল তাদের বিষয়াদির ফয়সালা করতো যারা ইহুদী হয়ে গিয়েছিলো।”

আর এটিই ছিল হযরত ঈসা আ. ও তাঁর হাওয়ারীদের (সহযোগী) দীন। যা পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদাহ-এর ১১১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আর যখন আমি হাওয়ারীদের প্রতি (কাছে) ওহী পাঠালাম যে, ঈমান আনো আমার প্রতি এবং আমার রসূলের প্রতি, তখন তারা বললো, আমরা ঈমান এনেছি এবং সাক্ষী থাকো আমরা মুসলিম।”

আসলে এ আয়াতগুলোতে যে কথাটি বলা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে প্রকৃত দীনটি এসেছে তা খৃষ্টবাদ, মূসাবাদ বা মুহাম্মদবাদ নয় বরং তা হচ্ছে নবীগণ ও আসমানী কিতাবসমূহের মাধ্যমে আগত আল্লাহ্র ফরমানের সামনে আনুগত্যের শির নত করে দেয়া এবং এ নীতি আল্লাহর যে বান্দা যেখানেই যে যুগেই অবলম্বন করেছে সে-ই হয়েছে একই বিশ্বজনীন, আদি ও  চিরন্তন সত্যদীনের অনুসারী। সে সত্যদীন হলো ইসলাম। যারা এ দীনকে যথার্থ সচেতনতা ও আন্তরিকতা সহকারে গ্রহণ করেছে তাদের জন্য মূসার পরে ঈসাকে এবং ঈসার পরে মুহাম্মদ সা.-কে মেনে নেয়া ধর্ম পরিবর্তন করা হবে না, বরং হবে প্রকৃত ও আসল ধর্মের অনুসরণ করার স্বাভাবিক ও ন্যাগসংগত কাজ। পক্ষান্তরে যারা আম্বিয়া আ.-এর উম্মতের মধ্যে না জেনে-বুঝে ঢুকে পড়েছে অথবা তাঁদের দলে জন্ম নিয়েছে এবং জাতীয় ও বংশীয় স্বার্থপ্রীতি যাদের জন্য আসল ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে তারা ইহুদী ও খৃস্টান হয়ে রয়ে গেছে এবং শেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আগমনে তাদের মূর্খতা ও অজ্ঞতার হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে গেছে। কারণ তারা আল্লাহ্র শেষ নবীকে অস্বীকার করেছে। আর এটা করে তারা শুধু যে নিজেদের ভবিষ্যতে মুসলিম হয়ে থাকাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাই নয়, বরং নিজেদের এ কার্যকলাপের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করে দিযেছে যে, তারা আসলে ইতিপূর্বেও মুসলিম ছিলো না, নিছক একজন নবীর বা কয়েকজন নবীর ব্যক্তিত্বের ভক্ত ও অনুরক্ত ছিল। অথবা পিতা-প্রপিতার অন্ধ অনুকরণকে ধর্মীয় আচারে পরিণত করে রেখেছিলো।

এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে তারা মুসলিম ছিলেন এবং তাদের ধর্ম ইসলাম। কিন্তু পরবর্তীতে এই সব আহলে কিতাবীদের অনেকেই আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাধের উপর ঈমান আনলেও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর প্রতি ঈমান আনেনি, আল্লাহ্র নবী স.-এর প্রতি প্রেরিত পবিত্র কুরআন মজিদের প্রতি ঈমান আনেনি। তারা দোয়াল্লিন ও মগদুব পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত। তারা অমুসলিম, তারা ইসলামকে অস্বীকারকারী, তারা জালেম, তারা আল্লাহ্ তা’আলার অবাধ্য, তারা অবিশ্বাসী। আর সে কারণেই মুমিনদেরকে আহলে কিতাবীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না রাখার ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআন মজিদে নিষেধ করেছেন।

আহলে কিতাবীদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও নাসারাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।”

এই আয়াতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন ইহুদী ও নাসারাদের সাথে সামঞ্জস্য ও গভীর বন্ধুত্ব না করে। সাধারণ অমুসলিম এবং ইহুদী ও খ্রীস্টানদের রীতিও তাই। তারা গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে শুধু স্বীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে; মুসলমানদের সাথে এরূপ সম্পর্ক স্থাপন করে না।

এরপর যদি কোন মুসলমান এ নির্দেশ অমান্য করে কোন ইহুদী অথবা খ্রীস্টানের সাথে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে সে ইসলামের দৃষ্টিতে সে সম্প্রদায়ের লোক বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য।

তফসীরবিদ ইবনে জরীর ইকরামা রা.-এর বাচনিক বর্ণনা করেন ঃ এ আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়েছে। ঘটনাটি এই যে, রাসূলুল্লাহ্ সা. মদিনায় আগমনের পর পার্শ্ববর্তী ইহুদী ও নাসারাদের (খ্রীস্টানদের) সাথে এই মর্মে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যে, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিজেরা যুদ্ধ করবে না, বরং মুসলমানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আক্রমণকারীকে প্রতিহত করবে। এমনিভাবে মুসলমানরাও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না এবং কোন বহিরাক্রমণকারীর সাহায্য করবে না, বরং আক্রমণকারীকে প্রতিহত করবে। কিছুদিন পর্যন্ত এ চুক্তি উভয় পক্ষেই বলবৎ থাকে, কিন্তু ইহুদীরা স্বভাবগত কুটিলতা ও ইসলাম বিদ্বেষের কারণে বেশিদিন এ চুক্তি মেনে চলতে পারল না এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে মক্কার মুশরিকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাদেরকে স্বীয় দুর্গে আহবান জানিয়ে পত্র লিখল। রাসূলুল্লাহ্ সা. হযরত জিবরাঈল আ. কর্তৃক এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে একটি মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করলেন। বনী-কুরায়যার এসব ইহুদী একদিকে মুশরিকদের সাথে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং অপর দিকে মুসলমানদের দলে অনুপ্রবেশ করে অনেক মুসলমানের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি সম্পাদন করে রেখেছিল। এভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের জন্যে গুপ্তচর বৃত্তিতে লিপ্ত ছিল। এ কারণে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং মুসলমানদেরকে ইহুদী ও নাসারাদের (খ্রীস্টানদের) সাথে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করে দেয়া হয়।

একই সাথে পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদাহ-এর সূরা ৫৭ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাবের মধ্য থেকে যেসব লোক তোমাদের দীনকে বিদ্রুপ ও হাসি-তামাশার বিষয়ে পরিণত করেছে তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। আল্লাহ্কে ভয় করো, যদি তোমরা  মুমিন হয়ে থাকো।”

সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫৯ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘তাদেরকে বলো, “হে আহলি কিতাব! আমাদের প্রতি তোমাদের ক্রোধের একমাত্র কারণ এই যে, আমরা আল্লাহ্র ওপর এবং দীনের সে শিক্ষার ওপর ঈমান এনেছি যা আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং আমাদের আগেও নাযিল হয়েছিলো। আর তোমাদের বেশির ভাগ লোকই অবাধ্য।”

সূরা আল-মায়েদাহ্-এর ৬৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “যদি (বিদ্রোহের পরিবর্তে) এ আহলে কিতাব গোষ্ঠী ঈমান আনতো এবং আল্লাহভীতির পথ অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের থেকে তাদের দুষ্কৃতিগুলো মোচন করে দিতাম এবং তাদেরকে পৌঁছিয়ে দিতাম নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতে।” সূরা আল-মায়েদাহ্-এর ৬৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হায়, যদি তারা তাওরাত, ইনজীল ও অন্যান্য কিতাবগুলো প্রতিষ্ঠিত করতো, যা তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিলো! তাহলে তাদের জন্য রিযিক ওপর থেকে বর্ষিত হতো এবং নিচে থেকেও উত্থিত হতো। তাদের মধ্যে কিছু লোক সত্যপন্থী হলেও অধিকাংশই অত্যন্ত খারাপ কাজে লিপ্ত।”

কাজেই ইহুদী ও নাসারারা (খ্রীস্টানরা) যদি ধর্মগ্রন্থে আল্লাহ ও নবীদের পক্ষ থেকে উদ্বৃত প্রকৃত শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে নিঃসন্দেহে নবী সা.-এর আবির্ভাবকালে তাদেরকে একটি ন্যায়বাদী ও সত্যপন্থী দল হিসেবে পাওয়া যেতো। এক্ষেত্রে তারা পবিত্র কুরআন মজিদের মধ্যে সেই একই আলো দেখতে পেতো, যা পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর মধ্যে পাওযা যেতো। এ অবস্থায় নবী সা.-এর আনুগত্য করার জন্য তাদের ধর্ম পরিবর্তন করার আদতে কোনো প্রশ্নই দেখা দিতো না, বরং যে পথে তারা চলে আসছিল সে পথের ধারাবাহিক পরিণতি হিসেবেই তারা মুহাম্মদ সা.-এর অনুসারী হয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারতো। অথচ তারা করেনি। তারা না করে অবাধ্য হয়েছে।

আহলি কিতাবী ও উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর বিয়ের ব্যাপারে কিছু কিছু আলেমেদীন ও মুফাস্সির মনে করেন এই বিয়ে বৈধ। পাশাপাশি অনেক আলেমেদীন মনে করেন যে, এই বিয়ে বৈধ নয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে, আল্লাহ্র পবিত্র কুরআন সম্পর্কে সম্পূর্ণ মুর্খ ও অজ্ঞ। আমিও মনে করি যে আহলি কিতাবী এবং উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর মধ্যকার বিয়ে বৈধ নয়। যারা বিয়ে বৈধ মনে করেন তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, যে সব আহলি কিতাবী আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদের উপর অবিচল আস্থা আছে তাদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর বিয়ে বৈধ। এখানেই শেষ নয়। আছে আরো কিছু যুক্তি আর তা হচ্ছে, আহলি কিতাবরা আল্লাহ্র নাম নিয়ে যদি কোন হালাল প্রাণীকে সঠিক পদ্ধতিতে যবেহ করে তাহলে তা মুসলমানদের জন্য তা হালাল গণ্য করা হয়েছে। তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মুশরিকদের যবেহ করা প্রাণীও হালাল নয় এবং তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়নি। পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল-মায়েদার ৫ নম্বর আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী কোনো কোনো মুফাস্সির আহলি কিতাবীদের মেয়েদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর পুরুষের সাথে বিয়ে বৈধ মনে করেন। উক্ত সূরায় বর্ণিত হয়েছে যে, “আজ তোমাদের জন্য সমস্ত পাক-পবিত্র বস্তু হালাল করা হয়েছে। আহলে কিতাবের খাদ্য দ্রব্য তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের খাদ্য দ্রব্য তাদের জন্য হালাল। আর সংরক্ষিত মেয়েরা তোমাদের জন্য হালাল, তারা ঈমানদারদের দল থেকে হোক বা এমন জাতিদের মধ্য থেকে হোক, যাদেরকে তোমাদের আগে কিতাব দেয়া হয়েছে। তবে শর্ত এই যে, তোমরা তাদের মোহরানা পরিশোধ করে দিয়ে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে তাদের রক্ষক হবে।”

এখানে ব্যাখ্যায় আহলি কিতাবী বলতে ইহুদী-খৃষ্টানদের (নাসারাদের) কথা বলা হয়েছে। কেবলমাত্র তাদের নারীদেরকেই বিবাহ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আর এর সংগে শর্তও আরোপিত হয়েছে যে, তাদের ‘মুহসানাত’ (সংরক্ষিত মহিলা) হতে হবে। এ নির্দেশটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিরূপণের ব্যাপারে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর মতে এখানে আহলে কিতাব বলতে সেসব আহলে কিতাবকে বুঝানো হয়েছে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজা। অন্যদিকে দারুল হারব ও দারুল কুফরের ইহুদী ও খৃস্টান (নাসারা) মেয়েদের বিয়ে করা জায়েয নয়। হানাফী ফকীহগণ এর থেকে সামান্য একটু ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে বহির্দেশের আহলে কিতাবের মেয়েদেরকে বিয়ে করা হারাম না হলেও মাকরূহ, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

তারপর ‘মুহসানাত’ শব্দের অর্থের ব্যাপারেও ফকীহগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর মতে ‘মুহসানাত’ অর্থ পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী মেয়েরা। ‘মুহসানাত’ শব্দের এ অর্থ গ্রহণ করার কারণে তিনি আহলে কিতাবের স্বেচ্ছাচারী মেয়েদের বিয়ে করাকে এ অনুমতির আওতার বাইরে রেখেছেন।

এপ্রসঙ্গে সূরা আল মায়েদাহ-এর ১৯ নম্বর আয়াতে কি বলা হয়েছে তা আমরা দেখে নিতে পারি। আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “হে আহলি কিতাব! রসূলদের সিলসিলা দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর প্রকৃত সত্যকে সুস্পষ্ট করার জন্য তোমাদের কাছে আমার রসূল এসেছে। যাতে তোমরা বলতে না পারো আমাদের কাছে না কোন সুসংবাদদানকারী এসেছিল, না এসেছিল কোন সতর্ককারী। কাজেই নাও,এখন তোমাদের কাছে সুসংবাদদানকারী এসে গেছে এবং সতর্ককারীও।”

এখানে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ স.-কেই একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ বলা হয়েছে। কিন্তু এর পরেও ইহুদী ও নাসারারা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি। পবিত্র কুরআন মজিদের প্রতি একীন রাখেনি। যা সূরা আল বাকারাহ-এ তাদেরকে আহবান জানানোর পরেও তারা অবাধ্য থেকে গেছে।

পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ২-৪ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে যে, “এটি আল্লাহ্র কিতাব, এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। এটি হেদায়াত সেই মুত্তাকীদের জন্যে, যারা অদৃশ্যে ঈমান রাখে নামায কায়েম করে এবং যে রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। আর যে কিতাব তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন) এবং তোমার আগে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিলো সেগুলোর ওপর ঈমান আনে এবং আখেরাতের ওপর একীন রাখে।”

পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাইয়েনাহ নাযিল হয়েছে মূলত আহলি কিতাব ও মুশরিকদের চিহ্নিত করার জন্য, তাদের সম্পর্কে বর্ণনা করার জন্য। আহলি কিতাবদের গোমরাহী তুলে ধরার জন্য। সূরায় একথাটি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যেসব আহলি কিতাব ও মুশরিক এই রসূলকে মেনে নিতে অস্বীকার করবে তারা নিকৃষ্টতম সৃষ্টি। তাদের শাস্তি চিরন্তন জাহান্নাম। আজকের আহলি কিতাবীরা আল্লাহ্র সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-কে অস্বীকার করেছে। (নাসারাদের) কেউ তিন আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস করে। (ইহুদিদের) কেউবা শেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ স.-এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। অথচ শেষ নবী মুহাম্মদ স.-এর প্রতি ভালবাসা ঈমানের অন্যতম শর্ত। ফলে তাদের সাথে যেমন বন্ধুত্ব করা অবৈধ, তেমনি ভাবে তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কও অবৈধ।

সূরা আল বাইয়েনাহ-এর ১-৩ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত তারা (নিজেদের কুফরী থেকে) বিরত থাকতে প্রস্তুত ছিল না। অর্থাৎ আল্লাহ্র পক্ষ থেকে একজন রাসূল যিনি পবিত্র সহীফা পড়ে শুনাবেন, যাতে একেবারে সঠিক কথা লেখা আছে।” ২ নম্বর আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী ‘যারা কুফরী করে, যারা আহলে কিতাব ও মুশরিকদের দলের অন্তরভুক্ত। সূরা আল- বাইয়েনাহ-এর ৬ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,“আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তারা নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।” এখানে কুফরী বলতে আল্লাহ্র নবী স.-কে মেতে নিতে অস্বীকার করা। অর্থাৎ মুশরিক ও আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারা এই রাসূলের নবুওয়াত লাভের পর তাঁকে মানেনি।

তাদের জন্য পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল বাকারাহ-এর ১৯-২০ নম্বর আয়াত প্রযোজ্য। সূরা আল বাকারাহ-এর ১৯-২০ নম্বর আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “অথবা এদের দৃষ্টান্ত এই যে, আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। তার সাথে আছে অন্ধকার মেঘমালা, বজ্রের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমক। বজ্রপাতের আওয়াজ শুনে নিজেদের মৃত্যুর ভয়ে এরা কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়। আল্লাহ্ এ সত্য অস্বীকারকারীদেরকে সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছেন। বিদ্যুৎ চমকে তাদের অবস্থা এই হয়েছে যে, বিদ্যুৎ যেন অচিরেই তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেবে। যখন সামান্য একটু আলো তারা অনুভব করে তখন তার মধ্যে তারা কিছুদূর চলে এবং যখন তাদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায় তারা থমকে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহ্ চাইলে তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপেই কেড়ে নিতে পারতেন। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর ওপর শক্তিশালী।”

আহলি কিতাবীরা তাদের কিতাবের উপর ঈমান এনেছিল। কিন্তু আল্লাহ্র শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর উপর ঈমান আনেনি। পবিত্র কুরআনের উপর তাদের তাদের একীন নেই। সে কারণেই তারা জালিম, তারা আল্লাহ্র অবাধ্য।

একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর উপর ওহী নাযিল হওয়ার পরে পূর্ববর্তী আমসানী কিতাবের কার্যকারীতা যে ভাবে স্থগিত হয়ে গেছে তেমনি ভাবে নতুন রাসূল আগমনের পরে পূর্ববর্তী নবীর কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে। যা মূলত স্থগিত হয়ে গেছে। উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, যে সব আহলি কিতাবীরা পূর্ববর্তী নবীর উম্মত হিসেবে আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদের উপর ঈমান এনেছিল তেমনি ভাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ স.-এর প্রতি ঈমান আনলে, পবিত্র কুরআন মজিদের উপর একীন রাখলেই তাদের ইসলাম ধর্মের ধারা অব্যাহত থাকে। কিন্তু আল্লাহ্র রাসূল স.-কে এবং পবিত্র কুরআন মজিদকে অস্বীকার করে তাদের মুসলিম বলার বা তাদের ধর্ম ইসলাম বলার এখতিয়ার নেই। তেমনি এসব আহলি কিতাবীদের ধর্মগ্রন্থ মৌলিক অবস্থায় আছে কী না সেটাও ধর্তব্যের বিষয় নয়। তাদের ধর্মগ্রন্থ মৌলিক অবস্থায় থাকলেও পবিত্র কুরআন মজিদ নাযিল হওয়ার পরে পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থের কার্যকারীতা স্থগিত হয়ে গেছে। তবে আগের কিতাবের যেসব বিধান কোরআনের বিধানের সাথে মিল থাকবে ওগুলো কুরআনের বিধানের অন্তরভূক্ত বলেই গণ্য হবে। ফলে আহলি কিতাবী নারীদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর পুরুষের বিয়ে বৈধ হতে পারে কিনা ভেবে দেখা দরকার। (এবিষয়ে যুগের সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম ও ফকিহগণের মতামত ব্যক্ত করে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।)

আহলি কিতাবী ও উম্মতে মুহম্মদী স.-এর বিয়ের বিষয়টি মেনে নেয়া হলে ইসলাম যে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, এটি যে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান এতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কারণ ইসলাম শুধু আনন্দ উপভোগ করার জন্য বিয়ে শাদীর ব্যবস্থা করেনি। এর মাধ্যমে মানুষকে বেবিচার-অনাচার থেকে বাঁচিয়ে রাখা যেমন উদ্দেশ্য। তেমনি পরিশুদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার জন্য খাঁটি অনুগত আল্লাহর (মুসলিম) বান্দা সৃষ্টি করাও উদ্দেশ্য। (পবিত্র কুরআন মজিদের ভাষায়) মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম আ. যেমনটি দোয়া করেছিলেন।

আল্লাহ্ তা’আলা যেখানে ইহুদী ও নাসারাদের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য নিষেধ করেছেন সেখানে আহলি কিতাবীদের সাথে উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর সাথে বিয়ের অনুমোদন বা বৈধতা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। বরঞ্চ তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করবে তারা তাদের দলে বলে স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করেছেন পবিত্র কুরআন মজিদের সূরা আল মায়েদাহ’এ। যাঁরা আহলি কিতাবী ও উম্মতে মুহাম্মদী স.-এর মধ্যে বিয়ে বৈধ বলেন তাঁদের সূরা আল-মায়েদাহ-এর ৫১ নম্বর আয়াত এবং ৫ নম্বর আয়াত ও আয়াতের ব্যাখ্যা দৃষ্টির সামনে রাখার জন্য বিনীত অনুরোধ করব।

এরপরেও কেউ আহলি কিতাবীদের সাথে উম্মতি মুহাম্মদী স.-এর বিয়ে বৈধ বলার অর্থ তা পবিত্র কুরআন মজিদের সাথে সাংঘর্ষিক ও আল্লাহ্র অবাধ্য আচরণ করা নয় কি? আল্লাহ্র অবাধ্যদের শাস্তি কী যাদের পবিত্র কুরআন মজিদ সম্পর্কে একটুও ধারণা রাখেন তারা ভাল ভাবেই জানেন।

বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য, পবিত্র কুরআন মজিদকে বুঝার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা সবাইকে তওফীক দান করুন। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন। আল্লাহ্ আমাদের কবুল করুন। আমীন।লেখক : সাংবাদিক, গবেষক।

সংগৃহিত

তাফসিরে যাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন, তাফসিরে আল বায়ান